টাইপরাইটার – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
সন্ধেবেলায় দাসের অফিসে ঢুকে দেখলাম, ও তখনো বসে বসে কী কতকগুলো কাগজপত্র পড়ছে৷ আমার পায়ের শব্দে চমকে উঠে বলল, ‘‘তুমি?’’ বললুম, ‘‘তোমার অফিসে আলো জ্বলতে দেখে ঢুকেছি৷ এখনো বসে আছ যে বড়?’’
‘‘নানা কাজ হে, তুমি বুঝবে না৷’’
সত্যিই আমি বুঝতে পারি নে৷ দাস ব্যবসা করে, কিন্তু কি জাতের ব্যবসা সে সম্বন্ধে আজো কোনো স্পষ্ট ধারণা করতে পারি নি আমি৷ সাপ্লাইয়ের কাজ করে, মর্টগেজ রেখে টাকা ধার দেয়—আরো কি দশ রকম করে বেড়ায়—তা দাস শুধু নিজেই জানে৷ ভগবানও জানেন কি না সন্দেহ৷
আমিও জানতে চাই নে৷ কারণ দাসকে জানি৷ সেই কলেজ-জীবন থেকেই৷ ইউনিয়নের টাকা সরিয়েই হাত পাকিয়েছিল দাস৷ তারপর বার্মা ইভ্যাকুয়িদের নিয়ে যখন নানা কেলেঙ্কারি হয়—তখন দাস ছিল একজন কন্ট্রাকটার৷ সেই থেকে ধাপে ধাপে কতদূরে সে এগিয়েছে, সে-সম্বন্ধে কোনো রকম অনুমান করতেও সাহস হয় নি আমার৷
জিজ্ঞাসা করতে পারেন, এ-সব সত্ত্বেও দুর্জনসংসর্গ করি কেন? তার কোনো স্পষ্ট উত্তর দিতে পারব না৷ শুধু এটুকু বলতে পারি, দাসকে আমার ভালো লাগে৷ অজস্র ত্রুটি থাকলেও একটা দুর্বোধ্য আকর্ষণ আছে ওর ব্যক্তিত্বে৷ সেটা ওর তীক্ষ্ন স্মার্টনেসের জন্যে হতে পারে, আমার মতে৷ ওরও সেরিকালচার সম্বন্ধে কৌতূহল আছে বলে হতে পারে, এমন কি ওর বিশেষ-ধরনের চুলের ব্যাকব্রাশের জন্যেও হতে পারে৷ কিন্তু মোট কথাটা হল, সময় পেলে দাসের সঙ্গে আড্ডা দিতে আমার ভালো লাগে৷ এই পথ দিয়ে যেতে যেতে ওর অফিসে আলো জ্বলতে দেখে তাই ঢুকে পড়েছিলুম৷
একটা বেয়ারা নেই—তিনজন কেরানীর একজনও না৷ মস্ত অফিস-ঘরটায়, সবুজ শেড দেওয়া আলোটার পাশে দাসকে কেমন প্রক্ষিপ্ত মনে হল যেন৷ তখুনি আমি বুঝলুম নিঃসঙ্গতা দাসকে মানায় না৷ ও ড্রয়িংরুমের জীব—ছাদের অন্ধকারে একলা বসে থাকবার জন্যে সৃষ্ট নয়৷
ওর সামনে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে আমি বললুম, ‘‘একলা একলা এতক্ষণ বসে যখের ধন পাহারা দিচ্ছ নাকি?’’
‘‘প্রায় তাই৷’’—বিশেষ ধরনে ব্যাকব্রাশ করা চুলের ওপর দাস সযত্নে একবার হাত বুলিয়ে নিলে, ‘‘এমন কতকগুলো কাজ ডান হাত দিয়ে করতে হয়, যা বাঁ হাতকে জানতে দিতে নেই৷’’
‘‘তা হলে আমিও যাই৷ বিরক্ত করব না৷’’
‘‘বোসো—বোসো৷’’ দাস হাসল, ‘‘কাজটা শেষ হয়ে গেছে৷’’ পাশের একটা লোহার ড্রয়ার খুলে তাতে কাগজগুলো রাখল, লক করে দিয়ে চাবিটা ফেলল ট্রাউজারের পকেটে৷ তারপর দামি সিগারেটের টিনটা আমার দিকে ঠেলে দিয়ে বললে, ‘‘একটা সিগারেট খেয়ে ওঠা যাবে তারপরে৷’’
কিন্তু সিগারেটটা ধরাতে গিয়ে—জ্বলন্ত দেশলাইয়ের কাঠিটার দিকে আড়াআড়ি তাকাতেই আমার নজর পড়ল কোণের টাইপরাইটার-এর দিকে৷ ঢাকনা খোলা৷ ঝকঝক করছে কী-বোর্ড, রোলারটাকে অদ্ভুত মসৃণ মনে হচ্ছে৷ আর সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিক্রিয়াটা বেরিয়ে এল প্রশ্নের আকারে৷
‘‘তোমার সেক্রেটারির খবর কী?’’
দাসের ঠোঁটের কোণে সিগারেটটা যেন চমকে দুলে উঠল, ‘‘কোন সেক্রেটারি?’’
‘‘আবার কোন সেক্রেটারি? মিস সুলতা পাল?’’
‘‘ওঃ!’’ ছাই জমে ওঠার আগেই অ্যাশ-ট্রেতে সিগারেটটা ঝাড়ল দাস—কয়েকটা নরম ফুলকি উড়ে গেল পাখার হাওয়ায়৷ ‘‘নো ট্রেস!’’
‘‘কোনো পাত্তা পাও নি?’’
‘‘নাঃ!’’
‘‘আশ্চর্য! এমন করে কোথায় গেল মেয়েটা?’’
অবজ্ঞাকুঞ্চিত মুখে আবার গোটাকয়েক ফুলকি ঝাড়ল দাস, ‘‘ও সব মেয়ের কথা ছেড়ে দাও৷ চেহারাটা ভালোই ছিল, দেখেছিলে তো? নিশ্চয় পালিয়েছে কারো সঙ্গে৷’’
আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, ‘‘পালাবার কী ছিল? যতদূর তোমার কাছে শুনেছিলুম, কলকাতার একটা বোর্ডিঙে একাই থাকত৷ আত্মীয়-স্বজন কেউ থাকলেও তাদের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না৷ ওর যদি কাউকে ভালো লেগে থাকে, তবে তাকে নিয়ে চোরের মতো পালাবার দরকার ছিল না নিশ্চয়৷’’
দাস উদাস ভঙ্গিতে বললে, ‘‘কে জানে! হয়তো কোনো রাইভ্যাল ছিল—কলকাতায় থাকলে খুন-টুন একটা কিছু হয়ে যেতে পারত৷ এ-ধরনের মেয়েকে নিয়ে কত নুইসেন্স হয় জানোই তো৷’’
তা হয়তো হয়৷ তবে দাসের সেক্রেটারি সুলতা পাল সম্পর্কে এরকম কথা ভাবতে আমার কষ্ট হচ্ছিল৷ মিষ্টি চেহারার শান্ত ধরনের ওই মেয়েটিকে কতদিন আমি নিবিষ্টমনে ওখানে বসে টাইপ করতে দেখেছি৷ সামান্য একটু নিরীহ ঠাট্টাতেও যে মেয়েটির গাল রাঙা হয়ে উঠত, নিচু হয়ে যেত চোখের পাতা—তার মধ্যে ঠিক এসব জিনিস আমি আশা করি নি৷ আমি সাহিত্যিক নই, তবু সাহিত্যিকের ভাষায় আমার মনে হল—যে সব মেয়ে প্রথম প্রেমের জন্যে চিরকুমারী থেকে যায়, সুলতা সেই দলের৷
কিন্তু সুলতা যে প্রায় পনেরো দিন নিরুদ্দেশ—এটা ঠিক কথা৷ কোনো অ্যাকসিডেন্ট হয় নি, কোনো বিপদে পড়বার মতো কাঁচা মেয়েও সে নয়৷ অতএব সে পালিয়েছে এটা ধরে নেওয়া যেতে পারে৷
দাস বললে, ‘‘সেক্রেটারির ভাবনা নেই—আজও তিনজন ইন্টারভিউ দিয়ে গেছে৷ তবে মেয়েটা বড় ভালো কাজ করত৷’’
‘‘তা করত!’’
দাস চুপ করে রইল৷ একটু আগে যে-সিগারেটটায় বার-বার টোকা দিচ্ছিল, অনেকটা ছাই জমতেও এবারে সে সেটাকে ঝাড়ল না৷ আমিও চুপ করে বসে বসে ছাইটা কখন ভেঙে পড়ে সেইটে দেখবার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলুম আর ভাবতে লাগলুম, সুলতা এতখানি সাহস পেল কী করে?
সুতরাং একটু পরেই দাস যখন বলতে যাচ্ছিল, এইবার ওঠা যাক,—অন্তত ওর মুখ থেকে এই কথাটাই বেরিয়ে আসবে বলে আমার মনে হচ্ছিল, ঠিক তখনি ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমে বসল বাইরে৷ খোলা দরজা দিয়ে ভেজা ধুলোর একটা তপ্ত রুদ্ধশ্বাস চলে এল ঘরে—দাসের সিগারেট থেকে ছাইটাকে কেড়ে নিয়ে চলে গেল৷
দাস বললে, ‘‘বৃষ্টি নামল যে! গাড়িটাও তো আনি নি!’’
বললুম, ‘‘না থামলে বেরোনো যাবে না৷ বেশ ঘটা করে নেমেছে, ট্রাম পর্যন্ত যেতে গেলেও ভিজিয়ে ভূত করে দেবে৷’’
‘‘তাই থামুক’’—দাস বললে, ‘‘তা হলে একটু বোসো তুমি৷ আমি একটা টাইপের কাজ সেরে নিই ততক্ষণ৷’’
উঠে টাইপরাইটারের দিকে এগিয়ে গেল দাস৷ সুলতার সম্পর্কে ভাবনাটা ভোলবার জন্যে আমি একটি বাণিজ্য সংক্রান্ত পত্রিকা কুড়িয়ে নিলুম টেবিল থেকে, তারপর মালটিপারপাস স্কিমের ওপরে একটা প্রবন্ধ পড়বার চেষ্টা করতে লাগলুম৷ আলগা মনোযোগের ভেতরে কানে আসতে লাগল বাইরের বৃষ্টির আওয়াজ—টাইপরাইটারের রোলারে কাগজ জড়ানোর খশখশানি, তারপরে খটাখট করে গোটাকয়েক টাইপিঙের শব্দ৷
পরক্ষণেই দাস হেসে উঠল৷ ‘‘হাসি কেন? ব্যাপার কী?’’
‘‘এসো এখানে দেখো, কী মজা হয়েছে৷’’
আমি উঠে গিয়ে ওর পাশে দাঁড়ালুম৷ মজাই করেছে বটে একটা৷ ওপরে ‘টেন্ডার’ বলে হেডিং দিয়ে তার নীচে তিনবার টাইপ করে বসেছে একটি নাম—‘সুলতা পাল৷’ অবাক হয়ে বললুম, ‘‘এর মানে? সুলতা পালের নাম টাইপ করছ কেন?’’
দাস বললে, ‘‘মানেটা তো আমিও ভাবছি৷ লিখতে গেলুম টেন্ডার—লিখে বসলুম সুলতা পালের নাম! তাও একবার নয়—তিনবার!’’
আমি বললুম, ‘‘তাতে অস্বাভাবিক কিছু নেই৷ এতক্ষণ ধরে ওকে নিয়েই তো আমরা আলোচনা করছিলুম৷ আর ওর ব্যাপারটাও এত বিস্ময়কর যে, মনের ভেতরে ওর নামটাই ঘুরছিল৷ অন্যমনস্কভাবে তাই ছেপে বসে আছ!’’
‘‘তাই বটে৷’’—দাসের মুখের উপর একটা বিষণ্ণ ছায়া নেমে এল, ‘‘আজ এক বছর ধরে এইখানে বসে টাইপ করেছে সুলতা—একেবারে ঘড়ির কাঁটার মতো৷ একটা দিন কামাই করে নি, এক মিনিট লেট করে নি, পাঁচ মিনিট আগে ছুটি নিয়ে চলে যায় নি কোনোদিন৷ এর প্রত্যেকটা চাবিতে সুলতার আঙুল জড়িয়ে রয়েছে৷’’
আবার আমরা দুজনে গম্ভীর হয়ে রইলুম৷ সুলতার শান্ত মিষ্টি মুখখানা আমি ভুলতে পারছি না৷ দাসের চোখ দুটোও কেমন উদাস আর গভীর হয়ে গেছে৷ আমার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হল, তুমি কি ওকে ভালোবাসতে?
বাইরে বৃষ্টি পড়তে লাগল৷ ধুলোর তপ্তশ্বাস নেই—দরজা দিয়ে ঠাণ্ডা ভিজে বাতাস আসছে৷ দাস দরজাটা বন্ধ করার কথা বললে না, আমিও উৎসাহ পেলুম না৷ শুধু বৃষ্টির শব্দ, আমাদের চুপ করে থাকা আর ঘরের ভেতর কোথা থেকে উড়ে আসা একটা চামচিকের চঞ্চল ছায়া—কিছুক্ষণ ধরে স্তম্ভিত হয়ে রইল৷
দাস স্তব্ধতা ভাঙল, ‘‘টাইপটা সেরেই ফেলি৷’’
কাগজটা খুলে দাস সেটাকে তাল পাকিয়ে নীচের বাস্কেটে ফেলে দিলে, জড়িয়ে নিলে আর একখানা৷ আবার খটখট করে বেজে উঠল টাইপিঙের আওয়াজ৷ আমি টাইপরাইটারের টেবিলের কোণে দাঁড়িয়ে রইলুম৷ একটানা বৃষ্টির শব্দর মধ্যে টাইপিঙের শব্দ একাকার হয়ে এল, কখনো কখনো স্পেসিং আর ঘণ্টার যতিপতন কানে আসতে লাগল৷
কতক্ষণ পরে জানি নে, কেন যে তাও জানি নে—হঠাৎ আমার চোখ নেমে এল দাসের টাইপের ওপর৷ কী আশ্চর্য—আগাগোড়া ক্যাপিটাল লেটার সাজিয়ে কী ছাপছে ও! যা দেখলুম, তাতে কয়েক মুহূর্ত আমার চোখকে বিশ্বাস করতে পারলুম না৷ প্রচণ্ড স্পিডে পাগলের মতো দাস যা ছেপে চলেছে, তা এই৷
টেন্ডার
আমি অকপটে স্বীকার করছি যে সুলতা পালকে আমি খুন করেছি৷ আমার ব্যারাকপুরের বাগানবাড়িতে—পুরোনো গ্যারেজের ভেতর একটা বড় কেবিন-ট্রাঙ্কে তার মৃতদেহ রয়েছে৷ আমি তার ওপরে বলপ্রয়োগে ব্যর্থ হয়ে—
কিন্তু আর তো আমি চোখকে অবিশ্বাস করতে পারি নে৷ যা দেখেছি, এ তো স্বপ্ন নয়৷ আমি আর্তনাদ করে উঠলুম, ‘‘দাস, এ কী ছাপছ তুমি—এ কী ছাপছ!’’
টুলের ওপরে দাস থরথর করে কেঁপে উঠল, একটা মৃত প্রাণী যেন নড়ে উঠেছে ইলেকট্রিক কারেন্টের ছোঁয়ায়৷ যেন এতক্ষণ সে ঘুমিয়ে টাইপ করে যাচ্ছিল—হঠাৎ জেগে উঠেছে৷
আমি আবার বললুম, ‘‘দাস—দাস! কী টাইপ করে যাচ্ছ তুমি?’’
নিজের টাইপিঙের ওপর চোখ বুলোতে দাসের দশ সেকেন্ডও লাগল না৷ তার পরেই পেছনে লাথি দিয়ে টুলটাকে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল সে৷ হ্যাঁচকা টানে কাগজটাকে টেনে বার করে নিয়ে বিকৃত গলায় চিৎকার করে বললে, ‘‘না—না, আমি না—আমি না—’’ আমি আরো কী বলতে যাচ্ছিলুম, দাস বলতে দিলে না—‘‘মিথ্যে কথা—আমি নয়!’’—জান্তব গলায় আবার চিৎকার করে উঠল সে৷ পরমুহূর্তেই ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল—নেমে গেল রাস্তায়৷
আমার বিহ্বলতা কাটতে আরো প্রায় এক মিনিট লাগল৷ তারপর যখন সেই বৃষ্টির মধ্যেই পথে বেরিয়ে এলুম তখন মাত্র কুড়ি গজ দূরেই একটা লোক চাপা পড়েছে বাসের তলায়৷
কাছে না গিয়েও আমি বুঝতে পারলুম, সে দাস ছাড়া আর কেউই নয়৷ আর বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ও আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে আমি ভাবতে লাগলুম—তাকে নিজের হাতেই তার শাস্তি দিয়েছে সুলতা৷ এর পরে একটিমাত্র কাজ আছে আমার৷ কোনো পাবলিক টেলিফোনে গিয়ে পুলিশকে জানাতে হবে ব্যারাকপুরের গ্যারেজে সেই কেবিন-ট্রাঙ্কটার কথা৷