টিউলিপ ফুল
কার্ডিফে আমরা বিশ-বাইশ দিন ছিলাম। নাকি তারও বেশি। এতকাল পর ঠিক মনেও করতে পারছি না। আমাদের জাহাজ তো কার্ডিফ বন্দরেই ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মাল খালাস করার জন্য জাহাজ ছিল ড্রাইভে আর আমরা পোর্টের কাছাকাছি লম্বা একটা টিনের চালায় উঠে গেছিলাম। তিন-চারদিন ছিলাম।
না! বোধহয় আরও বেশি।
স্মৃতি ধূসর হয়ে আসছে। ঠিক মনে করতে পারছি না। অস্বস্তি হচ্ছে ভেবে, ড্রাই ডক করাতে কতদিন সময় লাগার কথা। সাতদিন, দশদিন, না দু-দিনেই শেষ করা যায় কাজটা।
অবশ্য তিন দশক আগে একরকম, এখন অন্যরকম। আমি ছিলাম কয়লা জাহাজের নাবিক। জাহাজের তিনটে বয়লার হাইমাই করে সমুদ্রে রাক্ষসের মতো কয়লা গিলত। এখনতো শুনছি, কয়লায় আর জাহাজই চলে না। হয় মোটর ভেসেল, নয় ডিজেলে চলে।
আমাদের সময় মোটর ভেসেলে নাবিকের কাজ পাওয়াটা সৌভাগ্যের প্রতীক ছিল।
আর আমার তো ছেঁড়া কপাল। পড়বি তো পড়বি এমন জাহাজে, যার সব কিছু লরঝরে বোট-ডেকে উঠতে কতবার যে রেলিঙ খসে পড়েছে। ডেরিক ভেঙে পড়েছে। ইনজিন-রুম চিপিং করতে করতে হয়রান হয়ে গেছি। কখনও বালকেভে চিপিং করার সময় দেখি ফুটো। সমুদ্রের নীলজল দেখা যায়। দৌড়ে উঠে গেছি ইঞ্জিন রুম থেকে। সারেঙকে খবর দিয়েছি। তিনি ছুটে গেছেন মেজমিস্ত্রি লেসলির কেবিনে। মেজমিস্ত্রি তড়াক করে লাফিয়ে নেমে এসেছেন। অন্ধকারে টর্চ মেরে দেখে আবার দু-লাফে সিঁড়ি ডিঙিয়ে সোজা বড়োমিস্ত্রির কাছে। বড়োমিস্ত্রি কাপ্তানের ঘরে। কাপ্তান ইনজিন-রুমে নামছে, নাবিকেরা জড় হয়েছে টুইন-ডেকে। আতঙ্কে সবার মুখ কাল। কারণ ফুটো দিয়ে জল ঢুকে যেতেই পারে।
কশপ, ইনজিন-সারেঙ আর লেসলি তিনজনে মিলে কোনোরকমে জোড়াতালি দিয়ে বলে গেলেন নো চিপিং। সাদা খড়ি দিয়ে দাগ কেটে দিলেন। জাহাজ বন্দরে না ভেড়া পর্যন্ত চিপিং বন্ধ। চকখড়ির দাগ দেওয়া জাহাজটার দিকে যেতেও তখন ভয় করত। জং ধরে ভিতরে খেয়ে গেছে। বালকেভের প্লেট খুলে আবার লাগানো এবং আমার যতদূর মনে আছে ড্রাই ডকের সময়ই কাজটা সেরে ফেলা হয়েছিল।
দিনক্ষণের হিসাব দূরে থাকুক, রাস্তার নাম, বাড়ির নাম, ক্যাসেলের নাম কিছুই মনে নেই। মনে রাখার বাসনাও ছিল না। একজন অভাবী তরুণের কাছে জীবন তখন ছিল ভারি ক্ষুধার্ত।
সুতরাং কতদিন ছিলাম কার্ডিভ সঠিক বলতে পারব না। আমাদের ভাঙা জাহাজের দুর্গতি দেখলে আমার চোখেই জল চলে আসত। একবার তো পোর্ট মেলবোর্নে টানা তিন মাস। বড়ো বড়ো অক্সিজেন সিলিন্ডার, দিনরাত হাতুড়ির ঘা, খোলের প্লেট কেটে নতুন প্লেট বসানো, রিপিট মারা কত না হঠকারির তাণ্ডব চলত জাহাজটাতে। কেবল দেখতাম খুলে নেওয়া হচ্ছে, কেবল দেখতাম ঘেঁড়া কাথার ওপর সেলাই ফোঁড়াই হচ্ছে। ক্রম বাংকারে মেরামত, বয়লার-চক তুলে নতুন চক বসানো, হুড়মুড় করে কিনার থেকে মিস্ত্রিরা শকুনের মতো খাবলে খুবলে খাচ্ছে জাহাজটাকে। টানা তিনমাস, না আরও বেশি! না তাও মনে নেই।
এখন আর দিনক্ষণের হিসাব মাথায় নেই। শুধু কিছু ঘটনা, কিছু মুখ এই অপরাহ্ন বেলায় মনে পড়ে কিংবা কোনো দৃশ্য। বড়ো একঘেয়ে সমুদ্রযাত্রা। জাহাজে উঠে এটা আরও বেশি টের পেয়েছিলাম।
যেমন ড্রাই ডকের সময় ঘরে বসে গল্পগুজব, বিকেলে বেড়ানো—তখন তো জাহাজিদের হাতে কোনও কাজ থাকে না। খাও দাও ফুর্তি করো। আমার কপালে ফুর্তি বিষয়টা ছিল একটু অন্যরকমের। যে পারিবারিক পরিমণ্ডলে মানুষ তাতে শত হঠকারিতা সত্ত্বেও কোনো নারীর ঘরে রাত কাটানো দুঃস্বপ্নের শামিল।
অথচ ইচ্ছে করত। দুরারোগ্য ব্যাধির আতঙ্ক ছিল তীব্র। যে যার মতো বের হয়ে গেলে আমি কার্ডিফ-ক্যাসেলের পাশ দিয়ে হাঁটতাম। সারা বিকেল, কখনো সন্ধ্যা হয়ে যেত, কত উঁচু পাঁচিল পাথরের মনে হয় গ্রানাইট পাথরে তৈরি প্রাচীন কোনো পুরাতত্ত্ব আমাকে ধাওয়া করত। ফাঁক পেলেই পাঁচিলের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতাম। কোনো দোকানে ঢুকে টুকিটাকি জিনিস কিনতাম। কাউন্টারে কোনও যুবতী থাকলে তার সঙ্গে দু-দণ্ড কথা বলার জন্য বসে থাকতাম—কখন তার হাত খালি হবে। অপ্রয়োজনে ফলের দোকানে ঢুকে ফল কিনতাম-কারণ তরুণী আমারই বয়সী। সে বুঝত কি না জানি না, সে আমাকে দেখলেই হাই করে ডাকত।
একজন গরিব বামুনের ছেলের পক্ষে এটা ছিল বিপজ্জনক খেলা। তবু মনে হত যাই। বসি, তার ব্যস্ততা দেখি। কথা বলুক না বলুক, কাউন্টারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকারও স্বভাব ছিল আমার। অগত্যা শেষ বেলায় কিছু কেনা কাটাসে ভারি যত্নের সঙ্গে দুটো আপেল দেবার সময় বলত, গুড-নাইট সেলর।
অথবা কোনো অপরাহ্ন বসে থাকতাম, বন্দরের লাগায়ো পাহাড়ি উপত্যকায়। বসে থাকলে, অনেক জাহাজ এবং দূরের নীল সমুদ্র চোখে ভেসে উঠত। নৌবাহিনীর জাহাজ দেখতে পেতাম, ঘোরাফেরা করছে। আর রংবেরঙের হাজার হাজার পাখির ওড়াউড়ি। কিচির মিচির শব্দ, কখনো রাত হয়ে যেত। সমুদ্রে চাঁদ উঠত। নক্ষত্ররা জেগে থাকত মাথায় উপরে। কখনো বেশ রাত হয়ে যেত ফিরতে। ইঞ্জিন সারেঙ ধমক দিতেন, ব্যাটারে কোনখানে গ্যাছিলা! এত রাইত হইল ফিরতে। মন্দ জায়গায় যাও নাইত!
আমি হাসতাম। পিতৃতুল্য তিনি। একদিন তো এনজিন-ভাণ্ডারির উপর খাপ্পা। বাঁধাকপিতে বিটের টুকরো ডুমো ডুমো করে কেন দিয়েছে। বনার্জি খাইব কী দিয়া! যাও মিঞা! ডাল আলুভাজা দিয়া খাইব! তুমি কি চাও পোলাডা না খাইয়া মরুক। তুমি খাইতে পারবা রোজ রোজ।
আমরা মাত্র পাঁচ-সাতজন হিন্দু জাহাজি। বিফ খাই না। সপ্তাহে দু-দিন মটন রেশনে থাকে। বাদবাকি দিনগুলি বিফ। আমার হিন্দু সতীর্থরা পাঁচ-সাত সফর দেওয়া নাবিক। তাদের আটকায় না। আমার আটকায় কারণ এটাই আমার প্রথম সমুদ্র সফর।
আসলে আমি কেন এত একা ছিলাম, এবং নির্জনতা পছন্দ করতাম এখন বুঝি। হইচই ধাতে একদম নেই। ভালো আড্ডা দিতে পারি না। সংকোচ, এই বুঝি ধরা পড়ে গেলাম। তবু মানুষের তো কিছু চাই। সমুদ্রে আমার দিনরাত ছিল একটাই ভাবনা, আবার দেশে কবে ফিরে যাব। ফিরতে পারব কিনা, এও ছিল ভয়। তাপ্পি মারা জাহাজে উঠেছি, দৈব দুর্বিপাক যেন হাঙরের মতো সবসময় ঘোরাফেরা করত। ক্রস বাংকারে কয়লা টানছি, এক চাকা হুইলের গাড়িতে কয়লা ভরছি, ধুলো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন, শ্বাস নিতে কষ্ট-বারবার বোঁট-ডেকে উঠে বুক ভরে শ্বাস নিতাম। সমুদ্র দেখতাম—বড়ো নিস্তরঙ্গ। জাহাজ যাচ্ছে, জলকেটে প্রপেলার জাহাজের গতি তৈরি করছে। রেলিঙে ঝুঁকে দাঁড়াতে ভয় পেতাম। পড়ে গেলে প্রপেলার আমাকে ছিন্নভিন্ন করে দেবে। মাংসের টুকরো এবং রক্তের ঘ্রাণ পেয়ে গভীর সমুদ্র থেকে উঠে আসবে হাঙরের ঝাঁক। তাদের কোনোটার পেটে আমার হাত, আমার পা, কিংবা মুণ্ডু। আমি তাদের পেটের বাসিন্দা হয়ে গেছি এমনও মনে হত কখনও। রেলিঙে ভর করে দাঁড়াতে ভয় করত।
দেশে ফেরার পর বন্ধুদের একটাই প্রশ্ন, বন্দরে নারীসঙ্গ করেছি কি না।
আমি হাসতাম।
বলতো লাভ নেই। ইচ্ছে ছিল, পারিনি।
আর বললে, বিশ্বাসই বা করবে কেন। জাহাজে সফর করতে বের হয়ে কোনো নারী সংসর্গ হয়নি, এটা যেন বন্ধুদের বিশ্বাসের বাইরে। কী করে বলি, ইমানুল্লা বলে একজন মাথার ওপর ছিলেন জাহাজে। জাহাজে ফিরতে দেরি হলে গ্যাংওয়েতে পায়চারি করতেন। দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়তেন। আমি ফিরে এলে তার প্রশ্ন, কই গ্যাছিলি। এত রাত করলি!
আর বল না চাচা, সামোয়ার পিকনিক গার্ডেনে চুপচাপ বসেছিলাম। কী করে বোঝাই ডাঙা মানুষের কত প্রিয়। গাছপালা, পাখি এবং সুন্দরী বালিকার মুখ আমাকে টানে। জাহাজে ফিরতে ইচ্ছে হয় না। ফিরলেইতো রং বার্নিশের গন্ধ। চিফ কুকের গাফিলতিতে মাংসপোড়ার গন্ধ। আমার যে ওক উঠে আসে।
এমন কথায় তিনি কেন যে ক্ষেপে যেতেন বুঝি না। প্রায় তেড়ে মারতে আসার মতো!
কেন মরতে আইছিলা জাহাজে। কেডা কইছিল আইতে ভালো লাগব ক্যান! কার ভালো লাগে। তাই বইলা, এত রাতে ফিরবি। চিন্তা হয় না!
আচ্ছা চাচা অযথা রাগ করছ কেন বলত!
কই গেলি ক। আমি ছাড়ম না। জাহান্নামে যাইতে চাস। কণ্ঠ তুই। আমি কেবল ঘর-বার হইতাছি। রাস্তাঘাট ভালো না। তর বুদ্ধি সুদ্ধি কবে হইব। কিছু হইলে …
কী হবে!
কী হয় না জাহাজে! কত দেখলাম, ঘিলু চিবাইয়া খায়। রাস্তা খুঁইজা পায় না। পরি হুরির দেশ—মাথা ঠিক রাখন সোজা কথা! জাহাজ থাইকা যদি পালানোর চেষ্টা করস পুলিশ দিয়া ধইরা আনমু! আমার নাম ইমানুল্লা। আল্লার বান্দা। তারে ছাড়া কারে ডরাই ক!
ঠিক আছে, মাথা গরম করবেন না। আমি বের হচ্ছি না। কি খুশি!
বাইর হইতে বারণ করছি। মন-মেজাজ বলে কথা! তা ঘুইরা ফিরা দেখবি। ফাঁইসা যাবি না।
জাহাজে দুর্ঘটনার শেষ থাকে না। ওই তো পাশের জেটিতে কে গ্যাংওয়ের সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে জলে ডুবে গেল। নেশা করে উঠতে গিয়ে পা হড়কে গেছে। আমাদের জাহাজ থেকে দুজন বেপাত্তা। আসলে জাহাজ বিলাতে এলেই অনেকে পালায়। আমি না আবার কিছু করে বসি।
এই বনার্জি শোন।
কাছে গেলে বললেন, বড়টিভাল তরে কু-পরামর্শ দেয়!
কুপরামর্শ অবশ্য দেয়। বড়োটিন্ডাল অবশ্য ভাবে এটা তার সৎ পরামর্শ। বড়টিল্ডালের সঙ্গে দেখা হলেই এক কথা, দেশে ফিরা করবাড়া কী। বার্সিগ্রামে আমার খালাত ভাই আছে, তার কাছে চইলা যাও। সে হিল্লা কইরা দিব। লেখাপড়া জানা পোলা তুমি, একবার যখন আইসা পড়ছ ফিরা যাওন ঠিক না। বার্সিগ্রাম যে আসলে ব্লিসিংহাম পরে জেনেছিলাম।
ড্রাই-ডকের সময় বড়োটিন্ডাল দু-দিনের ছুটি নিয়ে বার্সিগ্রামে তার মেমান বাড়িতে ঘুরে এসেছে। মেমান নিজেও এসেছিলেন। কী একটা রেস্তোরাঁর মালিক। বিবি সঙ্গে। মেমসাব। কন্যা সঙ্গে মেমসাব। টিল্ডাল সাব তাঁর বালিকা ভাইঝিটির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবার সময় বলেছিলেন, বামুনের বেটার দশা দ্যাখ। সে তো বাংলা বোঝে না। সে আমার দিকে শুধু তাকিয়েছিল—তার অপরূপ লাবণ্য, এবং কাল চুল, গভীর নীল চোখ কোনও মায়াবী দ্বীপের কথা মনে করিয়ে দেয়। সারা দিন সে আমাকে নিয়েই শহরে ঘুরেছে। কেনাকাটা করেছে। কখনই মনে হয়নি আমি একা। স্টেশনে তাকে তুলে দিতে গিয়ে মনটা এত খারাপ হয়ে গেছিল—কী বলব—যেন সে আমাকে ইশারায় থেকে যাবার আমন্ত্রণ জানিয়ে গেছে।
ওর কথা আমার মনে হয়।
সে পরেছিল সাদা রঙের ভয়েলের স্কার্ট। লালরঙের জ্যাকেট। উরু পর্যন্ত নাইলনের মোজায় পরম স্নিগ্ধতা বিরাজ করছিল। আশ্চর্য ঘ্রাণ শরীরে। বিদেশি পারফিউমের এমন মৃদু সৌরভ এর আগে কখনো টের পাইনি।
ট্রেনটা চলে যাবার পরও আমি স্টেশনে চুপচাপ বসেছিলাম। হঠাৎ আমার মা র দু-চোখ কোথা থেকে যেন উঁকি দিয়ে গেল। চারপাশে ভাই, বোনেরা দাঁড়িয়ে আছে। ডাকছে—দাদারে ফিরবি না। বসেই থাকবি।
সম্বিত ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে একটা ঝাঁকুনি খেলাম। দেখি সারেঙ সাব পেছনে দাঁড়িয়ে।
বললেন, মন খারাপ!
না না।
ওঠ। চল। মন খারাপ করিস না। দেখবি দেখতে দেখতে দিন কাইটা যাইব।
সেই থেকে তিনি সতর্ক হয়ে গেলেন। বড়োটিন্ডালের সঙ্গে তাঁর অসাক্ষাতে কথা বললেই ক্ষেপে যান তিনি।
সম্ভবত আমি কার্ডিফে গেছিলাম জুন-জুলাইয়ে।
দু-পাঁচদিন বেশ রোদ, হালকা মেজাজ মানুষের—সুন্দর মনে হয়েছে মানুষের ঘরবাড়ি। ঘোরাঘুরিও মন্দ চলছিল না। তারপর টানা বিশ-বাইশ দিন সূর্যের মুখ দেখাই গেল না। প্যাঁচপ্যাচে বৃষ্টি। টিন্ডাল ডাকলেই টের পাই সারেঙ সাব একবার ঠিক উঁকি দিয়ে গেছেন।
টিল্ডাল বলেছিল, কি রে যাবি? তিন চার মাস পুলিশের চোখে ধুলা দিয়া থাকতে হইব। কইরা ব্যবস্থা খালাত ভাইসাব করে দিব কইছে।
যদি রোদ থাকত এবং ঝলমলে আকাশ কিংবা এত শীতের কামড় না থাকত হয়তো থেকে যেতাম। আর যখন জানতে পারলাম, সূর্যের মুখ দেখা সৌভাগ্যের সামিল, তখনই মনটা দমে গেল। চোখের উপরতো দেখছি শুধু সারাদিন ঝিরঝিরে বৃষ্টি। টানা বিশ-বাইশ দিন এমন দুঃসহ অভিজ্ঞতায় পর আর পালাবার ইচ্ছে হয়নি। বড়োটিন্ডালতো একদিন খোদ ভাইঝিকে নিয়ে ফের হাজির। জাহাজে মেয়ে উঠে এলে চাঞ্চল্য দেখা দেয়। কিন্তু বড়োটিন্ডাল গোমড়ামুখো মানুষ, বেয়াদপি একদম পছন্দ না। তাঁর ভাইঝি নাজিরা আমাদের সঙ্গে খেলল। গল্প করল, জানাল—যদি যেতে চাই, তার বাবা ব্যবস্থা করে দেবে। তার বাবার লেখা একটা চিঠিও সে আমাকে দিল। তখনই কেন যে শুনতে পাই, দাদারে বাড়ি ফিরবি না।
না আমার পালানো হয়নি।
আসলে মন্দ কপাল। ঘরমুখো মন, এই যে জাহাজে ভেসে পড়েছি শুধু একটি দুর্গত পরিবারকে রক্ষা করার জন্য। অন্তত আমার তখন এমন অবস্থা মুরুবিবর জোর নেই কলোনিতে থাকি, গরিব মানুষের ঘরে টিউশনি জোটে না, কোনোরকমে, আই এ পাস যুবক—অর্থাভাব, কিছু একটা করতে হয়।
কিছু একটা করতে হয় বলেই জাহাজে উঠে পড়। তার আগে হালিশহরে ট্রেনিং, ভদ্রা জাহাজে ট্রেনি, জাহাজে ওঠার ছাড়পত্র, সি ভি সি সংগ্রহ এতসব করার পর জাহাজ।
পাঁচ-সাত মাসও হয়নি। সেই কবে কলকাতা বন্দর থেকে জাহাজে উঠেছি। যেন কতকাল আগে, যেন কোনো পূর্বজন্মে ঘটনাটা ঘটেছে, এ জন্মে আমি নাবিক, এই অস্তিত্ব ছাড়া আর কিছু টের পাই না। আঠারো-উনিশ বছর বয়সের যুবক স্বপ্ন দেখতে ভালবাসে, সমুদ্রে ঘুরে বেড়াবে, এমন স্বপ্ন দেখতে ভালোই লাগত। জাহাজে উঠে টের পেলাম, বাড়ির কথা মনে হলেই মন খারাপ হয়ে যায়।
কলম্বো হয়ে ডারবান, কেপটাউন। মাস দুই লেগে গেছিল। এক নাগাড়ে মাসখানেক সমুদ্রে, শুধু জল আর জল-ইঞ্জিন রুম থেকে উঠে আসছি, ওয়াচ শেষ, বিধবস্ত। ঝড় সাইক্লোন, ডেকের ওপর কয়লা, জাহাজ দুলছে, তবু কয়লা টেনে নিয়ে যেতে হবে ইঞ্জিন রুমে। কখনো রক্ত বমি-নিস্তার নেই। জাহাজে মার মার কাট কাট লেগেই থাকত। সি-সিকনেস বড়োই কঠিন আপদ। সব সামলে সমুদ্রে ঘোড়সওয়ার আমি কখনই ভেঙে পড়ি না।
কেবল মাঝে মাঝে প্রশ্ন—ডাঙা কবে পাব।
ডাঙার কথা বললেই সারেঙ সাব মুখ গোমড়া করে থাকতেন। ভাঙা কী এত মধুর তিনি যেন বুঝতেই পারেন না। ডাঙা মানেতো জাহান্নামে যাওয়া। নেশা, নয় কার্নিভেলে ঘোড়া জুয়ার ঠেকে আটকে পড়া, আর রাতে পরি হুরির কজায়। তার চেয়ে যেন এই অনন্ত অসীম সমুদ্র তার কাছে খুবই পবিত্রতার কথা বলে। পাঁচ ওক্ত নামাজ তিনি সকাল আর সাঁজবেলায় সেরে নেন। সাইক্লোন থাকলে মেসরুমে মাদুর পেতে, না থাকলে ফল্কার উপর মাদুর বিছিয়ে তিনি যখন ছাড়ান, মাথায় কুরুশ কাঁটায় নকশা তোলা সাদা টুপি, পরনে লুঙ্গি, গায়ে সাদা পাঞ্জাবি এবং মুখে সাদা দাড়ি—যেন কোনও ফেরেস্তা। এই জাহাজ, এই সমুদ্র, এমনকী আরও গভীর নৈঃশব্দে ডুবে যাওয়া প্রাণীকুলের জন্য তাঁর মোনাজাত—আমাকে উদ্বুদ্ধ করে। ঈশ্বর প্রীতি হয়তো মানুষকে কোনো বড়ো জায়গায় নিয়ে যেতে পারে–কিন্তু আমি হঠকারি যুবক, না ভেবেচিন্তে জাহাজে উঠে পড়ায় তিনি খুশি না।
বুয়েন্সএয়ার্স বন্দরে জাহাজ ভেড়ার দিন তিনি আমাকে ডাকলেন। এত বেশি খবরদারি কখনও বিরক্তির কারণ হত। তিনি সোজা বলে দিলেন, জাহাজ ছেড়ে বেশি দূর যাবি না। হারিয়ে গেলে আমি কিছু জানি না।
হারাব কেন চাচা। আমাকে কী ভেবেছেন!
শোন কিছু ভাবিনি। তোর ভালোর জন্যই বলছি। কেউ তোর কথা বুঝবে না। একটা লোকও বাংলা-ইংরেজি কিছু বোঝে না!
তার মানে।
লোকগুলো ইংরেজি জানে না। হাতের ইশারায় কথা বলতে হবে। পারবি। তুইও বোবা, তারাও বোবা। ভাষা না জানলে এটা হতেই পারে।
দূর থেকেই মেঘমালা ভেসে ওঠে আকাশের গায়, বুঝি সামনেই বন্দর। প্রথমে দিগন্ত রেখায় এক টুকরো মেঘ ভেসে থাকে তারপর জাহাজ যত নিকটবর্তী হয় ধীরে মেঘ থেকে যেন বৃষ্টির ফোঁটা আলাদা হবার মতো—বোঝা যায় ঘরবাড়ি, বোঝা যায় জেটি, বোঝা যায়, জাহাজ নোঙর ফেলান আছে। প্রথমে মাস্তুল, পরে চিমনি, আরও পরে মানুষজন।
রাতের বেলাতে আলোর মালা পরে থাকে—ঢেউ ওঠে নামে, জাহাজে ওঠা-নামা করে—আমরা টুইনডেকে শুধু দাঁড়িয়ে থাকি। ওয়াচ না থাকলে, সারা সকাল, অথবা দুপুর এমনকী গভীর রাতেও উঠে যাই উপরে। সামনে ডাঙা। জাহাজিদের কাছে এর চেয়ে বড়ো সুখবর কিছু নেই।
সারাক্ষণ জাহাজের আফটার পিকে, খোলা ডেকে, নয় ফল্কার ওপর বসে থাকা, তাসের আড্ডা। কখনও, কেউ কেউ কোরান পাঠও করেন। যে যার মতো ডাঙার প্রত্যাশায় বসে থাকে।
আমারও মন আনচান করে।
জাহাজ বাঁধাছাঁদা হলে সারেঙ সাব বলেছিলেন, বসে থাকবি কেন। যা ঘুরে আয়। মন হালকা হবে।
আপনি যে বললেন, কথা বোঝে না কেউ।
বেশি দূরে যাস না। দেবনাথ বনার্জীকে নিয়ে যা। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ডাঙায় পা রাখলে জাহাজিদের আয়ু বাড়ে।
ডাঙায় পা রাখলে জাহাজিদের আয়ু বারে এটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। জাহাজ কলকাতা থেকে ছাড়ার পর কী যে ঝড়ঝঞ্ঝা, সমুদ্র উথাল-পাতাল, কলার খোলের মতো বে অফ বেঙ্গলে জাহাজের পিচিং-তারপর কী অমানুষিক কষ্ট, চারঘণ্টার ওয়াচ দিতে পাঁচ ঘণ্টা লেগে যায়, কাজ শেষ করতে পারি না—কয়লা টেনে ফেলছি ‘সুটে’, আর হড়হড় করে নেমে যাচ্ছি। জাহাজের দুলুনিতে মাথা তুলতে পারছি না। তবু ‘সুটের মুখের দিকে সতর্ক নজর। কারণ মুখ থেকে কয়লা নেমে গেলেই, স্ট্রোকহলভে হাইহাই হয়ে যায়। তিনটি বয়লার কেবল কয়লা গিলছে। স্টিম পড়ে যাচ্ছে। টন টন কয়লা পুড়িয়েও স্টিম ধরে রাখা যাচ্ছে না। ঝড়ের দরিয়ায়, আমার মতো পয়লা সফরের জাহাজির যে প্রাণান্ত হবে যেন এটা প্রথমে টের পেয়েছিলেন সারেঙ সাব।
কিছুতেই তিনি সঙ্গে নিতে রাজি না।
জাহাজ পাচ্ছিলাম না।
হাতে ‘সি ভি সি’ নিয়ে রোজ শিপিং অফিসে ‘মাস্তারে দাঁড়াচ্ছি। জাহাজ আসছে, ক্ল্যান লাইন, সিটি লাইন, বি আই কোম্পানির জাহাজ। জাহাজের সফর সেরে ফেরা জাহাজিরা নেমে যাচ্ছে। নতুন জাহাজি রিক্রুট হচ্ছে। আমিও সেই আশায় মাস্তারে দাঁড়াচ্ছি রোজ। আমার চোখ মুখ দেখছে। নলি’ দেখছে। সমুদ্র সফরের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। শরীরে বামুনের রক্ত। কিংবা শরীর শক্ত কিংবা ঋভু নয়, যে জন্যই হোক, বুড়ো কাপ্তান কিংবা যুবা চিফ ইঞ্জিনিরার কারও আমাকে পছন্দ নয়—পারবে না, ভালো করে দাঁড়ি-গোঁফ ওঠেনি ছেলের, সে আর কতটা কাজ পারবে। বমি টমি করে অসুস্থ হয়ে পালাবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে। এমনও ভাবতে পারে। যাই হোক রোজ মাস্তার দেওয়াই সার যখন, এবং মাসখানেক ধরে শিপিং অফিসে যাচ্ছি, বুড়ো মানুষটা লক্ষ করে থাকতে পারে।
তিনিই একদিন ক্যান্টিনে ডাকলেন, এই যে ব্যাডা রোজ আইসা লাভডা কি! পারবা না। জাহাজের মার মার কাট কাট সহ্য করতে পারবা না! দড়িয়ায় পানি সহ্য হইব না। কেডা তোমারে বুদ্ধি দিছে, জাহাজে যাইতে!
কী বলি, বুদ্ধিটা যে কারও নয়, বুদ্ধিটা যে আমারই এবং একজন উদ্বাস্তু পরিবার এ-দেশে এসে জলে পড়ে যাবার পর, আমিই যে একমাত্র বাবার সক্ষম পুত্র তার কাজ বসে থাকা নয়, যা হয় করে কিছু উপার্জন করা এ-সব একে একে তিনি জানতে পারলেন বলেছিলেন, করবি। জাহাজে গেলে না, পাক হয়ে যাবি। না-পাক অর্থ কী পরে বুঝেছিলাম। পাক কথার অর্থ পবিত্র, না-পাক মানে অপবিত্র।
তিনি আরও বলেছিলেন, তোর বয়সটা ভালো না।
আমি তাঁর পাশে বসে থাকতাম। জাহাজের নানাবিধ গল্প বলতেন। বলতেন তাঁরা চায় পুরুষের জাহাজি। তাঁরা বাধা দিলেন, সিটি লাইনের সারেঙ। তিনি নিজেও আমার বয়সে জাহাজে উঠে এসেছিলেন।
এবং তিনি যখন বুঝতে পারলেন, আমি নাছোরবান্দা তখন একদিন বলেই ফেললেন, ঠিক আছে, আমার জাহাজ আসছে, ওতে যাবি। বলে তিনি কিছুক্ষণ চুপচাপ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন!
তারপর কী ভেবে বলেছিলেন, জাহাজটা কয়লার জাহাজ। ধকল খুব। পারবি!
‘আমার তখন এক কথা, পারব।
‘ওয়াচে তিন টন কয়লা খায় কসবিটা।
ওয়াচ অর্থাৎ চার ঘণ্টায় তিন টন কয়লা যায়। কসবিটা কে বুঝতে অবশ্য কষ্ট হয়নি—আসলে জাহাজটাকেই তিনি কসবি হয়তো বলেছেন। কসবি কথাটা মন্দ কথা। এটাও বুঝেছিলাম। জাহাজটাকে তিনি কখনও ইলিশের বাচ্চা বলে গাল পাড়বেন। যেন জাহাজ না, একটা আস্ত শয়তানের বাচ্চা। এবং দুজন মাত্র সারেঙ আছেন, যারা এই শয়তানের বাচ্চার মেজাজ ঠান্ডা রাখতে পারে।
এমন একটা জাহাজে তিনি আমাকে নিতে অবশ্য শেষ পর্যন্ত রাজি হলেও, মুখে তার প্রায়ই দুশ্চিন্তার রেখা ফুটে উঠতে দেখতাম। জাহাজিদের ওপরওয়ালা বলতে সারেঙ। তার সুপারিশ থাকলে জাহাজ পেতে অসুবিধা হয় না। শিপিং অফিসে মাসখানেক যাতায়াত করেই তা টের পেয়েছিলাম।
যেদিন জাহাজ এল, তিনি ডেকে বললেন, ভেবে দ্যাখ, যাবি কি না! পরে দোষ দিতে পারবি না।
বললাম তো পারব। আমি নিজের ওপর কিছুতেই আস্থা হারাতে রাজি না।
তিনি আমাকে বলেছিলেন, লরঝরে জাহাজ। সারাদিন ঠায় খাটুনি। বন্দরে গেলেও রেহাই পাবি না। স্মোকবক্স পরিষ্কার করতে জান কয়লা হয়ে যাবে।
তাঁর ওপর মাঝে মাঝে তখন থেকেই আমি বিরক্ত। বড়ো বেশি ভাবনা! আমি তার কে, এমন মনে হত। এই যে তিনি বুয়েন্সএয়ার্স বন্দর ধরার আগে বললেন, যাবি। বের হবি। না বের হলে চলবে কেন! ডাঙায় নামলে জাহাজিদের আয়ু বাড়ে–হাড়ে হাড়ে এটা টের পেয়েছি জাহাজে থেকে। দিনের পর রাত, রাতের পর দিন, শুধু জল আর জল। নীল আকাশ। সমুদ্রে ঝড় থাকুক, সাইক্লোন থাকুক, ইঞ্জিন চালু রাখতেই হবে। চালু রাখতে না পারলেই মরণ। কয়লা টেনে ‘সুটে’ ফেললে ফায়ারম্যানদের কাজ শুরু। চকাচক বেলচায় কয়লা তুলে মারছে। ফার্নেসডোর খুলে দিলেই আগুনের হলকায় মুখ লাল। কয়লা মেরে, যাগ দিয়ে টেনে, কয়লা উলটেপালটে আঁচ ভোলা। এয়ারভালভ খুলে দিলে হাওয়ায় আগুন আরও তখন ঝলসে ওঠে। কেবল বেলচায় কয়লা হাকড়ানো—তিনটে বয়লার, তিনটে করে ফার্নেস বয়লারে কয়লা খাচ্ছেতো খাচ্ছেই। আর পোর্টসাইডের ক্রশ বাংকারে টানা চারঘণ্টা আমার কাজ। লম্ফ জ্বালিয়ে কোনো প্রাচীন গুহাবাসীর মতো অস্পষ্ট অন্ধকারে টানা ঘণ্টার পর ঘণ্টা কয়লা ভরছি। হুইলের গাড়িতে, সুটে এনে ফেলছি। বয়লার থেকে ছাই টেনে ফেললে, জল দিয়ে নেভাচ্ছি— অ্যাসরিজেকটারে আবার ছাই তুলে স্টোকহোলড পরিষ্কার করে দিতে হচ্ছে। ওয়াচ শেষে বিধবস্ত।
সিঁড়ি ধরে যে বোট ডেকে উঠে যাব তার পর্যন্ত ক্ষমতা থাকত না।
এবং এভাবেই বুঝেছিলাম, ইমানুল্লা সারেঙ আমার ভালো চান। কয়লা টানতে টানতে বমি করছি হড়হড় করে খবর পেয়ে জাহাজের বাংকারে তিনি ছুটে এসেছেন, দাঁড়িয়ে থেকেছেন, কখনও নুনজল এগিয়ে দিয়েছেন—নুনজল খেলে সি-সিকনেস কমে, এটা জানি, কিন্তু তিনি অন্য কাউকে ডেকে দেননি। বলেননি, ঠিক আছে, তুই যা। এনামুলকে পাঠাচ্ছি।
কোল-বয় আমরা মাত্র সাতজন।
দুজন করে আমাদের ওয়াচ।
পোর্ট-সাইডের বাংকারে মনু অর্থাৎ মৈনুদ্দিন। আসলে সে আমার ওয়াচের জুরিদার।
চারঘণ্টার ওয়াচে যতই আমি বিপাকে পড়ি না কেন, সারেঙ সাব অবিচল।
তার এক কথা, সব জাহাজে কি আমি থাকব। অভ্যাস হোক। তিনি চাইতেন, জাহাজে যখন উঠেই পড়েছি, তখন জাহাজের ধকল আমাকে মেনে নিতেই হবে।
অবশ্য জানতাম না, কার পরামর্শে মনু এসে আমার বাংকারে ঢুকে বলত, আরে বনার্জী সুট যে খালি হয়ে গেছে।
আমি তখন হয়তো ক্লান্ত। অবসন্ন। লোহার বাংকারে বেলচা মাথায় দিয়ে শুয়ে আছি। নীল জামা প্যান্ট কয়লার ভুসো কালিতে মাখামাখি। মুখ ভুসো কালিতে কয়লা খাদের মজুরের মতো। কয়লা টানা ছাড়া জীবনে যেন আর কোনো কাজ নেই আমার। এ জন্য জন্মেছি, এ জন্য বড়ো হয়েছি—ভাবলে তখন বিপন্ন বোধ করতাম। মাঝে মাঝে নিজের ওপর আস্থা হারালেই বেলচা ছুঁড়ে মারতাম কয়লার ওপর। তারপর চিৎপাত হয়ে পড়ে থাকলেই মনু এসে কয়লা টেনে দিত আমার হয়ে।
আমার খারাপ লাগত। উঠতাম। বলতাম, তুই যা। তোর ‘সুট’ কে ভরবে!
সে বলত, পয়লা সফরে পারবি কেন! পেটে তোর বিদ্যার জাহাজ, একাজ তোকে দিয়ে হয়!
এটা ঠিক জাহাজিরা প্রায় সবাই নিরক্ষর। তারা দেশে খত পাঠাবার সময় লেখাপড়া জানা আদমির খুবই কদর দেয়। দু-একজন চিঠি লেখার মতো বিদ্যা পেটে নিয়ে উঠলে, জাহাজিদের কাছে সে মাস্টার। তার প্রতি আলাদা সম্মান। আমি এ-জন্য সবার কাছেই সমাদর পেয়ে থাকি। ডেক আর এনজিন জাহাজি মিলে ষাট পঁয়ষট্টি জন জাহাজে উঠে এসেছিলাম—অনেক মুখ হারিয়ে গেছে কিন্তু বড়োটিন্ডাল, ছোটোটিন্ডাল, সারেঙ সাব কিংবা আমাদের দেবনাথ, অমিয়, হীরেনের কথা এখনও মনে করতে পারি। মনু আমার জুরিদার—তার কথাও মাঝে মাঝে ভাবি। এতদিন পর কে কোথায় জানি না। কারও খোঁজও রাখি না।
তবে ডাঙা যে জাহাজিদের পরমায়ু বাড়ায় এটা প্রথম বুঝেছিলাম, কলম্বো বন্দরে নোঙর ফেলার পর রাতের বেলায় নোঙর ফেলল, ভোর রাতে নোঙর তুলে ফেলা হল। প্রায় দশদিন এক টানা জাহাজ থেকে ডাঙার জন্য পাগল হয়ে আছি। আমরা জাহাজিরা ডাঙা দেখার জন্য সারারাত জেগেছিলাম ডেকে। একমাত্র প্রাচীন নাবিকদের কাছে ডাঙা এবং জল যেন সমান। কিন্তু যারা পাঁচ সাত কিংবা দশ সফরের জাহাজি তাদের কাছেও ডাঙা পরমায়ু বাড়ায়। তা না হলে কে সারারাত জেগে ডেকের ওপর বসে থাকে। কলম্বো থেকে জাহাজে রসদ তোলা হয়েছিল।
জাহাজ নোঙর করা, নামার সযোগ থাকলেও নিষেধ–কারণ ভোররাতে জাহাজ ছেড়ে দেবে। শুধু বন্দরের দূরবর্তী আলো এবং কখনো কোথাও লোহার পাত পড়ার শব্দ অথবা জাহাজ ছেড়ে যাবার সময় সাইরেন ছাড়া আর যা শব্দমালা টের পেয়েছি—সে শুধু সমুদ্রের জল এবং তার কল কল আওয়াজ। কিংবা কিছু সমুদ্র পাখির উড়ে যাওয়া, কখনো তারা ডানা মেলে মাস্তুলে বসে থাকলে বাড়ির জন্য মন কী যে খারাপ করত!
বুয়েন্সএয়ার্স বন্দরে ঢোকার সময় এটা আরও বেশি টের পাচ্ছি। আফ্রিকার ডারবান কেপটাউন বন্দরে স্রেফ পাঁচ দিনের বিরতি।
সেখানে পাটের গাঁট নামানো হয়েছে। ডারবান বন্দরে জাহাজ ভিড়লে ইমানুল্লা এসে আমার ফোকসালে উঁকি দিয়ে বলেছিলেন, বনাৰ্জী ওপরে আয়। কথা আছে।
তিনি কখনো তার ঘরে কাউকে ঢুকতে দিতেন না। এমনকী আমাকেও না। কেন এটা করতেন বুঝতাম না। আমাকে ওপরে ডেকে নিয়ে আফটার পিকের পেছনে গেলেন। রেলিঙে ভর করে দাঁড়ালেন।
এমনই যেন সব দৃশ্য দেখতে পাই।
তিনি বেশ গুম হয়েছিলেন। কথা বলছিলেন না। আমি বললাম, কী হল? ডাকলেন কেন?
তুই আবার ছোটোটিন্ডালের সঙ্গে মিশছিস!
মিশলে কী হয়।
না।
বড়োটিন্ডাল যে তার সুনজরে নেই, সেটা যেমন বুঝেছিলাম কার্ডিফ বন্দরে গিয়ে, তেমনি ছোটোটিন্ডালও যে তার কোপে পড়ে গেছে, সেটা বুঝেছিলাম ডারবান বন্দরেই।
তা বলবেন তো কথা বলছেন না কেন! ধুস, বুড়োর যত্ত সব বাতিক। আমি নষ্ট হয়ে না যাই এই এক ভিমরতিতে তিনি ভুগছেন! এ-জন্য মাঝে মাঝেই ক্ষেপে যেতাম।
শোন, তিনি মুখে সুপারি ফেলে বললেন, জায়গাটা ভালো না। রাতে বের হস। ছোটোটিল্ডালের ঘর আছে, এখানটায়। ওর পাল্লায় পড়ে গোল্লায় যাস না।
ঠিক আছে যাব না।
না তোকে যেতে বারণ করছি না। বন্দরের কাছাকাছি থাকবি। ওদিকটায় মাছ ধরতে পারিস। আমার ছিপ নিয়ে যা, বসে না থেকে দু-চারটে সেকরল মাছ ধরে আনলে জাহাজে বেশ ভোজ লাগান যাবে।
আসলে বুঝি, তিনি আমাকে মাছের নেশায় ফেলে দিয়ে ডারবান বন্দরটা পার করে নিয়ে যেতে চান।
এটা আমার মনে আছে জাহাজের খাওয়া বড়ো একঘেয়ে ছিল।
সকালে চর্বি ভাজা রুটি।
দুপুরে ডাল গোস্ত ভাত।
বিকেলে চর্বি ভাজা রুটি।
রাতে আবার ডাল, আলুভাজা, গোস্ত।
এই ছিল নিত্যদিনের খাবার। বরফঘরের বাসি পচা মাংস—বিস্বাদ, কিন্তু এমন যমের খিদে পেত যে শুধু ডাল দিয়েই সব ভাত তোলা হয়ে যেত।
কাজেই জাহাজিরা বন্দর পেলে, মাছ শিকারেও যায়। যেমন ইমানুল্লা সাব জাহাজে ওঠার সময় দুটো আলাদা কাঠের পেটি তুলে এনেছিলেন। একটা পেটিতে জাল তৈরি করার সুতো, আর একটা পেটিতে কয়েক রকমের ছিপ। ছিপগুলো ছিল, মাছ ধরার জন্য এবং তিনি বন্দরে গেলেই ছিপ ফেলে জাহাজের আফটার পিকে বসে থাকতেন। কখনো ছোটো ছিপ। কোন বন্দরে, কী ছিপ ফেললে, কোন মাছ পাওয়া যায় তিনি তা এত জানতেন যে আমরা অবাক হয়ে যেতাম।
জাহাজে ওঠার পর প্রথম ডারবান বন্দরে টের পেলাম, তিনি আমাকে হুকুম করছেন, বনার্জী, যা বাটলারের কাছ থাইকা, লিস্টি মিলাইয়া জিনিসগুলি নিয়া আয়।
বাটলার হাসান খুবই সেয়ানা লোক সে জানে, ডেক সারেঙ আর এনজিন সারেঙকে হাতে রাখতে পারলে, জাহাজিদের রেশন মারতে পারবে। গোস্ত ওজনে চুরি করতে পারবে, চিনি, টোবাকো সব চুরি করা সম্ভব শুধু দুই সারেঙ হাতে থাকলে। এ-জন্য ইনামও দেয়, যেমন জাহাদের অফিসারদের রেশনেই শুধু ডিম আছে—ডিম নয় শুধু, এক এলাহি ব্যবস্থা খাদ্য তালিকার। ইংলিশ মেনু। সকালে ওরা ব্রেকফাস্ট করার পর প্রায়ই দেখতাম পকেটে আপেল নিয়ে বের হয়ে আসত ডেকে। কাজ করত আর আপেলে কামড় বসাত।
তাদের খাওয়া দাওয়ার বহর দেখলে আমাদের জিভে জল আসত। চিফ কুক, সেকেন্ড কুক আট দশ জন অফিসারের খাদ্য তালিকা মেনু মাফিক তৈরি করতে গলদঘর্ম। আর আমাদের ইঞ্জিন ভান্ডারি এক হাতে সব সামলায়।
মনে আছে অফিসারদের মধ্যে একজনও বাঙালি ছিলেন না। এমনকী ভারতীয়ও নয়। ব্যাংক লাইনের জাহাজ অফিসাররা হোম থেকে উঠতেন। পরে জেনেছিলাম, অধিকাংশই ওয়েলসের বাসিন্দা।
অফিসারদের হরেকরকমের খাদ্য তালিকার বহর এবং আমাদের একঘেয়ে খাবার নানা কারণে জাহাজিদের মনে ঈর্ষার উদ্রেক করত। সারেঙই পারতেন সব সামলাতে। এবং এজন্য সারেঙকে হাতে রাখার নৈতিক দায়িত্ব বাটলারের। দুই সারেঙ অফিসারদের মেনু থেকে ফল ডিম আলাদা করে পেতেন। এছাড়াও যখনকার যা।
সুতরাং ডারবান বন্দরে ইমানুল্লা সাব আমার হাতে যে লিস্টি ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, যা নিয়ে আর সেটা নিশ্চয়ই হরেক কিসিমের খাবার—যেমন কিসমিস লবঙ্গ জায়ফল। এগুলি কখনো যদি কোনো অনুষ্ঠানে হত, যেমন ইদের পরবে বিরিয়ানি করার জন্য পাওয়া যেত। আমার ধারণা ছিল, তেমনই কিছু। কিন্তু আশ্চর্য সারেঙ সাব ওসব দিয়ে একসঙ্গে আদা এবং চিনির গাদ মিশিয়ে জাফরান দিয়ে মাছের চাড় তৈরি করে বলেছিলেন, বসে যা। পাঙ্গাস মাছ গাঁথতে পারিস কি না দ্যাখ।
বন্দরের জলে, হরেক রকমের সামুদ্রিক মাছের আড্ডা থাকে। কারণ জাহাজের উচ্ছিষ্ট খাবার জলেই ফেলে দেওয়া হয়। গভীর সমুদ্র থেকে মাছ যেমন উঠে আসে, তেমনি ভালো মাছ শিকারি হলে বড়ো দু-চারটে গলদা চিংড়িও কপালে মিলে যেতে পারে। এক ঘেয়ে খাওয়া, বৈচিত্র্য খোঁজাই স্বাভাবিক। তাছাড়া ভাত খেকো বাঙালির মাছ যে কী প্রিয় সবারই জানা। বন্দরে জাহাজ ভিড়লেই বঁড়শি নিয়ে কেউ কেউ বসে থাকে। আমিও বসেছিলাম ইমানুল্লা চাচার পাশে। মাছ ভিড়লই না।
কাহাতক ভাল্লাগে। খোঁট দিচ্ছি, উঠছে না। জাহাজ থেকে বন্ধু নেমে যাচ্ছে দেখেই মনটা দমে গেল।
বলেছিলাম, চাচা, বের হচ্ছি।
তিনি বোধহয় বুঝতে পারছিলেন মাছ শিকারের লোভ দেখিয়ে আমাকে আর আটকে রাখা যাবে না। শুধু বললেন, যা। তবে একা বের হস না। পারিসতো মাইজলা সাবের লগ ধরার চেষ্টা কর।
মাইজলা সাব অর্থাৎ জাহাজের সেকেন্ড অফিসার খুবই রসিক মানুষ। জাহাজিদের নেটিভ বলে ঘেন্না পেত্তা করে না। বরং হাই হুই করে একে ডাকে, ওকে ডাকে। দু-একটা হিন্দি বাতও বলতে পারে। যেমন, খানা মিলে গা! ইন্ডিয়ান কারি বহুত আচ্ছা।
অবশ্য সে মাঝে মাঝে আমাদের গ্যালিতে এসে প্রায় চুরি করে গোস্ত ভাত খেতে মজা পেত। তার দেশোয়ালি ব্রাদার অফিসারদের কাছে ধরা পড়ে না যায়, এই ভেবে সবসময় সতর্ক।
হ্যালো বাবা, প্লিজ লুক দেয়ার।
অর্থাৎ সে আঙুল তুলে কেবিনে ঢাকার রাস্তাটার দিকে নজর রাখতে বলত। কেউ বের হয়ে যদি এদিকে চলেই আসে, তবে মুখ মুছে, প্যান্টে হাত মুছে শিস দিতে দিতে নেমে যাবে। কারণ সে জানত, কাপ্তানের কানে খবর পৌঁছে গেলে আস্ত রাখবেন না। ন্যাস্টিম্যান বলে গালাগালি করবেন।
মনে আছে, সে আমাকে বাবা বলেই ডাকত। কারণ এই কথারও ইতিহাস আছে। কলকাতা থেকে জাহাজ ছাড়ার সময়ই আমার প্রতি তার কিছুটা সখ্যতা গড়ে তোলার চেষ্টা ছিল। সবার নাম জানারও কৌতূহল আছে। আমার নাম জিজ্ঞেস করতেই বন্ধু বলেছিল, সাহেব হি ইজ বস। হিজ নেম ইজ বাবা। অর্থাৎ আমার নাম বাবা। সারা সফরই সে আমাকে বাবা বলে ডাকত। খোঁজাখুঁজি করত, হোয়ার ইজ মাই বাবা?
সেই বাবা যখন ডারবানে জাহাজ ভিড়তেই নেমে পড়ার জন্য আকুল এবং আমি কোনো ফাঁদে পড়ে না যাই বন্দরে সেই আতঙ্কে সারেঙ সাব যখন কাবু তখন আমার প্রিয় পুত্র অর্থাৎ আমারই বাবার বয়সী মানুষটির সঙ্গে যাবার কথা শুনে এক পায়ে খাড়া হয়ে গেছিলাম।
জাহাজ থেকে নামার সময় সারেঙ সাব বললেন, সাহেব ওকে কিন্তু ফেলে এস না।
নো নো। হি মাস্ট কাম ব্যাক। ডোন্ট বি ওরি।
মনে আছে আমায়, ডারবানে তখন হাড় কাঁপানো শীত। এত শীত যে আমরা দুজনই ওভারকোট পরে বের হয়েছিলাম।
বন্দর থেকে জেটি এলাকা পার হয়ে রাস্তায় পড়তেই ছিমছাম ঘরবাড়ি। পার্ক। দৈত্যের মতো সব নিগ্রো পুরুষ রমণী। কী পুরুষ, কী রমণী কারো মাথায় প্রায় চুল নেই বললেই হয়! মনে হয় টাক মাথা। কোঁকড়ানো চুল থাকলেও ঘন নয়, খুব পাতলা। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত রোয়া ধান পোতার মতো কেউ যেন চুল টাকের যত্রতত্র পুঁতে রেখেছে। সৌখিন নিগ্রো মেয়েদের মাথায় সবারই প্রায় স্কার্ফ বাঁধা। শীতের জন্যও হতে পারে। আবার টাক আবৃত করার জন্যও হতে পারে।
এতকাল পর অবশ্য মনে করতে পারছি না, প্রথম দিনই কি না, না দু-পাঁচদিন পরে তিন নিগ্রো নারী ছিনতাইকারির হাতে পড়েছিলাম! মনে আছে ট্রলি বাস চেপে ইন্ডিয়ান মার্কেটের দিকে যাচ্ছিলাম। যাবার সময় দু-পাশের পার্কে দেখেছিলাম লেখা আছে, নাই ইউরোপিয়ান। এগুলো লেখা থাকে কেন পরে জেনেছিলাম। ভাষাটা যে ওলন্দাজ ভাষা তাও সেকেন্ড অফিসারই বলে দিয়েছিলেন। পার্কে, বাসে সর্বত্র এধরনের লেখা দেখে ঠিক করে নিতে হবে কার কোথায় জায়গা। কে কোন পার্কে ঢুকতে পারবে, কে ট্রলি বাসের নীচের বা উপরের তলায় উঠে যাবে।
বর্ণবৈষম্য কী প্রবল কদিন বন্দরে ঘুরেই টের পেয়েছিলাম।
সাঁজবেলায় আমরা বন্দরে ঢুকব বলে শটকাট করতে যাচ্ছি—এদিকটায় কিছু বস্তি অঞ্চল, কালো মানুষের বসবাস, নিজের সঙ্গে কিছুটা যেন আত্মীয়তাও অনুভব করছিলাম—কারণ এ দেশে আমি তাদের সমগোত্রীয় কাজেই আমার ভয় ডর কম ছিল।
সেকেন্ড অফিসার বললেন, এদিকটায় না ঢুকলেই হত। তার চেয়ে লিউস্ট্রিট ধরে চল যাই।
আমি ঠিক বুঝলাম না, কেন এ কথা তিনি বলছেন। কোনো উপদ্রবে পড়িনি। আর তখনই তিনজন নিগ্রো যুবতী। তিনজনই আমাদের চেয়ে উঁচু এবং লম্বা।
বিশাল এই তিন যুবতী আমাদের ওভারকোট ধরে বলেছিল, হাউ মুচ।
তার মানে হাউ মাচ। তার মানে কত দাম।
আমরা জানতাম, এইসব বন্দরে শহরে নাবিকরা পুরোনো কোট ওভারকোট কিংবা গরম জামাকাপড় বিক্রি করে টু পাইস কামায়। সেকেন্ড অফিসার এমন তিন যুবতীকে পেয়ে খুব খুশি। সে প্রায় দেখলাম মজেই যাচ্ছিল। দু-একটা ফাজিল কথাবার্তাও হয়ে গেল। আর ঠিক সে সময়ে দুই যুবতী আমাদের এমন আলিঙ্গনে আবদ্ধ করল যে আমরা বুরবকের মতো কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না সাঁঝবেলায় রাস্তার উপর—এটা তাদের কোনো আদব কায়দা কিনা অন্তরঙ্গ হবার তাও বুঝছিলাম, এই যখন অবস্থা তখন তৃতীয় যুবতী হাতের ওভারকোট দুটো টেনে নিয়ে অন্ধকারে উধাও হয়ে গেল। আর বাকি দুজনও সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে পালাল।
আমি তটস্থ হয়ে পড়েছিলাম। এমনিতেই বিদেশ বিভুঁইএ কোনো অপরিচিত শহরে একা বের হতে একটা অস্বস্তি আছে। দল বেঁধে বের হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। দুজন আমরা তখন ছুটে পালাচ্ছি। কারণ হাতঘড়ি খোয়া যায়নি—এটাও কম ভাগ্যের কথা না। বন্দরে ঢুকে সেকেন্ড অফিসার বললেন, বাবা, প্লিজ ডোন্ট ডিসক্লোজ ইট টু এনিবডি।
আসলে সেকেন্ড অফিসার চাননি, সবার কাছে বোকা বনতে। জাহাজে কে কতভাবে যে ঠকে আসে ফিগার থেকে! ডাঙার এমনই মোহ। এবং নাবিকরাও কেমন অন্ধের মতো আচরণ করে ফেলে যুবতী নারীর সামান্য সঙ্গ পেলে।
এরপর আর আমার ডারবান বন্দরে বের হওয়া। ক্লা সাবের পাশে বসে মাছ ধরায় মনোযোগ দিয়ে ফেললাম। একদিন দুটো বেশ বড়ো সাইজের গলদা চিংড়ি গেঁথে ফেললাম। ওভারকোট হারিয়ে যে কষ্টে ভুগছিলাম, দটো চিংড়ি শিকারে তার কিছুটা অন্তত লাঘব হয়েছিল এখনও তা মনে করতে পারি। তবে বন্দর ছাড়ার আগে এক সকালে, একজন নিগ্রো এসে আমার ফোকসালে হাজির। তাকে আমি চিনি। জাহাজ থেকে মাল খালাসের সময় সে এজেন্ট অফিসের হয়ে শ্রমিকের কাজ করে গেছে। হাসিখুশি মানুষ। ডেকে উঠেই দু-জ্যাব ভর্তি ভাত নিয়ে মুঠো করে খেত আর বলত ওয়ান ওয়াইফ নো গুড, টু ওয়াইভস গুড। থ্রি ওয়াইভস ভেরি গুড। সে আমার ওভারকোট ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিল ডোন্ট মাইন্ড, আই হ্যাভ থ্রি ওয়াইভস।
তবে আমি কেন যে ইমানুল্লা সাবের ওপর মাঝে মাঝে ক্ষেপে যেতাম বুঝতে পারতাম না। আর যারা এনজিন জাহাজি আছে, তাদের ওপর খবরদারি করায় যেন বিন্দুমাত্র তাঁর ইচ্ছে নেই। কাজ কাম শেষে কে কোথায় যায়, কোথায় রাত কাটায় কিছুই জানতে চায় না। জানার নিয়মও নয়।
অথচ আমার বেলায় তাঁর ষোলো আনা মেজাজ।—’এত রাত করে ফিরলি। কার সঙ্গে গেছিলি! কোথায় গেছিলি! কোথায় গেছিলি বল! চুপ করে আছিস কেন।
আসলে কখনো-কখনো রাত হয়ে যেত। দু-চারদিন নেশা করেও গিয়েছি। নেশা করলেই তিনি তার ফোকসালের দরজা বন্ধ করে দিতেন। রাতে খেতেন না। ভান্ডারি নীচে নেমে বলত, যান বনার্জী সারেঙ সাবের গোসা ভাঙান গিয়া। ক্যাম নে খান, বেতমিজ হতে ভালো লাগে!
পরে কেন যে নিজেরই খারাপ লাগত—বাংক থেকে উঠে পড়তাম। সিঁড়ি ভেঙে ওপরের ফোকসালে যেতাম। সারেঙ সাব একা একটা ফোকসালে থাকেন। একটা কাঠের পেটি বাংকের নীচে। একটা হুকা ঝোলানো বাংকের কোনায়। একটা বড়ো এনামেলের হাড়ি দড়ি দিয়ে বাঁধা। এবং সেটা ছাদের আংটায় ঝোলানো। তাতে রাব ভর্তি। তামাকের বস্তা আছে। বস্তা দিয়ে তামাক পাতা খুব যত্নের সঙ্গে জড়ানো। লকারে তার কী থাকে জানি না। আমি নেশা করে ফিরলে তার সেদিন কোরান পাঠ শুরু হয়। যেন আমার গুনাহ তিনি কোরান পাঠ করে স্পষ্ট করে দিতে চান। নামাজ শেষ করে দুলে দুলে পাঠ শুরু হবে, আর তখনই জাহাজে সবার এত কথা হয়ে গেল।
আর তারা এসে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। কিংবা যায় সঙ্গে যাই, সেও অপরাধী সাব্যস্ত হত। এমন হয়ে গেল শেষে যে কেউ আমাকে ডাঙায় সঙ্গেই নিতে চায় না।
তাদেরও দোষ নেই।
কারণ সারেঙ সাব আমার চেয়ে তাদের বেশি তড়পাবেন। হারামজাদা, বেয়াকুবের দল, নিজেরা জাহান্নামে গেছিস বলে, সেদিনের ছেলেটাকে নষ্ট করে দিচ্ছিস।
বুয়েন্সএয়ার্স বন্দরেও সেই ঘটনা। আমি যেতে চাইলে কেউ সঙ্গে নিতে চায় না।
আর তখন সারেঙ সাব নিজেই হন্তদন্ত হয়ে উপরে উঠে আসতেন!—এই দেবনাথ যা-বনার্জীরে নিয়া যা!
দেবনাথও ছেড়ে কথা বলে না, দেখুন সারেঙ সাব, দেরি টেরি হলে তেড়ে আসতে পারবেন না।
যা, তোরা মাথা গরম করিস কেন যে বুঝি না। যা। বনার্জীরে নিয়া যা। ডাঙায় ঘুরে বেড়াক। মনটা পরিষ্কার থাকব।
দেবনাথ বলত, আমি বারণ করেছি। তোমার তড়পানি কে এত সহ্য করে।
যা বাবা। রাগ করিস না, বনার্জীরে নিয়া যা। বনার্জী বসে থাকলি ক্যান। যা।
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলত, কিরে যাবি না! জাহাজে বসে বিকালটা কাটাবি কী করে! একা একা ভালো লাগবে!
শহরটা বড়ো বেশি সাজানো গোছানো। আমাদের জাহাজ জেটিতে বাঁধলে টের পেলাম, সামনে গাছের সারি। প্রকাণ্ড বড়ো বড়ো গাছ। গাছগুলো আমার চেনা নয়। ওক গাছ-টাছ হবে। নাও হতে পারে। প্রায় শ-খানেক গাছ সার দিয়ে লাগানো। গাছের নীচে সব কিনারায় লোক এসে জড় হয়েছে। জাহাজ থেকে নামলেই শহরে ঢুকে যাওয়া যায়। লেন্দ্রো অ্যালেন জায়গাটা বেশি দূরও নয়। শহরের জাঁকজমক এলাকা ওটাই। জেটি থেকে আধ কিলোমিটার রাস্তা হবে না। অনেক বন্দরে গেছি, কিন্তু একেবারে বন্দর বুকে নিয়ে একটা শহর গড়ে উঠেছে, এটা আর কোথাও দেখিনি। কোনও কাস্টম চেকিং নেই। জাহাজ থেকে নেমে দু-পা হেঁটে গেলেই শহর। কার্নিভেল। আর ফুলের সব দোকান। ফলের দোকান। যখন খুশি নেমে যাওয়া যায়—যখন খুশি ফেরা যায়। আর যুবতীরা এক একজন যেমন মিষ্টি আপেল হাতে নিয়ে হাঁটছে। আপেলের মতোই গায়ের রং। এবং সরস, কী নারী কি পুরুষ সবাই কী সুন্দর দেখতে। চোখ নীল, চুল নীলাভ, গায়ের রং গোলাপি এবং রং বেরঙের স্কার্ট, জ্যাকেট, দামি গাড়ি, বাড়ির পাশে ফুলের বাগান, তকতকে ঝকঝকে।
এই শহরে নেমে না খেতে পারলে আমি মরেই যাব। হঠাৎ ক্ষেপে গিয়ে বলেছিলাম, আমি একাই যায়। দেবনাথদা তোমরা যাও।
ইমানুল্লা সাব যেন জলে পড়ে গেছিলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, একা যাবি! তোর এত সাহস! পরি-হুরির দেশ। বাইন্দা রাখলে আমি কিছু জানি না।
সারেঙ সাব কখনো তাঁর দেশের ভাষায় কথা বলেন। রাগ কিংবা ক্ষোভ অভিমান হলেই মাতৃভাষা বের হয়ে পড়ে। তিনি গুম মেরে গেলে বলেছিলাম ওরা নেবে কেন সঙ্গে বলুন। আমার জন্য ওদের তাড়াতাড়ি জাহাজে ফিরে আসতে হয়। কে আপনার ধমক সহ্য করবে।
দেবনাথ, বন্ধু, অমিয় চলে যাচ্ছিল। সারেঙ সাব তাদের পেছনে ছুটছেন। আমি বসেছিলাম বিমর্ষ মুখে। আঙটায় পিচের বেঞ্চিতে বসে দূরের সমুদ্র দেখছি। গাছগুলি পার হয়ে ছোট্ট মতো পার্কটা পার হয়ে গেলে আমার সমুদ্র। অথচ গাছপালার জন্য দূরের কিছু দেখাও যায় না। ইন্ডিয়া থেকে জাহাজ গেলে যারা পার্কে বেড়াতে আসে, তারা জাহাজে ওঠে কিছু কেনাকাটাও করে। যেমন যারা পুরোনো জাহাজি যারা ব্যাংক লাইনের জাহাজেব সফর করেছে কয়েকবার। তারাই জানে, ময়ূরের পালক কিংবা কাঠের হাতি চওড়া দামে বিক্রি করা যায়।
জাহাজটা মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য কলম্বো বন্দরে থেমেছিল।
নীচে নৌকার ভিড়। কিনারার লোক কাঠের হাতি, কাঠের বুদ্ধমূর্তি কিংবা ময়ূরের পালকে তৈরি পাখা বিক্রি করতে চলে এসেছে নৌকায় করে। যারা জানে, তারা ঠিক কিনে নেয়। এতে যে দু-পয়সা কামানো যাবে বুয়েন্সএয়ারস বন্দরে গেলে তারা তাও জানে। এবং সেই সব জাহাজিরাই আফটার-পিকে বেশ দোকান সাজিয়ে বসার মতো বসে গেছে। স্প্যানিস নারী-পুরুষের যে কোনো কারণেই এই সব ময়ূরের পালক, কাঠের হাতি, কাঠের বুদ্ধ মূর্তির প্রতি বিশেষ আগ্রহ আছে টের পেলাম। জোড়ায় জোড়ায় উঠে আসছে। দর-দাম করে কিনে নিয়ে যাচ্ছে।
আমি এদের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসেছিলাম-ইমানুল্লা সাব ফিরে এসেই ডাকাডাকি শুরু করে দিয়েছিলেন, ওরে বনার্জীরে দেখছ! গেল কোথায়! অ বনার্জী গেলি কোথায় বাবা। যা। জামাকাপড় পালটে নে। সু বুরুশ করে নে। দেবনাথ কিনারায় অপেক্ষা করছে।
সারেঙসাবের এই কাতর ডাক আমাকে খুবই বিচলিত করে তুলত। শেষ পর্যন্ত রাগ পুষে রাখতে পারতাম না। দৌড়ে টুইন-ডেক পার হয়ে গ্যাংওয়ে ধরে নেমে যেতাম—ডাকতাম, দেবনাথদা দাঁড়াও। আমি আসছি।
গাছগুলি পার হলেই, শহরের বড়ো রাস্তা।
ওরা বড়ো রাস্তার পড়ার জন্য হাঁটছিল।
যেদিকে তাকাই চোখ জুড়িয়ে যায়।
কোথাও একটা মেয়ে সাদা ফ্রক আর সাদা প্যান্ট পরে একটা টেনিস বল নিয়ে পাঁচিলে মারছে, আবার ফিরে আসছে বলটা, আবার মারছে। শহরের মাথায় রোদ নেমে আসছে। এ-দেশে এটা শীতকাল না বসন্তকাল আমরা টের পাই না। আমাদের কাছে প্রচণ্ড ঠান্ডার দেশ। কোট প্যান্ট, শালদরাজ কী নেই—তবু সমুদ্র থেকে কনকনে ঠান্ডা বাতাস উঠে আসছে। অথচ মেয়েটা একটা স্কার্ট আর ফ্রক গায়ে নিজের মনে পাঁচিলটার সঙ্গে খেলছে। রাস্তায় কোনো ভিড় নেই। ইতস্তত মানুষের হাঁটাহাঁটি। নর-নারীদের পোশাকেও বিশেষ বাহুল্য নেই। কটনের সার্ট প্যান্ট পরে অনায়াসে ঘুরতে পারছে। আমরা পারছি না।
আমি যেখানে যা কিছু দেখি কেমন অবাক হয়ে যাই। নীলচে রঙের বব করা চুল, মুখ আপেলের মতো মসৃণ, শরীরে বোধ হয় আশ্চর্য সুবাস আছে। আমার বয়েসী এই মেয়েটা এখানে আছে ভাবতে কেমন অবাক লাগে।
ইচ্ছে হত কথা বলি।
কিন্তু সাহস হত না।
দেবনাথদা ডাকলেন, এই তুই কিরে! কি দেখছিস! কোনো লাভ নেই।
সত্যি কোনো লাভ নেই। তবু দেখার জন্য মনের মধ্যে একটা টান জন্মায় কেন বুঝি না। ওদের পছন্দ হচ্ছিল না।—এই হা করে দেখছিস দেবনাথদা চিৎকার করে বলল, হারামজাদা কী দেখছ বুঝি না!
আসলে আমি কী দেখছিলাম, ওর স্তন! কারণ ভারী স্তন খেলতে গিয়ে দুলে উঠছিল—ওর থাই এত মসৃণ, যেন হাত দিলে মোমের মতো পিছলে যাবে।
শুধু পিছলে যাবে, না আরও কিছু যেমন জংলার অন্তর্গত সেই নিদারুণ ভূমি— আমি কী তার আঁটো প্যান্টের ভিতর সেই আকস্মিক হতচ্ছারা তরুণকে খুঁজছিলাম। যার মধ্যে আছে অন্তহীন এক অন্তর্গত খেলা। কেমন যেচে বন্ধুত্ব করতে ইচ্ছে হচ্ছে। সে যদি পড়ে যেত, তাকে তুলে দিতাম। তার এই নমনীয়তা আমাকে আকর্ষণ করতেই পারে।
আর তখনই সাদা বলটা মাথার ওপর দিয়ে ফসকে গেল। আমি দৌড়ে গেলাম। বলটি কুড়িয়ে আবার তার কাছে দিলাম। বলটি দিলে সে সামান্য হেসে কিছুটা জানু নত করে আমার কাছে বোধহয় কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিল।
আমি নড়ছিলাম না।
দেবনাথদার হুঙ্কার, মর বেটা। হারামজাদা তুমি শালা ঈশ্বরের পুত্র। কেউ তোমাকে কিছু বলতে পারে না। তোমার নিন্দা শুনলে সারেঙসাব কথা ঠিক রাখতে পারেন না।
কিরে যাবি?
এই যাচ্ছি দাদা।
রাস্তাগুলি এত চওড়া যে ইচ্ছে করলে যেন ফুটবলও খেলা যায়। এটা বন্দরে ঢোকার রাস্তা, গাড়ি-টারি কম। আর তা ছাড়া এই প্রশস্ত রাস্তায় ইচ্ছে করলেই বেগে গাড়ি চালানো যায় না। কারণ সামনে সমুদ্র। বিচের দিকে যারা যায়, তারা এদিকটায় গাড়ি পার্ক করে যায়। পাশের মাঠে বেশ গাড়ির ভিড়।
আমি দাঁড়িয়ে আছি ওর থেকে প্রায় দশ গজ দূরে। এই সব রাস্তাকেই বুলেভার্ড বলে কিনা জানি না। মাঝখানে গাছপালার সারি। কোনো গাছে হলুদ রঙের ফুল ফুটে আছে। সমুদ্রের হাওয়ায় ফুলের ওড়াউড়ি ছিল বেশ। কেন যে তরুণীকে ফেলে শহরের ভিতরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। কেন যে দাঁড়িয়ে থেকে তার সঙ্গে খেলার অংশীদার হতে ইচ্ছে হচ্ছিল। কেমন নেশার মতো পেয়ে বসেছিল— আর দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম, আবার একটা বল মিস করলে সুযোগ পেয়ে যায়।
আমি পরেছিলাম, কালো সুট। জামার ওপর লাল রঙের পুলওভার। আর গলায় আমার স্কার্ফ জড়ানো।
যাক বেটা দাঁড়িয়ে থাক। রাস্তা হারিয়ে ফেললে আমরা জানি না।
মনে আছে, আমি বলেছিলাম, তোমরা যাও না। একা জাহাজে ঠিক ফিরে যায়।
ফিরেও গেছিলাম।
মেয়েটি গেট দিয়ে দৌড়ে ঢুকে গেলে আমি কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। লোহার গেট-বাড়িটার সামনে কোমর সমান পাঁচিল। সদ্য রং করা মনে হয়। বাড়িটা। সামনে অনেকটা জায়গা জুড়ে ফুল-ফলের বাগান। সব বাড়িগুলিই প্রায় দেখতে একরকম। কোনো বাড়ি থেকে আর একটা বাড়িকে আলাদা করা যায় না। কেবল এ-বাড়িটার বিশেষত্ব বাগানে একটা ইউক্যালিপটাস গাছ আছে। তার সাদা পাতা, সাদা রঙের ডালাপালা দেখলেই আমি ঠিক চিনতে পারব, এ বাড়িটার পাশেই কোমর সমান পাঁচিলের সামনে মেয়েটি দাঁড়িয়ে টেনিস খেলে। একা একা এই টেনিস খেলারই বা কী মজা আমি তখন জানতাম না।
ভয় হচ্ছিল।
দেবনাথদারা চলে গেছেন। বন্দরের জাহাজ, কিংবা মাস্তুলও অদৃশ্য। চলে গেলে ভাববে পালিয়ে গেছে। এটা একজন ভারতীয় নাবিকের পক্ষে শোভা পায় না, এমন মনে হচ্ছিল। অবশ্য জাহাজ পাটার, কিংবা যেখানেই গেছি দোকানে আমাদের দেখলেই এটা-ওটা কেনার পর প্রশ্ন করত, কোথা থেকে এসেছ!
বলতাম, ইন্ডিয়া থেকে।
তারপরই বেশ সমীহ জবাব, আই সি ইউ আর গ্যান্ডি পিপল।
ভারতীয় যে আমরা, তা যেন সে-সময়ে খুবই গৌণ হয়ে গেছিল। গান্ধি পিপল বলেই যেন খারাপ কাজ শোভা পায় না। আর তখনই ভদ্রা জাহাজে ট্রেনিং-এর সময়কার সেকেণ্ড অফিসারের সতর্ক কথাবার্তা শুনতে পাই।
মাই বয়েজ।
তিনি এ-ভাবেই কথা বলতেন।
মাই বয়েজ, তোমরা জান, স্বাধীন হওয়ায় আমাদের দায়িত্ব বেড়ে গেছে। তোমরা জান, জাহাজে নাবিকের কাজ যাঁরা করতেন, তারা অধিকাংশই এখন পূর্ব পাকিস্তানের লোক।
মাই বয়েজ, মনে রেখ, তোমাদের কাজ দেখে যেন জাহাজের কর্তা ব্যক্তিরা খুশি হন। বেঙ্গলি পিপল, লেজি, বাগার, এ ধরনের একটা ধারণা আছে তাঁদের।
এখানে বলে রাখা ভালো, জাহাজে ওঠার পর সবাই আমাদের বাঙালিবাবু বলতেন। পূর্ব-পাকিস্তান থেকে যারাই জাহাজে উঠতেন, তারা সবাই মুসলমান। তাদের থেকে আমরা যে আলাদা, বাঙালিবাবু বলে সেটা যেন মনে করিয়ে দিত? এই নিয়ে মনু, ইমতাজ, আমাদের সঙ্গে কতদিন তর্ক হয়েছে। আমরা বলতাম, তোরা কী, তোরা বাঙালি না! আমাদের বাঙালি বাবু বলিস!
ওরা কিছুতেই এটা মানতে পারত না। তারাও যে বাঙালি মুসলমান, বাংলা ভাষা তাদের মাতৃভাষা কিছুতেই বুঝতে চাইত না। আরবি ফারসিও নয়, এমনকী উর্দুও নয়, এত্তারে, ওত্তারে যাদের লজ্জা, তারা বাঙালি জাতি সম্পর্কে এত উদাসীন যে মাঝে মাঝে ক্ষেপে গিয়ে বলতাম, তোমাদের মিঞা ত যাবে না। মনে রেখ তোমরাও বাঙালিবাবু।
কেউ কেউ অবশ্য আমাদের যুক্তি ধরতে পেরে চুপ করে যেত।
বলতাম, পাকিস্তানি পাকিস্তানি বলে গেলে! এত দেমাক! আর বাংলা দেশটাকে ভাগ করে পাকিস্তান বানালেই হল। খেজুর গাছ আছে মরুভূমি আছে? আর দেশটা অনেক দূর জানিস। মুসলমান বলেই তারা তোদের সব, আমরা কেউ নয়! আবার কোনোদিন শুনছি ত, এই বাঙালিবাবু চা আছে, চিনি আছে, সিগারেট আছে—বললে কোনো সাড়া পাবি না বলে দিলাম।
তারপর এ নিয়ে তর্ক এত প্রবল হয়ে উঠত যে সারেঙ সাব এসে বলতেন, জাত আবার কিরে। মানুষের গোত্র বিচার মনুষ্যত্ব দিয়ে। তা না থাকলে, বাঙালি হও পাকিস্তানি হও কিছু আসে যায় না।
সারেঙ সাবের সামনে আমরা কেউই তর্ক করতাম না। তিনি বলতেন, যার ইমন নাই, সে হিন্দুও না মুসলমানও না। সে কাফের বুঝলি।
তিনি চলে গেলেই, আমেদ ক্ষেপে গিয়ে বলত, বুড়োর একমাত্র ছেলেটা লন্ডনে নেমে যাবার পর থেকেই কেমন হয়ে গেছেন। শুনলি তো কথাবার্তা। আমেদ আমার দিকে তাকিয়ে বলতেন, তোরই বয়সী। জাহাজে সঙ্গে নিয়ে উঠেছিলেন। জাহাজের কাজ কাম শিখলে সফরে বের হতে পারবে। আর সফর! বিলাতের ঘাটে সেই উধাও হয়ে গেল আর কোনো খোঁজ নেই।
সেদিনই আমি টের পেয়েছিলাম, বুড়ো মানুষটি আমি দেরি করলে কেন এত ক্ষেপে যান। তিনি কী তার পুত্রের কথা ভেবে বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি কী বোঝেন, এই বয়সটাই খারাপ! কী জানি, এত দিন পর জীবনের সে সব রহস্যময়তার কথা ভাবলেও মন কেমন উদাস হয়ে যায়।
যা বলছিলাম, সেকেন্ড অফিসার বলতেন, মনে রেখ, প্রায় দেশে আমাদের দূতাবাস আছে। তাদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের কোনো যোগাযোগ থাকে না। তোমরাই হলে আসল, এদেশের পরিচয়— তোমাদের আচরণে এই দেশ সম্পর্কে বিদেশিরা অনুমান করতে পারবে, ভারতীয়রা গরিব, তবে তাদের শালীন আচরণের তুলনা নেই। তোমরা জংলি নও। তোমরা হলে আসল ভারতীয় দূত।
আসল ভারতীয় দূত, এই উক্তি জাহাজে উঠে মনে থাকার কথা না। বিপদে পড়লে মনে পড়ত।
যেমন মেয়েটি না খেলে, বল নিয়ে দৌড়ে পালাল। বেশ সুন্দর জ্যোৎস্না উঠেছিল। বুলেভার্ডে মসৃণ ঘাস, গালিচার মতো। খুব যত্ন নেওয়া হয় ল্যান্ডমেয়ারে কাটা ঘাস হাঁটলেই বোঝা যায়।
দেখাই যাক না কী হয়।
আমি ঘাসের ওপর বসে পড়লাম।
দোতলার কোনো ঘরে কে আলো জ্বেলে দিল। রঙিন কাচের ভিতর এক নারীমূর্তিকে হাঁটাহাঁটি করতে দেখলাম। তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল।
কেমন সব মরীচিকার মতো, এই আছে এই নেই। কিন্তু বাড়ি থেকে আর কেউ প্রায় বেরই হল না। কিছুক্ষণ পর একটা গাড়ি বের হয়ে গেল। আবছা আলোয় টের পেলাম, গাড়িতে সে আছে।
জাহাজে ফিরতে ইচ্ছে করছিল না।
আমি সাদা টেনিস বল যতবার হাতে দিয়েছি, ততবার সামান্য নত হয়ে বাউ জানিয়েছে।
কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল।
হাজার হাজার মাইল দূরে আমি ঘাসের ওপর শুয়ে আছি। ছোটো ছোটো ভাইবোনদের অনাহার থেকে রক্ষা করার এ-ছাড়া আমার আর কোনো উপায়ই ছিল না।
বাবার বিষণ্ণ মুখ মনে পড়ছে।
মা-রও।
ছোট ভাইরা তখন চারপাশে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের এক কথা দাদারে।
আমি নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলি।
দাদারে।
বল।
ফিরবি না! কত রাত হল?
আমার মধ্যে আবার সে জেগে ওঠে—অথচ পিতার একমাত্র প্রথম পুত্র।
আমি উঠে বসি। জাহাজে ফিরে যাই।
গ্যাঙওয়ে ধরে উঠে যাবার জন্য সিঁড়ি ভাঙছি। কেমন ক্লান্ত মনে হত নিজেকে। জাহাজ কবে ফিরবে দেশে কেউ বলতে পারে না। কতকাল এভাবে জাহাজ নিয়ে বন্দরে বন্দরে ঘুরবে তাও জানি না। জাহাজ সমুদ্রে ভাসলেই আতঙ্ক। সেই ওয়াচ, টন টন কয়লা টেনে নিয়ে যাওয়া, রাশি রাশি ছাই হাপিজ করা কাজ সেরে উঠে এসে স্নান আহার, তারপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়া।
কিন্তু কী যে আতঙ্ক ছিল, কিছুতেই ঘুম আসত না।
এই বুঝি উঠে এল ইঞ্জিন রুমে যাদের ‘পরি’ থাকে, তাদেরই কাজ জাগিয়ে দেওয়া, আমার দিনের পরি’ অর্থাৎ ওয়াচ ছিল আটটা বারোটা। রাতেও আটটা বারোটা। চার ঘণ্টা করে কাজ আট ঘণ্টা বিশ্রাম ঠিক তবে কী দিনে, কী রাতে আমার ছিল অস্বস্তি। ওয়াচে যেতে হবে শুনলেই আতঙ্কে মুখ কাল হয়ে যেত।
তবে তিন চারমাসে রপ্ত হয়ে উঠেছিলাম। আগের মতো ওয়াচের আতঙ্কে ভুগতাম না। ডাঙা এলে খুশির জোয়ারে ভেসে যেতাম। শহরের রাস্তা ধরে হেঁটে গেছি, পাহাড়ি বন্দর হলে টিলায় উঠে সমুদ্রে সূর্যাস্ত দেখেছি, আর সব বন্দরেই একটা না একটা মোহে পড়ে গেছি।
ফিরতে বেশি রাত হওয়ায় সারেঙ সাব মুখ গোমড়া করে ফেলেছেন। নিশ্চয়ই দেবনাথদারা এসে সব বলেছে। কোনো তরুণীর টেনিস বল কুড়িয়েছি শুনে সারেঙ সাব নিশ্চয়ই ভেবেছেন ছোড়া হয়ে গেল। কিন্তু তার জন্য এত রাততো হবার কথা নয়। রাস্তা হারিয়ে ফেললে, বন্দরে ফেরা যাবে না এই দুশ্চিন্তাও থাকতে পারে।
আমাকে দেখে তিনি কথা বললেন না। আমি ফেরায় তিনি নিশ্চিন্ত দেখে তাও মনে হল না। কেবল সিঁড়ি ধরে নীচে নামার সময় বললেন, তোর খাবার ভাণ্ডারি ঢাকা দিয়ে রেখেছে। হাতমুখ ধুয়ে খেয়ে এবারে উদ্ধার কর।
পরদিন সেজে গুঁজে একাই বের হয়ে গেছিলাম। যেন হেঁটে গেলেই দেখতে পাব একটা ইউক্যালিপটাস গাছ দাঁড়িয়ে আছে। পাচিলের পাশে সাদা সাদা খাটো ফ্রক গায়ে টেনিস খেলছে। রোজই কেন যে মনে হত, আজ হয়ত গিয়ে তাকে দেখব না।
ঠিক দূর থেকে দেখলাম গাছটা।
কিন্তু কেউ খেলছে না।
তবে কী আমার মতো একজন অপরিচিত তরুণের বল কুড়িয়ে দেওয়া পছন্দ নয়।
তা ছাড়া মারধর করবার জন্য দলবল নিয়ে বাড়ির ভিতর সে ঘাপটি মেরে নেই ত। এমনও মনে হত।
মনটা দমে গেল।
জাহাজে ফিরে যাব ভাবছি। যদি সত্যি গেট খুলে ওরা ছুটে আসে। মেরে ছাল চামড়া তুলে দিতে পারে। এ-সব যখন ভাবছিলাম, তখনই দেখি মেয়েটা গাছের নীচ দিয়ে ছুটে আসছে। এক হাতে র্যাকেট অন্য হাতে টেনিস বল।
আমাকে দেখে মিষ্টি করে হাসল। তারপর বলটা ওপরে ছুঁড়ে দিয়ে সার্ভ করতেই আমার সব সংশয় জল হয়ে গেল। না, আমাকে সে খারাপ লোক ভাবেনি। আমি যে জাহাজি তাও বুঝতে পেরেছে। কারণ আমার চেহারা এবং পোশাকে দুর সমুদ্রের ঘ্রাণ আছে মেয়েটি বোধ হয় টের পেয়েছিল।
সেদিন সে ইচ্ছে করেই দেরি করেছিল, না টানে-টানে আমিই সকাল সকাল জাহাজ থেকে নেমে গেছিলাম মনে করতে পারছি না। কেবল মনে আছে দুধে আলতা রং তার। চোখ কালো, চুল নীলাভ। মুখে তার আশ্চর্য দেবী মহিমা।
সে সেদিন ইচ্ছে করেই বল বেশি মিস করছিল, আর আমি দৌড়ে দৌড়ে তার বল কুড়িয়ে দিয়ে যখন কৃতার্থ হচ্ছিলাম, তখনই একবার র্যাকেটটা বগল দাবা করে আমার দিকে এগিয়ে এল। মিষ্টি হেসে কী বলল, তার এক বর্ণও বুঝলাম না।
তবে আমি বললাম, ইয়েস সি সেলর।
কী বুঝল সেই জানে।
আবার বল নিয়ে সার্ভ করল। পাঁচিলে ঠেকে বল ফিরে আসছে, ডান হাত বাঁহাতে সে বল পাঁচিলে ফিরিয়ে দিচ্ছে। একটা বলও মিস করছে না।
আমি বোবার মতো পাশে দাঁড়িয়ে তার এই মজার খেলা দেখছি।
সে যে কী বলল!
আমার ভালো লাগছিল না। আশ্চর্য সে একটা বলও মিস করছে না। মিস না করলে আমার আর থেকে কাজ কী। আমি তো তার বল কুড়িয়ে দেবার জন্যই দাঁড়িয়ে থাকি। বোধহয় ভিতরে কোনো অভিমান কাজ করে থাকতে পারে। আমি হাঁটা দিচ্ছিলাম, আর তখনই-হুই। শিস দেবার মতো আমাকে উদ্দেশ্য করে কিছু যেন বলল।
কাছে গেলে দেখি সে র্যাকেটটা আমার দিকে এগিয়ে দিচ্ছে। বলটাও।
আমি যে এ-ব্যাপারে একেবারে আনাড়ি মেয়েটা বোধহয় জানে না। তাও ভাবতে পারে সাদা বলের প্রতি এত যখন আগ্রহ, তখন আমারও খেলার ইচ্ছে আছে। সে আমার হাতে র্যাকেট তুলে দিতে এলে সরে দাঁড়ালাম বললাম, নো নো।
তারপর বললাম, আই নো নাথিং অফ দিস গেমস।
আমার কথা সে কিছুই যে বুঝতে পারছে না, হাব ভাবেই বোঝা গেল।
সে আমার হাতে র্যাকেট দেবেই।
আমি খেলব সে বল কুড়োবে। খুব কাছে থেকে বুঝলাম, সে সবে বালিকা বয়স পার করেছে। একজন প্রৌঢ় মতো লোক বের হয়ে এলে তাকে কিছু বলল মেয়েটা। সেও আমার দিকে তাকিয়ে হাতের ইসারায় কিছু বোঝাবার চেষ্টা করল।
তখনই টের পেলাম হাতের ইশারায় কিংবা মুখের অঙ্গিভঙ্গি দিয়ে বোঝাতে না পারলে মেয়েটা আমার কোনো আগ্রহের কথাই বুঝবে না।
খেলার চেয়ে বল কুড়িয়ে আনার আগ্রহ যে বেশি, বোঝাই কী করে।
এ ছাড়া র্যাকেট কি ভাবে ধরতে হয় জানি না। যদিও এটা কোনো সমস্যা নয়–কিন্তু বল ছুঁড়ে মারতে গেলে ফসকে যাবারই সম্ভাবনা বেশি।
খুবই কাঁচা কাজ হয়ে যাবে ভেবে র্যাকেটটা কিছুতেই নিচ্ছিলাম না। জোর করে গছাবেই, অজস্র কথাও বলছে, যার এক বর্ণ বুঝতে পারছি না।
ওর শরীরে ভারি সুঘ্রান।
সামান্য হাওয়ায় ওর বব করা চুলে ঢেউ খেলে যাচ্ছিল। যেন এই যে বালিকা কিংবা তরুণী যাই বলা যাক, তার মুখে সামান্য অভিমানও ফুটে উঠতে দেখলাম।
এত নাছোরবান্দা হলে পারা যায়।
যেন খুশি করার জন্যই র্যাকেট হাতে সাদা বল মাথার ওপর ভাসিয়ে দিলাম।
যা হবার তাই হল।
কোথায় যে গেল বলটা।
ফসকে গেছে। এত জোরে মেরেছিলাম যে র্যাকেটও ফসকে গেল হাত থেকে।
আর আশ্চর্য দেখি মেয়েটা ফুলে ফুলে হাসছে। হা হা করে হাসছে। এত হাসছিল যে আমি খুবই অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম।
বয়সের দোষে অপমান বোধ প্রখর।
আমি হাঁটা দিতেই মেয়েটা এসে পেছন থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরল।
না এতটা আমি আশা করিনি, সমবয়সী এক তরুণ তার খেলা দেখার জন্য একা একা দাঁড়িয়ে থাকে—এটা তার কাছে কোনো বিস্ময়ের কারণ হতে পারে–কিংবা এপ্রিসিয়েট করছে তার খেলার এটাও ভাবতে পারে—সে যাই ভাবুক, আমি নড়তে পারলাম না।
সে হাত টেনে আমাকে নিয়ে গেল। কী করে র্যাকেট ধরতে হয় দেখাল, কী করে বল ছুঁড়ে দিতে হয় দেখাল। এবং সে আবার হাতে র্যাকেট দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকল, আমি ঠিক মারতে পারি কি না।
র্যাকেটটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়েছি। আর হাসির খোরাক হতে রাজি না। সে দু হাত নাচিয়ে আমাকে এনথু দিতে চাইছে। আমি যে কী করি!
সে এসে এবার র্যাকেটটা আমার হাত থেকে তুলে দিল। কী ভাবে ধরতে হয় দেখাল। বল লুফে মারতে হয় কী ভাবে তাও দেখাল। টেনিস র্যাকেট এত ভারী তাও আগে জানতাম না। দেখিওনি। খুব বেশি ব্যাডমিন্টন খেলেছি কলেজে। দু যাকেটের আকাশ পাতাল তফাত। কজির জোর না থাকলে হয় না।
তারপর আমি আবার মিস করলাম।
সে আবার দেখিয়ে দিল।
একবার সত্যি লেগে গেল।
আর মেয়েটা হাততালি দিয়ে আমাকে চিয়ার্স করল।
এই হল আমার মরণ।
আমাদের জাহাজ বুয়েন্সয়ার্স বন্দরে বোধহয় মাসখানেক ছিল। পাটের গাঁট নামানো, তারপর মাল বোঝাই হবার সময় আচমকা বন্দরে শ্রমিক ধর্মঘট।
জাহাজ টানা একমাসই বন্দরে লেগে থাকল। আর ক্রমে আমি চেরির ঘনিষ্ঠ হয়ে গেলাম। তার নাম চেরি। একদিন সে হাতে করে ফল এনে দেখাল। একবার আঙুলে ফল দেখায়, একবার আঙুল বুকে ঠেকায়। একদিন সে ইশারায় বোঝাল, আমার জাহাজ দেখতে আসবে। কিন্তু আমি যে সেকশনে থাকি, তা খুবই অপরিষ্কার, তাকে এনে কোথায় বসাব এই দুশ্চিন্তায় মাথা খারাপ। সারা সকাল বাংক পরিষ্কার করলাম। বিছানার চাদর কেচে ফেললাম। নোংরা পোষাক সব লকারের এক কোনায় কাগজ দিয়ে মুড়ে ফেললাম। সারেঙ সাবকে বলে বাংকে রং লাগালাম। বাংকে সাদা রং। তারপর কসপের কাছ থেকে একটা পুরোনো কম্বল এনে গালিচার মতো মেঝেতে বিছিয়ে দিলাম। আমার সাফসুতরোর ব্যাপারে এত মনোযোগ দেখে সব জাহাজিরা বেশ তাজ্জব বনে গেছে। বনার্জীর এই সুমতি–তার তো কিছুই ঠিক থাকে না। হপ্তার পর হপ্তা সমুদ্রে এক জামা-প্যান্ট পরে কয়লা টানি। ঘাম বসে গিয়ে শক্ত খড়খড়ে প্যান্ট। সারেঙ সাব দেখলে শুধু প্যান প্যান করেন। বলেন, তোর ঘেন্নাপত্তা নেই। দোতলাটায় আমরা দুজন থাকি। উপরে থাকে বাহারুদ্দিন। ওকে বাহার বলে ডাকি। গরমের সময় সমুদ্রে সে লোক ফোকসালে হয় গামছা নয় তোয়ালে পরে থাকে। খালি গা। তবে বুয়েন্সএয়ার্সের প্রচণ্ড ঠান্ডায় লুঙ্গি পরলেও, ওপরে পুলওভার গায়ে দেয়।
ওকে নিয়েই ঝামেলা।
ওর সতরঞ্জি শতছিন্ন। নানা জায়গায় সেলাই করা। কৃপণ স্বভাবের। ওর ফুটো কম্বল এবং মোটা কাঁথা এখুনি কোথায় যে রাখি। একমাত্র সারেঙ সাব যদি রাজি হন।
সারেঙ সাব রাজি। একজন কয়লাওয়ালার পেটি তার ঘরে রাখা খুব সম্মানের না। তবু সে জাহাজে আসবে শুনে সারেঙ সাব কেন যে আমার সম্মান রক্ষার্থে নিজেই দায়িত্ব নিয়ে ফেললেন। বাটলারের কাছ থেকে ফুলদানি পর্যন্ত চেয়ে আনলেন। এক গুচ্ছ মিমোসা ফুল ফুলদানিতে রাখলাম। প্রায় পূজা-পার্বণের মতো ঘরটাকে সাজিয়ে ফেললাম।
আমরা ইশারায় ততদিনে কথা বলতেও শিখে গেছি। দুটো একটা ইংরেজি সেও জেনে নিয়েছে। সে এলে কফি সার্ভ করা হল। এক প্লেট বিরিয়ানি দেওয়া হল। সে খেয়ে খুব খুশি। সর্বাগ্রে সঙ্গে সে ইশারায় কথা বলার চেষ্টা করছে। তাকে আমি ইঞ্জিনরুমে নামিয়ে সব ঘুরে ঘুরে দেখিয়েছি।
সেও আমার তার গাড়ি করে এক বিকেলে এভিতাতে নিয়ে গেল। এভাপেরনের সমাধিক্ষেত্র দেখলাম। কী শান্ত আর নির্জন। বড়ো বড়ো গাছের ছায়ায় নায়িকা এভাপেরনের সমাধি। গাড়ি করে দূর দূর থেকে লোক আসে। সেখানে আমি আর চেরি ঘাসের ওপর চুপচাপ শুয়ে থাকতাম। পাখিরা সমুদ্র থেকে উড়ে আসত। যেন এক মায়ায় জড়িয়ে যাচ্ছিলাম চেরির সঙ্গে। তার মা বাবা একদিন আমাকে জাহাজ থেকে নিয়ে গেল। আমরা খাওয়াদাওয়া সেরে সে দেশের বিখ্যাত আপেলবাগান দেখতে বের হয়ে গেলাম।
অথবা কোনো বিকেলে, কিংবা সাঁজবেলায় আকাশের নক্ষত্র দেখতে দেখতে আমার মনে হত, কতদূরে আমি। ঘাসের ওপর বসে আমরা কখনো হাতে হাত মিলিয়ে অদ্ভুত এক খেলা খেলতাম। এক দুই পাঁচ, তিন সাত চার, এমন ছিল খেলার হিসাবটা। কোথায় হাতের পাতা পড়বে, কোন দিকে, নীচে না ওপরে, না কোমরের কাছে, মাঝে মাঝে ভুল করে ফেললে প্রথম থেকে আবার শুরু করতে হত খেলাটা—এইভাবে এক বিকেলে কেন যে আমার মনে হচ্ছিল, এদেশ ছেড়ে গেলে আমি বাঁচব না। সে আর কোনোদিন পাঁচিলের পাশে এসে র্যাকেট হাতে নিয়ে দাঁড়াবে না, আমিও আর কোনোদিন সাদা বল তার হাতে কুড়িয়ে দিতে পারব না। যখন চেরির জন্য টান ধরে গেছে, ওদেশে থাকারও একটা হিল্লে হয়ে যেতে পারে–চেরিই বলেছিল, ওহ ইন্ডিয়ান।
‘ওহ ইন্ডিয়ান’ কথাটা এত বেশি গেঁথে গেছিল মনে যে সে আর আমি তাদের বাগানে ফুল চোর সেজে ছোটাছুটি করেছি কত বিকেলে।
এক বিকেলে গিয়ে দেখলাম, চেরি নেই।
সে চলে গেছে।
কোথায় গেছে?
তারা যা বলে বুঝি না।
কবে ফিরবে। তাও তাদের ভাষা থেকে ধরতে পারি না। কেমন ভেঙে পড়েছিলাম। না বলে কোথায় গেল। কবে ফিরবে। একবারও তো বলেনি। আবার বলতেও পারে, আমিই ঠান্ডায় তার ইশারা ধরতে পারিনি। বুলেভার্ডে রোজ গিয়ে বসে থাকি। জাহাজ ছাড়ার সময় হয়ে যাচ্ছে। এ-দেশে থাকি না থাকি, যাবার আগে তার সঙ্গে একবার দেখা হবে না ভাবতে পারি না।
গেটে তালা।
দরজা জানালা বন্ধ।
কেউ নেই বাড়িটাতে।
আর আমার কেন যে প্রত্যাশা ছিল, যেখানেই থাক, জাহাজ ছাড়ার আগে ঠিক চেরি চলে আসবে। অন্তত ও-দেশ ছেড়ে যাবার আগে তার সঙ্গে আর দেখা হবে না ভাবতে পারি না।
রোজ যাই। গাছের ছায়ায় বসে থাকি। দূর থেকে কোনো গাড়ি এলে মনে হত বাড়িটার সামনে থামবে। গেট খুলে চেরি তার বাবা মা এবং একজন কাকাও ছিল বোধহয়, তবে সম্পর্কটা সঠিক কি বুঝতে পারিনি।
এভাবে একদিন দেখলাম জাহাজ ছাড়ার নিশান উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
চব্বিশ ঘণ্টা আর মাত্র আছি এ-বন্দরে।
ভোর রাতে জাহাজ ছাড়বে।
জাহাজ ছাড়ার আগে কিছু কাজ থাকে, ডেক পরিষ্কার করা, ফল্কার কাঁঠ ফেলে ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দেওয়া খিল এঁটে দেওয়া চারপাশে—এই সব কাজ যত দেখছি, তত মুখ আমার শুকিয়ে যাচ্ছে। বিকেলে গেলাম। সাঁঝবেলায় ফিরে এলাম। ভিতরে কেন যে এত ছটফট করছিলাম জানি না। অন্তত জাহাজ ছেড়ে দিচ্ছে। আমরা বন্দর ছেড়ে চলে যাব, আর হয়তো জীবনে চেরির সঙ্গে দেখা হযে না। ভাবতেই চোখ ফেটে জল বের হয়ে এল।
এবং কেমন ঘোরে পড়ে গেছিলাম। মাঝরাতে জাহাজ থেকে পালিয়ে ভেসে যাব ভাবছি—এবং ডেক ধরে যাবার মুখেই দেখি পেছনে কে আমাকে অনুসরণ করছে। সারেঙ সাব।
কোথায় যাচ্ছিস?
মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। সাড়া মুখে তিক্ততা ভেবেছে কী। আমি কোথায় যাচ্ছি, না যাচ্ছি, এতে তার কী দায় থাকতে পারে। আমি মরি বাঁচি, তার কি তাতে আসে যায়।
প্রায় আর্তনাদ করে উঠেছিলাম—আমি যেখানে যাই, আপনার কী তাতে।
আমার কী! তিনি আমার কাঁধে হাত রেখে বলেছিলেন, আমার কিছু না। তোর বাবা-মার কথা ভাবলি না। পালাচ্ছিলি।
তার তখনই মনে হল, কে যেন ডাকছে, দাদারে বাড়ি ফিরবি না।
কত দূর দেশে আমার বাবা-মা, আমার ভাই বোনেরা রয়েছে। আর আমি কবে ফিরব এই অপেক্ষায় আছে। এজেন্ট অফিস থেকে বাবার নামে মাসোহারা যায়। জাহাজ ছেড়ে দিলে সব বন্ধ হয়ে যাবে।
আমি ফিরে এলাম। বাংকে শুয়ে গোপনে অশ্রুপাত। কার জন্য এখন আর সাঠিক মনে করতে পারছি না। বাবা-মা, ভাই বোন, না চেরি।
যাই হোক জাহাজ ছেড়ে দিলে চুপচাপ গ্যালির পাশে বেঞ্চিতে বসে থাকলাম। যতক্ষণ না বন্দর চোখের ওপর থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল, বসে থেকে ছিলাম।
কার্ডিফ বন্দর ছাড়ার সময়ও এক পরিস্থিতি। ইমানুল্লা সারেঙ নজর রাখছেন। এমন ভাবলেই আমার মাথা গরম হয়ে যেত সারেঙ সাবের ওপর। কেবল মনে হত আমার ভালোমন্দ দেখার এত দায় কে দিয়েছে আপনাকে। আমি জাহান্নামে গেলে আপনার কি! কিছু বললেই চটে যেতাম। এবং মনে হত, তিনি আপদবিশেষ। জাহাজের কাজকর্ম ছাড়া হয়তো খবরদারি করার কথাও নয়। বন্দরে কে কোথায় রাত কাটায়, জানার তাঁর কোনো অধিকার নেই। আমার বেলায় তাঁর যত নজর। কেমন যেন জেদি হয়ে যাচ্ছিলাম। উচিত শিক্ষা দিতে হবে। যাতে তিনি কখনো আর আমার ব্যক্তিগত কাজেকর্মে নাক না গলান, সেজন্য মরিয়া হয়ে উঠলাম।
বোধহয় সময়টা জুন-জুলাই। প্যাঁচপ্যাচে বৃষ্টি। কার্ডিফ থেকে এই বৃষ্টির মধ্যেই খালি জাহাজ নিয়ে আমরা রওনা হলাম।
কাছাকাছি আর কোনো বন্দরে জাহাজ ধরছে না।
বুয়েন্সএয়ার্স থেকেও আমরা খালি জাহাজ নিয়ে রওনা হয়েছিলাম। ভিক্টোরিয়া পোর্টে মাত্র দুদিনের জন্য থেমেছিল। ব্রাজিলের এই বন্দরটি লৌহ আকরিক রপ্তানির জন্য বিখ্যাত। দু-দিনেই লৌহ আকরিকে জাহাজ বোঝাই। সেখান থেকে টানা সমুদ্র ভেসে গেছি বে অফ বিসকে পর্যন্ত। প্রায় মাসখানেক জাহাজ সমুদ্রে।
কার্ডিফে মাল খালাস। ড্রাই-ডক সারতে বিশ-বাইশ দিন কী বেশি সময় লেগেছিল সঠিক এখন আর মনে নেই।
শুধু মাসখানেক পর আমরা পোর্ট অফ জামাইকা যাব। যেখানে জাহাজের রসদ নেওয়া হবে।
ক্যারাবিয়ান সিতে দু একদিনের জন্য নোঙর ফেলা হবে। জাহাজের চার্টে এমন খবর পেয়ে আমরা বেশ মুষড়ে পড়েছিলাম। কারণ তারপর কোনদিকে কী নিয়ে রওনা হবে জানি না বলে মন বেশ খারাপ।
এমনিতেই জাহাজটা লরঝরে। সাউথ-ওয়েলসের উপকূল থেকে একটানা এতদিন জাহাজটা ভেসে চলতে পারবে কি না সংশয়। প্রায়ই মনে হত জাহাজ বন্দর ধরার আগেই সমুদ্রে ডুবে যাবে। ঝড় সাইক্লোনে পড়লে এটা বেশি মনে হত। এই বুঝি স্টিয়ারিং ইঞ্জিন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। কারণ আমাদের ঠিক মাথার উপরেই ছিল হালের যন্ত্রপাতির ঘর। ঝড়ে মাঝে মাঝে উদ্ভট সব শব্দ পেতাম। একদিন তো দৌড়ে উঠেও গেছিলাম—দেখি না ক্রাংক ওয়েভগুলো ঠিকমতোই কাজ করছে।
আসলে আমরা যাচ্ছি কান্দি নিউ পোর্টে।
তার আগে পোর্ট অফ জামাইকা থেকে শুধু রসদ তোলা।
জাহাজ ছেড়ে দেবার পর কার্ডিফ বন্দরও অদৃশ্য হয়ে গেল। এ যে গভীর সমুদ্রে জাহাজ। আবার সেই ওয়াচ, কয়লা টানা, ছাই হাপিজ করা, চান, খাওয়া, ঘুম। প্রতিদিন একই দৃশ্য, নীল আকাশ। নীল সমুদ্র। অনন্ত অসীম এই সমুদ্র যাত্রা কবে যে শেষ হবে তাও জানি না।
বুঝতে পারছি, এবারে আমি একটু বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠছি। ইমানুল্লা সাবের কাজে নাজিরা যেন ডাইনি। তার সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছিলাম বলে দু-দিন কোনো কথাই বললেন না।
মাঝে মাঝে সারেঙ সাবের এমন ছেলেমানুষী দেখে আমার হাসি পেত। নাজিরা কি আমাকে খেয়ে ফেলবে। আমি কী সত্যি কোনো বন্দরে হারিয়ে যেতে পারি! হারিয়ে গেলে, তাঁর কী! আর যদি আমার ব্যক্তিগত অভিরুচিতে বারবার তিনি হস্তক্ষেপ করেন তবে রাগ হয় না।
জানি না কেন, অনেকের মতো আমিও ‘ফুল’ নেব জানতে পেরে আবার সারেঙ সাব খাপ্পা।
ছোটোটিন্ডাল করিম মিঞা ব্যাংক লাইনের পুরোনো জাহাজি। সে অনেক খবর রাখে। কারণ নিউপোর্ট থেকে জাহাজ সালফার বোঝাই হয়ে পানামা ক্যানেল অতিক্রম করে আবার দূর সমুদ্রের যাত্রা। পানামা ক্যানেল অতিক্রম করার সময় কে ফুল নেবে, এমন কথাবার্তা আমার কানে এসেছিল। বন্ধুই এসে খবর দিয়েছিল, ছোটোটিল্ডালের ঘরে যা। ডাকছে।
আমি এখন লকার গোছাচ্ছিলাম। মা শীতে কষ্ট পান বলে একটা কম্বল কিনেছি। সেটা যত্ন করে ভিতরে গুছিয়ে রাখছিলাম।
‘ফুল নেব’ এমন খবর যে সারেঙ সাবের মাথা খারাপ করে দিতে পারে আমি জানতাম। অনেক হয়েছে আর না। ঘোমটার তলে খ্যামটা নাচ আর ভালো লাগছে না। জাহাজিরা যা আমিও তাই। অত শুচিবাই জাহাজে উঠলে চলে না।
বন্ধুকে বললাম, যা আমি যাচ্ছি।
আমার ফোকসালে দুটো বাংক।
নীচের বাংকে থাকত বাহার। সে সারেঙের ‘ফালতু’ ছিল। অর্থাৎ অতিরিক্ত কোলবয়। আমাদের সাতজনের একজন। কার কঠিন অসুখ-বিসুখ হলে সে তার হয়ে পরি দিত। অন্য সময় সারেঙ সাবের ফুটফরমাস খাটত বাহার।
বাহারের মেজাজ বেশ দরাজ উঠেই টের পেয়েছিলাম। সে নীচের বাংকটা আমাকে ছেড়ে দিয়েছিল। উপরের বাংকে শুলে ঝড় সাইক্লোনে ঘুমোতে বেশি অসুবিধা। বেশি ওঠানামা করে বাংক। সে আমার সুবিধার দিকটা সব সময় নজর দিত। আমার টোবাকো কিংবা চিনি রেশনে সেই তুলত। সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস ছিল না। সেও ধূমপায়ী ছিল না বলে আমাদের টোবাকো জমে যেত। এবং কিনারায় সে টোবাকো তিন গুণ দামে বিক্রি করে আমার প্রাপ্য কড়ায় গণ্ডায় মিটিয়ে দিত। এই করে আমাদের হাতে অতিরিক্ত পয়সা এসে গেছিল। যার জন্য সহজেই একটা দামি কম্বল কিনে ফেলতে পারলাম। ঘাটে জাহাজ গেলে কোম্পানির ঘর থেকেও কিছু পয়সা তোলা যায়। সব মিলিয়েই কম্বল কেনার পয়সা জোগাড় হয়ে গেছিল। ফন্দিটা জুগিয়েছিল বাহারই। সেই বাহার কার্ডিফ বন্দরে হাওয়া হয়ে যাওয়ায় পুরো ফোকসালটা আমার একার দখলে এসে গেছিল।
আমরা তখন মিসিসিপি নদীর মোহনার সামান্য ভিতরে ঢুকে গেছি।
সেই এক ফুলের খবর। করিম টাকা পয়সা তুলছে।
যত শুনি তত নারীসঙ্গ পাবার জন্য মনটা উতলা হতে থাকে। বারবার সারেঙ সাব নিষেধ করলেন, ছোটোটিল্ডালের ফাঁন্দে যেন না আটকে যাই।
কেন যে এটা সারেঙ সাবের বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছিল এখন ভাবলে কষ্ট পাই।
সে যাই হোক, নিউপোর্ট আমরা নামতে পারলাম না। পোর্ট অফ সালফারেও না। কাপ্তান সারেঙ সাবের কাছে খবর পাঠালেন, কিনারায় আমরা যেন কেউ না নামি।
আমেরিকার দক্ষিণ মুল্লুক এটা।
বর্ণবিদ্বেষ প্রবল। কিছুদিন হল কালো সাদায় দাঙ্গা হয়ে গেছে। ভারতীয় জাহাজিদের নামার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়ে গেল।
এতেও হয়ত মনটা আরও বেশি উৎক্ষিপ্ত হয়ে গেছিল। গোপনে ছোটোটিন্ডালের হাতে ফুলের দাম একবারে পৌঁছে দিলাম।
এত কাছে ডাঙা। জেটি পার হলে বড়ো বড়ো তেলের পিপে রোদে ঝলমল করছে। শহর এলাকা একটু দূরে। তবু বোট ডেক থেকে নারী পুরুষের ফারাক বুঝতে পারে। আমরা বন্দি জীবন প্রায় যাপন করছি। কাঁহাতক সহ্য হয়।
আমার সঙ্গে সেকেন্ড অফিসারের কিছুটা গোপন দস্তি আছে জাহাজিরা জানে। তার সঙ্গে ইচ্ছে করলে নেমে যেতে পারি। কারণ আমি এমনিতেই বেস ফর্সা। জাহাজে উঠে সমুদ্রের নোনা হাওয়ায় রঙ আরও খুলে গেছে। সাহেবের স্বজাতি বলে চালাতে কষ্ট হবার কথা নয়। ইচ্ছে করলে নেমে যেতে পারি। ঘুরে আসতে পারি। কিন্তু ওই যত গেড়ো ইসানুল্লা সারেঙ। তার চোখে ফাঁকি দেওয়া কঠিন। আর কিনারায় নেমে যদি শেষে ধরা পড়ে যাই তবে আর এক কেলেঙ্কারি। সাত পাঁচ ভেবেই পোর্ট অফ সালফারেও নামা হল না।
আর এতে নিজের ভিতরে সেই চিরন্তন নাবিকের নেশা যে আরও পাক খেয়ে উঠছে বুঝতে কষ্ট হত না। তা না হলে বোধহয় এত মরিয়া হয়ে উঠতাম না।
সালাফার নিয়ে আবার পাড়ি দিতে হবে দূর সমুদ্রে। মাসখানেক, কি তারও ওপর জাহাজ ক্রমাগত সমুদ্রে ভেসে চলবে। কেবল লিখলেন যেতে আমরা পানামা ক্যানেলের দু-পাশের ডাঙা দেখতে পাব। এছাড়া শুধু দিনরাত সমুদ্র, নীল আকাশ, ঝড় জল আর মাঝে মাঝে সমুদ্র পাখিদের ওড়াউড়ি দেখা।
জাহাজ পোর্ট অফ সালফার থেকে দড়ি-দড়া খুলে দিল। মোহনা থেকে জাহাজ ভেসে পড়েছে সমুদ্রে। জাহাজের পেছনে উড়ে আসছে সব সমুদ্রপাখি। ডানা সাদা, হলুদ ঠোঁট কবুতরের মতো দেখতে বিশাল আকারের পাখিগুলি টানা কতদিন যে জাহাজের পেছনে উড়ে চলবে আমরা জানি না।
কখনো-কখনো দু-এক জোড়া পাখি আমাদের জাহাজের মাস্তুলে এসেও বসে থাকত। তাদের সঙ্গে আমরা কথাও বলতাম—বেশ আছ তোমরা, তোমার নারী তোমার পাশেই বসে আছে, উড়ছে। ঢেউ-এর মাথায় বসে সমুদ্রে ভেসে যাচ্ছে। তোমাদের হিংসা হয়। এমনই কথাবার্তা হত পাখিরা এসে মাস্তুলে বসে থাকলে।
জাহাজ তখন গভীর সমুদ্রে। খুব একটা ঝড়ঝাপ্টা নেই। কাজ সামাল দিতে কষ্ট হয় না। অবলীলায় কাজ কাম সেরে শিষ দিতে দিতে সিঁড়ি ভাঙতে পারি। উঠতে পারি বোট-ডেকে। শরীর দানবের মতো মজবুত হয়ে উঠেছে। হাতে পায়ের পেশি শক্ত হয়ে গেছে। সমুদ্র আমাকে অজ্ঞাতেই তার মতো সহনশীল করে নিতে পেরেছে। স্বাধীন হতে শিখিয়েছে। আমার ব্যক্তিগত অভিরুচির ওপর কারও খবরদারি একদম আর সহ্য করতে পারছি না।
এক রাতে সারেঙ আমাকে ডাকলেন। তিনি সেদিন আমাকে নিয়ে উপরে উঠে গেলেন না। দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে। খোপকাটা লুঙ্গি পরনে। মাথায় সাদা টুপি। গায়ে ফতুয়া।
তিনি বললেন, তুই নাকি ফুল নিবি বলেছিস!
নেব বলেছি।
সারেঙ সাবের মুখ থম থম করছে ক্ষোভে দুঃখে। তিনি বললেন, তুই নিবি!
হ্যাঁ নেব।
তুই নিবি বলতে পারলি। তোবা আল্লা! বলে সারেঙ সাব দরজা বন্ধ করে দিলেন মুখের ওপর।
নীচে এসে দেখি বন্ধু আমার ফোকসালে বসে চা খাচ্ছে।
বন্ধুকে দেখেই ক্ষেপে গেলাম। আসলে আমি সারেঙ-এর তপ্লিবাহক, আমার বেশিদূর যাবার ক্ষমতা নেই কারণ সারেঙ সাব যখন ডেকে পাঠিয়েছেন, আমার ক্ষমতার দৌড় শেষ—এবং এসব ভেবেই সে মজা পাচ্ছিল, কিংবা মজা দেখার জন্যই আমার ফোকসালে ঢুকে বসে আছে। বললাম, তুই এখানে কেন!
না দেখতে এলাম, সাধু পুরুষের কী সাধ যায়।
না পেরে বললাম, কেন ফুল নিতে পারি না!
পারবি না কেন! পারবি। তবে শেষ পর্যন্ত পারবি কি না জানি না। সারেঙ সাব মাথার ওপর আছেন ত।
সবই কেমন বিদ্রুপের মতো শোনাচ্ছে। আমি বললাম, ঠিক আছে, যা। এখন আমি শোব।
ওপরের বাংক খালি দেখে বন্ধু আমার ফোকসালে চলে আসবে বলেছিল। কিন্তু সারেঙ সাব রাজি হননি। রাজি না হবার কারণ পরে বুঝতে পেরেছি। দেশের খত কতজনার আমি লিখে দিই। দরকারে সারেঙ সাবের। আমার ফোকসালে অন্য কেউ থাকলে অসুবিধা। খতে কত ব্যক্তিগত কথা থাকে। এসব কথা দশকান হলে মন্দ ব্যাপার। সারেঙ সাব সেই ভেবেই হয়তো বন্ধুকে আমার ফোকসালে উঠে আসতে দেয়নি। এখন বুঝতে পারছি না দিয়ে ভালোই করেছেন। ইচ্ছেমতো দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়তে পারি। পেছনে লাগার কেউ নেই।
তাছাড়া বন্ধু এলে লকারটার ভাগ দিতে হত। জাহাজে আস্ত একটা ফোকসাল, একটা লকার একজন জাহাজির ভাবাই যায় না। লকারটা পুরো আমার। ওতে আমার কোট-প্যান্ট, কিছু গরম জামা কাপড়, রেশনের কনডেনসড মিল্ক, চা, চিনি, আর মার জন্য তুষের মতো নরম কম্বলটা আছে।
বন্ধুও দেখি বেশ ক্ষেপে আছে। বলল, সারেঙ সাবের এটা বাড়াবাড়ি। আমরা কী ভূত! এ ভাবে পারা যায়। তারপর বলল, তুই বুঝিয়ে বললে হয়তো রাজি হবে।
আমি আবার কী বুঝিয়ে বলব। কিছু বলতে পারব না। যা।
মাথা গরম করছিস কেন। সবাই আশা করে আছে।
থাকুক। আমি পারব না। ওঠ আমার বাংক থেকে। ওঠ বলছি। আচ্ছা তুই কিরে, ঘড়ি দেখে বললাম, দুটো ঘণ্টাও নেই, পরিতে যেতে হবে। একটু শুতেও দিবি না।
ওর কেন জানি কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। সে বাংকের নীচ থেকে একটা টব বের করে গবাগুব বাজাতে থাকল। আর গান। ওর গলা ভাল, হঠাৎ এত প্রসন্ন হবার কারণ কি বুঝতে পারলাম না। সে কী ভেবেছে কে জানে যাই হোক মনে আছে গাইছিল, ও ফুল তুমি ফোট না ক্যানে, ফুলরে আমার কেশের চুল।
আসলে গানটি যে বাংলা সিনেমার, কবি’ বই এর বুঝতে কষ্ট হল না। গানটি হবে, কালো যদি মন্দ তবে, কেশ পাকিলে কান্দ ক্যানে। সেই সুরেই গাইছিল শুধু শব্দ কিছু, কিছু কেন প্রায় সবটাই পালটে দিয়ে ফুলের লাইনে চলে এসেছে। কেশের লাইনে আর থাকেনি।
ওর গান শুনে আমিও হেসে ফেলেছিলাম।
তখনই যেন বন্ধু সাহস পেয়ে গেল। বলল, জানিস সারেঙ সাব ক্ষেপে গেছেন। বলছেন, না কেউ জাহাজে উঠতে পারবে না। ছোটোটিন্ডালকে ডেকে ফতোয়া জারি করে দিয়েছেন।
বুঝলাম, ছোটোটিন্ডাল তালিকায় আমার নাম রেখেই ভুল করেছে। আমি না থাকলে, তালিকাটিতে তার আপত্তি ছিল না। পানামা খালে কে উঠে এল, কে নেমে গেল, তা নিয়েও বোধ হয় ভাবতেন না। সারেঙ সাব হুকুম জারি করে দিয়েছেন। ক্যানেলে কাউকে তোলা যাবে না।
রাত দশটা বেজে গেছে। রাত বারোটায় আমার ওয়াচ। বন্ধুর কী বুদ্ধি সুদ্ধি নেই বসেই আছে। উঠছে না! আর তখনই দেখি ছোটোটিন্ডাল দলবল নিয়ে এসে হাজির। আমার মতো ওরাও সবাই ফুলের গাহেক।
যদি সারেঙ সাব ক্যানেলে কোনো নারী জাহাজে তোলার অনুমতি না দেন, তবে আমিই তার জন্য দায়ী।
ছোটোটিন্ডাল বলল, এই নাও টাকা। হবে না।
বাদবাকি বলল, কেন হবে না। সারেঙ কী ভেবেছে।
আমি বললাম, ঠিক আছে দাও। এবারে সারেঙ সাব হয়তো রাজি হয়ে যাবেন। গিয়ে বল, বনাৰ্জী ফুল নেবে না বলেছে।
জাহাজ তখন লেমন-বেতে ঢুকবে। আর দু-দিন বাকি। আমি পড়লাম মহাফাঁপড়ে।
ছোটোটিন্ডাল এসে বলল, না, সারেঙ সাবের এক কথা হবে না।
আমিও চোটপাট শুরু করে দিলাম, কেন হবে না। অন্য জাহাজে কি হয়ে থাকে! জাহাজিদের মেজাজ মর্জি বুঝতে হবে না। আমিতো ফুল নেব না বলেছি। তবে আর আটকাচ্ছেন কেন!
ছোটোটিন্ডাল বলল, তুই একটু বুঝিয়ে বললে হবে। জানিস গরিব গুরবো মেয়েগুলোর এই একটা উপার্জনের পথ। জাহাজিদের কছে টিউলিপ ফুল বিক্রি করে কিছু পয়সা রোজগার করে। ওতেই ওদের চলে। দুটো খেতে পায়। জাহাজ দেখলে, কত আশা নিয়ে থাকে।
বিষয়টা আমার কাছে তখনও খুব যে পরিষ্কার ছিল বলতে পারব না। আসলে ভেবেছিলাম, ওর ফুল বিক্রি করতে উঠে আসা। জাহাজ প্রশান্ত সাগরে পড়ার আগে আবার নেমে যায়। ফুল নিয়ে ডেকে সামান্য রং রসিকতা হতে পারে—কিংবা কারও গরজ থাকলে, সহবাসও হতে পারে—তবে এ-নিয়ে জাহাজিদের মাথা ব্যথা থাকার কথা না। কাপ্তানেরও না। কাপ্তানতো সব সময় চান, জাহাজিরা কিনারায় এনজয় করুক। বরং না করলেই দুশ্চিন্তায় কারণ—অনন্ত অসীম সমুদ্রে জীবন। হাতে নিয়ে ঘোরাঘুরি, একটু বেচাল না হলে চলবে কেন!
বাধ্য হয়ে উঠে পড়লাম। সারেঙ সাবের দরজায় টোকা মারতেই তিনি দরজা খুলে দিলেন। সব শুনে বললেন, যা খুশি কর। আমার কি। ইমান কে-কার রক্ষা করে। বন্দরে নেমে কে কোথায় যাস আমার জেনে দরকার নেই। আমার তোদের সঙ্গে কাজ নিয়ে কথা। কাজ পেলেই হল।
আসলে এ ব্যাপারে সারেঙ সাবেরও কোনো এক্তিয়ার নেই, না করার। দীর্ঘ সমুদ্র সফরে কোনও জাহাজি বন্দরে না নামলেই ভয়। একঘেয়ে সমুদ্রযাত্রায় কেউ কেউ পাগল পর্যন্ত হয়ে যায়। তাদের নেমে ফুর্তিফার্তা না করলে এটা বেশি হবার কথা। তবে জাহাজিদের বলতে গেলে সর্বময় কর্তা সারেঙ সাব। তাকে সমীহ না করলে জাহাজিদেরও ইজ্জত থাকে না। তিনি অনুমতি দিতেই সবাই হা হা করে লাফিয়ে সিঁড়ি ধরে উপরে উঠে গেল। শিস দিল কেউ। কেউ রাত দুপুরে রঙের জব নিয়ে বসে গেল। ডুবাডুব বাজনা আর সমস্বরে গান। মুহূর্তে জাহাজিদের চেহারাই পালটে গেল।
দু-দিন বাদে সাঁঝবেলায় দেখি সারেঙ সাব আমার ফোকসালে উঁকি দিয়ে কী দেখছেন। আমি উঠে বসলাম। তিনি সাধারণত অন্য ফোকাসালে ঢোকেন না। উঁকিও দেন না। একমাত্র দরকারে আমার ফোকসালে গলা বাড়িয়ে কথা বলেন। তার দেশে চিঠি লেখার প্রয়োজন হলে এটা করে থাকেন।
বললাম, কিছু বলবেন চাচা?
তিনি বললেন, শুয়ে থাকলি। উপরে উঠে যা। পানামা ক্যানেলে জাহাজ ডুকে যাচ্ছে। কী করে জাহাজটাকে টিলায় তুলে দিচ্ছি দেখবি না!
আমি বুঝি তিনি আমাকে নিয়ে বিশেষ ভালো নেই। তাঁর অহরহ দুশ্চিন্তা। একজন নতুন জাহাজিকে এ-ভাবে দমিয়ে রাখা সুবিবেচনার কাজ কি না তাই নিয়েও দ্বন্দে পড়ে গেছেন। তাঁর অশ্বস্তি বুঝি। বললাম, যাচ্ছি।
তাঁর মুখ ভারি প্রসন্ন হয়ে গেল। বললেন, যা বাবা যা। শুয়ে থাকিস না। শুয়ে থাকলে মন খারাপ থাকে।
সারেঙ সাবের কথা ভেবে আমার চোখ জলে ভারি হয়ে গেল।
আসলে, শুয়েছিলাম-ডাঙা দেখলে বাড়ি ঘরের জন্য মন বড়ো বেশি খারাপ হয়ে যায়। এতক্ষণ ওপরেই বসেছিলাম। দুটো লকগেট পার হবার পর কিছুই কেন জানি না ভালো লাগছিল না। একটার পর একটা লক গেটে ঢুকে জাহাজ যেন সিঁড়ি ভাঙছে। জাহাজ উপরে উঠে যাচ্ছে ক্রমে। সামনে বিশাল কৃত্রিম হ্রদ। পাহড়ের উপত্যকায় এই কৃত্রিম হ্রদের সৃষ্টি জাহাজ পারাপারের জন্য। গাছপালা কোথাও দ্বীপের মতো ভেসে আছে।
জাহাজ কাপ্তানের জিম্মায় নেই। জ্যোৎস্না রাত। দূরের জলরাশি এবং পাহাড়ের ছোটোখাটো ঢিবি চোখে পড়ছিল।
জাহাজ পাইলটের জিম্মায়। সে খাড়ি ধরে জাহাজ নিয়ে যাচ্ছিল।
ডেকের ওপর বসে মনে হচ্ছিল, জাহাজটা যেন পুৰ-বাংলার বর্ষাকালে নদী মাঠ কিংবা গ্রাম গঞ্জ ফেলে চলে যাচ্ছে। এখানে ওখানে ঝোপ জঙ্গল, টিলা, কলাগাছ, কচুগাছ। বুনো ফুলের গন্ধ পর্যন্ত পাচ্ছিলাম ডেকে বসে। এই প্রথম দেখলাম জাহাজের সার্চ লাইট জ্বলছে।
আর কেন যে সে-সময় বাড়ির কথা, মা-বাবা, ভাইবোনের কথা ভেবে চোখে জল চলে আসছিল। মনটা এতই দমে গেছিল যে আর বসে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। নীচে নেমে শুয়ে পড়েছিলাম। সারেঙ সাবের বোধ হয় সতর্ক নজর এড়াতে পারিনি। তিনি সিঁড়ি ধরে নেমে আমাকে শুয়ে থাকতে দেখে ঘাবড়ে যেতে পারেন।
অগত্যা আবার উপরে যেতে হল। ভাণ্ডারির গ্যালিতে ভিড়। কেউ আর নীচে নেই। একমাত্র এনজিন রুমের পরিচালকরা নীচে কয়লা হাকড়াচ্ছে। জাহাজের স্টিম খুব বেশি দরকার ছিল না। বড়ো বেশি টিমে তালে জাহাজ চালানো হচ্ছে।
উঠে দেখলাম, আমাদের আগে যে জাহাজটা যাচ্ছিল, ওটা সামনের ঝোপ জঙ্গল টিলার-ওপাশে হারিয়ে গেছে। কেমন স্বপ্নের মতো দূরাতীত ছবি—মগ্ন হয়ে যেতে হয়।
মেসরুমের পাশে একটা বেঞ্চিতে বসে আছি। আর সব জাহাজিরা আমার পাশে বসে গল্পগুজব করছে। তারা সবাই অপেক্ষা করছে, কখন ফুলওয়ালিরা সব উঠে আসবে।
তারা ফুল দেবে। মাত্র একটি করে টিউলিপ ফুল। ফুল তাদের চুলে গোঁজা থাকে। জাহাজিরা যে যার পছন্দমতো ফুল নেবে। মাত্র এক ডলার।
এক ডলার তখনকার সময়ে বেশ দাম।
আর এ-সময়ই দেখলাম লক-গেটের দিক থেকে একটা ডিঙি নৌকা ভেসে আসছে।
জাহাজটি থেমেছিল কেন তা অবশ্য তখন জানতাম না। জাহাজটা হঠাৎ স্ট্যান্ড বাই হয়ে গেল।
এখন আর সব ঠিক ঠাক মনেও করতে পারছি না। দুটো কারণ থাকতে পারে। হয়ত কাপ্তান জাহাজিরা নারী সঙ্গ পায় বলে, থামাবার অনুমতি দিতে পারেন, হয়তো দূরবর্তী জাহাজের কোনো সিগনালিং দেখে জাহাজ থেমে যেতে পারে। অথবা, এই জায়গাটায় এলে কোনো কারণে জাহাজকে দাঁড়িয়ে পড়তেই
দেখছি তর তর করে দড়ির সিঁড়ি বেয়ে কারা উপরে উঠে আসছে। জাহাজিরাই হল্লা জুড়ে দিয়েছে। সবাই প্রায় ছুটছিল। প্রাচীন নাবিকেরা শুধু চুপচাপ বসেছিলেন। তাঁরা যাননি। বরং তাঁরা জাহাজিদের গালমন্দ করছিলেন।
দেখছি গাউন পরা কজন নারী।
ছোটোটিল্ডালর মাতববরি শুরু হয়ে গেছে। কেউ বেশি বেলেল্লাপনা করলে ধমক-ধামক দিচ্ছে।
গাউন পরা ক’জন নারী যেন জাহাজটার প্রাণ। বেশ সাড়া পড়ে গেছে। ওরা খোলা ডেকে দাঁড়িয়ে আছে। আমি নিজেও বসে থাকতে পারলাম না। ছুটে গেছি। যারা ফুল নিবে বলে কথা দিয়েছে, তারা বেশ সামনে ঝুঁকে দেখছে।
আমার নামও ছিল। তবে নামটা কাটা। এক একজন যে যার ফুল নিয়ে জাহাজের ঘুপটি অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। আমাদের ছোটোটিল্ডাল মোল্লা, তার চাই সব চেয়ে তাজা ফুল। সেই কিনারার লোকের সঙ্গে দরদাম করে এদের তুলে এনেছে। তার হক আছে। সে সবচেয়ে কচি খুকিটির খোপার ফুল তুলে নিতেই মেয়েটা কেমন কুঁকড়ে গেল!
মেয়েগুলো প্রায় সবাই রদ্দি—ওদের শরীর মুখ দেখে টের পেলাম। মাস্তুলের আলোতে মুখ স্পষ্ট। ঠোঁট ভারি, চুল তোঁকড়ানো। তামাটে রং। কম বেশি সব নারীরাই মাঝারি বয়সের। দু-চারজন যুবতী এবং তরুণীও দলে আছে। ওদের কদর বেশি হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু সব চেয়ে তাজা তরুণীটিকেই ছোটোটিন্ডাল পাকড়েছে।
ছোটোটিন্ডাল হাত ধরতে গেলে মাথা গোঁজ করে দাঁড়িয়ে থাকল মেয়েটা। পছন্দ নয়। সে তার ফুল ফেরত নিতে চায়। খুবই নিয়মের বাইরে বলে, বুড়ি মতো মেয়েটা ধমকাচ্ছে।
ছোটোটিন্ডাল বেটপ। গোলগাল গাট্টাগোট্টা মানুষ। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। এই নরম উষ্ণতা যেন ছোটোটিন্ডালের পাল্লায় পড়লে তছনছ হয়ে যাবে। খুব খারাপ লাগছিল। ইস নাম কেটে দিয়ে কী যে ভুল করেছি। কারণ মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে ভরসা খুঁজছিল। কিন্তু সারেঙ সাবের জন্য ভরসা দেবার মতো ক্ষমতাও আমার নেই। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে কথা বলে। সবাই বুঝতে পারছিলাম। কিছু করার নেই। মনটা দমে গেল। ডেক ধরে ফিরে আসছি। মেসরুম পার হয়ে দেখি সারেঙ সাব দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে একা দেখে বেশ আশ্বস্ত।
সারেঙ সাব আমার পেছনে সিঁড়ি ধরে নামছেন। কাঠের সরু সিঁড়ি। একজনের বেশি নামা যায় না। তিনি হঠাৎ কেন যে বসেছিলেন, আজও তার রহস্য স্পষ্ট নয়–কারণ আমি তালিকায় ছিলাম না, তবু কেন যে বলেছিলেন, কি রে পছন্দ হল না।
যেন মজা করছেন।
পছন্দ অপছন্দের চেয়েও আমার মনে হচ্ছিল এরা রুগ্ন। অর্থাভাব প্রচণ্ড। হত দরিদ্র হলে যা হয়। না হলে এত কম বয়সে একজন কিশোরী জাহাজে উঠে আসে! ঠোঁট ভারি হলে কী হবে, ভারি মিষ্টি দেখতে।
আর এসব সময়ে কেন যে আমার মা-র কথা বেশি মনে পড়ত, ভাইবোনদের কথা বেশি মনে পড়ত-কিছু তখন ভালো লাগত না। বাংকে এসে চুপচাপ শুয়ে পড়লাম।
জাহাজটা ভোর রাতের দিকে সামনের লকগেটে গিয়ে পড়বে। এই সাত-আট ঘণ্টা উষ্ণতায় ভরিয়ে রাখবে জাহাজিদের। শুয়ে শুয়ে এ-সবই ভাবছিলাম।
আর তখনই দেখি সারেঙ সাব নিজেই চলে এসেছেন। মানুষের মনে কখন যে কি উদয় হয়, কে যে কি ভাবে না হলে সারেঙ সাব আমাকে এসেই বা খবরটা দেবেন কেন।
এই ওঠ। মেয়েটা কাঁদছে।
কাঁদছে কেন!
কে জানে! যা একবার। জাহাজে আবার ঝামেলা না হয়।
তারপর সারেঙ সাব নিজেই সব কেন যে খুলে বলেছিলেন, তার মাথামুণ্ডু বুঝছি না। বললেন, ছোটোটিন্ডাল নাছোরবান্দা। মেয়েটা কিছুতেই রাজি নয়। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আয়তো দেখি। এত ভালো কথা না! ছোটোটিন্ডাল বুড়িকে শাসাচ্ছে। অফিসাররাও বাদ নেই। নিজেদের ঘরে লকগেট থেকেই মেয়েমানুষ তুলে নিয়েছে। নেটিভদের কাণ্ড-কারখানা দেখতে হবে ভয়ে এলি-ওয়ের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।
কাছে গিয়ে হতবাক। সত্যি ফুঁপিয়ে কাঁদছে মেয়েটা। একদম নড়ছে না। নড়ানো যাচ্ছে না। শত হলেও এ-সব যৌন অভ্যাস মানুষের গোপনেই থাকবার কথা। আর তখন একটা ছোটো পরির মতো মেয়ে যদি ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে, শেষে আবার কোন কেলেঙ্কারিতে পড়ে যেতে হবে কে জানে! মেয়েটা তার খোঁপার ফুল কিছুতেই ছোটোটিন্ডালকে দেয়নি।
আর আশ্চর্য তখন কিনা সারেঙ সাব আমার দিকে তাকিয়ে বলছেন, দেখতো ফুলটা তোকে দেয় কিনা! চেয়ে দেখ।
আমি কেমন বিব্রত বোধ করছিলাম। আমার নামেতো কোনো টাকা জমা নেই। আমার কাছে কোনো ডলারও নেই। আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না।
সারেঙ সাবই বললেন, চেয়ে দেখ না। দাঁড়িয়ে থাকলি কেন?
আরও অবাক, হাত পাততেই মেয়েটা চুল থেকে ফুল খুলে আমার হাতে দিয়ে দিল। লজ্জায় মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে। একজন বালিকার স্বভাব যেমন হয়ে থাকে—সবার সামনে সে যেন কিছুতেই আর মুখ তুলে তাকাবে না।
খুব কাছ থেকে বুঝলাম, চোদ্দো পনেরোও হবে না তার বয়স। ছোটোটিন্ডাল ক্ষেপে গিয়ে শেষে বুড়িকে নিয়েই অন্ধকারে হারিয়ে গেল।
সারেঙ সাব বললেন, যা, ফোকসালে নিয়ে যা। বসিয়ে রাখ। ঘাটে নামিয়ে দেওয়া যাবে।
মেয়েটির আত্মসম্মান রক্ষার্থে তিনি হয়তো আর কোনো রাস্তা খুঁজে পাননি। আমার ওপর দায় চাপিয়ে রেহাই পেতে চান। সারারাত তো আমি তাকে ডেকে পাহারা দিতে পারি না—অগত্যা আফটার পিকের দিকে হাঁটা দিলাম। আফটার পিকের ওপরে এনজিন এবং ডেক-জাহাজিদের গ্যালি। সঙ্গে মেসরুম। তার পাশ দিয়ে কাঠের সিঁড়ি ধরে নেমে গেলে প্রথমে দু-পাশে পড়বে ডেক সারেঙ এবং এনজিন সারেঙের ফোকসাল। এখানেই দুটো রাস্তা দু-দিকে নেমে গেছে। একটা গেছে পোর্ট-সাইডে অন্যটা স্টাববার্ড-সাইডে যেখানে থাকি আমরা। ইনজিন জাহাজিরা। নীচে নামলেই আমার ফোকসাল।
সে আমাকে অনুসরণ করছে বুঝতে পারছি।
কী যে করি।
ফোকসালে ঢুকে যেতেই দেখি সেও পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
বললাম, কী নাম?
ভাঙা ইংরেজিতে কথা বলতে পারে। বুঝতেও পারে সব। নাম বলল, লেসি।
এই নারীর সঙ্গে ইচ্ছে করলেই এখন যৌন সংসর্গ করা যায়। সে তার খোঁপার ফুল দিয়ে তা বুঝিয়ে দিয়েছে। উত্তেজিত হয়ে পড়ছিলাম। নিজেকে দমন করতে পারছি না। কী ভেবে এক লাফে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে গেলাম। দেখি সারেঙ সাব দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন। আমার ওপর মেয়েটির ভার চাপিয়ে দিয়ে তিনি নিশ্চিন্ত দরজা বন্ধ দেখেই তা টের পেলাম।
ফোকসালে ঢুকে পড়লাম ফের। বেশ হাপাচ্ছি। মেয়েটিও আমার পাশে বসে পড়ল।
আমার হাত পা কাঁপছে। গলা শুকিয়ে উঠছে। কী যে বিড়ম্বনায় পড়া গেল। জল তেষ্টা পাচ্ছে। কী করব ঠিক করতে পারছি না। তারপরই মনে হল, আমার ত টাকা নেই যৌন সংসর্গ করার জন্য কোম্পানির ঘর থেকে ডলারও তুলিনি। নাম কেটে দিয়েছি বলে তার প্রয়োজনও হয়নি। মেয়েটি টাকার বিনিময় ছাড়া আমার সঙ্গে যৌন-সংসর্গ করবে কেন! যাক বাঁচা গেল।
বললাম, লেসি, তুমি নীচের বাংকে শুয়ে থাক। উপরের বাংকে আমি উঠে যাচ্ছি।
লেসি কথা বলছে না। অপলক তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কী করুণ চোখ মুখ! বললাম, চা খাবে?
ঘাড় কাত করে জানাল, খাবে।
বোসো।
লকার খুলে দুধ চিনি চা বের করে উপরে উঠে গেলাম। গ্যালিতে দু-গ্লাস চা বানালাম। তারপর গ্লাস দুটো হাতে নিয়ে নীচে নেমে এলাম। নামার সময় শুনতে পেলাম, ইমানুল্লা চাচা কোরান পাঠ করছেন ফোকসালে। তখনই কেন যে এক অপার্থিব পৃথিবীর খোঁজ পেলাম ভেতরে। মনে হল শরীরই সব নয়। অর্থের বিনিময়ে কেউ এ-কাজ করলে প্রেম ভালোবাসা কিংবা জীবনের রহস্যময় উষ্ণতা মরে যায়।
নীচে নেমে ওকে চা দিলাম। পাউরুটি দিলাম। খুব আগ্রহ নিয়ে খাচ্ছে। তার হাঁটুর ওপরে গাউন উঠে এসেছিল। সে বার বার পাতলা গাউন টেনে হাঁটু ঢেকে দেবার চেষ্টা করছে। চোখের মণি দুটোতে আলো পড়ায় তাকে বড়োই মায়াবী মনে হচ্ছিল—কিংবা কোনো দূরবর্তী সংকেত-অথচ আমি তার সঙ্গে সারাক্ষণ বাড়ি ঘরের গল্প করলাম।
লেসি জানাল, তার বাবা নেই। মা থেকেও নেই। কোন এক খামারে কাজ করত। সেখান থেকে নিখোঁজ। মেয়েটির ধারণা, অভাবের তাড়নাতেই মা কোথাও চলে গেছেন। ভাইবোনদের দুটো পেট ভরে খেতে দেবার জন্য সে এও লাইনে নতুন এসেছে। লোকটাকে দেখে ওর ভয় ধরে গিয়েছিল বলে কাঁদছিল।
সবারই আজ কিছু না কিছু উপার্জন হবে অথচ লেসিকে শুধু হাতে ফিরে যেতে। হবে। লেসির দুর্ভাগ্যের কথা ভেবে ভীষণ খারাপ লাগছিল।
আমার নিষ্ক্রিয় কথাবার্তায় লেসি বোধ হয় অস্বস্তি বোধ করছিল। দরজা –র বার দরজার দিকে তাকাচ্ছিল।
আমি মাথা নীচু করে বললাম, তোমার ছোটো ভাইটার কত বয়স?
জানি সে আমার কোনো কথা শুনতে চায় না। শোনার আগ্রহ নেই। ভাই-এর কী বয়স শোনানোর জন্য জাহাজে উঠে আসেনি। সে খুবই চঞ্চল হয়ে উঠছিল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, দরজাটা বন্ধ করে দিন না।
না।
কেন না।
না। বলছি তো।
আমি বন্ধ করে দিচ্ছি।
না।
কেন যে এত একগুঁয়ে হয়ে উঠেছিলাম, আজও তার সঠিক ব্যাখ্যা পাই না। বরং হাসি পায়, আমার পাপবোধের কথা ভেবে। নাকি তার কোনো ব্যাধি আছে এই ভয়ে কাছে যাইনি! অথচ এত সুন্দর যে নারী, যে যৌন-সংসর্গের বিনিময়ে পয়সা রোজগার করতে এসেছে তাকে আমি সত্যি ঘৃণা করছি। তা ত নয়। বরং আমার মনে হয়েছে এমন নারী জীবনে সত্যি দুর্লভ। অথচ আমি কেমন বিপাকে পড়ে গেছি। পাপ-পুণ্য কি বুঝতে পারছি না। কোম্পানির ঘর থেকে টাকা তুলে রাখলেও হত। অন্তত যৌন সংসর্গ না করি হাতে টাকাটা দিতে পারতাম। তাও আমার সম্বল নেই।
লেসিও মরিয়া হয়ে উঠেছে। বলছে, আমার কোনো অসুখ নেই। মা মেরির দিব্যি। বলে সে দাঁড়িয়ে গাউন খুলে ফেলতে গেলে আমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলাম।
তুমি রাগ করছ?
মুখ না তুলেই বললাম, না।
তবে আমাকে দেখছ না কেন? দরজা বন্ধ করে দিলাম। দেখছি তো!
না, তুমি দেখছ না। তুমি আমার কিছুই দেখছ না। প্রায় আমাকে ঝাঁকিয়ে দিয়ে বলল, কেন তবে ফুল নিলে। বল কেন নিলে। আমাকে কেন অপমান করলে! ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকল।
কী বলি! সত্যি ফুল নেওয়ার অর্থই তো গ্রহণ করা। আমি লেসির দিকে না তাকিয়েই বললাম, তুমি খুব সুন্দর। গাউনটা পরে ফেল। আমারও ভাইবোন আছে। তাদের বাঁচাবার জন্য এতদূরে জাহাজে কাজ নিয়ে চলে এসেছি।
তারপরই লকার খুলে বললাম, দেখতো কম্বলটা কেমন হয়েছে! শীতের সময় মা-র খুব কষ্ট। শীতে মা কষ্ট পান বলে এটা কিনে দিয়েছি! ভালো হয়নি।
ও দেখে আমার কী হবে। সে মুখ ফিরিয়ে আরও বিরক্ত প্রকাশ করে ফেলল। তারপরই কেমন চিৎকার করে বলার মতো, কেন ওসব দেখাচ্ছ। আমি তোমার মা-র কম্বল দেখতে জাহাজে উঠে আসিনি। প্লিজ। তুমি আমাকে আর খাটো করো না।
আমিও কেমন পাগলের মতো বলছিলাম, লেসি প্লিজ গাউনটা পরে ফেল। তোমার দিকে তাকানো যাচ্ছে না।
লেসি তখন উন্মত্তের মতো বলে যাচ্ছে, না, না, তুমি আমাকে ঘৃণা করছ। আমি মনে কর কিছু বুঝি না। আমার সত্যি কোনো রোগ নেই।
সে আমার সামনে এসে দাঁড়ালে আমার মা-এর কম্বলটা দিয়ে ওর নগ্ন শরীর ঢেকে দিয়ে বললাম, পাগলামি করো না। গাউনটা পরে ফেল।
সে এবার আমার হাত টেনে ধস্তাধস্তি শুরু করে দিয়েছে। বলছে, আর দেরি নেই। আমাদের নামিয়ে দেবে। শিগগির কর। আর যাই কর, তুমি আমাকে প্লিজ ঘৃণা করো না।
বললাম, লেসি আমি তোমার উপার্জনে সাহায্য করতে পারলাম না। দুঃখিত। এটা নাও। তোমকে দিলাম। ঘৃণা করলে আর যাই করি মার জন্য কেনা কম্বলটা তোমাকে দিতে পারতাম না।
সে কম্বলটা নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরল।
বলল, সত্যি দিচ্ছ।
হ্যাঁ। কেন বিশ্বাস হচ্ছে না!
এত দামি কম্বল! আমি যে তোমাকে কিচ্ছু দিতে পারলাম না।
বললাম, কেন ফুলইতো দিয়েছ। এর চেয়ে সুন্দর পবিত্র আর কী থাকতে পারে। একজন পুরুষতো নারীর কাছে এর চেয়ে বেশি কিছু পেতেও চায় না।
দেখি লেসি কাঁদছে। কম্বলে মুখ লুকিয়ে হাউ হাউ করে কাঁদছে।
এই অপরাহ্ন বেলায় আজকাল মেয়েটির মুখ কেন যে এত বেশি মনে পড়ছে তাও জানি না। যৌন সংসর্গ না করলেও সেদিনই জীবনে প্রথম যৌন সম্ভোগ কী টের পেয়েছিলাম। অপরাহ্ন বেলায় তাও মনে করতে পারি।