টিকিটিকি না, স্যালামেভার
সন্ধ্যা নামছে।
MRAU এর অফিস প্রায় ফাঁকা। কয়েকটা সিলিং লাইট বাদে বাকি সবগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। হাতে গোনা কয়েকজন আছে। তার ভেতরে এজেন্ট বরুণ, এজেন্ট মোহিনী, এজেন্ট রঞ্জনসহ আরও দুইজন আছে। আবির আর নাসরিন। তিনজন এজেন্ট আছে কারণ এজেন্ট রঞ্জনের কাছে বাকি দুইজনকে বশিরকে খুঁজে বের করার ব্যাপারে রিপোর্ট করতে হবে। আবির আছে কারণ আজ নাসরিনের সাথে তার ডিনারে যাওয়ার কথা। যদিও নাসরিনকে দেখে মনে হচ্ছে যে সে ব্যাপারটা পুরোপুরি ভুলে গিয়েছে। আর নাসরিন আছে, কারণ প্রতিদিনই সে সবার শেষে অফিস থেকে বের হয়।
এজেন্ট মোহিনী কফির শূন্য কাপটা দিয়ে টেবিলে মৃদু শব্দ করতে করতে বলল, “রঞ্জনদা, রাজধানীর তো বটেই, বহরমপুরের প্রধান প্রধান মোড়গুলোর সিসিটিভিগুলো চেক করেছি।” তারপর এমনভাবে দুদিকে মাথা নাড়ল, দেখে মনে হল তার কোন প্রিয়জন মারা গিয়েছে।
এজেন্ট বরুণও একইভাবে মাথা নাড়ল। বশিরকে খুঁজে বের করতে পারেনি কেউই। বশিরের লাশকেও না।
আবির নিজের ডেস্কেই বসে আছে। রিভলভিং চেয়ারে হেলান দিয়ে একটা বই পড়ছে। ভিক্টর ফ্র্যাংকেলের ‘ম্যানস সার্চ ফর মিনিং’। মনোযোগ অবশ্য বইয়ে নেই সেটা তার উসখুস করা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। সে একটু পর পর নাসরিনের ডেস্কের দিকে উঁকি দিচ্ছে। নাসরিন মূর্তির মত নিজের ডেস্কে বসে কি যেন লিখছে। নতমস্তক টেবিলে ল্যাম্পের আলোতে নাসরিনকে যেন গ্রীক দেবী মিনারভার মত মনে হচ্ছে। নাসরিনকে কি একবার মনে করিয়ে দেবে আবির? ভুলে যেতেই পারে। সারাদিন এই ফাইল সেই ফাইল করতে করতে ভুলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। না থাক। আরেকটু ধৈর্য্য ধরা যেতে পারে। আবির সিদ্ধান্ত নিল।
নাসরিনের ভেতরে জমে আছে দুইদিনের হতাশা। নকল ফাইলটা যেভাবে রাখা ছিল সেভাবেই আছে। কেউ খুলে দেখেছে বলে মনে হয়নি। কেউ নিয়েও যায়নি। ডাটাবেইজ রুমের সিসিটিভি ক্যামেরাটাও কিছুই বলেনি এখন পর্যন্ত।
রঞ্জন বললেন, “বরুণ, আপনি এক কাজ করেন। বশির জামানের কোন আত্মীয়স্বজন বেঁচে আছে কিনা খোঁজ করেন। দেখেন কারও সাথে সে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে কিনা। ঠিক আছে? আর যে তিনজনের কোডনেম দিলাম এই কোডনেম ধরে একটু খোঁজার চেষ্টা করেন।”
এজেন্ট বরুণ বলল, “কিন্তু রঞ্জনদা, বশির জামানের অতীতের সব ইতিহাস তো মেজর জেনারেলের কাছেই আছে। উনি একটু সাহায্য করলে তো আমাদের জন্য ভালো হয়।”
“সাহায্য করতে পারে এমন তথ্য থাকলে মেজর জেনারেল অবশ্যই দিতেন। সেরকম কোন তথ্য নেই। তাই জানাননি।” রঞ্জন বলল।
বাইরে গোধূলী। আশেপাশের কোন একটা মসজিদ থেকে মাগরিবের আজান শোনা যাচ্ছে।
এজেন্ট বরুণ চেয়ার ছেড়ে উঠলেন দেখে রঞ্জন জিজ্ঞাসা করলেন, “কোথায় যাচ্ছেন?”
“ওয়াশরুম থেকে আসছি।” এজেন্ট বরুণ বললেন।
নাসরিন ডেস্কের ওপরের ফাইলগুলো গুছিয়ে নিয়ে ধীর পায়ে ডাটাবেইজ রুমের দিকে এগিয়ে গেল। লম্বা একটা হাই তুলল। ঘুম আসছে। এটা নতুন কিছু না। সন্ধ্যার সময়টায় তার ঘুম ঘুম লাগে। পনের বিশ মিনিট পরে আবার ঠিক হয়ে যায়। আড়চোখে একবার আবিরের ডেস্কের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল নাসরিন। ছেলেটা এখনও বসে আছে।
ডাটাবেইজ রুমের দরজা খুলতে গিয়ে নাসরিনের মনে হল, কেউ তাকে লক্ষ্য করছে। নাসরিন চমকে বাম দিকে তাকালো। করিডোর অন্ধকারে ডুবে আছে। কেউ নেই। হয়ত মনের ভুল।
রুমে ঢুকে ফাইলগুলো লকারে রাখতে রাখতে পেছন ফিরে তাকাতেই চমকে উঠল নাসরিন। দরজার কাছে এজেন্ট বরুণ দাঁড়িয়ে আছে।”বরুণদা! উফ! ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।” নাসরিন মুখে একটা কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বলল।
বরুণ বললেন, “আপনার ডেস্কের ফোনটা বাজছে অনেকক্ষণ ধরে।”
ক্রিং ক্রিং। ক্রিং ক্রিং।
আসলেই নাসরিনের ডেস্কের ফোনটা বাজছে। অন্যমনস্ক হয়ে যাওয়ায় খেয়াল করেনি নাসরিন। মেজর জেনারেল ফোন দিয়েছেন নিশ্চয়! মুখের ওপরের চুলগুলো তাড়াতাড়ি সরাতে সরাতে সে বলল, “থ্যাংক্স বরুণদা। আমি অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম।” তারপর ডাটাবেইজ রুমের দরজা লাগিয়ে দ্রুত পায়ে ডেস্কের দিকে এগিয়ে গেল।
এজেন্ট রঞ্জন আর মোহিনীকে অফিস থেকে বের হতে দেখল নাসরিন।
ক্রিং ক্রিং। ক্রিং ক্রিং।
“হ্যালো নাসরিন বলছি।” নাসরিন রিসিভারটা তুলে বলল। বিপ বিপ বিপ বিপ। লাইনটা কেটে গিয়েছে। লাইনটা কেটে যাওয়ার পরেই নাসরিনের ভুল ভাঙল। অনেক বড় একটা ভুল হয়ে গিয়েছে। তাড়াহুড়া করতে গিয়ে ডাটাবেইজ রুমের দরজা খুলে রেখে এসেছে সে। ডাটাবেইজ রুমের দিকে ছুটে গেল সে।
রুমের দরজা লাগানো আছে। কিন্তু ভুয়া ফাইলটা গায়েব।
***
আবির খটখট করে একটা পায়ের শব্দ শুনল। ডেস্কের পার্টিশানের ওপর দিয়ে তাকাতেই নাসরিনকে দেখতে পেল সে। খুব দ্রুত অফিস থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। মুহূর্তের ভেতরে আবির রাগে অভিমানে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। ডিনার করবে না তো করবে না। এভাবে পালিয়ে যেতে হবে? দরকার নেই কাউকে ডিনারের দাওয়াত দেওয়ার।
হাতের বইটা ডেস্কের ওপরে ছুঁড়ে ফেলল আবির। ঢক করে শব্দ হল। ফাঁকা অফিসে সেই শব্দের প্রতিধ্বনি হল। নাহ। এভাবে অভিমান নিয়ে বসে থাকবে না আবির। নাসরিনকে কথাগুলো বলতে হবে। না হলে হবে না। চেয়ারের সাথে ঝোলানো জ্যাকেটটা নিয়ে আবিরও অফিস থেকে বের হয়ে গেল।
সেন্সর নিয়ন্ত্রিত অফিসটার সবগুলো লাইট বন্ধ হয়ে গেল। স্বয়ংক্রিয়ভাবে তালাবদ্ধ হয়ে গেল MRAU এর সদর দপ্তরের অফিস।
দোতলা থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে আবির নিচে নামলো। নিচে নেমেই গেটের কাছে নাসরিনকে দেখতে পেল সে। দ্রুত পায়ে একটা সিএনজির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সে। আবির একবার ডাক দিল নাসরিনের নাম ধরে। নাসরিন তাকাল না। শুনতে পেল না নাকি শুনতে পেয়েও তাকাল না বুঝতে পারল না আবির। কিন্তু তার খারাপ লাগাটা আরও বেড়ে গেল। তাড়াতাড়ি নিজের গাড়িটা নিয়ে নাসরিনের সিএনজিটাকে অনুসরণ করল। আবিরের ভেতরের অভিমানটা আস্তে আস্তে রাগে পরিণত হতে শুরু করল।
সিএনজিটা অফিসপাড়ার দিকে যেতে থাকল। আবিরের সিলভার রঙের এলিয়নটাও সেদিকে যেতে লাগল। কিন্তু, আফসোস। গমমন্ডির ২৭ নাম্বারে এসে চার পাঁচটা সিএনজির ভেতরে নাসরিনের সিএনজিটা হারিয়ে ফেলল আবির।
***
নাসরিনের মাথার ভেতরে ঝড় শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রাণপণে চেষ্টা করছে সেই ঝড়টাকে থামানোর জন্য। এজেন্ট বরুণ যে এমন একটা নীচ কাজ করতে পারেন ভাবতেই পারেনি নাসরিন। টেলিফোন এসেছে বলে নাসরিনকে ডাটাবেইজ রুম থেকে সরিয়েছে সে। তারপর সেই ফাইলটা গায়েব করেছে। এতে নাসরিনের কোন সন্দেহ নেই।
কিন্তু এজেন্ট বরুণকে হাতেনাতে ধরতে গেলে তাকে অনুসরণ করলে হবে না। হাতেনাতে ধরতে হলে তাকেই অনুসরণ করতে হবে যার কাছে ফাইলটা যাবে। একটু আগেই মেজর জেনারেলের মাধ্যমে ফোন করে নাসরিন জেনেছে আশফাক চৌধুরী মন্ত্রণালয়েই আছেন। যদি ফাইলের খবরটা এতক্ষণে এজেন্ট বরুণ আশফাক চৌধুরীকে দিয়ে থাকে, তাহলে তিনি মন্ত্রণালয় থেকে বের হবেন। কারণ মন্ত্রণালয়ে তিনি অবশ্যই এজেন্ট বরুণের হাত থেকে প্রায়শ্চিত্ত প্রকল্পের মত বিতর্কিত বিষয়ের ফাইল নেবেন না।
“ভাই, ডানে রাখেন,” নাসরিন বলল, “একটু অপেক্ষা করেন।” মন্ত্রণালয়ের সামনে রাস্তার বিপরীত দিকে সিএনজিটা দাঁড়ালো। প্রতিটা সেকেন্ডে নাসরিনের অস্থিরতা বাড়ছে। সেই অস্থিরতা আরও বাড়ল যখন দশ মিনিটেও মন্ত্রণালয়ের গেট দিয়ে আশফাক চৌধুরীর লেক্সাস গাড়িটা বের হল না তখন।
তাহলে কি এজেন্ট বরুণ ফাইলটা মন্ত্রণালয়েই দিতে গেল? নাসরিনের হিসাবে ভুল হয়ে গেল নাকি? পনেরো মিনিটের মাথায় যখন সিএনজিওয়ালা ভাড়া চেয়ে বসল তখন নাসরিন উপলব্ধি করল, আসলেই কোথাও ভুল হয়ে গিয়েছে। সে হাতের ব্যাগটা খুলতে খুলতে বলল, “কত হয়েছে ভাই?”
ঠিক তখনই মন্ত্রণালয়ের দরজাটা খুলে গেল। নাসরিনের হৃৎপিণ্ডে একপশলা রক্তের স্রোত বইয়ে বের হয়ে গেল সাদা লেক্সাস। এইটাই আশফাক চৌধুরীর গাড়ি। নাসরিন উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠল, “ভাই ওই সাদা গাড়িটারে ফলো করেন। তাড়াতাড়ি ফলো করেন। তাড়াতাড়ি।”
সিএনজিটা ভরর ভরর আওয়াজ তুলে সাদা লেক্সাসটার পিছু নিল। নাসরিনের ব্যাগের ভেতরে মোবাইলটা কাঁপতে শুরু করল। নাসরিন তাড়াতাড়ি ব্যাগটা খুলেই দেখল, আবির ফোন দিচ্ছে। উফ এই ছেলেটা! নাসরিন ফোনটা সাইলেন্ট করে রাখল। ব্যাগের ভেতরেই জ্বলতে আর নিভতে লাগল বোবা মোবাইলের স্ক্রিন।
***
আবিরের এলিয়নটা তসলিম সরণীর চটপটিওয়ালার দোকানগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আবিরের দুই চোখ তার ল্যাপটপের স্ক্রিনে আবদ্ধ। ল্যাপটপের সাথে একটা বিশেষ কেবল দিয়ে তার মোবাইলটা সংযুক্ত। ভেতরে একটা অন্ধ জেদ ধরে গিয়েছে। নাসরিনকে সে খুঁজে বের করবেই। কি এমন কাজে সে ব্যস্ত যার জন্য ডিনার বাদ দিতে হল? খুব বেশি কি ছেলেমানুষী হয়ে যাচ্ছে? হোক।
আবির তার মোবাইল থেকে বার বার নাসরিনকে কল দিচ্ছে। জিপিএস ট্র্যাকিং-এর সাহায্যে কোন মোবাইলের লোকেশন ট্র্যাক করা আবিরের কাছে ডালভাত ব্যাপার। কিন্তু যতক্ষণ না নাসরিন ফোনটা ধরছে, ততক্ষণ সঠিক লোকেশনটা জানা যাবে না। যদি কয়েক সেকেন্ডও নাসরিন কলটা রিসিভ করে করে কথা বলে, তাহলেও আবির নাসরিনের আইপি নাম্বারের লোকেশনটা জেনে ফেলতে পারবে।
“মামা, কি দিব?” আবিরের জানালার কাছে এক ছেলে এসে বলল। আবির মাথা নেড়ে জানাল তার কিছু লাগবে না। ছেলেটা চলে যাচ্ছিলো। কি মনে করে আবার ফিরে এসে বলল নিচু গলায় বলল, “কাঁচা মাংস লাগব মামা?”
আবির কঠিন চোখে ছেলেটার দিকে তাকালো। তারপর বলল, “একটা হালিম নিয়ে আয়।”
একভাবে কল হয়েই যাচ্ছে। আবিরও এক দৃষ্টিতে ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে। একবার, শুধু একবার কলটা ধরেন নাসরিন। মনে মনে নিজেকেই কথাটা বলল আবির। মোবাইলটা কেঁপে উঠল। নাসরিন ফোন ধরেছে!
“হ্যালো।”
“নাসরিন?”
“আমি ব্যস্ত আছি আবির ভাই। একটু পরে ফোন করছি।”
“শোনেন, আর্জেন্ট, হ্যালো, হ্যালো?”
“হ্যাঁ। হ্যাঁ শুনতে পাচ্ছি বলেন।”
“বলছি আপনি এখন কোথায় আছেন?”
“কাল অফিসে কথা হবে আবির ভাই।”
লাইনটা কেটে গেল। সতেরো সেকেন্ড। যথেষ্ট। আবির নাসরিনের আইপির লোকেশন ট্র্যাক করে ফেলল। মডুমহল সিনেমা হল। ওহ! তারমানে আমাকে বাদ দিয়ে অন্যকারও সাথে সিনেমা দেখা হচ্ছে? সাধে কি এরিস্টটোল বলেছিলেন যে নারী আর সাপকে কখনও বিশ্বাস করো না।
হালিমের বাটি নিয়ে আসতে থাকা ছেলেটার সামনে দিয়ে এলিয়নটা হুশ করে বেরিয়ে গেল।
***
মডুমহল সিনেমা হলের সামনের রাস্তা। ‘কেউটের বিষ’ সিনেমার পোস্টারের ওপরে টিমটিম করে জ্বলছে রড লাইট। নাইট শো শুরু হয়ে গিয়েছে এক ঘণ্টা আগে।
রিক্সাওয়ালাদের হৈচৈ আর লোকজনের কোলাহলে পরিপূর্ণ জায়গাটা। ছোট ছোট চায়ের টং-এর সারি। ব্ল্যাকারদের অলস ঘোরাফেরা। তাদেরকে ঘিরে রহস্যময় লোকদের ভিড়। আজকাল টিকেট বিক্রি করে তাদের কিছুই হচ্ছে না। টিকেটের সাথে ‘আরও’ কিছু বিক্রি করতে হচ্ছে।
লেক্সাসটা মডুমহল সিনেমাহলের বেজমেন্টে নেমে গেল। সিএনজিটা কড়া একটা ব্রেক করে থেমে গেল মডুমহলের সামনে। নাসরিন পড়িমড়ি করে ছুটল বেজমেন্টের দিকে। পেছন থেকে সিএনজিওয়ালার ডাকে আবার ফিরে আসল সে। ভাড়া দিতে মনে নেই। কোনরকমে ব্যাগ থেকে পাঁচশ টাকার একটা নোট বের করে সিএনজিওয়ালার দিকে ছুঁড়ে দিয়েই আবার নাসরিন বেজমেন্টের দিকে দৌড় দিল। পরমুহূর্তেই মনে হল, দৌড় দেওয়াটা উচিত হবে না। অযথা আশেপাশের মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করা হবে।
নাসরিন যতটা সম্ভব স্বাভাবিক গতিতে হাঁটতে লাগল। তারপর বেজমেন্টের অন্ধকারে হারিয়ে গেল।
***
আবিরের এলিয়নটা আসল আরেকটু দেরিতে। সিনেমা হলের সামনে দুটো রিক্সাওয়ালা রাস্তা বন্ধ করে ঝগড়া করছিল। আবির কয়েকবার হর্ণ দেওয়ার পরেও যখন কাজ হল না তখন নিজেই নেমে গিয়ে সপাটে এক রিক্সাওয়ালার গালে চড় কষিয়ে দিতেই সব ঠাণ্ডা। মুহূর্তের ভেতরে পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হয়ে গেল। তারপর এলিয়নটা নিয়ে ঢুকে পড়ল বেজমেন্টে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গাড়িটা রেখে হলের ভেতরে ঢুকতে হবে। যেভাবেই হোক আবিরকে জানতে হবে, তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ কে আছে নাসরিনের জীবনে।
বেজমেন্টটা সুনসান। শুধু দুইটা রডলাইট জ্বলছে। সেই রড লাইটের আলোও ঘোলাটে। পুরো বেজমেন্টের পার্কিং লট জুড়েই যেন জমাট অন্ধকার। তিনটা গাড়ি ছাড়া আর কোন গাড়ি নেই। মোটরসাইকেল আছে কয়েকটা। এলিয়নটা পার্ক করাতে গাড়ির সংখ্যা চারটা হল।
আবির এলিয়নের দরজা খুলে বের হয়ে আসল। পার্কিং লটের এমাথা থেকে ওমাথা খাঁ খাঁ করছে। কেউ নেই। আবির গাড়ি লক করে বেজমেন্ট থেকে ওপরে যাওয়ার সিঁড়িটা খুঁজতে লাগল।
***
লেক্সাস থেকে আশফাক চৌধুরীকে নামতে দেখল নাসরিন। তার হাতের ক্যামেরাটা তৈরিই ছিল। ভেবেছিল বেজমেন্টের অন্ধকারের ভেতর থেকেই এজেন্ট বরুণ বের হয়ে এসে আশফাক চৌধুরীকে ভুয়া ফাইলটা দেবে। নাসরিন ছবি তুলে নেবে।
কিন্তু সেরকম কিছু হল না। আশফাক চৌধুরী আশেপাশে দেখে অন্ধকারে হারিয়ে গেলেন। তার পিছু নিল নাসরিন। প্রমাণসহ বিশ্বাসঘাতকটাকে ধরার এই শেষ সুযোগ। এরপরে হয়ত আর সুযোগ আসবে না। কারণ এজেন্ট বরুণ এর পরে সতর্ক হয়ে যাবেন।
অন্ধকারের ভেতরে একটা সবুজ আলোয় আলোকিত সিঁড়ি দেখা গেল। আশফাক চৌধুরী সেই সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠে গেলেন। নাসরিনও একটা নিরাপদ দুরত্ব বজায় রেখে সেই পথেই গেল। সিঁড়িটা শেষ হয়েছে একটা ছোট দরজায়। আশফাক চৌধুরী দরজাটা খুললেন। নাসরিন দরজাটা বন্ধ হওয়ার অপেক্ষায় থাকল। দরজাটা বন্ধ হতেই সেও দরজার হাতলে হাত রেখে বোঝার চেষ্টা করল যে দরজার ওপাশে তার জন্য কোন ফাঁদ পাতা আছে কিনা।
খুব ভয় করছে নাসরিনের, খুব। জানে না দরজার ওপাশে কী অপেক্ষা করছে। যদি আশফাক চৌধুরী বা বরুণের কেউ একজনও জানতে পারে তাহলে তার আর রক্ষা নেই। তাকে বেঁচে ফিরে যেতে দেবে না কেউই। কিন্তু যা কিছুই অপেক্ষা করুক। নাসরিনের পিছু হটার আর রাস্তা নেই।
দেরি হয়ে যাচ্ছে। বেশি দেরি হয়ে গেলে আশফাক চৌধুরীকে হারিয়ে ফেলবে নাসরিন। দরজার নবে মোচড় দিল। একটা চাপা আর্তনাদ করে দরজাটা খুলে গেল।
ফ্লুরোসেন্ট লাইটের আলোয় আলোকিত করিডোর। ফাঁকা। নাইট শো হচ্ছে। তাই করিডোরে কেউ নেই। শূন্য করিডোরটা যেন ফিসফিস করে নাসরিনের কানে কানে বলে গেল, আর এগিয়ো না। ফিরতে পারবে না। নাসরিনের পুরো শরীর কেঁপে উঠল। না। মাথা ঠাণ্ডা করতে হবে। মেজর জেনারেলের দেওয়া কাজটা সে সম্পূর্ণ করবেই। সব ভয়ের উৎস মৃত্যুভয়। নাসরিন মৃত্যুকে হাসি মুখে মেনে নেবে। যদি ফিরতে নাও পারে তাও মেজর জেনারেল কোন না কোনভাবে তো জানবেন যে নাসরিন তার কাজের জন্য জীবন দিয়েছিল।
ডান দিকে বড় দরজাটা চোখে পড়ল নাসরিনের। ওইটাই হলরুমের দরজা। নাসরিন দ্রুত পায়ে দরজাটা খুলল। তারপর আস্তে করে ঢুকে পড়ল।
ভেতরটা গুমোট। সিগারেটের ধোঁয়া সেই গুমোট ভাবটা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই ভেতরটা অন্ধকার। শুধু প্রজেক্টরের আলোছায়ার কিছুটা প্রতিফলিত হয়ে দর্শকদেরকে আলোকিত করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছে। কিন্তু নাসরিন পেছন থেকে কাউকেই চিনতে পারল না। দর্শক খুব বেশি নেই। হাতে গোনা জনা বিশেক হবে। সবাই পুরুষ দর্শক। সবাই নিশ্চুপ।
স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই নাসরিনের গা গুলিয়ে উঠল। যেটা দেখানো হচ্ছে সেটা কোন সিনেমার দৃশ্য হতে পারে না। সে চোখ সরিয়ে নিল। মন দিল অন্ধকারে আশফাক চৌধুরীকে খুঁজে বের করতে।
হঠাৎ একটা ছায়ামূর্তিকে এগিয়ে আসতে দেখল নাসরিন। খুব দ্রুত। নাসরিন ব্যাগের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে চুল বাঁধা কাঁটাটা শক্ত করে চেপে ধরল। লোকটা কাছে আসতেই নাসরিন কাঁটাটা বিদ্যুৎ বেগে বের করে আনল। সাথে সাথে ছায়া মুর্তিটা বলল, “লেডিস? একা? একা আইছেন?” নাসরিন বুঝল, এটা টিকিট চেকার।
নাসরিন বলল, “না”।
“তয়? লাভারের লগে আইছেন?”
নাসরিন আমতা আমতা করে বলল, “হুম।”
টিকিট চেকার মাথা নেড়ে বলল, “দেখি টিকিট দেখি।”
“ওর কাছে আছে। ও ড্রিংকস আনতে গেছে।”
চেকার লোকটা টর্চ জ্বেলে একটা সিট দেখিয়ে বলল, “ওইখানে গিয়া বসেন। ইন্টারভাল চলতাছে। একটু পরেই বই শুরু হইবে। আর শোনেন, লাভারের লগে আইছেন, বকশিশ দিয়া যাইবেন।”
নাসরিন অন্ধকারে ব্যাগ হাতড়ে একশ টাকার নোট বের করে লোকটার দিকে এগিয়ে দিতেই লোকটা চলে গেল।
নাসরিন আরেকবার দর্শকদের ওপরে চোখ বুলিয়ে নিল। নাহ। আশফাক চৌধুরী নেই আশেপাশে। থাকলেই এই অন্ধকারে নাসরিনের পক্ষে খুঁজে বের করা সম্ভব না। তাছাড়া নিজেকেও আলোকিত করা যাবে না। করলে বরুণ দেখে ফেলতে পারে। বাধ্য হয়ে নাসরিন বসে পড়ল।
স্ক্রিনের নোংরা জিনিসটা বন্ধ হয়ে সিনেমা শুরু হল।
আর নাসরিন অবাক হয়ে আবিষ্কার করল, তার পাশে বসা মানুষটাই আশফাক চৌধুরী। ভয়ে শরীরের রক্ত বরফ হয়ে গেল নাসরিনের। নাসরিন নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগল। চট করে উঠে যাওয়া যাবে না। একটু পরে ধীরে সুস্থে উঠে যেতে হবে।
হঠাৎ একটা কণ্ঠ শুনল নাসরিন। আশফাক চৌধুরীর আরেক পাশে বসে আছে লোকটা। খুব ধীরে কথা বললেও নাসরিন এলোমেলো কয়েকটা শব্দ শুনতে পেল “আপনি……মেয়েটা……. একটু পরে………ওই তো……পাগলামী……..”
এই কণ্ঠটা তার ভীষণ পরিচিত। এই কণ্ঠটা সে কখনও ভুলতে পারবে না। নাসরিনের মাথায় যেন বাজ পড়ল। তার ধারণা ভুল। এটা এজেন্ট বরুণ না। এই কণ্ঠের মালিক অন্য একজন। ছায়াটা আশফাক চৌধুরীর কোলের ওপরে ফাইলটা রেখে দিল। তারপর অন্ধকারে উঠে চলে গেল।
নাসরিন দম বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগল। প্রজেক্টরের আলোয় তার মুখমন্ডল অনেকটা আলোকিত হয়ে আছে। লোকটা কিছুই খেয়াল করল না।”এক্সকিউজ মি” বলে নাসরিনের সামনে দিয়ে চলে গেল।
নাসরিন উঠতেও পারছে না, বসেও থাকতে পারছে না। কুল কুল করে ঘামছে। মৃত্যুর এত কাছাকাছি সে এর আগে আসেনি। এখনও তার বিশ্বাস হচ্ছে না যে এই লোকটাই তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এতদিন এত কাছে থেকেও লোকটাকে চিনতে পারেনি নাসরিন! তারমানে আজ সন্ধ্যায় এই লোকটাই কোনভাবে তার ডেস্কের ল্যান্ডলাইনে ফোন করেছিল তাকে ডাটাবেইজ রুম থেকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য। নাসরিন সরে গেলে তারপরেই লোকটা ডাটাবেইজ রুম থেকে ফাইলটা সরায় এবং আশফাক চৌধুরীর কাছে পাচার করে। পুরো হিসাবটা মিলে যায় নাসরিনের মাথার ভেতরে।
একটু পরে আশফাক চৌধুরী উঠে পড়েন। নাসরিনের ভাগ্য বিশ্বাসঘাতকতা করল। কি মনে করে একবার নাসরিনের মুখের দিকে তাকালেন আশফাক চৌধুরী। নাসরিন যতটা সম্ভব চাহনি স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল। তাকে চেনার কথা না আশফাক চৌধুরীর। নিজেকে সান্ত্বনা দিতে লাগল নাসরিন।
সান্ত্বনা কাজে লাগল। আশফাক চৌধুরী ফাইলটা হাতে নিয়ে বের হয়ে গেলেন। নাসরিন বুকের ভেতরে চেপে রাখা নিঃশ্বাসটা ছেড়ে দিল। তারপর ধীরে ধীরে চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে তার মনে হল, ছবি তোলা হয়নি। এত উত্তেজনার ভেতরে ছবি তুলতেই মনে নেই। প্রমাণ ছাড়া এই লোককে ধরা এক রকম অসম্ভব। কেউ বিশ্বাস করবে না যে এই লোকটাই MRAU থেকে তথ্য পাচার করছে।
হঠাৎ বাইরে একটা চিৎকার শুনে দর্শকদের ভেতরে গুঞ্জন শুরু হল। তারপর দড়াম করে হলরুমের দরজা খুলে গেল। একটা লোক চিৎকার করে বলল, “খুন হইছে। কে জানি খুন হইছে।”
নাসরিনের শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। ত্রস্ত পায়ে সিনেমা হল থেকে বের হয়ে গেল নাসরিন। সাবধানে ভিড়ের আগে আগে লোকটাকে অনুসরণ করল। ছোট দরজা, যেই দরজাটা দিয়ে নাসরিন ঢুকেছিল, সেই দরজা দিয়েই লোকটা ছুটতে ছুটতে ঢুকে পড়ল। নাসরিনও ঢুকল।
সবুজ আলোয় আলোকিত সিঁড়ির ওপরে কয়েকজন মানুষের জটলা। নাসরিন ভিড় ঠেলে দেখতে পেল, আবিরের রক্তাক্ত নিথর দেহ পড়ে আছে সিঁড়ির ওপরে। ছুরিকাঘাত করা হয়েছে আবিরকে। লাল রক্ত সবুজ আলোতে কালো দেখাচ্ছে।
নাসরিনের মুখ দিয়ে একটা আর্তচিৎকার বের হয়ে এলো। সন্দেহ নেই লোকটাই আবিরকে খুন করেছে। আবির লোকটাকে চিনত। শুধু আবির কেন, MRAU এর সবাই এই লোকটাকে চেনে। মুখোশ খুলে যাওয়ার ভয়ে আবিরকে খুন করেছে লোকটা।
কিন্তু আবির ওখানে কী করছিল? প্রশ্নটা অজানাই থেকে গেল নাসরিনের কাছে।