টিকটিকির ল্যাজের দিক
হুঁকাকাশি১ একজন নামজাদা গোয়েন্দা। আমাদের কল্কেকাশি তাঁরই ভায়রাভাই। তপ্ত কল্কের মতো গনগনে আর কাশির মতো খনখনে তাঁর দাপট। তাঁর নামডাকও ভায়রার চেয়ে কিছু কম যায় না।
টিকটিকি হিসেবে তিনিও কিছু কম নন। অনেক খুনের তিনি কিনারা করেছেন খুনির কিনারে না গিয়েও। কত ডাকাতকে তিনি কাত করেছেন, চোরকে ছেঁচড়ে এনেছেন দেখতে-না-দেখতে। কত রাহাজানির সুরাহা করেছেন জানাজানি হওয়ার আগেই।
বদলোক তিনি এক পলক তাকালেই টের পান। তাঁর চোখের সামনে সব পরিষ্কার। সমস্ত রহস্য, সবকিছুর হদিস, সরকারি পুলিশে যেসব তথ্যের ঠাঁই পায় না, থ হয়ে থাকে, শেষ পর্যন্ত তাদের তাঁর কাছেই ছুটতে হয়। তিনি শখের গোয়েন্দা হলেও সখ্যের খাতিরে, জলের মতো তাদের সব সমস্যা সমাধান করে দেন।
এহেন ডিটেকটিভ কল্কেকাশি এইমাত্র গোলদিঘিতে২ এসে বসেছেন। কোনও গোলমালের খোঁজে নয়, হাওয়া খাওয়ার মতলবে। মির্জাপুরের মোড়ে তাঁর টু-সিটারে চাবি মেরে রেখে, এখানে এসে একটু বিশ্রাম করবেন এখন।
বেঞ্চে তাঁর অদূরে আধময়লা জামাকাপড়ে আধাবয়সি এক ভদ্রলোক একমনে কী ভাবছিল। ভাবতে ভাবতে উঠে গেল লোকটা। দিঘির এক কোণের গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল সে। লোকটা উঠে যেতেই এক ছোকরা এসে তাঁর শূন্যস্থান পূর্ণ করল। ধপ করে বেঞ্চির ওপর বসে পড়ে সে বললে, ‘ধুত্তোর!’
বিরক্তিব্যঞ্জক তার ওই অর্ধস্ফুট আর্তনাদের মধ্যে এমন কিছু ছিল যে কল্কেকাশি কান না দিয়ে পারলেন না।
তুমি কী কোনও অসুবিধেয় পড়েছ?’ তিনি জিগ্যেস করলেন ছেলেটাকে।
‘অসুবিধে বলে!’ বলল ছেলেটি— ‘যা মুশকিলে পড়েছি মশাই! এমন অবস্থায় পড়লে কারো মাথার ঠিক থাকে?’
‘কী হয়েছে শুনি তো?’
‘শুনবেন তা হলে? এমন বিপদে মানুষ পড়ে! শুনুন তবে। পশ্চিম থেকে আজ দুপুরে এসে নেমেছি কলকাতায়। চেনা এক বন্ধুর বাড়ি উঠব এই স্থির। বছর-দুই আগে আর একবার যখন এসেছিলাম তাদের বাড়িতেই ছিলাম। আজ সেখানে গিয়ে দেখি— এই তো খানিক আগেই মশাই— কোথায় সেই বাড়ি, কোথায় কী! বন্ধুরও কোনও পাত্তা নেই।’
‘বলো কী হে! খুন-টুন করে ফেরার নাকি তোমার সেই বন্ধুটি?’ কল্কেকাশি উচ্চকিত হন— ‘কিন্তু বাড়ি? বাড়িও নেই? বাড়ি-অব্দি লোপাট?’
বাড়ির পলায়ন কল্কেকাশির কাছে ভালো লাগল না। একটু বাড়াবাড়িই বলে মনে হল। বাড়ির পালাবার কী প্রয়োজন ছিল? অ্যাঁ?
‘না, না, তা কী করে হয়! বাড়ি ঠিকই আছে। কোথাও যায়নি, যেতে পারে না। বাড়ি হচ্ছে ফেরার জায়গা, বাড়ি কি ফেরার হতে পারে? তুমি ভালো করে খুঁজে দ্যাখো গে।’
‘খুজঁতে কি আর বাকি রেখেছি মশাই? খোঁজবার কোনও কসুর করিনি’ যুবকটি জানায়। ‘কিন্তু খুঁজে কী হবে? যেখানে বন্ধুর বাড়ি ছিল সেখানে সিনেমা হাউস হচ্ছে, নিজের চোখেই দেখে এলাম। আপনি কি এর পরেও খুঁজতে বলেন’ সে জানতে চায়।
‘হ্যাঁ, এরকম প্রায় ঘটে থাকে বটে’ কল্কেকাশি এতক্ষণে আঁচ পান। ‘কাল যেখানে ছিল চায়ের দোকান, আজ সেখানে ডাইং ক্লিনিং। আজ যেখানে চুল-ছাঁটার সেলুন, কাল সেখানে দেখবে রেস্তোরাঁ। কাঁচির খচখচানির জায়গায় কাঁটা চামচের ঠনৎকার। আসল ব্যাঙ্ক ভেবে আজ যেখানে তোমার টাকা রাখলে, কাল দেখবে, আসলে সেটা রিভারব্যাঙ্ক ছাড়া কিছু না। তোমার যথা সর্বস্বই জলাঞ্জলি! যে যা পাচ্ছে, যেখানে পাচ্ছে, যাকে পাচ্ছে, মেরেধরে কেড়েকুড়ে নিয়ে সরে পড়ছে— আকচারই তো দেখা যায়। তুমি এক কাজ করো, ভালো একটা হোটেল দেখে ওঠ-গে।’
‘উঠেছিলাম তো। ট্যাক্সি-ড্রাইভারই তার জানা এক হোটেলে তুলে নিয়ে গেছল। হোটেলে আমার ঘরে ব্যাগ সুটকেস বিছানা মালপত্তর সব রেখে আমি একটা টুথপেস্ট কিনতে বেরিয়েছি— তারপর, তারপর আর কী বলব! সেই হোটেল আর খুঁজে পাচ্ছিনে এখন।’
‘হোটেলের নাম কী?’ কল্কেকাশি জিগ্যেস করলেন।
‘তা-ই তো মনে পড়ছে না মশাই, নাম মনে থাকলে তো হতই। তবে আর মুশকিল কীসের?
‘এ আর মুশকিল কী? এই গোলদিঘির আশপাশ— হ্যারিসন রোড৩, মির্জাপুর৪, আমহার্স্ট স্ট্রিট৫— সব হোটেলে ভর্তি। এইখানেই যত রাজ্যের হোটেল আর বোর্ডিং হাউস। তবে একটা তো হোটেল নয়, একটু ঘুরতে হবে এই যা। বাড়িটা দেখলে তো চিনতে পারবে?’
‘সেইখানেই তো গোল, মশাই! কী রঙের, কোন ঢঙের, কী রকমের, ক-তলা বাড়ি— কিছুই ভালো করে দেখিনি। কাছেপিঠেই একটা টুথপেস্ট কিনে ফিরে আসব। ভালো করে চিনে রাখবার দরকারও মনে করিনি—’
‘এখন দেখছ সব চিনেম্যান— কাউকেই চেনা যাচ্ছে না! বটে!?’
‘তারপর এ-দোকান সে-দোকান করতে করতে কখন রাস্তাটা গুলিয়ে গেছে—
‘তা হলে তো গোল বাধিয়েছ সত্যিই!… বেশ একখানা গোল বাধিয়ে এই গোলদিঘিতে এসে আমাকে বাধিত করেছ!’ পরের বাক্যটি কল্কেকাশি আর প্রকাশ করেন না; নিজের মনেই বলেন।
খুন খারাপির কিনারায় ওস্তাদ কল্কেকাশির বাড়ি খুঁজতে বেরুবার সাধ হয় না। গরু খোঁজা আর বাড়ি খোঁজায় কার উৎসাহ হয়? তার ওপরে গরুর জন্যে বাড়ি খুঁজতে হলেই তো হয়েছে!
‘আরও মুশকিল, বাড়িটা তো চিনে রাখিইনি—’ ছেলেটি বলতে থাকে, ‘তারপর কোন রাস্তায় যে তাও জানিনে। অথচ আমার জিনিসপত্র সব সেই হোটেলেই থেকে গেল। টাকাকড়ি যা কিছু… এখন কী যে করি!’
‘কী আর করবে! ফিরে যাও। যেখান থেকে এসেছ সেইখানেই ফেরত যাও পত্রপাঠ। নিজের বাড়ি ফিরে যাওয়া ছাড়া এখন আর কী করবার আছে? তবে হ্যাঁ, কাছাকাছি থানায় একটা খবর দিয়ে যেতে পারো। পুলিশ যদি তোমার হোটেল আর জিনিসপত্রের সন্ধান পায় তোমার দেশের ঠিকানায় পাঠিয়ে দেবে।’
‘তা না-হয় গেলাম। পুলিশেও খবর দিয়ে গেলাম না হয়। দেশেই ফিরে গেলাম রাত্রের ট্রেনেও। কিন্তু, কিন্তু— যাই কী করে? যেতে তো টাকা লাগবে— টাকা কই আমার?’
কল্কেকাশি এই তথ্য বহুক্ষণ আগেই জেনেছেন। তাঁর কাছে এ সংবাদের কোনও নূতনত্ব ছিল না।
‘আপনাকে— আপনি, আমাকে…’ যুবকটি বাধা কাটিয়ে বলেই ফেলে অবশেষে ‘আপনাকে সদাশয় ভদ্রলোক বলেই বোধ হচ্ছে। আপনি যদি আমায় বিশ্বাস করে— বিশ্বাস করবেন কি না জানি না— গোটা পঁচিশেক টাকা আমায়—’
‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই তোমাকে আমি দিতাম যদি তোমার কথায় আমার বিশ্বাস হত। মুশকিলটা কোথায় জানো? তোমার হোটেল হারানোয় নয়— টুথপেস্ট কিনতে বেরোনোতেও না—’ রূঢ় অপ্রিয় সত্যটা বলবেন কি না তিনি ভাবেন।
‘তা হলে?’
‘মুশকিল হয়েছে এই যে, সবই ঠিক, কিন্তু তুমি যে টুথপেস্টটা কিনেছ সেইটাই কেবল দেখাতে পারছ না।’
কল্কেকাশি মৃদু মধুর হাসেন, ‘কাহিনিটা ফেঁদেছিলে মন্দ না— ওস্তাদ গল্পকারের মতোই। কিন্তু তোমার প্লটের ওইখানটাতেই গলদ রয়ে গেছে। আসল জায়গাটাতেই কাঁচা রেখে দিয়েছো। সেইজন্যেই ধরা পড়ে গেলে। বুঝতে পারছি, এখনও ততটা পাকা হয়ে উঠতে পারোনি, বালক।’
কল্কেকাশির অভিযোগের সঙ্গে সঙ্গেই ছেলেটি চমকে যায়, জামার পকেটে হাত পুরে দেয় চট করে— আর তারপরেই সে লাফিয়ে ওঠে।
‘কোথায় হারালাম তা হলে?’ ককিয়ে ওঠে সে, ‘টুথপেস্ট?’
‘এক বিকেলের মধ্যে এক বন্ধুর বাড়ি, একটা হোটেল আর এক প্যাকেট টুথপেস্ট একসঙ্গে হারানো— বড়ো কম বাহাদুরি নয়!’
কল্কেকাশি আরও কী বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ছেলেটি শোনবার জন্য অপেক্ষা করে না। সবেগে সেখান থেকে চলে যায়।
‘হ্যাঁ, বাহাদুরই তোমায় বলতাম যদি শেষরক্ষা করতে পারতে। দেশ থেকে সদ্য ট্রেনে আসা, টুথপেস্ট কিনতে বেরোনো, হোটেল হারিয়ে ফেলা— সবই ঠিকঠাক করেছ, গল্পটা বানিয়েওছো মন্দ না। বলেছোও বেশ গুছিয়ে গড়গড় করে কোথাও না একটুও আটকে। সমস্তই নিখুঁত, কেবল ওই সামান্য একটুখানি ত্রুটির জন্যে সব ভেস্তে গেল। আরও একটু বুদ্ধি খরচ করে আগে থেকে আনকোরা টুথপেস্টের একটা চকচকে প্যাকেট দোকানের ক্যাশমেমো-সমেত নিজের পকেটে মজুত রাখতে— তা হলে, বলতে কী, আমি তোমাকে উদীয়মান প্রতিভাই বলতাম। তোমার জন্যে তা হলে আর আমার ভাবনা ছিল না। নিজের লাইনেই করে খেতে পারতে তুমি।’
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে কল্কেকাশি বেঞ্চি ছেড়ে ওঠেন। আর, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর নজরে কী যেন পড়ে। বেঞ্চির তলায় মোড়কে মোড়া, লম্বাকৃতি, কী ওটা? টুথপেস্টের প্যাকেট না? হাতে তুলে দেখেন তাই তো! টুথপেস্টই তো! দোকানের ক্যাশমেমো জড়ানো সদ্য কেনা যে, তার কোনও ভুল নেই। বোঝা গেল, ছেলেটি যে-সময়ে গা-ঝাঁকি দিয়ে ধপ করে বসেছিল, সেই সময়েই এটা পাঞ্জাবির পকেট থেকে টপকে ধরাশায়ী হয়েছে।
নাঃ, ছেলেটাকে খুঁজে বার করতে হল! একটু এদিক-ওদিক তাকাতেই গোলদিঘির আর এক ধারে পাত্তা মিলল তার।
‘ওহে, শোনো শোনো!’ কল্কেকাশি তার কাছে গিয়ে ডাকলেন।
যুবকটি উদ্ধতভাবে ফিরে তাকাল।
‘তোমার গল্পের প্রধান সাক্ষী এসে পৌঁছেছে।’ এই বলে প্যাকেটটা তিনি তার হাতে তুলে দিলেন: ‘এই নাও তোমার পেস্ট। বেঞ্চির তলাতেই পড়ে ছিল। তুমি চলে আসার পর এটা চোখে পড়ল আমার। যাক গে… যেতে দাও… তোমাকে অযথা সন্দেহ করেছি বলে মনে কিছু কোরো না। তোমার টাকার দরকার ছিল বলছিলে…’ এই বলে কল্কেকাশি তাঁর পকেট হাতড়ে নোটে টাকায় রেজকিতে যা ছিল তার হাতে দিয়ে বললেন, ‘টাকা কুড়ি-বাইশ হবে। এ দিয়ে তুমি দেশে পৌঁছতে পারবে। তারপর সেখান থেকে… এই নাও আমার কার্ড— এতে আমার নাম ঠিকানা লেখা আছে। বাড়ি পৌঁছে তারপর আমার টাকাটা মানি অর্ডারে তোমার সুবিধেমতো ফেরত পাঠিও। তা হলেই হবে।’
‘ভাগ্যিস টুথপেস্টটা আপনি পেয়েছিলেন!’ এই বলে ছেলেটি টাকাটা নিয়ে তো তো করে কী যেন বলল— ধন্যবাদের ভাষাই হয়তো বা— বলেই চোঁ চোঁ করে ছুটল। দেখতে-না-দেখতে ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেল।
ট্রেন ধরতেই ছুটেছে! কল্কেকাশি বললেন আপন মনে। যাক! তিনিও গোলদিঘিতে আরও দু-এক চক্কর মেরে বাড়ি ফিরবেন। ঘুরতে ঘুরতে, ঘুরপাক খাওয়ার মুখে সেই ভূতপূর্ব বেঞ্চির কাছাকাছি আসতেই আর এক অভূতপূর্ব দৃশ্য তাঁর নজরে পড়ল। এক ব্যক্তি অত্যন্ত ব্যগ্র, সতৃষ্ণ দৃষ্টিতে বেঞ্চির নীচে, তার আশেপাশে, চারিধারে ভারী উঁকিঝুঁকি মারছে।
দেখামাত্রই লোকটিকে তিনি চিনলেন। ছেলেটির আবির্ভাবের আগে এই লোকটিই বেঞ্চিতে তাঁর পাশে বসেছিল।
‘আপনার কি কিছু হারিয়েছে নাকি? কী খুঁজছেন অত করে?’
‘হ্যাঁ মশাই, এইমাত্র কেনা—’ লোকটি আর্তকণ্ঠে জানায়, ‘একটা টুথপেস্টের প্যাকেট।’
সামলাতে কল্কেকাশির সময় লাগে। তিনি কিছু বলতে পারেন না। লোকটিই বলে যায়, ‘টুথপেস্টের জন্যে তত না, ওটা হারানোর জন্যে নয়। কিন্তু ওর মধ্যে, ওই প্যাকেটের ভিতরে, আমার আজকের পাওয়া মাইনে— এ মাসের পুরো বেতন—’
‘ক-খানা নোট ছিল?’
‘আজ্ঞে, আটখানা দশ টাকার নোট— এ মাসের মাইনের সবটাই। ভারী পকেট মারে আজকাল, ভাবলুম প্যাকেটের মধ্যে টাকাটা রাখলে নিরাপদে থাকবে—’
কাহিনিটার এ পর্যন্ত এক বিখ্যাত লেখকের। তাঁর নাম সাকি৬— তাঁরই গল্পের ছায়ায় এটি লেখা। এখন, সাকির বাকি গল্পটা।
কেরানিটির কথা শুনে কল্কেকাশি গুম হয়ে গেলেন। বললেন, ‘হুঁ । বুঝেছি। দেখুন, আপনার টাকাটা খোয়া যাওয়ার জন্যে আমিই দায়ী। আপনি এক কাজ করুন, আমার সঙ্গে চলুন— আমি আপনার ক্ষতিপূরণ করে দেব। আমি অবশ্যি কলকাতার বাইরে থাকি ডায়মন্ডহারবার রোডেই’— তা হলেও আমার বাড়ি খুব বেশি দূরে নয়। সঙ্গে গাড়ি আছে। ফিরতি বাস পাবেন।’
ডায়মন্ডহারবার৭ রোড ধরে কল্কেকাশির মোটর তিরবেগে ছুটছিল। শহর ছাড়িয়ে শহরতলি পেরিয়ে একটানা পিচ-ঢালা পথের বুকের ওপর দিয়ে। দু-ধারেই ফাঁকা, নির্জন রাস্তা, মাঝে মাঝে এক-আধখানা বাড়ি। বাগানবাড়িই বেশিরভাগ।
কল্কেকাশি বেপরোয়া গাড়ি চালাচ্ছেন। কেরানিটি তাঁর পাশে বসে— চুপচাপ।
ভাবতে ভাবতে চলেছেন কল্কেকাশি। নাঃ, মানুষের রহস্য বোঝা দায়— জীবনের রহস্যের মতোই জটিল। মানুষের না হলেও, অন্তত বদলোকেদের আদি-অন্ত পেয়েছেন বলে নিজের সম্বন্ধে যে উচ্চ ধারণা তাঁর ছিল সেই গর্ব আজ চূর্ণ হয়েছে। নাঃ, মানুষ চেনা বড়ো কঠিন।
হঠাৎ কল্কেকাশির কেমন একটা খটকা লাগল। পাশ্ববর্তীর দিকে তিনি একবার ভ্রূক্ষেপ করলেন। গোলদিঘির সেই যুবকটি না-হয় এক নম্বরের ঠক, কিন্তু এই লোকটিই কি খাঁটি?
সন্দেহ হতেই নিজের বাঁ পকেটে তিনি হাত পুরে দিলেন— হুম, ঠিক! ঠিকই তো! অবিকল— যা ভেবেছেন!
তাঁর সন্দেহ অমূলক নয়।
অমনি ডান পকেট থেকে তাঁর রিভলবার বার হয়ে এল। (গোয়েন্দাদের পকেটে আর কিছু থাক বা না থাক, পিস্তল আর হাতকড়া সর্বদাই লেগে থাকে।) লোকটির দিকে সেটি উঁচিয়ে তিনি বললেন, ‘কই, ঘড়ি চেন সব দেখি!’
লোকটিও অমনি একটুও দেরি না করে নিজের পকেট থেকে ঘড়ি চেন বার করে দেয় বিনা বাক্যব্যয়ে।
ডান পকেট থেকে হাতকড়া মুক্ত করে কেরানিটির যুক্ত হাতে পরিয়ে দেন কল্কেকাশি। তারপর মোটর থামিয়ে পথের মাঝখানেই নামিয়ে দেন তাকে।
‘দয়া করে তোমায় আর পুলিশে দিলাম না। এখান থেকে হাতকড়া-হাতে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরো। এই তোমার যোগ্য শাস্তি।’
হ্যাঁ, কে এখন এমন সময় থানা-পুলিশ করে! সে সবের হয়রানির চেয়ে এই ভালো। এর শয়তানির ঢের সাজা দেওয়া হয়েছে। এখান থেকে কলকেতা— এতখানি পথ করজোড় আর জোর করে হাঁটানো বড়ো কম শাস্তি না।
তা ছাড়া, তাঁর মতো ধুরন্ধর গোয়েন্দার ট্যাঁক থেকেও ঘড়ি চেন চুরি যায়— নিজের এত বড়ো বাহাদুরির পরিচয় থানা পুলিশে, কোন মুখে জানাতে যাবেন? এ খবর জানাজানি হওয়ার উৎসাহ তাঁর ছিল না।
‘যেমন কর্ম তেমনি ফল! মরুকগে ব্যাটা সারা রাস্তা নিজের সঙ্গে হাতাহাতি করে!’ এই বলে তিনি আরও জোরে গাড়ি চালিয়ে দিলেন। থামলেন এসে সটান বাড়িতে।
বাড়ির ভিতরে পা না বাড়াতেই তাঁর ছোট ছেলে ছুটে এল, বাবা! তোমার চেনঘড়িটা৮ তুমি আজ নিয়ে যাওনি যে? টেবিলের ওপর ফেলে রেখে গেছো! হাতে পেয়ে আজ ওটাকে আমি ভালো করে সারিয়ে রেখেছি। তুমি তো বলো যে ভালো ঘড়ি আরও ভালো করা যায় না! কিন্তু দেখবে এসো কেমন মেরামত করেছিল একবার! ঢাকনি-টাকনি সমস্ত এঁটে দিয়েছি তেমনি করে। কেবল একটা সুতোর মতন সরু তার— গোল-পাকানো কিন্তু বেশ লম্বা— সেটাকে কিছুতেই আর ভিতরে আঁটানো গেল না। তা না যাক, তাতে কিছু যায় আসে না। কাঁটা-টাটা তোমার সব ঠিক আছে।’
***
১. হুঁকাকাশি: জাপানি গোয়েন্দা মি. হুকাকাশিকে হুঁকাকাশি করে দেওয়া শিব্রামী মজা ছাড়া কিছু না। সম্ভবত কল্কেকাশির কল্কের সঙ্গে মেলাতেই হুঁকা-র প্রবর্তন। জাপানের এই বিখ্যাত ক্রিমিনোলজিস্ট তথা গোয়েন্দা হলেন সাহিতিক্যক মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের লেখা পাঁচটি গোয়েন্দা গল্প এবং তিনটি গোয়েন্দা উপন্যাসের চরিত্র। একেবারে বাঙালিদের মতো জীবন যাপনে অভ্যস্ত এই গোয়েন্দাপ্রবরের আস্তানা ছিল স্কটিশ চার্চ কলেজের পেছনে ডাফ স্ট্রিটে। তাঁর শাগরেদ রণজিৎ কলকাতার বিখ্যাত ফুটবল খেলোয়াড়।
২. গোলদিঘি: উত্তর কলকাতার কলেজ স্ট্রিট অঞ্চলে প্রেসিডেন্সি কলেজের বিপরীতে ও হিন্দু স্কুলের দক্ষিণে অবস্থিত প্রাচীন সরোবর। পূর্বতন মালিকের নামে এর পরিচিতি ছিল মাধববাবু-কা-তালাও নামে। নামে গোলদিঘি হলেও বর্তমান আকৃতি চতুষ্কোণ। প্রচলিত নাম কলেজ স্কোয়ার। কারণ নিকটে একাধিক কলেজ অবস্থিত। বর্তমানে সরকারিভাবে বিদ্যাসাগর সরোবর নাম রাখা হয়েছে। সংলগ্ন বাগান ও চলনপথ হয়েছে বিদ্যাসাগর উদ্যান।
৩. হ্যারিসন রোড: বলা যেতে পারে হাওড়া স্টেশন এবং শিয়ালদহ স্টেশনের সংযোগকারী রাস্তা। হাওড়া ব্রিজের পূর্ব প্রান্ত থেকে প্রায় সরলরেখায় পশ্চিমমুখো গিয়ে শেষ হয়েছে শিয়ালদহ স্টেশনে। এই রাস্তা নির্মাণের আগে এর একাংশে সেন্ট্রাল রোড নামে একটি রাস্তা অবস্থান করত। কিন্তু এই রাস্তা নির্মাণ সম্পূর্ণ হওয়ার পর, ১৮৯২ সালে এটি পরিচিত হয় পুরসভার চেয়ারম্যান স্যর লেল্যান্ড হ্যারিসনের নামে। ১৯৬৬ সালে এই রাস্তার নতুন নামকরণ হয় মহাত্মা গান্ধি রোড।
৪. মির্জাপুর: কলুটোলা স্ট্রিটের পূর্বদিক থেকে গোলদিঘি বা কলেজ স্কোয়ার ঘেঁষে আমহার্স্ট স্ট্রিট এবং হ্যারিসন রোড অতিক্রম করে যে রাস্তাটি সার্কুলার রোড বা আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোডে পড়েছে তারই নাম ছিল মীর্জাপুর স্ট্রিট। বর্তমান নাম সূর্য সেন স্ট্রিট। এই রাস্তার লাগোয়া কিছু অঞ্চল মীর্জাপুর নামে পরিচিত।
৫. আমহার্স্ট স্ট্রিট : বউবাজার স্ট্রিট থেকে উত্তরমুখো এই রাস্তার নাম ছিল আর্মস হাউস স্ট্রিট। পরে লর্ড আমহার্স্টের নামে এর নামকরণ করা হয়। ১৯৬৮-র ফেব্রুয়ারি মাস থেকে এই রাস্তার নাম হয়েছে রাজা রামমোহন সরণি।
৬. সাকি : ইংরেজ সাহিত্যিক হেক্টর হিউ মনরো (১৮৭৯-১৯১৬)। ছদ্মনাম সাকি (Saki)। এডোয়ার্ডিয়ান ইংল্যান্ডের সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতি ব্যঙ্গ ফুটে উঠতো তাঁর লেখা। ছোটোগল্প রচনায় অসম্ভব দক্ষ সার্কি-র লেখার তুলনা হয় ও’হেনরি বা ডরোথি পার্কারের লেখা গল্পের সঙ্গে।
৭. ডায়মন্ডহারবার রোড : কলকাতার খিদিরপুর অঞ্চল থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরবর্তী ডায়মন্ডহারবার পর্যন্ত বিস্তৃত রাজপথ মোমিনপুর, ইকবালপুর, তারাতলা, বেহালা, জোকা, পৈলান, আমতলা, শিরাকোল, উস্তি, সরিষা প্রভৃতি অঞ্চলের ওপর দিয়ে ডায়মন্ডহাবড়ায় পৌঁছেছে। বর্তমানে এই রাস্তা হাওড়া জেলার কোনা অঞ্চলে দুই ও ছয় নং জাতীয় সড়কের সংযোগস্থল থেকে শুরু হয়ে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বকখালি পর্যন্ত বিস্তৃত ১১৭ নং ন্যাশনাল হাইওয়ের অংশভুক্ত।
৮. চেন ঘড়ি : সোনার বা অন্য ধাতুর তৈরি চেনের প্রান্তে বাঁধা পকেট ঘড়ি। ঘড়ি পকেটে রেখে চেন বাইরে ঝুলিয়ে রেখে প্রদর্শনের প্রচলন ছিল। ইংল্যান্ডের রানি ভিক্টোরিয়ার স্বামী প্রিন্স অ্যালবার্ট এই ধরনের ঘড়ি ব্যবহার করতেন। তাই এর পরিচিতি ছিল অ্যালবার্ট চেন নামে।