টয় পিস্তল

টয় পিস্তল

হঠাৎ আজব দৃশ্য দেখে ঘরসুদ্ধ লোক প্রথমে হতভম্ব হলো, পরে প্রচণ্ড অট্টহাসির ধুম পড়ে গেল। আমি তো হাসতে হাসতে দুহাঁটুর ফাঁকে মাথা গুঁজে প্রায় মরার দাখিল–ফুসফুস ফেটে যাবে মনে হচ্ছিল। তারপর কর্নেলের করুণ ও অস্ফুট স্বগতোক্তি শুনলুম-ওটা কেড়ে নিন ওর হাত থেকে। কেড়ে নিন!

মুখ তুলে টেবিলের ওপর দুহাত ভোলা, অর্থাৎ হ্যাঁণ্ডস আপ ভঙ্গিতে কর্নেল নীলাদ্রি সরকারকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলুম এবং ফের দমফাটানো হাসির চাপ এল। মেঝেয় ছোট্ট মেয়ে নিন তখনও খেলনার পিস্তলটা তাক করে আছে।

কিন্তু সেই মুহূর্তে আমার ষষ্ঠেন্দ্রিয়ের বোধ থেকে জানলুম-কর্নেলের মুখে এবং ওই ভঙ্গিতে দেখেছি তা যেন একটি ছোট মেয়ের সঙ্গে কৌতুক নয়। তা যেন ভান নয় মোটেও। যেন কোনও হিংস্র আততায়ী সত্যি সত্যি একটা প্রকৃত মারাত্মক আগ্নেয়াস্ত্র তার দিকে তাক করেছে।

একি আমার নিছক দেখার ভুল? কর্নেল নীলাদ্রি সরকার স্বভাবত সিরিয়াস টাইপের মানুষ। তার মানমর্যাদাও সামান্য নয়। বিশেষত প্রতাপপুর অখনির মালিকের এই বাড়িতে তিনি এখন একজন বরেণ্য অতিথি।

বিজয়েন্দু রায়ের সাত বছরের মেয়ে নিনা টয় পিস্তল হাতে ঘরে ঢুকেই তাকে তাক করে যেই বলেছে–হ্যাণ্ডস আপ, অমনি কি না ওই রাশভারী বৃদ্ধ কর্নেল আচমকা একলাফে কোণায় উঁচু টেবিলে উঠে দাঁড়ালেন–শুধু তাই নয়, দুহাত তুলে চেঁচিয়ে উঠলেন–নো নো নো! মিসেস রায়! মিসেস রায়! ওটা কেড়ে নিন।

পরক্ষণে চন্দ্রকণা মেয়ের হাতের টয় পিস্তলটা কেড়ে নিয়েছেন বাবাঃ! খুব ভয় পেয়েছেন কর্নেলদাদু। দেখছ না–হ্যাণ্ডস আপ করেছেন? ব্যস! এবার তুমি অন্য খেলা খেল গে কেমন?

ঘরে তখনও হাসির আবহাওয়া। কর্নেলকে নামতে দেখলুম! কিন্তু আশ্চর্য, মুখটা গম্ভীর। সোফার আগের জায়গায় বসে কঁচুমাচু হয়ে বললেন–আপনারা ক্ষমা করবেন আমায়। জাস্ট এ ফান। কিন্তু রিয়েলি–এত হঠাৎ ও অমনভাবে ঢুকল যে…মাই গড! হোয়াট এ ফান!

ফের সবাই হাসল। নিনা ওর মায়ের হাত থেকে পিস্তলটা নেবার চেষ্টা করছে। আমি বললুম–দিয়ে দিন না! তখন চন্দ্রকণা সেটা ওকে ফেরত দিলেন। মুখে প্রচুর হাসি।

নিনা পিস্তলটা নিয়ে ফের কর্নেলের দিকে তাক করতেই কর্নেল এবার সব গাম্ভীর্য এবং কঁচুমাচু ভাব ভেঙে হো হো করে হেসে ফেললেন এবং ডাকলেন– নিনি! চলে এস। দেখি তোমার পিস্তল! হুঁ–দেখি দেখি!

খুব ভয় পেয়েছিলুম। দারুণ ভয়! বসে কর্নেল ওর পিস্তলটা নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন।বাঃ! চমৎকার পিস্তল কিন্তু! আজকাল আমাদের খেলনা তৈরিতে খুব উন্নতি করেছে। ইয়ে মিসেস রায়, এটা–এটা বুঝি সম্প্রতি কেনা হয়েছে?

চন্দ্রকণা জবাব দিলেন—হ্যাঁ। পরশু উনি কলকাতা থেকে এনে দিয়েছেন। নিনা কদিন থেকে টয় পিস্তলের বায়না ধরেছিল, আজকাল বাচ্চা ছেলেমেয়েরা ওয়েস্টার্ন ফিল্মের কায়দায় গানডুয়েল খেলতে ভালবাসে। নিশ্চয় লক্ষ্য করে থাকবেন কর্নেল?

কর্নেল বললেন–তাই বটে! তবে আর একটা ব্যাপার নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন মিঃ রায়? আজকালকার খেলনা কিন্তু মোটেও খেলনার মতো দেখায় না। অবিকল আসলের ক্ষুদে সংস্করণ। তাই না? যেমন এই টয় পিস্তলটাই দেখুন। পরীক্ষা করার আগে কার সাধ্য এটা খেলনা ভাবতে পারে? তাছাড়া ওজনও দেখছি প্রকৃত পিস্তলের মতো।

এবার সকৌতুকে বললুম–তাই বুঝি আপনি প্রাণভয়ে টেবিলে চড়েছিলেন? কিন্তু আপনার কিলার নিনাও যে একটা বাচ্চা মেয়ে সে কথাটা নিশ্চয় মাথায় ঢোকেনি?

কর্নেল একটু হেসে রহস্যময় ভঙ্গিতে মাথা দোলালেন। বিজয়েন্দু হাসতে হাসতে বললেন–যদি সিরিয়াসলি ধরেন তাহলে বলব কর্নেলের গোয়েন্দা। মানসিকতারই এটা একটা প্রকাশ। অনবরত হত্যাকারীর মুখোশ ফাস করা যার নেশা ও পেশা, তার মনে এমন আতঙ্ক থাকা স্বাভাবিক।

একটু পরে সুদৃশ্য ট্রে এবং পট-পেয়ালায় কফি তার সঙ্গে কিছু স্ন্যাকস এল। এখন সকাল সাতটা। যে ঘরে আমরা বসে আছি তা পাহাড়ের গায়ে একটা বাংলোবাড়ি। দক্ষিণ-পশ্চিমে বিস্তৃত সুন্দর উপত্যকা, পূর্বে ছোটোখাটো পাহাড় এবং উপত্যকা পেরিয়ে একটা নদী, পূর্বের পাহাড় ঘেঁসে দক্ষিণে চলে গেছে। সময়টা সেপ্টেম্বর। তাই প্রাকৃতিক দৃশ্য তুলনাহীন।

খনি রয়েছে এই পাহাড়ের উত্তর দিকের অন্য একটা উপত্যকায়। এখান থেকে দুমাইল দূরে একটা সুন্দর পীচের রাস্তা বাংলোর পশ্চিম গেট থেকে শুরু হয়ে উত্তর ঘুরে উতরায়ে নেমেছে এবং বড় সরকারী সড়কে মিশেছে। ওই সড়ক ধরে এগোলে খনিতে পৌঁছানো যায়।

আমরা, দৈনিক সত্যসেবকের রিপোর্টার শ্রীমান জয়ন্ত চোধুরী এবং তার বৃদ্ধ বন্ধু গোয়েন্দা ও প্রকৃতিবিদ কর্নেল নীলাদ্রি সরকার দৈবাৎ এসে পড়েছি এখানে। দক্ষিণ-পশ্চিমের উপত্যকার জঙ্গলে কর্নেল কিছু বিরল প্রজাতির প্রজাপতি সংগ্রহ করবেন এবং আমি তাকে নিছক সঙ্গ দেব। ফরেস্ট বাংলোয় ওঠার কথা ছিল। কিন্তু পথে হঠাৎ বিজয়েন্দুর সঙ্গে দেখা এবং কর্নেল তার পরিচিত–অতএব কিছুতেই জঙ্গলে কাটাতে দেবেন না। তার অতিথি হয়ে গতকাল সন্ধ্যায় এখানে আসতে হলো। এখন এ ঘরে রায়দম্পতি ও তাদের মেয়ে নীনা ছাড়া আরও তিনজন ভদ্রলোক আছেন। আলাপ হয়েছে পরস্পর। সতীনাথ চাকলাদার কলকাতা থেকে এসেছে নিছক শিকারে। তিনি নামকরা শিকারী। আমাদের যে ফরেস্ট বাংলোয় থাকার কথা তিনি সেখানেই একটা ঘরে আছেন। এসেছেন গত পরশু। বিজয়েন্দু ওঁর বন্ধু। নরেন্দ্র সিংহরায় পাঁচ মাইল দূরের প্রতাপগড় বাজারের একজন ব্যবসায়ী। আর আছেন শ্যামল মুখার্জি বিজয়েন্দুর খনির ম্যানেজার।

বিজয়ের বয়স চল্লিশ-বেয়াল্লিশ। শক্ত সমর্থ বলিষ্ঠ গড়নের মানুষ, কেমন যেন বন্য চেহারা। গোঁরগোবিন্দ বলে মনে হয়েছে। শিকারী সতীনাথ কিন্তু উল্টো চেহারার ও স্বভাবের। ওঁর হাসিটি এত চমৎকার যে, ভাবাই যায় না এই মানুষ হিংস্র বন্য জন্তুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়তেও ওস্তাদ। রোগা, ঢ্যাঙা, বয়সে বিজয়ের কাছাকাছি। নরেন্দ্রবাবু হোঁদলকুতকুতে গড়নের সুখীসুখী চেহারার মানুষ বয়স অনুমান পঁয়তাল্লিশ-ছেচল্লিশ। সবসময় পান খান। কথা খুব কম বলেন। বেশি হাসেন। শ্যামলবাবু আমার বয়সী, অর্থাৎ বত্রিশ। সফিস্টিকেটেড বলা যায়, একটু গম্ভীর। তীক্ষ্ণ চোখজোড়ায় সর্বজ্ঞের হাবভাব। চন্দ্রকণা কিন্তু স্ত্রী হিসেবে বিজয়েন্দুর। বেমানানই বলব। অসাধারণ সুন্দরী তো বটেই বয়সেও মনে হলো অন্তত দশ বারো বছরের ছোট, স্বামীর চেয়ে।

কফি খেতে খেতে এবার শিকারের গল্প শুরু হলো। আমারও শিকারে এক আধটু নেশা ও অভিজ্ঞতা আছে। সঙ্গে রাইফেলও এনেছি একথা শুনে সতীনাথ আমার দিকে ঝুঁকলেন। বেগতিক দেখে কর্নেল বলে উঠলেন–তবে সাবধান মিঃ চাকলাদার, জয়ন্ত মাঝেমাঝে ভুলে যায় যে ওর হাতে রাইফেল আছে। ও খাঁটি রিপোর্টারের মতো বধ্য জন্তুর দিকে তাকায় যেন সত্যসেবকে কীভাবে ফাস্ট লাইনটা শুরু করবে। সুতরাং সাবধান!

সবাই হাসলেন। ওঁকে আশ্বস্ত করে বললুম–আমি এবার শিকার-টিকারে বেরুচ্ছিনে। এখানে বসে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখেই সময় কাটাব।

সতীনাথ বললেন কর্নেলও তো শুনেছি পাকা শিকারী! সুতরাং বেরুতে হলে তিন জনেই বেরুব। কী বলেন কর্নেল?

 এইসব গপ্পসপ্প হতে হতে আটটা বেজে গেল। চন্দ্রকণা ততক্ষণে মেয়েকে নিয়ে অন্য ঘরে গেলেন। নিনা খুব চঞ্চল মেয়ে।

তারপর সতীনাথ আমাদের দুজনকে ফরেস্ট বাংলোয় আমন্ত্রণ জানিয়ে চলে গেলেন। একটু পরে নরেন্দ্র বেরিয়ে গেলেন। তার কিছু পরে শ্যামলবাবু ও বিজয়েন্দু কাজকর্ম নিয়ে পাশের ঘরে কথা বলতে চলে গেলেন। ঘরে রইলুম কর্নেল ও আমি।

কর্নেলের মুখটা আবার গম্ভীর দেখাচ্ছিল। বললুম–হ্যালো ওল্ড ম্যান! ব্যাপারটা কী, বলুন তো!

কর্নেল তাকালেন–কিছু কি বলছ, ডার্লিং?

 উনি কি যেন ভাবছিলেন। বললুম–এনিথিং সিরিয়াস?

কর্নেল ঘাড় নাড়লেন। তারপর ঠোঁট ফাঁক করলেন–কিন্তু কিছু বললেন না।

মনে হচ্ছে একটা কিছু চক্রান্ত করছেন?

কর্নেল হঠাৎ আমার হাতে হাত রেখে চাপা গলায় বললেন-জয়ন্ত! ওই টয় পিস্তলটা–

উনি থামতেই চমকে উঠে বললুম–কেন? আপনার কি মনে হলো ওটা টয় পিস্তল না।

-হ্যাঁ, ডার্লিং। ওটা একটা খেলনার পিস্তলই বটে!

 –তাহলে?

 –কিন্তু আশ্চর্য, জয়ন্ত, আশ্চর্য!

এবার বিরক্ত হলুম। সব তাতেই ওঁর যেমন নাক গলানো অভ্যাস তেমনি যেন আজকাল সব কিছুতেই রহস্য টের পাবার বাতিক দাঁড়িয়েছে। বললুম–একটা টয় পিস্তলে কী আশ্চর্য থাকতে পারে বুঝলুম না! ছেড়ে দিন।

কর্নেল আমার বিরক্তি অগ্রাহ্য করে ফের বললেন–ওটা অবিকল আসল পিস্তলের মতো দেখতে। এমন কি ওজনও একই। কেন জয়ন্ত, কেন?

নির্ঘাৎ ওঁর এবার ভীমরতি ধরেছে। অগত্যা উঠে দাঁড়িয়ে বললুম–আপনার কিঞ্চিৎ ভোলা বাতাস সেবন করা দরকার। টুপি খুলে টাক বিকশিত করে, হে প্রাজ্ঞ ঘুঘুমশায়, নদীর ধারে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন। ঘিলুর ধুলোময়লা সাফ হয়ে। যাবে। আসুন।

কর্নেলও উঠে দাঁড়ালেন, তখুনি সায় দিয়ে বললেন–ঠিকই বলেছ ডার্লিং। এর চেয়ে আপাতত আরামদায়ক কিছু নেই। ওঃ, এই ঘরে যেন আমার দম আটকে আসছে।

.

সেই যে বেরুলুম দুজনে, পুরো দুপুর কেটে গেল জঙ্গলে-জঙ্গলে। কর্নেলকে স্বাভাবিক দেখে আশ্বস্ত হয়েছিলুম। কাঁধে কিটব্যাগ নিয়েছিলেন। তার মধ্যেese প্রজাপতি ধরা জাল আর ভাজকরা খাঁচাও ছিল। আড়াইটে অব্দি সাতটা প্রজাপতি ধরলেন উনি। পাখির পিছনেও বাইনোকুলার চোখে নিয়ে ছোটাছুটি করলেন। আমার অবস্থা তখন শোচনীয়। অবশেষে কর্নেলের দৃষ্টি ঘড়ির কাঁটার দিকে আনা গেল এবং দুজনে গলদঘর্ম হয়ে ফেরার পথে পা বাড়ালুম। ..

কিন্তু নদীর ধারে এসে হঠাৎ কর্নেল বললেন–জয়ন্ত, মনে হচ্ছে আমরা ফরেস্ট বাংলোর কাছে এসে পড়েছি। একবার অন্তত মিঃ চাকলাদারের সঙ্গে দেখা করা উচিত। কী বলে?

বিরক্ত হয়ে বললুম–লাঞ্চের সময় চলে গেল যে। তাছাড়া উনি এখানে, আছেন, না জঙ্গলে ঘুরছেন–ঠিক নেই!

কর্নেল আমার হাত ধরে সস্নেহে টানলেন। –ডার্লিং, এটা ভদ্রতা। জঙ্গলে আছি কিন্তু আমরা মানুষ।

বলে উনি যেন বীরবিক্রমে হাঁটা শুরু করলেন। একটু পরেই টের পেলুম, এ যাওয়া স্বাভাবিক গতিতে নয়। তাড়া খাওয়া জন্তুর মতো ঝোপঝাড় ভেঙে আগাছা মাড়িয়ে যেন আশ্রয়ের খোঁজে ছুটে যাওয়া। কয়েকবার ওঁর টুপি কাঁটায় আটকে গেল। দ্রুত ছড়িয়ে নিলেন। আমিও প্রায় ক্ষতবিক্ষত হলুম। তারপর হঠাৎ কর্নেল আমাকে টেনে ধরে বসিয়ে দিলেন এবং নিজেও বসলেন। ঝোপের আড়াল ছিল। তার ওধারে ফরেস্ট বাংলোটা দেখা যাচ্ছিল। নদীর এপারেই একটা টিলার গায়ে রয়েছে সেটা। তারপর দেখলুম, কর্নেল বাইনোকুলার দিয়ে বাংলোটা দেখছেন। আমি অবাক এবং অস্থির।

একটু পরে ঘুরে কর্নেল চাপা গলায় বললেন–এক মিনিট, জয়ন্ত। তুমি এখানে অপেক্ষা করো, আমি এখুনি আসছি। সাবধানে, যেভাবে বসে আছ, তাই থাকবে। নড়ো না।

কোনও প্রশ্নের সুযোগ না দিয়ে উনি গুঁড়ি মেরে এগোলেন। ওঁর ভঙ্গি দেখে, মনে হলো, একটা ক্ষুধার্ত সিংহ যেন চুপিসারে তার শিকারের দিকে এগিয়ে চলেছে। একটু পরেই ওঁকে গাছপালা ও ঝোপের আড়ালে অদৃশ্য হতে দেখলুম। এই অদ্ভুত কাণ্ডের মাথামুণ্ডু না খুঁজে পেয়ে অগত্যা হাল ছেড়ে দিতে হলো। ঝোপের ফাঁকে দুরের ওই বাংলোর দিকে চোখ রইল আমার।

কিন্তু বাংলো যেমন নির্জন ছিল তেমনিই আছে। জনপ্রাণীটি নেই। পনের মিনিট কেটে গেল। তারপর সামনের দিকে শুকনো পাতা মচমচ করে উঠল। শব্দটা এগিয়ে আসতে থাকল। রাইফেলটা সঙ্গে নিয়ে বেরোয়নি। তাই অসহায় হয়ে আশা করতে থাকলুম যে, ওই শব্দ যেন কর্নেলেরই হয়। শেষ অব্দি আশা মিটল। আন্দাজ দশ গজ দূর থেকে কর্নেলের টুপি চোখে পড়ল। ওঁর মুখে অমায়িক হাসি। কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন–যে পথে এসেছি সেই পথে এই ভাবেই ফিরতে হবে, জয়ন্ত। সাবধান।

অতএব ফের সেইসব কাঁটায় খোঁচা খেতে খেতে আগের জায়গায় পৌঁছানো গেল এবং এবার উনি চড়া গলায় জঙ্গলের সৌন্দর্যের প্রশংসা করতে করতে সুপথে পা বাড়ালেন।

বিজয়ের বাংলোর কাছে পৌঁছে এতক্ষণে বললুম–এসবের মানে কী?

কর্নেল আমার হাত টেনে নিয়ে বললেন-অধৈর্য হয়ো না। ঠিক মতো সব কিছু চললে তুমি এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারবে। জয়ন্ত, এটা আমার দূরদৃষ্টি বলতে পারো। যেখানে যাই, এক মারাত্মক আততায়ী আমার সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে এগিয়ে আসে। না, না, ডার্লিং। তুমি ভয় পেয়ো না। আশা করি, খুব বেশি কিছু ঘটবে না।

 অস্থিরতা চেপে রাখতে হলো। আর তখন খিদেয় নাড়িভুঁড়ি জ্বলছে।

.

সেদিন সন্ধ্যায় বিজয়ের সেই ঘরে আবার আজ্ঞা চলেছে। তবে এ-বেলা সেই ব্যবসায়ী ভদ্রলোক, অর্থাৎ নরেন্দ্র সিংহরায় আসেননি। শিকারী বা ম্যানেজারও না। আমি, কর্নেল ও রায়দম্পতি গল্প করছি। গল্প করার সময় কর্নেলের অন্যমনস্কতা লক্ষ করছিলুম। মাঝেমাঝে ঘড়ি দেখছেন আড়চোখে। কে যেন আসবে, প্রতীক্ষা করছেন। কে সে?

পাশের ঘরে নিনা ইংরেজি ছড়া মুখস্থ করছে, শোনা যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে আবার কথাও বলছিল। বাইরে তখন ফুটফুটে শরঙ্কালীন জ্যোৎস্না।

কর্নেলের চঞ্চলতা এবার বিজয়ের চোখে পড়ল। বললেন কর্নেলের কি। শরীর খারাপ করছে?

কর্নেল ব্যস্তভাবে বললেন–ও নো নো! আমি–ইয়ে মিঃ রায়, ভাবছি যে আজ রাতটা বরং ফরেস্ট বাংলোয় গিয়ে কাটাব। ভারি চমৎকার জ্যোৎস্না ফুটেছে। তাছাড়া আজ দুপুরে জায়গাটা দেখে এসেছি–অপূর্ব। আপনি যদি কিছু না মনে করেন

বিজয়েন্দু বললেন, না। মনে করার কি আছে?

 চন্দ্রকণা বললেন কিন্তু এক শর্তে। এখানে ডিনারে না খেয়ে নয়।

কর্নেল বেজার মুখে বললেন–প্লিজ মিসেস রায়। আপনার রাঁধুনীকে কিন্তু আগেভাগেই জানিয়ে দিয়েছি। সে আপনাকে কিছু বলে নি?

চন্দ্রকণা ক্ষুব্ধমুখে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন-কই না তো। তারপর ভেতরে চলে গেলেন। হয়তো রাঁধুনীকে ধমক দিতেই গেলেন।

বিজয়েন্দু একটু হেসে বললেন–তাহলে যা ভেবেছি। শরীর খারাপ। মুশকিল– কী জানেন, এ জায়গাটা একটা বিউটি স্পষ্ট। কিন্তু জলবায়ুটা তেমন ভাল নয়। আমারও মাঝে মাঝে পেটের অসুখ হয়।

কর্নেল এ সময় আমাকে গোপনে একটু খুঁচিয়ে দিলেন। তারপর বললেন-হ্যাঁ। জয়রেও সেই অবস্থা। তাই ওকেও বলেছি, রাত্তিরটা আমার সঙ্গে উপোস করতে।

আমি হতভম্ব হয়ে বসে রইলুম। পাশের ঘরে চন্দ্রকণা শুনলুম মেয়েকে বকাবকি করছেন–এখন খেলে না। এখন কি খেলার সময়? নিনা অনুযোগ করছে, শোনা গেল।

বাইরে কার সাড়া পাওয়া গেল রায়, আসতে পারি? বিজয়েন্দু উঠে গেলেন। তারপর দেখি, সতীনাথ ঢুকছেন ওঁর সঙ্গে। কর্নেলের মুখে উজ্জ্বল হাসি ফুটল। বললেন–আসুন, আসুন মিঃ চাকলাদার। আপনি না থাকায় মোটেও আচ্ছা জমছিল না। তারপর বলুন, আজ কী শিকার-টিকার করলেন।

সতীনাথ হাসিমুখে বসে বললেন–একটা সাপ মেরেছি। হ্যামাড্রায়াড। অর্থাৎ শঙ্খচুড়।

এরপর ফের গল্পের আবহাওয়া জমজমাট হয়ে উঠল। চন্দ্রকণা ফিরলে সতীনাথ। ফের গোড়া থেকে সাপ মারার ঘটনা শুরু করলেন। তারপর এক ফাঁকে হঠাৎ নিনা। সকালের মতো সেই টয় পিস্তল হাতে ঢুকে পড়ল। বিজয়েন্দু হেসে বললেন নিনি, এবার আর কর্নেলদাদুকে নয়–তোমার শিকারীকাকুকে অ্যাটাক করো! জোরে ট্রিগার টিপবে কেমন? তাহলেই কাকু ব্যস!

অমনি নিনা পিস্তল তাক করল সতীনাথের দিকে। কিন্তু আশ্চর্য, সতীনাথ, ঠিক সকালে কর্নেল যা করেছিলেন, তার চেয়েও হাস্যকর কাণ্ড করে বসলেন। এক লাফে তিনি প্রায় চোখের পলকে ঘর তেকে বেরিয়ে গেলেন। তারপর বাইরে ওঁর। প্রচণ্ড গর্জন শোনা গেল–বিশ্বাসঘাতক। ব্রুট। এর শধ একদিন নেবই নেব।

কর্নেল চেঁচিয়ে উঠলেন–মিঃ চাকলাদার। ফিরে আসুন। কোনও ভয় নেই।

 কিন্তু চেঁচিয়ে ওঠার মধ্যেই উনি একলাফে নিনার পিস্তলটাও ধরে ফেলেছেন। নিনা কেঁদে উঠেছে। চন্দ্রকণা স্তম্ভিত। বিজয়েন্দু হাঁ করে আছেন। সতীনাথের কোনও সাড়া পাওয়া গেল না। ভদ্রলোক কি সত্যি চলে গেলেন?

নিনার হাত থেকে পিস্তলটা কেড়ে নিয়ে কর্নেল হাসতে হাসতে জানালা দিয়ে তাক করলেন এবং আমাদের আরও হতবুদ্ধি ও আতঙ্কিত করে ট্রিগার টিপতেই সত্যিকার পিস্তলের আওয়াজ রাতের স্তব্ধতা খানখান করে দিল। আমার বুক চিব ঢিব করতে থাকল।

বিজয়েন্দু লাফিয়ে উঠে বললেন–সর্বনাশ! নিনা করেছে কী!

কর্নেল ভৎর্সনার ভঙ্গিতে বললেন–আপনার পিস্তলের সঙ্গে নিনার খেলনা পিস্তল বদল হয়ে গেছে, মিঃ রায়। আপনি এবার থেকে অস্ত্রের ব্যাপারে সতর্ক হবেন।

বিজয়েন্দু বললেন–আমি খুব দুঃখিত, কর্নেল। আমার পিস্তলটা ড্রয়ারে থাকে। কিন্তু মনে হচ্ছে, চাবি দিতে ভুলে গিয়েছিলুম। কী সর্বনাশ ঘটে যেত এক্ষুণি! কর্নেল পিস্তলটা ওঁকে দিয়ে বললেন–এবার চলি। জয়ন্ত তুমি গুছিয়ে নাও আর মিঃ রায়, মানুষকে ক্ষমা করতে শিখুন।

বিজয়েন্দু কোনও কথাও বললেন না। পিস্তলটা হাতে নিয়ে গম্ভীর মুখে বসে থাকলেন। নিজেদের ঘরে গিয়ে গোছগাছ করছি, সেই সময় চন্দ্রকণার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না শুনলুম। কর্নেল ফিসফিস করে বললেন-জয়ন্ত, ওই জটিল দাম্পত্য • • সমস্যা মেটাবার ক্ষমতা আমাদের নেই। অতএব দ্রুত বেরিয়ে পড়া যাক।

রাস্তায় গিয়ে বললুম–কিন্তু ব্যাপারটা কী?

কর্নেল বললেন–এখনও টের পাচ্ছ না? সতীনাথ চন্দ্রকণার পুরনো প্রেমিক। বিজয়েন্দু এবার ঠিক করেছিলেন সতীনাথ এলেই মেয়ের হাত দিয়ে ওঁকে খুন করাবেন। খুব সরল পন্থা। দৈবাৎ বাচ্চা মেয়ে তাঁর অটোমেটিক পিস্তলের সঙ্গে নিজের টয় পিস্তল বদল করে নিয়েছে। অতএব হত্যাকাণ্ডের দায়টা আইনের ফাঁকে উড়ে যাবে। আজ সকালে আমি যে আচরণ করেছিলুম, তা বিজয়েন্দুকেই সতর্ক করে দিতে। নির্বোধ বিজয়েন্দু তা আঁচ করেননি। আর, আজ দুপুরে আমার অত সতর্কতার কারণ আর কিছু নয়–বিজয়েন্দু খনিতে যাওয়ার পর চন্দ্রকণা প্রেমিকের কাছে আসবেন, এই ধারণা ছিল। তাই পাছে প্রেমিকদ্বয়ের চোখে পড়ি, একটু সতর্ক হয়েছিলুম।

বললুম–এবং গোপনে গিয়ে সবটা প্রত্যক্ষও করে এসেছিলেন।

কর্নেল বললেন–হ্যাঁ। কারণ আজ সকালেই চন্দ্রকণা ও সতীনাথের হাবভাবে আমার সন্দেহ জেগেছিল। যাকগে, এখন চলো বেচারা সতীনাথকে সান্ত্বনা ও উপদেশ দেওয়া যাক।…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *