টনি টাকিটানি

টনি টাকিটানি

টনি টাকিটানির আসল নাম সত্যি-ই টনি টাকিটানি।

কোঁকড়া চুল আর মূর্তির মতো শারীরিক গড়নের কারণে সব সময়-ই তাকে শংকর বালক বলে ভুল করা হতো। যুদ্ধের পরে অনেক শিশুই চোখে পড়ত যাদের শরীরে মার্কিন রক্তের অস্তিত্ব ছিল। তবে টনির বাবা-মা দুজনেই খাঁটি জাপানি। ওর বাবা শোজাবুরো টাকিটানি ছিলেন জাজ দলের একজন সফল বংশীবাদক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার বছর চারেক আগে নারী ঘটিত এক সমস্যার কারণে তাকে টোকিও ছাড়তে বাধ্য করা হয়। তখন সে তার বাদ্যযন্ত্রটি সঙ্গে নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে চীনে চলে যায়। তখনকার সময় নাগাসাকি থেকে একদিনের মধ্যেই নৌকায় করে সাংহাই যাওয়া যেত। শোজাবুরোর এমন কোনো সম্পদ টোকিও বা জাপানের কোথাও ছিল না যা হারানোর ভয় তার ছিল। কোনো রকম অনুশোচনা ছাড়াই সে জাপান ত্যাগ করে। তখন তার বয়স ২১।

যুদ্ধের উত্থান আর জাপানের চীন অভিযান থেকে শুরু করে পার্ল হারবারে হামলা আর বোমা বর্ষণ সবকিছুকেই টনি খুব সহজভাবে গ্রহণ করেছিল। সাংহাইয়ের নাইট ক্লাবগুলোতে সে বাঁশি বাজাত। তার চাওয়া-পাওয়া খুব বেশি ছিল না। বাঁশি বাজানো, দিনে তিনবেলা খাবার আর দু’একজন নারীর সঙ্গ পেলেই বর্তে যেত সে। একই সঙ্গে সে ছিল নরম আর উদ্ধত। প্রচণ্ডভাবে আত্মকেন্দ্রিক হলেও তার আশপাশের লোকদের প্রতি সব সময়ই দয়ামায়া প্রদর্শন করত, ফলে অধিকাংশ লোকই পছন্দ করত তাকে। তরতাজা, সুদর্শন আর প্রতিভাবান এই বাদ্যযন্ত্রী যেখানেই যেত বরফ ভেজা দিনের দৃঢ় একটা কাকের মতো লাগত তাকে। কতজন নারীর সঙ্গে বিছানায় যেত তার হিসাব রাখা সম্ভব হতে না তার পক্ষে। যাকে কাছে পেত তার সঙ্গেই রাত কাটাত টনি। হোক সে জাপানি, চীনা, সাদা চামড়ার রুশ মেয়ে, বেশ্যা, বিবাহিত মহিলা, বর্ণাঢ্য নারী, কিংবা অসুন্দরী মহিলা। অতি মনোহর বাঁশি, প্রচণ্ড সক্ষমতা আর বিশালাকৃতির লিঙ্গের জন্য সাংহাই নগরীতে খ্যাতি ছিল তার। কেজো বন্ধুত্ব’ তৈরিতে সব সময়ই আনুকূল্য লাভ করত; যদিও সেটা জানত না সে। উচ্চ পদের সামরিক কর্মকর্তা, কোটিপতি, যুদ্ধকালীন ফায়দা লুটত এমন সব গোপন কারবারিদের সাথে ভাল সম্পর্ক ছিল তার। যে-কোনো কারণেই হোক শোজাবুরো টাকিটানি ও তাদের মধ্যে খুব ভাল ব্যাটে-বলে সংযোগ ঘটে গিয়েছিল। ফলে কোনো সমস্যা হলে তারা ওর ভালরকম দেখভালই করত।

কিন্তু মেধাও কখনো আপনার বিপক্ষে যেতে পারে। যুদ্ধ শেষ হলে তার ওই সম্পর্কগুলোর কারণে চীনা আর্মিদের কোপানলে পড়ে যায় সে এবং দীর্ঘদিন কারারুদ্ধ থাকতে হয় তাকে। তার মতো আরও যাদের আটক করা হয়েছিল ক’দিন পর পর সেল থেকে বাইরে নিয়ে বিনা বিচারে হত্যা করা হতো। তেমন কিছু না, একজন গার্ড আসত কয়েদীকে বের করে নিয়ে পিস্তল দিয়ে মাথার খুলিটা উড়িয়ে দিত। শোজাবুরো ভেবেছিল কারগারেই মরণ হবে তার। কিন্তু মৃত্যুর সম্ভাবনা তাকে কোনো ভাবেই বিচলিত করতে পারেনি। মাথায় একটা গুলি করলেই তো সব শেষ হয়ে যাবে। কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার। এতোগুলো বছর যেমন ইচ্ছে তেমন জীবন যাপন করেছি। টনকে টন মেয়ে মানুষের সঙ্গে বিছানায় গেছি, ভাল-ভাল খাবার খেয়েছি, যাপন করেছি চমৎকার সময়, এমন জিনিস কমই আছে যা থেকে বঞ্চিত হয়েছি। তাছাড়া এমন অবস্থায় আমি নেই যে, মৃত্যুর ব্যাপারে অভিযোগ করতে পারি। যা হয় হবে। হাজার-হাজার জাপানি প্রাণ হারিয়েছে যুদ্ধে, তাদের অনেকের জীবন গেছে খুব ভয়ঙ্কর ভাবে। এসব কথা টনি ভাবছিল।

অপেক্ষা করতে করতে শোজাবুরো ছোট্ট জানালা দিয়ে দেখল মেঘেরা উড়ে যাচ্ছে। মনে মনে সে তার সেলের দেয়ালের একটা মানসিক চিত্র আঁকল আর স্মরণ করল সেই সব মেয়েদের মুখ আর শরীর যাদের সঙ্গে সে বিছানায় গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সে দুই সৌভাগ্যবান জাপানিদের একজন ছিল যারা কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে স্বদেশে ফিরে যেতে পেরেছিল। অন্যজন উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল।

শোজাবুরো বোটের ডেকে দাঁড়িয়ে সাংহাইয়ের ছোট হয়ে আসা অ্যাভিনিউয়ের দিকে তাকাল দূর থেকে, ভাবল : আহারে জীবন, এ জন্মে তোকে আমি বুঝতে পারলাম না।

.

শোজাবুরো রোগা হয়ে পড়েছিল, কথা বলার শক্তি ছিল না তার। যুদ্ধ শেষ হওয়ার নয় মাস পরে ১৯৪৬ সালের বসন্তে সে জাপানে ফিরে আসে। ১৯৪৫ সালের মার্চ মাসের বিমান হামলায় টোকিওতে অবস্থিত তাদের পৈত্রিক বাড়িটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। মা-বাবা দুজনেই মারা গেছে ওই হামলায়। একমাত্র ভাই বার্মা সীমান্তে নিখোঁজ হয়েছে। শোজাবুররা এখন এই পৃথিবীতে একা। যদিও এটা তার জন্য কোনো বড় আঘাত নয়। এইসব ব্যাপার তাকে বিশেষভাবে বেদনার্ত করে তুলেছে। তা-ও নয়। হ্যাঁ দুঃখ অবশ্য আছে, আছে হারানোর বেদনা; তবে তার বিশ্বাস আগে হোক পরে হোক একদিন সবাইকে চলে যেতে হয়। তার বয়স তিরিশের কোঠায়, একাকিত্ব নিয়ে অভিযোগ করার বয়স পেরিয়ে গেছে। তার মনে হয় হঠাৎ তার বয়স কয়েক বছর বেড়ে গেছে। আর কোনো আবেগ তার মনে দানা বাঁধেনি। যে কোনো ভাবেই হোক শোজাবুরো রক্ষা পেয়েছে, এখন সে বেঁচেবর্তে থাকতে চায় এই ধরাধামে।

বাঁশি বাজানো ছাড়া আর কিছু জানত না বলে সে ওই কাজের জন্য পুরনো কিছু বন্ধুবান্ধবকে খুঁজে বের করে এবং একটা জাজ ব্যান্ড দাঁড় করিয়ে ফেলে যেটি একটি মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে বাজাতে শুরু করেছে। লোকেদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে পারদর্শিতার কারণে সে জাজ ভালবাসে এমন একজন মার্কিন মেজরের সঙ্গে বন্ধুত্ব। পাতাতে সক্ষম হয়। অবসরে তারা দুজন একত্র হয়। মেজর তাকে সব ধরনের খাবার- দুধ, তরল খাবার সরবরাহ করে যা এই বাজারে জোগাড় করা দুষ্কর। শাজাবুরো ভাবে খারাপ নয়, বেঁচে থাকার জন্য খারাপ সময় নয় এটা মোটেও।

১৯৪৭ সালের দিকে এক দূর সম্পর্কের খালাত বোনকে বিয়ে করে সে। একদিন তারা একসাথে বসে চা পান করে, আত্মীয়স্বজনদের খোঁজখবর করে আর পুরনো দিনের নানা স্মৃতি নিয়ে আলাপ করে। শেষে তারা একসাথে বসবাসের সিদ্ধান্ত নেয় সম্ভবত এ কারণে যে, খালাত বোনটি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছিল। তার জন্মের ব্যাপারে। টনি টাকিটানি তার বাবার কাছ থেকে এমনটাই শুনেছিল। তার মা খুবই সুন্দরী ছিল, শান্তশিষ্ট মেয়ে ছিল সে, তবে স্বাস্থ্য ভাল ছিল না খুব একটা। বিয়ের এক বছর পর টনির জন্ম হয় আর এর তিন দিন পর মারা যায় সে। তাকে নীরবে ও দ্রুততার সাথে দাহ করা হয়। তার কোনো জটিলতা বা ভোগান্তির অভিজ্ঞতা হয়নি। যেন হঠাৎ করেই শূন্যে মিলিয়ে যায় সে।

বিষয়টি কী ভাবে অনুভব করতে হবে সে সম্পর্কে কোনো ধারণা শোজাবুরোর ছিল না। এই আবেগের কাছে সে যেন এক আগন্তুক। একটা অবিসংবাদিত ঘটনা হিসেবে ওটিকে হজম করে ফেলা ছাড়া আর কী-ই বা করার আছে তার? সে টের পায় অস্বস্তিকর কী একটা যেন তার বুকের ওপর চেপে বসে আছে। ওটা কী, আর ওখানে কেন তা সে বলতে পারে না। হাসপাতালে পড়ে থাকা শিশুটার কথা পর্যন্ত ভুলে বসে শোজাবুরো।

মেজর তাকে বুকে তুলে নেয় আর সম্ভাব্য সবরকম ভাবে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা পায়। তারা একসঙ্গে মদ পান করে। মেজর প্রায়ই তাকে বলে, “শক্ত হতে হবে। তোমাকে। শিশু সন্তানটিকে পালন করে বড় করতে হবে। এসব কথার কোনো মানেই খুঁজে পায় না সে। নীরবে শুধু মাথা নাড়ে। একদিন মেজর তাকে বলে, “তোমার ছেলেকে আমি লালন পালন করব, আমি হবো তার পালক পিতা। তার নামটাও আমি রাখব।” শোজাবুরো ভাবল, ছেলেটার একটা নাম রাখতেও ভুলে গেলাম আমি।

মেজর সাহেব পরামর্শ দিলেন-ডাকনাম থাক টনি; যদিও কোনো জাপানি শিশুর নাম সচরাচর টনি রাখা হয় না। কিন্তু এ রকম কোনো চিন্তা তার মনে কদাপিও উদিত হয়নি। ঘরে ফিরে শোজাবুরো একটা কাগজের ওপর লিখল- টনি টাকিটানি, তারপর ওটি টানিয়ে রাখল ঘরের দেয়ালে। পরবর্তী কয়েকদিন সে ওই কাগজটির দিকে বার বার তাকাল। টনি টাকিটানি, খারাপ না, চলে নামটা। মার্কিনীদের জাপানে অবস্থান আরও কিছু দিন স্থায়ী হবে, আমেরিকান ধাঁচের নামটি বাচ্চাটার জন্য বেশ লাগসই হবে, তাছাড়া নামটা বেশ ছোট।

.

ওই নামটা নিয়ে চলাফেরা করা শিশুটির জন্য নিতান্ত মস্করা মাত্র ছিল না। স্কুলে সবাই তাকে ‘আধা-জাপানি’ বলে অভিহিত করত। যখনই নিজের নামটি কারও কাছে বলত সবাই অবাক হয়ে তাকাত তার দিকে। কেউ কেউ মনে করত ঠাট্টা করছে বুঝি ছেলেটি; অন্যরা রেগে যেত।

এ ধরনের অভিজ্ঞতা বালকটিকে পৃথিবীর সবার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখছিল। ওর বাবা সঙ্গীত দলের সঙ্গে বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াত আর একজন হাউসকীপার তার দেখাশোনা করত। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার মতো বয়সে পৌঁছালে সে একাই থাকতে পারত। নিজে রান্না করত, ঘরে তালা লাগাত আর ঘুমাতেও যেত একা।

শোজাবুরো পুনর্বিবাহ করেনি, যদিও বিস্তর বান্ধবী তার ছিল। তবে তাদের কাউকে সে বাড়িতে আনত না। ছেলের মতো সে-ও নিজের দেখভাল নিজেই করত। পিতা আর পুত্র একে অন্য থেকে খুব বেশি একটা ভিন্ন ধরনের ছিল না। উভয়ে নিত্য নিঃসঙ্গতায় ভুগলেও দু’জনের একজনও তাদের হৃদয়টা একে অপরের কাছে মেলে ধরার কোনো উদ্যোগই নেয়নি। এর কোনো প্রয়োজনীয়তাও তারা অনুভব করেনি।

টনি আঁকতে ভালবাসত। ঘরের দরজা বন্ধ করে প্রতিদিন ছবি আঁকত সে। সবচেয়ে বেশি পছন্দ করত মেশিনের ছবি আঁকতে। পেন্সিলের সিস খুব চোখা করে সে বাইসাইকেল, রেডিও, ইঞ্জিন বা এ ধরনের ছবি আঁকত। কোনো চারাগাছের ছবি আঁকলে পাতার শিরা উপশিরা পর্যন্ত ফুটিয়ে তুলত। এ ভাবেই সে ছবি আঁকার কলাকৌশল রপ্ত করত। অন্য বিষয়ের চেয়ে আঁকাআঁকিতে বরাবরই ভাল করত সে, সাধারণত প্রথম পুরস্কার পেত আর্ট কম্পিটিশনে।

অতএব হাইস্কুলের পাঠ শেষ করে ইলাস্ট্রেটর হিসেবে নিজের ক্যারিয়ার গড়ার জন্য আর্ট স্কুলে ভর্তি হবে এটাই ছিল স্বাভাবিক। অন্য কোনো সম্ভাবনা খতিয়ে দেখার কোনো দরকারই ছিল না। ভবিষ্যতে কী করবে তা নিয়ে অন্যরা যখন উদ্বিগ্ন টনি তখন ধুমছে মেকানিক্যাল ড্রইং নিয়ে ব্যস্ত রাখত নিজেকে। স্কুলের শিক্ষকগণ বাঁকা হাসি দিয়ে তার কাজের মূল্যায়ন করতেন, বন্ধুরা তার চিত্রকর্মে আদর্শিক বিষয়ের অভাব আবিষ্কার করত। নিজের কাছে তার ছবি ছিল অপরিপক্ক, কুৎসিত আর অযথার্থ।

গ্রাজুয়েট হয়ে বেরুবার পর তার সবকিছুই বদলে গিয়েছি। তার বাস্তবভিত্তিক কাজের কারণে চাকরি পেতে মোটেও অসুবিধা হয়।ন। সবাই বলত তার কর্ম ‘বাস্তবের চেয়েও বেশি বাস্তব। হঠাৎ করেই সে এমন একজন ইলাস্ট্রেটরে পরিণত হলো যার চাহিদা প্রবল। সে কাজ করতে ভালবাসে এবং বিস্তর কামায়। টোকিওর অভিজাত শহরতলী সেতাগায়াতে সে বড় একটা বাড়ি কেনে। আরও কয়েকটা ফ্ল্যাটের মালিক হয়। ফলে মোটা ভাড়া পেতে থাকে। একজন হিসাবরক্ষক সবকিছু দেখভাল করে।

জীবনের এই পর্যায়ে এসে বেশ ক’জন নারীর সঙ্গে পরিচয় ঘটে তার। কিছু সময়ের জন্য একজনের সঙ্গে থাকে সে। কিন্তু বিয়ের ব্যাপারটা বিবেচনায় আনার কথা ভাল না মোটেও। রান্নাবান্না, ঘরদোর সাফ-সুতরা কিংবা কাপড় ইস্ত্রির মতো কাজগুলো নিজেই সে করে, অসুবিধা হলে হাউসকীপার রাখে। সন্তান লাভের ইচ্ছা জাগে না তার মনে। তার পিতার ভেতর যে সব বিশেষ আকর্ষণ ছিল তা ওর নেই। সত্যিকার কোনো বন্ধুও নেই তার যে তাকে বুদ্ধি পরামর্শ দিতে পারে কিংবা যার কাছে সে মনের সবকিছু অকপটে বলতে পারে বা এক সঙ্গে বসে পান করতে পারে। অথচ প্রতিদিন যেসব লোকের সঙ্গে তার দেখা সাক্ষাৎ হয় তাদের সঙ্গে চমৎকার সম্পর্ক বজায় রাখে। তার ভেতর কোনো অহংকার বা ঔদ্ধত্য নেই। পরিচিত সবাই তাকে পছন্দ করে। এক দু বছর বা তিন বছরে বাবার সঙ্গে দেখা হয় তার কোনো কাজ-টাজ থাকলে। কাজ শেষ হয়ে গেলে একে অপরকে বলার মতো কিছুই থাকে না তাদের। আর এভাবেই নীরবে নিভৃতে বয়ে চলে টনির জীবনের স্রোত।

কিন্তু একদিন কাউকে কেনো রকম জানান টানান না দিয়েই প্রেমে পড়ে টনি। মেয়েটি একটা প্রকাশনা সংস্থায় পার্টটাইম কাজ করত। একটা ইলাস্ট্রেশন নিতে সে টনির অফিসে গিয়েছিল। শান্তশিষ্ট আর গম্ভীর প্রকৃতির মেয়ে। বয়স বাইশের মতো। মুখে সব সময় হাসি লেগে থাকে। দেখতে শুনতে খারাপ নয়, তবে তাকে চোখ ধাঁধানো সুন্দরী বলা যায় না। তারপরও মেয়েটির ভেতর এমন কিছু একটা আছে যা টনিকে নাড়া দিয়েছে। প্রথম যখন মেয়েটিকে দেখে সে এমনভাবে মোহাবিষ্ট হয় যে, নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে তার। এ রকম আন্দোলিত সে কেন হলো তা-ও বলা সম্ভব ছিল না তার পক্ষে।

আকৃষ্ট হওয়ার দ্বিতীয় প্রধান কারণ ছিল মেয়েটার পোশাক। লোকজনের কাপড় চোপড় নিয়ে সে যে খুব মাথা ঘামায় তা-ও নয়। কিন্তু মেয়েটার পোশাকে এমন চমৎকার কিছু একটা সে খুঁজে পেয়েছে যা তাকে মুগ্ধ করেছে। তার পাশে যে সব মেয়ে সে দেখে তাদের পোশাক পরিচ্ছদও চমৎকার; কিন্তু এই মেয়েটা সবার থেকে আলাদা। এমন স্বাভাবিক সুন্দর উপায়ে সে তার কাপড়-চোপড় পড়ে যে, মনে হয় একটা পাখি উড়বার মুহূর্তে নিজেকে ডানার ভেতর লুকিয়ে রেখেছে, যেন সে উড়ে যাবে অন্য কোনো জগতে। এমন স্বচ্ছন্দে আর সুন্দর কাপড় পড়তে কোনো মেয়েকে সে দেখেনি আগে। মেয়েটা চলে যাওয়ার পর সে স্তম্ভিত হয়ে তার টেবিলের পেছনে বসে থাকে। সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত সে কোনো কাজ করতে পারে না।

পরের দিন সে ওই প্রকাশককে ফোনে নানা ছুতোছা করে মেয়েটাকে তার অফিসে পাঠাতে বলে। কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর সে মেয়েটাকে লাঞ্চের আমন্ত্রণ জানায়। খাবার সময় তারা খুব বেশি কথা বলে না। তাদের মধ্যে বয়সের ব্যবধান পনের বছর হলেও আশ্চর্য হয়ে তারা লক্ষ্য করে অনেক কিছুতেই তাদের ভেতর বিস্তর মিল। প্রতিটি ব্যাপারেই তারা একমত হয়। দু’জনের কারও আগে এ ধরনের অভিজ্ঞতা হয়নি। মেয়েটার মধ্যে প্রথমে খানিকটা নার্ভাস ভাব ছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে তা কেটে যায় আর সে ভোলামেলাভাবে হাসতে ও কথা বলতে সক্ষম হয়।

বিদায় নেয়ার সময় টনি বলে, “সত্যিই তুমি কাপড়-চোপড় পড় খুব সুন্দরভাবে।”

সলজ্জ হেসে মেয়েটা বলে, “নানা ধরনের পোশাক পরতে ভালবাসি আমি। আমার বেশির ভাগ টাকাই কাপড়-চোপড় কিনতে চলে যায়।”

সেদিনের পর আরও কয়েকবার সাক্ষাৎ হয় তাদের মধ্যে। কোথায়ও যায় না তারা। একটা নির্জন স্থানে বসে নিজেদের অতীত, তাদের কাজকর্ম, ভাবনা-চিন্তা ইত্যাদি বিষয়ে আলাপ করে। কথা বলতে বলতে কখনো তারা ক্লান্ত হয় না। মনে হয় তারা যেন একে অপরের শূন্যতা পুরণ করে যাচ্ছে।

যখন তাদের মধ্যে পঞ্চমবারের মতো সাক্ষাৎ ঘটে টনি বিয়ের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু স্কুল জীবন থেকে মেয়েটার একটা ছেলে বন্ধু আছে। মেয়েটি স্বীকার করে যে, সময়ের বিবর্তনের সাথে সাথে ওই সম্পর্কের আদর্শিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে, এখন দেখা হলে শুধু তুচ্ছ জিনিস নিয়ে নানা সংঘাত মোকাবিলা করতে হয় তাদের। সত্যিকথা বলতে গেলে টনির সঙ্গে সাক্ষাতে যে স্বাচ্ছন্দ্য ও মজা সে পেয়েছে ওর সঙ্গে তা পায়নি। তার মানে এই নয় যে, ওই সম্পর্কটা সে ভেঙে দেবে। যা-ই থাকুক

কেন মেয়েটির হাতে দেখানোর মতো অনেক যুক্তি আছে। আর তাছাড়া দু’জনের ভেতর বয়সের ব্যবধান পনের বছরের। মেয়েটি এখনও যুবতী, জীবন ও জগৎ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা কম। সে ভাবে ভবিষ্যতে বয়সের ওই ব্যবধান কি কোনো সমস্যা সৃষ্টি করবে? ভাববার জন্য কয়েকটা দিন সময় চায় সে।

ভাববার জন্য যে সময় মেয়েটি অতিবাহিত করছে তার প্রতিটি দিনকে টনির কাছে নরক-যাপনের মতো মনে হচ্ছে। কোনো কাজকর্মই করতে পারছে না সে। একা বসে বসে শুধু মদ পান করে। এই একাকিত্বের যন্ত্রণা থেকে তার ভেতর চরম উদ্বেগ দেখা দেয়। মনে হয় সে যেন কারাগারে বাস করছে। সে ভাবে, আগে কখনো এমন হয়নিতো! প্রচণ্ড হতাশা নিয়ে সে চারদিকের দেয়ালের দিকে তাকায় আর চিন্তা করে, মেয়েটা যদি না করে দেয় তাহলে আত্মহত্যা ছাড়া কোনো রাস্তা খোলা থাকবে না তার সামনে।

টনি একদিন মেয়েটার সাথে দেখা করে আর যা সে ভাবছে হুবহু তাকে বলে। সে জানায় সে খুব একা, আর বিগত বছরগুলোতে অনেক কিছুই সে হারিয়েছে। এখন কেমন করে সে সবকিছু তাকে বোঝাবে।

সে বুদ্ধিমতী মেয়ে। টনিকে সে পছন্দও করে। শুরু থেকেই সে ওকে নিয়ে ভেবেছে। ওর সঙ্গে প্রতিটি সাক্ষাতের পর থেকেই ওর প্রতি তার ভাললাগা উত্তরোত্তর বেড়েছে। সে বুঝতে পারে না এই ভালোগাকে ‘ভালবাসা’ বলে অভিহিত করা যায় কিনা। তবে সে বুঝতে পারে তার ভেতরে চমৎকার এক অনুভূতির সঞ্চার হয়েছে। ওর সঙ্গে জীবন গড়তে পারলে সে সুখীই হবে। অতঃপর তারা বিয়ে করে ফেলে।

.

তাকে বিয়ে করার মাধ্যমে টনির নিঃসঙ্গ জীবনের সমাপ্তি ঘটল। ঘুম থেকে উঠেই সে স্ত্রীর দিকে তাকায়। তার পাশে ওকে ঘুমাতে দেখে সে স্বস্তি অনুভব করে। বিছানায় সে না-থাকলে উদ্বিগ্ন হয় আর সারা বাড়ি তাকে খুঁজতে থাকে। নিঃসঙ্গতার বোধ না থাকাটাই তার কাছে অদ্ভুত লাগে এখন। নিঃসঙ্গতার বোধ না থাকায় তার ভেতর এই আশংকার সৃষ্টি হয় যে, সে আবার না নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে। এই ব্যাপারটি তাকে তাড়া করে ফেরে। এখন কী করবে সে? এই ভয় তার দেহে শীতল ঘামের সৃষ্টি করে। যেহেতু সে তার নতুন জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে, তার স্ত্রীর আকস্মিক চলে যাওয়ার ভয় কমে আসছে। কাজেই তার উৎকণ্ঠাও ধীরে ধীরে কমে আসে। শেষ পর্যন্ত সে সুস্থির হয় আর নিজেকে সুখ আর শান্তির ভেতর মুড়িয়ে ফেলে।

তার শ্বশুর সাহেব কী ধরনের সঙ্গীত সৃষ্টি করেন একদিন সে শুনতে চায়। বলে, “তার বাজনা শুনতে চাইলে তিনি কি মাইন্ড করবেন?”

“সম্ভবত না।” বলল টনি।

তার এক রাতে গিনজা নাইট ক্লাবে গিয়ে হাজির হলো যেখানে শোজাবুরো টাকিটানি বাজিয়ে থাকে। ছোটবেলার পর এই প্রথম সে তার বাবার বাজনা শুনতে এল। শোজাবুরো টাকিটানি সেই বাজনাই বাজাচ্ছিল যা সে অতীতে বাজাত, সেই একই জিলিস যা টনি তার বাল্যকালে রেকর্ডে শুনেছে। শোজাবুরোর রীতি সরল, চমৎকার আর মিষ্টি একে হয়ত শিল্প বলা যায় না, তবে তা খুব দক্ষতা আর পেশাদারিত্বের সঙ্গে বানানো। এই সঙ্গীত দর্শক-শ্রোতাদের দারুণ এক মুডের ভেতর নিয়ে যেতে পারে।

তারপরও টনির মনে হলো এখন যে সঙ্গীত সে শুনছে তা আগের থেকে একটু হলেও ভিন্ন। বেশ কয়েক বছর আগে সে এই বাজনা শুনেছে, শুনেছে শিশুর কান দিয়ে, তবুও তার মনে হলো, যে ভিন্নতাটুকু এখন সে অনুভব করছে তার গুরুত্ব অপরিসীম। তা নিতান্ত সামান্য হলেও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তার খুব ইচ্ছে হলো স্টেজে উঠে বাবাকে বলতে, “এটা কী বাবা? বদলেছে কোনটা?” কিন্তু সে পারলো না। তার মনে কী আছে কোনো দিন বলতে পারবে না সে। তার পরিবর্তে সে বসে বসে বাবার অনুষ্ঠান উপভোগ করল মদ পান করতে করতে। অনুষ্ঠান শেষে খুব হাততালি টালি দিয়ে বউকে নিয়ে বাড়ি ফিরে গেল।

.

এই দম্পতির বিবাহিত জীবনে কোনো ছায়া ছিল না। তারা ঝগড়া ফ্যাসাদ করেনি আর এক সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা সুখের সময় কাটিয়েছে, একসঙ্গে হেঁটেছে, বেড়িয়েছে, সিনেমায় গেছে। কর্মক্ষেত্রে টনির সাফল্য অব্যাহত আছে আর তার স্ত্রী। খুব যযাগ্যতার সাথে তাদের সংসার চালিয়েছে। তবে একটা ব্যাপার টনিকে খানিকটা উদ্বিগ্ন করেছে, তাহলে পোশাকের প্রতি ওর স্ত্রীর অসম্ভব আসক্তি। ভাল কোনো পোশাক চোখে পড়লে না কিনে ছাড়ে না সে। তখন তার চোখে-মুখে অদ্ভুত এক অভিব্যক্তির সৃষ্টি হয়, গলার স্বর পর্যন্ত বদলে যায়। প্রথম যখন ব্যাপারটা টনি লক্ষ্য করে, ভেবেছিল ও অসুস্থ হয়ে পড়েছে। বিয়ের আগেই সে খেয়াল করেছে জিনিসটা। তবে হানিমুনের পর থেকে ব্যাপারটা প্রকট আকার ধারণ করেছে। ইউরোপ ভ্রমণের সময় সে বিপুল পরিমাণ জিনিসপত্র কেনে। মিলান ও পারীতে সে এক বুটিক থেকে আর এক বুটিক, সকাল থেকে রাত আচ্ছন্নের মতো ঘুরে : বেরিয়েছে। কোনো দর্শনীয় স্থানে পর্যন্ত যায়নি। দুমো কিংবা লুভে না গিয়ে তারা ভ্যালেনটিনো, মিসোনি, সেন্ট লরেন্ট, গিভেন্সি, ফেরাগামো, আরমানি, মেরুত্তি, গিয়ানফ্রাঙ্কো ফের-এ গেছে। মহাবিষ্টের মতো সে হাতে যা যা ধরেছে কিনেছে। টনি শুধু তাকে অনুসরণ করেছে, আর বিল পরিশোধ করেছে। সে উদ্বিগ্ন হয়ে ভেবেছে কখন তার ক্রেডিট কার্ডের ব্যালেন্স শেষ হয়ে যায়।

জাপানে ফেরার পরও তার ওই ‘ক্রয়-জ্বর’ প্রশমিত হয়নি। প্রায় প্রতিদিনই কাপড়-চোপড় কিনছে সে। বাড়িতে এখন তার জামা-কাপড়ের বিশাল স্তূপ। ওগুলো রাখার জন্য টনিকে বিশাল-বিশাল কয়েকটি পোশাকাগার বানাতে হয়েছে। ওর জুতো রাখার জন্যও একটা ক্যাবিনেট বানিয়েছে টনি। তারপরও জিনিসপত্র রাখার জায়গা হচ্ছে না। শেষে রুমজুড়ে বড় একটা ক্লোসেট বানাতে হয়েছে তাকে। তাদের বাড়িতে অবশ্য ঘরের অভাব নেই আর টাকা-পয়সা তো কোনো সমস্যাই নয়। নতুন পোশাক পরলে তাকে দারুণ খুশি খুশি লাগে, ফলে টনি সেসব নিয়ে কোনো অভিযোগ-অনুযোগ না তোলার সিদ্ধান্ত নেয়। এই পৃথিবীতে কেউ-ই ত্রুটিহীন নয় টনি ভাবে।

এক সময় তার কাপড়-চোপড়ের পরিমাণ এত বেশি হয়ে যায় যে, বিশাল সে ঘরটিতে শুধু ওর কাপড়ই রাখা হতো সেখানেও স্থান সংকুলান হলো না আর। টনি নিজেও তখন সন্দেহ প্রবণ না হয়ে পারল না। একদিন সে যখন বাইরে ছিল টনি তার পোশাক গণনা করল। হিসাব করে দেখল, দিনে দু’বার কাপড় পাল্টালে ওই পোশাকে সে দু’বছর কোনো রকম রিপিটেশন ছাড়াই ব্যবহার করতে পারবে। সে শুধু পাগলের মতো ওগুলো কিনেছে, পরার সময় করে উঠতে পারেনি। টনি তখন ভাবল কোনো মানসিক সমস্যা সৃষ্টি হলো নাকি ওর। তাই যদি হয়ে থাকে তাহলে তো ওর ওই অভ্যাসটির পায়ে শেকল পরাতে হবে।

এক রাতে টনি ডিনারের সময় বলল, “তোমার পোশাক কেনার বাতিকটা তো একটুখানি কমাতে হয় হে। টাকা-পয়সার প্রশ্ন অবশ্য এটা নয়। তোমার কেনা কাটার ব্যাপারে তো আমার আপত্তি থাকবার কথা নয়, তাছাড়া সুন্দর পোশাকে তোমাকে দেখতে ভালও লাগে আমার, তবে কথা কি জানো এতো এতো দামি পোশাকের কী দরকার আছে?”

ওর স্ত্রী চোখ নামিয়ে কিছুক্ষণ ভাবল, তারপর ওর দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি ঠিকই বলেছ। এতো পোশাকের আমার কোনো দরকার নেই। আমি নিজেও তা জানি। তা সত্ত্বেও আমি নিজেকে সংযত করতে পারি না। সুন্দর পোশাক দেখলেই কিনতে ইচ্ছে হয় আমার। দরকার আছে কি নেই সেই বিচারে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। মোদ্দা কথা আমি নিরুপায় হয়ে পড়ি।”

সংযত হওয়ার শপথ করে সে বলল, “এভাবে কাপড়-চোপড় কিনলে সারা বাড়ি আমার পোশাকে-পপাশাকে সয়লাব হয়ে যাবে।”

কাজেই সে সপ্তাহখানেক বাড়ি থেকে বেরুল না এবং পোশাক কেনা থেকে বিরত থাকল। এই সময়টা সত্যিই তার জন্য ছিল দুর্ভোগের। তার মনে হলো, সে কোনো গ্রহের উপরিতল দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে যেখানে বাতাসের স্বল্পতা রয়েছে। ঘরেই কাটায় সে। একটা করে পোশাক বের করে আর স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ওটার দিকে। ওটা হাতে নিয়ে দলাই মলাই করে, গন্ধ শোঁকে। দু’চারটে আবার পরেও ফেলে। পরে সে আয়নায় নিজেকে দেখে। যত যত বেশি নিজেকে দেখে ততবেশি নতুন পোশাকের আকাঙ্ক্ষা মনের মধ্যে জন্ম নেয়। এক সময় নতুন পোশাকের জন্য তার তৃষ্ণা প্রবল হয়ে ওঠে। সে আর সইতেই পারে না …

তবে স্বামীকে সে গভীরভাবে ভালবাসে। শ্রদ্ধাও করে খুব। সে জানে ও ঠিকই বলেছে। একদিন সে তার প্রিয় এক পোশাক বিক্রেতাকে তার বাড়িতে ডেকে পাঠায়। এবং জানায় যেসব কাপড় সে দশ বারো দিন আগে কিনেছে, কিন্তু এখনও পরেনি সেগুলো সে ফেরৎ নেবে কিনা। দোকানদার জানায় অবশ্যই ফেরৎ নেবে। তিনি হচ্ছেন ওদের একজন ভাল খদ্দের। তার জন্য এইটুকু করতে পারবে না? তখন সে দ্রুত তার রেনাল্ট চিঙ্ক গাড়িটাতে চেপে বসে, আয়োমাতে অবস্থিত অভিজাত কাপড়ের দোকানে গিয়ে পোশাকগুলো ফেরৎ দেয় এবং ক্রেডিট স্লিপ নিয়ে দ্রুত গাড়িতে ফিরে আসে। দোকানের অন্য কোনো পোশাকের দিকে না তাকানোর চেষ্টা করে। পোশাকগুলো ফেরৎ দিতে পেরে অনেকখানি হালকা বোধ করে। নিজেকে বোঝায়, ওগুলোর কোনো দরকারই আমার ছিল না। বাকি জীবন চালিয়ে নেয়ার মতো কাপড় চোপড় আমার আছে। কিন্তু রাস্তায় যখন সে সবুজ সিগন্যাল বাতির জন্য অপেক্ষা করে তখন ফেরৎ দেয়া পোশাকগুলোর কথা মনে পড়ে তার। ওগুলোর রঙ, কাটিং, বুনোট ইত্যাদির কথা স্পষ্ট মনে পড়ে তার। তার মনে হয় ওগুলো তার চোখের সামনে ঝুলে আছে। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে। দু’হাত দিয়ে স্টিয়ারিং শক্ত করে ধরে দীর্ঘ একটা শ্বাস গ্রহণ করে চোখ বুজে ফেলে। সেই মুহূর্তেই চোখ খুলে দেখে সবুজ বাতি জ্বলে উঠেছে। এক্সলেটরে চাপ দেয়। একটা ট্রাক হলুদ বাতি জ্বালিয়ে মোড় অতিক্রম করার চেষ্টা করছিল তখন। সেটি সজোরে রেনাল্টটাকে আঘাত করে। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব শেষ হয়ে যায়।

.

টনি টাকিটানির ঘরে এখন শুধু পোশাক আর পোশাক। এ ছাড়াও আছে ১১২ জোড়া জুতো। এগুলো দিয়ে কী করবে সে এখন? তার সব পোশাক তো আর সে সারা জীবন রেখে দিতে পারবে না। সে একজন ডিলারকে তলব করে হ্যাট ও অন্য কিছু আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র বিক্রি করতে রাজি হলো। মোজা ও অন্তর্বাসগুলো পুড়িয়ে ফেলবে সে। তারপরও বাকি থাকবে বিপুল পরিমাণ কাপড়-চোপড় আর জুতো। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষ হয়ে যাওয়ার পর টনি পোশাকের ঘরে দরজা দিয়ে ওগুলোর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে পার করল ক’টা দিন।

দিন দশেক পরে মহিলা সহকারী চেয়ে কাগজে বিজ্ঞাপন দিল টনি। পোশাকের সাইজ ২, উচ্চতা ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি, জুতোর মাপ ৬, বেতন ভাল, কাজের পরিবেশ ও শর্তাবলী উত্তম। বেতন যেহেতু খুব বেশি ছিল ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য ১৩জন মহিলা এসে হাজির হলো। এদের মধ্যে কমপক্ষে পাঁচজন পোশাকের সাইজের ব্যাপারে মিথ্যে বিবৃতি দাখিল করেছিল। বাকি আটজনের মধ্যে থেকে একজনকে নির্বাচন করল সে।

গড়নের বিচারে মেয়েটি তার স্ত্রীর কাছাকাছি। বয়স মধ্য পঁচিশ। চেহারা বৈশিষ্ট্যহীন। তার পরনে ছিল সাদা ব্লাউজ আর নীল স্কার্ট। পোশাক-আশাক পরিচ্ছন্ন কিন্তু পুরনো।

টনি টাকিটানি মেয়েটিকে বলল, “তোমার কাজ কঠিন নয়। নটা-পাঁচটা অফিস করবে, টেলিফোন রিসিভ করবে, আমার করা ইলাস্ট্রেশন ডেলিভারি দেবে, আমার হয়ে নানা জিনিস রাখবে, ফটোকপি করবে এইসব আর কী। তবে একটা শর্ত আছে। সম্প্রতি আমার স্ত্রী মারা গেছে, বাড়িতে তার প্রচুর জামা কাপড় পড়ে আছে। এগুলোর বেশির ভাগই নতুন অথবা নতুনের মতো। ইউনিফর্মের মতো তুমি এগুলো পরে অফিস করবে। জানি শুনতে অদ্ভুত লাগছে তোমার কাছে; কিন্তু বিশ্বাস কর আমার কোনো খারাপ মতলব নেই। আমার স্ত্রী যে নেই তা বুঝতে আমাকে সময় দেয়া আর কী। তার কাপড়-চোপড় পরে থাকলে আমার শেষ পর্যন্ত ধারণা জন্মাবে আমার স্ত্রী আসলেই মারা গেছে।”

ঠোঁট কামড়াতে-কামড়াতে প্রস্তাবটি নিয়ে ভাবছিল মেয়েটি। অনুরোধটি অদ্ভুত তাতে কোনো সন্দেহ নেই, তবে বিষয়টা বোধগম্য হলো না তার। তার স্ত্রী বিয়োগের ব্যাপারটা বুঝলো। এ-ও বুঝলো তার স্ত্রী অনেক কাপড়-চোপড় রেখে গেছে। কিন্তু এটা কিছুতেই বুঝতে পারল না তার কাপড়-চোপড় পরে অফিস করতে হবে কেন। তবে তার মনে হলো, লোকটাকে দেখে খারাপ মনে হচ্ছে না। স্ত্রী বিয়োগের কারণে তার মনের মধ্যে কিছু একটা তৈরি হয়েছে। কিন্তু তিনি এমন ধরনের লোক নন যার দ্বারা কারও কোনো ক্ষতি হতে পারে। সে যা-ই হোক না কেন, কাজটা তার দরকার; অনেক দিন ধরেই একটা কাজ খুঁজছে সে। বেকারত্ব সংক্রান্ত ইন্সিওরেন্সের মেয়াদও ফুরিয়ে আসছে। এরকম ভাল বেতনের চাকরি আর সে না-ও পেতে পারে।

সে বলল, “মনে হয় আপনার কথা আমি বুঝতে পেরেছি। আমার ধারণা আপনার কথা মতো কাজ করতে পারব আমি। তবে কোন জামা কাপড়গুলো আমাকে পরতে হবে তা যদি একবার দেখাতেন, তাহলে চেক করতে পারতাম আমার গায়ে লাগবে কিনা।”

“অবশ্যই”। টনি বলল। সে মেয়েটিকে তার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে কাপড় চোপড়গুলো দেখতে দিল। কোনো ডিপার্টমেন্ট স্টোর ছাড়া এক সঙ্গে এক জায়গায় এত পোশাক-আশাক জীবনেও দেখেনি সে। প্রতিটি পোশাকই দামি ও উন্নত মানের। রুচিও নিখুঁত। সে এত অবাক হলো যে নিঃশ্বাসই নিতে পারছিল না। বুক ধড়ফড় করতে লাগল তার। বুঝতে পারল কামজ উত্তেজনা ঘিরে ধরেছে তাকে।

ঘরের ভেতর তাকে একা রেখে টনি বেরিয়ে গেল। মেয়েটি নিজে নিজেই কয়েকটা পোশাক পরার চেষ্টা করল। কয়েক জোড়া জুতো পছন্দ করে পরে দেখল। সবকিছুই ঠিক মতো লাগছে, যেন তার জন্যই বানান হয়েছে। একটার পর একটা পোশাক সে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। ওগুলোর গায়ে হাত বুলাল আর গন্ধ শুকলো। শত শত পোশাক থরেথরে সাজান। তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল। কিছুতেই সে তার অশ্রু সম্বরণ করতে পারছিল না। যে নারীর পোশাক পরে এখন সে দাঁড়িয়ে আছে সে এই পৃথিবীতে নেই। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল সে তখনও, নিজেকে সামলে নেয়ার চেষ্টা করছিল। তখনই টনি ঢুকল সেখানে।

“কী ব্যাপার কাঁদছ কেন তুমি?”

মাথা নাড়িয়ে সে বলল, “জানি না। এত সুন্দর সুন্দর পোশক আগে কখনো দেখিনি। ব্যাপারটা আমাকে বিচলিত করে তুলেছে। দুঃখিত, ক্ষমা করবেন আমাকে।” একটা রুমাল দিয়ে চোখ মুছল সে।

“না না ঠিক আছে। আমি চাই কালই কাজে যোগ দাও তুমি,” ব্যবসায়ী সুলভ কণ্ঠে বলল টনি, “সপ্তাহখানেক চলে এই পরিমাণ জামা কাপড় আর জুতো নিয়ে যাও।” সপ্তাহের কাপড় আর জুতো পছন্দ করতে অনেকটা সময় ব্যয় করল মেয়েটি। তারপর একটা স্যুটকেসে ভরে নিল।

টনি বলল, “একটা কোটও নিও, ঠাণ্ডা লাগতে পারে।”

একটা গরম কাশ্মিরী কোট পছন্দ করল সে। ওটি খুবই হালকা, মনে হয় পালকের তৈরি। এ রকম হালকা কোট কখনো পরেনি সে।

.

মেয়েটি চলে যাওয়ার পর উনি আবার পোশাকের ঘরে গিয়ে ঢুকল আর শূন্য দৃষ্টিতে ওগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। সে কিছুতেই ভেবে পেল না পোশাকগুলো দেখার সময় কেন মেয়েটি কেঁদেছিল। তার কাছে ওগুলোকে ছায়া বলে মনে হলো যা তার স্ত্রী রেখে গেছে। তার স্ত্রীর সাইজ ২ এর ছায়া সারিবদ্ধভাবে রাখা আছে এ ঘরে। এক সময় এগুলো ওর শরীরের সঙ্গে সেঁটে থাকত। যা তাদেরকে জীবনে উষ্ণতা যোগাত, দিত চলার গতি। তার সামনে টাঙ্গানো এই কাপড়গুলো এখন নোংরা ছায়া ছাড়া আর কিছুই নয়। জীবনের শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন, শুকনো বিবর্ণ বস্তু ছাড়া আর কিছুই নয়, যার কোনো মানেই এখন আর নেই। এখন সে ঘৃণা করে এগুলোকে। দেয়ালের উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে হাত দুটি ভাঁজ করে চোখ বন্ধ করে ফেলে সে। আবার নিঃসঙ্গতা এসে ঘিরে ধরে তাকে। সব শেষ। যা-ই করে থাকি কেন সব শেষ হয়ে গেছে।

সে মেয়েটিকে ডেকে পাঠায় এবং বলে এই চাকরির ব্যাপারটি যেন ভুলে যায় সে। ক্ষমা চেয়ে জানায়, তার জন্য কাজ করবার দরকার নেই আর।

অবাক হয়ে মেয়েটি বলে, “কী করে হয় স্যার?”

“আমি দুঃখিত। অবস্থা বদলে গেছে,” বলল টনি, ‘তুমি এই জামা কাপড় জুতো স্যুটকেস ভরে নিয়ে যেতে পার। আমি চাই ব্যাপারটা তুমি ভুলে যাও, আর কাউকে বোল না কিছু…।।

মেয়েটির কিছুই করার ছিল না। এ নিয়ে কথা বাড়িয়ে কোনো লাভও নেই, কাজেই সে বিদায় নিয়ে চলে গেল।

.

মুহূর্তের জন্য মেয়েটি টনির ওপর ক্ষিপ্ত হলো; কিন্তু শিগগিরই বিষয়টা অনুধাবন করল সে নিশ্চয়ই এর চেয়ে ভাল কোনো সমাধান সে খুঁজে পেয়েছে। শুরু থেকেই ব্যাপারটা ছিল অদ্ভুত। চাকরিটা হলো না বলে খুব মন খারাপ হলো তার। শেষে ভাবল, অন্য কোনো কাজ নিশ্চয়ই জুটে যাবে।

টনি টাকিটানির বাড়ি থেকে আনা পোশাকগুলো সে ইস্ত্রি করে ওয়ারড্রবে ঢুকিয়ে রাখল। আর জুতো রাখল দরজার পাশের ক্যাবিনেটে। সদ্য আনা পোশাকগুলোর তুলনায় তার কাপড় জামাগুলো কত্তো মলিন আর জীর্ণ। সে তার ব্লাউজ ও স্কার্ট খুলে জিন্স আর শার্ট পরে নিল। তারপর বিছানায় বসে ঠাণ্ডা বিয়ার পান করতে লাগল। টনির বাড়িতে দেখা পোশাকগুলোর কথা মনে করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সে। কত্তো সুন্দর সুন্দর পোশাক। আর ওগুলো রাখবার ক্লোসেটটা তার এই অ্যাপার্টমেন্টের চেয়েও বড়। ওগুলো কিনতে না জানি কত টাকা খরচ হয়েছে। আর সেই মহিলাই জীবিত নেই এখন। এত কাপড়-চোপড় রেখে মরে যাওয়া, অবাক লাগে না..

ওই মহিলার বান্ধবীরা ভাল করেই জানত সে ছিল গরিব, তারা প্রতিদিন ওকে নতুন নতুন দামি ও উন্নত ব্র্যান্ডের পোশাক পরতে দেখে অবাক হতো।

“এতো দামি-দামি পোশাক পাও কোথায়?” হয়ত জিজ্ঞেস করত তারা।

সে হয়ত উত্তর দিত, “না বলার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আছি, আর যদি বলিও বিশ্বাস করবে না তোমরা।”

শেষ পর্যন্ত টনি টাকিটানিকে আবারও একজন কাপড়ের ডিলারের শরণাপন্ন হতে হয় যে কিনা তার স্ত্রীর রেখে যাওয়া সব কাপড়-চোপড় কিনে নেয়। সে অবশ্য আসল দামের বিশ ভাগের এক ভাগ দিয়েছিল। কিন্তু টনির কিছু যায় আসেনি। ওগুলোকে সে এমন জায়গায় নিয়ে যাবে তাকে আর কোনো দিন দেখতে হবে না।

মাঝে মধ্যে কোনো দিন হয়ত সে ওই ফাঁকা ঘরটাতে ঢুকবে আর শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে। মেঝেতে বসে দেয়ালের দিকে তাকাবে, চোখ মেলে দেবে তার স্ত্রীর ছায়ার দিকে। কিন্তু কয়েক মাস অতিবাহিত হওয়ার পর ওই ঘরটিতে কী ছিল তা স্মরণে আনার ক্ষমতা হারাতে থাকে সে। ওগুলোর রঙ আর গন্ধের স্মৃতি সে বুঝে ওঠার আগেই ভুলে যায়। তার ভেতরে যে সুস্পষ্ট আবেগ অনুভূতি ছিল তা-ও পিছু হটে। যেন মনের গহন থেকেই বিদায় নিয়েছে তা। প্রতিটি স্মৃতিই এখন ছায়ার ছায়া এবং তার ছায়া। শুধু বাস্তব একটা জিনিসই আছে- না থাকার অনুভব।

কখনো কখনো স্ত্রীর মুখখানা সে মনেই করতে পারে না। শুধু এক মহিলার মুখ মনে পড়ে, সেই মহিলাকে মনে হয় আগন্তুক। সে শুধু শূন্য ঘরখানায় বসে চোখের জল ফেলে। দিন অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে সব কিছুই ভুলে গেছে সে, তার নাম; তার ইমেজখানা সে শুধু আশ্চর্যজনকভাবে মনে রেখেছে।

টনির স্ত্রীর মৃত্যুর দু’ বছর পরে লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে তার বাবা মারা গেছে। বেশিদিন অবশ্য ভোগেনি শোজাবুরো টাকিটানি। হাসপাতালেও ছিল অল্প ক’টা দিন। মৃত্যুর পর তাকে দেখে মনে হয়েছে যেন ঘুমিয়ে আছে। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে তার শেষ জীবনটা সে কাটিয়েছে হাসি খুশির মধ্য দিয়ে। সামান্য নগদ ক’টা টাকা আর স্টক শেয়ার রেখে গেছে সে, যাকে সম্পত্তি বলে অভিহিত করা যায় না। কিছু বাদ্যযন্ত্র আর জাজ সঙ্গীতের বড় একটা সংগ্রহ অবশ্য রেখে গেছে সে। টনি ওগুলো একটা ঘরের ভেতর বাক্সবন্দী করে রেখেছে কারণ ওগুলো থেকে। ছাতলার গন্ধ বেরুতে পারে। নিয়মিত তাকে ও ঘরের জানালা খুলতে হবে। তা না হলে ঢোকাই যাবে না সেখানে।

বাক্স ভর্তি ওই রেকর্ডগুলো এখন দারুণ ভোগাচ্ছে তাকে। ওই ঘরে ঢুকলেই দম বন্ধ হয়ে আসে তার। মাঝে মাঝেই মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে যায়। পরে আর ঘুম আসে না। ক্ষীণ হয়ে আসছে স্মৃতির পর্দা, তবে এখনও আছে, আগে যেখানে ছিল সেখানে সব ভার সমেত স্মৃতির যা থাকতে পারে। রেকর্ডগুলোর জন্য আবার ডিলারের শরণাপন্ন হতে হয় তাকে। অনেক মূল্যবান আর আউট অব প্রিন্ট রেকর্ড সেখানে থাকায় ভাল দাম পাওয়া যায়, যা দিয়ে ছোট একটা গাড়ি কেনা যায়। তার কাছে অবশ্য টাকার কোনো মানেই নেই। রেকর্ডগুলো ওর বাড়ি থেকে অপসারিত হওয়ার সাথে সাথে টনি সত্যিই একা হয়ে পড়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *