ঝিমলির সবুজ চোখ

ঝিমলির সবুজ চোখ

বরাদ্দ মাংসটা ব্যাগে নিয়ে বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে এমনিই একটু শীত করে উঠল ভজনের। এমনিতেই হেমন্তের শেষ, শীত আসি আসি করছে, ফলে শীত না করার কোনো কারণ নেই। তবে কিনা আধঘণ্টা আগেও একবার বেরিয়েছিল ভজন, তখন কিন্তু এত ঠান্ডা ছিল না।

ছেঁড়া শালখানা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ব্যাগের মধ্যে মাংসের টুকরোটা জড়িয়ে বগলের দিকে চেপে রাখল ও। পাক, একটু ওম পাক ব্যাটা। সিদ্ধ হতে সুবিধাই হবে। এটার সুরুয়া নাকি তন্দুরই বেস্ট হবে হরিয়ার হাতরুটির সঙ্গে? দোনামনা করতে করতে নিজের মনেই সুরুয়ার ওপর ভোট দিয়ে ফেলে ও।

হরিয়ার দোকান সামনেই, ফাঁকাই ছিল আজ। “কী বে চুতিয়ে, তোর দুকান বিলকুল ফাঁকা দেখছি যে আজ?” বলে হরিয়ার দোকানের সামনে রাখা বয়াম খুলে একটা বাসি নিমকি তুলে চিবোতে থাকে ভজন। আড়চোখে সেদিকে তাকায় হরিয়া, মনে মনে খিস্তি করে একটা। এই শুয়োরের বাচ্চা খোট্টাটা ব্যাবসা দেয় বটে, তবে ওর খাল খিঁচে নেয় এইভাবেই। ভেবেই মেজাজটা ফের টকে যায় হরিয়ার এমনিতেই শীতের সময় একঝটকায় কাস্টমার প্রায় আদ্ধেক হয়ে যায়। তার ওপর দোকানের এটা সেটা ফ্রি-তে খেয়ে গেলে কারই বা ভালোলাগে?

.

“ভালো মাল পেয়েছিস কিছু আজ?” বিরসবদনে রুটি সেঁকতে সেঁকতে প্রশ্ন করে হরিয়া।

“হাঁ বে, বিলকুল চুজ্জা মাল পেয়েছি একটা। একেবারে টাটকা।” বলেই কী একটা ভেবে ফিক করে হেসে ফেলে ভজন।

.

“হাসছিস কেন বে?” কীসের যেন একটা গন্ধ পায় হরিয়া, “ঘরে মেয়ে-ফেয়ে আনছিস নাকি আজ?” বলেই গলাটা নীচু করে, “আসব নাকি? পাঁচশোর পাত্তি চলবে তো?”

.

“চল ফোট বে ভিখারি কে অওলাদ,” খিস্তি করে ভজন, “গাঁড় ধোনে কা পানি নেহি, চুতিয়া চলে গঙ্গা নাহানে।” সামান্য টলতে টলতে খিস্তিটা দিয়ে ফেলেই বেশ ফ্রেশ ফিল করে ভজন। বাংলুর নেশাটা ভালোই চড়েছে তাহলে। ভালো দেশি দারুতে তামার পয়সা ঘষে আর ঝুল মিশিয়ে এই ইসপেসাল মালটা তৈরি করে ভজন। এর এক এক গেলাসে অনেক রথী মহারথীকে জমিন ধরিয়েছে ভজন।

.

আজ দোকানে মুরগিটা আসা মাত্তর পছন্দ হয়ে গেছিল ভজনের। অ্যাসিস্ট্যান্ট রহমানকে বলেছিল মালটা ভালো করে ড্রেসিং করে রাখতে, যেন অন্য কাস্টমারকে পয়সা দেখে গছিয়ে না দেয়। শুয়োরের বাচ্চাটা একনম্বরের হারামি, আগেরবার এরকমই ভজনের দেখে রাখা একটা ভালো মুরগা খদ্দের দেখে বেচে দিয়েছিল। সেই রাতে খানকির ছেলেটাকে ল্যাংটো করে বেল্ট দিয়ে চাবকেছিল ভজন। শালা বসের কথা শুনবি না কাস্টমারের?

হরিয়া একটা কাগজের ঠোঙায় চারটে রুটি প্যাক করে দেয়, হাতে তুলে দেওয়ার সময় বেজার মুখে বলে “আড়াইশো টাকা হল তোর। এবার অন্তত একটা পঞ্চাশের পাত্তি ছাড়।”

ফের খিস্তি করে ভজুয়া, “পালিয়ে যাচ্ছি না কি বে? শালা যার সোঙ্গে কোথা বোলি শুধু টাকা টাকা টাকা…” বলেই হরিয়ার দিকে সরু চোখে তাকায় সে।

.

সেই চোখের দিকে একবার তাকিয়ে চুপ করে যায় হরিয়া, চোখ সরিয়ে নেয় সে।

.

ভজন যে মারপিট খুনখারাপি করে তা নয়, সে এমন কিছু লম্বাচওড়া লোকও নয়। কম কথা বলা ঠান্ডা মাথার লোক সে। এক হরিয়া আর রহমান ছাড়া কারও সঙ্গে তার বিশেষ সখ্য নেই। যত চোটপাট খিস্তিখেউড় এদের ওপরেই। তা ছাড়া সারাদিন চুপচাপ নিজের কাজের জায়গায় বসে থাকে সে। লোকজন আসে, ঠান্ডা উদাসীন মুখে কাজকম্ম সারে সে। তারপর বরাদ্দ মাংসের খণ্ডটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। চেঁচামেচি ঝগড়াঝাঁটি খুব একটা করে না, বিরক্ত হলে একটাই কাজ করে ভজন। অপলক চোখে সোজা তাকিয়ে থাকে সামনের দিকে। ঠিক একটা ফণা তোলা কেউটের মতো।

ওই ঠান্ডা চোখ দুটোর মধ্যে এমন কিছু একটা আছে যে সেদিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে লোকের অস্বস্তি হতে থাকে। মনে হয় যেন শিরদাঁড়ায় গুঁড়ো গুঁড়ো বরফ পড়ছে যেন। লোকের মাথার মধ্যে অজান্তেই একটা ভয় চারিয়ে যেতে থাকে। অজানা এক ভয়।

.

ভজনকে লোকে ভয় পায়, খুব ভয় পায়। ভজনের চোখের রং সবুজ।

.

ভাঙা ল্যামব্রেটা স্কুটারটা কাত করে নেয় ভজন, তারপর কিক মেরে স্টার্ট করার চেষ্টা করে। এ বহুত পুরোনো মাল, ভজনের বাবা যখন এখানে চাকরি করত তখনকার। বুড়ি হলে কী হবে, জওয়ানি যায় যায় করেও যায়নি শালির। দু- বার ফলস মারার পর দাঁত চিপে একটা খিস্তি করে ভজন। খুব সম্ভবত সেই অশ্রাব্য খিস্তিটা শুনেই তিনবারের বার চালু হয়ে যায় ইঞ্জিন। পায়ের কাছে একটা ছোটো মতো ক্যারিয়ার বানানো আছে, মাংসের ব্যাগটা সেখানে রেখে ভুটভুট আওয়াজ তুলে বেরিয়ে যায় সে।

.

এই এলাকায় এমনিতেই লোকজন খুব একটা আসে না, তার ওপর শীতের শুরুয়াত। একটু একটু করে কুয়াশা নেমে আসছে রাস্তার ওপর। রাস্তা বিলকুল ফাঁকা। গলি থেকে মিনিট দুয়েক স্কুটার চালালে বড়ো রাস্তা শুরু। মোড়ের মাথার সর্দারজির টায়ার টিউবের দোকানটা সচরাচর রাত দশটা অবধি খোলা থাকে, আজ সেটাও বন্ধ। শুধু পাশের লছমনের পানের দোকানটা খোলা ছিল। টেমির টিমটিমে আলোয় দেখা যাচ্ছিল যে চুপচাপ পাথরের মূর্তির মতো বসে আছে লছমন আর ট্রানজিস্টরে গান ভেসে আসছে ‘তুম ইতনা জো মুসকুরা রহে হো…’

.

মাসখানেক আগে লছমনের বউ দুলারি বাচ্চা হতে গিয়ে মরে গেছে। মহিলার চরিত্র নিয়ে বাজারে কম গুজব উড়ত না, যার বেশিরভাগটাই সত্যি। লছমনের ঘরের মধু অবরে-সবরে ভজনও কম চাখেনি। শেষবারেও তো… আহা… মালটা তোফা ছিল… ভেবেই শীতের মধ্যেও চেগে উঠল ভজন। যেমন নরম তেমনই রসালো ছিল বটে দুলারি।

.

শীতের রাতে স্যাঁতসেঁতে হাই রোড ভজনের স্কুটারে চাকার নীচে সাঁইসাঁই পিছলে যাচ্ছে ক্ষুর ধার দেওয়ার চামড়ার বেল্টের মতো। রাস্তার দু-পাশের ফসলকাটা জমি বাঁজা মেয়েমানুষের ফাঁকা কোলের মতো এলিয়ে শুয়ে আছে। থেকে থেকে একটা ঠান্ডা হাওয়ার ঝলক এসে হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছিল ভজনের, বাংলুর ওমটা কমে আসছিল তার। চারিদিকে অন্ধকার রাত নেমে এসেছে কালো চাদরের মতো। ভজনের স্কুটারের আলোটা মরা মানুষের ঘোলাটে হলদে চোখের মতো রাস্তার ওপর ছলকে ছলকে উঠছিল। রাস্তায় দূর দূর অবধি মানুষ কেন, একটা প্রাণীর চিহ্নমাত্র নেই। সচরাচর এসময় এই রাস্তা কাঁপিয়ে মস্ত মস্ত পাঞ্জাব লরি ছুটে যায়। কিন্তু আজ তাদেরও চিহ্নমাত্র নেই। দু-ধারে ঠান্ডা কালো আকাশ নেমে এসেছে দিগন্ত জুড়ে, আকাশে উজাগর হয়ে রয়েছে কালপুরুষ। তারই মধ্যে ঘটঘট শব্দ করে তারার আলোয় পথ চিনে চিনে চলছিল ভজনের স্কুটার।

.

হালকা একটা শিস দিতে দিতে স্কুটার চালাচ্ছিল ভজন। প্রায় অর্ধেক রাস্তা চলে এসেছে ও। সামনে ফাঁসিবটের মোড় মোড়টা পেরিয়ে জংলাবুড়ির বিল, তার পাশের আলপথ বেয়ে স্কুটার চালালেই আর মিনিট পঁচিশেকের রাস্তার পর ওর বাড়ি।

মনটা প্রফুল্ল হয়েছিল ভজনের, খুব সম্ভবত বহুদিন বাদে এমন চুজ্জা মুরগি পাওয়ার জন্যই হয়তো। সেই প্রফুল্লতায় ডুবে থাকার জন্যই হঠাৎই কোথা থেকে যেন ক্যাঁওওওও আওয়াজ পেয়ে জোর চমকে যায় সে। ক্যাঁঅ্যাঅ্যাঅ্যাচ করে সজোরে ব্রেক কষে ভজন। আওয়াজটা যেন পাশের কালভার্টের নীচ থেকে আসছে কি?

মুহূর্ত খানেকের পরেই ব্যাপারটা বুঝতে পারে ভজন। আওয়াজটা ওর চাকার তলা থেকেই আসছে।

.

স্কুটারটা দাঁড় করিয়ে একটু ঝুঁকে দেখল ভজন। কী একটা যেন ওর চাকার তলায় ছটফট করছে। দ্রুত স্কুটারটা

৫০

পিছিয়ে আনে সে। তারপর স্ট্যান্ড লাগিয়ে উবু হয়ে দেখার চেষ্টা করে কেসটা কী। একটা বেড়ালের বাচ্চা। ওর স্কুটারের নীচে চাপা পড়েছে।

কেমন যেন একটু হতভম্ব হয়ে যায় ভজন। যতই অন্ধকার হোক, একটা বেড়াল বাচ্চা রাস্তা পেরিয়ে ওর গাড়ির চাকার তলা অবধি চলে এল, আর সেটা ওর নজরে পড়ল না? চোখ দুটোর মাথা খেয়েছে নাকি ও? আর-একটু নীচু হল ভজন। আর এইবার নজরে না পড়ার কারণটা নজরে এল ওর।

.

বেড়াল বাচ্চাটা কালো। কালো মানে কুচকুচে কালো। এমন কালো বিড়াল জন্মে দেখেনি ভজন। তবে যেটা দেখে একটু থমকে গেল ও সেটা হচ্ছে বিড়ালটার চোখ।

বিড়ালটার চোখ সবুজ। ঘন সবুজ। ওর চোখের মতোই।

.

সেই অন্ধকার রাতে ক্ষীণ তারার আলোয় জীবনে প্রথমবারের জন্য গা-টা শিরশির করে উঠল ভজনের। তখনও দাঁত খিঁচিয়ে খাবি খাচ্ছিল বেড়ালের বাচ্চাটা। সামনের থাবা দুটো থরথর করে কাঁপছিল ওর, আর গাঢ় সবুজ চোখ দুটো মেলে চেয়ে ছিল ভজনের দিকে।

.

ভজনকে কিছু কি বলতে চাইছিল বেড়ালছানাটা?

.

মাথাটা একবার ঝাঁকিয়ে নেয় ভজন। আজকে মালটা একটু বেশি হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। নইলে এসব বেফালতু ভাবনাচিন্তা ওর মগজে আসার কথাই নয়। বেড়াল মানে বিল্লি, আর কালো বেড়াল মানে কালি বিল্লি। মালের নেশা ছাড়া এই ছটফটানো কালি বিল্লি দেখে ওর এত বিচলিত হওয়ার আর কোনো কারণ থাকতে পারে নাকি?

সোজা হয়ে দাঁড়ায় ভজন। তারপর জুতোর ডগা দিয়ে দলা হয়ে যাওয়া বেড়াল বাচ্চার দেহটা ফুটবলের মতোই দূরে ছুড়ে দেয় ও। ফালতু ঝঞ্ঝাট যত। এসব চুদুরবুদুরে আটকে না গেলে এতক্ষণে বাড়ির কাছাকাছি চলে যাওয়ার কথা ওর।

.

স্কুটারের ক্যারিয়ারে একটা জলের বোতল রাখাই থাকে ভজনের। সেটা বার করে জুতোর ডগাটা ধুয়ে নেয় ও। কুলকুল করে রক্ত ধোওয়া কালো জলের স্রোত রাস্তার ওপর দিয়ে বয়ে যায়। দেখে মনে হয় কেউ যেন পেচ্ছাপ করেছে ওখানে। হি হি করে হাসে ভজন। তারপর ওর মনে পড়ে যে ওরও পেচ্ছাপের বেগ পেয়েছে প্রবল। রাস্তার মধ্যিখানে স্কুটারটা দাঁড় করিয়ে আলের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে প্যান্টের চেনটা খোলে সে।

শেষ হয়েছে কাজ, চেনটা টেনে বন্ধ করবে ভজন, ঠিক এমন সময় একটা কান্না শুনে ঘাড়ের রোঁয়া দাঁড়িয়ে গেল ওর। এখান থেকে ঠিক একটু দূরে একটা মা বেড়ালের কান্নার শব্দ ভেসে এল না? কে যেন ইনিয়েবিনিয়ে সেই খোলা মাঠে কেঁদে বেড়াচ্ছে?

গা-টা শিরশির করে উঠল ভজনের। চেনটা টেনে দ্রুত স্কুটারে চেপে বসে কিক মারল ও। ওর মন বলছিল যে এখানে যেটা ঘটছে সেটা একদম ঠিক নয়। একদম নয়।

.

স্কুটারটা ফুল স্পিডে ছোটাচ্ছিল ভজন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি ফিরতে হবে ওকে। জংলাবুড়ির বিলের পাশের রাস্তা ধরে প্রায় উড়েই যাচ্ছিল ওর স্কুটারটা। ডানপাশ থেকে বিলের জল ছুঁয়ে আসা ঠান্ডা হাওয়া ওর কপালের ঘামের ফোঁটায় খিলখিল করে হেসে উঠছিল যেন। শিরশিরানিটা আরও জমে যাচ্ছিল ওর বুকের মধ্যে।

বিলটা শেষ হয়ে এসেছে প্রায়, কুয়াশা আরও ঘন হয়ে এসেছে, এমন সময় হঠাৎ প্রতিবর্ত ক্রিয়াতেই ক্যাঁঅ্যাঅ্যাঅ্যাচ করে ব্রেক কষতে বাধ্য হল ভজন।

.

বাঁদিক থেকে ডানদিকে রাস্তা পার হচ্ছে একটি যুবতী মেয়ে। সে তার ডান হাতে একটি বাচ্চা মেয়ের হাত ধরে আছে। বাচ্চাটার ডান হাতে আবার পুতুল-টুতুল কিছু একটা হবে, বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে আছে। রাস্তার প্রায় মাঝখানে চলে এসেছিল দুজনে, আর-একটু হলেই ভজন ওদের ওপর ভিড়িয়ে দিচ্ছিল প্রায়। স্কুটারের চাকাটা একটু স্কিড করে যেতে খিস্তি দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে ভজন।

আর বোধহয় সেই শুনেই ডানদিকে ঘাড়টা ঘুরিয়ে তাকাল মেয়েটি। সেইদিকে তাকিয়ে পাথর হয়ে যায় ভজন।

এমন বীভৎস কুচকুচে কালো রং যে কোনো মানুষের গায়ের হতে পারে সে কোনোদিনও ভাবেনি ভজন। তার মনে হল কেউ যেন একদলা পিচ পিটিয়ে পিটিয়ে তৈরি করেছে এই মেয়েটার শরীর। মাথার মধ্যে সেই পিচের দলা পেটানোর শব্দটাও শুনতে পাচ্ছিল ভজন। যেটুকু তারার আলো চুঁইয়ে পড়ছিল আকাশ থেকে, সেসব শুষে নিচ্ছিল মেয়েটির অবয়ব। তবে তাতেও ভয় পায়নি ভজন, ভয় পেল যেটা দেখে সেটা হচ্ছে মেয়েটার চোখ দুটো।

.

মেয়েটার চোখের জায়গায় চোখ আছে বটে, কিন্তু সে দুটো মাটির সমান্তরাল নয়।

সে দুটো লম্বালম্বি বসানো!

আর কপাল থেকে গাল অবধি নেমে আসা সেই চোখে ভেতর দুটো খালি! একেবারে খালি!

.

ভেতরে ভেতরে কাঁপুনি শুরু হয়ে গেছিল ভজনের। সেইদিকে অপলক চোখে তাকিয়ে ছিল সে। তার মধ্যেই বাচ্চা মেয়েটাও ডানদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল তার দিকে।

আর কেন জানি না ভজনের মনে হল যে ঘাড়টা ঘুরল না, শুধু মাথাটা এদিকে ঘুরে গেল! বাচ্চাটার চোখ দুটো অবশ্য ঠিকঠাকই ছিল, কিন্তু সে দুটোর ভেতরেও একমুঠো অথই অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেল না ভজন।

যেতে যেতে দাঁড়িয়ে পড়ল বাচ্চাটা, আর তারপর তার ফেটে যাওয়া রক্তমাখা ঠোঁট দুটো হাসির ভঙ্গিমায় দু-দিকে বেঁকে গেল। বাচ্চাটা হাসছে!

সেই হাসি যেন ঠান্ডা করে দিল ভজনের প্রতিটা রক্তবিন্দু। থরথর করে কাঁপছিল তার হাত-পা। বিন্দু বিন্দু ঘাম নেমে আসছিল সারা শরীর জুড়ে। বুকের মধ্যে হাপর টানছিল কেউ আর হাজার ড্রাম বাজছিল। আর তাকিয়ে থাকতে পারল না ভজন, চোখের পাতা দুটো ভারী হয়ে নেমে এল ওর।

ভজনের মনে নেই কতক্ষণ চোখ দুটো বুজেছিল সে। কিছু পরে চোখ খোলে ভজন।

কেউ নেই। কেউ কোত্থাও নেই।

.

কাঁপা কাঁপা হাতে পকেট থেকে রুমাল বার করে ঘাম মোছে ভজন। বুঝতে পারে যে রগের শিরা দপদপ করছে তার। কান দুটো গরম হয়ে আছে আগুনের মতো। বুকের ভেতর ড্রাম পেটানোর আওয়াজটা তখনও কমেনি তার। হাত- পা তখনও একটু একটু কাঁপছে। কোনোমতে জলের বোতলটা তুলে মুখে চোখে জলের ঝাপটা দেয় ভজন।

ঠান্ডা জলের ঝাপটায় খানিকটা প্রকৃতিস্থ লাগে তার। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কিছুক্ষণ বিড়বিড় করে ভজন, তারপর নিজের গালে নিজেই দুটো থাপ্পড় মারে। নাহ, এত নেশা আর কখনোই করবে না ভজন। ঘাট হয়েছে তার। টাটকা লিভার ফ্রাইয়ের লোভে লোভে ফুল বোতল খালি করে দেওয়াটা একদমই উচিত হয়নি। তার ওপর কী যেন একটা ফুঁকছিল আজ?

আহ, এইবার বুঝল ভজন। রহমান ওর কোনো দেশোয়ালি ভাইয়ার কাছ থেকে ভালো কোয়ালিটির গাঁজা গেঁড়িয়েছিল কিছু। দুটো মিলেমিশেই আজ এই অবস্থা। সেই জন্যই চোখে এইসব ভুলভাল দেখছে ও।

.

নিজেকে বোঝালো বটে ভজন, কিন্তু কোথাও যেন একটা ধন্ধ তার মনের মধ্যে কাঁটার মতো খচখচ করতে লাগল।

বাচ্চা মেয়েটাকে খুব চেনা চেনা লাগছিল ভজনের। কোথায় যেন দেখেছে ও?

.

গাড়ি চালাতে চালাতে ভাবছিল ভজন। কোথায় যেন সদ্য দেখেছে বাচ্চাটাকে? নেশার ঘোরে স্মৃতিটা একটু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল তার। মুখটা তাকে বিব্রত করছিল খুব। ভজন কোথায় দেখেছে এই মুখ?

.

বাড়ির সামনে স্কুটারটা স্ট্যান্ড করার সময়েও কথাটা ভাবছিল ভজন। অস্বস্তিটা ক্রমশই বেড়ে উঠছিল তার। কোথায় যেন… কোথায় যেন… কোথায় যেন…

.

পাড়ার এককোণে একটা নতুন চারতলা বিল্ডিং, তার একতলাটা ভাড়া করে থাকে ভজন। বাকি বিল্ডিং-এর পুরোটাই ফাঁকা। অন্য ফ্লোরে কেউ আসেনি এখনও। তবে সেসব নিয়ে বিশেষ চিন্তা করে না ভজন। চিরকালই নির্জন নিরিবিলি পছন্দ করে এসেছে ও, তাতে ওর কাজের সুবিধাই হয়। স্কুটারটা স্ট্যান্ড করায় দরজার সামনে। তারপর চাবি দিয়ে দরজা খোলে ভজন। পাল্লা দুটো হাট করে খুলে যায় আর, ঠিক সেই সময়েই মেঝের ওপর পড়ে থাকা জিনিসটা নজরে পড়ে ওর। ওটা আবার কী?

টলতে টলতে ঘরে ঢোকে ভজন। ঝুঁকে পড়ে জিনিসটা তুলে নেয়।

জিনিসটা একটা পুতুল, আরও ভালো করে বলতে গেলে একটা মেয়ে পুতুল। বাচ্চারা যেমন পুতুল নিয়ে খেলে তেমনই আর কী। বাঁহাতে পুতুলটা নিয়ে সেটাকে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে ডানহাতে লাইটের সুইচ অন করে ভজন। মাথার ওপর একটা ষাট পাওয়ারের বাল্‌ব ক্লান্তভাবে দুলতে থাকে। অন্যমনস্ক ভাবে সেটা নিয়ে কিচেনে ঢোকে ভজন। তারপর ভালোভাবে দেখতে থাকে।

পুতুলটা কাপড়ের তৈরি, প্রায় আধহাত লম্বা। বুকের জামাটার ওপর বাচ্চাদের হাতের লেখায় বড়ো বড়ো করে ডটপেনের কালিতে লেখা ‘ঝিমলি’। তাতে পুতুলটাকে কিউট দেখানোর কথা, এখন ভীষণ নোংরা দেখাচ্ছে। মনে হয় কে যেন থেঁতলে পিষে কামড়ে বীভৎস অত্যাচার করেছে পুতুলটার ওপর। একটা হাত মোচড়ানো। একটা পা ছিঁড়ে নেওয়া। সারা গায়ে এখানে-ওখানে খোবলানো আর কামড়ানোর দাগ। মাথার একদিকটা ফাটা। মনে হচ্ছে কেউ একটা ডাস্টবিনে ফেলে গেছিল পুতুলটা, আর কুকুর বিড়ালে নিয়ে সেটা নিয়ে কামড়া- কামড়ি করেছে। নোংরা ঘিনঘিনে পুতুলটা দেখে বিরক্ত লাগল ভজনের। কিচেনের জানলাটা খুলল সে, আর তারপর গায়ের সমস্ত জোর দিয়ে যত দূরে সম্ভব ছুড়ে ফেলল পুতুলটাকে।

তারপর জানলাটা বন্ধ করতে যাবে, এমন সময় মনে পড়ল ভজনের, এই যাঃ, মাংসের প্যাকেটটা গাড়িতেই রয়ে গেল যে!

টলতে টলতে সদর দরজা খুলে দু-ধাপ সিঁড়ি নেমে স্কুটারের কাছে এল ভজন। তারপর ঢাকনাটা খুলে ক্যারিয়ারের মধ্যে হাত চালিয়ে দিল সে। খড়মড় করে তার আঙুলগুলো ক্যারিয়ারের চারিদিক ঘুরে চলে এল।

ক্যারিয়ার খালি। কিচ্ছু নেই সেখানে। মাংসের প্যাকেট উধাও!

এইবার মাথাটা গণ্ডগোল হয়ে যায় ভজনের। মাংসের প্যাকেট উধাও হয় কী করে? ঢাকনা দেওয়া ক্যারিয়ার। যতই ঝাঁকুনি লাগুক, সেখান থেকে প্যাকেটটা রাস্তায় পড়ে যেতে পারে না। যেটুকু সময়ের জন্য ভজন বাড়ির ভেতর ঢুকেছিল তার মধ্যে কুকুর বেড়ালের পক্ষেও সেটা নিয়ে যাওয়া অসম্ভ। তাহলে মালটা গেল কোথায়?

প্যান্টের বাঁ পকেটে রামের একটা ছোটো কোয়ার্টার সবসময়ই থাকে ভজনের, বিপদ-আপদের সঙ্গী। এতক্ষণ সেটার কথা মনেই ছিল না ওর। এইবার সেটার কথা মনে পড়াতে বোতলটা বার করে ছিপিটা খুলে পুরো বোতলটা গলায় ঢেলে দেয় ও।

নেশাটা নিভে আসছিল তার। কিন্তু হঠাৎই এই ইন্ধন পেয়ে যেন দাউ দাউ বেগে দ্বিগুণ জ্বলে উঠল তার আচ্ছন্নতা।

.

কিচেনে থুপথাপ করে ফিরে আসছিল ভজন। মাংসের প্যাকেটটা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় মাথাটা দাউ দাউ করে জ্বলছিল তার। এবার কী করবে সে? আজকের রাতটা কী করে চলবে তার? তার ওপর তখনও তার অবচেতনে একটা অস্বস্তি অনবরত তাকে খুঁচিয়ে যাচ্ছিলই। বাচ্চাটার মুখ তার এত চেনা লাগছিল কেন? কোথায় দেখেছে সে এই বাচ্চার মুখ? সেই বেড়াল বাচ্চাটার চোখ এমন সবুজ দেখাচ্ছিল কেন? যে পুতুলটাকে ছুড়ে ফেলে দিল সে, তার চোখই বা…

হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই থেমে গেল ভজন। যেটা তার নেশাগ্রস্ত মাথায় ধরা পড়েনি, সেটা কিন্তু তার সদাসতর্ক অবচেতনে ছাপ ফেলতে ভুল করেনি একেবারেই!

ওই ঝিমলি লেখা পুতুলটার, যেটা কিচেনের বাইরে ছুড়ে ফেলেছে ভজন, তারও চোখদুটো সবুজ। ঘন সবুজ! ঠিক ভজনের মতো!

.

সেই বেড়াল বাচ্চাটার মতো!

.

ভজনের স্নায়ু আর নিতে পারছিল না। দেরাজ খুলে একটা আধখাওয়া বাংলার বোতল বার করে আনে সে। তারপর একটা গ্লাসে ঢেলে হাফগ্লাস নিট বাংলু গলায় চালান করে দেয় সে!

.

মদটা তার গলা জ্বালিয়ে বুকে নামতে নামতেই কিচেনের দিকে হাঁটা দেয় সে। শালা, মালটা রাস্তায় পড়ল কোথায়? আহা, অমন কচি মাংস অনেকদিন জোটেনি ভজনের। আজ ভেবেছিল আয়েশ করে খাবে। একটা ব্যর্থতার রাগ ভেতরে ভেতরে চিতিসাপের বিষের মতো ছড়িয়ে পড়তে থাকে তার মস্তিষ্কের কোশে কোশে।

কিন্তু কিচেনে পৌঁছাতেই চমক! এই তো মাংসের প্যাকেটটা! কিচেন বেডের ওপর!

.

দেখেই ধক করে একরাশ নিশ্চিত খুশি নেমে আসে ভজনের বুকে। যাক বাবা, অনেকগুলো ঝামেলার হাত থেকে রেহাই পাওয়া গেল। আজ রাতে আর অন্য কিছু করে খেতে হচ্ছে না! ভজনের মনে হয় খুশিতে এবার নেচেই উঠবে ও। বাপ রে বাপ, কী টেনশনেই না পড়ে গেছিল সে।

ধীরে ধীরে কিচেন বেডের কাছে এসে দাঁড়ায় ভজন। একটা ট্রে এনে রাখে প্যাকেটটার সামনে। তারপর প্যাকেটটার গার্ডার খুলে ভেতরের মাংস খণ্ডগুলো সড়াৎ করে ট্রে-র ওপর এনে ফেলে।

বাহ বাহ, কাট দেখে মুগ্ধ হয়ে যায় ভজন। রহমানটা দিন দিন হারামি হয়ে উঠলে কী হবে, মাংস কাটাটা ভালোই শিখেছে ওর কাছে। গুরুর যোগ্য চ্যালাই বটে।

মাংস কাটার বড়ো চপারটা সবে হাতে নিয়েছে ভজন, এমন সময়ে দপ করে লোডশেডিং হয়ে যায়।

এই শালা এক মুসিবত এই ব্যহেনচোদ টাউনের, চাপা দাঁতে খিস্তি করে ভজন, থেকে থেকে বিজলি চলে যায়। হাতড়ে হাতড়ে কিচেনের ড্রয়ার থেকে মোমবাতিটা বার করে প্রথমে, তারপর পকেট থেকে লাইটারটা বার করে মোমবাতি জ্বালায় সে।

মোমবাতির আলোয় ভূতুড়ে দেখায় ভজনের দীর্ঘ ছায়া। মাথার ঝাঁকড়া চুলগুলো সাপের লেজের মতো উড়তে থাকে। হাতের চপারটা অনাবশ্যক রকমের দীর্ঘ দেখায়। আর সেই ছায়ার মধ্যে দপদপ করতে থাকে তার লাল লাল চোখ দুটো। ঢুলুঢুলু চোখে খানিকক্ষণ নিজের ছায়ার দিকে চেয়ে থাকে ভজন। বড়ো মোহময় লাগছিল তার নিজের ছায়াছবি। একটা শিরশিরে অনুভূতি ঠান্ডা কেঁচোর মতো তার শিরদাঁড়া বেয়ে বেয়ে নীচের দিকে নামছিল।

চপারটা তুলে নিয়েছিল ভজন, ট্রে-র ওপর রাখা মাংসখণ্ডের ওপর নামিয়ে আনবে। ঠিক তার আগের মুহূর্তে একটা কথা তার মাথায় যেন হঠাৎ হাউইয়ের মতোই জ্বলে উঠে তাকে হতভম্ব করে দিল।

ছায়ার চোখ জ্বলে কী করে? ছায়ার চোখ থাকে নাকি?

প্রশ্নটা এক লাথি মেরে তার মাথার দরজাটা হাট করে খুলে দেয়। অনেকগুলো প্রশ্ন, যেগুলো এতক্ষণ তার মনের অন্ধকার কোণে ঘাপটি মেরে পড়েছিল সেগুলো হুড়মুড়িয়ে তার মাথার মধ্যে ছায়ার মতো ভিড় করে আসে।

ঘরের দরজাটা বন্ধ থাকা সত্ত্বেও ঘরের মধ্যে পুতুলটা এল কোথা থেকে?

পুতুলটা আজকেই কোথায় একটা দেখল না ভজন? কোথায় দেখল যেন?

মাংসের প্যাকেটটা কিচেনে নিজে নিজে এল কী করে? সেই বিড়ালছানাটা থেকে শুরু করে বাচ্চা মেয়েটা, মায় এই পুতুলের চোখ অবধি, সবার চোখ অমন সবুজ হয় কী করে?

বাচ্চা মেয়েটাকে কোথায় দেখেছে ভজন? কোথায়?

হাঁ করে নিজের ছায়ার দিকে চেয়েছিল ভজন। তার ছায়ার চোখ দুটো যেন ক্রমশ আগুনে কয়লার মতো জ্বলে উঠছিল, ঠোঁট দুটো বেঁকে গেছিল অর্ধবৃত্তাকারে।

ছায়াটা তার দিকে তাকিয়ে হাসছিল।

হাসছিল সেই বাচ্চা মেয়েটার মতো!

ঠিক সেই সময়েই কিচেন বেডের ওপর পড়ে থাকা মোবাইলটা খড়খড় করে উঠে তাকে চমকে দেয়। স্ক্রিনের দিকে তাকায় ভজন, সেখানে কোনো নাম্বার নেই। কলটা অ্যাক্সেপ্ট করে মোবাইলটা কানে তোলে ভজন। সতর্কভাবে প্রশ্ন করে, “কে?”

ওপারে কিছুক্ষণের নৈঃশব্দ। তারপর লাইন বেয়ে একটা বাচ্চা মেয়ের ধাতব ক্যানক্যানে গলায় খিলখিল হাসি ভেসে এল, “ও আঙ্কেল, আমাকে বাইরে ফেলে দিলে কেন গো?”

ঘাড়ের রোঁয়া দাঁড়িয়ে গেল ভজনের। ফোনটা ঝট করে কেটে দিল সে। তারপর বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল ফোনের দিকে। কার ফোন ওটা? কে কল করল তাকে?

তার আতঙ্কিত চোখের সামনে ফের বেজে উঠল সেই ফোন।

স্ক্রিনে কোনো নাম্বার নেই।

নিজের সমস্ত ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার হাত যন্ত্রচালিতের মতো এগিয়ে গেল সামনের মোবাইলের দিকে। কল অ্যাক্সেপ্ট করে ঠান্ডা হাতে মোবাইলটা কানে নেয় সে। কপাল থেকে ঘামের ফোঁটা তার গাল বেয়ে নামতে থাকে।

.

“কী হল আঙ্কেল, আমার সঙ্গে খেলবে না? দরজাটা খোলো না আঙ্কেল, আমি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে যে।”

.

দরদর করে ঘামতে থাকে ভজন। সেই ধাতব স্বর যেন তার শরীরের সমস্ত রক্তকণা ঠান্ডা করে দেয়। তার মাথার সমস্ত বোধবুদ্ধি জমে যেতে থাকে মৃত মানুষের বরফ ঠান্ডা ঘিলুর মতো।

ঘোরের মধ্যে হেঁটে হেঁটে দরজার কাছে যায় সে। যন্ত্রের মতো বোধহীন হাতে দরজাটা খোলে সে, দু-হাট করে দেয় পাল্লা।

দরজার বাইরে কেউ নেই। কিছু নেই। হুহু করে হেমন্তের হাওয়া খেলে যায় ভজনের বুকে।

.

দরজা বন্ধ করে ফের কিচেনে আসে সে। বাংলুর বোতলটা গলায় উপুড় করে দেয় প্রায় আদ্ধেকটা। রোমে রোমে অশ্লীল উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে গোপন পাপের মতো। চপারটা থরথর হাতে ফের তুলে নেয় সে। কিমা করতে হবে ।মাংসের টুকরোগুলোকে।

আবার বেজে ওঠে ফোন। তখন বোধহয় ভজনের মস্তিষ্কের সমস্ত কোশগুলো আতঙ্কে আর ভয়ে মৃতপ্রায় হয়ে গেছে। অনুভূতিহীন হাতে মোবাইল তুলে নেয় সে। মোবাইলের ওপার থেকে খিল খিল করে টিনের খেলনার মতো শব্দে হেসে ওঠে কেউ, “ও আঙ্কেল, কোথায় গেলে? আমি তোমার বাড়ির ভেতরেএএএ।”

ফোনটা হাত থেকে পড়ে যায় ভজনের। এদিকে- ওদিকে ছড়িয়ে যায় ফোনের স্ক্রিন আর ব্যাটারি। পাথরের মতো সেদিকে তাকিয়ে থাকে ভজন। তার সাহস হয় না সেগুলো কুড়িয়ে তুলতে। মদের নেশায় চারপাশের সবকিছুই ঝাপসা দেখাচ্ছিল তার কাছে, ছায়া খেলে যাচ্ছিল প্রতিটি বস্তুর চারিপাশে। কিছুই আর স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল না তার কাছে। চপারটা কোথায় আছে সেটা নজরে আসেনি তার। পুরো কিচেন বেডটাই শ্মশানের চুল্লির মতো গলে গলে পড়ছিল যেন ভজনের চোখের সামনে।

দৌড়ে দৌড়ে সারা বাড়ি ঘুরতে থাকে ভজন। কোথায় লুকিয়ে আছে শুয়ার কি বাচ্চি! বেডরুমে যায় ভজন। খোলা জানালা থেকে আদ্ধেক জাগা রাতের আলো চুঁইয়ে এসে পড়ছিল বিছানার ওপর। সেই আলোয় ভজন দেখল সেখানে কেউ নেই! সেখান থেকে বাথরুম। বসার ঘর। পিছনের উঠোন। সোফার নীচে। বিছানার নীচে। বাইরের বারান্দা। উঠোনের বাইরের মাঠ।

ভয়ে আর আতঙ্কে বিচলিত ভজন দাঁতের ফাঁক দিয়ে থুতুর মতো খিস্তি ছেটাতে থাকে। থুতু ছেটাতে ছেটাতে সারা ঘর ঘুরে বেড়াতে থাকে প্রেতের মতো। ভয় আর অসহায় ক্রোধ ছড়িয়ে পড়ে সেই অন্ধকার মোমবাতি জ্বলা ঘরের মধ্যে। কোথায় সেই স্বর? কে বারবার কল করছে তাকে? কেন কল করছে?

ক্লান্ত হয়ে শেষে কিচেনে ফিরে আসে ভজন। ব্যর্থ শিকারি কুকুরের মতো হাঁপাতে থাকে সে। তার মধ্যে মিশে থাকে আতঙ্ক, মিশে থাকে রাগ, মিশে থাকে চোরা ভয়।

ওই তো কিচেন বেডের ওপর মাংসের টুকরোগুলো। পায়ে পায়ে সেদিকে এগিয়ে যায় ভজন। আজ বিকেল থেকে কীসব হচ্ছে তার সঙ্গে? কেন? এতদিন ধরে তো কিছুই হয়নি তার!

.

মাংসের ট্রে-টার সামনে এসে দাঁড়ায় ভজন। তারপর ডানহাতটা বাড়ায় চপারটার জন্য।

.

তার হাতটা খালি ঘুরে আসে সেখান থেকে। চপারটা নেই, উধাও।

.

চপারটা কোথায় গেল, কোথায়? কোথাও ফেলে এল নাকি? খালি জায়গাটার দিকে তাকিয়ে থাকে ভজন। মাথার ভেতরটা খালি হয়ে গেছিল তার।

ঠিক সেই সময় মোবাইলটা ফের বেজে ওঠে মেঝের ওপর থেকে। স্থির চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকে ভজন। মোবাইলটার ব্যাটারি এখনও পড়ে আছে অন্যদিকে। তবুও মোবাইলের নীলাভ স্ক্রিনে ইনকামিং কলের ছবি ভেসে উঠছে, কিন্তু কোনো নাম্বার নেই।

পাথরের মূর্তির মতো নীচু হয়ে মোবাইলটা তোলে ভজন, কল অ্যাক্সেপ্ট করে কানে লাগায় সে।

.

সেই ধাতব খিলখিল হাসি যেন গরম সিসের মতো ভজনের কানে নেমে আসতে থাকে, “কী গো আঙ্কেল, আমাকে ঘরে নিয়ে যাবে না? ঘুরে দেখো, আমি তোমার পেছনেই যে!”

ধীরে, অতি ধীরে পেছনে ঘোরে ভজন।

.

কিচেনের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে একটা বাচ্চা মেয়ে। তার বাঁহাতে একটা কাপড়ের পুতুল ধরা, আর ডানহাতে ধরা একটা মাংস কাটার চপার। ভজনের চপারটা।

.

ডানহাতে চপারটা ধরে, রক্তমাখা ফাটা ঠোঁট দুটো দু- পাশে বাঁকিয়ে হাসতে হাসতে ভজনের দিকে টলটলে পায়ে এগিয়ে আসতে থাকে সেই বাচ্চা মেয়েটা। তার সবুজ চোখ চিনতে ভুল হয় না ভজনের, ভুল হয় না পুতুলটা চিনে নিতে, ভুল হয় ন তার স্কুটারের চাকার নীচে চাপা পড়া বেড়াল বাচ্চাটির চোখের রং চিনে নিতে।

শুধু যেটা দেখে মরণান্তিক ভয়ে স্থির হয়ে যায় ভজন, সেটা হচ্ছে যে এতক্ষণে বাচ্চাটার মুখ মনে পড়ে গেছে তার।

যে রক্তাক্ত মুখের শিশুটি তার দিকে চপার হাতে টলোমলো পায়ে হেঁটে আসছে, সেই এখন বসন্তপুর মর্গের কেয়ারটেকার ভজন দুসাদের বাড়ির কিচেন বেডের ওপর রাখা ট্রেতে শুয়ে আছে খণ্ড খণ্ড মাংসের টুকরো হয়ে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *