টারজান ও ওপারের ধনরত্ন (টারজান এ্যাণ্ড দি জুয়েলস অফ ওপার)
লর্ড গ্রেস্টোক, ওরফে টারজান একদিন তার আফ্রিকার বিরাট জমিদারী তদারক করে ফিরে আসার পরই বাংলো থেকে দেখতে পেল একদল লোক জঙ্গল প্রান্তের ফাঁকা মাঠটা পার হয়ে তার বাংলোর দিকেই এগিয়ে আসছে।
আধ ঘণ্টার মধ্যে মঁসিয়ে ফ্রেকুলত নামে একজন ভদ্রলোক টারজনের বাংলোতে এসে বলল, আমি জঙ্গলের মধ্যে পথ হারিয়ে ফেলেছি। আমার ভাগ্যবলে আমি ঈশ্বরের বিধানে এখানে এসে পড়েছি।
ঠিক হলো মঁসিয়ে ফ্রেকুলত তার লোকজন নিয়ে কিছুদিন এই বাংলোতে থাকবে। তারপর টারজনের লোকেরা তাকে পথ দেখিয়ে দিয়ে আসবে। এইভাবে একজন ভদ্র শিকারীর ছদ্মবেশে টারজানকে ঠকিয়ে ওয়ারপার আশ্রয় পেয়ে গেল তার বাংলোতে।
ওয়ারপার আসার পর থেকে এক সপ্তাহ কেটে গেল। কিন্তু তার পরিকল্পনা কার্যকরী করার কোন উপায় খুঁজে পেল না। কিন্তু একদিন একটা ঘটনা ঘটল যাতে সে একটা আশার আলো খুঁজে পেল।
সেদিন বিকেলে টারজান জেনের সঙ্গে আলোচনা করতে লাগল তার পড়ার ঘরে বসে। ওয়ারপার বারান্দা থেকে তাদের কথাবার্তা শুনতে পেল।
টারজান বলল, এত সহজ পথ আর নেই। এখন ওপারে গিয়ে সেখানকার গুপ্তভাণ্ডার থেকে কিছু সম্পদ আনতেই হবে। তবে খুবই সাবধানে একাজ করব। ওপারের অধিবাসীরাও আমার যাওয়ার ব্যাপারটা জানতে পারবে না।
পরদিন সকালে ওয়ারপার টারজানকে বলল, সে এবার ফিরে যাবে। টারজান তাতে রাজী হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে।
পরদিন ওয়ারপার তার দলবল আর একজন ওয়াজিরি পথ-প্রদর্শক নিয়ে রওনা হয়ে গেল বাংলো থেকে। কিছুদূর যাওয়ার পরই ওয়ারপার অসুস্থতার ভান করে এক জায়গায় শিবির স্থাপন করে রয়ে গেল। তারপর টারজনের ওয়াজিরি পথ-প্রদর্শককে বলল, এখন তুমি যাও। আমি সুস্থ হলে তোমাকে ডেকে পাঠাব।
ওয়ারপার তখন আচমেতের একজন বিশ্বস্ত নিগ্রো ভৃত্যকে ডেকে বলল, তুমি টারজনের গতিবিধি লক্ষ্য করে এস।
পরের দিন দূত ফিরে এসে ওয়ারপারকে বলল, টারজান তার পঞ্চাশজন ওয়াজিরি অনুচর নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে যাত্রা করেছে সেই দিনই সকালে।
কথাটা শোনার পর আচমেত জেককে একটা চিঠি লিখে লোক মারফৎ আচমেত জেকের কাছে চিঠি পাঠিয়ে দিল। তারপর ছয়জন কুলি আর ছয়জন সাহসী বলবান যোদ্ধা সঙ্গে নিয়ে গোপনে টারজনের পিছু পিছু তাকে অনুসরণ করে যেতে লাগল একটু দূর থেকে।
সেদিন রাত্রিতে টারজান পথের ধারে লতাপাতা ও কাঁটাগাছের একটা শিবির তৈরি করে ঘুমিয়ে পড়ল।
পরদিন সকালে যখন টারজান তার দলবল নিয়ে যাত্রা শুরু করল তখন ওয়ারপারও রাত্রির বিশ্রামের পর তার শিবির থেকে তাকে অনুসরণ করার জন্য বেরিয়ে পড়ল।
অনেকটা পথ যাওয়ার পর বনের প্রান্তে এক শূন্য উপত্যকায় এসে উপনীত হলো টারজান। সেই উপত্যকাটার ওপারে অনেক সোনার গম্বুজওয়ালা ওপার নগরী। টারজান ঠিক করল রাত্রিবেলায় সে একা গিয়ে কোথায় সোনা আছে তার সন্ধান করে আসবে।
রাত্রি হতেই টারজান তার দল নিয়ে একটা পাহাড়ে উঠে পাহাড়টার ওপারে চলে গেল।
ওয়ারপার লক্ষ্য করল টারজান একটা খাড়াই উঁচু পাথরের উপর উঠে পড়ল। পরে ওয়ারপার অতি কষ্টে উঠল সেখানে।
ওয়ারপার দেখল বড় পাথরটার ওদিকে কতকগুলো পাথরের সিঁড়ি রয়েছে। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গিয়ে একটা অন্ধকার সুড়ঙ্গের মুখ দেখতে পেল।
এদিকে টারজান সেই অন্ধকার সুড়ঙ্গপথটা ধরে অনেকটা এগিয়ে যাবার পর একটা কাঠের দরজার সামনে এসে হাজির হলো। দরজাটা চাপ দিয়ে খোলার সঙ্গেই সঙ্গে ধনাগারটা পেয়ে গেল সে। টারজান দেখল ঘরটার চারদিকের দেওয়ালে অসংখ্য সোনার তাল সারবন্দীভাবে সাজানো আছে থরে থরে।
টারজান তার লোকদের ডাকার জন্য একবার ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ওয়ারপার তাকে দূর থেকে লক্ষ্য করে অন্ধকারে সরে গেল।
সুড়ঙ্গপথ পার হয়ে পাহাড়টার উপরে উঠে সিংহের গর্জনের মত জোর চীৎকার করে তার ওয়াজিরি লোকদের ডাকল। কিছুক্ষণের মধ্যেই দূর থেকে ওয়াজিরি সর্দার বাসুলি চীৎকার করে সাড়া দিল তার ডাকে।
টারজান আবার সেই ধনাগারে ফিরে এসে সোনার তালগুলো বয়ে নিয়ে গিয়ে সুড়ঙ্গপথের প্রান্তে সেই পাথরটার উপর রাখল। সে ভাবল বাসুলিয়া এসে পৌঁছবার আগে যতদূর সম্ভব কাজ এগিয়ে রাখবে।
বাসুলি নগর প্রাচীরের ওধারে এসে পড়লে টারজান দড়ি দিয়ে তাদের পাথরের উপর তুলে নিল। তারপর তাদের সকলকেই ধনাগারে নিয়ে গেল। এবার টারজান ওয়াজিরিদের প্রত্যেকের হাতে সোনার তাল দিয়ে শেষ বারের মত ধনাগারটা একবার ভাল করে দেখে নিল। তারপর যে বাতিটা সে হাতে করে এই ঘরে জ্বেলেছিল সে বাতিটা নিভিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিল।
এদিকে টারজান ধনাগার থেকে বার হয়ে সুড়ঙ্গপথে কিছুটা এগোতেই পিছন থেকে অদৃশ্যভাবে ওয়ারপার ধনাগারে ঢুকে সেই সোনার তালগুলোকে আশ্চর্য হয়ে দেখতে লাগল।
এমন সময় অকস্মাৎ বজ্রপাতের মত জোর একটা শব্দ হলো। টারজান তখন সুড়ঙ্গপথে যাচ্ছিল। সহসা সেই জোর শব্দের সঙ্গে সঙ্গে ছাদ ভেঙ্গে একটা পাথর তার মাথার উপর পড়ায় তার মাথার কিছুটা কেটে গেল আর সঙ্গে সঙ্গে সে অচৈতন্য হয়ে পড়ে গেল মাটির উপর।
আসলে তখন অল্প সময়ের মধ্যে জোর একটা ভূমিকম্প হয়।
ওয়ারপার প্রথমে টারজনের রেখে যাওয়া মোমবাতিটা জ্বালল। তারপর বাতিটা হাতে ধরে দরজার বাইরে আসতেই দেখল টারজনের অচৈতন্য দেহটা পড়ে রয়েছে সামনে। বাতির আলোতে আরও দেখল ভূমিকম্পের ফলে সুড়ঙ্গপথে অনেক বড় বড় পাথর পড়ে থাকায় পথ একেবারে বন্ধ।
তখন ওয়ারপার নিরুপায় হয়ে ধনাগারের মধ্যে ঢুকে অন্য কোন দরজা আছে কি না তার খোঁজ করতে লাগল। হঠাৎ দেখতে পেল ঘরটার পিছন দিকের দেওয়ালে একটা দরজা আছে। সেই দরজাটা খুলে একটা অন্ধকার সুড়ঙ্গপথ পেল সে। সেই পথে যেতেই সামনে একটা পাঁচিল পেল। পাঁচিলটার ওপারেও এই পথটা নিশ্চয় চলে গেছে। এই ভেবে বাতির আলোয় ওয়ারপার দেওয়ালটা পরীক্ষা করে দেখল পাথরের কতকগুলো হঁট সাজানো আছে দেওয়ালটাতে। ওয়ারপার কতকগুলো ইট সরিয়ে তার ওপারে যাবার মত পথ করে নিল।
আবার এগিয়ে চলল ওয়ারপার। অল্প কিছুটা গিয়েই সে দেখল তার সামনে একটা ঠাকুরের বেদী রয়েছে। বেদীটা পাথরের এবং তার উপরে রক্তের দাগ রয়েছে। বুঝল এখানে অতীতের অনেক মানুষকে বলি দেয়া হয়েছে। সে আরও দেখল বেদীর পিছন দিকে কয়েকটা দরজা রয়েছে।
কিন্তু একটা দরজা খুলে ওয়ারপার বাইরে বেরোতে যেতেই এক সঙ্গে প্রায় একডজন দরজা খুলে গেল আর সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো বেঁটে বেঁটে ভয়ঙ্কর আকৃতির লোক বাইরে থেকে ঢুকে পড়ল উঠোনটায়।
ভয়ে চীৎকার করতে করতে যে পথে এসেছিল সেই পথে পালাবার চেষ্টা করল ওয়ারপার। কিন্তু তার মতলব বুঝতে পেরে সেই সব ভয়ঙ্কর চেহারার পুরোহিতরা ধরে ফেলল তাকে। তারা ওয়ারপারকে বেঁধে ফেলে মন্দিরের ভিতরের দিকের ঘরটার মেঝের উপর ফেলে দিল। এরপর প্রধান পূজারিণী না। খগড় হাতে বেদীর সামনে এসে দাঁড়াল। ওয়ারপার বুঝতে পারল একটু পরেই তার দেহনিঃসৃত রক্ত ওদের অমানবিক রক্ত পিপাসা নিবৃত্ত করবে।
এমন সময় একটা ভয়ঙ্কর গর্জন শুনে চমকে উঠল ওয়ারপার। অনেকে ভয়ে পালিয়ে গেল। প্রধানা পূজারিণীর হাত থেকে খগড় পড়ে গেল, সে ওয়ারপারের পাশে মূৰ্ছিত হয়ে পড়ল। ওয়ারপার কোনরকমে পাশ ফিরে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল মন্দিরের মাঝখানে কোথা থেকে একটা সিংহ এসে একজন পুরোহিতকে ধরেছে।
ছাদ থেকে ধসে পড়া পাথরের আঘাতে টারজান অনেকক্ষণ মরার মত শুয়ে রইল। মাথায় জোর আঘাত লাগায় মাথা থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল তার। আর অতীতের কথা সব ভুলে গিয়েছিল সে।
ধীরে ধীরে উঠে বসল টারজান। কিন্তু এখানে কখন কিভাবে এল, সে কে তার কিছুই মনে করতে পারল না।
টারজনের কোমরে একটা থলি ছিল। সেই থলিটাতে যতগুলো পারল রংবেরঙের মণি-মাণিক্য ভরে নিল। তারপর সেই ঘরটা পেরিয়ে আবার সুড়ঙ্গ পথটা ধরে এগিয়ে যেতে লাগল। সুড়ঙ্গ পথটা যেখানে শেষ হয়েছে টারজান সেখানে গিয়ে কয়েকটা সিঁড়ি পেল। সিঁড়ি দিয়ে উঠে যেতেই একটা সিংহের গর্জন শুনতে পেল সে। সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো নর-নারীর সমবেত ভয়ার্ত চীৎকার কানে এল তার। টারজান তার বর্শাটা হাতে শক্ত করে ধরল।
টারজান দেখল একটা সিংহ মন্দিরের মাঝখানে বেদীর উপর শোয়ানো হাত পা বাঁধা এক হতভাগ্য বন্দীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে আর মন্দিরের পুরোহিত ও পূজারিণীরা প্রাণ ভয়ে ছোটাছুটি করছে। টারজান দেখল তার সামনে বেদীর ধারে একজন মহিলা পূজারিণী দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সে যে প্রধান পূজারিণী লা তার স্মৃতিবিভ্রম ঘটায় সে বুঝতে পারল না।
ওয়ারপার হাত পা বাঁধা অবস্থায় শুয়ে শুয়ে দেখল সিংহটা তার উপর ঝাঁপ দেবার জন্য উদ্যত হয়েছে। টারজানও সঙ্গে সঙ্গে তার বর্শটা সিংহের বুকটাকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দিল। সিংহটা গর্জন করতে করতে বর্শার ফলাটা নিয়ে কামড়াকামড়ি করতে করতে তার নতুন শত্ৰু টারজানকে আক্রমণ করল। এবার টারজান সিংহের উপর উঠে তার ঘাড়টা জড়িয়ে ধরে ছুরিটা বার বার তার পাঁজরে বসিয়ে দিতেই সিংহটা লুটিয়ে পড়ল।
ওয়ারপার এবার টারজানকে চিনতে পারল।
টারজান একে একে লা ও ওয়ারপারকে খুঁটিয়ে দেখল। কিন্তু সে কাউকে চিনতে পারল না।
এদিকে প্রধান পূজারিণী লা টারজনের পানে ভাল করে তাকিয়ে আশ্চর্য হয়ে বলল, টারজান তুমি? তুমি অবশেষে আমার কাছে ফিরে এসেছ?
টারজান বলল, আমি টারজান? ঠিক আছে নামটা ভালই মনে হচ্ছে। কিন্তু আমি তোমাকে চিনি না। আমি তোমার জন্য এখানে আসিনি। কেন আমি এখানে এসেছি তা আমি জানি না। কোথা থেকে এসেছি তাও জানি না।
ওয়ারপার এবার ব্যাপারটা বুঝতে পারল। বুঝল টারজনের মাথায় আঘাত লাগায় পূর্ব স্মৃতি তার একেবারে লোপ পেয়েছে।
ওয়ারপার তাই টারজনের প্রশ্নের উত্তরে বলল, কোথা থেকে তুমি এসেছ তা ত আমি বলত পারব না। তবে আমি শুধু এইটুকুই বলতে পারি যে এখান থেকে আমরা যদি এখনি বেরিয়ে না যাই তাহলে আমাদের দুজনকেই মরতে হবে।
তখন টারজান ওয়ারপারের বাঁধন কেটে দিয়ে বলল, চল তাহলে আমরা এখনি পালিয়ে যাই।
এই বলে একটা দরজা দিয়ে টারজান বার হতেই প্রতিটা দরজার মুখেই কয়েকজন করে ভয়ঙ্কর চেহারার বেঁটে বেঁটে পুরোহিত পথ আগলে দাঁড়াল। টারজনের সামনে যে লোকটা দাঁড়িয়েছিল পথরোধ করে টারজান তার বর্শা দিয়ে তার মাথায় জোর একটা আঘাত করতে তার মাথাটা ভেঙ্গে গেলে। এরপর যেই কাছে আসতে লাগল টারজান তাকেই বধ করতে লাগল।
অনেক খোঁজাখুঁজির পর নগরপ্রাচীরের মধ্যে একটা বার হবার পথ পেল টারজান। স্মৃতিবিভ্রমটা তখনো কাটেনি টারজনের। সে কে এবং কোথা থেকে এসেছে, কোথায় তাকে যেতে হবে কিছুই জানে না সে। ওয়ারপর তাকে কোনরকমে বুঝিয়ে বাংলোর পথে নিয়ে যেতে লাগল।
সেদিন রাত্রিতে তাদের ছোট্ট শিবিরে আগুনের আলোয় টারজান তার থলিটা খুলে সেই রত্নগুলো আবার দেখতে লাগল। ওয়ারপর তাকে জিজ্ঞাসা করল সে কোথায় ওগুলো পেয়েছে। টারজান তার উত্তরে বলল, ওপার নগরীর মন্দিরের তলায় একটা ঘরে সে এগুলো পেয়েছে। কিন্তু ওগুলো রংবেরঙের কতকগুলো পাথর ছাড়া আর কিছুই নয়।
ওয়ারপার দেখল টারজান ঐসব রত্নগুলোর দাম জানে না। এ বিষয়ে তার কোন ধারণা নেই। ফলে সেগুলো তার কাছ থেকে নিয়ে নেয়া সহজ হবে। ওয়ারপার টারজানকে বলল, আমাকে ওগুলো একবার দেখতে দাও।
টারজান তখন সেগুলোর উপর একটা হাত চাপা দিয়ে পশুর মত দাঁত বার করে তেড়ে এল ওয়ারপারকে।
ওয়ারপার ভাবল, সে যেমন করে হোক টারজনের দৃষ্টি এড়িয়ে আচমেত জেকের কাছে চলে যাবে। দুটো কারণে সে যেতে পারছিল না। প্রথম কথা, তার হাতে মাত্র একটা খঙ্গ ছাড়া আর কোন অস্ত্র নেই। এই ভীষণ জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বিনা আগ্নেয়াস্ত্রে পথ চলা অসম্ভব। তাছাড়া মূল্যবান ধাতুগুলো ছেড়ে যেতে মন সরছিল না তার।
ওপার থেকে বার হবার পর তিন দিনের দিন টারজান পথে যেতে যেতে তাদের পিছন দিক থেকে আসতে থাকা কিছু লোকের পায়ের শব্দ শুনতে পেল।
ঝোপের আড়াল থেকে তারা দেখল পঞ্চাশজন কৃষ্ণকায় নিগ্রো দুটো করে হলুদ রঙের সোনার তাল বয়ে নিয়ে আসছে। ওয়ারপর তাদের দেখে বুঝতে পারল এই লোকগুলোকেই টারজনের সঙ্গে ওপার নগরীর পথে যেতে দেখেছে সে। কিন্তু সে দেখল টারজান বাসুলি ও ওয়াজিরিদের চিনতে পারল না।
ওয়ারপার ভাবল, ওয়াজিরিরা ঠিক টারজনের বাংলোর দিকে যাবে এবং সোনার তালগুলো বাংলোর কাছাকাছি কোথাও রাখবে। সেই জায়গাটা ও দেখে নেবে। তাহলে আচমেত জেককে নিয়ে এসে সেই সোনা সহজেই উদ্ধার করে নিয়ে যেতে পারবে।
এইভাবে অনেকক্ষণ ধরে অনুসরণ করে বাংলোটার কাছে গিয়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল ওয়ারপার। বাংলোটার এখানে সেখানে কিছু ধ্বংসস্তূপ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেল না সে। বিরাট খামারবাড়িরও কোন চিহ্ন নেই। সে যেন নিজের চোখকে নিজেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। কিন্তু টারজান কিছুই চিনতে পারল না।
বাংলোর কাছে গিয়ে তার অবস্থা দেখে বাসুলি আর ওয়াজিরিরাও হতবুদ্ধি হয়ে গেল।
বাসুলি তার লোকদের বলল, আরবরাই নিশ্চয় এ কাজ করেছে।
একজন ওয়াজিরি বলল, আমাদের লেডী কোথায়?
টারজনের স্ত্রী লেডী গ্রেস্টোককে তারা লেডী বলত। বাসুলি বলল, আমাদের মালিকের স্ত্রী ও আমাদের স্ত্রীদের ধরে নিয়ে গেছে আরবরা।
ওয়াজিরিরা তখন প্রতিশোধ বাসনায় উন্মত্ত হয়ে উঠল।
বাসুলি বলল, এখন কাজের সময় বৃথা চীৎকার করে লাভ নেই। এখন কিছু খাওয়ার পর আরবদের সন্ধানে বেরিয়ে যেতে হবে আমাদের। নইলে আমাদের স্ত্রীদেরও উদ্ধার করতে পারব না।
বনের আড়াল থেকে টারজান আর ওয়ারপার দেখল বাংলোর কাছে একটা বড় খাল কেটে সোনার তালগুলো সব পুঁতে রাখল ওয়াজিরিরা। তারপর একটা অস্থায়ী শিবির গড়ে তুলে বিশ্রাম করতে লাগল।
টারজান অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল। তারপর যখন বুঝল ওয়ারপার সত্যি সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছে। তখন মাটি খুঁড়ে তার মধ্যে রত্নভরা থলিটা রেখে মাটি চাপা দিয়ে দিল। ওয়ারপার তা দেখল।
অনেকক্ষণ পর ওয়ারপার চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল টারজান ঘুমিয়ে পড়েছে। তখন সে তার খড়টা দিয়ে সেই জায়গার মটি খুঁড়ে থলিটা বার করে নিয়ে নিজের পকেটে ভরে রাখল।
ওয়ারপার একবার ভাবল যাবার আগে তার হাতের খটা দিয়ে ঘুমন্ত টারজনের গলাটা কেটে দিয়ে যাবে।
এই ভেবে ঘুমন্ত টারজনের গলার উপরে তুলে ধরল তার হাতের খাটা।
এদিকে মুগাম্বিও আরবদের খোঁজে পথ চলে চলে শিবিরের কাছে এসে দেখে ওয়ারপার ছেঁড়া ময়লা পোশাক পরে হাঁপাতে হাঁপাতে সেই গাছের তলা দিয়ে শিবিরের দিকে যাচ্ছে। প্রথমে সে ওয়ারপারকে দেখেই চিনতে পারে। এই শ্বেতাঙ্গই তাদের মালিক বড় বাওনার বাড়িতে একদিন অতিথি হিসেবে ছিল। তাকে দেখে ডাকতে যাচ্ছিল সে।
কিন্তু মুগাম্বি যখন দেখল ওয়ারপার স্বচ্ছন্দে আরবদের শিবিরে ঢুকে গেল এবং শিবিরে সবাই তাকে চেনে তখন সে বুঝতে পারল আসলে সে বিশ্বাসঘাতক। সে খবর দেয়াতেই বড় বাওনার অনুপস্থিতিতে আরবরা বাংলো আক্রমণ করে তাদের প্রভুপত্নীকে ধরে নিয়ে আসে এবং বাংলো আর খামারটা পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়।
আচমেত জেকের তাঁবুতে ওয়ারপার ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তাকে দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল আচমেত। বলল, কি ব্যাপার?
ওয়ারপার টারজনের কাছ থেকে যে মুক্তোর থলিটা চুরি করে আনে তার কথা ছাড়া যা যা ঘটেছিল সব বলল। থলিটা সে সাবধানে লুকিয়ে রেখেছিল। সোনার তালগুলো বাংলোর পাশে ওয়াজিরিরা পুঁতে রেখেছে শুনে আচমেতের লোভ বেড়ে গেল। ওয়ারপার আরো জানাল ওয়াজিরিরা তার শিবির আক্রমণ করতে আসছে।
আচমেত বলল, আগে ওরা আসুক। ওদের সবাইকে হত্যা করার পর সোনাগুলো তুলে আনার কাজ খুবই সহজ হবে।
ওয়ারপার বলল, টারজনের স্ত্রীকে কি করবে?
আচমেত বলল, ওকে উত্তরাঞ্চলের কোন দেশে বিক্রি করে দেব। মোটা দাম পাওয়া যাবে।
ওয়ারপার ভাবল আচমেতকে বলে তার মত করে সে লেডী গ্রেস্টোককে নিয়ে উত্তরের দিকে রওনা হয়ে তার মুক্তির পথ করে নেবে।
সে তাই আচমেতকে বলল, কে তাকে নিয়ে যাবে উত্তর দিকে?
আচমেত জেক ভেবে বলল, তুমিই লেডী গ্রেস্টোককে নিয়ে রওনা হয়ে যাও। আমি নিজে যাব গুপ্তধনের সন্ধানে। আমাদের সকলেরই আপন আপন কাজ হয়ে গেলে এখানেই আবার দেখা হবে।
এক সময় তাঁবুতে কেউ নেই দেখে কোমর থেকে মুক্তোর থলিটা বার করে সেগুলো গুণতে লাগল। ওয়ারপার। এমন সময় দেখল দরজার বাইরে থেকে আচমেত জেক তাকে দেখছে। ওয়ারপার এবার ভয়। পেয়ে গেল। বুঝতে পারল আর তার পরিত্রাণ নেই। আচমেত জেক যখন মুক্তোগুলো দেখতে পেয়েছে তখন সে সেগুলো কেড়ে নিয়ে তাকে হত্যা করবে তার বিশ্বাসঘাতকতার জন্য। তাই রাতের অন্ধকারে শিবির থেকে গোপনে বেরিয়ে গেল ওয়ারপার।
এদিকে গভীর রাতে আচমেত একটা ছুরি নিয়ে ওয়ারপারের তাঁবুতে ঢুকে বারবার বিছানাটার উপর তার ছুরিটা বসাতে লাগল। কিন্তু যখন সে দেখল ওয়ারপার বিছানায় নেই, পালিয়ে গেছে, তখন সে। সবাইকে ডেকে ঘোড়ায় চেপে বেরিয়ে পড়ল ওয়ারপারের খোঁজে।
মুগাম্বি শিবিরের কাছে একটা গাছের উপর পাতার আড়াল থেকে সবকিছু দেখছিল। আরবরা সবাই বেরিয়ে পড়লে গাছ থেকে নেমে শিবিরে গিয়ে তাদের প্রভুপত্নী জেনের খোঁজ করতে লাগল। কিন্তু লেডী জেনকে কোথাও দেখতে পেল না।
ঘুমন্ত টারজনের গলা কাটার জন্য ওয়ারপার উদ্যত হতেই অদূরে একটা সিংহের শব্দ পেয়ে পালিয়ে গেল। ঝোপঝাড় ভেঙ্গে সিংহটা যখন এগিয়ে আসছিল তখন তার শব্দে টারজান জেগে ওঠে ঘুম থেকে।
কিন্তু সিংহটা কি মনে করে পিছন ফিরে বনের মধ্যে ঢুকে গেল। টারজান এবার খেয়াল করে দেখল তার সঙ্গী কাছে নেই। সে একবার ভাবল তার সঙ্গী ওয়ারপার হয়ত সিংহের ভয়ে পালিয়ে গেছে।
পরদিন টারজান যখন একটা গাছের উপর শুয়ে ঘুমোচ্ছিল তখন তারই সন্ধানে ওপার নগরীর মন্দিরের প্রধান পূজারিণী লা পুরোহিতদের এক সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে সেইখানে চলে আসে।
পুরোহিতদের প্রত্যেকেরই হাতে একটা করে ছুরি আর একটা করে খাঁড়া ছিল। লা-এর দলে যে ক’জন বাঁদর-গোরিলা ছিল তাদের মধ্যে একজন বাতাসে গন্ধ শুঁকে বলল, সেই বড় শ্বেতাঙ্গ বাঁদরটা একটা গাছে ঘুমোচ্ছে, আমরা তাকে মেরে ফেলতে পারি।
এই বলে ওরা পা টিপে টিপে বনের ভিতর দিয়ে গিয়ে একটা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে দেখল সেই গাছের একটা ডালে টারজান তখনো ঘুমোচ্ছিল। তিনটে বাঁদর-গোরিলা গাছের উপর উঠে গিয়ে টারজানকে ধরে মাটিতে ফেলে দিল। তারপর সকলে মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ল টারজনের উপর। তখন লা এসে হুকুম করল, ওকে মেরো না, বেঁধে ফেল। তারপর আমার কাছে নিয়ে এস।
ক্রমে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এল বনভূমিতে। শিবিরের ভিতরে হাত পা বাঁধা অবস্থায় শুয়ে থাকা টারজনের সামনে ছুরি হাতে পায়চারি করতে লাগল লা। লা একবার বড় গলায় টারজানকে বলল, আমাদের দেবতার খড় নিয়ে পালিয়ে এসেছ তুমি। সে খড়া কোথায়? টারজান বলল, আমার সঙ্গে যে লোকটা ছিল সে, তা নিয়ে পালিয়েছে। আমাকে ছেড়ে দিলে আমি তাকে ধরে আনতে পারি এবং খটাকে ফিরিয়ে দিতে পারি। সেকথা শুনে লা হেসে উঠল হো হো করে।
সন্ধ্যে হতেই লা টারজনের পাশে ছুরি হাতে পায়চারি করতে করতে এক সময় বসে ছুরির তীক্ষ্ণ ডগাটা টারজনের পাঁজরের উপর ঠেকিয়ে অল্প অল্প করে চাপ দিতে লাগল। কিন্তু তাকে মারতে গিয়েও মারতে পারল না।
পরদিন সকালে পুরোহিতদের সমবেত স্তোত্রগানের শব্দ কানে আসতে ঘুম ভেঙ্গে গেল টারজনের। পরে লা-এর ঘুম ভাঙ্গল। ঘুম ভাঙ্গার সঙ্গে সঙ্গে লা চীৎকার করে তার লোকদের ডাকল, কই, জ্বলন্ত দেবতার পুরোহিতরা এস। বলিদানের জন্য প্রস্তুত হও।
আদেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই অদ্ভুত চেহারার পুরোহিতগুলো লা-এর শিবিরের মধ্যে ঢুকে টারজানকে ধরে বাইরে নিয়ে এল।
ছুরিটা হাতে তুলে এগিয়ে এল লা। টারজান নীরবে মৃত্যুর জন্য প্রতীক্ষা করতে লাগল।
এমন সময় জঙ্গলে একটা হাতির শব্দ শোনা গেল। টারজানও জোরে অদ্ভুতভাবে একটা চীৎকার করল। এবার সবাই দেখল জঙ্গলের ঝোপঝাড় ভেঙ্গে একটা হাতি গর্জন করতে করতে ক্রমশই এগিয়ে আসছে। এবার লা টারজনের মুখপানে তাকিয়ে বুঝতে পারল টারজানই চীৎকার করে হাতিটাকে ডেকেছে এবং তাকে উদ্ধার করার জন্য হাতিটা আসছে।
টারজান বলল, হাতিটা আসছে। প্রথমে ভেবেছিলাম ও আমাকে উদ্ধার করতে আসছে। কিন্তু এখন ওর ডাক শুনে বুঝেছি ও পাগলা হয়ে গেছে। এখন ও আমাকে বা যাকে পাবে তাকেই মেরে ফেলবে।
লা বুঝল, টারজান ঠিকই বলেছে। সে অসহায়ভাবে পাথরের প্রতিমূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইল। টারজান বলল, দেখ লা, এখনো সময় আছে, তুমি আমার বাঁধন খুলে দাও। আমি তোমাকে বাঁচাব।
লা দেখল উন্মত্ত হাতিটা ডালপালা ভেঙ্গে ক্রমশই তীব্র বেগে এগিয়ে আসছে।
লা তার পুরোহিতদের বলল, তোমরা সবাই পালাও।
এই কথা বলেই লা টারজনের বাঁধনগুলো সব কেটে দিল। সঙ্গে সঙ্গে পুরোহিতরা চীৎকার করে উঠল। তারা সবাই ছুটে এল লা-এর দিকে।
প্রধান পুরোহিত তার হাতের খাড়া উঁচিয়ে লাকে বলল, বিশ্বাসঘাতক, নাস্তিক, অধর্মাচারী বন্দীকে তুমি ছেড়ে দিলে। এর জন্য তোমাকেও মরতে হবে।
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে লাকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে এল টারজান। সে প্রধান পুরোহিতের হাত থেকে খাঁড়াটা কেড়ে নিয়ে তাকে শূন্যে তুলে ধরে সজোরে পুরোহিতদের মাঝখানে ছুঁড়ে ফেলে দিল।
এমন সময় পাগলা হাতিটা সেখানে এসে হাজির হলো। টারজান সঙ্গে সঙ্গে লাকে তুলে নিয়ে শূন্যে লাফ দিয়ে আর একটা গাছে চলে গেল। এইভাবে গাছে গাছে অনেকটা দূরে চলে গেল।
হাতিটা তখন আর কাউকে না পেয়ে চলে গেল।
হাতিটা অনেক দূরে চলে গেলে টারজান লাকে নিয়ে গাছ থেকে নেমে পড়ল। বলল, তোমার পুরোহিতদের ডাক।
লা বলল, ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।
টারজান বলল, আমি যতক্ষণ আছি কেউ তোমার গায়ে হাত দিতে পারবে না। ওদের ডাক, আমি কথা বলব ওদের সঙ্গে।
লা পুরোহিতদের ডাকতেই তারা টারজনের কাছে এসে দাঁড়াল। টারজান তখন ওদের বলল, তোমাদের প্রধান পূজারিণী লা এখন নিরাপদ। সে আমাকে হত্যা করলে সে বাঁচতে পারত না এবং তোমাদের অনেকেই মারা যেত। আমিই তাকে বাঁচিয়েছি। এবার তাকে নিয়ে তোমরা দেশে ফিরে যাও। আমি আবার জঙ্গলে ফিরে যাব। তাছাড়া তোমরা তোমাদের রানীর আদেশ অবশ্যই মেনে চলবে। তাকে নিয়ে ওপারে চলে যাও। যদি একথায় রাজী না হও তাহলে আমি জঙ্গলের সব জন্তুদের ডাকব। তারা এসে তোমাদের সকলকেই মেরে ফেলবে।
পুরোহিতরা টারজনের কথায় রাজী হয়ে গেল, কারণ তারা সত্যি সত্যিই ভয় পেয়ে গিয়েছিল।
ওরা চলে যেতেই টারজান গাছের উপর উঠে দূরে চলে গেল।
ওয়ারপার টারজনের কাছ থেকে পালিয়ে যাবার দুদিন পর মুক্তার থলিটার কথা মনে পড়ল টারজনের। তার মনে পড়ল সেটা সে এক জায়গায় মাটির ভিতর পুঁতে রেখেছে। তখন সেখানে গিয়ে ঠিক সেই জায়গাটা ছুরি দিয়ে খুঁড়ল। কিন্তু থলিটা পেল না টারজান। সে বুঝতে পারল ওয়ারপারই তার থলিটা চুরি করে নিয়ে পালিয়ে গেছে। তাই সে আর অপেক্ষা না করে সোজা পলাতক চোর ওয়ারপারের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ল।
যেতে যেতে এক আরব শিবিরের সন্ধান পেল। টারজান যখন আরবদের শিবিরের কাছে গিয়ে পৌঁছল তখন শিবিরের কাছাকাছি একটা গাছ থেকে বাতাসে গন্ধ শুঁকে বুঝল সে যার খোঁজ করছে সেই ওয়ারপার এই শিবিরেই আছে।
গাছের উপর পাতার আড়ালে বসে অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করল টারজান। তারপর যখন রাত গম্ভীর হল, শিবিরে লোক চলাচল বন্ধ হয়ে গেল, তখন গাছ থেকে নেমে পড়ল টারজান।
একটা ঘরের সামনে এসে ওয়ারপারের কিছুটা গন্ধ পেল সে। কিন্তু টারজান তাঁবুর একটা দিক তুলে ভিতরে প্রবেশ করে দেখল ঘরের মধ্যে কেউ নেই।
তখন সেই কুঁড়েটা থেকে বেরিয়ে টারজান শিবির সংলগ্ন আদিবাসীদের বস্তিতে চলে গেল। সেখানে একটা ঘরের কাছে এসে আবার পলাতক ওয়ারপারের কিছুটা গন্ধ পেল সে। গুঁড়ি মেরে ঘরটার মধ্যে ঢুকে দেখল ঘরটার পিছন দিকে একটা লোক বার হবার মত ফাঁক রয়েছে। বুঝল ঐ ফাঁকটা দিয়ে কিছু আগে ওয়ারপার পালিয়ে গেছে।
ঘর থেকে বেরিয়ে আবার সে গন্ধের সূত্র ধরে ওয়ারপারের খোঁজে এগিয়ে যেতে লাগল।
ওয়ারপার সেদিন রাতে তাঁবু থেকে বেরিয়েই জেন যে কুঁড়েটাতে বন্দী হয়ে ছিল সেই কুঁড়েটার সামনে সোজা চলে যায়। কিন্তু ঘরের ভিতর ঢুকেই ওরপার দেখল সেখানে জেন নেই। ওয়ারপার বুঝল লেডী জেন পালিয়ে গেছে।
লেডী জেন চলে যেতে ওয়ারপারের আশা নির্মূল হয়ে গেল। সে ভেবেছিল লেডী জনের মত এক সম্ভ্রান্ত ব্রিটিশ মহিলা কাছে থাকলে পূর্ব উপকূলভাগে ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোর সাহায্যে পূর্ব ইউরোপে চলে যাবে।
যাই হোক, ঘর থেকে বেরিয়ে ওয়ারপার বনে যাবার পথ ধরল। তারপর বনে গিয়ে পূর্ব দিকে এগিয়ে যেতে লাগল।
ওয়ারপার যেতে যেতে এক সময় পিছন ফিরে দেখল একজন আরব অশ্বারোহী তার খোঁজ করতে আসছে। আরবটাকে দেখেই একটা গাছের উপর উঠে ঘন পাতার আড়ালে লুকিয়ে পড়ল।
পথের ধারে যে গাছটার উপর বসে ছিল ওয়ারপার সে গাছটার উল্টো দিকে দেখল ঝোপের ধারে একটা সিংহ শিকারের আশায় ওৎ পেতে বসে আছে। কিন্তু হঠাৎ একজন অশ্বারোহী কাছে এসে পড়ায় তার নজর পড়ল সেই অশ্বারোহী আরবটার উপর।
সিংহটা আরবটার উপর লাফ দিতেই ঘোড়াটা লাফিয়ে ওয়ারপারের কাছাকাছি চলে এল। ওয়ারপার তখন সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়াটার শূন্য পিঠে উঠে তীরবেগে ঘোড়াটাকে ছুটিয়ে চলে গেল।
এদিকে যে পথে মুগাম্বি আর ওয়ারপার যাচ্ছিল সেই পথের ধারে এক জায়গায় আবদুল মুরাকের নেতৃত্বে একদল আবিসিনীয় সৈন্য শিবির খাঁটিয়ে বিশ্রাম করছিল। ওয়ারপার না জেনে ঘোড়া ছুটিয়ে সোজা সেই শিবিরে গিয়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে তাকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করার পর তাকে ঘোড়া থেকে নামিয়ে বন্দী করে শিবিরে রেখে দেয়া হলো।
আবিসিনীয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবায় মেনেলেক নামে যে সম্রাট ছিল আবদুল মুরাক ছিল তারই অধীনস্থ এক সামরিক অফিসার। আচমেত জেক মাস দুয়েক আগে মেনেলেকের রাজ্যে তার আদেশ অমান্য করে ক্রীতদাস ধরতে গিয়েছিল বলে তাকে ধরার জন্য মুরাকের অধীনে একদল সৈন্য পাঠিয়ে দেয় মেনেলেক।
ওয়ারপার বন্দী হবার পর মুগাম্বি শিবিরের কাছাকাছি বনের ভিতরে এক জায়গায় লেডী’ ‘লেডী’ বলে চীৎকার করে উঠতেই কয়েকজন সৈনিক তার ডাক শুনে তাকে ধরে নিয়ে আসে, মুগাম্বি মুরাককে বলে সে এক স্থানীয় আদিবাসী এবং শিকারের জন্য বনে এসেছে। সুতরাং ছেড়ে দেয়া হোক। কিন্তু মুরাক দেখল মুগাম্বির মত এক শক্ত সমর্থ নিগ্রোকে ধরে নিয়ে গিয়ে সম্রাটের হাতে তুলে দিলে সে খুশি হবে তার উপর। এই ভেবে মুগাম্বিকেও বন্দী করে রেখে দেবার হুকুম দিল। মুগাম্বি ওয়ারপারকে দেখে তাকে মঁসিয়ে ফ্ৰেকুল হিসেবে চিনতে পারল। কিন্তু কোন কথা বলল না।
এদিকে ওয়ারপার যখন কথায় কথায় মুরাকের মুখ থেকে জানতে পারল আচমেত জেক তাদের শত্রু তখন সে বলল, সে আফ্রিকার জঙ্গলে শিকারে এসেছিল দলবল নিয়ে। কিন্তু পথে আচমতে জেকের লোকেরা তার দলের লোকদের অনেককে হত্যা করে বাকি লোকদের ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে।
তবু ওকে ছাড়ল না মুরাক। ওয়ারপার মুরাককে বলল, আচমেত জেকের কাছে অনেক আরব সৈন্য আছে আর সে তার সেনাদল নিয়ে এই দিকেই আসছে। সেকথা শুনে মুরাক তার লোকদের পরদিন সকালেই শিবির গুটিয়ে দেশে রওনা হতে হুকুম দিল। সঙ্গে ওয়ারপার আর মুগাম্বিকেই বন্দী অবস্থায় নিয়ে যাবে ঠিক করল।
পরদিন সকালে রওনা হবার সময় মুরাক দেখল তার শিবির থেকে গতরাতে পালিয়ে গেছে মুগাম্বি। ওয়ারপার তার পকেটে হাত দিয়ে দেখল তার মুক্তার থলিটা ঠিকই আছে।
আচমেত জেক তার দু’জন সহচরকে নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে ওয়ারপারের খোঁজ করতে করতে বনের মধ্যে একটা ফাঁকা জায়গার ধারে চলে এসেছিল। তার মন মেজাজ মোটেই ভাল ছিল না। ওয়ারপার তাকে ফাঁকি দিয়ে তার চোখে ধুলো দিয়ে চলে গেছে। তার উপর তার মুক্তার থলিটাও নিয়ে গেছে।
জঙ্গলে কিসের একটা খস্ খস্ শব্দ শুনে আচমেত জেক তার সহচরদের একটা ঝোপের আড়ালে লুকোতে বলে নিজেও লুকিয়ে রইল।
সহসা দেখল গাছের আড়াল থেকে এক নারীমুখ বেরিয়ে এল। আচমেত জেক আশ্চর্য হয়ে দেখল এই নারীই তার বন্দিনী যে আজও তার শিবিরে বন্দী অবস্থায় আছে বলে সে একটু আগে ভাবছিল। সে নিজেকে কখন মুক্ত করে পালিয়ে এসেছে বনে তার কিছুই জানে না সে।
হঠাৎ জেন তার পিছনে কিসের শব্দ পেয়ে পিছন ফিরে দেখল একটা বাঁদর-গোরিলা তার পিছু পিছু আসছে। জেন তাই ঘুরে অন্য দিকে পালাবার চেষ্টা করতেই আচমেত জেক আর তার দু’জন সহচর তাকে ধরে ঘোড়ার উপর ওঠাবার চেষ্টা করতে লাগল।
এমন সময় দেখা গেল কোথা থেকে টারজান কতকগুলো বাঁদর-গোরিলাকে সঙ্গে করে সেইদিকে ছুটে আসছে। জেন টারজানকে দেখতে পেয়ে চীৎকার করে বলল, জেন, ঠিক সময়েই এসে পড়েছ।
কিন্তু টারজান তাকে দেখে চিনতে পারল না। তার স্মৃতিবিভ্রম তখনো কাটেনি। তবু তার মনে হলো মুখটা যেন তার কত চেনা এবং তাকে যেমন করেই হোক উদ্ধার করতে হবে।
এই ভেবে আরবদের হাত থেকে জেনকে উদ্ধার করার জন্য তার বাঁদর-গোরিলাদের নিয়ে ছুটে গেল টারজান। কিন্তু আচমেত জেক নিজে টারজানকে লক্ষ্য করে তার রাইফেল থেকে একটা গুলি করে তার সহচরদেরও গুলি করতে বলল। তাদের গুলিতে টারজান পড়ে গেল।
এই অবসরে আরবরা জেনকে ঘোড়ায় চাপিয়ে চলে গেল। তাদের শিবিরে নিয়ে গিয়ে জেনকে এবার সেই কুঁড়ে ঘরটায় হাত পা বেঁধে রেখে দিল। ঘরের দরজায় এবার দু’জন পাহারাদার রাখল।
এদিকে আচমেত জেকের যে সব আরব অনুচরেরা ওয়ারপারকে খুঁজতে গিয়েছিল তারা একে একে ফিরে এল বিফল হয়ে। তারা এসে জানাল ওয়ারপারের কোন খোঁজ পাওয়া গেল না কোথাও। এই খবর শুনে আচমেত জেকের রাগ আরো বেড়ে গেল।
আরবরা ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেলে টারজান বাঁদর-গোরিলাদের কাছে নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, আমি আবার বাঁদর-গোরিলাদের রাজ্যে ফিরে এসেছি। আমার সঙ্গে চল তোমরা। আরবদের হাত থেকে মেয়েটাকে উদ্ধার করতে হবে।
বাঁদর-গোরিলারা বলল, এখন আমরা পূর্ব দিকে শিকার করতে যাব। দিনকতক পরে শিকার থেকে এসে আরব শিবিরে যাব।
তখন টারজান চুলুক ও তাগলৎ নামে দু’জন বাঁদর-গোরিলা নিয়ে আরব শিবিরের দিকে রওনা হয়ে পড়ল।
শিবিরের কাছে গিয়ে টারজান দেখল একজন আরব অশ্বারোহী শিবির থেকে বেরিয়ে এই দিকেই আসছে। টারজান ঠিক করল আরবটাকে মেরে পোশাকটা নিয়ে নেবে।
আরবটা ঘোড়ায় চেপে গাছটার তলায় আসতেই আচমকা গাছ থেকে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল টারজান। তারপর আরবটার গলাটা দু’হাত দিয়ে টিপে তাকে বধ করল। তার পোশাকটা ছাড়িয়ে নিয়ে। আবার গাছে উঠে পড়ল টারজান।
কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখল আরবদের পোশাক পরা দু’জন কৃষ্ণকায় লোক গাছের তলা দিয়ে শিবিরের দিকে যাচ্ছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই টারজান ঐ দু’জন নিগ্রোকেও হত্যা করে তাদের আরবী পোশকগুলো খুলে নিল। গাছের উপর উঠে তারা তিনজনেই তিনটে আরবী পোশাক পরল।
তারপর সন্ধ্যার অন্ধকার ঘন হয়ে উঠলে টারজান তার সঙ্গীদের নিয়ে শিবিরের গেটের কাছে গিয়ে হাজির হলো। তারা যখন বাতাসে গন্ধ শুঁকে বুঝল জেন সেই ঘরটাতেই বন্দী অবস্থায় আছে তখন তারা আগে সেখানে না গিয়ে আচমেত জেকের তাবুটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তারা শুনতে পেল ভিতরে। আচমেত তার সহকারীদের সঙ্গে কথা বলছে।
টারজনের সঙ্গে চুলুক তাঁবুর ভিতরে ঢুকলেও তাগলাৎ তাদের সঙ্গে গেল না। সে একা চলে গেল জেন যে কুঁড়েটাতে বন্দিনী অবস্থায় ছিল সেইখানে। দেখল একজন শ্বেতাঙ্গ মহিলা হাত পা বাঁধা অবস্থায় শুয়ে আছে মেঝের উপর। অন্ধকারে ঘরের মধ্যে কিছু দেখা না গেলেও সে দেখতে পাচ্ছিল। জেন দেখল আরবী পোশাক পরা একটা লোক তাকে তার কাঁধের উপর তুলে নিল। পোশাকটায় তার সর্বাঙ্গ ঢাকা ছিল বলে সে তাকে চিনতে পারল না।
বাকি রাতটা গাছেই কাটাল টারজান। সকালে দেখল একদল সশস্ত্র অশ্বারোহী সেই গাছটার তলায়। বনপথটা ধরে কোথায় যাচ্ছে। সেই দলের সামনেই পলাতক ওয়ারপারও একটা ঘোড়ায় চেপে যাচ্ছিল। টারজান তাকে দেখেই চিনতে পারল।
দলটা চলে যেতে টারজান তাদের অনুসরণ করতে লাগল গাছের উপর দিয়ে। কারণ সে বুঝল ঐ সশস্ত্র সেনাদলের ভিতর থেকে পলাতক ওয়ারপারকে ছিনিয়ে নেয়া সম্ভব নয়।
দু’দিন ক্রমাগত এইভাবে যাওয়ার পর ওরা একটা ফাঁকা সমতল ভূমিতে এসে পৌঁছল। জায়গাটা টারজনের অনেক দিনের চেনা চেনা মনে হলো। কিন্তু স্পষ্ট করে কিছু মনে করতে পারল না। সে দেখল অশ্বারোহী সেনাদলটা একটা ভাঙ্গা বাড়ির পাশে একটা জায়গার মাটি খুঁড়ে অনেকগুলো হলুদ রঙের এক। ধাতুর তাল বার করল। ঝোপের আড়ালে বসে সবকিছু দেখতে লাগল টারজান।
আবদুল মুরাকের আবিসিনীয় সৈন্যরা সোনার তালগুলো নিয়ে যেমনি ঘোড়ায় উঠতে যাবে এমন সময় আচমেত জেক একদল আরব অশ্বারোহী ঘোড়া ছুটিয়ে সেদিকে আসতে দেখা গেল। ওয়ারপার ভয় পেয়ে মুরাককে বলল, আরবরা এই সোনা নেবার জন্য আসছে।
মুরাক তার লোকদের ঘোড়ায় চেপে লড়াই-এর জন্য প্রস্তুত হতে বলল।
আচমেত জেক ওয়ারপারকে দেখেই সব বুঝতে পারল। আচমেত জেক সবাইকে ছেড়ে ওয়ারপার এর দিকে ছুটে গেল। ওয়ারপার বেগতিক দেখে ঘোড়া ছুটিয়ে পালিয়ে গেল।
এক সময় লড়াই করতে করতে টারজান যে ঝোপের ধারে লুকিয়ে ছিল সেই ঝোপের কাছে এক আবিসিনীয় সৈন্য ঘোড়া থেকে পড়ে গেলে টারজান সেই ঘোড়াটার উপর লাফ দিয়ে উঠেই ঘোড়াটা তীর বেগে ছুটিয়ে বনের দিকে চলে গেল।
এদিকে দেখতে দেখতে সব আবিসিনীয় সৈন্যরা মারা গেল। আরবরা ঠিক করল সোনাগুলোকে এইখানে রেখে তারা আচমেতের খোঁজে বনে যাবে। পরে তার দেখা পেলে এগুলো এসে নিয়ে যাবে।
আরবরা সোনার তালগুলো মাটির উপর সেইখানে রেখে চলে যেতে নদীর ধারে লুকিয়ে থাকা একদল নিগ্রো যোদ্ধা সেখান থেকে উঠে এল ধীরে ধীরে।
ওয়ারপার পিছন ফিরে যখন দেখল আচমেত নিজে তাকে ধরতে আসছে। তখন সে ঘোড়াটার। গতিবেগ আরো বাড়িয়ে দিল। কিন্তু সরু বনপথে ঘোড়াটা ছুটতে পারছিল না ভালভাবে। এক সময় পথের ধারে একটা গাছের ডালে পড়ে গেল ওয়ারপারের ঘোড়াটা। এদিকে আচমেত তার অনেক কাছে। চলে এসে ওয়ারপারকে লক্ষ্য করে গুলি করতে গেল।
তখন ওয়ারপার আচমেত জেককে বলল, শোন আচমেত জেক, এই মারামারিতে আমাদের মধ্যে কার মৃত্যু হবে তা কেউ বলতে পারে না। তুমি ত আমার মুক্তার থলিটা চাও। সুতরাং এটা আমি আমার ঘোড়ার উপর রেখে দিয়ে চলে যাচ্ছি। আমি এই মুক্তার বিনিময়ে শুধু আমার মুক্তি চাই। তুমি এত রাজী হলে তোমার রাইফেলটা তোমার ঘোড়র উপর রেখে এসে নিয়ে যাও এটা।
এই বলে তার থলিটা ঘোড়ার উপর রেখ চলে গেল ওয়ারপার।
আচমেত জেক থলিটা খুলে দেখল তাতে মুক্তা নেই, আছ শুধু কতকগুলো নদীর ধারে পাওয়া ছোট ছোট পাথর। সেগুলো রেগে ফেলে দিয়ে সেখান থেকে চলে গেল আচমেত।
বনের মধ্য তাগলাৎ যখন অচেতন জেনের হাত পায়ের বাধন খুলছিল তখন একটা সিংহ তার খুব কাছ থেকে গজন করে উঠল সহসা। তাগলাৎ দেখল সিংহটা তার উপর ঝাঁপ দেবার জন্য তৈরি হচ্ছে। সে দেখল পালাবার আর উপায় নেই। তাই সে সিংহটার আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হয়ে রইল। সিংহটা তাগলাতের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তেই তাগলাৎ তার দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে সিংহটার কেশর ধরে তার গায়ের বিভিন্ন জায়গায় দাঁতগুলো বসিয়ে দিতে লাগল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পেরে উঠল না। সিংহটা তার পেটের মধ্যে দাঁত বসিয়ে নাড়ীভুড়ি বার করে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাগলাৎ মারা গেল।
জেন তখন গড়িয়ে গড়িয়ে গাছের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। এইভাবে কিছুটা যাওয়ার পর জেন এক সময় লাফ দিয়ে উঠেই গাছটার একটা ডাল ধরল। সিংহটাও সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিল জেনকে ধরার জন্য। কিন্তু ধরতে পারল না।
এমন সময় দেখল আচমেত জেক নামে যে আরবটা তাকে ধরতে গিয়েছিল সে একটা রাইফেল হাতে কাকে খুঁজছে। জেন গাছের উপর লুকিয়ে থেকে দেখতে লাগল সব। কিছু পরে দেখল মঁসিয়ে ফ্রেকুলত নামে যে ফরাসী ভদ্রলোক কিছুদিন আগে তাদের বাংলোতে আতিথ্য গ্রহণ করেছিল কিছুদিনের জন্য সে তার রাইফেলটা তুলে আরবটাকে লক্ষ্য করে গুলি করল। আচমেত জেক হাত পা ছড়িয়ে সামনের দিকে মুখ থুবড়ে পড়ে মারা গেল।
এবার আচমেত মারা যেতে জেন আনন্দের আবেগে গাছ থেকে নেমে আচমেত জেকের হাতে বন্দী। হওয়ার পর থেকে যা যা ঘটেছিল তা ওয়ারপারকে সব বলল।
তা শুনে ওয়ারপার সহানুভূতি দেখিয়ে বলল, আপনি আমার সঙ্গে আসুন। আপনি আমার উপর অকুণ্ঠ বিশ্বাস রাখতে পারেন।
যাই হোক, আরবদের শিবিরের দিকে জেনকে সঙ্গে করে তখনি রওনা হয়ে পড়ল ওয়ারপার। তার শয়তানির কথা কিছুই জানতে পারল না জেন।
পরদিন বিকালের দিকে ওরা আরবদের শিবিরের কাছাকাছি এসে পড়ল। ওয়ারপার জেনকে বলল, আমি যা যা বলব আপনি তাই করবেন। আমি ওদের বলব, আপনি ওদের থেকে পালিয়ে যাবার সময় আমার হাতে ধরা পড়েন। আমি তখন আপনাকে আচমেত জেকের কাছে নিয়ে যাই। সে সোনাগুলোর দখল নিয়ে জোর লড়াই করছে বলে আসতে পারল না। আমাকে বলল, একে শিবিরে নিয়ে যাও। তারপর সেখান থেকে লোক নিয়ে উত্তরাঞ্চলে গিয়ে এক ক্রীতদাস ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে দেবে।
ওয়ারপার জেনের হাত ধরে শিবিরের দিকে সোজা চলে গেল। শিবিরের লোকেরা ওয়ারপার আর তার সঙ্গে বন্দিনী জেনকে দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল।
আচমেতের অনুপস্থিতিকালে শিবিরের ভার ছিল মহম্মদ বেজের হাতে।
মহম্মদ বেজ ওয়ারপারকে বলল, আমার যতদূর বিশ্বাস আচমেত জেক মারা গেছে। তা না হলে তুমি আসতে না। তুমি সত্যি কথা বল। আচমেত জেক যদি মারা গিয়ে থাকে তাহলে চল আমরা দু’জনেই মহিলাটিকে নিয়ে উত্তরাঞ্চলে গিয়ে তাকে বিক্রি করে সেই বিক্রির টাকাটা দু’জনে ভাগ করে নিই। তাছাড়া তোমার কাছে সেই মুক্তার থলিটাও ত আছে।
ওয়ারপার রাজী হয়ে গেল মহম্মদের কথায়। তার কাছে মুক্তার থলিটা আর নেই এ কথা প্রকাশ করল না সে। কারণ তাতে সন্দেহ দেখা দিতে পারে মহম্মদের মনে।
অবশেষে আসল কথাটা খুলে বলল ওয়ারপার। বলল, আচমেত জেক সত্যিই সোনার জন্য লড়াই করতে গিয়ে মারা গেছে। আমি পালিয়ে এসেছ। তবে আবিসিনীয়রা এই শিবিরেও এসে পড়বে।
মহম্মদ বলল, আমি কাল সকালেই শিবির তোলার হুকুম দিচ্ছি।
ওয়ারপার বলল, সব লোককে সঙ্গে নিয়ে লাভ নেই। কিছু সাহসী ও সুযোগ্য যোদ্ধাকে বাছাই করে নাও।
পরদিন সকালেই রওনা হলো ওরা। জেনের হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিয়ে তাকে কিছু রুটি খেতে দিয়ে একটা ঘোড়ার উপর তোলা হলো। পথে ওয়ারপার কোন কথা বলল না জেনের সঙ্গে।
রাত্রি হতেই এক জায়গায় তাঁবু গেড়ে শিবির স্থাপন করল ওরা। জেনের থাকার ব্যবস্থা হলো মহম্মদ আর ওয়ারপারের তাঁবুর মাঝখানে একটা তাঁবুতে। তাতে সামনে পিছনে দু’জন প্রহরী ছিল। তারপর খাওয়ার পর শুয়ে পড়ল তার বিছানায়।
জেন ঘুমিয়ে পড়লে মহম্মদ প্রহরীর কানে কানে কি বলতেই জেনের তাঁবু থেকে প্রহরীরা সরে গেল। মহম্মদ তখন সোজা জেনের কাছে চলে গেল।
এদিকে ওয়ারপারের চোখে ঘুম ছিল না। বিছানা থেকে উঠে পড়ল ওয়ারপার। সে সোজা জেনের তাঁবুতে চলে গেল।
তাঁবুর ভিতরটা অন্ধকার। শুধু কিছুটা চাঁদের আলো ভিতরে এসে পড়ায় কিছু কিছু দেখা যাচ্ছিল। ওয়ারপার দেখল জেনের বিছানার উপর ঝুঁকে পড়ে কে কথা বলছে। সে বেশ বুঝতে পারল মহম্মদ ছাড়া সে আর কেউ নয়। মহম্মদ জেনকে কি বলতেই জেন উঠে বসল। তাকে ঘৃণার সঙ্গে কি বলল। মহম্মদ তখন জেনের গলাটা টিপে ধরে তাকে আবার বিছানায় শুইয়ে দিল।
এমন সময় ওয়ারপার গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল মহম্মদের উপর।
কিন্তু মহম্মদ তার ছোরাটা ধরে এগিয়ে যেতেই ওয়ারপার তার রিভলবারটা বার করে তার বুক লক্ষ্য করে গুলি করল। মহম্মদ ধড়াস করে পড়ে গেল মেঝের উপর।
জেন সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে ওয়ারপারের কাছে এসে বলল, হে বন্ধু, কিভাবে ধন্যবাদ দেব আপনাকে?
বাইরে গুলির শব্দ পেয়ে আরবরা এই তাঁবুর দিকে ছুটে এল।
ওয়ারপার তাঁবুর বাইরে অপেক্ষমান আরবদের বলল, বন্দিনী বাধা দিতে গেলে মহম্মদ তাকে গুলি করে। তবে মারা যায়নি। আমি আর মহম্মদ দুজনে মিলে ব্যাপারটা সামলে নেব। তোমরা গিয়ে শুয়ে পড়।
তার এই কথা শুনে আরবরা যে যার তাঁবুতে চলে গেল।
ওয়ারপার জেনকে বলল, আমি একটা পরিকল্পনা খাড়া করেছি, আপনার পক্ষ থেকে শুধু কিছু সাহস দরকার। আপনি মৃতের ভান করবেন। আমি আপনার দেহটা বয়ে নিয়ে যাব। বলব, মহম্মদ আপনাকে ভালবাসত, তাই নিজের হাতে আপনাকে মারায় সে দুঃখিত। সে তাই শুয়ে আছে শোকে দুঃখে অভিভূত হয়ে। সে আমাকে আপনার মৃতদেহটা জঙ্গলে বয়ে নিয়ে যেতে বলেছে।
জেন হাসিমুখে বলল, কিন্তু একথা ওরা বিশ্বাস করবে?
ওয়ারপার বলল, আপনি ওদের চেনেন না। দেহে ওদের যতই শক্তি থাকুক, মগজে বুদ্ধি নেই সেই পরিমাণে।
এরপর জেনকে একটা বাড়তি রিভলবার আর কিছু গুলি দিয়ে বলল, আপনাকে আমি বনের ভিতরে রেখে এখনি চলে আসব। কাল সকালে আমি আপনার কাছে ফিরে যাব। এইভাবে জেনকে নিয়ে তাঁবু থেকে বেরিয়ে পড়ল ওয়ারপার। শিবিরের শেষ প্রান্তে রক্ষীরা আগুন জ্বালিয়ে রেখে পাহারা দিচ্ছিল সিংহের ভয়ে। ওয়ারপার সেখানে গিয়ে জেনের মুখ থেকে কাপড়টা তুলে বলল, মহম্মদ মেয়েটাকে মেরে ফেলেছে। সে আমাকে মৃতদেহটাকে জঙ্গলে ফেলে দিয়ে আসতে বলল।
তখন আর কেউ কিছু বলল না। জেন ভয়ে কাঠ হয়ে ছিল। ভাবছিল ওরা হয়ত ওয়ারপারের কথা বিশ্বাস করবে না।
ওয়ারপার সোজা চলে গিয়ে একটা গাছের উপর তুলে দিল জেনকে। তারপর বলল, রাতটা এখানে কাটান কোনরকমে। সকাল হলেই আমি ফিরে আসব।
শিবিরে এসে ওয়ারপার সোজা মহম্মদ বেজের মৃতদেহটা মহম্মদের তাঁবুতে বয়ে নিয়ে গেল। তার বিছানায় মৃতদেহটা শুইয়ে তার হাতে তারই রিভলবারটা গুঁজে দিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল ওয়ারপার। নিশ্চিন্তে ঘুমোতে লাগল।
পরদিন সকালেই একজন আরব ঘুম থেকে জাগাল ওরপারকে। বলল, মহম্মদ বেজ আত্মহত্যা করেছে তার ঘরে।
ওয়ারপার ঘর থেকে বেরিয়ে সমবেত আরবদের মাঝখানে গিয়ে প্রথমে রাগের সঙ্গে বলল, কে হত্যা করেছে মহম্মদকে?
আরবরা বলল, আমরা কেউ না, ও নিজেকেই নিজে হত্যা করেছে।
আচমেত জেক ও মহম্মদের মৃত্যুতে নেতা শূন্য হয়ে পড়ল আরবরা। তারা ঠিক করল উত্তরাঞ্চলে গিয়ে তারা যে যার পথ বেছে নেবে। ওয়ারপার বলল, আমিও এখান থেকে যেখানে খুশি চলে যাব।
এই বলে সে তার ঘোড়াটায় চেপে বনের দিকে চলে গেল।
কিন্তু বনে গিয়ে যে গাছে জেনকে রেখে এসেছিল সে গাছে দেখল আশেপাশে কোথাও জেনের কোন চিহ্ন নেই।
সোনার তালগুলোর কথা মনে পড়তে টারজান আবার তার বিধ্বস্ত বাংলোর দিকে চলে গেল। গিয়ে দেখল সেখানে কেউ নেই। যুদ্ধরত দু’পক্ষই চলে গেছে। সোনার তালগুলোর কোন চিহ্ন নেই। সে তাই হতাশ হয়ে বনে ফিরে এল আবার।
বনে এসেই একটা ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ শুনে গাছে উঠে লুকিয়ে রইল। আড়াল থেকে দেখল যাকে সে অনেকদিন ধরে খুঁজছে সেই চোর পলাতক লোকটাই ঘোড়া ছুটিয়ে যাচ্ছে। গাছের তলায় ওয়ারপারের ঘোড়াটা আসতেই তার উপর গাছ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল টারজান। তারপর তার বুকের উপর বসে বলল, আমার মুক্তার থলিটা কোথায় বল, তা-না হলে তোমাকে মেরে ফেলব।
ওয়ারপার বলল, থলিটা আচমেত জেক আমার কাছে থেকে কেড়ে নিয়েছে।
টারজান বলল, মিথ্যা কথা, বলেই তার গলাটা টিপে ধরতেই ওয়ারপার কোনরকমে বলল, সামান্য ক’টা পাথরের জন্য আপনার মত লোক হয়ে আমাকে হত্যা করবেন লর্ড গ্রেস্টোক?
টারজান বিস্ময়ে অবাক হয়ে বলল, কে লর্ড গেস্টোক?
ওপারপার বলল, কেন আপনিই জন ক্লেটন, লর্ড গ্রেস্টোক।
টারজান এবার ওয়ারপারকে ছেড়ে দিয়ে নিজে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। এবার হারানো স্মৃতি ফিরে পেয়েছে সে। অতীতের সব কথা মনে পড়ছে তার একে একে।
হঠাৎ সে বলল, জেন, আমার স্ত্রী কোথায়? আমার খামার আর বাড়ি সব ভস্মীভূত হয়েছে তুমি তা জান। এতে তোমারও হাত আছে। তুমি আমায় অনুসরণ করে ওখানে গিয়েছিলে। তুমিই আমার মুক্তা চুরি করেছিলে। তুমি কুটিল প্রকৃতির এক শয়তান।
তার থেকেও খারাপ।
সহসা টারজনের পিছন থেকে কে একজন কথাটা বলে উঠল। টারজান দেখল সামরিক পোশাক পরা এক অফিসার কয়েকজন নিগ্রো সৈন্যসহ ওয়ারপারকে ধরতে এসেছে।
সামরিক অফিসার টারজানকে বলল, ও একজন খুনি মঁসিয়ে। উপরওয়ালা এক অফিসারকে খুন করে পালিয়ে এসেছে ও। এর বিচারের জন্য ওকে খুঁজছি আমি। আমি ওকে নিয়ে যাব।
টারজান বলল, কিন্তু আমার কাজ এখনো মেটেনি।
ওয়ারপার টারজনের কানে কানে বলল, তুমি আমাকে ওদের হাত থেকে উদ্ধার করো। আমি গত রাতে তোমার স্ত্রীকে যেখানে দেখেছিলাম সেই জায়গাটা দেখিয়ে দেব তোমাকে।
টারজান তখন ওয়ারপারকে তুলে নিয়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করতে একজন নিগ্রো সৈনিক রাইফেলের বাঁট দিয়ে তার মাথায় আঘাত করল। টারজান পড়ে গেল। তখন তাকে নিগ্রো সৈনিকরা বেঁধে ফেলল। তারপর তাদের যাত্রা শুরু করল।
সন্ধ্যার সময় একটা নদীর ধারে রাত্রির মত একটা শিবির তৈরি করল ওরা। টারজান দেখল সে আর ওয়ারপার হাত পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে একটা তাঁবুর ভিতরে।
জেনকে বনে একা রেখে ওয়ারপার আরব শিবিরে চলে গেলে জেনের চোখে একটুও ঘুম এল না। কখন ওয়ারপার ফিরে আসবে সেই চিন্তাই বারবার করতে লাগল সে।
ভোরের দিকে আরবী পোশাক পরা এক অশ্বারোহীকে সেই দিকে আসতে দেখে গাছ থেকে নামতেই জেন দেখল সেই অশ্বারোহীর পিছনে আরও অনেক অশ্বারোহী আসছে এবং তাদের মধ্যে ওয়ারপার নেই।
ভয়ে আবার গাছে উঠতে যেতেই আবদুল মুরাক তার লোকদের ধরে ফেলতে বলল জেনকে।
সন্ধ্যের সময় পথের মাঝে যেখানে একটা শিবির খাড়া করল মুরাকরা সে জায়গাটায় সিংহের উৎপাত খুবই বেশি।
শিবিরের চারদিকে আগুন জ্বালানো সত্ত্বেও অন্ধকার ঘন হয়ে ওঠার পর কতকগুলো সিংহ গর্জন করতে করতে ঘোরাফেরা করতে লাগল শিবিরটার চারদিকে।
শিবিরের সকলে তখন আপন আপন প্রাণ বাঁচাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ায় জেনের দিকে নজর দিতে পারেনি কেউ।
এদিকে সেই রাতে টারজান আর ওয়ারপার যখন ফরাসী সৈনিকদের শিবিরে বন্দী ছিল তখন গভীর রাতে শিবিরের কাছে একটা গাছ থেকে অদ্ভুত একটা শব্দ আসে। শিবিরে মাত্র দু’জন সৈনিক পাহারা দিচ্ছিল। বাকি সবাই ঘুমোচ্ছিল। পাহারাদার ছাড়া আর যারা জেগে ছিল তারা হলো টারজান আর ওয়ারপার।
গাছ থেকে আসা সেই শব্দটার মানে বুঝতে পারল টারজান। সেও তেমনি একটা শব্দ করে জবাব দিল। রক্ষী দু’জন সেই শব্দ শুনে দারুণ ভয় পেয়ে গেল।
এমন সময় গাছ থেকে একটা বাঁদর-গোরিলা নামতেই তার পিছু পিছু আরো অনেকগুলো গোরিলা নেমে এসে সোজা শিবিরে ঢুকে পড়ল। টারজনের নির্দেশমত তারা টারজান আর ওরপারকে তুলে নিয়ে শিবির থেকে বেরিয়ে এল।
ততক্ষণে রক্ষীদের চীৎকারে শিবিরের সবাই জেগে উঠেছে। তখন ফরাসী অফিসার গুলি করল আর সেই গুলিটা চুলুকের গায়ে লাগল। তবু সে ওয়ারপারকে বয়ে নিয়ে রাতের মধ্যে তার দলের সকলের পিছু পিছু ছুটতে লাগল। তারপর এক সময় পড়ে গেল ওয়ারপারকে নিয়ে।
হঠাৎ চুলুকের হাতে হাত পড়তেই তার হারানো মুক্তার আসল থলিটা পেয়ে গেল ওয়ারপার। টারজানরা তখন কিছুটা এগিয়ে পড়েছিল। ওয়ারপার দেখল এগুলো ওপারের আসল মুক্তা, যে থলিটা তার জামার তলায় লুকিয়ে রেখেছিল।
এবার টারজান ছুটে এসে দেখল চুলুক মারা গেছে গুলির আঘাতে। তখন সে ওয়ারপারকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেল সেখান থেকে।
টারজান এবার ওয়ারপারকে বলল, তোমার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করো। আমি তোমাকে উদ্ধার করেছি। ওয়ারপার তখন পথ দেখিয়ে তাকে জেনকে যেখানে রেখে এসেছিল সেই দিকে নিয়ে যেতে লাগল।
যেতে যেতে এক সময় সিংহের সমবেত গর্জন আর ঘোড়া ও মানুষের আর্ত চীঙ্কার শুনতে পেল। সে ওয়ারপারকে বলল, কারা বিপদে পড়েছে, দেখি একবার। তুমি এখানেই থাক। আমি এখনি ফিরে আসব।
তখন ওয়ারপারকে সেখানে অপেক্ষা করতে বলে টারজান সেই গোলমালের শব্দ লক্ষ্য করে চলে গেল ওয়ারপার উল্টোদিকে তীরবেগে পালিয়ে গেল।
শিবিরের কাছে গিয়ে একটা গাছের উপর থেকে টারজান দেখল সেই গাছের নিচে এক মহিলা একটা মরা ঘোড়র পাশে দাঁড়িয়ে আছে আর একটা সিংহ তাকে আক্রমণ করার জন্য উদ্যত হচ্ছে।
এদিকে জেন দেখল সিংহটা সত্যি সত্যি পা তুলে ঝাঁপ দিচ্ছে আর সেই সঙ্গে গাছ থেকে বাদামী রঙের এক দৈত্যাকার প্রেমূর্তি সিংহটার উপর ঝাঁপ দিল। মৃত স্বামীকে জীবন্ত দেখে ভয়ের কথা ভুলে গেল জেন।
জেন দেখল টারজনের হাতে কোন অস্ত্র নেই। টারজান দেখল একটা মৃত সৈনিকের একটা রাইফেল পড়েছিল। সেটা তুলে নিয়ে টারজান সিংহটার মাথা এত জোরে মারল যে সিংহের মাথার খুলিটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল।
টারজান চারদিকে দেখে আর সময় নষ্ট না করে জেনকে তুলে নিয়ে গাছের উপর উঠে পড়ল। মুরাকের সৈন্যরা তখন সিংহদের হাত থেকে নিজেদের বাঁচাবার জন্য এতই ব্যস্ত ছিল যে টারজান তাদের বন্দিনীকে নিয়ে গেলেও তারা কোনভাবে হস্তক্ষেপ করল না।
টারজান জেনকে সঙ্গে করে যেখানে ওয়ারপারকে ছেড়ে এসেছিল সেইখানে গেল। কিন্তু ওয়ারপারকে দেখতে পেল না।
টারজান বলল, ও পালিয়ে গিয়েই প্রমাণ করল যে ও দোষী। যাক, ও নিজের কবর নিজের হাতে খুঁড়ল।
এবার দু’জনে তাদের খামারবাড়ির দিকে রওনা হলো। টারজান বলল, ওপারের ধনরত্ন গেল, বাড়ি গেল, খামার গেল, সব গেল। কিন্তু তোমাকে আজ আমি ফিরে পেয়েছি এটাই আমার আজ সবচেয়ে বড় লাভ। আবার আমরা আমাদের অনুগত ও বিশ্বস্ত ওয়াজিরিদের কাছে যাব।
টারজান যখন ওয়াজিরিদের বস্তিতে গিয়ে হাজির হলো তখন ওদের নেতা বাসুলির আর মুগাম্বি দু’জনেই ছিল। তারা আরবদের আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। দীর্ঘকাল পরে তাদের প্রিয় প্রভু আর। প্রভুপত্নীকে ফিরে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠল তারা। সঙ্গে সঙ্গে নাচগান শুরু করে দিল। তার আগে বাসুলি টারজানকে জানাল কিভাবে সোনার তালগুলো উদ্ধার করে আরবদের হাত থেকে।
টারজান দেখল ওপার নগরীর ধনাগার থেকে যেসব সোনার তাল সে ওয়াজিরিদের হাতে দিয়েছিল তা সবই আছে।
যে সব ঘটনার কথা তার বিশ্বস্ত ওয়াজিরিদের কাছ থেকে শুনল টারজান তার থেকে বুঝতে পারল সিয়ে ফ্রেকুলত নামধারী বেলজিয়ান ওয়ারপারই এই সব কিছু করিয়েছে। সমস্ত অঘটনের মূলে আছে সে।
কয়েকমাস ধরে ওয়াজিরিয়া দিনরাত খেটে টারজনের ভস্মীভূত বাংলো-বাড়িটা আবার আগের মত করে গড়ে তুলল। ওয়াজিরিদের শ্রম আর ওপারের সোনায় আবার সবকিছু ফিরে পেল টারজান।