টাটকা বরফের মাছ – সমরেশ মজুমদার
ঠিক তিনদিনে মুকুন্দর গায়ের চামড়া মোটা হয়ে গেল। এত মোটা যে হাঁটু গেড়ে বসতে কষ্ট হয়, কনুই ভাঁজ করা মুশকিল। সারাক্ষণ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করে, চেয়ারে বসতেও কেমন অস্বস্তি হয়, টান ধরে। এছাড়া আর কোনও অসুবিধে নেই, জ্বরজারি, যন্ত্রণা অথবা কোনও রকম শারীরিক কষ্ট হচ্ছে না।
তিনদিন আগে ঘুম থেকে ওঠার পর মনে হয়েছিল সমস্ত শরীর শিরশির করছে। চামড়ার তলায় যেন কিছু ঘুরে বেড়াচ্ছে। শহরে দু’জন বিখ্যাত ডাক্তার আছেন। গত তিনদিনে তাঁদের ওষুধ কোনও কাজ দেয়নি। চামড়া যে মোটা হয়েছে তা চট করে ধরা যায় না। হাত দিলে বোঝা যায় বেশ খসখসে, লোমগুলো ঝরে গেল দ্বিতীয় সকালে। আজ ব্লেড বসাতে গিয়ে হেরে গেল মুকুন্দ। ব্লেড বেঁকে গেল কিন্তু চামড়ায় আঁচড় পর্যন্ত পড়ল না। মুকুন্দর মাথায় এমনিতেই চুল কম ছিল, বংশের ধারা, সেগুলোও ঝরে গেল এর মধ্যে, দাড়ি কামাবার ঝামেলা আর নেই। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে খুঁটিয়ে নিজেকে লক্ষ করেছে, মোটা চামড়ার জন্যে তার শরীরের কোনও পরিবর্তন হয়নি, ফোলেনি। ডাক্তার দু’জন এমন হতভম্ব হয়ে পড়েছিলেন যে তাঁরা সরাসরি দেশের সব বড় ডাক্তারদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। মুকুন্দ তাঁদের কাছে জেনেছে এদেশে কেউ এরকম পরিবর্তনের কথা শোনেনি। প্রতিকারের জন্যে একমাত্র বিদেশ যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। মুকুন্দর সেই টাকা নেই, তা ছাড়া চতুর্থ দিন সকালে সে আবিষ্কার করল তার তিন চারটে ছাড়া অন্য কোনও অসুবিধে হচ্ছে না।
কিন্তু একটি ব্যাপারে ওর মন খুব খারাপ হয়ে গেল। খালি গা হলেই ওর একটা অভ্যেস হল দু’হাতে নিজেকে একটু আদর করা। বগলের নীচে অথবা পেটে হাত বোলালে বেশ শিহরণ জাগত। তিনদিনে সেই অনুভূতিটা হারিয়ে গেল। এখন হাত বোলালে কোনও প্রতিক্রিয়া হয় না।
এবার মুকুন্দর পরিচয়টুকু সেরে নেওয়া যাক। পঞ্চাশ বছর বয়স, সাধারণ স্বাস্থ্য এবং নির্বাচনে ভোট দেয়। বন্ধু-বান্ধব নেই, পিতামাতাও পরলোকে এবং একটি সুন্দরী স্ত্রী বর্তমান। স্ত্রী তাকে তিনটি সন্তান দিয়েছেন। এর মধ্যেই বোঝা গেছে তার আগামী কালে প্রধানমন্ত্রী হওয়া দূরে থাক ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার কিংবা ব্যারিস্টার হবার যোগ্যতাও নেই। মুকুন্দ কোথায় পড়েছিল একমাত্র দুষ্ট চরিত্রের মহিলারাই প্রৌঢ়া বয়সে যুবতী থাকেন। তাই সে নিয়ত স্ত্রীর দিকে সন্দেহের চোখে তাকায়। কিন্তু তাকানো আর সেটা প্রকাশ করা ভিন্ন কথা। সুন্দরী স্ত্রীদের আধিপত্য চিরকালই সংসারে স্বীকৃত এবং মুকুন্দ তাই এই সংসারে খুব নিরীহভাবে বাস করেন। ছেলেমেয়েরা বড় হবার পর তাদের শোয়ার জায়গা আলাদা হয়েছিল। মুকুন্দ বুঝতে পারছিল যৌবন যাওয়ার সময় বড্ড কাঁদিয়ে যায়। মুকন্দ যে চাকরি করে তাতে খাওয়াপরার তেমন অসুবিধে হয় না। সেই সুবাদে তার একটি রিভলভার আছে। সপ্তাহে দুটি দিন সে সেটা পকেটে রাখতে পারে। অবশ্য আজ অবধি কখনও ট্রিগারে হাত দিতে হয়নি।
তিনদিন বাদে যখন মুকুন্দর স্ত্রী বুঝেছিল এটা শুধু চামড়ার পরিবর্তন, তখন তার কান্না থেমেছিল। এই তিনদিন সে মাঝে মাঝেই ককিয়ে কেঁদেছে। এমন উদ্ভট রোগেও মানুষটা যে মরে যাচ্ছে না তাতে নিশ্চিন্ত হয়ে বলেছিল, “তা বাবা, তোমার গায়ের চামড়া চিরকালই মোটা—!”
মুকুন্দ এইরকম সংলাপে আশ্বস্ত হল। গত তিনদিনে স্ত্রীর বিলাপে সে মনমরা হয়েছিল। খুব আদরের কেউ বিলাপ করছে অথচ তাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেওয়া যাবে না এটা ভাবা যায় না। প্রথম দিনে পিঠে শুধু হাত রেখেছিল। তার নিজের কোনও অনুভব হয়নি কিন্তু স্ত্রী শিউরে উঠেছিল। কান্না কান্না গলায় আঁতকে বলেছিল, ‘ওমা, কী ভারী হাত! সরাও সরাও।’ শেষের শব্দ দুটোতে ধমকের সুর স্পষ্ট।
তৃতীয় রাত্রে শুতে গিয়ে মুকুন্দ আবিষ্কার করল তার খাটে মশারি টাঙানো নেই। এখানে চড়ুই পাখির সাইজে মশা ঘুরে বেড়ায়। বিরক্ত হয়ে সে বড় ছেলেকে ডাকল। আঠারো বছরের ছেলে দাঁত বের করল, ‘মা তোমার চামড়ার এক্সপেরিমেন্ট করবে বলছে। মশা কামড়ালে চেঁচিয়ে ডেক।’
‘তোর মা কোথায়?’
‘ঘুমিয়ে পড়েছে। সারাদিন অনেক কেঁদেছে তো!’
মুকুন্দ দাঁতে দাঁত চেপে শুয়ে রইল। কানের কাছে ভনভন শব্দ হচ্ছে। ইচ্ছে করে বেড সুইচ নেভাল না সে। বিশাল চেহারার একটা মশা এসে তার ডান হাতে বসল। বাঁ হাতটা নিঃশব্দে তুললেই ব্যাটাকে খুন করা যায়। কিন্তু মশাটা হুল ফোটাতে চাইছে অথচ তার একটুও লাগছে না। মুকুন্দ পিটপিটিয়ে দেখল মশাটা বেশ হতভম্ব হয়ে পড়েছে। তারপর ভোঁ করে উড়ে গেল। এই পুরু চামড়া ভেদ করতে গিয়ে বেচারার হুলটাই ভেঙে গিয়েছে। তারপর আরও তিনটে এল। খা তোরা, কত রক্ত খাবি খা। মাথা খোঁড়াখুঁড়ি করে তিনটেই উড়ে গেল। মুকুন্দ চোখ বন্ধ করল। অথচ ঘুম আসছে না। কানের কাছে শব্দ হলেই ভয় লাগছে। সে শেষ পর্যন্ত দুটো কাপড়ের টুকরো কানের ফুটোয় গুঁজে দিল।
পরদিন সকালেই বড় ছেলে চেঁচাল, ‘মা দ্যাখো, বাবাকে একটাও মশা কামড়ায়নি।’ স্ত্রী ছুটে এলেন। খানিকটা দূর থেকে খুঁটিয়ে দেখে বললেন, ‘তাই তো। তুমি আর মানুষ নেই গো। তোমাকে খোঁচালেও রক্ত পড়বে না।’
মেজ ছেলে বলল, ‘খুঁচিয়ে দেখব বাবা।’ মুকুন্দ চমকে উঠল, ‘খোঁচাবি কি? আমি তোর বাবা না?’
স্ত্রী বললেন, ‘আহা, ছেলেটার সাধ হয়েছে, তোমার সব তাতে না।’
মেজ ছেলে একটা শিক নিয়ে এসে মুকুন্দর পিঠে ঠেকাল। স্ত্রী বললেন, ‘আস্তে চাপ দিস।’ শেষ পর্যন্ত সরু শিকটা বেঁকে গেল কিন্তু মুকুন্দর চামড়ায় সামান্য আঁচড় পড়ল না। একটুও কষ্ট হল না মুকুন্দর, শুধু চাপ বোধ করেছিল। ছেলেরা হাঁ হয়ে গেল। স্ত্রী আবার ডুকরে উঠলেন, ‘তুমি, তুমি আর মানুষ নেই!’
শোক পুরনো হয়ে গেলে তার ওজন কমে যায়। চারদিনের দিন মুকুন্দকে বাজারে যেতে হল। আর যখন কিছুই করার নেই তখন সংসারের দিকে নজর দেওয়া দরকার। তিন দিনে দুই ছেলে বাজার থেকে বেশ মেরেছে। বাজারে গিয়ে সে হোঁচট খেল। একটাও মানুষ নেই সেখানে। শোনা গেল সরকারি অফিসে শহরের লোক লাইন দিয়েছে আলু পেঁয়াজের জন্যে। এখন আর বাজারের জায়গায় বাজার বসছে না। প্রায় শূন্য হাতে ফিরে আসতেই ছেলে দুটো ফিক করে হাসল। স্ত্রী বললেন, ‘তুমি লাইন দিতে পারলে না? ওদের দিলেই তো টাকা মারবে। আমার হয়েছে জ্বালা।’
‘টাকা মারবে আর তুমি কিছু বলবে না?’
‘কী করে বলব? এটা নাকি কেন্দ্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।’
মুকুন্দ থতমত হয়ে গেল। কিন্তু সে আবিষ্কার করল তার তেমন রাগ হচ্ছে না। এমনিতেই ক্ষুধাতৃষ্ণা তার কমে এসেছে। ব্যাপারটা সে ইচ্ছে করেই কাউকে বলছে না। সারাদিন না খেলেও তেমন খিদে পাচ্ছে না। বাজার থেকে মারুক আর যা-ই করুক তাতে তার কী এসে যায়! আবিষ্কার আর প্রতিবাদ যাদের ব্যাপার তারাই করুক। সে শুধু মাইনে এনে দিয়ে খালাস।
চতুর্থ দিনে দুটো ঘটনা একসঙ্গে ঘটল। বিকেলবেলায় প্রণব এল খবর নিতে। মুকুন্দর সঙ্গে কাজ করে। মুকুন্দ তিনদিন অফিসে যায়নি কেন সে তা জেনে গেছে। প্রত্যেক শুক্রবার অফিস থেকে যে কাজটা করতে মুকুন্দকে ষাট কিলোমিটার যেতে হয়। প্রণব তার সঙ্গী। মদ, জুয়ো ইত্যাদিতে প্রচণ্ড আসক্ত কিন্তু ব্যবহারে কোনও খুঁত নেই। প্রণব জানতে এসেছিল সে কতদিন ছুটিতে থাকবে। প্রণবকে মোটেই পছন্দ করে না মুকুন্দ। কথা বলতে বলতে প্রণবের চোখ শুধু স্ত্রীর ওপর আটকে যায়। আর বয়স্কা সুন্দরী মহিলা হলে যা হয়, প্রণব এলে যেন হেসে গলে পড়ে। এই নিয়ে বলতে গিয়ে মুখ ঝামটা খেয়েছে মুকুন্দ আগে।
তা আজ প্রণব এসে যখন ঘরে ঢুকল তখন সে খাটে শুয়ে। প্রণবের পেছনে এলেন স্ত্রী, ‘দেখুন না, বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই কিন্তু ভেতরে ভেতরে চামড়া এত মোটা হয়েছে যে মশাও কামড়ায় না।’
মুকুন্দর হাতে হাত রেখে প্রণব জিজ্ঞাসা করল, ‘কদ্দিন থেকে মোটা হচ্ছিল?’
‘তিন দিন।’
‘তাই ইদানীং বস্ তোমাকে ঠুকলে তোমার গায়েই লাগত না। হাঁটাচলা করতে অসুবিধে হচ্ছে?’ প্রণব প্রশ্নটা স্ত্রীকে করল।
‘মোটেই না। দিব্যি আছে।’ স্ত্রী জবাব দিলেন।
‘তাহলে কাল অফিসে আসছ?’
‘দেখি।’
তবে তোমার শরীর বেশ শক্ত হয়ে গেছে। কেউ মারলেও লাগবে না।’
প্রণব দাঁত বের করে হাসতেই মুকুন্দ উঠে দাঁড়াল। তারপর কথাটার জবাব না দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। তার জলবিয়োগ করার দরকার ছিল। কিন্তু বাথরুমের দিকে তাকাতেই দেখল দরজাটা বন্ধ। সে বাগানে নেমে এল। নামেই বাগান, আগাছার ভিড়ে চারধার ঢাকা। হঠাৎ তার মনে হল ওই ঘরে প্রণব আর স্ত্রীকে সে একলা রেখে এল, ছেলেরাও ধারে কাছে নেই অথচ তার তেমন কোনও প্রতিক্রিয়া হচ্ছে না। আগে হলে সে প্রাণ থাকতেও এটা পারত না, এখন ওই মনে হওয়া ছাড়া কোনও অনুভব নেই। প্রণবকে সন্দেহ করে বুক জ্বলে যাচ্ছে না বরং বেশ আরাম লাগছে।
জলবিয়োগ করা হয়ে গেলে দ্বিতীয় ঘটনাটা ঘটল। বড় বড় ঘাসের গায়ে ব্যাটা আটকে ছিল। হঠাৎ লাফিয়ে উঠে বসল মুকুন্দর পায়ে। আঁতকে উঠতে গিয়ে শব্দটা গিলে ফেলল সে। জোঁকটা যেন ছটফট করছে। কয়েকবার পায়ের বিভিন্ন জায়গায় চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত পা থেকে ঘাসে পালিয়ে গিয়ে যেন বেঁচে গেল। দৃশ্যটাকে চোখের ওপর ঘটতে দেখল মুকুন্দ।
বাগানে ঘোরাফেরা করতে করতেই স্ত্রীর ডাক শুনতে পেল, ‘কী হল, শুনছ? আমি প্রণব ঠাকুরপোর সঙ্গে একটু বের হচ্ছি, ডাক্তারের কাছে যাব।’
মুকুন্দ ঘাড় নাড়ল, যাবে যাও। আর তখনই সে ছোট মেয়েকে আসতে দেখল। এটি সবার শেষে, বড্ড মায়াময় চোখ দুটো, একটু বেশি বয়সে হওয়ায় এখনও বয়স সাতে পড়েনি। মুকুন্দকে দেখে সে যেন ভয়ে ভয়ে তাকাল। তারপর কাঁপা গলায় বলল, ‘তুমি কেমন আছ, বাবা?’
‘ভাল মা। খুব ভাল।’
‘তোমার গায়ের চামড়া খুব মোটা হয়ে গিয়েছে?’
‘হ্যাঁ মা, জোঁকটাও পালাল।’
‘সাপ কামড়াতে পারবে না?’
‘বোধহয় না।’
‘তোমার ব্যথা লাগবে না? কী মজা তাই না! তাহলে মা বলল কেন তোমার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকতে!’
আগে হলে মুকুন্দ এই নিয়ে কুরুক্ষেত্র করত। আজ হাসল। মেয়ে আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা বাবা, তোমার যখন ব্যথা করে না তখন তুমি খুব বীর, না?’
মুকুন্দ মাথা নাড়ল। সেটা কী অর্থে সে নিজেই জানে না। তারপর বেরিয়ে এল রাস্তায়।
অনেকেই তার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে। মুকুন্দ দেখল একটা মিছিল চাই চাই দাবিতে চলে গেল। এবং তাদের পেছন পেছন প্রণব আর স্ত্রী।
পরদিন স্নান খাওয়া সেরে মুকুল বের হল। আজ রাত্রে সে ফিরবে না, এটা চাকরির অঙ্গ। বাসস্ট্যাণ্ডে এসে দেখল বেজায় ভিড়। অনেকক্ষণ গাড়ি আসছে না, সবাই সরকারি ব্যবস্থার সমালোচনায় সোচ্চার। মুকুন্দ একমুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে হাঁটা শুরু করল। মাইল খানেক, আগে খেয়েদেয়ে রোদ মাথায় নিয়ে হাঁটার কথা ভাবতে পারত না, এখন সেসব খেয়ালেই এল না। মাঝপথে বাদুড়ঝোলা বাসটাকে বেরিয়ে যেতে দেখল। একটা লোক বলল, ‘এ শালার দেশে বাস করা যায় না।’
মুকুন্দ মাথা নাড়ল। সেটা কী অর্থে তা সে নিজেই জানে না।
অফিসে যাওয়ামাত্র সবাই উৎসুক চোখে মুকুন্দকে দেখতে লাগল। তাদের এই অফিসে মানুষের সংখ্যা কম, কোনও ইউনিয়ন নেই, মালিকই অফিসার। আর তার ম্যানেজার বড়বাবু। মুকুন্দ ঢোকামাত্র বড়বাবু চোখ ছোট করলেন, ‘কি মশাই, আপনি নাকি গণ্ডার হয়ে গেছেন?’
‘গণ্ডার?’ মুকুন্দ মাথা নাড়ল।
‘গায়ের চামড়া মোটা হয়েছে তো অফিস কামাই করেছেন কেন? এ তো আর অসুখ বিসুখ নয় যে বিছানায় শুয়ে থাকতে হচ্ছে। ওয়ার্থলেস।’
মুকুন্দ মাথা নাড়ল তারপর নিজের চেয়ারে গিয়ে বসল। আজ প্রণব আসেনি। একটা নাগাদ মালিক তাকে ডেকে পাঠালেন, ‘শরীর কেমন আছে?’
‘ভাল’।
‘বিনা নোটিশে কামাই আমি পছন্দ করি না। আপনাকে আজ যেতে হবে না। আপনি বরং হাসপাতালে যান।’
‘হাসপাতালে, কেন?’
‘আপনার বাড়িতে একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে।’
মুকুন্দ একটু অবাক হল। তার বাড়িতে অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে অথচ সে জানে না। মালিক আবার বললেন, ‘প্রণববাবুর কাছে খবর এসেছে, তিনি আপনাকে জানাতে বলে বেরিয়ে গেছেন দরকারি কাজে।’
মুকুন্দ মাথা নাড়ল। আজকের রাতটা বাঁচা গেল। পঞ্চাশ হাজার টাকার ব্যাগ কোলে নিয়ে ড্রাইভারের পাশে সজাগ হয়ে বসে থাকতে হয় পুরো জঙ্গুলে পথটা। সঙ্গে প্রণব থাকে বটে তবে সারাটা পথ ও মাল খায়। পথে নানান ধরনের বিপদ, বিশেষ করে হাতি আর ডাকাতের। তাদের সঙ্গে রিভলভার থাকে বটে কিন্তু কোনও দিন বিপদে পড়তে হয়নি। ওই টাকা পৌঁছে দিলে কোম্পানির কারখানায় পেমেন্ট হয়। শুক্রবার রাতের মধ্যে টাকাটা পৌঁছে দেওয়া চাই।
হাসপাতালের গেটেই বড় ছেলের সঙ্গে দেখা হল, ‘তাড়াতাড়ি যাও। বুড়িকে গাড়ি চাপা দিয়েছে।’
মুকুন্দ পা চালাল। বুড়ি তার ছোট মেয়ে। তাকে গাড়ি চাপা দিয়েছে। কী করে দিল কে জানে। নিশ্চয় রাস্তায় অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছিল। বুড়ি মরে গেলে—! সঙ্গে সঙ্গে অনেক মৃত মানুষের মুখ মনে পড়ে গেল। তাদের কথা আজকাল মনেও পড়ে না, কষ্টও হয় না।
পাগলের মতো কান্নাকাটি করছিল স্ত্রী। মেজ ছেলে তাকে ধরে রেখেছে। মুকুন্দকে দেখে ছুটে এলেন স্ত্রী, ‘কী হবে, বুড়ির কী হবে?’
মুকুন্দ নির্লিপ্ত গলায় বলল, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে।’
এই সময় একজন এলেন, ‘ওকে রক্ত দিতে হচ্ছে। মনে হয় বেঁচে যাবে। আপনাদের রক্ত ডোনেট করতে হবে, আসুন।’
স্ত্রী পাগলের মতো এগিয়ে চললেন। মুকুন্দ পেছন পেছন। হঠাৎ স্ত্রী চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘তুমি যাচ্ছ কোথায়?’
‘রক্ত চাইল যে।’
‘আঃ। তোমার গায়ে ওরা ছুঁচ ফোটাতে পারবে? ওই চামড়া ভেদ করতে পারবে? আয় খোকা।’ মেজ ছেলেকে নিয়ে স্ত্রী ভেতরে ঢুকে গেলেন।
মুকুন্দর একটু অস্বস্তি হল। সত্যি তো, তার গায়ে ছুঁচ ঢুকবে কী করে! মেয়েটাকে একবার দেখার চেষ্টা করেও পারল না সে। এখন দেখতে দেবে না। অতএব তার কিছুই করার নেই। নেই যখন তখন খামোখা কামাই করে কী হবে।
মালিক তাকে দেখে চমকে উঠলেন, ‘এ কী, আপনি ফিরে এলেন যে!’
‘কিছু করার নেই স্যার।’
মালিক খুশি হলেন। বোধহয় নিজেই টাকা নিয়ে যাচ্ছিলেন, বেঁচে গেলেন। তার আধঘণ্টা বাদে মুকুন্দ ড্রাইভারের পাশে বসে। কোলের ওপর টাকার ব্যাগ, হাতে রিভলভার। আজ প্রণব আসেনি। তার নাকি শরীর খারাপ। মালিক কিন্তু কিন্তু করেছিলেন কিন্তু মুকুন্দ মাথা নেড়েছিল, সে একাই পারবে। প্রণব তো বসে বসে মাল খায়।
দেরি হয়ে গিয়েছিল আজ। খুনিয়ার মোড়ের কাছেই বিকেল হয়ে গেল। দু’পাশে ঘন জঙ্গলে ঝিঁঝি ডাকছে। ছায়া ঘন হয়ে আসছে। এখন কুড়ি কিলোমিটারের মধ্যে মানুষ নেই, এই সময় গাড়িও যায় না। প্রচণ্ড স্পিডে ছুটছিল গাড়িটা। ড্রাইভার মাঝে মাঝে তার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে। একটা বাঁক ঘুরতেই অনেক দূরে ঠিক রাস্তার ওপরে কিছু নড়তে দেখেই ড্রাইভার গাড়ি থামাল ব্রেক কষে। মুকুন্দ জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হল?’
‘হাতি মালুম হোতা হ্যায়।’
এটা অবশ্য তেমন কিছু নয়, এ রাস্তায় হাতি বের হয় এবং যায়। মিনিট পাঁচেক বসে থাকার পরই রাস্তা পরিষ্কার হল এবং ঝুপ করে অন্ধকার লামল। ড্রাইভার স্টার্ট নিতে গিয়ে আবিষ্কার করল ইঞ্জিনটা শুধু গোঙানি ছাড়া অন্য কাজ করতে চাইছে না। একটা অশ্লীল শব্দ ছুঁড়ে দিয়ে ড্রাইভার নেমে গেল। তারপর মুখ শুকিয়ে এসে বলল, ‘বেল্ট টুট গিয়া সাব।’
অর্থাৎ এখন এক পা যাওয়ার উপায় নেই। মুকুন্দ কাঁধ ঝাকাল। আজ রাত্রে টাকাটা পৌঁছে দেওয়ার কথা, কাল ভোরে পেমেন্ট না হলে কুরুক্ষেত্র হবে। আর এই নির্জন জঙ্গলে এইভাবে বসে থাকা মানে আত্মহত্যা করা। এখন ভরসা যদি কোনও গাড়ি এই পথে যায় তাহলে তার পেছনে জিপটাকে জুড়ে দেওয়া যায়।
জঙ্গলে খুব দ্রুত অন্ধকার নামে। ড্রাইভার লোহার হ্যাণ্ডেলে ন্যাকড়া পেঁচিয়ে পেট্রলে ডুবিয়ে মশাল জ্বালল। গভীর অন্ধকারে ওই আগুন দেখলে জন্তুরা আসবে না। কিন্তু খানিক বাদে ন্যাকড়া ছাই হয়ে গেলে মুকুন্দ দেখল ড্রাইভার একটুও ইতস্তত না করে নিজের গেঞ্জি-শার্ট পেট্রলে ডোবাল। সেটা শেষ হলে মুকুন্দ নিঃশব্দে নিজের গেঞ্জিটা এবং পরে সার্ট দিয়ে দিল। আলোটাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। ন’টা নাগাদ মুকুন্দ প্যান্টে হাত দিল। তলায় আন্ডারওয়ার আছে। আর এই সময় সামনেই বৃংহিত শুনতে পেল। জঙ্গলটা যেন কেঁপে উঠল আচমকা। ড্রাইভার বলল, ‘সাব ভাগিয়ে।’ বলে অন্ধকারে উধাও হয়ে গেল। এখনও হ্যান্ডেলে প্যান্টটা জ্বলছে। মুকুন্দ গাড়ি থেকে আন্ডারওয়ার পরে নেমে বনেটে উঠে বসল। চিৎকার করলে নাকি হাতি কাছে আসে না। সে একা বনেটে উঠে লাফাতে লাগল আর প্রাণপণে চিৎকার শুরু করল। জিপের ওপর লাফানোর শব্দ আর মুকুন্দর চিৎকারে বৃংহিত থেমে গেল কিন্তু মুকুন্দ থামল না। ওর মনে হচ্ছিল এই শব্দ বন্ধ করলেই হাতিরা এগিয়ে আসবে। কিন্তু একসময় গলা ধরে আওয়াজ মিইয়ে গেল কিন্তু শরীরের নাচুনি থামাল না। আর তখন প্যান্টটা সম্পূর্ণ ছাই।
চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। অনেক দূরের গাছের মাথা থেকে চিৎকার ভেসে এল, ‘সাব, পেড়মে উঠ যাইয়ে।’
মুকুন্দ একহাতে রিভলভার অন্য হাতে টাকার ব্যাগটা নিয়ে দাঁড়াতে দেখল তিন দিকে হাতিরা ঘিরে দাঁড়িয়েছে। এখন রিভলভার ছোঁড়ার কোনও মানে হয় না। হাতিদের টাকারও প্রয়োজন নেই। ওগুলোকে জিপের মধ্যে ফেলে দিয়ে সে পেট্রলের টিনটা নিয়ে রাস্তার ওপর উপুড় করে দিল। দিয়ে দেশলাই জ্বালাল। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। হঠাৎ মুকুন্দর কী খেয়াল হল, আগুনে হাত রাখল। একটুও ছ্যাঁকা লাগছে না তার। মুকুন্দ স্বচ্ছন্দে আগুনের মধ্যে চলে আসতেই তার আন্ডারওয়ার জ্বলতে জ্বলতে খসে পড়ল।
এখন সম্পূর্ণ নিরাবরণ মুকুন্দ আগুনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে হঠাৎ বুড়ির কথা মনে করতে পারল। সে জানল না হাতিগুলো এই দৃশ্য দেখে সরে সরে যাচ্ছে। মুকুন্দ ভাবছিল, তার চামড়া মোটা হয়ে গেছে এটা প্রমাণিত কিন্তু শরীরে কি রক্তও নেই? গাড়ির ভেতর একটা ছুরি ছিল। সেটা নিয়ে সে আগুনের মধ্যে আবার ফিরে এল। তারপর পাগলের মতো নিজের শরীরে খোঁচাতে লাগল। ছুরিটা বসছে না, আগুন তাকে পোড়াচ্ছে না, মশা, জোঁক তাকে কামড়ায় না। সেই আদিম জঙ্গলে মুকুন্দ সম্পূর্ণ নিরাপদ। তবু, ছুরিটা বেঁকে গেলেও তার হাত থামছিল না। এক ফোঁটা রক্তের দর্শন চাই।
১২.০২.১৯৮৪
লেখক পরিচিতি
সমরেশ মজুমদার: ১০ মার্চ ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে জলপাইগুড়িতে জন্ম। শৈশব কেটেছে উত্তরবাংলার চা-বাগানে। প্রথম উপন্যাস ‘দৌড়’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে। তারপর ‘এই আমি রেণু’। দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক উপন্যাস ‘উত্তরাধিকার’ প্রসিদ্ধি আনে। ১৯৮২-তে আনন্দ পুরস্কার এবং ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে ‘কালবেলা’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার।