1 of 2

ঝুমরি-তিলাইয়ায়

ঝুমরি-তিলাইয়ায়

অনিকেতকে ট্রেনটা কোডারমা স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল গয়ার দিকে। স্টেশনে নেমে সব কিছুই নতুন লাগল। প্রায় ত্রিশ বছর পরে এল এদিকে। অথচ কৈশোর এবং প্রথম যৌবন সব কিছুই কেটেছে এই অঞ্চলেই। সময় যে কী করে কেটে যায়।

মাঝখানে কোডারমা স্টেশন। ডানদিকে শিবসাগর। সেখানে অনিকেতদের সময়ে সাহেবি অভ্র কোম্পানি ছিল, নাম ক্রিশ্চান মাইকা। এই পুরো এলাকা জুড়েই ছিল নানা অভ্রখাদান। গিরিডি পর্যন্ত। ক্রিশ্চান কোম্পানির খুব বড়ো খাদান ছিল রহৌলির ঘাটে। তার নাম ছিল খলকতুস্কি। বাঙালি সামন্তদেরও বেশ কিছু খাদান ছিল। মাড়োয়ারি রামঘড়িয়াদেরও। অনিকেতের বাবা ছিলেন কোডারমা স্টেশনের স্টেশন মাস্টার।

স্টেশনের উলটোদিকে ছিল ছোট্ট একটি জনপদ। নাম ঝুমরি-তিলাইয়া। অনিকেত যখন স্কুলে পড়ে, তখন দামোদর ভ্যালি করপোরেশন-এর তিলাইয়া, মাইথন, পাঞ্চেৎ ইত্যাদি বাঁধ বানানো হয়। হাজারিবাগ যেতে হলে আগে মানুষকে গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোডের বগোদর হয়ে যেতে হত। হাজারিবাগ রোড স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে সারিয়া হয়ে বগোদরে জি টি রোড ক্রশ করে বিষ্ণুপুরের মোড় ছেড়ে টান্টিঝরিয়ার উপর দিয়ে কোরমা মোড় হয়ে হাজারিবাগ শহরে পৌঁছাতে হত।

অনিকেতের ছোটোপিসিমার বিয়ে হয়েছিল হাজারিবাগ শহরের পাগসল-এ। সেই ছোটোপিসিমারই অকাল মৃত্যু হল ক-দিন আগে। অকালমৃত্যু মানে, ষাট বছর মতো বয়স হয়েছিল তাঁর। আজকালকার দিনে অকাল মৃত্যুই। তখন বড়হিহয়েও আসা যেত তবে দূর পড়ত অনেক। এখন তিলাইয়া বাঁধ হয়ে গেলে কম রাস্তা পড়ে। যখন অনিকেতের ছোটোপিসিমার। বিয়ে হয়েছিল তখনও বাবা চাকরিতে। সেই ছোটোপিসিমার শ্রাদ্ধেই এবারে এসেছিল অনিকেত হাজারিবাগে। ছোটোপিসেমশাই অনেক করে বলেও ছিলেন। বাড়িটা শ্রাদ্ধের পরে একেবারে ফাঁকা হয়ে যাবে, কটা দিন থেকে গেলেই পারতিস। তোর ছেলেবেলার এলাকা সব। তোর। ছোটোপিসির কাছেই শুনেছি এখানকার কত গল্প। একবার তো ঝুমরি-তিলাইয়াতেও গেছিলাম কাঠটগরের কাছে। তোর সঙ্গে তার নাকি খুবই ভাব ছিল। তোর সঙ্গে বিয়ের কথাও হয়েছিল। কিন্তু কাঠটগরের বাবা তাকে বিয়ে দিয়েছিলেন বার্নপুরের এক বড়ো ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে। কিন্তু বিয়ের তিনবছরের মধ্যেই কাঠটগরের স্বামী মারা যান। কাঠটগর ঝুমরি-তিলাইয়াতে ফিরে আসে এবং নিজেদের বাড়িতেই তারপর থেকে থেকে যায়। কাঠটগরের বাবা প্রাংশুবাবুর এই একটিই সন্তান ছিল। কোডারমাতে বাড়ি না বানিয়ে ঝুমরি-তিলাইয়াতেই অনেকখানি জমি নিয়ে রিটায়ার করার পর পরই বাড়ি করেছিলেন তিনি। সঙ্গে মস্ত বাগানও ছিল। দেহাতে চাষযোগ্য অনেক জমিজমাও ছিল। সস্তার দিন। পেঁহু, বাজরা, গিন্না, ধান এসবের চাষও করতেন উনি। অবশ্য ভাগচাষিদের মাধ্যমে। পেনশন-এর টাকা এবং জমিজমার ফসল দিয়ে দাসদাসি নিয়ে বাবা ও মেয়ের দিন স্বচ্ছন্দেই কেটে যেত। কাঠটগরই তোমার ছোটোপিসিকে জানিয়েছিল। প্রাংশুবাবুর চলে যাওয়ার কথা। তাও বছর দশেক তো হলই কম করে। ওঁর স্ত্রী কাঠটগরের বাল্যাবস্থাতেই চলে যান। তাই বড়ো আদরের মেয়ে ছিল কাঠটগর প্রাংশুবাবুর।

ছোটোপিসের কাছে কাঠটগরের কথা শুনেই বহুদিন পরে কলকাতার গাড়ি ধরার আগে ঝুমরি তিলাইয়া থেকে একবার ঘুরে যাবে মনস্থ করল অনিকেত।

অনিকেতেরও কলকাতাতে পিছুটান নেই কোনো। তার বয়সও তো পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই হল। মা ও বাবা দুজনেই চলে গেছেন অনেকদিনই। দাদা আছেন। যদিও অসুস্থ। কিন্তু বউদি এবং তাঁর। ছোটো বোন দুজনে মিলে দেখাশোনা করে তাঁকে। দাদার সঞ্চয় এবং পেনশন তো আছেই তার উপরে বউদির ছোটোবোন চুমকি সেলস-ট্যাক্স অফিসার। তার ডিভোর্স হয়ে গেছে বিয়ের পরে পরেই। তখন থেকে চুমকি দিদি-জামাইবাবুর কাছেই থাকে।

আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে এপক্ষ ওপক্ষ দু-পক্ষেরই অনেকেই বলেছিলেন এদের দুজনের বিয়ে দিয়ে চুমকিকে ওদের বাড়ির একজন করে নিতে। কিন্তু দু-জনে দু-জনকে অপছন্দ না করলেও

ওই বিয়েতে মত ছিল নাদু-জনেরই। আজকালকার মেয়েদের আর্থিক স্বাধীনতা থাকলে, বিয়ে। যে একটা অবশ্যকরণীয় কর্তব্য একথা মানে না কেউই। তা ছাড়া বিয়ে যারাই একবার করেছে। এবং তারপরে হয় বিধবা হয়েছে অথবা ডিভোর্স হয়েছে যাদের, তারা বিয়ের প্রতি। অধিকাংশক্ষেত্রেই আর তেমন বেশি আগ্রহ রাখে না।

ঝুমরি-তিলাইয়াতে পৌঁছে অনিকেতই প্রথম যৌবন থেকে কাঠটগরদের বাড়ির গেটের ডানদিকের মহুয়া গাছটার মতো একা দাঁড়িয়ে রইল। নট নড়ন চড়ন নট কিছু হয়ে। মনে হয়, সব গাছের বয়স বাড়ে, মহুয়াদের বাড়ে না। ঋতুচক্রের সঙ্গে তারা বদলে যায় প্রতিবছর। প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে যাবার পরে, একেক ঋতুতে চেহারারই বদল হয় শুধু, মহুয়া গাছের বয়স চোখে ঠাহর হয় না।

ঝুমরি-তিলাইয়াতে কোডারমা স্টেশন থেকে আগে হেঁটে যেতে বেশ সময় লাগত। সাইকেলে একটু কম। তখনও অবশ্য কম হলেও সাইকেলরিকশ পাওয়া যেত। আর এখন তো অটো এবং ট্যাক্সিও পাওয়া যায়।

প্রাংশুকাকা বাড়িটার নাম রেখেছিলেন মহুয়া। গেট-এর পাশের তরুণী মহুয়া গাছটির নামে। এখন সামনের মাটির পথে পিচ পড়েছে। ছোটোখাটো দোকান এবং অনেক দোতলা বাড়ির। ভিড়ে গেটটাকেই খুঁজে পাওয়া যায় না কিন্তু মহুয়াটি মস্ত বড়ো হয়ে দু-দিকে বড়ো বড়ো ডাল ছড়িয়েছে। এখন বসন্ত তাই মহুল ফুলের গন্ধ উড়ছে হাওয়ায়। কোকিল ও পিউ কাঁহা ডাকছে, অনিকেতদের ছেলেবেলাতে যেমন ডাকত। ঝুমরি-তিলাইয়া আছে মহুয়া নামের বাড়িটা আছে, মহুয়া গাছটাও আছে যে তাই শুধু নয়, গত তিন-চার যুগে মস্ত বড়োও হয়েছে। সবই আছে শুধু ছেলেবেলাটাই পুরোপুরি হারিয়ে গেছে।

মস্ত বড়ো গেটের সামনে মহুয়া গাছতলাতে একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল অনিকেত। আব্রুর জন্যে গেটের ভিতরের দিকে একটি বাঁশের বেড়া লাগানো হয়েছে। তার উপরে সবুজ রং করা। তার ডান বা বাঁ-দিক দিয়ে ভিতরে বা বাইরে যেতে হয়। গেট-এর বাইরে পথের উপরে সবচেয়ে কাছের যে সাইকেল-সারানো-দোকানি অনিকেতকে ইতস্তত করতে দেখে শুধোলো কিসকা তালাসমে বাবু?

অনিকেত কী বলবে ভেবে না পেয়ে বলল, মাজিকো।

কাঁহাসে?

কলকাত্তা।

ও। যাইয়ে, অন্দর যাইয়ে। নোকর-চাকর লোগ সব অন্দরহি মেই হ্যায়।

অন্দর ঘুসকে আওয়াজ দিজিয়েগা।

ভিতরে ঢুকতেই আবার সেই পুছতাছ। কিন্তু ওরা যখন বলল, আপনি নাম না বাতাইয়ে বাবু।

একটু ইতস্তত করে অনিকেত বলল, বোলো অন্দর যাকর, গুটলু বাবু আয়া। কলকাত্তাসে।

ওকে একটুক্ষণ দাঁড় করিয়ে রেখে, দরজা থেকেই ভিতরের আয়াকে শুধোলো এবং আয়াকে নামও বলে দিল। ভিতর থেকে কী শুনল তা তারাই জানে, বলল, আইয়ে বাবু, অন্দর আইয়ে।

বলে, মস্ত বড়ো বসার ঘরে ওকে নিয়ে গিয়ে বসাল।

দেওয়াল থেকে একটি বাঘের চামড়া, একটি শিঙাল শম্বরের বাঁধানো মাথা এবং দুটি ভালুকের মাউন্ট-করা মাথা টাঙানো আছে। এই ট্রফিগুলোও অনিকেত প্রাংশুকাকাবাবু এই বাড়ি বানাবার পর থেকেই ঝুলতে দেখছে। দেখে মনে হল, মিয়মিত ঝাড়-পোঁছ হয়। কাকাবাবু অনিকেতের বাবাকে বলেছিলেন বাঘটি ইটখোরি-পিতিজ-এ বদি রায়ের শুটিং লজ-এর কাছে হাঁকোয়া করিয়ে মেরেছিলেন, মেরেছিলেন ভালুক দু-টি রহৌলির ঘাটে এবং শম্বরটি দানুয়া-ভুলুয়ার জঙ্গলে। দেওয়ালে ঝোলানো ওই ট্রফিগুলির দিকে চেয়ে অনেক পুরোনো কথাই মনে পড়ে গেল গুটলুবাবুর।

তখনও পাখা চালাবার মতো গরম পড়েনি–তবুও খিতমদগার জিগগেস করল, পাখা চালাবে কি না?

অনিকেত বলল, না না। টিক্কে হ্যায়। ওর মনে হল প্রাংশুকাকাবাবু চলে যাবার পরে মহুয়ার শোভার কিছু হয়নি। হয়েছে বটে, তবে সৌন্দর্যর কোনো অভাব ঘটেনি। জানালা এবং খোলা দরজা দিয়ে নানা ফুলের গন্ধ আর পাখির ডাক ভেসে আসছিল। অনিকেতের মনে হল, এই মহুয়া বাড়ি তেমনই আছে, দেওয়ালের ট্রফিগুলোও একইরকম আছে, কিন্তু খরস্রোতা কোনো নদীর মতো শব্দ বয়ে যাচ্ছে পথ পেয়ে। নানারকম শব্দ। সাইকেল, সাইকেলরিকশ, অটো, ট্যাক্সি, দু-একটি প্রাইভেট গাড়ি ও সব কিছুর সম্মিলিত শব্দ, মানুষের চিকৃত গলার স্বর সব। মিলে সেই ছেলেবেলার শান্ত ঝুমরি-তিলাইয়ার সব শান্তির গলা টিপে মারছে। কাঠটগর কখন চানে গেছে, কে জানে?

একজন খিতমতগার এসে জিগগেস করল, চায়ে লাউ সাব?

অনিকেত ডান হাত তুলে মানা করল।

শরবত লাউ ক্যাবাবু?

তাতেও অনিকেত না করল।

তারপর দোতলার ল্যান্ডিং থেকে কাঠটগরের গলা ভেসে এল, মুনরী, বাবুকো হামারা সালাম বাতাও ঔর উপর লেকে আও।

একজন মাঝবয়সি আয়া উপর থেকে নেমে এসে অনিকেতকে নিয়ে দোতলাতে উঠে এল। অনিকেতের মনেই পড়ল না শেষ কবে এ বাড়ির দোতলাতে উঠেছিল। ও শেষ-কৈশোরে। পৌঁছোনোর পরে বোধহয় আর ওঠেনি। ততদিনে কাঠটগরও তো কিশোরী হয়ে গেছিল। অল্পবয়সি মা-মরা মেয়েটিকে তার বাবা চোখে চোখেই রাখতেন সবসময়ে, কাচের-বাসনের মতো, পাছে হাত থেকে পড়ে ভেঙে যায়।

কাঠটগর অনিকেতকে দেখে চমকে উঠল। এলোখোঁপা বাঁধতে বাঁধতে। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে সে অবাক হয়ে বলল, ওমাঃ। গুটলুদা। তুমি! আমি ভেবেছিলাম, কলকাতা থেকে যতীনমামা এসেছেন বুঝি। আসবেন বলে চিঠিও লিখেছিলেন। রাজঘড়িয়াদের কাছে কাজ সেরে আমার ওখানে খেয়ে, সন্ধ্যের পরের কোনো গাড়িতে কলকাতা ফিরে যাবেন বলে জানিয়েছিলেন।

তারপর কাঠটগরের যেন বাকরোধ হয়ে গেল। বলল, তুমি যে আসবে তো ভাবনারও বাইরে ছিল। তাও আমাকে মনে করে নয়, নিশ্চয়ই হাজারিবাগের তোমার ছোটোপিসির কাছে এসেছিলে। দেখেছ! এতদিন পরে দেখা একটু সাজগোজও করতে পারলাম না। আসামাত্র কাজের লোকদের নিজের নামটা তো বলবে অন্তত।

অনিকেত হেসে বলল, আমার দু-টি নামই তো অ্যানাউন্স করার মতো নয়। তাই-ই বলিনি। তাছাড়া, নাই-বা সাজলে। মনে আছে? তোমাকে একটি শায়েরি বলতাম আমি।

শুধু একটা বলতে তো অনেকই। তখন তোমার মুখে শায়েরির ফুলঝুরি ফুটত।

তারপরে বলল, কোন শায়েরির কথাটি বলছ তুমি?

–ওই যে। সেইটা। বলেই, অনিকেত বলল,

উলঝি সুলঝিরহনে দো
কিউ শরপর আফৎ লাতি হো
দিলকি ধড়কন বড়তি হ্যায়
যব বাঁলোকো সুলঝাতি হো।

থাক থাক। পুরোনো কথা না হয় থাকই এখন। তোমার এই শায়েরির সঙ্গে বসন্তের এই মাঝসকালে আমার সমস্তটা কৈশোর-যৌবন আর ফুলদাওয়াই ফুলের মতো গাঢ় লাল আর গাঢ় বেগুনি ফুলে ফুলে ভরে গেল। কোকিল, হলুদ বসন্ত আর পিউ কাঁহারা আমাদের সেই সময়টাকে যেন ফিরিয়ে নিয়ে এল।

আর মহুয়ার গন্ধ?

সে তো আছেই।

তারপরই কাঠটগর বলল, এই মহুয়াটা আমার দিদিমার চেয়েও বয়সে বড়ো।

তারপরে বলল, এর বয়স বাড়ে না কেন বলো তো?

–শুধু মহুয়াই বা কেন? আমাদের সেই ছেলেবেলাটা, কৈশোর আর প্রথম যৌবনটা ঠিক সেখানেই আটকে আছে-একটা ফ্রেমে বাঁধানো জলরঙা ছবির মতো। তাই না?

–তাই। ঠিক তাই।

আমাদের জীবনের অবেলাতেই যদি এসেছ তুমি গুটলুদা, তোমাকে অনেকদিন এখানে আটকে রাখব। যেতে দেব না। দুপুরে তো খেতেই হবে। রাতেও থাকতে হবে। ইচ্ছে করলে সারাজীবনও থাকতে পার। তোমার সব খবরই রাখি আমি। কিন্তু তুমি তো আগ-বাড়িয়ে কখনো কিছু বলেনি। আমিও তাই চুপ করেই ছিলাম এতগুলো বছর।

তারপরে বলল, তুমি কি এখনই দুপুরের খাবার খাবে? আমার রান্না কিন্তু হয়ে গেছে। আমি নিজে অবশ্য রান্না করিনি। তুমি আসবে জানালে করতাম।

–না। আমি খাব না।

–কেন? এতবছর পরে এসেও…

–অন্যের জন্যে রাখা খাবার আমি খাই না। যেমন, উচ্ছিষ্টও খাই না। আজ বলে নয়, কোনোদিনই খাইনি।

–এটা তোমার অন্যায় অভিমান।

–অভিমান যদি হয়েই থাকে, হয়তো খুব বোকা বোকা অভিমানও, কারও অভিমানের পেছনেই কোনো যুক্তি কোনোদিনই থাকে না। কারো অভিমানকেই যুক্তির নিক্তি দিয়ে কখনো মাপতে চেও না।

–তবে? তুমি খাবে কোথায়?

–কোথাও খেয়ে নেব। রেললাইনের এপাশে ঝুমরি-তিলাইয়া, আর ওপাশে কোডারমা শহর আর একটু পিছিয়ে গেলেই তিলাইয়া ড্যাম–কত ধাবা, দোকান, ঝুপ্পি, ঝোপড়ি। খাওয়াটা কি সমস্যা কোনো?

তারপর অনিকেত বলল, তার চেয়ে এসো, বোসো, আমরা দুজনে মিলে পুরোনো গল্প করি। কত গল্পই যে ভুলে গেছি। তোমার হয়তো মনে থাকতে পারে কিছু কিছু।

–তুমি আমাকে বড়ো লজ্জিত করেছ। আমার প্রথম যৌবনে হারিয়ে-যাওয়া প্রেমিক তুমি গুটলুদা। এতদিন পরে এলে। আমি শাড়িটা পালটে আসি, একটু ফিরদৌস আতর মেখে আসি। মনে আছে, তুমি ভালোবাসতে।

–আর তোমার বর? লোকটা মানুষ হিসেবে খারাপ ছিল না কিন্তু কোনোরকম রসবোধই ছিল না। লোকটা ইঞ্জিনিয়ার না হয়ে অ্যাকাউন্ট্যান্ট হলেই ভালো হত। ব্যাঁকাদার মতো। অনিকেত চুপ করে থাকল।

বসার ঘর থেকে যেতে যেতে কাঠটগর বলল, মনে আছে? আমাদের সময়ে প্রেম শব্দটা উচ্চারণ করাটাও গর্হিত অপরাধ ছিল। তাই না?

–অনিকেত মৃদু হেসে বলল, তা ছিল। তবে আমরা খুব ঘন ঘনও পড়তাম প্রেমে।

–কাঠটগর হেসে বলল, তা ঠিক।

–আসছি আমি।

বলেই, কাঠটগর নিজের শোবার ঘরের দিকে চলে গেল।

খোলা জানালা দিয়ে বাগানে চেয়ে রইল অনিকেত। বাগানময় চৈত্র পবনে শুকনো পাতা উড়ে বেড়াচ্ছে। কাঠটগরের বাবার স্বহস্তে লাগানো পলাশ, অশোক, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়ার পাতা উথাল পাথাল হাওয়াতে আন্দোলিত হচ্ছে। সুখ নেইকো মনে, নাকছাবিটি হারিয়ে গেছে হলুদ বনে বনে।

অনিকেত ভাবছিল, তাদের কৈশোর-যৌবনের সেই ঝুমরি-তিলাইয়ার দিনগুলিও এ জন্মের মতো হারিয়ে গেছে। তবে ও গান গাসনে, গাসনে, যে দিন গিয়েছে চলে সে আর ফিরিবে না, তবে ও গান গাসনে…

কাঠটগর ফিরলে ওকে এই গানটি গাইতে বলবে। ভাবছিল অনিকেত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *