ঝিঁঝোটি দাদরা
পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা যাকে বলে তা কোনােদিন কুড়িয়ে পায়নি শােভনলাল। একবার ভবানীপুরে ট্রাম থেকে দুপুরবেলা নামতেই জগুবাজারের উল্টোদিকের ফুটপাথে সে তিনখানা এক টাকার নােটকে গলাগলি করে শুয়ে থাকতে দেখে। তা প্রায় তিরিশ বছর আগে।
চারদিক তাকিয়ে তখনকার শােভনলাল—বেকার ও প্রেমিক—বাঁ পায়ের স্যান্ডেলের গােড়ালি দিয়ে তিনখানা নােটের ওপরেই পুরাে তিন মিনিট দাঁড়িয়েছিল।
গলি দিয়ে গলি দিয়ে পায়ে হেঁটে তার ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে যাওয়ার কথা। চাকরির পরীক্ষার পড়া। বিকেল হলে অফিস থেকে ইরা আসবে। সন্ধেবেলা লাইব্রেরি ক্যানটিনে দুজনের চা নিয়ে বসার কথা। ফিরবেও এক সঙ্গে দুজনে। শােভনলাল নিচু হয়ে গােড়ালির তলা থেকে ধুলােমাখা নােট তিনখানা তুলে নিয়ে বুক পকেটে রেখেছিল। যেন স্যান্ডেলের খুলে আসা একটা পেরেক তুলে দুরে ফেলে দিয়েছিল শােভন—এমনভাবেই সে আবার উঠে দাঁড়ায়।
বছর পনেরাে আগেও বর্ষা বােঝাই শেষ রাতে শােভন স্বপ্ন দেখত—তার ঘরের বাইরে জানলার ঠিক নীচেই ঘাসের ভেতর কয়েকটা আধুলি, সিকি, কঁচা টাকা পড়ে আছে। কয়েকটা কুড়ােবার পরেই সে দেখতে পেত—আরাে অনেকগুলাে ঘাসের ভেতর ঢাকা পড়ে আছে। শেষে দেখত—অফুরন্ত সিকি আধুলি পড়ে আছে। কুড়িয়ে কুড়িয়ে কেঁচড় ভরে গেল। কুড়ােতে কুড়ােতে রাত ফর্সা হয়ে আসত।
এই আট দশ বছর আগে শােভনলাল যখন টের পেল—সে খুবই অর্ডিনারি, জীবনে বা অফিসে তার কোথাও বিশিষ্ট হবার কোনাে চান্স নেই—তখন সে পায়ে পাম্পসু পরে খুব ভােরে মর্নিং ওয়াক শুরু করল। আর ডাকঘরে টাকা ডবলের ছ-বছরি সার্টিফিকেট কিনতে লাগল। দুটোর মধ্যে একটা যােগ আছে।
টাকা ডবল হলে তা ভােগ করার জন্যে বেঁচে থাকা দরকার। তাই ভােরে উঠে হাঁটাহাঁটি। সেই সঙ্গে সে ফৈয়াজ খাঁ, রসুলেন বাঈ, জ্ঞান গোঁসাই শুনতে লাগল। কেদার, কাফি, তিলক কামােদ তাকে প্রশান্তি দিতে লাগল। খুবই সাধারণ হয়ে পড়ার হাত থেকে বাঁচতেই সে রাগরাগিণী আর নানান সােনালি গলার সঙ্গী হয়ে যেতে থাকল।
ফলে লটারির টিকিট কিনে সে যখন দেখত তার নম্বর ওঠেনি—তখন তার কোনাে আপশােশ হত না। কেননা ধ্রুপদ, খেয়াল, সরােদ ইত্যাদি শুনে শুনে তার ভেতর একটা শান্ত ভাব সবসময়ের জন্যে খেলা করতে থাকে।
ঠিক এই সময়েই সে একদিন ধর্মতলার ফুটপাথে ৭৫ পয়সায় একখানা গওহরজান পায়। গানের শেষে ৮০ বছর পেছন থেকে ভেসে আসে গওহরের গলা—মাই নেম ইজ গওহরজান। এইভাবে কিনতে কিনতে—ফুটপাথে ঘুরতে ঘুরতে সে পেয়ে যেতে থাকল—মাই নেম ইজ আঙুরবালা। একদিন পেয়ে গেল ফৈজুদ্দিনকে। পেল জমিরুদ্দিনকে। একদিন তাে সে আলিপুরে গােপালনগরের মােড়ে একখানা পুরনাে রেকর্ডে শুনল কানাকেষ্টকে। চাপা বনে-এ-এ। কী গলা। পঞ্চাশ বছর আগের রেকর্ড হবে। দাম নিল আড়াই টাকা। ভরা যৌবনের তেজি কে সি দে। কী দাপট! রেকর্ড ফেটে যায়। অথচ মাত্র এক প্যাকেট সিগারেটের দামে কী দামি জিনিস। এ তাে একটা বড়ো দাঁও বলেই মনে হল শােভনলালের।
রেকর্ডখানা বগলে নিয়ে সে আদি গঙ্গার ওপরে নতুন পুলে দাঁড়িয়ে জেলের উঁচু পাঁচিল, ডুবন্ত সূর্য দেখতে দেখতে পরিষ্কার বুঝল, পৃথিবীতে এখনাে চোদ্দ আনা পড়ে পাওয়া যায়। এখনাে জীবনে অনেক কিছু পাওয়ার আছে। এই সব গান খনির মণি। খুজলে এখনাে পাওয়া যায়। কে সি দে আর নেই। এই গানটি গাওয়ার সময়কার পৃথিবী আর নেই। তখনকার মানুষজনও অনেকে কবেই চলে গেছে। রয়ে গেছে গানখানি। যতবার বাজাও—সেই তেজ। সেই দাপট। সেই লাবণ্য।
ইদানীং শােভনলাল রেকর্ড খুঁজতে বেরিয়ে–খুঁজতে খুঁজতে হরিমতি কিংবা দক্ষিণারঞ্জন—যাকেই পাক না কেন—ঘুঙুরের সঙ্গে হারমােনিয়মের হাত ধরে গান কিংবা ক্লারিনেট তাকে জাগ্রত দশায় স্বপ্নের ভেতরকার সিকি আধুলি কুড়ােতে দেয়।
কানাকেষ্টর গলায় ‘রাই-ই’ দিয়ে আখর শুরু হতেই সে তার নানান সময়কার ডায়রিতে টুকে রাখা নাম আর টেলিফোন নম্বরগুলাে দেখেই তখন তখনকার মানুষগুলােকে পরিষ্কার মনে করতে পারে। এই সেদিনও সে এবেলার জানা পরিচিতদের ওবেলাতেই গুলিয়ে ফেলতে শুরু করেছিল। খানিক আগেই বলা কথা বলা হয়নি ভেবে রিপিট করে যাচ্ছিল। কিন্তু পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা জ্ঞানে যখন থেকে শােভনলাল ছায়ানট, আহির ভৈঁরাের আড়টা ধরে স্মৃতি আর মনে রাখার ভেতর ভেসে থাকতে পারল তখনই সে ঘূর্তি আর আহ্লাদের স্বাদ ফিরে পেল।
এখন ধর্মতলায়, গােপালনগরের মােড়ে কিংবা চোরবাজারে ভরদুপুরে পুরনাে রেকর্ডের গাদি ঘাঁটতে ঘাঁটতে খনির মণি—ভীষ্মদেব, শচীনদেব, তরতাজা কানন, কী পঙ্কজ পেয়ে গেলে শােভনলালের মনে হয়—সে সেই দুপুরের গলাগলি পড়ে থাকা তিনখানা একটাকার নােট আচমকাই পেয়ে গেছে। কার বুকপকেটের ডায়রির ভেতর থেকে ভঁজ করা তিনখানা নােট তিরিশ বছর আগে রাস্তায় পড়ে গিয়েছিল। এইসব রেকর্ড গাদি ধরে পুরনাে কাগজওয়ালারা গেরস্ত বাড়ি থেকে কিনে এনেছে। এককালের রসিকদের স্বাদ আহ্লাদ মেশানাে এইসব রেকর্ড তার ওয়ারিশরা জঞ্জাল জ্ঞানে ওজনদরে বিদায় করেছে। অথচ এরই ভেতর সুর তাল লয় সব সময় ঘুমিয়ে আছে। জাগালেই উঠবে।
পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা কুড়ােতে গিয়ে উমা বসুর রেকর্ড পেয়ে যাওয়া ননী গোঁসাই, পারুল ঘােষের ছ-খানা সেভেনটি এইট রেকর্ড শিকারি হীরুবাবু, নজরুল আর অতুলপ্রসাদের গলায় গাওয়া চারখানি গানের ই পি-র মজুতদার বিশু ঘােষ ইত্যাদি লােকজনের সঙ্গে শােভনলালের বন্ধুত্বও হয়ে যায়। কারাের সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল ধর্মতলায়—কারাে সঙ্গে বা গােপালনগরের মােড়ে। এখন শােভনলাল এদের বাড়ি চেনে। এরাও শােভনলালের বাড়ি যায়। ছুটিছাটায়। কানাকেষ্ট কিংবা গওহরকে শুনতে। শােভন এক একদিন অফিস ফেরত পারুল ঘােষ শুনতে চলে যায় হীরুবাবুর বাড়ি। লীলা চিটনিসের গলায় এসব গান সিনেমায় একসময় মাত করে। কোনাে কোনােদিন বা বিশু ঘােষ তার সঙ্গে ধর্মতলার মােড়ে দেখা করে সন্ধেবেলা। বিশু ঘােষ কর্পোরেশন অফিসে রিটায়ার করবে আর ছ-বছর পরে। ভিড়ে ধর্মতলা বিলকুল হরিহরচ্ছত্র। সেই ডামাডােলের ভেতরেই বিশু ঘােষ ভিক্টোরিয়া হাউসের মাথার আকাশে তাকিয়ে এক একদিন এক এক গানের কথা বলে। আহা! দেবকীবাবুর কবি-তে কী গান গেয়েছিল রবীন মজুমদার। তারাশঙ্করের বাণী। অনিল বাগচির সুর। তুমি হােয়াে শিমূল ফুল—আহা! শােভনবাবু—কতকাল গানখানা শুনিনি। বড়াে শুনতে ইচ্ছে যায়। পাওয়া যায় ?
নাঃ! কত খুঁজেছি। তবে হীরুবাবুর কালেকশনে আছে—টেপ করে নিলে পারেন।
নেব নেব করে নেওয়া হয়নি। এবারে নেব। আর তােক-টা বছর অফিসে আছি। ছুটি হয়ে গেলে শুধু গান শুনব। এসপ্ল্যানেডের ভিড়ের ভেতর আলুকাবলি হয়ে যেতে যেতে শােভনলাল বুঝল, ভাঙা ট্রামলাইন, বাসে বাদুড়ঝােলা ভিড়, রেস্তরাঁয় একটা চেয়ারও খালি নেই—তবু এই পৃথিবীতে আশা করার অফিস থেকে পাকাপাকি ছুটি হলে পর রসিয়ে রসিয়ে শােনার মতাে গান রয়েছে—কত গান—যেসব গানে গলার নীচের ভেলভেটের নীল নরম টের পাওয়া যায়। সেখানে পৃথিবীর বাতাসে কোনাে ধুলাে নেই। আলাের ভেতর থেকেই আহ্লাদ বেরিয়ে পড়ে।
এক-একদিন হীরুবাবুর সঙ্গে অফিস থেকেই ফোনে কথা হয় শােভনলালের। হীরু তারই বয়সি। স্কুলের ছেলেমেয়েদের টিফিনের বাক্স বানাবার একটা কারখানা আছে। নিজের বাড়ি টবিন রােডে। একতলায় ঘর ভর্তি করে সাজানাে পড়ে পাওয়া সব চোদ্দ আনা। আট আনা থেকে আড়াই টাকায় কেনা এক একখানা রেকর্ড। সেসব গলায় সােনা ছিল, কিন্তু এখন আর মাথা খুঁড়লেও পাওয়া যাবে না সেইসব রেকর্ড। জঞ্জাল সাফ করতে বেরসিকরা পূর্বপুরুষদের যেসব রেকর্ড বেচে দিয়েছে ওজন দরে সেইসব রেকর্ড—যার ভেতর লুকিয়ে থাকে আমীরবাঈ কর্ণাটকি, প্রতিভা সােম, জোহরাবাঈ অফ আম্বালা, তারাপদ চক্রবর্তী।
একদিন ফোনে শােভনলাল হীরুবাবুর কাছে জানতে চেয়েছিল—একবারই শুনেছি গানটা—কার বাড়ির রেকর্ডে মনে নেই—অনেকটা এরকম-ভালােবাসার তুমি কী জানাে ও-ও-বাজনা ছাড়াই খােলা গলার গান। রেকর্ডখানা আছে আপনার?
হীরুবাবু ফোনের ওপাশ থেকে বলেছিল—বাকিটুকু গেয়ে শােনান তো অফিসের ফোনে একজন বয়স্ক লােকের গান গাওয়া খুবই রিস্কি। বিশেষত পি বি এক্স-এর মেয়েরা শুনলে কী ভাববে। তা ছাড়া শােভনের মনেও ছিল —
বাকিটা। শুধু গুনগুন করে ধরতাইটা ধরিয়ে দিয়েছিল সে-হীরুবাবুর কানে—ফোনে।
এক সপ্তাহের ভেতর হীরুবাবু সে গান খুঁজে বের করে। সত্যজিবুর চিড়িয়াখানা ছবিতে গানটা ছিল। বেশিদিন আগের নয়। হয়তো সত্যজিৎবাবুরই সুর। ভারী সুন্দর। কথাও বােধহয় সত্যজিৎবাবুর। গানটা রেকর্ড হয়নি, আপনি সিনেমায় শুনেছিলেন শােভনবাবু—
এইভাবেই শােভনলালের দিন চলে যাচ্ছিল—আর এইভাবেই সে এক দিন করে করে রিটায়ারমেন্টের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। তার সিথিতে কয়েকগাছি রুপােলি তার। বউ বাতের সিমটম বলে পাড়ার ডাক্তারখানা থেকে বড়ি এনে খাচ্ছিল। পৃথিবীও একদিন করে বুড়াে হচ্ছিল। ছেলেরা বিয়ে করে বউ নিয়ে যে যার কাজের জায়গায় চলে যাওয়ায় শােভনলাল বাড়ির ফাঁকা জায়গায় পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা দামে রেকর্ড কিনে কিনে এনে ধুলাে ধুয়ে গাদা করে দিতে লাগল। এক-একটা গাদি কত যে গানের—কত যে সেতার সরােদের দাপট, লাবণ্য, তেজের স্তুপ দেওয়া ফসল হয়ে উঠল। সেদিকে তাকিয়েও শােভনলালের মনের ভেতরটা ঝলমল করে ওঠে আহ্বাদে। যেন বাজারে চাল উধাও হওয়ার আগেই তিন সপ্তাহের রেশন আগেভাগে তুলে রেখেছে। সে তৈরি, অনটন আসুক—পরােয়া নেই। বিপদ আসুক পরােয়া নেই। আনন্দ আহ্লাদ তাে স্টক করা আছেই। যৌবনের অশােককুমারের সঙ্গে কাননদেবীর ‘অনাদি কালের স্রোতে মােরা দুটি প্রাণ’—গানটার নীচেই তাে ভেলভেটের নীল নরম জমা করা আছে। এইসময় সে বউকে নিয়ে বি গার্ডেন লেখা মিনিবাসে চড়ে বােটানিকসে বেড়াতে যায়। সেখান থেকে ফেরার সময় ঘুরপথে উজিয়ে জীবনে প্রথম তারা বেলুড় মঠও দেখে ফেলে। এরই হপ্তা খানেকের ভেতর ওরা দুজনে টালার মাঠে বাঘের বােটকা গন্ধ শুকতে শুকতে সার্কাস এনজয় করে। এমনকি একদিন সন্ধে সন্ধে শােভনলাল সস্ত্রীক ফিল্ম ফেস্টিভালে দেবীকারানির অচ্ছুকন্যা দেখে ফেলে।
দেখেই শােভনের মাথা খারাপ। অশােককুমার নয়—দেবীকারানি নয়—এক সিনে এক কাঠকুড়ানির গান—মাথায় কাঠের বােঝা—ফেস্টিভাল হল ফেটে যায় যায়—লয়কারীতে সুন্দর মােচড়। হলের ভেতরেই গানটা মুখস্থ হয়ে যায় শােভনলালের। গানের চেহারাও সে চিনে ফেলে। গায়িকার গলায় দারুণ জোয়ারি।
কিৎ গয়া হো
খইবন হিয়ারে-এ-এ
কিৎ গয়া হো—
পঞ্চাশ বাহান্ন বছর আগের গান। তখনাে প্লেব্যাক আসেনি নিশ্চয়। ঝিঝােটি দাদরায় গাওয়া। কিৎ মানে বােধহয় কোথায়। মারাঠি টান হবে।
এই গায়কী, এই ঝিঝােটি দাদরার জন্যে শােভনলাল ধর্মতলার ফুটপাথ, গােপালনগরের মােড়, চোরবাজার চষে ফেলল। ঝিঝােটি দাদরা ছাড়া এই কলকাতাই বৃথা লাগল শােভনলালের। সিনেমার পর্দায় কাঠকুড়ানির এই গান ঝমঝম করে উঠেছিল।
কোথায় সেই সব অপদার্থ উত্তরপুরুষ—যারা রসিক বাপ-দাদার খনির মণি-প্রায় রেকর্ডের গাদি ওজন দরে হাওয়া করে দেয়। তাদের ঠিকানা দিয়ে একটা ডাইরেক্টরি বের করা দরকার। ডাইরেক্টরি থাকলে ঠিকানা ঘেঁটে শােভনলাল ওর ঝিঝােটি দাদরা খুঁজে বের করত। ঝিঝােটি দাদরা শােভনলালের মাথার তালুতে গিয়ে আটকে আছে। অশােককুমারকে চিঠি লিখবে? কত ছবি। করেছেন। তার কি এসব মনে থাকবার কথা। সে বম্বে টকিজ তাে আর নেই। পুরনাে ছায়াছবির ফেস্টিভালে ছাপানাে কাগজপত্রে দেখল—অচ্ছুকন্যার মিউজিক ডিরেক্টর ছিলেন—এক গায়িকা মহিলা। রণছােড়জি মনমুখজি—আরও লম্বা নাম। যাকেই বলে—কেউই মনে করতে পারে না।
রবিবার রবিবার বিকেলের দিকে হীরুবাবুর টবিন রােডের ডেরায় শােভনলাল, ননী গোঁসাই, বিশু ঘােষের হাজিরা দেওয়া চাই। ফি হপ্তায় ওই সময়টায় যে যার হপ্তা জুড়ে পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা একবার হীরুর মেশিনে বসিয়ে শুনে নেয়। ভালাে লাগলে বারবার বাজানাে হয়। হীরু ঘােষ শুনে হয়তাে বলল—এ রেকর্ডখানা তাে আমি আগেই পেয়ে গেছি। কিংবা না পেলে হীরু সে-গান টেপে তুলে রাখে।
শীতের বিকেল। ঝিঝােটি দাদরার জন্যে উতলা শােভনলাল একবার হীরুর মুখে তাকিয়ে বলল, লীলা চিটনিসকে চিঠি লিখে দেখব?
ননী গোঁসাই হেসে বলল, তিনি কি আর মনে করে রেখেছেন ! তাহলে দেবীকারানিকে লিখি? ঠিকানা পাবেন কোথায়? পেলেও না হয় লিখলেন। তিনি কি আর আমার আপনার চিঠির জবাব দিতে বসে আছেন।
হীরু তার রেকর্ডের জাবদা খাতার পাতা উল্টোচ্ছিল। হঠাৎ থেমে বলল, এই রেকর্ডখানা যদি খুঁজে পাই তাে বাজিয়ে দেখি— | খাতা বন্ধ করে হীরুবাবু তাক থেকে একখানা সাত পুরনাে রেকর্ড বের করে ভালাে করে মুছল। তারপর মেশিনে বসাল।
কাটা রেকর্ড নয়। একটুও দাগ পড়েনি। সেই আশ্চর্য ঝিঝােটি দাদরা। হীরুর ঘরের জানলা দিয়ে টবিন রােডের ব্যস্ত ভিড়ে গিয়ে উথলে পড়তে লাগল। গান শেষ হতে হীরুর বউ একটি বাচ্চা কোলে করে ঘরে ঢুকল, এই দেখুন আমার নাতি।
গানটা শােভনলালকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। সে এ-গান খুঁজে পাওয়ায় সারাটা মন জুড়ে হীরুর কাছে কৃতজ্ঞ। পঞ্চাশ বছর পেছন থেকে কেউ যদি এমন আচমকা সুর, তাল, লয় ফিরিয়ে আনে তাকে কী বলে ধন্যবাদ দেওয়া যায়। শােভনলাল পকেট থেকে একখানা দশ টাকার নােট বের করে হীরুর নাতির মুখ দেখল। বাঃ! বেশ সুন্দর হয়েছে তাে। আপনাদের দেশ কোথায় বউঠান ?
আপনার বন্ধুর দেশ তাে নদীর পাড়ে—
কোথায় ?
এবার হীরু নিজেই বলল, দেশে বেশি থাকিনি। ৯-১০ বছর বয়স অব্দি ছিলাম—ভৈরবের গায়ে খালিশহরে—দৌলতপুর কলেজ ছাড়িয়ে রেললাইন
আর ভৈরব নদীর মাঝখানে।
আরে ওখানে তাে আমিও ছিলাম। বেলেপাড়ায়—
হীরু বলল, আমরাও ছিলাম ওখানে–১৯৪২-৪৩ অব্দি। পুকুরপাড়ে—
একতলায়—
শােভনলাল ঝিঝােটি দাদরায় স্নান করে উঠেছে এইমাত্র। সে মন্ত্রপড়া গলায় বলল, ঠিক ওই সময় পুকুরপাড়ে তােমাদের ওই হলুদ রংয়ের বাড়িটার পাশের বাড়িতেই আমরা থাকতাম। তখন ফাইভ সিকসে পড়ি।
আমিও তাে তখন ফাইভ সিকসে পড়ি। হীরুর এ কথায় শােভনলালের খেয়ালই থাকল না—সে হীরুকে তুমি তুমি করে কথা বলে যাচ্ছে। আমি জেলা স্কুলে পড়তাম—। তুমি?
হীরু বলল, আমি মডেল স্কুলে পড়তাম। কিন্তু তােমার চেহারা মনে করতে পারছি না শােভন।
আমিও সব ভুলে গেছি হীরু। কিছুতেই তােমাকে মনে করতে পারছি না।
নাতি কোলে হীরুর বউ বলল, আহা! তা পারবেন কী করে? তখন তাে আপনারা দুজনই অন্যরকম দেখতে ছিলেন। এখন কত বদলে গেছেন সবাই।