টাকা আর টাকা আর মন
মন! মন আবার কী? টাকা ছাড়া মন কী? টাকা ছাড়া আমাদের মন নাই; টাঁকশালে আমাদের মন ভাঙে—গড়ে। বঙ্কিমচন্দ্রর কমলাকান্তর উক্তি। ধনতান্ত্রিক সভ্যতার শ্রেষ্ঠ দান এই মন যা টাঁকশাল ভাঙে—গড়ে।
টাকা স্বর্গ টাকা ধর্ম টাকাই জপ—তপ—ধ্যান। অটোমোবিল ও স্কাইস্ক্রেপারের যুগে মেট্রোপলিটন মহানগরে আর কোনো টান মানুষকে টানতে পারে না। এককালে মা ছিলেন স্বর্গাদপি গরীয়সী এবং পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম—পিতাই ছিলেন পরম তপস্যার বস্তু। তখন মানুষের টানে মানুষ চলত, গোরুর টানে গাড়ি চলত মাটির পথে। ইট—পাথর—লোহার পথ ছিল না, বাড়িঘর ছিল না, অটোর মতো যন্ত্র মানুষকে প্রচণ্ড বেগে টানত না। মাটির টানে, মানুষের টানে মানুষ চলত। ক্রমে মাটি থেকে দূরে সরে যেতে থাকল মানুষ, মাটি থেকে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকল, কংক্রিটের স্পর্শে মাটির স্পর্শবোধ চলে গেল। গৃহসীমানায় প্রাচীর উঠল, ছোট প্রাচীর, বড় বড় প্রাচীর। বড় বাড়ি ছোট বাড়িকে আড়াল করে দিল। মনের মধ্যেও প্রাচীর উঠল। ইটের উচ্চতার আড়ালে মনও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। তারপর ‘গ্রামের আলো নিবল। শহরে কৃত্রিম আলো জ্বলল—সে আলোয় সূর্য চন্দ্র নক্ষত্রের সংগীত নেই। প্রতি সূর্যোদয়ে যে প্রণতি ছিল, সূর্যাস্তে যে আরতির প্রদীপ জ্বলত, সে আজ লুপ্ত, ম্লান। শুধু—যে জলাশয়ের জল শুকোলো তা নয়, হৃদয় শুকোলো’ (রবীন্দ্রনাথ)। মন হল একমুখী। লোভ ও স্বার্থের সওয়ার হয়ে অর্থের দিকে ধাবিত হল মন কলকাতা শহরে।
লোভের টানে, স্বার্থের টানে, অর্থের টানে গ্রাম থেকে শহরমুখী হল মানুষ ও মানুষের মন। সুতানুটির গঙ্গাতীরে কতকগুলি তাঁবু, কুঁড়েঘর ও নৌকো নিয়ে জোব চার্নক যখন প্রায় বন্য যাযাবরের মতো বাস করছিলেন তখন তাঁর সপ্তদশ শতকী কল্পনার দিগন্তেও কলকাতার বর্তমান মেট্রোপলিটন মূর্তি ভেসে ওঠেনি।* চার্নকের মৃত্যু হল ১৬৯৩ সালের জানুয়ারি মাসে। তার পরবর্তী তিন বছরের মধ্যে সুতানুটি টাউনের দ্রুত সমৃদ্ধি দেখে উল্লসিত হয়ে কোম্পানির ডিরেক্টররা ১৬৯৭ সালে লিখলেন : ‘We are glad to hear your Town of Chuttanutee increases so exceedingly’ এবং তার আরও দু—বছর পরে ১৬৯৯ সালে কলকাতার কর্তারা লিখে জানালেন : ‘Chuttanutee very much increased within these 5 years’। সুতানুটির গঙ্গার ঘাটে পদার্পণ করার পর জোব চার্নক জানান—‘endeavouring to bring the trade down from Hughly to Sootanuttee’ (August 1688) এবং অষ্টাদশ শতকের গোড়াতেই ডিরেক্টররা খুশি হয়ে লেখেন : ‘It is enough our Cash feels the benefit’ (26 February 1703)।
‘Our Cash feels’—কথাটি কোম্পানির ডিরেক্টরদের বটে কিন্তু মনে হয় যেন কালের ইতিহাসের মর্ম থেকে উৎসারিত। কে ফিল করে? ক্যাশ। জন্তু নয়, মানুষ নয়—ক্যাশ! নবাবকে নগদ ‘ক্যাশ’ দিয়ে লক্ষ্মীকান্ত মজুমদারের বংশধরদের জমিদারি কলকাতা—গোবিন্দপুর—সুতানুটি কোম্পানি নামে কিনতে হয়েছে, সেই জমিদারি ‘টাউন’ হয়ে গড়ে উঠছে, তার লোকসংখ্যা বাড়ছে, বাণিজ্যের উন্নতি হচ্ছে। কাজেই যে ক্যাশ টাকাটা দিয়ে জমিদারি কেনা হয়েছে সেই টাকাটাই অনুভব করছে যে সে উপকৃত। টাকার যে শুধু চক্রগতি আছে তা নয়, তার অনুভূতি আছে, হৃৎস্পন্দন আছে। টাকার অনুভূতি এবং মানুষের অনুভূতি একাকার হয়ে মিশে গেল। মানবিক ও সামাজিক সম্পর্ক আর্থিক সম্পর্কে পরিণত হল। কলকাতা শহরের পত্তন হল ক্যাশের উপর এবং ক্যাশ নেক্সাস হল সামন্ততান্ত্রিক কলকাতার মানবিক ও সামাজিক সম্পর্ক।
কোনো বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী লন্ডন শহর সম্বন্ধে বলেছিলেন : ‘London has never acted as England’s heart but often as England’s intellect and always as her moneybag.’ কলকাতা শহর সম্বন্ধেও ঠিক সেই কথা বলা যায়। লন্ডন যেমন কোনোদিন ইংল্যান্ডের হৃদয়ের কাজ করেনি, কেবল তার মননশক্তি ও মনিব্যাগের কাজ করেছে, কলকাতা শহরও তেমনি কোনোদিন বাংলা দেশের হৃদয়ের পরিচয় দেয়নি, তার মননশক্তি ও মনিব্যাগের পরিচয় দিয়েছে। এই হৃদয়হীন অর্থের অন্বেষণ অষ্টাদশ শতকেও কলকাতার ইতিহাস। পঞ্চানন ঠাকুর, ব্ল্যাকডেপুটি গোবিন্দরাম, নবকৃষ্ণ দেব, মদন দত্ত, রামদুলাল দে এবং অন্যান্য দেওয়ান, বেনিয়ান, মুচ্ছুদ্দিরা এই অর্থের লোভে গ্রাম ছেড়ে কলকাতা শহরে এসেছেন অষ্টাদশ শতকে। নিরাপদ জীবনযাত্রা ও নির্লিপ্ত অর্থান্বেষণের সুযোগ কলকাতার মতো আর কোথাও তখন ছিল না। যুগসন্ধির বিশৃঙ্খলার গ্রাম্য জীবন বিপর্যস্ত। ভারতের ও বাংলার রাজদরবারের পরিবেশে স্বার্থের হীন হানাহানি ও চক্রান্ত। বিদেশি বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ডরূপে দেখা দিতে উদ্যত। ইংরেজরা ক্রমে ছোট জমিদার থেকে বড় জমিদার হয়ে উঠছেন এবং ধাপে ধাপে বাণিজ্যের অবাধ স্বাধীনতা লাভ করছেন। তাঁদের সুতানুটির বাণিজ্যকুঠি ধীরে ধীরে বিস্তৃত হচ্ছে। গ্রাম থেকে নগরে রূপ ধারণ করেছে কলকাতা এবং রূপায়ণের প্রথম পর্বে মধ্যযুগের নগরের যাবতীয় ঐতিহাসিক উপাদান নিয়েই তার বিকাশ হয়েছে। নগরের চারদিকে প্রহরী মোতায়েন বেষ্টনী ও গড়খাই, পশ্চিমে নদীতীরে কেল্লা ও তার চারদিকে শত্রুমুখী কামান। কলকাতার বাল্যকালের এই রূপ (‘The original town of Calcutta was at one time at least a fenced city… Every road issuing from the town was secured by a gate’) প্রাচীন মানচিত্র পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি প্রায় ক্যাপ্টেন উইলিয়াম হলকুম্ব (১৭৪২—) কলকাতার নির্বিঘ্নতার পরিকল্পনা করেছিলেন কামান ও বেষ্টনী দিয়ে। তিনি তাঁর রিপোর্টে বলেছিলেন যে উত্তর কলকাতায় শেঠদের বাগানের কাছে ছয়টি কামানের ব্যাটারি থাকবে, তার মধ্যে দুটি গঙ্গামুখী ও চারটি উত্তরমুখী। কেল্লা ও কুঠির কাছে থাকবে চারটি কামান, জ্যাকসন ঘাটে তিনটি, জেলখানার কাছে তিনটি, অন্যান্য কয়েকটি রাস্তার মুখে, পুবে ও পশ্চিমে আরও প্রায় দশ—বারোটি কামান বসানো থাকবে। নগরবাসীর মধ্যে প্রবেশপথগুলির সামনে থাকবে দেওয়াল, তারপরে গড়খাই। তা ছাড়া কামানের প্রত্যেকটি ব্যাটারির চারদিকেও পরিখা থাকবে। কলকাতা শহর সাদা ও কালো রঙের মানুষ হিসেবেও ভাগ করা হল—’সাদা বা হোয়াইট টাউন’ এবং ‘কালো বা ব্ল্যাক টাউন’। ব্ল্যাক টাউনের ফটকগুলির চারদিকে দেয়াল থাকবে এবং তার উদ্দেশ্য হল যাতে সাদা—কালোয় না মিশে যায়। সাদা সাদা, কালো কালো। সাদা ‘মাস্টার’, কালো ‘স্লেভ’। সাদা শাসক—শোষক—অভিজাত ও উচ্চশ্রেণির ‘হোমো স্যাপিয়েন্স’ আর কালো ‘নিগার’, ‘নেটিভ’ ও কতকটা যেন ‘অ্যানথ—পয়েড এপ’। সাদা ‘হোমো’ এবং কালো ‘অ্যানথ্র পয়েডার’ কলকাতা শহরে বিভক্ত হয়ে গেল। নতুন কলকাতার নাগরিক সমাজে প্রথম বৈষম্যের দাগ পড়ল চামড়ার রঙের উপর দিয়ে। কলকাতা শহরের দেহ থেকে সে দাগ আজও মেলায়নি।
শুধু চামড়ার রঙের দাগ নয়, আরও অনেক দাগে কলকাতার নাগরিক দেহ ক্ষতবিক্ষত হল। দাগের উপর দাগ, তার উপর আবার দাগ। প্রত্যেকটি দাগ কলকাতার বয়সবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গভীর হয়েছে, বিস্ফারিত হয়েছে, যেমন গাছের গায়ে কাটা দাগ হয় তেমনি। সামাজিক বৈষম্যের দাগ। সাদার মধ্যে ‘ক্রিশ্চান টাউন’, তার মধ্যে পর্তুগিজ—আর্মেনিয়ান টাউন, ইংরেজ—ফরাসি—ডাচদের টাউন। টাউন মানে এখানে অঞ্চল। গির্জার ভেদ নয় কেবল, বসতির ভেদ, জীবনের ভেদ এবং সবার উপর চরম সত্যের মতো সামাজিক ভেদ। শ্রেণিগত ভেদ, স্টেটাসগত ভেদ। কলোনিয়াল টাউন কলকাতার ঊর্ধ্বাধ সামাজিক ভেদরেখা একটার পর একটা প্রলম্বিত হতে থাকল। খণ্ডিত নাগরিক সমাজ মৌচাকের রূপ ধারণ করল। রকমটা মধ্যযুগের কারুজীবী নগরের মতো কতকটা। যেমন কুমোরদের জন্য কুমোরটুলি, কলুদের জন্য কলুটোলা, জেলেদের জন্য জেলেপাড়া, ডোমদের জন্য ডোমটুলি, গোয়ালদের জন্য গোয়ালটুলি, বিহারি গোয়ালা বা আহিরদের জন্য আহিরিটোলা, কসাইদের জন্য কসাইটোলা, পটুয়াদের জন্য পটুয়াটোলা, শাঁখারিদের জন্য শাঁখারিটোলা, খুদে ব্যবসায়ী বা ব্যাপারীদের জন্য ব্যাপারীটোলা, কম্বলিদের (যারা কম্বল কেনাবেচা করে) জন্য কম্বলিটোলা, হাড়িদের জন্য হাড়িপাড়া, কাঁসারিদের জন্য কাঁসারিপাড়া, কামারদের জন্য কামারপাড়া, মুসলমানদের জন্য মুসলমানপাড়া, ওড়িয়াদের জন্য ওড়িয়াপাড়া, দরজিদের জন্য দরজিপাড়া, খালাসিদের জন্য খালাসিপাড়া, ধোপাদের জন্য ধোপাপাড়া, তেলিদের জন্য তেলিপাড়া, ছুতোরদের জন্য ছুতোরপাড়া, বেনিয়াদের জন্য বেনিয়াটোলা, যুগিদের জন্য যুগিপাড়া, শিকদারদের জন্য শিকদারপাড়া। এরকম আরও অনেক আঞ্চলিক বিভাগ হল কলকাতা শহরে এবং মধ্যযুগের জাতিবর্ণবিভক্ত সমাজটাকে তুলে এনে নবযুগের নির্মীয়মাণ নগরের স্কন্ধে চাপিয়ে দেওয়া হল। কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের কালকেতুর নতুন নগরপত্তনের কথা মনে হয়। কবিকঙ্কণের মতো কোনো কবি যদি একালে ‘কলকাতা মঙ্গলকাব্য’ রচনা করতেন, কলকাতার দৈহিক বিকাশ ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বিন্যাসের বিষয় নিয়ে, তাহলে তার মাহাত্ম্যও লোকমুখে যথেষ্ট প্রচারিত হত। বৃত্তিগত বর্ণভেদ, জাতিভেদ খণ্ডিত করল কলকাতার দেহ এবং সঙ্গে সঙ্গে কলকাতার মনও খণ্ডিত হল।
তারপর ব্রাহ্মণ কায়স্থ বৈদ্য বণিক তেলি তিলি শুঁড়ি সকলে কাঁধ ঘষাঘষি করে অর্থ উপার্জনের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হলেন। প্রতিযোগিতার চেহারা আলাদা। নবাব বা জমিদারের স্বেচ্ছাচারিতার ভয় নেই এবং ইংরেজরা যতই নবাবি আদবের অনুকারী হন, এমনকী আচার—আচরণে পর্যন্ত, তাতেও নবাবি আমল আর ইংরেজ আমলের সামাজিক প্রতিবেশের ঐতিহাসিক পার্থক্য উপলব্ধি করতে নগরবাসীদের অসুবিধা হয়নি। নতুন কলকাতা হাওয়ার মধ্যে সেই পার্থক্যের আমেজ রয়েছে এবং তারই মধ্যে নতুন জীবন আস্বাদনের হাতছানি। যুগের সাইনবোর্ডের উপর হাতের ইঙ্গিতে দেখানো কলকাতা শহর। তার উপরে লেখা :
শহরে যাও—ক ল কা তা য়
স্বা ধী ন হ বে
লা ভ বা ন হ বে
কীসের স্বাধীনতা? লাভ কীসের? জীবন ও জীবিকার স্বাধীনতা এবং টাকায় লাভবান হওয়া। সমাজে এই স্বাধীনতা আগে ছিল না এ দেশের গ্রাম্য সমাজে। কলুটোলা, পটুয়াটোলা প্রভৃতি টোলাটুলি ও পাড়াতে পুরোনো গ্রাম্য সমাজের জীর্ণ কাঠামোটাকে কলকাতার নতুন নাগরিক সমাজে আরোপ করা হল বটে কিন্তু বর্ণগত বৃত্তিবন্ধনের কঠোরতা রইল না, অন্তত শহরের মধ্যে নয়। ক্রমে টাকার মানদণ্ডে যখন নতুন যুগের লোকসমাজে মর্যাদার পরিমাপ হতে থাকল তখন নাগরিক সমাজের ‘অ্যানোনিমিটি’ বা নামগোত্রহীনতার যে বিশিষ্ট রূপ সেটাও পরিস্ফুট হয়ে উঠল। যত সমাজের অজ্ঞাতকুলশীলতা বাড়তে লাগল তত নগরের লোকের পক্ষে সহজ হল কুলবৃত্তিগত বন্ধন ছিন্ন করে বেরিয়ে আসার। বর্ণগত বৃত্তির সংকীর্ণ গর্ত থেকে বেরিয়ে এল মানুষ জীবনের বৃহত্তর বৃত্তের মধ্যে। জীবিকার পথ অনেকটা মুক্ত, জীবনযাত্রাও অনেকটা স্বাধীন। কলুর ছেলে গ্রামে কলু, গ্রাম্য সমাজে তার মর্যাদা নির্দিষ্ট একেবারে বংশানুক্রমে, কিন্তু কলকাতা শহরে সে মোটামুটি একজন মানুষ, তার স্বাতন্ত্র্য আছে, স্বাধীনতা আছে এবং নতুন একটা সামাজিক মর্যাদার স্বাদও সে পেয়েছে, যে মর্যাদার মানদণ্ড বর্ণবৃত্তিগত ততটা নয়, যতটা বিত্তগত। কুল নয়, বর্ণ নয়, টাকাই নতুন নাগরিক মানমর্যাদার বড় মাপকাঠি। এই টাকার ঐন্দ্রজালিক স্পর্শে কলকাতার সমাজের যে রূপান্তর হতে থাকল তার আভাস দিয়েছেন ভবানীচরণ তাঁর ‘নববাবুবিলাস’, রচনায় (১৮২২—২৩) :
…ইংরেজ কোম্পানি বাহাদুর অধিক ধনী হওনের অনেক পন্থা করিয়াছেন এই কলিকাতা নামক মহানগর আধুনিক কাল্পনিক বাবুদিগের পিতা কিম্বা জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা আসিয়া স্বর্ণকার কর্মকার বর্ণকার চর্মকার চটকার পটকার মটকার বেতনোপভুক হইয়া কিম্বা রাজের সাজের কাঠের খাটের ঘাটের মাঠের ইটের সরদারি চৌকিদারী জুয়াচুরি পোদ্দারী করিয়া অথবা অগম্যাগমন মিথ্যাবচন পরকীয়রমণীসংঘটনকামি ভাঁড়ামি রাস্তাবন্দ দাস্য দৌত্য গীতবাদ্যতৎপর হইয়া কিম্বা পৌরোহিত্য ভিক্ষাপুর গুরুশিষ্যভাবে কিঞ্চিৎ অর্থসঙ্গতি করিয়া কোম্পানির কাগজ কিম্বা জমিদারি ক্রয়াধীন বহুতর দিবসাবসানে অধিকতর ধনাঢ্য হইয়াছেন…
‘বহুতর দিবসাবসানে’ বলতে পুরো অষ্টাদশ শতকটাকে ধরা যেতে পারে। এই শতকের মধ্যে কলকাতার লোকসংখ্যা দশ—বারো হাজার থেকে (১৭১০ সাল) বেড়ে পাঁচ—ছয় লক্ষ পর্যন্ত (১৮০০ সাল) হয়। বৃদ্ধির হার কম নয়। কীসের টানে শহরে এই গ্রামছাড়া জনস্রোত বয়ে এল অনর্গল ধারায়? টাকার টানে। গিরিনির্ঝরের স্রোতের টানের মতো এর প্রাবল্য। বড় বড় বোল্ডার সেই টানে গড়িয়ে চলে, ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায় এবং তার শব্দের প্রকম্প চারদিকে বিকীর্ণ হতে থাকে। গোবিন্দরাম, রামদুলাল, মহারাজ নবকৃষ্ণ সকলেই বোল্ডারের মতো গড়াতে থাকেন এবং ভাঙতে থাকেন টাকার টানে। অনেকেই ‘অধিকতর ধনাঢ্য’ হন এবং টাকার উপরে গড়াতে গড়াতে তাঁদের মানবসত্তা ভাঙতে থাকে। ‘বেতনোপভুক’ হয়ে ‘সরদারি চৌকিদারী জুয়াচুরি পোদ্দারি’ করে অথবা ‘অগম্যাগমন মিথ্যাবচন ভাঁড়ামি দাস্য দৌত্য’ করে কোম্পানির কাগজ কিংবা জমিদারি কিনে, হাটবাজার বসিয়ে নিমক পোক্তানের দালালি ও দেওয়ানি—বেনিয়ানি করে যাঁরা ধনাঢ্য হন তাঁরা ক্রমে মন ও বিবেকটাকে বাজারের বিনিময়যোগ্য পণ্যে পরিণত করেন। টাকার কাছে নির্বিকার চিত্তে তাঁরা মনটাকে উৎসর্গ করে দেন। টাকার মন্থনদণ্ডে মন থেকে শুধু বিষ ওঠে, অমৃত নয়। বিবাহে—শ্রাদ্ধে—দোল, দুর্গোৎসবে, আমোদ—প্রমোদে, অনাথ—আতুরসেবায়, পুণ্যকর্মে, দেবালয়—প্রতিষ্ঠায় ধনাঢ্যরা যে অনর্গল অর্থব্যয় করতে কুণ্ঠিত হন না তার কারণ বাইরের লোকসমাজে তাঁরা নিজেদের বদান্যতা ও উদারতা সশব্দে জাহির করতে চান। তার চেয়েও বড় কারণ হল নানাবিধ অসৎ উপায়ে অর্থোপার্জনের ফলে তাঁদের মনের তলায় যে পাপ ও অন্যায়বোধের ময়লা জমে সেই ময়লাটাকে তাঁরা নিষ্কাশন করতে চান সমাজসেবায়, দরিদ্রনারায়ণের সেবায় ও পুণ্যকর্মে অঢেল অর্থব্যয় করে। একশো বছর আগে ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকা এ বিষয়ে জমিদারদের প্রসঙ্গে লিখেছেন (২০ শ্রাবণ ১২৬৯ সন, আগস্ট ১৮৬২) :
জমিদারদিগের মধ্যে আর একটি দল হইয়াছে তাঁহারা বড় পাকা লোক। তাঁহারা কুকার্য পরিপাক করিবার উদ্দেশ্যে বাহিরে বিদ্যালয় ও চিকিৎসালয় প্রভৃতি স্থাপন করিয়া থাকেন। আমাদিগের প্রাচীন দলের একটি সম্প্রদায় হইতে তাঁহাদিগের এই শিক্ষাটি হইয়াছে। এই সম্প্রদায় না করেন এমন কুকর্ম নাই, পরদারগমন, উৎকোচ গ্রহণ ও কৃতঘ্নতা করিয়া পরে সর্বস্ব হরণ প্রভৃতি কিছুতেই পরাঙ্মুখ নহেন। তাঁহাদিগের এই সকল কুক্রিয়া জীর্ণ করিবার মহৌষধ আছে। সে ঔষধ এই, গঙ্গাস্থান ও নামাবলী গ্রহণ।
কলকাতা শহরে যাঁরা নতুন সামাজিক আভিজাত্যের তকমা পেলেন তাঁরা প্রায় সকলেই একশ্রেণির নতুন জমিদার হলেন। গ্রাম্য ভূসম্পত্তির জমিদাররা ‘অ্যাবসেন্টি’ হয়ে নিশ্চিন্ত আলস্যবিলাসে শহরে কালহরণ করতে লাগলেন। ইংরেজ শাসকরা এই জীবনযাত্রার সমস্ত বাধা দূর করে দিলেন ভূমি সংক্রান্ত বিধানে ‘সাবইনফিউডেশন’ বা উপস্বত্ব সৃষ্টির সুব্যবস্থা করে দিয়ে। এই বিধানের ফলে গ্রাম ও শহর একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। মধ্যে এসে মাথা তুলে দাঁড়াল অভ্রভেদী টাকা। শহর ও গ্রামের মতো দেহ ও মনও বিচ্ছিন্ন হল। এ বিচ্ছেদ আর ঘুচল না কোনোদিন। টাকার অভ্রংলিহ মদগর্ব তা ঘুচতে দিল না। দেখা গেল, ‘এক জায়গায় একদল মানুষ অন্নউৎপাদনের চেষ্টায় নিজের সমস্ত শক্তি নিয়োগ করেছে, আর—এক জায়গায় আর—একদল মানুষ স্বতন্ত্র থেকে সেই অন্নে প্রাণ ধারণ করে। চাঁদের যেমন এক পিঠে অন্ধকার, অন্য পিঠে আলো, এ সেই রকম। এক দিকে দৈন্য মানুষকে পঙ্গু করে রেখেছে—অন্যদিকে ধনের সন্ধান, ধনের অভিমান ভোগবিলাস—সাধনের প্রয়াসে মানুষ উন্মুক্ত। অন্নের উৎপাদন হয় পল্লীতে, আর অর্থের সংগ্রহ চলে নগরে। অর্থ উপার্জনের সুযোগ ও উপকরণ যেখানেই কেন্দ্রীভূত, স্বভাবত সেখানেই আরাম আরোগ্য আমোদ ও শিক্ষার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়ে অপেক্ষাকৃত অল্পসংখ্যক লোককে ঐশ্বর্যের আশ্রয় দান করে। পল্লীতে সেই ভোগের উচ্ছিষ্ট যা—কিছু পৌঁছয়, তা যৎকিঞ্চিৎ। গ্রামে অন্ন উৎপাদন করে বহু লোকে, শহরে অর্থ—উৎপাদন ও ভোগ করে অল্পসংখ্যক মানুষ, অবস্থার এই কৃত্রিমতায় অন্ন ও ধনের পথে মানুষের মধ্যে সকলের চেয়ে প্রকাণ্ড বিচ্ছেদ ঘটেছে।’ (রবীন্দ্রনাথ : ‘উপেক্ষিতা পল্লী’)
টাকার পথে মানুষের সঙ্গে মানুষের এই বিচ্ছেদ ঘটল এবং তার ব্যাদান ক্রমেই বাড়তে লাগল কলকাতার নাগরিক সমাজে। শুধু গ্রামের সঙ্গে আধুনিক শহরের বিচ্ছেদ নয়, এ হল প্রাচীন ও মধ্যযুগের নগরের সঙ্গে আধুনিক শহরের বিচ্ছেদ। গ্রাম জীর্ণশীর্ণ—পরিত্যক্ত হল এবং সেকালের নগরেরও শ্রীসমৃদ্ধি ম্লান হয়ে এল। ঢাকা—মুর্শিদাবাদের মতো নবাবি আমলের রাজধানী শহর, অন্যান্য বাণিজ্যনগর, কারুজীবীনগর, তীর্থনগর সকলের আকর্ষণ স্তিমিত হয়ে এল নতুন কলকাতা শহরের টাকার দুরন্তচক্রগতি ও ঔজ্জ্বল্যের কাছে। সেকালের আমেদাবাদ শহর দেখে রবীন্দ্রনাথের যা মনে হয়েছিল, কলকাতার পাশে ঢাকা মুর্শিদাবাদ দেখেও তাঁর মনে হত :
এই প্রথম দেখলুম, চলতি ইতিহাস থেমে গিয়েছে, দেখা যাচ্ছে তার পিছনফেরা বড়ো—ঘরোয়ানা। তার সাবেক দিনগুলো যেন যক্ষের ধনের মতো মাটির নিচে পোঁতা। আমার মনের মধ্যে প্রথম আভাস দিয়েছিল ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পের।
সে আজ কত শত বৎসরের কথা। নহবতখানায় বাজছে রোশনচৌকি দিনরাত্রে অষ্টপ্রহরের রাগিণীতে। রাস্তায় তালে তালে ঘোড়ার খুরের শব্দ উঠছে, ঘোড়সওয়ার তুর্কি ফৌজের চলছে কুচকাওয়াজ, তাদের বর্শার ফলায় রোদ ঝকঝকিয়ে। বাদশাহি দরবারের চারদিকে চলেছে সর্বনেশে কানাকানি ফুসফাস। অন্দরমহলের খোলা তলোয়ার হাতে হাবসি খোজারা পাহারা দিচ্ছে। বেগমদের হামামে ছুটছে গোলাব—জলের ফোয়ারা, উঠছে বাজুবন্ধ—কাঁকনের ঝনঝনানি। আজ স্থির দাঁড়িয়ে শাহিবাগ, ভুলে—যাওয়া গল্পের মতো—তার চারদিকে কোথাও নেই সেই রং, সেই সব ধ্বনি—শুকনো দিন, রস—ফুরিয়ে—যাওয়া রাত্রি। (রবীন্দ্রনাথ : ‘ছেলেবেলা)
কলকাতা শহরেও নতুন ইংরেজ বাদশাহদের দরবারে লাটভবনে এর চেয়ে কম জমকালো উৎসব হয়নি। আঠারো—উনিশ শতকের উৎসবের ফোয়ারা ছুটত লাটভবনে। ভারতজয়ের উৎসবই বেশি। একটার পর একটা প্রদেশে ব্রিটিশ সামরিক শক্তির জয়ের উৎসব। উনিশ শতকের গোড়ায় এরকম একটি উৎসবে শুধু যে আতশবাজির খেলা দেখানো হয়েছিল তার বর্ণনা দিচ্ছি (ফেব্রুয়ারি ১৮০৩) : আতশবাজিতে হাতির লড়াই দেখানো হল আকাশে। উপরে বাজি ফাটল তার ভিতর থেকে আগুনের মালায় দুটি হাতি বেরিয়ে এল এবং লড়াই করল। আগুনের একটি আগ্নেয়গিরি থেকে কিছুক্ষণ ধরে আকাশে রংবেরঙের রকেট উদগীরিত হতে থাকল। আবার একটি বাজি ফাটল আকাশে এবং তার ভিতর থেকে আগুনের রেখায় আঁকা দুটি মন্দির ভেসে উঠল চোখের সামনে, ভারতের দেবদেউল। মন্দিরের পাশে একটি বাজির ঝরনা থেকে অজস্র ধারায় আগুনের বিন্দু ঝরতে থাকল এবং বিন্দুগুলি নীল রঙের। অবশেষে সূর্য—চন্দ্র—তারা উদ্ভাসিত হয়ে উঠল বাজির আকাশে এবং তার ভিতর থেকে একটি বৃত্তাকার আগুনের ভূমণ্ডল ঘুরতে ঘুরতে ছিটকে বেরিয়ে এল এবং তার ভিতর থেকে আবার অগ্নিকন্যা বিচ্ছুরিত হতে থাকল। আশ্চর্য হল, আগুনের মধ্যে ফারসি হরফে লেখা : ‘কল্যাণ হোক সকলের’।
আতশবাজির এই খেলা পুরো উৎসবের অঙ্গবিশেষ এবং এর মধ্যে বাদশাহি আমলের প্রমোদাবশেষ যে বেশ কিছুটা আছে তা বোঝাই যায়। যেমন হাতির লড়াই বাদশাহের কাছে খুবই প্রিয় ও উপভোগ্য ছিল এবং মোগল চিত্রকলায় পর্যন্ত তার বহু নিদর্শন আছে।* এ ছাড়া রকেট, দেবদেউল, ভূমণ্ডল এগুলির মধ্যে বিদেশি সুদক্ষ বাজিকরদের কলাকৌশল দেখানো হয়েছে। তবু ইংরেজদের লাটভবনের অন্দরমহলে খোলা তলোয়ার হাতে খোজাদের দেখা যেত না। তার বদলে দেখা যেত বন্দুকসঙিনধারী প্রহরীদের। তাদের পোশাক অন্যরকম, দাঁড়াবার ভঙ্গি অন্যরকম, যেন যন্ত্রের মানুষ। লাটভবনের অন্দরমহলের বেগমদের হামামে গোলাপজলের ফোয়ারা ছুটত না অথবা বাজুবন্ধ, কাঁকনের ঝনঝনানিও শোনা যেত না। বোঝা যেত যে চলতি ইতিহাস কলকাতার লাটভবনে চলছে কিন্তু শাহিবাগে থেমে গিয়েছে। শাহিবাগ স্থির দাঁড়িয়ে আছে আর লাটভবন বেগের আবেগে অস্থির। শাহিবাগ—আমেদাবাদ, মুর্শিদাবাদ বা ঢাকা যেখানকারই হোক—না কেন—এখন ভুলে যাওয়া গল্পের মতো, কারণ তার সেই রং নেই, ধ্বনি নেই। যেন শুকনো দিন, রস ফুরিয়ে যাওয়া রাত্রি আর লাটভবনের গল্প নতুন, তার রং আছে, ধ্বনি আছে, দিন ও রাত্রি সবসময় সেখানে নতুন যুগজীবনের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। যন্ত্রবৎ প্রহরীরা সঙিন হাতে পাহারা দিচ্ছে, কামান দিয়ে ঘেরা আছে লাটভবন। শাহিবাগের প্রাণশক্তি নিঃশেষ হয়েছে, তার উৎসব ম্লান হয়ে গিয়েছে। এখন লাটভবনের যুগ এবং তার ইম্পিরিয়াল ঔদ্ধত্যের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ হচ্ছে আতশবাজির বিজয়োৎসবে।
সাম্রাজ্যলোভী অর্থলোভী বণিকবুদ্ধি ইংরেজ শাসকদের নতুন দম্ভের যুগ এল আর তার সঙ্গে এল অর্থলোভী নির্জীব শাসিতদের নতুন গোলামির যুগ। বণিকের মানদণ্ডই বড়, তার উপরে সতর্ক পাহারা রাজদণ্ড। বণিকের বুদ্ধিই রাজনীতির আদর্শ, সমাজনীতির আদর্শ, শিক্ষানীতির আদর্শ। এই নবযুগ ও আদর্শের অভ্যুদয় হল কলকাতা শহরে। বণিকের স্বার্থবুদ্ধি সংক্রমিত হল কলকাতার জনমনে। স্বার্থ টাকার ও মুনাফার। মানবিক স্বার্থ, সামাজিক স্বার্থ, কোনো স্বার্থই তার চেয়ে বেশি বড় নয়। আগেকার কালেও মোহর ছিল, মুদ্রা ছিল, পয়সা ছিল, কড়ি ছিল। কিন্তু বিনিময়টা প্রধানত ছিল বস্তুর সঙ্গে বস্তুর। পয়সাকড়ি—মোহর—মুদ্রা কালেভদ্রে হাত ঘুরত। হাত ঘোরার ক্ষমতাই তাদের ছিল না, সামান্য একটু ঘুরেফিরে পরম নিশ্চিন্তে সিন্দুকের বা কলসির গহ্বরে গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে পড়ত। বর্তমান মুদ্রা তা নয়। তার চক্রগতির শক্তি অফুরন্ত। তার ঘুমিয়ে থাকার সেই সময় নেই। সিন্দুক বা হাঁড়ি—কলসির কন্দরে তাকে ‘হোর্ড’ করা হয় না, ব্যাঙ্কে ‘সেভ’ করা হয় এবং ব্যাঙ্ক বা বিমার ‘সেভিং’ আবার ‘ইনভেস্টমেন্ট’—এর ভিতর দিয়ে ঘুরতে থাকে। টাকার গতির বিরাম নেই। আমার নিষ্ক্রিয় সঞ্চিত টাকা অন্যের হাতে সক্রিয় হয়ে ঘুরতে থাকে, তবেই ব্যাঙ্ক চলে, বিমা চলে, শাসন চলে, শোষণ চলে এবং সমস্ত কিছু টাকার বিনিময়ে মাপাজোখা যায়। সকলকেই একটা ‘কমন মেজর’—এ আনা যায়, কোয়ালিটিকে একনিমেষে কোয়ান্টিটিতে পরিণত করা যায়। অঙ্কের ব্যাপার। সমাজের চারদিকে দাঁড়িপাল্লা, টাকার ওজনে মাপা যায় না এমন কিছু নেই। জর্জ সিমেল বলেছেন : ‘…it asks for the exchange value, it reduces all quality and individuality to the question ‘‘how much’’?’
মানুষের জীবনের সমস্ত উপকরণ, দোষগুণ, মানবিক, পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক, প্রেম—ভক্তি—স্নেহ—ভালোবাসা, পাপপুণ্য সবই টাকার বিনিময়মূল্যে সঠিকভাবে নির্ধারণ করা যায়। সমাজটাই একটা বড় মার্কেটের মতো এবং মার্কেটে যেমন দ্রব্যমূল্যের তালিকা থাকে, বর্তমান সমাজের মার্কেটেও বহুবিধ মনুষ্যের মূল্যতালিকা সর্বদাই তেমনি লটকানো থাকে। জ্ঞানীগুণী—মানী, প্রেমিক—প্রেমিকা, গুরু—শিষ্য, স্বামী—স্ত্রী, পুত্রকন্যা, ভাইবোন, উচ্চশিক্ষিত—মধ্যশিক্ষিত—অল্পশিক্ষিত, পণ্ডিত—মূর্খ সকলের দাম টাকার বিনিময় হিসেবে সমাজের বাজারে টাঙানো আছে। এ টাকা একালের গতিশীল টাকা, সদাজাগ্রত সতত সঞ্চরণশীল টাকা, সেকালের মন্থরগতি জরদগব মোহরমুদ্রা নয়। এই টাকাই কলকাতার টাকা। এই টাকার ভিত্তির উপরেই কলকাতা শহর প্রতিষ্ঠিত। এ টাকার হৃৎস্পন্দন আছে, অনুভূতি আছে, ‘ক্যাশ—ফিলস’। এবং এই গতিশীল টাকার স্পন্দন—অনুরণন—অনুভূতি যত বেড়েছে, ক্যাশের ফিলিং যত গভীর ও ব্যাপক হয়েছে, কলকাতা শহরের মন তত অসাড় ও অবরুদ্ধ হয়েছে এবং কলকাতার ইট—পাথরের নিরেট ছাঁটাকাটা স্থাপত্য সেই মনের রূপ প্রতিবিম্বিত হয়েছে। নাগরিক মন হয়েছে টাকার মতো ক্যালকুলেটিং, ইট—পাথরের মতো কঠিন।
নগরবিজ্ঞানী মামফোর্ড বলেছেন যে আধুনিক জীবনের বিকাশে এই ছন্দ নগরস্থাপত্যের বিভিন্ন পর্বে ধ্বনিত হয়ে উঠেছে। প্রথম পর্বের নাগরিক স্বাধীনতা কতকটা যেন বোজানো চোখ খুলে আলো দেখার মতো। নগরে এলে সকলে স্বাধীন—এই অনুভূতি হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো। সেই আলো দেখাতে হবে, কাজেই স্থাপত্যে তার প্রতীক হল ‘রাউন্ড আর্চ’, গোলাকার খিলান। স্তম্ভের উপর তোরণ, তোরণপথ, তোরণাকৃতি বাঁক। তোরণের ফাঁক দিয়ে আলো দেখা যায়, অনন্ত আকাশ দেখা যায়, দূর দিগন্তের আভাস পাওয়া যায়। তারপর যত জীবনের গতি দ্রুততর হতে থাকে যন্ত্রের বেগে, জীবন যত ‘স্ট্যান্ডার্ডাইজড’ হয় ততই জীবন ও মনের চেহারা মুদ্রিত অক্ষরের মতো একমাপের একধাঁচের ছাঁচে—ঢালা ছাঁটাকাটা হতে থাকে। সেনাবাহিনীতে, আইনকানুনে, টাকাপয়সায়, আমলাতান্ত্রিক শাসনে এই ছাঁচে ঢালা জীবন প্রতিফলিত হয়। শহরের পথঘাট এই সময় বিস্তৃত ও প্রসারিত হয় এবং নগরের ঘরবাড়ির ‘ফাসাদ’ বা মুখটা স্ট্যান্ডার্ডাইজড হয়, বিশ্বভুবন তার মোহিনী রূপ নিয়ে গিল্টপ্ল্যাস্টারে আত্মপ্রকাশ করে। এই প্রকাশের চরম পর্ব হল শহরের প্রাকৃতিক শোভাবর্ধন। প্রকৃতির সঙ্গে শহরের বিচ্ছেদ যখন অনিবার্য হয়ে উঠল তখন স্থাপত্যের চক্রান্ত হল প্রকৃতির পায়ে শিকল দিয়ে শহরের পাথরস্তম্ভে বেঁধে রাখা। শহরে পার্ক উদ্যান হল, পথের ধারে ধারে গাছ বসল, ঝোপঝাড় গজিয়ে তোলা হল। সবটাই হল প্রকৃতিকে জ্যামিতির ছককাটা ডিজাইনে বেঁধে ফেলার চেষ্টা। ঘাসছাঁটা, ঝোপঝাড়ছাঁটা, গাছছাঁটা এবং সেই ছাঁটাঝোপ আর ছাঁটাগাছের ভিতর দিয়ে সোজা বাঁধানো পথ আর তার দু—পাশে একধাঁচের সারবন্দি বাড়ি। শহরের পার্ক—উদ্যানগুলি সবুজ ন্যাকড়ার ফালির মতো অথবা সবুজ কালিতে ছোপানো কাগজের টুকরো। ঝোপের সারি, গাছের সারি যেন সবুজ রঙের দেয়াল। গৃহসীমানার দেয়াল, জেলখানার দেয়াল আর পথের দেয়ালের মধ্যে তফাত শুধু রঙের। এ যেন মামফোর্ডের ভাষায় : ‘the deformation of life in the interest of an external pattern of order…’
যেন গ্রিক দস্যু প্রকস্টিস শিল্পী র্যাফেলের প্রেরণায় উদবুদ্ধ। অষ্টাদশ শতকের শেষদিক থেকে ঊনবিংশ শতকের মধ্যে নগরোন্নয়ন কমিটি, লটারি কমিটি এবং পরে কর্পোরেশনের পরিকল্পনায় কলকাতা শহর স্থাপত্যের এই পর্বগুলি অতিক্রম করে ক্রমে এক বিকৃত ও বিবর্ণ জীবনের বিশ্রী প্রতিমূর্তি হয়ে উঠেছে। তাই বিকৃত ও বিবর্ণ মনের প্রতিচ্ছবি হয়েছে কলকাতা।
এই তো কলকাতার মনের গড়ন। স্তরিত শিলার মতো এই মনের প্রত্যেকটি স্তরের বিশ্লেষ সম্ভব। ভিত্তিস্তরে টাকা অর্থাৎ ‘ক্যাশ’। ক্যাশের স্পন্দন আছে, গতি আছে, টান আছে প্রবল। মানুষের বুদ্ধি, বিচারবোধ, বিবেক, মনুষ্যত্ব এই টাকার টানে ভেসে যায় এবং টাকা দিয়ে মানুষকে মাপা যায়। টাকা যেমন টাকশালে স্ট্যান্ডার্ডাইজড, মনও ঠিক তেমনি মানুষের স্ট্যান্ডার্ডাইজড মহানগরে। মানবিক, পারিবারিক ও সামাজিক সমস্ত সম্পর্ক টাকার সম্পর্ক। এই ভিত্তিস্তরের পরে ভেদবৈষম্যের স্তর। কলোনিয়াল শহর কলকাতায় প্রথম বৈষম্য শাসক—শাসিতের যা গায়ের চামড়ার রঙের বৈষম্য এবং যা প্রাগৈতিহাসিক বর্বর যুগেও সমাজে অচিন্তনীয় ছিল। তার সঙ্গে এল নতুন যুগের ধনবৈষম্য যা আগেকার বর্ণবৃত্তিগত বৈষম্যের চেয়ে আরও ভয়ংকর। অবশ্য আধুনিক শিক্ষার স্বর্ণকাঠিস্পর্শে সেকালের জাতিবর্ণের বৈষম্যের অবসান হল না বরং শাসকদের কৌশলে শহরেও তা জাঁকিয়ে বসল আর তার সঙ্গে ধনবৈষম্যের বৈকট্য যুক্ত হল। এই দুই বৈষম্যের আঘাতে কলকাতার মন ফেটে চৌচির হয়ে গেল। কলকাতার দৈহিক বিকাশ হল ‘বারোক’ শহরের কিম্ভূতকিমাকার রূপে। গড়নের মধ্যে যান্ত্রিকতা ফুটে উঠল সর্বত্র যেমন বাড়িঘরে, পথেঘাটে, উদ্যানে ও ময়দানে। প্রকৃতিকে খণ্ডছিন্ন বিক্ষিপ্ত করে ছড়িয়ে দিয়েও এই যান্ত্রিকতা ঢাকা গেল না বরং তা আরও বিকৃত ও কুৎসিত হল। কলকাতার জীবনের ব্যাপক বিকৃতি রূপায়িত হল তার দৈহিক স্থাপত্যের মধ্যে। কলকাতার মন হল বিবর্ণ বিকৃত যান্ত্রিক। কলকাতার সমাজ হল এক্সচেঞ্জ—মার্কেট, বিনিময়ের বাজার যেখানে টাকার বিনিময়ে সবকিছু কেনা যায় এবং সবই বিনিময়যোগ্য পণ্য, মানুষ পর্যন্ত। শুধু যে মানুষকেই কেনা যায় তা নয়, মানুষের মনও কেনা যায় টাকার বিনিময়ে। মর্যাদা—খ্যাতি—প্রতিপত্তি এসব সমাজের নিলেমে ডাক দিয়ে উচ্চদামে কেনার বস্তু মাত্র। নিলেমের মাল। খেতাব—উপাধি এসব বাহারে প্যাকেট বা মোড়ক, মালবিকোনোর জন্য। যত পচা মাল তত বেশি তার মোড়কের বাহার। নাগরিক মন যত বিবর্ণ ও বিকৃত হতে থাকে তত তার নিত্যনতুন লেবেল ও মোড়ক বদলায় এবং বোঝা যায় যে লেবেলের তলায় যে মন তা শীতের পাষাণের মতো হিমশীতল, কোনো উত্তাপ নেই তার মধ্যে। তাই কৃত্রিম তাপের জন্য কলকাতার মন সর্বদাই উন্মুখ। তাপ মানে উত্তেজনা, প্রবল থেকে প্রবলতর উত্তেজনা।
১৯৬৫
……….
* They live in a wild unsettled condition at Chuttanutee neither fortifyed houses nor godowns, only tents, huts and boats (May 25, 1691),
* লেখকের ‘বাদশাহী আমল’ গ্রন্থের নতুন সংস্করণ (১৯৭৭) দ্রষ্টব্য।