টিকটিকি
মৃদু শব্দ হচ্ছে ফটোকপি মেশিনটাতে। একটা লম্বা আলো ডান থেকে বামে বসরে যাচ্ছে। আর মেশিনের নিচের বাক্সে খস খস করে সাদা পাতা বের হয়ে আসছে। ফটোকপি মেশিনটার এক টানা মৃদু শব্দে নাসরিন আনমনা হয়ে দাঁড়িয়ে বেশ অনেকক্ষণ। দৃষ্টি মেঝের দিকে, কিন্তু সেই দৃষ্টি শূন্য।
“আমি চাই তুমি টিকটিকিটাকে খুঁজে বের কর নাসরিন,”- কথাটা বারবার নাসরিনের কানে বাজছে। তাকে এত বড় দায়িত্ব মেজর জেনারেল এর আগে কখনও দেননি। মনে মনে অনেক গর্ব বোধ করেছিল নাসরিন। কিন্তু পুরো দুইদিন কেটে যাওয়ার পরেও কাজের কোন অগ্রগতি নেই নাসরিনের। নাসরিন কিছুই করতে পারেনি এখন পর্যন্ত।
সব এজেন্ট আর কর্মচারীদের ফাইল সে ঘেঁটেছে এই দুইদিনে। কাউকে এতটুকু সন্দেহ করতে পারেনি। সবাই খুব বিশ্বস্ত আর অফিসে নিয়মিত। কে কখন অফিস থেকে বের হচ্ছে আর কে ঢুকছে সেটার রেকর্ডও চেক করেছে নাসরিন। সেখানেও সে কারও দিকে আঙুল তুলতে পারেনি। শেষমেষ মনে সন্দেহ তৈরি হওয়া শুরু হয়েছে নাসরিনের, অফিসের বাইরের কেউ তথ্য পাচার করছে না তো? না না, তা কি করে হয়? মেজর জেনারেল যখন অনুমান করেছেন অফিসের ভেতরের কেউ, তখন অবশ্যই অফিসের ভেতরের কেউই হবে।
“নাসরিন! সাদা কাগজ ফটোকপি করছেন নাকি?” আবিরের কণ্ঠ শুনে নাসরিন চমকে উঠল। মুশফিকুর রহমান আবির। MRAU এর আইটি ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র সিকিউরিটি ইনচার্জ। সোজা কথায়, ‘হ্যাকার’। হোয়াইট হ্যাট হ্যাকার। মাথাভর্তি কোঁকড়া চুল। চোখে রিমলেস চশমা। আর ঠোঁটে লেগে থাকা মুচকি হাসি। আজ তিন বছর সে MRAU এর সাথে জড়িত।
আসলেই সাদা কাগজ ফটোকপি হচ্ছে। যে ফাইলটা ফটোকপি করবে সেটা না দিয়েই নাসরিন কমান্ড দিয়ে দিয়েছে। একা একাই সাদা কাগজ ফটোকপি হয়ে যাচ্ছে।”ওহ হো। ধুর” নাসরিন কিছুটা লজ্জা পেয়েই কথাটা বলল। তাড়াতাড়ি ফটোকপি মেশিনটা বন্ধ করে নিচু হয়ে সাদা কাগজগুলো গোছাতে শুরু করল।
“কার কথা ভাবছিলেন বলেন তো, হ্যাঁ?” আবির মুচকি হেসে বলল। তার হাতে ধরা কফির মগ থেকে ধোঁয়া উঠছে। নাসরিন নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “আপনি অনেক দিন বাঁচবেন বুঝছেন?”
“কেন কেন?” আবির কফির মগে চুমুক দিতে দিতে বলল।
“আপনার কথাই ভাবছিলাম কিনা, এইজন্য। আপনার কথা ভাবছিলাম আর আপনি চলে আসলেন, তাই আপনি অনেকদিন বাঁচবেন।” নাসরিন বলল।
আবির মুচকি হাসল। মেয়েটাকে যতটা বোকা ভাবা হয় ততটা বোকা না। নাসরিন মোটা ফ্রেমের ওপর দিয়ে তাকিয়ে বলল, “আপনাকে মনে হয় আমি একটা কাজ দিয়েছিলাম। না?”
আবির বলল, “হ্যাঁ। ওই কাজটার ব্যাপারেই কথা বলতে আসলাম।”
“হয়েছে কাজটা?”
“হ্যাঁ।”
“চলেন দেখছি।”
সকালবেলা। MRAU এর সদর দপ্তর প্রায় ফাঁকা। প্রায় সব এজেন্টই বাইরে। বাকিরা আসবে আস্তে আস্তে। প্রায়শ্চিত্ত প্রকল্প কেলেঙ্কারির পরে অফিস যেন ঝিমিয়ে পড়েছে। ফিরোজের হঠাৎ করে অফিসে না আসা আজ নতুন না। কিন্তু সবাই আঁচ করতে পেরেছে, সবকিছু ঠিক নেই। কিছু একটা গোলমাল হয়েছে।
আবির তার ডেস্কে বসতে বসতে বলল, “কফি খাবেন?” নাসরিন মাথা নাড়লো। তার দৃষ্টি আবিরের ডেস্কের ওপরে রাখা তিনটা মনিটরের ওপরে নিবদ্ধ। কালো দুটো স্ক্রিনে অনেকগুলো ছোট ছোট লেখা। আর একটা স্ক্রিনের ব্যাকগ্রাউন্ডে একটা টাইপরাইটারের ছবি।
আবির একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে কিবোর্ডে খড়খড় করে কি সব লিখতে লাগল। নাসরিন চেয়ারটা টেনে বসল। আবির বলল, “আপনার কথামত আমি অনেকভাবে দেখার চেষ্টা করেছি কেউ আমাদের সার্ভারে হ্যাক করার চেষ্টা করেছে কিনা। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ আমাদের সার্ভারে ঢোকার চেষ্টা পর্যন্ত করেনি।”
“আপনি নিশ্চিত?” নাসরিন বলল।
“হ্যাঁ। যদিও আমি আমাদের মেইন সার্ভার কখনও অনিরাপদ অবস্থায় রাখি না, তারপরেও আপনার কথামত আমি একটা মিরর সার্ভার বানাই।”
“মানে?”
“মানে আমাদের সার্ভারের মত দেখতে হুবহু আরেকটা সার্ভার। সেই সার্ভারের এক্সেস কোড আমি কিছুটা সহজ করে দেই যাতে কেউ ইচ্ছা করলেই সার্ভারটা হ্যাক করতে পারে।”“
“মানে একটা ডামি সার্ভার? এই তো? ‘
“একজাক্টলি।
“ফলাফল?”
“ফলাফল হল, কেউ সেই সার্ভারটাও হ্যাক করার চেষ্টা করেনি।”
নাসরিন আশা করেছিল কেউ না কেউ তো চুরি করে সার্ভারে ঢোকার চেষ্টা করবে। এমন কাউকে তো পাওয়া যাবে যাকে দিয়ে সে তদন্ত শুরু করতে পারে। কিন্তু এখন তো সমস্যা আরও জটিল হয়ে গেল। কাউকেই সন্দেহ করা যাচ্ছে না। তাহলে তথ্য পাচার হচ্ছে কিভাবে?
আবির একদৃষ্টিতে নাসরিনের মুখের দিকে তাকিয়েছিল। নাসরিন আবিরের দিকে তাকাতেই আবির চমকে উঠল। ইতস্তত বোধ করে নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বলল, “ইয়ে আসলে, মানে, আমি কি জানতে পারি আপনি হঠাৎ এইটা দেখতে কেন বললেন?”
মেজর জেনারেল কাউকে এই ব্যাপারে কিছু বলতে নিষেধ করে দিয়েছেন। নাসরিন বলল, “এমনি।”
বুকের সব সাহস একসাথে করে আবির বলল, “কাল ফ্রি আছেন? চলেন ডিনার করি।”
নাসরিন কোন উত্তর দিল না। তার দুই কোঁচকানো ভ্রুতে ঢাকা চোখে গভীর দুঃশ্চিন্তা।
আবির ভেতরে ভেতরে কিছুটা ঘাবড়ে গেল। নাসরিন রাগটাগ করল নাকি আবার? আবির সরি বলতে যাচ্ছিলো।
কিন্তু নাসরিন উঠে চলে গেল। তাকে বের করতেই হবে তথ্য কে পাচার করছে এবং কিভাবে পাচার করছে। আজ প্রায়শ্চিত্ত প্রকল্পের তথ্য পাচার হয়েছে, কাল অন্য কোন তথ্য পাচার হবে না তার নিশ্চয়তা কি?
ডাটাবেজ রুমে গিয়ে এলোমেলো ফাইলগুলো গোছাতে শুরু করল নাসরিন। এই রুমে মেজর জেনারেলের অনুমতি ছাড়া কারও ঢোকা নিষেধ। কাল মেজর রঞ্জন প্রায়শ্চিত্ত প্রকল্পের প্রায় সবগুলো ফাইল আর সিসি টিভি ফুটেজের হার্ডড্রাইভ নিয়ে গিয়েছে। ফাইলগুলো গোছাতে গিয়ে নাসরিনের মনে হল, রঞ্জনের পরেও কেউ একজন এসেছিল এই রুমে। ফাইলগুলোর এলোমেলো হওয়া দেখে চট করে বোঝা যাবে না। কিন্তু একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে যে, কেউ প্রত্যেকেটা ফাইল খুলে খুলে দেখেছে।
নাসরিনের ভুজোড়া কুঁচকে গেল। কেউ তো আছেই, যে এই প্রকল্পের আরও তথ্য জানতে চাচ্ছে। হঠাৎ তার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। ডাটাবেইজ রুমে তালা দিয়ে আবিরের ডেস্কে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “আপনি কি করেছিলেন বললেন?”
আবির কিবোর্ডে খটখট করে কি যেন লিখছিল। বলল, “কি করেছিলাম বলতে?”
“আরে ওই যে, মিরর সার্ভার না কি যেন করেছিলেন বললেন না?” নাসরিন বলল।
“ও হ্যাঁ। আমি একটা মিরর সার্ভার বানিয়েছিলাম। কেন বলেন তো?” নাসরিনের চোখগুলো এলইডি বাল্বের মতো জ্বলে উঠল। নাসরিন কোন উত্তর না দিয়েই দৌড়ে ডাটাবেজ রুমে চলে গেল।
এক ঘণ্টার ভেতরে একটা ফাইল বানিয়ে ফেলল নাসরিন। ভেতরে প্রায়শ্চিত্ত প্রকল্পের হেডিং দিয়ে আবোলতাবোল কিছু তথ্য দিয়ে অনেকগুলো রিপোর্ট বানালো। তারপর সেগুলো ফাইলের ভেতরে ভরে ফাইলের ওপরে লিখল, “টপ সিক্রেটঃ প্রায়শ্চিত্ত প্রকল্প।”
ফাইলটা একেবারে ওপরের একটা লকারে ঢুকিয়ে রাখল নাসরিন। এখন শুধু শিকারের অপেক্ষা।
“পরশু অফিস শেষে, আচ্ছা?” নাসরিন বলল।
আবির বলল, “কী?”
“ডিনার।”