ঝাঙুরলতা – রতনতনু ঘাটী

ঝাঙুরলতা – রতনতনু ঘাটী

কাঁকন মনে করে তার খুব বুদ্ধি। কিন্তু সে ছাড়া পৃথিবীর আর সব্বাই জানে যে, কাঁকনের মতো বোকা একটিও নেই। একথা কাঁকনকে অনেকেই বলেছেন। দিদিমা তো প্রায়ই বলেন, ‘এমন বোকা মেয়ে ঘুরে-ঘুরে শেষে আমাদের বাড়িতেই এল!’

আর সায়ন, কাঁকনের দাদা, হোস্টেলে থেকে পড়াশুনো করে। এখন তার ক্লাস সিক্স। ছুটিতে যখন বাড়িতে আসে, বোনকে নিয়েই তার যত পরিকল্পনা। কীভাবে পাশের বাড়ির টুকুকে বোকা বানাবে, কোথায়-কোথায় লুকোবে ‘চোর-চোর’ খেলার সময়। সেইসব পরিকল্পনার মাথামুণ্ডু কাঁকন যখন কিছুতেই বুঝতে পারে না, তখন সায়ন হাসতে-হাসতে বলে, ‘কাঁকন, এই বুদ্ধি নিয়ে অঙ্কে তুই ‘ভেরি গুড’ পাস কী করে? বাবাকে বলব, তোকে রোজ মাছের মুড়ো খাওয়াতে।’

আসলে এরকম একটা ধারণা কাঁকনের অনেক দিনের। সেই কোনদিন মধুপুর থেকে বিজনকাকু এসেছিলেন বেড়াতে। হাসতে-হাসতে বলেছিলেন, ‘মাছের মুড়ো খাবি কাঁকন, দেখবি মাথায় অনেক বুদ্ধি হবে।’

কাঁকন লজ্জা পেয়ে বলেছিল, ‘ধ্যাত!’

বিজনকাকু বলেছিলেন, হ্যাঁ রে, এই যে, আমার এত বুদ্ধি, সবই তো মাছের মুড়ো খাওয়ার জন্যে। আসলে মাছের মুড়ো খেলে কী হয় জানিস, মাছের বুদ্ধিগুলো চলে যায় মানুষের মাথার মধ্যে। তখন বর্ণপরিচয়ের কঠিন-কঠিন বানান বা কঠিন কঠিন অঙ্ক চটপট করে ফেলতে পারবি। ক্লাসে একদম ফার্স্ট।’

কাঁকন বিশ্বাসের ভঙ্গিতে বলেছিল, ‘তাই ক্ক’ তার দু-চোখে গভীর বিস্ময়।

আর বিজনকাকু এইসব আস্ত আজগুবি কথা এমনভাবে বলেন যে, বিশ্বাস না-করাই মুশকিল। বলেছিলেন, ‘শোন কাঁকন, মাছের মাথায় যে দারুণ বুদ্ধি, সে তো তোকে বলে বোঝাতে হবে না। জাল ফ্যাল বা ছিপ ফ্যাল, সহজে কী আর ধরা দেয়।’

বিজনকাকুর কথাটা কাঁকনের মনে ধরেছিল খুব।

সত্যি মাছগুলোর ভীষণ বুদ্ধি। সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা নেড়েছিল কাঁকন।

তাই দেখে বিজনকাকু বলেছিলেন, ‘আচ্ছা কাঁকন, সায়ন কি মাছের মুড়ো পছন্দ করে?’

কাঁকন বেশ জোরের সঙ্গেই বলেছিল, ‘না না, দাদা মাছের মুড়ো খেতে চায় না।’

বিজনকাকু কাঁকনের কথার রেশ টেনে বলেছিলেন, ‘তাই না সায়নের বুদ্ধি এত কম!

কাঁকন চিন্তিত মুখে মাথা নেড়েছিল, ‘বিজনকাকু, তুমি ঠিক বলেছ, দাদা যদি মাছের মুড়ো খাওয়ার জন্য। তার চেয়ে ওই সময় বসার ঘরে একাই যদি একটা ক্রিকেট ম্যাট শেষ করতে পারে, ঢের ভালো। কিন্তু সায়নের বুদ্ধি যে খুব এ-কথা পাড়ার সব্বাই জানে। গত বছরই তো একটা খুব নামি স্কুলে ফাইভে ভর্তির পরীক্ষায় ভালো ফল করে ভর্তি হয়ে গেছে। থাকতে হয় হস্টেলে। সবাই বলেন, ‘সায়নের মতো ছেলে খুব কম হয়। দেখবে, ও একদিন বড়ো হবেই হবে।’

কাঁকন কিন্তু একথা কিছুতেই বিশ্বাস করে না যে, তার চেয়ে সায়নের বুদ্ধি বেশি। পৃথিবীর সকলের চেয়ে যে কাঁকনের বুদ্ধি বেশি, একথা কাঁকনের মন থেকে কেউ তাড়াতে পারবে না, এমনকি আইনস্টাইনের বুদ্ধি কম না-বেশি ছিল কাঁকনের চেয়ে, একথা এখন জিজ্ঞেস করলে কাঁকন প্রথমেই প্রশ্ন করবে, ‘তিনি কী মাছের মুড়ো খেতেন?’ উত্তরে যদি না বলা হয় তো কাঁকন সঙ্গে সঙ্গেই বলবে, ‘তাহলে তো আমার চেয়ে তাঁর বুদ্ধি কমই ছিল।’

একথা শুনে আশপাশে সকলেই যত হাসুক, তাতে কাঁকনের বিশ্বাসের কোনো হেরফের হবে না।

বিজনকাকু মধুপুর থেকে বছরে একবার করে বেড়াতে আসেন। আর বিজনকাকুর শখ শুধু ঘুরেবেড়ানো, দেশ দেখা মানুষের সঙ্গে মেশা। কত রকম উদ্ভট বুদ্ধি যে তাঁর মাথায় ঘোরে তা না-শুনলে বিশ্বাস করাই কঠিন। সায়ন অনেক সময় বিজনকাকুর আজগুবি কথায় হেসে উঠলেও কাঁকন কিন্তু মনোযোগী শ্রোতা।

একবারতো বিজনকাকু এলেন বর্ষার সময়।

এসেই একথা-সেকথার পর বললেন, ‘জানিস কাঁকন, এবারে একটা আজব দেশে বেড়িয়ে এলাম।’ বলেই বেশ উদাস এবং আনমনা হয়ে গেলেন বিজনকাকু। সায়ন আর কাঁকন হাঁ করে তাকিয়ে আছে তাঁর মুখের দিকে। ধীরে-ধীরে বলতে শুরু করলেন তিনি, ‘সেখানে একটা পলাশ- গাছের জঙ্গল আছে। আমি একটা, দুটো কী তিনটে পলাশগাছ একসঙ্গে দেখেছি। কিন্তু এত পলাশগাছ একজায়গায়, ভাবতেই পারিনি। এবার বসন্তে যাব একবার সেখানে। দেখে আসব পলাশ বনের আসল রূপ।’

বলে একটু চুপ করে থাকলেন বিজনকাকু। তারপর ধীরে-ধীরে বলতে শুরু করলেন, ‘সেই পলাশ জঙ্গল পেরোলে একটা ধুধু শ্মশান। তার মাঝখানে একটা মস্ত বটগাছ।’

শ্মশান এবং মস্ত বটগাছের কথা শুনেই কাঁকন সরে এল বিজনকাকুর কাছে, একদম কোলের মধ্যে। বিজনকাকু বললেন, ‘না, আমি ভূতের গল্প বলছি না। সত্যিই ভূত বলে কিছু নেই। সেই বটগাছের বাদামি ঝুরির ঘেরাটোপ পেরিয়ে হাঁটো, তারপর দেখবে একটা ছোট্ট নদী। কী সুন্দর তার পাড়, কী সুন্দর ছবির মতো দু-তিনটে পানসি নৌকো ভেসে যাচ্ছে, মাঝি গান গাইছে। সেই নদীর কথা বলছিলাম। সেই নদীতে কখনও জোয়ারভাটা হয় না। জল সবসময় একই দিকে বয়ে যায়।’

সায়ন বলল, ‘বিজন কাকু, তোমার সব বাজে কথা। তাই কখনো হয়?’

কাঁকন কিন্তু সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল।

বিজনকাকু বললেন, ‘এই দ্যাখ, কাঁকন ঠিক ধরেছে। বুঝলি সায়ন, সেই নদীটা হল কাঁকনের দুটো চোখের মতো। বল কাঁকন তুই যখন বায়না করিস, বায়না না-মিটলে কাঁদিস, তখন তোরও তো চোখের জলের নদী নীচে নেমে আসে হুড়মুড় করে, কি আসে না? কখনো কী সেই নদী চোখের দিকে বয়ে যায়?’

কাঁকন লাজুক মুখে মাথা নাড়ল।

বিজনকাকু বললেন, ‘কাঁকনের চোখের জলের মতো সেই নদীটাও।’

সায়ন বিশ্বাস না-করলেও কাঁকন বিশ্বাস করে।’

কাঁকনের খাওয়াদাওয়া নিয়ে বাড়ির সবাই খুব নাজেহাল। এটা খাব না, ওটা খাব না। বেগুন খাব না, শিম খাব না, করলা খাব না, আবার আপেল খাব না, আঙুর খাব না। সবচেয়ে বেশি অপছন্দ হল আঙুর। কোনো ছোটো ছেলে বা মেয়ে আঙুর খেতে চায় না, একথা কাঁকনকে না-দেখলে বিশ্বাস করাই কঠিন। কিছুতেই আঙুর খাবে না। সে যত মিষ্টি বা টক আঙুরই হোক। সেবার এসে বিজনকাকু দেখে গিয়েছিলেন, আঙুর খাবে না বলে কাঁকনের সে কী কান্না। তাই গত বছর যখন এলেন, তাঁর হাতে বড়ো একথোকা আঙুর। তাই দেখে মা ইঙ্গিতে বললেন, ‘ওসব আবার আনতে গেলেন কেন? কাঁকন তো একদম দাঁতেও কাটতে চায় না।’

মার ইঙ্গিত বুঝতে পারলেন বিজনকাকু। মুখ ফুটে কিছু বলা যাচ্ছে না, তাহলে তো কাঁকন বুঝতে পারবে। তাই বিজনকাকুও ইঙ্গিতে মাকে অপেক্ষা করতে বললেন। তারপর কাঁকনের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললেন, ‘বল তো কাঁকন, আমি কী এনেছি।’

সায়নেরও স্কুল ছুটি। তাই হস্টেল থেকে সেও বাড়িতে এসেছে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছিল সব। কাঁকন বলল, ‘কই দেখি কী এনেছ?’

বিজনকাকু বেশ মজা করে হাসতে-হাসতে বার করলেন একথোকা আঙুর। দেখেই দু-হাত দূরে ছিটকে সরে গেল কাঁকন। বলল, ‘এ মা, তোমার মাথায় একটুও বুদ্ধি নেই বিজনকাকু? আমি তো একদম আঙুর পছন্দ করি না। যাও, তোমার সঙ্গে একটাও কথা বলব না। আড়ি, আড়ি, আড়ি।’

বিজনকাকু, তো পড়লেন মহাবিপদে। বললেন, ‘শোন কাঁকন, আমি কী এনেছি ভালো করে না-দেখেই অমনি রাগ করলি তো?’

কাঁকন দু-দিকে মাথা নেড়ে বলল, ‘না না, আমি কোনো কথাই বলব না। না, না।’

বিজনকাকু দমবার মানুষ নন। বললেন, ‘আচ্ছা বাবা, কথা না-ই বলবি। তার আগে বল তো, আমি কোথায় বেড়াতে গিয়েছিলাম?’

বিজনকাকু কাঁকনের বাবাকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন আগেই যে, ‘এবারে আর বন-জঙ্গল, পাহাড়, ভালো লাগছে না। তাই এবারে সমুদ্রে চললাম। দিঘায়। ঝাউবন, টেউ, বালি, নির্জনতা, বেশ কাটবে ক-দিন। এখান থেকেই যাব তোমাদের বাড়ি।’

তাই কাঁকনও জানত সে-কথা। বলল, ‘তুমি তো দিঘায় বেড়াতে গিয়েছিলে।’

বিজনকাকু ম্যাজিশিয়ানের মতো বললেন, ‘ঠিক তাই, এবার আমি দিঘা গিয়েছিলাম। সেখান থেকেই তো সোজা আসছি!’

কাঁকন বলল, ‘তা বেশ করেছ। আমি কথা বলব না তোমার সঙ্গে, যাও।’

বিজনকাকু বললেন, ‘আগে তো গোটা ঘটনাটা শোন, তারপর না-হয় কথা নাই বলিস। তুই তো জানিস, সায়নও জানে, কোথাও বেড়াতে গেলে সেখানকার কোন জিনিসটা খুব মজার আর নতুন, আগে তা ভেবে দেখি, তারপর তাই কিনি। তো হল কী, দিঘায় ঘুরতে-ঘুরতে ঝাউবনে বেশ অনেক দূর চলে গেছি। পূর্ণিমা ছিল, তাই আকাশ জুড়ে চাঁদও উঠেছে সোনার থালার মতো। আর সে কী জ্যোৎস্না! অমন জ্যোৎস্না তোরা কোনোদিন দেখিসনি, এ আমি হলপ করে বলতে পারি। তা হঠাৎ দেখি, ঝাউগাছে কী সব ছোটো-ছোটো ফল। একসঙ্গে অনেক ঝাউগাছ কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। আর ঝাউগাছগুলো সব ছোটো-ছোটো ফলে ভর্তি। ফিরে এলাম গুনগুন করে গান গাইতে-গাইতে। পরদিন সকালে আবার গেলাম। দেখি বাগানে মালি কাজ করছে। বললাম, হ্যাঁ গো, ঝাউগাছে আঙুরের মতো দেখতে ওগুলো কী?’

মালি হেসে বলল, ‘না বাবু, ওগুলো আঙুর নয়। ও হল ঝাঙুরগাছ।’

আমি বললাম, ‘ঝাঙুরগাছ? এমন ফলের নাম তো কখনও শুনিনি!’

মালি বলল, ‘আমার মালিকের ঠাকুরদা হনলুলু থেকে এই গাছের চারা এনেছিলেন। তারপর এখানে বাগান করেছেন। ঝাউগাছের মতো গাছে এই ফল হয় বলে এর নাম ঝাঙুর। খান না বাবু একটা, খুব ভালো লাগবে।’

আমি একটা ফল মুখে দিয়ে দেখলাম কী মিষ্টি! ঠিক আঙুরের মতো!

মালি বলল, ‘এই ফল বিদেশে চালান যায়।’

মালি বলল, ‘এই ফল বিদেশে চালান যায়। ছোটো ছেলেমেয়েদের খাওয়ানো হয়। তাই তো বিদেশের ছেলেমেয়েদের মাথায় অত বুদ্ধি!’

বিজনকাকু একটু থেমে বললেন, ‘তখনই কাঁকন, তোর কথা মনে পড়ে গেল। অমনই মালির কাছ থেকে একথোকা ঝাঙুর চেয়ে নিলাম।’

বিজনকাকুর কথা শুনে সায়ন মুচকি হেসে চলে গেল ফুটবল মাঠে। কাঁকন দু-চোখের জল মুছে বলল, ‘কই দাও তাহলে, খাই।’

বিজনকাকু জলে ধুয়ে ঝাঙুর ফল খেতে দিলেন কাঁকনকে। কাঁকন খেতে-খেতে হেসে বলল, ‘খেতে একদম আঙুরের মতো। কিন্তু সেই বাজে গন্ধটা একদম নেই। খুব ভালো।’

বিজনকাকু হাসতে-হাসতে বললেন, ‘তাহলে কাঁকনরানি , আর আড়ি নয়। এবার থেকে তোমার বাবকে বলে যাব, খুঁজে-খুঁজে আঙুর নয়, ঝাঙুর ফল কিনে আনতে। তোমার মাথায় বুদ্ধিও হবে খুব!’

কাঁকন মাথা নেড়ে সায় দিল বিজনকাকুর কথায়।

সায়ন সন্ধেবেলা খেলার মাঠ থেকে ফিরে এসে বিজনকাকুর মুখে সব শুনে বলল, ‘তা- হলে বিজনকাকু, কাঁকনের এমনিতেই তো অনেক বুদ্ধি, তার ওপর ঝাঙুর ফল খাবে, বুদ্ধিও বাড়বে খুব। তাই আজ থেকে আমরা কাঁকনের নাম রাখি না কেন ঝাঙুরলতা?’

সেই থেকে বাবা বাজারে গেলেই কাঁকনের জন্য কিনে আনেন আঙুর। এসেই বলেন, ‘কই, আমাদের ঝাঙুরলতা কই? এই দ্যাখো কত্ত ঝাঙুর এনেছি!’

আর তাই দেখে ঝাঙুরলতা আহ্লাদে আটখানা নয়, আহ্লাদে বত্রিশখানা হয়ে যায়। একগাল হেসে বলে, ‘জানো বাবা, পৃথিবীতে ঝাঙুর ফলের মতো জিনিস আর একটাও নেই!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *