টারজনের পুত্র (দি সন অফ টারজান)
সেদিন একটা লম্বা নৌকা উগাম্বি নদীর উপর দিয়ে ভাটার টানে মোহানার দিকে ভেসে চলেছিল।
এমন সময় মাঝিরা দেখল নদীর পাড় থেকে ভূতের মত অস্থিচর্মসার একটা লোক হাত বাড়িয়ে তাদের ডাকছে। তার ডাক শুনে মাঝিরা লোকটাকে নৌকায় তুলে নিয়ে আবার মোহানার দিকে এগিয়ে। চলল। সেখানে সমুদ্রের মুখে ম্যাজোরি নামে একটা জাহাজ অপেক্ষা করছে নৌকারোহীদের জন্য।
আসলে লোকটা তার আসল নাম গোপন করে উদ্ধারকারীদের কাছে। সে হলো নিকোলাস রোকোফের সহচর পলভিচ। দশ বছর আগে রোকোফ যখন টারজনের হাতে ধরা পড়ে তখন পলভিচ জঙ্গলের গভীরে পালিয়ে যায়।
ম্যাজোরি জাহাজে আশ্রয় পেয়েও ওদের সেবাযত্ন লাভ করে কিছুদিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠল। পলভিচ। এখন আর তার মনে কারো প্রতি কোন প্রতিশোধ বাসনা নেই।
ম্যাজোরি জাহাজটা ভাড়া নিয়ে আফ্রিকার জঙ্গলে এসে এক বিশেষ কাঁচা মালের সন্ধান করতে থাকে একদল ধনী ব্যবসায়ী।
পলভিচকে নিয়ে ম্যাজোরি জাহাজটা অবশেষে সেই দ্বীপের কূলে গিয়ে ভিড়ল। দ্বীপটা নানারকম সারবান গাছের জঙ্গলে ভরা।
একদিন পলভিচ বনে শিকারীদের সঙ্গে গিয়ে একটা গাছতলায় ঘুমিয়ে পড়েছিল। এমন সময় কার স্পর্শে জেগে উঠে দেখে একটা বিরাট বাদর-গোরিলা তার পাশে বসে তার মুখটা খুঁটিয়ে দেখছে। পলভিচ ভয় পেয়ে গেল। পলভিচ বাঁদর-গোরিলাটা তার কোন ক্ষতি করছে না। তাই সে ভাবল একে যদি কোন শহরে নিয়ে যাওয়া যায় তবে তাকে বিক্রি করে অথবা খেলা দেখিয়ে অনেক টাকা পাওয়া যাবে।
নাবিকরা পলভিচের একটা বিরাটকায় বাদর দেখে তাদের দিকে ছুটে এল।
নাবিকরা পলভিচকে বাঁদরটা সম্বন্ধে অনেক প্রশ্ন করতে লাগল।
কিন্তু পলভিচ শুধু সব সময় একটা কথা বলতে লাগল, বাঁদরটা আমার।
এরপর জাহাজের সবাই মিলে বাঁদরটার নাম দিল এ্যাজাক্স।
তারা দেখল এ্যাজাক্সের বয়স হয়েছে। কিন্তু বয়সে বুড়ো হলেও তার গায়ে তখনো প্রচুর শক্তি।
অবশেষে ইংল্যান্ডে গিয়ে জাহাজ ভিড়তেই বাঁদরটার প্রশিক্ষণের জন্য একজন ওস্তাদের কাছে গেল পলভিচ।
হারল্ড মূর নামে এক গৃহশিক্ষক কোন এক ব্রিটিশ লর্ডের বাড়িতে তার ছেলেকে পড়াত। কিন্তু শত চেষ্টাতেও সে ছেলেটির পড়ার কোন উন্নতি ঘটাতে পারছিল না। তাই সে একদিন ছেলেটির মার কাছে তার সম্বন্ধে অভিযোগ করল।
সে বলল, ওর আসল আগ্রহের বস্তু হলো দৈহিক শক্তির চর্চা আর আফ্রিকার জঙ্গলের আবিষ্কার সম্বন্ধে কোন বই পেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে নিবিষ্ট মনে পড়ে যাবে।
ছেলের মা বলল, আপনি নিশ্চয় এসব বই পড়তে দেন না?
কিন্তু ওরা যার সম্বন্ধে আলোচনা করছিল সেই ছেলেটি ঘরের পাশে একটি গাছের ডালে চেপে বাঁদরের মত হুপ করে একটা শব্দ করে উঠল। তার মা ও গৃহশিক্ষক তাকে দেখে জানালার কাছে যেতে নাযেতে সে গাছ থেকে বারান্দায় লাফিয়ে পড়ে ঘরে চলে এল।
এরপর সে নাচতে নাচতে বলল, শহরের মিউজিক হলগুলোতে একটা আশ্চর্য বাঁদর-গোরিলাকে দেখানো হচ্ছে। কথা বলা ছাড়াও সে মানুষের মত অনেক কিছুই করতে পারে। আমি আজ গিয়ে দেখব মা? দয়া করে আমাকে যাবার অনুমতি দাও।
মা ছেলেটির গাল ধরে আদর করে বলল, না জ্যাক, তুমি ত জান, এসব প্রদর্শনীতে যাবার অনুমতি আমি কখনো দিই না।
হঠাৎ দরজা ঠেলে ছেলেটির বাবা এসে ঘরে ঢুকলো। ছেলেটির বাবা বলল, কোথায়? মা বলল, ও একটা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাঁদর-গোরিলা দেখতে একটা মিউজিক হলে যেতে চায়। ছেলেটির বাবা বলল, কে এ্যাজাক্স? ছেলেটি ঘাড় নেড়ে বলল, হ্যাঁ। তার বাবা বলল, চল আমিও যাব তোমার সঙ্গে। জেন, তুমিও চল না।
জেন ঘাড় নেড়ে অসম্মতি জানিয়ে গৃহশিক্ষক মূরকে স্মরণ করিয়ে দিল, এখন তাকে পড়ার ঘরে গিয়ে জ্যাককে আবৃত্তি শেখাতে হবে।
মূর আর জ্যাক ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে জেন তার স্বামী টারজানকে বলতে লাগল, দেখ জন, যেমন করে হোক জ্যাকের মন থেকে তোমার কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া প্রবৃত্তিগুলো দূর করে ফেলতে হবে যাতে বন্যজীবনের প্রতি কোন আকাক্ষা দানা বেঁধে উঠতে না পারে।
টারজান বলল, বন্যজীবনের প্রতি একটা আসক্তি উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়ার মধ্যে কোন সত্যিকারের বিপদ আছে বলে আমি মনে করি না।
সন্ধ্যের সময় জ্যাক আবার তার বাবার কাছে এ্যাজাক্সকে দেখতে যাবার কথাটা তুলল। কিন্তু টারজান বলল, তোমার মা যখন এটা চায় না, তখন আমি তোমাকে অনুমতি দিতে পারি না।
সন্ধ্যের পর এক সময় হঠাৎ মূর জ্যাকের ঘরের পাশ থেকে দেখল জ্যাক পোশাক পরে বাইরে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। মূর দরজার কাছে গিয়ে বলল, কোথায় যাচ্ছ জ্যাক।
জ্যাক বলল, আমি এ্যাজাক্সকে দেখতে যাচ্ছি।
মূর বলল, আমি তোমার ব্যবহারে লজ্জিত।
মূর একথা বলতে না বলতেই জ্যাক তাকে জোর করে তুলে নিয়ে তার বিছানার উপর শুইয়ে দিল। তারপর একটা বিছানার চাদর দিয়ে দড়ি করে মূরের হাত পা বেঁধে ফেলল খাটের সঙ্গে। তারপর দরজায় ভিতর থেকে তালাবন্ধ করে দিয়ে জানালা দিয়ে পাইপ বেয়ে নিচে নেমে গেল।
কিছু পরে টারজান ও জেন এসে দরজায় ঘা দিয়ে জ্যাককে ডাকতে লাগল। কিন্তু কোন সাড়া না পেয়ে টারজান দরজা ভেঙ্গে ফেলল। ঘরে ঢুকে দেখল হাত পা বাঁধা অবস্থায় মূৰ্ছিত হয়ে ঘরের মেঝের উপর পড়ে আছে মূর।
মুখে চোখে জল দিতেই মূর চেতনা ফিরে পেয়ে চোখ মেলে তাকাল। তাকিয়েই বলে উঠল, আমি গৃহশিক্ষকতার পদ থেকে অব্যাহতি চাইছি। আমি আপনার ছেলেকে আর পড়াতে পারব না।
টারজান বলল, কিন্তু জ্যাক কোথায়?
মূর বলল, সে আমাকে এইভাবে বেঁধে রেখে এ্যাজাক্সকে দেখতে গেছে।
সঙ্গে সঙ্গে তার গাড়ি বার করতে বলল টারজান। তারপর সোজা মিউজিক হলের দিকে গাড়ি ছুটিয়ে দিল।
মিউজিক হলে টারজানকে দেখে তার মনের মানুষকে খুঁজে পেয়ে তাদের ভাষায় আনন্দ প্রকাশ করতে করতে এ্যাজাক্স ছুটে গেল তার দিকে। টারজানও তাকে চিনতে পেরে স্তম্ভিত বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার মুখ থেকে শুধু একটা কথা বেরিয়ে এল, আকুৎ তুমি?
আকুৎ বলল, দীর্ঘদিন ধরে তোমাকেই খুঁজছি টারজান। তোমাকে যখন পেয়ে গেছি তখন আমি তোমাকে নিয়ে আবার জঙ্গলে গিয়ে বাস করব তোমার সঙ্গে।
টারজান নীরবে আকুতের মাথায় হাত বোলাতে লাগল। আফ্রিকার জঙ্গলের সব ঘটনা মনে পড়ল তার একে একে। টারজান আকুৎকে বলল, তুমি আজ ওদের সঙ্গেই যাও আকুৎ। কাল আমি তোমার সঙ্গে দেখা করব।
বাড়ি যাবার পথে তার পূর্ব জীবনের সব কথা সংক্ষেপে বলল টারজান জ্যাককে।
পরদিন পলভিচ আর আকুৎ যেখানে ছিল সেখানে গিয়ে দেখা করল টারজান। টারজান আকুৎকে টাকা দিয়ে কিনতে চাইল। পলভিচ তার উত্তরে বলল, কথাটা ভেবে দেখব।
টারজান বাড়ি ফিরে জেনকে বলল, আমি ভাবছি আকুৎকে কিনে নিয়ে আফ্রিকার জঙ্গলে পাঠিয়ে দেব।
জ্যাক বলল, ওকে কিনে আমাদের বাড়িতে রেখে দাও। আমার বন্ধু হিসেবে থাকবে ও এখানে।
একথা জেন বা টারজান কেউ সমর্থন করতে পারল না।
জ্যাক তখন আকুৎকে দেখতে যাবার অনুমতি চাইল। কিন্তু সে অনুমতি তার বাবা মা কেউ দিল না।
তখন জ্যাক একদিন কোনরকমে ঠিকানা যোগাড় করে খুঁজে খুঁজে শহরের একপ্রান্তে পলভিচের আস্তানায় চলে গেল। সেখানে গিয়ে পলভিচকে কিছু টাকা দিয়ে জ্যাক বলল, আমার বাবাকে একথা বলো না। আমি মাঝে মাঝে এখানে এসে ওকে দেখে যাব। ওর জন্য আমি তোমাকে কিছু করে টাকা দেব।
জ্যাক যখন বলল, সে টারজনের ছেলে তখন পলভিচের মাথায় ষড়যন্ত্রের একটা পরিকল্পনা খেলে গেল। সে ভাবল টারজান রোকোফকে হত্যা করেছে, তাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। তাই তার ছেলের মধ্য দিয়ে টারজনের উপর প্রতিশোধ নেবার প্রতিজ্ঞা করল মনে মনে।
দিন দুইয়েকের মধ্যেই টারজনের কাছ থেকে মোটা টাকা নিয়ে আকুৎকে বিক্রী করতে রাজী হয়ে গেল পলভিচ। ঠিক হলো দু’দিন পর ডোভার থেকে আফ্রিকাগামী একটা জাহাজে তুলে দেবে আকুৎকে পলভিচ।
এই ঘটনার কিছু পরেই জ্যাক এসে কিছু টাকা পলভিচের পকেটে গুঁজে দিয়ে বলল, তোমাকে আর কষ্ট করে ডোভারে যেতে হবে না। আমিই আকুৎকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব। আজই সন্ধ্যায় আমার স্কুল বোর্ডিং-এ যাবার কথা। সুতরাং আমি ওভাবে গেলে তাতে বাবার কোন সন্দেহ হবে না। ডোভারে আকুৎকে পৌঁছে দিয়েই আমি স্কুলে চলে যাব।
পলভিচ মনে মনে শয়তানির হাসি হেসে রাজী হয়ে গেল জ্যাকের কথায়।
কিন্তু তার বাবা মা স্টেশান ছেড়ে চলে গেলেই জ্যাক ট্রেন থেকে নেমে সোজা পলভিঢের বাসায় চলে গেল। গিয়ে দেখল আকুৎকে মোটা দড়ি দিয়ে বেঁধে বিছানার উপর ফেলে রাখা হয়েছে। পলভিচ ঘরের মধ্যে অশান্তভাবে পায়চারি করছে।
পলভিচ এবার জ্যাককে বলল, তুমি আমার কাছে এসে পিছন ফিরে দাঁড়াও।
জ্যাক তখন তার সামনে এসে পিছন ফিরে দাঁড়াতেই পলভিচ তার পিছন থেকে একটা মোটা দড়ির ফাঁস তার দুটো হাতের কব্জিতে শক্ত করে লাগিয়ে দিল। মুহূর্তমধ্যে পলভিচের মুখের চেহারা অন্য রকম হয়ে গেল। সে ভয়ঙ্করভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে অতর্কিতে জ্যাককে মেঝের উপর চিৎ করে ফেলে দিয়ে তার বুকের উপর বসল। তারপর দুটো হাত দিয়ে তার গলাটা টিপে ধরে বলল, তোর বাবা আমার সর্বনাশ করেছে। এইভাবে আমি তার প্রতিশোধ নেব।
জ্যাক কিন্তু চীৎকার করল না। সে হাত নাড়তেও পারল না। অসহায়ভাবে শুয়ে রইল সে আর তার গলাটা টিপতে লাগল পলভিচ।
এদিকে আকুৎ হাত পা বাঁধা অবস্থায় শুয়ে সবকিছু দেখছিল। সে এবার তার বন্ধুর অবস্থা দেখে গর্জন করতে লাগল। টানাটানি করতে করতে সে বাঁধনগুলো খুলে যেতেই পলভিচের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
মুখ তুলে তাকিয়ে দেখে ভয়ে সাদা হয়ে গেল পলভিচ। আকুৎ এক ঝটকায় জ্যাকের উপর থেকে পলভিচকে ফেলে দিয়ে নখ দিয়ে তার গাটাকে চিরে দিয়ে তার গলায় দাঁত বসিয়ে এক সাংঘাতিক কামড় দিল। সঙ্গে সঙ্গে পলভিচের প্রাণটা বেরিয়ে গেল।
অনেক কষ্টে জ্যাকের হাতের বাঁধনগুলো খুলে দিল আকুৎ। জ্যাক উঠে দাঁড়িয়ে আর অপেক্ষা না করে আকুৎকে সঙ্গে করে ডোভারের পথে চলে গেল।
মাসখানেক পর টারজান খবর পেল স্কুল থেকে জ্যাক সেখানে যায়নি। খোঁজ নিয়ে একটা কথা শুধু জানতে পারল তারা জ্যাককে স্কুলে যাওয়ার জন্য ট্রেনে তুলে দেওয়ার পর ট্রেন ছাড়ার আগেই সে ট্রেন। থেকে নেমে একটা গাড়ি ভাড়া করে পলভিচের বাসায় আসে।
পলভিচের মৃত্যুর পরদিনই ডোভার থেকে একটি ছেলে তার অসুস্থ বুড়ি ঠাকুরমাকে রোগীর গাড়িতে করে জাহাজে চাপিয়ে একসঙ্গে যাত্রা করল।
যাত্রীদের মধ্যে কন্ডন নামে একজন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বড় বড় শহরগুলোতে অপরাধমূলক কাজ করে বেড়াত। লোকটা দুষ্ট প্রকৃতির। সে একদিন জ্যাকের হাতে বড় এক তাড়া নোটের গোছা দেখে তা চুরি করার জন্য সচেষ্ট হয়ে ওঠে।
এমন সময় জাহাজটা আফ্রিকার জঙ্গলবর্তী এক ছোটখাটো বন্দরে দু-একদিনের জন্য নোঙর করে। এই সময় জ্যাকের বাড়ির জন্য সহসা মন খারাপ করে ওঠে। সে তাই সেই বন্দরে নেমে ইংলন্ডগামী একটা জাহাজে করে বাড়ি ফিরে যাবে ঠিক করে।
বুড়ি ঠাকুরমাবেশী আকুৎকে চেয়ারে করে জাহাজ থেকে নামাবার সময় জ্যাকের পকেট থেকে নোটের তাড়াটা কখন পড়ে যায় তা সে দেখতেই পায়নি। ছোটখাটো একটা হোটেলে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে জ্যাক ইংল্যান্ডে জাহাজে করে যাবার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
সে রাত্রিতে জ্যাক আকুৎকে বুঝিয়ে বলল, তুমি জঙ্গলে চলে যাও আকুৎ, আমি বাড়ি ফিরে যাব। এখান থেকে।
আকুৎ নীরবে মেনে নিল জ্যাকের কথাটা। তারপর ঘুমিয়ে পড়ল বিছানায়। আকুৎ মেঝের উপর শুল।
জ্যাকরা ঘুমিয়ে পড়লে চুপি চুপি দরজাটা খুলে ঘরে ঢুকল কডন। তার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল জ্যাকের প্যান্টের পকেট থেকে নোটগুলো বার করে নেওয়া। কিন্তু কোথাও কোন নোট পেল না। এবার সে গলাটা টিপে ধরতেই জ্যাক জেগে উঠে চোখ মেলে তাকাল। সেও তখন উঠে বসে কন্ডনের হাতের কব্জিটা চেপে ধরল।
এদিকে কন্ডন এতক্ষণ বুঝতে পারেনি ঘরের মধ্যে অন্ধকারে কে খুব নিঃশব্দে পায়চারি করে বেড়াচ্ছিল অশান্তভাবে। এবার তার লোমশ হাতদুটো কন্ডনের ঘাড়ের উপর পড়তেই সে চমকে উঠল।
কন্ডন এবার তার হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে জ্যাকের মুখের উপর একটা ঘুষি মারল। সঙ্গে সঙ্গে আকুৎ তাকে বিছানা থেকে টেনে এনে মেঝের উপর ফেলে দিল। কন্ডন একটা অদ্ভুত গর্জন শুনতে পেল। তার গলাটা কে এক হাতে ধরে তার মুণ্ডুটা ঘোরাচ্ছে। ব্যাপারটা বুঝতে না বুঝতেই চোখে অন্ধকার দেখতে দেখতে সব চেতনা হারিয়ে ফেলল সে আর তার প্রাণহীন দেহটা মেঝের উপর ঢলে পড়ল।
এবার বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠল জ্যাক।
মহা বিপদে পড়ল জ্যাক। একে ঘরের মধ্যে মৃতদেহ। মাথার উপর ঝুলছে খুনের দায়! তার উপর। নোটের বান্ডিলটাও খুঁজে পেল না। হোটেলের ভাড়া মেটাবে তারও কোন উপায় নেই। বাড়ি ফিরবে তার জাহাজ ভাড়াও নেই। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে জ্যাক দেখল ঘরের পাশে একটা গাছ রয়েছে, তার ওপাশ থেকেই জঙ্গল শুরু হয়েছে। সে আকুৎকে তার অনুসরণ করতে বলে জানালা থেকে বিড়ালের মত লাফ দিয়ে গাছটার ডালে গিয়ে উঠে জঙ্গলে চলে গেল।
ফরাসী সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন আর্মন্দ জ্যাক নামে একজন অফিসার মরুভূমির মাঝখানে একটা তালগাছের তলায় পা ছড়িয়ে বসেছিল। সেনাদলের কাছে সাদা পোশাক পরা পাঁচজন আরব দস্যু বন্দী। অবস্থায় বসেছিল। বন্দীদের মধ্যে তাদের সর্দার আচমেত বেন হুদিনও ছিল। এই দস্যুদের ধরার জন্য এক সপ্তা ধরে প্রচুর বেগ পেতে হয়েছে আর্মন্দ জ্যাককে।
সহসা একদল আরব ঘোড়া ছুটিয়ে সোজা ফরাসী সেনাদলের শিবিরের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। একজন ফরাসী সার্জেন্ট এগিয়ে গিয়ে আগন্তুক দলের প্রধানকে ক্যাপ্টেন আর্মন্দের কাছে নিয়ে এল। আগন্তুকের নাম শেখ অরম বেন খাতুর।
আর্মন্দ বলল, বল কি ব্যাপার।
খাতুর বলল, আচমেত বেন হুদিন আমার বোনের ছেলে। তুমি যদি তাকে আমার হাতে ছেড়ে দাও তাহলে সে আর কখনো এ কাজ করবে না।
ক্যাপ্টেন বলল, তা সম্ভব নয়। তাকে আমি সঙ্গে করে নিয়ে যাব। বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলে তাকে মরতেই হবে।
যাবার সময় শেখ বলে গেল, মনে রেখ আজ রাতেই আমার বোনের ছেলে পালাবে।
রাগে কাঁপতে কাঁপতে সার্জেন্টকে ডাকল আর্মন্দ। বলল, এই কালো কুকুরটাকে নিয়ে যাও এখান থেকে। আর রাত্রিবেলায় শিবিরের কাছে কোন আরবকে দেখামাত্র গুলি করবে।
এই ঘটনাটা ঘটে তিন বছর আগে। তখন আচমেত হুদিনের বিচার হয় এবং তাতে তার প্রাণদণ্ড কার্যকরী হয়। আর তার এক মাস পরেই ক্যাপ্টেন আর্মন্দের সাত বছরের মেয়ে জা জ্যাক রহস্যজনকভাবে অন্তর্হিত হয়। আরবরা তাকে চুরি করে নিয়ে যায়।
একটি উপনদীর ধারে গভীর জঙ্গলের মধ্যে তালপাতার ছাউনিওয়ালা কুড়িটি কুঁড়ে ঘরে ভরা একটি গাঁ ছিল। সেই কুঁড়েগুলোর মাঝখানে একটা ফাঁকা জায়গায় আধডজন চামড়ার তাঁবুতে কতকগুলো আরব অস্থায়ীভাবে বাস করত।
আরবদের সেই তাঁবুগুলোর একটিতে সেদিন দশ বছরের একটি মেয়ে তার পুতুলের জন্য ঘাসের একটি জামা তৈরি করছিল। তার চোখদুটো এবং মাথার চুলগুলো ছিল কালো এবং গায়ের রংটা ছিল ফর্সা। তার নাম ছিল মিরিয়েম।
জীবনে প্রথম আফ্রিকার জঙ্গলে রাত কাটানোর অভিজ্ঞতাটা কখনো ভুলতে পারবে না জ্যাক।
সকালে সূর্য উঠতে তার মনে আশা জাগল নতুন করে। রাত্রিতে একটা গাছের ডালে আকুতের গায়ে গা দিয়ে রাত কাটিয়েছে। সকাল হতেই জ্যাক আকুৎকে ডেকে বলল, ওঠ, আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে। কিছু খাবারের সন্ধান করতে হবে।
একদিন নদীর ধার দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ তারা একটা আদিবাসীদের গায়ের সামনে এসে হাজির হলো। কতকগুলো ছেলেমেয়ে গায়ের সামনেই ফাঁকা জায়গাটায় খেলা করছিল। কিন্তু ছেলেগুলো জ্যাককে দেখেই ভয়ে গাঁয়ের ভিতর পালিয়ে গেল। তাদের ভয়ার্ত চীৎকার শুনে গাঁয়ের পুরুষ যোদ্ধারা অস্ত্র হাতে বেরিয়ে এল।
ব্যাপার দেখে আকুৎ একটা গাছের উপর উঠে পড়েছে। সে জ্যাককে পালাতে বলল, জ্যাকও হতাশ হয়ে জঙ্গলের দিকে ছুটে পালাতে লাগল। নিগ্রো যোদ্ধারাও তাকে তাড়া করল। কিন্তু জ্যাক গাছের উপর উঠেই আকুতের সঙ্গে গাছের ডালে ডালে জঙ্গলের গভীরে চলে গেল। নিগ্রোরা জঙ্গলের ভিতরে অনেক দূর গিয়ে তাদের খোঁজ করতে লাগল। জ্যাক আকুতের সঙ্গে না গিয়ে গাছে গাছে তাদের অনুসরণ করতে লাগল। সে যখন দেখল নিগ্রো যোদ্ধারা অনেকটা এগিয়ে পড়েছে এবং তাদের একজন একা পিছিয়ে পড়েছে তখন সে গাছের উপর থেকে হঠাৎ লোকটার ঘাড়ের উপর অতর্কিতে লাফিয়ে পড়ে তাকে মাটিতে ফেলে দিয়ে তার গলাটা জোরে টিপে ধরল। শ্বাসরোধ হয়ে লোকটা মারা গেলে সে তার সবকিছু কেড়ে নিয়ে আবার গাছের উপর উঠে পড়ল। তার বর্শাটা হাতে নিল। পরনের চামড়ার কৌপীনটা পরল। ছুরিটা কোমরে গুঁজে নিল। তারপর আকুতের কাছে সেই বেশে গিয়ে হাজির হয়ে গর্বের সঙ্গে বলল, আমি শুধু আমার হাত আর দাঁত দিয়ে একটা লোককে খুন করেছি।
আকুতের সঙ্গে জ্যাক কিছুদূর যাবার পর হঠাৎ কিসের গন্ধ পেল বাতাসে। গন্ধ শুঁকে জ্যাক বুঝতে পারল একদল মানুষ আসছে। তার মনে হলো শ্বেতাঙ্গরা নিশ্চয় কোন বন্দরের দিকে যাচ্ছে। আনন্দে অন্তরটা লাফিয়ে উঠল জ্যাকের।
ধীর গতিতে এগিয়ে আসা দলটাকে জ্যাকই প্রথমে দেখতে পেল। গাছের উপর থেকে সে দেখল সামনে একদল নিগ্রো যোদ্ধা আসছে আর তাদের পিছনে একদল পিঠে মালের বোঝা নিয়ে ধীর গতিতে পথ হাঁটছে। মালবাহী লোকগুলোর দু’ধারে দু’জন ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গ হাতে চাবুক নিয়ে তাদের সঙ্গে হাঁটছে আর মাঝে মাঝে চারদিকে ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছে।
জ্যাক এগিয়ে গেল শ্বেতাঙ্গদের লক্ষ্য করে। জ্যাককে দেখার সঙ্গে সঙ্গে ভীতিসূচক এক চীৎকার ফেটে পড়ল একজন শ্বেতাঙ্গ। সঙ্গে সঙ্গে সে রাইফেল উঁচিয়ে জ্যাককে লক্ষ্য করে গুলি করল। গুলিটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে একটা গাছের ডালে লাগল।
ব্যাপার দেখে জ্যাক গাছের আড়ালে সরে গিয়ে গাছের উপর উঠে পড়ল। আসলে ঐ দু’জন ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গ হলো কার্ল জেনসেন আর সেভেন মলবিন। ওরা হাতির দাঁতের অনেক বোঝা নিয়ে। আরবদের ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পথ হাঁটছিল।
শেখদের গাঁ থেকে কার্ল জেনসেন আর মলবিন শিবির গুটিয়ে চলে যাবার পর থেকে দু’ছর কেটে গেছে। তখন শেখ বাড়িতে ছিল না। কি একটা কাজে বিদেশে গেছে।
এদিকে জ্যাক আর আকুৎ ক্রমাগত বাঁদর-গোরিলাদের সন্ধানে ঘুরে বেড়াতে লাগল বনের মধ্যে। জ্যাক বর্শা ছেঁড়া শিখে বর্শা দিয়ে চিতাবাঘ, হরিণ, জেব্রা প্রভৃতি শিকার করতে লাগল। পথে যেতে যেতে এইভাবে শিকারের অভিজ্ঞতা বেড়ে যেতে লাগল তার।
একদিন রাত্রিবেলায় একটা বিরাট গাছের উপর শুয়ে ঘুমোচ্ছিল ওরা দু’জনে। এমন সময় জয়টাকের শব্দে দু’জনেরই ঘুম ভেঙে গেল, আকু বলল, বাঁদর-গোরিলাদের ঢাকের শব্দ। ওরা দমদম নাচ নাচছে। এস কোরাক, আমাদের জাতির লোকদের কাছে এস।
কিছুদিন হলো জ্যাকের এক নতুন নাম রেখেছে আকুৎ। জ্যাককে আজকাল কোরাক বলে ডাকে। আকুৎদের ভাষায় কোরাক’ শব্দের মানে হলো হত্যাকারী। ওরা দমদম নাচের বাজনার শব্দ অনুসরণ করে এগোচ্ছিল। কিছুটা গিয়ে ওরা আবার গাছের উপর উঠে ডালে ডালে যেতে লাগল।
নাচের জায়গাটার কাছাকাছি গিয়ে আকুৎ একটা শব্দ করতেই বাঁদর-গোরিলাদের রাজা এগিয়ে এল। আকুৎ বদরদলের রাজাকে বলল, আমি হচ্ছি আকুৎ, বাঁদরদলের রাজা ছিলাম। আর এর নাম কোরাক, এর বাবা টারজান বদরদলের রাজা ছিল। আমরা তোমাদের দলেই থাকব, তোমাদের সঙ্গে শিকার করে বেড়াব, শত্রুদের সঙ্গে লড়াই করব।
বাঁদরদলের নবনির্বাচিত রাজা আকুৎ ও কোরাককে একবার দেখে নিল। ওদের দেখে মনে মনে ভয় হলো রাজার। সে গর্জন করতে করতে বলল, তোমরা চলে যাও, তা না হলে তোমাদের মেরে ফেলব।
কোরাকের মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে আকুতের পিছনে দাঁড়িয়েছিল। সে চীৎকার করে বলল, আমি কোরাক। আমি হচ্ছি মহা হত্যাকারী। আমি চলে যাব ঠিক, তবে যাবার আগে দেখিয়ে দিয়ে যাব আমি আমার পিতা টারজনের মতই শক্তিশালী এবং আমি তোমাদের বা তোমাদের রাজাকে ভয় করি না।
বাঁদর-গোরিলাদের রাজা কোরাকের কথা শুনে বিস্ময়ে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর কোরাকের দিকে গর্জন করতে করতে এগিয়ে এল। কোরাক একটা জোর লাফ দিয়ে বাঁদররাজাকে আক্রমণ করল। সে হাত দুটো বাড়িয়ে কোরাকের গলাটা ধরতে এলে দুটো হাতের ঘুষি সজোরে এক সঙ্গে রাজার তলপেটে মারল। যন্ত্রণায় চীৎকার করতে করতে সে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে অন্য সব বাঁদর গোরিলাগুলো তাদের রাজাকে মারার জন্য কোরাককে একযোগে আক্রমণ করার জন্য এগিয়ে আসতে লাগল। আকুৎ তখন কোরাককে কাঁধে চাপিয়ে একটা গাছের উপর উঠে পড়ল। তারপর ডালে ডালে লাফিয়ে বনের গভীরে চলে গেল। বাঁদর-গোরিলাগুলো কিছুক্ষণ ধরে তাদের পিছু পিছু তাড়া করে গেলেও তাদের ধরতে পারল না।
যেতে যেতে কোরাক দেখল একটা তাঁবুর সামনে একটি শ্বেতাঙ্গ বালিকা বসে একটা পুতুল নিয়ে খেলা করছে আপন মনে। তা দেখে মুখে হাসি ফুটে উঠল কোরাকের, হাতের উদ্ধত বর্শাটা নামিয়ে নিল।
হঠাৎ কোরাক দেখল গাঁয়ের বাইরে কিসের গোলমাল শোনা যাচ্ছে। দেখল গাঁয়ের সর্দার একজন বুড়ো আরব শেখ লোকজন ও উটসমেত দীর্ঘদিন পর গাঁয়ে ফিরল বলে গাঁয়ের লোকেরা সবাই ছুটে দেখতে যাচ্ছে তাকে।
কোরাক দেখল, একজন বৃদ্ধ শেখ কুঁড়েটার দিকে এগিয়ে আসছে। তার মনে হলো ঐ শেখই হয়ত মেয়েটির বাবা।
শেখ এসেই মেয়েটিকে লাথি মেরে ফেলে দিল। তারপর তার অভ্যাসমত সে মেয়েটিকে আবার ধরে হাত উঁচিয়ে মারতে গেল। কোরাক আর স্থির থাকতে পারল না। গাছ থেকে হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে শেখের পাশে এসে দাঁড়াল। তার বা হাতে বর্শা থাকা সত্ত্বেও সে শুধু তার ডান হাত দিয়ে সজোরে ঘুষি মারল শেখের মুখে। অচৈতন্য ও রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ল শেখ।
এবার মেয়েটির দিকে তাকাল কোরাক। মেয়েটি কোরাককে বলল, ও চেতনা ফিরে পেলেই আমাকে মেরে খুন করবে।
সে আরবী ভাষায় কথাটা বলল। কোরাক তা বুঝতে পারল না। মেয়েটি তখন কোরাকের কাছে এসে তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপতে লাগল। মেয়েটির চোখে জল দেখে বিচলিত হয়ে সে মেয়েটির গায়ে হাত বুলিয়ে বলল, এস আমাদের সঙ্গে। তুমি আমাদের সঙ্গে জঙ্গলেই বাস করবে।
আকুৎ একটু দূরে ছিল। আকুৎ দেখল কোরাক একটা মেয়েকে কাঁধে করে বয়ে আনছে। কোরাক আকুতের কাছে এসে বলল, এ আমাদের সঙ্গে যাবে।
কিন্তু আকুতের কাছে এসেই ভয় পেয়ে গেল মিরিয়েম। কিন্তু যখন দেখল আকুৎ তার কোন ক্ষতি করছে না তখন আর ভয় করল না তাকে। ওরা মিরিয়েমকে সঙ্গে নিয়ে চলতে লাগল।
এর পর কয়েক মাস ওদের তিনজনের জীবনে বিচিত্র কোন কিছু ঘটলা না। প্রথম প্রথম অসুবিধা হলেও মিরিয়েম আজকাল বন্যজীবনের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছে।
মিরিয়েম যাতে কিছুটা আরামে ও নিরাপদে ঘুমোতে পারে তার জন্য কোরাক একটা মাচা তৈরি করেছিল একটা গাছের উপর।
ওরা দিনের বেলায় যখন শিকার করতে যেত তখন মিরিয়েম তার পুতুলটাকে নিয়ে একা একা খেলা করত আর বনের যত সব ছোট ছোট বাঁদরগুলো তার চারদিকে কিচিরমিচির করত।
একদিন কোরাক আর আকুৎ যখন শিকার করতে গিয়েছিল তখন সে একা একাই খেলা করছিল বাঁদরগুলোর সঙ্গে। দিনের শেষে তার মনে হলো কোরাক আর আকুৎ আসছে। সে ভাবল আজ ঘুমিয়ে থাকার ভান করে সে ঠকাবে কোরাককে।
মিরিয়েম তাই চুপচাপ শুয়ে রইল চোখ বন্ধ করে। কিন্তু চোখ খোলার সঙ্গে সঙ্গে মিরিয়েম দেখল একটা বাঁদর-গোরিলা তাকে হাত বাড়িয়ে ধরতে আসেছ। তার পিছনে আর একটা বাঁদর-গোরিলা। সে তখন লাফ দিয়ে উপরের ডালে উঠে গিয়ে এডাল ওড়াল করে বেড়াতে লাগল। বাঁদর-গোরিলা দুটোও তাকে ধরার জন্য পিছু পিছু তাড়া করল।
এইভাবে এডাল ওডাল করতে করতে গিয়ে একবার একটা সরু ডাল মিরিয়েম ধরতেই ডালটা ভেঙ্গে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে মিরিয়েম মাটিতে পড়ে গেল।
তখন বড় গোরিলাটা মিরিয়েমের অচেতন দেহটাকে কাঁধের উপর তুলে নিয়ে চলে গেল।
শিকার থেকে ফিরে এসে কোরাক দেখল গাছের মাচার উপর মিরিয়েম নেই। আর চারদিকে বাঁদরগুলো কিচিরমিচির করছে। কতকগুলো বাদর বনের একটা দিকে ছোটাছুটি করছে। কোরাক বুঝল বাঁদরগুলো মিরিয়েমের বন্ধু। তার দিকে ছুটছে সেইদিকে নিশ্চয় কেউ মিরিয়েমকে নিয়ে পালিয়েছে।
কোরাকও সেই দিকে গাছে গাছে তীরবেগে যেতে লাগল। কিছুদূর গিয়ে দেখল একটা বাঁদর গোরিলা মিরিয়েমের অচেতন দেহটা কাঁধের উপর তুলে নিয়ে পালাচ্ছে।
কোরাককে দেখে বাঁদর-গোরিলাটা বুঝল কোরাক তার শিকার ছিনিয়ে নিতে এসেছে। সে তাই মিরিয়েমের অচেতন দেহটাকে মাটির উপর নামিয়ে রেখে কোরাককে আক্রমণ করল। কিন্তু তার আগেই কোরাক অতর্কিতে তাকে ধরে তার ঘাড়ে একটা জোর কামড় বসিয়ে দিয়েছে।
সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্তায় ঘাড়ে কামড় আর কয়েকটা ঘুষি খেয়ে ঘায়েল হয়ে পড়েছিল। বাঁদর গোরিলাটা। এমন সময় মিরিয়েম চেতনা ফিরে পেয়ে কোরাককে দেখেই চীৎকার করে উঠল আনন্দে। বলল, কোরাক, আমার কোরাক, ওকে মেরে ফেল। ও আমাকে নিয়ে পালাচ্ছিল।
কোরাক বর্শাটা তুলে নিয়ে তার ফলাটা তার গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে গোরিলাটার পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। বাঁদর-গোরিলাটা আগেই ঘায়েল হয়েছিল। এবার সে রক্তাক্ত দেহে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।
কোরাক মিরিয়েমকে কি বলতে যাচ্ছিল। এতক্ষণে আকুও চলে আসে সেখানে কিন্তু আকুৎ তাকে ইশারায় কোন শব্দ করতে বারণ করল। ওরা কাদের পদশব্দ শুনতে পেল। প্রথমে দেখল একটা বাঁদর গোরিলা অদূরে একটা ঝোপের ভিতর থেকে মুখ বাড়িয়ে উঁকি মেরে কি দেখছে। তারপর আর একটা গোরিলাও তাই করল। এইভাবে প্রায় চল্লিশটা পুরুষ ও মেয়ে গোরিলা একে একে তাদের কাছে এসে দাঁড়াল। কোরাক বুঝল যে বাঁদর-গোরিলাটাকে ও মেরেছে এরা তারই দলের।
আকুৎ ওদের লক্ষ্য করে বলল, শক্তিশালী কোরাক তোমাদের রাজাকে হত্যা করেছে। এখন সে-ই তোমাদের রাজা। তোমাদের দলে তার থেকে শক্তিশালী আর কে আছে?
একথা শুনে বাঁদর-গোরিলারা নিজেদের মধ্যে কি বলাবলি করতে লাগল। তারপর এক যুবক শক্তিশালী বাদর-গোরিলা এগিয়ে এল কোরাকের কাছে।
বাঁদর-গোরিলাটাই প্রথমে আক্রমণ করল। কোরাক চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। গোরিলাটা তার কাছে হাত বাড়িয়ে তার গলাটা ধরতে এলেই কোরাক জোরে তার মুখে আর একটা জোর ঘুষি মারল। তার চোয়াল থেকে রক্ত ঝরতে লাগল এবং সে পড়ে গেল মাটিতে। এরপর গোরিলাটা যতবার উঠতে চেষ্টা করতে লাগল ততবারই কোরাক একটা করে ঘুষি মারতে লাগল। অবশেষে একেবারে কায়দা হয়ে পড়লে তার ঘাড় ধরে কোরাক বলল, ‘কাগোদা অর্থাৎ হার মেনেছ?
এবার বাঁদর-গোরিলাটা বলল, কাগোদা। অর্থাৎ হ্যাঁ, হার মেনেছি।
কোরাক তখন বলল, তাহলে উঠে চলে যাও। যারা আমাকে একবার দল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে তাদের দলে গিয়ে আর রাজা হতে চাই না আমি।
কোরাক আকুতের দিকে তাকিয়ে ওদের বলল, তবে এই হবে তোমাদের রাজা।
আকুৎ দীর্ঘদিন পর তার মনের মত এক দল খুঁজে পেয়ে তাদের দলের সঙ্গে বাস করতে ইচ্ছা করছিল। কিন্তু সে বলল, কোরাককে ছেড়ে কোথাও যাবে না। সে কোরাককে ঐ দলেল সঙ্গে থাকতে বলল। কিন্তু কোরাক মিরিয়েমের কথা ভেবে রাজী হলো না।
কোরাক তাই বলল, তুমি ওদের সঙ্গে যাও আকুৎ। আমি তোমাদের কাছাকাছি থাকব। তোমরা যেখানে যাবে আমিও সেখানে যাব। তবে দলে থাকব না।
ফলে আকুৎই ওদের দলের রাজা হলো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আকুৎ তার দলের সঙ্গে ধীরে ধীরে চলে গেল। কিন্তু এমন সময় কোরাকের পিছনে একদল মানুষের চীৎকার শুনে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখল একদল সশস্ত্র কৃষ্ণকায় মানুষ তাকে আক্রমণ করার জন্য এগিয়ে আসছে। মিরিয়েমের হাতে তখনো বর্শাটা ধরা ছিল।
যে গাঁ থেকে কোরাক আর আকুৎ পালিয়ে আসে এই নিগ্রোরা হলো সেই গাঁয়েরই লোক। এদের সর্দার ছিল কভু। মিরিয়েমকে দেখে কভুন্ডু তার লোকদের বলল, আমি যখন একদিন আরব বস্তিতে এক শেখের ক্রীতদাস ছিলাম তখন শেখের বাড়িতে এই মেয়েটাকে দেখেছি। একে ধরে শেখকে দিতে পারলে সে মোটা পুরস্কার দেবে।
এই বলে সে পর পর দুটো তীর মারল কোরাককে লক্ষ্য করে। তীর দুটো তার ঘাড়ে আর একটা পায়ে লাগল। কোরাক পড়ে যেতেই নিগ্রোদের সর্দার কভুন্ডু কোরাককে বধ করে মিরিয়েমকে নিয়ে পালিয়ে যাবার জন্য এগিয়ে এল।
কিন্তু এমন সময় তাদের চীৎকার ও হৈ চৈ শুনে আকুৎ তার দলবলকে নিয়ে ছুটে এল। বাঁদর গোরিলাদের এক বিরাট দল দেখে কভুডু কোরাককে ছেড়ে দিয়ে শুধু মিরিয়েমকে নিয়ে পালিয়ে গেল।
একটু সুস্থ হয়ে উঠলে মিরিয়েমের খোঁজে অবশেষে কোরাক যখন কভুন্ডুদের গাঁয়ে গিয়ে পৌঁছল তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। একটা ঘরের কাছে গিয়ে সে বুঝল এই ঘরেই বন্দী আছে মিরিয়েম।
অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে ঘরটার সামনের দিকে এসে কোরাক দেখল ঘরখানার ভিতরে হাত পা বাঁধা অবস্থায় শুয়ে আছে মিরিয়েম আর ঘরের দরজার উপর একটা নিগ্রো বসে পাহারা দিচ্ছে।
কোরাক নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে অতর্কিতে লোকটার গলাটা জোরে টিপে ধরল। ক্রমে তার দেহটা অসাড় হয়ে ঢলে পড়ল। কোরাক তখন ঘরে ঢুকেই মিরিয়েমের হাত-পায়ের সব বাঁধন কেটে দিল।
কিন্তু কোরাক নিঃশব্দে মিরিয়েমকে কাঁধের উপর তুলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই একটা কুকুর কোরাককে দেখেই ঘেউ ঘেউ করে উঠল। তখন সেই শব্দে গাঁয়ের লোকেরা সচকিত হয়ে ছুটে এল ঘরখানার দিকে। ততক্ষণে কোরাক মিরিয়েমকে কাঁধে নিয়ে পালিয়ে গেছে।
এরপর তারা কোরাক যে পথে গিয়েছিল সেই পথে তাড়া করল তাকে। কভুন্ডুর লোকেরা কিছুক্ষণের মধ্যেই ধরে ফেলল তাদের। তখন কভুন্ডু তাদের লোকদের বলল, আমাদের দরকার শুধু মেয়েটাকে, ওকে কেড়ে নিয়ে লোকটাকে তাড়িয়ে দাও। ওকে মারার দরকার নেই।
মিরিয়েমের হাত পা বেঁধে আবার ওকে ওরা গায়ের ভিতরে নিয়ে গিয়ে তাদের সর্দার কভুন্ডুর ঘরের মধ্যে রেখে দিল।
কিন্তু মিরিয়েম জানত না কভুন্ডু তাকে আর গাঁয়ের মধ্যে বেশি দিন রাখতে চায় না। সে শেখের কাছে দূত পাঠিয়েছে। মিরিয়েমকে তার হাতে তুলে দিলে সে কি পুরস্কার তাদের দেবে একথা জানতে চেয়েছে।
এদিকে কভুন্ডু জানতে পারেনি তার দূত কার্ল জেনসেন আর মলবিনের হাতে ধরা পড়ে। কার্লদের ক্রীতদাসদের কাছে কভুন্ডুর দূত মিরিয়েমের কথাটা ফাঁস করে দেয়। এরপর কার্লরা মিরিয়েমকে পাবার জন্য কভুন্ডুদের গায়ের দিকে রওনা হলো।
কিন্তু ওদের গায়ে গিয়ে বন্দিনী মিরিয়েম সম্পর্কে কিছু বলল না কার্লরা। তবে কভুন্ডুর সঙ্গে একথা সেকথা বলতে গিয়ে মলবিন শেখের মৃত্যুর খবরটা দিয়ে ফেলল। কভুন্ডু আশ্চর্য হয়ে মাথা চুলকাতে লাগল। মলবিন বলল, সেকি! তুমি জান না?
কভুন্ডু তখন দেখল বন্দিনী মেয়েটার আর দাম নেই। শেখের হাতে মোটা পুরস্কারের বিনিময়ে তুলে দেবার জন্যই ও রেখেছিল মেয়েটাকে। সে তাই কার্লদের বলল, তোমরা কিনবে মেয়েটাকে?
জেনসেন বলল, পথে ওকে নিয়ে যেতে আমাদের কষ্ট হবে, তাছাড়া মেয়েটা বুড়ি।
কভুন্ডু বলল, আমি তোমাদের দেখাব। ও মোটেই বুড়ি নয়, তরুণী এবং সুন্দরী।
এই বলে কভুন্ডু ওদের ঘরটার মধ্যে নিয়ে গিয়ে মিরিয়েমকে দেখল। তার বাঁধন খুলে দিল। তারপর কভুন্ডু মিরিয়েমকে বিক্রি করে ওদের শিবিরে পাঠিয়ে দিল।
ওদের কথাবার্তা মিরিয়েম বুঝতে না পারলেও একটা কথা বুঝতে পারল। বুঝল মলবিন লোকটা খারাপ এবং তার কবল থেকে জেনসেন তাকে উদ্ধার করেছে। জেনসেন তাকে বলল, যদি ও কখনো তোমার কোন ক্ষতি করতে যায় তাহলে আমাকে চীৎকার করে ডাকবে।
মিরিয়েম তখন জেনসেনকে বন্ধু ভেবে বলল, আমাকে মুক্ত করে দাও, আমি কোরাকের কাছে যাব।
কিন্তু জেনসেন বলল, তুমি নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করলে শাস্তি পাবে।
রাত্রিটা শিবিরে কাটিয়ে পরদিন সকালে যাত্রা শুরু করল ওরা। এইভাবে তিন দিন কেটে গেল।
একদিন মিরিয়েমকে রেখে জেনসেন ও মলবিন শিকার করতে গেল। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে মলবিন শিকার না করেই ফিরে এল। তাকে দেখে ভয়ে চমকে উঠল মিরিয়েম। মলবিন তাকে ধরতে গেলে জেনসেনের নির্দেশমত সে জেনসেনকে ডাকতে লাগল চীৎকার করে।
এমন সময় কার্ল জেনসেন শিকার থেকে ফিরল। মিরিয়েমের আর্ত চীৎকার সে শুনতে পেয়েছিল।
জেনসেনকে দেখেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল মলবিন। সে তার রিভলবারটা বার করে গুলি করল জেনসেনকে লক্ষ্য করে। জেনসেন লুটিয়ে পড়ল মেঝের উপর।
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তাবুর ভিতর এক লম্বা চেহারার অচেনা শ্বেতাঙ্গ ঢুকেই মলবিনের ঘাড়ের উপর হাত রাখল। শ্বেতাঙ্গ লোকটি বনের মধ্যে শিকার করতে থাকাকালে মিরিয়েমের আর্ত চীৎকার শুনে এই তাঁবুতে এসে হাজির হয়। সে মিরিয়েমকে জিজ্ঞাসা করল, ব্যাপারটা কি?
মিরিয়েম আরবী ভাষায় বলল, এরা আমাকে জোর করে ধরে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে।
এরপর মলবিনকে দেখিয়ে মিরিয়েম বলল, এই লোকটা আমার ক্ষতি করতে যাচ্ছিল। যে লোকটা এই মাত্র মারা গেছে সে এই লোকটাকে বাধা দিতে গেলে তাকে হত্যা করে এই বদ লোকটা।
অপরিচিত শ্বেতাঙ্গ লোকটি মলবিনকে বলল, মৃত্যুই তোমার যোগ্য শাস্তি। অবশ্য আমি তোমায় এখন মারব না। তবে তোমাকে এখনি আমাদের এই দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে। না গেলে এর পর বুঝবে আমি কে।
মলবিন বলে গেল সেই অপরিচিত শ্বেতাঙ্গ মিরিয়েমকে বলল, তুমি একা এই জঙ্গলে কোথায় খুঁজবে তোমার সাথীকে। তার চেয়ে তুমি আমাদের সঙ্গে আমার বাড়িতে চল। সেখানে আমার স্ত্রীর কাছে থাকবে। সে তোমাকে পেয়ে খুশি হবে।
রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত দেহে কোরাক জঙ্গলের মধ্যে এসে বেবুনদের খোঁজে এগিয়ে যেতে লাগল।
বেবুনদের রাজা কোরাককে চিনতে পেরে বলল, তুমি কোরাক। এস আমরা একসঙ্গে শিকার করব। আমি তোমার বন্ধু।
কোরাক বলল, আমি এখন শিকার করতে পারব না। গোমাঙ্গানী অর্থাৎ নিগ্রোরা আমার মিরিয়েমকে চুরি করে নিয়ে গেছে। চল আমরা একযোগে গোমাঙ্গানীদের গাঁ আক্রমণ করে মিরিয়েমকে উদ্ধার করি। তারা তাকে সাহায্য করতে রাজী হলো।
তখন একযোগে তারা সকলে মিলে কভুন্ডুদের গায়ের দিকে যাত্রা শুরু করল। পার্বত্য বেবুনদের সংখ্যা প্রায় দু’তিন হাজার হবে। ওরা যখন কভুন্ডুদের গায়ের কাছে গিয়ে পৌঁছল তখন ভর দুপুর।
বেবুনদের চীৎকার শুনে কভুন্ডুদের গায়ের নিগ্রোরা বেরিয়ে এল। মেয়েরা তাদের ছেলেদের নিয়ে গা ছেড়ে ভয়ে পালাতে লাগল।
কোরাক তখন প্রতিটা ঘর খুঁজে দেখল। কিন্তু মিরিয়েমকে কোথাও পাওয়া গেল না।
বেবুনরাও তখন ক্লান্তদেহে এক জায়গায় বসে বিশ্রাম করতে লাগল। অবশেষে মিরিয়েমকে না পেয়ে হতাশ হয়ে কিছু নিগ্রোকে বন্দী করে তাদের সঙ্গে নিয়ে গেল।
নতুন বাড়িতে এসে মিরিয়েমের দিনগুলো ভালই কাটতে লাগল। বাড়ির মালিক যে তাকে উদ্ধার করেছে তাকে সে আরবী ভাষায় বাওনা’ বলে ডাকত। মালিক ও তার স্ত্রী ইংরেজিতে কথা বলত। কিছুদিন পরে মরিসন বেনেস নামে এক ইংরেজ যুবক তাদের বাড়িতে বেড়াতে আসে জঙ্গলে শিকারের আশায়। মিরিয়েমের বেশ ভাব হয়ে যায় তার সঙ্গে।
সেদিন মিরিয়েম আর বাওনা বাংলোর বারান্দাতে বসেছিল। এমন সময় দূরে একজন শ্বেতাঙ্গ অশ্বারাহী বাংলোর গেটের কাছে এসেই বাওনাকে অভিবাদন জানিয়ে বলল, আমি দক্ষিণ থেকে আসছি। শিকার আর ব্যবসার জন্য আফ্রিকার এ অঞ্চলে এসেছি আমি। আমার লোকজন দক্ষিণাঞ্চলে এক শিবিরে আছে। আমি আপনার নাম শুনেছি। আপনার অনুমতি ছাড়া এখানে কেউ শিকার করতে পায় না। আমি কয়েক সপ্তাহ এর অঞ্চলে শিবির স্থাপন করে শিকার করতে চাই।
বাওনা বলল, আপনি তাহলে নদীর ধারে আমার খামারের কাছাকাছি শিবির স্থাপন করতে পারেন এবং সেখান থেকে শিকার করে বেড়াতে পারেন।
আগন্তুক বলল, আমার শিবির যেখানে আছে সেখানেই থাক, কারণ আমার লোকেরা বড় ঝগড়াটে।
আগন্তুক তার নাম বলল, হ্যানসন।
ক্রমে হ্যানসন পরিবারের বন্ধু হয়ে দাঁড়াল।
হ্যানসন প্রায়ই বাংলোর ফুলবাগানে এসে একা একা বেড়াত। বলত সে খুব ফুল ভালবাসে।
একদিন রাত্রিবেলায় ঘুম আসছিল না মিরিয়েমের। আজ সন্ধ্যার সময় মরিসন বেনেস তার কাছে তার প্রেমের কথাটা আবার তোলে। ফলে সেকথা ভাবতে গিয়ে ঘুমোতে পারেনি সে। সে তাই একা একা বাগানে চলে আসে। এসে দেখে হ্যানসন বাগানে এক জায়গায় শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।
কিছুক্ষণের মধ্যে একটা ঘোড়ার পায়ের শব্দ শুনতে পেল মিরিয়েম। দেখল বেনেস ঘোড়ায় চেপে তার দিকে এগিয়ে আসছে। মিরিয়েম বলল, আমার ঘুম আসছে না। চল জঙ্গলে গিয়ে একটু বেড়িয়ে আসি।
ফাঁকা মাঠ পার হয়ে জঙ্গলের ধারে গিয়ে মিরিয়েম বলল, চল বনের ভিতর যাই, বনের এদিকটা বেশ ফাঁকা ফাঁকা, কোন অসুবিধা হবে না।
বেনেসের ভয় লাগলেও সে বলল, হ্যাঁ, তাছাড়া এ অঞ্চলে মানুষখেকো সিংহের বড় একটা দেখা পাওয়া যায় না।
কোরাক দেখল একজন শ্বেতাঙ্গ একজন শ্বেতাঙ্গ মেয়ের সঙ্গে কথা বলছে। কিন্তু মেয়েটি যে। মিরিয়েম এটা সে বুঝতে পারল না। তবে দেখতে পেল ঝোপের উপর একটা সিংহ ওৎ পেতে আছে। সে যাই হোক, মেয়েটিকে ক্ষুধার্ত সিংহের কবল থেকে রক্ষা করার জন্য হাতি নিয়ে অপেক্ষা করছিল সে। এবার সিংহটা হঠাৎ গর্জন করে উঠতেই তার উপর চোখ পড়ল তাদের।
মিরিয়মে ছুটে গিয়ে তার ঘোড়াটার উপর চাপতেই সিংহটা লাফ দিয়ে তাকে ধরার জন্য আর সঙ্গে সঙ্গে কোরাকও হাতির পিঠ থেকে একটা বর্শা ছুঁড়ে সিংহের একটা কাঁধ বিদ্ধ করল। মিরিয়েম ততক্ষণে ঘোড়ার পিঠ থেকে এক লাফে একটা গাছের উপর উঠে পড়েছে। বেনেসও তার ঘোড়ার উপর চড়ে তীর বেগে পালিয়ে গেল। কোরাক বর্শাটা ছুঁড়েই হাতির পিঠে চড়ে চলে গেছে।
এদিকে সিংহটা আহত হবার সঙ্গে সঙ্গে আবার প্রচণ্ডভাবে আক্রমণ করল মিরিয়েমকে। কিন্তু সে গাছের উপর উঠে যাওয়ায় তার আর নাগাল পেল না। সিংহটা তবু আবার লাফ দিতেই তার পিছন থেকে। হ্যানসন তার রাইফেল থেকে একটা গুলি করল সিংহটাকে লক্ষ্য করে। সিংহটা সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে পড়ে মরে গেল।
হ্যানসন তখন মিরিয়েমের নাম ধরে ডাকতেই মিরিয়েম গাছের উপর থেকে সাড়া দিল। বলল, এই যে, আমি এখানে। সিংহটা মরেছে?
হ্যানসন বলল, হ্যাঁ, নেমে এস। খুব বেঁচে গেছ। রাত্রিতে জঙ্গলে আর বেড়িও না। তোমার এতে শিক্ষা হওয়া উচিত।
সিংহটা মরে যেতে বেনেস ওদের কাছে এগিয়ে এল। তখন তিনজনে বাংলোর পথে রওনা হলো।
এদিকে ওদের জন্য বাংলোর বারান্দাতে তখন বাওনা অধীর আগ্রহে এবং গভীর উদ্বেগের সঙ্গে অপেক্ষা করছিল। হ্যানসনের রাইফেলের গুলির আওয়াজ শুনে তার হঠাৎ ঘুমটা ভেঙ্গে যায়। উঠে দেখে বাড়িতে মিরিয়েম বা মরিসন কেউ নেই। তাদের ঘোড়া দুটোও নেই। বাংলোর গেট খোলা।
কিছুক্ষণের মধ্যে ওরা তিনজন বাংলোতে এসে পড়ল। হ্যানসন ঘটনার যে বিবরণ দিল তাতে সন্তুষ্ট হলো না বাওনা। মিরিয়েম দেখল বাওনা খুব রেগে গেছে। বাওনা তাকে বলল, তোমার ঘরে যাও মিরিয়েম।
তারপর বেনেসকে বাওনা বলল, আমার পড়ার ঘরে এস, একটা কথা আছে।
এই বলে বাওনা হ্যানসনের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, তুমি কোথায় এবং কি করে দেখলে হ্যানসন?
হ্যানসন বলল, আমি রাত্রিতে মাঝে মাঝে ফুলবাগানে এসে বসে থাকি। আজও ছিলাম। এমন সময় দেখি ওরা ঘোড়ায় চেপে দু’জনে বেরিয়ে গেল। এত রাতে এভাবে বেড়াতে যাওয়া মোটেই নিরাপদ নয় ভেবে আমিও গোড়ায় করে অনুসরণ করতে লাগলাম ওদের। তারপর ওরা যখন বনের ধারে এক জায়গায় বসে গল্প করছিল তখন হঠাৎ একটা সিংহ ওদের আক্রমণ করে। আমি তখন সিংহটাকে গুলি করে মারি।
হ্যানসন আরও বলল, সন্ধ্যের সময় প্রায়ই বাগানে আসায় ওদের অনেক কথাই শুনতে পাই। বেনেস মেয়েটিকে নিয়ে পালিয়ে যাবার একটা পরিকল্পনা করছিল। আমি বলি কি, আগামীকাল সকালে আমি যখন এখান থেকে উত্তরাঞ্চলে চলে যাচ্ছি তখন আপনি ওকেও আমার সঙ্গে যেতে বলুন।
বাওনা বলল, শুধু এই তথ্যের উপর ভিত্তি করে বেনেসের উপর আমি কোন অভিযোগ আনতে পারি না। সে আমার অতিথি।
এরপর পড়ার ঘরে গিয়ে বনেসকে বাওনা বলল, কাল সকালে হ্যানসন উত্তর দিকে রওনা হচ্ছে। সে বলছিল তুমি যদি তার সঙ্গে যাও ত সে খুশি হবে।
পরদিন হ্যানসন যখন বেনেসকে সঙ্গে করে তার শিবিরের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল তখন বেনেস এক নীরব গাম্ভীর্যে স্তব্ধ হয়ে ছিল।
এক সময় হ্যানসন বলল, আমি হলে মেয়েটাকে কিছুতেই ছাড়তাম না। তবে এ ব্যাপারে আমার সাহায্যের যদি দরকার হয় তাহলে বলবে। মেয়েটি যদি তোমাকে ভালবাসে তাহলে অবশ্যই সে তোমার সঙ্গে যাবে।
বেনেস বলল, এখানে তা সম্ভব নয়। চারদিকে ওর লোকজন পাহারায় আছে। ধরে ফেলবে আমাদের।
হ্যানসন বলল, না ধরতে পারবে না। আমিও এ অঞ্চলে দশ বছর ধরে ব্যবসা করছি। আমারও জানাশোনা কম নেই এখানে। আমি বলছি তুমি একটা চিঠি লিখে দাও। আমি একটা লোক পাঠিয়ে দিচ্ছি। তুমি মেয়েটিকে লিখে দাও ও এসে পত্রপাঠ যেন দেখা করে তোমার সঙ্গে।
কথাটা মানতে মন চাইছিল না বেনেসের। তবু সে বুঝল হ্যানসন ঠিকই বলেছে। সে তখন একটা চিঠি লিখল মিনিয়েমকে। একটা লোক মারফৎ চিঠিটা পাঠিয়ে দিল হ্যানসন। তারপর আবার এগিয়ে চলল ওরা।
পথের ধারে একটা গাছ থেকে ওদের দেখে চিনতে পারল কোরাক। সে বুঝতে পারল বেনেস নামে ইংরেজ যুবকটাকে মেরিয়েমের মত দেখতে সেই মেয়েটির সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে দেখেছে সে। মেয়েটা দেখতে ঠিক মিরিয়েমের মত। তাকে দেখলেই মিরিয়েমকে মনে পড়ে যায় তার। কোরাক তাই ভাবল এই যুবকরা কোথায় শিবির স্থাপন করে তা সে লক্ষ্য রাখবে।
এদিকে মিরিয়েম সেদিন সন্ধ্যায় বাংলোর বারান্দাতে অশান্তভাবে পায়চারি করছিল আর বেনেসের কথা ভাবছিল।
চাঁদের আলোয় বাগানে বেড়াতে বেড়াতে বেড়ার কাছে চলে গেল। সহসা কার চাপা পদশব্দ শুনতে পেয়ে থমকে দাঁড়ালো। সে চাঁদের আলোয় দেখতে পেল একটা নিগ্রো বেড়ার ওধার থেকে একটা চিঠি দিয়ে চলে গেল। চিঠিটা কুড়িয়ে নিয়ে সেটা পড়ে দেখল মিরিয়েম। তাতে বেনেস লিখেছে, তোমার সঙ্গে একবার দেখা না করে আমি যেতে পারছি না। কাল সকালে বনের ধারে ফাঁকা জায়গাটায় এস। একা আসবে।
পরদিন সকাল না হতেই শিবির থেকে বেরিয়ে পড়ল বেনেস ঘোড়ায় করে। বেলা ন’টার সময় সে সেই ফাঁকা জায়গাটায় পৌঁছল। এদিকে কোরাকও তাকে গাছে গাছে অনুসরণ করে সেই জায়গায় পৌঁছল। অনেকক্ষণ ধরে সেখানে অপেক্ষা করে ক্লান্ত হয়ে পড়ল বেনেস। কোরাকও গাছের উপর সমানে বসে রইল।
অবশেষে মিরিয়েমের ঘোড়াটা দেখা গেল বাংলোর গেটের কাছে। ক্রমে সে এগিয়ে এল। তার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে দুটি মানুষ।
মেয়েটি কাছে এলে তাকে চিনতে পারল কোরাক। সে-ই মিরিয়েম। তার বুকটাকে যেন কে বিদ্ধ করল। মিরিয়েম তাহলে বেঁচে আছে, মরেনি। একবার ভালব একটা বিষাক্ত তীর মেরে ইংরেজ যুবকটির প্রাণনাশ করবে সে। কিন্তু আবার ভাবল মিরিয়েম যাকে ভালবাসে তাকে হত্যা করবে না সে কখনো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বেনেস ঘোড়া ছুটিয়ে তার শিবিরের দিকে চল গেল। কোরাকও তাকে অনুসরণ করে শিবিরের কাছে একটা গাছের উপর উঠে বসে রইল। সে ভাবল নিশ্চয় আজ রাতে বেনেস আবার সেই ফাঁকা জায়গাটায় মিরিয়েমকে আনতে যাবে। কিন্তু সন্ধ্যে হতেই সে দেখল বেনেসের পরিবর্তে অন্য এক শ্বেতাঙ্গ এক নিগ্রো ভৃত্যকে সঙ্গে নিয়ে ঘোড়ায় চেপে রওনা হলো।
রাত্রি প্রায় নটার সময় মিরিয়েম তার ঘোড়ায় চেপে হ্যানসনের কাছে এল। বেনেসকে দেখতে না পেয়ে বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেল সে। হ্যানসন বলল, বেনেস ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে পায়ে আঘাত পেয়েছে। আজ রাতটা সে বিশ্রাম করবে। তাই আমাকে পাঠিয়ে দিল। নাও, তাড়াতাড়ি করো, তা না হলে আমরা ধরা পড়ে যাব।
পরের দিন দুপুরের দিকে ওরা বন পার হয়ে একটা নদীর ধারে এসে পৌঁছল। নদীর ওপারে একটা শিবির দেখা গেল। শিবিরটা দেখে মনে আশা হলো মিরিয়েমের। নদীটা পার হয়ে মিরিয়েম বলল, বেনেস কোথায়?
হ্যানসন শিবিরের একটা ঘর দেখিয়ে বলল, ঐ ঘরে।
কিন্তু ঘরের মধ্যে ঢুকে বেনেসকে দেখতে না পেয়ে ভয় পেয়ে গেল মিরিয়েম। হ্যানসনের মুখে এক ক্রুর হাসি ফুটে উঠল।
মিরিয়েম বুঝতে পারল হ্যানসন তাকে ঠকিয়েছে। হ্যানসন ক’দিন ধরে দাড়ি কামায়নি বলে তার মুখে বেশ দাড়ি গজিয়ে উঠেছে। এবার তার মুখপানে তাকিয়ে মিরিয়েম বেশ বুঝতে পারল আসলে এই হ্যানসনই শয়তান মলবিন।
যে নিগ্রো ভৃত্যটিকে বনের প্রান্তে দাঁড় করিয়ে রেখে মিরিয়েমের সঙ্গে দেখা করতে যায় মলবিন সে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। রাত গভীর পর্যন্ত অপেক্ষা করেও সে যখন দেখল তার মালিক হ্যানসন ফিরে এল না তখন সে একটা গাছের উপর উঠে পড়ল।
এদিকে মরিসন বেনেস সারারাত একটুও ঘুমোতে পারেনি। বেনেস বুঝতে পারল মেয়ে চুরির জন্য বাওনা অবশ্যই তাদের খোঁজ করবে। তাই সে অনিচ্ছাসত্ত্বেও শিবির তুলে দিয়ে রওনা হলো।
দুপুরের দিকে হ্যানসনের সঙ্গী সেই নিগ্রো ভৃত্যটি ঘর্মাক্ত দেহে ওদের কাছে এসে হাজির হলো। এসেই সে অন্যান্য নিগ্রো ভৃত্যদের হ্যানসনের শয়তানির কথা সব বলল।
তার কথা শুনে সবাই হ্যানসনের উপর রেগে গেল। বেনেস সব কথা শুনে হ্যানসনের বিশ্বাস ঘাতকতার কথা বুঝতে পারল। বুঝল তাকে এতখানি বিশ্বাস করা উচিত হয়নি।
সেই নিগ্রো ভৃত্যটিকে ডেকে বেনেস বলল, তোমার মালিক কোথায় গেছে তা তুমি জান? সেখানে তুমি আমাকে নিয়ে যেতে পারবে?
ভৃত্যটি বলল, হ্যাঁ, পারব মালিক। অনেক দূরে একটা বড় নদীর ধারে সে তার কিছু লোককে পাঠিয়ে দিয়ে এক নতুন শিবির গড়ে তুলেছে।
এরপর বেনেস সর্দারকে বলল, তোমরা উত্তর দিকে যাও। আমি পরে ফিরে যাব।
এদিকে কোরাক যখন গাছের উপর উঠে দেখল ইংরেজ যুবক বেনেস সকালবেলায় উল্টো দিকে যাত্রা করল তখন সে একাই মিরিয়েমকে দেখার জন্য সেই বনের ধারে ফাঁকা জায়গাটার কাছে গিয়ে হাজির হলো। কিন্তু সেখানে মিরিয়েমকে দেখতে পেল না।
মিরিয়েম মলবিনের সঙ্গে লড়াই করতে করতে হঠাৎ তার রিভলবারটা হাতে পেয়ে যায়। কিন্তু রিভলবারে কোন গুলি ছিল না। তখন মলবিন তাকে আবার ধরে ফেলে। কিন্তু নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে মলবিনের রাইফেলটা তুলে নিয়ে তার বাঁট দিয়ে মাথায় সজোরে আঘাত করতেই অচেতন হয়ে পড়ে যায় সে।
সঙ্গে সঙ্গে শিবির থেকে বেরিয়ে বনের দিকে ছুটতে থাকে মিরিয়েম। সে ভাবল আবার তার বাওনার কাছে ফিরে যাবে। কিন্তু সে অনেক দূরের ও অনেক দিনের পথ।
এই ভেবে সে আবার শিবিরের কাছাকাছি গিয়ে গাছ থেকে দেখল মুখ থেকে রক্ত মুছতে মুছতে মলবিন তার সব লোক নিয়ে শিবির থেকে বেরিয়ে গেল। শিবিরে কেউ নেই দেখে সে সোজা শিবিরের মধ্যে চলে গেল। তাঁবুর কোণে একটা বাক্সের মধ্যে কিছু গুলি, একটি বাচ্চা মেয়ের ফটো আর কিছু খবরের কাগজের কাটা টুকরো পেল। এই সব কিছু তার পকেটে ভরে নিল সে। কিন্তু তার এই ছেলেবেলাকার ফটোটা মলবিনের কাছে কি করে এল, কি করেই বা তা খবরের কাগজে ছাপা হলো তা সে বুঝতে পারল না।
এমন সময় মলবিনের গলা শুনতে পেল। ও তাঁবুর দিকে ফিরে আসছে। তখন মিরিয়েম তাঁবুর পিছন থেকে ত্রিপলটা উঠিয়ে গুঁড়ি মেরে বাইরে চলে গেল। তারপর ভৃত্যদের ঘরের পাশে যে একটা বড় গাছ। ছিল তার উপর উঠে পড়ল।
সেখান থেকে লক্ষ্য করল মিরিয়েম নদীর ঘাটে দু-তিনটে ছোট ডিঙ্গি নৌকা রয়েছে। নদীর ওপারে ঘন বন। নদীটা পার হয়ে সেই বনে যেতে পারলে সে অনেকটা নিরাপদ হবে। ভাবল এখন দিনের শেষ। অন্ধকার হলেই নদীটা পার হবে সে।
সে দেখল মলবিন আর একবার তার খোঁজ করে তার লোকদের নিয়ে দুটো নৌকায় করে ওপারে চলে গেল। একটা নৌকা রয়ে গেল।
ওদিকে মলবিন ওপারে গিয়ে লক্ষ্য রাখছিল নৌকাটার উপর। সে জানত আজ হোক কাল হোক ঐ নৌকাটা করে মিরিয়েম নদী পার হয়ে পালাবে। হটাৎ সে দেখল সত্যিই মিরিয়েম নৌকায় করে নদীর প্রায় মাঝখানে এসে পড়েছে।
তখনি মলবিন তার লোকদের নিয়ে নৌকায় চেপে মিরিয়েমের নৌকাটাকে ধরতে গেল। মিরিয়েমের নৌকাটা কূলের কাছাকাছি যেতেই নৌকা থেকে নেমেই মিরিয়েম জঙ্গলের দিকে ছুটতে লাগল। মলবিন যখন দেখল মিরিয়েমকে ধরার আর কোন উপায় নেই তখন সে তার রাইফেলটা নিয়ে তাকে লক্ষ্য করে গুলি করল। কিন্তু গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। মিরিয়েম জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
এদিকে বেনেস সেই ভূত্যকে নিয়ে নদীটার ধারে এসে পড়ল। ভৃত্যটি বলল, আমরা এসে পড়েছি মালিক। কিছুক্ষণ আগেই তারা মলবিনের রাইফেরের গুলির আওয়াজ শুনতে পেয়েছে। নদীর ধারে এসে বেনেস বলল, নদীটা পার হব কি করে?
নিগ্রো ভূত্যটি তখন নদীর কোলের কাছে একটা গাছের তলায় একটা ছোট ডিঙ্গি নৌকা দেখতে। পেল। ওরা দু’জনে নৌকাটায় উঠতেই নৌকাটা তীর বেগে ছুটে যেতে লাগল ওপারের দিকে। নদীর মাঝখানে গিয়ে বেনেস দেখতে পেল ওপারের ঘাটে একটা নৌকা থেকে কয়েকজন লোক নামছে। প্রথমে যে নামল সে হলো মলবিন।
এবার মলবিনও দেখতে পেল মাঝ নদীতে একটা নৌকাতে করে বেনেস ও একজন নিগ্রো লোক তাদের দিকে আসছে।
তাই মলবিন চীৎকার করে বলল, কি চাও?
বেনেস উত্তরে বলল, শয়তান কোথাকার, কি চাই?
এই বলে সে রিভলবার থেকে গুলি করল মলবিনকে লক্ষ্য করে। মলবিনও তার রাইফেল থেকে গুলি করল বেনেসকে লক্ষ্য করে। মলবিনের একটা গুলি বেনেসের নিগ্রো ভৃত্যটির কপালে বিদ্ধ হওয়ায় সে সঙ্গে সঙ্গে মারা গেল। বেনেসের নৌকাটা স্রোতের টানে ভেসে চলল। বেনেস আবার গুলি করল এবং তার আঘাতে নদীর ঘাটে পড়ে গেল মলবিন।
ক্রমে, নদীর বাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেল বেনেসের নৌকাটা।
গাঁয়ের পথ অর্ধেকটা পার হবার আগেই কতকগুলো সাদা পোশাক পরা নিগ্রো পাশের কুঁড়েগুলো থেকে অকস্মাৎ লাফিয়ে উঠল। মিরিয়েম পালাবার চেষ্টা করতেই একজন তাকে ধরে ফেলল। মুখ ঘুরিয়েই মিরিয়েম দেখল তার সামনে সেই বুড়ো শেখ দাঁড়িয়ে আছে। ভূত দেখে যেন চমকে উঠল মিরিয়েম।
শেখ বলল, তাহলে আবার ফিরে এসেছ তুমি আমার কাছে। এসেছ খাদ্য আর আশ্রয়ের সন্ধানে।
মিরিয়েম বলল, না, আমি কিছুই চাই না। আমি শুধু আমার বড় বাওনার কাছে ফিরে যেতে চাই।
শেখ বলল, বড় বাওনার কাছেই তুমি তাহলে এতদিন ছিলে? বড় বাওনাই নদী পার হয়ে এখন তোমাকে খুঁজতে আসছে।
মিরিয়েম বলল, না, যে সুইডিস লোকটাকে তুমি একদিন গাঁ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলে এবং যে একদিন আমাকে চুরি করে নিয়ে যাওয়ার জন্য মবিদার সঙ্গে চক্রান্ত করেছিল ও হচ্ছে সেই।
সঙ্গে সঙ্গে শেখ তার লোকদের হুকুম দিল তারা যেন নদীর ধারে মলবিনকে দেখতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে মেরে ফেলে।
কিন্তু শেখ সদলবলে নদীর দিকে যাবার আগেই মলবিন পালিয়ে যায়। সে মরেনি। বেনেসের নৌকাটা অদৃশ্য হয়ে যাবার পর সে উঠেই শেখকে দেখতে পায়। শেখকে সে দারুণ ভয় করত। তাই মুহূর্তের মধ্যে গা-ঢাকা দেয়।
মলবিনকে না পেয়ে শেখ মিরিয়েমকে বন্দী করে তার গায়ের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।
দু’দিন ক্রমাগত পথ চলার পর শেখ তার গায়ে গিয়ে পৌঁছল।
গাঁয়ে যেতেই অনেক লোক ভিড় করে এল মিরিয়েমকে দেখার জন্য। মিরিয়েম এখন অনেকটা বড় হয়েছে।
অচৈতন্য বেনেসকে নিয়ে নৌকাটা স্রোতের টানে ভেসে চলছিল। চেতনা ফিরে পেয়ে বেনেস দেখল তখন রাত্রিকাল। আহত অবস্থায় নৌকাতে সে সম্পূর্ণ একা।
সে কোনরকমে একটু বসে হাত দিয়ে জল কেটে নৌকাটাকে কূলের দিকে নিয়ে যেতে লাগল।
কিন্তু বনের কাছে কোন রকমে যেতেই একটা সিংহের গর্জন শুনতে পেল সে। তার মনে হলো সিংহটা নদীর পারে যেন তারই জন্য দাঁড়িয়ে আছে। কুলের কাছে একটা গাছের ডাল দেখতে পেয়ে নৌকার উপর থেকে ডালটা ধরে ফেলল বেনেস। কিন্তু নৌকাটা থেকে পা দুটো তুলতেই নৌকাটা স্রোতের টানে চলে গেল। সে ঝুলতে লাগল। একবার ভাবল নদীতেই সে ঝাঁপ দেবে। কিন্তু পায়ের কাছে একটা কুমীরের হাঁ দেখে ভয়ে হিম হয়ে গেল সে। এমন সময় তার হাতের উপর একটা মাংসল বস্তু অনুভব করল। সঙ্গে সঙ্গে কে যেন তাকে ধরে গাছের উপর তুলে নিল।
এদিকে কোরাক বনের মাঝে হাতির দল নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে সেই গাছটার উপর শুয়েছিল। সেদিন সে এই গাছটার উপর যখন শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল তখন একটা সিংহের ডাকে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। সে দেখতে পায় নদীর পাড়ে একটা সিংহ গর্জন করছে আর নদীর উপর সেই গাছটার একটা ডাল ধরে একটা লোক ঝুলছে। লোকটা অসহায় ভেবে সে তাকে গাছের উপর তুলে নেয়।
বেনেস ভাবল একটা উলঙ্গ গোরিলা তাকে ধরেছে। সে রিভলবারটা খাপ থেকে বার করে গুলি করতে যাচ্ছিল এমন সময় কে তাকে মানুষের ভাষায় জিজ্ঞাসা করল, কে তুমি?
বেনেস বলল, হা ভগবান! তুমি মানুষ? আমি ত ভেবেছিলাম তুমি গোরিলা।
কোরাক বলল, তুমি কে?
বেনেস বলল, আমি এক ইংরেজ। নাম বেনেস। কিন্তু তুমি কে?
কোরাক বলল, আমাকে ওরা কোরাক বলে, তার মানে হত্যাকারি। আচ্ছা তুমিই কি সেই লোক যে বনের ধারে ফাঁকা জায়গাটায় একটি মেয়েকে নিয়ে গল্প করছিলে আর ঠিক তখনি একটা সিংহ তোমাদের আক্রমণ করে?
বেনেস বলল, হ্যাঁ।
এখানে কি করছিলে?
মেয়েটিকে চুরি করে নিয়ে গেছে। আমি তাকে উদ্ধার করার চেষ্টা করছি।
কোরাক আশ্চর্য হয়ে বলল, কে তাকে চুরি করেছে?
কোরাককে তখন সব কথা খুলে বলল বেনেস। হ্যানসনের শিবিরটা কোথায় তাও বলল।
কোরাক তখন বলল, আমি তার শিবিরে যাচ্ছি।
এই বলে কোরাক রওনা হয়ে পড়ল গাছ থেকে নেমে। কোরাক অনেক দূর চলে গেলে বেনেস তার পিছু পিছু যেতে লাগল। বেনেস হঠাৎ তার পিছনে একটা ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনে পাশের একটা ঝোপে লুকিয়ে রইল। আড়াল থেকে দেখল সাদা আলখাল্লা পরা একটা আরব ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেল উত্তর দিকে। কিছুক্ষণ পর আবার অনেকগুলো ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনতে পেল। কিন্তু এবার আর পথের ধারে লুকোবার কোন ঝোপ বা আড়াল পেল না।
বেনেস যখন পথ থেকে সরে যাচ্ছিল তখন আরবরা ঘোড়া থেকে নেমে তাকে ধরে ফেলল। তারা আরবী ভাষায় বেনেসকে কি বলল। কিন্তু বেনেস তা বুঝতে পারল না। তখন আরবদের সর্দার দু’জনকে হুকুম দিল তারা যেন বেনেসকে বেঁধে শেখের বাড়িতে নিয়ে যায়। বাকী আরব অশ্বারোহীরা কোরাকের খোঁজে চলে গেল।
ততক্ষণে বেনেসের নির্দেশমত কোরাক সেই নদীটার ধার দিয়ে চলতে চলতে হ্যানসনের শিবিরটার উল্টো দিকে এসে পড়েছে। কিন্তু নদীটা পার হবে কি করে? এমন সময় একটা হাতির ডাক শুনতে পেয়ে তাকে ডাকল কোরাক।
হাতিটা কাছে এলে কোরাক বলল, আমাকে নদীটা পার করে ঐ শিবিরে নিয়ে চল।
কোরাককে হুঁড় দিয়ে পিঠে তুলে সাঁতার কেটে নদী পার হয়ে শিবিরে নিয়ে হাজির হলো হাতিটা।
হ্যানসন তখন আহত অবস্থায় বাইরে শুয়েছিল। হাতিটা তার দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে সে ভয় পেয়ে গেল।
কোরাক হাতিটাকে সেখানে থামতে বলে পিঠের উপর থেকে হ্যানসনকে জিজ্ঞাসা করল, মেয়েটি কোথায়?
হ্যানসন শুয়ে শুয়েই বলল, এখানে কোনো মেয়ে নেই।
কোরাক বলল, শ্বেতাঙ্গ মেয়েটি কোথায়? মিথ্যা কথা বলো না। তুমি তাকে তাদের বন্ধুদের কাছ থেকে ভুলিয়ে এনেছ।
মলবিন বলল, আমি নই, বেনেস নামে একজন ইংরেজ তাকে চুরি করে লন্ডনে নিয়ে যেতে চেয়েছিল।
কোরাক বলল, আমি তার কাছ থেকেই আসছি। মেয়েটি তার কাছে নেই। সে আমাকে পাঠিয়েছে। মেয়েটিকে নিয়ে যাবার জন্য। মিথ্যা কথা বলো না।
এই বলে হাতির পিঠ থেকে নেমে মলবিনের কাছে এগিয়ে গেল ভীতিবিহ্বল ভঙ্গিতে।
মলবিন বলল, আমার কোন ক্ষতি করো না, আমি তোমাকে সব কথা খুলে বলছি। মেয়েটিকে আমি এখানেই এনেছিলাম। কিন্তু সে নদী পার হয়ে পালিয়ে যায়। পরে শেখের হাতে ধরা পড়ে। আমি তাকে উদ্ধার করতে গেলে শেখ আমাকে তাড়িয়ে দেয়।
কোরাক আশ্চর্য হয়ে বলল, সে তাহলে শেখের মেয়ে নয়? তাহলে কার মেয়ে?
মলবিন বলল, তুমি তাকে আগে খুঁজে বার করো। তারপর আমি সব বলব। কিন্তু আমাকে যদি মেরে ফেল তাহলে তার কথা কিছুই জানতে পারবে না।
কোরাক বলল, আমি এখন শেখের গাঁয়ে যাব। সেখানে সে না থাকে ফিরে এসে তোমাকে হত্যা করব।
মলবিনকে দেখার পরই হাতিটার মনে সন্দেহ জাগে। তখন সে তার দেহটা শুঁকে বুঝতে পারল এই লোকটাই কয়েক বছর আগে তার সাথীকে হত্যা করে। হাতিরা কখনো তাদের শত্রুকে ভোলে না, সে তাই একবার রাগে গর্জন করে মলবিনের দেহটা শুড় দিয়ে জড়িয়ে ধরে তাকে তুলে নিল। মলবিন ভয়ে চীৎকার করে কোরাককে বলল, আমাকে বাঁচাও, মেরে ফেলল।
কোরাক ছুটে এসে হাতিটাকে বিরত করার চেষ্টা করলেও হাতিটা তার গুঁড় থেকে মলবিনকে মাটিতে ফেলে দিয়ে পা দিয়ে মাড়িয়ে দিল। তারপর তার রক্তাক্ত মাংসপিণ্ডটা তাঁবুর উপর ছুঁড়ে ফেলে দিল।
শেখের বাড়িতে বেনেসকে বেঁধে তার লোকেরা ধরে নিয়ে গেলে শেখ বেনেসকে ফরাসী ভাষায় জিজ্ঞাসা করল, কে তুমি?
বেনেস বলল, আমি লন্ডনের মরিসন বেনেস।
শেখ বলল, তুমি আমার দেশে কি করছিলে?
বেনেস বলল, তার বাড়ি থেকে অপহৃতা এক তরুণীর খোঁজ করছিলাম আমি। পথে তোমার লোকেরা আমাকে ধরে।
শেখ বলল, তরুণী? তবে কি এই মেয়েটা?
মিরিয়েম তখন তাদের পিছনের সেই তাঁবুরই এক দিকে বসেছিল। তাকে চিনতে পেরে বেনেস ডাকল, মিরিয়েম।
মুখ ঘুরিয়ে মিরিয়েম বলল, মরিসন!
বেনেস বুঝতে পারল না মিরিয়েম হ্যানসনের কাছ থেকে এখানে কিভাবে এল।
শেখ তখন তার লোকদের বেনেসকে একটা ঘরে বন্দী করে রাখার হুকুম দিল। তারা হাত দুটো বেঁধে একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে মেঝের উপর ফেলে দিল।
এমন সময় বেনেস শুনতে পেল পাশের ঘরে একজন পুরুষের সঙ্গে মিরিয়েমের জোর কথা কাটাকাটি আর ধস্তাধস্তি চলছে। তা শুনে আর থাকতে পারল না বেনেস। সে অনেক চেষ্টা করার পর একটা হাতের বাঁধন খুলে ফেলল। পাশের ঘরে যাবার জন্য ঘর থেকে বার হতেই একটা নিগ্রো প্রহরী তার পথ রোধ করে দাঁড়াল।
এদিকে কোরাক তার সেই হাতির পিঠে চেপে মিরিয়েমের খোঁজে শেখের গায়ের কাছে এসে হাতির পিঠ থেকে নেমে পড়ল। তার কাছে একটা লম্বা দড়ি আর একটা ছুরি ছাড়া আর কিছু ছিল না। তারপর মিরিয়েমের খোঁজে আরবদের তাঁবুগুলো দেখতে দেখতে এগিয়ে চলল। তখন অনেক আরব খাওয়ার পর তামাক খাচ্ছিল তাঁবুর ভিতরে বসে।
শেখ তখনও ঘুমোয়নি। খাওয়ার পর মিরিয়েমকে ডাকল শেখ।
শেখ মিরিয়েমকে বলল, আমি বুড়ো হয়েছি। আর বেশিদিন বাঁচব না। আমি তাই তোমাকে আমার ভাই আলি বেন কাদিনের হাতে তুলে দিচ্ছি। তুমি এবার থেকে তারই কাছে থাকবে।
এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে আলি বেন মরিয়েমকে টানতে টানতে তার ঘরে নিয়ে গেল। মিরিয়েম প্রাণপণে তাকে বাধা দিচ্ছিল।
বেনেস তার ঘর থেকে বার হতেই একজন নিগ্রো প্রহরী তাকে বাধা দিল। বেনেস তাঁর গলাটা টিপে ধরতেই সে একটা ছুরি দিয়ে বেনেসের কাঁধে আঘাত করে। বেনেস তখন হাতের কাছে একটা পাথর পেয়ে তাই দিয়ে প্রহরীটার মাথায় আঘাত করতে থাকায় সে পড়ে গেল। তারপর মিরিয়েম যে তাঁবুতে ছিল সেই দিকে এগিয়ে গেল।
কোরাক তার আগেই সেই তাঁবুতে ঢুকে পড়েছে। আলি বেন তখনো মিরিয়েমের হাতটা ধরে ছিল। মিরিয়েম কোরাককে দেখার সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারল।
কোরাক নীরবে আলি বেনের গলাটা ধরে বুকের উপর ছুরি মারল। আলি বেনের নিষ্প্রাণ দেহটা লুটিয়ে পড়ল মেঝের উপর। এমন সময় রক্তাক্ত দেহে টলতে টলতে বেনেস ঘরে ঢুকল। তখন শেখের লোকজন খবর পেয়ে তাঁবুর দিকে ছুটে আসছিল।
কোরাক বেনেসকে দেখে চিনতে পারল। বলল, তোমরা পালিয়ে যাও।
মিরিয়েম বলল, আর তুমি?
কোরাক বলল, পরে যাব আমি।
এই বলে যারা তাঁবুতে আসছিল তাদের সঙ্গে লড়াই করতে লাগল কোরাক। বেনেস মিরিয়েমকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
সঙ্গে সঙ্গে দলে দলে আরবরা এসে ঘিরে ধরল কোরাককে। সে একা অনেকক্ষণ ধরে লড়াই করল অনেকের সঙ্গে। কিন্তু ক্রমে সংখ্যায় ওরা অনেক বেড়ে যাওয়ায় আর পেরে উঠল না। তখন ওরা ওর হাত পা বেঁধে শেখের কাছে ধরে নিয়ে গেল।
শেখ তার লোকদের বলল, ওকে পুড়িয়ে মার।
একজন আরব শেখকে খবর দিল গাঁয়ের বাইরে গেটের কাছে একটা হাতি ঘোরাফেরা করছে। এমন সময় কোরাক একবার চীৎকার করল অদ্ভুতভাবে এবং হাতিটাও তার উত্তর দিল। ওরা কেউ কিন্তু এর মানে বুঝতে পারল না। গাঁয়ের মাঝখানে একটা খুঁটি পোঁতা ছিল।
কোরাককে সেই খুঁটিতে বেঁধে তার পাশের কাঠের গাদায় আগুন লাগিয়ে দেয়া হলো। আগুন দাউ দাউ করে জ্বলতে জ্বলতে তার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। কোরাক আবার চীৎকার করে হাতিটাকে সঙ্কেত জানাল। হাতিটা ততক্ষণে প্রবল গর্জন করতে করতে কাঠের গেটটা জোরে ঠেলা দিতে গেটটা ভেঙ্গে গেল। তারপর উন্মত্তভাবে কোরাকের কাছে ছুটে গেল। তারপর শুড় দিয়ে খুঁটিটাকে জড়িয়ে ধরে তাকে পিঠের উপর তুলে নিয়ে ছুটে এসে গা থেকে বেরিয়ে যেতে লাগল। শেখ একটা রাইফেল তুলে হাটিতার সামনে পথের উপর দাঁড়িয়ে গুলি করল হাতিটাকে। কিন্তু গুলিটা লাগল না। তখন হাতিটা রেগে গিয়ে শেখকে ফেলে দিয়ে পা দিয়ে মাড়িয়ে গেল।
বেনেস আর মিরিয়েম গাঁয়ের বাইরে গিয়ে কোরাকের জন্য অপেক্ষা করছিল। তারা এক সময় দেখল হাতিটা কোরাককে পিঠে চাপিয়ে ছুটে পালাচ্ছে আর গাঁয়ের লোকগুলো ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে। এই অবসরে তারা সুযোগ বুঝে দুটো ঘোড়া নিয়ে তার উপর চেপে সোজা বড় বাওনার বাংলোর দিকে যেতে লাগল।
ওরা উত্তর দিকে ক্রমাগত সারারাত ধরে ঘোড়া ছুটিয়ে চলল। সকাল হতেই দেখল বড় বাওনা নিজেই একদল নিগ্রো যোদ্ধা নিয়ে তাদের খোঁজে এগিয়ে আসছে। বেনেসকে দেখেই রাগে কুঞ্চিত হয়ে উঠল বাওনার দুটো। কিন্তু মিরিয়েমের মুখ থেকে সব কথা না শোনা পর্যন্ত মুখে কিছু বলল না।
মিরিয়েমের কাছ থেকে সব কথা শুনে বাওনা কোরাকের জন্য চিন্তিত হয়ে উঠল।
বাওনা তখন তার প্রধান ভূত্যকে বলল, মিরিয়েম আর বেনেসকে বাংলোতে নিয়ে যাও। আমার ঘোড়াটাও নিয়ে যাও। আমি জঙ্গলে যাচ্ছি।
মিরিয়েম প্রথমে তার ঘোড়ায় করে বাওনার লোকদের সঙ্গে বাংলোর দিকে এগিয়ে চলল। কিন্তু কোরাকের কথাটা কিছুতেই ভুলতে পারল না সে। সে নিগ্রো ভৃত্যদের সর্দারকে বলল, আমি বাওনার সঙ্গে জঙ্গলে যাচ্ছি।
কিন্তু সর্দার আপত্তি জানালে মিরিয়েম ঊর্ধ্বশ্বাসে শেখের গাঁয়ের দিকে গাছে গাছে যেতে লাগল। অনেক দূর যাওয়ার পর সে বাতাসে হাতির গন্ধ পেল।
মিরিয়েম দেখল কোরাক হাতির পিঠে চেপে তার পথেই আসছে। কাছে আসতে গাছের উপর থেকে ডাকল কোরাককে। কোরাক আসতেই মিরিয়েম তার দিকে ছুটে গেল তার বাঁধন খোলার জন্য। কিন্তু হাতিটা শত্রু ভেবে খুঁড় উঁচিয়ে তেড়ে এল মিরিয়েমকে। কোরাক চীৎকার করে বলল, চলে যাও মিরিয়েম, ও তোমাকে মেরে ফেলবে।
কোরাক আবার বলল, তুমি এখন চলে যাবার ভান করো। আমি হাতিটাকে নদী থেকে জল আনতে পাঠাব। তখন তুমি এসে আমার বাঁধন খুলে দেবে।
হাতিটা প্রথমে চলে গেল। কিন্তু ওরা ভীষণ চালাক। কিছুটা যাওয়ার পর দেখল মিরিয়েম গাছ থেকে নেমে কোরাকের কাছে এল। হাতিটা যেতে যেতে হঠাৎ থেমে একবার অপেক্ষা করল। তারপর মিরিয়েমের দিকে ছুটে গেল। মিরিয়েম প্রাণ ভয়ে গাছটার দিকে ছুটে যেতে লাগল। কিন্তু হাতিটা উন্মত্ত হয়ে ছুটতে লাগল। কোরাক দেখল মিরিয়েমকে এখনি ধরে ফেলবে হাতিটা। তার বাঁচার আর কোন আশা নেই।
এমন সময় একটা গাছ থেকে এক দৈত্যাকার শ্বেতাঙ্গ হাতিটার সামনে নেমে পড়ে হাত বাড়িয়ে থামতে বলল তাকে। হাতিটা মন্ত্রমুগ্ধের মত থেমে গেল। মিরিয়েম নিরাপদে গাছে উঠে পড়ল। মিরিয়েম শ্বেতাঙ্গকে চিনতে পেরে বলে উঠল, বাওনা!
বাওনা এবার কোরাকের দিকে মুখ করে বলল, জ্যাক!
কোরাক বলল, বাবা! ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, তুমি এসে পড়েছিলে। তুমি ছাড়া আর কেউ হাতিটাকে থামাতে পারত না।
এবার টারজান নিজের হাতে জ্যাকের হাত পায়ের বাঁধন কেটে মুক্ত করে দিল।
হঠাৎ হাতিটা চীৎকার করে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ওরা সবাই দেখল বনের একদিক থেকে কতকগুলো বাঁদর-গোরিলা টারজনের দিকে এগিয়ে আসছে। তাদের সকলের সামনে আছে আকুৎ। আকুৎ অভিবাদন জানাল টারজানকে। তাদের ভাষায় বলল, জঙ্গলের রাজা টারজান আবার ফিরে এসেছে।
বাংলোর কাছাকাছি সেই মাঠটায় পৌঁছতে ওদের দু’দিন লেগে গেল।
বাংলোতে গিয়ে টারজান তার স্ত্রী জেনকে সুখবরটা দিয়ে বলল, ছেলে আর মেয়ে দুটোকেই পাওয়া গেছে।
হারানো ছেলে আর মেয়ের মত মিরিয়েমকে ফিরে পাওয়ার আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠল জেন।
কোরাক আর মিরিয়েম আসতে দু’হাত দিয়ে দুজনকে জরিয়ে ধরল জেন। তারপর মিরিয়েমকে বলল, একটা দুঃখের বিষয় বেনেস সেই অসুখেই মারা গেছে।
জেন একবার তার ছেলের দিকে তাকাল। তার ছেলেই একদিন লর্ড গ্রেস্টোক হবে। মিরিয়েমের যোগ্যতা সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই তার। সে শুধু জানতে চায় জ্যাক মিরিয়েমকে সত্যিই ভালবাসে কি না।
কিন্তু জ্যাকের চোখেই এ কথার উত্তর খুঁজে পেল জেন।
জেন বলল, আজ আমি আমার সত্যিকারের মেয়েকে পেলাম।
নিবটবর্তী কোন চার্চে বিয়েটা হবার পরই ওরা দেশে ফিরল। ওরা লন্ডনের বাড়িতে ফিরলে পর টারজনের বন্ধু দার্ণতের চিঠি নিয়ে একদিন জেনারেল আর্মন্দ জ্যাকৎ এসে দেখা করল টারজনের সঙ্গে।
জেনারেল জ্যাকৎ একটা ফটো দেখিয়ে টারজানকে তার মেয়ে চুরি যাওয়ার ঘটনার কথা সব বলল। তারপর বলল, সপ্তাহখানেক আগে আবদুল কামাক নামে এক আরব তার কাছে গিয়ে বলে তার মেয়েকে মধ্য আফ্রিকার এক আরব শেখ তার ঘরে বন্দিনী করে রেখেছে। তাই আমার মেয়ের উদ্ধারের ব্যাপারে আপনার সাহায্য চাই।
ফটোটা দেখে টারজান মিরিয়েমকে তাদের কাছে ডেকে পাঠাল।
মিরিয়েম তাদের কাছে এলে জ্যাকৎ তাকে চিনতে পারল। বলল, কিন্তু ও হয়ত আমায় চিনতে পারবে না।
এই বলে মিরিয়েমকে বলল, আমার মেয়ে, তুই আমার মেয়ে।
মিরিয়েমও এবার তার বাবাকে চিনতে পেরে বলল, আমার বাবা। এবার আমি চিনতে পেরেছি। সব কথা মনে পড়েছে আমার।
এই বলে সে তার বাবাকে জড়িয়ে ধরল। মিরিয়েম তার বাবা মাকে ফিরে পাওয়ায় তারা সবাই খুশি হলো।