টলিউডে তারিণীখুড়ো
তাকিয়াটাকে কোলের উপর টেনে নিয়ে আরো জমিয়ে বসে ঝুঁকে পড়ে তারিণীখুড়ো তাঁর গল্প আরম্ভ করলেন।—
আমার তখন তেইশ বছর বয়স, তবে একটা তেকোণা ফ্রেঞ্চকাট গোছের দাড়ি রেখেছিলাম বলে মনে হত তেত্রিশ। বেয়াল্লিশ সালের কথা বলছি। তখন যুদ্ধ চলেছে পুরোদমে, কলকাতার রাস্তাঘাটে খাকি পরা জি. আই. সেনা ঘোরাফেরা করছে, শহরের চেহারাটাই পালটে গেছে। জোড়া জোড়া মার্কিন মিলিটারি পুলিশ চৌরঙ্গীতে টহল দিয়ে ফেরে, তাদের জামার আস্তিনে কুনুই-এর ওপর লেখা এম. পি.। সিনেমা হাউসগুলো খালি পড়ে থাকে না কখনো; ম্যাটিনি-ইভনিং-নাইট তিনটেই হাউস ফুল, সব ছবিই হিট, তা সে দিশিই হোক আর বিলিতিই হোক। আমাদের টলিউডের স্টুডিওগুলো গমগম করছে, কুইক মানির লোভে রোজই টাকাওয়ালা নতুন নতুন প্রোডিউসার আসছে। তারা জানে ছবি একবার লেগে গেলে কোনো ব্যবসাতে চটজলদি এত লাভ হয় না। আমার মেজোমামার এক সহপাঠী, নাম পরেশ মুস্তোফি, তিনি ভারত মাতা স্টুডিওর মালিক। আমাকে ডেকে পাঠিয়ে যেচে একটা চাকরি দিলেন প্রোডাকশন ম্যানেজারের। কাজটা নেহাৎ ফেলনা নয়; একটা ছবি হলে পরে সবাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, খরচের হিসেব রাখা, আর্টিস্ট আর কর্মীদের পেমেন্ট করা, এমন কি ছুঁচ থেকে হাতি পর্যন্ত যা কিছু একটা ছবিতে লাগবে সব কিছু জোগাড় করার ভার আমার উপর। তখন বয়স কম, তাছাড়া টুপাইস রোজগার হচ্ছে, খাটনি হলেও কাজটা ভালোই লাগছিল।
সেই সঙ্গে এটাও বলা দরকার যে ভেতরে ভেতরে আমার অভিনয়ের একটা শখ ছিল। আমার চেহারাটা যে এককালে ভালো ছিল, সেটা ত তোদের বলেইছি। তাছাড়া আমি ছিলাম হলিউডের ছবির পোকা। বাংলা ছবিতে ত আর অভিনয় হত না, হত রং তামাশা। আমি দেখি পৃথিবীর সব সেরা স্টারের অভিনয়, যাকে দেখে অভিনয় বলেই মনেই হয় না। অবিশ্যি সেই সঙ্গে ভালো বাংলা পেশাদারী থিয়েটারও বাদ দিই না, কারণ শিশির ভাদুরী, যোগেশ চৌধুরী মনোরঞ্জন ভট্টাচায্যি—এঁরা সব ছিলেন বাঘা বাঘা অভিনেতা। কিন্তু যেচে গিয়ে বলব আমায় একটা পার্ট দিন, তেমন সাহস তখনো হয়নি। তবে স্টুডিও পাড়ায় থাকলে কোনো প্রযোজক বা পরিচালকের চোখে পড়ে গিয়ে সুযোগ যে আসবে না, এমনই বা কে বলতে পারে?
একদিন জানতে পারলাম যে আলমগীর ছবি হচ্ছে আমাদের এই ভারত মাতা স্টুডিওতেই, আর স্টুডিওই টাকা ঢালছে সে ছবিতে। বস্ মুস্তোফি সাহেব আমাকে ডেকে সব ডিটেল বললেন। তখনকার নামকরা পরিচালক জগদীশ নস্কর পরিচালনা করবেন, সেরা অভিনেতারা সব অভিনয় করছেন। তবে নাম ভূমিকায়—অথাৎ আলমগীরের চরিত্রে—একটি নতুন লোককে নেওয়া হচ্ছে। এর নাম রমণীমোহন চ্যাটার্জি, সুন্দর চেহারা, উচ্চবংশের ছেলে, অনেক পয়সা। মুস্তোফিমশাই নিজেই নাকি ছেলেটিকে এক বিয়ে বাড়িতে দেখে সোজাসুজি অফারটা দেন, এবং ছেলে নাকি এককথায় রাজি হয়ে যায়।
রমণীমোহন চ্যাটার্জি নামটা চেনা চেনা লাগছিল কেন বুঝতে পারছিলাম না, শেষটায় হঠাৎ মনে পড়ল যে শ্যামবাজারের একটা ক্লাবে আমারই স্কুলের সহপাঠী ব্রতীন থিয়েটার করে, তার কাছে শুনেছি এই রমণীমোহনের কথা। চেহারা ভালো—‘অনেকটা তোর মতো দেখতে’—বলেছিল ব্রতীন, আর অ্যাকটিংটাও নাকি ভালোই করে। তবু মনে একটা খটকা ছিল তাই ব্রতীনের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করলাম, আর করে জানলাম যে এ সেই একই রমণীমোহন। বললাম, ‘পারবে ত এত বড় দায়িত্ব কাঁধে নিতে?’ ব্রতীন বললে, ‘আদা নুন খেয়ে উঠে পড়ে লেগেছে ত ছোকরা। শখ প্রচণ্ড। আর,ও একটা আংটি পরে সেটা নাকি মুঘল আমলের; ওর ঠাকুরদাদার ছিল; খুব পয়া। আলমগীর সাজলে ওটা আঙুলে পরবে, আর তাহলে নাকি আর দেখতে হবে না। আসলে, রমণী আবার তুকতাকে বিশ্বাস করে, পুজো আচ্চা করে। বড়লোক বাপের একমাত্র ছেলে, বুঝতেই ত পারিস, পয়সার জন্য যে করছে তা ত নয়, শখ হয়েছে চিত্রতারকা হবার।
পয়লা বৈশাখ মহরতের দিন স্থির হয়েছে, এখন মার্চের মাঝামাঝি, তাই হাতে কিছুটা সময় আছে। ইতিমধ্যে পরিচালক জগদীশ নস্কর একদিন বলে বসলেন যে নতুন ছেলেটিকে একবার বাজিয়ে দেখবেন। শুধু চেহারাতে ত হবে না, তাকে ডায়ালগ বলতে হবে, তাই অভিনয় ছাড়াও কণ্ঠস্বর, উচ্চারণ ইত্যাদি ভালো হওয়া চাই। আর একমাত্র সেই যখন নতুন, তখন তাকে একবার পরীক্ষা করে দেখা উচিত। এই পরীক্ষায় উৎরোলে তারপর একটা ক্যামেরা টেস্ট নিলেই চলবে।
আমারই উপর ভার পড়ল রমণীমোহনকে টেলিফোন করে তারই বাড়িতে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা। রবিবার সকাল দশটায় টাইম ঠিক হল। আমি আর পরিচালকমশাই যাবো। টেস্টে পাশ করলে পর মুস্তোফির সঙ্গে বাকি কথা হবে।
রবিবার এসে পড়ল। জগদীশ নস্কর সময়ানুবর্তিতায় বিশ্বাসী, ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় দশটায় গিয়ে রমণীমোহনের বাড়ি সদর দরজার বেল টিপলেন। বেয়ারা আমাদের বৈঠকখানায় নিয়ে গিয়ে বসাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রমণীমোহনের আবিভাব হল। চেহারা ভালো তাতে সন্দেহ নেই, আর এতেও সন্দেহ নেই যে আমার সঙ্গে একটা মিল আছে। দুজনেরই হাইট ছ ফুট, দোহারা চেহারা, ফরসা রং, চোখা নাক, পাতলা ঠোঁট। আমার তেকোনা দাড়ির জন্য মিলটা হয়ত অতটা ধরা পড়ে না, কিন্তু আমি জানি, দাড়ি বাদ গেলেই পড়বে।
পরিচালকমশাই সঙ্গে আলমগীরের ডায়ালগ এনেছিলেন। তারই একটা অংশ পড়তে দিলেন রমণীমোহনকে। ছোকরা বেশ ভালোই পড়ল। বলল ও নাকি ভাদুড়ীমশাইকে গুরু বলে মানে, আর হলিউডের তারকাদের মধ্যে রোনাল্ড কলম্যান। নস্কর মশাই বেশ খুশি, আমাকে বললেন অবিলম্বে দরজি এনে রমণীমোহনের পোশাকের মাপ নিতে। এই ফাঁকে রমণীমোহনও তাঁর আংটিটা দেখিয়ে দিলেন। দেখলাম সত্যি খাসা জিনিস; সোনার আংটির মাঝখানে হীরেকে ঘিরে গোল করে পান্না বসানো। নস্করমশাই বললেন আলমগীর গালে হাত দিয়ে বসে থাকলে আংটিটা ক্লোজ-আপের সৌন্দর্য অনেক গুণে বাড়িয়ে দেবে।
তিনদিন বাদে ক্যামেরা টেস্টেও রমণীমোহন দিব্যি উৎরে গেলেন।
এরপর একটা দিন ঠিক করে বস্ মুস্তোফি মশাইকে সঙ্গে নিয়ে রমণীমোহনের বাড়ি গিয়ে তার সঙ্গে চুক্তি সই হয়ে গেল। পঞ্চাশ হাজার টাকা পাবে রমণীমোহন, আর পাঁচ হাজার অ্যাডভান্স! তখনকার দিনে একজন নতুন অভিনেতার পক্ষে এটা অঢেল টাকা, আজকের দশলাখের সমান। পয়লা বৈশাখ মহরৎ; তাতে কোনো অভিনয়ের ব্যাপার নেই, কিন্তু রমণীমোহনকে মেক্-আপ নিয়ে, কস্টিউম পরে আসতে হবে। এইখানে রমণীমোহন একটি বায়না করলে। সে বললে যে স্টুডিওর মেক-আপ রুম তার জানা আছে, সে অতি রদ্দি, তাতে সে মেক-আপ করবে না। মেক-আপ-ম্যান যেন সকাল সকাল তার বাড়িতে চলে আসে, সে বাড়িতেই মেক-আপ নিয়ে কস্টিউম পরে স্টুডিওতে হাজির হবে। মুস্তোফিমশাই দেখলাম এতে রাজি হয়ে গেলেন, যদিও একজন নবাগতের পক্ষে আবদারটা একটু বাড়াবাড়ি রকমের। বুঝলাম নতুন হিরোকে খুবই পছন্দ হয়েছে কর্তামশাইয়ের।
পয়লা বৈশাখ ভারত মাতা স্টুডিওতে আলমগীরের মহরৎ হয়ে গেল। লোকে লোকারণ্য, ফিল্ম লাইনের কেউ বাদ যায়নি, খানাপিনার বন্দোবস্ত ছিল, নতুন তারকাকে মোগল বাদশার মেক-আপে দেখে সকলেই খুব তারিফ করে গেলেন। ইতিমধ্যে রমণীমোহন নাকি আলমগীরের ডায়ালগ পেয়ে গেছেন, এবং সবই তাঁর মুখস্থ হয়ে গেছে। আচকান জোব্বা পরচুলা দাড়ি গোঁফ তলোয়ার নাগরা সব রেডি, প্রথম সুটিং-এর তারিখ স্থির হয়েছে পনেরই বৈশাখ।
এদিকে আমি তখন পুরোদস্তুর প্রোডাকশন ম্যানেজারের কাজ করছি। উদয়াস্ত খাটছি, দম ফেলার ফাঁক নেই। কিন্তু এতেও যে আপত্তি নেই তার কারণ হল যে স্টুডিওর পরিবেশে একটা জাদু আছে। এটা স্বীকার করতেই হবে। বিশেষ করে ঐতিহাসিক ছবিতে যারা কাজ করবে—সে অভিনেতা-অভিনেত্রীই হোক আর সাধারণ কর্মীই হোক—তাদের সকলেরই মেজাজে যেন একটা আমীরী ভাব চলে আসে। স্টুডিওর ভিতরে সেট তৈরী হচ্ছে প্রাসাদের—তার খিলেন, থাম, ঝাড়লণ্ঠন, দেয়ালগিরি, গালিচা, মসনদ, ফরাস, তাকিয়া—সমস্ত আবহাওয়াটাই যেন গেছে পালটে। মাঝে মাঝে কথা বলতে যে উর্দু-ফারসিও বেরিয়ে পড়ছে না তা নয়।
দেখতে দেখতে ১৫ই বৈশাখ এসে গেল। আলমগীরকে দিয়েই কাজ শুরু; বাপ শাজাহানের সঙ্গে দৃশ্য। ঠিক সাড়ে দশটার সময় তাঁর নিজের লাল শেভ্রোলে গাড়িতে আলমগীরের বেশে এসে হাজির হলে রমণীমোহন।
ক্যামেরাম্যানের আলো করা প্রায় শেষ, দু-একটা খুচরো রিহার্সেলও হয়ে গেল, এবং তাতে শাজাহান-বেশী পেশাদারী অভিনেতা জয়নারায়ণ বাগচির বিপরীতে নিউকামার রমণীমোহন বেশ ভালোই অভিনয় করলেন। কেবল, পাখা সত্তেও তিনি যে এত ঘামছেন, সেটা বোধহয় প্রথম দিনের উত্তেজনা ও কিঞ্চিৎ নার্ভাসনেসের জন্য। শট-এর সময়ে এটা না হলেই আর কোনো চিন্তার কারণ থাকবে না।
এবার ডিরেকটার সাহেব ‘লাইটস!’ বলে চেঁচাতেই সেটের প্রয়োজনীয় সব আলোগুলো জ্বলে উঠলো; অভিনেতা দুজন তাঁদের নিজেদের নির্দিষ্ট গণ্ডীর মধ্যে হেঁটে চলে দেখে নিলেন যে আলো ঠিক আছে। ঠিক আছে বলছি অবিশ্যি বাংলা ছবির কথা ভেবে। প্রাসাদের দেয়াল যে চটের তৈরি সেটা বিশ হাত দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছে, মেক-আপ আর পোশাক একেবারে যাত্রামার্কা। তবে এ-টুকু জানি যে রমণীমোহন যদি উৎরে যায় তাহলে এ ছবি হিট হবার সমূহ সম্ভাবনা।
‘সব রেডি?’ হাঁক দিয়ে প্রশ্ন করলেন পরিচালক জগদীশ নস্কর। নস্কর সাহেব হচ্ছেন সেই জাতের পরিচালক যিনি যার যার কাজ তাকে তাকে দিয়ে নিজে পরম নিশ্চিন্ত বোধ করেন। কেবল পরিচালনার সময়টুকুতেও তাঁর ব্যক্তিত্বে একটা পরিবর্তন আসে। তাও সেটা বেশি না। আর এঁর আরেকটি অভ্যাস হচ্ছে যে ইনি কাজের মধ্যে সামান্যতম ফাঁক পেলেই একটু বসে নেন, এবং আরামকেদারা পেলে কক্ষনো মোড়া বা কাঠের চেয়ারে বসেন না।
সব্বাই রেডি ছিল, কাজেই শট নেওয়ায় কোনো বাধা নেই, কিন্তু রমণীমোহন দেখছি ঘেমেই চলেছেন। মেক-আপ অ্যাসিস্টান্ট প্রতি তিন মিনিট অন্তর তোয়ালে দিয়ে তাঁর মুখ ‘প্যাড’ করে দিচ্ছে, কিন্তু তাও ঘামের অন্ত নেই। স্টুডিওতে বৈশাখ মাসে গরম ঠিকই, কিন্তু এখন তো চতুর্দিকে বিরাট বিরাট পাখা চলছে; শট-এর সময়ে সেগুলো বন্ধ হয়ে গেলে কী অবস্থা হবে?
শুটিং-এ একটা রেওয়াজ আছে যে প্রথম দিনের প্রথম শটটা একবার উৎরে গেলে সবাই হাততালি দেয়। বিশেষ করে নতুন অভিনেতা হলে ত কথাই নেই।
কিন্তু অত্যন্ত আক্ষেপ ও বিস্ময়ের ব্যাপার যে পর পর সাতবার চেষ্টার পরেও হাততালির সুযোগ এল না, এবং তার জন্য দায়ী স্বয়ং আলমগীর বাদশা। তাঁর ডায়ালগ ছিল অতি সহজ। বাপকে তিনি বলবেন, ‘আমি ত আগেই বলেছি, আমার পথে কোনো বাধা আমি সহ্য করব না।’ এই কয়েকটি কথা পর পর ঠিকভাবে বলা যে এত কঠিন হতে পারে তা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। ‘আমার পথে কোনো বাধা আমি সহ্য করব না’—এটা একবার হল ‘আমার বাধা আমি কোনো পথে সহ্য করব না,’ তারপর হল, ‘আমার সহ্যের পথে আমি কোনো বাধা দেব না,’ তারপর হল, ‘আমি কোনো পথেই আমার সহ্যে বাধা দেব না,’ আর চতুর্থবার পরিচালক হুঙ্কার দিয়ে ‘অ্যাকশান’ বলার পরে আওরঙ্গজেবের মুখ দিয়ে কোনো কথাই বেরোল না। আমি দেখি তার পা ঠকঠক করে কাঁপছে। সে তার কাছেই একটা সিংহাসন গোছের গদির চেয়ার ছিল, তাতে বসে মাথার পাগড়িটা খুলে ফেলল। তারপর বলল যে তার ব্লাড প্রেশার নাকি মাঝে মাঝে অত্যন্ত বেশি নেমে যায়, সম্ভবত এখনও তাই হয়েছে, তাই একজন ডাক্তারের ব্যবস্থা করতে পারলে ভালো হয়।
রিহার্সাল মোটামুটি ঠিক হয়েছিল বলে সকলে আরো অবাক, কিন্তু আমি ত জানি যে শট নেবার ঠিক আগে যে মুখের সামনে খটাস করে ক্ল্যাপস্টিক মারা হয়, তাতে অনেক পাকা অভিনেতাও টসকে যায়। এখানেও তাই হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
ডাক্তার এসে বললেন প্রেশার নামলেও তেমন কিছু নয়, কিন্তু অভিনেতাকে দিয়ে আজকে আর কাজ না করানোই ভালো।
রমণীমোহন বাড়ি চলে গেলেন। পরিচালকও একা শাজাহানকে নিয়ে গোটা পাঁচেক শট নিয়ে তিনটের মধ্যে কাজ শেষ করে দিলেন।
কিন্তু বাকি কাজ কবে হবে?
আর এই রমণীমোহনকে দিয়ে আদৌ কাজ চলবে কি? নাকি, শেষ মুহূর্তে অন্য অভিনেতা দেখতে হবে?
আমার বস্ মিঃ মুস্তোফি আমায় ডেকে বললেন, ‘তুমি একবারটি ওই ছোকরার বাড়িতে গিয়ে সঠিক খবরটা নিয়ে এস ত। সে নিজে কী মনে করে সেটা জানা দরকার। সে ফ্র্যাঙ্কলি বলুক সে পারবে কি না। যদি কদিন সময় চায় তাও দিতে রাজি আছি, কারণ চেহারার দিক দিয়ে ওকে মানিয়েছিল চমৎকার। হয়ত জড়তাটা টেম্পোরারি। অবিশ্যি দ্বিতীয় দিনেও এই একই ব্যাপার ঘটলে অন্য লোক নিতেই হবে।
মুস্তোফি সাহেব যেন একবার ভুরু কুঁচকে আমার দিকে চাইলেন, ভাবটা যেন—একে দিয়েও ত কাজটা চলতে পারত। কিন্তু তারপর আর কিছু বললেন না, আর আমিও চেপে গেলুম।
দুদিন পরে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে রমণীমোহনের ট্যাগোর কাস্ল্ রোডের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলুম। বেয়ারা আমায় বৈঠকখানায় বসানোর এক মিনিটের মধ্যে বাবু এসে ঢুকলেন। দেখলুম এই কদিনে ওর বয়স যেন বেড়ে গেছে দশ বছর। বললুম, ‘কী ব্যাপার বলুন ত? এরকম হল কেন?’
ভদ্রলোক গভীর আক্ষেপের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বললেন, ‘কী এর বলব বলুন, শুটিং-এর তিনদিন আগে আমার এক বন্ধু এক জ্যোতিষী এনে হাজির করে বলল—“নতুন কাজে হাত দিতে যাচ্ছ, এঁকে দিয়ে একবার ভাগ্যটা যাচাই করে নাও।” আমিও আপত্তি করলুম না, কারণ ওসবে আমার বেশ আস্থা আছে। আর এঁর নাকি জ্যোতিষার্ণব-টার্ণব উপাধি আছে, চেহারাও বেশ ইমপ্রেসিভ। কিন্তু মশাই, হাত দেখার আগেই আমার মাথার দুদিকের রগ বুড়ো আর কড়ে আঙুলে টিপে লোকটা কী বললে জানেন? বললে, “এ লাইন তোমার নয়। অভিনয়ের দিকে যেও না; গেলেই হোঁচট খেতে হবে।”—ভেবে দেখুন তো কী কথা! তিনদিন বাদে শুটিং, পার্ট মুখস্থ হয়ে গেছে, আর লোকটা বলে কিনা আমায় দিয়ে অ্যাকটিং হবে না? সাধে কি ডায়ালগ গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল? যেই মুখ খুলতে যাব অমনি জ্যোতিষীর মুখটা মনে পড়ে যাচ্ছে, আর কে যেন গলার ভেতর পাথর গুঁজে দিচ্ছে। ওফ্! সে যে কী অবস্থা, সে আর আপনাকে কী করে বোঝাব? রাজ্যি শুদ্ধু লোক জেনে গেছে আমি আলমগীর করছি আর সেই সময় অকেজো বলে বাদ হয়ে যাওয়া—এর চেয়ে বেশি অপমান আর কী হতে পারে বলুন?’
আমি আর কী করি? যথাসাধ্য সহানুভূতি দেখালুম। জিগ্যেস করলুম, ‘কী করলে পরে এই বিভীষিকা আপনার মন থেকে দূর হতে পারে? কারণ আপনার মধ্যে যে অ্যাকটিং আছে সে ত আমরা রিহার্সেলেই দেখেছি।’
রমণীমোহন মাথা নাড়ল। ঘাড় হেঁট ছিল, এবার মুখ তোলাতে দেখলুম চোখে জল। আমার হাত দুটো ধরে অত্যন্ত করুণ সুরে বললে, ‘কতদিনের যে স্বপ্ন সিনেমায় অভিনয় করে নাম করব! আর সেই সুযোগ এসেও গ্রহের ফেরে বানচাল হয়ে গেল! এখন আপনি যদি কোনো রাস্তা বাতলাতে পারেন। আমার নিজের মাথায় একটা রাস্তা এসেছে কিন্তু সেটা সভয়ে বলব না নির্ভয়ে বলব বুঝতে পারছি না।’
আমি বললুম, ‘নির্ভয়ে বলুন।’
রমণীমোহন কয়েক মুহূর্ত আমার দিকে চেয়ে থেকে বলল, ‘আপনার অভিনয় আসে?’
‘হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?’
‘কারণ আমার সঙ্গে আপনার চেহারার মিল আছে। সে কথা আমার বেয়ারা প্রসন্নও বলছিল। ভাবছিলুম, আমার বদলে আপনি যদি আমার বাড়ি থেকে মেক-আপটা করে নিয়ে পোশাকটা পরে আমার হয়ে অভিনয়টা করে দিয়ে আসতেন। অবিশ্যি, কিছু লোককে ব্যাপারটা বলতেই হবে। যেমন মেক-আপ-ম্যান যতীন, তার সহকারী হাবুল, আর ড্রেসার তারাপদ। তাদের হাতে কিছু গুঁজে দিলে তারা কখনই ব্যাপারটা ফাঁস করবে না।’
আমি বললাম, ‘তার মানে অভিনয় করবেন তারিণী বাঁড়ুজ্জে আর নাম হবে রমণী চাটুজ্যের?’
‘এ-ছাড়া আর রাস্তা আছে কি?’
‘আর প্রোডাকশন ম্যানেজারের কাজটা কে করবে?’
‘সেটার একটা অন্য ব্যবস্থা করবে ওরা। আপনি বলে দেবেন বোম্বাই থেকে একটা ভালো অফার পেয়েছেন, তাই চলে যাচ্ছেন।’
‘কথাটা মন্দ বলেননি। কিন্তু যদি অভিনয় আমার ভালো হয়, আর তার জন্য যদি কোনো সংস্থা পুরস্কার ঘোষণা করে, তাহলে সেটাও ত আপনিই নেবেন?
‘তা ত নিতেই হবে। তবে আপনাকে পারিশ্রমিক ছাড়াও আমি একটা জিনিস দিতে রাজি আছি।’
‘কী জিনিস?’
‘আমার এই মোগলাই আংটি। আজকের বাজারে এর দাম কত জানেন ত?’
পুরোন ভালো জিনিসের উপর আমার মোহ আছে সেটা ত তোরা জানিস। সেটা তখনও ছিল। বলে দিলুম ‘ঠিক হ্যায়। আমি আপনার প্রস্তাবে রাজি। কিন্তু সবচেয়ে আগে আপনার চিত্রনাট্যটি চাই। ডায়ালগ মুখস্থ করতে হবে ত।’
রমণীমোহন তৎক্ষণাৎ তাঁর ফাইলটা এনে আমায় দিলেন।
সেইদিনই বিকেলে মিঃ মুস্তোফির কাছে গিয়ে বললুম যে রমণীমোহন আরেকটা চান্স চাইছে। বলছে, এবার না হলে যেন তাকে বাদ দেওয়া হয় মুস্তোফি মশাই রাজি হয়ে গেলেন, ওদিকে পরিচালক মশাইকেও খবরটা দিয়ে দেওয়া হল।
রমণীমোহনকে সুস্থ হবার সময় দিয়ে পনের দিন পরে শুটিং রাখা হল। অন্যদের কাজের তারিখ আর স্টুডিওর বুকিংও সেভাবে বদলে দেওয়া হল। যাদের দলে টেনে নেবার কথা তাদের সকলকেই তালিম দেওয়া হয়ে গেছে। আমার জায়গায় নতুন প্রোডাকশন ম্যানেজার এসে গেছে। তাঁকেও দলে টেনে নিয়েছি, কারণ প্রোডাকশন ম্যানেজারের কাছে কোনো কিছু লুকোনো বড় কঠিন ব্যাপার। আমি মুস্তোফি মশাইকে অবিশ্যি জানিয়ে দিয়েছি যে একটা ভালো চান্স পেয়ে বোম্বে চলে যাচ্ছি, এ ছবিতে আর আমার কাজ করা সম্ভব হবে না।
যথারীতি শুটিং-এর দিন এসে পড়ল। সকাল দশটায় রমণীমোহনের লাল শেভ্রোলে এসে ঢুকল ভারত মাতা স্টুডিওতে। তার থেকে আলমগীরের বেশে নামলেন তারিণী বাঁড়ুজ্জে—কার বাপের সাধ্যি ধরে যে অ্যাকটর চেঞ্জ হয়ে গেছে!’
সেই একই দৃশ্য তোলা হবে, সব তৈরি, সবাই তৈরি, ‘স্টার্ট সাউণ্ড’ বলে চেঁচিয়ে উঠলেন পরিচালক। সাউণ্ডম্যানের কাছ থেকে উত্তর এল ‘রানিং’।
‘অ্যাকশন।’
আলমগীর তাঁর বাবার সামনে এসে অত্যন্ত সাবলীলভাবে তাঁর কথা বলে গেলেন; শট-এর শেষে পরিচালক ‘কাট’ বলতেই হাততালিতে স্টুডিও গমগম করে উঠল।
সারাদিনের তেরোটি শট-এর একটিতেও রমণী-তারিণী ঠেকলেন না।
ছবি শেষ হতে লাগল পাঁচমাস। তোরা তখন জন্মাসনি তাই তোদের খবরটা দিতে হচ্ছে যে আলমগীর হয়েছিল সুপারহিট, আর রমণীমোহন বছরের শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে তিনটে সংস্থা থেকে পুরস্কার পেয়েছিলেন। অবিশ্যি তাঁর কেরিয়ারের শুরু এবং শেষ এই একটি ছবিতে, কারণ তাঁর গুরু তাঁকে ফিল্মে অভিনয় করতে বারণ করায় সে প্লাস্টিকের ব্যবসায় চলে যায়। আর আমি হয়ত নিজের নামে ছবিতে একটা চান্স নিতে পারতুম, কিন্তু তখনই উদয়পুরে একটা ভালো চাকরি জুটে গেল। আমার কাছে তখন থেকেই নতুন দেশ দেখার চেয়ে বড় আর কিছু নেই, তাই আর দ্বিধা না করে পাড়ি দিলুম রাজস্থানে। অবিশ্যি সেটা আরেকটা গল্প।
‘তাহলে সেটাও হোক।’ বলল ন্যাপলা।
‘তা কী করে হবে,’ বললেন তারিণীখুড়ো, ‘আগে যেটা বলছি সেটা শেষ হোক।’
আমরা ত অবাক। এ গল্পে আর কী থাকতে পারে?
‘আমি যে দ্বৈত ভূমিকা বা ডবল পাট করেছিলুম সেটাই ত তোদের বলা হয় নি।’ বললেন তারিণীখুড়ো, তাঁর ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি।
‘কিরকম, কিরকম?’ আমরা সকলে একসঙ্গে বলে উঠলাম।
‘আমার বন্ধু ব্রতীনকে দিয়ে রমণীমোহনকে আমিই বলালুম যে নতুন কাজে নামার আগে একবার ভাগ্য গণনা করিয়ে নাও। তখন ব্রতীনই ত জ্যোতিষার্ণবকে নিয়ে যায় রমণীমোহনের কাছে। কে সেই জ্যোতিষার্ণব? হুঁ হুঁ—স্বয়ং তারিণীচরণ বাঁড়ুজ্জে। নিজের হাতে তৈরি মেক-আপ, নিজের হাতে লেখা সংলাপ। বাজিমাৎ না হয়ে যায় কোথায়?’