টকটক গন্ধ
সেই এক সীতানাথ বন্দ্যো, সুকুমার রায় তাঁর ছড়ায় পাধ্যায় উহ্য রেখেছিলেন। সেই সীতানাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, “আকাশের গায়ে নাকি টকটক গন্ধ।’
আকাশের গায়ে কী না জানি না, মহামহিম সুকুমার রায়ের মতো আমার কল্পনাশক্তি নেই, কিন্তু আমি জানি সব মিথ্যে কথার গায়ে টকটক গন্ধ লেগে থাকে। তাই টোপা কুলের আচার কিংবা আমের চাটনির মতো সব মিথ্যে কথা, সব মিথ্যে গল্প, বানানো কাহিনী আমার এবং আমাদের ভাল লাগে।
আমাদের এবারের উপজীব্য মিথ্যে কথা, মিথ্যে কাহিনী।
নবীনা পাঠিকা, তুমি চোখ মিটমিট করে হাসছ, ভাবছ, হায়রে তারাপদ রায়, আপনি কবে মিথ্যে ছাড়া সত্যি লিখেছেন? এবার এত ভনিতা কেন?
প্রিয় পাঠিকা, আগে সাদা কথাটা বলে নিই। এত যে ভণিতা সে সবই তোমাদের জন্যে। তোমাদের মুখে সামান্য হাসি ফোটানোর জন্যই এইসব মিথ্যের বেসাতি।
সেই আদিকালে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির একটিমাত্র মিথ্যে কথা বলেছিলেন। সেইজন্যে তিনি সশরীরে স্বর্গে যেতে পারেননি। সে কাহিনী তো মহাভারতের শ্রোতারা, পাঠকেরা যুগ যুগ ধরে জানেন।
আর আমার তো পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়েছে। হাজার হাজার মিথ্যে নিয়ে আমার বছরের পর বছর কারবার। বয়স বাড়ছে, এখন চিন্তা হয়, অবশেষে আমার কী হবে?
তবে একটা কথা বলি, শাস্ত্র বলেছে—অপ্রিয় সত্যি কথা বলবে না। শাস্ত্র বলেছে, মিথ্যে কথা বলবে না। আমি দেখলাম, প্রায় সব সত্যি কথাই অপ্রিয়। অবশ্য দু’-চারটে সাদামাটা কথা ছাড়া। সুতরাং শাস্ত্রসম্মতভাবে অপ্রিয় সত্য বা মিথ্যা কথা যদি না বলা যায়, তা হলে তো বোবা হয়েই থাকতে হয়।
আবার কোনওদিন মিথ্যা কথা বলিনি, কখনও মিথ্যা কথা বলি না—এসব কথা বললেও কেউ বিশ্বাস করে না।
সেই ধর্মযাজকের গল্প তো সবাই জানে। সারা পৃথিবীতে, দেশে দেশে গল্পটা ছড়িয়ে পড়েছে।
ধর্মযাজক ভদ্রলোক এক রবিবার সকালে গির্জার দিকে যাচ্ছিলেন, পথে দেখেন কয়েকটি অল্পবয়েসি ছেলে রাস্তার মোড়ের একটা সুন্দর কুকুরছানা নিয়ে জটলা করছে। ধর্মযাজক দেখলেন, ছেলেগুলো নিজেদের মধ্যে বাজি রেখেছে, তাদের মধ্যে যে সবচেয়ে চমকপ্রদ মিথ্যে কথা বলতে পারে, সেই কুকুরছানাটা পাবে।
একে রবিবারের পুণ্য প্রভাত। তার ওপরে চাৰ্চমুখী ধর্মযাজক। তিনি তো চমকে উঠলেন। তিনি বালকদের মিথ্যে কথা বলা থেকে নিবৃত্ত করতে গেলেন। তাদের সামনে এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘ছিঃ ছিঃ, তোমরা এই অল্প বয়সে মিথ্যে কথা বলার প্রতিযোগিতা করছ! এই দেখ আমাকে—আমি বুড়ো মানুষ। আমার প্রায় সারাজীবন চলে গেল, এই জীবনে কখনও একটাও মিথ্যে কথা বলিনি।’
এর পরের ঘটনা অবিশ্বাস্য। ছেলেরা ধর্মযাজকের কথা শুনে অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকাল। তারপর কুকুরছানাটি তাঁর হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘আপনিই এই কুকুরছানাটি জিতেছেন। আপনার মতো মিথ্যে কথা আমরা কেউ বলতে পারব না।’
ধর্মযাজকের পর ভগবান প্রসঙ্গে আসি। এটি এক বুদ্ধিমান বালকের কাহিনী। যে বালক কৃর্থায় কথায় মিথ্যে বলতে ভালবাসত, নিতান্ত নির্দোষ মিথ্যে, রং চড়িয়ে বলে সে আনন্দ পেত।
বালকটি রাস্তায় একা একা খেলছিল। হঠাৎ সে ছুটে এসে বাড়িতে ঢুকল।
তার মা তাকে দৌড়ে বাড়িতে ঢুকতে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘খোকা, কী হয়েছে?’
খোকা বলল যে রাস্তায় এক ভালুক দেখে সে ভয়ে পালিয়ে এসেছে। তার মা জানলা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলেন যে ভালুক-টালুক কিছু নয়, একটা বড় গোছের কালো রংয়ের কুকুর শান্তভাবে রাস্তার মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।
খোকার মা এরপর অবশ্যই খুব রাগ করলেন। তাঁর নিজের পেটের এইটুকু ছেলে এমন জলজ্যান্ত মিথ্যেবাদী হয়ে উঠছে! এটা তাঁর পক্ষে খুবই অসহ্য। তিনি ছেলেকে ধমক দিয়ে বললেন, ‘তুমি একটা মিথ্যুক হয়েছ। জান না ভগবান মিথ্যে কথা বলা পছন্দ করেন না! যাও ওপরে দোতলায় পুজোর ঘরে। সেখানে গিয়ে ভগবানকে বলো, ঠাকুর আমাকে ক্ষমা করে দাও, আমি আর কখনও মিথ্যে কথা বলব না।’
বেশ কিছুক্ষণ পরে হাসিমুখে খোকা দোতলার পুজোর ঘর থেকে নেমে এল। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে খোকার মনের বেশ পরিবর্তন হয়েছে এই ভেবে খোকার মা খুব খুশি। খোকা নেমে আসতে তিনি খোকাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ভগবানের কাছে ক্ষমা চেয়েছিস?’
‘চেয়েছি মা’, ‘খোকা বলল, ‘কিন্তু—’
খোকার মা বললেন, ‘কিন্তু আবার কী?’
খোকা হাসিমুখে বলল, ‘ভগবান বললেন, ক্ষমার কোনও দরকার নেই খোকা, অতবড় কালো কুকুরটাকে দেখে আমিও প্রথমে ভালুক ভেবেছিলাম।’
এবার মর পৃথিবীতে আসি, ধর্ম ও ঈশ্বরের কথা আপাতত থাক।
সাধারণ মানুষেরা, যারা খুব বেশি মিথ্যে কথা বলে না, কখনও বেকায়দায় পড়লে যদি মিথ্যে কথা বলে তবে সে এক ভয়াবহ ব্যাপার হয়ে যায়।
রাধেশ্যামবাবু জীবনবিমা করবার জন্যে ফর্ম পূরণ করেছিলেন। সেই ফর্মে এক জায়গায় লিখতে হয়, বাবা এবং মা কে কত বয়সে মারা গিয়েছিলেন এবং কী অসুখে?
রাধেশ্যামবাবু সত্যি কথাই লিখেছিলেন। বাবা মারা যান একচল্লিশ বৎসর বয়সে হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে। আর মা মারা যান চুয়াল্লিশ বছর বয়সে। মা-র ক্যানসার হয়েছিল।
জীবনবিমার এজেন্ট যাঁর মারফত রাধেশ্যামবাবু জীবনবিমা করেছিলেন, সেই ভদ্রলোক এই দেখে বললেন, ‘ফর্মটা নষ্ট হল—নিন, আরেকটা নতুন ফর্ম পূরণ করে দিন। বাবা-মা অত অল্প বয়সে ওইসব অসুখে মারা গেছেন, লিখবেন না।’
রাধেশ্যামবাবু বললেন, ‘কেন?’
এজেন্ট জানালেন, ‘তা হলে আপনার জীবনবিমার আবেদন নাও গৃহীত হতে পারে, তা ছাড়া প্রিমিয়াম তো অনেক বেশি লাগবেই।’
রাধেশ্যাম দ্বিধাগ্রস্তভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তা হলে কী লিখব?’
এজেন্ট সাহেবের সময়ের তাড়া আছে, তিনি বললেন, ‘চটপট করে যা হয় একটা লিখে দিন।’
তখন রাধেশ্যামবাবু লিখলেন—‘বাবা মারা গেছেন বিরানব্বুই বছর বয়সে, পাহাড়ে চড়তে গিয়ে বরফ-চাপা পড়ে। আর মা মারা গেছেন পঁচাশি বছর বয়সে, প্রসূতিসদনে সন্তান হওয়ার সময়।’
এই গল্পের সারমর্ম: লোককে মিথ্যে কথা বলতে উত্তেজিত বা প্রলুব্ধ করা উচিত নয়। তবুও বিমাপ্রসঙ্গে যখন এসেছি, আরেকটি গল্প না বললেই নয়।
গল্পটি অবশ্য কুকুর নিয়ে। ক্লাবে জোর আজ্ঞা হচ্ছিল। আড্ডার বিষয় কুকুরের বুদ্ধি।
একেকজন একেকরকম বলছেন, যা প্রাণে আসে প্রায় তাই।
শ্ৰীযুক্ত কখগ বললেন যে, তাঁর মামার বাড়িতে একটা কুকুর ছিল সেটা দু’পায়ে চলাফেরা করত এবং শুধু তাই নয়, সেই কুকুরটা বুড়ো বয়সে হাঁটার সময় লাঠি ব্যবহার করত।
আরেকজন শ্ৰীযুক্ত চছজ বললেন, তাঁদের জেলার পুলিশকর্তা প্যাট্রিক সাহেবের একটা লেজফোলা কানঝোলা বিলিতি কুকুর ছিল, সেটা অঙ্ক কষতে পারত। বাড়ির সামনের লনে পলিশ সাহেব একটা ব্ল্যাকবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি যেই টু প্লাস টু (2 + 2) লিখতেন কুকুরটি পর পর চারবার ঘেউ ঘেউ করত, আবার টু মাইনাস টু (2 – 2) লিখলে একবারও ঘেউ ঘেউ করত না, চুপচাপ থাকত।
সেদিন ক্লাবের নৈশ আড্ডা খুবই জমজমাট। সুতরাং গল্পের গোরু উচ্চ থেকে উচ্চতর বৃক্ষে আরোহণ করতে লাগল।
অবশেষে এল হযবরল বাবুর পালা। তিনি বললেন, ‘অন্যের বাড়ির কুকুরের কথা বলতে হবে না, আমার নিজের বাড়ির কুকুরের কথা বলছি।’
কে একজন বললেন, ‘আপনার কুকুর আছে নাকি, কখনও দেখিনি তো।’
হযবরলবাবু চটে গেলেন গোড়াতে বাধা পেয়ে, বললেন, দেখবেন কী করে? আমি কি কুকুর কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়াই না ক্লাবে আসি?’
দু’-একজন বুদ্ধিমান সভ্য মধ্যস্থতা করে উক্ত অনুপ্রবেশকারীকে থামিয়ে দিলেন। হযবরলবাবু বিরক্তভাবে আবার শুরু করলেন, ‘বছর দুয়েক আগে একবার আমাদের বাড়িতে আগুন লেগেছিল’…
আবার বাধা, কে যেন বললেন, ‘আপনার বাড়িতে আগুন লেগেছিল? কই শুনিনি তো, আপনিও বলেননি!’
এবারে সবাই হইহই করে বাধাদানকারীকে থামিয়ে দিলেন। একটু বিরতি দিয়ে হযবরলবাবু বলতে লাগলেন, ‘রাত দুটো নাগাদ ঘুম ভেঙে বুঝতে পারলাম আগুন লেগেছে। ঘরভর্তি ধোঁয়া, আগুনের আঁচ। তাড়াতাড়ি আপনাদের বউদিকে ঘুম থেকে তুলে, ছেলে-মেয়ে, কাজের লোক, সবাইকে জাগিয়ে এক বস্ত্রে সবাই ছুটে রাস্তায় বেরিয়ে এলাম। তখন খেয়াল হল, কুকুরটাকে তো সঙ্গে নিয়ে আসিনি। এমন সময় দেখি ঘরের মধ্যে ধোঁয়া আর আগুনে ভরা জানালা দিয়ে মুখে ভেজা গামছা দিয়ে জড়ানো কী একটা জিনিস নিয়ে কুকুরটা রাস্তায় লাফিয়ে পড়ল। তারপর একছুটে আমার কাছে এসে লেজ নাড়তে নাড়তে মুখের জিনিসটা আমার দিকে এগিয়ে দিল। ভাবতে পারেন, জিনিসটা কী হতে পারে?’
সবাই প্রায় সমস্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী?’
হযবরলবাবু বললেন, ‘কুকুরের মুখ থেকে ভেজা গামছায় জড়ানো জিনিসটা নিয়ে দেখি সেটা আমার বাড়ির আর জিনিসপত্রের ফায়ার ইনসিওরেন্স। অগ্নিবিমার কাগজ।’
ঘনঘন করতালির মধ্যে শ্রোতৃবৃন্দ স্বীকার করলেন, হযবরলবাবর কুকুর তথা হযবরলবাবুর এলেম আছে বটে।
পাঠিকা দেবী, ধৈর্য ধরুন। আর ঠিক একটা গল্প বাকি আছে। খুব ছোট। কিন্তু প্রকৃত মিথ্যুকের গল্প।
শহরতলির এক বাগানবাড়ির নির্জন পুকুরে এক শৌখিন মৎস্যশিকারি লুকিয়ে মাছ ধরছিলেন, এমন সময় এক ভদ্রলোক তাঁর সম্মুখীন হলেন। ভদ্রলোক মৎস্য-শিকারিকে জিজ্ঞাসা করলেন,’ ‘কী, মাছ-টাছ কিছু ধরতে পারলেন?’
মৎস্য-শিকারি বললেন, ‘প্রচুর।’
ভদ্রলোক বললেন, ‘কী রকম?’
মৎস্য-শিকারি বললেন, ‘গোটা চারেক দু’-আড়াই কেজি কাতলা, একটা শোলমাছ, প্রায় চার কেজি হবে।’
ভদ্রলোকে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি জানেন—আমি কে?’
মৎস্য-শিকারি হুইল গুটোতে গুটোতে বললেন, ‘না।’
ভদ্রলোক বললেন, ‘আপনি জানেন আমি এই বাগানবাড়ির, এই পুকুরের মালিক?’
জিনিসপত্র গুছিয়ে রওনা হতে হতে মৎস্য-শিকারি বললেন, ‘না।’
ভদ্রলোক চেঁচিয়ে বললেন, ‘জানেন, আমি একজন ম্যাজিস্ট্রেট?’
দ্রুত অন্তর্হিত হতে হতে মৎস্য-শিকারি এবার নিজেই প্রশ্ন করলেন ভদ্রলোককে, ‘আপনি কি জানেন, আমি কে?’
ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব থমকিয়ে গিয়ে বললেন, ‘না। আপনি কে?’
বাগানবাড়ির দেয়াল ডিঙোতে ডিঙোতে সেই মৎস্য-শিকারি বললেন, ‘আমি এই এলাকার সেরা মিথ্যুক।’