ঝুমু খালার গ্রামের বাড়ি
সন্ধেবেলা যখন ঝুমু খালা শিঙ্গাড়া ভেজে এনেছে তখন বড় চাচা ঝুমু খালাকে বলল, “ঝুমু, তোমার একটা চিঠি এসেছে।”
ঝুমু খালা হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, “বাড়িতে ঠিকানাটা দেওয়াই ঠিক হয় নাই। দুই দিন পরে পরে খালি চিঠি।”
টুম্পা বলল, “কেন ঝুমু খালা, তোমার চিঠি পেতে ভালো লাগে না?”
“সেইটা নির্ভর করে চিঠির ভিতরে কী আছে তার উপরে। বাড়ি থেকে যে চিঠি আসে সেইখানে থাকে খালি নাই নাই খবর। এইটা নাই, সেইটা নাই, এইটা লাগবে, সেইটা লাগবে-এই রকম কথাবার্তা। এই চিঠি পেলে কি ভালো লাগে? উল্টা মেজাজ গরম হয়।”
মুনিয়া বলল, “চিঠিটা খুলে দেখো-ভালো খবরও তো থাকতে পারে।”
“বাসার কাজকর্ম শেষ করি তারপর খুলব।”
ঝুমু খালা বুঝতে পারে নাই বাসার কাজকর্ম শেষ করে চিঠি খোলাটা অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে, তার সাথে সাথে চিঠিটা খোলা উচিত ছিল। চিঠিটা লিখেছে ঝুমু খালার ছোট বোন ঝর্ণা। ঝর্ণা গ্রামের স্কুলে ক্লাস নাইনে। পড়ে, সে দুই লাইনের একটা চিঠি লিখেছে :
বুবু,
বড় চাচা
রবিবার চব্বিশ তারিখ আমার বিয়ে ঠিক করেছে। আমি বিয়ে করব না। যদি জোর করে আমাকে বিয়ে দেয় আমি
গলায় দড়ি দিব, খোদার কসম।
ঝর্ণা।
চিঠি পড়ে ঝুমু খালা মাথায় হাত দিয়ে বসে রইল। তার এই ছোট বোনটাকে সে অনেক আদর করে। অল্প বয়সে বাবা মরে যাওয়ার কারণে তার নিজের লেখাপড়া হয় নাই। সেই জন্যে ঝুমু খালা তার ছোট বোনটাকে লেখাপড়া করাতে চায়। ছোট বোন ঝর্ণা লেখাপড়ায় খুব ভালো, তাকে এইভাবে কেউ জোর করে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে ঝুমু খালা জীবনেও ভাবে নাই।
আজকে তেইশ তারিখ শনিবার, যার অর্থ বিয়ে আগামীকাল। ঝুমু খালা যদি খালি বাড়িতে গিয়ে হাজির হতে পারত তাহলেই সে বিয়ে আটকে দিত। কিন্তু এখন রাত হয়ে গেছে, শেষ নাইট কোচটা ছেড়ে দিয়েছে, যার অর্থ কাল সকালের আগে ঝুমু খালা রওনা দিতে পারবে না। বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকাল হয়ে যাবে। ততক্ষণে ঝর্ণাকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিবে। কিংবা ঝর্ণা সত্যি সত্যি গলায় দড়ি দিয়ে দেবে।
ঝুমু খালা কী রকম জানি উদ্রান্তের মতো রান্নাঘরের দরজায় বসে রইল। সে এখন কী করবে?
সবার আগে টুনি ঝুমু খালাকে রান্নাঘরের দরজায় গালে হাত দিয়ে এভাবে বসে থাকতে দেখল। টুনি একটু অবাক হয়ে বলল, “কী হয়েছে ঝুমু খালা?”
ঝুমু খালা সবকিছু বেশি বেশি করে, যখন অল্প একটু খুশি হওয়ার কথা তখন অনেক বেশি খুশি হয়, যখন অল্প একটু রাগ হওয়ার কথা তখন অনেক বেশি রাগ হয়, যখন অল্প একটু কথা বলার কথা, তখন অনেক বেশি কথা বলে। এই প্রথমবার ঝুমু খালা কোনো কথা না বলে কেমন যেন ফ্যালফ্যাল করে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল, দেখে মনে হলো ঝুমু খালা যেন। টুনির কথা বুঝতেই পারে নাই।
টুনি আবার জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে ঝুমু খালা?”
ঝুমু খালা কোনো কথা না বলে হঠাৎ করে শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ঝুমু খালা কাঁদছে-দৃশ্যটা এত অস্বাভাবিক যে টুনি একেবারে হতবাক হয়ে গেল। সে ঝুমু খালার পাশে বসে তার হাত ধরে বলল, “কী হয়েছে ঝুমু খালা, কোনো খারাপ খবর?”
ঝুমু খালা মাথা নাড়ল, বলল, “আমার ছোট বোনটারে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। কাল বিয়ে, আমি বিয়েটা ঠেকাতে পারমু না।”
টুনি বলল, “রাত্রে তো বাস থাকে
“নাই। আমার গ্রামে যাওয়ার নাইট কোচ নাই। কাল বিকালের আগে পৌঁছাতে পারুম না-ততক্ষণে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেবে।”
“তুমি টেলিফোন করো-টেলিফোন করে না করো।”
“টেলিফোন করে লাভ নাই। বড় চাচা ফোন ধরবে না, ধরলেও কথা শুনবে না। খালি যদি আমি নিজে হাজির থাকি তাহলে বিয়েটা ঠেকানো যেত”-বলে ঝুমু খালা আবার মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, বিড়বিড় করে বলল, “ঝর্ণারে, তোরে আমি বাঁচাতে পারলাম না।”
টুনি ঝুমু খালাকে রেখে উঠে ভিতরে গেল। ছোটাচ্চু তার ঘরে বিছানায় আধশোয়া হয়ে একটা বই পড়ছিল, টুনি ঘরে ঢুকে বলল, “ছোটাচ্চু, ঝুমু খালা কাঁদছে।”
ছোটাচ্চু ধড়মড় করে উঠে বসল। চোখ বড় বড় করে বলল, “ঝুমু কঁদছে?”
“হ্যাঁ।”
“কেন কাঁদছে?”
“ঝুমু খালার ছোট বোনকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে সেই জন্যে,। কাল বিয়ে-ঝুমু খালা গিয়ে বিয়ে থামাতে পারবে না, সেই জন্যে ঝুমু খালার খুব মন খারাপ। সেই জন্যে কাঁদছে।”
“রাতে বাস নাই?”
“না।”
ছোটাচ্চু কিছুক্ষণ মুখ সুচালো করে বসে রইল। তারপর উঠে দাঁড়াল। গাল চুলকাতে চুলকাতে ঘরের ভেতর একটু হাঁটল, তারপর বলল, “তুই যা, ঝুমুকে বল রেডি হতে। আমি একটা গাড়ি ভাড়া করে আনি। ঝুমুকে রাতে তার বাড়ি নিয়ে যাই।”
টুনি চোখ বড় বড় করে বলল, “সত্যি?”
“হ্যাঁ। একটা ছোট মেয়েকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেবে, ফাজলেমি নাকি?”
টুনি ছোটাচ্চুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “ছোটাচ্চু, তুমি হচ্ছ সুইট থেকেও সুইট।”
ছোটাচ্চু অন্যমনস্কভাবে বলল, “শুধু একটা ছোট সমস্যা।”
“কী সমস্যা?”
“কাল বিকালে আমার আর ফারিহার শিল্পকলাতে একটা নাটক দেখতে যাওয়ার কথা ছিল, সেই প্রোগ্রামটা ক্যান্সেল করতে হবে। ফারিহা অনেক দিন থেকে এই নাটকটা দেখার জন্যে অপেক্ষা করে ছিল।”
“এটা কোনো সমস্যা না ছোটাচ্চু। ফারিহাপু অনেক সুইট, কিছু মনে করবে না। তুমি একটা ফোন করে বলে দাও।”
“হ্যাঁ, আমি ফোন করে দিই। তুই যা ঝুমুকে বল রেডি হতে।”
.
টুনি রান্নাঘরে গিয়ে দেখে ঝুমু খালা ঠিক একইভাবে বসে আছে। চোখে একটা শূন্য দৃষ্টি, তাকিয়ে আছে কিন্তু কিছু দেখছে বলে মনে হচ্ছে না। টুনি ঝুমু খালার পিঠে হাত দিয়ে বলল, “ঝুমু খালা।”
ঝুমু খালা একটুখানি চমকে উঠে বলল, “হ্যাঁ!”
“তুমি রেডি হও। ছোটাচ্চু তোমাকে তোমার বাড়ি নিয়ে যাবে।”
মনে হলো ঝুমু খালা কথাটা বুঝতে পারল না। কেমন যেন অবাক হয়ে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল, বলল, “কে বাড়ি নিয়ে যাবে?”
“ছোটাচ্চু। একটা গাড়ি ভাড়া করে আনবে।”
“গাড়ি ভাড়া? আমাকে নেওয়ার জন্যে?”
“হ্যাঁ। তোমাকে নেওয়ার জন্যে।”
“ছোট ভাই গাড়ি ভাড়া করবে? আমার জন্যে?”
“হ্যাঁ। কাল সকালে পৌঁছে যাবে।”
টুনি ভেবেছিল ঝুমু খালা বুঝি খুশিতে চিৎকার দিবে কিন্তু টুনি অবাক হয়ে দেখল ঝুমু খালা আবার আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, “বুঝলা টুনি, আগের জন্মে আমি নিশ্চয়ই কুনো একটা ভালো কাম করছিলাম। সেই জন্যে এই জন্মে তোমাদের বাসায় থাকার সুযোগ পাইছি। এই বাসার মানুষেরা সব ফিরেশতা। কেউ ছোট ফিরেশতা, কেউ বড় ফিরেশতা। তা না হলে আমার জন্যে কেউ গাড়ি ভাড়া করে? আমি কে?”
টুনি বলল, “ছোটাচ্চু মানুষটা সহজ-সরল, কিন্তু তার মনটা ভালো।”
.
ঝুমু খালাকে রেডি হতে বলে টুনি ছোটাচ্চুর কাছে গিয়ে দেখল ছোটাচ্চু তার বিছানায় বসে পা দোলাচ্ছে। তার মুখে বিশাল একটা হাসি। টুনি জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
“আমি যখন ফারিহাকে বললাম ঝুমুকে তার বাড়ি নিয়ে যেতে হবে গাড়ি ভাড়া করে, তখন ফারিহা রেগে গেল। বলল, তোমার টাকা বেশি হয়েছে? আমি বললাম, একটা ইমার্জেন্সি কেস, টাকা খরচ করতে হবে। তখন ফারিহা কি বলল জানিস?”
“কী বলল?”
“বলল, আমি ঝুমুকে গাড়ি ড্রাইভ করে তার বাড়ি নিয়ে যাব।”
“ফারিহাপু? ফারিহাপু ঝুমু খালাকে বাড়ি নিয়ে যাবে?”
“হ্যাঁ। নূতন নূতন ড্রাইভিং লাইসেন্স হয়েছে তো, গাড়ি চালানোর খুব উৎসাহ। সে নিজে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাবে।”
টুনি হাততালি দিয়ে বলল, “কী মজা!”
“সারারাত গাড়ি চালাতে হবে, এর মাঝে মজাটা কোথায় দেখছিস?”
টুনি মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, “ছোটাচ্চু তোমাকে একটা কথা বলি তুমি রাগ করবে না তো?”
“কথাটা কী, না জেনে আমি কীভাবে বলব?”
“কথাটা হচ্ছে, আমাকে তোমাদের সাথে নিয়ে যাবে?” ছোটাচ্চু চোখ কপালে তুলে বলল, “তোকে?”
“হ্যাঁ। প্লিজ! ঝুমু খালা কেমন করে বিয়েটা ভাঙে সেটা দেখতে চাই!”
“সারা রাত তুই গাড়িতে বসে থাকবি?”
“হ্যাঁ। ফারিহাপু গাড়ি চালাবে, তুমি পাশে বসবে। আমি আর ঝুমু খালা বসব পিছনে।”
“কে কোনখানে বসবে সেটাও ঠিক হয়ে গেছে?” টুনি ছোটাচ্চুর হাত ধরে বলল, “প্লিজ ছোটাচ্চু, প্লিজ! প্লিজ! প্লিজ!”
ছোটাচ্চু কিছুক্ষণ মুখ সুচালো করে রেখে বলল, “দেখি তোর আম্মু আবু কী বলে। যদি পারমিশান দেয়–”
“তুমি বললেই দেবে ছোটাচ্চু। প্লিজ তুমি বলো–”
.
ঝুমু খালা যখন শুনেছে তাকে বাড়ি নেওয়ার জন্যে ছোটাচ্চুর আর গাড়ি ভাড়া করতে হচ্ছে না, ফারিহাপু নিজে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাবে তখন ঝুমু খালা আবার একটু কেঁদে ফেলল, তারপর চোখ মুছে আগের ঝুমু খালা হয়ে গেল। চিৎকার-চেঁচামেচি করে ঘরবাড়ি মাথায় তুলে ফেলল। কী হয়েছে জানার জন্যে যখন বাচ্চারা ঝুমু খালাকে ঘিরে ধরল তখন ঝুমু খালা হাত পা নেড়ে বলল, “কত বড় সাহস, আমার ছোট বইনকে, বাচ্চা মেয়েটাকে বিয়া দিতে চায়! আমি খালি একবার পৌঁছে নেই, তারপর দেখো কী করি।”
মুনিয়া জিজ্ঞেস করল, “কী করবে ঝুমু খালা?”
“খাবলা দিয়ে যদি চোখ দুইটা তুলে না নেই!”
“কার চোখ তুলে নেবে ঝুমু খালা?”
“যারা আমার বইনকে জোর করে বিয়ে দিতে চায়।”
মুনিয়াকে খুব বিভ্রান্ত দেখা গেল, “চোখগুলি তারপর কোথায় রাখবে ঝুমু খালা?
“বয়মের ভিতরে রেখে দিমু।”
টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “জামাইকে কিছু করবে না ঝুমু খালা?”
“করব না মানে! ঝাড়ুর মুড়া দিয়ে যদি দাঁত না ভাঙি!”
দৃশ্যটা কল্পনা করে বাচ্চারা সবাই কেমন জানি শিউরে শিউরে ওঠে।
.
রাত এগারোটার দিকে ফারিহাপু তার গাড়ি নিয়ে চলে এলো। ঝুমু খালা তার ছোট একটা ব্যাগ নিয়ে রেডি ছিল, সে সবার কাছ থেকে বিদায় নিল। দাদি বললেন, “ঝুমু, মাথা গরম করে কিছু কোরো না। সবাইকে বুঝিয়ে বলো যে এত ছোট মেয়ের বিয়ে দেয়া ঠিক না।”
বড় চাচা বললেন, “এলাকার টি.এন.ও. আর থানায় খবর দিয়ে রাখবে।”
মেজ চাচি বলল, “তোমার বোন যে স্কুলে পড়ে সেই স্কুলের হেড মাস্টারকে জানিয়ে রেখো।”
বড় ফুপু বলল, “বেশি ঝামেলা হলে সাথে করে এখানে নিয়ে এসো, কয়েক সপ্তাহ এখানে থেকে যাবে।”
শান্ত ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ঝামেলা হলে একটা মিসড কল দিবে, আমি চলে আসব। তারপর দেখি কত ধানে কত চাল।”
ঝুমু খালা বলল, “আপনারা খালি দোয়া করেন। দুই-চাইরটা মানুষের ঠ্যাং যেন ভেঙে আসতে পারি।”
সবাই নিচে নেমে গেল, ঝুমু খালাকে গাড়িতে তুলে দেওয়ার জন্যে। ছোটাচ্চু টুনিকে নিয়ে যেতে রাজি হয়েছে, টুনির আব্বু-আম্মুর কাছ থেকে পারমিশানও নেওয়া হয়েছে। বাসার ছোটরা কেউ জানত না তাই সবাই যখন দেখল গাড়ির পিছনে ঝুমু খালার সাথে টুনিও উঠে বসেছে তখন একসাথে সবাই হই হই করে উঠল। এখন তারাও সবাই সাথে যেতে চায়! গাড়িতে জায়গা নেই, ফেরত আসার সময় ঝুমু খালার ছোট বোন ঝর্ণাকে নিয়ে আসতে হতে পারে, সামনে পরীক্ষা, রাস্তা খারাপ, এই সব কথা বলে ছোটাচ্চু কোনোভাবে সামাল দিল।
ছোটাচ্চু ড্রাইভারের সিটের পাশে বসতেই ফারিহাপু গাড়ি স্টার্ট দিল। বাসার সামনের রাস্তাটা ধরে খানিকটা গিয়ে বড় রাস্তায় ওঠার সাথে সাথে ফাহিরাপু বলল, “শাহরিয়ার সিট বেল্ট বাঁধে।”
“সিট বেল্ট! সিট বেল্ট কেন বাঁধতে হবে?”
“আমার গাড়িতে যে-ই উঠবে তাকেই সিট বেল্ট বাঁধতে হবে।”
“যদি না বাঁধি?”
ফারিহাপু দাঁত বের করে হেসে বলল, “তাহলে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিব।”
ছোটাচ্চু বিরস মুখে সিট বেল্ট বেঁধে নিল।
রাস্তা যথেষ্ট ফাঁকা, ফারিহাপু তার মাঝে গাড়ি চালাতে থাকে। ঝুমু খালা কিছুক্ষণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে ফারিহাপুর ড্রাইভিং দেখল, তারপর বলল, “আপা, আপনি বড় সুন্দর গাড়ি চালান। একেবারে এক নম্বর।”
ফারিহাপু হাসল, বলল, “ইচ্ছা করলে তুমিও গাড়ি চালানো শিখতে পারবে। তারপর তুমিও এক নম্বর ড্রাইভার হয়ে যেতে পারবে।”
“আমি পারমু?”
“পারবে না কেন? পৃথিবীর স্ট্যাটিস্টিক্স অনুযায়ী মেয়েরা ছেলেদের থেকে ভালো ড্রাইভার।”
“সত্যি?”
“সত্যি। যে কাজ ছেলেরা পারে, মেয়েরাও সেইটা পারে। বরং ভালো পারে।
ছোটাচ্চু বলল, “এইটা একটু বেশি বলে ফেললে। বলো সমান সমান পারে। ভালো পারে তার কী প্রমাণ আছে?”
“নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু এই গাড়িতে আমাদের প্রমাণ দেওয়ার কোনো দরকার নাই। গাড়িতে আমরা তিনজন তেজি মেয়ে। তুমি একজন দুবলা ছেলে। আমরা যেটা বলব তোমাকে সেটা শুনতে হবে।”
ছোটাচ্চু হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে। ঠিক আছে।”
ফারিহাপু ছোটাচ্চুর সাথে গল্প করতে করতে গাড়ি চালাতে লাগল। ছোটাচ্চু বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করল, “ফারিহা, তোমার ড্রাইভ করতে বেশি কষ্ট হচ্ছে না তো? কষ্ট হলে আমাকে বোলো।”
ফারিহাপু বলল, “কেন? তাহলে তুমি কী করবে?”
“তাহলে তুমি গাড়ি থামিয়ে একটু রেস্ট নেবে। হাঁটাহাঁটি করবে। একটু চা-নাশতা খাবে।”
ফারিহাপু বলল, “আমার চা খাওয়ার ইচ্ছা করলে গাড়ি থামাব। হাইওয়ের পাশে চায়ের দোকান চব্বিশ ঘণ্টা খোলা থাকে।”
ছোটাচ্চু বলল, “যখন কেউ রাতে লং ড্রাইভে যায় তখন একজনকে দায়িত্ব নিতে হয়, যে ড্রাইভারের সাথে টানা কথা বলবে, যেন ড্রাইভার ঘুমিয়ে না পড়ে।”
ফারিহাপু বলল, “সেটা ভালো আইডিয়া।”
ছোটাচ্চু বলল, “আমি সেই দায়িত্ব নিলাম, আমি সারা রাত জেগে থেকে তোমার সাথে কথা বলে যাব, যেন তুমি ঘুমিয়ে না পড়ো।”
ফারিহাপু বলল, “থ্যাংকু শাহরিয়ার।”
টুনি গাড়ির পিছনে বসে থেকে লক্ষ করল ছোটাচ্চু ফারিহাপুকে জাগিয়ে রাখার জন্যে তার সাথে জোরে জোরে হাত-পা নেড়ে কথা বলছে। ফারিহাপু বেশি কথা বলছে না, ছোটাচ্চুর কথার সাথে সাথে হু-হা করে যাচ্ছে।
একটু পরেই টুনি লক্ষ করল ছোটাচ্চু গাড়ির সিটে মাথা রেখে বিচিত্র ভঙ্গিতে ঘুমিয়ে গেছে। সিট বেল্ট বেঁধে রাখার কারণে মাথাটা বাঁকা হয়ে ছিল, সে কারণেই কি না কে জানে ছোটাচ্চুর নাকডাকা শোনা যাচ্ছে।
বিষয়টা ঝুমু খালাও লক্ষ করল, সে ফারিহাকে বলল, “আপা, একটু আগেই না ছোট ভাইজান কইল হে সারা রাত জাইগা থাইকা আপনার সাথে কথা বলব, এখন দেখি ছোট ভাইজান ঘুমায়।”
ফারিহাপু হাসল, বলল, “থাক ঘুমাতে দাও। মনে হয় সারা দিন ঝামেলায় গেছে।”
“কিন্তু হে যে কইল আপনারে জাগায়া রাখব!”
“সেটা তো রাখছেই। নাকডাকার শব্দটা শুনছ না? এটা দিয়েই জাগিয়ে রাখবে।”
ফারিহার কথা শুনে ঝুমু খালা আর টুনি দুজনেই হি হি করে হেসে উঠল। তাদের হাসির শব্দ শুনে ছোটাচ্চু হঠাৎ ধড়মড় খেয়ে উঠল। চমকে উঠে বলল, “কী হয়েছে? কী হয়েছে?”
ফারিহাপু বলল, “কিছু হয় নাই। তুমি ঘুমাও।”
ছোটাচ্চু বলল, “ঘুমাব কেন? না, না, আমি ঘুমাব না। আমি জেগে আছি। পুরোপুরি জেগে আছি।”
ফারিহাপু বলল, “ঠিক আছে, তুমি জেগে থাকো।”
টুনিও চেষ্টা করছিল জেগে থাকতে। কিন্তু কখন যে সে ঘুমিয়ে পড়ল নিজেই জানে না। ঘুমের ভেতর মনে হলো কয়েকবার গাড়ি থেমেছে। গাড়ি থেকে নেমে কেউ কেউ চা খেতে গিয়েছে। আবার গাড়ি চলেছে। হঠাৎ হঠাৎ পাশে দিয়ে যাওয়া ট্রাক কিংবা বাসের বিকট হর্নের শব্দে ঘুম ভেঙে গেছে, তারপর সে আবার ঘুমিয়ে গেছে।
শেষ পর্যন্ত যখন তার ঘুম ভেঙেছে তখন ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। টুনি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেল, কী সুন্দর একটা ছোট রাস্তা এঁকেবেঁকে গেছে। রাস্তার দুই পাশে বড় বড় গাছ। যত দূর চোখ যায় সবুজ ধান খেত, বাতাসে ধান গাছের মাথা এমনভাবে নড়ছে যে দেখে মনে হয় বুঝি ধান খেতের উপর দিয়ে ঢেউ বয়ে যাচ্ছে। দূরে হালকা কুয়াশা, দেখে মনে হয় যেন কেউ একটা ছবি এঁকে রেখেছে।
টুনি জিজ্ঞেস করল, “আর কত দূর ফারিহাপু?”
“মনে হয় কাছাকাছি পৌঁছে গেছি।”
ঝুমু খালা বলল, “সামনে মাগরাবাজার, তারপরেই আমাগো গ্রাম।”
ফারিহাপু জিজ্ঞেস করল, “গাড়ি তোমার বাড়ি পর্যন্ত যাবে?”
“না। গাঁও-গেরামে কি আর বাড়ি পর্যন্ত গাড়ি যায়?”
“তাহলে তুমি আমাকে বলল কোথায় থামতে হবে।”
“জে বলব। বাড়ি থেকে অনেক দূরে থামবেন। আমি আগে চলে যাব, তারপর আমি যখন খবর পাঠাব তখন আপনারা আসবেন। গাড়িটা কাছাকাছি রেখে হেঁটে আসতে হবে। বাড়িতে এসে ভান করবেন আপনারা আমাকে চেনেন না।”
“তোমাকে চিনি না? কেন?”
ঝুমু খালা দাঁত বের করে হাসল, বলল, “সেইটা সময়মতো আপনাদের বলব।”
টুনি বলল, “ঝুমু খালা, আমি কি তোমার সাথে আগে যেতে পারি?”
“আমার সাথে যেতে চাও? হাঁটতে হবে কিন্তু। পারবা? “পারব।”
“ঠিক আছে, তাহলে তুমি আমার সাথে যাবে।”
ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “আগে গিয়ে কী করবি?”
টুনি মুখ টিপে হেসে বলল, “ঝুমু খালা কেমন করে বিয়েটা ভাঙবে সেইটা দেখতে চাই।”
হঠাৎ করে ঝুমু খালার মুখ শক্ত হয়ে গেল, দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “আমি যদি খাবলা দিয়ে চোখ তুলে না ফেলি তাহলে আমি বাপের বেটি না।”
গাড়ি একটা ছোট বাজার পার হলো, বেশ ভোর, তাই দোকানপাট এখনো খোলেনি। বাজারটা পার হয়ে মিনিট দশেক যাবার পর ঝুমু খালা ফারিহাপুকে বলল, “আফা, সামনে স্কুলের সামনে আপনে থামেন। স্কুলের সামনে একটা গেস্ট হাউস আছে, আপনারা সেইখানে হাত-মুখ ধুয়ে নাশতা-পানি খেতে পারবেন।”
ফারিহাপু গেস্ট হাউসের সামনে গাড়ি থামাল। দরজা খুলে সবাই নেমে পড়ল। ঝুমু খালা তার ছোট ব্যাগটা নিয়ে বলল, “আফা, ছোট ভাইজান, আমি তাড়াতাড়ি যাই। আপনারা হাত-মুখ ধুইয়া ফেরেশ হন।”
তারপর টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “চলো টুনি। অনেক দূর হাঁটতে হবে।”
“চলো ঝুমু খালা।”
ছোটাচ্চু বলল, “গুড লাক ঝুমু। আমরা আছি।”
ঝুমু খালা স্কুলের পাশ দিয়ে একটা সরু রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে। এখনো বেশ সকাল, তাই মানুষজন খুব বেশি নেই। একটা শুকনো ছেলে একটা বিশাল গরু নিয়ে যাচ্ছে। দুই পাশে ধান খেত। দূরে দূরে এক একটা গ্রাম, সেখানে গাছপালা, বাড়িঘর।
ঝুমু খালা টুনির সাথে কথা বলতে বলতে পা চালিয়ে হাঁটছে, কিন্তু যতই সে তার বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছাতে লাগল, ততই সে চুপ হয়ে যেতে লাগল। টুনি টের পেল ঝুমু খালার ভেতরে একধরনের অস্থিরতা শুরু হয়েছে। বাড়িতে গিয়ে ঠিক কী দেখবে জানে না, সেই জন্যে তার ভেতরে এই অস্থিরতা।
প্রায় আধা ঘণ্টা হাঁটার পর ঝুমু খালা একটা বড় পুকুরের কাছে দাঁড়াল, টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “ওই যে সামনে দেখছো জোড়া তালগাছ, সেইটা আমার বাড়ি।”
টুনি বলল, “কী সুন্দর!”
ঝুমু খালা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “জায়গাটা সুন্দর, কিন্তু মানুষের মনটা সুন্দর না, তা না হলে আমার ছোট বোনটারে জোর করে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে?”
ঝুমু খালা বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে, টুনি ঝুমু খালার পিছু পিছু হেঁটে যায়, বড় একটা গাছ পার হয়ে তারা একটা বাড়ির উঠোনে হাজির হলো। সেখানে বেশ কিছু মানুষ, কিছু পুরুষ, কিছু মহিলা, কিছু বাচ্চাকাচ্চাও আছে। লোকজন ব্যস্তভাবে যাওয়া-আসা করছে, কথাবার্তা বলছে, তার মাঝে ঝুমু খালা এসে ঢুকল এবং তাকে দেখে হঠাৎ করে সবাই চুপ করে গেল।
ঝুমু খালা একটু এগিয়ে তার ব্যাগটা নিচে রেখে, শাড়ির আঁচলটা কোমরে পেঁচিয়ে নিল। ঝুমু খালার চেহারার মাঝে সবসময় একটা তেজি ভাব থাকে, শাড়ির আঁচল কোমরে প্যাচিয়ে নেওয়ার পর তেজি ভাবটা কেমন যেন একশ’ গুণ বেড়ে উঠল। ঝুমু খালা একজন বয়স্কা মহিলার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, “মা, ঝর্ণা কই?”
টুনি বুঝতে পারল এই বয়স্কা মহিলাটা ঝুমু খালার মা। ঝুমু খালাকে দেখে কেমন জানি ভয় পেয়ে গেছে, দুর্বল গলায় বলল, “ভিতরে। ঘরের ভিতরে।”
“গলায় কি দড়ি দিছে, নাকি এখনো দেয় নাই?”
“এইটা তুই কী বলিস, গলায় দড়ি দিবে কেন?”
“গলায় দড়ি দিব কেন তুমি বুঝ নাই? ঝর্ণারে তুমি কি আসলেই পেটে ধরছিলা, সত্যি করে কও দেখি?”
ঝুমু খালার মা কেমন জানি থতমত খেয়ে বলল, “ঝুমু, কী রকম কথা বলিস তুই?”
ঝুমু খালা এবারে ঘরের দিকে এগিয়ে গলা উঁচু করে ডাকল, “ঝর্ণা, এই ঝর্ণা। বাইরে আয়।”
টুনি তখন দেখল ঘরের ভেতর থেকে তার চাইতে একটু বড় একজন মেয়ে প্রায় ছুটে বের হয়ে এসে ঝুমু খালাকে জাপটে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। ঝুমু খালা ঝর্ণাকে শক্ত করে ধরে রেখে বলল, “কান্দিস না বোকা মেয়ে। মেয়ে হয়ে যখন জন্ম হইছে তখন কান্দাকাটি বন্ধ কর। গলায় দড়ি দিবি তো বল, তোরে দড়ি কিনে এনে দেই।”
ঝুমু খালা এদিক-সেদিক তাকাল। এক পাশে দশ-এগারো বছরের একটা ছেলে দাঁড়িয়ে ছিল, ঝুমু খালা তাকে ডাকল, বলল, “এই জহুরুল। শোন।”
জহুরুল এগিয়ে এলো। ঝুমু খালা বলল, “পাকঘরে যা, গিয়া দা’টা নিয়ে আয়।”
ছেলেটা অবাক হয়ে বলল, “দা?”
“হ্যাঁ।”
ঝুমু খালার মা বলল, “দা কেন? দা দিয়ে কী করবি?”
ঝুমু খালা তার মায়ের কথা শুনল বলে মনে হলো না, ছেলেটাকে একটা ধমক দিয়ে বলল, “কী বললাম তোরে! কথা কানে যায় না? দৌড় দে।”
ছেলেটা এবারে সত্যি সত্যি একটা দৌড় দিল এবং প্রায় সাথে সাথে একটা দা নিয়ে বের হয়ে এলো। ঝুমু খালা দা’টা হাতে নিয়ে তার ধার পরীক্ষা করে একটা সন্তুষ্টির মতো শব্দ করে ঝর্ণাকে টেনে তার মায়ের কাছে নিয়ে যায়। তারপর দা’টা তার মায়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “নেও মা।
দা’টা নেও। তারপর জোরে ঝর্ণার ঘাড়ে একটা কোপ দাও।”
মা রেগে গিয়ে বলল, “কী বলিস তুই ঝুমু!”
ঝুমু খালা শান্ত গলায় বলল, “মা, আমি কোনো ভুল কথা বলি না। কেলাস নাইনে পড়ে বাচ্চা একটা মেয়েরে দামড়া একটা মানুষের সাথে বিয়া দেওয়ার থেকে তারে এক কোপে মাইরা ফেলা ভালো। বিয়া দেওয়ার অনেক যন্ত্রণা মা। দুই দিন পর জামাই আসব যৌতুক নিতে। যৌতুক দিতে না পারলে শ্বশুর-শাশুড়ি-জামাই মিলে এমনিতেই ঝর্ণার গলা টিপে ধরবে। তার থেকে এখন এক কোপে মেরে ফেলো!”
ঝুমু খালার মা বলল, “কী বলিস তুই! জামাই ছেলে খুব ভালো, লন্ডন থাকে। এমনি এমনি কি বিয়ে দিচ্ছি নাকি?”
“না মা, তুমি বিয়া দিচ্ছ না, তুমি ঝর্ণার জীবনটা নষ্ট করতাছ। কিন্তু মা, জেনে রাখো, আমি বেঁচে থাকতে তুমি ঝর্ণারে এইভাবে বিয়া দিতে পারবা না। খোদার কসম। তুমি আমারে এখনো চিনো নাই। টি.এন.ও. সাহেব, ও.সি. সাহেব, হেড মাস্টার সাহেব সবাইরে খবর দেওয়া হইছে। পুলিশ আইসা যদি দেখে আঠারো বছরের কম বয়সে বিয়া দিতাছ, সবাইরে কোমরে দড়ি দিয়া বাইন্ধা হাজতে নিয়ে যাইব!”
হাজতের কথা শুনে হঠাৎ উপস্থিত সবার ভিতরে এবারে একটা আতঙ্কের ভাব ছড়িয়ে পড়ল। সবাই নিচু গলায় গুজগুজ করে নিজেদের ভিতর কথা বলতে থাকে। ঠিক তখন একজন বয়স্ক মানুষ হেঁটে হেঁটে এগিয়ে আসে। ঝুমু খালার মা ফিসফিস করে বলল, “তোর বড় চাচা আসছে, খবরদার কোনো বেয়াদপি করবি না।”
ঝুমু খালা বলল, “কী যে বলো মা, আমি মুরব্বিদের সাথে বেয়াদপি করব? সেইটা তুমি কেমন করে ভাবলা?”
ঝুমু খালা এবারে ঝর্ণার হাত ছেড়ে দিয়ে উঠানের এক কোনায় দাঁড়িয়ে থাকা টুনিকে দেখিয়ে বলল, “ঝর্ণা, এই হচ্ছে টুনি। তারে নিয়া যা, হাত মুখ ধোয়ার ব্যবস্থা করে কিছু খেতে দে।”
ঝর্ণাকে একটুখানি বিভ্রান্ত দেখাল, একবার টুনির দিকে তাকাল আরেকবার ঝুমু খালার দিকে তাকাল। একটু আগে তাকে নূতন বউ হিসেবে কঠিন পাহারার মাঝে রেখেছিল, এখন হঠাৎ করে সে ছাড়া পেয়ে গেছে, কেউ কিছু বলছে না, বিষয়টা সে ভালো করে বুঝতেই পারছে না। কী করবে বুঝতে না পেরে শেষ পর্যন্ত ঝুমু খালার কথামতন টুনির কাছেই গেল। টুনিকে বলল, “আসো, ভিতরে আসো। একটু হাত-মুখ ধোও।”
টুনি একটু হাসির চেষ্টা করে বলল, “ঝর্ণাপু, আমি আরো একটুক্ষণ বাইরে থাকি?”
“হাত-মুখ ধোবা না? কিছু খাবা না?”
“পরে। আগে দেখি ঝুমু খালা কী করে।”
ঝুমু খালা যেটা করছিল সেটা অবশ্যি দেখার মতোই একটা দৃশ্য! তার বড় চাচা ঝুমু খালার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, “তুমি কোন সময় আসছ?”
“সকালবেলা চাচাজি।”
“আইসাই একটা ঘোট পাকাচ্ছ? এই জন্যে বলছিলাম সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবার পর যেন তোমারে খবর দেয়।”
“কিন্তুক আগেই খবর পাইছি চাচাজি। মায়ের পেটের বোনের বিয়া, আমি না থাকলে কেমন হয়?”
ঝুমু খালার বড় চাচা মুখ গম্ভীর করে বলল, “ঠিক আছে। আইসা যখন পড়ছেই, থাকো। কিন্তু কোনো ঝামেলা করবা না। অনেক খানদানি ফেমিলির ছেলে–”
ঝুমু খালা তার হাতের দা’টা হাতবদল করে অদৃশ্য একটা কিছুকে কোপ দেওয়ার ভঙ্গি করে বলল, “মনে হয় না খানদানি বংশ। তাহলে কেলাস
নাইনের মেয়েরে বিয়া করার জন্যে পাগল হইত না। হাজার হলেও কাজটা বেআইনি। মেয়েদের বিয়ার বয়স আঠারো। ঝর্ণার বয়স মাত্র পনেরো–”
“এইগুলি কে জানে? কে দেখে?”
“জানাইলেই জানে। দেখাইলেই দেখে।” বলে ঝুমু ধারালো দা’টা বিপজ্জনকভাবে ধরে রেখে মুখটা হাসি হাসি করল।
বড় চাচা চোখ ছোট ছোট করে বলল, “তুমি হাসো কেন?”
“এমনিই হাসি।” তারপর হঠাৎ করে মুখটা গম্ভীর করে বলল, “চাচাজি, এই বিয়েতে আমার মত নাই। এই বিয়া বন্ধ করেন।”
“তুমি মত দেওয়ার কে? তুমি মেয়ে মানুষ–”
ঝুমু খালা মুখ শক্ত করে বলল, “চাচাজি, মায়েরে জিজ্ঞাসা করেন মাসে মাসে কে টাকা পাঠায়। সংসার কার টাকায় চলে। এই বাড়িতে মত কে দিতে পারে একবার জিজ্ঞাসা করেন।”
বড় চাচা ধমক দিয়ে বললেন, “বড় বড় কথা বলবা না। বরযাত্রী রওনা দিচ্ছে, দুপুরে পৌঁছে যাবে।”
“আসতে না করেন। বেআইনি বিয়া, পুলিশ ধরে নিয়ে গেলে বেইজ্জতি হবে। আপনার বেইজ্জতি, নূতন জামাইয়ে বেইজ্জতি।”
বড় চাচা হাসির মতো শব্দ করল, বলল, “তোমার কথায় পুলিশ আসব?”
“জে না। আমার কথায় পুলিশ আসব না। আমি কে? কিন্তু আমি যেই বাড়িতে থাকি সেই বাড়ির মানুষজনের কথায় পুলিশ আসব। পুলিশের বাবাও আসব। যদি বিশ্বাস না করেন, অপেক্ষা করেন। নিজের চোখে দেখবেন।”
ঠিক তখন একটা ছোট ছেলে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে বলল, “একটা লাল রঙের গাড়ি আসতাছে। লাল রঙের গাড়ি!”
বড় চাচা চমকে উঠল, বলল, “গাড়ি কোথায় আসে?”
ঝুমু উত্তর দিল, “এই বাড়িতে।”
“কেন?”
“আসলে পরে আপনি জিজ্ঞেস করেন।”
যারা আশেপাশে দাঁড়িয়ে ছিল তাদের একজন ভীত গলায় বলল, “মনে হয় পুলিশ।”
আরেকজন বলল, “না, পুলিশ না। মনে হয় টি.এন.ও. সাহেব।”
এই প্রথমবার বড় চাচাকে বিচলিত হতে দেখা গেল, দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে বলল, “কাজটা ঠিক হইল না।”
“চাচাজি, বেয়াদপি দিয়েন না, কাজটা কিন্তু আসলে ঠিকই হইছে। ঝর্ণা লেখাপড়া শেষ করব, চাকরি করব। তারপর বিয়া করব।”
“ভাত খাওয়ার পয়সা নাই। লেখাপড়ার শখ–”
“ভাত খাওয়ার পয়সা নাই কথাটা ঠিক না। বাপ মরে গেছে বলে আপনারা আমারে লেখাপড়া করতে দেন নাই। এখন আমি রোজগার করি, আমি ঝর্ণারে লেখাপড়া করামু। খোদার কসম।”
বড় চাচা বিষদৃষ্টিতে ঝুমু খালার দিকে তাকাল, তারপর মেঘস্বরে বলল, “বরযাত্রী আইসা যখন দেখব এই অবস্থা তখন কী হবে?”
“একটা ফোন দেন। দিয়া বলেন যেন না আসে। দরকার হইলে আমার কথা বলেন-বলেন যে আমার মাথা আউলাঝাউলা। আমি দা নিয়ে ঘুরতাছি।”
অনেকেই গোল হয়ে ঘিরে কথাবার্তা শুনছিল, হঠাৎ একটা ছোট মেয়ে রিনরিনে গলায় বলল, “ঝর্ণা বুবুর সাথে বিয়া না হলে ঝুমু বুবু তুমি বিয়ে করে ফেলো!”
কথাটা বুঝতে ঝুমুর একটু সময় লাগল, যখন বুঝতে পারল তখন হি হি করে হাসতে লাগল। ছোট মেয়েটা জিজ্ঞেস করল, “বুবু, তুমি হাসো কেন? আমি কি কিছু অন্যায্য কথা কইছি?”
ঝুমু হাসি থামিয়ে বলল, “না, তুই মোটেও অন্যায্য কথা বলিসনি। কিন্তু আমারে বিয়ে করতে সাহস লাগে! এই রকম সাহস কার আছে?”
ছোট মেয়েটা বলল, “তুমি একটু চিল্লাফাল্লা করে বুবু, কিন্তু তোমার মনটা তো ভালা! তুমি রাজি হয়ে যাও।”
ঝুমু হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল, বলল, “শোন, তোরে বলে রাখি, কেউ আমারে বিয়া করতে চাইলেই আমি তারে বিয়া করুম না। আমারও তারে পছন্দ হইতে হবে। বুঝলি?”
“বুঝছি।”
“যখন তোর বিয়ার বয়স হইব, তখন তুইও এই কথাটা মনে রাখিস।”
“যাও!” বলে লজ্জা পেয়ে মেয়েটা পিছনে সরে গেল।
এ রকম সময় ছোটাচ্চু আর ফারিহাপু এসে উঠানে ঢুকল, একদল বাচ্চাকাচ্চা তাদেরকে ঘিরে হাঁটছে। একজন মেয়ে নিজে গাড়ি চালিয়ে
আসছে, এ রকম বিষয় তারা আগে কখনো দেখেনি!
উঠানের লোকজনের মাঝে একধরনের উত্তেজনা দেখা গেল, দৌড়াদৌড়ি করে দুইটা চেয়ার নিয়ে আসা হলো। গামছা দিয়ে মুছে সেই দুইটা চেয়ার উঠানের মাঝখানে রাখা হলো। ঝুমু খালার বড় চাচা বিনয়ে একেবারে গলে গিয়ে হাত কচলে বলল, “বসেন। বসেন। আপনারা কি টি.এন.ও. সাহেব আর ও.সি. সাহেব?”
ছোটাচ্চু মাথা নেড়ে বলল, “না, না, আমরা টি.এন.ও. না, ও.সি.ও। আমরা ঝুমুকে নিয়ে এসেছি।”
ফারিহাপু বলল, “তবে আমি টি.এন.ও., লোকাল থানার ওসি, আর স্কুলের হেড মাস্টারের সাথে কথা বলেছি। তারা সবাই আসছেন।”
ছোটাচ্চু বলল, “টি.এন.ও. সাহেব একটু ব্যস্ত, কিন্তু আপনাদের বরযাত্রী আসার আগেই চলে আসবেন। আমাদের কথা দিয়েছেন।”
বড় চাচা হাত কচলে বললেন, “অনুগ্রহ করে যদি তাদের বলে দেন তাদের আসার কোনো দরকার নাই। আমরা নিজেরাই বিয়েটা বন্ধ করে ফেলছি!”
টুনি খুবই শান্তশিষ্ট মেয়ে, নিজের আনন্দ বা রাগ প্রকাশ করার জন্য কখনোই চিৎকার-চেঁচামেচি করে না। কিন্তু আজকে কী হলো কে জানে সে আনন্দে একটা চিৎকার দিল এবং সাথে সাথে অন্যান্য বাচ্চাকাচ্চারা তার সাথে চিৎকার করে উঠল। ঝুমু খালাও একটা চিৎকার দিল এবং চিৎকার দেওয়ার সময় তার হাতের ধারালো দা’টা মাথার উপর ঘোরাতে লাগল।
ছোটাচ্চু ভয় পেয়ে বললেন, “এই ঝুমু, তোমার হাতে দা কেন? সর্বনাশ! দা রেখে এসো।”
ঝুমু খালা দাঁত বের করে হেসে বলল, “ঠিক আছে ছোট ভাইজান, দা রেখে আসি।”
বড় চাচা হাত কচলে আবার বলল, “পুলিশকে কি অনুগ্রহ করে আবার একটু ফোন করবেন? বলেন যে আসার কোনো দরকার নাই। বুঝতেই পারছেন, পুলিশ মানেই একটা ঝামেলা!”
ছোটাচ্চু বলল, “কোনো ঝামেলা না। আসুক, আসার পর আমরা কথা বলব। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।”
.
এদিকে বিয়ে বন্ধ করার উত্তেজনা শেষ হবার পর, চাউলের গুঁড়া দিয়ে তৈরি রুটি এবং মোরগের মাংস দিয়ে নাশতা করা হলো। (টুনি নিজের চোখে দেখতে পেল উঠানে ধাওয়া করে মোরগটিকে জহুরুল ধরে এনেছিল।) বড়রা যখন উঠানে বসে গ্রামের নানা ধরনের সমস্যা এবং তার সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে আলোচনা করছে তখন টুনি ঝর্ণাকে ফিসফিস করে বলল, “ঝর্ণা আপু, তোমাদের গ্রামে জরিনী বেওয়া নামে একজন আছে না?”
ঝর্ণা অবাক হয়ে বলল, “হ্যাঁ, আছে। তুমি তার নাম জানো কীভাবে?”
“ঝুমু খালা সবসময় তার গল্প করে।”
“ও!”
টুনি বলল, “আমাকে জরিনী বেওয়ার কাছে নিয়ে যাবে?”
“কেন?”
“এমনি! একটু দেখতে চাই মানুষটা কেমন।”
ঝর্ণা বলল, “ঠিক আছে, তাহলে এখনই চলে যাই।”
“কত দূর?”
ঝর্ণা হাসল, বলল, “ছোট গ্রামের ভিতরে সবকিছু কাছাকাছি। কোনোটাই দূরে না।”
.
ঝর্ণা টুনিকে নিয়ে বের হলো। একটু আগে যে মেয়েটার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল এখন সে গ্রামে বেড়াতে বের হয়েছে, সেটা যথেষ্ট আলোচনার বিষয়। কাজেই তাকে একটু পরে পরে তার ব্যাখ্যা দিতে দিতে যেতে হলো। যেমন ঝুমু খালার বাড়ি থেকে বের হতেই একজন মহিলা ঝর্ণার পথ আটকাল, বলল, “হেই ঝর্ণা, তোর বিয়া নাকি ভাইঙ্গা গেছে।”
“জি চাচি! আপনাদের দোয়া।”
“এইটা কী রকম কথা?”
“সত্যি কথা। আমি লেখাপড়া করতে চাই চাচি। পাস করে চাকরি বাকরি নিমু। তারপর বিয়া।”
“জামাই পার্টি কী বলে? বরযাত্রী আহে নাই?”
“রওয়ানা দিছিল। মাগরার বাজারের কাছে আইসা থাইমা গেছে। আর আসার সাহস পায় নাই।”
“ভয়টা কীসের?”
“মনে হয় পুলিশের। আমার বিয়ার বয়স হয় নাই-বিয়া বেআইনি।”
মহিলা চোখ কপালে তুলে বলল, “পুলিশ আইছিল নাকি?”
“জি আইতাছে। ওসি সাহেব আর টি.এন.ও.।”
“সর্বনাশ! কাউরে ধইরা নিব নাকি?”
“জে না চাচি। শহর থেকে যারা আসছে তারা সামাল দিবে।” তারপর টুনিকে দেখিয়ে বলল, “এই যে এই মেয়ে, তার চাচা, চাচার বন্ধু-সবাই আমার বিয়া ঠেকাইতে আসছে।”
মহিলা তখন খুবই তীক্ষ্ণ চোখে টুনিকে পরীক্ষা করল, তারপর বলল, “কয়দিন থাকবা?”
“আজকেই চলে যাব।”
“আজকেই! আমাদের গেরামটা একটু দেইখা যাও।”
“সেই জনেই বের হয়েছি।”
“কোথায় যাও?”
ঝর্ণা বলল, “জরিনী বেওয়ার কাছে।”
মহিলা চোখ কপালে তুলে বলল, “জরিনী বেওয়া? সমস্যাটা কী?”
ঝর্ণা হাসল, বলল, “কোনো সমস্যা নাই। অনেক নাম শুনছে তাই দেখতে চাচ্ছে।”
“যাচ্ছ যখন জরিনী বেওয়ার একটা তাবিজ নিয়া যাইও। লেখাপড়ার তাবিজ, শক্ত তাবিজ। এই তাবিজ নিয়া পাস করে নাই সেই রকম কখনো ঘটে নাই।”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “জি আচ্ছা।”
এই মহিলার কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে দশ পা এগোয়নি, তার মাঝে আরেকজন মহিলা তার পথ আটকাল, বলল, “এই ঝর্ণা, তোর বিয়া নাকি ভাইঙ্গা গেছে?”
ঝর্ণা আবার দাঁত বের করে হেসে বলে, “জি চাচি, আপনাদের দোয়া!”
তারপর হুবহু আগের আলোচনা চলতে থাকে!
.
জরিনী বেওয়ার বাড়ি খুব দূরে নয়, কিন্তু ঝর্ণাকে পথে কথা বলতে বলতে আসতে হয়েছে বলে পৌঁছাতে বেশ সময় লাগল। জরিনী বেওয়ার ছোট একটা মাটির বাড়ি, দরজাটা এত ছোট যে দেখে মনে হয় বুঝি হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হবে। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ঝর্ণা ডাকল, “নানি, বাড়ি আছ?”
ভেতর থেকে থুরথুরে একজন বুড়ির গলা শোনা গেল, “কেডা?”
“আমি ঝর্ণা।”
“কুন ঝর্ণা?”
“ঝুমুর ছোট বোন।”
“ও আচ্ছা। কী খবর?”
“একজন মেহমান আসছে, তোমার সাথে দেখা করতে চায়।”
“কী সমস্যা? বিয়া-শাদি? নাকি পরীক্ষা পাস?”
“এগুলো কিছু না, তোমার নাম শুনেছে, তাই তোমারে একবার দেখতে চায়।”
ভিতরে কিছুক্ষণ নীরবতা, তারপর ছোট দরজা দিয়ে একেবারে থুরথুরে একজন বুড়ি লাঠিতে ভর দিয়ে বের হয়ে এলো। এত বুড়ি যে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। মানুষের বয়স হলে চুল কমে যায়, জরিনী বুড়ির মাথা ভরা চুল এবং সেই চুল শণের মতো ধবধবে সাদা। সারা শরীরের চামড়া কুঞ্চিত, মুখে একটিও দাঁত নেই। এলোমেলোভাবে একটা সাদা শাড়ি পরে আছে।
লাঠি ঠকঠক করে বাইরে এসে বলল, “কেডা আমারে দেখতে চায়?”
টুনি বলল, “আমি।” টুনি অবাক হয়ে জরিনী বেওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। সে মনে মনে জরিনী বেওয়া যে রকম হবে ভেবেছিল হুবহু সে রকম। কথা বলার ধরনটা পর্যন্ত তার কল্পনার সাথে মিলে গেছে। জরিনী বেওয়া চোখ কুঁচকে টুনিকে দেখার চেষ্টা করে বলল, “কাছে আও বইন। আজকাল চোখে দেখি না, কানেও শুনি না। শীতের সময় গরম লাগে, গরমের সময় শীত। রাত্রে চোখে ঘুম আসে না, সারা রাত জাইগা বইসা থাকি।”
টুনি একটু কাছে এগিয়ে গেল, জরিনী বেওয়া টুনিকে দেখে বলল, “চউখে চশমা বইন, কারণটা কী?”
টুনি বলল, “জানি না নানি। ছোট থাকতেই চোখ খারাপ হয়ে গেছে।”
“মনে হয় লেখাপড়া বেশি করছ।” জরিনী বেওয়া তার ঘরের বারান্দায় একটা পিঁড়িতে বসে বিড়বিড় করে কথা বলতে থাকে, “সংগ্রামের সময় তোর নানারে যখন পাঞ্জাবিরা মারছে তখন আমার বয়স ষাইট। এখন বয়স একশ’র উপরে-আর কত? আজরাইল আইসা জানটা কবচ করলে তো জীবনটা বাঁচে–”
ঝর্ণা বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে পড়ল, “কী বলো নানি! তুমি এখনই মরার কথা চিন্তা করো কেন? তুমি এই গ্রামের মুরুব্বি, তুমি না থাকলে আমাগো কে দেখে-শুনে রাখবে?”
“আল্লাহ দেখব।”
“তাবিজ-কবজ কে দিব?”
“ধুর বেকুব মেয়ে। তাবিজ কি আমি দেই নাকি? আল্লাহর কালাম পইড়া ফুঁ দেই। কখনো কামে লাগে কখনো লাগে না।”
টুনি বলল, “ঝুমু খালা আপনার কথা অনেকবার বলেছে। আপনার পানি-পড়া দিয়ে নাকি মানুষের জবান বন্ধ করা যায়। পান-পড়া দিলে বিয়ে শাদি হয়!”
জরিনী বেওয়া টুনির কথা শুনে খিকখিক করে হাসতে থাকে, হাসতে হাসতে তার চোখে পানি এসে যায়। চোখ মুছে বলে, “তুমি ঝুমুর কথা বিশ্বাস করছ? হেই মেয়েটা হইছে আমার পাগলি মেয়ে। তোমারে আসল কথাটি কই, তুমি শুনো।”
টুনি বলল, “বলেন নানি।”
জরিনী বেওয়া ষড়যন্ত্রীদের মতো গলা নামিয়ে বলল, “আসলে তাবিজ কবজ বলে কিছু নাই! যার মন দুর্বল হে আমার কাছে আসে, আমি আল্লাহর নামে ফুঁ দেই। তাবিজ চাইলে একটা তাবিজ দেই। দোয়া চাইলে মাথায় হাত দিয়া দোয়া দেই! দুর্বল মানুষ তখন মনে জোর পায়-নিজে নিজে কাম হয়-আর বলে জরিনী বেওয়ার তাবিজ!” কথা শেষ করে জরিনী বেওয়া আবার খিকখিক করে মাড়ি বের করে হাসতে থাকে।
টুনির মানুষটাকে খুব পছন্দ হলো। সবাইকে পানি-পড়া আর তাবিজ দোয়া দিচ্ছে কিন্তু নিজে কিছু বিশ্বাস করে না।
টুনি আর ঝর্ণা থাকতে থাকতেই একজন মাঝবয়সী মানুষ এসে জরিনী বেওয়ার সামনে হাঁটু ভাঁজ করে বসে বলল, “নানি, বড় বিপদে পড়েছি!”
জরিনী বেওয়া বলল, “কে? তুমি কি শামসুদ্দি নাকি?”
“জি নানি।”
“তোমার বাপের শরীল ভালা?”
“জি নানি। আপনার দোয়া।”
“তা, তোমার সমস্যা কী?”
“নানি, আমার সাদা ছাগলডা খুঁইজা পাই না।”
“ছাগল খুঁইজা পাও না?”
“না, নানি।”
“শেয়াল ধইরা নেয় নাই তো?”
“না নানি, বড় ছাগল। শেয়াল নিব না।”
জরিনী বেওয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “তাহলে কি মনে হয় চুরি গেইছে।”
“জি নানি।”
জরিনী বেওয়া একটা নিশ্বাস ফেলল, বলল, “এই গ্রামে তো চুর-ডাকাইত আছিল না।”
“এখন মনে হয় আসতেছে।”
“তোমার কাউরে সন্দেহ হয়?”
“কিছু তো হয় কিন্তুক প্রমাণ নাই।”
ঠিক আছে, “ওই মটকা থেকে এক মুঠ চাউল আনো।”
মানুষটি বারান্দার এক পাশে রাখা মটকা থেকে এক মুঠি চাউল নিয়ে এলো। জরিনী বেওয়া চাউল ধরে রাখা মুঠিটি হাত দিয়ে ধরে বিড়বিড় করে কী যেন পড়ে ফুঁ দিল। তারপর বলল, “যারে সন্দেহ হয় তারে এই চাউল খেতে দিও। চুরি করলে চাবাইয়া চাউল নরম করতে পারব না। যাও।”
মানুষটি তখন তার গামছায় বাঁধা একটা মাঝারি লাউ বের করে জরিনী বেওয়ার পায়ের কাছে রেখে বলল, “নানি, গাছে লাউ ধরছে। ভাবলাম পয়লা লাউটা তোমারে দিয়া যাই।”
“আমার কি আর লাউ খাওনের সময় আছে। ঠিক আছে, আনছো যখন রাইখা যাও!”
মানুষটা চলে যাবার পর ঝর্ণা বলল, “নানি, তোমারে একটা জিনিস জিজ্ঞাসা করি?”
“করো।”
“যে চুরি করেছে সে আসলেই এই চাউল চিবাইতে পারব না?”
জরিনী বেওয়া কিছু বলার আগেই টুনি বলল, “না, পারবে না।”
“কেন?”
টুনি বলল, “তার কারণ যে চুরি করেছে তার মন দুর্বল। যখন শুনবে নানির চাউল পড়া তখন আরো ভয় পাবে। ভয়ে মুখ শুকিয়ে যাবে, লালা বের হবে না। সেই জন্যে চাউল চিবাতে পারবে না!”
জরিনী বেওয়া একটু অবাক হয়ে বলল, “তুমি এইটা কেমন করে জানো?”
টুনি বলল, “আমি একটা বইয়ে পড়েছি!”
“বইয়ে এই সব লেখা থাকে?”
“জি নানি, অনেক কিছু লেখা থাকে। কিছু সত্যি, কিছু ভুলভাল, কিছু মিথ্যা!”
জরিনী বেওয়া বলল, “তাই তো বলি বইন, তোমার এত কম বয়সে চউখে চশমা কেন! বই পড়ে পড়ে চউখে চশমা! তোমার মাথায় অনেক বুদ্ধি বইন। খুব খুশি হইছি তোমারে দেইখা। বুদ্ধিরে শান দিও। বুদ্ধিরে শান দিলে বুদ্ধি বাড়ে।”
ঝর্ণা জিজ্ঞেস করল, “বুদ্ধিরে শান দেয় কীভাবে?”
“বুদ্ধির কাম করলেই বুদ্ধির শান দেওয়া হয়। খোদা বুদ্ধি দিছে মানুষরে, আর কাউরে দেও নাই।”
টুনি আরো কিছুক্ষণ বসে জরিনি বেওয়ার সাথে কথা বলতে চাচ্ছিল কিন্তু তাদের আবার আজকেই ফিরে যেতে হবে, তাই সে উঠে পড়ল। জরিনী বেওয়া টুনি আর ঝর্ণার মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে দিল। হেঁটে যেতে যেতে টুনি একবার পিছন ফিরে দেখল, জরিনী বেওয়া গভীর মনোযোগ দিয়ে একটা হামান দিস্তায় পান ভেঁচছে। যাদের দাঁত নেই তাদের পান খাওয়া একটা জটিল সমস্যা।
ঝর্ণার সাথে হেঁটে কিছু দূর যাওয়ার পর আবার শামসুদ্দিন নামের মানুষটার সাথে দেখা হলো। রাস্তার এক পাশে সে দাঁড়িয়ে এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে। ঝর্ণা জিজ্ঞেস করল, “চাচা তুমি কী খোঁজ?”
“আমার মনে হলো আমার ছাগলের ডাক শুনলাম!”
সামনেই কুচকুচে কালো একটা ছাগল মনোযোগ দিয়ে একটা ছোট গাছের মাথা মুড়িয়ে খাচ্ছে, ঝর্ণা সেইটা দেখিয়ে বলল, “এইখানে ছাগল
তো এই একটাই!”
“কিন্তু এইটা কালো ছাগল! আমারটা সাদা।”
শামসুদ্দিন নামের ছাগল হারানো মানুষটা এদিক-সেদিক তাকিয়ে আরো কিছুক্ষণ তার সাদা ছাগলটা খুঁজল, না পেয়ে একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে হেঁটে বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেল।
ঠিক তখন খোঁচা খোঁচা দাড়ি মুখের একজন মানুষ কোথা থেকে যেন হাজির হলো, মানুষটার ভাবভঙ্গি কেমন যেন সন্দেহজনক। ময়লা কাপড়, ঘাড় থেকে ময়লা একটা ঝোলা ঝুলছে। সেখানে হাত দিয়ে একটা দড়ি বের করে কালো ছাগলটার গলায় দড়িটা বেঁধে ফেলল, তারপর ছাগলটাকে টেনে নিতে লাগল।
ছাগলটা মোটেই যেতে চাচ্ছিল না, রীতিমতো মানুষ-ছাগলে টানাটানি। কিন্তু মানুষটা ছাগলটাকে রীতিমতো টেনেহিঁচড়ে নিতে থাকে।
টুনি হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল, তার কিছু একটা সন্দেহ হলো। তারপরে প্রায় ছুটে মানুষটার কাছে গিয়ে বলল, “এই যে আঙ্কেল–”
মানুষটা ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, “আমারে বলো?”
“জি। এইটা আপনার ছাগল?”
মানুষটা বিরক্ত হয়ে বলল, “তা না হলে কার হবে?”
“কী সুন্দর ছাগল! বাহ!” বলে সে ছাগলটার পাশে বসে তার গায়ের উপর হাত বুলিয়ে হাতটা চোখের সামনে নিয়ে আসে। তার হাত কালো রং লেগে কালো হয়ে গেছে। সে নিচু হয়ে ছাগলটাকে এঁকে দাঁড়িয়ে নাক কুঁচকে বলল, “আঙ্কেল, আপনার ছাগলটার শরীরে জুতার কালির গন্ধ। মনে হচ্ছে জুতা যেইভাবে রং করে এই ছাগলটাকে সেভাবে রং করা হয়েছে।”
মানুষটাকে দেখে মনে হলো সে টুনির কথা বুঝতে পারছে না, মুখটা অর্ধেকটা খুলে সে টুনির দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল।
টুনি আরেকটু এগিয়ে গিয়ে বলল, “আঙ্কেল, আপনার ঝোলাটা একটু দেখি, ভিতরে জুতার কালি আর ব্রাশ আছে কি না?”
টুনি এগিয়ে যেতেই মানুষটা নিজের ঝোলাটা শক্ত করে ধরে ফেলল, সে ভিতরে দেখতে দিবে না। কী হচ্ছে বুঝতে ঝর্ণার একটু সময় লাগল, এবারে সেও এগিয়ে এসে টুনির সাথে যোগ দিল, দুইজনে মিলে ঝোলাটা
ধরে ফেলল এবং এবারে রীতিমতো একটা টানাটানি শুরু হয়ে গেল। গ্রামের মেঠোপথ, মানুষজন নেই কিন্তু চেঁচামেচি শুনে বাড়ির ভেতর থেকে একজন-দুইজন মানুষ বের হয়ে আসে। মানুষটা হঠাৎ করে নিজের বিপদ বুঝতে পারল, তখন ঝোলাটা ছেড়ে দিয়ে উল্টো দিকে একটা দৌড় দিয়ে দেখতে দেখতে অদৃশ্য হয়ে গেল!
আশেপাশের বাসা থেকে মানুষজন এগিয়ে আসে, এদের মাঝে শামসুদ্দিনও আছে। ঝর্ণা শামসুদ্দিনকে বলল, “চাচা, এই যে আপনার ছাগল!”
“আমার ছাগল! এইটা?”
“জি। এইটারে কালা রং করছে! রং কাঁচা, হাত দিলে রং উঠে আসছে। এই দেখেন”-বলে ঝর্ণা ছাগলের গায়ে হাত বুলিয়ে দেখাল রং উঠে আসছে।
টুনি ততক্ষণে মানুষটার ঝোলাটার ভিতরে উঁকি দিয়েছে, সত্যি সত্যি তার ভেতরে জুতার কালি, কালি দেওয়ার ব্রাশ, কিছু ময়লা কাপড় এবং একটা টাকার বান্ডিল পাওয়া গেল।
দেখতে দেখতে মানুষের ভিড় হয়ে গেল এবং কীভাবে ছাগল-চোর ধরা হয়েছে গল্পটা ডালপালা নিয়ে ছড়াতে শুরু করল। ঝর্ণাকে ঘটনাটা বর্ণনা করতে হচ্ছে এবং টুনি লক্ষ করল প্রত্যেকবারই ঘটনাটার মাঝে আরেকটু রং লাগানো হচ্ছে! চোরের সাথে হাতাহাতির একটা অংশ কীভাবে জানি ঢুকে গেল। চোরের চেহারার বর্ণনাটা রীতিমতো রোমহর্ষক।
টুনি ঝর্ণাকে ফিসফিস করে মনে করিয়ে দিল যে তাদের ঢাকা ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে, এখন তাদের বাড়ি যাওয়া দরকার।
.
বিকেলের দিকে টুনি ছোটাচ্চু আর ফারিহাপুর সাথে ঢাকা রওনা দিল। আগের রাত ফারিহাপু ঘুমায়নি, তাই সে দুপুরবেলা কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিয়েছে। ঝুমু খালা থেকে গেল। অনেক দিন তার বাড়িতে আসা হয়নি, এসেছে যখন কিছুদিন থেকে যাবে!
গাড়ি ছাড়ার পর ছোটাচ্চু বলল, “ফারিহা, আমি তোমার সাথে টানা কথাবার্তা বলে যাব, যেন তোমার ঘুম না পায়।”
ফারিহাপু মুখ টিপে হেসে বলল, “ঠিক আছে।”
ছোটাচ্চু টানা কথাবার্তা বলতে বলতে কিছুক্ষণের মাঝেই শিশুর মতো ঘুমিয়ে গেল। টুনি ছোটাচ্চুকে জাগিয়ে দিতে চাইছিল; ফারিহাপু বলল, “থাক, তুলে কাজ নেই। বেচারাকে ঘুমাতে দাও-তার চাইতে চললা তুমি আর আমি গল্প করি!”
টুনি হাসি হাসি মুখে বলল, “ঠিক আছে ফারিহাপু, কী নিয়ে গল্প করব?” “তোমার যেটা ইচ্ছা।”
টুনি কী যেন একটা চিন্তা করল, তারপর বলল, “ফারিহাপু, তুমি বলতে পারবে ছেলেদের যে ওয়াই ক্রোমোজম থাকে সেটার সাইজ এত ছোট কেন? এত ছোট একটা ক্রোমোজোম নিয়ে তারা থাকে, সে জন্যে তারা কি মেয়েদের সামনে লজ্জা পায় না?”
ফারিহাপু হেসে ফেলল, বলল, “সেটা তো জানি না। তোমার ছোটাচ্চু ঘুম থেকে উঠুক, তখন জিজ্ঞেস করতে হবে।”
তারপর দুজনেই ছোটাচ্চুর ঘুম থেকে ওঠার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে!