টাইম মেশিনের টোপ
সাত কি সতেরো হাত ফেরত, বলা যাবে না। তবে এই পালিশ-চটা পুরোনো টেবিলটা নিঃসন্দেহেই ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিতে চলেছে। রাসেল এক্সচেঞ্জ থেকে রবিবারের অকশনে কেনা টেবিলটা কোনও আহামরি বস্তু নয়। নয় বলেই অবশ্য রিসার্চ স্কলার সায়ন্তন মুখার্জি প্রায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অ্যান্টিক বিশেষজ্ঞদের চোখের সামনে থেকে মাত্র ন-শো টাকায় রাইটিং ডেস্কটা হস্তগত করতে পেরেছে।
পরের দিনই টেবিলটা ডেলিভারি নিল সায়ন্তন। সস্তায় ভাড়া-করা নড়বড়ে টেম্পো। টায়ারে গ্র্যাটিস মারা। তার ওপর সায়ন্তন থাকে শিবপুরে। লক্ষ লক্ষ ঝাঁকানি খেয়েছে টেবিলটা। এই ঘটনারও গুরুত্ব কম নয়। না হলে, ডেস্কের ডানদিকের ড্রয়ারটা খসে পড়ত না এবং ওই গুপ্তকক্ষটা এতকালের মতো সায়ন্তনেরও অগোচরেই থেকে যেত।
সোম থেকে বুধ বাড়ি থেকে বেরোয়নি সায়ন্তন। টেবিলের পেছনে ছোট্ট একটা খুপরির মধ্যে থেকে উদ্ধার করেছে বিয়াল্লিশ পাতার একটি ইংরেজি পাণ্ডুলিপি। এইটাই তাকে বিভোর করে রেখেছে। কোনও সন্দেহ নেই যে, এটি এক টাইম মেশিন নির্মাতার নোটবই। নোটবইয়ের শেষ পাতায় লেখক পুরো নাম লেখেননি, শুধু আদ্যক্ষর এইচজিডব্লিউ। আদ্যক্ষরের নীচে সম্ভবত লেখা শেষ হওয়ার তারিখ, ১৫ জানুয়ারি ১৮৯৩।
সায়েন্স কলেজ ও ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে পরবর্তী দু-দিন বৃথা নষ্ট করল সায়ন্তন। ওই আদ্যক্ষরের সূত্র ধরে এমন কোনও বিজ্ঞানীর সন্ধান মেলেনি, যিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে ফোর্থ ডাইমেনশন নিয়ে কাজ করেছিলেন। এরপরে আবিরকে ফোন করা ছাড়া উপায় ছিল না।
এ তো দুরূহ প্রবলেম রে! তা ধরো, যদি বলি এইচ জি ওয়েলস–চলবে? এই ভদ্রলোক টাইম মেশিন নামে একটা ছোট্ট উপন্যাস লিখেছিলেন। তাতে ফোর্থ ডাইমেনশনেরও উল্লেখ আছে। কোনও কথা সোজা করে বলা আবিরের ধাতে নেই।
একটু দোটানায় পড়ে সায়ন্তন। আবির তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ঠিকই, কিন্তু তা হোক, এখনই কি সবটা খুলে বলা উচিত? আবার এটাও ঠিক যে, আবিরকে বাদ দিয়ে একা তার পক্ষে এগোনোও সম্ভব নয়। শোন আবির, ব্যাপারটা জরুরি। ওই টাইম মেশিন বইটা একবার পড়াতে পারবি?
জরুর। ওটা কিন্তু সায়েন্স নয়, সায়েন্স ফিকশন।
বুঝেছি, বুঝেছি।
শুধু বইটা পেলেই হবে? নাকি ফিমেরও একটা ক্যাসেট দরকার?
ফিলম হয়েছে টাইম মেশিন?
জি হুজুর। অবশ্য বই প্রকাশের কমপক্ষে ছ-দশক বাদে।
১৮৯৩। পাণ্ডুলিপি রচনার সালটা আচমকা মনে পড়ে গেল সায়ন্তনের। আচ্ছা আবির, সায়ন্তন রুদ্ধশ্বাসে প্রশ্ন করে, ওয়েলসের উপন্যাসটা কবে লেখা হয়েছিল জানিস?
কবে লেখা বলতে পারব না, ১৮৯৫-এ ছাপা হয়।
বই এবং দু-দুটো ক্যাসেট হাতে পরের দিনই হাজির আবির। প্রতিশ্রুতির অতিরিক্ত ব্যাক টু দ্য ফিউচার নামে একটা ফিমের ক্যাসেট সংগ্রহ করেছে। এটা ওয়েলসের গল্প অবলম্বনে তৈরি না হলেও, কারবারটা টাইম মেশিন নিয়েই। প্রয়োজনমতো ফাস্ট ফরওয়ার্ড করে ক্যাসেটে ভরা টাইম মেশিন দুটোকে ভালো করেই পর্যবেক্ষণ করে নিয়েছে সায়ন্তন। এবং বেজায় হতাশ হয়েছে, রাবিশ! যেমন রড টেলরের টাইম মেশিন, তেমনই লয়েডের ডি-লরিয়ান গাড়ি। বোগাস!
হতাশাব্যঞ্জক নতুন এক-আধটা সমার্থক শব্দের সন্ধানলাভের এমন সুযোগ খারিজ করে দিল আবির। টাইম মেশিন বইটা এগিয়ে দিয়ে বলল, চূড়ান্ত অভিমত পেশ করার আগে দেখা দরকার, স্বয়ং ওয়েলস তোকে সন্তুষ্ট করতে পারেন কি না!
দ্রুত পাতা উলটে টাইম মেশিনের মডেলের বিবরণে পৌঁছে থমকে যায় সায়ন্তন। আপন মনে বলে, ব্লক ওয়ার্ক? ঘড়ির যন্ত্রাংশ? বেশ, বেশ। কিন্তু শক্তি জোগাচ্ছে কে? শুধু স্প্রিং–এর ভরসায় তো হবে না।
আরও কয়েক পাতা উলটে মূল টাইম মেশিনের বর্ণনার অংশে পৌঁছেছে সায়ন্তন। দুর্দান্ত! অসাধারণ। ওয়ান্ডারফুল! এক-একটা লাইন পেরোয় আর একটি করে বিশেষণ প্রয়োগ করে। বইটা নামিয়ে রেখে আবিরের দিকে তাকাল সায়ন্তন, অসাধারণ। ওসব ফিল্ম-টিম কিছু নয়। আসল জিনিস এখানেই আছে। কোয়ার্টজ। শুধু এই একটি ক্ল ছাড়া আর কিছু ভেঙে বলেননি ওয়েলস। কিন্তু ওইটুকুই যথেষ্ট। আর কোনও সন্দেহ নেই যে, স্বয়ং ওয়েলসের লেখা টাইম মেশিন তৈরির অপ্রকাশিত কারিগরি বৃত্তান্ত এখন আমার পকেটে। বুঝলি আবির, উপন্যাসে উনি আসল কথাটা কায়দা করে এড়িয়ে গেছেন, অথচ মিথ্যেও লেখেননি। সিঙ্গল ক্রিস্টাল–এই বিশেষণটা বর্জন করে শুধু কোয়ার্টজ। না হলে এত দিনে কেউ-না-কেউ নিশ্চয় অসিলেটর সার্কিটের গন্ধ পেয়ে যেত।
এইসব অশ্বত্থামা হত ইতি উক্তিকে আমি সত্যভাষণের মর্যাদা দিতে রাজি নই। আবিরের আবেগবিহীন মন্তব্য।
আবির সাহিত্যের ছাত্র। কিন্তু তাহলেও গত এক সপ্তাহ তাকে সায়ন্তনকে সঙ্গ দিতে হয়েছে। কিছু বুঝুক বা না, ঘাড় নেড়ে উৎসাহিত করেছে বন্ধুকে। নানা দিক থেকে সায়ন্তন ওয়েলসের থিয়োরিগুলো বাজিয়ে দেখেছে। তত্ত্বগতভাবে ওয়েলস টাইম মেশিন নির্মাণের কৌশল পুরোপুরি আয়ত্ত করেছিলেন–এ কথা মানতে দ্বিধা নেই সায়ন্তনের। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও স্পষ্ট যে, ওই তত্ত্বকে কার্যকর করার মতো অগ্রগতি ঘটেনি সে যুগে ইলেকট্রনিক্স বিদ্যার। টেকনিক্যাল দিক থেকে আবিরের কোনও ভূমিকা গ্রহণের সুযোগ নেই, কিন্তু পাণ্ডুলিপিটা ওয়েলস কেন তাঁর লেখার টেবিলের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলেন, সে সম্বন্ধে তার অভিমত খুবই যুক্তিপূর্ণ। টাইম মেশিনের উদ্ভাবন মানবসমাজের পক্ষে ক্ষতিকর হতে পারে বলে নিশ্চয় দুর্ভাবনা ছিল তাঁর। তাই টাইম মেশিন নিয়ে শুধু সাহিত্যরচনার ভান করেছেন।
টাইম মেশিন তৈরির ব্যবস্থা করতে তিন মাস কেটে গেছে। এখন বোঝা যাচ্ছে যে, যন্ত্রটা তৈরি করার খরচ আয়ত্তের মধ্যে থাকলেও প্রয়োজনীয় শক্তিক্ষেত্র সৃষ্টির জন্য জ্বালানি সংগ্রহ অত সহজ হবে না। বছর দুই-তিনের জন্যও ভবিষ্যতে পাড়ি জমাতে হলে যা খরচ হবে, সেটা চাঁদে রকেট পাঠানোর চেয়ে কম নয়। পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করতে পারলে অনেকটাই সুরাহা হবে, কিন্তু তখন ভারতীয় বিজ্ঞানী সায়ন্তনের আর প্রোজেক্টটার ওপর কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকবে না।
গণিতের হিসেব অনুসারে সায়ন্তন ভেবেছিল, টাইম মেশিনে চড়ে প্রথমবার সে দিন পনেরোর মতো ভবিষ্যতে পাড়ি দিতে পারবে। অর্থাৎ দু-সপ্তাহ বাদে পৃথিবীতে কী ঘটবে, তার খোঁজখবর সংগ্রহ করা যাবে। কিন্তু কার্যত সাত দিনের মাথায় তাকে ফিরে আসতে হয়েছে। সায়ন্তন হতাশ হলেও আবির হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে। পৃথিবীর ঘড়ির কাঁটার হিসেবে চার ঘণ্টা সাতচল্লিশ মিনিট আবিরকে একটা বন্ধ ঘরের মধ্যেই কাটাতে হয়েছে। দুর্বিষহ সেই প্রতীক্ষা। এই কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সাত দিন এগিয়ে গিয়েছিল সায়ন্তন টাইম মেশিনে চড়ে। কিন্তু সায়ন্তনের তখন কী ঘটছে, কিছুই জানতে পারেনি আবির। গহন বনে সন্ধে নামার মুখে ঝিঁঝিপোকাদের ঐকতানের মতো ধারালো গুঞ্জন তুলে ও রঙের রামধনু ছিটিয়ে টাইম মেশিন তার যাত্রা শুরুর পর্বে দশ-পনেরো সেকেন্ডের মধ্যেই উধাও হয়ে গিয়েছিল। পূর্বপরিকল্পনামতো সায়ন্তনের সঙ্গে তারপরে আর টেলিকমিউনিকেশন সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। আবিবের বিজ্ঞানচেতনার অভাবকে তার জন্য দোষী সাব্যস্ত করলে ভুল করবে সায়ন্তন, প্রকৃতির এমন কিছু নির্দেশ আছে, যা আজ অবধি অমান্য করার সুযোগ পায়নি মানুষ।
সায়ন্তন একটা টেপরেকর্ডার সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল, যাত্রা শুরুর মুহূর্ত থেকেই ধারাবাহিক বিবরণ রেকর্ড করার জন্য। কিন্তু ফিরে আসার পর দেখা গেল, উচ্চ বিদ্যুৎ চৌম্বকক্ষেত্র টেপটাকে নষ্ট করে দিয়েছে। আবির বলল, তার মানে, ভিডিয়ো ক্যামেরা নিয়ে গেলেও তার একই হাল হত। ভবিষ্যতের কোনও ছবি বা শব্দ রেকর্ড করে আনা সম্ভব নয়।
এই মুহূর্তে হয়তো সম্ভব নয়। কিন্তু সে যা-ই হোক, আমার স্মৃতি ডিস্টার্বড় হয়নি। যা দেখেছি বা শুনেছি, সব মনে আছে।
তাহলে, ডিটেলগুলো ভুলে যাওয়ার আগেই তোর ভ্রমণবৃত্তান্তটা রেকর্ড করে নেওয়া দরকার।
টেপরেকর্ডার ও আবিরকে সামনে বসিয়ে প্রায় নব্বই মিনিট স্মৃতিচারণা করেছে। সায়ন্তন। হাওড়া ও কলকাতার চৌহদ্দির বাইরে যেতে পারেনি সায়ন্তন। এবং মাত্র সাত দিনের মধ্যে একটা শহরের ছবি কতটুকুই বা বদলায়! ভবিষ্যৎ থেকে উল্লেখ করার মতো খবর বলতে দুটি সংগ্রহ করেছে সে। পরশু সারা কলকাতা এক ভয়াবহ যানজটে প্রায় সাত ঘণ্টা অচল হয়ে থাকবে। দ্বিতীয়ত, ছ-দিন পরে, আগামী শুক্রবার ক্যালকাটা ল্যাম্প কোম্পানির বেকার শ্রমিক ডোমজুড় নিবাসী রশিদ আলি লটারিতে কুড়ি লক্ষ টাকার প্রাইজ পাবে। আগামী শুক্রবার যে আনন্দবাজার পত্রিকাটি প্রকাশিত হবে, সেটা দেখার সুযোগ পেয়েছে। সচিত্র প্রতিবেদন থেকে সায়ন্তন দেখেছে, রশিদের টিকিটের নাম্বার ২০৭১৪৫৷ রশিদের সংসারে আটটি মানুষ। তাদের মুখে অন্ন জোগাবার দায়িত্ব পালন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছিল তার পক্ষে। দেনায় ডুবে গিয়েছিল। ঠিক এই সময়ে এই অভাবনীয় পুরস্কার। রশিদকে ঘিরে ক্যালকাটা ল্যাম্পের শ্রমিকদের এক করুণ বৃত্তান্ত দিয়েছেন সংবাদদাতা। কাগজের একটা কপিও হস্তগত করেছিল সায়ন্তন, কিন্তু আনতে পারেনি। মনে হচ্ছে ভবিষ্যতের কোনও বস্তুকে বর্তমানে নিয়ে আসা সম্ভব নয়।
টাইম মেশিনের দৌলতে সংগ্রহ-করা তথ্য যাচাই করার প্রথম সুযোগ আজই পাবে ওরা। ভবিষ্যতে ভ্রমণের সময়ে অচল কলকাতার একঝলকমাত্র দেখেছিল সায়ন্তন। আজ সেই দিন। হাওড়া ব্রিজের পুব মুখে সকাল দশটা থেকেই দাঁড়িয়ে আছে দু-জনে। এগারোটা নাগাদ ব্রেক ফেল করল একটা অয়েল ট্যাংকারের। ব্রিজের মাঝামাঝি জায়গায়। একটা লরি ও ট্রামের সঙ্গে সংঘর্ষে ছড়িয়ে পড়ল তেল। অগ্নিকাণ্ড। মুহূর্তের মধ্যে তুলকালাম কাণ্ড। সবাই পালাতে চায়। যানজটের সূচনা হয়ে গেছে।
আচ্ছা সায়ন্তন, তুই যদি এই অয়েল ট্যাংকারটার নাম্বার জেনে আসতিস, আর আমরা ওটাকে আজ ডিপো থেকে বেরোতে না দিতাম, তাহলে কী হত বলতে পারিস?
কঠিন প্রশ্ন।
কিন্তু প্রশ্নটা ভাইটাল। ভবিষ্যৎ দুনিয়া থেকে খবর সংগ্রহ করে বর্তমানকে বদলে দেওয়া যায় কি না, বা তার ফল কী হতে পারে ভেবে দেখা দরকার।
সায়ন্তনের ঘরে পা রেখেই থমকে দাঁড়াল আবির, এ কী! তার দৃষ্টি অনুসরণ করে সায়ন্তন লক্ষ করল, টেপরেকর্ডারটা মুখ হাঁ করে রয়েছে। এবং ক্যাসেটটা উধাও, যে ক্যাসেটে সায়ন্তন তার অভিজ্ঞতা রেকর্ড করেছিল। দু-জনেই একসঙ্গে ছুটে গেল পাশের ঘরে। না, টাইম মেশিন চুরি হয়নি। মিনিট দশ-বারো অনুসন্ধানের পর এখন বোঝা যাচ্ছে, ক্যাসেট ছাড়া আর কিছুই খোয়া যায়নি।
ক্যাসেট চোরকে ধরার জন্য গোয়েন্দা নিয়োগের দরকার হবে না। এটা সুনীল সেন ছাড়া আর কারও কীর্তি নয়। একটা ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানার মালিক সুনীল। নিজে হাতে কাজ করে, জটিল যন্ত্রাংশ নির্মাণে খুবই দক্ষ। সুনীলের কারখানা থেকে টাইম মেশিনের কয়েকটা পার্টস তৈরি করা হয়েছিল। ফিটিং-এর সময় কিছু অসুবিধে দেখা দেয়, তাই সুনীলকে কয়েকবার বাড়িতেও ডাকতে হয়েছে। তখনও টাইম মেশিন পুরোপুরি তৈরি হয়নি, তা সত্ত্বেও তার চেহারা দেখে সুনীল অবাক হয়েছিল। বারবার প্রশ্ন করেছে, জানতে চেয়েছে যে, এই মেশিনটা কী কাজে লাগবে! থিয়োরিটিক্যাল পদার্থবিদ্যার দোহাই দিয়ে সুনীলের কৌতূহলকে যে মেটানো যায়নি, আজ তার প্রমাণ মিলেছে।
সায়ন্তন বলল, ক্যাসেটটা হাতিয়েও কোনও লাভ হবে না সুনীলের। টাইম মেশিন তৈরির কোনও হদিশ পাবে না।
টাইম মেশিন তৈরি করার চেষ্টা করবে না সুনীল। সে চাইবে লটারির টিকিটটা, যাতে রশিদের জায়গায় ওই কুড়ি লক্ষ টাকার পুরস্কারটা তার পকেটে আসে।
সায়ন্তনের সুরে হতাশা, তাহলে, টাইম মেশিন তৈরি করার সুবাদে আমরা প্রাইজটা একটি দুঃস্থ মানুষের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে সুনীলের হাতে তুলে দিলাম।
এখনই সে কথা জোর দিয়ে বলা যাবে না। দেখাই যাক।
আবিরই টেনে আনল সায়ন্তনকে, ক্যালকাটা ল্যাম্পে। শুধু ডোমজুড় বললে তো হবে না। বাড়ির ঠিকানাটা চাই। কারখানার গেটে তালা, কিন্তু উলটোদিকেই শ্রমিক পঞ্চায়েতের অফিস। রশিদের নাম শুনেই বয়স্ক ভদ্রলোক ভুরু কুঁচকে তাকালেন, হল কী বলুন তো, হঠাৎ জনে জনে রশিদের খোঁজখবর শুরু করল কেন? এই তো কালই এক ভদ্রলোক এসেছিলেন। ঠিক আপনাদের মতোই…
কথাটা ঘুরিয়ে দিয়ে আবির বলল, ওহ হে, এসেছিল তাহলে! আমরাই পাঠিয়েছিলাম। দেখুন তো, খবরটা নিয়ে গেল অথচ জানাল না। শুধু শুধু আমাদের দৌড় করাল। এরপর ভদ্রলোক আর রশিদের ঠিকানা দিতে দ্বিধা করেননি।
পরের দিন সকাল সাড়ে নটায় ডোমজুড়ের বাস ধরেছে। রশিদের বাড়ি খুঁজে বের করতে অসুবিধে হয়নি। থানার দু-স্টপ আগে বাস রাস্তা থেকে হাঁটা-পথে মিনিট দশেক। একটা ভোলা উঠোন ঘিরে ছ-সাত ঘর মানুষের বাস। বাচ্চাদের ফৌজ তাদের রশিদের দরজা চিনিয়ে দিয়েছে। ইট-বিছোনো দাওয়ায়। বসে রশিদের বউ ও দুই মেয়ে ঠোঙা তৈরি করছে। খালি গায়ে বেরিয়ে এল রশিদ। শরীরটা এককালে মজবুত ছিল। হাড়ের খাঁচাটা তার সাক্ষী।
নমস্কারের পর আর এগোতে দেয়নি রশিদ, আপনারাও আবার লটারির টিকিট গছাতে এসেছেন নাকি? কী ব্যাপার বলুন তো! কিছুই তো মাথায় ঢুকছে না। কবে এক-আধবার লটারির টিকিট কেটেছি, আর আমার কাছেই যত… কাল একজন… আজ আপনারা। তা ও আবার অষ্টগন্ডা প্রশ্ন। টিকিট কাটলে কোত্থেকে কাটি, কোন লটারি পছন্দ করি!
রশিদের বউ মাথা না তুলেই বলল, চাকরি থাকতে তা-ও একরকম। এখন দু-তিন টাকাও অমন জলে ঢালা পোষাবে না। গলার স্বর শুনেই বোঝা গেল, রশিদ টিকিট কাটলে বউকে লুকিয়েই কাটবে।
রশিদ যতই রাগ করুক, আসল কথাটা বের করে নেওয়া গেছে, যার খোঁজে সুনীলও কাল হানা দিয়েছিল। ডোমজুড় বাজারের কাছে লক্ষ্মী লটারি সেন্টার থেকে টিকিট কাটে রশিদ।
লক্ষ্মী লটারি সেন্টার থেকে জানা গেল, গতকালই এই কাউন্টার থেকে ২০৭১৪৫ নম্বর টিকিট বিক্রি হয়েছে। খরিদ্দার নিজে বেছে নিয়েছিল টিকিটটা। টিকিট বইয়েও দেখা গেল, ওই নম্বরের আগে ও পরে অনেক টিকিট এখনও বিক্রি হয়নি।
সুনীল পুরোপুরি গা-ঢাকা দিয়েছে। বাড়িতেও বলে যায়নি কোথায় যাচ্ছে। দিনকয়েক বাদে ফিরবে, এ ছাড়া কেউ কিছু বলতে পারেনি। মনে হচ্ছে, পুরস্কারের টাকা পকেটে না ভরে আর মুখ দেখাবে না।
সায়ন্তন বলল, টিকিট যখন হাতিয়েছে, প্রাইজও পাচ্ছে।
আবির তবু হাল ছাড়েনি। রোজ সকালে একবার সুনীলের কারখানায় যায় খবর নিতে। পুরস্কার ঘোষণার আর একদিন বাকি যখন, সকাল সাড়ে দশটায় সুনীলের কারখানার কারিগরদের কাছ থেকে দুর্ঘটনার খবর শুনল আবির। দু-দিন অচৈতন্য অবস্থায় কাটিয়েছে সুনীল হাসপাতালে। বড়গাছিয়ার কাছে বাস রাস্তার ধারে তাকে মাথায় ডান্ডা মেরে ফেলে দিয়েছিল দুষ্কৃতীরা। স্থানীয় অধিবাসীরা পরের দিন সকালে তাকে অচৈতন্য অবস্থাতেই হাসপাতালে নিয়ে এসেছিল। পকেটে কোনও পরিচয়মূলক কাগজপত্র ছিল না, তাই বাড়িতেও খবর দেওয়া যায়নি। জ্ঞান ফেরার পর সুনীল নাম-ঠিকানা জানিয়েছে। প্রাণের ভয় আর নেই, কিন্তু আংশিকভাবে স্মৃতিভ্রংশ ঘটেছে। আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা একটুও মনে নেই। বারবার শুধু একই কথা বলছে, বড়গাছিয়ায় গিয়েছিল সস্তায় উড স্ক্রু কিনতে।
সায়ন্তনকে নিয়ে সুনীলের বাড়িতে হাজির হল আবির। ডাক্তারের কাছ থেকে দেখা করার অনুমতি সংগ্রহ করেছে, কিন্তু লাভ হয়নি। ওদের চিনতেই পারছে না সুনীল। রশিদ ক্যালকাটা ল্যাম্প বা লক্ষ্মী লটারির নাম করে নানাভাবে ওরা চেষ্টা করেছে, কিন্তু এই অধ্যায়টা পুরোপুরি বিস্মৃত সুনীল। ফেরার আগে বাড়ির লোকেদের মুখে শুনল, পুলিশের সন্দেহ, সুনীল ডাকাতদের হাতে পড়েছিল। মানিব্যাগ, ঘড়ি, আংটি–সব খোয়া গেছে।
সাতসকালে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল সায়ন্তনের। কখন খবরের কাগজ দিয়ে যাবে, তার জন্য ধৈর্য ধরতে পারেনি। কাগজের গাড়ি আসে বাজারের কাছে। সেখান থেকেই কিনে এনেছে আনন্দবাজার। প্রায় ছুটে বাড়ি চলে এসেছে সায়ন্তন। কাগজে চোখ গুঁজেই সে নিঃসন্দেহ যে, টাইম মেশিন অব্যর্থ। ঠিক এই ছবি আর সংবাদই সে দেখেছিল ভবিষ্যৎ ভ্রমণের সময়ে। বলা বাহুল্য, রশিদই শেষ পর্যন্ত পুরস্কার পেয়েছে, আর তার টিকিটের নম্বর ২০৭১৪৫। সায়ন্তন অবশ্য এত খুঁটিয়ে খবরটা তখন পড়েনি। অবশ্য পড়লেও শেষ পরিচ্ছেদের এই রসিকতার মর্ম তখন তার পক্ষে বোঝা সম্ভব হত না। সংবাদদাতা লিখছেন, প্রাইজ পাওয়ার পরেও লাখপতি রশিদ কিন্তু তাঁর স্ত্রী-কে এখনও আগের মতোই ভয় পান। রশিদ আলির বিবি লটারির টিকিট কেটে পয়সা নষ্ট করা পছন্দ করেন না। রশিদ পুরস্কার পাওয়ার পরেও তিনি তাঁর অভিমতে অচল। ফলে রশিদও কিছুতেই কবুল করতে রাজি নন যে, স্ত্রী-র ইচ্ছার বিরুদ্ধে তিনি টিকিট কেটেছিলেন। শুনতে হাস্যকর মনে হলেও রশিদ বারবার বলেছেন, টিকিটটা তিনি ক-দিন আগে বাস রাস্তার ধারে কুড়িয়ে পান।
টেলিফোন বেজে উঠল। জানা কথা, আবির। উত্তেজনায় সায়ন্তনের কথা গুলিয়ে যাচ্ছে, হয়েছে, হয়েছে। যা ভেবেছি। টাইম মেশিনের মার নেই। সব সত্যি। বল?
প্রশান্তস্বরে আবির বলল, তোর বৈজ্ঞানিক বা কারিগরি অ্যাচিভমেন্ট নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। ওয়েলসের পাণ্ডুলিপিটা যদি পুরো হজম করে দিস, তাহলে হয়তো নোবেল প্রাইজও পেয়ে যাবি। কিন্তু আমার চিন্তা ইতিহাস নিয়ে।
তার মানে?
মানে অতি সরল। এটা ধরেই নিচ্ছি যে, সুনীল বড়গাছিয়ায় আক্রান্ত হয়। টাকাপয়সার অতিরিক্ত কিছু কাগজপত্রও হস্তগত করেছিল দুষ্কৃতীরা। সেগুলো আবর্জনা ভেবেই তারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যায় পালাবার সময়ে। তার মধ্যে নিশ্চয় লটারির টিকিটটাও ছিল। এবং সেটা ইতিহাসের নির্দেশ অনুসারেই ডোমজুড়ের কাছে রশিদ আলির চলতি পথে পরিত্যক্ত হয়।
বেশ তো! তাতেই বা হলটা কী?
যা হওয়ার তা-ই হল, শুধু একটা প্রশ্ন রয়ে গেল। ইতিহাস বলতে আমরা সাধারণত তার লিখিত বা নথিভুক্ত বিবরণের কথা ধরি। সেটাকেই ইতিহাসের মূলস্রোত বলা হয়। সেই ইতিহাস হয়তো পরিবর্তিত হয়নি। কিন্তু…
প্লিজ, আর-একটু স্পষ্ট করে…
স্পষ্ট! স্পষ্ট নিরেট মূর্খ! তবে শোন। আমার একটাই প্রশ্ন। তুই যদি টাইম মেশিনে না। চড়তিস, তাহলেও কি সুনীল সেনকে মাথায় ডান্ডার বাড়ি খেতে হত?
[আনন্দমেলা, পূজাবার্ষিকী ১৯৯৩]