টনটনিয়ার ঠেনঠনিয়া বাবু রামগোপাল ঘোষ
বাবু রামগোপাল ঘোষের পিতা গোবিন্দচন্দ্র ঘোষ ছিলেন কলকাতার একজন ব্যবসায়ী এবং কুচবিহারের মহারাজার কলকাতাস্থ এজেন্ট। এঁরা জাতিতে কায়স্থ। ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে কলকাতায় রামগোপালের জন্য মিঃ শোরবোর্নের স্কুলে তিনি প্রাথমিক ইংরেজি শিক্ষা লাভ করেন। তের বছর বয়সে তাঁকে হিন্দু স্কুলে ভর্তি করা হয়; এখানে মিঃ এইচ এন ভি ডিরোজিওর অধীনে শিক্ষা লাভ করে তিনি (শিক্ষায়) অসাধারণ উন্নতি করেন। অবস্থা পড়ে যাওয়ায় তাঁকে স্কুল ছাড়তে হয়; এই সময় ডেভিড হেয়ারের জোর সুপারিশের ফলে কলকাতায় ইহুদী ব্যবসায়ী মিঃ যোসেফের প্রতিষ্ঠানে তাঁর একটি চাকরি হয়।
তাঁর বিশ্বস্ততাপূর্ণ কাজের ফলে এবং তিনি বাংলার (কৃষিজ) দ্রব্যের ও শিল্পজাত পণ্যের একটি বিবরণ এবং তৎসহ রফতানি বাণিজ্যে তাদের স্থান সম্পর্কে কার্যকর একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন, তার ফলে হি যোগেক অত্যন্ত খুশি হয়ে, কিছুকালের জন্য ইংল্যান্ড যাবার সময় তাঁকে ব্যবসা পরিচালনার সম্পূর্ণ দায়িত্ব দিয়ে যান। এমন সাবধানতার সঙ্গে তিনি ব্যবসায় পরিচালনা করেন যে, মিঃ যোসেফ ইংল্যান্ড থেকে ফিরে দেখেন তাঁর ব্যবসায়ে প্রকৃত লাভ হয়েছে। কিছুকাল পরে মিঃ কেনসান এই প্রতিষ্ঠানে অংশীদাররূপে যোগদান করেন রামগোপাল কিন্তু তাঁদের সহকারী হিসাবে থেকে যান। যোসেফ ব্যবসা থেকে অবসর নেবার পর, কেনসাল রামগোপালকে প্রতিষ্ঠানের অংশীদার করে নেন; প্রতিষ্ঠানটির নতুন নামকরণ হয় মেসার্স কেলসাল অ্যান্ড ঘোষ।
কেনসাল ও রামগোপানের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হলে, রামগোপাল ১৮৪৬ সালে ২,০০,০০০ টাকা নিয়ে কোম্পানির সংস্রব ত্যাগ করেন। এই সময় সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে স্থল কজ কোর্টের দ্বিতীয় জজের পদে নিয়োগ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়; কিন্তু ‘কোম্পানির নূন যাব না’ তাঁর এই স্থির সিদ্ধান্তের জন্য তিনি ঐ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
বাবু রামগোপাল ঘোষ এর পর নিজেই একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। তিনি আরাকান থেকে চাল রফতানি করে অল্পকালের মধ্যে ধনাঢ্য হয়ে ওঠেন। আকিয়াব এবং রেঙ্গুনেও তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠানের শাখা স্থাপন করেন। ব্যবসায়ী হিসাবে তিনি সম্ভ্রান্ত ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের মধ্যে এত বিখ্যাত হন যে, ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ নভেম্বর তাঁকে বেঙ্গল চেম্বার অফ কমার্সের সভ্য করে নেওয়া হয়। ১৮৫৪-তে মিঃ ফিল্ড তাঁর অংশীদার হন; কিন্তু এর কিছুকাল পরেই রামগোপালবাবু ব্যবসা থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
১৮৪৭-এর ব্যবসায়িক সংকটের সময় কলকাতার বহু ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান উঠে যায়; কিন্তু রামগোপাল দৃঢ়ভাবে স্বীয় ব্যবসা ধরে রাখেন। এই সময় তাঁর কিছু “অনুধ্যায়ী” ইংল্যান্ড থেকে পাওনা বিলগুলিকে বেনামা করার পরামর্শ দেন যাতে বিলের টাকা পরিশোধ না হলে, তাঁর প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত না হয়ে পড়ে। উত্তরে তিনি জানান, ‘পাওনাদারদের ঠকানোর পরিবর্তে তিনি তাঁর পরনের শেষ ন্যাকড়াখানি বরং বেচে দেবেন।’ এমনই ছিল তাঁর সততা, নৈতিক সাহস ও ঔচিত্যবোধ!
কয়েক বছরের মধ্যে তিনি বিশেষ ধনবান হয়ে ওঠেন। কামারহাটিতে একটি ভিলা নির্মাণ করে সেখানে তিনি বসবাস এবং বন্ধুবর্গকে মাঝে মাঝে আপ্যায়ন করতে থাকেন। এই গোটা সময়ে কখনই তিনি তাঁর সাহিত্যকর্ম বন্ধ রাখেননি। ‘সিভিস’ ছদ্মনামে তিনি জ্ঞানান্বেষণ পত্রিকায় ভারতীয় রপ্তানি পণ্যের শুল্ক সম্পর্কে কয়েকটি প্রবন্ধ লেখেন। তিনি ডিপ্লট নামক একখানি পত্রিকা সম্পাদনা, স্পেক্টেটর নামক একখানি পত্রিকা প্রতিষ্ঠা এবং মিঃ জর্জ টমসনের সহযোগে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান সোসাইটি স্থাপন করেন। রামগোপালবাবু বিশেষ বিদ্যোৎসাহী এবং সমাজসেবী মানুষ ছিলেন। বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তিনি ডেভিড হেয়ারের সঙ্গে সহযোগিতা করে, উপহার ও পুরস্কার দিয়ে হিন্দু কলেজের ছাত্রদের উৎসাহদান, মেডিক্যাল কলেজের বিষয়ে আগ্রহ প্ৰকাশ এবং বাৰু দ্বারকানাথ ঠাকুরের সঙ্গে সহযোগিতা করে বিভিন্ন পেশায় শিক্ষালাভের জন্য চারজন ছাত্রকে ইংল্যান্ডে প্রেরণ করেন। মাননীয় বেখুনের অনুরোধে তিনি ১৮৪৫-এর সেপ্টেম্বরে শিক্ষা পরিষদের সভ্যপদ গ্রহণ করেন এবং বাংলায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে অনুদান দেবার ব্যাপারে সরকারকে সাহায্য করেন। কলকাতার একটি স্ত্রীশিক্ষা প্রতিষ্ঠান (বালিকা বিদ্যালয়) স্থাপনের বিষয়ে তিনি মাননীয় বেথুনকে সাহায্য করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়ে ডঃ মাউন্টকে কার্যকর সুপরামর্শ দান করেন। রাজনীতিতে তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল; ভারতে রেলওয়ে প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবকে তিনি বিপুলভাবে সমর্থন করেন এবং বিধবা বিবাহ আন্দোলনেও হস্তক্ষেপ করেন। লর্ড হার্ডিঞ্জকে সম্মান প্রদর্শনের বিষয়ে কলকাতার অধিবাসীদের এক সভায় লর্ড হার্ডিঞ্জের একটি মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হোক, রামগোপাল তাঁর এই প্রস্তাব, মিঃ টারটন, মিঃ ডিকেন্স ও মিঃ হিউম এই তিন জন ইংরেজ ব্যারিস্টারের বিরোধিতা সত্ত্বেও পাস করিয়ে নিত সক্ষম হন। পরদিন জন বুল পত্রিকায় লেখেন, ‘এক যুবক বাঙালী বাগ্মী তিনজন ইংরেজ ব্যারিস্টারকে ভূমিসাৎ করেছেন’; তাঁকে ‘ভারতের ডিমস্থিনিস’ আখ্যায় ভূষিত করেন।
১৮৫৩-র জুলাইয়ে কলকাতা টাউন হলে চার্টার সম্পর্কিত সভায় প্রদত্ত রামগোপালের বক্তৃতাকে (লন্ডন) টাইমস পত্রিকা প্রশংসা করে লেখে ‘বাগ্মীতার অতি উৎকৃষ্ট নিদর্শন’। মহারাণীর ঘোষণা উপলক্ষে প্রদত্ত রামগোপালের বক্তৃতার সুখ্যাতি করে ইন্ডিয়ান ফিল্ড পত্রিকায় মিঃ হিউম লেখেন, বাবু রামগোপাল ঘোষ জাতিতে ইংরেজ হলে মহারাণী তাঁকে নাইট খেতাবে ভূষিত করতেন। তাঁর কালা কানুন বিরোধী বক্তৃতার জন্য তাঁকে রয়্যাল এগ্রিহটিকালচার সোসাইটি থেকে বহিষ্কৃত করা হয়; বিরোধীদের এই কাজের জবাব দিয়ে তিনি জোরালো একখানি পুস্তিকা লেখেন। ডাঃ গ্র্যান্ট তো বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না যে, কোন (ইংরেজের) সহায়তা না নিয়ে এদেশীয় কোন ব্যক্তি এরকম ইংরেজি ভাষা লিখতে পারেন। শ্মশান ঘাট প্রশ্নে কলকাতার জাস্টিসদের সভায় তাঁর প্রদত্ত বক্তৃতা হিন্দু সমাজ চিরকাল কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবেন। কী লেখা, কী বক্তৃতা উভয় ক্ষেত্রেই ইংরেজির বাগ্ বৈশিষ্ট্যের উপর তাঁর অসাধারণ ক্ষমতা প্রকাশ পেত। একথা বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে উঠত যে ইংরেজি ভাষা, তার ভাব ও প্রকাশ ভঙ্গি তাঁর কাছে বিদেশী ভাষা, ভাব বা প্রকাশভঙ্গি; একথাও বিশ্বাস করা কঠিন ছিল যে, তিনি ইংল্যান্ডের গৃহস্থ বাড়িতে লালিত পালিত হননি। মিঃ কোচরেন একবার মন্তব্য করেন, ‘স্বদেশবাসীর মঙ্গল হতে পারে এমন কোন বিষয়ে (রামগোপালবাবু যে বক্তৃতা দিতেন) তার মতো বাগ্মীতা বা আত্যন্তিক উৎসাহ তিনি আর কখনও কোথাও (বা কারও মধ্যে) দেখেননি।’ রামগোপালবাবু ছিলেন বঙ্গীয় আইন পরিষদের সভ্য, কলকাতার অনারারী ম্যাজিস্ট্রেট ও জাস্টিস অব দি পীস, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো, ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সভ্য এবং জেলা দাতব্য সমিতির সভাপতি। তিনি সভ্য ছিলেন ১৮৪৫-এর পুলিশ কমিটির, ১৮৫০-র স্মল পক্স কমিটির; তাছাড়া সেন্ট্রাল কমিটি ফর দি কলেকশন অব ওয়ার্কস অব আর্ট অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, ১৮৫১-র লন্ডন এগজিবিশনের, ১৮৫৫ ও ১৮৬৭-র প্যারিস এগজিবিশন দুটির এবং ১৮৬৪-র (কমিটি ফর দি) বেঙ্গল এগ্রিকালচারাল এগজিবিশনের। কি সরকার, কি বিশিষ্ট ইউরোপীয় ভদ্রলোক, সকলেই রামগোপালবাবুর স্বাভাবিক গুণাবলী সম্পর্কে অতি উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন। মিঃ থিওডোর ডিফেন্স (যিনি রামগোপাল সম্পর্কে শত্রুতার ভাব পোষণ করেন বলে অনেকের ধারণা ছিল)-কে বিদায়-ভোজে আপ্যায়ন করার আগে মাননীয় প্রসন্নকুমার ঠাকুর রামগোপালকে ওই ভোজসভায় আমন্ত্রণ জানানো সম্পর্কে ডিফেন্সের আপত্তি আছে কিনা জানতে চান; উত্তরে ডিফেন্স জানান, না, কোন আপত্তি নাই। পূর্বের বিরোধিতা থাকা সত্ত্বেও মিঃ ডিফেন্স উক্ত ভোজসভায় রামগোপালবাবুর স্বাস্থ্য কামনা করে অত্যন্ত প্রশংসা সূচক এক বক্তৃতায় মন্তব্য করেন, হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতার পদ গ্রহণের একমাত্র উপযুক্ত ব্যক্তি– বাবু রামগোপাল ঘোষ।
রামগোপাল বাবু ছিলেন স্বভাবতই দয়াবান; তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করেছেন ৪০,০০০ টাকা; জেলা দাতব্য সমিতিকে ২০,০০০ টাকা এবং তাঁর কাছে ঋণী ব্যক্তিদের মোট ঋণ ৪০,০০০ টাকা মওকুফ করেন। দেশের মহা উপকারী বন্ধু ও দেশের গৌরব বাবু রামগোপাল ঘোষ ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দের ২৫ জানুয়ারি পরলোক গমন করেন। তাঁর মৃত্যুতে কি ধনী কি দরিদ্র সকলেই শোকে অভিভূত হন। তাঁর পুত্র সন্তান ছিল না; মৃত্যুকালে তিনি তাঁর একমাত্র বিবাহিতা কন্যাকে রেখে যান। এই কন্যা নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যান ৷