টারজনের পশুসঙ্গীরা (দি বীস্টস অফ টারজান)
লর্ড গ্রেস্টোক একদিন যে বাঁদরদলের রাজা’ নামে পরিচিত ছিল তখন প্যারিসে তার বন্ধু লেফটন্যান্ট পল দার্ণতের বাড়িতে বসে ছিল। সে তখন ভাবছিল তার শত্রু রোকোফের পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা। তারই সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে এই রোকোফের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।
টারজান বলল, আমি নিজের জন্য ভাবি না পল। অতীতে তার অনেক কু-অভিসন্ধিই ব্যর্থ করেছি আমি। আমার যতদূর মনে হয় সে আমাকে কায়দা করতে না পেরে আমার স্ত্রী পুত্রের মাধ্যমেই আমার উপর প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা করবে এখন। তাই আমাকে ফিরে গিয়ে বাড়িতে থাকতে হবে রোকোফ আবার ধরা না পড়া পর্যন্ত।
টারজান যখন এইভাবে তার বন্ধুর সঙ্গে প্যারিসে বসে কথা বলছিল ঠিক সেই সময়ে লন্ডনের এক বাড়িতে দু’জন কুটিলদর্শন লোক কথা বলছিল নিজেদের মধ্যে। তাদের মধ্যে একজনের মুখে ছিল বড়। দাড়ি আর একজনের মুখে ছিল মাত্র কয়েকদিনের অল্প দাড়ি।
কম দাড়িবিশিষ্ট লোকটি দাড়িওয়ালা লোকটিকে বলল, তোমার দাড়িটা কামিয়ে ফেলতে হবে। এ্যালেক্সি। তা না হলে ওরা তোমায় চিনে ফেলবে। এখন আমাদের এখানেই ছাড়াছাড়ি হবে। এরপর যখন আমাদের কিনসেড জাহাজে দেখা হবে তখন আমাদের সম্মানিত অতিথি দু’জনও এসে পড়বেন। যাদের জন্য আমাদের এই সমুদ্র যাত্রার পরিকল্পনা।
রোকোফ বলল, আমাদের চেষ্টা সফল হলে তাতে আমদের লাভ আর আনন্দ দুই-ই হবে। ফরাসীরা কী বোকা! আমার পালিয়ে যাবার খবরটা জেল কর্তৃপক্ষ গোপন রেখেছে। তার ফলে আমার পরিকল্পনাটা কার্যকরী করার প্রচুর সুযোগ পেয়েছি আমি। এখন বিদায়।
এর তিন ঘণ্টা পরই প্যারিসে পল দার্ণতের বাসায় একখানা টেলিগ্রাম এসে হাজির হলো। টারজান সেটা পড়ে দার্ণতের হাতে দিয়ে বলল, পড়ে দেখ পল।
পল পড়ে দেখল, তাতে লেখা আছে, নতুন চাকরের যোগসাজসে কে আমাদের বাগানবাড়ি থেকে জ্যাককে চুরি করে নিয়ে গেছে। অবিলম্বে চলে এস।-জেন।
লন্ডনের বাড়িতে গিয়ে টারজান তার স্ত্রীর সঙ্গে কিছুক্ষণ এখন কি করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করতে লাগল। এমন সময় হঠাৎ তাদের লাইব্রেরী ঘরের টেলিফোন বেজে উঠল।
ওদিক থেকে ফোনে বলে উঠল, কে লর্ড গ্রেস্টোক?
টারজান বলল, হ্যাঁ।
আপনার ছেলে চুরি হয়েছে? আমি আপনার ছেলের উদ্ধারের ব্যাপারে সাহায্য করতে পারি। আমি জানি কারা তাকে চুরি করে নিয়ে গেছে। তবে একটা শর্তে আমি আপনার ছেলেকে উদ্ধার করে দেব। আপনি আমাকে এ ব্যাপারে জড়াবেন না।
টারজান জিজ্ঞাসা করল, কোথায় এবং কখন আপনার সঙ্গে দেখা হবে?
ওপার থেকে উত্তর এল, ডোভারের বন্দরের কাছে নাবিকদের বিশ্রামাগারে। আজ রাত্রেই দশটার সময় চলে আসুন। আপনার ছেলে ততক্ষণ নিরাপদেই থাকবে। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দা বিভাগে কোন কথা জানাবেন না এবং এবিষয়ে আমি লক্ষ্য রাখব। যদি আপনার সঙ্গে কেউ থাকে তাহলে আমি দেখা করব না আপনার সঙ্গে এবং তার ফলে আপনার সন্তানের উদ্ধারের শেষ আশাটিও নির্মূল হয়ে যাবে।
কথাটা তার স্ত্রীকে সঙ্গে সঙ্গে জানাল টারজান। তার স্ত্রী জেন তার সঙ্গে যাবার জন্য জেদ ধরল। টারজান বলল, অচেনা লোকটি বারবার আমাকে একা যেতে বলেছে।
কথাটা বলেই তৎক্ষণাৎ ডোভারের পথে রওনা হলো টারজান। সে চলে যাওয়ার পর জেন তাদের লাইব্রেরী ঘরে চিন্তিত মনে পায়চারি করতে লাগল। তার কেবলি ভয় হতে লাগল ছেলে উদ্ধারের নাম। করে টারজানকে আবার বিপদে ফেলবে না ত? বলা যায় না, তার স্বামী আর সন্তান একই সঙ্গে দু’জনকেই শয়তান রোকোফের কবলে ফেলার চক্রান্ত চলছে না ত?
জেন আর স্থির থাকতে পারল না। সে ঠিক করল টারজনের পিছু পিছু সেও যাবে ডোভারে।
ডোভারে সমুদ্রের কাছে সেই নির্দিষ্ট বাড়িটায় গিয়ে টারজান যখন পৌঁছল তখন রাত্রি ন’টা পঁয়তাল্লিশ বাজে। দুর্গন্ধওয়ালা একটা ঘরে টারজান ঢুকতেই একটা লোক এসে টারজানকে বলল, আসুন স্যার।
লোকটাকে আগে কখনো দেখেছে বলে মনে হলো না টারজনের। লোকটা যে আসলে ছদ্মবেশী রোকোফের সহকারী ও সহচর পলভিচ সেকথা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেনি টারজান।
টারজান বলল, আমার ছেলে কোথায়?
লোকটা বলল, ঐ যে একটা ছোট জাহাজে আলো দেখা যাচ্ছে ঐটাতে আছে। জাহাজটার নাম কিনসেড।
টারজান বলল, ঠিক আছে চল সেখানে।
টারজানকে সঙ্গে করে কিনসেড নামে ছোট জাহাজটাতে নিয়ে গিয়ে লোকটা বলল, ডেকের তলায় এই ঘরটাতে আছে। আপনি নেমে যান ঘরটার মধ্যে।
টারজান তার ছেলেকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল। সঙ্গে সঙ্গে ঘরটার মধ্যে নেমে গেল আর মুহূর্তের মধ্যে দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে শিকল দিয়ে দিল লোকটা। টারজান এবার বুঝতে পারল ছলনা করে তাকে ঘর থেকে টেনে এনে বন্দী করল রোকোফ।
এমন সময় টারজান দেখল জাহাজটা ছেড়ে দিল। এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই নারীকণ্ঠের এক ভয়ার্ত চীৎকার শুনে টারজনের মত সাহসী লোকের বুকেও হিমশীতল ভয়ের একটা শিহরণ খেলে গেল।
টারজান সেই লোকটার সঙ্গে কিনসেড জাহাজে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জেন একটা গাউন পরে আর মাথায় ওড়না দিয়ে নাবিকদের সেই বাড়িতে হাজির হলো। গিয়ে দেখল দশ বারোজন নাবিক সেখানে বসে জটলা পাকিয়ে গল্প করছে। জেন তাদের একজনকে বলল, ভাল পোশাক পরা লম্বা একজন ভদ্রলোক এখানে এসে একজনের সঙ্গে কথা বলছিলেন।
নাবিকটি বলল, হ্যাঁ কিছুক্ষণ আগে তিনি একজনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ঐ জাহাজটার দিকে চলে গেলেন।
জেন দেখল দুটো লোক একটা নৌকায় করে জাহাজটায় গিয়ে উঠছে। তখন সে লোকটাকে বলল, তুমি আমাকে একটা নৌকায় করে ঐ জাহাজটায় নিয়ে চল। তোমাকে আমি দশ পাউন্ড দেব।
লোকটা তখন জেনকে নৌকায় করে জাহাজে তুলে দিলে জাহাজটা ছেড়ে দিল। কিন্তু কোন কেবিনেই তোক দেখতে পেলো না। অবশেষে শেষ প্রান্তে একটা কেবিনের দরজা একটু ঠেলা দিতেই দরজাটা খুলে গেল। ভিতরে একজন লোক ছিল। সে জেনকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে জোর করে তাকে ঘরে টেনে এনে দরজাটা বন্ধ করে দিল।
জেন চিনতে পারল লোকটা নিকোলাস রোকোফ। জেনের মুখ থেকে বেরিয়ে এল, নিকোলাস রোকোফ! মঁসিয়ে থুরান।
সঙ্গে সঙ্গে জেন জোরে চীৎকার করে উঠল এবং সেই ভয়ার্ত চীৎকারটা টারজান তার ঘর থেকে শুনে চমকে উঠল।
রোকোফ বলল, এখন নয়, জাহাজটা কূল থেকে অনেকটা দূরে চলে গেলে তবে চীৎকার করবেন।
এই বলে সে জেনের ঠোঁটের উপর তার হাতটা চাপা দিল। মাথাটা নত করে বলল, আমি হচ্ছি আপনার ভক্ত এবং গুণগ্রাহী।
রোকোফের কথায় কান না দিয়ে জেন বলল, হায়, আমার ছেলে, সে কোথায়? এত নিষ্ঠুর তুমি কি করে হতে পারলে নিকোলাস রোকোফ? বল সে কোথায়? সে কি জাহাজেই আছে? আমাকে আমার ছেলের কাছে দয়া করে নিয়ে চল।
রোকোফ বলল, আমার কথামত আপনি যদি কাজ করেন তাহলে আপনার ছেলের কোন ক্ষতি হবে না।
এই কথা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে দরজাটা তালাবন্ধ করে দিল। এরপর পর পর দু’দিন রোকোফকে দেখতে পায়নি জেন। এই সময়ের মধ্যে জেন শুধু একটা সুইডেনবাসী লোককে দেখতে পেল। লোকটা খাবার সময় তাকে খাবার দিয়ে যেত।
টারজান তখনো পর্যন্ত বুঝতে পারেনি জেনও এই জাহাজেই বন্দী হয়ে আছে। যে নাবিকটা জেনকে খাবার দিয়ে যেত, সেই নাবিকটাই টারজানকেও খাবার দিত। টারজান লোকটা তার ঘরে এলেই তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করত। কিন্তু কোনক্রমেই কোন কথা বলত না লোকটা।
এইভাবে কয়েক সপ্তাহ কেটে গেল। কিন্তু বন্দীরা কেউ বুঝতে পারল না তাদের কোথায় নিয়ে গিয়ে কি করা হবে।
জেনকে সেই ঘরটায় বন্দী করে তালাবন্ধ করে রাখার কয়েকদিন পর রোকোফ একদিন দেখা করল জেনের সঙ্গে। বলল, আমাকে যদি একটা মোটা অঙ্কের চেক দাও তাহলে তোমার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে তোমায় ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেব।
কিন্তু জেন বলল, তুমি আমার ছেলে ও স্বামীকে যদি কোন সভ্য দেশের বন্দরে নামিয়ে দাও তাহলে তুমি যা চাইছ তার দ্বিগুণ স্বর্ণমুদ্রা তোমাকে দেব। তা করার আগে তোমাকে একটা কপর্দকও দেব না।
রোকোফ বলল, আমার কথামত যদি চেক না দাও তাহলে তুমি বা তোমার স্বামী বা সন্তান কেউ কোন সভ্য দেশে কোনদিন নামতে পারবে না।
জেন বলল, আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না।
রোকোফ ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, তোমাকে যা বলছি তাই করো। মনে রেখো, তোমার ছেলে আমার হাতে। যদি তুমি তোমার ছেলের আর্ত চীৎকার শোন তাহলে বুঝতে পারবে তোমার গোঁড়ামির জন্যই তোমার ছেলে কষ্ট পাচ্ছে।
অবশেষে জেন একটা মোটা টাকার চেক লিখে রোকোফের হাতে দিল আর রোকোফ মুখে এক তৃপ্তির হাসি নিয়ে বেরিয়ে গেল কেবিন থেকে।
পরদিন পলভিচ টারজনের ঘরে গিয়ে দেখা করল তার সঙ্গে। সে টারজানকে বলল, লর্ড গ্রেস্টোক, আপনি দীর্ঘকাল ধরে রোকোফের সঙ্গে শত্রুতা করে আসছেন এবং তার সব পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দিয়েছেন। আপনার জন্যই তাকে অনেক টাকা খরচ করে এই জাহাজ ভাড়া করতে হয়েছে। সুতরাং এর খরচ আপনাকেই বহন করতে হবে। তাহলে আপনার স্ত্রী সন্তান তাদের অশুভ পরিণাম থেকে মুক্ত হবে এবং আপনাকেও মুক্তি দেয়া হবে।
টারজান বলল, কত টাকা তোমরা চাও? তোমরা যে তোমাদের চুক্তি মেনে চলবে তারই বা নিশ্চয়তা কোথায়? তোমাদের মত শয়তানকে বিশ্বাস করাও ত মুস্কিল।
পলভিচ বলল, আমাদের এভাবে অপমান করবেন না। আমরা কথা দিচ্ছি এটাই যথেষ্ট। আমরা আপনাকে এখনি হত্যা করতে পারি, কিন্তু তাতে আপনাকে শাস্তি দেয়ার পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যাবে।
টারজান বলল, একটা কথার উত্তর দাও। আমার ছেলে কি এই জাহাজেই আছে?
পলভিচ বলল, না আপনার ছেলে অন্যত্র নিরাপদেই আছে। আপনি আমাদের দাবি মানতে অস্বীকার করলে আপনাকে হত্যা করা হবে আর আপনাকে হত্যা করা হলেই আপনার ছেলেকেও হত্যা করতে হবে। সুতরাং আমার কথামত চেকটা লিখে দিয়ে আপনার নিজের জীবন ও আপনার ছেলের জীবন রক্ষা করুন।
টারজান বলল, ঠিক আছে। কত টাকা চাও?
পলভিচ বিরাট একটা টাকার পরিমাণ বলল। টারজান তখন চেকে একটা মোটা টাকার অঙ্ক লিখে দিল। কিন্তু অত টাকা তার ব্যাংকে ছিল না।
টারজান চেকটা পলভিচের হাতে দিয়ে বাইরে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল অদূরে জঙ্গলঘেরা তীর দেখা যাচ্ছে। দেখতে দেখতে জাহাজটা উপকূলে গিয়ে ভিড়ল।
জঙ্গলটার দিকে তাকিয়ে পলভিচ বলল, ওইখানে আপনাকে মুক্তি দেয়া হবে।
পলভিচ টারজনের হাত থেকে চেকটা নিয়ে তাকে বলল, নাও, তোমার পোশাকটা খুলে ফেল। কারণ জঙ্গলে পোশাকের কোন দরকার হবে না।
জাহাজ থেকে একটা নৌকায় করে টারজানকে নামিয়ে দেয়া হলো। নাবিকরা টারজানকে কূলে রেখে জাহাজে ফিরে আসার জন্য নৌকাটা ছেড়ে দেবার সময় টারজনের হাতে একটা চিঠি দিয়ে গেল। নৌকাটা চলে গেলে টারজান কুলে দাঁড়িয়ে দেখল জাহাজের ডেকে রোকোফ তার ছেলেটাকে দুহাতে করে মাথার উপর তুলে ধরে টারজানকে দেখাচ্ছে। টারজান তখন বুঝল বিরাট ভুল করেছে সে। ভেবেছিল এ জাহাজে তার ছেলে নেই।
টারজনের পিছনে তখন কতকগুলো ছোট বাঁদর কিচমিচ করছিল। টারজান আপন মনে বলল, থাক, একটা সান্ত্বনা, জেন এখন লন্ডনে আছে। এই সব শয়তানদের কবলে সে এখনো পড়েনি।
পরে সে চিঠিটা খুলে যতই পড়তে লাগল ততই রোকোফদের চক্রান্তের ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে উঠল তার কাছে। চিঠিটাতে লেখা ছিল, তোমার সম্বন্ধে আমার আসল মতলবটা কি তা এই চিঠিটা পড়ে বুঝতে পারবে। তুমি একদিন জঙ্গলে জন্তু জানোয়ারদের মত নগ্নদেহে বাস করতে। কিন্তু তোমার সন্তান তা করবে না। সে প্রথম থেকে মানুষের সমাজে মানুষের মতই বেড়ে উঠত। কিন্তু তাকে সে সুযোগ দেয়া হবে না। সে নরখাদক এক বর্বর আদিবাসীদের সমাজে পরনে কৌপীন, পায়ে তামার গয়না আর নাকে আংটি পরে তাদের মত বেড়ে উঠবে। আমি তোমাকে হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হত্যা করতে পারতাম। কিন্তু তাতে যে শাস্তি তুমি ভোগ করেছ এতদিন আমার হাতে সে শাস্তি দীর্ঘায়িত হত না এতখানি। অথচ এমন একটা জায়গায় তোমাকে নির্বাসন দেয়া হলো যেখান থেকে তুমি তোমার ছেলেকে উদ্ধার করার কোন চেষ্টাই করতে পারবে না। রোকোফের বিরুদ্ধে যাওয়ার এই হলো শান্তি। ইতি-নিকোলাস রোকোফ।
চিঠিটা পড়া শেষ করেই নিজের বাস্তব অবস্থা সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠল টারজান। সে ঘুরে দেখল। এক দুর্ধর্ষ পুরুষ-গোরিলা তাকে আক্রমণ করতে উদ্যত হয়ে উঠেছে।
টারজান দেখল শুধু একটা নয় প্রায় ডজনখানেক বাঁদর-গোরিলা তার পিছনে রয়েছে। কিন্তু সে বুঝল সব বাদর-গোরিলাগুলো এক সঙ্গে আক্রমণ করে না। তাদের দলের রাজা হিসেবে একটা গোরিলাই তাকে আক্রমণ করবে।
আক্রমণকারী বাঁদর-গোরিলাটা তাকে আক্রমণ করার জন্য এগিয়ে আসতেই টারজান আগের মত সরাসরি তাকে না ধরে সে তার তলপেটে একটা জোর ঘুষি মেরে দিল। গোরিলাটা ঘুরে পড়ে গেল মাটিতে। সে অতি কষ্টে উঠে দাঁড়াতেই টারজান তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। টারজান এবার তার সাদা ঝকঝকে দাঁতগুলো গোরিলাটার লোমশ ঘাড়ের উপর বসিয়ে দিল। গোরিলাটা কামড়াতে এলে টারজান এমন একটা জোর ঘুষি মেরে দিল যে তার মুখটা ভেঙ্গে গেল।
অন্য গোরিলাগুলো টারজানদের চারপাশে দাঁড়িয়ে শ্বাসরুদ্ধ হৃদয়ে তাদের লড়াই দেখতে লাগল। অবশেষে টারজান যখন তাদের রাজার ঘাড়টা মটকে দিল তখন তার শব্দটা শুনতে পেল তারা। তখন তার নিস্পন্দ দেহটার উপর দাঁড়িয়ে উপর দিকে মুখ তুলে চীৎকার করে তার বিজয়-উল্লাস প্রকাশ করল টারজান।
টারজান বুঝল, এরপর গোরিলাদের মধ্য থেকে আর একজন তার কাছে এসে যুদ্ধের আহ্বান জানাবে। হলোও ঠিক তাই। একজন বলিষ্ঠ যুবক গোরিলা টারজনের দিকে এগিয়ে এসে গর্জন করতে থাকলে টারজান বলল, কে তুমি, বাঁদর-দলের রাজা টারজানকে ভয় দেখাচ্ছ?
গোরিলাটা বলল, আমি হচ্ছি আকুৎ। মোনাক মারা গেছে। এখন আমিই হচ্ছি রাজা। এখান থেকে চলে যাও, তা না হলে খুন করব তোমায়।
টারজান বলল, তুমি দেখেছ কত সহজে আমি মোনাককে মেরেছি। আমি যদি রাজা হতে চাইতাম তাহলে আমি তোমাকেও মারতে পারতাম। কিন্তু টারজান আকুৎদের দলের রাজা হতে চায় না। আমি তোমাদের বন্ধু হয়ে শান্তিতে এ দেশে বাস করতে চাই।
আকুৎ বলল, তুমি আকুৎকে মারতে পারবে না। আকুতের সমান শক্তিশালী কেউ নেই।
একথার কোন উত্তর না দিয়ে টারজান আকুতের একটা হাতের কব্জি ধরে হাতটা জোরে ঘুরিয়ে তাকে ফেলে দিল। টারজান তাকে প্রাণে বধ না করে হার মানাতে চাইল শুধু। তাই সে ঘাড়টার উপর চাপ দিয়ে বলল, কা গোদা? অর্থাৎ হার মানছ?
আর একটু চাপ দিলেই আকুতের ঘাড়টা ভেঙ্গে যেত। আকুৎ বলল, কা গোদা অর্থাৎ হার মেনেছি।
টারজান তার ঘাড়টা এবার ছেড়ে দিয়ে বলল, যাও, আমি রাজা হব না, তুমিই হবে রাজা। যদি তোমাকে কেউ বাধা দেয় তাহলে তোমাকে সাহায্য করব।
আকুৎ ধীরে ধীরে উঠে তার দলের কাছে চলে গেল।
এবার টারজান দেখল তার একটা অস্ত্র চাই।
এরপর দিনকতক ধরে অস্ত্র তৈরির কাজে মন দিল টারজান। মরা হরিণের চামড়া দিয়ে তার ধনুকের ছিলা তৈরি করল আর তার কৌপীন তৈরি করতে লাগল। সেই সঙ্গে শুকনো ঘাস দিয়ে একটা লম্বা দড়ি তৈরি করল। সে একটা তৃণ আর বেল্টও তৈরি করল।
একদিন পথে যেতে যেতে টারজান গাছের উপর বসেছিল কিছুক্ষণের জন্য। হঠাৎ সে বাতাসে একদল বাঁদর-গোরিলার গন্ধ পেল। আবার দেখল যে গাছটায় সে বসে আছে সেই গাছেরই নিচের ডালে একটা চিতাবাঘও আছে। কিছুক্ষণের মধ্যে টারজান দেখল বাঁদর-গোরিলাদের দলটা সেই গাছটার কাছে এসে পড়েছে এবং তাদের নেতা আকুৎ সেই গাছের তলায় খুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বসে আছে। ঠিক সেই সময় চিতাবাঘটা আকুতের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য উদ্যত হচ্ছে।
কিন্তু চিতাটা সামনের পা দুটো তুলতেই টারজান তার পাথরের ছুরিটা তার গায়ে বসিয়ে দিয়ে তার ঘাড়ে একটা জোর কামড় দিল। আকুৎ উপর দিকে তাকাতেই বুঝতে পারল ব্যাপারটা। এখন চিতাটা আর টারজান দু’জনেই গাছ থেকে মাটিতে পড়ে গেল। টারজান তখন তার পাথরের ছুরিটা বারবার বসাতে লাগল চিতাটার গায়ে। অবশেষে লুটিয়ে পড়ে গেল চিতাটা। তার উপর দাঁড়িয়ে টারজান বিয়জগর্বে একটা বিকট চীৎকার করে উঠল।
টারজান এবার আকুৎকে লক্ষ্য করে বলল, আমি হচ্ছি বাঁদরদলের টারজান। বিরাট শক্তিশালী যোদ্ধা। কিছুদিন আগে আকুতের প্রাণ নিতে নিতে বাঁচিয়ে দিই। আজ চিতার কবল থেকে তাকে রক্ষা করলাম। তোমরা বিপদে পড়লে টারজানকে ডাকবে। আর টারজান যদি কখনো বিপদে পড়ে তোমাদের ডাকে তাহলে তোমরা সবাই ছুটে আসবে। বুঝলে ত?
আকুৎ ও তার দলের সবাই একযোগে বলল, হুঁ।
এরপর তখনকার মত ওদের সঙ্গেই রয়ে গেল টারজান। একযোগে সকলে মিলে শিকারের খোঁজে বেরিয়ে পড়ল।
একদিন পথে যেতে যেতে টারজান দেখল একটা বিরাট গাছ পড়ে গেছে আর তার একটা বড় ডালের। নিচে একটা চিতাবাঘ চাপা পড়ে যন্ত্রণায় চীৎকার করছে।
টারজান ইচ্ছা করলেই চিতাটাকে মেরে ফেলতে পারত তখনি। কিন্তু সে ভাবল সে যখন একটু চেষ্টা করলেই তাকে তার জীবন আর স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিতে পারে তখন কেন সে তা করবে না? টারজান কাছে যেতেই মুক্তির আশায় তার পানে সকরুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল চিতাটা। টারজনের চেষ্টায় ডালটা তার দেহের উপর থেকে উঠে যাওয়ায় সে এবার মুক্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল।
টারজান ভেবেছিল, চিতাটা মুক্ত হয়েই হয়ত আক্রমণ করবে তাকে দাঁত বার করে। কিন্তু টারজান তার পাশ দিয়ে যখন চলে যাচ্ছিল তখন সে কিন্তু তাকে কামড়াতে এল না। উল্টে তার পিছু পিছু পোষা কুকুরের মত আসতে লাগল।
বিকালের দিকে চিতাটা টারজনের কাছ থেকে একটু সরে গিয়ে একটা ঝোপের মধ্যে বসেছিল শিকারের আশায়। টারজান ছিল একটা গাছের ডালে বসে। গাছের তলায় একটা হরিণকে আসতে দেখেই টারজান তার ঘাসের দড়ির ফাঁসটা হরিণটার গলায় আটকে দিল। তারপর শীতা শীতা’ বলে চিতা বাঘটাকে ডাকতে লাগল। বাঁদর-গোরিলাদের ভাষায় চিতাবাঘকে শীতা বলে।
টারজনের ডাক শোনার সঙ্গে সঙ্গে ঝোপঝাড় ভেঙ্গে হুড়মুড় করে বেরিয়ে এল চিতাটা। ঝাঁপিয়ে পড়ল হরিণটার উপর। হরিণটা মরে গেলে টারজান গাছ থেকে নেমে এসে দু’জনে মিলে তার মাংস খেতে লাগল। এরপর থেকে তাদের দুজনের একজন কোন শিকার পেলেই আর একজনকে তা না দিয়ে খেত না।
একদিন টারজান আর তার সঙ্গী চিতাবাঘটা পথে যেতে যেত আকুতের গোরিলা দলটার কাছে এসে পড়ল। চিতাবাঘটাকে দেখেই আকুত্রা ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু টারজান তাদের সাহস দিয়ে ডাকতেই কাছে এল তারা।
একদিন একদিকে চিতাবাঘটা আর একদিকে আকুৎ তার দলবল নিয়ে শিকার করতে গিয়েছিল। টারজান তখন একা একা সমুদ্রের ধারে বেলাভূমির উপর চিৎ হয়ে শুয়েছিল। সে একমনে কি ভাবছিল।
এমন সময় কোথা থেকে একদল নিগ্রো যোদ্ধা টারজনের কাছে এসে পড়ে তাকে লক্ষ্য করতে থাকে। তারা খুব কাছে এসে পড়ায় তাদের পদশব্দ শুনে চমকে উঠে পড়ে সে। নিগ্রো যোদ্ধারাও তাকে আক্রমণ করার জন্য উদ্যত হয়ে ওঠে।
টারজান উঠেই তার হাতের লাঠিটা দিয়ে মাথায় জোর আঘাত করে একজন নিগ্রোকে মেরে ফেলল। তখন অন্যান্য নিগ্রোরা ভয়ে বিহ্বল হয়ে সরে গেল কিছুটা। কিন্তু এরপর ওরা টারজানকে তিন দিক হতে ঘিরে ফেলে তার উপর এক সঙ্গে অনেকগুলো বর্শা ছোঁড়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠল।
টারজান দেখল তার পিছনেই সমুদ্র এবং একমাত্র এই দিকটা দিয়েই পালাতে পারে সে। কিন্তু হঠাৎ তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মুখ দিয়ে জোরে অদ্ভুত একটা শব্দ করে কাদের ডাকতে লাগল।
এমন সময় কোথা থেকে ঝোপঝাড় ভেঙ্গে একদল বাঁদর-গোরিলা আর একটা চিতাবাঘ ছুটে এসেই একযোগে আক্রমণ করল নিগ্রোদের। নিগ্রোদের বর্শার ঘায়ে কয়েকটা বাঁদর-গোরিলা মারা গেল। কিন্তু ক্ষতি হলো নিগ্রোদেরই বেশি।
টারজান অবশেষে দেখল, মাত্র একজন নিগ্রো যোদ্ধা নিরাপদে পালিয়ে গেল সমুদ্রের কূলের দিকে। সেখানে একটা নৌকা ছিল। বাকি সব নিগ্রো যোদ্ধারা মারা গেছে। তাদের মৃতদেহগুলো চিতাটা আর বাঁদর-গোরিলাগুলো ছিঁড়েখুঁড়ে খাচ্ছিল।
টারজনের কি মনে হতে পলাতক নিগ্রো যোদ্ধাটার পিছু পিছু গিয়ে অনুসরণ করতে লাগল তাকে। লোকটা নৌকাটার কাছে যেতেই পিছন থেকে টারজান বলল, আমি তোমাকে মারব না যদি তুমি আমাকে এই দ্বীপটা থেকে অন্যত্র চলে যেতে সাহায্য করো।
মুগাম্বি বলল, হ্যাঁ, সাহায্য করব। কিন্তু তুমি আমার দলের সব লোকদের মেরে ফেলেছ। দাঁড় বাইবার কোন লোক নেই। কি করে নৌকা নিয়ে যাব?
টারজান দেখল, লোকটার স্বাস্থ্যটা খুবই বলিষ্ঠ এবং দৈত্যের মত। তাকে হাতে রাখতে পারলে অনেক কাজ হবে তাকে দিয়ে। সে তাকে বলল, এখন এস আমার সঙ্গে।
মুগাম্বি যখন দেখল টারজান তাকে সেই ভয়ঙ্কর জন্তুগুলোর দিকে নিয়ে যাচ্ছে তখন সে ভয়ে পিছু হটতে লাগল।
কিন্তু টারজান তাদের সকলকে শান্ত করে মুগাম্বির ভয় ভাঙ্গিয়ে দিল।
সেদিন টারজান, মুগাম্বি, শীতা আর আকুৎ এই চারজনে মিলে একটা হরিণ শিকার করল। মুগাম্বি আগুন জ্বেলে তার ভাগের মাংস পুড়িয়ে খেল। কিন্তু টারজান ও আর সকলে কাঁচা মাংস খেল। তারপর মুগাম্বিকে নিয়ে এখান থেকে মূল মহাদেশে যাবার একটা পরিকল্পনা খাড়া করল টারজান।
টারজনের কথায় মুগাম্বির হুঁস হলো। সে বুঝতে পারল, এ জায়গাটা আসলে একটা ছোট দ্বীপ। সারা দ্বীপটাই জঙ্গলে ভরা। তবে মূল মহাদেশটা এই দ্বীপটা থেকে খুব বেশি দূরে নয়।
টারজান ঠিক করে ফেলল মুগাষি আর তার কিছু পশু অনুচরদের সঙ্গে করে নৌকাটা করে মূল মহাদেশে চলে যাবে।
অবশেষে একদিন সে মুগাম্বি, আকুৎ, তারা বারো জন বাঁদর-গোরিলা আর শীতা বা চিতাবাঘটাকে সঙ্গে করে নৌকাটা ভাসিয়ে দিল সমুদ্রে।
এইভাবে ক্রমাগত দশ ঘণ্টা যাওয়ার পর ওরা বনভূমি ঘেরা কুল দেখতে পেল। কিন্তু তখন সন্ধ্যার অন্ধকার অনেকটা ঘন হয়ে ওঠায় ওরা উগাম্বি নদীর মোহানাটা দেখতে পেল না।
নৌকাটা কূলে ভিড়তেই ওরা নেমে পড়ল। আর সঙ্গে সঙ্গে একটা ঢেউ এসে ভাসিয়ে নিয়ে গেল নৌকাটাকে।
টারজান কিন্তু চুপ করে বসে থাকতে পারল না। মুগাম্বিকে সঙ্গে নিয়ে উগাম্বি নদীটা খুঁজতে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা একটা বড় নদী দেখতে পেল। সেখান থেকে মাইলখানেক গিয়ে ওরা সেই মোহনাটা দেখতে পেল যেখানে নদীটা সমুদ্রে পড়েছে।
মোহানার কাছে গিয়ে টারজান গতকালের সেই নৌকাটা দেখতে পেল যেটাকে স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। মুগাম্বি বলল, এইটাই আমাদের উগাম্বি নদী। নদীতে তখন ভাটা চলছিল। তবু ওরা নৌকাটাতে উঠে উজান বেয়ে অতি কষ্টে মোহানার উল্টোদিকে এগিয়ে গেল। টারজান ভাবল আগে প্রথমে ওর দলের কাছে গিয়ে দলের সবাইকে নৌকায় উঠাবে। তারপর মুগাম্বিকে নিয়ে ওদের গায়ে গিয়ে রোকোফের খোঁজ করবে। তার ধারণা রোকোফ বেশি দূর জাহাজে করে তার ছেলেকে নিয়ে যাবে না।
যাই হোক, সকলকে নিয়ে নৌকায় গিয়ে উঠল টারজান। দুপুরের দিকে আহার আর বিশ্রামের জন্য বনের ধারে নদীতীরে এক জায়গায় নৌকা থামানো হলো। তখন কিছুটা দূরে গাছের আড়াল থেকে একটা নগ্ন আদিবাসী ওদের দেখেই ছুটে ওদের গায়ে গিয়ে খবর দেয়। বলে, আবার একজন শ্বেতাঙ্গ একটা নৌকায় করে কয়েকজন যোদ্ধা নিয়ে আমাদের গাঁয়ের দিকে আসছে।
ওদের গায়ের নেতার নাম ছিল কাভিরী। এই গাঁয়েই কিছুদিন আগের দাড়িওয়ালা এক শ্বেতাঙ্গ অর্থাৎ রোকোফ এসে খুব খারাপ ব্যবহার করে যায়। তাই আর কোন শ্বেতাঙ্গকে ওদের গায়ে আসতে দিতে চায় না কাভিরী। সে ঢাক বাজিয়ে গায়ের যোদ্ধাদের ডাক দিতে বলল। তারপর বড় ড় বর্শা আর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যোদ্ধারা সাতটা ডিঙ্গিতে গিয়ে উঠল। কাভিরী উঠল অন্য একটা ডিঙ্গিতে।
কিছুদূর নদীপথে যাওয়ার পর কাভিরী তার নৌকা থেকে যখন টারজান আর তার পশুসঙ্গীদের দেখল তখন সে ভয় পেয়ে গেল।
দেখতে দেখতে কাভিরীদের নৌকাগুলো চারদিক থেকে ঘিরে ফেলল টারজানদের নৌকাটাকে।
নিগ্রোদের নৌকাগুলো টারজনের নৌকাটার খুব কাছে আসতেই টারজান আকুৎ আর শীতাকে কি বলল। সঙ্গে সঙ্গে তারা নিগ্রোদের দুটো নৌকাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারা কয়েকজন নিগ্রো যোদ্ধাকে কামড়ে ঘায়েল করে দিল। কয়েকজন মারা গেল।
টারজান বুঝতে পারল কাভিরীই নিগ্রো যোদ্ধাদের দলনেতা। সে তাই তাকে প্রাণে মারতে চাইল না। সে বেঁচে থাকলে তার থেকে কিছু খবরাখবর পাওয়া যেতে পারে। কাভিরী আহত ও অচেতন হয়ে নৌকার পাটাতনের উপর পড়ে গেলে সে তার হাত পা বেঁধে ফেলল। যে কয়জন নিগ্রো যোদ্ধা বন্দী হয়েছিল তাদেরও হাত পা বেঁধে দিল।
কাভিরীর চেতনা ফিরে এলে সে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল তার পাশে দৈত্যাকার এক নগ্নপ্রায় শ্বেতাঙ্গ আর একটা বিরাট আকারের চিতাবাঘ থাবা গেড়ে বসে আছে। টারজান তাকে বলল, তোমার লোকদের কাছ থেকে জানতে পারলাম তোমার নাম কাভিরী।
কাভিরী বলল, হ্যাঁ।
টারজান বলল, কেন তুমি আমাদের আক্রমণ করতে এলে?
কাভিরী বলল, কিছুদিন আগে অন্য এক শ্বেতাঙ্গ আমাদের গাঁয়ে আসে। আমরা তাকে অনেক উপহার দিয়ে খাতির করলেও সে তার বন্দুক দিয়ে আমাদের কিছু লোককে হত্যা করে আমাদের গায়ের কয়েকজন পুরুষ ও নারীকে ধরে নিয়ে যায়।
টারজান জিজ্ঞাসা কলল, তার সঙ্গে একটা ছেলে ছিল?
কাভিরী বলল, না মালিক। একটা শ্বেতাঙ্গ ছেলে ছিল অন্য দলে।
টারজান আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করল, অন্য দল! কোন্ দল?
কাভিরী বলল, দুবৃত্ত শ্বেতাঙ্গটা আসার তিনদিন আগে আর একটা দল এসেছিল। সেই দলে ছিল একজন শ্বেতাঙ্গ পুরুষ, একজন শ্বেতাঙ্গ মহিলা, একটা ছেলে আর ছ’জন মুসলমান নাবিক। তারা মনে হয় সেই দুর্বত্ত শ্বেতাঙ্গটার দল থেকে পালিয়ে আসে। তাই দুবৃত্ত শ্বেতাঙ্গটা তাদের খোঁজ করছিল। এই দলটা একটা নৌকা করে এই নদী দিয়ে পালিয়ে যায়।
টারজান বুঝতে পারল পলাতক দলটির মধ্যে যে ছেলেটি ছিল সে-ই জ্যাক, কিন্তু শ্বেতাঙ্গ পুরুষ ও মহিলা কে তা বুঝতে পারল না।
টারজান আর কাভিরীর নৌকা দুটো কাভিরীদের গায়ের কাছে এসে পড়তেই নৌকা থেকে নেমে পড়ল তারা। কাভিরীদের গায়ে এসে টারজান কিছু খাবার খেয়ে কাভিরীর কাছ থেকে তার নৌকা চালিয়ে নিয়ে যাবার জন্য ডজনখানেক লোক চাইল।
কাভিরী বলল, লোক দেব কি বাওনা, আমি ছাড়া গাঁয়ে আর একটি লোকও নেই।
কাভিরী টারজনের সব কথা মেনে নিতে রাজী ছিল, কারণ সে ভাবছিল টারজান তার যত সব ভয়ঙ্কর সঙ্গীদের নিয়ে যত তাড়াতাড়ি তাদের গাঁ থেকে চলে যায় ততই ভাল। কিন্তু টারজনের পশুসঙ্গীদের দেখে গাঁয়ের সবাই জঙ্গলে পালিয়ে গিয়েছিল গা ছেড়ে। যে দু’চারজন কাভিরীর কাছে ছিল তারাও টারজনের কথা শুনে জঙ্গলে পালিয়ে গেল।
টারজান বলল, ঠিক আছে কাভিরী, আমি তোমার পাশে লোকদের সব এনে দিচ্ছি।
এই বলে সে মুগাম্বিকে কাভিরীর কাছে রেখে শীতা আর বাঁদর-গোরিলাদের নিয়ে জঙ্গলে চলে গেল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল টারজান পালিয়ে যাওয়া লোকদের ভেড়ার পালের মত তাড়িয়ে নিয়ে এল। এবার কাভিরীর সামনে টারজান দাঁড়িয়ে বলল, তোমার সব লোক এসে পড়েছে। এবার তুমি আমার সঙ্গে কারা যাবে তাদের বাছাই করে দাও।
কাভিরী ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়িয়ে তার লোকদের ডাকল। কিন্তু কেউাড়া দিল না তার ডাকে।
টারজান তখন কাভিরীকে বলল, তোমার কথায় কেউ রাজী না হলে ওদের বলে দাও আমি আবার জন্তুদের লেলিয়ে দেব তাদের পিছনে।
এই কথা শুনে গাঁয়ের অনেক লোক কাভিরীর চারপাশে এসে দাঁড়াল। কাভিরী তাদের মধ্যে থেকে বারোজন লোককে বাছাই করে তাদের যেতে বলল টারজনের সঙ্গে। লোকগুলো অনিচ্ছা সত্ত্বেও টারজনের নৌকায় গিয়ে বসল।
একদিন নৌকা থেকে নদীর ধারে নেমে টারজান মুগাম্বি আর আকুৎকে তার পরিকল্পনার কথাটা বুঝিয়ে বলল। বলল, একজন শ্বেতাঙ্গ নৌকায় করে এই পথেই পালাচ্ছে। তাকে ধরতে চায় সে। কিন্তু আদিবাসীরা তাদের দেখে পালাচ্ছে বলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না। তাই সে একাই ওদের গায়ে গিয়ে খোঁজ করতে চায়।
ওদের কূলের উপর রেখে টারজান বলল, দু-একদিনের মধ্যেই তোমাদের কাছে ফিরে আসব আমি।
এই বলে বনের মধ্যে দিয়ে একাই চলে গেল টারজান।
টারজান ভেবে পেল না কিভাবে গঁয়ে গিয়ে যোগাযোগ করবে লোকগুলোর সঙ্গে। অবশেষে সে একটা বুদ্ধি খাটাল। গাছের উপর পাতার আড়াল থেকে চিতাবাঘের মত জোর একটা গর্জন করল সে। তখন গাঁয়ের লোকেরা গেটের কাছে ছুটে এসে গাছটার দিকে তাকাতে লাগল। টারজান তখন গাছ থেকে নেমে আদিবাসীদের ভাষায় বলল, আমাকে তোমাদের গায়ের মধ্যে ঢুকতে দাও। আমি একজন শ্বেতাঙ্গ, তোমাদের বন্ধু। অন্য যে একজন শ্বেতাঙ্গ এখানে এসে তোমাদের অত্যাচার করেছিল তাকে ধরে আমি শাস্তি দিতে চাই।
গাঁয়ের লোকগুলো গেটটা খুলে দিতেই টারজান ভিতরে ঢুকে গাঁয়ের সর্দারকে রোকোফের কথা জিজ্ঞাসা করল। কিন্তু সে যা বলল তার সঙ্গে কাভিরীর কথা মিলল না। গায়ের সর্দার বলল, রোকোফ নামে শ্বেতাঙ্গটা তাদের গায়ে এক মাস ছিল। তবে দ্বিতীয় দলটার কথা দু’জনেরই এক হলো। রোকোফের আগেই একটা দল আসে। সে দলে এক শ্বেতাঙ্গ পুরুষ, এক শ্বেতাঙ্গ মহিলা, এক শিশু আর কয়েকজন মুসলমান মালবাহী কুলী ছিল।
গাঁয়ের সর্দার রাতে শোবার জন্য একটা কুঁড়ে ঘর ছেড়ে দিতে চাইল। কিন্তু টারজান বলল, আমি গাঁয়ের বাইরে ঐ গাছতলাটায় ঘুমাব। তবে আমার দলের লোকরা আগামীকাল নৌকায় করে এখানে এসে পড়বে। দলে কতকগুলো জন্তু থাকলেও তারা তোমাদের কোন ক্ষতি করবে না। সঙ্গে মুগাম্বি নামে। একজন নিগ্রো আদিবাসীও থাকবে।
টারজান কিন্তু ঘুমোল না গাছতলাটায়। সেই রাতেই উগাম্বি নদীর ধারে ধারে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলল। পথে দু-একটা আদিবাসী বস্তি দেখতে পেল। তাদের কাছ থেকে জানতে পারল রোকোফ এই পথেই গেছে।
দুদিন এইভাবে যাওয়ার পর উগাম্বি নদীর ধারে একটা বড় গায়ে এসে উঠল টারজান। কিন্তু সে গাঁয়ের সর্দারকে দেখে নরখাদক বলে মনে হলো তার। লোকটাকে দেখে ভাল না লাগলেও অতিশয় ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ায় কিছু আহার ও বিশ্রামের জন্য কয়েক ঘণ্টা কাটাতে চাইল সে সেখানে। তবে সে বুঝল সর্দারটা মুখে তাকে খাতির করলেও ভিতরে ঘৃণা অনুভব করছে তার প্রতি।
টারজান অল্পক্ষণের মধ্যেই একটা কুঁড়ে ঘরের পাশের ছায়ায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। সর্দার টারজনের এই উপস্থিতির ব্যাপারটা একেবারে গোপন রাখল গাঁয়ের লোকদের কাছে। তারপর সে গোপনে। জনকতক লোককে রোকোফকে খবর দেবার জন্য নদীর ধার দিয়ে পূর্ব দিকে পাঠিয়ে দিল।
ঘণ্টা তিনেকের মধ্যেই কতকগুলো ডিঙ্গি এগিয়ে আসতে লাগল গাঁয়ের ঘাটের দিকে। একটা নৌকাতে ছিল রোকোফ আর তার পাঁচজন শ্বেতাঙ্গ সহচর।
রোকোফ নৌকা থেকে নেমেই সর্দারকে জিজ্ঞাসা করল, তোমার লোকরা যার কথা বলল, সেই শ্বেতাঙ্গ কোথায়?
সর্দার বলল, আমাদের গায়েতেই আছে, ঘুমোচ্ছে। সে তোমার বন্ধু না শত্রু জানি না। তবে সে তোমার খোঁজ করছিল।
সর্দারের পিছু পিছু রোকোফ আর তার দলের লোকেরা পা টিপে টিপে টারজান যেখানে ঘুমোচ্ছিল সেখানে গিয়ে হাজির হলো। সর্দার গিয়ে দেখল টারজান তখনো ঘুমোচ্ছে। রোকোফ দেখেই চিনতে পারল টারজানকে। এক কুৎসিত শয়তানি হাসি ফুটে উঠল তার মুখে। সর্দার যখন বুঝতে পারল ঘুমন্ত টারজান রোকোফের শত্রু তখন সে তার লোকদের টারজান জেগে ওঠার আগেই তার হাত পা বেঁধে ফেলার হুকুম দিল। টারজানকে রোকোফ বলল, শুয়োর কোথাকার! রোকোফের পথ থেকে দূরে সরে। দাঁড়াবার মত সুবুদ্ধি এখনো আসেনি তোমার মাথার মধ্যে?
এই কথা বলে টারজনের মুখে একটা লাথি মারল রোকোফ।
টারজান বলল, তোমাকে অভ্যর্থনা করার জন্যই সে বুদ্ধি আমার মাথায় আসেনি।
রোকোফ বলল, ঠিক আছে আজ রাতে আমার নরখাদক ইথিওপ বন্ধুরা তোমাকে খেয়ে ফেলার আগেই তোমার স্ত্রী ও ছেলের কি অবস্থা হয়েছে এবং ভবিষ্যতে কি হবে বলবে তাকে।
যে গাঁটায় হাত পা বাঁধা অবস্থায় বন্দী ছিল টারজান সেই গাঁয়ের দিকে অন্ধকার বনভূমি নিঃশব্দ পদক্ষেপে পার হয়ে একটি চিতাবাঘ তার জ্বলন্ত চোখ দুটো নিয়ে এগিয়ে আসতে লাগল। গন্ধ এঁকে এঁকে সে একটা কুড়ে ঘরের বাইরে এসে হাজির হলো। তারপর ঘরটার চালের উপর উঠে খড়পাতার ছাউনি। সরিয়ে কিছুটা ফাঁকা করে ঘরের মধ্যে লাফিয়ে পড়ল।
টারজানও এতক্ষণ একটা পরিচিত গন্ধ পেয়ে সচকিত হয়ে ওঠে। মেঝের উপর লাফিয়ে পড়ার পর টারজনের গা-টা শুঁকতে লাগল শীতা।
এমন সময় একজন নিগ্রো যোদ্ধা বাইরে উৎসবের জায়গাটা থেকে টারজানকে সেখানে তুলে নিয়ে যাবার জন্য ঘরে এসে ঢুকল। বাইরে তখন উৎসবের জন্য এক বিরাট প্রস্তুতি চলছিল গ্রামবাসীদের।
অন্ধকারে সে চিতাবাঘটাকে দেখতে পায়নি। সে বর্শা দিয়ে টারজনের গায়ে একটা আঘাত করতেই টারজান চীৎকার করে উঠল আর সঙ্গে সঙ্গে চিতাটা আদিবাসীদের বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার গলাটা কামড়ে ধরল। লোকটা রক্তাক্ত দেহে লুটিয়ে পড়ল মেঝের উপর। চিতাটার গর্জনের সঙ্গে সঙ্গে আহত লোকটার আর্তনাদ শুনতে পেয়ে উৎসব ছেড়ে বাইরের লোকরা ছুটে আসতে লাগল।
প্রথমে রোকোফের দলের দু’জন শ্বেতাঙ্গ একটা টর্চ নিয়ে ঘরের ভিতরটা দেখতে লাগল। আদি বাসীরা ঘরের ভিতরে তাদের একজনকে রক্তাক্ত ও ছিন্ন-ভিন্ন দেহে মরে পড়ে থাকতে দেখে দারুণ ভয় পেয়ে গেল। তারা ভয়ে ঘরের ভিতর কেউ ঢুকল না। এদিকে ঘরের দরজার সামনে অনেক লোক দেখে চিতাটা গর্জন করতে করতে লাফ দিয়ে চালের উপর উঠে সেই ফাঁকটা দিয়ে বেরিয়ে গেল বাইরে।
রোকোফ তখন সর্দারকে বলল, এস, ওকে এবার বাইরে নিয়ে গিয়ে আমাদের কাজ শেষ করে ফেলি। তা না হলে আবার কোন বিপদ ঘটতে পারে।
চারজন নিগ্রো যুবক টারজানকে তুলে নিয়ে গিয়ে সেই নাচের জায়গাটায় একটা খুঁটির সঙ্গে বেঁধে দিল দাঁড় করিয়ে। রোকোফ এবার একজন আদিবাসীর হাত থেকে একটা বর্শা নিয়ে টারজনের দেহে আঘাত করতে গেল। কিন্তু সর্দার তার হাত থেকে বর্শাটা কেড়ে নিয়ে বলল, আমাদের প্রথামত নাচ না হওয়া পর্যন্ত কিছু করা চলবে না। তাছাড়া বন্দীকে আমরা মারব। আমাদের বিধিমত না চললে তোমারও ঐ অবস্থা করব।
রোকোফ সরে গেল। সে টারজানকে বলল, ঠিক আছে, নাচ হয়ে গেলে আমি নিজে তোমার হৃৎপিণ্ডটা খাব।
এবার নরখাদক আদিবাসীদের নাচ শুরু হলো। নাচ শেষ হয়ে এলে ওদের সর্দার প্রথমে তার বর্শার ফলা দিয়ে একটা খোঁচা দিল টারজনের গায়ে। সেই সময় জঙ্গলের ভিতর থেকে কার একটা চীঙ্কার শুনে টারজানও সাড়া দিল সেইভাবে।
আদিবাসীরা ভয়ে ভয়ে তাকাতে লাগল চারদিকে।
কিনসেড জাহাজ থেকে টারজানকে যখন নামিয়ে নৌকায় করে জঙ্গলাকীর্ণ সেই দ্বীপটায় নিয়ে যাওয়া হয় তখন একটা কেবিনের জানালা দিয়ে তা দেখতে পায় ক্লেটন। কিন্তু জায়গাটার নাম কি, কোথায় নিয়ে যাওয়া হয় তা সে জানতে পারল না কোনক্রমেই। একমাত্র সেভেন এ্যান্ডারসন নামে একজন সুইডেনবাসী রাঁধুনি ছাড়া আর কাউকে দেখতে পেল না। এ্যান্ডারসন রোজ দু’বার করে খাবার দিয়ে যেত জেনের কেবিনে। তাকে জেন কোন কথা জিজ্ঞাসা করলে সে শুধু ইংরেজিতে একটা কথাই বলত, আমার মনে হয় এরা শিগগির একটা অঘটন ঘটাবে।
টারজানকে সেই দ্বীপটায় নামিয়ে দেবার তিন দিন পর কিনসেড জাহাজটা সমুদ্র থেকে উগাম্বি নদীর মুখে গিয়ে পড়ল।
সেইদিনই সেখানে জাহাজটাকে থামিয়ে রোকোফ জেনের কেবিনে এসে বলল, আমরা আমাদের গন্তব্যস্থলে এসে পড়েছি। এবার তোমাকে সহজেই মুক্তি আর নিরাপত্তা দুইই দেব। আর আমি তোমাকে ভালবাসি জেন। তুমি শুধু একবার হ্যাঁ বললেই তোমার ছেলেকে ফিরিয়ে দেব।
এবার জেন রোকোফকে বলল, আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি তোমার কথা শুনে। এতদিন তোমাকে একজন কাপুরুষ আর শয়তান বলে ভাবতাম, কিন্তু এখন দেখছি তুমি নির্বোধ।
রোকোফের চোখ দুটো ছোট হয়ে গেল। রাগে আর লজ্জায় লাল হয়ে উঠল তার মুখখানা। সে জেনের দিকে কিছুটা এগিয়ে ভীতি প্রদর্শনের সুরে বলল, শেষে দেখা যাবে কে বোকা। তোমার সামনে যখন তোমার ছেলের বুকের ভিতর থেকে হৃৎপিণ্ডটা উপরে নেয়া হবে তখন বুঝবে নিকোলাস রোকোফকে অপমান করার অর্থ কি।
জেন বলল, তুমি ভয় দেখিয়ে আমাকে বশীভূত করতে পারবে না।
জেনের অনমনীয় মনোভাব দেখে আরো রেগে গেল রোকোফ।
কিন্তু রোকোফ দমে গেল না। উত্তেজনায় কাঁপছিল সে। জেনের দিকে সে ভয়ঙ্করভাবে এগিয়ে গিয়ে তার দু’হাত দিয়ে গলাটা টিপে ধরল।
এমন সময় কেবিনের দরজাটা ঠেলে এ্যান্ডারসন জেনের খাবার নিয়ে ভিতরে ঢুকলো। রোকোফ তাকে দেখেই বাধা পেয়ে চীৎকার করে উঠল, বিনা অনুমতিতে কেন তুমি ঘরে ঢুকলে? এখনি বেরিয়ে যাও, তা না হলে তোমাকে জলে ফেলে দেব।
এই কথা বলে রোকোফ ভয়ঙ্করভাবে এগিয়ে যেতেই এ্যান্ডারসন তার পোশাকের ভিতর লুকিয়ে রাখা ছুরিটা তার একটা হাত দিয়ে ধরতে গেল।
রোকোফ তা দেখে জেনের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ঠিক আছে, আমি তোমাকে আগামীকাল পর্যন্ত সময় দিলাম ভেবে দেখার জন্য। পলভিচ আর আমি ছাড়া এ জাহাজে ইতোমধ্যে কেউ থাকবে না। সকলকেই কূলে পাঠিয়ে দেয়া হবে। আমার ছাড়া এ জাহাজে থাকবে তুমি আর তোমার ছেলে।
রোকোফ কথাগুলো বলল ফরাসী ভাষায়। ভাবল এ্যান্ডারসন তা বুঝতে পারবে না। কথাটা বলেই কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল রোকোফ। এ্যান্ডারসন তখন জেনকে বলল, ও ভাবে আমি বোকা। কিন্তু আসলে ও-ই বোকা।
জেন আশ্চর্য হয়ে বলল, তুমি ওর কথা বুঝতে পেরেছ?
এ্যান্ডারসন বলল, হ্যাঁ। আমি বাইরে থেকেও ওর সব কথা শুনেছি। আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন। ও আমাকেও কুকুরের মত জ্ঞান করে। আমি আপনাকে সাহায্য করব।
কথাটা ঠিক বিশ্বাস করতে না পারলেও লোকটার প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ জাগল জেনের। এত সব শত্রুদের মাঝে অন্তত সহানুভূতিশীল একটা বন্ধুকে এতদিনে খুঁজে পেল সে।
সেদিন আর রোকোফের দেখা পেল না জেন। সন্ধ্যের সময় সেভেন এ্যান্ডারসন খাবার দিতে এল। তার উদ্ধারের ব্যাপারে জেন তার সঙ্গে কিছু কথা বলতে চাইলে সেভেন জেনকে বলল, আপনি আপনার জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখবেন, আমি এলেই বেরিয়ে পড়বেন।
জেন বলল, কিন্তু আমার ছেলে? তাকে ছাড়া আমি ত যেতে পারব না।
সেভেন বলল, আমি আপনাকে সাহায্য করছি। এর বেশি কিছু জানতে চাইবেন না।
কিছুক্ষণের মধ্যে দরজা ঠেলে সেভেন এসে হাজির হলো। তার হাতে একটা পুঁটলি আর এক হাতে কাপড় ঢাকা কি একটা জিনিস। সেভেন সেটা জেনের হাতে দিয়ে বলল, এই নিন আপনার ছেলে। কোন শব্দ করবেন না।
কাপড় ঢাকা ছেলেটাকে বুকে চেপে ধরল জেন। আনন্দে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল তার চোখ থেকে। আর দেরী না করে কেবিন থেকে বেরিয়ে মই বেয়ে জাহাজ থেকে নেমে নৌকাতে উঠে পড়ল। নৌকাতে উঠেই নৌকা ছেড়ে দিল সেভেন। নৌকাটা তীরবেগে ছুটে চলল উগাম্বি নদীর উপর দিয়ে।
রাত তিনটের সময় নদীর ধারে একটুখানি ফাঁকা জায়গায় কতকগুলো কুঁড়ে ঘরের একটা আদিবাসী বস্তি দেখে সেইখানে নৌকা ভেড়াল এ্যান্ডারসন। জেনকে নৌকা থেকে নামিয়ে নৌকাটা একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখল। তারপর দুজনে ঘরগুলোর দিকে এগিয়ে এল।
এ্যান্ডারসন বারকতক ডাকাডাকি করতেই সর্দার আর তার স্ত্রী ঘর থেকে বেরিয়ে এসে গাঁয়ের গেট খুলে দিল। এ্যান্ডারসন আবিদাসীদের ভাষায় সর্দারের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলল। সর্দারের স্ত্রী তাদের থাকার জন্য একটা ঘর দিতে চাইল। কিন্তু ঘরটা নোংরা হবে ভেবে সে বলল, তারা বাইরেই শোবে।
সকালে ঘুম ভাঙ্গলে জেন দেখল তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে। আদিবাসী মেয়েরা ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে তার চারদিকে।
সর্দারের নির্দেশে আদিবাসীরা সবাই সরে গেল জেনের কাছ থেকে। এ্যান্ডারসন কিছুটা দূরে কথা বলতে লাগল সর্দারের সঙ্গে। জেন বুঝল এ্যান্ডারসনকে এর আগে যতখানি অযোগ্য ভেবেছিল ততখানি অযোগ্য সে নয়। গত চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সে তার যোগ্যতা আর বিচক্ষণতার যথেষ্ট পরিচয় দিয়েছে। জেন দেখল ইংরেজি, ফরাসী আর পশ্চিম উপকূলের আদিবাসীদের ভাষায় ভালভাবেই কথা বলতে পারে এ্যান্ডারসন।
এমন সময় জেনের কোলে ছেলেটা কেঁদে উঠতেই কাপড়টা সরিয়ে তার মুখটা দেখল জেন। কিন্তু দেখার সঙ্গে সঙ্গে ভূত দেখার মত চমকে উঠল ভয়ে। তারপরই সেখানে মূৰ্ছিত হয়ে পড়ে গেল।
নিগ্রো যোদ্ধারা তখন সবাই ঘরটার পানে তাকিয়ে দেখল একটা চিতাবাঘ গর্জন করতে করতে এই দিকে আসছে। তার উপর টারজনের গলার স্বর শুনে একদল বাঁদর-গোরিলা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে গায়ের দিকে আসছে। গাঁয়ের সর্দারই প্রথমে গোরিলাদের নেতা আকুৎকে দেখতে পাবার সঙ্গে সঙ্গে সে নিজে জঙ্গলের দিকে ভয়ে ছুটে পালাতে থাকে। তার দেখাদেখি গাঁয়ের অন্য সব লোকেরাও প্রাণভয়ে ছুটতে থাকে।
আকুৎ তার দলের গোরিলাদের নিয়ে টারজনের পাশে ছুটে এসে দাঁড়াল। তখন শীতাও এসে পড়েছে। টারজান তখন তার দুই পায়ের বাঁধনগুলো থেকে মুক্ত হতে চাইছিল। কিন্তু ওর কথা বাদর গোরিলারা বা শীতা বুঝতে পারছিল না কেউ।
সারাটা রাত এমনিভাবে কেটে গেল। টারজান হাত পা বাঁধা অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইল সেইখানে। গাঁ থেকে সব লোক পালিয়ে জঙ্গলে চলে গিয়েছিল। সকাল হতেই তারা আবার গাঁয়ে আসার চেষ্টা করতে লাগল।
এমন সময় হঠাৎ কোথা থেকে ছুটতে ছুটতে মুগাম্বি এসে হাজির হলো। মুগাম্বি এসেই ছুরি দিয়ে টারজনের সব বাঁধন কেটে দিল। টারজান তখন মুগাম্বিকে সঙ্গে নিয়ে একটা মৃত আদিবাসীর বর্শাটা নিয়ে আদিবাসীদের তেড়ে গেল। আদিবাসীরা আগের থেকে আরো বেশি ভয় পেয়ে গেল। কয়েকজন আদিবাসী বন্দী হলো টারজনের হাতে।
তাদের কাছে টারজান জানতে পারল রোকোফ আগের দিন রাত্রিবেলাতেই তার শ্বেতাঙ্গ সহচরদের নিয়ে নৌকায় করে পালিয়ে গেছে।
টারজান আর বৃথা লড়াই করল না। সে তার দলের সবাইকে নিয়ে নৌকায় করে রোকোফের খোঁজে চলে গেল।
এবারেও টারজান দেখল কোন গাঁয়ে গেলে পশু-সঙ্গীদের ভয়ে কোন আদিবাসী কথা বলছে না তার সঙ্গে। সে তাই এক জায়গায় তার দলের সবাইকে মুগাম্বির হাতে ছেড়ে রেখে একাই বেরিয়ে পড়ল রোকোফের খোঁজে।
একদিন বন পথে যেতে যেতে একটা দৃশ্য দেখে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল টারজান। একটা ঝোপের মধ্যে একজন অসুস্থ ও রুগ্ন শ্বেতাঙ্গ শুয়েছিল আর একজন নিগ্রো যোদ্ধা তাকে হত্যা করার চেষ্টা করছিল।
টারজান নিগ্রোটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার হাতের বর্শাটা কেড়ে নিল। নিগ্রোটা আত্মসমর্পণ না করায় টারজান তাকে মেরে ফেলল। তারপর দেখল এই শ্বেতাঙ্গটাই রোকোফের কিনসেড জাহাজে রাঁধুনীর কাজ করত। টারজান তাই ভাবল এও নিশ্চয় রোকোফের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিল এবং সব খবর জানে। লোকটার নাম সেভেন এ্যান্ডারসন।
টারজান তাকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করল, আমার স্ত্রী আর ছেলে কোথায়?
সেভেন কাশছিল। তার বুকে তীরটা তখনো বিধে ছিল। তার বুক থেকে রক্ত ঝরছিল। কাশিটা থামলে সেভেন বলল, আমি তোমার স্ত্রী আর ছেলেকে রোকোফের হাত থেকে উদ্ধার করার জন্য পালিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু রোকোফ এসে আমাদের ধরে ফেলে। আমাকে এইখানে ফেলে রেখে তারা চলে যায়। তোমার স্ত্রী ও ছেলে আবার ধরা পড়েছে তার হাতে। তুমি তার খোঁজে চলে যাও।
একটু আগে রাগের মাথায় তাকে হত্যা করতে যাচ্ছিল টারজান। কিন্তু এখন এবার সব কথা শুনে নিজের ভুল বুঝতে পেরে তার কাছে ক্ষমা চাইল। কিন্তু সেভেন একবার জোর কেশে তখনি মারা গেল।
সেদিন সন্ধ্যা হতেই প্রবল বৃষ্টি শুরু হলো। সাত দিন ধরে বৃষ্টি সমানে চলতে লাগল।
সাত দিনের দিন মেঘ কেটে গিয়ে সূর্য উঠল আকাশে। কিন্তু টারজান কোন দিকে রোকোফের খোঁজে যাবে তা ঠিক করতে পারল না।
অনেক ভাবার পর অবশেষে উত্তর-পূর্ব দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। পরের দিন সে একটা আদিবাসী গাঁয়ে গিয়ে পৌঁছল। কিন্তু তাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে গাঁয়ের লোকেরা ছুটে পালাত লাগল। কিন্তু টারজানও ছাড়ল না। সে তাড়া করে একজন যুবককে ধরে ফেলল। যুবকটা তাকে দেখে এতখানি ভয় পেয়ে গেল যে সে তার হাত থেকে সব অস্ত্র ফেলে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল টারজনের পায়ের কাছে।
টারজনের অনেক প্রশ্নের উত্তরে নিগ্রো যুবকটি যা যা বলল তার থেকে বুঝতে পারল টারজান। দিনকতক আগে কয়েকজন শ্বেতাঙ্গ এসেছিল। তারা বলে গেছে এক ভয়ঙ্কর শ্বেতাঙ্গ শয়তান পরে তাদের গাঁয়ে আসবে। তার সঙ্গে থাকবে একদল হিংস্র জন্তু।
কিন্তু টারজনের সঙ্গে কোন হিংস্র জন্তু জানোয়ার না দেখে সাহস হলো যুবকটির।
টারজান যুবকটিকে সঙ্গে করে তাদের গায়ে চলে গেল।
ওদের সর্দারকে ডেকে আনাল। সে দেখল সর্দার লোকটা বেঁটে এবং বলিষ্ঠ চেহারার। তার মুখটা কুটিল প্রকৃতির। টারজান বুঝল এরাও নরখাদক। টারজনের প্রশ্নের উত্তরে সর্দার যা বলল তার থেকে। বোঝা গেল একজন শ্বেতাঙ্গ দিনকতক আগে তাদের গায়ে এসেছিল বটে, কিন্তু তাদের সঙ্গে কোন নারী বা শিশু ছিল না। এতে টারজনের সন্দেহ হলো সর্দার ঠিক বুলছে না। তবু টারজান সে রাতটা তাদের গাঁয়েই কাটাবার কথা বলল।
সর্দার এ কথায় উৎসাহিত হয়ে তার একটা ঘর ছেড়ে দিল। কিন্তু সে ঘরে আর এক বুড়ি স্ত্রী ছিল। বুড়িকে রাত্রিতে ঘর থেকে বার করে দিলে ঠাণ্ডায় কষ্ট হবে তার একথা ভেবে টারজান সেই ঘরে রইল না। সে অন্য ঘরে থাকার জন্য জেদ ধরলে তাকে অন্য একটা ঘর দেওয়া হলো।
সন্ধ্যার পর যখন ওদের নাচ শুরু হলো এবং গাঁয়ের সবাই যখন উৎসবে মেতে ছিল তখন টারজান সেই কুঁড়ে ঘরটার মধ্যে একা বসে ভাবছিল। এমন সময় একটা বুড়ি চুপি চুপি সেই অন্ধকার ঘরটায় ঢুকে টারজানকে চুপি চুপি বলল, আমার নাম তমুদজা। আমি সর্দার মগনওয়াসামের প্রথমা স্ত্রী। আমার কথা শোন। ওরা তোমাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছে। তুমি ঘুমিয়ে পড়লেই ওরা তোমাকে হত্যা করবে।
মূৰ্ছিত জেন চেতনা ফিরে পেয়ে দেখল, ছেলেটাকে কোলে করে বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এ্যান্ডারসন। তার মুখখানা বিষাদে ভরা।
জেন বলল, আমার ছেলে কোথায়? এ ছেলে আমার নয়। তুমি তা জানতে। তুমিও রোকোফের মতই শয়তান।
এ্যান্ডারসন আশ্চর্য হয়ে বলল, তা ত জানি না। তাহলে নিশ্চয় দুটো ছেলে ছিল। কিন্তু আমি তার কিছুই জানতাম না।
তার কথা শুনে জেন বুঝতে পারল আসলে এ্যান্ডারসনের সততায় কোন সংশয় নেই। সে ঠিকই বলেছে।
এমন সময় এ্যান্ডারসনের কোলের মধ্যে শিশুটা কেঁদে উঠল। হাত বাড়িয়ে এ্যান্ডারসনের কাছ থেকে সেই অসহায় শিশুটাকে নিজের কোলে তুলে নিল জেন। হতাশার সঙ্গে সঙ্গে তার মনে একটা আশা জাগল, হয়ত বা শেষ মুহূর্তে তার ছেলে জ্যাককে কেউ উদ্ধার করেছে রোকোফের হাত থেকে।
এ্যান্ডারসন বলল, এখন তাহলে কি করব আমরা? আমি কিনসেড জাহাজে ফিরে গেলে রোকোফ আমাকে গুলি করে মারবে। কিন্তু আপনি সেখানে ফিরে যেতে পারেন।
জেন বলল, না আমি মৃত্যুবরণ করব, তবু তার কাছে আর ফিরে যাব না। তার থেকে এই অসহায় শিশুটাকে নিয়ে চল আমাদের সঙ্গে।
আবার তারা এগিয়ে যেতে লাগল।
পথে দু-একজন পথচারীর কাছ থেকে ওরা জানেত পারল একজন লোক তাদের সন্ধানে তাদের পিছনে পিছনে আসছে। তবে এখনো দূরে আছে।
যেতে যেতে এ্যান্ডারসন জেনকে বলল, মাইলখানেকের মধ্যেই একটা গাঁ আছে। আপনি সেখানে ছেলেটাকে নিয়ে চলে যান। গাঁয়ের সর্দারকে আপনি সব কথা বলবেন। সে আপনাকে জাহাজের ব্যবস্থা, করে দেবে যাতে আপনি সভ্য জগতে চলে যেতে পারেন। আমি এইখানে থাকব। রোকোফকে বলল, আপনি মারা গেছেন। তাহলে ও আর আপনার খোঁজ করবে না। বিদায়, আপনি চলে যান। আমার এই রাইফেলটা আর গুলিগুলো নিয়ে যান।
এই বলে রোকোফের হাতে ধরা দেবার জন্য সেখান থেকে চলে গেল সেভেন এ্যান্ডারসন।
আধ ঘণ্টা পরে গাঁটায় পৌঁছল জেন। তাকে দেখে ঘিরে ধরল গাঁয়ের মেয়েরা। ছেলেটা হঠাৎ দারুণ অসুস্থ হওয়ায় সে কথা তাদের কোনরকমে বোঝাল জেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। মাঝরাতের দিকে জেনের কোলের মধ্যেই মারা গেল শিশুটা।
এমন সময় গায়ের সর্দার মগনওয়াজাম এসে জেনকে নানা কথা জিজ্ঞাসা করতে লাগল। লোকটাকে দেখে কুটিল প্রকৃতির বলে মনে হলো জেনের।
জেন শুনতে পেল গায়ের গেটের কাছে কারা যেন এসেছে বাইরে থেকে। কথাবার্তার শব্দ আসছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই জেনের কাছে এসে তার নাম ধরে কে ডাকল।
মুখ তুলে আগুনের আলোয় দেখল জেন, তার সামনে রোকোফ দাঁড়িয়ে আছে।
রোকোফ এসেই বলল, ছেলেটাকে এখানে আনার জন্য এত কষ্ট করে এখানে এলে কেন? তার থেকে আমাকে বললেই ত হত। এখন দাও ওকে আমার হাতে।
জেন নীরবে তার হাত থেকে ছেলেটাকে তুলে দিল রোকোফের হাতে। বলল, ও তোমাদের সব পীড়নের বাইরে চলে গেছে।
ছেলেটার মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে রোকোফ দেখল, সত্যি সত্যিই ছেলেটা মারা গেছে।
সঙ্গে সঙ্গে এক প্রচণ্ড রাগে জ্বলে উঠল রোকোফ।
তার রাগ দেখে জেন বুঝল এটা যে তার ছেলে নয় রোকোফ তা জানে না। না জানাটাই ভাল, তাহলে তার ছেলে যেখানেই থাক নিরাপদে থাকতে পারবে।
রোকোফ বলল, আমার কাছ থেকে ছেলেটাকে ছিনিয়ে নিয়েছ। তা নাও, এবার তোমার পালা। তোমাকে নরখাদক মগনওয়াজামের হাতে তুলে দেব। তুমি হবে নরখাদকের স্ত্রী।
তারপর রোকোফ জেনকে সঙ্গে করে একজন আদিবাসীকে নিয়ে গা পার হয়ে তার শিবিরের পথে যেতে লাগল।
শিবিরে গিয়ে জেন দেখল সেখানে কিসের গোলমাল চলছে। রোকোফ গিয়ে শুনল, তার দলের আরো কিছু লোক তার অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পালিয়ে গেছে শিবির থেকে। কথাটা শুনে রাগে চেঁচামিচি করতে লাগল রোকোফ। পরে জেনের হাত ধরে টানতে টানতে তার ঘরের মধ্যে নিয়ে গেল রোকোফ। জেন বাধা দিলে তার মুখে একটা ঘুষি মারল রোকোফ।
হঠাৎ এই সময় ঘরের বাইরে কিসের গোলমাল হতে রোকোফ জেনের উপর থেকে তার দৃষ্টি সরিয়ে বাইরে সেই দৃষ্টি ছড়িয়ে দিল। সেই অবসরে জেন চোখের পলকে রোকোফের বন্দুকটা টান মেরে হাতে নিয়ে তার বাঁট দিয়ে রোকোফের মাথায় সমস্ত শক্তি দিয়ে তাকে আঘাত করল। সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল রোকোফ। জেন তখন রোকোফের কোমর থেকে লম্বা ছুরিটা দিয়ে তাই নিয়ে তাঁবুর পিছনের খানিকটা কেটে তার পালাবার পথ করে নিল।
এদিকে বুড়ি তম্বুদজা টারজানকে সঙ্গে করে রোকোফের তাঁবুর দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। রোকোফের তাঁবুতে গিয়ে দেখল সেখানে খুব গোলমাল চলছে।
সেই দিন সকালে জেন চলে যাওয়ার পর রোকোফের জ্ঞান ফিরে এলে সে দেখে সে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল এতক্ষণ এবং জেন পালিয়ে গেছে শিবির থেকে। এমন সময় মগনওয়াজামের গাঁ থেকে দূত মারফৎ খবর আসে টারজান ঐ গাঁয়ে আটক ছিল এবং আজ রাতেই তাকে হত্যা করা হত, কিন্তু সে পালিয়ে যায় এবং হয়তো এই শিবিরেই সে আসবে রোকোফের সন্ধানে।
এই খবরটা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রোকোফের নিগ্রো ভৃত্যরা সব টারজনের আসার খবর পেয়েই শিবির থেকে অনেক জিনিসপত্র নিয়ে পালিয়ে গেল। শিবিরে রয়ে গেল শুধু রোকোফ আর তার সাতজন শ্বেতাঙ্গ নাকিব।
এই সব অবাঞ্ছিত ঘটনার জন্য রোকোফ কিন্তু তার শ্বেতাঙ্গ নাবিকদের দায়ী করতে লাগল। এতে নাবিকরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠায় রোকোফ শিবির ছেড়ে পালিয়ে যাবে ঠিক করে ফেলল। শিবির থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় সে দেখতে পায় শিবিরের সামনে দিয়ে টারজান তারই খোঁজে আসছে। তাতে তার ভয় আরো বেড়ে যায়।
এদিকে বুড়ি তদজার সঙ্গে শিবিরে এসে টারজান দেখল রোকোফ বা জেন কেউই সেই শিবিরে নেই। নাবিকদের কাছ থেকে জানতে পারল, বন্দিনী মহিলাটি আগেই পালিয়ে যায়। রোকোফ পালায় তার পরে।
টারজান তখন যে পথে তারা পালিয়েছে সেই পথ ধরে বেরিয়ে পড়ল তাদের খোঁজে।
টারজান জঙ্গলের মধ্য দিয়ে যে পথে যাচ্ছিল সেই পথেই তার সামনে অনেক দূরে জেন তখন একা উগাম্বি নদীর ঘাটের দিকে এগিয়ে চলছিল।
নদীর ঘাটে গিয়ে জেন দেখল একটা নৌকা কাছেই একটা গাছের সঙ্গে বাঁধা রয়েছে। দড়িটা খুলে নৌকাতে উঠতে গিয়ে হঠাৎ তার চোখে পড়ল রোকোফ নদীর পাড়ে এসে পড়েছে এবং সে তাকে থামতে বলছে এবং ভয় দেখাচ্ছে না থামলে তাকে গুলি করে মারবে। অথচ জেন দেখল সে একা এবং তার কাছে কোন অস্ত্র নেই।
নৌকাটা নদীর স্রোতের টানে ছুটে যেতে শুরু করতেই জেন দেখতে পেল রোকোফ কোথা থেকে একটা ছোট ডিঙি নৌকা বার করল ঘাটের পাশ থেকে। জেন বুঝতে পারল রোকোফ ঐ নৌকাটা করে ধরতে আসবে তাকে। রোকোফের হাতে আবার ধরা পড়ার ভয়েতে প্রাণপণ শক্তিতে দাঁড় বাইতে লাগল জেন।
রোকোফের শিবির থেকে বেরিয়ে বনপথে উগাম্বি নদীর দিকে আসতে আসতে মাঝ পথে তার দলের সঙ্গে দেখা হলো টারজনের। কিন্তু তারা জেন বা রোকোফের কথা কিছু বলতে পারল না। অথচ টারজান বাতাসের গন্ধ শুঁকে বুঝতে পারল কিছু আগে জেন আর রোকোফ দুজনেই এই পথে নদীর দিকে গেছে।
তখন টারজান ওদের সঙ্গে করে নদীর ধারে এল। নদীর পারে একটা গাছের উপর চড়ে টারজান দেখতে পেল দূরে একটা ছোট নৌকায় রোকোফ একা দাঁড় বাইছে। টারজান তখন নদীর ধারে ধারে রোকোফকে লক্ষ্য করে উধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগল। রোকোফের কাছাকাছি এসে নদীর জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে। তার দলের সবাই নদীর ধারে এগিয়ে চলল।
এদিকে টারজানকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে সাক্ষাৎ মৃত্যুর মত মনে হতে লাগল রোকোফের। সে দেখল টারজনের সঙ্গে সেই সব ভয়ঙ্কর জন্তুগুলোও রয়েছে।
নদীর জলে ঝাঁপ দিয়ে রোকোফের নৌকার দিকে এগিয়ে যেতে লাগল টারজান। নৌকার কাছে গিয়ে নৌকাটাকে হাত বাড়িয়ে ধরতেই রোকোফ দাঁড়ের কাঠটা দিয়ে টারজনের মাথায় জোর একটা ঘা দিল আর এমন সময় একটা কুমীর টারজনের একটা পা ধরে তাকে জলের ভিতর দিয়ে টেনে নিয়ে যেতে লাগল। রোকোফ দেখল টারজান হঠাৎ জলে ডুবে গেল। সে তখন নৌকাটাকে জোরে চালাতে লাগল। তবু তার ভয় গেল না।
ক্রমে রোকোফের নৌকাটা কিনসেড জাহাজের কাছে এসে পড়ল। জাহাজটা তখনো দাঁড়িয়ে আছে দেখে আশা হলো তার।
ক্ষিপ্ত হাতে দাঁড় বেয়ে জাহাজের কাছে এসে নৌকার উপর থেকে ডাকতে লাগল পলভিচকে। কিন্তু কেউ তার ডাকে সাড়া দিল না। মনে হলো জাহাজে কোন লোক নেই। এদিকে নদীর পাড়ে সেই ভয়ঙ্কর জন্তুগুলো তখনো গর্জন করছিল। তার ভয় হলো নিগ্রোটা হয়ত কোন নৌকা যোগাড় করে জাহাজে গিয়েও তাকে ধরবে।
কিন্তু কোথায় গেল পলভিচ? তবে কি ওরা জাহাজে কেউ নেই।
তবু সাহসে ভর করে জাহাজের কাছে দাঁড় বেয়ে গিয়ে জাহাজের গায়ে লাগানো মইটাকে ধরে ফেলল রোকোফ। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে জাহাজের ডেকের উপর থেকে রাইফেল হাতে জেন চীৎকার করে বলল, খবরদার, জাহাজে ওঠার চেষ্টা করলেই গুলি করে মারব। রোকোফ এবার জেনকে কোনরকম ভয় না দেখিয়ে অনেক অনুনয় বিনয় করল। কিন্তু তাকে কিছুতেই জাহাজে উঠতে দিল না জেন।
রোকোফ তখন কোন উপায় না দেখে নৌকাটাকে কোনরকমে জাহাজের কাছে ফেলে রেখে কূলের দিকে চলে গেল।
এর আগে রোকোফ জেনের নৌকাটা ধরার জন্য খুব জোরে দাঁড় বাইতে থাকলেও জেন তার থেকে দু’ঘণ্টা আগেই অপেক্ষমান কিনসেড জাহাজটাতে গিয়ে ওঠে। সেও জাহাজটাকে দেখে আশান্বিত হয়ে ওঠে। ভাবে রোকোফ এখন সে জাহাজে না থাকায় নাবিকদের টাকা দিয়ে বশ করে সে জাহাজটাকে সভ্যজগতের কোন বন্দরে নিয়ে যেতে বলবে।
তখন নৌকা থেকেই জাহাজের গায়ে ঝুলতে থাকা শিকলটা ধরে ফেলল জেন। তারপর নৌকাটাকে ছেড়ে দিয়ে কোন রকমে মইটাতে উঠে পড়ল। সোজা ডেকের উপর উঠে গিয়ে জেন দেখল সারা জাহাজটার মধ্যে দু’জন নাবিক ছাড়া আর কেউ নেই। তারা মদ খেয়ে নেশার ঘোরে একটা কেবিনের মধ্যে ঘুমোচ্ছিল। জেন, দরজায় শিকল তুলে দিয়ে ডেকের উপর বসে রাইফেল হাতে পাহারা দিতে লাগল।
একঘণ্টা নিরাপদে কেটে গেল। কিন্তু এমন সময় জেন দেখল কিনসেড জাহাজের যেসব নাবিক কয়লা আনার জন্য কূলে গিয়েছিল তারা কূল থেকে একটা নৌকায় করে উজান বেয়ে জাহাজের দিকে আসছে। তাদের দলে পলভিচও ছিল। জেন এবার ভয় পেয়ে গেল।
জেন আরও দেখল নদীর অপর পার হতে একটা নৌকায় করে পাঁচটা ভয়ঙ্কর বাঁদর-গোরিলা, একটা চিতাবাঘকে সঙ্গে করে একটা নিগ্রো যোদ্ধা এদিকেই আসছে।
এখানে আর থাকা যুক্তিসঙ্গত নয় ভেবে নাবিক দুটোকে কেবিন থেকে মুক্ত করে জাহাজ ছেড়ে দেবার কথা বলল। তার কথা না শুনলে তাদের গুলি করবে বলে ভয় দেখাল। তারা জাহাজ ছাড়ার জন্য প্রস্তুত হতে থাকলে জেন আবার ডেকে এসে পাহারা দিতে লাগল।
এদিকে নাবিকদুটো যখন জাহাজের উপর থেকে দেখল তাদের মালিক আর অন্য নাবিকরা একটা নৌকায় করে জাহাজের দিকে আসছে তখন তারা সাহস পেল। তখন তারা অতর্কিতে জেনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার হাত থেকে রাইফেলটা কেড়ে নিল।
টারজান যখন দেখল একটা কুমীরে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তখন সে তার পাথরের ছুরিটা কুমীরের পেটটার নরম অংশ দেখে তার মধ্যে বার বার ঢুকিয়ে দিতে লাগল।
টারজান দেখল কুমীরটা তার ছুরির আঘাতে হাঁপাচ্ছে এবং কিছু পরেই তার দেহটা শক্ত হয়ে গেল। সে যখন বুঝল কুমীরটা মারা গেছে তখন টারজান নদীর ধারে যে গাছের একটা ডাল জলের উপর ঝুলে পড়ে ছিল সেটা ধরে সেই গাছটার উপর উঠে পড়ল।
গাছটার উপর কিছুক্ষণ বসে থেকে বিশ্রাম করতে লাগল টারজান। সে দেখল নদীর যে পার থেকে সে ঝাঁপ দিয়েছিল জলে সেই পারেই সে উঠেছে। তবে রোকোফের নৌকাটাকে আর দেখতে পেল না। গাছ থেকে নেমে কিছু ঘাস থেঁতো করে পায়ের ক্ষতস্থানটায় লাগিয়ে দিল।
নানারকমের চিন্তা হচ্ছিল তখন তার মনে। তম্বুদজা তাকে কথায় কথায় এক সময় বলেছিল তাদের গাঁয়ে জেনের কোলে একটা বাচ্চা ছেলে ছিল সেটা মারা যায়। টারজান ভাবল সেটা হয়ত তারই ছেলে। আবার ভাবল আসলে হয়ত সে জেন নয় এবং ছেলেটাও তার নয়। জেন হয়ত রোকোফের হাতে ধরা পড়েনি এবং সে এখানে লন্ডনের বাড়িতেই আছে।
নদীর পাড় ধরে বরাবর মোহানার দিকে এগিয়ে চলল টারজান। এইভাবে অনেক দূর যাওয়ার পর সন্ধ্যা হয়ে এল। কূল থেকে টারজান দেখল সমুদ্রের কাছে নদীর বুকের উপর রোকোফের কিনসেড জাহাজটা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। সে বেশ বুঝতে পারল রোকোফ এতক্ষণে নিশ্চয় জাহাজটায় উঠে গেছে।
এমন সময় পরপর দুটো গুলির শব্দ আর সঙ্গে সঙ্গে নারীকণ্ঠের এক আর্ত চীৎকার শুনে থাকতে পারল না টারজান। সে কুমীরের কথা ভুলে গিয়ে নদীর জলে আবার ঝাঁপ দিল।
এদিকে রোকোফ যখন তার দলবল নিয়ে নৌকায় করে কিনসেড জাহাজের দিকে আসছিল তখন। সে অন্য একটা নৌকাতে মুগাম্বি আর তার ভয়ঙ্কর পশু সঙ্গীগুলোকে দেখতে পায়। নৌকা দুটো কাছাকাছি হলে চিতাবাঘটা আবার হাঁ করে তাদের নৌকায় ঝাঁপ দেবার চেষ্টা করে। রোকোফ তখন গুলি করতে বলে। গুলিটা অবশ্য কারো গায়ে লাগেনি। তবে নৌকার ভিতরে যে একজন আদিবাসী মেয়ে ছিল সে চীৎকার করে ওঠে ভয়ে। এই চীৎকারটা আর গুলির শব্দ শুনতে পায় টারজান।
বিদ্রোহী নাবিক দুটো যখন জেনের কাছ থেকে রাইফেলটা কেড়ে নেবার জন্য ধস্তাধস্তি করছিল তখন টারজান মই বেয়ে জাহাজের উপর উঠে পড়ে। সে গিয়ে সরাসরি নাবিক দুটোকে বলে এসব কি হচ্ছে?
এই বলে সে নাবিক দুটোকে ধরে ডেকের উপর থেকে সমুদ্রের জলে ফেলে দিল। তারপর জেনকে দু’হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরল।
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে রোকোফ, পলভিচ আর জনাছয়েক নাবিক সেখানে গিয়ে হাজির হলো। রোকোফ টারজানকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে গুলি করার হুকুম দিল। টারজান জেনকে পাশের একটা কেবিনে ঢুকিয়ে দিয়ে রোকোফকে আক্রমণ করার জন্য এগিয়ে গেল। রোকোফের পিছনে তার লোকেরা ছিল। রোকোফের দু’জন লোক গুলি করল তাদের রাইফেল থেকে। কিন্তু তাদের হাত তখন কাঁপছিল ভয়ে। কারণ তাদের পিছন দিক থেকে একদল ভয়ঙ্কর জন্তু এগিয়ে আসছিল তাদের দিকে। প্রথমে এল পাঁচজন। বাঁদর-গোরিলা, তারপর একটা চিতাবাঘ আর সবশেষে এক দৈত্যাকার নিগ্রোযোদ্ধা। রোকোফের লোকরা গুলি করার কোন অবকাশ পেল না।
রোকোফ ভয়ে পালিয়ে গিয়ে সামনের দিকে একটা ঘরে গিয়ে আশ্রয় নিল। টারজনের বাঁদর গোরিলারা মুগাম্বির নেতৃত্বে রোকোফের লোকদের আক্রমণ করল।
টারজান রোকোফকেই খুঁজছিল। পরে সে দেখল রোকোফ তার নাবিকদের তাড়া খেয়ে বেরিয়ে আসছে ঘর থেকে।
কিন্তু তাকে দেখতে পেয়ে টারজান তার দিকে এগিয়ে যাবার আগেই শীতা ছুটে গেল তার দিকে। তার উপর শীতা ঝাঁপিয়ে পড়তেই রোকোফ চিৎ হয়ে পড়ে গেল। এক ভয়ঙ্কর প্রতিশোধবাসনায় সর্বাঙ্গ জ্বলছিল টারজনের। কিন্তু সে যখন দেখল শীতা তাকে সে প্রতিশোধ গ্রহণের কোন সুযোগ না দিয়ে রোকোফকে ছিঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে, তখন সে শীতাকে বারকতক ডাকল। কিন্তু শীতা তার প্রভুর কথা শুনল না। শীতা রোকোফের মুখে একটা জোর কামড় বসিয়ে তার বুকটা কামড়াচ্ছিল।
আকুতের বাঁদর-গোরিলাগুলো তখন ভয়ঙ্করভাবে ঘোরাঘুরি করছিল জাহাজে। তারা জেনকে চিনতে না পেরে তার দিকেও দাঁত বার করে এগিয়ে আসছিল। টারজান তখন তাদের জেনের পরিচয়টা দিতে তারা শান্ত হলো।
রোকোফের দলের মধ্যে শুধু পলভিচকে পাওয়া গেল না। যে চারজন ঘরের মধ্যে ঢুকে ছিল তাদের প্রাণে না মেরে বন্দী করে রাখল টারজান। তারা নাবিক, জাহাজ চালনার কাজে লাগতে পারে। বাকি সবাই লড়াইয়ে নিহত হয়েছে।
সেদিন সন্ধ্যায় জেন আর টারজান যখন কিনসেড জাহাজের ক্যাপ্টেনের কেবিনের মধ্যে বসে পরস্পরের অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করছিল তখন তাদের অলক্ষ্যে অগোচরে কূলের উপর দাঁড়িয়ে একটা। লোক এক উন্মত্ত প্রতিহিংসায় জাহাজটার পানে তাকিয়েছিল। লোকটা হলো পলাতক পলভিচ।
সকাল হওয়ার কিছু পরে ঘুম থেকে জেগে উঠল টারজান। সে দেখল ঝড় থেমে গেছে। আকাশ পরিষ্কার সুতরাং জাহাজ ছাড়ার পথে আর কোন বাধা নেই।
টারজান নাবিকদের জাহাজ ছাড়ার নির্দেশ দিল।
জাহাজটা অবশেষে চলতে শুরু করল। উগাষি নদীর মোহানা পার হয়ে সেটা আটলান্টিক মহাসাগরে পড়ল। টারজান আর জেনের মনে তখন শুধু একটাই দুঃখ, তাদের ছেলেটার কোন খোঁজ পাওয়া গেল না।
এমন সময় হঠাৎ একটা প্রবল বিস্ফোরণে একটা কেবিনের ছাদ উড়ে গেল। সবাই আশ্চর্য হয়ে তাকাল সেইদিকে। কিন্তু এই বিস্ফোরণের কারণ কি তা বুঝতে পারল না। কিন্তু সকলেই সন্ত্রস্ত হয়ে ছোটাছুটি করতে লাগল। একমাত্র টারজানই সাহস দিতে লাগল সকলকে। একমাত্র একটা নাবিক বুঝতে পারল এ হলো শয়তান পলভিচের কাজ। রাত্রিবেলায় পলভিচ লুকিয়ে তার কেবিনে ঢুকে জিনিসপত্র নেবার সময় কোন বিস্ফোরক পদার্থ রেখ যায়। কিন্তু সে কথা ভয়ে আর প্রকাশ করতে পারল না নাবিকটা।
টারজান দেখল তাদের বিপদ কাটেনি। জাহাজের কাঠে আগুন ধরে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে গোটা জাহাজটাই পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে। পাম্প করে আগুন নেভানোর চেষ্টা করতে গিয়ে দেখা গেল আগুন কমার থেকে বেড়ে যাচ্ছে আরো। ইঞ্জিন ঘরেও আগুন ধরে গেছে।
তখন টারজান নাবিকদের বলল, জাহাজটাকে আর বাঁচানো যাবে না। সুতরাং এখানে থেকে আর লাভ নেই। আর যে দুটো নৌকা আছে জাহাজে তা নামিয়ে দাও। এখান থেকে কূল বেশি দূরে নয়।
দুটো নৌকায় করে সকল মালপত্র নিয়ে বেলাভূমির দিকে এগিয়ে গেল ওরা। মাটিতে পা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে আকুতের দলের বাঁদর-গোরিলারা আর শীতা ছুটে জঙ্গলের মধ্যে চলে গেল।
টারজান তাদের লক্ষ্য করে বলল, বিদায় বন্ধু, তোমরা ছিলে আমার বিশ্বস্ত বন্ধু। তোমাদের ভুলতে পারব না জীবনে কখনো।
জেন বলল, ওরা কি আবার ফিরে আসবে?
টারজান বলল, আসতে পারে, আবার নাও আসতে পারে।
উপকূলের উপর নেমে দেখল কিনসেড জাহাজটা তখন সেখানে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে জ্বলছে। এইভাবে দু’ঘন্টা জ্বলার পর জাহাজটা ডুবে গেল একেবারে।
দ্বীপের মধ্যে টারজনের প্রথম কাজ হলো ভাল জলের জায়গার কাছাকাছি শিবির স্থাপন করা। কোথায় জল আছে তা সে জানত এবং সেই জায়গায় শিবির স্থাপন করল। দলের নাবিকরা যখন শিবির স্থাপনের কাজ করছিল টারজান তখন মুগাম্বি আর সেই আদিবাসী মেয়েটিকে জেনের কাছে রেখে বনের মধ্যে শিকার করতে গেল।
দলের মধ্যে কে কি কাজ করবে তা সব ভাগ করে দিল টারজান। ঠিক হলো সারাদিন শিবিরের কাছে একটা বড় পাথরের উপর থেকে একজন সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকবে, কোন জাহাজ আসছে কি না তা দেখবে। কোন জাহাজ দেখতে পেলেই পাহারাদার নাকিবদের কাছ থেকে নেওয়া একটা লাল জামা উড়িয়ে সংকেত দেখাবে। রাত্রিতে সেইখানে শুকনো ডালপালা দিয়ে একটা আগুন জ্বালিয়ে রাখা হলো।
কিন্তু কয়েকদিন কেটে গেলেও দিগন্তে সমুদ্রের উপর কোন জাহাজ দেখতে পাওয়া গেল না। টারজান তখন বলল, জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে একটা বড় নৌকা তৈরি করতে হবে। তাই দিয়ে ওরা এই দ্বীপ থেকে মূল মহাদেশে গিয়ে উঠবে। সেখানে কোন জাহাজের দেখা পাওয়া যেতে পারে। টারজান নৌকা তৈরি কিভাবে করতে হয় তা জানে। কিন্তু তাকে সাহায্য করার জন্য লোকের দরকার। এ কাজে প্রচুর পরিশ্রম আর লোকের দরকার। এ ব্যাপারে সারাদিন প্রচুর পরিশ্রম করতে গিয়ে বন্দী নাবিকরা ক্রমে অসন্তুষ্ট হয়ে উঠল।
টারজানদের শিবিরে যখন এইরকম গোলমাল চলছিল তখন তাদের উত্তর-পূর্ব দিকে কিছু দূরে কাউরি নামে একটা ছোট জাহাজ উপকূলভাগের একটা শাড়ির মধ্যে লুকিয়ে থাকতে শুরু করে। কারণ। এই জাহাজের দশজন নাবিক কিছু মুক্তোর লোভে সহসা বিদ্রোহী হয়ে উঠে অফিসারদের হত্যা করে। অফিসারদের পক্ষে কিছু অনুগত নাবিক যোগদান করলে তাদেরও হত্যা করা হয়। বিদ্রোহী নাবিকদের নেতা ছিল তিনজন, গান্ট নামে এক সুইডিশ, মমুলা মাওরি নামে এক নিগ্রো আর কাইশাং নামে একজন। চীনদেশীয় লোক।
যেদিন এই জঙ্গলদ্বীপের উপকূলভাগের খাড়ির মধ্যে কাউরি জাহাজটাকে ওরা লুকিয়ে রাখে তার আগের দিনই ওরা দক্ষিণ দিগন্তে একটা যুদ্ধ জাহাজের চিমনি দিয়ে ধোয়া উড়তে দেখে। যুদ্ধ জাহাজটাকে দেখে ওদের ভয় হয়। ওরা ভাবে ওদের বিদ্রোহ ও অফিসার হত্যার খবর পেয়েই হয়তো। যুদ্ধ জাহাজটা খোঁজ করছে ওদের।
কাইশাং আর মাওরি গান্টকে তাদের জাহাজটা ছেড়ে দিতে বলল ধরা পড়ার ভয়ে। কিন্তু গান্ট বলল, ও জাহাজ আমাদের ধরতে আসবে কেন? আমাদের বিদ্রোহের কথা কেউ জানে না।
একদিন টারজান দুপুরের দিকে হরিণ শিকার করতে যায় মুগাম্বিকে শিবিরে রেখে। মুগাম্বির সঙ্গে জোনস আর সালিভান নামে দু’জন অনুগত নাবিকও ছিল।
টারজান বেরিয়ে যেতেই কাইশাং ও তার দলের পাঁচজন লোককে শিবিরের কাছে এক জায়গায়। লুকিয়ে রেখে স্নাইদার হঠাৎ একসময় ব্যস্ত হয়ে শিবিরে গিয়ে মুগাম্বিকে বলে তার সঙ্গী স্মিথসকে বাঁদর গোরিলারা ধরেছে। তাকে মেরে ফেলবে। তুমি এখনি জোনস আর সালিভানকে সঙ্গে নিয়ে ছুটে যাও।
কথাটা শুনে মুগাম্বি শিবির ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই স্নাইদার কাইশাং-এর কাছে চলে গেল। বলল, চলে এস, শিবির ফাঁকা।
কাইশাং গিয়ে প্রথমে জেনকে বলল, চলে এস আমাদের সঙ্গে।
জেন কিছু বুঝতে না পেরে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। জেন উঠেই স্মিথসকে দেখতে পেল। বুঝল একটা দারুণ ষড়যন্ত্র চলছে। সে স্মিথসকে বলল, এর মানে কি?
স্মিথস বলল, আমরা একটা জাহাজ পেয়েছি। এখন আমরা এখান থেকে মুক্তি পেতে পারি।
জেন স্নাইদারকে বলল, তুমি তাহেল মুগাম্বিকে কোথায় পাঠালে?
স্নাইদার বলল, তারা আসবে না।
তখন কাইশাং-এর লোকজনরা জেন আর আদিবাসী মেয়েটিকে তুলে নিয়ে কাউরি জাহাজটার দিকে চলে গেল। কিছুটা দূরে থেকে গান্ট সব দেখল।
এদিকে মুগাম্বি যখন স্নাইদারের কথামত নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে দেখল স্মিথস বা কোন বাঁদর-গোরিলা নেই, তখন সে বুঝতে পারল এর পিছনে কোন একটা চক্রান্ত আছে। তখন সে উধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে শিবিরে ফিরে এসে দেখল শিবির শূন্য।
এমন সময় হরিণ না পেয়ে টারজান ফিরে এলে তার দুটো কুঁচকে উঠল।
টারজান বলল, কিন্তু জঙ্গলে ওরা জেনকে নিয়ে যাবে কোথায়? পালাবার জাহাজই বা পাবে কোথায়? এখন এস, ওদের খোঁজ করা যাক।
ওরা শিবির থেকে বার হতেই গান্ট এসে টারজনের সামনে দাঁড়াল।
গান্ট সরাসরি টারজানকে বলল, তোমাদের মেয়েদের ওরা চুরি করে নিয়ে পালিয়েছে। যদি তাদের ধরতে চাও তাড়াতাড়ি এস আমার সঙ্গে। তা না হলে কাউরি জাহাজটা এখনি ছেড়ে দেবে।
টারজান বলল, কে তুমি? আমার স্ত্রীর অপহরণের কথা তুমি কি করে জানলে?
গান্ট বলল, আমি নিজে দেখেছি আমাদের দলের কাইশাং আর মমুলা মাওরি তোমাদের দলের দু’জন লোকের সঙ্গে চক্রান্ত করছিল। তাদের কথা আমি সব শুনেছি। কাইশাং আর মাওরি আমাকে তাদের শিবির থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। তারা আমাকে খুন করতে চেয়েছিল। আমি পালিয়ে এসেছি শিবির থেকে।
গান্ট তাদের পথ দেখিয়ে উপকূলের কাছে নিয়ে গেল। কিন্তু সামান্য একটুর জন্য দেরী হয়ে গেছে। কাউরি জাহাজটা এইমাত্র ছেড়ে দিয়েছে। ওরা দেখল জাহাজটা পূর্ব দিকে এগিয়ে চলেছে ধীর গতিতে। জীবনে কখনো কোন ক্ষেত্রে হার মানেনি, আশা হারায়নি টারজান। কিন্তু জীবনে আজ প্রথম যেন হতাশার বেদনা অনুভব করল সে।
টারজান যখন তার শিবিরে ফিরে গেল সবার সঙ্গে তখন সন্ধ্যার অন্ধকার ঘন হয়ে আসছে।
হঠাৎ অন্ধকার বনভূমির মধ্যে একটা চিতাবাঘের ডাক শুনতে পেল ওরা। সে ডাক শুনে টারজানও জন্তুদের মত অদ্ভুতভাবে চীৎকার করে উঠল। কিছুক্ষণের মধ্যেই শীতা এসে হাজীর হলো টারজনের সামনে। টারজান তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।
হঠাৎ সমুদ্রের উপকূলভাগের কাছাকাছি একটা আলো দেখতে পেয়ে বলল, দেখ দেখ, আলো। নিশ্চয় ও আলোটা কাউরি জাহাজের। জাহাজটা এখন দাঁড়িয়ে আছে শান্ত হয়ে। একটা নৌকা যোগাড় করো কোনরকমে। আমরা ও জাহাজে হানা দিয়ে জাহাজটা দখল করে নেব।
গান্ট বলল, কিন্তু ওদের সকলের হাতেই আগ্নেয়াস্ত্র আছে। কিন্তু আমরা মাত্র পাঁচজন।
টারজান তার চিঅবাঘটার দিকে তাকিয়ে বলল, আমার এই শীতা কুড়িটা সশস্ত্র লোকের সমান। এরপর যারা আসবে তারা সব একশোজন লোকের কাজ করবে।
এই বলে টারজান দাঁড়িয়ে মুখ তুলে বাঁদর-গোরিলাদের মত একটা জোর আওয়াজ করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আকুতের সঙ্গে ভয়ঙ্কর একদল বাঁদর-গোরিলা সেখানে এসে গেল। গান্ট তাদের ভয়ে। কাঁপতে লাগল।
একটু খুঁজতেই বেলাভূমির উপর কিছু দূর সরে যাওয়া নৌকা দুটা পেয়ে গেল তারা। আকুৎ ও তার। দলের সবাই আর শীতা নৌকাতে গিয়ে উঠল। এছাড়া ছিল গান্ট, টারজান, মুগাম্বি, সানিভাল আর জোনস। সমুদ্রের শান্ত জলের উপর দিয়ে কাউরি জাহাজের আলোটা লক্ষ্য করে তীর বেগে ছুটে যেতে লাগল নৌকা দুটো।
টারজান যা ভেবেছিল ঠিক তাই। কাউরি জাহাজটাই তখন দাঁড়িয়ে ছিল। ডেকের উপর একটা নাবিক ঝিমোচ্ছিল।
জাহাজের নিচের তলায় একটা কেবিনে তখন স্নাইদার জেনকে বশীভূত করার চেষ্টা করছিল। যে ঘরে জেনকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল সেই ঘরের একটা টেবিলের ড্রয়ারে একটা রিভলবার পেয়ে গিয়েছিল জেন। স্নাইদারের হাতে তখন কোন অস্ত্র না থাকায় স্নাইদারকে গুলি করার ভয় দেখিয়ে বেকায়দায় ফেলেছিল জেন।
এমন সময় ডেকের উপর থেকে একটা গোলমালের আওয়াজ আসতেই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে জেন আর সঙ্গে সঙ্গে রিভলবারটা কেড়ে নেয় স্নাইদার।
ডেকের উপর যে লোকটা পাহারা দিচ্ছিল সে ঝিমোতে ঝিমোতে একটা অচেনা লোককে জাহাজের মই বেয়ে উঠতে দেখে চীৎকার করে ওঠে এবং সঙ্গে সঙ্গে একটা গুলি করে তার রিভলবার থেকে। শব্দ। শুনেই চমকে ওঠে জেন।
কিন্তু প্রহরীর গুলিটা কারো গায়ে লাগেনি বলে সে ভয়ে চীৎকার করে জাহাজের লোকজনদের ডাকতে থাকে। কিন্তু তার আগেই টারজান আর তার জন্তু-জানোয়ারগুলো ডেকের উপর উঠে ঘুরে। বেড়াতে থাকে ভয়ঙ্করভাবে।
কাউরি জাহাজের সশস্ত্র নাবিকরা জন্তু-জানোয়ারগুলোকে দেখে ভয়ে বিহ্বল হয়ে পড়ে। তারা। কম্পিত হাতে গুলি ছুঁড়লেও সে গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পড়ে স্বাভাবিকভাবে। আকুতের বাদর-গোরিলাগুলো। তাদের দু-এক জনের গলা টিপে ধরতেই তারা ভয়ে পালিয়ে সামনের ঘরটাতে গিয়ে আশ্রয় নিল।
কাইশাং ছুটে পালাচ্ছিল। কিন্তু শীতা একটা নাবিককে শেষ করার পর কাইশংকে ধরল। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেহের সব মাংস খেয়ে ফেলল সে।
এদিকে স্নাইদার যখন নিচের তলায় কেবিনটার মধ্যে জেনের অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে জেনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার রিভলবারটা কেড়ে নিতে যাচ্ছিল ঠিক সইে সময় দরজা ঠেলে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল টারজান। আদিবাসী মেয়েটি তখন ভয়ে নতজানু হয়ে জেনের কাছে বসেছিল।
কিছু না বলে পিছন থেকে স্নাইদারের গলাটা টিপে ধরল টারজান। স্নাইদার মুখ তুলে টারজানকে দেখেই ভয়ে স্তম্ভিত হয়ে পড়ল। টারজান এত জোরে গলাটা তার টিপে ধরেছিল যে কোন কথা বলার সুযোগ পেল না সে। তার জিভটা বেরিয়ে আসতে লাগল। মুখটা নীল হয়ে গেল।
স্নাইদারের নিষ্প্রাণ দেহটাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে জেন আর আদিবাসী মেয়েটিকে নিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে এল টারজান। এসে দেখল সব লড়াই শেষ। মাত্র চারজন ছাড়া শত্রুদের সবাই খতম হয়েছে। তারা হলো স্মিথ, মাওরি আর তাদের দলের দু’জন নিগ্রো নাবিক।
টারজান তাদের বলল, হয় জাহাজে নাবিকের কাজ করো, না হয় মৃত্যুবরণ করো।
তারা সবাই নাবিকের কাজ করতে লাগল।
টারজনের নির্দেশমত জাহাজটাকে আবার জঙ্গল-দ্বীপের উপকূলে একবার আনা হলো। ঐ উপকূলে জন্তুগুলোকে ছেড়ে দেয়া হলো। তারা আবার জঙ্গলে চলে গেল। এবার জাহাজ চলল লন্ডনের পথে।
তিনদিন পর শোরওয়াটার নামে একটা ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজের সংস্পর্শে এল কাউরি। সেই জাহাজের বেতারের মাধ্যমে লর্ড গ্রেস্টোক তার লন্ডনের বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করল। জানল, তার ছেলেকে রোকোফ নিয়ে আসতে পারেনি। মোটা টাকার লোভে ছেলেটাকে রোকোফের হাতে তুলে না দিয়ে পলভিচ অন্য একজনের কাছে রাখে ছেলেটাকে। ঠিক করে মোটা টাকার ঘুষ নিয়ে ছেলেটাকে ফিরিয়ে দেবে। তাই সে জ্যাকের পরিবর্তে একই রকমের অন্য একটি ছেলেকে জাহাজে নিয়ে গিয়ে তুলে দেয় রোকোফের হাতে। আফ্রিকার কোন এক আদিবাসীদের গায়ে জেনের কোলে মারা যায় সেই ছেলেটি।
টারজান আর জেন বাড়ি গিয়ে দেখল বুড়ি নিগ্রো নার্স এসমারাল্ডাই জ্যাককে মানুষ করছে পরম যত্নের সঙ্গে।
টারজনের সঙ্গে ছিল তার বিশ্বস্ত সহচর মুগাম্বি আর সেই আদিবাসী তরুণীটি যাকে একদিন একটা নৌকার পাটাতনে শুয়ে থাকতে দেখে। মেয়েটি পরিষ্কার বলে দেয় সে আর বাড়ি ফিরে যাবে না। সে টারজনের বাড়িতেই থেকে যাবে।
টারজনের এখন একমাত্র জীবিত শত্রু পলভিচ যে এখন আফ্রিকার জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে।