টান

টান 

ছত্রিশ বছর পর দেশে ফিরলাম। এত বছরে দেশের প্রায় সব আত্মীয়তার সুতোগুলো একে একে ছিঁড়ে গেছে। অনেকেই ছিল। মামাবাড়ি, পিসিরা, নিজের খুড়তুতো, মামাতো পিস্তুতো মাসতুতো ভাই বোনের দল… ছিল কেন বলছি, এখনও নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু আমিই নেই ওদের কোথাও। আজ আমাকে ওরা আর চিনতে পারবে কিনা তাই সন্দেহ। এতে ওদের কোনও দোষ নেই। ইংল্যান্ডে সেট্ল করার পর থেকে তো আমিই আর কোনও সম্পর্ক রাখিনি কারোর সঙ্গে। তখন বয়স কম। মাত্র চব্বিশ বছর বয়সেই বহুজাতিক সংস্থার মোটা মাইনের চাকরি নিয়ে চলে গিয়েছিলাম। তখন মনে হত, স্বর্গে বসে আছি। দেশের খবর নেওয়ার কোনও প্রয়োজন বোধ করিনি। মনে মনে স্থির করেই নিয়েছিলাম বাকি জীবনটা ইংল্যান্ডেই কাটাব। কাজেই বাবা, মা মারা যাওয়ার পর থেকে নিজের হাতে এক এক করে সম্পর্কের সুতোগুলো কেটেছি আমি। তারপর অন্তত পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর হয়ে গেল কেউ আমার খোঁজ করেনি, আমিও না। কখনও মনে হয়নি দেশে ফিরতে হবে। কিন্তু হল। কিছুদিন থেকেই মনটা কেমন উলটো গাইতে শুরু করল। বিদেশের যান্ত্রিক জীবনযাত্রায় হাঁপিয়ে উঠছিলাম। দেশের সহজ সরল সম্পর্ক, মেঠো পথঘাট আমায় ডাকছিল। কাজেই একরকম স্থির করে ফেললাম স্বেচ্ছাবসর নিয়ে ফিরব দেশে। তা সিদ্ধান্ত নিয়ে তাকে কাজে পরিণত করে সবকিছু গুটিয়ে দেশে ফিরব ফিরব করেই কেটে গেল আরও কয়েক বছর। আসলে শিকড় বসে গেলে তাকে উপড়ানো খুব সহজ নয়। এইজন্যেই হয়তো পরিণত গাছকে ঠাঁইনাড়া করা যায় না। চারাগাছকে যায়। 

তা চলে তো এলাম। কিন্তু আজ দেশের মাটিতে পা দিয়ে কেমন কনফিউজড হয়ে গেলাম। কী করব এখানে! সম্পর্কগুলোকে নতুন করে বাঁধা যাবে কি আর? চেষ্টা করে দেখতেই হবে। বুকের ভিতরে যে টান অনুভব করছি তা আমাকে তিষ্ঠোতে দিচ্ছে না। সে টান কীসের তা আমাকে জানতেই হবে। আর তার জন্য আগেই যাব আমার শরীকী বাড়িতে। উত্তর চব্বিশ পরগনার এক প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলে আমি। কালীনগর। সেখানে ছিল আমাদের বিশাল শরীকী বাড়ি। আমার দাদুরা ছিলেন তিন ভাই। তাঁদের সন্তান-সন্ততি নিয়ে থাকতেন ওই বাড়িতে। আমার জন্ম ওখানেই। কিন্তু বছর বারো বয়স থেকেই আমি কলকাতায় হোস্টেলে। তাই ভাইবোনদের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ কখনোই ছিলাম না। 

দেশে এসেই কানে এল বাজি ফাটানোর শব্দ। আরে কাল তো কালিপুজো। বিদেশে দুর্গাপুজোর রেশ পাওয়া গেলেও কালিপুজো, ভাইফোঁটা ইত্যাদির খবর আর রাখা হত না। ঠিক করলাম সোজা যাব কালীনগর। ধর্মতলা গিয়ে বাসে চেপে বসলাম। চাইলে গাড়ি ভাড়া করতে পারতাম। কিন্তু মনটা কেন যেন এতদিন পর দেশের মানুষের সান্নিধ্য চাইছিল। বাসে উঠে বসলাম জানলার ধারের সিটে। আমাকে বোধহয় একটু বেমানান লাগছিল। কিন্তু আমার খুব ভালো লাগছিল। 

কালীনগর পৌঁছলাম যখন, তখন সন্ধে ছ’টা। বাসটা আমাকে নামিয়ে দিয়ে ধুলো উড়িয়ে মোড়ের মাথায় মিলিয়ে যাওয়ার পর একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে নিজের পরবর্তী পদক্ষেপ ভেবে নিলাম। এত বছর পর রাস্তা চিনতে পারবো তো? হাঁটতে শুরু করার পর দেখলাম কিছুই ভুলিনি। মানুষের স্মৃতিশক্তি এক আশ্চর্য হেঁয়ালি। 

বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে একটা মিশ্র অনুভূতি হতে লাগল। একসময়ে জমজমাট আলোকোজ্জ্বল বাড়িটা আজ প্রায় ভূতের বাড়ির মতোই নিস্তব্ধ আর অন্ধকার। ভিতরে ঢোকার সাহসই হত না, যদি না কয়েকটা টিমটিমে প্রদীপের আলো আমাকে আশ্বাস দিত যে ভিতরে মানুষ আছে। বাড়িটার আনাচে-কানাচে জ্বলে উঠছে আরও কিছু প্রদীপ। একে একে চোদ্দটি। ওহ আজ তো ভূত চতুর্দশী। মৃত আত্মার ঘরে ফেরার দিন। বুকটা টনটন করে উঠল। কত বছর, কত বছর এইসব ঐতিহ্য ভুলে ছিলাম। বাড়ির সিং দরজার দু’পাশের সিংহের মূর্তিগুলো ভেঙে প্ৰায় লুপ্ত হয়ে গেছে। 

লোহার গেট একদিকে ভেঙে ঝুলছে। নিশি ডাকা মানুষের মতো এগিয়ে চললাম। অন্ধকার সিঁড়ির ধারে প্রদীপের টিমটিমে আলো আমাকে পথ দেখাচ্ছে। আমি আসছি ছোটবেলা, আমি আসছি আমার ফেলে যাওয়া মানুষজন, আসছি তোমাদের ভুলে-যাওয়া ইতিহাসের অংশ হয়ে পুরোনো স্মৃতির গন্ধ গায়ে মেখে নিতে। আর কখনো যাব না তোমাদের ছেড়ে। আজ থেকে এটাই আমার আশ্রয়। তোমরা আমাকে ঠাঁই দেবে তো? 

দোতলায় উঠে ঘরে উঁকি দিলাম। বেশিরভাগ ঘরেই এখন তালাবন্ধ। কোণের দিকে একটা ঘরের চৌকাঠের সামনে দু’দিকে দুটো প্রদীপ জ্বলছে। ঘরের ভিতর একটা কালি-পড়া লন্ঠন। বিছানায় শুয়ে আছেন সাদা শনের নুড়ির মতো চুলের একজন বৃদ্ধা। ঘুমন্ত। ভালো করে দেখে বোঝার চেষ্টা করলাম কে উনি। আরে, ছোটো কাকি না? হিসেব করে বুঝলাম ওঁর বয়স এখন প্রায় আশির কোঠায়। একসময়ে নিঃসন্তান ছোটো কাকির কোলেপিঠেই বড়ো হয়েছে এ বাড়ির ছেলেপিলের দল। সবচেয়ে ছোটো বউ বলে ঠাকুমার নির্দেশে এটাই ছিল ছোটো কাকির কাজ। ঠাকুমার স্নেহের পাত্রী হওয়ায় কখনো রান্নাঘরে ঢুকতে হয়নি ছোটো কাকিকে। এ নিয়ে মা জেঠিমাদের কত আক্ষেপের কথা শুনেছি। কিন্তু ঠাকুমার ওপরে কথা বলার সাহস ছিল না কারো। 

উত্তরের খোলা ব্যালকনি দিয়ে হু হু করে উত্তুরে হাওয়া বইছে। বাগানের নারকেল গাছগুলোর পাতায় সরসর করে শব্দ। আমি কাকির ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিলাম। প্রদীপগুলো হাওয়ায় নিভে না যায়। এগুলো যেন এক একটা ভুলে-যাওয়া ইতিহাস। এগুলোই তো আমাকে এতটা টেনে এনেছে। কিন্তু বাড়ির অন্যরা কোথায়? হঠাৎ চোখ পড়ল ছাদের সিঁড়ির দিকে। একটা মেয়ে। বছর তেরো বয়স হবে। ফুটফুটে চেহারা। লাল রঙের একটা ফ্রক পরনে। খুব চেনা চেনা যেন। কিছুতেই মনে করতে পারছি না কোথায় দেখেছি ওকে। হাতে একটা জ্বলন্ত প্রদীপ নিয়ে অন্য হাতে তার শিখাটা হাওয়া থেকে আড়াল করতে করতে নেমে আসছে। অন্ধকারে আমাকে দেখতে পায়নি। 

আমি চুপিচুপি ওর পিছু নিলাম। সিঁড়ির পাশের ঘরের দরজা খুলে ঢুকল। ওটা একসময়ে আমাদের ঘর ছিল। আমার, ভাইয়ের আর আমার বাবা মায়ের। আমিও সাবধানে ঢুকলাম ওর পিছু পিছু। মেয়েটি ঘরের ভিতরে রাখা একটা টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখল প্রদীপটা। টেবিলের ওপর দুটো ছবি ফ্রেমে বাঁধানো। একটাতে আমার বাবা-মা, আর একটাতে… আরে এ ছবিটা ওরা এখনও রেখে দিয়েছে? এ তো কলেজে পড়ার সময়ে ভাইকে প্রথম বার কলকাতা বেড়াতে নিয়ে গিয়ে চিড়িয়াখানার সামনে তোলা ছবি। এটা ভাই তুলে দিয়েছিল। আমি তুলেছিলাম ওর ছবি, আর ও আমার। আমার এই ছবিটার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। ছবিটার বেশ কিছুটা অংশ ঢাকা পড়ে গেছে রজনীগন্ধার মালায়। ওহ এরা তাহলে খবর পেয়েছে! 

একটা খনখনে গলার ডাকে চটকা ভাঙল আমার। 

“ও মিলি, হলো তোর চোদ্দ প্রদীপ দেওয়া? আয় মা, নে এবার পড়তে বস। এখুনি তোর বাবা মা এসে পড়বে।” 

“এই যে ছোটো ঠামি যাই। দাদু, ঠামি আর জ্যেঠুনের ছবিতে প্রদীপ দিয়ে আসি। ওরা যে নইলে পৃথিবীর পথ খুঁজে পাবে না।” বলতে বলতে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় মেয়েটি। “তুমিই তো বলো ছোটো ঠামি, আজ পূর্বপুরুষদের আলো দেখাতে হয়। ওঁরা যে সারাবছর অপেক্ষায় থাকেন আজকের দিনটার জন্যই।” 

.

ততক্ষণে আমার মনে পড়ে গেছে কোথায় দেখেছি মেয়েটিকে। আয়নায়। আমার মুখের সঙ্গে বড্ড মিল ওর। আমার ছোটো ভাইয়ের সন্তান ও। ভূত চতুর্দশীর রাতে চোদ্দ প্রদীপের আলো দিয়ে যে মায়ার টান পাঠিয়েছিস, তাকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা নেই আমার। তাই প্রতি বছর ফিরে ফিরে আসবো তোর কাছে মা। তুই শুধু চিরদিন চোদ্দ প্রদীপে উদ্ভাসিত করে রাখিস তোর স্মৃতির অলিগলি। সেখানে যে আমরা, তোর পূর্বপুরুষেরা প্রতীক্ষায় থাকি বছর ভর। এ টান কখনো ভুলে যাস না। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *