২৫
রাত হয়েছে।
খাওয়ার পরে শুভ্রকে আফরোজার ঘরে পাঠানো হয়েছে। আফরোজা একটা ফিনফিনে পোশাক পরে খাটে বসে ছিল। ঘরে ঢোকামাত্র দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে দেওয়া হল।
শুভ্রর হাঁফ ধরে গেছিল। মাথা কাজ করছিল না লতিফের থেকে সব প্ল্যান শোনার পরে। সে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল।
আফরোজা তাকে দেখে বলল “হুজুরেরা আবার তোমাকে জন্নতের সফর করতে পাঠিয়েছেন বুঝি?”
শুভ্র জল খেল অনেকটা। খেয়ে বলল “জানি না, শেষ পর্যন্ত ওরা কী চান”।
আফরোজা বলল “পাকিস্তান থেকে বেশ কয়েকজন এসেছে। কোন মিশন বোঝা যাচ্ছে না। তাদের মধ্যে একজনকে কাল আমার কাছে পাঠিয়েছিল। তোমার মত না। ছিঁড়ে খেল আমাকে। তুমি বাকিদের মত নও। আমি এখনও ভাবি তুমি এখানে কী করে এলে?”
শুভ্র আফরোজার দিকে তাকিয়ে বলল “পাকিস্তান থেকে কতজন এসেছে?”
আফরোজা বলল “জনা পঁচিশ তো বটেই। উসমানই ওদের ট্রেনিং দেবে”।
শুভ্র বলল “তোমাকে ওই ছেলেটা বলল?”
আফরোজা মাথা উপর নিচ করল।
শুভ্র মাথা নিচু করে বসে রইল। মাথায় ঝিঁঝিঁ ডাকছে বটে কিন্তু ভীষণ ক্ষীণ ভাবে। শুভ্র কিছুই শুনতে পাচ্ছিল না।
আফরোজা বলল “এদের পর পর একগাদা প্ল্যান আছে। সব ছারখার করে দেবে এরা”।
শুভ্র বলল “তুমি এসব নিয়ে ভাবো?”
আফরোজা ম্লান হাসল “কেন ভাবব না? মানুষ ভাবো না আমাকে তোমাদের মত, তাই না? ঘরেই আটকে থাকব সারাজীবন, যখন তখন যে কেউ এসে আমার সঙ্গে শুয়ে যাবে, এভাবেই কেটে যাবে জীবন? কত সহজ না?”
শুভ্র লজ্জিত হয়ে বলল “না না, আমি সেটা বলি নি। তুমি এত খবর পাচ্ছ কীভাবে, আমি সেটাই জানতে চাইছি”।
আফরোজা বলল “পেয়ে যাই। এই যেমন খবর পেলাম তোমাকে ওরা খুব পছন্দ করছে। ওদের মিশন তুমি সফল করবেই ভেবে ওরা খুব আনন্দিত”।
শুভ্র আফরোজার দিকে তাকাল। শান্তভাবে কথা বলে যাচ্ছে মেয়েটা। এখানে কি হাওয়ায় কথা ভাসে? চার দেওয়ালের ভেতরে থাকার পরেও এরা সব জানতে পারছে।
আফরোজা বলল “দূরে বসে থাকবে? এসো, এখানে এসে বস”।
শুভ্র মাথা নাড়ল “না, না। ঠিক আছে”।
আফরোজা হাসল “রাতটাও চেয়ারে বসেই কাটাবে বুঝি? এসো। মাঝে একটা পাশবালিশ দিয়ে দিচ্ছি”।
শুভ্র উঠে দাঁড়াল। আফরোজা বলল “এই ঘরের মধ্যে ক্যামেরা থাকতে পারে। হুজুরেরা যদি দেখেন তাদের পেয়ারের টিম লিডার এ ঘরে এসে কিছুই করে না, ঘুমিয়ে পড়ে, তবে তোমার কপালে দুঃখ আছে”।
শুভ্র চমকাল।
আফরোজা বলল “এরা সব পারে। আবার নাও থাকতে পারে। কে জানে!”
শুভ্র আফরোজার পাশে গিয়ে বসল।
আফরোজা তার চুলে হাত বুলিয়ে বলল “তোমার মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে জানো। প্রথম প্রথম তোমার চোখে যে দিশেহারা ভাবটা ছিল, সেটা কমেছে। তবে তোমাকে সব সময় দেখলে মনে হয়, তুমি কিছু না কিছু ভেবে যাচ্ছো। কী ভাবো তুমি? এখান থেকে পালাবে কী করে?”
শুভ্র মাথা নাড়ল, “আমি দেখে নিয়েছি। এখান থেকে পালানো সম্ভব না। তাছাড়া এই জায়গাটা বাংলাদেশে। আমি কিছুই চিনি না এখানকার। ফিরবই বা কীভাবে?”
আফরোজা বলল “ভুলেও সে কথা ভেবো না। মেরে ফেললে এক কথা ছিল, তার পরিবর্তে ওরা তোমার ওপর যে অত্যাচার করবে, তখন তোমার মনে হবে এর থেকে মরে গেলেই হয়ত ভাল হত। আমি চেষ্টা করেছিলাম একবার। পাঁচজন হুজুর একসঙ্গে আমার ওপর হামলে পড়েছিল তাবুর মধ্যে। ওরা বুঝিয়ে দিয়েছিল আমায়, ওসব মাথায় আনাও যাবে না। এর থেকে একটা গুলিতে মেরে দিলে ভাল জানো তো”!
শুভ্র চুপ করে বসে রইল। আফরোজা বলল “তুমি ঘুমিয়ে পড়। আমার তো অভ্যাস নেই ঘুমানোর”।
শুভ্র শুল। আফরোজা তাদের দুজনের মাঝখানে একটা পাশবালিশ রাখল।
কতগুলো বাচ্চা ছেলেকে হাতে অত্যাধুনিক কতগুলো অস্ত্র দিয়ে এরা শহরে ছেড়ে দেবে? কী ভয়ংকর!
শুভ্র শিউরে উঠল।
ঝিঁঝিঁর ডাক এবার স্পষ্ট শুনতে পেল শুভ্র “ওদের প্ল্যান কিছু জানতে পারলে?”
শুভ্র ফিসফিস করে বলল “এখন কিছু বলা সম্ভব না”।
আফরোজা বলল “আমায় কিছু বললে?”
শুভ্র বলল “না”।
ঝিঁঝিঁ বলল “ওরা যা বলে করে যাও শুভ্র। অন্যথা কোর না”।
শুভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলল। একই কথা শুনে শুনে বিরক্ত হয়ে গেছে সে।
আফরোজা ঘরের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে বলল “কতদিন বাইরে যাই না। আমার মনে হয় বাকি জীবনটা এভাবেই কেটে যাবে। কিংবা যৌবন ফুরিয়ে গেলে ওরা আমাকে গুলি করে মেরে দেবে। ভেতরের সব কথা জানি। আমাকে কি আর ওরা বাঁচিয়ে রাখবে?”
দরজায় টোকা পড়ল। আফরোজা দরজা খুলল। একজন কিশোর দাঁড়িয়ে আছে।
আফরোজা বলল “কী হল?”
ছেলেটা বলল “ওনাকে আমার সঙ্গে যেতে বললেন। শেখ এসেছেন। দেখা করতে হবে ওঁর সঙ্গে এখনই”।
শুভ্র উঠল।
আফরোজা বলল “যাও। আসল লোকেরা এসে গেছে তার মানে”।
শুভ্র অবাক হয়ে আফরোজার দিকে তাকাল।
আসল লোক! মানে?
(ক্রমশ)
ঝিঁঝিঁ
২৬
এ ঘরটায় শুভ্র আগে আসে নি। তাদের কলেজের কনফারেন্স রুমের মত ঘর।
একগাদা বিদেশী লোক বসে আছে। তাদের মধ্যে উসমান এবং লতিফও আছে। লতিফ তাকে ইঙ্গিতে বসতে বলল।
একজন অত্যন্ত স্মার্ট এবং সুন্দর দেখতে যুবক উঠে দাঁড়িয়ে ঝরঝরে ইংরাজিতে বলল “আমরা এখানে অত্যন্ত পবিত্র একটা কারণে সবাই মিলে একত্রিত হয়েছি। পৃথিবীতে পাপীর সংখ্যা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। এর সব থেকে বেশি প্রভাব পড়েছে আমাদের ধর্মে। আমরা ধর্মপালন করতে গিয়ে বাধা পেয়েছি আমেরিকানদের থেকে। আমরা মনে করি আমাদের নারীদের পর্দানশীন করে রাখলে পরপুরুষের কু নজরের হাত থেকে তাদের বাঁচানো সম্ভব হবে। কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ষড়যন্ত্র করে হিজাবকে ব্যান করে দেওয়া হচ্ছে। আপনারা সকলেই জানেন আমাদের এখন কীভাবে বিভিন্ন জায়গায় কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে। ইন্ডিয়ায় গুজরাট, কাশ্মীরে আমরা যেভাবে প্রতিদিন নিষ্পেষিত হচ্ছি তা সকলেই অবগত আছেন। এখন সময় এসেছে প্রত্যুত্তর দেওয়ার। চুপ করে বসে থাকলে হবে না। আমরা যেভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আমাদের সংগঠনের কাজ এগিয়ে দেওয়ার জন্য পরিশ্রম করে চলেছি, আশা রাখছি, অদূর ভবিষ্যতে গোটা পৃথিবীর মানুষ আমাদের মানুষদের ক্ষতি করার আগে দুবার ভাববে। মনে রাখবেন, আমেরিকা ইরাকে কী করেছে, আফগানিস্তানে কী করেছে, কীভাবে মিডল ইস্টে দিনের পর দিন নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এক শ্রেণীর মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। প্যালেস্তাইনে কী হচ্ছে ভুলে যাবেন না। এদের মিত্রশক্তি ইন্ডিয়াকে ছেড়ে রাখা হবে না। এবার সময় এসেছে, গোটা পৃথিবীকে বুঝিয়ে দিতে হবে আমরা কারা”।
শেষের দিকে যুবকটির গলা উত্তেজনায় কেঁপে উঠল। সবাই জোরে মাশাল্লাহ বলে উঠল।
যুবকটি বলল “ইকরিত থেকে এতটা পথ এসেও আমরা বিন্দুমাত্র ক্লান্ত নই। নিজেদের মানুষদের বাঁচানোর স্বার্থে যত দূর যেতে হয়, আমরা ততদূর যেতে প্রস্তুত। এই মিশনের জন্য আমাদের কাছে পৃথিবীর সমস্ত ভাইরা যে ডলার পাঠিয়েছেন, তা আপনাদের তহবিলে আমরা তুলে দিয়েছি। আমরা এবার আপনাদের থেকে শুনতে চাই। ঠিক কোন প্ল্যানে ইন্ডিয়াকে আপনারা লাল করে তুলবেন”।
লতিফ উঠে দাঁড়াল। প্রয়োজনীয় সম্ভাষণ করে ঘর অন্ধকার করে ল্যাপটপ খুলল। প্রজেক্টর স্ক্রিণে ভারতবর্ষের মানচিত্র ভেসে উঠল। লতিফ বলল “জনাব, আমরা আপনাদের কাছে আমাদের প্ল্যান জমা দিয়েছি। দিল্লি, মুম্বই, চন্ডীগড়, কানপুর, ত্রিবান্দ্রম, পানাজি, হায়দ্রাবাদ, চেন্নাই, ব্যাঙ্গালোর আর কলকাতায় একই সঙ্গে আমাদের ছেলেরা মিশন কমপ্লিট করে জন্নতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে। প্রতিটা শহরের সব থেকে জনবহুল এলাকায় অতর্কিতে হানা এবং সুইসাইড বোম্বিং হবে”।
লতিফের কথা শুনে সবাই সাবাশ বলে উঠল।
যুবকটি গম্ভীর গলায় বলল “কথাগুলো শুনতে যতটা সোজা লাগছে, একজিকিউশন করা ততটাই কঠিন। আপনার প্রত্যেক সৈনিক সেই ট্রেনিং কি পেয়েছে? ধরা পড়ে যদি?”
লতিফ হেসে বলল “জি জনাব, উসমান তাদের সেই ট্রেনিং যথাযথভাবেই দিয়েছে। তাছাড়া ধরা পড়ার প্রশ্নই আসবে না। মিশনে যাওয়া প্রতিটি মিলিট্যান্টের শরীরেই আমরা…”
লতিফ চুপ করে গেল।
যুবকটি বলল “ইন্ডিয়াতে কোন রুট ধরে ঢুকতে চাইছেন?”
লতিফ বলল “সিলেট সীমান্ত দিয়ে। গুয়াহাটি এয়ারপোর্ট থেকে ওরা বিভিন্ন শহরে রওনা দেবে। আমাদের মিশন লিডার আতিক খান নিজে গুয়াহাটি এয়ারপোর্টে তদারকিতে থাকবে। শহরগুলোতে পৌঁছে আমাদের ডেরা থেকে ছেলেদের হাতে প্রয়োজনীয় অস্ত্র সরবরাহ করা হবে”।
যুবকটি বলল “আতিক খান এখানে আছে? কোথায়?”
শুভ্র উঠে দাঁড়াল।
যুবকটি নিজের সিট ছেড়ে শুভর সামনে এসে দাঁড়াল। কয়েক সেকেন্ড শুভ্রর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল “কাফেরদের আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু যারা নিজেদের ধর্ম ত্যাগ করে নিজের জীবন আমাদের ধর্মে উৎসর্গ করতে চায়, তাদের আমি সব থেকে বেশি পছন্দ করি”।
শুভ্র চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
যুবকটি বলল “আমার মাথার দাম একশো মিলিয়ন ডলার। তুমি যদি মিশন সারভাইভ করে ফিরে আসতে পারো, তোমার দামও কিছু কম হবে না। ট্রাই নেবে নাকি?”
যুবক শুভ্রর চোখে চোখ রাখল।
শুভ্র বলল “যা প্ল্যান হবে, সেটাই আমি মেনে চলব’।
যুবকটি শুভ্রর কপালে চুমু খেয়ে বললে “আমরাই জিতব।আমি জানি আমরাই জিতব”।
শুভ্রর গা গোলাচ্ছিল। তবু চুপ করে থাকল।
(ক্রমশ)
ঝিঁঝিঁ
২৭
ক্যাম্পে উৎসবের পরিবেশ। সবার মধ্যে খুশি খুশি ভাব। বাইরের লোকেদের সামনে ছেলেরা নিজেদের উৎসাহ দেখাতে ব্যস্ত। পাকিস্তানের ছেলেগুলোর সঙ্গে শুভ্রর একবার চোখাচুখি হয়েছে। তাকে দেখে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে ছিল। শুভ্র বুঝতে পারছিল এরা কোন প্ল্যান করছে, কিন্তু কী চাইছে বুঝতে পারছিল না। দম বন্ধ হয়ে আসছিল তার।
লতিফ শুভ্রকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলল “এরা কারা জানো?”
শুভ্র বলল “আন্দাজ করতে পারছি। এরাই সমস্ত প্ল্যান করে দেন”।
লতিফ খুশি হয়ে শুভ্রর কাঁধ চাপড়ে দিয়ে বললেন “তুমি বুদ্ধিমান। আমাদের নিউক্লিয়াস এরাই। এরাই বলে দেন আমাদের কীভাবে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে হবে। ধীরে ধীরে আমরা ছড়িয়ে পড়ছি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। যে আমেরিকা ইরাকে ক্ষমতা দখল করতে আমাদের ব্যবহার করল, তারাই ক্ষমতা পেয়ে যাবার পর আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করল। অবশ্য, এর দরকার ছিল। প্রতিটা ভুল থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়ার প্রয়োজন আছে। আমাদেরই ভুল হয়েছিল কাফেরদের বিশ্বাস করা। ওসামা বিন লাদেনের পরিণতি আমরা যেন কোন দিন না ভুলি”।
শুভ্র দেখল বাইরে গাড়িবারান্দায় একটা বড় ট্রাক এসে দাঁড়াল। বেশ কয়েকজন ছেলে গিয়ে ট্রাক থেকে বস্তা নামাতে শুরু করল। সে লতিফকে বলল “আমি যাব ওদের সঙ্গে?”
লতিফ বলল “না দরকার নেই। আনাজ এসেছে। ওরা নামিয়ে নেবে ঠিক। তুমি মনঃসংযোগ কর। তোমার খবরটা বিভিন্ন নিউজপেপারে বেরনো মাত্রই পৃথিবী চমকে উঠবে আতিক। তুমিই প্রথম কনভার্টেড মুসলিম হবে যে স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করে নেবে। আমি নিশ্চিত তোমার দেখাদেখি তোমাদের বয়সী অনেকেই আমাদের সঙ্গে আসতে চাইবে। আচ্ছা, তোমাকে একটা কাজ দেব আতিক, তুমি ভেবে আমায় বোল”।
শুভ্র জিজ্ঞাসু চোখে লতিফের দিকে তাকাল।
লতিফ বলল “তোমাকে আমি স্টেশনগুলোর ম্যাপ দেব। তুমি আমাকে একটা এসকেপ রুট দিতে পারবে? অপারেশনের পরে ভিড়ে মিশে তোমাকে আমাদের বেস ক্যাম্পে চলে আসতে হবে পিছনে কোন রকম টিকটিকি না নিয়ে। যদি তুমি বেঁচে ফিরতে পারো, সেটার থেকে বড় অ্যাচিভমেন্ট আর কিছু হতে পারে না”।
শুভ্র বলল “আসলে কলকাতা শহরটা আমি অতটা ভাল চিনি না”।
লতিফ মাথা নাড়ল “আমি জানি তো, কিন্তু ব্যাপারটা খুব একটা কঠিনও কিন্তু না। তোমাদের অতর্কিতে হানার পরে ওরা যেভাবে থতমত খেয়ে যাবে, সে জায়গাটা থেকেই তোমাকে পালিয়ে যেতে হবে। আমরা চাইলে কাশ্মীর বা পাকিস্তানের মুজাহিদিনদের কলকাতার মিশনে পাঠাতে পারতাম, তোমাকে কেন বেছেছি? যাতে অনায়াসে কলকাতার মানুষের ভিড়ে তুমি মিশে যেতে পারো। ওরাও চাইছেন তুমি বেঁচে ফেরো। তার জন্য প্রয়োজনীয় গাড়ির ব্যবস্থা আমরাই করব। অবশ্য তোমার মেইলগুলো থেকে আমি বার বার আঁচ পেয়েছি, তুমি আমাদের স্বার্থে আত্মবলিদান দিতে চাও, কিন্তু এই মুহূর্তে আমরা মনে করছি তোমার ফিরে আসাটা আমাদের আরও বেশি সাহায্য করবে”।
শুভ্র বলল “তাহলে কি আমাকে এই মিশন থেকেই বাদ দিয়ে দেওয়া হবে?”
লতিফ হাসল “কখনই না। আমি জানি,তোমার স্বপ্নের প্রোজেক্ট এটা। কলকাতাকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হতে দেখতে চাও তুমি। কী কারণ আতিক? কোন মেয়েঘটিত কেস?”
শুভ্র ভ্যাবাচ্যাকা খেল প্রথমে, মেইলে তার নামে আর কী কী লেখা হয়েছে কে জানে! অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল “আমি না বলতে পারলেই খুশি হব”।
লতিফ বলল “নিশ্চয়ই। তবে তোমার মত ডেডিকেশন আমাদের দেশের ছেলেদের থাকলে আমার আর কোন চিন্তা থাকত না। এরা আধুনিক হবার নেশায় সব আমেরিকার পা চাটা কুকুরে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের যুব সমাজ ধর্ম শিক্ষা থেকে এত দূরে চলে গেছে দেখলে আমি মাঝে মাঝে হতাশ হয়ে পড়ি। কিন্তু এও জানি, যে মুহূর্তে আমরা আমাদের উপস্থিতি সঠিকভাবে দেখাতে সক্ষম হব, সেই মুহূর্তে বাংলাদেশে আমাদের সংগঠন আরও শক্তিশালী হবে। শেষের সেদিনটাতে সবাইকে তাঁর মুখোমুখি হতেই হবে, কী বল আতিক?”
লতিফ শুভ্রর দিকে তাকাল। শুভ্র বলল “হ্যাঁ। নিশ্চয়ই”।
ট্রাকে রাখা বস্তার একাংশ নিচে নামিয়ে রাখার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আকারে বেশ বড় কয়েকটা বন্দুক চোখে পড়ল শুভ্রর।
লতিফ হেসে বলল “বলিউড হলিউডে দেখেছ এদের, রকেট লঞ্চার বলে এদের। তোমাদের বর্ডার পার করানোর দিন কাজে লাগবে”।
শুভ্র মৃত চোখে ট্রাকের দিকে তাকাল।
কোন কিছুই আর তার অবিশ্বাস্য লাগছিল না।
(ক্রমশ)
ঝিঁঝিঁ
২৮
রজতবাবু ছোট্ট বিল্ডিংটায় যখন ঢুকলেন তখন সন্ধ্যা সাতটা। বিল্ডিংটার তালা বন্ধ ছিল।
রজতবাবু চাবি বের করে দরজার তালা খুলে ঘরের ভিতরে ঢুকে সন্তর্পণে দরজাটা বন্ধ করলেন। একটা সুইচ অন করলে জিরো পাওয়ারের বাল্ব জ্বলে উঠল। মেঝেতে রাখা একটা পাটাতনের সামনে দাঁড়ালেন। বাল্ব জ্বলার ঠিক দশ সেকেন্ডের মধ্যে পাটাতনটা সরে গেল।
পাটাতনের নিচ থেকে একটা প্ল্যাটফর্ম বেরিয়ে এল।
রজতবাবু সেটার ওপর দাঁড়াতে প্ল্যাটফর্মটা নিচে নামতে শুরু করল। উপরের পাটাতন নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে গেল।
প্ল্যাটফর্মটা প্রায় একতলা সমান নেমে দাঁড়িয়ে গেল।
রজতবাবুর সামনে একটা দরজা এল। পাশে বায়োমেট্রিক মেশিন। রজতবাবু নিজের বুড়ো আঙুল মেশিনে দিতেই দরজাটা খুলে গেল।
দরজা খুলতে দেখা গেল একটা কর্মব্যস্ত অফিস। তবে বেশি লোক নেই। চারজন লোক মনোযোগ সহকারে কম্পিউটারের সামনে বসে কাজ করছেন। রজতবাবুকে দেখে চারজনই হাসলেন।
রজতবাবু ঘরের ভেতর ঢুকে বললেন “আমার স্ত্রী বেশ সমস্যা তৈরী করছেন। সন্তান জ্বালা বড় জ্বালা বুঝলে পট্টনায়েক?”
পট্টনায়েক বয়স্ক লোক। রজতবাবুরই বয়সী। তার দিকে তাকিয়ে বললেন “নিজের ছেলেকে পাঠাতে কে বলেছিল তোমাকে রজত?”
রজতবাবু চেয়ারে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন “চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম। নিজের ছেলে করবে না তো অন্যের ছেলেকে দিয়ে করাব? কী আপডেট আছে?”
পট্টনায়েক বললেন “মাথারা এসে গেছে। ওরা যে কোন মুহূর্তে ইন্ডিয়া ঢুকবে। সমস্যা হল শুভ্রর মাথায় যে চিপ ইনসার্ট করা হয়েছে, তা কখন কাজ করা বন্ধ করে দেবে বুঝতে পারছি না”।
রজত চিন্তিত গলায় বললেন “সে রিস্কটা আমাদের নিতেই হবে। গোটা গ্যাংটাকে ধরার এর থেকে ভাল সুযোগ আর কিছু হতে পারে না। বাংলাদেশ গভর্নমেন্ট কি কোন ভাবেই হেল্প করতে পারছে না?”
পট্টনায়েক বললেন “সমস্যা হল সব খানে তো আর ইন্ডিয়া গভর্নমেন্ট নেই। বাংলাদেশ গভর্নমেন্টের আইনের হাতও তত লম্বা নয়। আমাদের কম্যান্ডোদের ওখানে পাঠানোটা বিরাট ঝুঁকি হয়ে যাবে। ওরা কখন ইন্ডিয়ায় ঢুকবে তার অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই”।
সত্যজিত বর্মণ কম্পিউটার অ্যানালিস্ট। শুভ্রর থেকে আসা প্রতিটা শব্দ রেকর্ড করে চলেছেন নিরলস ভাবে। রজত বললেন “সত্যজিত, ওদের ক্যাম্পে ঠিক কতজন লেডিজ আছে?”
সত্যজিত বললেন “শুভ্রর সঙ্গে কনট্যাক্ট হয়েছে সুলেখা এবং আরেকটি মেয়ের। এছাড়া শুভ্রর সঙ্গে আর কারো যোগাযোগ হয় নি। তবে মেয়েটির কথা শুনে যা বোঝা গেছে, ক্যাম্পে আরও মেয়ে আছে”।
পট্টনায়েক বললেন “অ্যাকরডিং টু স্যাটেলাইট ইমেজেস, মায়ানমার থেকে আর্মস ট্রাক ঢুকছে এদের ক্যাম্পে। প্রচুর গোলা বারুদ মজুদ হচ্ছে”।
সত্যজিত বললেন “এদিকে মায়ানমার বৌদ্ধ কান্ট্রি। ওদের বাংলাদেশের সঙ্গে চাপান উতোর লেগেই থাকে”।
পট্টনায়েক বললেন “তাতে কী হয়? টাকা কথা বলে। রিলিজিয়ন তো ছুঁতো। আচ্ছা রজত, তোমার ছেলেকে ওরা আর্মস ট্রেনিং দিয়ে দিচ্ছে। একদিকে ভালই হচ্ছে, কী বল?”
রজত হেসে ফেললেন “হ্যাঁ, ছেলে তো জানে বাবা ক্লারিকাল জব করে। সবই ভাল হচ্ছে। তবে ওর মায়ের হাব ভাব আমার সুবিধের লাগছে না। শয্যা নিয়েছে একপ্রকার”।
পট্টনায়েক বললেন “আর তোমার ছেলের গার্লফ্রেন্ড সৌমিতা? ওকে আকারে ইঙ্গিতে কোন বার্তা পাঠাব কি না জানিও। মেয়েটা যথেষ্ট ওয়ারিড”।
রজত বললেন “স্বাভাবিক। ও কী করে জানবে ইন্ডিয়ান ইন্টেলিজেন্সে আমরা শুভ্রকে ইনভলভ করে নেব? যাই হোক, আমি এখনই কাউকে কিছু বলার পক্ষপাতী নই। শুভ্রর থেকে যতটা পারা যায় ইনপুটস নিয়ে যেতে হবে”।
সত্যজিত বললেন “ওরা ফোরটিন্থ আগস্ট গুয়াহাটি পৌছচ্ছে। ফিফটিন্থে দেশ জুড়ে ব্লাস্টের প্ল্যান আছে। আমরা গুয়াহাটি যাচ্ছি তো?”
পট্টনায়েক রজতের দিকে তাকালেন। রজত ঘরে এতক্ষণ নীরব বসে থাকা প্রৌঢ় মানুষটির দিকে তাকালেন।
পট্টনায়েক বললেন “প্রফেসর শর্মা, আপনিই এই প্রোজেক্টের সব কিছু। আপনিই বলুন আমরা গুয়াহাটি যাচ্ছি তো? নাকি সব দায়িত্ব অ্যাকশান ফোরসের হাতে ছেড়ে দিয়ে এখানেই বসে থাকব?”
গাল ভর্তি সাদা দাড়ি প্রফেসর শর্মার। ডি আর ডি ও চিফ হিসেবে রিটায়ার করেছেন কয়েক বছর হল। শুভ্রর মাথায় বসানো চিপটার আবিস্কারক তিনিই।
এই আবিস্কারের খবর এই গোপন ঘরে বসে থাকা চারজনের বাইরে আর কেউ জানে না।
পট্টনায়েকের প্রশ্নের উত্তরে শর্মা বললেন “গুয়াহাটির তাম্বুল বিখ্যাত। খেতে খারাপ লাগবে না। চল, ঘুরেই আসি। আর রজত, ভয় পাবে না, তোমার ছেলের কিচ্ছু হবে না। এই বুড়ো তোমাকে কথা দিচ্ছে, আগেও দিয়েছে, তোমার ছেলের কিচ্ছু হবে না। তবে তাম্বুল ভাল জিনিস। চল গুয়াহাটি ঘুরেই আসা যাক”।
(ক্রমশ)
ঝিঁঝিঁ
২৯
শুভ্রকে আফরোজার ঘরে পাঠানো হয়েছে।
আফরোজা তাকে দেখে বলল “তোমার দিন এগিয়ে আসছে”।
শুভ্র ম্লান হাসল।
আফরোজা বলল “আমি শুনেছি, যাদের ফাঁসি হয়, যত দিন এগিয়ে আসে, তাদের মধ্যে বিভিন্ন রকম পরিবর্তন হয়। অথচ যারা এরকম কোন মিশনে যায়, তাদের মধ্যে ঠিক উল্টোটা হয়। তারা উত্তেজিত হয়ে পড়ে, সারাক্ষণ আল্লাহর নাম নেয়, ধর্মের কথা বলতে থাকে। তোমার মধ্যে ফাঁসির আসামীর ভাবটা প্রকট হচ্ছে। তুমি কি নিজের ইচ্ছায় কিছু করছ না?”
শুভ্র কোন উত্তর না দিয়ে খাটের এক কোণে শুয়ে পড়ল। তার প্রবল ঘুম পাচ্ছিল। চোখ মুখ অন্ধকার করে দেওয়া ঘুম। আফরোজা তার চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে স্থানীয় বাঙাল ভাষায় মিষ্টি একটা গান গাইতে থাকল।
শুভ্রর ঘুম চলে আসছিল।
আফরোজা বলল “আচ্ছা, আজকে এত হুজুর এল, তাদের কাউকে এ ঘরে না পাঠিয়ে তোমাকে পাঠাল কেন?”
শুভ্র ঘোর লাগা গলায় বলল “জানি না। আমি কিছুই জানি না”।
আফরোজা বলল “হতে পারে মিশনের দিন এগিয়ে আসছে বলে তোমাকে এখানে পাঠানো হয়েছে। আচ্ছা তুমি গান জানো? হিন্দি গান?”
আফরোজার গলায় আগ্রহ দেখা দিল।
শুভ্র বলল “জানি”।
আফরোজা বলল “কর না”।
শুভ্র বলল “ইচ্ছা করছে না। আমাকে একটু ঘুমাতে দেবে? আমি আর পারছি না। আমার সব কিছু অসহ্য মনে হচ্ছে”।
আফরোজা হাসল “আচ্ছা। ঘুমাও। আমি ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি তোমায়”।
শুভ্র চোখ বুজল।
আর তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দরজায় জোরে জোরে কেউ ধাক্কা মারল।
শুভ্র ধড়মড় করে উঠে বসল।
আফরোজা বলল “তুমি বস। আমি দেখছি”।
আফরোজা উঠে দরজা খুলল।
একজন লম্বা, ফর্সা, কালো আলখাল্লা পরা লোক দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। আফরোজা তাকে দেখে সিটিয়ে গেল।
শুভ্র এই লোককে আগে দেখে নি কোথাও। সে অবাক চোখে তাকাল।
লোকটা আফরোজার দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট বাংলাভাষায় বলল “এই সেই ছেলে?”
আফরোজা মাথা উপর নীচ করল।
লোকটা আফরোজাকে বলল “কতবার করেছে?”
আফরোজা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
লোকটা ঘরের ভেতর প্রবেশ করে শুভ্রর সামনে এসে শুভ্রর গালে সপাটে এক চড় মারল।
শুভ্রর মাথা ঝিন ঝিন করে উঠল। সে ছিটকে পড়ল। লোকটা শুভ্রর চুলের মুঠি ধরে উঠে বসিয়ে বলল “তুই কে? সত্যি করে বল এখানে তুই কী করতে এসেছিস?”
আফরোজা ছুটে শুভ্রকে বাঁচাতে এল। লোকটা আফরোজা জোরে এক চড় মারল। আফরোজা ছিটকে পড়ল।
শুভ্রর চড় খেয়ে মাথা কাজ করছিল না। সে কোন মতে বলল “আমি আতিক। আমি কলকাতা থেকে এসেছি। আমাকে লতিফ রহমান নিয়ে এসেছেন”।
লোকটা শুভ্রর চোখ নাক মুখ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করে শুভ্রর চুলের মুঠি ছেড়ে দিয়ে বলল “যে মানুষ তার লিঙ্গ দিয়ে না ভেবে তার মাথা দিয়ে ভাবে, সে মানুষের মাথায় অন্য কিছু আছে। কী আছে তোর মাথায়? সত্যি করে বল”।
শুভ্রর বমি পাচ্ছিল। কোনমতে বলল “আমি ওনাকে ভয় পাই। তাই কিছু করি নি। এছাড়া কিছু না। বিশ্বাস করেন”।
লোকটা জোরে হেসে উঠল। বলল “একে ভয়? এই মাগীকে? এই তুই এদিকে আয়”।
আফরোজা মেঝেতে পড়ে গেছিল। কোনমতে উঠে লোকটার সামনে এল। লোকটা আফরোজাকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে দাঁত বসিয়ে দিল প্রায়। আফরোজা টুঁ শব্দটি করল না। মিনিট খানেক পরে আফরোজাকে ছেড়ে দিয়ে বলল “কীসের ভয়? এ মাগী কি বাঘ? তোদের জন্য এখানে জন্নতের ব্যবস্থা করে দিয়েছি, তোরা গোটা শহর উড়িয়ে দিবি আর ভয় পাস এই বেশ্যাগুলোকে?”
শুভ্র কিছু বলল না।
লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে কয়েক সেকেন্ড বিষ চোখে শুভ্রর দিকে তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
আফরোজা তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজা বন্ধ করল।
শুভ্রর মাথায় ব্যথা করছিল। কোন মতে বলল “কে ইনি? আগে তো দেখি নি?”
আফরোজা খাটে বসে মাথা নীচু করে বলল “ইনিই বড় হুজুর। আসাদ শেখ। কোন দিন বেরোন না, যেদিন বেরোন, এভাবেই বেরোন। দেখতে এসেছিলেন তুমি সত্যিই কী কর এ ঘরে এসে”।
শুভ্র কথা বলতে পারল না। এবার তার ভয় হচ্ছিল। তীব্র ভয়।
(ক্রমশ)
ঝিঁঝিঁ