ঝুলা
বোম্বে শহরের এ-দিকটি বেশ নিরিবিলি। দোকানপাটও কম। কাফ-প্যারেডের এই হোটেলটা থেকে পেছনে তাকালে চোখে পড়ে দূরে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার। তার পেছনে আরব সাগরের একফালি ব্যাকওয়াটার এবং ব্যাকওয়াটার পেরিয়ে মূলসমুদ্র। ওয়ার্ল্ড ট্রেড-সেন্টারের সামনের রাস্তাতে সার সার কুড়ি বাইশতলা ছিমছাম মাল্টিস্টোরিড সব বাড়ির সারি। চুপচাপ, ফর্মাল, শুধু ‘হ্যালো’ বলা, আত্মমগ্ন, বোম্বেবাসীদের আবাস।
বোম্বে শহরে থাকলে মনে হয় বিদেশেরই কোনো শহরে আছি। বিদেশি গাড়ির মেলা, কোটি কোটি টাকার খেলা। কলকাতাবাসীদের মতো, বেতোঘোড়ার মতো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ডিজেলের কালো প্রাণহারী ধোঁয়া গিলতে গিলতে যাতায়াত করতে হয় না এদের। চল্লিশ থেকে ষাট কিলোমিটার গতিতে গাড়ি ও বাস চলে এখানে। সফল কেজো লোক গিস গিস করে এখানে।
রাতের ফ্লাইটে পৌঁছেছিলাম। এই প্রথমবার উঠলাম এই হোটেলটাতে। কনফারেন্সের জন্যে। ঘরের পর্দা সরিয়ে দিতেই দেখি কংক্রিটের পাহাড়শ্রেণিতে আলোর মালা। নানারঙা পর্দা-ঘেরা, এয়ার কণ্ডিশানার লাগানো অগণ্য মণিমুক্তোর মতো আলো-জ্বলা সব পায়রাখুপি ঘর।
সকালে ঘুম থেকে উঠে, চা খাওয়ার সময় ঘরের পর্দাগুলো আবার সরালাম। ঘরটা পশ্চিমমুখো। আলো এসে পুবমুখো মালটিস্টোরিড বাড়িগুলোকে হালকা সোনা-রঙে ভরিয়ে দিয়েছে। বোম্বে শহর জেগে উঠেছে। দলে দলে মেয়ে-পুরুষ ধবধবে সাদা শর্টস আর গেঞ্জি অথবা জগিং-স্যুট এবং সাদা ও রঙিন কেডস পায়ে প্রাত্যহিক সকালের ব্যায়ামে নেমে পড়েছে ওয়ার্ল্ড ট্রেডসেন্টারের সামনের রাস্তায়। কয়েক হাজার সাদা সি-গাল জোড়ায় জোড়ায় ভাটা-পড়া কালচে ব্যাকওয়াটারকে ভালোবাসার স্নিগ্ধ আভায় উজ্জ্বল করে বসে আছে।
আমার ঘরের ঠিক সামনেই যে-বাড়িটা, যার বেসমেন্ট ও ফার্স্ট ফ্লোরে গ্যারেজ, সার সার বিদেশি গাড়ি, সেই বাড়িরই একটি ফ্ল্যাটের বসার ঘরে চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম। একটি ‘ঝুলা’। গুজরাটিদের বাড়িতে যেমন দেখা যায়। তাতে সাদা পায়জামা আর গেঞ্জি পরা একজন মানুষ আর দারুণ সুন্দর শরীরের একজন মানুষী পাশাপাশি বসে দোল খাচ্ছেন। ভদ্রমহিলা বসেছেন বাঁ-পাশে। তাঁর মুখ দেখতে পাচ্ছি না। পরনে একটি মেরুন-রঙা শাড়ি। বাঁ-পায়ের ওপর ডান পা তুলে বসে আছেন দোলনাতে। ভারি সুন্দর পায়ের গড়ন তাঁর। রুপোর পায়জোর পায়ে। ঝুলা দুলছে। ওঁরা বড়ো প্রেমে, প্রভাতি ভালোবাসায়, দুজনে দুলতে দুলতে গল্প করছেন।
আশ্চর্য হলাম আরও দেখে যে, ঠিক তাঁদের সামনেই, বসার ঘরের বারান্দাতে একটি সবুজ গাছ। কাল রাতে যা-চোখে পড়েনি। গাছটি বাবলা গাছের মতো। মহারাষ্ট্রের শুকনো লালচে পাহাড়ি রুক্ষ পটভূমিতে যেমন গাছ সচরাচর জন্মায়, তেমন কোনো গাছ। আদিগন্ত কংক্রিটের প্যাস্টেল-রঙা পটভূমিতে ওই একঝলক সবুজ এবং তার পেছনে পরমপ্রেমে ঝুলায় দুলতে-থাকা দম্পতির দিকে চেয়ে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম।
মোহাবিষ্টের মতো ওই বারান্দার দিকে তাকিয়ে রইলাম। চা ঠাণ্ডা হয়ে যেতে লাগল।
ঝুলা দুলছে। প্রযত প্রেমে কত কী কথা বলছেন ওঁরা দুজনে। আর একজোড়া সুন্দর পা, একবার কাছে আসছে আবার দূরে সরে যাচ্ছে। উড়ে যাচ্ছে আর ফিরে আসছে, সংগমলিপ্ত জোড়া পাখির মতো। আমারও ইচ্ছে হল কোনো পাখি হয়ে কাচ ফুঁড়ে উড়ে গিয়ে সেই পায়জোর পরা পায়ের পাতায় চুমু খাই, নতজানু হয়ে বলি, হে ঈশ্বরী, প্রেমের প্রতিমা; পরমপ্রেমময়ী, তোমারই মাধ্যমে মানুষের আদিমতম ও প্রথমতম বোধকে বাঁচিয়ে রেখেছ। তোমার সুন্দর হাতে জলসিঞ্চন করে চিকন ও সবুজ করেছ উদবাস্তু গাছকে। তুমি প্রণম্য।
ঠাণ্ডা চায়ে চুমুক দিয়ে আবার তাকিয়ে দেখলাম ভদ্রলোকের বেশ একটু ভুঁড়ি আছে। বসার ভঙ্গিটিও অতিপ্রাকৃত। অভব্য। অতি, অতি, অতীব সাধারণ সেই লোক। অথচ এইরকম মানুষদের জন্যেই ঠিক এইরকম সুন্দরী দেবীসুলভা মানুষীরা তাদের মহার্ঘ প্রেমের এমন বেহিসেবি অব্যবহার চিরদিনই করে এসেছেন। যোগ্যজনের সঙ্গে কখনোই যোগ্যাজনের মিল হয়নি। হবে না। এই-ই হয়তো বা প্রাকৃতিক নিয়ম।
রোদ আস্তে আস্তে জোর হচ্ছে। নারী উঠে গিয়ে একটি থালায় করে কিছু খাবার নিয়ে এসে দুজনের মধ্যে রাখলেন। দোলনা আবার দুলতে লাগল। সুন্দরীর যত ক্রিয়াকর্ম সবই মনে হল ঘরের বাঁ-দিক ঘেঁষে—আমি শতচেষ্টা করেও প্রেমময়ীর মুখ দেখতে পেলাম না। মনে হল, তাঁর বয়েস তিরিশের নীচে। কিন্তু তাঁর প্রেম অনাদিকালের, পবিত্র, স্বচ্ছতোয়া, প্রাণদায়িনী। মুখ দেখতে পেলাম না বলেই ওই শ্রীমুখ দেখার লোভ আমার বেড়ে যেতে লাগল ক্রমশ।
অমন মাঝবয়েসি, ভুঁড়িঅলা, ফাটকা খেলা অথবা লোহালক্কড়ের কারবারি স্বামীর প্রতি এমন অনুরক্তা সুন্দরী প্রেমবিলোনো স্ত্রী কি এখনও আছেন? যিনি ঝুলায় ঝুলতে ঝুলতে সাতসকালে স্বামীর মুখে সোহাগে খাবার গুঁজে দেন? কী জানি! এমন সব স্ত্রীদের সান্নিধ্যে এসেই বোধ হয় স্বামীরা বড়ো হন, বড়ো ব্যবসায়ী, ধনপতি, বড়ো শিল্পী, লেখক, গায়ক।
ভদ্রলোক ধনে যে বড়ো বুঝতেই পারছি, কারণ এ অঞ্চলের ফ্ল্যাটের দাম নাকি দু-হাজার টাকা, প্রতি স্কোয়ার ফিট। এই এক-একটি ফ্ল্যাট নিদেনপক্ষে একহাজার স্কোয়ার ফিটের। অতএব দাম সোজা হিসেবে কুড়ি লাখ টাকা। ভাবলেই মাথা ঘোরে। এই ফ্ল্যাটের ধনবান মালিকের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করে হীনম্মন্যও লাগে। যিনি স্ত্রীর এমন মান পেয়েছেন তাঁর অন্য মানের প্রয়োজনই বা কী?
চান করে কাজে বেরোবার জন্যে তৈরি হয়ে নিতে উঠলাম চেয়ার ছেড়ে। ঠিক দশটাতে কনফারেন্স। এই হোটেলেরই কনফারেন্স রুমে, চ্যান্সারিতে।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখি দোলনাটা শূন্য। কিন্তু তখনও শূন্য দোলনাটা দুলছে। একটু আগে নিশ্চয়ই ওঁরা উঠে গেছেন।
কনফারেন্স। সোয়া এগারোটায় কফি-ব্রেক। দেড়টায় সুইমিং পুলের পাশে লাঞ্চ।তার পর বিকেল সাড়ে চারটেয় টি-ব্রেক। আবার একটানা ছ-টা অবধি। কিন্তু কনফারেন্স চলাকালীন সমস্ত সময়টাতে আমার মাথার মধ্যে হয় একটি শূন্য দোলনা দুলতে লাগল, নয়, পায়জোর-পরা একজোড়া সুন্দর পা ও একটি মেরুনরঙা শাড়ি-ঘেরা মুখ-না-দেখা পরি দোলনার দোলায় এগোতে-পেছোতে লাগল মস্তিষ্কের কোষে কোষে। কে, কী বললেন, স্লাইড-প্রোজেক্টারে কী কী স্লাইড দেখানো হল, কোন রিজিয়নের ম্যানেজারের বাজেট ফোরকাস্ট কী হল কিছুই মাথায় ঢুকল না আমার।
বিকেলে ঘরে ফিরে চান-টান করে পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে আবার পর্দা সরিয়ে বসলাম।
ঠিক এমন সময় ফোনটা বাজল। মিস্টার রথম্যান। ফোন করে সি-রক হোটেলের রিভলভিং রুফ-টপ রেস্তরাঁতে চাইনিজ ডিনার খাওয়ার জন্যে পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন।
তার পরেই নন্দু পারেখ ফোন করল, বলল, গাড়ি পাঠাচ্ছি। বাড়িতে বসে চিভাস-রিগ্যাল হুইস্কি খেতে খেতে ভিডিয়োতে দারুণ ব্লু-ফিলম দেখব।
আমি দুজনের নেমন্তন্নই সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করলাম। ব্লু-ফিলম দেখার বয়েস আর নেই। যে-বয়েসে দেখা যেত, সে-বয়েসেও দেখার কুরুচি ছিল না।
সি-রক হোটেলও বোম্বেতেই থাকবে, তার রুফ-টপ রিভলভিং রেস্তরাঁও রোজ রাতে চাঁদের মতো নরম উজ্জ্বল হয়ে বোম্বে শহরকে প্রদক্ষিণ করবে প্রায় অনন্তকাল ধরে। কিন্তু এর পরের বার এই হোটেলে উঠতে নাও পারি। এখন আমি এই দোলনা-দোলা রহস্যময়ী নারীর প্রতি অন্য সব কিছু থেকে বেশি মনোযোগী। গোয়েন্দার মতো আমার ঔৎসুক্য এখন তীব্র, তীক্ষ্ণ। না-দেখা মুখটি দেখতে পরমব্যগ্র আমি এবং জানতে যে, কোন মন্ত্রে এই দম্পতি এমন মোহময় করে রেখেছেন তাঁদের বিবাহিত প্রেমকে? দৈনন্দিনতার কালি লাগতে দেননি একটুও। মধুচন্দ্রিমার দিনকে কোন জাদুতে করতলগত করে রেখেছেন চিরদিনের মতো?
আলো জ্বলছে। কিন্তু উনিশ তলার ফ্ল্যাটটির বসবার ঘর শূন্য। দোলনা স্থির। আমার ঘর অন্ধকার করে, রুম সার্ভিসে হুইস্কির অর্ডার দিয়ে আমি বসে আছি। ইশ, একটা বায়নাকুলার জোগাড় করতে পারলে বড়ো ভালো হত। রহস্যভেদের সুরাহা হত।
একটা হুইস্কি শেষ হল। দোলনা তবুও নিষ্কম্প, নির্দোল। দ্বিতীয় হুইস্কি এল। হঠাৎ মঞ্চে নায়কের প্রবেশ ঘটল। নীলরঙা সাফারি-স্যুট পরা ভদ্রলোক ঢুকলেন। সাহেবি পোশাকে ভুঁড়িটা একটু কম মনে হল, রংটাও একটু বেশি ফর্সা। হয়তো রাতের বিজলি আলোর জন্যেই।
ভদ্রলোক দোলনার পেছনের সোফায় বসলেন। ব্রিফকেস খুলে কী যেন রাখলেন সাইড টেবিলে? কাগজ? টাকার বাণ্ডিল? কিছুই স্পষ্ট বোঝা যায় না এতদূর থেকে। প্রৌঢ়ত্বের শুরুতে এসে শৈশবের দিকে চাইলে যেমন কুয়াশা কুয়াশা ঠেকে তেমন লাগছে এখন আলো-জ্বলা বসার ঘরটিকে। হঠাৎ বাঁ-দিকের শোয়ার ঘরে আলো জ্বলল। প্রেমময়ীর পরনে এখন হালকা নীল শাড়ি। বেডরুমের দেওয়ালের এয়ার কণ্ডিশানারের ওপরের কাচের ফাঁক দিয়ে ওঁকে একটু দেখা গেল। চমৎকার চলার ভঙ্গিটি। লেটেস্ট মডেলের মার্সিডিস গাড়ির মতো। মুখ স্পষ্ট দেখা গেল না। হতাশা বাড়ল। পরি অনেক দূরে। ভীষণ কষ্ট আমার, এমন আবছা আবছা দেখতে পাওয়ার চেয়ে দেখতে না পাওয়া অনেক ভালো ছিল। সুখ, প্রেম, উষ্ণতা এসব বোধ হয় সব সময়ই আমার কাছ থেকে দূরে।
ভদ্রলোক সোফা থেকে উঠে শোয়ার ঘরে এলেন। তার পর শোয়ার ঘরের আলো জ্বলতে লাগল। কিছু বোঝা গেল না আর। আমার চোখের ক্ষমতায় কোনো দৃশ্য নেই। এখন চলচ্চিত্র, কল্পনায়। একটু পরেই এয়ার কণ্ডিশানারের ওপরের কাচ পর্দাতে ঢেকে গেল। দোলনাটা শূন্য এবং নিষ্কম্পই পড়ে ছিল সন্ধে থেকে। হঠাৎ একজন বুড়ি মতো আয়া এসে বারান্দার রেলিঙে হাত রেখে দাঁড়াল। তার পর সে দোলনায় বসে দোল খেতে লাগল। আমার ভীষণ রাগ হল। রাক্ষসী।
দু-হাতে পর্দা টেনে দিয়ে রথম্যানকে ফোন করলাম। বললাম, চলো ডিক, ডিনারই খেতে যাব সি-রকের রুফ-টপে।
২
রাতে ফিরতে দেরি হয়েছিল। সাড়ে সাতটাতে মর্নিং অ্যালার্ম কল দিতে বলে রেখেছিলাম। আর চা। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি বোম্বেতে সকালও হয় সাড়ে সাতটাতেই। টেলিফোন বাজতেই, উঠে পড়ে পর্দা সরালাম। চা-ও নিয়ে এল সেই সময়। চা নিয়ে ওই দোলনা-টাঙানো বারান্দার দিকে মুখ করে বসলাম সোফাতে।
উনিশ তলায় দোলনা দুলছে। হালকা নীল শাড়ি পরা প্রেমময়ী এবং ফিকে হলুদরঙা স্লিপিংস্যুট পরা ভদ্রলোক। স্লিপিংস্যুটে ভদ্রলোককে গেঞ্জি পায়জামার চেয়ে ভালো দেখাচ্ছে অনেক। একটু রোগা এবং বেশি ফর্সাও দেখাচ্ছে কাল থেকে। অনেক সভ্য এবং সম্ভ্রান্তও। প্রেমময়ী কালকেরই মতো পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছেন। সকলে মেয়েদের মুখ-চোখ-বুকেই সৌন্দর্য খোঁজে। আমার কাছে পায়ের ভূমিকা অসামান্য। পায়ের এবং পায়ের পাতার গড়নে মেয়েদের পেডিগ্রি খুঁজে নিতে হয়। সুন্দর পা ব্যতিরেকে কোনো মেয়ে কখনো সুন্দরী হতে পারে না। হয়তো পুরুষও নয়।
দোলনা দুলছে। বাঁ-পায়ের গোড়ালির একটু ওপর অবধি দেখা যাচ্ছে প্রেমময়ীর। সোহাগে কথা হচ্ছে। একটু-আধটু আদর-টাদর। নিশ্চয়ই চোখ দিয়েই বেশি হচ্ছে আদর। দিনের বেলা রাতের বেলার চেয়ে বেশি অস্পষ্ট। বড়ো দূর, বড়ো অস্পষ্টতা, এই ভালোবাসা।
একটু পর, কালকেরই মতো একটি থালায় করে খাবার নিয়ে এলেন। দুজনে দুলতে দুলতে খেলেন। একটু পর হঠাৎ দুজনে একসঙ্গে উঠে গেলেন। শূন্য ঝুলা দুলতে লাগল, এগোতে লাগল পেছোতে লাগল।
হঠাৎ সেই বুড়িমতো আয়াটি কোত্থেকে এসে আবার রেলিং ধরে দাঁড়াল। ডাইনি, অপ্রেম অসুন্দর। ঘেন্না, ঘেন্না, ঘেন্না।
৩
সেদিন বিকেলে কনফারেন্স শেষ হওয়ার পর ঘরে ফিরে আমার খুব ইচ্ছে হল চান-টান করে ওই বাড়িতে গিয়ে হাজির হই। তার পর ওই ফ্ল্যাটে। আমার জানতেই হবে এত প্রেম আসে কোত্থেকে। প্রেমময়ী আর তার স্বামী কতদিন বিবাহিত? কোন গুপ্তবিদ্যাতে এই প্রেম, এই সবুজ গাছ সঞ্জীবিত আছে এমন চিকনতায়, ঔজ্জ্বল্যে?
এমন সময় ফোনটা বাজল। নন্দু বলল, দাদা হোটেলে আসছি এক্ষুনি। কোথাও বেরিয়ো না।
আমি বলতে গেলাম, এক্ষুনি…?
ও কথা না শুনে ফোন নামিয়ে রাখল।
আমার স্নান শেষ হতে না হতে নন্দু এসে হাজির হল। টিপিক্যাল গুজরাটি। গলায় হার। পায়ে কোলাবার রিগ্যাল থেকে কেনা চটি। পরনে পায়জামা-পাঞ্জাবি গা থেকে ভুর ভুর করে দামি পারফিউমের গন্ধ বেরুচ্ছে। ঘরে ঢুকেই বলল, তোমার হয়েছেটা কী বাঙালিবাবু? বোম্বেতে কেউ এত তাড়াতাড়ি ঘুমোয় নাকি? বাচ্চারা ছাড়া? সন্ধেই তো হয় আটটাতে, সকাল হয় সাড়ে সাতটায়। এত ঘুমোলে ব্রেন ডাল হয়ে যাবে।
আমাকে অন্যমনস্ক দেখে বলল, চলো, আমার নতুন এয়ার কণ্ডিশানড শেভ্রলে গাড়িতে মেরিন ড্রাইভে একটা চক্কর দিয়ে তার পর খাইয়ে-দাইয়ে আবার পৌঁছে দিয়ে যাব তোমায়। গজল শুনবে? ভালো গজল? যেমন গাইয়ে, তেমন গান!
আমি বললাম, আমি একটা সমস্যায় পড়েছি নন্দু। আমার কিছুই ভালো লাগছে না।
নন্দু হাসল। ওর নীচের পাটির দুটো দাঁত সোনা দিয়ে বাঁধানো। গুজরাটিরা সোনা দিয়ে দাঁত বাঁধাতে ভালোবাসে। হেসে বলল, সমস্যা? বলল, আজীব-আদমি। বোম্বাই শহরে নন্দু পারেখ যার চেলা তার ভালো লাগছে না কীরকম? ভালো-না-লাগা কাকে বলে?
নন্দুর দিকে তাকিয়ে আমার মনে হল, ও যেন মৃদু মৃদু হেসে নীরবে বলতে চাইছে, কত টাকা লাগবে বলো তোমার ভালোলাগা কিনতে? কী করলে তোমার ভালো লাগবে শুধু বলো, এক্ষুনি আরব সাগরের হাওয়া-বওয়া শহরের সব ভালোলাগা তোমাকে কিনে দিচ্ছি।
আমি চুপ করে তাকিয়ে থাকলাম।
ও বলল, কী হল? কথা বলো।
আমি ঘরের পর্দা-সরানো কাচের জানলা দিয়ে ফ্ল্যাটটির দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলাম, জানো নন্দু, ওই বাড়ির উনিশ তলায়, ওই ফ্ল্যাটে একটি কাপল থাকে, বড়ো প্রেম তাদের। আর একটি গাছ। অনেক সবুজ নরম পাতা সে-গাছে, অনেক…
তুমি চুপ করবে? নন্দু আমাকে ধমক দিল। বলল, তোমাকে তো কতদিন বলেছি, বম্বে চলে এসো। এখানে আমার একটা ফ্ল্যাট খালি পড়ে আছে। বেয়ারা-কাম বাবুর্চি আছে। এখানে থাকো আর লেখো। নোংরা প্রাগৈতিহাসিক কলকাতায় কি ভদ্রলোক থাকতে পারে? মাসে মাসে তোমার সংসার খরচা আমি পাঠিয়ে দেব। আমার তিনটে কোম্পানিতে তোমাকে ডিরেক্টর করে নেব। আমার কাজে একটু-আধটু সাহায্য কোরো, আর বেশি সময়টা এখানে হিন্দি ছবির জন্যে স্ক্রিপ্ট লেখো। কত পয়সা। তোমার দুটো প্রফেশান এক করলেও তার একুশ ভাগও পাবে না এঁদো কলকাতায়।
আমি চুপ করে রইলাম।
নন্দু আমাকে গম্ভীর দেখে ওর স্বগতোক্তিতে ভাটা দিয়ে সিরিয়াসলি বাড়িটির দিকে তাকাল। নিজের মনেই বিড় বিড় করে বলল, এটা কোন দিক? তার পর নিজেই এদিক-ওদিক আলোজ্বলা বাড়িগুলোর দিকে চেয়ে বলল, বুঝেছি। কোন তলার ফ্ল্যাট বললে?
উনিশ তলা।
আরে… উ-নি-শ-ত-লা…। নিজের মনেই বলল নন্দু।
তার পর আবার বলল উনিশ তলা। ওই ফ্ল্যাট! আরে…
তুমি চেনো?
আমি যেন হাতে চাঁদ পেলাম। বললাম, তাহলে চলো। ওদের কাছেই চলো। নন্দু উঠে দাঁড়াল। বলল, বেশ! তাই-ই চলো।
তোমার যা-হুকুম।
আমি কাবলিটা পায়ে গলাতে গলাতে ওকে বললাম, কতখানি চেনো?
নন্দু টেলিফোন ডায়াল করতে করতে হেসে বলল, কাউকে যতখানি চেনা সম্ভব।
তার পরই ফোনে গুজরাটিতে ছে ছে করে কথা বলল।
বলেই, জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল।
অবাক হয়ে আমি দেখলাম, প্রেমময়ী একটা ফিকে বেগুনি শাড়ি পরে দোলনায় এসে বসল। আমার ঘরের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল।
নন্দু আমার দিকে ফিরে বলল, ওই ফ্ল্যাট তো? আমি স্ত্রী-আচারে কাবু-হওয়া জামাইয়ের মতো ক্যাবলা, ভদভদে গলায় বললাম, হ্যাঁ।
নন্দু বলল, এবার চলো বাঙালিবাবু।
বলেই, বলল, শালার রবিঠাকুরের জাতের কিসসু হবে না। আনপ্র্যাকটিক্যাল রোমান্টিক ফুলস।
তার পর আরও কিছু বলল মহান বাঙালিদের উদ্দেশ করে ভালোবাসামিশ্রিত অশ্রাব্য ভাষায়, যা লেখা সম্ভব নয়।
যখন আমরা রকেটের মতো গতিসম্পন্ন ওটিস এলিভেটরে চড়ে মালটিস্টোরিড বাড়িটির উনিশ তলায় পৌঁছে বেল বাজালাম তখন সেই রাক্ষসী আয়া এসে দরজা খুলল। নন্দুকে কুর্নিশ করল।
নন্দু বলল, কোথায়?
শোয়ার ঘর দেখিয়ে, আয়া সসম্মানে বলল, ভেতরে যান।
নন্দু এমনভাবে এগিয়ে গেল যেন ওটা ওরই বাড়ি। দোলনাটা চোখে পড়ল। সবুজ গাছটাও। দোলনাটাতে একবার বসতে ভারি ইচ্ছে হল আমার। কিন্তু এ-দোলনাতে একা বসলে আমাকেও রাক্ষস মনে হবে। শ্রীকৃষ্ণ আর রাধা ছাড়া এই ঝুলাতে অন্য কারো ঝুলন মানায় না।
ঘরের দরজা খুলে নন্দু ঢুকল, পেছনে পেছনে আমি। কার্পেট মোড়া এয়ার কণ্ডিশানড ঘর। বিরাট ডাবল বেড। পুরু ডানলোপিলো পাতা। এককোনায় সোফা। টেবিলের ওপর ‘ব্ল্যাক-ডগ’ হুইস্কির বোতল, বরফ, সোডা গ্লাস সব সাজানো। প্রেমময়ী সোফা ছেড়ে উঠে এলেন আমাকে দেখে অবাক হয়ে। নন্দু বলল, আমার বাঙালি দোস্ত। খুব মানী লোক। প্রেমময়ী নমস্কার করল জোড়হাতে। আহা কী রূপ। ঘরের নীল আলোর চেয়েও স্নিগ্ধ, নরম। কী চুল, কী চোখ, কী চিবুক!
নন্দু আমার দিকে ফিরে বাংলায় বলল, পছন্দ তো? আজ রাতটা তুমি তাহলে এখানেই থাকো। আমার মেহমান হয়ে। এর ফিস পাঁচ হাজার। ট্রাইব্যুনালে ধড়াচূড়া পরে দাঁড়ালে তুমি নিশ্চয়ই এর চেয়ে অনেক অনেকই কম পাও। জীবনে কিছুই করতে পারলে না বাঙালিবাবু। বিজনেস তো করলেই না প্রফেশানেও তোমরা আটারলি আনসাকসেসফুল। ফু:।
একটা হুইস্কি খাওয়ার পর আমি বললাম, আমি এবার যাব নন্দু।
কিছু ভালো লাগছিল না, কিছুই না।
নন্দু আমার দিকে ভর্ৎসনার চোখে তাকাল। তার পর বিরক্তির সঙ্গে বলল, নীচে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, ড্রাইভারকে নিয়ে যাও। আমি পরে যাচ্ছি।
প্রেমময়ী আবার উঠে দাঁড়িয়ে হেসে নমস্কার করলেন। বসবার ঘরে দোলনাটা স্থির হয়েছিল।
সমুদ্র থেকে হু-হু হাওয়া বইছিল কিন্তু তবু গাছটার পাতা নড়ছিল না একটাও।
৪
সকালের আলো ফুটতেই পর্দা সরিয়ে চেয়ারটা টেনে বসলাম, অন্য দিকে মুখ করে। ঝুলাটাকে আমি আর দেখতে চাই না। একবারের জন্যেও নয়। ব্যাকওয়াটারের দিকে তাকালাম। আশ্চর্য। আজ একটি সি-গালও নেই। নরম, পবিত্র ভালোবাসার প্রতীক, সুগন্ধি সব সি-গালেরা কাল রাতে আরব সাগরের ওপর কোনো অন্ধঝড়ে ডানা ভেঙে পড়ে, অবুঝ অন্ধকারে জোড়ায় জোড়ায় ভেসে গেছে প্রমত্ত ঢেউয়ের দোলায়। আর সেই ঢেউয়েরই দোলনা চেপে রাতারাতি উধাও হয়েছে পৃথিবী থেকে মনের সব ভালোবাসা জলজ দুর্গন্ধের মধ্যে থিক থিক করা পোকার মতো নন্দুদের আর তাদের শরীরের শরিক মনহীন বারাঙ্গনাদের প্রতি দুর্মর ঘৃণায়।