1 of 2

টটনের কুকুর

টটনের কুকুর

টটনের বাবা খুব গরিব। কিছু জমিজমা, পুকুর ছাড়া টটনের বাবা মনমোহন বলতে গেলে ফকির। টটনের ভাইবোন মেলা। মা-ঠাকুমা তো আছেনই। জমিজমায় চলে না। প্রথমে কোপটা পড়ল উটনের ওপর। ওর লেখাপড়া বন্ধ। জমির কাজে লেগে গেলে সংসারে দু-পয়সা আসে। গোরু-বাছুর সামলালে মনোমোহনের কাজ হালকা।

টটনের বাবা গরিব বলে, তাকে সবাই ফকিরের ব্যাটা’ বলে। গাঁয়ে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে গেলেও ফকিরের ব্যাটা। অবশ্য টটনের দোষও আছে। যে কেউ ভালোমন্দ খেলে তার খেতে ইচ্ছে হয়। সে হাত পাতে। টটনকে দেখলেই তারা খাবার লুকিয়ে ফেলে।

টটন টের পায়।

এই যেমন নব, ওর বাবার চায়ের দোকান। দোকানে নবও মাঝে-মাঝে বসে। বসলেই লজেন্স-বিস্কুট সরায়। পালিয়ে খেতে দেখলেই টটন ছুটে যাবে, কী খাচ্ছিস রে? তাড়াতাড়ি পকেটে যাই থাকুক লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করে নব।

কিন্তু টটন ছাড়বার পাত্র নয়।

তখন নব বলবে, আন, এক বালতি জল।

সে জল নিয়ে আসে এক বালতি।

তারপর বলবে, কাপ-প্লেটগুলো ধুয়ে রাখ।

টটন খুশিমনেই কাপ-প্লেট ধুয়ে দিলে হয়তো দুটো লজেন্স দিয়ে বলবে, ভাগ ফকিরের

ব্যাটা!

এতে সে কিছু মনে করে না। তার বাবা ফকির, গরিব আর ফকিরের তফাতই বা কি? তা ফকিরের ব্যাটা বললে সে খুশিই হয়।

খুশিতে সে আরও দু-একটা ফাউ কাজ করে ফেলে।

পাড়াপ্রতিবেশীরাও টটনকে দেখলে ফাউ কাজ করিয়ে নেওয়ার তালে থাকে।

গাছ থেকে আম পাড়।

সে আম পেড়ে দেয়।

একটা আম হাতে দিলেই খুশি।

সাইকেলটা সাফ কর। কাদা মুছে ফেল।

টটন সাইকেল ন্যাকড়া দিয়ে ঝকঝকে করে ফেললে—দশটা পয়সা। হাত পেতে নেবে আর দেখবে। কোথায় যে রাখবে! জামা নেই গায়ে। প্যান্টের পকেট ছেঁড়া। যা রাখে সবই পড়ে যায়। সেই টটন একদিন জমিতে বাপকে ভাত দিয়ে ফেরার সময় এক কাণ্ড। কোথা থেকে একটা কুকুরের বাচ্চা ল্যাংচাতে-ল্যাংচাতে বাবুর অনুসরণ করছে।

সে রেগে যায়। সে গাল দেয়, ফকিরের ব্যাটা আমার লগ ধরলি! যা। আমার পকেটে কিছু নেই।

টটনের ধারণা, কুকুরের বাচ্চাটা সেয়ানা। খাবারের লোভে তার লগ ধরেছে। পকেটে যে কিছু নেই, তাও নয়। লেড়ো বিস্কুটটি সে পেয়েছে পীতাম্বরের দোকান। থেকে। একটা বিস্কুট দিয়ে তাকে মেলা ফাউ কাজ করিয়ে নিয়েছে। এতে সেও খুশি, পীতাম্বরও খুশি। তার সেলাই-কলের দোকান। ঘর ঝাঁট দেওয়া থেকে খাবার জল কল থেকে তুলে দিয়ে এসেছে।

বাচ্চা কুকুরটা ঠিক টের পেয়েছে। সে যেমন টের পায় তাকে লুকিয়ে কে কখন কী খায়। সে তো মাত্র একবার লেড়ো বিস্কুটের খানিকটা ভেঙে নিয়েছে, তারই ভেতর নজর পড়ে গেল! ভাইবোনেরা পর্যন্ত টের পায় না। পেলেই হেঁকে ধরে। আর তুই কোথাকার ফকিরের ব্যাটা টের পেয়ে গেলি! ধাঁই করে একটা লাথি কষাল। কুকুরটা ফুটবলের মতো কিছুটা উড়ে গিয়ে পড়ে গেল। কুঁই-কুঁই করছে। সঙ্গে সঙ্গে টটনের মনে হল, পা-টা কে যেন খামচে ধরেছে! পা-টা সরিয়ে নিল। টটন বেশ ঘাবড়ে গেছে।

সে হাঁটা দিল। আমবাগানের ভেতর থেকে দেখল, কুকুরটার লজ্জা নেই। আবার পায়ে-পায়ে ল্যাংচাতে-ল্যাংচাতে হাঁটছে। তার পিছু নিয়েছে। আর পারা যায়। বিস্কটের খানিকটা ভেঙে দিয়ে বলল, নে। খবরদার আর পা বাড়াৰি না। নুয়ে সে পা দেখল। পায়ে দুটো দাঁত ফোঁটাবার দাগ। কীসের দাগ, বুঝল না। কে শোনে কার কথা! কুকুরটা ল্যাংচাতে-ল্যাংচাতে ফের তার পিছু পিছু আসছে। যত দেয়, তত কুকুরটা ল্যাংচায়। আর কুঁই-কুঁই করে। উটনের মহা মুশকিল। বাড়ি গিয়ে উঠলে মায়ের তেজ, নিজের খেতে ঠাঁই নেই শঙ্করাকে ডাকে!

মায়ের দোষ নেই। বাবা না আনতে পারলে দেবেন কোত্থেকে। তবে একবার বোঝাতে পারলে, তার মায়ের মতো মা হয় না। যদি বুঝে যান—তখন মা নিজেই ডাক খোঁজ করবেন। আরে নিজে খেলি, কুকুরটাকে দিলি না। ভগবানের দান, যাবে কোথায়?

তা কুকুরটাকে দেখে মাও কেমন খুশি। বাবা জমি থেকে ফিরে বললেন, কুকুরটার ঠ্যাং ভাঙল কে? ল্যাংচাচ্ছে। তোমার ছেলের কাজ নয় তো!

টটন রাস্তায় দাঁড়িয়ে সব শুনতেই দৌড়ে গেল। বাবার মেজাজও কুকুরটিকে দেখে অপ্রসন্ন নয়। বাবা-মা খুশি থাকলে সেও খোশমেজাজে থাকে। সে বলল, কী পাজি এটা, মাঠ থেকে লগ ধরেছে। কিছুতেই যাবে না। আমার সঙ্গে বাড়ি উঠে এল। লাথি মারলাম। তাও না। অবশ্য লাথি মারার সময় কে যেন খামচে দিয়েছিল। সে-কথা বলল না।

খামচে দিয়েছিল, না কামড়ে দিয়েছিল—সে তা ঠিক মনে করতে পারছে না। তবে গোড়ালির জায়গাটা লালায় ভেজা মনে হয়েছিল। দাঁতের কামড়ও। তবে শুধু দাগ। কামড় জোরে বসায়নি রক্ষে।

কে যে কামড়াল! কুকুরের কামড়ের মতো। অবশ্য এ-নিয়ে ভাবে না। কোথাও ছিল, ঝোপজঙ্গলে পালিয়ে গেছে। তবে বাচ্চা কুকুরটা নয়। কারণ এটা তো ধানের জমিতে ছিটকে পড়েছে। বললে, তরাস লেগে যাবে। মা বলবেন, আরে বলছিস কী! কই দেখি আয় তো। চেঁচামেচি শুরু করে দেবেন।

ছোটোভাই মটর বলল, দাদা, কী সুন্দর না দেখতে। কুকুরটার নামও সে দিয়ে দিল। টুটু।

মটরের মাথা সাফ। বাবা তার স্কুলের পড়া গজব করেননি। টটন এজন্য রাগ পুষে রাখেনি। তার যখন হবে না, আর তার তো বই দেখলেই রাগ ধরে যায়— এত খোলামেলা বাড়ি, গাছপালা, গোরু-বাছুর, জমিতে ফুলকফি-বাঁধাকপির চাষ, এক হাতে বাবা সামলাতেও পারেন না। সে বাবার কাজে লেগে গিয়ে ভালোই করেছে। সংসারের সাশ্রয়। তার নাম টটন, কুকুরের বাচ্চাটার নাম টুটু। টটনের কুকুর টুটু।

বাচ্চাটাকে বাংলা সাবান দিয়ে স্নান করাবার সময় দেখল একটা পায়ে বেশ বড়ো ক্ষত। মাকে দেখাল। মা চুন-হলুদ গরম করে লাগিয়ে দিতেই কুকুরটির আরাম বোধ হচ্ছে টের পেল টটন।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই মনোমোহন দেখতে পেলেন, একজন কাঁপালিক গোছের লোক, গাছের নীচে বসে আছেন।

মনোমোহন উঠোনে দাঁড়িয়ে সবে সূর্যপ্রণাম করছেন।

আমার কুকুরটা?

মনোমোহন তাকালেন। কাঁপালিক মানুষকে সবাই ভয় পায়, সে কাছে গিয়ে বলল, ‘কিছু বলছেন ঠাকুর?’

আমার কুকুরটা?

কুকুরের কথা শুনে সবাই উঠোন পার হয়ে গাছতলায়।

মটর বলল, এখানে কোনো কুকুর নেই।

আছে। একটা বাচ্চা কুকুর। কালো রং। এক পা খোঁড়া। আরে টুটুর কথা বলছেন? সে দৌড়ে ঘরে ঢুকে বলল, দাদা, টুটুকে নিতে এসেছে।

কে? টুটুকে কে আবার নিতে এল!

টুটু কিছুতেই কোল থেকে নামবে না। মা চেঁচাচ্ছেন, দিয়ে দে বাবা? কার মনে কী আছে কে জানে।

মা ঠাকুর-দেবতাকে ভয় পান, সাধুসন্তের ভয়ে কাবু থাকেন। টটন জানে, যার কুকুর তাকে দেওয়াই ভালো। কি না আবার অনাসৃষ্টি শুরু হবে। সে কুকুরটাকে নামিয়ে দিলেই কুঁই-কুঁই করতে লাগল। যাবে না। কাঁপালিক গোছের লোকটি যেই না টুটুকে খপ করে ধরতে গেলেন, কী হল কে জানে, ওরে বাবা এ তো আগুন রে বাবা। লোকটা ধপাস করে পড়ে গেলেন, না কিছু দেখে ঘাবড়ে গেলেন, বুঝল না। লোকটা চিমটে, ত্রিশূল থলে নিয়ে দৌড়োতে লাগলেন। যেন কেউ ঠেলে ফেলে দিয়েছিল তাঁকে।

সবাই তাজ্জব।

বাবা বললেন, কী হল, পড়িমরি করে ছুটে পালাল কেন? যেন কেউ ঠেলে দিল লোকটাকে। কোনোরকমে প্রাণে বেঁচে গেছে।

টটন বলল না, তারও মনে হয়েছে। পায়ে কীসে কামড়ে দিয়েছিল। তবে দাঁত ফোঁটায়নি। তাই রক্ষে।

টটন বলল, লোকটা মিছে কথা বলছে বাবা। কুকুরটাকে আমি তো নীলপুকুরের পাড়ে পেয়েছি।

সে যা হোক, কুকুর নিয়ে আর কেউ পরে কথা চালাচালি করেনি। জবরদস্ত কাঁপালিক কোন সুবাদে বাড়িতে হাজির, কী করেই বা জানলেন, টুটু মনোমোহনের বাড়ি গিয়ে উঠেছে তাও তারা বুঝল না। তবে কুকুরটার মধ্যে কিছু একটা আছে। মা তো একেবারে চুপ। বাবা বললেন, দ্যাখ, যেন পালিয়ে না যায়। কী আবার বিপদে পড়ব বুঝতে পারছি না।

টুটুকে নিয়ে শীতকালটা মজারই ছিল। ভালো খেতে পেয়ে নাদুসনুদুস, গড়িয়ে গড়িয়ে হাঁটে। সর্বক্ষণ টটনের সঙ্গে। সে জমিতে গেলে টুটু জমিতে, সে ঝোপজঙ্গলে ঘুরে বেড়ালে, সঙ্গে টুটু। সে যা পায় সবই দুজনে ভাগ করে খায়।

একদিন এক ছাগলের ব্যাপারী বাড়ি হাজির। সেও বলল, তার কুকুর হারিয়েছে। এই বাড়িতেই আছে।

বাবা রেগে গিয়ে বললেন, ‘কুকুর হারালেই আমার বাড়ি! এ তো আচ্ছা ঝামেলা।’ সোজা জবাব, না, এখানে কুকুরটুকুর নেই।

আছে। আপনি জানেন না। মিছে কথা বলছেন।

আরে, মিছে কথা বলব কেন! বলছি কারো কুকুর আমার বাড়ি আসেনি। আমাদের কুকুর ছাড়া অন্য কোনো কুকুর আমাদের বাড়িতে নেই।

ওটাই আমার। দেখান। বলে পাঁচখানা বগল থেকে নিয়ে হাতের ওপর ঘোরাতে থাকল।

টটন কোথা থেকে এসে শুনেই খাপ্পা। সে টুটুকে বগলে তুলে গাছতলায় দৌড়। ব্যাপারীকে বলল, এটা?

হ্যাঁ, এটা। এটাই আমার কুকুরের বাচ্চা! আর যায় কোথায়। পাঁচনটাচন ফেলে লোকটা চিত হয়ে পড়ে গেল। আর্ত ডাক, বাঁচান কর্তা। আমারে খেয়ে ফেলল। যেন লোকটাকে কেউ আক্রমণ করছে। পা ছুঁড়ছে, হাত ছুঁড়ছে-গড়াগড়ি খাচ্ছে। এক হাতে কাপড় সামলাচ্ছে, অন্য হাতে পাঁচন দিয়ে আক্রমণ—যেন সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে।

টটন, তার বাবা, মা এমনকী, দু-একজন প্রতিবেশীও হাজির। আর দেখল, লোকটা প্রাণভয়ে দৌড়োচ্ছ। বলছে, ওরে বাবা রে, আমাকে কামড়ে দিল রে!

টটন, বাবা, প্রতিবেশীরা অবাক। লোকটার পা থেকে রক্ত চুইয়ে পড়ছে।

মনোমোহনের মাথা ঘুরছে।

কুকুরের বাচ্চাটার দিকে মনোমোহন তাকালেন। ওটা তো টটনের কোলেই আছে। কেমন ত্রাসে পড়ে গেলেন। বাচ্চাটাকে রাখা উচিত-অনুচিতের কথাও ভাবছেন। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলার সাহস নেই।

মনোমোহনের ছেলেকে প্রশ্ন না করে পারলেন না, নীলপুকুরের কাছে কোথায় পেলি?

জমিতে। ওই সেখানে করদের জমিতে। পাশটায় হোগলা বন আছে, বন থেকে বের হয়ে এল।

মনোমোহন জানেন, নীলপুকুরের বেলগাছটা ভালো না। দোষ পেয়েছে। ওঁর ধারণা ছিল যদি বেলগাছটার নীচে কুকুরের বাচ্চাটাকে পায়, তবে গাছের দোষ কুকুরেও বর্তাতে পারে। রাতেবিরেতে কেউ বড়ো গাছটার নীচ দিয়ে আসে না। গাছটায় নীরদা গলায় ফাঁস দিয়েছিল। কিন্তু জমিতে পাওয়া গেলে গাছের দোষ দেওয়া যায় না! খুব বেশি বলাও মুশকিল। কে আবার অদৃশ্যলোক থেকে তাকেই আক্রমণ করবে। কিংবা কামড়াবে। ব্যাপারী তো ছুটেই পালাল, সবাই দেখেছে গোড়ালি থেকে, হাঁটুর নীচ থেকে চুইয়ে রক্ত পড়ছে। কুকুরে কামড়ালেই এমনটা হওয়ার কথা।

কিন্তু বাচ্চাটা তো টটনের কোলেই ছিল। কামড়াবে কি করে! বাচ্চা কুকুর কামড়াতেও জানে না। লোকটারই বা দোষ কী। তার কুকুর যদি হয়, সে বলতেই পারে, কুকুরটা আমার। আমার বাচ্চা কুকুরটাকে টটন চুরি করে এনেছে। টটন আনতেও পারে। মারের ভয়ে সে কখনো সত্যি কথা বলে না। কিন্তু নিজের চোখের ওপর দেখার পর টটনের গায়ে হাত ভোলা তো দূরে থাক, তোষামোদের বাড়াবাড়ি শুরু হয়ে গেল।

টটনের দিকে তাকিয়ে মনোমোহন বললেন, সত্যি বলছিস, জমিতে পেয়েছিস! বা রে, মিছে কথা বলি কখনো।

না, তুই মিছে কথা আর কবে বললি। ধর্মপুত্তুর, মুখে এসে গিয়েছিল, তবে বললেন না। কারণ কীসে কোন আপদ সৃষ্টি হবে, তা তিনি নিজেও জানেন না। খুবই বিনয়ের গলায় বললেন, বলছিলাম, যার কুকুর তাকে দিয়ে দেওয়াই ভালো।

মাও বললেন, আমি ভেবেছিলাম, পরপর যা হচ্ছে, তাতে কিন্তু কুকুরটাকে সুবিধের মনে হচ্ছে না।

টটনের এক কথা, কুকুরটা কি তোমাদের কামড়ায়, না রাতে ঘেউ-ঘেউ করে? তোমাদের ঘুমের কি ব্যাঘাত হয়, বলো!

না, তা অবশ্য করে না। তোর বুকের কাছে শুয়ে থাকতে পারলেই নিশ্চিন্তি। চোর-ছ্যাঁচোড়ের ভাবনা তার নেই। ডাকাডাকির বিষয়টা কুকুরটা জানেই না। কখনো তো দেখলাম না ঘেউ-করতে। কেবল লেজ নেড়ে এটা-ওটা শুকে বেড়ায়। খাবার পেলে লাফায়। তোকে দেখলেই লাফিয়ে কোলে উঠতে চায়।

তবে! টটনের এক কথা। যার কুকুর তাকে দিয়ে দিতে বলছ কেন? আমি জানিই না কার কুকুর! আর কে নেবে? যে আসে সেই তো পালায়। বলো দেবটা কাকে?

এরপর আর কী বলা যায়, মনোমোহন ভেবে পেলেন না। এবারে শীতের ফসল খুবই ভালো হয়েছে। মা লক্ষ্মী তাঁকে ঢেলে দিয়েছেন। এক কেজি, দেড় কেজি মুলোর ওজন। বাজারে দরও ভালো যাচ্ছে। মনোমোহন এত পয়সার মুখ কোনো শীতের মরসুমে দেখেননি। কুকুরটা আসায় তাঁর যেন ধনে-জনে লক্ষ্মীলাভ।

মানুষের হাতে পয়সা এলে যা হয়, খাওয়াপরার লোভ বাড়ে। মনোমোহনও সেই লোভে শহরে রওনা হবেন। ছেলেমেয়েদের জামা-প্যান্ট, পরিবারের একখানা

ভালো শাড়ি, নিজের দুটো লুঙ্গি, গেঞ্জি, একটা শার্ট কেনার জন্য শহরে যাবেন।

বাবা শহরে গেলে ভালো মিষ্টিও নিয়ে আসেন। টটন-মটর দুজনেই বাবাকে বাস রাস্তায় এগিয়ে দিতে গেল। মোড়ের বটগাছটার নীচে বাস লোকজন তুলে নেয়। বাবাকে তুলে দিয়ে ফিরে আসবে।

অবাক, কুকুরটা কিন্তু সেই থেকে কুঁই-কুঁই করছে কোলে। কেন করছে বুঝছে না। টটনের বুকে লেপটে থাকতে চাইছে না। টটন ছেড়ে দিল। ছেড়ে দিলেই বাড়িমুখো ছুটতে চাইছে। এত দূর থেকে পথ চিনে না-ও যেতে পারে। বাচ্চা কুকুর ছেড়ে দিতেও ভয়। কোথায় কোন কাঁপালিক, কিংবা ব্যাপারী ওঁত পেতে থাকবেন কে জানে! কুকুরটাকে জোরজার করেই যেন নিয়ে যাচ্ছে টটন-মটর।

আর বাসে ওঠার সময়ই মনে হল মনোমোহনের, তাঁর কোঁচা ধরে কে টানছে। তিনি পা-ঝাড়া দিলেন। বললেন, কে রে? কেউ তো নেই। কাছেই টটন-মর্টর দাঁড়িয়ে আছে। বাচ্চাটাও টটনের কোলে। কেবল কুঁই-কুই করছে। ছটফট করছে।

আবার পা ঝটকা দিলেন। তাঁর কাপড় ধরে কেউ টানছে। মনে হল, কোঁচা ধরে টানছে। ভারি তাজ্জব ব্যাপার তো! তিনি নেমে পড়লেন। মনে সন্দেহ। বাস কণ্ডাক্টর বললেন, ‘আরে উঠবেন তত উঠুন।’ কিন্তু উঠতে গেলেই কোঁচা ধরে কে যেন টানছে। যেন এবার কিছুতে পা কামড়ে ধরল। মনোমোহন নেমে গেলেন বাস থেকে। চারপাশে তাকালেন। কেউ নেই। কে তবে পায়ে এত জড়াজড়ি করছে।

বাসটা ছেড়ে দিল।

বিকেলে খবর পেলেন, বাসটা দুর্ঘটনায় পড়েছে। বাসসুদ্ধ লোক নয়ানজুলিতে। সকালেই খবরের কাগজে পড়লেন, বাস দুর্ঘটনায় পঁয়ত্রিশজনের মৃত্যু। ভাগ্যিস মনোমোহন বাসে যাননি। তিনি কুকুরটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। মাকে ফিসফিস করে বাবা কী বললেন, টটন বুঝল না।

দুদিনও পার হয়নি। টটন জমিতে বাবার ভাত দিতে গেছে। সঙ্গে কুকুরের বাচ্চাটা।

ফেরার সময় ঝোপজঙ্গলে ঢুকে যাওয়া তার স্বভাব। এদিকটা খুবই শুনশান। বড়ো বড়ো সব গাছ আর জঙ্গলে ভরতি। শিশু গাছই বেশি। রাজরাজড়ার পতিত জায়গা। জঙ্গল খুব বাড়ছেই। তবে শীত শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে, ঝোপজঙ্গলের পাতাও ঝরে গেছে। গরিব মানুষেরা কাঠকুটোর জোগাড়ে জঙ্গলে এবারে ঢুকে যাবে। সেও কতবার মরা ডাল, শুকনো ডালপাতা মাথায় করে বাড়ি নিয়ে গেছে। জঙ্গলটা ঘুরে দেখার একটা মোহ আছে। সেই মোহে পড়ে এমন একটা তাজ্জব কাণ্ড দেখবে সে আশাই করেনি। দুজন যণ্ডামার্কা লোক কী নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করছে। মারামারি করছে। একজন অন্যজনকে ছোরা দেখিয়ে ব্যাগ কেড়ে নিতে চাইছে। ধুন্ধুমার কাণ্ড। জঙ্গলের মধ্যে অকারণ ব্যাগ নিয়ে মারামারি তার পছন্দ না। আর দেখল, তখনই লম্বামতো লোকটা বেঁটে মতো লোকটাকে মাটিতে ফেলে গলা টিপে ধরেছে। ব্যাগটা পড়ে আছে একপাশে।

সে বুঝল, তাকে দেখতে পেলে রক্ষে নেই। সে দৌড়ে পালাল। কুকুরের বাচ্চাটাও তার পিছু ধরেছে। সড়কে উঠে বেমালুম তাজ্জব বনে গেছে। কাউকে কিছু বলারও সাহস নেই, বাড়িতে নালিশ হবে এবং বাবা ধরে পেটাবেন। ‘আবার জঙ্গলে ঘোরাঘুরি! বলেছি না, জায়গাটা ভালো না।’

সে বাড়ি এসেও চুপ। সে জঙ্গলে ঢুকলেই মা খাপ্পা হয়ে যান।

কিন্তু পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই মনোমোহনের মাথায় হাত। বারান্দায় ব্যাগ। কার ব্যাগ, কী আছে, চেঁচাতেও পারছেন না। কার মুণ্ডু কেটে ব্যাগে ভরে রেখে গেছে তাও জানেন না। যা দিনকাল, খুনখারাপি জলভাত। কোনোরকমে ব্যাগের মুখ খুলে উঁকি দিতেই মাথার ঘিলু হজম। তাঁর চোখ ছানাবড়া। জড়োয়া গয়নায় ভরতি ব্যাগ। দামি পাথরটাথরও আছে।

মনোমোহন মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। তারপর কিছুটা মন শান্ত হলে ডাকলেন, ওগো শুনছ! ওঠো। আমার যে এবার সব যাবে। দ্যাখো কী কাণ্ড! কী করি এখন!

মা দেখলেন। টটনও দেখল। কারও মুখে রা নেই।

মা বললেন, যার ব্যাগ সে ঠিক নিতে আসবে। রেখে দাও। যার জিনিস তাকে ফেরত দেওয়াই ভালো। গরিবের কপালে সুখ সয় না।

বাবা বললেন, সেই ভালো।

টটনও বলল, সেই ভালো।

কিন্তু আতঙ্ক, আবার ব্যাগ নিতে এসে যদি পালায়। তখন তিনি যাবেন কোথায়! থানা পুলিশকে যমের মতো ভয় পান মনোমোহন। আর সেই রাতেই, রাত তখন

অনেক। দুজন তোক বাড়িতে হাজির। টর্চ জ্বেলে বলল, মনোমোহন!

মনোমোহন দরজা খুলে বাইরে বের হলেন না। চুপি দিয়ে বললেন, আপনাদের কিছু হারিয়েছে?

হারিয়েছে মানে! তোমার পুত্র ব্যাগ নিয়ে পালিয়ে এসেছে। দাও। কিছু খোয়া গেলে পরিবারের কেউ বেঁচে থাকবে না। খবর ফাঁস হলেও খুন!

মনোমোহন বললেন, আজ্ঞে না। আমরা কিছু ধরিনি। বলে ব্যাগটা তুলে হাতে দিতে গেলেই, ওরে বাবা রে বলে দৌড়।

কোথায় গেল! মনোমোহন, টটন, মটর হ্যারিকেন নিয়ে লোক দুজনকে খুঁজছে। যত তাড়াতাড়ি ব্যাগটিকে ধরিয়ে দেওয়া যায়। না, কোথাও পাওয়া গেল না। এখন এই ব্যাগ নিয়ে উপায়! কার কাছে যাবে। কাউকে বললেই দশ কান—নানা ঝামেলা। চুরির দায়ে জেল! কী দরকার, যার ব্যাগ তাকেই ফেরত দেওয়া ভালো। কিন্তু লোক দুজন বেপাত্তা। তিনি ডাকলেন, কোথায় গেলেন দাদারা? অগত্যা ফিরে আসতে হল। রাতে কারো ভালো ঘুম হল না।

সকালে শোনা গেল, সড়কের ধারে দুজন লোক মরে পড়ে আছে। গলার নলিতে কোনো জন্তুর কামড়।

বিপাকে পড়ে কুকুরের মালিকের খোঁজে বের হয়ে গেলেন মনোমোহন। কুকুরটা আসার পর থেকে বাড়িতে নানা উপদ্রব। পীতাম্বরই খবর দিলেন, আরে, এই বাচ্চাটা! এটার মা-টা তো লরি চাপা পড়ে মরেছে। রাস্তার কুকুর। বাচ্চাটা নিয়ে এধার-ওধার ঘুরত। বাচ্চাটাই চাপা পড়ত, তবে মার পরান বোঝোই! নিজে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাচ্চাটাকে বাঁচিয়েছে। কেন, কী হয়েছে?

না, কিছু না! তারপর মনোমোহন বললেন, আচ্ছা, ওর জন্য পিণ্ডদান করলে কেমন হয়!

‘কার? কুকুরের!’

পীতাম্বর শুনে অবাক। বললেন, কুকুরের আবার পিণ্ডদান কী?

তোর কি মাথাখারাপ?

তার পরদিন মনোনোহন আরও তাজ্জব। কুকুরের বাচ্চাটা বাড়িতে নেই। কোথাও নেই টটন সারাদিন ডেকে বেড়ায়, টুটু, তুই না বলে-কয়ে চলে গেলি! কোথায় গেলি?

কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। সাড়া আর পায়নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *