ঝিকিমিকি তারা

ঝিকিমিকি তারা

ঝিকিমিকি তারা ওর আকাশ-বাড়ির আঙিনায় চুপ করে বসেছিল, নীলমেঘ ভেসে যেতে-যেতে ডেকে বলল, ‘খরগোশ ভায়া ডেকেছে তোমায় ঝিক্—এক্ষুনি একবার যেতে বলেছে।’

ঝিকিমিকি তারা যেন একটু ঝিমিয়ে পড়েছিল, নীলমেঘের কথায় আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়াল। তারপর হুস্ করে নিচের দিকে নেমে গেল। খরগোশ নীলমেঘকে দিয়ে খবর পাঠিয়ে আকাশের দিকেই হা করে চেয়েছিল। ঝিকিমিকি তারাকে নামতে দেখে ওর মুখ হাসিতে ভরে উঠল। খরগেশের কান দুটোতে আজ মাড় দেবার কথা – মুশকিল হল, খরগোশ একা কাজটা পারে না। যা লম্বা ওর কান— কড়কড়ে করে মাড় বানিয়ে তাতে ঠিকমতো চুবিয়ে সোজা করে তুলে ধরতে পারে না খরগোশ, ঝিকিমিকি তারাই ওকে বরাবর সাহায্য করে। আর ও পারেও নিখুঁত করে কাজ করতে। এমন কড়বড়ে করে মাড় দিয়ে দেবে ও— পুরো সপ্তাহ ধরে খরগোশের কান সটান খাড়া হয়ে থাকবে।

ঝিকিমিকি তারা খরগোশের গর্তের মধ্যে ঢুকে উঠানে এসে দাঁড়াল। খরগোশ আগেই মাড়, ডেকচি, গামলা, তোয়ালে – সব নিয়ে তৈরী। ঝিকিমিকি তারাও কথাটি না বলে ওর সাথে কাজে লেগে গেল। কড়কড়ে মাড় বানিয়ে সবে খরগোশের কান দুটি সাবধানে মাড়ের গামলায় চুবিয়ে ধরেছে, এমন সময় চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে ছুটে এলো ইঁদুর, ‘এই শুনছ, শুনছ, ভালুক ভাইয়ার গুহায় একটা রুগী বেড়াল এসে ঢুকেছে। ভারি অসুখ ওর – দেখবে এসো।’

ঝিকিমিকির আর পরিপাটি করে কাজ করা হল না। কোনোমতে মাড় দেয়া সেরে ও আর খরগোশ দুজনেই দৌড় লাগাল ভালুকের গুহার দিকে। গুহায় ঢুকে দেখে, এককোণায় একটা ছোট্টমতো জীব বসে কাঁদছে। ভালুক ওটার সামনে বোকার মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে— কী যে করবে বুঝতে পারছে না। এরা ঢুকতেই ভালুক বলল, ‘এই অসুখ বেড়ালটাকে রাস্তায় দেখতে পেয়ে তুলে নিয়ে এসেছি। এখন তো এর ঠিকমতো চিকিৎসা হওয়া দরকার।’

খরগোশ ভালো করে দেখে বলল, ‘ওর দেখছি হাম হয়েছে। দেখছ না সারা গায়ে গোটা-গোটা দাগ!’ ইঁদুর বলে উঠল, ‘না না, হাম হবে কেন। বসন্তের গুটি ওগুলো, দেখছ না কেমন মোটা মোটা কালো কালো। হামের গুটি কি এত মোটা হয়?

ঝিকিমিকি তারা এতক্ষণ তাকিয়েই ছিল জানোয়ারটার দিকে, কথাটি বলেনি, এবার ও বলল, ‘এটা বেড়াল না, আর ওর গায়ে হাম, বসন্ত কিছুরই গুটি বেরোয়নি। এটা একটা চিতাবাঘের বাচ্চা। ভাবছি, এইটুকু ছোট বাচ্চা বাড়ি থেকে এদ্দূর এল কী করে? অবাক কাণ্ড!’

ভালুক বলল, ‘আমিও তাই ভেবে অবাক হচ্ছি!’

চিতাবাঘের বাচ্চাটা এতক্ষণে কান্না থামিয়ে বলল, ‘আমি একটা প্রজাপতির পেছনে ছুটতে ছুটতে এতদূর এসে পড়েছি। এখন আর পথ চিনে বাড়ি যেতে পারছিনে।’ বলেই আবার কান্না শুরু করল বাচ্চাটা, হুঁ হুঁ, আমি হারিয়ে গেছি। আমি কেমন করে বাড়ি ফিরব, আমি হারিয়ে গেছি – ‘

ইঁদুর গম্ভীরভাবে বলল, ‘তা তুমি গেছ বটে। এ্যাদ্দিন জানতাম বেড়ালের মতো চিতারাও চালাক-চতুর।

চিতার বাচ্চা কান্নার ফাঁকে ফাঁকেই বলতে লাগল, ‘আমি যে ছো-ছোট্টটি এখনো। চালাক-চতুর হবো কী করে? এত ছোটতে কেউ কখনো চালাক হতে পারে?

খরগোশ বলে উঠল, ‘ও বাবা, জ্ঞান দেখি এদিকে টনটনে।’ এই হতচ্ছাড়া বাচ্চাটার জন্যেই ওর কানের মাড় দেওয়াটা আজ যেমন-তেমন করে সারতে হয়েছে, সেইজন্যে খরগোশ একটু অসন্তুষ্ট চিতার বাচ্চাটার ওপর।

ঝিকিমিকি তারা এ-সব কথায় কান না দিয়ে চিতার বাচ্চাটাকে বলল, ‘তোমায় তো বাড়ি পৌঁছে দেওয়া দরকার। নইলে তোমার বাপ-মা ভাববেন।’

চিতার বাচ্চা হাপুস নয়নে কেঁদে বলল, ‘তা তো ভাববেন, কিন্তু আমি একা বাড়ি ফিরব কেমন করে?’

ঝিকিমিকি বলল, ‘একা ফিরতে হবে না। আমি তোমার সঙ্গে যাব। আমি তোমাদের জঙ্গলটার কাছে নিয়ে যাব, তারপর তুমি গুহা চিনতে পাবে তো?’

চিতার বাচ্চার কান্না থেমে গেল। ও বলে উঠল, ‘তা খুব পারব।’

ঝিকিমিকি তারা বলল, ‘তোমার থাবাগুলো দিয়ে আমার কোমর জড়িয়ে ধরো। শক্ত ধরে করে থাকবে। একবার পড়ে গেলে আর আস্ত থাকবে না। এক্কেবারে ছাতু – বুঝলে?’ বাচ্চাটা ভয়ে ভয়ে বলল, ‘হ্যাঁ বুঝেছি।’ বলে ঝিকিমিকির পিঠের দিকে দাঁড়িয়ে ওর চারটে থাবা দিয়ে ঝিকিমিকির কোমরটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।

ঝিকিমিকি তারা আকাশ-পথ উড়ে চলল। অনেকক্ষণ ধরে, অনেকদূর উড়ে শেষপর্যন্ত চিতাবাঘের আস্তানা যে জঙ্গলটায়, সেই জঙ্গলটায় এসে নামল। বাচ্চাটা খুশি হয়ে বলে উঠল, ‘এইবার চিনে গেছি আমাদের ডেরা। এখন আমি খুব একা যেতে পারব আমাদের গুহায়।’ বলেই দুই লাফে জঙ্গলের মধ্যে উধাও হয়ে গেল।

ঝিকিমিকিও উড়তে যাবে, এমন সময় ওর চারপাশ ঘিরে গর্জন উঠল। ও চমকে তাকিয়ে দেখে ইয়া বড়বড় চিতাবাঘ ওকে চারপাশ দিয়ে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। ওদের বড়বড় ভাটার মতো চোখগুলো জ্বলছে, সেই চোখ দিয়ে কটমট করে চেয়ে মাটিতে লেজ আছড়াচ্ছে।

ঝিকিমিকি তারা চমকে হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সবচেয়ে বড় চিতাবাঘটা গর্জন করে বলে উঠল, ‘কেমনতরো শত্রু তুমি, শুনি?’ ও-টাই পালের গোদা। ওর কথায় সায় দিয়ে আরেকটা বাঘ বলল, ‘এ সাংঘাতিক শত্রু বলেই মনে হচ্ছে। যেমন-তেমন নয়।’ দলের মোড়ল বাঘটা আবার বলে উঠল, ‘কি? কী মতলবে এসেছিলে এখানে? আমাদের বাচ্চা চুরি করতে? তোমার আস্পর্ধা তো কম নয়?’

ঝিকিমিকি তারা ভয়ে হকচকিয়ে উঠল। এমন সময় সামনে কিসের একটা ছায়া পড়ল। ঝিকিমিকি মুখ তুলে দেখে মাথার ওপরেই নীলমেঘ। নীলমেঘ বলল, ‘জলদি উড়ে চলে এসো ঝিক্। ওদের মতলব ভালো নয়। ওরা মারবে তোমাকে মনে হচ্ছে।’

ঝিকিমিকি মাথা ঝাঁকিয়ে বলল ‘উহু, পালাব কেন? আমি তো কোনো দোষ করিনি। বরং উপকারই করেছি। ওদেরই হারানো ছেলে ফিরিয়ে এনেছি। আমি ওদের বুঝিয়ে ছাড়ব।’

নীলমেঘ রেগে বলল, ‘তোমার নিজের বুঝতেই এখনো ঢের বাকি। ওরা বুঝবার আগেই তোমার দফা খতম করে ছাড়বে।’ বলেই নীলমেঘ সাঁ করে উড়ে গেল – শিলা-মেঘ, বাজ-মেঘ, পানি-মেঘ যেখানে জটলা করেছিল সেখানে। গিয়ে ঝিকিমিকির বিপদের কথা বলল ওদের। ওরা তো রেগেই অস্থির। ঝিকিমিকি ভারি ভালো তারা, সবারই উপকার করে বেড়ায়, সেই তারাকে চিতাবাঘগুলো হম্বি-তম্বি করছে এতখানি! উপকারের বদলে? দাঁড়াও, ওদের কেমন শাস্তিটা করি।’ পানি-মেঘ বলে উঠল, ‘বিষ্টির তোড়ে নদী বইয়ে ওদের সবাইকে ভাসিয়ে দেবো এক্ষুনি।

বাজ-মেঘ বলল, ‘বাজের শব্দে ওদের কানে তালা লাগিয়ে দেব— একেবারে জন্মের মতো কালা হয়ে যাবে বাছাধনরা।

শিলা-মেঘ বলল, ‘আর আমি শিলাবৃষ্টি শুরু করে দিই, ওদের মাথা ফুটুক।’

বিজলি-মেঘও সুর মেলাল, ‘আমি ঘন ঘন বিজলি চম্‌কিয়ে ওদের চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দেব— সেই ফাঁকে ঝিকিমিকি উড়ে চলে আসতে পারবে।’

সবাই হুড়মুড় করে জঙ্গলটার ওপরে এসে পড়ল। ওদের রাগের চোটে চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল। সব মেঘ নিজের নিজের কাজ শুরু করতে যাবে, এমন সময় কোথা থেকে সেই ছোট্ট চিতার বাচ্চাটা ছুটে এসে হাজির হল। চেঁচিয়ে বলল, ‘থামো, থামো। এই আমার বন্ধু ঝিকিমিকি। এই তারাটাই আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে। এ না-থাকলে কোথায় যে হারিয়ে যেতাম! তোমরা একে কিছু বলো না

অমনি চিতাবাঘগুলো ঝিকিমিকিকে ছেড়ে সরে দাঁড়াল। তা দেখে শিলা-মেঘ, বাজ-মেঘ, পানি-মেঘ, বিজলি-মেঘ– ওরাও আস্তে আস্তে ভেসে সরে গেল। আবার আকাশ নীল হয়ে উঠল, অন্ধকার দূর হয়ে গেল।

পালের গোদা চিতাটা বলল, ‘তোমাকে শত্রু ভাবার জন্য দুঃখিত আমরা। আমাদের বড্ড ভুল হয়ে গেছে।’

আরেকটা চিতা বলল, ‘ভুল যা হবার তা হয়েই গেছে। এখন এটাকে সংশোধন করা যায় কীভাবে?

ঝিকিমিকি তারা সুন্দর করে হাসল, বলল, ‘আমার এই ছোট বন্ধুটির দিকে একটু ভালো করে নজর রাখবেন, তাহলেই হবে।’

মোড়ল-চিতা গম্ভীরভাবে বলল, ‘হ্যাঁ, তা রাখতেই হবে দেখছি। পরের বার হারিয়ে গেলে ও হয়তো খারাপ লোকের কবলে পড়বে; কিন্তু তুমি বাপু একটুখানি অপেক্ষা কর এখানে, আমি একটু আসছি।’ বলেই মোড়ল জঙ্গলের ভেতর ঢুকে গেল।

ঝিকিমিকি অন্য চিতাগুলোর সঙ্গে দাঁড়িয়ে রইল। ছোট চিতার বাচ্চাটাও ওর হাত ধরে দাঁড়িয়ে রইল। এ-দিকে মোড়লের ফিরতে দেরি হচ্ছে। ঝিকিমিকি উস্ করতে শুরু করল। ওর আবার বাড়ি ফিরতে হবে – মা হয়তো ভাবছেন।

শেষপর্যন্ত মোড়ল-চিতাকে ফিরতে দেখা গেল; কিন্তু ওর সঙ্গে ও কে আসছে? দেখেই তো আর সব চিতাবাঘ সন্ত্রস্ত হয়ে সটান দাঁড়য়ে গেছে এক্কেবারে অ্যাটেনশনে। মোড়ল-চিতা বনের রাজা সিংহের খাস্ মন্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ফিরছে। মন্ত্রী এসে ঝিকিমিকিকে বললেন, ‘আমাদের রাজা আপনার মহত্ত্বের কথা শুনে খুব খুশি হয়েছেন। তিনি আপনাকে নিজের হাতে সোনার মেডেল পরিয়ে পুরস্কৃত করতে চান। তাই আপনাকে এখন একটু মেহেরবানি করতে হবে। কষ্ট করে একটু চলুন রাজ-দরবারে।’

ঝিকিমিকি তারা চলল রাজদরবারের দিকে। তাকে ঘিরে চলল চিতাবাঘের দল। আর ছোট্ট চিতার খুশি দেখে কে! সে তার বন্ধুর হাত ধরে বুক ফুলিয়ে চলল।

রাজ-দরবারে সিংহ-রাজা বসেছিলেন তাঁর পাত্রমিত্র নিয়ে। ঝিকিমিকি তারা যেতেই রাজা একটা সোনার মেডেল পরিয়ে দিলেন তার বুকে। মেডেলটার গায়ে লেখা, ‘বিপন্নের বন্ধু ঝিকিমিকি তারার মহত্ত্বের পুরস্কার – সিংহ রাজার কাছ থেকে।’

মেডিলটা পরিয়ে রাজা বললেন, ‘আপনি যে আমাদের রাজ্যের একটি ছোট্ট চিতার বাচ্চাকে কষ্ট করে গাড়ি ফিরিয়ে দিয়েছেন, তার জন্য আমরা সবাই আপনার কাছে কৃতজ্ঞ।

ঝিকিমিকি তারা বিনয়ে নুয়ে পড়ে রাজাকে কুরনিশ করল। তারপর তার ছোট্ট বন্ধু আর অন্য চিতাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উড়ে চলল আকাশ-পথে – নিজের বাড়ির দিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *