টলস্টয়, গান্ধী ও আমি
আমার যখন সতেরো কী আঠারো বছর বয়স তখন আমি আবিষ্কার করি যে আমি অন্তর থেকে নৈরাজ্যবাদী। আমার পছন্দ রাষ্ট্রহীন অস্তিত্ব—সৈন্য নেই, পুলিশ নেই, নেই ম্যাজিস্ট্রেট, নেই আদালত। পরিবার, বিবাহ, জাত, শ্রেণি এগুলিতে আমার বিশ্বাস অল্পই। সম্পত্তি, মালিকিস্বত্ব, উত্তরাধিকার, টাকা-খাটানো এগুলোরও কোনো অর্থ হয় না আমার কাছে।
অদৃষ্টের এমনই পরিহাস যে আমিই হয়ে দাঁড়াই রাষ্ট্রযন্ত্রের অঙ্গ। ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে পুলিশ নিয়ে কাজ করি। জজ হয়ে আইন প্রয়োগ করি। আবার ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে ফৌজ নিয়ে কাজ করি, স্বরাজের পরে অর্ধসামরিক ক্রিয়াকলাপ পরিচালনা করি। বেশ বুঝতে পারি যে, আমার জীবিকা নির্ভর করে প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাকে কায়েম রাখার ওপর। যে ব্যবস্থা বৈদেশিক শাসনের চেয়েও গভীর, ধনতন্ত্রের চেয়েও বনেদি, ফিউডালিজমের চেয়েও প্রাচীন।
তবে কি আমি আমার নৈরাজ্যবাদ বিসর্জন দিই বা অতিক্রম করি? না। বরঞ্চ উপলব্ধি করি যে নৈরাজ্যবাদের মধ্যে রয়েছে আরও উন্নত, আরও তৃপ্তিকর ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি। যদি নৈরাজ্যবাদের পূর্বে একটি বিশেষণ বসানো হয়। বিশেষণটি ‘অহিংস’। একথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য যে আগে আসবে অহিংসা, তারপরে আসবে নৈরাজ্যবাদ।
এমনি করে আমি অন্তরের প্রত্যয় থেকে হলুম অহিংস নৈরাজ্যবাদী। এক্ষেত্রে আমার গভীর সাযুজ্য ছিল টলস্টয়ের সঙ্গে, গান্ধীর সঙ্গে। একই বিশ্বাসে বিশ্বাসবান আমরা। সে-বিশ্বাস দাঁড়িয়েছে ঋদ্ধ অভিজ্ঞতার অচলের ওপরে। রণজর্জর জগতে আমরা ধরে আছি সেই নিশ্চিত বিশ্বাসকে যে-বিশ্বাস স্থির থাকবে সব বিপর্যয়ের পরেও, সব ভাঙাচোরার পরেও।
কিন্তু এর মানে কি এই যে আমি টলস্টয়বাদী বা গান্ধীবাদী? না। তার কারণ তাঁদের সঙ্গে দু-তিনটি জায়গায় আমার গুরুতর মতভেদ আছে।
প্রথমত, আমার কাছে আর্ট হচ্ছে নিজেই নিজের লক্ষ্য। মহত্তর লক্ষ্যের উপলক্ষ্য হতে গেলে আর্ট তার আত্মাকে হারায়। অহিংস নৈরাজ্যবাদী হিসেবে আমার আত্মাকে পেতে গিয়ে আর্টিস্ট হিসেবে আমি আমার আত্মাকে হারাতে রাজি নই। নতুন সমাজব্যবস্থায় শিল্পীকে ছেড়ে দিতে হবে তার নিজের মতো করে বাঁচতে, তার নিজের মনের মতো সৌন্দর্যপ্রতিমা গড়তে। তার জীবিকার জন্যে সে এমন লোকের অনুগ্রহনির্ভর হবে না যারা শিল্পকে শিল্প বলে মূল্য দেয় না। এ জায়গায় আমি টলস্টয় ও গান্ধীর মতো আপোশহীন, কিন্তু তাঁদের বিরুদ্ধে।
দ্বিতীয়ত, প্রেম বলতে আমিও মানবপ্রেম বুঝি, যেমন বুঝতেন টলস্টয় ও গান্ধী। কিন্তু আমি প্রেম বলতে আরও বুঝি পুরুষের প্রতি নারীর ও নারীর প্রতি পুরুষের প্রেম। টলস্টয়ের সারাজীবন গেল এর সঙ্গে যুঝতে। গান্ধীও বৃথা চেষ্টা করলেন সন্তোষজনক সমাধানে পৌঁছোতে। টলস্টয়ের অপূর্ব জ্ঞান সত্ত্বেও, গান্ধীর নিখুঁত শিভ্যালরি সত্ত্বেও নারীকে তাঁরা কেউ চিনতেই পারলেন না। অচেতনভাবে নারীকে তাঁরা দেন অধীনতার ভূমিকা, যেমন দিয়ে এসেছেন ধার্মিক পুরুষেরা এতকাল মাতৃত্বের নামে। গৌরবে দিশাহারা হয়ে। আসলে কিন্তু নারীকে তাঁরা নরকের মতো ডরাতেন। তাঁদের সহজাত সংস্কার তাঁদের বলত, নারী ও পাপ একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। আমি এ মনোবৃত্তি সম্পূর্ণ অস্বীকার করি। নতুন সমাজব্যবস্থায় মানবপ্রেম ও নরনারীর প্রেম সমান গুরুত্ব পাবে।
তৃতীয়ত, টলস্টয় বা গান্ধী কেউ বিশ্বাস করতেন না আধুনিক সভ্যতায়। আমি বিশ্বাস করি। এই সভ্যতার কতকগুলি মূল্য যে মন্দ তা আমিও মানি। কিন্তু কতকগুলি মূল্য আছে যা ভালো, যা উৎকৃষ্টতর, যা অনন্য। এই মার্গই বিবর্তনের মার্গ। এই মার্গে চলতে চলতে আমরা মন্দকে অতিক্রম করতে পারি। যন্ত্রপরায়ণ, নাগরিক, প্রকৃতির সঙ্গে যুধ্যমান, দুর্বলের যম, নির্মমভাবে হিংস্র এই সভ্যতা নিজের হাতেই মরবে, যদি-না এর অন্তরের পরিবর্তন হয়। তা বলে এর কীর্তিগুলো কেবলমাত্র আধিভৌতিক নয়, আধ্যাত্মিকও বটে। এ সভ্যতা আমাদের বহু পরিমাণে দিয়েছে অভাব থেকে, উৎপীড়ন থেকে, অতীত উপাসনা থেকে, পারলৌকিকতা থেকে, সামাজিক অবিচার থেকে মুক্তি; বহু পরিমাণে সাম্য, বহু পরিমাণে জ্ঞান। বহির্বিশ্বের জ্ঞান তো বটেই, অন্তজর্গতের জ্ঞানও। সত্যই যে ভগবান, এটি আধুনিক সভ্যতারই দান। এমনকী অহিংসার নতুন ব্যাখ্যাও আধুনিক সভ্যতার কল্যাণে। টলস্টয় ও গান্ধী উভয়েই আধুনিক সভ্যতার সন্তান। আমিও। কিন্তু সজ্ঞানে।