ঝুমুর
গাঁথিব ফুলেরই মালা, যতনে সাজাব কালা,
আমি ঘুচাইব মনের জ্বালা, দুঃখ যাবে দূরে৷
(১)
হোটেলের একতলায় ডাইনিংরুমে বসে ডিনার করছিল ইন্দ্র৷ গুনগুন আওয়াজ ভরিয়ে দিয়েছে হোটেল লবিটাকে৷ আশপাশের চেয়ারগুলোও প্রায় ভর্তি হয়ে গেছে৷ তাদের মধ্যে জনা পাঁচেক ঘুরতে-আসা ট্যুরিস্ট৷ বাকি অর্ধেক শুটিং-পার্টি৷
দইয়ের বাটিটা হাতে তুলে নিয়ে তাতে চামচ ডুবিয়ে দেয় ইন্দ্র৷ চারপাশটা একবার চোখ তুলে দেখে নেয়৷ একদিকের গদি-আঁটা চেয়ারে বসে আছেন মিস লাবনী৷ তার দু-পাশে দাঁড়িয়ে ম্যানেজার রূপায়ণ ধর আর প্রোডিউসার দেবজ্যোতিবাবু৷ মহিলার চেহারা বেশ গোলগাল৷ ধবধবে ফর্সা চামড়া, যার বেশিরভাগটাই এখন অনাবৃত৷ ক্যাটকেটে পোশাক গায়ে৷ গলায় আর হাতে শান্তিনিকেতনি কাজের কাঠের অলংকার৷ লিপস্টিক বাঁচিয়ে সাবধানে চামচ মুখে তুলছেন৷ এই হোটেলে এসি নেই৷ ফলে মাঝে মাঝেই মুখে আর গলায় ঘামের বিন্দু ফুটে উঠছে৷ বাঁহাতে ধরা রুমাল দিয়ে দ্রুত সেগুলো মুছে ফেলছেন৷
চোখ সরিয়ে নিল ইন্দ্র৷ এসি নয়, এই দু-দিন সব থেকে বেশি যে জিনিসটা সে মিস করছে তা হল মোবাইল ফোন৷ এখানে এসে থেকে একবারও সেটা অন করেনি৷ তার অবশ্য একটা কারণ আছে৷ তবে খাওয়ার সময় সব থেকে বেশি দরকার পড়ে জিনিসটা৷ ইন্দ্রর অনেক দিনের অভ্যাস৷ মোবাইলে ইউটিউব খুলে কিছু একটা চালিয়ে সেটা দেখতে দেখতে খায়৷ একসময় টিভি দেখতে দেখতে খাওয়ার শখ ছিল, ইদানীং আউটে শ্যুট এত বেশি হচ্ছে যে ইউটিউবই ভরসা৷
আবার মিস লাবণির দিকে চোখ পড়ে তার৷ মহিলার বয়স চল্লিশের খানিক উপরে হলেও কিছু একটা আছে তাঁর হাবভাবে৷ নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবারই চোখ চলে যায় অজান্তে৷ খাওয়া শেষ করে সিগারেটের প্যাকেট খুলে একটা সিগারেট ধরাচ্ছেন তিনি৷ হঠাৎ ইন্দ্রর চোখে চোখ পড়ে তাঁর৷ ইন্দ্র চোখ নামিয়ে নেয়৷
ব্যাপারটা লজ্জাজনক৷ সে সামান্য একজন ফটোগ্রাফার৷ শ্যুট থাকলে এইসব সখীমার্কা রমণীদের উপর-নীচ আগে-পিছে তাগ করে ছবি তোলাই তার কাজ, কিন্তু ক্যামেরা হাতে থাকলেই একমাত্র সে ছাড়পত্র মেলে৷ অন্যসময়ে হ্যাংলার মতো তাকিয়ে থাকা৷
ইন্দ্রর কান লাল হয়ে ওঠে৷ টেবিল থেকে উঠে পড়তে যাচ্ছিল সে, এমন সময় একটা মিহি গলা থামিয়ে দেয় তাকে, ‘ও হ্যালো৷ লিসন৷’
মিস লাবণি ডেকেছেন ওকে৷ তবে কাছে ডাকেননি৷ ইন্দ্র দেখল মহিলা নিজেই চেয়ার থেকে উঠে এগিয়ে এসেছেন ওর টেবিলের কাছে৷ সে মাথা নীচু করে উঠে দাঁড়াল৷
‘এই যে তুমি, তোমাকে আমি আগে কোথায় দেখেছি বলো তো?’ একটা টাওয়েলে হাত মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করলেন মিস লাবণি৷ নিজেকে একটু সামলে নিয়ে মুখ তোলে ইন্দ্র, ‘আপনার আগে একটা শ্যুট ছিল পুরুলিয়ার৷ ওখানেও আমি ক্যামেরা করেছিলাম৷’
একটু চিন্তিত দেখায় লাবণিকে, ‘ওঃ, ইয়েস৷ আমার মাথাটা আজকাল এমন প্যাকড হয়ে আছে, সেই যদুদার প্রোডাকশন ছিল৷ নাইস টু সি ইয়ু এগেইন৷’
ইন্দ্র হাসে৷ উঠে দাঁড়ানো উচিত কি না বুঝতে পারে না৷ মিস লাবণি পেশাগত যোগ্যতা আর বয়স, দুটোতেই ওর থেকে বড়ো৷ মহিলা ফিরেই যাচ্ছিলেন, হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ইফ ইয়ু ডোন্ট মাইন্ড, আমার একটা কাজ করে দেবে?’
‘হ্যাঁ, বলুন-না৷’
‘আমার রুমে এটাচড একটা ব্যালকনি আছে৷ ওখান থেকে ভিউ আসছে খুব সুন্দর, যদি আমার কয়েকটা ছবি…’
‘নিশ্চয়ই৷ চলুন-না৷ আমি ক্যামেরাটা নিয়ে আসছি৷’
টেবিল ছেড়ে উঠে পড়ে ইন্দ্র৷ দইটা শেষ হয়নি এখনও৷ খেতে ভালোই লাগছিল, কিন্তু এখন আর উপায় নেই৷ ইন্দ্র জানে একবার খেপে গেলে তাকে এই প্রোজেক্ট থেকে বাদ দেওয়ারও ক্ষমতা রাখেন মহিলা৷
দ্রুত রুমে ঢুকে ক্যামেরাটা নিয়ে আসে ইন্দ্র৷ লেন্সটা পরিষ্কার করে গুঁজে নেয়৷ তবে সকাল হয়েছে৷ ঝাঁ ঝাঁ রোদ পড়ে আছে বাইরে৷ বারান্দায় ছবি তুললে ফ্ল্যাশ লাগবে না৷
বেল বাজাতে দরজা খুলে দেন মিস লাবণি৷ একটু আগের পোশাকটাই পরে আছেন তিনি, কেবল বাঁধা চুলের ঝাঁক খুলে দিয়েছেন৷ ইন্দ্রর দিকে চেয়ে একগাল হাসলেন তিনি, ‘এসো ভাই৷ শ্যুট ইয়োরসেলফ৷’ ঘরে ঢুকে বারান্দার দিকে এগোচ্ছিল ইন্দ্র৷ মিস লাবণি তার পিছু নিতে নিতে বলেন, ‘যদি কিছু মনে না করো, একটা কথা জিজ্ঞেস করি?’
‘হ্যাঁ করুন-না৷’
‘আগেরবার যতদূর মনে পড়ছে তুমি পুরো শ্যুটটায় থাকোনি৷ আগেই চলে গিয়েছিলে কী একটা কারণে…’
মিহি হাসে ইন্দ্র, ‘একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল৷’
‘কার?’
বড়ো করে একটা নিঃশ্বাস নেয় ইন্দ্র, ‘আমার তখন এক বান্ধবী ছিল৷ কালীপুজোয় মদ-টদ খেয়ে বন্ধুদের সঙ্গে নাচতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিল ছাদ থেকে৷’
‘ওহ আই সি, ওই জন্যেই মনে পড়ছিল৷ মানে গার্লফ্রেন্ডের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে বলে শ্যুট ফেলে যাওয়া৷ তা কেটে গেল কী করে?’
এতক্ষণে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে দু-জনে৷
লেন্সের ক্যাপ খুলতে খুলতে ইন্দ্র বলল, ‘অ্যাকচুয়ালি আমার সঙ্গে রিলেশনটা সেভাবে ছিল না কোনওদিন৷ ওই একটা আলগা প্রেম-প্রেম ব্যাপার৷ আসলে আমিই একটু ছন্নছাড়া টাইপ৷ বিপদে-আপদে পাশে থাকতাম৷ সুখের দিন এলে ভেগে যেতাম৷ ওরও একটা ভালোলাগা ছিল আমার উপর৷ ব্যস৷’
‘তোমার ভালোলাগা ছিল না?’
ইন্দ্র কাঁধ ঝাঁকায়, ‘জানি না৷ শি অলরেডি হ্যাড আ বয়ফ্রেন্ড৷ আর আমার ওই ছুঁকছুঁকানি ভালো লাগে না৷’
মিস লাবণি বারান্দার একদিকের রেলিং ধরে দাঁড়ান৷ দূরে একটা সাঁওতাল বস্তি দেখা যাচ্ছে৷ তার লাগোয়া একটা ঝিল৷ হোটেলের চৌহদ্দি পেরিয়ে খানিকটা জঙ্গল আর ঝোপঝাড় যেন স্নান করতে গিয়েছে সেই ঝিলে৷
‘ওই ওয়াটারবডিটা পিছনে রেখো, বুঝলে? রেডি?’
ক্যামেরাটা সামনে ধরে লাইভ-ভিউটা দেখে নেয় ইন্দ্র৷ তারপর চোখের সামনে ধরে, ‘ফুল এক্সপোজার আছে৷ ফ্যান্টাস্টিক!’
‘তা সেই বয়ফ্রেন্ডটার এখন কী হাল?’
‘কার বয়ফ্রেন্ড?’
‘তোমার সেই গার্লফ্রেন্ডের৷’
‘ওহঃ,’ ফোকাসটা ঠিক করতে থাকে ইন্দ্র, ‘দে আর গেটিং ম্যারেড৷’
‘সে কী! কবে?’
‘কাল৷’
ছোটো একটা শব্দ করে ছবি তোলে ক্যামেরাটা৷ এতক্ষণে ঠোঁটের কোণে মিহি একটা হাসি মেখে দাঁড়িয়ে ছিলেন মিস লাবণি৷ আওয়াজটা হয়ে যেতেই তিনি সোজা হয়ে দাঁড়ালেন, ‘এই দাঁড়াও, দাঁড়াও৷ ছবি পরে তুলবে, আজ তুমি এখানে কী করছ?’
‘মানে?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে ইন্দ্র৷
‘মানে তোমার এত কাছের বান্ধবীর বিয়ে কাল, আর আজ তুমি এইসব আল-বাল মিউজিক ভিডিও শ্যুট করছ!’
‘আমাকে ইনভাইট করেছিল, যাব না বলে দিয়েছি৷ পরশু থেকে ফোন করে চলেছে৷ ওই জন্যেই ফোনটা সুইচড অফ৷’ রেলিং ছেড়ে ইন্দ্রর দিকে সরে আসেন মিস লাবণি, ‘ইউ লাভড হার, তাই না?’
এইমাত্র তোলা ছবিটা দেখতে থাকে ইন্দ্র, ‘যদি বেসেও থাকি সেটা আর সতেরো ঘণ্টা ভ্যালিড৷ এই সময়টুকু কাটিয়ে দিতে পারলে তারপর আর কিচ্ছু যাবে-আসবে না৷’
মিস লাবণি আবার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন৷ তার আগেই বারান্দার বাইরে কিছুর দিকে চোখ গেছে তার৷ অনেকগুলো কুরমালি-সাঁওতাল মেয়ে এসে জড়ো হয়েছে সেখানে৷ এরা সবাই ব্যাকআপ ডান্সার৷ মিস লাবণির মিউজিক ভিডিও শ্যুটের জন্য গ্রাম থেকেই ভাড়া করা হয়েছে এদের৷ আবলুশ কাঠের মতো গায়ের সং সবার৷ গায়ে হলদে শাড়ি, চ্যাপ্টা নাক, খোঁপায় কী একটা ফুল গাঁথা আছে৷
নাচের মহড়া চলছে, স্পিকারে গান বাজছে, ঝুমুর গান— ‘গাঁথিব ফুলেরই মালা, যতনে সাজাব কালা, আমি ঘুচাইব মনের জ্বালা, দুঃখ যাবে দূরে৷’
ইন্দ্র চেয়ে দেখে মিস লাবণির ঠোঁট নড়ছে৷ স্পিকারে যে গানটা বাজছে সেটাও তাঁরই গাওয়া৷ একটু আগের প্রসঙ্গটা যেন ভুলেই গেছেন তিনি৷ ইন্দ্রর দিকে না তাকিয়েই বললেন, ‘এই এরা যে হাত ধরাধরি করে নাচছে, এটাকে কী বলে জানো?’
‘কী?’
‘দাঁড়শালিয়া, একরকম ঝুমুর গান৷ আরও অনেকরকম ঝুমুর হয়৷ বাউলছোঁয়া, কীর্তনছোঁয়া, খেমটি, আড়হাইয়া, সেগুলো আবার…’ থেমে গিয়ে মিষ্টি করে হাসেন তিনি,‘তুমি বোর হচ্ছো, তাই না?’
‘এ-বাবা বোর হব কেন? আমার ভালোই লাগে শুনতে৷’
‘ধুর, আমিও যেমন খ্যাপা৷ কাল তোমার বান্ধবীর বিয়ে আর আমি তোমাকে ঝুমুর শেখাচ্ছি৷ আচ্ছা হোয়াই ডন্ট ইউ টক উইথ হার?’
‘কী বলব বলুন?’
একটু ভাবলেন মিস লাবণি, ‘আচ্ছা ধরো বললে, থাক থাক প্রাণবল্লভ বাঁধা প্রেম-ডোরে/ হৃদয়-মন্দিরে রাধিকে রাখিব আদরে৷’
হেসে ফেলে ইন্দ্র, ‘ধুর, এসব বললে আজকালকার মামনিরা বাংলা অনার্স বলে গালাগাল দিয়ে চলে যায়৷’
‘আরে রাখো তোমার মামনি৷ স্বয়ং শ্রী রাধিকা এসব শুনে গলে যেতেন আর এরা তো কালকের ছুঁড়ি৷ তা চুমু-টুমু খেয়েছিলে?’
গোল-গোল চোখে তাকায় ইন্দ্র, ‘বললাম যে বান্ধবী ছিল, চুমু খেতে যাব কেন?’ ব্যঙ্গের হাসি হাসেন লাবণি, ‘শুধু ডিওপি হয়ে রয়ে গেলে হবে? একবার শো-বিজে ঢুকে দেখো, মিউজিক ডিরেক্টর থেকে শুরু করে স্পট-বয় অবধি সবার সঙ্গে কেমন চকাচক চুমু খাওয়া যায়৷ তা মেয়েটা তোমাকে রিজেক্ট করেছিল নাকি?’
ইন্দ্র বুঝতে পারে লাবণি পছন্দের টপিক ছেড়ে সহজে বেরোতে চাইছেন না৷ সে ক্যামেরাটা আবার চোখের সামনে ধরে নীচে নৃত্যরত সাঁওতাল মেয়েগুলোর মাঝে সাবজেক্ট খোঁজে, ‘বলার কী আছে, ও একটা স্টেবল রিলেশনে ছিল৷ খামোখা এসব বলে আবার ব্যাগড়া দিতে যাব কেন?’
‘খালি মদ খেয়ে পড়ে পা ভাঙলে ছুটে যেতে?’
‘একটু মাতাল টাইপের ছিল, কী করব, আমি আগেরবার আসতেই চাইছিলাম না, ওই জোর করে পাঠাল৷’
ঠোঁট ওলটান মিস লাবণি, ‘আমার শালা শুনে হিংসা হচ্ছে, বুঝলে? একদিকে কমিটেড বয়ফ্রেন্ড অন্যদিকে প্লেটোনিক বেস্টফ্রেন্ড, আর আমাদেরই দিন নেই, রাত নেই প্রোডিউসারের বিছানা গরম করতে হয়৷’ চাপা অস্বস্তি হয় ইন্দ্রর৷ মিস লাবণির ট্র্যাক রেকর্ড ভালো নয়৷ রেলিং-এ হাত রেখে ঝুঁকে দাঁড়িয়েছেন৷ শরীরের অনেকটা অংশ দুপুরের ঝকঝকে রোদ উন্মুক্ত করে রেখেছে৷ মহিলার গানের গলাটা সত্যি মন কেমন করানোর মতো৷ বিশেষ করে লোকগান গেয়েই নাম তাঁর৷ তবে আজকাল গানের সিডি আর ক-টা লোকেই বা কেনে৷ গান গেয়ে নাম করতে হলে অনলাইন প্ল্যাটফর্মই ভরসা৷ মহিলা বছর দশেক হল সেটাই অবলম্বন করে আসছেন৷ তবে ফোক গেয়ে আজকাল লোক-টানা দায় হয়েছে৷ ফলে, সেই গানের ভিডিয়োগ্রাফিতে গ্রাম্য মেয়ে দেখানোর অছিলায় কিছু শহুরে মেকআপ সম্বলিত ও অর্ধনগ্ন মহিলা দেখিয়ে আমজনতার মনোরঞ্জন করা ছাড়া গতি নেই৷ এই সহজ সত্যিটা আগেভাগেই বুঝেছিলেন মিস লাবণি৷
যৌবন থাকতে থাকতে নিজের গানের ভিডিয়োগ্রাফিতে নিজেই নেমে পড়েন৷ অল্প বয়সে দেখতে শুনতে খারাপ ছিল না৷ খানিকটা নাম হয়৷ বছরখানেক পরে কোনও এক সহগায়কের সঙ্গে কীসব স্ক্যান্ডেলে জড়িয়ে পড়েন৷ তার ফলেই আর একটু ভাইরাল হয় তাঁর ভিডিয়ো৷ এরপর থেকেই মহিলার খ্যাতি আকাশছোঁয়া৷
ইচ্ছা করেই একটু পিছিয়ে এসে আবার ক্যামেরা তাগ করে ইন্দ্র৷ মিস লাবণি একটু পিছিয়ে গিয়ে কোমর বাঁকিয়ে দাঁড়ান৷
‘সতেরো ঘণ্টা বাকি আছে যখন একবার বলে দেখতে পারতে৷’ মুখ প্রায় বন্ধ করেই বলেন তিনি৷
‘আচ্ছা সে হবে খন৷ আপনি একটু ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে দাঁড়ান তো!’
খচখচ করে গোটা তিনেক ছবি তোলে ইন্দ্র৷ তারপর এগিয়ে গিয়ে মিস লাবণিকে দেখায় সেগুলো৷ মহিলা ক্যামেরাটা হাতে নেন৷ তারপর নিজের ছবিগুলো দেখতে দেখতে হঠাৎ করেই ব্যাক-বাটন টিপে পিছিয়ে আসেন৷ মাসখানেক আগে তোলা কয়েকটা ছবি ভেসে ওঠে স্ক্রিনে, একটা মেয়ের ছবি৷ বই হাতে দিয়ে ছাদের পাঁচিল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে সে৷ মেয়েটাকে ভালো করে লক্ষ করেন মিস লাবণি, ‘নাম কী?’
‘দীপাবলি৷’
‘বাঃ, সুন্দর নাম৷ মিষ্টি দেখতে৷’
পরপর অনেকগুলো ছবি দেখতে থাকেন মিস লাবণি৷ মেয়েটার একার ছবি ভর্তি হয়ে আছে মেমোরি-কার্ড জুড়ে৷ কখনও হাতের ফাঁকে মুখ ঢাকা দিয়ে হাসছে সে, কখনও লালপাড় সাদা শাড়ি জড়িয়ে টিপ পরছে কপালে, আবার কখনও উসকো-খুসকো চুলে একটা ময়লা টিশার্ট জড়িয়ে দাঁত মাজছে৷
‘সবগুলো তোমার তোলা?’
‘হ্যাঁ, ও আমাকে বাড়ি ডেকে নিয়ে যেত ছবি তুলতে৷’
‘সতেরো ঘণ্টা পরে ডিলিট করে দেবে এগুলো?’
উত্তর দিতে কয়েক সেকেন্ড সময় নেয় ইন্দ্র, তারপর বলে, ‘না৷ ওগুলো ছাড়া আর কিছু নেই আমার কাছে৷’
ক্যামেরাটা ফেরত দিতে দিতে বলেন তিনি, ‘জাস্ট আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে পারবে না বলে এমন একটা জিনিস হারাতে চলেছ যেটা সারাজীবন আর কোথাও পাবে না৷ বড্ড বোকা ছেলে তো তুমি৷’
ইন্দ্র আর কিছু বলে না৷ ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে লেন্সের ঢাকাটা লাগাতে থাকে৷
মিস লাবণি ঘরের দিকে এগোতে এগোতে বলেন, ‘আচ্ছা বেশ, আমি তোমার ক্ষততে একটু মলম লাগাতে পারি৷ আজ সন্ধেয় একটু টাইম হবে তোমার?’
‘কাল তো শ্যুট, আজ সন্ধেয় কাজ নেই৷’
‘ব্যস, শ্যুটিং ইউনিটের কয়েকজনকে নিয়ে একটা জায়গায় যাচ্ছি৷ তুমিও চলো তাহলে৷’
‘কোথায়?’
ইন্দ্রর থুতনি ছুঁয়ে চুমু খাওয়ার মতো ভঙ্গি করেন মিস লাবণি, ‘দ্যাট মাই ডিয়ার ইজ আ সারপ্রাইজ৷’
(২)
গাড়ি থেকে নামতে নামতেই আওয়াজটা শুনতে পেয়েছিল ইন্দ্র৷ এখন খানিকটা এগিয়ে যেতেই সুরটা কানে এল৷ মাদল বাজছে৷
একটা ফাঁকা মাঠের মাঝখানে ঝুমুরের আসর বসেছে৷ কয়েকটা বুড়ো লোক ডুগডুগি ঢোল আর মাদল জাতীয় কিছু যন্ত্র নিয়ে আগুন করে বাজিয়ে চলেছে একমনে৷ তাদের থেকে কয়েক গজ দূরে কিছু সাঁওতাল মেয়ে কোমর বেঁধে দুলে দুলে নাচছে৷
‘পিদাঁড়ে পলাশের বন, পালাবো পালাবো মন’
এই গোটা জায়গাটাকে ঘিরে জড়ো হয়েছে ট্যুরিস্টের দল৷ পুরুলিয়ার এই জায়গাটায় সারি-গানের চল আছে বেশ৷
গাড়ি থেকে নেমে মাঠের মধ্যেই একটা মোটামুটি ফাঁকা জায়গা খুঁজে নেয় ইন্দ্র৷ এখনও অন করেনি ফোনটা৷ সেটা পকেট থেকে বের করে একবার চোখ বুলিয়ে নেয় বন্ধ স্ক্রিনের উপরে৷ পাওয়ার-বাটনের উপর হাত রেখেও সরিয়ে নেয়৷ কাল রাতের আগে কিছুতেই অন করবে না ফোনটা৷ নিজের দুর্বলতাকে কিছুতেই সুযোগ করে নিতে দেবে না৷
‘এই নাও, এটা তোমার জন্য৷’ চেনা গলা পেয়ে মুখ তুলে ইন্দ্র দেখে মিস লাবণি এসে দাঁড়িয়েছেন ওর পেছনে, হাতে একটা মাটির গ্লাস জাতীয় কিছু৷ মহুয়া৷
ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে গ্লাসটা হাতে নেয় ইন্দ্র, মিস লাবণি তার কাঁধে একটা হাত রেখে বলেন, ‘তুই ব্যাটা আজ দেবদাস হলে আমি চুনিবাবু৷ আর এই হল আমাদের পাইট, ভালো কথা তুমি নাচতে পারো?’
‘নাচতে!’ আঁতকে ওঠে ইন্দ্র, ‘একদম না৷’
‘আরে ও জিনিস পেটে পড়লে শুধু নাচতে কেন উড়তেও পারবে৷ মাথাটা একটু ঝিমঝিম করবে, ঘুম পাবে৷ এদিকে নাচতে ইচ্ছা করবে, এ ভারী চমৎকার জিনিস৷’ মহুয়ায় একটা চুমুক দেন মিস লাবণি, মন দিয়ে গানটা শুনতে থাকেন,
‘হেই, ন্যাংটা ইন্দুরে ঢোল কাটে
হে কাটে রে, বতরে পিরিতের ফুল ফুটে’
‘ভালো কথা, এই যে বলছে, ‘বতরে পিরিতের ফুল’, ‘বতর’ মানে জানো?’
গুছিয়ে বসেন মিস লাবণি, ‘আমাদের সব কাজের একটা উপযুক্ত সময় আছে, বুঝলে? সেই সময় না আসলে ফুল ফোটে না, আবার সেই সময়টা চলে গেলেও দেরি হয়ে যায়৷ বতর মানে হল সেই উপযুক্ত সময়, আর তুমি তোমার বতরটাকে জাস্ট হেলায় হারাচ্ছ৷’
‘তো কী করব?’
‘কী করব!’ ভেংচি কাটেন মিস লাবণি, ‘আরে বাল, একটা ঘোড়া ভাড়া করবে, সাদা ঘোড়া৷ তারপর তার পিঠে চেপে বিয়ের আসরে গিয়ে ওর সামনে গিয়ে বলবে দ্যাট ইউ লাভ হার, ওই একটা মানুষের সঙ্গে থেকে রেস্ট অফ দ্য লাইফ হাসিমুখে হেজিয়ে ফেলতে চাও৷’
‘বটে? আর ওর বয়ফ্রেন্ডের কী হবে? সে ভালোবাসে না আপনি কী করে জানলেন?’
‘শোনো ভাইটি৷’ ইন্দ্রর পিঠে চাপড় মারে মিস লাবণি, ‘এই মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি আমাকে একটা জিনিস শিখিয়েছে৷ শুধু ভালো গান গাইলেই হবে না, তার সঙ্গে মার্কেটিংটাও জানা চাই৷ তেমনই একটা মেয়েকে শুধু ভালোবাসলেই সে ভালোবাসা সংসার অবধি গড়ায় না, সেখানেও একটু মার্কেটিং দরকার৷ এক বছর আগে আমার কাছ থেকে মার্কেটিংটা শিখে নিলে আজ এরকম নেংটি ইঁদুরে তোমার ঢোল কাটত না৷’
ইন্দ্র হেসে ফেলে, ‘আচ্ছা, আপনাকে উপর থেকে যতটা মেকআপ সর্বস্ব মনে হয় আপনি ততটা নন৷’
বড়ো করে নিঃশ্বাস ফেলেন মিস লাবণি, ‘আমার খালি মার্কেটিংটাই রয়ে গিয়েছে৷ ভালোবাসাটা কবে যেন হারিয়ে গিয়েছে৷’
মহুয়ার গ্লাসে চুমুক দেয় ইন্দ্র৷ ঝাঁঝালো জিনিস৷ তবে এই পরিবেশে খারাপ লাগে না৷ সামনে মেয়ের দল গানের ছন্দে নেচে চলেছে৷ মিস লাবণি বলেছিলেন ঝুমুর নানারকমের হয়৷ কখনও কৃষ্ণ রাধার প্রেম নিয়ে, কখনও দেহতত্ত্ব, কখনও রসিকতা৷ তবে এখন যে গানটা এরা গাইছে, সেটা স্থানীয় উপভাষা৷
ওরা দু-জনে মাঠের ঘাসের উপরেই বসে পড়ে৷ ইন্দ্র হাতের গ্লাসটা তুলে লোকগুলোকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা এই গানটার মানে কী বলুন তো?’
‘কী জানি, কুঁদমালি ভাষায় গাইছে৷ আমি ও ভাষা জানি না৷’ মিস লাবণি একটা বড়োসড়ো চুমুক দেন গ্লাসে৷ ‘তাহলে শুনছেন যে!’
একহাতে ধরে নিজের চুলগুলো পিছনে ঠেলে দেন লাবণি, ‘কারণ ভালো লাগছে৷ এই তোমার সঙ্গে গল্প করতে ভালো লাগছে এখন, কেন করছি বলো তো, তুমি আমার বয়ফ্রেন্ড না, হাজবেন্ড না, এমনকি বন্ধুও না৷ তা-ও ভালো তো লাগছে, ঝুমুর ইজ অল অ্যাবাউট দ্যাট৷ ঠিক যেটুকু ভালো লাগছে, একেবারে মনের ভিতর থেকে ইচ্ছা হচ্ছে সেটা চোখ বন্ধ করে করে যাও৷’
‘বলছেন?’
‘আলবাত বলছি৷ যে সাঁওতালরা এইসব গান তৈরি করেছিল, তারা শালা কিছুর পরোয়া করত না৷ প্রেম, বিয়ে, সংসার, যেদিন ইচ্ছা হত হারামজাদারা সব ছেড়ে বেরিয়ে যেত৷ আর…’
‘আর কী?’
‘শালাদের ফেরার ইচ্ছা হলে কী করত বলতো!’
‘ফিরে আসত হয়তো৷ এই তো বললেন যা ইচ্ছা হয় করত৷’
সজোরে মাথা নাড়েন মিস লাবণি, ‘না হে, ততদিনে বউ অন্য কারও সঙ্গে ঘর বেঁধেছে, ছেলেমেয়ে অন্য কাউকে বাবা বলছে৷ কোথাও থেকে ছেড়ে যাওয়া যত সোজা, ফিরে আসা কি ততটাই?’
ঝিমেঝিমে হাওয়ার তেজ এখন বেড়েছে, মিস লাবণির চুল মাঝে-মাঝে উড়ে আসছে ইন্দ্রর মুখের উপরে, সে চুলগুলো সরাতে সরাতে বলে, ‘আচ্ছা, এই ধরুন একটা মানুষকে না পেয়ে তাকে দূর থেকে ভালোবেসে যাওয়া, আপনার মনে হয় না এতে এক রকমের সুখ আছে?’
‘আছে হয়তো৷ কিন্তু কী জানো ভাই, জীবন মানুষকে দু-বার সুযোগ দেয় না৷ একবার থেকে সংসার ধর্ম করে, একবার না থেকে বিরহে কবিতা লিখে লিখে জীবন কাটানোর অভিজ্ঞতা ট্যালি করার অপশন দেয় না৷ তাই, থেকে যাওয়াই ভালো৷ নইলে কী হবে জানো তো?’
ঘাড় নাড়ে ইন্দ্র, ‘জানি৷ সারাজীবন মনে পড়বে ওর কথা৷ জীবনে বড়ো কোনও দুঃখ পেলে বারবার ওর নম্বরটা ডায়াল করতে ইচ্ছা করবে, ওর ঘুমন্ত মুখটা দেখতে পাব না, তরকারিতে নুন বেশি হওয়া নিয়ে ঝগড়া করতে পারব না, স্নানের আগে গামছা খুঁজে দেবে না, ঘরময় ওর নূপুরের ঝিনঝিন আওয়াজ শোনা যাবে না…’
ইন্দ্রর আরও কাছে সরে আসেন মিস লাবণি, ‘তাহলেই ভেবে দ্যাখো, দিস ইজ ইয়োর বতর, ম্যান৷’
হঠাৎ মুখটা মুছে নিয়ে মহিলার দিকে ফিরে বসে ইন্দ্র, ‘আচ্ছা আমাকে তো জ্ঞান দিয়ে চলেছেন, আপনি নিজে কী করছেন?’
‘আমি কী করলাম?’
‘আপনার ইচ্ছা করে না এই ফালতু মার্কেটিং ছেড়ে, দেহ প্রদর্শন ছেড়ে জাস্ট গান নিয়ে থাকতে, যেটাকে ভালোবেসেছিলেন?’
অবাক চোখে ইন্দ্রর দিকে চেয়ে থাকেন মিস লাবণি, ‘করে তো, কিন্তু এসব ছেড়ে দিলে পেট চলবে আমার? আর এই যে ফেম, একটা আধদামড়া মহিলার দিকে কচি কচি ছেলেদের হাঁ করে তাকিয়ে থাকা, এটা কোথায় পাব? আমি তো কুরমালি সাঁওতাল নই৷ এই তুমি আমার আসল নাম জানো?’
‘না তো!’
‘লাবণ্য অধিকারী৷ আমার বাবা দিয়েছিল৷ ‘‘শেষের কবিতা’’ থেকে৷’ পাশে ঘাসের উপরে গ্লাসটা নামিয়ে রাখলেন মিস লাবণি, ‘শালা আমার ভালো নামটা ভুলে গিয়েছে লোকে, এদিকে কাপ সাইজ জিজ্ঞেস করো, ঠিক বলে দেবে৷’
ইন্দ্রর মনে হয় ধীরে ধীরে নেশাটা চড়ছে মিস লাবণির, ‘তুমি একটা গান্ডু বুঝলে, উঁচু লেভেলের গান্ডু৷’
ইন্দ্র আর উত্তর দেয় না৷ লাবণি নিজেই বলতে থাকেন, ‘নিজের হাতে নিজের লাইফটাকে ভোগে পাঠিয়ে দিচ্ছ৷’
ইন্দ্রর বিরক্ত লাগে, মহিলা আশ্চর্যরকম গায়ে পড়া৷ তার নিজের মন ভালো নেই তার উপর ইনি ওই প্রসঙ্গ ছেড়ে নড়তেই চাইছেন না৷
‘আপনার কি মনে হয় আমি দীপাবলিকে সব বললেই ও বিয়ে ভেঙে দেবে? ড্যাং ড্যাং করে আমাকে বিয়ে করে ফেলবে? ও ওর বয়ফ্রেন্ডকে যথেষ্ট ভালোবাসে, এটা আমার থেকে ভালো কেউ জানে না৷’
‘আরে রাখো তো ভাই ওসব বালের বয়ফ্রেন্ড৷ দেখো গিয়ে ইউটিউবে মিস লাবণি হট ভিডিয়ো সাবস্ক্রাইব করে রেখেছে৷’
‘রাখলেই বা আমার কী? ওর একটা নিজস্ব ওপিনিয়ন আছে৷’ ইন্দ্রর পিঠে চাপড় মারেন মিস লাবণি, ‘আজব মাকড়া তো তুমি, আমি কি ওকে তুলে আনতে বলেছি? বলছি জাস্ট গিয়ে মালটাকে বলো যে তুমি ওকে ভালোবাসো, ওকে ছাড়া বাঁচবে না৷’
হাতটা সরিয়ে দেয় ইন্দ্র, মিস লাবণির গলা নকল করে, ‘ভালোবাসো, ওকে ছাড়া বাঁচবে না৷ যত্তসব৷’
ইন্দ্রর নেশাও বেড়ে উঠেছে৷ মাঠের মাঝে নেচে চলা মেয়েগুলো মাঝে মাঝে কালো আকাশ আর আগুনের চাদরে হারিয়ে যাচ্ছে৷ সে স্তব্ধ হয়ে ঠায় তাকিয়ে থাকে সেইদিকে৷
‘এই, চলো তো৷’
‘কোথায়?’
‘আমার ভীষণ গান গাইতে ইচ্ছা করছে, ওদের মতো৷’
‘আপনি যান৷’
‘উঁহুঁ, একা যাব না, তুমিও চলো৷ যেতেই হবে৷’
সজোরে টান দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নেয় ইন্দ্র৷ মিস লাবণি নাছোড়বান্দা হয়ে ওঠেন আরও৷ দু-জনেই নেশার ঘোরে হারিয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে৷ দিমদিম মাদলের সুর ওদের চেতনাকে অন্য কোনও জগতে বয়ে নিয়ে গেছে৷
‘ওরে আলতা সিন্দুরে রাঙা, বিহা ছেড়ে করবো সাঙা…’
‘ছাড়ুন আমার হাত৷ আমি কোথাও যাব না, কিছু ভালো লাগছে না আমার৷’
‘কেন যাবে না শালা, মিস লাবণিকে চেনো তুমি? তোমার বয়সের ক-টা ছেলে রাতে স্বপ্ন দেখে আমাকে নিয়ে খেয়াল আছে?’
‘বালের স্বপ্ন৷’ রাগের মাথায় হাত-পা ছুঁড়তে থাকে ইন্দ্র, ‘শরীর দেখিয়ে গান গাইতে হয় তার আবার বড়ো বড়ো কথা৷ আরে আপনি ভালোবাসার কী বুঝবেন? নিজের আর্টটাকেই অনেস্টলি ভালোবাসতে পারলেন না৷’
‘শুয়োর, শালা তুমি ভালোবাসার ঝাঁটের ডগাটাও বোঝো না৷ বুঝলে নিজের ভালোবাসাকে অন্যের বিছানায় তুলে এখানে নিশ্চিন্তে বসে লম্পট মহিলার সঙ্গে মাল খেতে না৷’
‘শাট আপ ইউ ফিলথি৷’
নেশায় চুর দু-জনেই৷ মিস লাবণি ইন্দ্রর চুল খামচে ধরেন৷ ইন্দ্র তাঁর পেট লক্ষ্য করে লাথি চালায় কয়েকটা৷
ছোটো একটা ধস্তাধস্তি শুরু হয় দু-জনের মধ্যে৷ মাঠের আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা শ্যুটিং-টিমের যে ক-জন সুস্থ অবস্থায় ছিল, তারা দৌড়ে আসে ওদের দিকে দু-জনকে আলাদা করে ফেলে তারা৷
(৩)
মাঝরাতে নেশাটা কেটে গিয়ে ঘুম থেকে উঠে বসে ইন্দ্র৷ ঘুমটা ভেঙেছে একটা আওয়াজে৷ দরজার উপরে দুমদুম করে বাড়ি মারছে কেউ৷ ঘরের ভিতর নিকষ অন্ধকার৷ ঘড়িতে দেড়টা বাজছে৷
উঠে গিয়ে আলো জ্বেলে দরজা খুলে দেয় ইন্দ্র৷ মিস লাবণি দাঁড়িয়ে আছেন বাইরে৷ ব্যাপারটা খানিকটা আগে থেকেই আঁচ করেছিল সে৷ এই মুহূর্তে মহিলার গায়ে রাতের পোশাক৷ তার নীচ দিয়ে শরীরের আদল স্পষ্ট চোখে পড়ছে৷ চোখ-মুখ দেখে বোঝা যায় জ্ঞান খানিকটা ফিরলেও নেশার ঘোর পুরোপুরি কাটেনি৷
ইন্দ্রকে দরজা খুলতে দেখেই একটা আঙুল তুললেন তিনি, ‘উঁহুঁ না৷ আমি মাঝরাতে তোমার সঙ্গে সাডেন-সেক্স করতে আসিনি৷ আমার কিছু কথা বলার আছে৷ অ্যান্ড ইউ হ্যাভ টু লিসেন টু ইট৷’
বাইরেটা একবার উঁকি মেরে দেখে নিল ইন্দ্র৷ তারপর মহিলাকে ভিতরে ঢুকিয়ে দরজাটা ভালো করে বন্ধ করে দিল, ‘প্লিজ আপনি একটু শান্ত হোন, আমি বুঝতে পারছি আজ একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে৷ কিন্তু আপনি এভাবে…’
‘শাট ইট ম্যান৷ সারাদিন তোমার অনেক বকবক শুনেছি আমি, এবার আমি বলব, তুমি শুনবে৷ বাট বিফোর দ্যাট, তোমার কাছে পেনকিলার আছে?
‘পেনকিলার?’
‘ইয়েস৷ শালা এত জোরে লাথি মেরেছ আর একটু হলে নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়ে যেত৷’
ইন্দ্র দ্রুত উঠে গিয়ে ব্যাগ থেকে দুটো এনালজেস্টিক বের করে মহিলার হাতে ধরিয়ে দেয়, নীচু করে কাতর গলায় বলে, ‘এক্সট্রিমলি সরি ম্যাম, আমি আসলে নেশার ঘোরে থাকলে…’
ওষুধটা গলায় ফেলে এক ঢোক জল খান মিস লাবণি, বাঁকা সুরে বলেন, ‘রাজযোটক৷ মেড ফর ইচ আদার৷ এবার নাটক-ফাটক না মেরে এখানে বসো, আমার কিছু বলার আছে৷’
বিছানায় তাঁর পাশে বসে পড়ে ইন্দ্র, ‘বেশ, বলুন৷’
‘আই হ্যাভ ডিসাইডেড সামথিং৷ আমি কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছি৷’
‘বলুন কী সিদ্ধান্ত?’
‘পরে৷ আগে বলি কেন নিয়েছি৷’ বিছানার উপর আর একটু চড়াও হয়ে বসেন মিস লাবণি, পা দুটো ছড়িয়ে দেন দুই দিকে, হাতটা এলিয়ে দেন মাথার উপরে, ‘ইউ সি আমার বাবা ভালো গান গাইতেন৷ ছোটো থেকে আমি তার কাছেই মানুষ হয়েছি, গান শিখেছি৷’
‘বেশ৷ তারপর?’ চোখ রগড়ে হাই তুলে ঘুমটা কাটিয়ে নেয় ইন্দ্র৷
‘বাবা সাঁওতাল পরগনায় কাজ করতেন একসময়৷ ওদের থেকেই গান শিখেছিলেন৷ সেসব গান আমাকে শেখাতেন৷ ছোটো থেকে খাসা গানের গলা ছিল আমার, ভেবেছিলেন লাবণ্য বড় হয়ে বিখ্যাত গায়িকা হবে৷ বাল৷ আমার বাপটা একটা বাল৷’
‘আপনি বাপান্ত পরে করবেন, আগে সিদ্ধান্তটা বলুন৷’
‘ওকে,’ মাথার চুলগুলো সরিয়ে নিয়ে বলতে থাকেন মিস লাবণি,
‘আমারও গানের দিকের ঝোঁক ছিল, কলেজ পাস করে মিউজিকে এম.এ করলাম৷ অ্যালবাম বের হল, সিডি লঞ্চ হল৷ আশপাশে কিছু লোকজন জড়ো হল৷ ব্যস, ওর বেশি আর কিছু এগোয় না৷ ইন্ডিভিজুয়াল আর্টিস্টের গান কে আর শুনবে বলো তো? হাজারটা লোক গান গাইছে৷’
‘তারপর আপনি ভিডিয়োগ্রাফিতে নেমে এলেন?’
হাসলেন মিস লাবণি, ‘তারপর আমি গায়িকা থেকে একটা দামি বেশ্যা হয়ে গেলাম ভাই৷ তুমি যতটা তোমার জামাকাপড় খুলে দেখাতে পারবে তত ভাইরাল হবে তোমার গান৷ আই মিন প্রথম প্রথম খারাপ লাগত, ভাবতাম, একটা ফ্যান ফলোয়িং তৈরি হয়ে গেলে এসব ছেড়ে জাস্ট গান গাইব৷ কিন্তু ওসব করতে গেলেই দেখেছি লোকজন আর আগ্রহ দেখায় না৷ ওরা ল্যাংটো মিডল এজড মহিলা দেখতে চায়, আর আমি শালা সেই পারভার্শানটাকে ফ্যান-ফলোইং ভেবে ভিতরের গায়িকাটাকে…’
ইন্দ্র বোঝে মহিলার কথাগুলোর মধ্যে একটা হালকা নেশাড়ু ভাব থাকলেও কথাগুলো আজগুবি নয়৷ এই ইন্ডাস্ট্রিটা তার নিজের ইচ্ছামতো শিল্পীকে দুমড়ে-মুচড়ে বদলে নেয়৷ মুখ তুলে সে তাকায় মিস লাবণির দিকে, কী যেন একটা চিন্তায় বিভোর হয়ে গেছেন মহিলা, ইন্দ্র জিজ্ঞেস করে, ‘তা এখন কী চাইছেন আপনি?’
‘আমি ভেবেছি এসব আমি ছেড়ে দেব৷’
ইন্দ্র খুশি হয়, ‘বাঃ উত্তম প্রস্তাব৷’
মহিলা বাধা দিয়ে ওঠেন, ‘না না, আগে বলো ইউ ডু আন্ডারস্টান্ড যে এটা আমার কাছে একটা বিগ ডিল, আমার নাম, যশ নষ্ট হয়ে যাবে৷ এখন যা টাকাপয়সা কামাই তার টেন পার্সেন্ট কামাব না৷’
‘হুম, তো?’
ইন্দ্রর মুখের কাছে এগিয়ে আসেন মিস লাবণি, ‘তো ইউ হ্যাভ টু ডু দ্য সেম থিং৷’
‘মানে?’
‘মানে কাল সকালে ছ-টার সময় একটা ট্রেন আছে কলকাতার৷ এনিহাউ ওটায় করে কলকাতা ফিরবে তুমি৷ তোমার সেই বান্ধবীর বাড়ি যাবে৷ তাকে গিয়ে বলবে ইউ লাভড হার, ইউ লাভড হার ফর আ লং লং টাইম৷ যা কিছু বলার সব বলে ফেলবে, দেন লেট হার ডিসাইড৷’
‘আপনি?’
‘আপনি না, আমি৷’ একটা হাত ইন্দ্রর দিকে বাড়িয়ে দেন মিস লাবণি,
‘ডিল?’
‘মানে কী এসবের?’ বিরক্ত হয়ে বলে ইন্দ্র৷
হাঁটুর উপরে ভর দিয়ে ইন্দ্রর কাছে চলে আসেন মিস লাবণি, দুটো হাত রাখেন তার দুই গালে, ‘মানে? ওই যে আমাদের সবার মনের ভিতর একটা গানের সুর বাজে৷ কখনও ডিস্কো, কখনও রক, কখনও ভাটিয়ালি, আজ ভেবে নাও সব কিছু ভুলে একটা রাতের জন্যে আমাদের বুকের মধ্যে ঝুমুর বাজবে৷ একটা রাতের জন্য আমরা ঠিক তাই করব যা আমাদের মন চায়৷’
‘আচ্ছা বেশ৷ ডিল৷’
ইন্দ্রর কথায় নিজেই অবাক হয়ে যান মিস লাবণি৷ ছেলেটা এত সহজে রাজি হয়ে যাবে তিনি ভাবতে পারেননি৷
‘কাল সকালে ডুমুরতলার কাছে একটা ঝুমুরের আসর আছে জানো, পরশু আমাকে ইনভাইট করে গিয়েছিল, পয়সাকড়ি কিছু দেবে না৷ যাব না ভেবেছিলাম৷ শ্যুট ক্যানসেল করে কাল ওখানেই যাব ভেবেছি৷’
‘বুঝলাম৷’ আশ্চর্যরকম শান্ত দেখাচ্ছে ইন্দ্রকে৷
‘আর তুমি যা বলেছ মনে থাকবে তো?’
‘থাকবে৷’
বিছানা থেকে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে যান মিস লাবণি৷ যাওয়ার আগে, ইন্দ্রকে সজোরে জড়িয়ে ধরেন একবার৷
(৪)
ছোটো বাঁশের মাচা থেকে যখন নেমে এল লাবণ্য, তখন তার গলার কাছটা জ্বালা করছে৷ এখানে মাইকের ব্যবস্থা নেই, খালি গলাতেই চিৎকার করে গান গাইতে হয়, বহুদিনের অনভ্যাস৷ তাছাড়া আজ অনেকদিন পর পুরনো সালোয়ারটা বের করে পরেছে৷ আগের থেকে মোটা হয়েছে খানিক, সেটা গায়ে আঁটোসাঁটো হয়৷ অস্বস্তি হয়৷
জনা পঞ্চাশেক গ্রাম্য লোক জড়ো হয়েছিল গান শুনতে৷ লাবণ্য নেমে আসতে হালকা হাততালির শব্দ পাওয়া গেল কয়েক সেকেন্ড৷ তারপর হারিয়ে গেল সেটা৷ লাবণ্যর মুখে তাতেই হাসি ফুটল৷
ওর বদলে অন্য একটা স্থানীয় মেয়ে উঠে গান গাইতে শুরু করেছে এবার৷ ঝুমুর গান,
‘লদীধারে চাষে বঁধু মিছাই কর আশ
ঝিরিহিরি বাঁকা লদি বইছে বারমাস’
সেটা শুনতে শুনতেই দর্শক আসনের মধ্যে একটা ফাঁকা চেয়ার খুঁজে নিয়ে বসে পড়ে লাবণ্য৷ মনটা অনেক দিন পর এতটা খুশি হয়েছে তার, সকালে ইন্দ্রর ঘরে গিয়ে দেখে এসেছে ছেলেটা ঘর ছেড়ে দিয়েছে৷ কলকাতায় ফিরে কী হল জানাবে কি না কে জানে!
হাতের ব্যাগ খুলে এক ঢোক জল খায় লাবণ্য৷ কী এক আনন্দে মনটা শান্ত হয়ে আসে ওর৷ ওই গোটাদশেক হাততালির শব্দই অন্ধকারের মধ্যে একটুকরো পুরনো মোমবাতি জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছে ওর ভিতরে৷
জল খেয়ে আড়মোড়া ভেঙে আশপাশে তাকাতেই চোখ থমকে যায়৷ ঝট করে ঘড়ির দিকে চায় ও৷ সকাল ন-টা বেজেছে৷ কলকাতায় ফেরার আর কোনও ট্রেন নেই৷
ইন্দ্র বসে আছে একটু দূরে৷ এক মনে মেয়েটার গান শুনছে৷
মাথাটা গরম হয়ে যায় লাবণ্যর৷ চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে, ইন্দ্রর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে সে৷ ইন্দ্র বিরক্ত হয়, ‘এ কী, আপনি গার্ড করছেন কেন?’
‘কী কথা ছিল তোমার?’ ঝাঁজের সঙ্গে বলে লাবণ্য৷
‘আশ্চর্য! যা কথা ছিল তাই তো করছি৷’ ইন্দ্র দ্রুত উত্তর দেয়৷
‘কাল রাতের সব কথা ভুলে গিয়েছ? তুমি বলেছিলে, যা তোমার মন চাইছে সেটাই করবে, নিজেকে আটকে রাখবে না৷ আর আজ ট্রেন মিস করে এখানে বসে….’
ইন্দ্রর গম্ভীর মুখে একটা হাসি ফুটে ওঠে, ‘ট্রেন মিস করিনি৷ ইন ফ্যাক্ট আমি ট্রেন ধরতেই যাইনি৷’
‘বেইমান কোথাকার,’
ইন্দ্র আবার হাত নাড়ে, ‘ধ্যার বাবা, একটু সরুন তো৷ সামনে গার্ড হয়ে যাচ্ছে৷’
‘তোমার লজ্জা করছে না? আমি এত বড়ো স্যাক্রিফাইসটা করতে পারলাম আর তুমি…’
আরও বিরক্ত হয়ে লাবণ্যর মুখের দিকে চায় ইন্দ্র, ‘আচ্ছা, আপনার কী মনে হয়? আমার মন সত্যি সত্যি কী চাইছে?’
‘চাইছে, কলকাতায় গিয়ে দীপাবলিকে…’
‘না, একেবারেই না৷’ লাবণ্যকে মাঝপথেই থামিয়ে দেয় ইন্দ্র, নির্লিপ্ত গলায় বলে, ‘ভালো করে শুনুন৷ আমার মন চাইছে আজ রাতে মেয়েটার বিয়ে, সকালে গিয়ে এইসব বলে ওর মানসিক কষ্ট না বাড়াতে৷ ওর ভবিষ্যতের সংসারটা যাতে সুখের হয় সেই সুযোগটা ওকে দিতে৷ আমি ওকে ভালোবাসি, তাই সত্যি সত্যি মনের একেবারে ভিতর থেকে চাই ও ভালো থাক, শান্তিতে থাক, যার সঙ্গে খুশি৷ বিশ্বাস করুন, একটুও মিথ্যে বলছি না৷ আমার মন যা চাইছে তা করেই এসেছি এখানে৷’
‘চিংড়ি মাছের ভিতর করা, তায় ঢালেছি ঘি
নিজের হাতে ভাব ছেড়েছি, ভাবলে হবে কি?’
মেয়েটা গেয়ে চলেছে এখনও৷ ইন্দ্রর পাশে বসে পড়ে লাবণ্য৷ একটা নরম হাত রাখে ওর পিঠে৷ মিহি হাসি ফুটে ওঠে তার মুখে৷
‘দিব্যি গাইলেন গানটা, অনেকদিন পর ঝুমুর গাইলেন, না?’ ইন্দ্র জিজ্ঞেস করে৷ লাবণ্য মাথা নাড়ে কেবল৷
ডুমুরতলার গানের আসর আজ সকাল গড়িয়ে গভীর রাত অবধি চলবে৷ আর সারাটা দিন ঝুমুর বাজবে৷