ঝিলম নদীর তীরে – শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
আলেকজান্ডার সৈন্যদের নিয়ে হাইডাসপিস নদী পার হলেন৷ হাইডাসপিসের সংস্কৃত নাম-বিতস্তা, চলতি কথায়-ঝিলম৷ রবীন্দ্রনাথ এই ঝিলম সম্বন্ধে লিখেছেন, ‘সন্ধ্যারাগে ঝিলিমিলি ঝিলমের স্রোতখানি বাঁকা আঁধারে মলিন হল, যেন খাপে-ঢাকা বাঁকা তলোয়ার৷’ এই বাক্যে তলোয়ারের ক্ষুর-ধার একদিন আলেকজান্ডারের দিগ্বিজয়ী সেনাকে ঠেকিয়ে রেখেছিল৷ রাত্রির অন্ধকারে লুকিয়ে আলেকজান্ডার নদী পার হয়েছিলেন৷
এপারে পুরু রাজা তাঁর চতুরঙ্গ সেনা নিয়ে তৈরি ছিলেন৷ ঘোর যুদ্ধ বেধে গেল৷ সেকালে গ্রিক সৈনিকেরা বড়ো বড়ো দাড়ি রাখত৷ গল্প আছে, সুযোগ পেয়ে হিন্দু যোদ্ধারা সেই দাড়ি ধরে গ্রিকদের প্রচণ্ড মার দিতে লাগল৷ গ্রিকদের অবস্থা যায়-যায় হয়ে উঠল৷ কিন্তু দুঃখের বিষয়, যুদ্ধ প্রথম দিন শেষ হল না, পরদিনের জন্য মুলতুবি রইল৷ সেকালে রাত্রিকালে যুদ্ধ করবার নিয়ম ছিল না৷
আলেকজান্ডার ভারি কূটবুদ্ধি সেনাপতি ছিলেন, তা নাহলে অর্ধেক পৃথিবী জয় করতে পারতেন না৷ পরদিন সকালে যখন আবার যুদ্ধ আরম্ভ হল তখন দেখা গেল, সেনাপতির হুকুমে গ্রিক সৈন্যেরা বিলকুল দাড়ি কামিয়ে ফেলেছে৷ তাই দেখে হিন্দু যোদ্ধারা ভারি বিমর্ষ হয়ে পড়ল৷ এরকম তো কথা ছিল না৷ তারা আর মন দিয়ে যুদ্ধ করতে পারলে না৷ গ্রিকরা উলটে তাদের মার দিতে লাগল৷
যুদ্ধে যে আলেকজান্ডারেরই শেষ পর্যন্ত জিত হয়েছিল, যারা ইতিহাস পড়েছে তারাই একথা জানে৷ পুরু রাজা আলেকজান্ডারের কাছে ধরা দিলেন, আলেকজান্ডার তাঁর রাজোচিত ব্যবহারে খুশি হয়ে তাঁকে নিজের ক্ষত্রপ নিযুক্ত করে সিংহাসন ফিরিয়ে দিলেন৷ কিন্তু এসব ব্যাপারের সঙ্গে আমাদের কাহিনির কোনো সম্বন্ধ নেই৷
দ্বিতীয় দিনের যুদ্ধ যখন চলছিল, তখন যুদ্ধক্ষেত্রের একধারে একটি টিলার উপর দাঁড়িয়ে দু-টি লোক যুদ্ধ দেখছিলেন৷ একজন যুবা-বয়স্ক; কাঁচা সোনার মতো গায়ের রং, বৃষের মতো বলিষ্ঠ দেহ, মুখে চোখে তীক্ষ্ণ বুদ্ধির দীপ্তি, পরিধানে লৌহজালিক, কোমরে তরবারি৷ দ্বিতীয় ব্যক্তিটি বৃদ্ধ; শীর্ণ দেহ, মুণ্ডিত মাথা, গায়ে কেবল উত্তরীয়, অস্ত্রশস্ত্র কিছু নেই৷
দু-জনে টিলার উপর দাঁড়িয়ে যুদ্ধ দেখছেন৷ ভীষণ যুদ্ধ চলছে৷ গ্রিকদের ঘনসন্নিবদ্ধ ফ্যালাংক্স কখনো হিন্দুদের ঠেলে পেছিয়ে দিচ্ছে, হিন্দুদের রণহস্তীর দল কখনো গ্রিকদের আক্রমণ করে ছত্রভঙ্গ করে দিচ্ছে৷ প্রকাণ্ড এক হাতির পিঠে বসে পুরু রাজা সৈন্য চালনা করছেন, আলেকজান্ডার সাদা ঘোড়ার পিঠে৷ মুহুর্মুহু তূর্যনিনাদ হচ্ছে৷ আহত হাতি চিৎকার করছে, হিন্দুদের রথের তলায় পড়ে গ্রিকরা আর্তনাদ করছে, গ্রিকদের তলোয়ারের আঘাতে হিন্দু-সৈন্যদের মাথা কেটে মাটিতে পড়ছে৷ রক্তের হোলিখেলা৷ এমন যুদ্ধ কুরুক্ষেত্রের পর ভারতবর্ষে আর হয়নি৷ যুদ্ধের পর আলেকজান্ডার নাকি বলেছিলেন, ‘আমি ম্যাসিডোনিয়া থেকে সপ্তসিন্ধু পর্যন্ত বারো হাজার মাইল যুদ্ধ করতে করতে এসেছি, কিন্তু এমন বীর, রণকুশল শত্রু কোথাও পাইনি৷’
টিলার উপর থেকে যুদ্ধ দেখতে দেখতে যুবকটি মাঝে মাঝে ভারি উত্তেজিত হয়ে উঠছিলেন, তাঁর ভাব দেখে মনে হচ্ছিল তিনি বুঝি এখনই তলোয়ার খুলে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বেন! বৃদ্ধ কোনোরকমে তাঁকে শান্ত করে রেখেছিলেন৷
একবার যুদ্ধ যখন ভয়ংকর ভাব ধারণ করেছে, তখন যুবক হঠাৎ তরবারি নিষ্কোষিত করে টিলা থেকে নীচে লাফিয়ে পড়বার উপক্রম করলেন৷ বৃদ্ধ তখন তাঁর কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘বৃষল, শান্ত হও৷ এখন যোগ দিয়ে কোনো লাভ নেই৷ এই যবনরাজা অতিশয় রণ-নিপুণ, পৌরব তাঁর কাছে হেরে যাবেন৷’
যুবক বললেন, ‘দেব, হার-জিতে কী আসে যায়? ক্ষত্রিয়ের যুদ্ধই ধর্ম৷ আমার রক্তে যুদ্ধের উন্মাদনা নৃত্য করছে৷ আপনি অনুমতি দিন৷’
বৃদ্ধ বললেন, ‘না, অসি কোষবদ্ধ করো৷ বৃহত্তর প্রয়োজনে তোমার বেঁচে থাকতে হবে, আত্মঘাতী হলে চলবে না৷’
যুবক বললেন, ‘যুদ্ধের চেয়ে ক্ষত্রিয়ের বৃহত্তর প্রয়োজন আর কী আছে?’
বৃদ্ধ রণক্ষেত্রের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললেন, ‘আজ পৌরব পরাজিত হবেন, আমি দেখতে পাচ্ছি৷ তারপর যবনকে আর্যাবর্ত থেকে ঠেকিয়ে রাখবে কে? তোমার রক্ত উষ্ণ হয়েছে-ক্ষত্রিয়ের পক্ষে তা স্বাভাবিক৷ কিন্তু তাই বলে যুদ্ধের নেশায় বুদ্ধি হারানো উচিত নয়৷’
যুবক তখন নিশ্বাস ফেলে অসি কোষবদ্ধ করলেন৷
ক্রমে অপরাহ্ন হল৷ যুদ্ধের ফলাফল সম্বন্ধে আর কোনো সংশয় রইল না৷ হিন্দু সৈন্যদের অধিকাংশই যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দিয়েছে, যারা বাকি আছে তারা পালাচ্ছে৷ গ্রিক সৈন্য তাদের পশ্চাদ্ধাবন করে বন্দি করছে৷
যুবক বললেন, ‘আমি এদৃশ্য দেখতে পারছি না৷ চলুন তক্ষশিলায় ফিরে যাই৷’
কিন্তু তাঁদের ফেরা হল না৷ টিলা থেকে নামবার উপক্রম করতেই একদল গ্রিক সৈন্য এসে তাঁদের ধরে ফেলল৷
বৃদ্ধ বললেন, ‘আমাদের ধরছ কেন? আমরা তো যুদ্ধ করিনি৷’
একজন গ্রিক সেনানী বলল, ‘তুমি তো নিরস্ত্র, বৃদ্ধ, তোমাকে ছেড়ে দিতে পারি৷ কিন্তু এ যুদ্ধ করেছে, একে ছাড়ব না৷’
বৃদ্ধ বললেন, ‘ও যুদ্ধ করেনি৷ ওর তলোয়ার খুলে দেখো, তলোয়ারে রক্তের দাগ নেই৷’
গ্রিকরা যুবকের তলোয়ার খুলে দেখল সত্যিই রক্তের দাগ নেই; কিন্তু তবু তারা যুবককে ছেড়ে দিতে রাজি নয়৷ ‘যোদ্ধার বেশধারী কাউকে আমরা ছাড়ব না৷ বৃদ্ধ, তুমি যেতে পার৷’
গ্রিকরা যুবককে আগেই নিরস্ত্র করেছিল, এখন তাঁর হাত বাঁধবার উপক্রম করল৷ যুবক প্রতিরোধের চেষ্টা করছেন দেখে বৃদ্ধ বললেন, ‘বৃষল, অনর্থক প্রাণ দিয়ো না৷ যবন সেনাপতি বিচক্ষণ ব্যক্তি, তুমি যুদ্ধ করনি শুনলে নিশ্চয় তোমায় মুক্তি দেবেন৷ এখন যাও৷ সতর্ক থেকো, সংযত থেকো৷ বিপদে সংযমই সহায়৷’
বৃদ্ধ চলে গেলেন৷ গ্রিকরা যুবকের হাত বেঁধে তাঁকে আলেকজান্ডারের ছাউনিতে নিয়ে গেল৷
দুই
ঝিলম নদীর তীরে আলেকজান্ডারের সেনাশিবির পড়েছে; শিবিরে মেঘলোক সৃষ্টি হয়েছে৷ মাঝখানে আলেকজান্ডারের প্রকাণ্ড উঁচু বস্ত্রাবাস৷ যুদ্ধের শেষে বিজয়ী আলেকজান্ডার সদর্পে নিজের বস্ত্রাবাসে ফিরে এলেন৷
ক্রমে রাত্রি হল৷ শত শত মশাল জ্বলে উঠল৷ দূর থেকে দেখলে মনে হয়, ঝিলমের তীরে দেওদার বনের মধ্যে অসংখ্য আলেয়া জ্বলছে-নিভছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে৷
আলেকজান্ডারের বস্ত্রাবাসের দ্বারে ভল্লধারী প্রতীহার৷ ভিতরে প্রশস্ত কক্ষটি বহু তৈলদীপের আলোয় উজ্জ্বল৷ চারদিকে নানা অস্ত্রশস্ত্র ছড়ানো রয়েছে৷ কক্ষের মাঝখানে একটি পারসিক গালিচার উপর বসে আছেন স্বয়ং আলেকজান্ডার৷
আলেকজান্ডার স্নান সমাপন করে আহারে বসেছেন৷ আঙুর ডালিম প্রভৃতি ফল এবং প্রকাণ্ড একটি ভেড়ার রাং সোনার থালে সাজানো রয়েছে, আলেকজান্ডার তাই কেটে কেটে খাচ্ছেন৷ তাঁর ঊর্ধ্বাঙ্গ নগ্ন৷ দুইজন কৃষ্ণকায় ভৃত্য তাঁর সর্বাঙ্গে তেল মর্দন করে দিচ্ছে৷ কয়েকজন অন্তরঙ্গ বন্ধু তাঁর পাশে বসে গল্প করছেন৷ যুদ্ধের কথাই হচ্ছে৷
আলেকজান্ডারের বয়স এই সময় ত্রিশ বৎসর৷ শরীরের দৈর্ঘ্য খুব বেশি নয় কিন্তু বাহু ও বক্ষের পেশি লোহার মতো মজবুত; বলদৃপ্ত দেহ থেকে পৌরুষ যেন ফেটে পড়ছে৷ এই বয়সে তিনি অর্ধেক পৃথিবী জয় করেছেন, ত্রিভুবনে তাঁর তুল্য যোদ্ধা নেই, একথা তিনি জানেন৷ তাই তাঁর প্রিয়দর্শন মুখে বিজয়গর্ব এবং আত্মাভিমান সুপরিস্ফুট৷
আজ কিন্তু তাঁর মন ভারি খুশি আছে৷ তিনি যুদ্ধের নানা ঘটনা সঙ্গীদের সঙ্গে আলোচনা করছেন; কখন কীভাবে যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেল এই নিয়ে তর্ক চলছে৷ সকলেই রণপণ্ডিত সেনাপতি, খুব উৎসাহের সঙ্গে আলোচনা চলছে৷
আহার শেষ হল৷ ভৃত্য দু-জন তৈলমর্দন সমাপ্ত করে আলেকজান্ডারের গায়ে একটি সুক্ষ্ম মখমলের উত্তরীয় জড়িয়ে দিল৷ আলেকজান্ডার ইশারা করলেন৷ তারা ভোজনপাত্রগুলি তুলে নিয়ে গেল, তারপর বড়ো বড়ো পাথরের কারুকার্য খচিত ভৃঙ্গারে পানীয় এনে প্রভুর সামনে রাখল৷
সুরার প্রতি আলেকজান্ডারের অতিরিক্ত আসক্তি ছিল৷ এই সুরাই শেষ পর্যন্ত তাঁর মৃত্যুর কারণ হয়েছিল; কিন্তু সে আরও দু-তিন বছর পরের কথা৷ তিনি অসম্ভব মাত্রায় মদ খেতে পারতেন, কিন্তু সহজে মাতাল হতেন না৷ তাঁর সঙ্গে সমান তালে মদ খেয়ে তাঁর বন্ধুবান্ধবেরা যখন ধুলায় গড়াগড়ি দিতেন, আলেকজান্ডার তখন খাড়া থাকতেন৷ এই বিষয়ে তাঁর মনে বেশ গর্ব ছিল৷
সোনার পানপাত্রে ইরানি সুরা ঢেলে তিনি পাত্র মুখে তুলতে যাবেন, এমন সময় বাইরে থেকে প্রতীহার এসে সসম্ভ্রমে জানাল, একজন বন্দি সম্রাটের সঙ্গে দেখা করতে চায়৷ আলেকজান্ডার বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘বন্দি? কী চায়?’
প্রতীহার বলল, ‘তা কিছু বলছে না৷ তাকে খেতে দেওয়া হয়েছিল, সে খাচ্ছে না, বলছে, সম্রাটের দেখা না পেলে সে অন্ন স্পর্শ করবে না৷’
আজকাল যেমন, সে কালেও তেমনি সভ্যজাতির মধ্যে শত্রুপক্ষের বন্দি সৈন্যদের প্রতি সদয় ব্যবহার করবার রীতি ছিল৷ এই যুদ্ধে হিন্দুদের প্রায় নয় হাজার সৈন্য বন্দি হয়েছিল, তারা সকলে গ্রিকদের হাতে সমুচিত সদ্ব্যবহার পেয়েছিল৷ কিন্তু সম্রাটের সঙ্গে দেখা করবার আগ্রহ কেউ প্রকাশ করেনি৷ আলেকজান্ডার একটু চিন্তা করে বললেন, ‘নিয়ে এসো বন্দিকে আমার কাছে৷’
বন্দি আর কেউ নয়, আমাদের পূর্বপরিচিত যুবক৷ দু-জন সান্ত্রি হাত বাঁধা অবস্থায় তাঁকে আলেকজান্ডারের সম্মুখে উপস্থিত করল৷ আলেকজান্ডার তীক্ষ্মদৃষ্টিতে তাঁকে নিরীক্ষণ করে বুঝলেন, এ সাধারণ বন্দি নয়, আভিজাত্যের চিহ্ন এর সর্বাঙ্গে ছাপ মারা রয়েছে৷
তিনি জিজ্ঞেসা করলেন, ‘তুমি কে?’
যুবকও দিগ্বিজয়ী যোদ্ধাকে ভালো করে দেখে নিলেন, তারপর শান্তস্বরে বললেন, ‘আমার নাম চন্দ্র৷’
আলেকজান্ডার বললেন, ‘ভালো৷ তোমার বাড়ি কোথায়?’
যুবক উত্তর দিলেন, ‘আমার বাড়ি নেই, আমি গৃহহীন৷ আমার দেশ মগধ৷’
আলেকজান্ডার বললেন, ‘মগধ! সে তো শুনেছি এখান থেকে অনেক দূর৷ তুমি এখানে কী করছ?’
যুবক বললেন, ‘আমি এখানে যুদ্ধক্ষেত্রের পাশে একটা উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে যুদ্ধ দেখছিলাম, যুদ্ধের শেষে আপনার সৈন্যরা আমায় বন্দি করেছে৷’
আলেকজান্ডার আবার তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে বন্দির সর্বাঙ্গ নিরীক্ষণ করলেন, তার লৌহজালিক এবং শূন্য তরবারির কোষ দেখলেন, তারপর বললেন, ‘তাই নাকি? তুমি যুদ্ধ করনি?’
‘না৷’
‘শুধু যুদ্ধ দেখছিলে?’
‘হ্যাঁ’
‘যুদ্ধ দেখছিলে কেন?’
যুবক স্থিরনেত্রে আলেকজান্ডারের পানে চেয়ে বললেন, ‘আপনার রণকৌশল লক্ষ করছিলাম৷’
আলেকজান্ডার একটু হাসলেন, ‘বটে৷ কী দেখলে?’
যুবক বললেন, ‘দেখলাম, আপনার সৈন্যচালনার কৌশল অপূর্ব৷ হিন্দুরা সাহসে এবং দৈহিক পরাক্রমে গ্রিকদের চেয়ে হীন নয়, আপনি কেবল রণদক্ষতার জোরে যুদ্ধে জিতেছেন৷’
আলেকজান্ডার সজোরে হেসে উঠলেন, সান্ত্রি দু-জনকে বললেন, ‘তোমরা বন্দির হাতের বাঁধন খুলে দাও৷’
হাতের বাঁধন খোলা হলে আলেকজান্ডার সান্ত্রিদের ইশারা করলেন, তারা চলে গেল৷ তখন তিনি যুবককে বললেন, ‘তোমার নাম চন্দ্র? উপবেশন করো৷’
চন্দ্র গালিচার একপ্রান্তে বসলেন৷ তখন আলেকজান্ডার বললেন, ‘তোমার চেহারা দেখে তোমাকে ক্ষত্রিয় বলে হয়৷ অথচ তুমি যুদ্ধ কর না৷ আবার যুদ্ধবিদ্যা সম্বন্ধে তোমার বিলক্ষণ জ্ঞান আছে দেখছি৷ এ সবের মানে কী?’
চন্দ্র বললেন, ‘সম্রাট, তবে শুনুন৷ আমি মগধের রাজপুত্র৷ আমার ভাগ্যদোষে এক ক্ষৌরকার পুত্র ন্যায্য-সিংহাসন ভোগ করছে, আমি তক্ষশিলায় পালিয়ে এসেছি৷ তক্ষশিলায় আমার গুরু থাকেন৷ তিনি জাতিতে ব্রাহ্মণ হলেও যুদ্ধবিদ্যা ও রাজনীতিতে মহা পণ্ডিত৷ তিনি আমাকে বললেন, যদি যুদ্ধবিদ্যা শিখতে চাও, যবন সম্রাটের রণকৌশল প্রত্যক্ষ করো৷ তাই আজ আমি যুদ্ধ দেখতে এসেছিলাম৷’
আলেকজান্ডার বললেন, ‘বুঝলাম, তুমি রণকৌশল শিক্ষা করে তোমার রাজ্য জয় করতে চাও৷ কিন্তু আজকের যুদ্ধ দেখে যুদ্ধবিদ্যা কতখানি শিখেছ বলো দেখি?’
চন্দ্র উদ্দীপ্ত চক্ষে চেয়ে বললেন, ‘সম্রাট, আজ আপনার যুদ্ধ দেখে এই শিখেছি যে, যুদ্ধের কোনো বাঁধাবাঁধি নীতি নেই, অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করাই যুদ্ধের নীতি৷ পুরু মহাবীর কিন্তু তিনি বিধিবদ্ধ রণনীতি পদে পদে অনুসরণ করেছিলেন, তাই তিনি হেরে গেলেন৷’
আলেকজান্ডারও উদ্দীপ্ত হয়ে বললেন, ‘তুমি ঠিক ধরেছ৷ যুদ্ধ সতরঞ্জ খেলা নয়, জীবন-মরণের খেলা; এখানে নিয়মের কোনো মূল্য নেই, নিয়ম ততটুকুই দরকার যতটুকু যুদ্ধজয়ে সাহায্য করবে৷ আমার মূলমন্ত্র হচ্ছে মারি অরি পারি যে কৌশলে৷’
চন্দ্র বললেন, ‘আজ আমি সে-শিক্ষা পেয়েছি৷ ভারতবর্ষে এ-শিক্ষা নেই, এখানে যুদ্ধের চেয়ে যুদ্ধনীতি বড়ো৷ জয়-পরাজয়ের উপর যে দেশের সুখ-দুঃখ নির্ভর করে, একথা ভারতবাসী ভাবে না৷ আজ আপনার কাছে যে-শিক্ষা পেলাম, তার বলে আমি মগধ জয় করতে পারব৷ আপনি আমাকে অন্ধ সংস্কারের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছেন৷’
আলেকজান্ডার একটু হেসে বললেন, ‘ভালো, ভালো৷ কিন্তু একটা কথা আছে৷ আমিও যে মগধ জয় করতে চাই৷’
চন্দ্রের মুখে উৎকন্ঠার ছায়া পড়ল, তিনি বললেন, ‘আপনি কি এখন ভারতবর্ষের দিকেই যুদ্ধযাত্রা করবেন? কিন্তু শুনেছিলাম-‘
‘কী শুনেছিলে?’
‘তক্ষশিলায় জনরব শুনেছিলাম, আপনার সৈন্যদল এখন দেশে ফিরে যেতে চায়, তারা আর পূর্বদিকে এগোতে চায় না৷’
আলেকজান্ডার কিছুক্ষণ চন্দ্রের পানে চেয়ে রইলেন, তারপর বললেন, ‘তুমি অনেক খবর রাখো দেখছি৷ আমার সৈন্যদল বহু যুদ্ধ করে ক্লান্ত হয়েছে একথা সত্য৷ হয়তো উপস্থিত আমি ফিরেই যাব৷ কিন্তু আবার আসব৷ ভারতবর্ষ আমি জয় করতে চাই৷’
চন্দ্র কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন, তারপর আস্তে আস্তে বললেন, ‘আপনি যদি আবার ফিরে আসেন, আবার আমার সঙ্গে দেখা হবে৷’
‘কোথায়?’
‘এই ঝিলম নদীর তীরে৷’
কথার ইঙ্গিত আলেকজান্ডার বুঝলেন, সকৌতুকে হেসে বললেন, ‘বেশ৷ তুমি কেমন যুদ্ধবিদ্যা শিখেছ হাতে-কলমে তার পরীক্ষা হবে৷’
আলেকজান্ডার এতক্ষণ সুরার পাত্রটি হাতে ধরে ছিলেন, পান করেননি৷ এখন সেটি চন্দ্রের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘বন্দি হলেও তুমি রাজপুত্র, তোমাকে সমুচিত সম্ভাষণ করা হয়নি৷ এই নাও৷’
চন্দ্র হাত জোড় করে বললেন, ‘ক্ষমা করবেন, আমি মদ খাই না৷’
আলেকজান্ডার অবাক হয়ে বললেন, ‘সেকী! রাজপুত্র তুমি, মদ খাও না?’
‘না সম্রাট৷ শৈশব থেকে আমার জীবন বড়ো দৈন্যের মধ্যে কেটেছে৷ আমার পিতার যুদ্ধে মৃত্যু হয়, আমি তখন মাতৃগর্ভে৷ আমার মা বনে পালিয়ে গিয়ে আমার জন্মদান করেন৷ সেই বনে অনেক ময়ূর ছিল, তাদের মধ্যে আমি লালিত হই৷ তাই আমার নাম-চন্দ্রগুপ্ত ময়ূরীয়৷ বালকদের সঙ্গে আমি গো-চারণ করতাম৷ তারপর একদিন আমার গুরুদেব দেখা দিলেন৷ তিনি মূল্য দিয়ে রাখালদের কাছ থেকে আমাকে কিনে নিলেন৷ সেই থেকে আমি গুরুর দাস৷ সুরাপানের অভ্যাস আমার হয়নি৷’
আলেকজান্ডার গম্ভীরমুখে শুনলেন; শেষে সুরাপাত্রটি নিজেই নিঃশেষ করে বললেন, ‘তোমার জীবন বিচিত্র৷ এমনি বিচিত্র অবস্থার মধ্যে দিয়েই প্রকৃত মানুষ তৈরি হয়৷ হয়তো আমি যা পারিনি, তুমি তা পারবে৷’
চন্দ্র জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি পারেননি এমন কিছু আছে কি?’
আলেকজান্ডার আর একপাত্র সুরা ঢেলে বললেন, ‘আছে৷ আমি নিজেকে জয় করতে পারিনি৷ এই সুরা-এর কাছে আমি পরাস্ত হয়েছি৷’ বলে এক চুমুকে পাত্র শেষ করে ফেললেন৷
কিছুক্ষণ আর কোনো কথা নেই; আলেকজান্ডার ভ্রূ কুঞ্চিত করে শূন্য পাত্রের দিকে চেয়ে আছেন৷ তাঁর সঙ্গীরা, যাঁরা এতক্ষণ চিত্রার্পিতের মতো বসে কথা শুনছিলেন, তাঁরাও কথা কইলেন না৷
চন্দ্র তখন উঠবার উপক্রম করে বললেন, ‘এবার তবে অনুমতি দিন, আমি যাই৷’
আলেকজান্ডারের চমক ভাঙল; তিনি চন্দ্রের মুখের পানে এমনভাবে চাইলেন, যেন তাঁকে দেখেননি৷ তারপর সহসা উচ্চহাস্য করে উঠলেন৷ ক্ষণিকের জন্য তাঁর মনে যে আত্মগ্লানি এসেছিল তা কেটে গেল৷ তিনি বললেন, ‘যাবে কীরকম? তুমি আমার বন্দি৷’
‘কিন্তু-‘
‘তুমি যা বলবে আমি জানি৷ কিন্তু, যুদ্ধ না করলেও তোমাকে আমি বন্দি করতে পারি, করেছিও, এখন ছেড়ে দেব কেন? কারণ দেখাতে পার?’
চন্দ্র বললেন, ‘কারণ এই যে, আমাকে বন্দি রেখে আপনার কোনো লাভ নেই৷ বন্দিকে খেতে পরতে দিতে হয়, সেটা লোকসান৷’
আলেকজান্ডার হাসতে হাসতে বললেন, ‘লোকসান খুব বেশি নয়, তুমি তো মদ খাও না-‘
এই পর্যন্ত বলে আলেকজান্ডার থেমে গেলেন, তাঁর মাথায় একটা খেয়ালের উদয় হল৷ এইরকম দুষ্ট কৌতুক মাঝে মাঝে তাঁর মাথায় উদয় হত৷ তিনি বললেন, ‘তোমাকে এমনি মুক্তি দেব না, কিন্তু এক শর্তে মুক্তি দিতে পারি-‘
‘কী শর্ত?’
‘তোমাকে মদ খেতে হবে৷ আমি যত পেয়ালা মদ খাব তুমিও তত পেয়ালা খাবে৷ আমি মাটি নেবার আগে তুমি যদি মাটি নাও তাহলে মুক্তি পাবে না, কিন্তু আমি মাটি নেবার পর তুমি যদি পায়ে হেঁটে আমার শিবির থেকে বেরিয়ে যেতে পার, তাহলে তুমি মুক্ত৷ কেউ তোমাকে আটকাবে না৷’
চন্দ্রের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল৷
‘কিন্তু সম্রাট, আমি যে কখনো মদ খাইনি৷’
‘তা আমি জানি না৷ এই শর্ত৷ তুমি যদি হেরে যাও, তোমাকে আমি বন্দি করে নিয়ে যাব-এখান থেকে পারস্য, পারস্য থেকে মিশর, মিশর থেকে ম্যাসিডোনিয়া-রাজি আছ?’
চন্দ্র দেখলেন, এছাড়া মুক্তির আর উপায় নেই৷ তিনি মনে মনে দৃঢ় সংকল্প করলেন, মদ তিনি খাবেন, কিন্তু কিছুতেই নেশা হতে দেবেন না-কিছুতেই না৷ গুরুর কথা তাঁর মনে পড়ল,-বিপদে সংযম সহায়৷
তখন এই অদ্ভুত বাজিখেলা আরম্ভ হল-আলেকজান্ডার তাঁর বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমরা এই বাজির বিচারক রইলে৷ যুবকের যদি জিত হয় তাকে মুক্তি দিয়ো –নিয়ার্কস, তুমি মেপে মেপে দু-জনের হাতে পাত্র দাও৷’
আলেকজান্ডারের বন্ধুদের মধ্যে একজন ছিলেন নিয়ার্কস-বিখ্যাত সেনাপতি৷ তিনি এগিয়ে দু-টি পাত্রে সমান করে সুরা ঢাললেন, দু-জনের হাতে পাত্র দিলেন৷
আলেকজান্ডার এবং চন্দ্র চোখে চোখে চেয়ে পাত্রে চুমুক দিলেন৷
মনের বলে বলীয়ান চন্দ্র গালিচা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, ‘আমি এখন যেতে পারি?’
নিয়ার্কস আলেকজান্ডারের পানে চাইলেন; দেখলেন, আলেকজান্ডার গালিচার উপর গভীর নিদ্রায় অভিভূত৷ সুরার শূন্য ভৃঙ্গারগুলিও কাত হয়ে পড়ে আছে৷ নিয়ার্কস চন্দ্রের দিকে চেয়ে একটু ঘাড় নাড়লেন৷
মনের বলে অবশ দেহকে জয় করে চন্দ্র দৃঢ়পদে শিবির থেকে বেরিয়ে এলেন৷ রাত্রি তখন গভীর৷ ঝিলম নদীর ঠান্ডা বাতাস তাঁর কপালে লাগল৷
মনের বল যার আছে তার কাছে বিষও নির্বিষ হয়ে পড়ে৷
পরদিন সকালে তক্ষশিলায় পৌঁছে চন্দ্র গুরুর পদে প্রণাম করলেন৷
চাণক্য তখন নিজের কুটিরে বসে অর্থশাস্ত্রের পুঁথি লিখছিলেন, সস্নেহে চন্দ্রের গায়ে হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করলেন৷
চন্দ্র বললেন, ‘দেব, যবন-সম্রাটকে আত্মজয়ের যুদ্ধে পরাজিত করে মুক্তি পেয়েছি৷’
সমস্ত কাহিনি শুনে চাণক্য বুঝলেন, শিষ্য জীবন-পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার যোগ্যতা লাভ করেছে৷ বললেন, ‘এবার কী করবে?’
চন্দ্র বললেন, ‘পাটলিপুত্র যাব৷ যবন-সম্রাটকে বলে এসেছি, তিনি যদি আবার ভারত আক্রমণ করতে আসেন, ঝিলমের তীরে আমার দেখা পাবেন৷ তিনি ফিরে আসার আগেই সমস্ত ভারতবর্ষ আমি জয় করব৷ গুরুদেব, আপনি আমার সহায় হোন৷’
চাণক্য বললেন, ‘তথাস্তু৷’
দেবপুত্র কনিষ্কের কথাচিত্রা দেব
কনিষ্কের কথা মনে আছে? কুষাণ সম্রাট দিগ্বিজয়ী বীর কনিষ্ক৷ যাঁর মাথা কাটা মূর্তিটা ইতিহাসের পাতায় অনেকবার চোখে পড়েছে৷ সেই কনিষ্ক৷ ছোটোবেলায় ছবি দেখে খুব দুঃখ হত৷ প্রাচীনকালের অধিকাংশ রাজাই কেমন দেখতে ছিলেন জানা যায় না, সম্রাট কনিষ্কের একটা বড়োসড়ো, সুন্দর মূর্তি মথুরায় যদি-বা পাওয়া গেল, তার মাথাটাই গেল হারিয়ে৷ মূর্তিটা আছে দিল্লির মিউজিয়ামে৷ যাক সে কথা, ওই মূর্তির মতোই রাজাধিরাজ কনিষ্কের জীবনের প্রায় সবটাই আমাদের অপরিচিত৷ এমনকী কে তাঁর পিতা, কে তাঁর সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হলেন, কিছুই জানা যায় না৷ যদিও তিনি মহাপরাক্রমশালী বীর ছিলেন, রোম সাম্রাজ্যে তাঁর দূত গিয়েছিল, রোমানদের মতো তিনি স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন করেন নিজের রাজ্যে এবং ভারতে কুষাণ রাজারাই প্রথম স্বর্ণমুদ্রা চালু করেন, তবু ইউরোপের কেউ তাঁর নাম শোনেনি৷ আর আমরাই-বা কতটুকু জানি তাঁর সম্পর্কে? কনিষ্ক বেঁচে আছেন তিব্বতে, চীন ও মঙ্গোলিয়ার কিংবদন্তিতে৷ বৌদ্ধদের কাছে সম্রাট অশোকের পরেই প্রিয় নাম হচ্ছে সম্রাট কনিষ্ক৷
সত্যিকথা বলতে কি, কুষাণ সম্রাটদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম হচ্ছেন কনিষ্ক৷ তাঁর আগে, দু-জন কুষাণ রাজার নাম শোনা যায়, প্রথম ও দ্বিতীয় কদফেসিসের৷ এঁরা কেউই ভারতের রাজা ছিলেন না৷ মধ্য এশিয়ার অনেক অংশ জুড়ে ছিল কুষাণ সাম্রাজ্য৷ আফগানিস্তান, পাকিস্তান, মঙ্গোলিয়া, তিব্বত ও চীনের কিছু অংশ এবং কাশ্মীর কুষাণ রাজাদের অধীনে ছিল, কনিষ্কের আমলে ভারতের অধিকাংশই চলে যায় তাঁর হাতে৷ ছোটো ছোটো অগুণতি রাষ্ট্র নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করায় কুষাণ সাম্রাজ্য বিস্তার করা সহজ হয়৷
ভীম কদফেসিসের পরে রাজা হন কনিষ্ক৷ সেজন্য তাঁকে দ্বিতীয় কদফেসিসের ছেলে ভাবাই সংগত৷ কিন্তু প্রাচীনকালে লোকে ভাবত কনিষ্ক দৈবশক্তিসম্পন্ন রাজা এবং আসলে একজন ‘দেবপুত্র’৷ সে গল্পও পরে শোনাব৷ কনিষ্কের রাজধানী ছিল পুরুষপুর বা পেশোয়ারে৷ কনিষ্কের রাজত্বকাল নিয়েও সন্দেহ আছে৷ আমরা প্রখ্যাত ঐতিহাসিক দীনেশচন্দ্র সরকার মশাইয়ের মতটা গ্রহণ করতে পারি৷ তাঁর মতে, কনিষ্কের প্রথম রাজ্যবর্ষ থেকেই শকাব্দ আরম্ভ হয়, এই শকাব্দ শুরু হয়েছে ৭৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে এবং এখনও আছে৷ বৌদ্ধ সাধুরা বলেন, চতুর্থ বৌদ্ধ মহাসম্মেলন আহ্বান করেছিলেন সম্রাট কনিষ্ক, কাশ্মীরে৷ আর এখানেই নতুন বৌদ্ধধর্মমত মহাযানবাদ প্রকৃত মর্যাদা পায়৷ কনিষ্ক প্রথম জীবনে মোটেই বুদ্ধভক্ত ছিলেন না৷ এ নিয়ে দু-একটি গল্প শুনিয়েছেন চীনের পরিব্রাজকেরা৷ তাঁরা বলেন, ‘শাক্যমুনি বুদ্ধ একবার শিষ্যদের নিয়ে পুরুষপুরে বেড়াতে আসেন৷ তখন শহরের বাইরে একটা এক-শো হাত উঁচু বিরাট গাছের নীচে বসে প্রিয় ভিক্ষু আনন্দকে বলেছিলেন, আমার নির্বাণের চার-শো বছর পরে কনিষ্ক নামে একজন রাজা এই দেশের রাজা হবেন আর এখানে একটি স্তূপ তৈরি করে আমার অস্থি ও দেহভস্ম সেখানে রাখবেন৷’
সত্যিই কনিষ্ক একদিন রাজা হলেন৷ দেশ জয় করতে করতে পুরুষপুরে এলেনও৷ বিজয়ী রাজারা সবসময় বিজিত দেশের ধনসম্পদ নিয়ে চলে যান৷ কনিষ্ক ঠিক করলেন বুদ্ধের ভিক্ষাপাত্র যা পুরুষপুরের একটি বিহারে রাখা আছে, সেটিও সঙ্গে নিয়ে যাবেন৷ পাত্রটি সাধারণ নয়৷ চাররকম দামি পাথর দিয়ে তৈরি করা৷ চকচকে এই পাত্রে দু-কুনকে চাল ধরে৷ এর বাইরের দিকটা নানা রঙের পাথরে উজ্জ্বল, তবে কালো রং-ই বেশি৷ সাড়ে পাঁচ ইঞ্চি মোটা৷ কিংবদন্তি, গরিব ভক্তেরা সামান্য একটি ফুল দিলেও পাত্র ভরে যায়, ধনীদের লক্ষ লক্ষ পুষ্পের ডালি দিয়েও পাত্র ভরা যায় না৷ কনিষ্ক এমন একটি অদ্ভুত জিনিস স্বদেশে নিয়ে যাবার প্রলোভন ত্যাগ করতে পারলেন না৷ বৌদ্ধ না হলেও কোনো ধর্মের প্রতি তাঁর বিদ্বেষ ছিল না৷ কারও ধর্মেও হস্তক্ষেপ করতেন না৷ রাজার ইচ্ছেয় কে বাধা দেবে? আর দিলেই-বা নিরস্ত্র ভিক্ষুদের কথা শুনছে কে? নির্দিষ্ট দিনে একটি সাজানো থালার ওপরে ভিক্ষাপাত্র নিয়ে একটি হাতির পিঠে চাপানো হল, সঙ্গেসঙ্গে কী আশ্চর্য! হাতিটি সেখানে বসে পড়ল, তাকে কিছুতেই ওঠানো গেল না৷
‘ঠিক আছে৷’ কনিষ্ক বললেন, ‘গাড়ি নিয়ে এসো৷’
এলো চার চাকার রথ৷ ভিক্ষাপাত্র তার ওপরে রেখে গাড়িতে জুড়ে দেওয়া হল আটটি মহাশক্তিশালী হাতি৷ কিন্তু এবারেও সেই একই ঘটনা ঘটল৷ হাতিরা হাজার চেষ্টা করেও গাড়িটি নড়াতে পারল না, চাকাও ঘুরল না৷ এবার কনিষ্ক নিজের ভুল বুঝতে পারলেন৷ বুঝলেন বুদ্ধের ভিক্ষাপাত্র গ্রহণ করার উপযুক্ত সময় এখনও আসেনি, তিনি সেখানেই একটি স্তূপ ও বিহার তৈরি করে দিলেন৷ সেখানেই হল তাঁর রাজধানী৷
একদিন ঘুরতে ঘুরতে কনিষ্ক দেখলেন, একটা ধবধবে সাদা খরগোশ লাফাতে লাফাতে যাচ্ছে৷ ভারি সুন্দর দেখতে৷ তিনি তখনই তার পিছু নিলেন, শিকার করবেন কিংবা জ্যান্ত ধরবেন বলে৷ খরগোশটা ছুটতে ছুটতে এসে শ্রীবুদ্ধ যে গাছের তলায় বসে কনিষ্কের কথা বলেছিলেন, সেখানে হারিয়ে গেল৷ কনিষ্ক অবাক৷ এদিক-ওদিক খুঁজছেন, হঠাৎ দেখেন, একটি রাখাল ছেলে আপনমনে একটা ছোট্ট স্তূপ তৈরি করছে৷ কনিষ্ক তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘খোকা কী করছ?’ ছেলেটি বলল, ‘আমি স্তূপ তৈরি করছি৷ তথাগত বলেছিলেন, একজন বিজয়ী রাজা একটা স্তূপ তৈরি করবেন৷ আমি তোমাকে সেকথা মনে করিয়ে দিচ্ছি৷’
কনিষ্ক শুনে খুশি হলেন৷ বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি এই স্তূপটিকে ঘিরে একটি বড়ো স্তূপ তৈরি করব৷’ এদিকে রাজার স্তূপ যত বড়ো হয়, রাখালের স্তূপ আপনা-আপনি উঁচু হয়৷ কনিষ্ক আবার বুঝতে পারলেন দেবতার ইচ্ছের কাছে নত হতে হয় তাই তিনি স্তূপ উঁচু করা বন্ধ করলেন৷ ইতিহাস বলে, দু-টি স্তূপই তৈরি করেছিলেন কনিষ্ক, মধ্যেরটি চার-শো হাত উঁচু, লোকে একে বলত ‘কনিষ্ক চৈত্য’৷
বৌদ্ধধর্ম নিয়ে কনিষ্ক পাঠ ও আলোচনা শুরু করলেন, কিন্তু দেখলেন, নানা মুনির নানা মত৷ এক-একজন আচার্য এক-এক রকম বৌদ্ধধর্মের কথা বলেন৷ তা হলে আসল কোনটা? সত্যি সত্যি বুদ্ধ কী বলতে চেয়েছিলেন? একজন সাধু বা অর্হৎকে তিনি প্রশ্ন না করে আর পারলেন না৷
অর্হৎ পার্শ্ব বললেন, ‘বুদ্ধের নির্বাণের পর অনেক বছর কেটে গেছে, কাজেই তিনি কী বলেছিলেন, আজকের আচার্যেরা তা জানেন না৷ এঁরা নিজেদের গুরুর কাছে যা শুনেছেন তাই বলেছেন৷’
শুনে কনিষ্ক খুব দুঃখ পেলেন এবং এক ধর্মমহাসভা ডাকবার ব্যবস্থা করলেন, যাঁরা ত্রিপিটক চর্চা করে প্রকৃত সত্য কী তা জানাতে পারবেন৷ হলও তাই৷ কাশ্মীরে এই সভা হল৷ বসুমিত্র সভাপতি৷ পাঁচ-শোজন যতি বা ত্রিপিটক বিশেষজ্ঞ বহু শ্লোক রচনা করলেন৷ তারপর কনিষ্ক তাম্রপত্রে এই শ্লোকগুলি খোদাই করে একটি স্তূপের মধ্যে রেখে দিয়ে নিজের দেশে ফিরে গেলেন৷ যাবার সময় কাশ্মীরের পশ্চিমদ্বার থেকে বেরিয়ে পুব দিকে মুখ করে হাঁটু গেড়ে বসে রাজ্যটি ভিক্ষুদের দান করে গেলেন৷ তিব্বতে এবং চীনে কনিষ্ক বৌদ্ধধর্ম প্রচারের ব্যবস্থা করেন৷ বিখ্যাত সিল্করোড বা চীন থেকে পারস্য পর্যন্ত যে বাণিজ্যপথটি ছিল, সেই পথটির ধারে ধারে তৈরি হল অনেক বৌদ্ধ স্তূপ৷ মূর্তি গড়ায় কনিষ্কের উৎসাহ ছিল, তাঁর সময়েই যে অনেক জায়গায় বুদ্ধের মূর্তি তৈরি হয় তার প্রমাণও আছে৷ তাই ‘দেবতাদের প্রিয় অশোক’ ও ‘দেবপুত্র কনিষ্ক’ বৌদ্ধদের এত প্রিয় ছিলেন৷
কণিষ্কের দৈবক্ষমতার গল্প শুনিয়েছেন আর একজন, তিনি হচ্ছেন আলবেরুনি৷ সেও বেশ মজার গল্প৷ কনিষ্ক তখন দিগ্বিজয়ী রাজা৷ নানা দেশ থেকে রাজারা উপহার পাঠান৷ এমনিতে কনিষ্ক বেশ ভালো লোক ছিলেন৷ সাধারণ মানুষ তাঁকে দেবতার মতো ভক্তি করে৷ একবার কান্যকুব্জরাজ তাঁকে কিছু উপহার পাঠালেন৷ তার মধ্যে ছিল একটা সুন্দর কাপড়৷ সম্রাটের মনে হল, এত সুন্দর কাপড় তিনি দেখেননি৷ ভারতবর্ষের কাপড় বিখ্যাত৷ কনিষ্ক তাড়াতাড়ি তাঁর নিজস্ব দরজিকে ডেকে পাঠালেন, সেই কাপড়ের একটা রাজপোশাক তৈরি করাবেন বলে৷ রাজ্যের সেরা দরজি এসে দাঁড়াতেই তিনি বললেন, ‘সূচিক, তুমি যত শীঘ্র সম্ভব এই কাপড় দিয়ে আমার পোশাক তৈরি করে দাও৷’ দরজিকে সেকালে বলা হত সূচিক৷
এক সপ্তাহ কেটে গেল৷ সম্রাট প্রতিদিন ভাবছেন আজ তাঁর নতুন পোশাক আসবে৷ পোশাক আর আসে না৷ কী হল? পাইক-পেয়াদা পাঠিয়ে সূচিককে ধরে আনা হল৷ বলল, ‘মহারাজ রক্ষা করুন, আমি নির্দোষ৷ আমি কোনো অপরাধ করিনি৷’
‘তোমার স্পর্ধা তো কম নয়৷ আমার পোশাক কই? সাতদিনেও তৈরি হল না?’
‘প্রভু, আমি মরে গেলেও এই কাপড় দিয়ে আপনার জামা তৈরি করতে পারব না৷’
‘তার মানে’
‘মহারাজ, কাপড়খানি মহামূল্যবান কিন্তু এর এক জায়গায় দু-টি পায়ের ছাপ আছে৷ যেভাবেই কাটি না কেন ওই মানুষের পায়ের ছাপ দু-টি পড়বে কাঁধের ঠিক নীচে৷ বহু চেষ্টা করেও তাই আমি আপনার পোশাক তৈরি করতে পারিনি৷’
কনিষ্ক বুঝতে পারলেন ব্যাপারটা৷ কান্যকুব্জের রাজা কৌশলে তাঁর পিঠে পদাঘাত করেছেন৷ রাগে সর্বাঙ্গ জ্বলে গেল৷ দরজিকে ছেড়ে দিয়ে তিনি সেনাপতিকে সেনা সাজাতে বললেন৷ এই অপমানের উত্তর দিতেই হবে৷
রাজাধিরাজ কনিষ্ক সসৈন্যে ভারতের দিকে যাত্রা করেছেন শুনে ঘরে ঘরে হাহাকার পড়ে গেল৷ কান্যকুব্জের রাজা শুকনো মুখে মন্ত্রীর কাছে এলেন, ‘মন্ত্রীমশাই, সর্বনাশ হয়েছে৷ আমি ধনেপ্রাণে মারা যাব৷ কনিষ্কের হাত থেকে আপনি বাঁচান৷’
বৃদ্ধ মন্ত্রী সব শুনে চটে গিয়ে বললেন, ‘মহারাজ, আপনি সর্বনাশ করেছেন৷ একজন শান্তশিষ্ট রাজাকে রাগিয়ে দিয়েছেন৷ কনিষ্ককে পায়ের ছাপ আঁকা কাপড় পাঠানো খুব অন্যায় হয়েছে৷’
‘যা হয়ে গিয়েছে, তার তো কোনো উপায় নেই৷ একটা ভুল করে ফেলেছি, এখন পারেন তো আমাকে বাঁচান৷’
মন্ত্রী বহুক্ষণ ভাবলেন৷ কনিষ্কর সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রশ্নই ওঠে না৷ শেষে বললেন, ‘যা বলি শুনুন৷ আপনি আমার নাক-কান কেটে আমাকে বিকলাঙ্গ করে দিন৷ তারপর দেখি কী করতে পারি!’
প্রিয় মন্ত্রীর নাক-কান কাটতে রাজার খুব খারাপ লাগল৷ কিন্তু কী করবেন? নিজের ধনপ্রাণ বাঁচাবার জন্যই তাঁকে এখন মন্ত্রীর কথা শুনতে হল৷ মন্ত্রীকে সেখানে ফেলে রেখে রাজা রাজ্যের অন্য জায়গায় গিয়ে লুকিয়ে রইলেন৷ বিকলাঙ্গ মন্ত্রী যাত্রা করলেন কনিষ্কের পথে৷ পথেই দেখা হল রাজার সেনাবাহিনীর সঙ্গে৷ তাঁরা তাঁকে ধরে নিয়ে গেল কনিষ্কের কাছে৷ কনিষ্ক জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে তুমি? এখানে কী করছ? তোমার অবস্থাই বা এরকম হল কী করে?’
মন্ত্রী বললেন, ‘রাজাধিরাজ, আমি চিরদিন আমার প্রভু কান্যকুব্জরাজকে সুপরামর্শ দিয়ে এসেছি৷ বলেছি সম্রাট কনিষ্কের আনুগত্য স্বীকার করতে, কিন্তু তিনি তা শোনেননি৷ আপনার পক্ষপাতি বলে তিনি আমাকে দেখতে পারতেন না৷ এখন আপনি রাজ্য আক্রমণ করবেন জানতে পেরে আমাকে রাজদ্রোহের শাস্তি দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছেন৷ আমি অপমানের প্রতিশোধ নিতে চাই, তাই আপনার কাছে এসেছি৷’
কনিষ্ক বললেন, ‘শীঘ্রই তোমার মনোবাসনা পূর্ণ হবে৷ আমি কান্যকুব্জরাজকে যমালয়ে পাঠিয়ে কান্যকুব্জ অধিকার করব৷’
‘আপনার জয় হোক,’ বলে হাতজোড় করে নমস্কার করে মন্ত্রী বললেন, ‘কিন্তু তা তো হবার নয়!’
‘কেন?’
‘আপনার আগমন সংবাদ পেয়ে তিনি রাজ্যের বাইরে এক গুপ্ত জায়গায় পৌঁছেছেন৷ সেখানে সহজে পৌঁছোবার একটা মাত্র দুর্গম পথ আছে, মরুভূমির মধ্যে দিয়ে৷’
‘বেশ তো, তাই যাব৷ সঙ্গে নেওয়া হবে প্রয়োজনীয় পানীয়৷ তুমি পথ দেখিয়ে নিয়ে চলো৷’
মন্ত্রী কনিষ্ককে এক বিশাল মরুভূমিতে নিয়ে গেলেন৷ পথ আর ফুরোয় না৷
নির্দিষ্ট দিন এল৷ পানীয় জল ফুরোল৷ ধু-ধু মরুভূমি ফুরোয় না৷ কনিষ্ক কান্যকুব্জর মন্ত্রীকে ডেকে পাঠালেন৷ বললেন, ‘তুমি পথ ভুল করনি তো?’
মন্ত্রী হেসে বললেন, ‘রাজাধিরাজ, শত্রুশিবির দূরে বটে, কিন্তু আপনার সর্বনাশের সময় এসে গেছে৷ আমরা মরুভূমির মাঝখানে এসেছি৷ এখান থেকে প্রাণ নিয়ে কেউ ফিরতে পারে না৷ জলাভাবে আপনারা সকলে মরবেন৷ এখন আমাকে যা শাস্তি দেবার দিন৷ আমি বিশ্বাসঘাতক মন্ত্রী নই৷’
কনিষ্ক সব বুঝতে পারলেন৷ তাঁর সেনাদলে হাহাকার পড়ে গেল৷ কিন্তু কনিষ্ক একা বেরিয়ে পড়লেন একটা বর্শা হাতে, ঘোড়ার পিঠে চেপে৷ ঘুরতে ঘুরতে একটা নীচু জমি দেখতে পেয়ে তিনি সেখানে গিয়ে বর্শা দিয়ে প্রচণ্ড আঘাত করলেন৷ অনেকখানি বর্শা বিঁধে গেল আর সম্রাট দেখলেন, একটা জলের রেখা বেরিয়ে আসছে৷ সবাই দেবানুগৃহীত রাজার জয়ধ্বনি দিল৷
মন্ত্রী বললেন, ‘মহারাজ, আপনি দৈবশক্তির অধিকারী৷ দেবতার সঙ্গে আমি ছলনা করতে চাইনি, মানুষের বিরুদ্ধেই কূটকৌশল প্রয়োগ করেছি৷ আমাকে এবং আমার প্রভুকে যা শাস্তি দেবার হয় দিন৷’
কনিষ্ক হেসে তাঁর প্রভুভক্তির প্রশংসা করে তাঁকে মুক্তি দিয়ে বললেন, ‘আমি পুরুষপুরে ফিরে যাচ্ছি৷ তোমার প্রভুভক্তির প্রশংসা করি, কিন্তু তোমার প্রভু উপযুক্ত শাস্তিই পেয়েছেন৷’
কনিষ্ক দেশে ফিরলেন৷ মন্ত্রীও কান্যকুব্জে ফিরলেন৷ ফিরে দেখেন, যেদিন কনিষ্ক জলের জন্য মাটিতে বর্শা পুঁতেছিলেন সেদিনই রাজার দেহ থেকে হাত-পা খসে পড়ে গেছে৷ বুঝলেন, দেবতাই তাঁকে শাস্তি দিয়েছেন৷
সম্রাট কনিষ্ক এভাবেই বেঁচে আছেন কিংবদন্তি আর লোককথার মধ্যে৷