টাইপ-রাইটার
তখন আমার বন্ধুদের মধ্যে দু-একজন সবে সিগারেট-টিগারেট খায়, সেও মোটামুটি লুকিয়ে-চুরিয়ে। দাদার বন্ধুরা কিন্তু মদ ধরেছে।
অনেকদিন আগের কথা। কলেজে পড়ার বয়স সেটা। আমি পড়তাম, দাদা কলেজ-টলেজে পড়েনি। লেখাপড়ায় দাদার মোটেই আস্থা ছিল না।
আমরা থাকতাম সেই কালীঘাটের পুরনো বাড়ির দোতলায়–পাশাপাশি দুটো ছোট ঘরে। ঘরের সামনে একটা একচিলতে পূর্বমুখী বারান্দা। সেই বারান্দায় দড়ি দিয়ে ঝোলানো ছিল একটা ঘণ্টা। ঘন্টাটা পিতলের বা কাসার, ঠাকুমার পুজোর সামগ্রীর মধ্যে ওটা আমরা পেয়েছিলাম। বেশ ভারী, পুজো করার সময় পুরোহিতেরা যেরকম ঘণ্টা হাতে দুলিয়ে বাজান–সেই জাতের ঘণ্টা, তবে অপেক্ষাকৃত বড় সাইজের। আর শব্দটাও একটু গম্ভীর প্রকৃতির। ছোটবেলায় আমরা শুনেছি, দেশের বাড়িতে এ ঘণ্টাটাকে বলা হত কাঠমাণ্ডুর ঘণ্টা। কবে কোনকালে কে যেন চৈত্র মাসে পশুপতিনাথের মেলায় গিয়ে কিনে এনেছিল। সেসব আমাদের জন্মের ঢের আগের কথা।
তবে একটা কথা বলে রাখি, শুধু এ কাঠমান্ডুর ঘণ্টাই নয়–এইরকম আমাদের বাড়ির অনেক জিনিসের গায়েই–সেগুলো যেখানে থেকে এসেছে–সে জায়গার নামের ছাপ দেওয়া ছিল। কাশীর কলসি ছিল, ছিল পুরীর লাঠি, হরিদ্বারের থালা। আর শুধু জিনিসপত্রের কথা নয়, জীবজন্তু, গাছপালা–তার পরিচয়ও আমাদের জায়গা দিয়ে। দেওঘরের পেয়ারা বা ধামরাইয়ের কুলগাছ– সেও আমাদের দেশের বাড়িতেই ছিল এবং শুধু তাই নয়, আরও ছিল সরাইলের কুকুর আর ঢাকার বেড়াল।
জীবজন্তু বা গাছপালা দেশের বাড়ি থেকে নিয়ে আসা সম্ভব ছিল না, কিন্তু পাকিস্তান হওয়ার পরে জিনিসপত্র কিছু কিছু আমরা কলকাতায় কালীঘাটের বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম তার মধ্যে পুজোর জিনিসপত্র ছিল। বোধ হয় চিন্তাটা ছিল এরকম যে, পাকিস্তানে পুজোআচ্চা চলবে না, তাই পুজোর সামগ্রীই সবচেয়ে আগে আনা হয়েছিল। যার একটি ছিল ওই কাঠমাণ্ডুর ঘণ্টা।
কাঠমাণ্ডুর ঘণ্টাটাকে আমরা দিশি কলিংবেল হিসেবে বারান্দায় টাঙিয়ে ছিলাম। বুদ্ধিটা ছিল দাদারই। ছাদের সঙ্গে দড়ি দিয়ে ঘণ্টাটাকে ঝুলিয়ে লম্বা পাটের দড়ির অন্য প্রান্ত সদর দরজার চৌকাঠের মাথায় একটা ফুটো করে রাস্তার দিকে বার করা ছিল। ওই দড়ি ধরে টানলেই দোতলায় ঘণ্টা বেজে উঠত। অনিবার্য কারণে সদর দরজায় দড়িটা যেখানে বার করা ছিল, ঠিক সেখানে দাদা আলকাতরা দিয়ে বড় বড় কাঠের পাল্লায় ওপরে লিখে দিয়েছিল, দোতলায় ঘন্টা বাজাইবার জন্য দড়ি একবার টানিবেন। বেশি টানিবেন না। ইহা গৃহস্থের বাড়ি, ফায়ার ব্রিগেড নহে। সাবধান!
বলা বাহুল্য, এই নির্দেশনামাটি যথেষ্টই প্ররোচনামূলক ছিল। ফলে এটা পড়ে অনেকেই, অনেক ভাল লোক পর্যন্ত, দড়ি ক্রমাগত টেনে যেত, যতক্ষণ পর্যন্ত দোতলার বারান্দায় কারও আবির্ভাব না হত। ফায়ার ব্রিগেডের মতো উচ্চ নাদে না হলেও ঢং ঢং করে বেজে যেত কাঠমাণ্ডুর ঘণ্টা।
সেদিনটা ছিল কালীপুজোর আগের দিন কিংবা আগের আগের দিন। আমাদের বাড়ির সামনেই ছিল পাড়ার কালীপুজোর মণ্ডপ। দুর্গাপুজো হত বড় রাস্তায় ট্রামলাইনের কাছে, কালীপুজোটা পাড়ার মধ্যেই আমাদের বাড়ির উলটোদিকের খালি তেকোণা জায়গায় হত। এখনও বোধ হয় তাই হয়।
সে যা হোক, সেদিন মণ্ডপে প্রতিমা নিয়ে আসা হয়েছে। আমি আর দাদা সেখানে দাঁড়িয়েছিলাম রাত বারোটা পর্যন্ত কিংবা তারও বেশি। দুর্গাপুজোর সময় দাদা ব্যবসা করতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছিল। পুজোমণ্ডপে দাদা শরবতের দোকান দিয়েছিল–রায় স্পেশাল ড্রিঙ্ক। লেমন জুসের সঙ্গে রোজ সিরাপ মিশিয়ে তিন রকম শরবত হার্ড ড্রিঙ্ক মিডিয়াম এবং সফট। কঁচালঙ্কা বেটে রস করে একটা কাঁচের শিশিতে রাখা ছিল। হার্ড ড্রিঙ্কে দশ ফোঁটা, মিডিয়ামে পাঁচ ফোঁটা আর সফটে মাত্র এক ফোঁটা। হার্ডের দাম চার আনা, মিডিয়ামে সাড়ে তিন আনা আর সফট তিন আনা। অষ্টমীর দিন এক দুর্ঘটনায় সে শরবত বিক্রি বন্ধ হয়ে যায়। তবে তার আগেই বোঝা গিয়েছিল, জিনিসটা পাবলিক নেবে না। তখন খাঁটি কোকাকোলা চার আনা, লেমনেড, অরেঞ্জ তিন আনা। লোকে কেন দাদার এই গোলমেলে শরবত খেতে যাবে! তা ছাড়া সে বছর পুজোর সময় কাঁচালঙ্কার দাম দারুণ চড়া, পাঁচসিকে দেড় টাকা সের। তখন এক সের মাংসের দাম আড়াই টাকা, তার মানে দেড় টাকা সেরের লঙ্কা ভয়াবহ ব্যাপার। পাইকারিতে সস্তায় পাওয়া যাবে বলে একসঙ্গে পাঁচ সের কাঁচালঙ্কা সাত টাকায় কিনে দাদা রস করিয়েছিল।
দাম বেশি ছিল বটে, কিন্তু সে যে কী ঝঝ ছিল সেই কঁচালঙ্কাগুলোর! ছাদে হামানদিস্তা দিয়ে লোক লাগিয়ে হেঁচানো হয়েছিল সেই লঙ্কা, এর পর যাবতীয় চড়ুই, পায়রা আর কাক এক মাস বর্জন করেছিল আমাদের ছাদ। এমনকী লঙ্কার জ্বালায় পাড়ার বেড়ালগুলো পর্যন্ত আমাদের বাড়িমুখো হয়নি বেশ কয়েক সপ্তাহ।
আমাদের পিছনের বাড়ির এক বৃদ্ধ প্রতিদিন ভোরবেলা ছাদে উঠতেন সূর্যপ্রণাম করার জন্যে। ঘেঁতো লঙ্কার খোসাগুলো আমাদের ছাদের এক পাশে উঁই করে রাখা ছিল। চতুর্থ না পঞ্চমীর শেষরাতে একটু ঘুর্ণিঝড়ের মতো–এখনও কোনও কোনও বছর যেরকম হয় আর কী–ভোরবেলা মেঘ কেটে গিয়েছে কিন্তু তুমুল হাওয়া বইছে, দাদা হঠাৎ ছাদে উঠে গেল, আমাকে বলে গেল, বেদম হাওয়া উঠেছে, এবার লঙ্কার খোসাগুলো হাওয়ায় উড়িয়ে দিই, সব কালীঘাট আদিগঙ্গায় গিয়ে পড়বে, বিজনেস সিক্রেট গোপন করে ফেলি।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ভয়াবহ আর্ত চিৎকারে পুরনো কালীঘাটের ঘুমন্ত পাড়া চমকিয়ে জেগে ওঠে। সেই কাঁচালঙ্কার জ্বলন্ত খোসার ঝড় বয়ে গিয়েছিল বৃদ্ধ সূর্যপ্রণামকারীর ওপরে। তারপর ডাক্তার, হাসপাতাল। কাঁচালঙ্কার জ্বালায় আমাদের নিজেদেরও বেশ জ্বলতে হয়েছিল। দাদার কথা ছেড়ে দিচ্ছি, দাদার শোধবোধ ছিল না, আমার নিজের মুখ চোখ লাল হয়ে গিয়েছিল। একসঙ্গে কয়েকশো পিঁপড়ে কামড়ালে যেমন যন্ত্রণা হওয়া সম্ভব, তাই হয়েছিল।
দাদার শিক্ষা হয়েছিল মহাষ্টমীর দিন। সপ্তমীর দিন শরবত ভাল বিক্রি হয়নি। পুজোর মেজাজ কোনও বছরই সপ্তমীতে বিশেষ জমে না। জমাটি পুজো শুরু হয় অষ্টমীর সন্ধ্যা থেকে। শহর, শহরতলি, গ্রাম, গঞ্জ থেকে দলে দলে কাতারে কাতারে লোক এসে উপচিয়ে পড়ে কলকাতার পুজোর প্যান্ডেলে। তখনই বেড়ে যায় খাওয়া-দাওয়া, ফুর্তির সওদা, কেনাবেচা।
দাদাও অষ্টমীর সন্ধ্যার জন্যে অপেক্ষা করে ছিল। কিন্তু গোলমাল হয়ে গেল দুপুরে।
কালীঘাট পাড়ায় চিরাচরিত রীতি অনুসারে মহিলারা অষ্টমীর দিন উপোস করেন। ঠিক নির্জলা উপোস নয়, ফল-শরবত এসব খাওয়া চলে। দুপুরবেলা সন্ধিপুজোর পরে যে মহিলারা অঞ্জলি দিতে এসেছিলেন, তাদের সবাইকে দাদা বিনি পয়সায় এক গেলাস করে শরবত উপহার দিলেন, বেশি করে লঙ্কার রস মেশানো স্পেশাল হার্ড ড্রিঙ্ক।
খালি পেটে সেই ঝাল শরবত দু-এক চুমুক খেয়েই প্রায় সকলের মাথা ঘুরতে লাগল। অনেকে মণ্ডপেই বমি করে ফেলল। অনেকের বাসায় ফিরে গিয়ে পেটে ভয়ানক যন্ত্রণা হতে লাগল। ডাক্তার এসে বালতি বালতি নুন জল খাইয়ে গলায় আঙুল দিয়ে বমি করিয়ে পেট খালাস করে তাদের রক্ষা করলেন।
পুজো কর্তৃপক্ষ দাদার শরবতের ব্যবসা বন্ধ করে দিলেন। প্যান্ডেলের পাশে দোকান করার জন্যে দাদা পঞ্চাশ টাকা আগাম দিয়েছিল, কর্তৃপক্ষ সে টাকাও বাজেয়াপ্ত করলেন।
ওই কালীপুজোর আগের দিন রাত বারোটা এবং তারপরে পর্যন্ত আমি আর দাদা প্যান্ডেলে কর্তৃপক্ষদের ধরাধরি করছিলাম, ওই আগাম পঞ্চাশ টাকা ফেরত পাওয়ার জন্যে। কর্তৃপক্ষ তাদের সিদ্ধান্তে অবিচল ছিলেন, এক পয়সাও ফেরত দেননি।
অনেক রাতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আমরা শুয়েছিলাম। ঘুম আসতে না আসতে সদর দরজায় ধাক্কাধাক্কির শব্দে জেগে উঠলাম। আমাদের বাড়িতে কোনও অভিভাবক না থাকায় দাদার বন্ধুরা আজকাল কেউ কেউ মদ খেয়ে গভীর রাতে এসে হল্লা করে, বিরক্ত করে। ঘণ্টা-টণ্টা তারা বাজায় না, দরজা ধাক্কাধাক্কি করা মাতালদের খুব পছন্দ।
একটু পরে ধাক্কাধাক্কির সঙ্গে ঘণ্টাও বাজতে লাগল, বেশ জোরে এবং দ্রুতলয়ে। তাড়াতাড়ি চোখ কচলাতে কচলাতে বারান্দায় এসে দেখি, দরজার কাছে সোয়েটার গায়ে এক ব্যক্তি ধাক্কা দিচ্ছে আর একটু পিছে পাড়ারই একটি বখা ছেলে দড়ি টেনে ঘণ্টা বাজিয়ে তাকে সাহায্য করছে।
দাদাও বারান্দায় আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ওখান থেকে হেঁকে জিজ্ঞাসা করল, কে রে ওখানে?
দাদার গলার আওয়াজ পেয়ে পাড়ার ছেলেটি সরে গেল। দ্বিতীয় ব্যক্তিটি, যার গায়ে সোয়েটার, সে বলল, মামু, আমি তমিজ। মকদমপুরের তমিজ।
আমি সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে তমিজকে উপরে নিয়ে এলাম। তমিজ মানে তমিজমামু। আমার মামাবাড়ির দেশের লোক। মামাবাড়িতেই কাজ করে। আমার মাকে দিদি বলে, গ্রাম সম্পর্কে আমরাও মামু বলি। তবে আমরা বাবুদের বাড়ির ছেলে বলে, আমরা বয়েসে অনেক ছোট হওয়া সত্ত্বেও তমিজমামু আমাদের নাম ধরে ডাকে না, দাদাকে বলে বড়মামু আর আমাকে বলে মাঝের মামু অর্থাৎ মেজমামু।
হেমন্তের শুরু, বাতাসে একটা হিম হিম ভাব। কিন্তু সোয়েটার গায়ে দেওয়ার সময় কলকাতায় এখনও হয়নি। বারান্দায় উঠে দেওয়ালের পাশে একটা জলচৌকি ছিল, সেখানে তমিজমামু বসল। এ বাড়ি তমিজমামুর চেনা। মামারবাড়ি থেকে গত কয়েক বছর পাকিস্তান হওয়ার পর থেকে জিনিসপত্র নিয়ে সে মাঝেমধ্যেই এখানে আসছে।
বারান্দায় আলোটা জ্বালিয়ে দিতে দেখলাম, সোয়েটার গায়ে দিয়ে তমিজমামু দরদর করে ঘামছে। শরীর থেকে সোয়েটারটা খুলতে খুলতে ভিতরের পকেট থেকে একটা চিঠি বার করে দাদার হাতে দিয়ে তমিজমামু ডুকরে কেঁদে উঠল, সর্বনাশ হয়ে গেছে! শেষরক্ষা করতে পারলাম না!
আমরা খুব ঘাবড়িয়ে গেলাম। দেশে কেউ মারা-টারা গেল নাকি, বুড়ো-বুড়ি বেশ কয়েকটা রয়েছে।
চিঠি পড়ে এবং তমিজমামুকে জেরা করে অবশ্য বোঝা গেল যে, ব্যাপারটা সত্যিই তেমন মারাত্মক কিছু নয়, অন্তত সর্বনাশ হওয়ার মতো নয়।
চিঠিটা আমার মাতামহের। দাদাকে এবং আমাকে যুগ্মভাবে লেখা। দীর্ঘ চিঠি, সে বিষয়ে পরে যাচ্ছি, আগে তমিজমামুর ব্যাপারটা বলি।
গ্রাম থেকে একটা পুরনো টাইপরাইটার যেটা আমার মাতামহ তাঁর পাটের অফিসের চিঠিপত্র লেখার কাজে ব্যবহার করতেন, আমাদের দুভাইকে পাঠিয়েছেন তিনি তমিজের মারফতে। বর্ডারে চেকপোস্ট দিয়ে এই টাইপরাইটার নিয়ে আসা যাবে না বলে তমিজমামু বর্ডারের কয়েক স্টেশন আগে ট্রেন থেকে নেমেছে। তারপরে সেখান থেকে ঘোড়ার গাড়িতে সাতক্ষীরা। সাতক্ষীরা থেকে নৌকোয় ভোমরা, বসিরহাট হয়ে কলকাতায়। কলকাতায় মানে কেষ্টপুরের খালে, এখন যেখানে সল্টলেক তারই পাশে। এরপর কেষ্টপুর থেকে কিছুটা পায়ে হেঁটে, তারপরে রিকশায়, শেষে বাসে।
সবশেষে নিরাপদে টাইপরাইটার নিয়ে ধর্মতলার মোড়ে নেমে যখন বাস বদলিয়ে কালীঘাটের বাসে উঠতে যাবে, তখন রাত প্রায় এগারোটা। এসপ্ল্যানেডের চারদিকটা কালীপুজোর মরশুম সত্ত্বেও নিঝুম হয়ে এসেছে। এসপ্ল্যানেডের বাসস্ট্যান্ডে যখন হাজরার বাসের জন্য তমিজমামু অপেক্ষা করছে, তিনজন সাদা পোশাকের পুলিশ এসে তাকে ধরে।
টাইপরাইটার ফুটপাতে নামানো ছিল। এদের মধ্যে একজন লাথি মেরে জিজ্ঞাসা করে, এ জিনিসটা কী?
যখন তমিজমামু জানায় যে এটা টাইপরাইটার, তারা বলে, চোরাই মাল, চলো থানায়, যেতে হবে। তমিজমামু অনেক অনুনয়-বিনয় করে কিন্তু তারা তাকে জোর করে বউবাজার থানার কাছে নিয়ে যায়, তারপর থানার সামনে থেকে গলাধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দেয়, বলে যে, এখন ভাগো। তোমার যা বলার আছে কাল সকালে এসে বড়বাবুকে বলবে।
তমিজমামুর বৃত্তান্ত শুনে আমরা খুব একটা বিচলিত হলাম না। পার্টিশনের পর বর্ডার পার করে জিনিস আনতে গিয়ে কত লোকের কত কিছু খোয়া গিয়েছে, এ তো সামান্য একটা পুরনো টাইপ-রাইটার! তাও ইংরেজি নয়, ফরাসি টাইপরাইটার!
ফরাসি টাইপ-রাইটারের ব্যাপারটা বলি। ফরাসি টাইপ-রাইটার ইংরেজি টাইপরাইটারের চেয়ে তেমন কিছু আলাদা নয়। যন্ত্রপাতি, অক্ষরাদি সবই প্রায় একরকম, তবে কিছু কিছু ফরাসি অক্ষরের মাথায় একরকম চিহ্ন আছে, যা ইংরেজি অক্ষরে অনুপস্থিত।
টাইপ-রাইটারটি আমার মাতামহ উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিলেন তাঁর খুল্লতাতের কাছ থেকে। আমাদের সেই খুল্ল-প্রমাতামহকে আমরা খুব ছোটবেলায় দেখেছি। তিনি আগুন খেতে পারতেন। ইংরেজিতে যাকে বলে ফায়ার-ইটার, তিনি সেই ফায়ার-ইটার ছিলেন। যৌবনকালে তিনি আস্ত মশালের আলো গিলে খেতে পারতেন, গনগনে জ্বলন্ত মশাল হাঁ করে মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতেন, সমস্ত আগুন নিঃশেষে খেয়ে নেবানো মশাল মুখ থেকে বার করে আনতেন। ও বিষয়ে তাঁর খুবই নামডাক ছিল, দূর-দূরান্তর এমনকী ঢাকা-কলকাতা পর্যন্ত তার খ্যাতি বিস্তারিত হয়েছিল।
সতেরো-আঠারো বছর বয়েসে এনট্রান্স পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে সেই খুল্ল-প্রমাতামহ বাড়ি থেকে পালিয়ে যান গারো পাহাড়ে। সেখানে মান্ধাই নামে এক পাহাড়ি উপজাতির সংস্রবে আসেন, তাদের কাছেই আগুন খাওয়া শেখেন এবং আরও অনেক কিছু।
দুরারোগ্য গোপন রোগের টোটকা চিকিৎসাও জানতেন তিনি। যত রাজ্যের যত দুশ্চরিত্র, দুশ্চরিত্রা এসে ভিড় করত তাঁর কাছে। কোনও কোনও কুলত্যাগিনীর সঙ্গে তাঁর নিজেরও নাকি গর্হিত সম্পর্ক ছিল। সে অপবাদ কখনও কখনও বাড়ির অন্যদের গায়েও লেগেছে।
এসব অনেককাল আগেকার কথা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হতে তখন ঢের বাকি। আমি, দাদা, আমরা কেউই তখনও জন্মাইনি। যাকে বলে গিয়ে বাবার বিয়ে, আমাদের বাবার বিয়ে পর্যন্ত হয়নি তখনও, মামারবাড়ি তো বহু দূরে।
সেই সময়ে ঢাকা শহরে এক ফরাসি জাদুকর খেলা দেখাতে এসেছিলেন। আমার মাতামহের কাকা নৌকোয় করে ঢাকায় গিয়ে সেই খেলা দেখেছিলেন। খেলার শেষে সেই ফরাসি জাদুকরের সঙ্গে দেখা করে তিনি তাঁকে নিজের আগুন খাওয়ার খেলা দেখান। অচিরেই দুজনার মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।
ঢাকা থেকে খেলা দেখিয়ে চট্টগ্রাম হয়ে বার্মায় যান ফরাসি সাহেব। আমাদের মাতামহের ওই কাকাও তাঁর সঙ্গে যান। বার্মা থেকে ইন্দোচিন হয়ে দেশে চলে যাওয়ার সময় সাহেব তার অনেক জিনিসপত্র–যার মধ্যে ওই টাইপ-রাইটারটিও ছিল–তাকে দিয়ে যান।
কালক্রমে টাইপরাইটারটি খারাপ হয়ে এসেছিল, তবে ব্যবহারযোগ্য ছিল। মাতামহের চিঠিতে জানা গেল যে, যন্ত্রটির সবই ঠিকঠাক আছে, শুধু ছোট হাতের এম অক্ষরটি খসে পড়ে গেছে আর কতকগুলো অক্ষরের মাথায় চিহ্ন দেওয়া আছে।
এসব সমস্যা সম্পর্কে মাতামহ তাঁর চিঠিতে সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছিলেন। সে এক দীর্ঘ চিঠি, সম্পূর্ণ লিখতে গেলে গল্প মারা যাবে। পুরনো চিঠির তাড়া খুঁজে চিঠিটা বার করে শুধু অনিবার্য অংশটুকু উদ্ধৃত করছিঃ
ওঁ ভগবান ভরসা।
নিরাপদে দীর্ঘজীবেষ্ণু
বাবাজীবনদ্বয়,
…এখন তোমাদের চারদিকে চাকুরির দরখাস্ত পাঠাইবার বয়েস হইয়াছে। হাতে লেখা দরখাস্ত সাহেবরা কোনও কালে পাঠ করেন না। টাইপ করিয়া দরখাস্ত পাঠাইবার জন্য তোমাদের এই মেশিন পাঠাইলাম।
এই মেশিনটি খুবই সৌভাগ্যপ্রদ। ইহা ঘরে আসিবার পরই
আমাদের পাটের ব্যবসা জমজমাট হইয়াছিল। এখন দেশকালের অবস্থা বিবেচনা
করিয়া অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে
ভগ্নহৃদয়ে এবং তৎসঙ্গে
বহু আশা করিয়া তোমাদের সৌভাগ্য কামনা করিয়া মেশিনটিকে পাঠাইলাম।
মেশিনটিতে যৎসামান্য খুঁত আছে। ছোট হাতের এম অক্ষরটি নাই এবং
কয়েকটি অক্ষরের মাথায় শুভ সংকেত আছে। চাকুরির আবেদনপত্র
লিখিবার সময় চেষ্টা করিবে
ছোট হাতের এম অক্ষর যেন কোনও শব্দে না থাকে। একটু মনোযোগ দিয়া চেষ্টা করিলেই ইহা করা সম্ভব।
যদি একান্তই এম অক্ষর বাদ দেওয়া
না যায়, তাহা হইলে টাইপ
করার কালে ওই জায়গাগুলি
ফাঁকা রাখিবে, টাইপ করা সম্পূর্ণ শেষ হইয়া গেলে কাগজ উলটাইয়া নিয়া শূন্য স্থানগুলিতে ডাবলিউ
টাইপ করিয়া দিবে, কাহারও ধরিবার সাধ্য থাকিবে না।
শুভ সংকেতগুলি রাখিয়া দিয়ো, ওইগুলি ফরাসি কেতার। ইংরাজি-পড়া সুশিক্ষিত সাহেবদের কাছে উহার কদর আছে।
ইতি ১২ কার্তিক, বুধবার বাংলা সম্বৎসর ১৩৬২
চির আশীর্বাদক,
তদীয় মাতামহ।
বলা বাহুল্য, ওই দীর্ঘ পত্রে আরও বহু সদুপদেশ, ন্যায়বাক্য ও পরামর্শ ছিল। আমাদের পত্র পাঠ করা শেষ হওয়ামাত্র তমিজমামু আবার ডুকরে কেঁদে উঠল, এত বড় সর্বনাশ হয়ে গেল, বড়বাবুকে আমি কী করে মুখ দেখাব?
বড়বাবু মানে আমাদের মাতামহ। দাদা ধমকিয়ে উঠল, তুমি থামো তো তমিজমামু। বড়বাবুকে যা বোঝানোর আমি বোঝাব। তা ছাড়া কাল সকালে তো আমরা বউবাজার থানায় যাচ্ছি টাইপরাইটার নিয়ে আসতে, এখন তুমি ঘুমোওগে।
এই বলে দাদা ভেতরের ঘরে গিয়ে ছাদের টঙ থেকে পরপর তিনটে লেপ নামাল। এই লেপগুলোই গত বছর শীতে তমিজমামু এনে দিয়েছিল।
কিন্তু আজ অতগুলো লেপ দেখে ঘামন্ত তমিজমামু শিউরে উঠল, দাদাকে জিজ্ঞাসা করল, বড়মামু, এত লেপ কী জন্যে?
দাদা বলল, একটায় তুমি শোবে, একটায় তুমি মাথায় দেবে, আরেকটা গায়ে দেবে।
তমিজমামু বলল, এত শীত কোথায়?
দাদা তখন বলল, তাহলে এতক্ষণ সোয়েটার গায়ে দিয়ে ছিলে কী করে?
.
পরদিন সকালে আমরা দুভাই আর তমিজমামু অসীম সাহসে ভর করে বউবাজার থানা অভিমুখে রওনা হলাম। আমাদের দুভাইয়ের ইতিপূর্বে কোনও থানার মধ্যে প্রবেশ করার কারণ বা সৌভাগ্য ঘটেনি। তমিজমামুর পুলিশ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা একটু অন্য রকম। প্রথম যৌবনে রক্তের চাঞ্চল্যবশত তমিজমামু কিছুকাল ধলেশ্বরীতে নৌকো ডাকাতি করেছিল, তমিজ মিঞার বীরত্ব ও সাহসের কাহিনি শুনে আমার মাতামহ বহু কৌশলে ও অর্থব্যয়ে তাকে পুলিশের হাত থেকে ছাড়িয়ে এনে আমাদের পাটগুদামের রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিযুক্ত করেন। পরে পাটগুদাম বন্ধ হয়ে গেলেও তমিজমামু মাতামহের কাছে থেকে যায়।
আজ সকালবেলা থানায় যাওয়ার সময় তমিজমামু কালকে রাতের সোয়েটারটা আবার গায়ে দিয়ে নিল। যদিও কার্তিক মাস, কিন্তু আজ সকালবেলা ঝনঝনে রোদ উঠেছে, বেশ গরম। এর মধ্যে তমিজমামুর গায়ে সোয়েটার দেখে আমরাও ঘামতে লাগলাম। দাদা বলল, আমরাও সোয়েটার গায়ে দিয়ে নেব নাকি?
আমি বললাম, সে কী!
দাদা বলল, থানায় মারধর করলে গায়ে সোয়েটার থাকলে চোট কম লাগবে।
দাদার কথার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে তমিজমামু বলল, পুলিশের মারপিট সোয়েটার ঠেকাতে পারবে না। আমি সোয়েটার গায়ে দিলাম মনে বল আনার জন্যে। আঁটোসাঁটো পোশাক পরা থাকলে ভয় কম লাগে।
কিছুক্ষণের মধ্যে বাসে করে এসপ্ল্যানেডে নেমে আমরা গুটি গুটি হেঁটে দুরুদুরু বক্ষে টাইপরাইটার পুনরুদ্ধার করার জন্যে বউবাজার থানায় প্রবেশ করলাম।
থানা জায়গাটা যত ভীতিজনক ভেবেছিলাম, ঠিক তা নয়। সকালের দিক বলেই বোধ হয় থানার ভিতরটা প্রায় খালি। বড়বাবু দোতলায় না তিনতলায় বসবাস করেন, এখনও নামেননি। সামনের ঘরে টেবিলের ওপরে মাথা রেখে এই সাতসকালে ইউনিফর্ম পরা এক অফিসার ঘুমোচ্ছেন। তার মাথার কাছে একটা হুলো বেড়াল চোখ বুজে গ-র-র করছে।
আমরা ভদ্রলোককে ওঠানোর চেষ্টা করতে গেটের সেপাই বলল, এখন তুলবেন না। কাল রাতে নাইট ডিউটি ছিল।
একটু খোঁজখবর করতে বুঝলাম, কালীপুজো বলে এরকম ডিউটি প্রায় সকলেরই। কথা বলার লোক পাওয়া কঠিন। বহুক্ষণ অপেক্ষা করার পর থানার মালবাবু এলেন। মালবাবু নামে যে কোনও পদ থাকতে পারে, এ ধারণা আগে ছিল না। তবে মালবাবু লোক ভাল। আমাদের কথা মন দিয়ে শুনলেন। শুনে মাল-রেজিস্টার খুলে দেখে বললেন, না, কালকের তারিখে তো কোনও টাইপরাইটার মেশিন জমা পড়েনি! তারপর নিজে উঠে গিয়ে মালখানা খুলে দেখে বললেন, মালখানায় কোনও টাইপরাইটার নেই। কাল কেন, কোনওদিনই জমা পড়েনি।
আমরা হতাশ হয়ে থানা থেকে বেরিয়ে এসে সামনের ফুটপাতে দাঁড়ালাম। খিদে লেগেছিল, কাছে একটা চায়ের দোকানে বসে চা আর কেক খেতে খেতে দাদা বলল, চল চাপাতলায়, পিসিমার ওখানে যাই।
দাদার প্রস্তাবের পিছনে যুক্তি আছে। আমাদের এক দূরসম্পর্কের পিসির শ্বশুরবাড়ি কাছেই। বউবাজার চাপাতলায়। পিসির শাশুড়ি কনকলতা দেবী অতি ডাকসাইটে মহিলা। অনেককাল আগে। বউবাজার কালীবাড়িতে তখনকার বউবাজার থানার বড়বাবুর স্ত্রীর সঙ্গে তার আলাপ ও ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। সেই সূত্র ধরে কালক্রমে সমস্ত বড়বাবুর স্ত্রী এবং সেই সঙ্গে থানার বড়বাবু সমেত সেপাই-দারোগা সকলের সঙ্গে তার গভীর ঘনিষ্ঠতা। কালীবাড়িতে তাদের হয়ে তিনি মানত দেন। পুলিশের সঙ্গে তার এই সৌহার্দ্যের বিষয় আত্মীয়স্বজন সকলেরই জানা ছিল এবং এতে আমরা বিশেষ গৌরবান্বিত বোধ করতাম।
আমরা যখন চাঁপাতলায় পিসির শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে পৌঁছলাম, তখন কনকলতা দেবী পুজোর ঘরে রয়েছেন। আমরা এসেছি শুনে তিনি একটু পরে বেরিয়ে এলেন। কাজের লোকদের বললেন আমাদের জলখাবার দিতে। তারপর আমাদের, বিশেষ করে তমিজমামুর কাছে বিস্তারিত শুনলেন। শোনার পর একটু থেমে গম্ভীর গলায় স্বগতোক্তি করলেন, কী সাহস, টাইপ-আইটার কেড়ে নিয়েছে। ভদ্রমহিলা আদ্যের উচ্চারণ করতে পারতেন না, রামকে আম বলতেন, রাইটার আইটার হয়ে গেল।
পুরনো আমলের বনেদি বাড়ি। ভেতরের বারান্দায় বড় কালো টেবিলের ওপরে টেলিফোন রয়েছে। কনকলতা আমাদের সেখানে নিয়ে গেলেন। তারপর দাদাকে বললেন, ফোনে বউবাজার। থানা ধরতে। ডিরেকটরি দেখে একটু চেষ্টা করতে বউবাজার থানা পাওয়া গেল।
এবার কনকলতা দেবীর নির্দেশমতো বিচিত্র কথোপকথন শুরু হল। বেলা প্রায় বারোটা হতে চলল, মনে হল, থানায় ইতিমধ্যে অনেক লোক এসে গেছে। দাদা ফোনে জানাল যে, কনকলতা দেবীর বাড়ি থেকে বলছি। তাতে বেশ সাড়া পাওয়া গেল এবং বোঝা গেল যে কনকলতা দেবীর প্রভাব থানার ওপরে যথেষ্ট পরিমাণ বিদ্যমান।
থানার সঙ্গে দাদার কথোপকথন চলল কনকলতা দেবীর নির্দেশে, দাদা জিজ্ঞেস করল, আপনি কে বলছেন? সাধারণত থানা কিংবা কোনও সরকারি অফিস থেকে এজাতীয় প্রশ্নের কোনও উত্তর পাওয়া যায় না, কিন্তু দাদার মুখ দেখে বোঝা গেল উত্তর এসেছে এবং সঙ্গে সঙ্গে দাদা সেটা রিলে করে দিল, রমেশ চক্রবর্তী।
সঙ্গে সঙ্গে কনকলতা দেবী বললেন, জিজ্ঞেস করো, কোন অমেশ?
এখানে এই ব্যাপারটার একটু ব্যাখ্যা প্রয়োজন। সেই সময়ে বউবাজার থানায় দুজন রমেশ চক্রবর্তী ছিলেন, দুজনেই এ-এস-আই বা ছোট দারোগা। এসব ক্ষেত্রে যেমন হয়, আসামি-ইনফরমার-সেপাই–থানার কাছাকাছি ও আশেপাশের লোকজন একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য রচনা করেছিল দুজনের মধ্যে, তারা যেকোনও কারণেই হোক একজনকে বলত চালাক রমেশ অন্যজনকে বলত বোকা রমেশ। এসব খবর আমরা পরে জেনেছিলাম। কিন্তু সেদিন ফোনে দাদা বাধ্য বালকের মতো যখন জিজ্ঞাসা করল, আপনি কোন রমেশ? ও প্রান্ত থেকে স্পষ্ট উত্তর এল, আপনি দিদিমাকে বলুন, আমি বোকা রমেশ।
বলা বাহুল্য, বোকা রমেশ চক্রবর্তীকে সবাই যত বোকা ভাবত, হয়তো তিনি তা ছিলেন না। তা হলে অন্তত তিনি জানাতে পারতেন না যে তিনিই বোকা রমেশ। সেসব অন্য কথা। আসল কথা হল, এবার কনকলতা দেবী ফোনটা দাদার হাত থেকে তুলে নিলেন এবং যথাসম্ভব অপ্রাকৃত ভাষায় বোকা রমেশ চক্রবর্তীকে জানালেন পুলিশবাহিনীর অপদার্থতা বিষয়ে তার ব্যক্তিগত মতামত এবং তমিজমামুর টাইপ-আইটারের করুণ কাহিনি।
মহানুভব লোক ছিলেন বোকা রমেশ চক্রবর্তী। তিনি কনকলতা দেবীকে বললেন, আমাদের সঙ্গে সঙ্গে থানায় পাঠিয়ে দিতে। কনকলতা বললেন, এখন নয়, ওরা দুপুরে খেয়ে-দেয়ে বিশ্রাম করে তিনটে নাগাদ যাবে।
সেদিন দুপুরে অনেকদিন পরে পিসির হাতের রান্না খেলাম। মুলেশাক ভাজা, লাউচিংড়ি, মিষ্টি কুমডোর চাপরঘণ্ট, বোয়াল মাছের ঝাল, নতুন আলুকপি দিয়ে রুই মাছের ঝোল আর সবশেষে অনবদ্য মাছের ল্যাজা আর শালুকের টক। মনে হচ্ছিল দেশে ফিরে গেছি। একটু গাঁইগুঁই করে আমাদের পাশে বসে তমিজমামুও খেল। চাপাতলা লেনের সেই বাড়িতে কেউ খেয়াল করতে যায়নি আমাদের তমিজমামু ব্রাহ্মণ কিংবা হিন্দু কিনা। দেশের বাড়িতে এ গোলমালটা তখনও ছিল।
সোয়া তিনটে নাগাদ থানায় গেলাম। অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ। গেটের সেপাই আমাদের দেখে কী করে কী বুঝল কে জানে, জিজ্ঞাসা করল, আপনারা রমেশবাবুর কাছে যাবেন?
দাদা চালাকি করে জিজ্ঞেস করল, কোন রমেশবাবু?
সেপাই গলা নামিয়ে বলল, বোকা রমেশবাবু। সামনের বাঁদিকের ঘরে আছেন। বলে চোখের কোণে এক ঝিলিক হাসল।
সামনের বাঁদিকের ঘরে ঢুকে গেলাম। একটা টেবিলের পিছনে চেয়ার জুড়ে গোলগাল নাদুসনুদুস এক ভদ্রলোক বসে রয়েছেন। যদিও পুলিশের পোশাক কিন্তু চেহারায় কেমন ভাল মানুষের ভাব, ইনিই নিশ্চয় বোকা রমেশবাবু। তাঁর পাশে মেঝের ওপরে দুটো লোক হাঁটু মুড়ে বসে রয়েছে। লোক দুটোকে দেখেই তমিজমামু চেঁচিয়ে উঠল, এই তো, এ দুজন! আরও একজন ছিল।
কোনওরকম পরিচয় বিনিময় করার আগেই রমেশবাবু বললেন, আপনারা এসে গেছেন, ভালই হয়েছে। এ দুটোকে ধরে এনেছি। তিন নম্বরটাকে ধরা যায়নি। তবে যাবে কোথায়? তারপর টেবিল থেকে একটা কালো কাঠের রুল তুলে মেঝেয় বসা লোকদুটোর পেটে দুটো খোঁচা দিয়ে বললেন, এগুলো পাকা জোচ্চোর। থানার নাম করে লোকের মাল কেড়ে নেয়।
ওই দুজনের মধ্যে একজন ফিরিঙ্গি, চুলের রং লাল, চোখের রং কটা, গায়ে রং সাদা–তাকে চুলের মুঠি ধরে দাঁড় করালেন রমেশবাবু। তারপর আমাদের বললেন, এর নাম পিটার। মহা শয়তান। এটাই পালের গোদা। এর সঙ্গে যান, টাইপ-রাইটার ফেরত দিয়ে দেবে। তারপর দ্বিতীয় লোকটাকে একটা লাথি মেরে বললেন, যা ভাগ।
আমরা বেরোতে বেরোতে শুনলাম, পেছন থেকে রমেশবাবু বলছেন, কোনও চালাকি করতে যেয়ো না পিটার, তা হলে একদম ডাকাতির মামলায় জুড়ে দেব।
আমরা রাস্তায় নেমে পিটারের সঙ্গে হাঁটতে লাগলাম। পিটার লোকটি জোচ্চোর কিন্তু সজ্জন, সে আমাদের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে চমৎকার তালতলার বাংলায় বলল, স্যার, আপনাদের নিয়ে। যেতে লজ্জা করছে। আমরা কিন্তু খুব খারাপ জায়গায় যাচ্ছি।
আমি আর তমিজমামু মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। দাদা জিজ্ঞাসা করল, খারাপ জায়গা কেন?
পিটার খুব সংকুচিত হয়ে বলল, স্যার, আমার স্বভাবদোষ। কাল রাতে মেশিনটা আমি জলিকে দিয়ে এসেছি।
দাদা বলল, জলি? জলি আবার কে?
পিটার আরও সংকুচিত হয়ে বলল, জলি খুব বাজে মেয়ে স্যার। খারাপ পাড়ার মেয়ে। মাঝে মাঝে ওর ওখানে যাই। সব সময় টাকা দিতে পারি না, কাল ওই মেশিনটা দিয়ে এসেছি।
ততক্ষণে আমরা হাঁটতে হাঁটতে চৌরঙ্গির মোড় পার হয়ে বাঁদিক ধরে জানবাজারের কাছে এসে পড়েছি। সত্যি গোলমেলে জায়গা, কার্তিক মাসের পড়ন্ত বিকেল, একটু ছায়া ছায়া অন্ধকার ভাব। এরই মধ্যে দালাল আর নষ্ট মেয়েছেলেরা রাস্তায় নেমে পড়েছে।
পরিবেশ বুঝতে আমাদের কোনওই অসুবিধে হচ্ছিল না, কালীঘাটে আমাদের বাড়ির পিছনেই খারাপ পল্লি, আর তমিজমামুও পাকা লোক।
একটি পুরনো দোতলাবাড়ির প্যাসেজে কয়েকটি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ও চিনা মেয়ে সেজেগুঁজে দাঁড়িয়ে, তারা পিটারকে দেখে চিনতে পারল। একজন বলল, হ্যালো পিটার?
পিটার জিজ্ঞাসা করল, জলি কঁহা? হোয়ার ইস জলি? জানা গেল জলি ঘরে আছে।
এ জায়গা পিটারের বেশ চেনা। সে আমাদের নিয়ে দোতলায় উঠল। সিঁড়ির শেষ মাথায় জলির ঘর। ঘরের সামনে মোটা পর্দা। পিটার আমাদের বলল, আসুন। বলে হন হন করে এগিয়ে গেল, তমিজমামু একবার গলাখাঁকারি দিল, দাদা দরজায় দুবার ঠুকঠাক করল, ভেতর থেকে সুললিত মেমকণ্ঠে জবাব এল, সরি, আই অ্যাম বিজি।
ঘরের মধ্যে ঢুকে কী দৃশ্য দেখব কী জানি, আমরা থমকে গেলাম। পিটার কিন্তু পর্দা সরিয়ে ঢুকে গেল। ঢুকে আমাদের ডাকল, আসুন স্যার, আপনারা আসুন।
একটু ইতস্তত করে আমরা ঢুকলাম। ঘরে ঢুকে দেখি একটা ডবলবেডের খাটের পাশে একটা ছোট গোল টেবিল। সেই টেবিলে আমাদের টাইপরাইটারটা বসানো। সামনে খাটে বসে একটি মেয়ে সেই মেশিনে কাগজ লাগিয়ে একমনে কী সব টাইপ করে যাচ্ছে।
অল্পবয়সি ফিরিঙ্গি মেয়ে, একুশ বাইশের বেশি হবে না। রং তত ফরসা নয়, কিন্তু বড় বড় দুটি। নীল চোখ, মুখে বেশ কমনীয়তা। শরীরে যৌবনের মাদকতা।
পিটার মেয়েটিকে বলল, জলি, ভেরি সরি। মেশিনটা ফেরত দিতে হবে। এঁরা নিতে এসেছেন।
টাইপ করা থামিয়ে জলি অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকাল। একটু পরে খাট থেকে নেমে উঠে দাঁড়াল, তারপর পিটারকে বলল, অলরাইট, নিয়ে যেও। আমার পাওনা টাকাগুলো মিটিয়ে দিয়ে। বলে সে বেরিয়ে যাচ্ছিল।
দাদা হঠাৎ তার পথ আগলিয়ে দাঁড়াল, প্রশ্ন করল, কোথায় যাচ্ছ?
জলি বলল, আপনি কী করবেন জেনে? নিজের কাজে যাচ্ছি। আপনারা আপনাদের মেশিন নিয়ে চলে যান।
দাদা কী ভাবল কে জানে, জলিকে জিজ্ঞাসা করল, টাইপ মেশিনটা তুমি চাও? তুমি টাইপ করতে পারো? কিছু না বলে জলি থমথমে মুখে দাদার দিকে তাকাল। আমি আর তমিজমামু নিষেধ করতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু তার আগেই দাদা জলিকে বলল, ভাল মেয়ে হও। ভাল পথে থেকে উপার্জন করো। মেশিনটা তোমাকে দিয়ে দিলাম। এখন থেকে সভাবে থাকো।
পিটার হাঁ করে দাদার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর আমাকে বলল, স্যার, বোকা রমেশবাবু কী বলবে?
তমিজমামু হাঁ করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর দাদাকে বলল, বড়মামু, বড়বাবু কী বলবে?
আমি হাঁ করে জলির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
পরের দিন তমিজমামু দেশে ফিরে গেল।
দাদা তার হাতে চিঠি দিয়ে দিল, শ্রীচরণকমলেষু, টাইপরাইটার পাইয়া খুব খুশি হইয়াছি। ইত্যাদি।
দাদার কিন্তু এর পর কাজ বেড়ে গেল। দু-একদিন পরে হাজরার মোড়ে একটা সাইনবোর্ডের দোকান থেকে ইংরেজি এবং বাংলায় টাইপিং ডান হিয়ার, এখানে টাইপ করা হয় একটা ছোট বোর্ডে লিখিয়ে জলিদের বাড়ির গেটে লাগিয়ে দিয়ে আসে। বাড়িউলি সামান্য আপত্তি করেছিল, তাকে দাদা বোকা রমেশ দারোগার ভয় দেখায়।
এর পরেও দাদা মধ্যে মধ্যে জলির ওখানে যেত। জলি সত্যিই সচ্চরিত্র জীবনযাপন করছে কিনা দেখবার জন্যে।
তবে সে অন্য গল্প।