ঝাঁম জঙ্গলে দস্যু বনহুর

ঝাঁম জঙ্গলে দস্যু বনহুর

ঝাঁম জঙ্গল অভিমুখে রওয়ানা দেবার পূর্বে বনহুর তার উচ্চ আসনের পাশে এসে দাঁড়ালো। জমকালো ড্রেসে আবৃত তার দেহ, মাথায় পাগড়ি, পায়ে ভারী বুট, কোমরের বেল্টে গুলী ভরা রিভলভার, পিঠে বাঁধা রাইফেল।

রহমান এবং অন্যান্য অনুচরের দেহেও জমকালো ড্রেস, পায়ে বুট আর প্রত্যেকের পিঠেই বাঁধা রয়েছে রাইফেল। এক এক জনের চোখেমুখে কঠিন সংগ্রামিক চিহ্ন ফুটে উঠেছে। মৃত্যুকূপে ঝাঁপিয়ে পড়তেও তাদের নেই যেন এতোটুকু দ্বিধা-দ্বন্দ্ব।

 বনহুর গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠে–ভাই তোমরা জানো আমাদের এ যাত্রা অত্যন্ত সংগ্রামময়। শত্রুর সঙ্গে লড়াই করতে চলেছি আমরা। প্রতিশোধ নিতে চলেছি আমাদের ভাই কাওসার আর সাইফুদ্দিনের নৃশংস হত্যার। মনে রেখো ভাই এ, যতক্ষণ আমরা শয়তান মঙ্গল ডাকুকে গ্রেফতার বা নিহত করতে সক্ষম না হয়েছি ততক্ষণ আমাদের এ সংগ্রাম চলবে।

সকল অনুচর একসঙ্গে বলে উঠলো-আমরা শপথ গ্রহণ করলাম, যতক্ষণ আমরা শত্রুকে পরাজিত করতে না পারবো ততক্ষণ আমরা বিশ্রাম গ্রহণ করবো না।

উচ্চকণ্ঠে বনহুর বলে উঠলোসাবাস!

তারপর সে আসনের পাশ থেকে নেমে এলো নিচে। দরবার কক্ষ ত্যাগ করে দৃঢ় পদক্ষেপে বেরিয়ে এলো বাইরে। বনহুরের পিছনে তার অনুচরগণ তাকে অনুসরণ করে চললোঁ।

 আস্তানার বাইরে এসে দাঁড়ালো সবাই, যেখানে তাদের অশ্বগুলো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে প্রতীক্ষা করছিলো। অসংখ্য মশাল জ্বলে উঠলো দপ দপ করে।

একে রাত্রির অন্ধকার তারপর গভীর জঙ্গলে অসংখ্য মশালের আলো সৃষ্টি করলো এক অদ্ভুত দৃশ্য। এ দৃশ্য সহসা কেউ লক্ষ্য করলে ভয়ে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

কেশব এতদিন ধরে সব দেখছে; যদিও সে পূর্বেই ফুলের নিকটে বনহুর সম্বন্ধে সব অবগত হয়েছিলো তবু বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গেছে। আজ কেশব লুকিয়ে লুকিয়ে সব দেখলো–কোথায় যাচ্ছে ওরা? কেনই বা যাচ্ছে? কিই বা উদ্দেশ্য—কেশব যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না তার বাবু দস্যু সর্দার।

বনহুর তাজের পিঠে চেপে বসতেই অন্যান্য অনুচর উঠে বসলো নিজ নিজ অশ্বপৃষ্ঠে। একসঙ্গে অশ্বগুলো সম্মুখের পা তুলে চিহি চিহি শব্দ করে উঠলো।

ছুটতে শুরু করলো বনহুরের অশ্ব তাজ।

 অন্যান্য অশ্বও ছুটতে শুরু করলো তাজের সঙ্গে সঙ্গে।

গহন জঙ্গল অতিক্রম করে ছুটে চলেছে দস্যু বনহুরের দল। শুধু অশ্ব-পদশব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দই শোনা যাচ্ছে না। আলো, শুধু আলো–মশালের আলোতে বনভূমি আলোকিত হয়ে উঠেছে। উঁচুনীচু টিলা আর জলাভূমির মধ্য দিয়ে তীর বেগে ছুটছে বনহুরের দল। মশালের আলোতে তাদের দেহের জমকালো ড্রেসগুলো ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছিলো।

 জঙ্গলের হিংস্র জীবজন্তুগুলো ভয়ে পালাচ্ছিলো এদিক সেদিকে। ব্যাঘ্র আর সিংহের গর্জন অশ্বখুরের শব্দে চাপা পড়ে যাচ্ছে। রাত ভোর হবার পূর্বেই তারা ঝাঁম জঙ্গলে পৌঁছবে।

*

বনহুরের দল যখন বন-জঙ্গল ভেদ করে উধ্বশ্বাসে অগ্রসর হচ্ছিলো তখন আঁম জঙ্গলের অভ্যন্তরে শিবমন্দির থেকে সুড়ঙ্গ পথে বেরিয়ে এলো মঙ্গল ডাকু তার সঙ্গে কয়েকজন সহচর।

শিবমন্দিরে আজ তাদের পূজা হবে।

মন্দিরের সম্মুখে অসংখ্য ডাকাত দণ্ডায়মান। সবাই নত মস্তকে প্রতীক্ষা করছে শিবপূজা শেষ হবার পরই তারা যাত্রা শুরু করবে। দস্যু বনহুরের সন্ধানে তাদের এ অভিযান।

পুরোহিত সন্ন্যাসী বাবাজী শিবলিঙ্গের সম্মুখে নতজানু হয়ে বসে মন্ত্র উচ্চারণ করে চলেছে।

মঙ্গল ডাকু এসে বসলো পুরোহিত ঠাকুরের পাশে, তার কয়েক জন বিশ্বস্ত অনুচরও বসলো হাঁটু গেড়ে।

পূজা শুরু হলো।

একদল ডাকু ঢাক বাজিয়ে চলেছে।

পুরোহিত মন্ত্র উচ্চারণ করছে।

সম্মুখস্থ অগ্নিকুণ্ড থেকে ধূপের ধূয়া ছড়িয়ে পড়ছে মন্দির মধ্যে। পুরোহিতের সঙ্গেই মন্ত্র উচ্চারণ করছে মঙ্গল ডাকু স্বয়ং। তার সঙ্গে অনুচরগণও মন্ত্র উচ্চারণ করে চলেছে।

একসঙ্গে যখন মন্ত্র উচ্চারণ হচ্ছিলো, তখন বনভূমির মধ্যে যেন মেঘ গর্জনের মত শোনা যাচ্ছিলো। এক একটা ডাকুর সেকি ভীষণ চেহারা। মাথায় ঝাকড়া চুল, এক একজনের চোখগুলো যেন আগুনের ভাটার মত জ্বলছে। তেমনি কর্কশ গম্ভীর তাদের কণ্ঠস্বর।

পূজা শেষ হবে, এমন সময় মন্দিরের বাইরে শোনা গেলো অসংখ্য অশ্বের পদশব্দ। বন-জঙ্গল যেন থরথর করে কেঁপে উঠলো সে শব্দে।

পরক্ষণেই বিপদ-সংকেতধ্বনি ভেসে এলো।

 মঙ্গল ডাকু এবং তার অনুচরগণ আতঙ্কিত হয়ে উঠলো। গহন জঙ্গলে মঙ্গল ডাকুর অনুচরগণ এখন পূজায় রত। পূজা শেষে তারা মন্ত্র গ্রহণ করবে।

মঙ্গল ডাকু সেদিন তার অনুচরগণের নিকটে যখন জানতে পেরেছিলো দস্যু বনহুরের দল তার কয়েকজন অনুচরকে হত্যা করেছে এবং একজনকে ধরে নিয়ে গেছে, তখন সে ভীষণভাবে ক্ষেপে গিয়েছিলো। দস্যু বনহুরের নাম শুনতেই তার শরীরে আগুন ধরে যাচ্ছিলো। তারপর সেই দস্যু বনহুর তার অনুচরদের নিহত করেছে আর একজনকে ধরে নিয়ে গেছে–কথাটা শুনে রাগে সে অগ্নিশিখার মত জ্বলে উঠেছিলো, আদেশ দিয়েছিলো অনুচরদের প্রতি তোমরা তৈরি হয়ে নাও, আমি অচিরেই দস্যু বনহুরের সন্ধানে বের হবে। তাকে যতক্ষণ না শায়েস্তা করেছি ততক্ষণ আমার স্বস্তি নেই।

আজ সে কারণেই শিবপূজা করছিলো মঙ্গল ডাকু। যখনই সে দস্যুতা বা লুটতরাজ করতে বের হতো তখনই সে শিবপূজা শেষ করে নিতে।

পূজা শেষ হবার পূর্ব মুহূর্তে অসংখ্য অশ্বারোহী ঘিরে ফেললো শিবমন্দির। পালাবার সময় পেলো না কেউ।

অশ্বারোহিগণ অন্য কেউ নয়–তারা দস্যু বনহুরের দল। সঙ্গে সঙ্গে ভীষণভাবে আক্রমণ করলো ওরা মঙ্গল ডাকুর দলকে। ক্ষিপ্তের মত উন্মাদ হয়ে উঠলো সবাই।

দু’দলে শুরু হলো ভীষণ যুদ্ধ।

অল্পক্ষণেই মঙ্গল ডাকুর দল ছত্রভঙ্গ হয়ে কে কোথায় অন্তর্ধান হলো, আর দেখা গেলো না।

 বনহুর প্রবেশ করলো শিবমন্দিরে।

 কিন্তু তার পূর্বেই মঙ্গল ডাকু আত্মগোপন করতে সক্ষম হয়েছে।

বনহুর স্মরণ করলো মঙ্গল ডাকুর অনুচর মৃত্যুর পূর্বে তাদের কাছে প্রকাশ করেছিলো ঝাঁম জঙ্গলে শিবমন্দিরের মধ্যেই আছে একটি সুড়ঙ্গপথ, সে পথে প্রবেশ করলেই পাওয়া যাবে মঙ্গল ডাকুর আস্তানা। বনহুর যখন শিবমন্দির মধ্যে সুড়ঙ্গ পথের সন্ধান করে চলেছে তখন মঙ্গল ডাকু বা তার কোনো অনুচরের টিকিটি পর্যন্ত ছিলো না। শুধু এখানে সেখানে ছড়িয়ে পড়ে আছে কতগুলো নিহত মানবদেহ।

 বনহুর মন্দিরমধ্যে প্রবেশ করে সন্ধান করতে লাগলো সেই সুড়ঙ্গপথ কোথায়? আর সেই ডাকু মঙ্গলই বা গেলো কোথায়? বহুকালের পুরোন মন্দির হলেও মন্দিরটা মজবুতভাবে তৈরি কোথাও ভাঙাচুরা বা ফাটল নেই। পাথরের মত মসৃণ মন্দিরের দেয়ালটা।

 বনহুর আশ্চর্য হয়ে অন্বেষণ করে চললো–লোকটা কি তবে মিথ্যা বলেছিলো তাদের কাছে! কই, মন্দিরের মধ্যে কোথাও কোনোরকম চিহ্ন পর্যন্ত নেই যেখানে কোনো সুড়ঙ্গমুখ থাকতে পারে কিন্তু সে লক্ষ্য করেছে-মন্দির মধ্যেই ছিলো কয়েকজন দস্যু এবং তার মধ্যেই যে মঙ্গল ডাকু ছিলো তাতে কোনো ভুল নেই। তবে তারা গেলো কোথায়?

বনহুরের সঙ্গেই ছিলো রহমান আর কায়েস। অন্যান্য অনুচর বনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিলো, মঙ্গল ডাকু এবং তার অনুচরদের সন্ধানে, কিন্তু কোথাও তাদের খোঁজ পাওয়া গেলো না।

রহমান আর কায়েস যখন মন্দিরের পিছন দিকে এগিয়ে গেছে তখন বনহুর ঠিক শিবলিঙ্গটার উপরে হাত রেখে খুব জোরে চাপ দিয়ে দেখছিলো কোনো কৌশল এখানে আছে কিনা–বনহুর যেমন লিঙ্গটা বলিষ্ঠ হাতে ধরে খুব জোরে একপাশে ঠেলে দিয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে আচমকা বনহুর পড়ে গেলো এক অন্ধকারময় গর্তে।

বনহুর যখন গর্তটার মধ্যে পড়ে গেলো তখন রহমান আর কায়েস তার নিকট হতে বেশ দূরে সরে গিয়েছিলো, যদিও মন্দিরের মধ্যেই ছিলো তারা, তবু মোটেই টের পেলো না। কোনোরকম শব্দও হয়নি, যেন যাদুমন্ত্রে কোথায় উবে গেলো ধূমকেতুর মত।

 রহমান আর কায়েস সর্দারকে না দেখে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। মনে করলো সর্দার কি তাদের না বলেই মন্দিরের বাইরে চলে গেছে! হয়তো তাই হবে।

রহমান মন্দিরের বাইরে এসে সন্ধান করেও যখন সর্দারকে পেলো না তখন চিন্তিত হয়ে পড়লো৷ সংকেতধ্বনি করে অনুচরদের আহ্বান জানানো হলো। একরকম ভেঁপু ধরনের চোং আছে, তাতেই ফুঁ দিলো রহমান নিজে।

এ রকম সংকেতধ্বনি তারা ঐ মুহূর্তে করে থাকে যে মুহূর্তে তারা সবচেয়ে বেশি বিপদের সম্মুখীন হয়।

সংকেতধ্বনি শ্রবণের সঙ্গে সঙ্গে অশ্ব নিয়ে সবাই দ্রুত এসে একত্রিত হলো মন্দিরের সম্মুখে রহমান নিজের অশ্বের পাশে দাঁড়িয়ে বললো–ভাই এ, একটা দুঃসংবাদ আমাদের সর্দারকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। না জানি সর্দার কোথায় গেলেন। তিনি যে নিজ ইচ্ছায় আমাদের দৃষ্টির আড়ালে চলে যাননি তা নিশ্চিত।

সমস্ত অনুচরের মুখ গম্ভীর বিষাদময় হলো, এতোক্ষণ যে উদ্যমে তারা সগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলো নিমিষে তা যেন মুছে গেলো। একটা অজানা আশঙ্কা ছড়িয়ে পড়লো তাদের চোখেমুখে

রহমান আদেশ করলো-এসো আমরা অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে সর্দারের সন্ধান করি।

আবার চললো অনুসন্ধান।

সমস্ত ঝাঁম জঙ্গল চষে ফেললো, মন্দিরের মধ্যে তন্ন তন্ন করে খোঁজা শুরু হলো তবু কোথাও সর্দারের কোনো চিহ্ন পাওয়া গেলো না।

ওদিকে বনহুর যখন শিব লিঙ্গটায় খুব জোরে জোরে চাপ দিচ্ছিলো তখন হঠাৎ তার পায়ের নিচে মেঝেটা সরে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে পড়ে যায় গর্তের মধ্যে। আসলে সেটা গর্ত নয় একটা সুড়ঙ্গমুখ। এ সুড়ঙ্গমুখের কথাই বলেছিলো মঙ্গল ডাকুর অনুচরটি।

 বনহুর সুড়ঙ্গমধ্যে পড়ে যেতেই দেখতে পায় তার চারপাশে ঘিরে রয়েছে অসংখ্য সূতীক্ষ্ণধার বর্শা। সোজা হয়ে দাঁড়াতেই দু’জন বলিষ্ঠ লোক ধরে ফেললো বনহুরের বাহুদ্বয়।

বনহুর মুহূর্তের জন্যও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলো না, সে বুঝতে পারলো, তাকে কৌশলে বন্দী করলো মঙ্গল ডাকু।

সম্মুখে তাকাতেই একজন অসুরের মত ভয়ঙ্কর লোককে দেখতে পেলো বনহুর। লোকটা সাধারণ মানুষ নয় তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। সেকি ভীষণ আকার! মাথায় এক আংগুল ছোট করে ছাটা চুল। সজারুর কাঁটার মত খাড়া একজোড়া গোঁফ। চোখ দুটো যেন আগুনের ভাটার মত জ্বলছে। শরীরের মাংশপেশীগুলো যেন পাথরের মত শক্ত-কঠিন মনে হচ্ছে। বনহুরের সম্মুখে এসে দাঁড়ালো লোকটা। প্রথম নজরেই বনহুর অনুমান করে নিলো–এ শয়তানই ঝাঁম জঙ্গলের সর্দার মঙ্গল ডাকু। তীক্ষ্ণ নজরে তাকালো বনহুর ওর দিকে।

 মঙ্গল ডাকুর চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে। দৃঢ় মুষ্টিতে আচমকা চেপে ধরলো। বনহুরের গলার কাছে জামাটা।

 সঙ্গে সঙ্গে বনহুরের দক্ষিণহস্তের বজ্রমুষ্টি গিয়ে পড়লো মঙ্গল ডাকুর নাকের উপর। আশ্চর্য, বনহুরের মুষ্ট্যাঘাতে মঙ্গল ডাকু এতোটুকও টললো না।

 বনহুর যে মুহূর্তে মঙ্গল ডাকুর নাকের উপর মুষ্ট্যাঘাত করেছিলো সেই দণ্ডে তার চারপাশের অস্ত্রধারিগণ বনহুরের দেহে বর্শা বিদ্ধ করতে উদ্যত হলো।

মঙ্গল ডাকু হাত দিয়ে তাদের ক্ষান্ত হবার জন্য ইংগিত করলো; এবার মঙ্গল ডাকু বনহুরের জামার কলার চেপে ধরে ঝাঁকুনি দিলো, তারপর দাঁত পিষে বললো….কে তুমি বলো?

এতোক্ষণে বনহুর আশ্বস্ত হলো যেন, যাক শয়তানটা তাহলে তার পরিচয় জানে না। বনহুর বললো–আমি তোমার বন্ধু।

বন্ধু! হাঃ হাঃ হাঃ, বন্ধুই বটে! তাহলে আচমকা এ আক্রমণ করে আমাদের পূজা নষ্ট করলে কেন বন্ধু?

বনহুর ওকে যতখানি মূর্খ বন্য পশু ভেবেছিলো, ওর কথায় সে ভুল ভেঙে গেলো। বুঝতে পারলো, শয়তানটার মাথায় বেশ বুদ্ধি আছে। কথা বলার ঢং দেখে বনহুর অবাকও হলো কিছুটা, স্থিরকণ্ঠে বললো–পূজা নষ্ট করতে আসিনি, তোমার পূজায় যোগ দিতে এসেছিলাম।

অট্টহাসি হেসে উঠলো মঙ্গল ডাকু-হাঃ হাঃ হাঃ, হাঃ হাঃ হাঃ পূজায় যোগ দিতে এসেছিলে? তা ভালই করেছো, এবার বলো কে তুমি?

আমি তো বললাম, তোমার বন্ধু।

জানো আমার কাছে বন্ধুর পরিণতি অতি নির্মল? আমি বন্ধুকে তার মর্যাদাস্বরূপ অগ্নিদগ্ধ করে হত্যা করে থাকি।

চমৎকার! আমিও বন্ধুর কাছে সেরূপ মর্যাদাই কামনা করে থাকি।

এমন সময় একজন অনুচর বলে উঠে-হুজুর, এ লোকটা নিশ্চয়ই দস্যু বনহুরের অনুচর।

হাঁ ঠিক বলেছো, আমারও সেরকম মনে হচ্ছে। দস্যু বনহুরের লোক ছাড়া এমন কথাবার্তা আর কোনো দলের লোক বলতে পারবে না–বলো তুমি দস্যু বনহুরের অনুচর কিনা?

তোমাদের অনুমান মিথ্যা নয়।

মঙ্গল ডাকুর চোখ দুটো মশালের আলোতে জ্বলে উঠলো তীব্রভাবে। দাঁতে দাঁত ঘষে বললো–আমি প্রথমেই মনে করেছিলাম দস্যু বনহুরের দল ছাড়া আমার লোকদের পরাজিত করে কার শক্তি! এবার মঙ্গল ডাকু নিজের অনুচরগণকে লক্ষ্য করে বললো–নিয়ে চলো আস্তানার ভিতরে।

 বনহুর বুঝতে পারলো, সে ঠিক পথেই প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছে। যদিও বন্দী হওয়ায় একটু চিন্তিত হয়ে পড়েছে সে তবু মনে মনে খুশিও হয়েছে। কৌশলে মঙ্গল ডাকুকে হাতের মুঠায়। আনতে তাকে বেগ পেতে হবে না আর।

 চতুর্দিকে অস্ত্র বাগিয়ে ধরে বনহুরকে নিয়ে অগ্রসর হলো মঙ্গল ডাকু ও তার অনুচরগণ। বনহুর ভালভাবে লক্ষ্য রেখে চলছিলো, যদিও তার চারিপাশে ঘিরে রয়েছিলো অগণিত অস্ত্রধারী দস্যুদল।

মঙ্গল ডাকু সর্বপ্রথম চলছিলো।

 বনহুরের মুখমণ্ডল কঠিন, তার সঙ্গে এখনও সবগুলো অস্ত্র রয়েছে পিঠে ঝুলছে রাইফেল, কোমরের বেল্টে সূতীক্ষ্ণ ধার ছোরা। রিভলভারও রয়েছে ছোরার পাশে বেল্টের সঙ্গে। এতোগুলো অস্ত্র সঙ্গে থাকা সত্ত্বেও বনহুর যেন নিরীহ মানুষটির মত এগিয়ে চলেছে। ইচ্ছা করলে সে এদের কাবু করতে পারে কিন্তু পালানোর পথের সন্ধান তার জানা নেই, কাজেই নীরবে এদের কথা পালন করাই এখন শ্রেয়ঃ।

 যে পথে বনহুর এখন অগ্রসর হচ্ছিলো সে পথ যে অত্যন্ত গোপনীয় কোনো সুড়ঙ্গপথ তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলো। কারণ সে পথে কোনোরকম বাইরের আলো প্রবেশ করছিলো না।

 মশালের আলো ছাড়া আর কোনো আলোই দৃষ্টিগোচর হচ্ছিলো না সে পথে। অনেকক্ষণ লাগলো–বনহুরকে নিয়ে ওরা পৌঁছলো একটা মস্তবড় ঘরে। বিস্মিত হলো বনহুর সে ঘরে প্রবেশ করে মশালের আলোতে তাকিয়ে দেখলো ঘরটার মধ্যে অনেকগুলো লোককে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। কারো হাতে-পায়ে লৌহশিকল কেটে বসে গেছে, কারো গলায় শিকল বাঁধা কতদিন যে তার গলায় শিকল পরা রয়েছে যার দরুন গলায় গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। কারো চক্ষুদ্বয় অগ্নিদ্বগ্ধ লৌহশলাকা দ্বারা অন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কারো জিভ কেটে ফেলা হয়েছে, রক্ত ঝরছে মুখ দিয়ে। সেকি নির্মম মর্মান্তিক দৃশ্য! বনহুরের দস্যু-প্রাণও কেঁদে উঠলো, এ দৃশ্য সে যেন সহ্য করতে পারছিলো না।

 বনহুর হতবাক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলো এ সব অসহায় বন্দীদের দিকে। বনহুর নিজেও বহু বন্দীকে নির্মম সাজা দিয়েছে বা হত্যা করেছে কিন্তু এভাবে তিল তিল করে নয়।

 কঠিন কণ্ঠে বললো বনহুর–মঙ্গল, এরা তোমার কাছে কি অপরাধ করেছিলো যার জন্য হত্যা না করে এ ভাবে শাস্তি দিচ্ছো?

 বন্দীর মুখে তার নাম শুনে অবাক হলো মঙ্গল ডাকু। বললো সে–আমার নাম জানলে কি করে?

তোমাকে দেখেই আমি নাম জেনে নিয়েছি।

 বড় সুচতুর দেখছি তুমি! বললো মঙ্গল ডাকু।

বনহুর হাসলো।

 মঙ্গল ডাকু বললো–জানো এদের মতই তোমাকেও বন্দী করে রাখা হবে।

সে কথা আমি প্রথমেই অনুমান করে নিয়েছি। কিন্তু আমি জানতে চাই, এরা কি অপরাধ করেছিলো যার জন্য এদের এ রকম শাস্তির ব্যবস্থা করেছো?

মঙ্গল ডাকু বললো এবার–জানতে চাও এদের অপরাধের কথা?

হা বলো?

 তোমাকেও এমনি সাজা দেওয়া হবে যদি তুমি আমাদের কথা না শোনো।

 আমাকে শাস্তি দেবার পূর্বে আমি এদের কথা জানতে চাই?

শোনো দস্যু, আমি জানি তুমি দস্যু বনহুরের লোক–আর এও জানি, তোমরা সহজে তোমাদের সর্দারের সন্ধান দিতে রাজি নও। জানো এ কারণেই আমি তোমাদের দলের দু’জনকে নির্মমভাবে হত্যা করেছি, তবু তারা তাদের সর্দারের সন্ধান বলেনি বা আস্তানার খোঁজ দেয়নি। তুমি যদি এ ব্যাপারে তোমার ভাইদের মত আচরণ করো তাহলে তোমার মৃত্যু এদের মত হবে। না।

 বেশ, তুমি যেভাবে চাও আমাকে হত্যা করো তাতে আমার কোনো দুঃখ নেই।

 কি বললে–তুমিও মরবে তবু সর্দারের সন্ধান দেবে না?

আমি সর্দারের সন্ধান দেবো, তার পূর্বে জানতে চাই–এরা–এই বন্দীগণ তোমাদের কাছে কি দোষ করেছিলো?

 মঙ্গল ডাকু তার অনুচরদের ইংগিত করলো কয়েকজন থাকবে আর বাকীগুলো বেরিয়ে যাবে।

 মঙ্গল ডাকুর আদেশ অনুসারে বেরিয়ে গেলো কয়েকজন অনুচর, আর মশাল হস্তে দাঁড়িয়ে রইলো কয়েকজন।

মঙ্গল ডাকু বললো–এই যে বৃদ্ধ লোকটাকে দেখছো এর অবস্থা অত্যন্ত ভাল-রাজাধিরাজ! আমি এর কাছে চেয়েছিলাম ওর কন্যা শমশেরী বানুকে, কিন্তু ও দেয়নি–তাকে অন্যদেশে বিয়ে দিয়ে নিজে রেহাই পেতে চেয়েছিলো…..হেসে উঠলো মঙ্গল ডাকু, তারপর হাসি থামিয়ে বললো–মঙ্গল ডাকুর কাছে রেহাই পাবে না কেউ, হত্যা করলে কষ্ট হবে কি করে, তাই আজ সাত বছর ধরে ওকে গলায় শিকল পরিয়ে বন্দী করে রেখেছি; জানে মারবো না। এক সপ্তাহ পর মরা গরুর মাংস সিদ্ধ করে খেতে দেই, তাই খেয়ে বেঁচে আছে আজও……হাঃ হাঃ হাঃ মরবে না, মরতে দেবো না কিন্তু যতদিন না শমশেরী বানুকে পাবো ততদিন আমি ওকে এভাবে শাস্তি দেব।

বনহুরের দক্ষিণহস্ত মুষ্টিবদ্ধ হলো, মঙ্গল ডাকু সম্বন্ধে সে পূর্বে যা অবগত হয়েছিলো সে কথা মিথ্যা নয় তবে। একবার হাতখানা কোমরের বেল্টে রিভলভারে গিয়ে ঠেকলো কিন্তু নিজেকে সংযত করে নিলো সে অতি কষ্টে।

বনহুর তাকালো বৃদ্ধের ওপাশে একটা জিহ্বা ছেদন-করা বন্দীর দিকে। কি করুণ সুরে সে গোঙাচ্ছে! তখনও তার মুখ দিয়ে দলা দলা জমাট রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।

মঙ্গল ডাকু বললো–এ শয়তান আমাকে মিথ্যা ধোকা দিয়েছিলো, আমাকে ভুল পথে নিয়ে গিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেবার সুযোগ খুঁজেছিলো, তাই আমি ওর উল্টা শাস্তি দিয়েছি। মরবে না সহজে কিন্তু খেতেও পারবে না বা কথাও বলতে পারবে না। আর ঐ যে দেখছো ওকে শিকল পরিয়ে রেখেছি আজ তিন বছর, আমার দলের লোককে হত্যা করেছিলো বলে। আর ঐ যে লোকটা, চোখ দুটো ওর অগ্নিদগ্ধ করে অন্ধ করা হয়েছে……

বনহুর কঠিন কণ্ঠে বলে উঠে–থামো আর শুনতে চাই না। শয়তান ওরা নয়– তুমি…..বনহুর রিভলভারে হাত দেবার পূর্বেই মঙ্গল ডাকু বজ্রমুষ্টিতে চেপে ধরে বনহুরের হাত।

 বনহুর এক ঝটকায় মুক্ত করে ফেলে নিজের হাতখানা, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তার চারপাশে অসংখ্য উদ্যত বর্শা লক্ষ্য করে স্থির হয় সে।

মঙ্গল ডাকু এবার আদেশ দেয় তার অনুচরদের–এর সব অস্ত্র নামিয়ে ফেলো।

 সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন বনহুরের শরীর থেকে অস্ত্র কেড়ে নেওয়ার জন্য অগ্রসর হয় কিন্তু বনহুর তাদের শরীরে হাত দেবার পূর্বেই একজনকে মুষ্ট্যাঘাতে ধরাশায়ী করে।

 তৎক্ষণাৎ কয়েকটা বর্শা বনহুরের দেহে বিদ্ধ হবার উপক্রম হয়, এবারও মঙ্গল ডাকু ক্ষান্ত করে তাদের, বলে–একে হত্যা করলে আমাদের সব কিছু ব্যর্থ হবে। দস্যু বনহুরের সন্ধান এর কাছে নিতেই হবে।

বনহুরের দেহ থেকে সমস্ত অস্ত্র নামিয়ে নেওয়া হলো।

এবার নীরব রইলো বনহুর, অবশ্য কতকটা ইচ্ছা করেই সে চুপ রইলো বটে।

 মঙ্গল ডাকু বললো–এই বন্দীদের শাস্তি দর্শন করেই তুমি অবাক হচ্ছো দস্যু বনহুরের অনুচর? আরও বন্দী আছে–তারা বন্দিনী বটে…..

বন্দিনী।

 হ, এসো আমার সঙ্গে। মঙ্গল ডাকু এগিয়ে চললো।

 বনহুর অনুসরণ করলো মঙ্গল ডাকুকে।

অন্যান্য বর্শাধারী অনুচর বনহুরকে ঘিরে ধরে অগ্রসর হলো।

বন্দীকক্ষের পরই আর একটি কক্ষ; ঠিক কক্ষ নয়–যেন এক একটি গুহা। বনহুর এই গুহা বা কক্ষে প্রবেশ করে থমকে দাঁড়ালো এবং সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণহস্তের বাজু দিয়ে চোখ দুটো ঢেকে ফেললো। প্রায় আট-দশটি নারীকে উলঙ্গ অবস্থায় হাত-পা দেয়ালের সঙ্গে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। কারো শরীরে বসন নেই, হাত-পা শিকল দিয়ে দেয়ালে আটকানো। মাথার চুল এলোমেলো বিক্ষিপ্ত। সেকি বীভৎস দৃশ্য! বনহুর দ্বিতীয়বার তাকাতে পারলো না, সে ফিরে দাঁড়ালো।

মঙ্গল ডাকু বললো–কি হলো?

 বনহুর বললো–বেরিয়ে চলো এ কক্ষ থেকে।

মঙ্গল ডাকু আর বনহুর বেরিয়ে এলো, পূর্বের সেই বন্দীশালায় এসে বললো বনহুর–ঐ নারীদের তুমি কেন এভাবে সাজা দিচ্ছো?

 মঙ্গল ডাকু আমার নাম, আমি কাউকে খাতির করি না। যে নারী আমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করবে তাকেই আমি এভাবে সাজা দিয়ে থাকি।

 বনহুরের ধমনীর রক্ত টগবগ করে উঠলো, এই মুহূর্তে ওর টুটি ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছা হলো– কিন্তু এখন কোনো উপায় নেই। তাকে ধৈর্য ধরতেই হবে, না হলে কোনো কাজই সমাধা হবে না। তবু বললো বনহুর-শয়তান, তোমার মা-বোন-স্ত্রী নেই? অসহায়া নারীদের প্রতি তোমার এই কুৎসিত নির্মম আচরণ কেন?

 মঙ্গল ডাকুকে জানো না বাছাধন? আমাকে শয়তান বলছে, কিন্তু কিছুক্ষণ পর জানতে পারবে তোমার নিজের অবস্থাটা কি হয়! মা-বোন-স্ত্রী…..হাঃ হাঃ হাঃ, মঙ্গল ডাকুর আবার মা-বোন-স্ত্রী?

সে তোমার আচরণেই টের পেয়েছি।

একটু দাঁড়াও আরও পাবে! মঙ্গল ডাকু ইংগিত করলো–একে লৌহশিকল দিয়ে বেঁধে ফেলো, জানতে চাই-এর সর্দার বনহুরকে, আর কোথায় তার আস্তানা?

বনহুর বললো–আমাকে শিকল পরালে আমি কোনো উত্তরই দেবো না। বরং আমাকে মুক্ত অবস্থায় তুমি যে-কোনো প্রশ্ন করবে, আমি সঠিক উত্তর দেবো।

 বেশ তাই হবে, কিন্তু কোনোরকম চালাকি বা বদমাইশি করলে তোমাকে আমরা অগ্নিদগ্ধ লৌহশলাকা দ্বারা অন্ধ করে দেবো। তাছাড়া পালাবার চেষ্টা করলেও সম্পূর্ণ ব্যর্থ হবে।

বনহুর মঙ্গল ডাকুর কথায় কান না দিয়ে বললো–তুমি কি জানতে চাও বলো?

জানতে চাই তোমাদের সর্দার বনহুর কে? কি তার পরিচয়।

আমাদের সর্দার মানুষ–এই তার পরিচয়।

 মানুষ তো আমরাও।

 না, তোমরা মানুষ নও।

 মানুষ নই আমরা?

না। তোমরা জানোয়ার।

কি বললে–আমরা জানোয়ার?

তা না হলে এই নিষ্পাপ মানুষগুলোকে এভাবে বন্দী করে রেখেছো কেন?

 আমি জানি, তোমাদের সর্দার আমার চেয়েও নির্মম।

কিন্তু সে অমানুষ নয়! বনহুরের কণ্ঠ এবার বজ্রকঠিন শোনালো।

মঙ্গল ডাকু পর্যন্ত কেঁপে উঠলো সে কণ্ঠস্বরে, স্তব্ধ হয়ে তাকালো।

বনহুর বললো–আমাদের সর্দার বিনা কারণে বা বিনা অপরাধে কাউকে সাজা দেয় না। আর তুমি এসব নিরীহ নিরপরাধ লোকদের যেভাবে পিষে মারছে এতে তোমাকে মানুষ বলতে ঘৃণা হয়।

মঙ্গল ডাকুর চোখ দুটো আগুনের গোলার মত জ্বলে উঠলো। খপ করে চেপে ধরলো বনহুরের গলার কাছে জামাটা–আমাকে তুমি ঘৃণা করো! এতো বড় সাহস তোমার?

বনহুর অতি সহজেই মঙ্গল ডাকুর হাত ছাড়িয়ে দিলো, ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বললো–তোমার মত কুকুরকে ঘৃণা ছাড়া কি করবো বলো?

মঙ্গল ডাকু তখনই আদেশ দিলো তার অনুচরগণকে বেঁধে ফেলো মজবুত করে–তারপর শাস্তির ব্যবস্থা করবো।

 মুহূর্ত বিলম্ব হয় না, কয়েকজন বলিষ্ঠ লোক বনহুরকে লৌহশৃঙ্খলে আবদ্ধ করে ফেললো। বাধ্য হলো বনহুর নীরব থাকতে, কারণ এই ভূগর্ভস্থ আস্তানার পথ তার জানা নেই যে পথে বের হওয়া যায়, তাছাড়া তার চারপাশে অসংখ্য বর্শা উদ্যত হয়ে রয়েছে। বনহুরকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হলো।

মঙ্গল ডাকু কর্কশ কঠিন কণ্ঠে বললো–এবার বলো তোমার সর্দারের আস্তানা কোথায়?

 আমার সর্দারের আস্তানা ভূগর্ভে।

ভূগর্ভে–কিন্তু কোথায়? কোন্ এলাকায় বলো?

 বললে তুমি খুঁজে পাবে না, দস্যু বনহুরের আস্তানার সন্ধান পাওয়া সহজ কথা নয়।

 তবু তোমাকে বলতে হবে।

কান্দাই-এর অদূরে সারথী নদীর নিচে এ আস্তানা আছে।

মনে রেখো, মিথ্যা হলে তোমাকে ভয়ঙ্কর মৃত্যু গ্রহণ করতে হবে।

মৃত্যুভয়ে ভীত না হলেও তোমার হাতে মরার হীনতা আমি সহ্য করতে পারবো না। কাজেই আমার কথার একবর্ণ মিথ্যা নয়।

সেখানেই তোমার সর্দারকে পাবো?

হাঁ, নিঃসন্দেহে।

জানো মঙ্গল ডাকু দস্যু বনহুরের প্রধান শত্রু?

জানি, কিন্তু কারণ জানি না।

কারণ মঙ্গল ডাকুর উপরে পৃথিবীর বুকে কোনো ডাকু বড় হবে–এ আমি সহ্য করবো না।

 হাসলো বনহুর দস্যু বনহুর তাহলে তোমার চেয়ে বড়?

হাঁ, আমার মনে হয় সে আমার চেয়েও বড় দস্যু।

 তাই তাকে নিঃশেষ করতে চাও?

তোমার অনুমান সত্য; আমি তোমাদের সর্দারকে নির্মূল করবো। দেখ, তুমি যদি তোমাদের সর্দারের সন্ধান দাও তাহলে আমি তোমাকে আমার সহচর করে নেবো।

বনহুরের মুখোভাব প্রসন্ন হলো, খুশিভরা কণ্ঠে বললো-হাঁ, আমার ইচ্ছাও তাই।

 সত্যি করে বলছো তুমি আমার দলে আসবে?

আসবো।

 তোমাকে শপথ করতে হবে।

 বেশ করবো।

 মঙ্গল ডাকু ইংগিত করলো–একে সাবধানে বেঁধে রাখো, কাল ভোরে শিবলিঙ্গ স্পর্শ করে। একে শপথ করতে হবে।

তারপর চলে গেলো মঙ্গল ডাকু সেখান থেকে।

এবার মঙ্গল ডাকুর অনুচরগণ বনহুরকে পাথরের দেয়ালের বালার সঙ্গে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে রাখলো। ইচ্ছা করলে বনহুর বাধা দিতে পারতো কিন্তু সে বাধা দিলো না, কারণ বাধা দিয়ে তখন। কোনো কিছুই করা সম্ভব নয়। পরদিন ভোরের প্রতীক্ষায় রইলো সে।

*

ঝাঁম জঙ্গলের শিবমন্দির এবং সমস্ত ঝাঁম জঙ্গল তন্ন তন্ন করে অনুসন্ধান করেও রহমান ও কায়েস তাদের সর্দারের কোনো খোঁজ পেলো না। দুশ্চিন্তায় রহমান মুষড়ে পড়লো, কায়েসের অবস্থাও তাই। রহমান এক কৌশল অবলম্বন করলো। এবার সে কায়েসকে গোপনে বললো কায়েস, তুমি দলবল নিয়ে ফিরে যাও।

 আর তুমি কি করবে রহমান? বললো কায়েস।

রহমান গম্ভীর কণ্ঠে বললো–আমার যাওয়া সম্ভব নয়, যতক্ষণ না আমি সর্দারের সন্ধান পেয়েছি।

সর্দার কোথায় অন্তর্ধান হলেন কি করে তার সন্ধান পাবে রহমান?

আমি জানি, শয়তান মঙ্গল ডাকুর চক্রান্তে সর্দার বন্দী হয়েছেন।

 বলো কি?

হাঁ, আমার মন বলছে কায়েস।

 কিন্তু কোথায় কিভাবে তাকে বন্দী করা হলো আমরা নিকটে থেকেও বুঝতে পারলাম না?

জানো না কায়েস মঙ্গল ডাকু অসাধারণ পাজী, দুর্দান্তও বটে। তার পৈশাচিক আচরণে দেশময়। আজ আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। কারো স্ত্রী-কন্যা-ভগ্নী এই নরপিশাচের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। আমার মনে হয়, সে সর্দারকে কৌশলে বন্দী করে ফেলেছে। কায়েস, আমি সর্দারের সন্ধান না করে ফিরে যাবো না। তোমরা যাও কিন্তু আবার আগামী রাতে তোমরা দুলকীকে নিয়ে এই জঙ্গলে আসবে। মনে রেখো, যতক্ষণ আমরা সর্দারকে না পেয়েছি ততক্ষণ নিশ্চিন্ত নই।

রহমানের নির্দেশ অনুসারে কায়েস এবার অনুচরদেরসহ ঝম থেকে বিদায় গ্রহণ করলো। আবার জেগে উঠলো অসংখ্য পদধ্বনি। কায়েস যখন দলবল নিয়ে ফিরে চললো তখন রহমান আত্নগোপন করলো জঙ্গলের মধ্যে, মঙ্গল ডাকুর একটি নিহত অনুচরের দেহ থেকে রক্তমাখা পোশাক খুলে নিয়ে পরে নিলো দ্রুতহস্তে। মৃতদেহটা লুকিয়ে রাখলো একটা ঝোঁপের মধ্যে।

এবার রহমান নিজের ছুরি দিয়ে কপালের পাশে কিছুটা কেটে ফেললো, ঝর ঝর করে পড়তে লাগলো তাজা লাল টকটকে রক্ত। আর মুহূর্ত বিলম্ব না করে রহমান মঙ্গল ডাকুর নিহত অনুচরদের মধ্যে গিয়ে শুয়ে পড়লো, মৃতবৎ পড়ে রইলো সে।

কায়েস ও তার দলবলের অশ্ব-পদশব্দ মিশে যেতে না যেতেই বেরিয়ে আসে মঙ্গল ডাকুর কয়েকজন অনুচর। আহত এবং নিহত অনুচরদের মধ্যে এসে সবাইকে তুলে নেয় কাঁধে। রহমানও বাদ যায় না, তাকেও দু’জন ধরে কাঁধে তুলে নেয়।

মঙ্গল ডাকুর অনুচরগণ রহমানকে চিনতে পারে না, কারণ রহমানের দেহে তাদেরই মত পোশাক রয়েছে এবং রক্ত ঝরছে তার কপাল থেকে। সমস্ত মুখমণ্ডল আর গলা কাঁধ রক্তে ভেসে গেছে। যন্ত্রণায় কোকাচ্ছে রহমান।

 মঙ্গল ডাকুর অনুচরগণ রহমান এবং তাদের নিহত আর আহত অনুচরদের নিয়ে প্রবেশ করলো শিবমন্দিরের মধ্যে।

রহমান মঙ্গল ডাকুর অনুচরদের কাঁধে শায়িত অবস্থায় থেকেই লক্ষ্য করছিলো সব, যদিও তার কষ্ট হচ্ছিলো তবু সহ্য করে যাচ্ছিলো সে নীরবে–যেমন করে হোক সর্দারের সন্ধান তাকে করতে হবে। সর্দারের জন্যই রহমান নিজ দেহে অস্ত্রাঘাত করেছে। প্রাণ দিয়েও সে সর্দারকে উদ্ধার করতে চায়।

অবাক হয়ে দেখছে রহমান–এরা কি করে, কোন্ পথে তাকে কোথায় নিয়ে যায়। মন্দিরমধ্যে প্রবেশ করার উদ্দেশ্য কি? তবে কি মন্দিরমধ্যেই গোপন পথ আছে? যে পথে তাদের সর্দারকে উধাও করা হয়েছে।

আশায় বুক দুলে উঠে রহমানের, নিশ্চয়ই তার বাসনা সিদ্ধ হবে। রহমান গোঙানির মত শব্দ করতে থাকে, আর মাঝে মাঝে ‘জল, জল’ বলে ক্ষীণ শব্দ করে চলে।

মঙ্গল ডাকুর অনুচরগণ মন্দিরমধ্যে প্রবেশ করে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ালো। প্রত্যেকের কাঁধেই আহত এবং নিহত দেহ। আহত অনুচরগুলো নানারকম করুণ আর্তনাদ করছে।

রহমান দেখলো, একজন অনুচর শিবলিঙ্গের পিছনে এসে লিঙ্গটা ধরে জোরে টান দিলো, সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত কাণ্ড–সেই লিঙ্গটার পাশে বেরিয়ে পড়লো একটা বিরাট সুড়ঙ্গমুখ।

 অনুচরগণ আহত এবং নিহত দেহগুলোকে নিয়ে সেই সুড়ঙ্গ মধ্যে প্রবেশ করলো। এমন একটা ভয়ঙ্কর অবস্থার মধ্যেও রহমানের মনে আনন্দের বান ডেকে গেলো, যাক তাহলে সে ডাকু মঙ্গলের গুপ্ত আস্তানার পথ আবিস্কার করে নিতে সক্ষম হলো। যে পথের সন্ধান করতে তারা হিমসিম খেয়ে গিয়েছিলো, সর্দারকেও হারাতে হয়েছে এ পথের খোঁজ করতে গিয়ে। এবার রহমান। কতকটা আশ্বস্ত হলো–নিশ্চয়ই সর্দার এই গুপ্ত সুড়ঙ্গপথেই অদৃশ্য হয়েছে।

 মঙ্গল ডাকুর অনুচরগণ অন্যান্য নিহত আর আহত অনুচরের সঙ্গে রহমানকে সুড়ঙ্গপথে নিয়ে অগ্রসর হলো। রহমান লক্ষ্য করলো, অনুচরগণ ভিতরে প্রবেশ করে একটা শিকলের মত কিছু ধরে টান দিলো, সঙ্গে সঙ্গে সুড়ঙ্গমুখ বন্ধ হয়ে ঠিক পূর্বের আকার ধারণ করলো।

রহমানের কপাল বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিলো, তখনও চোখেমুখে রক্তের ধারা ঝরছে। তবুও। ভালভাবে সব সে লক্ষ্য করে চলেছে। সুড়ঙ্গপথটা গভীর অন্ধকারে আচ্ছন্ন হলেও মশালের আলোতে সম্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো। ঝাঁম জঙ্গলে ভূগর্ভে যে এমন একটা সুড়ঙ্গ আছে, কোনোদিন। কেউ জানতো না। জানতো না দস্যু বনহুর বা তার অনুচরগণ। রহমানের ধমনীর রক্ত উষ্ণ হয়ে উঠেছে। যদিও সে সত্যি সত্যি কিছুটা অসুস্থ বোধ করছিলো।

 একটানা বেশ কিছুক্ষণ চলার পর একটা কক্ষে নিয়ে তাদের নামানো হলো। পাশাপাশি সবাইকে শুইয়ে দেওয়া হলো মেঝেতে। রহমান তাকিয়ে দেখলো, কক্ষমধ্যে কয়েকজন। অনুচরবেষ্টিত একজন ভয়ঙ্কর চেহারার লোক দাঁড়িয়ে আছে। রহমান বুঝতে পারলো, এ লোকটাই এদের সর্দার হবে। তবে কি এই সেই মঙ্গল ডাকু? লোকটার ভীষণ চেহারা দেখে তাই মনে হচ্ছে। রহমান ঠিক অনুচরদের অনুকরণে ভান করে উঃ আঃ করতে লাগলো।

 পাশাপাশি আহত এবং নিহত অনুচরদের মেঝেতে শুইয়ে দেওয়ার পর সেই ভয়ঙ্কর চেহারার লোকটি ক্রুদ্ধ সিংহের ন্যায় গর্জে উঠলো। বললো–এতোগুলো লোক প্রাণ দিয়েছে, আর ওদের ক’জনকে হত্যা করতে পেরেছো তোমরা?

নিহত আর আহত লোকগুলোর পাশে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ালো অন্যান্য অনুচর। মঙ্গল ডাকুর কথায় কারো মুখে কথা সরলো না, পুনরায় মঙ্গল ডাকু গর্জন করে উঠলোনরাধম, তোমরা এতোগুলো প্রাণ দিলে আর তাদের একজনকেও হত্যা করতে পারলে না?

অনুচরদের মধ্য হতে একজন ভয়কম্পিত কণ্ঠে বললো-হুজুর আমরা সম্পূর্ণ নিরস্ত্র ছিলাম, কারণ তখন আমরা পূজার মন্ত্র উচ্চারণে ব্যস্ত ছিলাম।

 সেকথা অবশ্যই ঠিক, তোমরা প্রস্তুত ছিলে না।

সর্দার এবং তার অনুচরদের মধ্যে যখন কথাবার্তা হচ্ছিলো তখন রহমান সব মনোযোগ সহকারে শুনে যাচ্ছিলো।

বলে চললো মঙ্গল ডাকু–তোমরা জানো না হয়তো, যারা আমাদের এতোগুলো লোককে, হত্যা করেছে তারা কারা?

অনুচরদের মধ্য হতে একজন বলে উঠলো–হুজুর, আমরা জানতে চাই তারা কারা?

 দস্যু বনহুর তার দলবল নিয়ে হামলা করেছিলো, তা ছাড়া আর কার সাধ্য আমার আস্তানায়। হানা দেয়। হাঁ, আর একটা সংবাদ তোমরা জানো না, দস্যু বনহুরের একজন অনুচর আমাদের গুপ্তগুহায় প্রবেশ করে ধরা পড়েছে।

অনুচরগণ আনন্দধ্বনি করে উঠে!

অনুচরদের একজন বলে–হুজুর এর পূর্বে আমাদের হাতে দস্যু বনহুরের দু’জন লোক বন্দী হয়েছিলো কিন্তু তাদের নিকট হতে আমরা একটি কথাও বের করতে পারিনি।

হাঁ আমরা ব্যর্থ হয়েছিলাম, তাদের দুজনকে নির্মম শাস্তি দেওয়া সত্ত্বেও তারা তাদের সর্দার সম্বন্ধে কোনো কথা জানাতে রাজি হয়নি। শেষ পর্যন্ত তারা প্রাণ দিলো তবু সর্দারের আস্তানার সন্ধান দিলো না।

হুজুর এবার যে ধরা পড়েছে সেও তো তার সর্দারের সম্বন্ধে সব গোপন রাখতে পারে। কাজেই একজনকে হত্যা করে আমরাও কোনো তৃপ্তি পাবো না বা প্রতিশোধও নেওয়া হবে না।

 হাঁ, তোমার কথা সত্য; আমাদের এতোগুলো প্রাণের বিনিময়ে দস্যু বনহুরের একজন। অনুচরকে হত্যা করে কোনো লাভ হবে না। স্বয়ং দস্যু বনহুরকে যতক্ষণ হত্যা করতে না পারছি আর তার আস্তানা যতক্ষণ সমূলে ধ্বংস করতে সক্ষম না হয়েছি ততক্ষণ কিছুতেই আমার স্বস্তি : নেই। তবে মনে হচ্ছে, এই দণ্ডে যাকে আমরা বন্দী করতে পেরেছি তার দ্বারাই আমরা দস্যু বনহুরের সন্ধানলাভে সক্ষম হবো।

 হুজুর, দস্যু বনহুরের লোকরা অত্যন্ত ধূর্ত; তারা জীবন দেয় তবু সর্দারের খোঁজ দেয় না।

এ কথার প্রমাণ আমরা কালই পাবো। যাকে আমরা বন্দী করেছি সে পূর্বের দু’জনের মত ভীতু ধরনের লোক নয়। এর কথায় বোঝা যায়, দস্যু বনহুরের সন্ধান আমাদের কাছে জানাতে তার আপত্তি নেই।

আবার অনুচরদের মধ্যে আনন্দসূচক শব্দ শুনা যায়।

মঙ্গল ডাকু আদেশ দেয়–এবার তোমরা নিহতদের মধ্য হতে আহতদের বেছে বের করে নাও। নিহতদের লাশ গুম গর্তে নিক্ষেপ করো, আহতদের জন্য ঔষধপত্রের ব্যবস্থা করো।

সঙ্গে সঙ্গে অনুচরগণ নিহতদের মধ্য হতে আহতদের দেহ বেছে বের করে নিলো। নিহতদের লাশ গুম গর্তে নিক্ষেপ করার জন্য কাঁধে তুলে নিলো আহতদের এক একটা খাটিয়ায় শুইয়ে দেওয়া হলো।

মঙ্গল ডাকু বেরিয়ে গেলো সেই কক্ষ হতে।

মঙ্গল ডাকু বেরিয়ে যেতেই অন্যান্য অনুচর বেরিয়ে গেলো সে কক্ষ হতে। মাত্র দু’জন বইলো আহতদের সেবা-যত্নের জন্য। অনুচরদ্বয় আহতদের দেহের ক্ষতস্থানে ঔষধ লাগিয়ে বেঁধে দিতে লাগলো এবং যারা ‘জল, জল’ বলে আর্তনাদ করছিলো তাদের জলপান করাতে লাগলো।

 অন্যান্য আহতের সঙ্গে রহমানকেও জলপান করালো ওরা এবং তার ললাটের ক্ষতেও ঔষধ লাগিয়ে দিলো। রহমান পানি পান করে অনেকটা সুস্থ এবং সবল হয়ে উঠলো। এখন সে প্রতীক্ষা করতে লাগলো সুযোগের। বুঝতে তার বাকী নেই–তাদের সর্দার এখন মঙ্গল ডাকুর আস্তানায় মঙ্গল ডাকু হস্তে বন্দী রয়েছে।

*

গভীর রাত।

আহত অনুচরগণ সবাই এখন গভীর নিদ্রায় অচেতন।

শুধু রহমানের চোখে ঘুম নেই, সে অতি সন্তর্পণে চারদিকে তাকিয়ে দেখছিলো। ভূগর্ভ আস্তানা বলে মঙ্গল ডাকু তার সুড়ঙ্গ পথে কোনো পাহারার ব্যবস্থা করেনি বা রাখা প্রয়োজন মনে করেনি।

কক্ষটা নিস্তব্ধ।

মাঝে মাঝে আহত অনুচরদের গোঙানির ক্ষীণ শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ তখন শোনা যাচ্ছিলো না। রহমান সতর্কতার সংগে শয্যা ত্যাগ করে নেমে দাঁড়ালো, তারপর বেরিয়ে গেলো অতি সাবধানে।

রহমান কক্ষ থেকে বেরিয়ে যখন অগ্রসর হচ্ছিলো তখন সে আশ্চর্য হলো, মঙ্গল ডাকু তার আস্তানা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নিশ্চিত, কাজেই কোথাও কোনোরকম পাহারা নেই। স্বচ্ছন্দভাবেই এগিয়ে চললো রহমান, বিস্ময় নিয়ে দেখতে লাগলো মঙ্গল ডাকুর অদ্ভুত গুপ্তগুহাটা। ভূগর্ভে এতোবড় গুহা দস্যু বনহুরের ছাড়া আর কারো থাকতে পারে, ভাবতেও পারেনি রহমান। দেয়ালটা উঁচুনীচু জমকালো পাথর দিয়ে তৈরি। মাঝে মাঝে গর্ত আছে, তারই মধ্যে মশাল গোঁজা রয়েছে।

রাত গভীর, তাই মশালের আলোগুলো জ্বলে জ্বলে এখন প্রায় নিভু নিভু হয়ে এসেছে। কেমন যেন একটা থমথমে ভাব ছড়িয়ে আছে চারদিকে।

 রহমান জানে না, কোন গুহায় তার সর্দার দস্যু বনহুর বন্দী রয়েছে। এখনও রহমানের মাথায় পটি বাধা, ক্ষতস্থান দিয়ে রক্ত চুপসে উঠছে, পট্টিটা রক্তের ছোপে রাঙা হয়ে উঠেছে। দিশেহারার মত সে সর্দারের অন্বেষণ করে ফিরছে গুহার মধ্যে। হঠাৎ যদি ধরা পড়ে যায় তাহলে অবস্থা কি দাঁড়াবে তা জানে রহমান, কিন্তু কোনো উপায় নেই–জীবন দিয়ে হলেও তাকে সর্দারের অন্বেষণ করতে হবে।

 হঠাৎ একটা গুহায় প্রবেশ করতেই চমকে উঠে রহমান, সংগে সংগে মুখ ফিরিয়ে নেয়–এটা সেই গুহা যে গুহায় প্রবেশ করে বনহুর হাত দিয়ে চোখ দুটো ঢেকে ফেলেছিলো। কতগুলো নারীকে সম্পূর্ণ উলংগ অবস্থায় হাত-পা শৃঙ্খলাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। কেউ বয়স্ক, কেউ বা তরুণী, কেউ বা মধ্যবয়সী–নানারকম নারীই আছে এখানে। পিশাচ শয়তান মঙ্গল ডাকু কাউকে ক্ষমা করেনি।

 রহমান দ্বিতীয় বার গুহার মধ্যে তাকাতে পারলো না, সে যে পথে প্রবেশ করেছিলো সে পথে বেরিয়ে এলো, বুঝতে তার বাকী রইলো না–এ মঙ্গল ডাকুর পৈশাচিক কীর্তি।

এবার রহমান আরও উদগ্রীবভাবে অন্বেষণ করে চললো। হঠাৎ সম্মুখে নজর পড়তেই থমকে দাঁড়ালে, আধো অন্ধকারে স্পষ্ট দেখলো একটা নারকীয় দৃশ্য–কতগুলো উলংগ, অর্ধ-উলংগ নিদ্রারত নারী-দেহের মধ্যে শায়িত একটি ভীষণ আকার মানুষ। রহমান ভালভাবে লক্ষ্য করতেই দেখলো, এ লোকটিই তখন অনুচরদের আদেশ দিচ্ছিলো, আহতদের মধ্য হতে নিহত ব্যক্তিদের বেছে গুমগর্তে নিক্ষেপ করে দাও। এ লোকটিই এদের সর্দার বা দলপতি তাতে সন্দেহ নেই এবং এ লোকই মঙ্গল ডাকু। রহমানের মুখমণ্ডল কঠিন হয়ে উঠলো, ঘৃণায় নাসিকা কুঞ্চিত হলো তার। রহমানও দস্যু লুটতরাজ আর হত্যা করা তারও নেশা কিন্তু জঘন্য মনোবৃত্তি তার নয়। অবশ্য এ শিক্ষা তার সর্দারের নেতা যদি উচ্ছল, বদমাইশ আর লম্পট হয় তাহলে তার অনুচর বা সহচরগণও তেমনি হবে। দস্যু বনহুর ডাকাত, তবু সে জঘন্য কাজ থেকে সব সময় বিরত থাকে, কাজেই তার অনুচরগণ কোনোদিনই কুমনোবৃত্তিসম্পন্ন হতে পারে না।

 রহমান এই মূল্যবান সময় নষ্ট করলো না, সে দ্রুত বিভিন্ন গুহাগুলো অনুসন্ধান করে চললো। অল্পক্ষণেই পেয়ে গেলো তার অন্বেষিত গুহাটি। স্থির হয়ে দাঁড়ালো রহমান ক্ষণিকের জন্য, দেখলো তার প্রিয় সর্দারকে হাত-পা লৌহশিকলে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে এবং লৌহশিকলগুলো দেয়ালে মজবুত বালার সংগে আটকানো। শুধু সর্দার নয়, আরও বহু লোককে এভাবে বন্দী করে রাখা হয়েছে। জীর্ণশীর্ণ কঙ্কালসার কতগুলো মানুষ পড়ে আছে মেঝেতে; সকলের হাত-পায়ে শিকল বাঁধা। তারা বেঁচে আছে না মরে গেছে বোঝা মুস্কিল।

 বনহুরকে এমনভাবে দেয়ালের সংগে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে যাতে সে বসতে বা শুতে না পারে বনহুর কখন যে কাঁধের উপর মাথাটা কাৎ করে ঝিমিয়ে পড়েছে তার খেয়াল নেই।

রহমান চাপা স্বরে ডাকে–সর্দার!

চির পরিচিত স্বর, মুহূর্তে তন্দ্রা ছুটে যায় বনহুরের, সজাগ দৃষ্টি মেলে তাকাতেই চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠে, বলে–রহমান তুমি?

সর্দার, আপনার এ অবস্থা? রহমান বনহুরের হাতখানা মুক্ত করার চেষ্টা করে।

 বনহুর বলে–রহমান, তুমি এভাবে…..

সর্দার, পরে সব জানতে পারবেন, কি করে আপনাকে মুক্ত করবো এখন সে পরামর্শ দিন?

তুমি কি তাহলে এই সুড়ঙ্গমধ্যে প্রবেশের পথ আবিস্কার করতে সক্ষম হয়েছ রহমান?

হাঁ সর্দার, হয়েছি।

শোন, ঐ যে একটি তাক দেখছো ওখানেই চাবি আছে। সবচেয়ে বড় চাবি দুটো নিয়ে এসো, ঐ দুটো চাবি দ্বারা আমার হাত এবং পায়ের তালা খুলে ফেলল।

 রহমান বনহুরের কথা অনুযায়ী কাজ করলো, ও পাশের তাকের উপর অনেকগুলো চাবি সাজানো আছে তার মধ্য হতে বড় চাবি দুটো বেছে নিয়ে ফিরে এলো বনহুরের পাশে, দ্রুতহস্তে খুলে ফেললো বনহুরের হাত এবং পায়ের শিকলের তালা।

 বনহুরের হাত-পা বন্ধনমুক্ত হওয়ায় সে নিজের দেহের অন্যান্য বন্ধন মুক্ত করে নিলো তারপর বন্দীদের নিকটে এসে চাপা স্বরে বললো–বন্ধু, তোমরা আর কয়েক দিন কষ্ট করো, আমি তোমাদের মুক্ত করে নেয়ার জন্য অচিরেই আবার আসছি! কথাটা বলে রহমানের সংগে বনহুর বেরিয়ে আসে কক্ষ থেকে।

বনহুরকে রহমান যখন মুক্ত করে দিচ্ছিলো তখন বন্দীগণ লক্ষ্য করলেও তারা কোনোরকম প্রতিবাদ করলো না, কারণ তারা বন্দী অবস্থায় মৃত্যুযন্ত্রণা অনুভব করছিলো; তাদের মধ্য হতে কেউ যদি পালিয়ে প্রাণ বাঁচায় বাচুক। তাছাড়াও বনহুরের দেব চেহারা বন্দীদের মনে একটা মায়ার সঞ্চার করেছিলো, তাই কেউ কোনোরকম সাড়াশব্দ করলো না।

বনহুর রহমানের সংগে বেরিয়ে এলো সুড়ঙ্গমধ্য হতে শিবমন্দির মধ্যে, তারপর মন্দিরের বাইরে।

 বনহুর রহমানকে বুকে জড়িয়ে ধরলো-রহমান, তুমি আমার সহচরই শুধু নও–আমার বন্ধু।

রহমান আবেগভরা কণ্ঠে বললো–সর্দার!

 হাঁ, চলো এখানে বিলম্ব করা আর মোটেই ঠিক নয়।

*

রহমান?

সর্দার?

আজ কদিন হলো আমি ঝাঁম জঙ্গল ত্যাগ করে কান্দাই ফিরে এসেছি, কিন্তু এতটুকু সময়ের জন্য মনে শান্তি পাচ্ছি না। যতক্ষণ না ঝম জংগলে মঙ্গল ডাকুর কবল থেকে সেই নির্যাতিত আমার ভাই এবং বোনদের মুক্ত করে আনতে সক্ষম না হয়েছি ততদিন আমি স্বস্তি পাবো না। বনহুর তার বিশ্রামকক্ষের মেঝেতে পায়চারিত অবস্থায় কথাগুলো বলে শয্যার পাশে বসে পড়লো।

রহমান দাঁড়িয়ে ছিলো বনহুরের অদূরে, সরে এলো কয়েক পা, ঠিক শয্যার পাশে এসে দাঁড়ালো–সর্দার, আমাদের লোকজন এবং অস্ত্রশস্ত্র সব প্রস্তুত। আপনার আদেশের অপেক্ষামাত্র।

 বনহুর শয্যায় অর্ধশায়িত অবস্থায় বালিশে ঠেস দিয়ে বসে বললো–আর বেশি বিলম্ব করা চলবে না, অচিরেই আমরা ঝাঁম জঙ্গল আক্রমণে যাত্রা করবো।

সর্দার?

বলো রহমান?

 ঝাঁম জঙ্গল আক্রমণে যাওয়ার পূর্বে একবার বৌরাণীর সংগে দেখা করা…..।

 হাঁ, একবার তার সংগে দেখা করা আমার কর্তব্য। নূরীও আছে সেখানে, কাজেই….কথা শেষ না করে চুপ হলো বনহুর।

রহমান কোনো কথা বললো না, কিন্তু বনহুরের কথা বলার ভাব দেখে একটু মুষড়ে পড়লো, সর্দারকে সে এমন ব্যথাকরুণভাবে কোনোদিন কথা বলতে দেখেনি। রহমান বললো–সর্দার, আপনি যদি আদেশ করেন তবে আমরা দলবল নিয়ে ঝম জংগলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে পারি।

আর আমি?

আপনি বিশ্রাম করুন।

 হেসে উঠলো বনহুর–বিশ্রাম করবো তুমি?

সর্দার, আপনার শরীর ভাল মনে হচ্ছে না, কাজেই…

কে বললো আমার শরীর ভাল নয়? রহমান, তুমি আগামী পরশু ঝাঁম জঙ্গল আক্রমণে যাত্রার জন্য প্রস্তুত হয়ে নাও। আমি আজ রাতেই কান্দাই শহরে রওয়ানা দেবো।

আজকে তৈরি করার জন্য নির্দেশ দেবো সর্দার?

 হাঁ, তাই দাও।

 সর্দার?

 বলো?

 কেশব এখন থেকে কাঁদাকাটা শুরু করেছে।

 কেন?

 আপনার ঝাঁম জঙ্গলে যাত্রার কথা শুনে।

এত ভীতুজনকে আস্তানায় রাখা যায় না রহমান।

এমন সময় কোথা হতে কেশব ছুটে এসে বনহুরের পায়ের কাছে বসে পড়ে–আমাকে। তাড়িয়ে দেবেন না বাবু, আমাকে তাড়িয়ে দেবেন না,

 গম্ভীর কণ্ঠে বললো বনহুর–পারবে অস্ত্রচালনা করতে? পারবে ঘোড়ায় চড়তে? পারবে মানুষ হত্যা করতে?

সব পারবো কিন্তু মানুষ হত্যা করতে পারবো না।

ধরো কেউ যদি তোমার সামনে তোমার ভাইয়ের বুকে ছুরি বসিয়ে দেয় কিংবা তোমার মায়ের বুক থেকে সন্তানকে ছিনিয়ে নিয়ে গলা টিপে মেরে ফেলে? বলো তবু পারবে না সেই মানুষনামী পাপিষ্ঠকে হত্যা করতে?

 পারবো। একশোবার পারবো! আমার ভাইয়ের বুকে যে ছুরি বসিয়ে দেবে তাকে আমি শুধু হত্যাই নয়, তার দেহের চামড়া ছাড়িয়ে দেহে লবণ মাখিয়ে হত্যা করবো। যে আমার মায়ের বুক থেকে সন্তান কেড়ে নিয়ে মেরে ফেলবে তাকে আমি জীবন্ত কবর দেব….

 বনহুর কেশবকে বুকে জড়িয়ে ধরে–সাবাস! কেশব, এই যে দেশবাসী জনগণ–এরা কি তোমার ভাই নয়?

হ বাবু, এরা আমার ভাই, বিশ্বজননীর সন্তান–সবাই আমরা ভাই ভাই।

তবে আর কেন কেশব, এসো হাত মিলাও আমার সংগে, শপথ করো-ভাই হয়ে ভাইদের জন্য জীবন দিতে দ্বিধা করবে না?

কেশব বনহুরের প্রশস্ত হাতখানার উপর হাত রাখলোবাবু আমি শপথ করছি, আজ থেকে……চুপ হয়ে গেলো কেশব।

 বনহুর বিপুল আগ্রহ নিয়ে বললো–বলো কেশব, থামলে কেন? বলো বিশ্বজননীর নির্যাতিত সন্তানদের জন্য তুমি জীবন বিলিয়ে দেবে?

 কেশব আবিষ্টের মত উচ্চারণ করে চললো–বিশ্বজননীর নির্যাতিত সন্তানদের জন্য আমি নিজ জীবন বিলিয়ে দেবো।

বনহুরের হাতের উপরে হাত রেখে কথাগুলো বললো কেশব।

 রহমান উচ্চারণ করলো–খোদা হাফেজ।

বনহুরের চোখ দুটো তখনও কেশবের চোখে স্থির হয়ে আছে। বললো বনহুর-কেশব, আজ থেকে তুমি বাইরের লোক নও। দস্যু বনহুরের একজন অনুচর।

কেশব মাথা নত করলো।

রহমান বললো–চলো কেশব, শিক্ষাগারে চল, তোমাকে আমাদের নিয়ম-কানুন শিক্ষা দেওয়া হবে।

রহমান আর কেশব বেরিয়ে গেলো।

 বনহুর শয্যা গ্রহণ করলো।

কিন্তু বেশিক্ষণ শয্যায় শয়ন করে থাকতে পারলো না, উঠে এসে দাঁড়ালো টেবিলের পাশে। জমকালো ড্রেসে সজ্জিত হয়ে নিলো–মাথায় পাগড়ি, কোমরের বেল্টে রিভলভার–বেরিয়ে এলো বনহুর আস্তানার বাইরে। তাজের পাশে এসে দাঁড়াতেই তাজ সম্মুখের পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করতে লাগলো। তাজের এটা অভ্যাস–বনহুর তার পাশে এলে সে মনের আনন্দ এভাবেই প্রকাশ করতো।

তাজ প্রভুকে পিঠে পাবার জন্য সদা উন্মুখ।

বনহুর উঠে বসলো তাজের পিঠে, তারপর ছুটে চললো কান্দাই শহর অভিমুখে।

 উল্কা বেগে তাজ ছুটে চললো।

শহরে পৌঁছতে কয়েক ঘন্টা লেগে গেলো। অতি সন্তর্পণে শহরের নির্জন পথ ধরে বনহুর চৌধুরী বাড়ির পিছনে এসে যখন পৌঁছলো তখন রাত গভীর।

সমস্ত শহরটার সংগে চৌধুরী বাড়িও ঝিমিয়ে পড়েছে। চারদিক নীরব-নিস্তব্ধ, গেটের পাহারাদারটাও টুলে বসে দেয়ালে ঠেস দিয়ে ঝিমুচ্ছে।

বনহুর তাজের পিঠ থেকে নেমে দাঁড়ালো, বাগানবাড়ির প্রাচীর টপকে প্রবেশ করলো ভিতরে। অদূরেই ঝি-চাকরদের কক্ষগুলো বাগানবাড়ির দিকেই ওদের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন মরিয়ম বেগম।

 এরই একটি কক্ষে থাকে নূরী, বনহুর আলগোছে নূরীর কক্ষের দরজায় এসে দাঁড়ায়, মৃদু টোকা দেয় দরজায়। একবার, দুবার, তিনবার–না, ভিতর থেকে কোনোরকম সাড়া পাওয়া যায় না। বনহুর দরজায় আস্তে হাত রাখতেই খুয়ে যায় দরজাটা। ভিতরে ডিমলাইট জ্বলছে। বনহুর কক্ষমধ্যে তাকিয়ে দেখে নূরীর শয্যা শূন্য, নূরী কক্ষে নেই।

বনহুরের মুখে চিন্তার ছাপ পড়লো, নূরী গেলো কোথায়? এভোরাতে নূরী নিজ কক্ষ ত্যাগ করে কোথায় থাকতে পারে? বিমর্ষ মনে বনহুর মনিরার কক্ষের পিছনে এসে দাঁড়ালো, তারপর পাইপ বেয়ে উঠে গেলো উপরে। দরজা অর্ধ ভেড়ানো ছিলো, বনহুর কক্ষে প্রবেশ করলো, সংগে সংগে থমকে দাঁড়ালো বনহুর–দেখলো মনিরার শিয়রে বসে নূরী তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

বনহুরকে দেখে মনিরা এবং নূরী উভয়ে সোজা হয়ে বসলো। চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তাদের। মনিরার চোখে ঘুম আসছিলো না, তাই সে নূরীকে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে নিচ্ছিলো, যদি একটু ঘুম পায়।

নূরীর আচরণে মনিরা মুগ্ধ–ওকে ওর বড় ভাল লাগে। অই সে যখন তখন নূরীকে ডেকে পাশে নিয়ে গল্প করে, মাথায় হাত বুলিয়ে নেয়। তাছাড়া যখন খারাপ লাগে তখন নূরীর নাচ ওর প্রিয়। এ নাচ দেখতে গিয়েই মনিরা একদিন আত্মহারা হয়ে নিজের গলার লকেটসহ চেন মালাটা ভুল করে দিয়েছিলো নূরীকে যার জন্য বনহুর খুঁজে পেয়েছিলো মনিরাকে। আজও মনিরার চোখে যখন ঘুম আসছিলো না তখন নূরীকে সে ডেকে পাঠিয়েছিলো নিজ ঘরে, বলেছিলো–ফুল, আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দেনা, দেখি যদি ঘুম পায়।

নূরী মৃদু হেঁসে বলেছিলো–আপামণি, কেন আপনার চোখে ঘুম আসে না?

তুই বুঝবি না ফুল। বলেছিলো মনিরা।

ফুল হেসেছিলো মনে মনে, বলেছিলো–আমরা গরিব সাপুড়ে মেয়ে, আপনারা বড়লোক মানুষ, তাই আপনাদের কথা আমরা বুঝবো কি করে।

রাগ করলি ফুল?

না আপামণি। মনিরার কপাল টিপে দিতে দিতে বলেছিলো নূরী।

মনিরা একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বলেছিলো, একটু আগে ফুল, পুরুষজাতটা বড় বেঈমান, তাই না রে?

 নূরী মাথা নিচু করেছিলো, কোনো জবাব দেয়নি, কারণ সে জানে, মনিরা কাকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলছে। যাকে উদ্দেশ্য করে মনিরা বলছে, তাকে নূরী কোনোদিন বেঈমান বলতে পারে না। নূরীর কাছে সে যে চির মহান-বেঈমান সে নয়।

 কিরে, চুপ করে রইলি কেন? বুঝেছি, বিয়ে তো করিসনি, এখনও তাই পুরুষদের সম্বন্ধে বুঝবি কি করে!

নূরী এ কথাতেও কোনো জবাব দেয়নি, নীরবে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে।

বনহুর কক্ষমধ্যে প্রবেশ করে মনিরার পাশে নূরীকে দেখে খুশিই হলো।

মনিরা যদি তখন লক্ষ্য করতো তাহলে বুঝতে পারতো, বনহুরের আগমনে শুধু তার চোখে মুখেই খুশির উৎস বয়ে যায়নি, তার পরিচারিকা ফুলের মুখমণ্ডলেও ফুটে উঠেছে এক স্বর্গীয়

বনহুরের সংগে নূরীর দৃষ্টি বিনিময় হলো, অভিনন্দন জানালে নূরী দৃষ্টির মাধ্যমে।

মনিরা শয্যা ত্যাগ করে আনন্দোচ্ছ্বসিত স্বামীর পাশে এসে দাঁড়ালো, হাত দু’খানা মূঠায় চেপে ধরে বললো–এসেছো?

নুরী সেই মুহূর্তে বনহুর আর মনিরার পাশ কেটে বেরিয়ে গেলো কক্ষ থেকে।

মনিরা স্বামীর বুকে মাথা রেখে বললো–বড্ড দেরী করলে?

এক সঙ্কটপূর্ণ ভয়াবহ অবস্থায় পড়েছিলাম মনিরা, তাই আসতে পারিনি ক’দিন। তারপর শয্যার দিকে তাকিয়ে বললো-”নূর কোথায়, মনি?

ভয় নেই, নূর আজকাল মামীমার ঘরে শোয়, কারণ সে এখন বুঝতে শিখেছে। বলে হাসে মনিরা।

 বনহুর মনিরার চিবুকে মৃদু চাপ দিয়ে বলে–অতি বুদ্ধিমতী তুমি! তারপর উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে শয্যার কাছে ফিরে আসে বনহুর। মাথার পাগড়িটা খুলে রাখে টেবিলে।

 মনিরা বনহুরের কোমর থেকে রিভলভারসহ বেল্টখানা খুলে নেয়, তারপর রেখে দেয় পাগড়িটার পাশে।

বনহুর শয্যায় অর্ধশায়িত অবস্থায় হেলান দিয়ে বসে, মনিরাকে টেনে নেয় কাছে, ওর কপাল থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বলে–ফুলকে নিয়ে এভোরাতে কি গল্প হচ্ছিলো শুনি?

ঘুম পাচ্ছিলো না তাই মাথায় হাত বুলিয়ে নিচ্ছিলাম। জানো মেয়েটা বড় ভালো, যেমন অমায়িক তেমনি সরল। মামীমার দক্ষিণ হাত হয়ে পড়েছে। আমারও সাথী, যখন ভাল লাগে না ওকে নিয়ে গল্প করি, গান শুনি, নাচ দেখি। খুব সুন্দর গান গাইতে পারে, নাচতে পারে চমৎকার। নূর প্রথমে ওর কাছে যেতেই চাইতো না, এখন ফুল বলতে পাগল!

 মনিরার কথায় বনহুর স্বস্তির নিশ্বাস ত্যাগ করে, যাক নূরীর সম্বন্ধে সে অত্যন্ত চিন্তিত ছিলো, কারণ নূরী জংলী মেয়ে–কখন কি বিভ্রাট ঘটিয়ে বসবে কে জানে! মনিরা যখন নূরীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ তখন বনহুরের হৃদয় আনন্দোচ্ছ্বাসে ভরে উঠছিলো–নূরী যে দ্ৰসমাজে এসে সভ্য মানুষের মত চলাফেরা করতে পারবে, এ কথা সে ভাবতে পারেনি। আশঙ্কা ছিলো মনে, সে ভয় আজ নিঃশেষে মুছে গেলো মন থেকে, বললো বনহুর–মেয়েটি বড় অসহায়, তোমাদের স্নেহ আর মায়া দিয়ে ওকে আপন করে নিয়েছো শুনে আমি অনেক খুশি হলাম।

একদিন ওর নাচ দেখাবো তোমাকে।

আমার সামনে নাচতে চাইবে কি?

তোমাকে লুকিয়ে রাখবো আড়ালে, ফুল নাচবে আমার সম্মুখে, তুমি দেখবে।

 হাসলো বনহুর, কোনো জবাব দিলো না।

দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলো এতক্ষণ নূরী, এবার সে মৃদু হেসে চলে গেলো। সেখান থেকে। নিজের ঘরে প্রবেশ করে বিছানায় গা ঢেলে দিলো।

*

ঘুমিয়ে পড়েছে মনিরা।

ধীরে ধীরে উঠে বসলো বনহুর, মনিরার হাতের মুঠো থেকে নিজের হাতখানা বের করে নিয়ে, আলগোছে নেমে দাঁড়ায় শয্যা থেকে। টেবিলের উপর থেকে রিভলভাসহ বেল্টখানা তুলে নিলো তারপর কোমরে বেল্ট এটে পাগড়িটা পড়ে নিলো মাথায়, সন্তর্পণে বেরিয়ে এলো কক্ষ থেকে।

সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো নিচে।

ঐ সময় ঝি আলীর মার ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো, সিঁড়িতে বুটের চাপা শব্দ শুনে জানালার পাশে উঁকি দিলো, চমকে উঠলোজমকালো পোশাক পরা একটি লোক নেমে আসছে সিঁড়ি বেয়ে, ভয় আর বিস্ময় নিয়ে আলীর মা দেখতে লাগলো। সিঁড়ির বাতিতে সে সব স্পস্ট দেখতে পাচ্ছে।

বনহুর লঘু পদক্ষেপে এসে দাঁড়ালো নূরীর কক্ষের দরজায়।

 আলীর মার চোখ ছানাবড়া হলো, কি ব্যাপার দেখবার জন্য উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে রইলো সে।

বনহুর আঙ্গুল দিয়ে মৃদু টোকা দিচ্ছে তখন।

দরজা খুলে গেলো।

 বনহুর প্রবেশ করলো কক্ষমধ্যে।

নূরী দরজা বন্ধ করে দিলো।

আলীর মা’র ধৈর্যচ্যুতি ঘটলো, সে বেরিয়ে এলো বাইরে–আস্তে এসে দাঁড়ালো নূরীর কক্ষের দরজায়। ভিতর থেকে ভেসে আসছে নূরীর হাসির শব্দ, তার সংগে পুরুষের গলার আওয়াজ। আলীর মার মুখ হা হয়ে গেছে, যে ফুলকে তারা খুব ভাল মেয়ে বলে জানে সে ফুল চরিত্রহীনা মেয়ে? ঘৃণায় নাক তার কুঞ্চিত হয়ে উঠলো। কান পেতে শুনতে লাগলো আলীর মা।

কতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনলো, তারপর পা ঠিপে টিপে উঠে গেলো উপরে, মরিয়ম বেগমের কক্ষের দরজায় এসে ধীরে ধীরে ডাকতে লাগলো বিবি সাহেব, বিবি সাহেব, দরজা খুলুন, দরজা খুলুন..

মরিয়ম বেগমের ঘুম ভেঙে গেলো, তাড়াতাড়ি দরজা খুলে আলীর মাকে দেখে বিস্মিত হলেন, বললেন–কি হয়েছে আলীর মা?

ঠোঁটের উপর আংগুল চাপ দিলো আলীর মা–চুপ। চলুন ভিতরে, সব বলছি।

মরিয়ম বেগম আলীর মাকে কক্ষে প্রবেশ করার জন্য পথ ছেড়ে দিলেন।

 আলীর মা কক্ষে প্রবেশ করে বললো–বিবি সাহেব, তাজ্জব ব্যাপার!

কি হয়েছে বল না?

 মাগো, সেকি কাণ্ড–একটা ভূতের মত কালো পোশাক পরা মানুষ সিঁড়ি বেয়ে উপর থেকে নেমে গেলো…..

বলিস কি আলীর মা?

আগে সব শোনো বিবি সাহেব……বেশি উত্তেজিত হলে আলীর মায়ের কোনো হুশ-জ্ঞান। থাকতো না, সে কার সংগে তুমি বা আপনি বলছে সে কথাও মনে হতো না।

বললো আলীর মা-কালো লোকটার মাথায় পাগড়ি, কোমরে বাঁধা পিস্তল, যেন ডাকাতের মত চেহারা…….

বলিস কি আলীর মা, ডাকাত এসেছিলো আমার বাড়িতে?

ঠিক বলতে পারছি না বিবি সাহেব, আমার মনে হয় ডাকাতই হবে।

কি সর্বনেশে কথা বলছিস আলীর মা, ডাকতে পারলি না দারওয়ানকে।

ডাকবো কি, সে লোকটা সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলো নিচে, আমি ভয়ে কাঁপছি, দেখি লোকটা সোজা ফুল ঝির ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো। ওমা কি অবাক কাণ্ড, ফুল ঝির দরজায় টোকা দিতে লাগলো লোকটা।

তারপর?

 কি বলবো বিবি সাহেব, ফুল ঝিকে আমরা খুব ভাল মেয়ে বলে জানি কিন্তু তার মধ্যে এতো ..

 কি হলো বল্ না?

বলছি তো, লোকটা টোকা দিতেই দরজা খুলে দিলো ফুল ঝি, যেন সে লোকটার জন্য পথ চেয়ে ছিলো। দরজা খুলে দিতেই লোকটা ঢুকে পড়লো ভিতরে।

 বলিস কি আলীর মা? মরিয়ম বেগমের চোখেমুখে অবিশ্বাসের ছাপ ফুটে উঠলো, তিনি। বললেন পুনরায় মিথ্যা কথা বলছিস তুই।

আগে সব শোনো, আমি একটি কথাও মিথ্যা বলছি না। লোকটা ঘরে ঢুকতেই আমি দরজায় এসে ওৎ পাতলাম। ওমা, সেকি বিশ্রী কাণ্ড, ছিঃ ছিঃ ঘেন্নায় আমি বাঁচি নাঘরের ভিতর থেকে ভেসে আসতে লাগলো ফুলের হাসির শব্দ, পুরুষের গলাও শোনা যাচ্ছিলো। মাগো আমি যেন শরমে মরে গেলাম একেবারে……।

মরিয়ম বেগম রাগত কণ্ঠে বললেন–ফুল তেমন মেয়েই নয়। তুই ভুল করছিস আলীর মা।

এই চোখে হাত দিয়ে কসম কাটছি, পশ্চিম দিকে মুখ করে বলছি, একবর্ণ আমি মিথ্যা বলছি না।

মরিয়ম বেগম যেন বিবর্ণ হয়ে উঠলেন, কোনো কথা তার মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না আর।

 আলীর মা এবার জোর গলায় বললো-দাঁড়িয়ে আছো কেন বিবি সাহেবা, দেখবে চলো।

মরিয়ম বেগম কি করবেন ভেবে পাচ্ছেন না–কে ঐ লোক, চোর না ডাকাত। ফুলের ঘরে। সে প্রবেশ করে হাসি-তামাসা করছে–এ কেমন কথা! বললেন মরিয়ম বেগম–সরকার সাহেব। নিচে ঘুমিয়ে আছেন তাকে ডাক দিয়ে বল্‌গে, যা।

আলীর মা আর দাঁড়ায় না। সে প্রথমে দারওয়ানকে ধাক্কা মেরে জাগিয়ে দেয়–এই, বাড়িতে চোর এসেছে আর তুই নাক ডেকে ঘুমুচ্ছিস হতভাগা……

আলীর মার ধাক্কা খেয়ে ধড়মড় করে জেগে উঠে পশ্চিমা দারওয়ান, বলে–কিয়া হুয়া আলী মাই?

হয়েছে আমার মাথা। বাড়িতে চোর এসেছে আর নবাব নাক ডেকে ঘুমাচ্ছো।

চোর? কাহা চোর?

ঐ ফুলকা ঘরমে দেখো গিয়ে…..

 ফুলকা ঘরমে!

হাঁ, যাও শীগগির, আমি সরকার সাহেবকে জাগাতে যাচ্ছি।

আলীর মা যখন শোর-হাঙ্গামা করে দারওয়ানকে জাগাতে চেষ্টা করছিলো, বনহুর তখন নূরীর ঘরে বসে সব শুনছিলো–বেরিয়ে আসে বনহুর নূরীর কাছে বিদায় নিয়ে। আলীর মা তখন সরকার সাহেবের ঘরের দিকে এগুচ্ছিলো, বনহুর অন্ধকারে তার পথ আগলে দাঁড়ালো এবং সংগে সংগে খপ করে টিপে ধরলো তার গলাটা। অমন চেঁচামেচি করছো কেন?

ভয়ে গোংগাতে লাগলো আলীর মা-হ্যাঁ হ্যাঁ কে-কে-কে তুমি..

বনহুর যখন আলীর মার টুটি টিপে ধরেছে তখন দারওয়ান চিৎকার শুরু করে দিয়েছে চোর…..চোর…..চোর..

গভীর রাতে দারওয়ানের চিৎকার শুনে চৌধুরী বাড়ির সবাই জেগে উঠলো।

বনহুর শুনতে পেলো চারদিকে দ্রুত পদশব্দ। এই দণ্ডে সে আর বিলম্ব করা সমীচীন মনে করলো না। আলীর মায়ের গলা মুক্ত করে দিয়ে অন্ধকারে আত্মগোপন করলো, পরক্ষণেই বাগানবাড়ির পিছনে শোনা গেলো অশ্ব পদশব্দ খট খট খট।

আলীর মা তখনও গলায় হাত বুলিয়ে গোঁ-গোঁ আওয়াজ করছে, মুখমণ্ডল ফ্যাকাশে বিবর্ণ। গলায় চাপ পড়ায় চোখ দুটো লালে লাল হয়ে উঠেছে–আর একটু, তাহলেই আলীর মার চোখমুখে রক্ত বেরিয়ে পড়তো।

সরকার সাহেব এবং অন্যান্য কর্মচারী সবাই এসে ঘিরে ধরলো আলীর মাকে। ততক্ষণে মরিয়ম বেগমও এসে দাঁড়িয়েছে সেখানে। সকলেরই চোখেমুখে একটা আতঙ্কভরা ভাব ফুটে উঠেছে। সবাই বলছে কি হলো, কি হলো–কোথায় চোর, কোথায় চোর……

 শোরগোল শুনে মনিরার ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো, জেগেই সে চমকে উঠলো, পাশে স্বামীকে না দেখতে পেয়ে বিমর্ষ হলো। বুঝতে পারলো, সে পালিয়েছে। পরক্ষণেই কানে গেলো দারওয়ানের চিৎকারের শব্দ–চোর…..চোর….চোর…..

মনিরা মনে করলো, ঠিকই তার স্বামীকে ওরা চলে যেতে দেখেছে, তাই চিৎকার করছে।

মনিরাও নিচে নেমে এলো, দেখলো সবাই জটলা করে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে আলীর মাকে। আলীর মা গলায় হাত বুলিয়ে রোদন করছে, ভয়ে তার মুখ ছাই-এর মত ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে।

বললো মনিরা–কি হয়েছে মামীমা? হঠাৎ নজর পড়লো ওদিকে নত মস্তকে দাঁড়িয়ে আছে। ফুল।

 মরিয়ম বেগম কিছু বলবার পূর্বেই বলে উঠলো আলীর মা–আপামণি, চোর নয়, ডাকাত ডাকাত এসেছিলো। আর একটু হলে আমাকে গলা টিপে মেরে ফেলতো। ওরে বাবা, হাত দু’খানা যেন লোহার সাঁড়াশী……

মনিরা বলে আবার কি হয়েছে? ডাকাত তোর গলা টিপে ধরেছিলো নাকি?

হাঁ, আপামণি, তোমাকে কি বলবো–সেকি ভীষণ চেহারা, জমকালো পোশাক পরা, কোমরে পিস্তল, মাথায় হেইয়া বড় পাগড়ি..

আলীর মার বলার ভংগী দেখে মনে মনে হাসছিলো মনিরা, বললো–ঠিক তবে ডাকাতই হবে! তা তুই ধরতে পারলি না?’

ধরবো আমি! বাবাঃ কি শক্তি তার গায়ে, গলাটা আমার গেছে–একবার আড়চোখে নূরীর দিকে তাকিয়ে বললো আলীর মা-চলো আপামণি, ঘরে গিয়ে সব বললো তোমায়।

মনিরা আলীর মাকে সংগে করে ফিরে এলো নিজের ঘরে।

*

আলীর মার মুখে সব শুনে মনিরার মুখ কালো হয়ে উঠলো, চোখ দুটো যেন জ্বলে উঠলো তার। বললো–আলীর মা, সত্যি তুমি সেই কালো পোশাক পরা লোকটাকে ফুলের ঘরে প্রবেশ করতে দেখেছিলে?

হন্তদন্ত হয়ে বললো আলীর মা–ছিঃ ছিঃ ছিঃ আমি মিথ্যা কথা বলবো! আমি নিজের চোখে দেখেছি–শুধু দেখিনি, ঘরের মধ্যে মেয়ে আর পুরুষের হাসির শব্দও শুনেছি…..

মনিরা. ক্রুদ্ধ সিংহীর ন্যায় গর্জে উঠলো–মনে রেখো, যদি এ কথার একটা বর্ণ মিথ্যা হয় তাহলে তোমাকে বাড়ি ছাড়তে হবে।

কেন আপামণি আমাকে অবিশ্বাস করছেন, ফুলকে আপনি যত ভাল মেয়ে বলেই মনে করেন আসলে সে মোটেই ভাল নয়। কোথাকার কে–চোর না ডাকাত, তার সঙ্গে রাত দুপুরে প্রেম করা……

আলীর মা, আমি নিজের কানে শুনবো, ডেকে আনো এক্ষুণি ফুলকে।

আচ্ছা তাই শোন, যদি একবর্ণ মিথ্যা হয় তবে আমাকে বাড়ি-ছাড়া করবে বলেছো তাই। করো। বেরিয়ে যায় আলীর মা।

 মনিরা মাথার চুল টেনে ছিঁড়তে থাকে, তবে কি তার স্বামীর সঙ্গে ফুলের…..না না, তার স্বামী কোনো দিন অসৎ চরিত্র লোক নয়, তার সমতুল্য মানুষ হয় না। কত দিনের কত কথা মনে পড়লো, মনে পড়লো বিয়ের পূর্বের কথা–যখন মনিরের সঙ্গে তার প্রথম পরিচয় ঘটেছিলো, কতদিন এক সঙ্গে মিশেছে কিন্তু কই কোনো দিন সে তো তাকে কোনো রকম কুৎসিত অসঙ্গত কথা বলতে শোনেনি বা কোনো মন্দ আচরণ করেনি। কতবড় সৎ ব্যক্তি হলে সে এমন হয় জানে মনিরা। নিজের স্বামীকে সে ভালভাবেই জানে……।

 মনিরার চিন্তাজালে বাধা পড়ে, কক্ষে প্রবেশ করে আলীর মা–পেছনে নূরী। নূরীর মুখে গভীর চিন্তার ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। কতকটা অপরাধীর মতও লাগছে তাকে। নূরী হঠাৎ এমন একটা অবস্থার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলো না, সে ভাবতেও পারেনি–আজ বনহুর তার কক্ষে প্রবেশ করতে গিয়ে নিজেকে প্রকাশ করে ফেলবে। যদিও বনহুরকে সে স্বামী বলে গ্রহণ করেছে। যখন সে নিজেকে নারী বলে জানতে শিখেছে তখন থেকেই। প্রকাশ্যে তাদের বিয়ে হয়নি। লৌকিকতাপূর্ণ বিয়ে যাকে বলে সেটা না হলেও তারা উভয়ে উভয়কে খোদা সাক্ষী রেখে বিয়ে করেছে। তাদের বিয়ের কথা জানে বন-জঙ্গল, বনের পশু-পাখি, আকাশ-বাতাস আর জানে একজন–সে হলো রহমান। তবু কেন তার মনে দুর্বলতা? কেন সে ভীত হরিণীর মত চকিতভাবে প্রবেশ করলো মনির কক্ষে।

মনিরা আলীর মা আর নূরীকে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। তীব্র চাহনীতে নূরীকে দেখে নিয়ে বললো–ফুল, আমি যা জিজ্ঞাসা করবো সঠিক জবাব দেবে কিন্তু?

চোখ দুটো একবার মনিরার মুখে স্থির হয়ে পুণরায় নত হলো, মুখে কোনো জবাব দিলো না।

মনিরার মুখ কঠিন গম্ভীর।

 কিছুক্ষণ পূর্বেই যে মনিরা তার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছিলো এখন যেন সে মনিরা আর নেই। মনিরার ক্রদ্ধ চেহারা নূরীর মনে ভয়ের উদ্বেগ সৃষ্টি করলো।

মনিরা আলীর মাকে বললো–আলীর মা, তুমি যাও।

 বেরিয়ে গেলো আলীর মা, মনিরার রুদ্রমূর্তি দেখে সে আর কোনো কথা বলতে পারলো না। বা সাহসই হলো না।

আলীর মা বেরিয়ে যেতেই মনিরা ফুলকে লক্ষ্য করে বললো–ফুল, আজ রাতে তোমার ঘরে কে এসেছিলো?

ফুল নীরব।

 মনিরা কঠিন কণ্ঠে বলে-বলো কে এসেছিলো?

 তবু মাথা নিচু করে রইলো নূরী।

মনিরা পুনরায় পূর্বের মত রাগতকণ্ঠে বললো-জবাব দিচ্ছো না কেন? বলো কে এসেছিলো আজ রাতে?

এবার নূরী চোখ তুললো, পরক্ষণেই দৃষ্টি নত করে নিলো সে। ঠোঁট দু’খানা কেঁপে উঠলো মাত্র।

 মনিরার সমস্ত দেহ রাগে কাঁপছে যেন, নূরীর নীরবতা তার দেহে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। ওর মুখ দেখেই বুঝতে পারছে–আলীর মা মিথ্যা বলেনি। সত্যি কি তাহলে তার স্বামীর সঙ্গে এই সাপুড়ে মেয়েটার কোনো ঘনিষ্ঠতা আছে। আবার বললো মনিরা–তুমি যখন আমার ঘরে ছিলে তখন দেখেছিলে আমার স্বামী এসেছিলো?

হা দেখেছিলাম। এতোক্ষণে একটা কথা উচ্চারণ করলো নূরী।

বললো আবার মনিরা-আমার স্বামীর সঙ্গে তোমার পরিচয় আছে জানতাম কিন্তু এতোটা জানতাম না। জবাব দাও, সে একটু পূর্বে তোমার কক্ষে কেন গিয়েছিলো?

জানি না।

জানো না, সে তোমার ঘরে গেলো অথচ তুমি জানো না?

 না।

তুমি তাহলে অস্বীকার করতে চাও আমার স্বামী তোমার ঘরে যায়নি?

 হ গিয়েছিলো।

ফুল।

নূরী মনিরার পায়ের উপর উবু হয়ে বসে পড়ে দু’হাতে ওর পা দু’খানা চেপে ধরে আমাকে আর কোনো কথা জিজ্ঞাসা করবেন না আপামণি।

 মনিরা পা সরিয়ে ক্রুদ্ধকণ্ঠে বললো–তোমাকে বলতে হবে সব কথা, নাহলে আমি তোমায় রেহাই দেবো না।

আপামণি। নূরী দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।

মনিরা বললো জানতাম তুমি সচ্চরিত্রা মেয়ে কিন্তু—

না না, আপনার পায়ে পড়ি আপামণি, আমাকে মাফ করে দিন, আমাকে মাফ করে দিন—

 লজ্জা করে না তোমার মাফ চাইতে? আমার স্বামীর চরিত্রকে তুমি বিনষ্ট করেছে। আমি তোমাকে মাফ করবো–একথা তুমি মুখ দিয়ে উচ্চারণ করতে পারলে?

আপামণি—

না, কোনো কথা তোমার শুনতে চাই না, তুমি এই মুহূর্তে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও, বেরিয়ে যাও বলছি।

নূরীর কণ্ঠরোধ হয়ে গেছে যেন, একটি কথাও তার গলা দিয়ে বের হলো না। নীরবে রোদন করতে লাগলো, তার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো অশ্রুধারা।

মনিরা তখন কিছুতেই নিজেকে সংযত রাখতে পারছে না। দাঁতে অধর দংশন করে রক্ত বের করে ফেলছিলো। সে ভাবতে পারছে না, তার স্বামী অন্য একটি নারীর গৃহে প্রবেশ করতে পারে কোনো কুমতলব নিয়ে। এ কখনও হতে পারে না, কিছুতেই না। গর্জে উঠে মনিরা–যাও বেরিয়ে যাও। রাত ভোর হবার আগেই তোমাকে এ বাড়ি ত্যাগ করতে হবে।

নূরী এবার বললো–আপামণি, একবার নূরকে দেখবো।

হবে না। তোমার ঐ অপবিত্র চোখ দিয়ে আমার নূরকে দেখতে দেবো না। যাও, আর কেউ জানার পূর্বে তুমি চলে যাও।

নূরী আঁচলে চোখ মুছে কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলো, তারপর ফিরে গেলো নিজের কক্ষে। বালিশে মুখ গুঁজে অনেকক্ষণ কাঁদলো সে, আজ রাতেই তাকে এ বাড়ি ত্যাগ করে চলে যেতে হবে। কিন্তু কোথায় যাবে সে, রাতের অন্ধকারে কে তাকে পথ বলে দেবে।

 তবু যেতে হবে, কক্ষমধ্যে সবকিছু পড়ে রইলো, রিক্ত হস্তে রাস্তায় বেরিয়ে এলো নূরী। রাতের অন্ধকারে পথ চলতে লাগলো দিশেহারার মত।

 তারা-ভরা আকাশ।

নিস্তব্ধ পৃথিবী, পথের দু’পাশে জোনাকীর আলোগুলো পিট পিট করে জ্বলছে। আর জ্বলছে ইলেকট্রিক লাইট পোষ্টের আলোগুলো এক একটা ধ্রুবতারার মত।

জোনাকীর আলোগুলো লাইট পোষ্টের আলোতে কেমন বিবর্ণ ম্লান দেখাচ্ছে।

নির্জন পথ বেয়ে চলেছে নূরী।

*

শহরে বড় একটা আসেনি নূরী, বিশেষ করে কান্দাই শহরে। এসব পথঘাট তার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত। সূর্য উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে জেগে উঠলো ঘুমন্ত নগরী। কর্ম-কোলাহলমুখর হয়ে উঠলো রাজপথগুলো। অসংখ্য গাড়িঘোড়ার ছুটোছুটি আর পথচারীদের ভিড়ে নূরী যেন দিশেহারা হয়ে পড়লো। কোথায় যাবে, কি করবে, ভেবে পাচ্ছিলো না–হাতে একটি পয়সাও নেই যে কোনো গাড়িতে চেপে চলবে।

নূরী ঘোড়ায় চাপতে জানে; একটা ঘোড়া পেলেও সে চেষ্টা করে দেখতে আস্তানার কোনো সন্ধান করতে পারে কিনা। কিন্তু সে আশা দূরূহ–কোথায় পাবে সে ঘোড়া। ক্ষুধা–পিপাসায় কাতর হয়ে উঠলো সে। বেলা যতই বাড়ছে ততই পা দুখানা যেন অবশ শিথিল। হয়ে আসছে। সম্মুখে একটা হোটেল দেখতে পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো নূরী, হোটেলের ভিতরে খানাপিনা চলছে। নূরী, দরজায় উঠে দাঁড়ালো, লোলুপ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইলো যারা টেবিলের চারপাশ ঘিরে খাবার খাচ্ছে তাদের দিকে।

দারওয়ান বন্দুক হাতে পাহারা দিচ্ছিলো, নূরীকে দেখে খেঁকিয়ে উঠে–ভাগ হিয়াসে।

 নূরী তেমনি দাঁড়িয়ে থাকে, কোনো কথা বলে না।

দারওয়ান পুনরায় কঠিন কণ্ঠে ধমক দেয়–তুম কেয়া মাঙ্গতে? হিয়া ভিক নাহি হোগা, যাও।

নূরী এবার বলে–আমাকে একটু ভিতরে যেতে দাও না।

 আন্দরে মে যায়েগা?

 হাঁ, আমাকে যেতে দাও, খাবো।

 দারওয়ান ওকে পথমুক্ত করে দিলো।

নূরী ভিতরে প্রবেশ করে একটা টেবিলের পাশে গিয়ে বসে পড়লো, চারদিকে অগণিত লোকজন খাবার খাচ্ছে, হাসিগল্পে হোটেল-কক্ষ সরগরম হয়ে উঠেছে। নূরীকে তেমন করে কেউ লক্ষ্য করলো না।

 বয় এসে নূরীর সম্মুখে খাবারের প্লেট রেখে গেলো, মাংস আর চপও দিলো। খাবার শেষ হলে বললো–কফি না চা দেবো?

নূরী বললো–ওসব লাগবে না।

বয় মিষ্টি সুপারীর সঙ্গে বিল দিলো নূরীর সম্মুখে।

নূরী বললো–আমি তো পড়তে জানি না।

বয় বললো–দু’টাকা আট আনা হয়েছে।

নূরী অস্পষ্ট কণ্ঠে উচ্চারণ করলো–দু’টাকা আট আনা।

হাঁ, দিয়ে চলে যান।

 কিন্তু আমার কাছে তো পয়সা নেই।

সেকি! বয়ের চোখেমুখে বিস্ময় ছড়িয়ে পড়লো, এর পূর্বে সে এমন উক্তি কোনোদিন শোনেনি। আজ আট বছর সে এই হোটেলে কাজ করছে। বয় এবার মালিককে জানালো-স্যার, ঐ মেয়েটি দু’টাকা আট আনার খাবার খেয়েছে কিন্তু এখন বলছে তার কাছে কোনো পয়সা নেই।

 মালিক তাকালো নূরীর দিকে; এতোক্ষণ সে নূরীকে লক্ষ্যই করেনি, অমন কত মেয়ে-পুরুষ তার হোটেলে অবিরত খাচ্ছে; কখন এসব খেয়াল করবে–হিসাবের খাতা নিয়ে সে বসে থাকে। সম্মুখের টেবিলে।

নূরীকে লক্ষ্য করে লোকটা উঠে দাঁড়ালো, এগিয়ে এলো তার পাশে–পয়সা নেই তবে খাবার খেলে কেন? কঠিন কণ্ঠে বললো সে কথাটা।

নূরী অসহায় দৃষ্টি মেলে তাকালো, কোনো কথা বললো না।

মালিক এবার ধমকে উঠলো–কি, কথা বলছো না যে?

আমার কাছে পয়সা নেই তো!

 তবে খেলে কেন?

ক্ষিদে পেয়েছিলো তাই—

তাই পয়সা না দিয়েই খাবে?

 হাঁ খাবো।

 মালিক ধরে ফেললো নূরীকে খপ করে–তোমাকে আটকে রাখবো যতক্ষণ টাকা পরিশোধ না করেছো ততক্ষণ ছেড়ে দেবো না।

নূরী এক ঝটকায় মালিকের হাতের মুঠা থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো, রাগে ফোঁস ফোঁস করছে সে।

 মালিক ইংগিত করতেই তার হোটেলের কয়েকজন কর্মচারী তাকে পুনরায় ধরে ফেললো।

নূরী কামড়ে-ছিড়ে সে এক ভীষণ কাণ্ড শুরু করে দিলো, টেবিল থেকে প্লেট-গ্লাস-কাপ ছুঁড়ে ফেলে দিতে লাগলো মেঝেতে। পাকা মেঝেতে কাঁচের বাসনপত্র পড়ে ভেঙে খান খান হয়ে যেতে, লাগলো।

হোটেলের লোকজন সবাই ছুটে এলো চারপাশ থেকে। ভিড় জমে গেলো নূরীর চারপাশে।

 এমন সময় ভিড়ের ভিতর থেকে একজন ভদ্রলোক এগিয়ে এলোনূরীর সৌন্দর্য তাকে অভিভূত করে ফেলেছে। লোকটা পকেট থেকে দশটা টাকা বের করে মালিকের হাতে খুঁজে দিলো–এই নাও, ওকে ছেড়ে দাও তোমরা।

মালিক টাকা পেয়ে নূরীকে মুক্তি দিলো।

নূরী কুতজ্ঞতাপূর্ণ নয়নে তাকালো সেই লোকটার দিকে।

লোকটা নূরীর পাশে এসে বললো-তুমি কোথায় যাবে?

 নূরী ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো, কোনো উত্তর দিলো না।

 বললো লোকটা–এসো তোমাকে পৌঁছে দেবো। এসো।

নূরী লোকটিকে অনুসরণ করলো।

ভদ্রলোক নূরীকে নিয়ে রাস্তায় থেমে থাকা একটি গাড়ির পাশে এসে দাঁড়ালো, গাড়ির দরজা খুলে ধরে বললো–উঠো।

নূরীর এখন এমন অবস্থা তার ভাববার শক্তিও যেন লোপ পেয়ে গেছে। কি করবে, কোথায় যাবে–দিশেহারার মত নূরী উঠে বসলো গাড়ির মধ্যে।

ভদ্রলোকটা ড্রাইভ আসনে বসে গাড়িতে স্টার্ট দিলো।

কান্দাই শহরের পথ বেয়ে গাড়ি ছুটতে শুরু করলো।

নূরী জানে না কোথায় তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, কেমন লোক এ ভদ্রমানুষটি। কেনই বা তাকে নিয়ে যাচ্ছে সে, কি-ই বা তার উদ্দেশ্য। নিশ্চুপ পুতুলের মত বসে আছে নূরী বাইরের দিকে তাকিয়ে।

একটা বাড়ির সম্মুখে এসে গাড়িখানা দাঁড়িয়ে পড়লো। ভদ্রলোক গাড়ি থেকে নেমে পিছন আসনের দরজা খুলে ধরলো-এসো।

নূরী মোহগ্রস্তের মত গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো।

ভদ্রলোকটি যখন নূরীকে তার সঙ্গে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করছিলো তখন নূরী কোনো কিছু চিন্তা না করে তার সঙ্গে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করলো। ভাবলো, যাক বিপদকালে একটা আশ্রয় তবু পেলো সে। নিশ্চয়ই এ বাড়িতে ভদ্রলোকটির স্ত্রী পুত্র-কন্যা আছে। তাদের মধ্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে নেবে সে কোনো রকমে, তারপর খুঁজে বের করে নেবে তার বনহুরকে।

লোকটার সঙ্গে নূরী অন্দর বাড়িতে প্রবেশ করতেই গাটা তার ছমছম করে উঠলো। বাড়িতে কোনো মেয়েমানুষের চিহ্ন নেই। ঘরের মধ্যে টেবিলে ছড়িয়ে আছে অনেকগুলো মদের বোতল আর খালি গেলাস। দেয়ালে উলঙ্গ অর্থ উলঙ্গ নারী মূর্তি। মেঝেতে দামী কার্পেট বিছানো, কিন্তু কার্পেটের উপরে বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে আছে কয়েকটা নুপুর সেট।

মনে মনে শিউরে উঠলো নূরী, ভয়াতুর দৃষ্টি নিয়ে চারদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলো সে।

লোকটি নূরীর দিকে লক্ষ্য করে বললো–আজ থেকে তুমি এ বাড়িতেই থাকবে।

 নূরীর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে, বললো–আপনার স্ত্রী-সন্তান–তারা কই?

 বললো লোকটি–আরো ছোঃ স্ত্রী-পুত্র-কন্যার বালাই আমি ভালবাসি না, তাই ওসব নেই।

 আপনি একা থাকেন এ বাড়িতে?

হাঁ, আমি ছাড়া এ বাড়িতে আর দু’জন আছে–তারা আমার দেহরক্ষী পাহারাদার।

বাবুর্চি-বয়–এসব?

ওসবও আমি বরদাস্ত করতে পারি না। বয়-বাবুর্চি আমার প্রয়োজন হয় না। গোসল করি লেকে, কাপড় দেই ধোপারবাড়ি, খাই হোটেলে, বিশ্রাম করি বাসায়। দেখো তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে, বলো কি নাম তোমার?

 কিছুক্ষণ পূর্বেই হোটেলে লোকটা যখন তার খাবারের টাকা পরিশোধ করে দিয়েছিলো তখন নূরীর মন কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠেছিলো। আর এখন সেই কৃতজ্ঞতার পরিবর্তে তার সমস্ত শরীর ঘৃণায় রি রি করে উঠলো। নূরী বেরিয়ে যাওয়ার জন্য দরজার দিকে পা বাড়ালো।

সঙ্গে সঙ্গে লোকটা নূরীর পথ রোধ করে দাঁড়ালো–যাবে কোথায়?

না, আমাকে যেতে দিন।

 যাবে, কিন্তু আমার টাকা?

নূরীর মুখ চুণ হয়ে গেলো, কোথায় পাবে সে টাকা। এক্ষণে তার পেটের মধ্যের খাবারগুলো যেন কাটার মত খচ খচ করতে লাগলো, নিরুপায় কণ্ঠে বললো–টাকা আমার কাছে নেই জেনেই আপনি টাকা দিয়েছিলেন।

সে কারণেই তো তোমায় আমি এনেছি।

 কি চান আপনি আমার কাছে?

 তোমার রূপসুধা পান করতে চাই সুন্দরী। হাত ধরে ফেলে নূরীর।

কি বললে শয়তান? এক ঝটকায় হাতখানা ছাড়িয়ে নিয়ে ভীষণ জোরে একটা চড় বসিয়ে দেয় সে লোকটার গালে।

লোকটা চড় খেয়ে আরও ভীষণ হয়ে উঠে, জোর করে ধরে ফেলে নূরীকে।

 নূরী কামড়ে ধরে দাঁত দিয়ে লোকটার হাতখানা।

নূরীর ধারালো দাঁত কেটে বসে যায় লোকটার হাতে রক্ত গড়িয়ে পড়ে, যন্ত্রণায় মুখটা বিকৃত হয়ে উঠে, সঙ্গে সঙ্গে মুক্ত করে দেয় সে নূরীকে।

নূরী মুহূর্ত বিলম্ব করে না, টেবিল থেকে একটা বোতল তুলে ছুঁড়ে মারে লোকটার মাথা লক্ষ্য করে।

 লোকটা তখন কেবল সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে, নূরীর নিক্ষিপ্ত বোতলটা গিয়ে লাগে তার মাথায়।

 মদের ভারী বোতলটা ওর মাথায় লেগে ভীষণভাবে কেটে যায় ওর মাথাটা, গড় গড় করে রক্তধারা বেরিয়ে আসে কপাল বেয়ে, চোখমুখ রক্তে লাল টকটকে হয়ে উঠে।

নূরীর দিকে এগোয় লোকটা বিকৃত চেহারা নিয়ে, ভয়ঙ্কর নর পিশাচের মত আক্রমণ করে সে। ওকে।

নূরী হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে উন্মাদিনীর মত হয়ে উঠে। সে মেঝে থেকে ভাঙা বোতলটা তুলে নিয়ে পাল্টা আক্রমণ করে লোকটাকে। চোখেমুখে আঘাতের পর আঘাত করে চলে।

লোকটা পড়ে যায় মেঝেতে, যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে। নূরী তখনও ওর চোখেমুখে ভাঙা বোতলটা দিয়ে অবিরত খোঁচা দিয়ে চলেছে।

অল্পক্ষণেই মারা পড়ে লোকটা।–

নূরী তখনও আঘাত করে চলেছে। এমন সময় কক্ষে প্রবেশ করে দু’জন লোক। হঠাৎ কক্ষে প্রবেশ করে এই অবস্থা দেখে হতভম্ব হয়ে যায় কিন্তু সে ক্ষণিকের জন্য, পরক্ষণেই লোক দুটো নূরীকে ধরে ফেলে।

 নূরী তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মত অসাড় হয়ে পড়েছে যেন, পালানোর কথা সে ভুলেই গিয়েছিলো। লোক দু’জন যখন এসে পড়েছে তখন নূরীর হাতে শয়তানটার ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে গেছে।

নূরীকে বন্দী করে পুলিশে খবর দিলো লোক দু’জন।

অল্পক্ষণেই পুলিশ এসে পড়লো।

খুনের দায়ে গ্রেফতার করা হলো নূরীকে।

নূরীর হাতে হাতকড়া, কোমরে দড়ি বেঁধে পুলিশ ভ্যানে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো পুলিশ অফিসে। নূরীর কোনো কথাই তারা শুনলো না। হাজতে নিয়ে বন্দী করে রাখা হলো তাকে।

*

নূরীকে যখন হাজতে কারারুদ্ধ করা হলো তখন কান্দাই জঙ্গলে বনহুর তৈরি হচ্ছে ঝাঁম জঙ্গল আক্রমণে যাত্রার জন্য। অস্ত্রশস্ত্র আর গোলা-বারুদ নিয়ে প্রস্তুত সবাই। সকলের দেহেই জমকালো ড্রেস, পিঠে রাইফেল বাধা, কোমরের বেল্টে রিভলভার আর সূতীক্ষ্ণ ধার ছোরা।

 বনহুর যখন অন্যান্য অনুচরকে নিয়ে অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণের জন্য অপেক্ষা করছে তখন রহমান নাসরিনের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।

 আজ কদিন থেকে নাসরিন রহমানের উপর অভিমান করে বসে আছে, একটি বার কথাও বলেনি সে তার সঙ্গে। নাসরিন যেদিন জানতে পেরেছে, ঝাঁম জঙ্গলে মঙ্গল ডাকুর আস্তানা। আক্রমণে যাবে ওরা সেদিন থেকে তার মনে দুশ্চিন্তার ঝড় উঠেছে। আশঙ্কা হচ্ছে, যদি কোনো বিপদ ঘটে তাহলে কি হবে। হয়তো এই তাদের শেষ দেখা হবে। নাসরিন শুধু স্বামী রহমানের জন্যই চিন্তিত নয়, তাদের সরদার বনহুরের জন্যও অত্যন্ত ভাবত। রহমানের মুখে সব শুনেছিলো, জানতে পেরেছিলো মঙ্গল ডাকুর আস্তানার সব ঘটনা। কত বড় নৃশংস ভয়ঙ্কর এই মঙ্গল ডাকু সেকথা জেনে শিউরে উঠেছিলো সে। রহমানকে বলেছিলো–তোমাদের সরদারকে ক্ষান্ত করো; মঙ্গল ডাকু যা খুশি করুক তাতে তোমাদের কি? সে তো তোমাদের কোনো অমঙ্গল করছে না।

 রহমান বলেছিলো–বলো কি নাসরিন, মঙ্গল ডাকু আমাদের কোনো অমঙ্গল করেনি বলতে চাও? আমাদের দুজনকে বন্দী করে সে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে।

তোমরাও দু’জনার পরিবর্তে মঙ্গল ডাকুর কতগুলোকে হত্যা করেছে, সে কথা ভুলে যেও না।

কিন্তু তুমি তো জানো নাসরিন, কি অমানুষ এই মঙ্গল ডাকু–সব তোমাকে বলেছি। মঙ্গল ডাকু শত শত অবলা নারীকে ধরে নিয়ে গিয়ে সে উলঙ্গ অবস্থায় বন্দী করে রেখেছে। কাউকে সে রেহাই দেয়নি তার কুৎসিত মনোবৃত্তি থেকে।

উঃ কি মর্মস্পর্শী কথা। এসব তুমি স্বচক্ষে দেখেছো?

সব আমি নিজের চোখে দেখেছি–অমানুষিক বীভৎস কাণ্ড। বলো নাসরিন, এরপরেও তুমি আমাদের ক্ষান্ত হতে বলো?

না, যাও যাও তোমরা জয়ী হয়ে ফিরে এসো এই কামনা করি।

রহমান নাসরিনের মুখখানা তুলে ধরলোনাসরিন।

 বলো?

যদি ফিরে না আসি?

তোমায় ক্ষমা করবো।

নাসরিন, তুমি বীর জায়ার মতই জবাব দিয়েছে।

যাও আর বিলম্ব করো না, সরদার হয়তো ক্ষুণ্ণ হবেন।

হাঁ যাচ্ছি।

রহমান নাসরিনের দক্ষিণ হস্তখানা উঁচু করে চুম্বন করলো, তারপর বেরিয়ে গেলো সেখান থেকে।

ফিরে এলো রহমান দলবলের পাশে যেখানে তারই জন্য অপেক্ষা করছে সরদার স্বয়ং এবং অন্যান্য অনুচর।

বনহুর বুঝতে পারলো, রহমান নাসরিনের কাছে বিদায় নিতে গিয়েছিলো, কাজেই সে কোনোরকম প্রশ্ন তাকে করলো না, কেন তার বিলম্ব হলো।

 আজ কেশবও তাদের সঙ্গী হয়েছে।

যদিও বনহুর অকে বার বার বারণ করেছিলো।

কেশব অশ্বপৃষ্ঠে চড়া জানতো না কিন্তু সে এখন অশ্বে-চাপা, অস্ত্র-চালনা, সব ভালভাবে শিখে নিয়েছে। বনহুর অশ্বপৃষ্ঠে চেপে বসতেই অন্যান্যের সঙ্গে কেশবও চেপে বসলো অশ্বপৃষ্ঠে।

দস্যু বনহুরের আস্তানা প্রকম্পিত হয়ে উঠলো অশ্ব-পদশব্দে।

 তীর বেগে ছুটে চলেছে অশ্বগুলো।

যুদ্ধযাত্রার মতই সবাই বীরদর্পে অগ্রসর হচ্ছে। বনহুর আর রহমান সর্বাগ্রে।

বনহুর তাজের পিঠে।

আর রহমান দুলকীর পিঠে। জমকালো রং তাজের আর দুলকীর রং মেটে ধরনের। রাতের অন্ধকারে মিশে গেছে যেন এ দুটি অশ্ব। অন্যান্য অশ্ব কালো তবে কোনোটা লালচে, কোনোটা ধলাটে আর কোনোটা গাঢ় কালো।

এক সঙ্গে এতোগুলো অশ্বের পদধ্বনিতে চারদিক যেন থরথর করে কেঁপে উঠছে।

মঙ্গল ডাকুর আস্তানায় পৌঁছে গেলো এক সময় দস্যু বনহুরের দল। তখন রাত্রি তৃতীয় প্রহর। মঙ্গল ডাকুর শিব মন্দিরের নিকটে এসে নেমে পড়লো সবাই অশ্বপৃষ্ঠ থেকে।

বনহুর অনুচরদের অশ্ব ত্যাগ করে তাকে এবং রহমানকে অনুসরণ করতে বললো।

 বনহুর আর রহমান সর্বাগ্রে এগুচ্ছে।

বনহুরের হাতে রিভলভার, রহমানের হাতে রাইফেল। রহমানই শিবলিঙ্গটাকে একপাশে টেনে ধরলো, সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এলো একটা প্রকাণ্ড সুড়ঙ্গমুখ।

 প্রথমে সুড়ঙ্গমধ্যে প্রবেশ করলো বনহুর স্বয়ং, তার হাতে উদ্যত রিভলভার। পর পর অন্যান্য সকলে প্রবেশ করতে লাগলো–সবশেষে রহমানও প্রবেশ করলো সুড়ঙ্গমধ্যে। আশ্চর্য হলো সবাই সুড়ঙ্গমুখে কোনো পাহারা নেই। কিছুদূর এগুতেই কানে এলো মঙ্গল ডাকুর গলার আওয়াজ।

বনহুর সবাইকে সন্তর্পণে আত্মগোপন করতে আদেশ দিলো, যে মুহূর্তে বনহুর শীস দিবে সবাই যেন বেরিয়ে আসে।

বনহুরের নির্দেশ অনুযায়ী সুড়ঙ্গমধ্যে যে যেখানে পারলো লুকিয়ে পড়লো।

সম্মুখে এগিয়ে চললো বনহুর আর রহমান।

উভয়ের হাতে উদ্যত আগ্নেয় অস্ত্র।

এবার স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে মঙ্গল ডাকুর কণ্ঠস্বর–আমাদের ঝম আস্তানার সন্ধান তারা জেনে গেছে, কাজেই এখানে আর বিলম্ব করা আমাদের মোটেই উচিত হবে না। তোমরা প্রস্তুত হয়ে নাও, এখান থেকে সরে পড়তে হবে।

হুজুর, আমরা সব প্রস্তুত হয়ে রয়েছি, শুধু আপনার আদেশের প্রতীক্ষা করছি। এটা অন্য একটা গলার স্বর বলে মনে হলো।

বনহুর আর রহমান ধৈর্যসহকারে কান পেতে শুনতে লাগলো। পুনরায় ভেসে এলো সরদার মঙ্গল ডাকুর গলার আওয়াজ–বন্দী এবং বন্দিনীদের বেঁধে গোপন পথ দিয়ে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করো।

 বন্দী আর বন্দিনীদের হাত-পা’র শিকল খুলে দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেকের কোমরে রশি বেঁধে একসঙ্গে গেঁথে নেওয়া হচ্ছে। হুজুর, আপনি একবার দেখবেন চলুন।

যাচ্ছি, তোমরা যাও।

 হুজুর, আমাদের ধনভাণ্ডার কিভাবে নেওয়া হবে?

সে ব্যবস্থা আমি নিজে করবো।

 আচ্ছা হুজুর। কতগুলো পদশব্দ শোনা গেলো।

হয়তো বা সে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলো অনুচরগণ।

বনহুর ইংগিত করলো রহমানকে, পরক্ষণেই ঝাঁপিয়ে পড়লো কক্ষমধ্যে।

মঙ্গল ডাকু বনহুর আর রহমানকে দেখে হকচকিয়ে গেলো না, সে যেন এমন একটা অবস্থার জন্য তৈরিই ছিলো। বনহুর আর রহমানকে লক্ষ্য করে মঙ্গল ডাকু একটা গোল বেলুনের মত কিছু ছুঁড়ে মারলো। সঙ্গে সঙ্গে একটা ধুম্রকুণ্ডলী ছড়িয়ে পড়লো কক্ষমধ্যে।

বনহুর আর রহমান আর কিছু দেখতে পেলো না, সব যেন ঘোলাটে হয়ে এলে তাদের চোখে।

বনহুর তাড়াতাড়ি নাকে রুমাল চাপা দিয়ে বললো–রহমান, শীগগির নাকে রুমাল চাপা দাও—-

রহমান নাকে রুমাল চাপা দেওয়ার পূর্বেই ঢলে পড়লো মেঝেতে।

বনহুর দ্রুত বেরিয়ে এলো কক্ষমধ্য হতে এবং শীস দিলো সে অত্যন্ত জোরে।

 বনহুরের শীসের ইংগিতপূর্ণ শব্দ শোনামাত্র তার অনুচরগণ যে যেখানে আত্মগোপন করে ছিলো সব বেরিয়ে এলো। বনহুর বললো–তোমরা দ্রুত সবাইকে বন্দী করে ফেলো, কেউ যেন পালাতে না পারে।

মুহূর্তে সবাই ছড়িয়ে পড়লো কাট কাট, মার মার’ শব্দে ভরে উঠলো চারদিক। অস্ত্রের ঝন ঝন শব্দ আর তীব্র আর্তনাদ এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হলো মঙ্গল ডাকুর আস্তানায়।

মঙ্গল ডাকুর অনুচর আর দস্যু বনহুরের অনুচর মিলে শুরু হলো তুমুল যুদ্ধ। বনহুর পুনরায় প্রবেশ করলো সেই কক্ষে যে কক্ষ থেকে একটু পূর্বে সে বেরিয়ে এসেছিলো গ্যাসের ধোয়ায় অতিষ্ঠ হয়ে। এখন সে কক্ষের ধোয়া কমে গেছে। রহমান সংজ্ঞা হারিয়ে পড়ে আছে মেঝেতে। বনহুর কক্ষমধ্যে দ্রুত অন্বেষণ করে চললো, কিন্তু মঙ্গল ডাকু কোথায়? শূন্য কক্ষ পড়ে আছে–মঙ্গল ডাকুর চিহ্ন পর্যন্ত নেই। কর্পূরের মত উবে গেছে যেন সে।

রহমানকে কাঁধে তুলে নিলো বনহুর তারপর কক্ষের বাইরে এনে শুইয়ে দিলো। একজন অনুচরকে পাহারায় রেখে বনহুর ছুটে গেলো মঙ্গল ডাকুর সন্ধানে এদিক সেদিক থেকে তীব্রভাবে আক্রমণ করতে লাগলো বনহুরকে মঙ্গল ডাকুর অনুচরগণ। বনহুর তাদের পাল্টা জবাব দিয়ে দ্রুত অগ্রসর হতে লাগলো, অন্বেষণ করতে লাগলো মঙ্গল ডাকুর–কিন্তু আশ্চর্য, মঙ্গল ডাকুর সন্ধান আর পাওয়া গেলো না।

 সম্পূর্ণভাবে লোকটা যেন হাওয়ায় মিশে গেছে। যেদিকে তাকাচ্ছে সেদিকেই শুধু আহত আর নিহত দেহ পড়ে আছে, রক্তে রাঙা হয়ে উঠেছে মঙ্গল ডাকুর ভূগর্ভ আস্তানা, যেন রক্তের স্রোত বইছে।

নিহত আর আহতদের মধ্যে উভয় পক্ষের লোকই আছে, তবে মঙ্গল ডাকুর অনুচরগণই নিহত হয়েছে বেশি। দস্যু বনহুর স্বয়ং নিহত করেছে মঙ্গল ডাকুর অনুচরদের। কলাগাছ কাটার মতই হত্যা করেছে সে এদের।

কিন্তু মঙ্গল ডাকু কোথায়? তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অল্পক্ষণেই সমস্ত আস্তানা এক ধ্বংসলীলায় পরিণত হলো। মঙ্গল ডাকুর অনুচরদের মধ্যে কেউ জীবিত রইলো না। বনহুর কয়েকজনকে সুড়ঙ্গমুখে পাহারা রেখেছিলো তারা কাউকে বের হতে দিলো না আস্তানার মধ্য থেকে।

হত্যালীলা শেষ করে ক্ষান্ত হলো বনহুর, সমস্ত আস্তানা জুড়ে শুধু তাদের লোক এখন বিদ্যমান। বনহুর বন্দীশালায় এসে দাঁড়ালো। অসংখ্য বন্দীকে সারিবদ্ধ করে বাঁধা হয়েছে। এই মুহূর্তে তাদের অন্যস্থানে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছিলো। ভাগ্যিস সে দলবল নিয়ে ঠিক সময় এসে পড়েছে, আর একটি দিন বিলম্ব হলেই মঙ্গল ডাকু তার আস্তানা অন্য জায়গায় পাল্টে নিতো। বনহুর বন্দীদের মুক্ত করে দিবার জন্য আদেশ দিলো।

 বন্দীগণ বনহুরকে দেখেই খুশিতে দীপ্ত হয়ে উঠেছিলো, কারণ এই লোকটিই পালিয়ে যাবার দিন তাদের আশ্বাস দিয়ে গিয়েছিলো–তোমরা অপেক্ষা করো, আমি আবার আসবো এবং তোমাদের মুক্তির জন্যেই আসবো।

 বনহুর যখন বন্দীদের বন্ধন উন্মোচন করে দিচ্ছিলো তখন তার পাশে তাকে সাহায্য করছিলো কায়েস ও কেশব।

হঠাৎ কেশবের দৃষ্টি চলে যায় ওদিকে একটা দেয়ালের ফাঁকে–একজন ভীষণ চেহারার লোক সূতীক্ষ্ণধার একখানা ছোরা ছুঁড়ে মারলো বনহুরের পিঠ লক্ষ্য করে।

 কেশব মুহূর্ত বিলম্ব না করে বনহুরকে আড়াল করে দাঁড়ালো, সঙ্গে সঙ্গে ছোরাখানা বিদ্ধ হলো কেশবের বুকে।

বনহুর ফিরে তাকালো মুহূর্তে, কেশব তখন ভূতলে লুটিয়ে পড়েছে, রক্তে রাঙা হয়ে উঠেছে তার দেহের বসন। বনহুর চট করে বসে পড়লো এবং দ্রুতহস্তে ছোরাখানা টেনে খুলে নিলো কেশবের বুক থেকে।

বনহুরের চোখ দুটো ব্যথা-বেদনায় মোচড় দিয়ে উঠলো, কেশবের মাথাটা তুলে নিলো বনহুর কোলে–একি হলো কেশব? কে তোমাকে এভাবে হত্যা করলো?

কেশব জড়িত কণ্ঠে বললো–একটি ভয়ঙ্কর চেহারার লোক ঐ—ওখান থেকে—ছোরা মেরেছে—ঐ ওখান—কথা শেষ করতে পারলো না কেশব, ঘাড় একপাশে কাৎ হয়ে পড়ে।

 এমনভাবে আজ কেশবকে হারাতে হবে ভাবতেও পারেনি বনহুর। কায়েস বললো–সরদার, কেশব আপনাকে রক্ষার জন্যই আজ নিজের প্রাণ বিসর্জন দিলো।

 বনহুর বললো–কেশব আমার বন্ধুই শুধু নয়–আমার প্রাণরক্ষক, ওকে হারিয়ে আমি আজ কতবড় বন্ধুকে হারালাম তা বলতে পারবো না।

বেশিক্ষণ দুঃখ করার সময় ছিলো না বনহুরের, কেশবের হীমশীতল মাথাটা মাটিতে নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ালো সে। চোখ দুটো তার ছলছল করছে, বললো বনহুর নিশ্চয়ই মঙ্গল ডাকু কেশবকে হত্যা করেছে, কারণ মঙ্গল ডাকুর উদ্দেশ্য ছিলো আমাকে হত্যা করা। কেশব প্রাণ দিয়ে আমাকে বাঁচিয়ে নিলো। কিন্তু আজ আমি শপথ করছি–যতদিন মঙ্গল ডাকুকে এর উপযুক্ত শাস্তি না দিয়েছি ততদিন আমি বিশ্রাম গ্রহণ করবো না। এসো ভাই, তোমরা এসব অসহায় বন্দী ভাই এবং বোনদের উদ্ধার করে নাও। এসো তোমরা।

 বনহুর বন্দীদের মুক্ত করে দিয়ে এবার কায়েসসহ প্রবেশ করলো নারীদের বন্দীশালায়। বস্ত্রহীন উলঙ্গ নারীদের দেখেই কায়েস বেরিয়ে যাচ্ছিলো, বনহুর বললো–কায়েস, লজ্জা করলে চলবে না, এদের রক্ষা করতে হবে। এসো দ্রুতহস্তে বন্ধন উন্মোচন করে দাও। বনহুর নিজে মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ে থাকা ছিন্নভিন্ন ন্যাকড়ার টুকরোগুলো তুলে নিয়ে এক একজন বন্দিনীর দেহে চাপা দিতে লাগলো।

 কায়েস বন্ধন উন্মোচন করে চললো।

অপূর্ব-অদ্ভুত এ দৃশ্য-বনহুর মা-বোনদের ইজ্জৎ আবরণে আচ্ছাদিত করে চললো। যেমন করে হোক তাদের উদ্ধার করতেই হবে। আজকের এ সংগ্রাম তার শুধু মা-বোন আর অসহায় ভাইদের জন্য। নির্মম অকথ্য অত্যাচারের কবল থেকে তাদের বাঁচিয়ে নিতে হবে।

 মহিলাদের মুক্ত করে নিয়ে বনহুর আশ্বস্ত হলো। ততক্ষণে রহমানের সংজ্ঞালাভ ঘটেছে। এবার বনহুর সমস্ত বন্দী এবং বন্দিনীসহ নিজ অনুচরদের বেরিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলো। রহমান। কেশবের মৃতদেহটা তুলে নিলো কাঁধে।

সবাই যখন বেরিয়ে এলো বাইরে তখন বনহুর আর কায়েস একটা বোমা বের করে আগুন ধরিয়ে দিলো, তারপর দ্রুত বেরিয়ে এলো তারা। মন্দিরের বাইরে বেরিয়ে আসতে না আসতে ঝাঁম জঙ্গল প্রকম্পিত করে ভীষণ একটা আওয়াজ হলো। সঙ্গে সঙ্গে বনহুর চিৎকার করে বললো–শীগগির সরে পড়ো শীগগির সরে পড়ো।

বনহুরের কথায় সবাই মন্দিরের নিকট হতে দ্রুত সরে যাবার জন্য ছুটতে শুরু করলো।

পিছনে শোনা গেলো গাছপালার সঙ্গে মাটি ধসে পড়ার শব্দ। সেকি ভয়ঙ্কর প্রচণ্ড বিস্ফোরণের আওয়াজ,সকলের কান তালা লেগে গেলো।

একটু পড়ে সবাই সজ্ঞানে ফিরে এলো। বনহুর এবার সবাইকে নিয়ে ফিরে চললো ঝাঁম শহরে। ঝাঁম জঙ্গল থেকে কয়েক মাইল দূরে ঝাঁম শহর। বনহুর প্রথমে ঝাঁম শহরে যাওয়াই মনস্থ করলো।

ঝাঁম শহরে বনহুর নিজেকে বিদেশী সওদাগর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করলো। শহরের এক প্রান্তে মস্তবড় একটা বাড়ি ভাড়া নিলো এবং সেবাড়িতে মঙ্গল ডাকুর নিপীড়িত বন্দী ও বন্দিনীদের থাকার ব্যবস্থা করলো।

এবার তাদের খাওয়া-পরা এবং চিকিৎসার প্রয়োজন। বনহুর কায়েস আর দু’জন অনুচরকে রেখে রহমান ও অন্যান্য অনুচরকে কান্দাই ফিরে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিলো।

রহমান বনহুরের আদেশ অনুযায়ী অনুচরদের নিয়ে ফিরে চললো নিজ আস্তানায়।

 কায়েস, মাহমুদ আর সোহরাবকে নিয়ে বনহুর রয়ে গেলো ঝাঁম শহরে। প্রতিটি বন্দী এবং বন্দিনীকে মুক্ত করলেও তাদের নিজ নিজ বাড়িতে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থাও তাকেই করতে হবে, নাহলে অসহায় অবস্থায় পথে ধুকে ধুকে মরবে ওরা তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

কিন্তু এখন চাই প্রচুর অর্থ।

এতোগুলো মানুষকে বাঁচাতে হলে অর্থের প্রয়োজন। বনহুর আস্তানা থেকে এসেছিলো সংগ্রামের জন্য, কাজেই সে টাকা-পয়সা নিয়ে আসেনি।

বনহুর অর্থের অন্বেষণে বেরিয়ে পড়লো ঝাঁম শহরে।

বনহুর তার আংগুলের হীরক অংগুরীটা বিক্রয় করে টাকা সংগ্রহের জন্য প্রস্তুত হয়ে নিলো। ভাড়া করা একটা টাঙ্গা গাড়িতে চেপে বসে বললো–একটা স্বর্ণকারের দোকানে নিয়ে চলো।

টাঙ্গাওয়ালা ঝাঁমবাসী, বনহুর তাকে ঝম দেশীয় ভাষায় কথাটা বললো।

 টাঙ্গাওয়ালা বললো–লালাসাম! মানে আচ্ছা স্যার।

বনহুর ঠেশ দিয়ে বসে আছে, ঝাঁম শহরে সে কোনোদিন আসেনি, তাই নতুন দেশটাকে নতুন দৃষ্টি নিয়ে বনহুর নির্নিমেষ নয়নে দেখছে।

পথঘাটে অন্যান্য দেশের মত তেমন ভিড় নেই, ঝাঁম অধিবাসীদের সংখ্যা পথে অনেক কম, তবে নারী-পুরুষ উভয়েই ব্যস্তভাবে চলাফেরা করছে।

 পথের দু’পাশে অন্যান্য দেশের মত দোকানপাট, হোটেল রয়েছে। মাঝে মাঝে সিনেমা হলও নজরে পড়ে। শহরটা খুব বড় নয়, মাঝারি গোছের।

বনহুর নীরবে বসে চিন্তা করছিলো, তার মনে সদা-সর্বদা উদয় হচ্ছিলো কেশবের কথা। ঝাঁম জঙ্গলে কেশব শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছে। শেষ পর্যন্ত কেশবের মৃতদেহ ফিরে আনবে ভেবেছিলো। কিন্তু সম্ভব হয়নি। কাঁম জঙ্গলে তাকে রেখে আসতে হয়েছে। বনহুরের বড় আফসোস নূরীর সঙ্গে তার আর দেখা হলো না। নূরীকে কেশব বোনের মত ভালবাসতো। নূরীও তাকে সমীহ করতো, ভালবাসতো ঠিক বড় ভাই-এর মতো। আহা বেচারী কেশব—

হঠাৎ বনহুরের চিন্তা বিচ্ছিন্ন হয়, টাঙ্গাওয়ালা বলে–সাম্ আসামো। মানে স্যার এসে গেছে।

বনহুর টাঙ্গাওয়ালার ভাড়া মিটিয়ে দিলে বললো–কামরুদা হুসসো। মানে, টাঙ্গাওয়ালা ধন্যবাদ।

বনহুর টাঙ্গা থেকে নেমে স্বর্ণকারের দোকানে প্রবেশ করলো।

স্বর্ণকার বনহুরের দেহে কালো পোশাক দেখে অবাক হলো। বিশেষ করে তাদের দেশে কালো পোশাক পরা মানুষ সচরাচর দেখা যায় না। কালো পোশাক পরা ব্যক্তি নাকি এদেশে সবচেয়ে বেশি সম্মানী হয়, তাই তারা বের হয় কম।

বনহুর স্বর্ণকারের দোকানে প্রবেশ করতেই স্বর্ণকার তাকে নত হয়ে অভিনন্দন জানালো।

বনহুর একটু আশ্চর্য হলো।

 স্বর্ণকার তার সবচেয়ে বড় আসনটা এগিয়ে দিয়ে ঝাঁম ভাষায় বললো–বসুন স্যার।

বনহুর আসন গ্রহণ করলো।

স্বর্ণকার নত হয়ে বিনত কণ্ঠে বললো–কি কারণে আগমন আপনার?

বনহুর ভাঙা ভাঙা ঝাঁম ভাষায় উত্তর দিলো, কারণ সে খুব ভাল ঝাঁম ভাষা জানতো না, তবে যতটুকু জানতো তা দিয়েই কাজ চলবে, বললো–একটি অংগুরী বিক্রয়ের জন্য এসেছি।

 স্বর্ণকারকে বনহুর নিজ অংগুরী খুলে দেখালো।

স্বর্ণকার অংগুরী হাতে নিয়ে উল্টে-পাল্টে দেখে বললো–এ অংগুরী আপনি কেন বিক্রয় করবেন?

বললো বনহুর–অর্থের প্রয়োজন।

স্যার, যত অর্থ প্রয়োজন নিয়ে যান আপনি, কিন্তু এ অংগুরী আমরা কিনে নিতে পারি না।

 অবাক হয়ে বললো বনহুর-কেন?

কারণ, এ অংগুরী ঝিন্দের রাণীর হস্তের প্রতীক।

ঝিন্দের রাণী। চমকে উঠলো বনহুর–তাইতো, এ অংগুরী মনিরা তার আংগুলে একদিন পরিয়ে দিয়েছিলো, যেদিন বনহুর মনিরাকে ঝিল শহর থেকে নৌকাযোগে কান্দাই নিয়ে যাচ্ছিলো। মনিরা একদিন ঝিন্দের রাণী-বেশে ঝিন্দ সিংহাসনে আরোহণ করেছিলো বটে। তাহলে এটা ঝিন্দের রাণীর।

বললো স্বর্ণকার–আপনি ঝাঁম রাজ্যে বাস করেন অথচ ঝাঁমের সঙ্গে ঝিন্দ রাজ্যের সম্বন্ধ কি জানেন না?

না তো? বললো বনহুর।

স্বর্ণকার বললো–ঝাঁম রাজ্যের রাজার বোন হলেন ঝিন্দের রাণী। কাজেই আমাদের রাজ্যে রাজার বোনের সমাদর বা সম্মান ঠিক ভাই-এর মতই। আপনি বুঝি ঝিন্দের রাণীর আত্মীয়?

বনহুর স্থির হয়ে কিছু চিন্তা করলো, তারপর বললো-হাঁ, আমি ঝিন্দ রাণীর আত্মীয়ই বটে।

 স্যার, আপনি কত টাকা নেবেন বলুন আমি দিয়ে দিচ্ছি।

না দরকার নেই, আমি ঝাঁম রাজার নিকটেই যাচ্ছি, তার কাছেই নিয়ে নেবো।

স্বর্ণকার তাতে আপত্তি করলো না, বললো–সাম্ এহি লালু–অর্থ হলো, স্যার আপনি ঠিক বলেছেন।

বনহুর স্বর্ণকারের কাছে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলো।

এবার বনহুর ভাবতে লাগলো, রাজার নিকট হতেই তাকে এ অর্থ সংগ্রহ করতে হবে।

 এগিয়ে চললো বনহুর ঝাঁম শহরের পথ ধরে। সম্মুখে একটা উটের গাড়ি দেখে উঠে বসলো-রাজবাড়ি নিয়ে চলো।

বনহুরের দেহে কালো পোশাক দেখে পথচারিগণ তাকে পথ মুক্ত করে দিচ্ছিলো, সবাই নত হয়ে সম্মান দেখাচ্ছিলো তাকে।

বনহুর যখন উটের গাড়িতে উঠে বসলো তখন গাড়ির চালক তাকে সসম্মানে বসার জন্য সহায়তা করলো। মনে মনে বনহুর তার পোশাকটাকে ধন্যবাদ জানালো।

ঝাঁম অধিবাসিগণ সবাই কালো পোশাক পরতে পারতো না, এ পোশাক পরম সম্মানিত পোশাক। বনহুর যখন রাজদরবারে পৌঁছলো তখন তাকে সবাই অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে অভিনন্দন জানালো।

বনহুরকে রাজদরবারের মধ্যে রাজার সম্মুখে নিয়ে যাওয়া হলো।

বনহুরের সৌম্য-সুন্দর দীপ্তময় চেহারা দেখে ঝাঁম রাজা তাকে উঠে সমাদর করে পাশে বসালেন, এবং কোথা থেকে এসেছে জিজ্ঞাসা করলেন।

বনহুর দক্ষিণ হস্তের অংগুরীটা দেখিয়ে বললো–ঝিন্দ রাজ্য থেকে এসেছি।

অংগুরী দেখামাত্র ঝাঁমরাজ বনহুরের দক্ষিণ হস্তখানা হাতে উঠিয়ে নিয়ে পরপর তিনবার চুম্বন করে চললেন। বিস্মিত হলো বনহুর।

ঝাঁম রাজা সঙ্গে সঙ্গে হুকুম দিলেন–রাজ অতিথির জন্য শহরে মহোৎসবের আয়োজন করো। রাজদরবার হতে রাজা স্বয়ং বনহুরকে নিয়ে গেলেন অন্দর মহলে। বাগানবাড়ির বিশ্রামাগারে বনহুরের থাকার সুব্যবস্থা করে দিলেন।

 বনহুর বাগানবাড়ির বিশ্রামাগারে প্রবেশ করে অবাক হলো, এ যেন স্বর্গপুরী। সুন্দর দুগ্ধফেননিভ শয্যা। সদ্য ফোঁটা ফুল দিয়ে সমস্ত কক্ষটা আচ্ছাদিত। দেয়ালে নানারকমের চিত্র অঙ্কিত রয়েছে। টেবিলে স্বর্ণ এবং মণি-মাণিক্য খচিত, ফুলদানীতে মুক্তার ফুল-ঝাড়। উজ্জ্বল আলোতে আলোকিত চারদিক। সবচেয়ে বনহুর বেশি আশ্চর্য হলো, কয়েকটি সুন্দরী নারী। কক্ষমধ্যে দণ্ডায়মান।

বনহুর কক্ষে প্রবেশ করতেই সুন্দরী নারীগণ তাকে নত মস্তকে অভিবাদন জানালো।

বনহুরকে বিশ্রামাগারে পৌঁছে দিয়ে ঝাঁমরাজ বেরিয়ে গেলেন দরবার কক্ষে, সেনাপতি আর মন্ত্রীকে বললেন উৎসবের আয়োজন করতে।

বনহুর কক্ষমধ্যে দণ্ডায়মান হয়ে চারদিকে তাকালো। এক একটি তরুণীর মুখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখতে লাগলো–তরুণীগুলোর চেহারা সুঠাম, বয়স বিশ বছরের বেশি নয় কারো। মূল্যবান বেশভূষায় সজ্জিত তারা। মাথার চুলগুলো বেণী করে কাঁধের দু’পাশে ঝুলানো। হাতে গলায় ফুলের মালা, চোখে কাজল, কপালে সোনার টিপ। ঠোঁটের কোণে মিষ্টি মিষ্টি হাসি।

 বনহুর তাকিয়ে দেখছিলো আর ভাবছিলো, ঝাঁম রাজার অতিথি সৎকারের অদ্ভুত আচরণ। তরুণীগুলোকে রাখা হয়েছে অতিথির মনোতুষ্টি কারণে তাতে কোনো ভুল নেই।

বনহুর অবাক হয়ে দেখছে তখন দু’জন তরুণী মূল্যবান চামর হস্তে তার দু’পাশে এসে দাঁড়ালো, হাওয়া করতে লাগলো তারা বনহুরকে। একজন বনহুরের দক্ষিণহস্তখানা ধরে শয্যায়। দিকে এগুলো। বনহুর যন্ত্রচালিতের মত এগুলো।

বনহুরকে যুবতীগণ বসালো শয্যার উপরে।

 বনহুর বসলো। অবোধ শিশুর মতই যেন সে ওদের ইচ্ছামত সব করতে লাগলো।

এবার যুবতীগণের মধ্য হতে একজন বনহুরের মাথার পাগড়িটা খুলে টেবিলে রাখলো।

অন্যজন পা থেকে জুতো জোড়া খুলে নিলো যত্নসহকারে।

বনহুর অর্ধশায়িত অবস্থায় শয্যায় ঠেশ দিয়ে শুয়ে পড়লো।

যুবতীগণ বনহুরকে ঘিরে বসলো চারপাশে–কেউ বা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, কেউ বা হাতে, কেউ বা পায়ে। একজন বনহুরের সম্মুখে, একটা বেহালার মত যন্ত্র নিয়ে বসে পড়লো। অদ্ভুত এক সুরের সৃষ্টি হলো কক্ষমধ্যে। অপূর্ব সে সুর। যুবতী তন্ময় হয়ে বাজিয়ে চললো। বেহালাটা।

এবার একজন যুবতী নাচতে শুরু করলো। বিচিত্র ভঙ্গিমায় নাচতে লাগলো সে।

 বনহুর নিজেও যেন ধীরে ধীরে মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।

শয্যার পাশেই ছিলো একটা গোল টেবিল। দুগ্ধধবল শ্বেত পাথরে তৈরি টেবিলটার উপরে স্তূপাকার নানা ফুলমূল। একজন যুবতী টেবিল থেকে সুস্বাদু ফলগুলো তুলে দিতে লাগলো। বনহুরের মুখে। সুমিষ্ট আংগুর ফল আর আনারস খেয়ে বনহুর অসীম তৃপ্তি বোধ করলো। বনহুরের কাছে ফল ছিলো অত্যন্ত প্রিয়। কাজেই ফল সে বিনা দ্বিধায় গ্রহণ করতে লাগলো।

বনহুর নাচ দেখছে–সত্যি এমন নাচ সে কোনোদিন দেখেনি। বৈচিত্রময় ভঙ্গিমায় নেচে চলেছে যুবতীটি। নাচের তালে তালে তার যৌবনভরা সুঠাম অঙ্গগুলো দুলে দুলে উঠছিলো। বনহুর দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো– না না, এসব কি হচ্ছে। ঝাঁম শহরের নির্জন এক বাড়িতে তারই প্রতীক্ষায় অপেক্ষা করছে মৃতপ্রায় কতগুলো নারীপুরুষ, ক্ষুধা-পিপাসায় যাদের দেহ হয়ে গেছে। ক্ষীণ, অস্থি-পাঁজর ছাড়া কিছুই যাদের নজরে পড়ে না, সে সব অসহায় ভাই-বোনদের রেখে সে বনহুর সমগ্র সুস্বাদু ফল ভক্ষণ করে চলেছে! মনের আনন্দের জন্য দর্শন করে চলেছে বৈচিত্রময় মনমাতানো, নাচ। এক মুহূর্ত তার বিলম্ব করা ঠিক নয় আর। বনহুরের মন চঞ্চল হয়ে উঠলো, যুবতীগণকে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য ইংগিত করলো সে।

যুবতীগণ অবাক হলো, এর পূর্বে কোনো অতিথিকে তো এমন দেখেনি। সব পুরুষই তাদের পেয়ে আনন্দে মেতে উঠেছে। নানা রকম আলাপ-আলোচনা আর হাসি-গান করেছে তাদের নিয়ে। কেউ তো তাদের এমনভাবে উপেক্ষা করেনি।

যুবতীগণ বনহুরের ইংগিত অনুসারে বেরিয়ে গেলো কক্ষ থেকে।

শুধুমাত্র একজন, যে বেহালা বাজাচ্ছিলো সে বসে রইলো–তার হাতে তখনও বেহালা। হরিণ-ডাগর চোখ মেলে তাকিয়ে আছে সে বনহুরের মুখের দিকে।

বনহুর নিপুণ চোখে তাকিয়ে দেখলো-যুবতী ঝমবাসিনী হলেও অপূর্ব তার চেহারা, কতকটা ইরাণী মেয়েদের মত। মাথায় ঝাকড়া চুল, কপালে চন্দনের টিপ, দেহের রং গোলাপী। ঠোঁট দু’খানা সরু রক্তজবার মত লাল টুকটুকে।

বনহুরের দিকে তাকিয়ে ঝাঁম ভাষায় বললো–তুমি কেমন লোক, এতোগুলো মেয়ের একটিকেও তোমার পছন্দ হলো না?

বনহুর সোজা হয়ে বসে হেসে বললো তোমাদের সবাইকে আমার পছন্দ কিন্তু সবচেয়ে বেশি তোমাকে।

বনহুরের কথায় যুবতী খুশি হলো, বললো–আমার বোনদের চেয়ে আমি সুন্দর, একথা আরও অনেকের মুখে শুনেছি। এটা আমার পরম সৌভাগ্য—

যুবতী হাত বাড়ালো বনহুরের দিকে।

বনহুর যুবতীর কোমল হাতখানার উপর হাত রাখলো।

একি, যুবতী ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো বনহুরের পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে, বনহুরের মুখের কাছে মুখ এগিয়ে আনলো।

বনহুর অতিকষ্টে নিজেকে সংযত করে রাখলো যুবতীর কাছ থেকে, কিন্তু যুবতীর উষ্ণ নিঃশ্বাস তার ধমনীতে আলোড়ন জাগালো। নিজের ঠোঁটখানা দাঁত দিয়ে দংশন করতে লাগলো সে। যুবতীর হাতের মুঠায় তার দক্ষিণ হাতখানা তখন চাপা রয়েছে।

বনহুর বললো–তোমার নাম কি সুন্দরী?

 যুবতী জবাব দিলো–সামশী।

 বনহুর অস্ফুটকণ্ঠে উচ্চারণ করলো সামশী।

 যুবতী এতো ঘনিষ্ঠ হয়ে এসেছে যে বনহুর একটু পিছিয়ে বসতে বাধ্য হলো, বললো –সামশী, আজ আমার বিশ্রাম করবার সময় নেই, উঠতে হবে এখন।

অবাক কণ্ঠে বললো সামশী–আজ থাকবে না এ বিশ্রামাগারে?

না। অনেক কাজ আছে।

কিন্তু রাজা তো কাউকে এভাবে যেতে দেয় না?

 রাজা আমাকে যেতে না দিলেও যেতে হবে।

 যুবতী করুণ চোখে তাকালো বনহুরের দিকে, বললো–আবার আসবে না?

আসবো।

তোমাকে আমারও খুব পছন্দ হয়েছে, বলো তোমার নাম কি?

আমার নাম মহাসিন্ধু।

মহাসিন্ধু।

হা।

যুবতী নত হয়ে প্রণাম জানালো বনহুরকে।

বনহুর জানত, তাদের সবচেয়ে বড় দেবতার নাম মহাসিন্ধু। কাজেই যুবতী তাকে স্পর্শ করবে না–এ লোকটা নিশ্চয়ই তাদের দেবতার সমতুল্য হবে। বনহুরের অনুমান মিথ্যা নয়, যুবতীটা বনহুরের নিকট হতে সরে দাঁড়ালো।

বনহুর বললো–যাও সামশী তোমার মুক্তি।

শামসী ধীরে ধীরে নত মস্তকে কক্ষ ত্যাগ করলো।

বনহুর এবার নিশ্চিন্ত মনে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে নিলো, তারপর পুনরায় মহারাজের দরবারে হাজির হলো।

ঝাঁম রাজা বনহুরকে পাশে বসিয়ে নাচগানের নির্দেশ দিলো। শুরু হলো নাচ আর গান, দরবার-কক্ষ নানারকম বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজে মুখর হয়ে উঠলো।

 বনহুরের কাছে এ উৎসব অসহ্য বোধ হচ্ছিলো, বিশ্রামাগারে নর্তকীদের কবল থেকে উদ্ধার পেলেও রাজার হাত থেকে মুক্তি পেলো না সে। সমস্ত রাত ধরে চললো নানারকম আনন্দ উৎসব।

শরাব পান করে ঢুলু ঢুলু হলো মহারাজের আঁখিদ্বয় রাজ পারিষদগণের অবস্থাও তাই। একসময় নাচগান বন্ধ হলো, বন্ধ হলো সমস্ত উৎসব। নিস্তব্ধ হলো দরবার কক্ষ।

 কে কোথায় ঘুমের ঘোরে ঢলে পড়লো তার ঠিক নেই। বনহুর ঘুমের ভাণ করে একটা আসনে বসে হেলান দিয়ে চুপ করে পড়ে রইলো।

রাত ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে।

 রাজবাড়ির পাহারাদারগণও যে যেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝিমুচ্ছে। বনহুর তখন আসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ালো, আলগোছে বেরিয়ে এলো বাইরে। কোষাধ্যক্ষের কক্ষে প্রবেশ করলো সে সন্তর্পণে। বিরাট বপুওয়ালা কোষাধ্যক্ষ মহাশয় ভুড়ি উঁচু করে নাক ডাকিয়ে ভোম্ হয়ে ঘুমাচ্ছিলো। বনহুরের জামার ভিতর পকেটে গুলী ভরা রিভলভার এখনও বিদ্যমান। বনহুর কোষাধ্যক্ষের শয্যার পাশে এসে দাঁড়ালো, আজ তার খাওয়া বুঝি বেশি হয়েছিলো, তাই ঘুমটা বেশি জেকে গেছে।

বনহুর পকেট থেকে রিভলভার বের করে রিভলভারের ডগা দিয়ে কোষাধ্যক্ষের গা থেকে চাদরখানা সরিয়ে দিলো।

সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভেঙে গেলো ঝম কোষাধ্যক্ষের, ধড়ফড় করে উঠে বসে তাকালো, সম্মুখে তাদের নতুন অতিথিকে দণ্ডায়মান দেখে অবাক হলো কিন্তু তার হস্তস্থিত রিভলভারখানার উপরে নজর পড়তেই ফ্যাকাশে হলো তার মুখমণ্ডল। ঢোক গিলে বললো–আপনি এখানে?

বনহুর বললো–উঠে পড়ুন দেখি।

রিভলভারের দিকে তাকিয়ে কোষাধ্যক্ষ মহাশয় কোনো কথা আর উচ্চারণ করতে পারলো না, ভয়কম্পিত দেহে শয্যা ত্যাগ করে নেমে দাঁড়ালো।

বনহুর কোষাধ্যক্ষসহ কোষাগারে প্রবেশ করে বললো–চাবি দ্বারা সিন্দুক খুলে ফেলুন।

বনহুর ইচ্ছামত অর্থ তুলে নিলো একটা থলেতে। তারপর একটা কাগজে খচ খচ করে লিখলো।

মহারাজ
অপরাধ ক্ষমা করবেন; দুঃস্থ অনাথ
ভাই-বোনদের জন্য কিছু অর্থ আপনার
কোষাগার থেকে নিয়ে গেলাম
–দস্যু বনহুর।

চিঠির অক্ষরগুলো বনহুর ঝাঁম ভাষায় লিখতে পারলো না, কারণ ঝাঁম ভাষা কিছুটা বলতে পারলেও লিখতে পারতো না। ইংরেজিতে লিখলো, বনহুর জানতো ইংরেজি কেউ না কেউ নিশ্চয়ই জানে। চিঠি খানা লিখে কোষাধ্যক্ষের হাতে গুঁজে দিলো–জাম, শশা, মিংলো লা সিয়াং। মানে, বন্ধু, এ চিঠিখানা তোমার প্রভুকে দিও।

হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কোষাধ্যক্ষ মহাশয়।

বনহুর টাকার থলেটা বাম হাতের মুঠায় চেপে ধরে ডান হাতে রিভলভার উদ্যত রেখে বেরিয়ে গেলো কোষাগার হতে।

*

ঝাঁম জঙ্গল।

মঙ্গল ডাকুর আস্তানা আজ ধ্বংসলীলায় পরিণত। যে স্থানে শিবমন্দির ছিলো আর ছিলো আস্তানায় প্রবেশের সুড়ঙ্গমুখ, সব ধসে পড়েছে। শিবমন্দিরের কোনো চিহ্নটি পর্যন্ত নেই সেখানে।

ঝাঁম জঙ্গলের বিস্তৃত এলাকা নিয়ে গভীর খাদের সৃষ্টি হয়েছে। গাছপালা লতাগুলু সব বসে গেছে মাটির তলায়।

 ঝাঁম জঙ্গলে মঙ্গল ডাকুর আস্তানা ধ্বংস হবার তিন দিন পর গভীর খাদের মধ্য হতে রক্ত মাখা বীভৎস দেহে কচ্ছপের মত উঠে এলো মঙ্গল ডাকু স্বয়ং। দক্ষিণ চোখটা তার সম্পূর্ণ গলে গেছে। চোয়ালের একটা হাড় ভেঙে যাওয়ায় মুখটা বাঁকা হয়ে গেছে যেন একপাশে। বামহস্তটা উড়ে গেছে একেবারে। এক হস্ত এবং এক চক্ষুহীন মঙ্গল ডাকু তিন দিন তিন রাত্রি মাটির নিচে চাপা পড়ে থাকার পর জ্ঞান লাভ করে। স্বজ্ঞানে ফিরে মঙ্গল ডাকু স্মরণ করে এখন সে কোথায়, তার এ অবস্থা কেন? ধীরে ধীরে সব মনে পড়ে-মনে পড়ে দস্য বনহুরের দলবলের আক্রমণের কথা। মনে পড়ে তার পরাজয়ের কথা। তার কদাকার মুখটা প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলে উঠে। ভাগ্যিস মঙ্গল ডাকুর পা দু’খানা বিনষ্ট হয়নি তাই সে আবার পৃথিবীর আলো-বাতাস গ্রহণ করার সৌভাগ্য লাভে সক্ষম হলো।

মাটি ফুঁড়ে কচ্ছপের মত বেরিয়ে এলো মঙ্গল ডাকু। বন্য শুয়োরের মত ঘোৎ ঘোৎ করতে লাগলো রাগে। একটি অনুচরও তার আজ অবশিষ্ট নেই।

একদিন যে ডাকুর ভয়ঙ্কর হুঙ্কারে ঝাঁম জঙ্গলের মাটি প্রকম্পিত হতো, আজ সে ডাকু একটা পোড়ো হাতির মত গড়াচ্ছে।

 অজস্র টাকা-পয়সা আর ধন-রত্ন সব রয়ে গেলো মাটির তলায়। লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্ত শুষে পাতালপুরী গহ্বরে যে সৌধ গড়ে তুলেছিলো সব তলিয়ে গেছে, নিঃশেষ হয়ে গেছে, চাপা পড়ে গেছে মাটির নিচে।

মঙ্গল ডাকু আজ নিঃস্ব, শুধু নিঃস্বই নয়, ভয়ঙ্করভাবে আহত। টলতে টলতে এগুলো সে ঝাঁম শহরের দিকে।

এমন সময় একদল শিকারী ঝাঁম জঙ্গলে এসেছিলো, শিকারের আশায়, তাদের নজরে পড়ে যায় মঙ্গল ডাকু।

আহত মঙ্গল ডাকুকে দেখে তারা অবাক হয়, বলে–কে তুমি? এ জঙ্গলে কি করে এলে?

 মঙ্গল ডাকু করুণ অসহায় কণ্ঠে বললো–আমি একজন শিকারী। এ জঙ্গলে শিকারের আশায়। এসেছিলাম, হঠাৎ একটা বাঘ আমাকে তাড়া করে, আমি নিরুপায় হয়ে গাছে উঠি। কিন্তু গাছে। উঠতে গিয়ে পড়ে যাই এবং এভাবে আহত হই। তোমরা দয়া কর, আমাকে শহরে নিয়ে চলো, আমাকে কেনো হসপিটালে ভর্তি করে দাও। আমি আর কিছুই চাই না তোমাদের কাছে।

শিকারিগণের মনে দয়ার সঞ্চার হলো, তাইতো লোকটা বড় অসহায়। ওকে ঘোড়ায় তুলে নিলো, নিজেদের সঙ্গে যে খাবার ছিলো তাই খেতে দিলো ওকে।

 শিকারিগণ জানে না, কত বড় ভয়ঙ্কর জীবকে তারা জীবিত করতে যাচ্ছে। যেমন বিষধর সর্পকে দুধ খাইয়ে জিইয়ে তোলা, ঠিক সেরকম। সুযোগ পেলেই ছোবল মারবে সাংঘাতিকভাবে।

 মঙ্গল ডাকুকে নিয়ে শিকারিগণ চললো ঝাঁম শহরে এবং একটা ভাল হসপিটালে তাকে ভর্তি করে দিলো।

 বনহুর এক গাদা জামা কাপড় আর খাদ্যদ্রব্য নিয়ে ফিরে এলো তার ভাড়াটে বাড়িতে, যেখানে তার প্রতীক্ষায় পথ চেয়ে আছে অগণিত অসহায় ভাই-বোন।

বনহুর প্রত্যেককে জামা এবং কাপড় দিয়ে বললো–তোমরা এসব পরে নাও। আর খাবার আছে, পেট পুরে খাও।

কায়েস, সোহরাব আর মাহমুদকে নির্দেশ দিলো–এদের সুখ-সুবিধার দিকে খেয়াল রাখো।

বনহুরের নির্দেশে কায়েস তাদের সুঃস্থ অসহায় অতিথিদের সেবায় আত্মনিয়োগ করলো। মঙ্গল ডাকুর নির্মম অত্যাচারে নিষ্পেষিত বন্দী এবং বন্দিনীগণ এতো ক্ষীণ হয়ে পড়েছিলো যে তাদের কথা বলবার মত তেমন ক্ষমতাই ছিলো না। সেই শিকলের আঘাতে এক এক জনের হাত পায়ে এবং গলায় ঘা হয়ে গিয়েছিলো। বনহুর প্রত্যেকের চিকিৎসার ব্যবস্থা করলো।

 ঝাঁম শহর থেকে ডাক্তার ডাকা হলো।

ডাক্তার নিয়মিতভাবে রোগী দেখতে লাগলেন।

এসব দুঃস্থ ভাই-বোনদের জন্য প্রতিদিন প্রচুর অর্থ ব্যয় হতে লাগলো। বনহুর রাজকোষ থেকে যে অর্থ সংগ্রহ করে এনেছিলো তাতেই প্রচুর খরচ চললো।

কয়েক দিনের মধ্যেই অপরিসীম প্রচেষ্টায় তার অসহায় অতিথিগণ সুস্থ হয়ে উঠতে লাগলো। ক্ষীণ দেহগুলোতে শক্তির সঞ্চার হলো, সবল হয়ে উঠতে লাগলো তারা। লৌহশিকলের চাপে তাদের দেহে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছিলো দিন দিন তা শুকিয়ে এলো।

 বনহুর নিজে পাশে বসে ওদের দেখাশোনা করতো, কার কখন কি প্রয়োজন নিজে জেনে নিয়ে সেভাবে ব্যবস্থা নিতো। সবাইকে সস্নেহে সান্ত্বনা দিতে, কখনও বা নিজ হস্তে ঔষধ লাগিয়ে দিতো তাদের ক্ষতে।

 ক্রমান্বয়ে সবাই সুস্থ সবল হয়ে উঠলো। বনহুর এবার আদেশ দিলো কায়েস, সোহরাব আর মাহমুদকে, তোমরা এদের নিজ নিজ বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এসো।

বনহুর নিজেও এ কাজে মনোযোগ দিলো। অসহায় দুঃস্থ ব্যক্তিদের পৌঁছে দিতে লাগলো সে নিজে তাদের বাড়ি গিয়ে। বনহুর রাজ কোষাগার হতে অর্থ নিয়ে আসার পর হতে সে আত্মগোপন করেছিলো। অবশ্য সে ছদ্মবেশে শহরে বিচরণ করে ফিরতো, কেউ যাতে তাকে চিনতে না পারে।

 বনহুর একটা এক্কা ঘোড়ার গাড়ি কিনে নিয়েছিলো, সেই ঘোড়ার গাড়ি করেই সে এই সর্বহারা মুক্ত বন্দীদের তাদের নিজ নিজ আবাসে পৌঁছে দিচ্ছিলো।

কেউ তাকে দেখলে সহসা চিনতে পারবে না–সম্পূর্ণ কোচওয়ানের ড্রেস তার দেহে।

*

বনহুর অবসর সময়েও খালি গাড়ি নিয়ে শহরের মধ্যে ঘুরে বেড়াতো, কোচওয়ানের বেশে কোচবাক্সে বসে ঘুরে দেখতো ঝাঁম শহরটি।

 রাজা তো সেদিনের ঐ ঘটনার পর রাজ্যময় ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করে দিয়েছেন, যে ব্যক্তি কালো পোশাক পরা অতিথিকে ধরে দিতে পারবে, তাকে দশ হাজার টাকা এবং একটা ভাল চাকুরী দেওয়া হবে।

সেই ঘোষণার পর হতে রাজ্যের লোকজন সবাই উন্মুখ হয়ে উঠেছে, সকলেরই ইচ্ছা এই দশ হাজার টাকা লাভ করে এবং একটা ভাল চাকুরী পায়। কালো পোশাক পরা লোক দেখলেই ঝামবাসিগণ তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে রাজদরবারে হাজির করে।

 রাজা স্বয়ং পরীক্ষা করে দেখে ছেড়ে দেন, কিংবা বন্দী করে রাখেন। রাজ-কারাগার কালো। পোশাক পরা ঝামবাসী দ্বারা পূর্ণ হয়ে উঠলো। ভয়ে আর কেউ এ শহরে-কালো পোশাক পরতে চায় না। এমন কি সম্মানিত ব্যক্তিগণও নয়। ক্কচিৎ কোনো কারণে কালো পোশাক পরে শহরে বের হলেই তার মুক্তি নেই, ধরা পড়ে যেতে হবে রাজদরবারে।

বনহুর শহরে ঘুরে বেড়ানোকালে পাহারাদারগণ তার গাড়ি পরীক্ষা করে দেখতে কসুর করে। না, গাড়ি রুখে তারা গাড়ির ভিতরে ভালভাবে দেখে নেয়–এ গাড়িতে সেই কালো পোশাক পরা অতিথি আছে কি না।

 বনহুর সেই অংগুরীটা খুলে রেখেছে, হঠাৎ যদি কারো দৃষ্টিপথে পড়ে যায় তাহলে আর রক্ষা থাকবে না, ধরে নিয়ে যাবে ঝাঁম রাজার কাছে। কাজ কি অহেতুক সময় নষ্ট করে।

সেদিন বনহুর যখন বিশ্রাম করছিলো তখন কায়েস এসে বললো–সর্দার, আমাদের কাজ শেষ হয়েছে। ঝাঁম শহরে যাদের বাড়ি তাদের সবাইকে পৌঁছে দেওয়া হয়ে গেছে। আর ঝাঁম শহরের বাইরে যাদের বাড়ি তাদের সোহরাব আর মাহমুদ নিয়ে গিয়ে পৌঁছে দিয়ে এসেছে।

বনহুর বললো–যাক এবার তাহলে আমি নিশ্চিন্ত।

সর্দার, একটি যুবতী এখনও রয়ে গেছে।

অবাক কণ্ঠে বনহুর বলে কেন?

এ পৃথিবীতে তার কেউ নেই।

 তার মানে?

সর্দার, সে কোথায় যাবে এমন আশ্রয় তার নেই। হুঁ, কিন্তু এখানেই বা তার আশ্রয় কি করে সম্ভব কায়েস?

সর্দার, আমরা অনেক করে বললাম কিন্তু সে কেঁদে-কেটে আকুল হলো, কোথায় যাবে ভেবে পাচ্ছে না।

নতুন এক দুশ্চিন্তায় ফেললে কায়েস।

তাছাড়া মেয়েটি ঝাঁম অধিবাসীও নয়।

কোথায় থাকতো সে?

সে বললো তার বাড়ি নাকি বাংলাদেশে।

বাংলাদেশে?

হ সর্দার।

 কিছুক্ষণ নীরবে চিন্তা করলো বনহুর–তার চোখের সামনে বাংলাদেশে প্রতিচ্ছবি ভেসে। উঠতে লাগলো। বাংলাদেশে সে গিয়েছিলো, বাংলার মাটির আস্বাদও সে গ্রহণ করেছে। বললো। বনহুর–চলো কায়েস, দেখি কে সে মেয়ে যার দেশ বাংলায়।

 কায়েসসহ বনহুর ভিতরে গেলো। যে কক্ষে সেই তরুণী ছিলো ঐ কক্ষে প্রবেশ করলো বনহুর আর কায়েস।

বনহুর নারীদের মুক্ত করে আনলেও প্রত্যেককে ভালভাবে লক্ষ্য করে দেখার মত তার সময় ছিলো না, এ মুহূর্তে কক্ষে প্রবেশ করে তাকালো তরুণীর দিকে। তরুণীর মুখে নজর পড়তেই চমকে উঠলো বনহুর–কোথায় যেন ওকে দেখেছে, অতি পরিচিত মুখ বলে মনে হলো। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে বনহুর তরুণীর দিকে।

তরুণীর মুখোভাব স্বাভাবিক, বনহুরকে তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে দৃষ্টি নত করে নিলো সে।

বনহুর বললো–তোমাকে আমি পূর্বে কোথাও দেখেছিলাম?

তরুণী মাথা তুললো, কিছুদিন পূর্বের সেই জীর্ণ-শীর্ণ দেহখানা এখন যৌবন ঢলঢল হয়ে উঠেছে। ছিন্ন-ভিন্ন পোশাক পরিচ্ছদ আর নেই, এখন ভাল শাড়ি অঙ্গে শোভা পাচ্ছে। তরুণী স্থির নয়নে তাকিয়ে বললো–আমি সুভাষিণী।

বনহুরের কুঞ্চিত হলো, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো–তুমি সুভাষিণী।

হাঁ, আমাকে চিনতে পারোনি এতোদিন?

বনহুর কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মত কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মনে পড়লো সুভাষিণীর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের কথা।—-ডাকাতের কবল থেকে সুভাষিণীকে বনহুর উদ্ধার করেছিলো এবং নিজের ঘোড়ায় তাকে পৌঁছে দিয়েছিলো তার পিতামাতার নিকটে। সে আজ অনেকদিন আগের কথা, বনহুরের মন থেকে কবে মিশে গেছে সে সব স্মৃতিগুলো। আজ নতুন করে মনে উদয় হয় আবার সেই তলিয়ে যাওয়া স্মৃতির প্রতিচ্ছবি।

 সুভাষিণী ভালবেসে ফেলেছিলো বনহুরকে, বনহুরের অপরূপ সৌন্দর্য তাকে পাগল করে তুলেছিলো কিন্তু বনহুরের মনকে আকৃষ্ট করতে পারেনি সুভাষিণী। সেই সুভাষিণী আজ আবার তার সম্মুখে। বনহুর বললো–চিনতে পেরেছি তোমাকে।

আজ চিনলে তুমি? কিন্তু আমি তোমাকে সেদিনই চিনেছিলাম যেদিন তুমি ঝাঁম জঙ্গলে মঙ্গল ডাকুর ভূগর্ভস্থ আস্তানার বন্দীশালায় প্রথম প্রবেশ করেছিলে।

 বনহুর নিস্তব্ধ হয়ে শুনতে থাকে সুভাষিণীর কথাগুলো। বলে চলে সুভাষিণী–তোমাকে দেখেই আমি চিনতে পারলেও আমি কোনোরকম উক্তি উচ্চারণ করিনি বরং নিজেকে গোপন রাখার চেষ্টা করেছি। কারণ আমার অবস্থা তখন বর্ণনাতীত ছিলো।

বনহুর বললো তোমার পিতামাতা এবং স্বামী–এরা কোথায়?

সবাইকে ঐ নরাধম শয়তান মঙ্গল ডাকু হত্যা করেছে।

 বলো কি? অস্ফুট ধ্বনি করে বনহুর।

সুভাষিণীর গণ্ড বেয়ে পড়ে তপ্ত অশ্রুধারা। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে সে, কান্না থামিয়ে বলে– মঙ্গল ডাকু বন্ধু সেজে প্রথমে বাবাকে হত্যা করে তারপর মাকে। বাবা-মাকে হত্যা করে তাদের যথাসর্বস্ব লুটে নিয়ে একদিন গভীর রাতে হানা দেয় আমার শ্বশুর বাড়িতে। শ্বশুরকেও হত্যা করে নির্মম পাষণ্ড—

ব্যস্তকণ্ঠে বলে উঠে বনহুর–তোমার স্বামী?

আমার স্বামীকেও সে আমার সঙ্গে বন্দী করে নিয়ে এসেছিলো কিন্তু ওর আস্তানায় আসার পর তাকে আর কোনোদিন দেখিনি।

বলো কি সুভাষিণী?

হাঁ, তাকে ওরা হত্যা করেছে না জীবিত রেখেছে তাও জানি না।

 বনহুর বললো এবার–বন্দীদের মধ্যে খুঁজে দেখেছিলে তুমি?

অনেক খুঁজেছি, বন্দীদের মধ্যে আমার স্বামীকে পাইনি।

চিন্তিত কণ্ঠে বললো বনহুর–তাহলে সে গেলো কোথায়? শয়তান মঙ্গল ডাকু তাকে কোথায় সরিয়েছিলো?

সুভাষিণী আঁচলে চোখের জল মুছে বলে–ভগবান জানেন।

কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলে বনহুর–এখন তুমি কি করতে চাও?

নত মস্তকে বসেছিলো সুভাষিণী, মাথা তুলে একবার তাকালো বনহুরের দিকে, তারপর দৃষ্টি নত করে নিয়ে বললো–এখন মৃত্যু ছাড়া কোনো পথ নেই আমার।

বনহুর কোনো কথা বলতে পারলো না, সে মন্থর গতিতে বেরিয়ে গেলো কক্ষ থেকে।

কায়েসও ছিলো তার পাশে, সে বনহুরকে অনুসরণ করে বেরিয়ে এলো।

 নিজের কক্ষে এসে বসলো বনহুর।

কায়েস দাঁড়িয়ে রইলো তার পাশে।

বনহুর বললো–কায়েস, সুভাষিণীর কথা শুনেছো?

 হ সর্দার।

এখন কি করা যায়?

সর্দার, মেয়েটি বড় অসহায়–তার বাবা-মা কেউ নেই। স্বামীর সন্ধানও সে জানে না, এমন অবস্থায় তাকে কোথাও তাড়িয়ে দেওয়া যায় না।

কিন্তু এখানে রাখাও সম্ভব নয় জানো?

জানি সর্দার।

 কারণ ঝাঁমের কাজ আমার শেষ হয়েছে। এবার আমি আস্তানায় ফিরে যাবো।

সর্দার।

 বলো?

মেয়েটিকে আমাদের সঙ্গে নিলে হয় না?

আমার আস্তানায় বাইরের নারী–অসম্ভব কায়েস।

 কি করবেন তাহলে?

বনহুর পায়চারি শুরু করলো, কোনো কথা বললো না বা বলতে পারলো না।

 কায়েস ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেলো কক্ষ থেকে।

*

কারাগারে বন্দিনী নূরী।

নরহত্যার দায়ে তাকে আটক করা হয়েছে।

বিচার শেষে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে।

নূরী চিন্তায় মগ্ন। নিজের জন্য সে চিন্তিত নয়–যত ভাবনা তার বনহুরের জন্য আর চিন্তা নূরের জন্য। এতদিনে নূর তাকে গভীরভাবে ভালবেসেছিলো। এক মুহূর্ত নূর তাকে ছাড়া থাকতো না। কোনোরকমে স্কুলের সময়টা সে স্কুলে যেতো তারপর সর্বক্ষণ নূরীর পাশে পাশে থাকতো। প্রথম প্রথম কিন্তু নূর কিছুতেই ফুলের কাছে আসতে চাইতো না, ফুল ওকে কোলে করতে গেলে ছুটে পালিয়ে যেতো। ঘুমের সময় ফুল ওকে বুকে টেনে নিয়ে আদর করতো, চুমু দিতো নরম ছোট গাল দুটিতে।

 কতদিন নূরকে এভাবে আদর করতে দেখে মনিরা অবাক হয়ে গেছে। প্রথম দিকে সন্দেহ জেগেছিলো মনে, ফুল এভাবে তার সন্তানকে আদর করে কেন? কতদিন দেখেছেনূর যখন ঘুমাচ্ছে ফুল তখন শিয়রে বসে নীরবে তাকিয়ে আছে তার মুখের দিকে। কখনো বা ওর ছোট্ট ললাটে হাত ঝুলিয়ে দিচ্ছে, কখনো বা পাকা দিয়ে বাতাস করছে ধীরে ধীরে।

মনিরা অনেকদিন ক্রুদ্ধ হয়েছে এ ব্যাপারে, সন্দেহের ছোঁয়া লেগেছে তার মনে কিন্তু কিছুদিন পর সে ভুল ভেঙে গিয়েছিলো, মনিরা চুপি চুপি লক্ষ্য করেছে–তার সন্তানের কোনো অমঙ্গল ফুল করে কি না। কিন্তু ফুলের মধ্যে সে কোনোরকম সন্দেহজনক কিছু লক্ষ্য করেনি বা করতে পারেনি।

 মনিরা অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করেছিলো ফুলকে, তাই সে ভালও বেসেছিলো ওকে গভীরভাবে কিন্তু একদিনের ঐ ঘটনার পর সব বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো মুহূর্তে। এমন মেয়ের মধ্যেও এতেবড় দোষ আছে! তার স্বামীর চরিত্রকে ফুল কলুষিত করেছে-না না, তাকে সে ক্ষমা করতে পারে না। কিছুতেই মনিরা সহ্য করতে পারেনি সেদিন ফুলকে। বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েও শান্তি পাচ্ছিলো না, অহরহ তুষের আগুনের মত দাহ হচ্ছিলো তার মন। বিশেষ করে সে ভাবতেও পারছে না তার স্বামী চরিত্রহীন।

ফুলকে বাড়ি থেকে বের করে দেবার পর মনিরা অসহনীয় মনোকষ্ট বোধ করছিলো। না জানি মেয়েটি গেলো কোথায়, বিদেশ বিভূই জায়গা–কেই বা ওকে খেতে দেবে, কেই বা দেবে আশ্রয়, পথে পথে ধুকে মরবে। পরক্ষণেই মনের মধ্যে একটা দুর্দমনীয় ক্রুদ্ধভাব জেগে উঠেছে–ওকে বাড়ি থেকে বিতারিত করে ভালই করেছে সে। যে মেয়ে অপর একটি পুরুষের সঙ্গে মিশতে কিছুমাত্র দ্বিধা বোধ করে না তাকে এভাবেই শাস্তি দেওয়া উচিত। ওর মুখ না দেখাই ভাল।

নূরী চলে যাবার পর মনিরা অন্তরে অন্তরে দাহ হচ্ছিলো বটে কিন্তু মুখে সে স্বাভাবিক ছিলো। মরিয়ম বেগম পরদিন মনিরাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন–মনিরা, ওকে এভাবে তাড়িয়ে দেওয়া কি ঠিক হয়েছে?

 মনিরা মামীমার কথায় বুঝতে পারলো, আলীর মা তাকে সব বলে দিয়েছে। মনিরা গম্ভীর কণ্ঠে বলেছিলো–ব্যাভিচারিণী মেয়েকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়ে ভালই করেছি। তাছাড়া কোনো উপায় ছিলো না।

কিন্তু নূরকে যে রাখাই যাচ্ছে না, সব সময় ফুল ফুল করে কাঁদছে। সারাটা দিন গেলো নূর মুখে কিছু দেয়নি।

মনিরা রাগতভাবে বললো–আমি প্রথমেই সন্দেহ করেছিলাম মেয়েটি যাদু জানে।

অবাক হয়ে বলেছিলেন মরিয়ম বেগম–মেয়েটি যাদু জানতো?

হাঁ, না হলে সে আমার নূরের মত ছেলেকে এমনভাবে আপন করে নেয়। শুধু তাই নয়। মামীমা, ফুল আমার সর্বনাশ করেছে।

 বিস্ময়ে দু’চোখ কপালে উঠে মরিয়ম বেগমের, মনিরা বলে কি?

মনিরা তেমন কঠিন কণ্ঠেই বলেছিলো আবার জীবন থাকতে আমি ফুলকে ক্ষমা করবো না।

কিন্তু নূর—

 মরিয়ম বেগমকে কথা শেষ করতে দেয়নি মনিরা, বলেছিলো নূরের জন্য তুমি কিছু ভেবো না, আমি ওকে শুধরে নেবো।

তারপর মরিয়ম বেগম কোনো কথা বলতে পারেননি। চলে গিয়েছিলেন মন্থর গতিতে।

 নূর কিন্তু রেহাই দেয়নি মাকে, ছুটে এসে জড়িয়ে ধরেছিলো মনিরাকে–মাম্মি, ফুল কই? ফুলকে দেখছি না কেন?

মনির ক্রুদ্ধ কণ্ঠে সন্তানকে তিরস্কার করে বলেছিলো–আমি জানিনা।

মায়ের রাগতভাব লক্ষ্য করে আর দ্বিতীয়বার কিছু বলতে সাহস পায়নি নূর, বেরিয়ে গিয়েছিলো দাদীমার কক্ষে। দাদীমাকে ধরে বলেছিলো—-দাদু, ফুল কোথায় গেছে বলো না? দাদু, ফুল কোথায় গেছে বলো?

মরিয়ম বেগম বলেছিলেন–চলে গেছে দাদু।

কোথায় গেছে? কখন আসবে বলো না দাদু?

নূর মাঝে মাঝে দাদীমাকে দাদু বলে ডাকতো। আজও সে ফুলের জন্য ব্যতিব্যস্ত করে তুললো।

 অনেক করেও নূরকে প্রকৃতিস্থ করা সম্ভব হচ্ছিলো না। নূর ফুলকে অত্যন্ত ভালবেসে ফেলেছিলো।

চৌধুরী বাড়ির অনেকেই ফুলের জন্য অন্তরালে অশ্রু ফেলেছিলো সেদিন। মরিয়ম বেগম নিজেও বিশেষভাবে ব্যথিত-মর্মাহত হয়ে পড়েছিলেন ফুলের জন্য, কিন্তু প্রকাশ্যে তিনি কিছু বলতে পারেননি যেহেতু মনিরা ফুলের নাম পর্যন্ত শুনতে চায় না আর।

চৌধুরী বাড়িতে ফুলের জন্য নূর যেমন ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো তেমনি, কান্দাই হাজতে বসে নূরের জন্য নীরবে রোদন করছিলো নূরী। নূরকে সে শুধু ভালই বাসতো না নিজ সন্তানের চেয়ে অধিক স্নেহ করতো। শুধু নূরকে পাশে পাবে বলেই নূরী তার হুরের কাছে কথা দিয়েছিলো, শহরে চৌধুরী বাড়িতে সে থাকবে। নূরকে পাওয়া তার যে চরম সান্ত্বনা ছিলো কিন্তু সব অদৃষ্ট, তাই তাকে পথ বেরিয়ে পড়তে হয়েছিলো। হায়, সে কি ভাবতে পেরেছিলো নিয়তি তাকে এভাবে পরিহাস করবে।

চৌধুরী বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ার পর সে অসহায়ার মত পথে পথে ঘুরেছে, ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কণ্ঠ তার শুকিয়ে কাঠ হয়েছে, তবু এতোটুকু সহানুভূতি পায়নি সে কারো কাছে। কি অসহ্য ক্ষুধার জ্বালায় সে প্রবেশ করেছিলো হোটেলে যার পরিণাম তাকে টেনে এনেছে এতোদূর।

মেঝেতে বসে নীরবে অশ্রু বিসর্জন করছিলো নূরী। শেষ পর্যন্ত তার ললাটে নরহত্যার দায়ে মৃত্যুই ছিলো প্রাপ্য।

কান্দাই পুলিশ ইন্সপেক্টর রওশান রিজভী নূরীর কেস সম্বন্ধে তদারক করছিলেন। নূরীকে যেদিন মিঃ রিজভী প্রথম দেখলেন সেদিন ওর প্রতি একটা অনুরাগ এসে গিয়েছিলো তার মধ্যে। নূরীর চেহারা এবং চাল-চলনে মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি।– রওশান রিজভী স্বয়ং নূরীর জবানবন্দী গ্রহণ করার সময় জানতে পেরেছিলেন নূরী নিজেকে রক্ষা করার জন্যই নরহত্যা করতে বাধ্য হয়েছিলো।

 রওশান রিজভী তাই কেসটা যাতে হাল্কা হয়ে আসে এবং তরুণীটা মুক্তি লাভ করে, এ নিয়ে চেষ্টা করছিলেন।

তরুণ অফিসার রিজভী যেমন ভদ্র তেমনি ছিলেন অমায়িক। তার সদাশয় ব্যবহারে প্রত্যেকে সন্তুষ্ট ছিলো। নূরীর কেসের ব্যাপারে তিনি বুদ্ধিমানের ন্যায় কাজ করতে লাগলেন। অসহায় অনাথা মেয়েটি বিনা অপরাধে মৃত্যুদণ্ড গ্রহণ করবে–এ কখনও হতে পারে না।

কেস চলতে লাগলো।

রওশান রিজভী নূরীর পক্ষ অবলম্বন করে উকিল দিলেন এবং টাকা-পয়সা খরচ করতে লাগলেন।

 নূরী যখন জেলে বন্দিনী তখন বনহুর ঝাঁম শহরে কোথায় কোন অসহায় পথে পথে ধুকে ধুকে মরছে–তারই অন্বেষণ করে ফিরছে। যার কেউ নেই তাকে পথ থেকে তুলে নিয়ে পৌঁছে দিচ্ছে অতিথিশালায়। যে অসুস্থ তাকে নিজের গাড়িতে উঠিয়ে ভর্তি করে দিচ্ছে সে হসপিটালে।

একদিন বনহুর কোচওয়ানের বেশে একটি রোগীকে হসপিটালে পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসছিলো সে মুহূর্তে একটা কণ্ঠস্বর শুনতে পেলো সে–এই কোচওয়ান, শোনো।

কোচবাক্সে বসে ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরলো বনহুর, গাড়ি থেমে পড়লো। দেখতে পেলো একটা বিকৃত আকার লোক এগিয়ে আসছে, তার এক চোখ অন্ধ এবং এক হস্তবিহীন। কিছুটা নিকটবর্তী হতেই চমকে উঠলো বনহুর–এযে সেই দুর্ধর্ষ শয়তান মঙ্গল ডাকু! তবে কি সে বোমা বিস্ফোরণে নিহত হয়নি।

 বনহুর গাড়ি রাখলো, মাথার পাগড়ির আঁচলখানা দিয়ে মুখের খানিকটা ঢেকে ফেললো ভাল করে, যাতে চিনতে না পারে মঙ্গল ডাকু।

 ঘোড়াগাড়ির সম্মুখে এসে দাঁড়ালো মঙ্গল ডাকু, আজই সে হসপিটাল থেকে ছাড়া পেয়েছে। বনহুর অবাক হয়ে দেখলো মঙ্গল ডাকুর নির্মম পরিণতি। শয়তানের উপযুক্ত সাজা হয়েছে। বোমের আঘাতে তার একটি হাত এবং একটি চোখ সম্পূর্ণ উড়ে গেছে। মুখের নিচের কিছুটা অংশও খসে গেছে। মুখটা কেমন’বাকা আর বিকৃত হয়ে উঠেছে সহসা কেউ তাকে দেখলে ভূত বলে ধারণা করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

মঙ্গল ডাকু এক লাফ দিয়ে ঘোড়াগাড়িতে উঠে বসলো। তারপর বললো–চলো।

বনহুর বললো কোচবাক্স থেকে–স্যার কোথায় যাবেন?

 চলো, পরে বলবোগাড়ির মধ্য থেকে বললো মঙ্গল ডাকু।

বনহুর হাসলো, লোকটার কি বোমার আঘাত খেয়ে মাথাও বিগড়ে গেছে। ঘোড়ার পিঠে চাবুক মারলো বনহুর। ঘোড়া ছুটতে শুরু করলো।

গাড়ি চলছে।

ঝাঁম শহরের রাজপথ বেয়ে গাড়ি ছুটছে, কোথায় যাচ্ছে কোনো ঠিক নেই। বেশ কিছুক্ষণ এ পথ সে-পথ গাড়ি ছুটার পর বনহুর উচ্চকণ্ঠে বললো–কোথায় যাবেন স্যার বললেন না? আমি কোথায় নিয়ে যাবো?

গাড়ির ভিতর থেকে উত্তর এলো–এখন কোন রাস্তায় গাড়ি চালাচ্ছো?

 কোচবাক্স থেকে জবাব দিলো বনহুর-ঝম পুলিশ অফিসের রাস্তা।

গাড়ির মধ্য হতে এবার ভেসে এলো চাপা কণ্ঠস্বর–এ পথে এনেছো কেন?

তবে কোথায় যাবেন স্যার, বলুন?

আপাতত তোমার বাড়িতে চলো।

চমকে উঠলো বনহুর কোচবাক্সে বসে, বললো–স্যার, আমি গরিব মানুষ–আমার আবার বাড়ি, সে তো কুড়েঘর।

সেখানেই নিয়ে চলো।

অবাক হয়েছে বনহুর–বলে কি মঙ্গল ডাকু। এখন কোথায় নিয়ে যাওয়া যায় ওকে? বনহুর বুঝতে পেরেছে, মঙ্গল ডাকু এখন গৃহহারা, আস্তানাহারা, অনুচরহারা, সর্বস্বহারা–এমন কি হস্তহারা চক্ষুহারা সে। চালাক মঙ্গল ডাকু তাই কোচওয়ানের বাড়িতে আশ্রয় নিতে চায়—

কোচওয়ানকে নীরব দেখে গাড়ির ভিতর থেকে বললো মঙ্গল ডাকু–কি হে, কিছু বলছে না যে?

বনহুর বললো-স্যার, আমার নিজের কোনো বাড়ি নেই।

তবে থাকিস কোথায় বেটা?

 স্যার, পরের বাড়িতে থাকি।

শোন্ তবে।

বলুন স্যার?

আমাকে তোর কুটুম্ব বলে পরিচয় দিবি, নিয়ে চল।

 কুটুম্ব।

 হা।

স্যার—

কোনো আপত্তি করবি না বলে দিলাম। কথাগুলো যেন ক্রীতদাসের প্রতি প্রভুর আদেশের মত কঠিন শোনালো।

বনহুর যেন বিপদে পড়লো, কি করা যায় ভাবতে লাগলো সে। সহজে ওকে এড়ানো সম্ভব হবে না, গাড়িতে যখন চেপে বসেছে তখন শেষ অবধি গাড়িতেই আস্তানা গাড়বে। বনহুর ওকে সহজে ছাড়বার বান্দাও নয়, দেখা যখন ঘটেছে তখন সুভাষিণীর স্বামীর সন্ধান না নিয়ে রেহাই দিচ্ছে না মঙ্গল ডাকুকে। বাছাধন একেবারে এসে পা দিয়েছে সিংহের গহ্বরে।

 হুঙ্কার শোনা গেলো ভিতর থেকে–কিরে ব্যাটা, কোনো কুমতলব আটছিস নাকি?

 ছিঃ ছিঃ এই যে নাকে-কানে খৎ দিচ্ছি, আমরা গরিব বেচারী, দুটো পয়সার জন্য খেটে মরছি রাতদিন। কুমতলব আটবো কোন্ দুঃখে।

তবে নিয়ে চল্ যেখানে থাকিস্ তুই।

 তাই চলুন স্যার।

বনহুর মঙ্গল ডাকুকে নিয়ে চললো বাসা অভিমুখে। এ পথ সে পথ ঘুরে গাড়িখানা ছুটে চলেছে, কোচবাক্সে বসে দস্যু বনহুর আর গাড়ির মধ্যে বসে মঙ্গল ডাকু।

গাড়ি বাসায় এসে পৌঁছলো।

কোচবাক্সের উপর থেকে বনহুর নেমে পড়লো-স্যার, এ বাড়িতে আমি থাকি।

ততক্ষণে মঙ্গল ডাকু একলাফে গাড়ির ভিতর থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে। বাড়িখানার দিকে তীক্ষ্ণ .. দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখছে সে। বাড়ি দেখে অবাক হয়েছে মঙ্গল ডাকু, ভাবছে একটা কোচওয়ানের বাড়ি এমন হতে পারে।

বনহুর বুঝতে পারলো, মঙ্গল ডাকুর মনে বাড়িটা সন্দেহ জাগিয়েছে, তাই সে বললো–স্যার, এ বাড়ির মালিক আমার প্রভু হয়।

 প্রভু!

হাঁ স্যার, প্রভু–মানে আমি তার মাইনে করা গোলাম।

ওঃ বুঝেছি, এ বাড়ির মালিকের কাছে চাকুরী করো?

হ।

দেখো, তোমার মালিককে বলবে আমি তোমার আত্মীয়।

ঠিক তাই বলবো। আসুন স্যার আমার সঙ্গে।

বনহুর অগ্রসর হলো।

গেটের ভিতরে প্রবেশ করতেই সোহরাব আর মাহমুদ শসব্যস্তে এগিয়ে এলো, বনহুরকে লক্ষ্য করে মাহমুদ কিছু বলতে গেলো–সর্দার—

 সঙ্গে সঙ্গে বনহুর চোখের ইঙ্গিতে তাদের ক্ষান্ত হবার জন্য নির্দেশ দিয়ে বললো–সর্দার আমাকে খুঁজছিলো বুঝি?

মাহমুদ আর সোহরাব হঠাৎ কিছু বুঝতে না পেরে উভয়ে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে নিলো। বনহুর পুনরায় বললো–কানে কম শুনছো নাকি?

এবার সোহরাব বলে উঠে–সর্দার এতোক্ষণ–

আরে বলছিতো এক্ষুণি আমি সর্দারের সঙ্গে দেখা করে সব বলবো, তারপর মঙ্গল ডাকুর দিকে তাকিয়ে হাতের মধ্যে হাত রগড়ে বললো–স্যার, আপনি সামনের ঘরে গিয়ে বসুন, আমার ফিরতে বিলম্ব হয়েছে বলে সর্দার রাগ করছেন, যাই তাকে সব কথা বুঝিয়ে বলিগে।

মঙ্গল ডাকু মাথা দুলিয়ে বলে–আচ্ছা বসছি, কিন্তু ফিরতে দেরী করো না, আমি ভয়ানক ক্ষুধতি।

বনহুর সোহরাব আর মাহমুদসহ অন্দর বাড়িতে প্রবেশ করলো। সোহরাব বললো–সর্দার, কিছু বুঝতে পারছি না?

তা পারবে কেন। জানো আমার সঙ্গী কে? তোমরা চিনতেও পারোনি?

না সর্দার।

 মঙ্গল ডাকু।

সর্দার? আপনি বলেছিলেন সে নাকি বোমার আঘাতে পাতালপুরী আস্তানায় মারা পড়েছে।

 আমার ধারণা ছিলো সে আর জীবিত নেই, কিন্তু তাকে আজ পথে দেখে গাড়িতে তুলে নিলাম।

সর্দার।

 হাঁ, কারণ তাকে আমার প্রয়োজন। এসো তোমরা, কথা আছে তোমাদের সঙ্গে।

বনহুর সোহরাব ও মাহমুদকে সঙ্গে করে এগুচ্ছিলো, কায়েস ব্যস্তভাবে এসে পড়লো তাদের পার্শ্বে–সর্দার।

 বনহুর কায়েস এবং তাদের তিনজনকে সঙ্গে করে এগুলো সুভাষিণীর কক্ষের দিকে, বললো–তোমার এসো।

 সুভাষিণী বনহুর এবং তার অনুচর তিন জনকে তার কক্ষে প্রবেশ করতে দেখে একটু অবাক হলো, নিশ্চয়ই কোনো কারণ ঘটেছে।

 বনহুর একটা আসনে বসে পড়ে বললো–সুভাষিণী এসো, মন দিয়ে শোনো আমার কথাগুলো।

সুভাষিণী সরে এলো বনহুরের পাশে।

কায়েস, সোহরাব আর মাহমুদও বনহুরের সম্মুখে এসে দাঁড়ালো, বনহুর বললো–মঙ্গল ডাকুর মৃত্যু হয়নি, সে জীবিত—

অস্ফুট কণ্ঠে বললো কায়েস–মঙ্গল ডাকু এখনও জীবিত।

শুধু জীবিতই নয়, সে এখন আমার বাড়িতে অতিথি।

শোনো তোমরা—বনহুর সংক্ষেপে সব কথা বললো, আরও বললো–কায়েস তোমাকে এ বাড়ির মালিক সাজতে হবে এবং সোহরাব ও মাহমুদ হবে তোমার চাকর, আমিও—

সর্দার—কিছু বলতে চেষ্টা করলো কায়েস।

 বনহুর তাকে ক্ষান্ত হবার জন্য আদেশ করলো এবং বললো–তোমরা আমার কথা অনুযায়ী কাজ করবে। মঙ্গল ডাকুর নিকটে আমি জেনে নিতে চাই সুভাষিণীর স্বামীর সন্ধান। কিন্তু সহসা তার নিকট হতে একথা জানা সম্ভব নয়। কাজেই আমাদের ধৈর্যের প্রয়োজন। কৌশলে একথা জানতে হবে। কায়েস, তুমি শীঘ্র ঝাঁম সর্দারের ড্রেস পরে নাও। সোহরাব তুমি আর মাহমুদ মঙ্গল। ডাকুর খাবারের আয়োজন করো। যাও কায়েস—

কায়েস পাশের কক্ষে চলে গেলো এবং অল্প সময়ে ঝাঁম সর্দারের বেশে বেরিয়ে এলো বাইরে।

বনহুরের বাড়িতে ছদ্মবেশ ধারণের প্রতিটি জিনিস বিদ্যামান ছিলো। কোনো অসুবিধা ছিলো না এসব আয়োজনের।

 কায়েস ঝাঁম সর্দারের বেশে বেরিয়ে এলো, বনহুর তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করে দেখলো। মাথায় রঙীন পাগড়ি, ললাটে চন্দনের আলপনা, গলায় মতির মালা, হাতে মোটা বালা, কাপড়টা মাড়োয়ারীদের মত কুচি দিয়ে প্রা। কানে দুটো মূল্যবান রুবী। রুবী দুটো দিয়ে উজ্জ্বল আলোকচ্ছটা ঠিকরে বের হচ্ছে যেন।

বনহুর স্বয়ং মাথার পাগড়িটা ভালভাবে ঠিক করে দিলো তারপর বললো–এখন তুমি আমার মালিক আর আমি হলাম তোমার চাকর, বুঝলে?

বুঝেছি সর্দার।

খবরদার, সর্দার বলে আমাকে ডাকতে যেও না যেন। মঙ্গল ডাকু কিছুতেই যেন টের না পায় আমি দস্যু বনহুর আর তোমরা আমার লোক।

ঠিক মনে থাকবে।

বেশ চলো। বনহুর অগ্রসর হলো।

মঙ্গল ডাকুর কক্ষের দরজায় এসে নত মস্তকে বললো বনহুর–স্যার, আমাদের সর্দার আসছেন।

মঙ্গল ডাকু একটু নড়ে বসলো, কিন্তু তার চোখটা চক চক করে উঠলো, বললো-বেটা এত দেরী হলো কেন?

সর্দার ব্যস্ত ছিলেন, তাই একটু দেরী হয়ে গেলো স্যার।

ততক্ষণে ঝাঁম সর্দারের বেশে কায়েস প্রবেশ করলো কক্ষমধ্যে।

বনহুর নত মস্তকে একপাশে সরে দাঁড়ালো।

মঙ্গল ডাকু উঠে করমর্দন করলো ঝাঁম সর্দারের।

ঝাঁম সর্দার বললো–বসুন। শুভ তো?

মঙ্গল ডাকু আসন গ্রহণ করবার পূর্বেই আসন গ্রহণ করলো ঝাঁম সর্দার।

মঙ্গল ডাকু এবার আসন গ্রহণ করলো।

বনহুর একপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার দেহে সম্পূর্ণ কোচওয়ানের ড্রেস। মুখ তুলে বললো– সর্দার, ইনি আমার কাকা হন।

কায়েস মাথা দুলিয়ে আনন্দ প্রকাশ করলো, তারপর বললো–যাও, তোমার কাকার জন্য ভাল খাবার আর পানীয় নিয়ে এসো।

আচ্ছা সর্দার। কথাটা নত মস্তকে বলে বেরিয়ে গেলো বনহুর।

একটু পরে সোহরাব আর মাহমুদের হাতে নানাবিধ খাদ্যসম্ভার নিয়ে বনহুর প্রবেশ করলো, তার হাতেও ফলমূলের ঝুড়ি।

বনহুর মঙ্গল ডাকুর সম্মুখে খাদ্যদ্রব্যগুলো সাজিয়ে রাখলো।

কায়েস বললো–বন্ধু আরম্ভ করুন।

মঙ্গল ডাকু গোগ্রাসে খেতে শুরু করলো।

অবাক হয়ে তার খাওয়া দেখতে লাগলো কায়েস, সোহরাব আর মাহমুদ। বনহুর অনুগত দাসের মত জড়োসড়ো হয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে রইলো।

কায়েস নিজে পরিবেশন করতে লাগলো–আপনি লজ্জা করবেন না যেন, আমার বাড়িতে কোনোদিন অতিথির অনাদর হয় না।

বনহুর হাতের মধ্যে হাত কচলাতে কচলাতে বললো হ আমাদের সর্দারের এখানে শত্ৰুমিত্র সবাই সমান। সবাই সমান যত্ন লাভ করে থাকেন। কাকা, আপনি যতদিন খুশি আমাদের। সর্দারের বাড়ি থাকতে পারেন, কোনো অসুবিধা হবে না।

মঙ্গল ডাকুর মুখে হাসি ফুটলো।

কায়েস বললো-হাঁ, আপনি যতদিন থাকতে চান থাকতে পারেন, এতে আমার কোনো আপত্তি হবে না।

বললো বনহুর–অতিথি-যত্ন আমার মালিকের নেশা।

মঙ্গল ডাকুর খাওয়া হয়ে গিয়েছিলো, মূল্যবান খাদ্যদ্রব্য আর ফলমূল উদরপূর্ণ করে তার দেহ পূর্বের ন্যায় সবল, সতেজ হয়ে উঠলো, বললো সে–আমাকে কয়েকদিন থাকতে হবে বলেই তো আমি এসেছি। বনহুরকে দেখিয়ে বললো–আমার ভাতিজার সঙ্গে অনেক দিন পর দেখা কিনা?

বনহুর মঙ্গল ডাকুর কথায় উৎসাহ নিয়ে বললো–আমার কাকা ঠিক বলছেন; বহুদিন পর কাকাকে পেয়ে আমি অনেক খুশি হয়েছি।

হা, তোমার কাকা আমারও বন্ধু হলো আজ থেকে–রহমত?

বলুন সর্দার?

একে থাকার জন্য পাশের কামরাটা খুলে দাও।

আচ্ছা সর্দার।

মঙ্গল ডাকুকে লক্ষ্য করে বললো বনহুর–আসুন কাকা, আপনার বিশ্রামের দরকার।

 উঠে পড়লো মঙ্গল ডাকু–চলো।

পাশের কক্ষের দিকে এগুলো বনহুর, তাকে অনুসরণ করলো মঙ্গল ডাকু।

মঙ্গল ডাকু জানে না, কার কবলে সে পড়েছে–যে কোনো মুহূর্তে ওকে কুকুরের মত হত্যা করতে পারে বনহুর, কিন্তু এতো সহজে সে কাউকে হত্যা করে না। সিংহ যেমন মেষশাবক নিয়ে খেলা করে তেমনি দস্যু বনহুর খেলা শুরু করেছে মঙ্গল ডাকুকে নিয়ে।

*

হঠাৎ নুরীর নিরুদ্দেশে ফুলমিয়াও বেশ ঘাবড়ে গেছে। নূরীর জন্যই ফুলমিয়া রয়ে গিয়েছিলো এখানে, মরিয়ম বেগম আর সরকার সাহেবের অপরিসীম স্নেহ পেয়ে নিজকে ধন্য মনে করেছিলো। ভেবেছিলো, যাক তার লাঠিয়াল জীবনে এসেছে এক বিরাট পরিবর্তন। ভালই হয়েছে। তার, আর তাকে পেটের দায়ে কুকর্ম করতে হবে না।

কিন্তু নূরী যেদিন থেকে চৌধুরী বাড়ি ত্যাগ করে চলে গেলো, সে দিন থেকে ফুলমিয়াও যেন কেমন একা একা হয়ে পড়লো, সবসময় বিষণ্ণ মনে বসে বসে ভাবতো। একবার কোনোক্রমে বাবু। এসে পড়লে হয়–সে আর থাকবে না এখানে, চলে যাবে তার কাছে। কিন্তু ফুলমিয়ার চলে যাওয়া আর হলো না, ফুলকে হারিয়ে নূর ফুলমিয়াকে পেয়ে বসলো। সব সময় ফুলমিয়ার কাছে ছাড়া তার চলতো না, স্কুলে যাবে ফুলমিয়ার সঙ্গে; মাঠে খেলা করবে– সেখানেও ফুলমিয়াকে যেতে হবে। বাগানে বসবে–সেখানেও ফুলমিয়াকে চাই। এক সময় সরকার সাহেব ছিলেন নূরীর সঙ্গী-সাথী সব কিছু, আজকাল সরকার সাহেব বড় একটা নড়াচড়া করতে পারতেন না। আগের মত তেমন মনের উৎসাহও নেই আর তার মধ্যে। কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়েছেন আজকাল। বয়স তো তার কম হয়নি, প্রায় পয়ষট্টির কাছাকাছি। শিথিলতা এসে। গেছে তার জীবনে এখন নূরের সঙ্গে তেমন করে আর ছুটতে পারেন না তিনি, হাসতেও পারেন নানআর আগের মত প্রাণ খুলে। নূর তাই সরকার সাহেবের নিকট হতে সরে পড়েছিলো ধীরে ধীরে, পেয়েছিলো ফুলকে। অবশ্য ফুল থাকাকালেও ফুলমিয়ার সঙ্গে নূরকে আকৃষ্ট করেছিলো। ফুল মিয়া নূরকে কাঁধে করে, কখনও বা দোলনায় দোলা দিয়ে নানাভাবে খেলায় উৎসাহ জোগাতো। স্কুলে যাবার সময় নূরের বই-পুস্তকের ব্যাগটা হাতে করে বয়ে নিয়ে যেতো ফুলমিয়া, আবার ফিরিয়ে আনতে স্কুল ছুটির পর।

আজকাল ফুলমিয়ার সঙ্গে নূরের এক গভীর বন্ধুত্ব ভাব জমে উঠেছিলো।

তাই ফুলমিয়া আর চলে যেতে পারে না চৌধুরী বাড়ি থেকে। সে চৌধুরী বাড়িরই একজন হয়ে যায়।

মনিরার নির্দেশে ফুলমিয়াকে ড্রাইভ শেখানো শুরু হলো।

অল্প দিনের মধ্যেই ফুলমিয়া দক্ষ ড্রাইভার বলে সুনাম অর্জন করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মনোযোগসহকারে ড্রাইভ শিখতে লাগলো সে।

আজকাল চৌধুরী বাড়ির একজন ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি হয়ে উঠেছে ফুলমিয়া। চৌধুরী বাড়ির ভালমন্দ সব ফুলমিয়া অন্তর দিয়ে গ্রহণ করে।

নূরের মুখের দিকে তাকিয়ে মনিরা রাগ-অভিমান মুছে ফেলতে চেষ্টা করেছিলো কিন্তু পারেনি, সব সময় মনে হচ্ছিলো তার স্বামী কি করে এমন অসৎ চরিত্র হতে পারে। ক্ষমা সে করতে পারে না কোনোদিন বনহুরকে।

 প্রতিদিন মনিরা স্বামীর প্রতীক্ষায় প্রহর গুণে চলেছে, একবার এলে তাকে দেখে নেবে মনিরা এতো অধঃপতনে সে গেলো কি করে। কার দোষ-বনহুরের না ফুলের? মনিরা নিজ মনকে কতবার প্রশ্ন করেও কোনো সমাধান খুঁজে পায়নি।

 মনিরা যখন স্বামীর প্রতি ক্রুদ্ধ ভাব নিয়ে অহরহ দগ্ধীভূত হয়ে চলেছে তখন তার স্বামী এক অসহায়া নারীর স্বামীর সন্ধানে ব্যাপৃত। কৌশলে সে মঙ্গল ডাকুকে হাতের মুঠার মধ্যে এনেছে, এবার তার কাছে সুভাষিণীর সন্ধান চায় বনহুর। কোনোরকমে একবার জানতে পারলে তার বাসনা সিদ্ধ হবে।

 মঙ্গল ডাকু সমাদরের অভাব নেই।

সব সময় রহমত তাকে আদর-যত্নকরে চলেছে। পাশে পাশে থাকে সর্বক্ষণ–কখন কি প্রয়োজন হয় তাই।

ঝাঁম সর্দার কায়েস মাঝে মাঝে এসে বসে মঙ্গল ডাকুর কাছে, নানারকম গল্প করে।

 একদিন মঙ্গল ডাকু রহমতবেশী বনহুরকে বললো–এই রহমত, একটা কথা তোকে জিজ্ঞাসা করবো, সঠিক জবাব দিবি?

মাথা নিচু করে হাতের মধ্যে হাত কচলায় রহমত-বলুন কাকা?

হাঁ, তুই আমাকে কাকা বলেই ডাকবি।

আপনি আমাকে যেভাবে ভালবাসতে শুরু করেছেন তাতে নিজ কাকার চেয়েও আপনাকে বেশি মনে হয়। বাবা বলে ডাকতে ইচ্ছে করে আপনাকে।

বেটার স্পর্ধা দেখো, কাকা বলেই রক্ষা পেয়েছিস। বাবা বলে আমাকে একে বারে কিনে নিতে চাস, তাই না?

না কাকা, আমার সাধ্য কি আপনাকে কিনে নেবো। তবে সব আপনার দয়া।

 শোন্ বেটা?

বলুন স্যার?

আবার স্যার বলছিস—

 মাফ করবেন, ভুল হয়েছে। বলুন কাকা?

আমাকে তোদের সর্দার রোজ যে ভারী আদর-যত্ন করে খাওয়াচ্ছে দামী দামী সব খাবার এতোসব পায় কোথা থেকে।

কাকা, এসব তো সামান্য। আমাদের সর্দার যা পায় যদি দেখতেন তবে আপনার চোখে ধ ধা লেগে যেতো।

বলিস কি রহমত? কথাটা শুনেই মঙ্গল ডাকুর চোখ জ্বলে উঠে যেন।

বলে রহমত–আপনি আবার সর্দারকে বলে দেবেন না তো?

না না, বলবো কি-তুইতো আমার চাকর বেটা।

 শুধু চাকর নই কাকা, আপনার গোলাম।

বেটা মূর্খ, জানিস না চাকর আর গোলাম এক কথা?

কাকা, অতোসব বুঝি না কিনা।

বল্ এতো সব পায় কোথায় তোদের সর্দার?

রহমতবেশী বনহুর এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে নয়। তারপর চাপা গলায় বলে আমাদের সর্দার ডাকু।

কি বললি? তোদের সর্দার ডাকু?

কাকা আস্তে কথা বলেন। হাঁ, আমাদের সর্দার শহরের সেরা ডাকু, তাই তার টাকা-পয়সার অভাব হয় না কোনদিন।

 তাই না কি?

হাঁ কাকা। একটু থেমে পুনরায় বললো রহমত-কাকা, আপনার চেহারা দেখে আমার মনে হয় আপনি আমাদের সর্দার হলেও খুব ভাল হয়।

 মুহূর্তে মঙ্গল ডাকুর বিকৃত বীভৎস মুখে খুশির আভাস ফুটে উঠলো–আরও ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। ওকে। বললো মঙ্গল ডাকু-রহমত, তোর কথাটা আমার অত্যন্ত মনে ধরেছে।

 কাকা, আপনার মত ভাল মানুষ আমাদের হলে আমরা অনেক আরাম পেতাম। জানেন কাকা, আমাকে এই সর্দার কেন রেখেছে?

 তা কেন রেখেছে তোকে? ডাকাতি করার জন্য বুঝি?

না কাকা, আমায় নিয়ে আর একটা ব্যবসা চালায়।

 তাই না কি?

 হা কাকা, আমাদের সর্দারের বড় বদ-অভ্যাস আছে।

বদ অভ্যাস?

হাঁ। মেয়েছেলের লোভ—কথার ফাঁকে বনহুর তীক্ষ্ণ নজর ফেলে মঙ্গল ডাকুর মুখে।

কপালে একটা চোখ, চোখটা জ্বলে উঠে যেন দপ করে। বিকৃত মুখে লালসার হাসি ফুটে উঠে, বলে সে আগ্রহ ভরে–তুই বুঝি মেয়ে আমদানি করিস?

 কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে রহমত–করি কিন্তু একটাকেও সর্দার আমার হাতে ছেড়ে দেয় না। দেখুন কাকা, খবরদার এসব কথা যেন সর্দার জানতে না পারে, তাহলে আমার মাথাটা যাবে।

 বলবো না, তবে একটা কাজ করতে হবে তোকে–যদি আমার কাজ না করবি তবে সবকথা। আমি বলে দেবো তোদের সর্দারকে।

বলুন কাকা, কি কাজ করতে হবে?

আমি তোদের সর্দার হবো, বুঝলি?

তা তো অনেক আগেই বুঝেছি কাকা।

এখন থেকে যেসব মেয়ে তুই ধরে আনবি প্রথমে আমার কাছে নিয়ে আসবি তারপর পৌঁছে দিবি তোদের সর্দারের কাছে।

তাহলে আমার কি লাভ হচ্ছে?

 তোকে ফাঁকি দেবো না রে, তোকে ফাঁকি দেবো না।

 কাকা, দস্যু বনহুরের নাম শুনেছেন?

 দস্যু বনহুর? মুখমণ্ডল কঠিন হয়ে উঠলো মঙ্গল ডাকুর, দাঁতে দাঁত পিষে বললো–দস্যু বনহুর আমার সর্বনাশ করেছে।

বলেন কি কাকা, দস্যু বনহুরকে আপনি দেখেছেন?

 হাঁ, শুধু দেখিনি, তার সংগে লড়াই করেছি।

 অবাক হয়ে বলে রহমত দস্যু বনহুরের সঙ্গে আপনি লড়াই করেছেন?

 কেন, বিশ্বাস হচ্ছে না তোর?

কাকা, শুনেছি দস্যু বনহুরকে নাকি কেউ কোনোদিন দেখেনি।

 আমি তাকে নিজের চোখে দেখেছি।

কেমন দেখতে সে? খুব বুঝি ভয়ঙ্কর–আপনার চেয়েও কুৎসিত?

রেগে গেলো মঙ্গল ডাকু-আমি বুঝি কুৎসিত?

না কাকা, মানে আপনার মত সুন্দর না কি দস্যু বনহুর?

গর্ব ভরে বললো মঙ্গল ডাকু এবার–আমার চেয়েও সে খারাপ। একটা ঝড়ের মত, নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বললো–আমাকে সে সর্বহারা করেছে। জানিস্ রহমত, আজ আমার এ অবস্থা কেন?

 এতোক্ষণে বনহুরের মনে একটা খুশির উৎস বয়ে যায়, পাশের গেলাসটা শরাবপূর্ণ করে বলে–কাকা,গলাটা আপনার শুকনো লাগছে, একটু ভিজিয়ে নিন। বাড়িয়ে ধরলো গেলাসটা রহমত মঙ্গল ডাকুর মুখের কাছে।

মঙ্গল ডাকু তার এক হস্ত দ্বারা গেলাসটা নিয়ে শরাবটুকু ঢক ঢক করে গিলে ফেললো।

রহমত তাড়াতাড়ি গেলাসটা মঙ্গল ডাকুর হাত থেকে নিয়ে টেবিলে রাখলো, তারপর বললোবলুন কাকা, আজ আপনার এ অবস্থা কেন?

ঐ শয়তান বদমাইশ দস্যু বনহুরের জন্যই আমার এ অবস্থা হয়েছে–আমিও সর্দার, বুঝলি?

আপনি সর্দার?

হাঁ, আমি মঙ্গল ডাকু।

আপনি–আপনি মঙ্গল ডাকু? বনহুর এমন মুখোব করলো যেন সে অবাক হয়েছে চরম আকারে।

 মঙ্গল ডাকুর মনে তখন জোশ এসে গেছে, বললো সে–হাঁ, আমিই ঝাঁম জঙ্গলের অধিপতি সর্দার মঙ্গল ডাকু। ঐ শয়তান আমার সর্বনাশ করেছে। আমার বন্দীদের নিয়ে পালিয়েছে, আমার আস্তানা বোমা দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে। আমার এ চরম অবস্থা করেছে–

দস্যু বনহুর আপনার এ অবস্থা করেছে। কি দুর্দান্ত ডাকু কি ভয়ঙ্কর ডাকু তবে দস্যু বনহুর–আমি ভাবতে পারছি না।

 ঠিক বলেছিস রহমত, দস্যু বনহুরকে পেলে আমি তার হাড়ি ছিঁড়ে মাংস কামড়ে খাবো।

কাকা, আপনার বন্দীদের মধ্যে সব বুঝি পুরুষ মানুষ?

না, অনেক মেয়ে ছিলো–অনেক সুন্দরী মেয়ে। সব মেয়েকে ঐ শয়তান হরণ করে নিয়ে গেছে।

বললো রহমত–চোরের উপর বাটপারি করেছে বেটা।

কি বললি?

না কিছু না, বলছিলাম কি, অতো মেয়ে আপনি কোথায় পেয়েছিলেন কাকা?

আমার অনেক অনুচর ছিলো, তাদের শক্তিবলেই ওদের লাভ করেছিলাম।

 সবগুলো মেয়েই বুঝি ঝাঁম শহরের?

 ঝাঁম শহরের ছিলো বেশি, আর বিভিন্ন দেশেরও ছিলো।

 বাঙালি মেয়ে ছিলো কি? কাকা, বাঙালি মেয়েদের যদি একবার দেখতেন?

হেসে বললো মঙ্গল ডাকুবাঙালি মেয়ে ছিলো দু’জন–তাদের একজন মরে গিয়েছিলো আর একজন ছিলো জীবিত।

বলেন কি কাকা, বাঙালি মেয়েও ছিলো তবে?

 হাঁ, একজন জীবিত ছিলো।

 তাকেও বুঝি নিয়ে গেছে দস্যু বনহুর?

 তাকেও সে নিয়ে গেছে।

কিছুক্ষণ রহমত চিন্তা করলো মাথা নিচু করে, তারপর বললো–বাঙালি মেয়ে দুটিকে কোথা হতে এনেছিলেন কাকা?

সে কথা আর শুনে কি হবে বল?

বলুন না কাকা, আমার বড় শুনতে ইচ্ছা হচ্ছে।

মঙ্গল ডাকু বললো–দে, শরাব দে তবে আর এক গেলাস।

 তাড়াতাড়ি আর এক গেলাস শরাব ঢেলে দ্রুত বাড়িয়ে ধরলো মঙ্গল ডাকুর মুখের কাছে নিন।

মঙ্গল ডাকু শরাবের গেলাস উজাড় করে রহমতের হাতে দিলো–নও রাখো।

রহমত গেলাসটা নিয়ে রাখলো, মঙ্গল ডাকু বলতে শুরু করলো–বেশ কিছুদিন আগে আমি বাংলাদেশে গিয়েছিলাম বিদেশী সওদাগরের বেশে। কয়েকজন অনুচরও ছিলো আমার সঙ্গেই, অল্পদিনেই বহু টাকা-পয়সা আর ধন-রত্ন আমার হাতে আসে। অনেক মেয়েও আমি পেয়েছি বাংলাদেশে, ভোগ করেছি খুশি মত। ঐ সময় বাসবপুর বলে একটা জায়গা আছে, সে জায়গার জমিদারের মেয়ে আমার নজরে পড়ে–অমন মেয়ে আমি জীবনে দেখিনি, অপূর্ব খাসা মেয়ে যেমন চেহারা তেমনি যৌবন—

বলেন কি কাকা?

হাঁ ঠিক বলছি, যেন হুরপরী।

তারপর কাকা?

তারপর মেয়েটাকে পাবার জন্য আমি বাসবপুরের জমিদারের সঙ্গে ভাব জমিয়ে তুলি, বন্ধু হয়ে প্রবেশ করি অন্তঃপুরে। কিন্তু পরে জানতে পারি, মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছে।

হায় কাকা,তাহলে তো সব আশা মাঠে মারা গেলো?

না না তা যাবে কেন, একদিন রাতের অন্ধকারে বাসবপুরে হানা দিলাম, হত্যা করলাম বাসপুরের জমিদার ও তার স্ত্রীকে হত্যা করলাম তার বাড়ির সবাইকে কিন্তু যার জন্য এতোগুলোকে খতম করলাম তাকে পেলাম না—

পেলেন না কাকা?

পাবো না আমি? আমার নাম মঙ্গল ডাকু, একটা চাকরের কাছে জানতে পারলাম, মধুপুরে মেয়ের শ্বশুর বাড়ি। মধুপুরে আছে সে। আমি মধুপুরে হানা দিয়ে সুভাষিণীকে চাইলাম। আমাকে ওরা বাধা দিলো–আমি হত্যা করলাম সুভাষিণীর শ্বশুর বাড়ির বাধাদানকারীদের।

সবাইকে আপনি হত্যা করেছেন কাকা?

 হাঁ, কাউকে বাদ দেইনি—

সুভাষিণীর স্বামীকেও আপনি হত্যা করেছেন কাকা?

 ঐ বেটাকে আমি হত্যা না করে বন্দী করে নিয়ে আসলাম, কিন্তু বেটা পালিয়েছে।

পালিয়েছে?

কিন্তু পালিয়ে লাভ করতে পারেনি, সুভাষিণীকে আমি নিয়ে এসেছিলাম আমার ঝম আস্তানায়।

সুভাষিণীর স্বামী তাহলে ঝাঁম জঙ্গলে এসে পালিয়েছে কি?

 না না, সে তো খসে পড়েছে বাংলাদেশেই—

মুহূর্তে রহমতবেশী বনহুরের চোখ আনন্দ দীপ্ত হয়ে উঠলো। বললো তাহলে সে আর সুভাষিণীর সন্ধান পায়নি?

পাবে কোথায়, সে রইলো বাংলাদেশে আর সুভাষিণী রইলো ঝাঁম জঙ্গলে।

বড় আফসোস কাকা, সুভাষিণীকে আপনি হারিয়েছেন।

 হাঁ আফসোসই বটে, মেয়েটাকে পেলাম কিন্তু রাখতে পরালাম না।

কাকা?

বল কি বলতে চাস?

কাকা, মেয়েটার আপনি সর্বনাশ করেছিলেন?

 সর্বনাশ? এ তুই কি বলছিস বেটা?

বলছি কি কাকা, মেয়েটার মানে–মানে সুভাষিণীর ইজ্জৎ নষ্ট করেছিলেন?

হাঃ হাঃ করে হেসে উঠলো মঙ্গল ডাকু–যেন সাক্ষাৎ শয়তান মূর্তি, তারপর হাসি থামিয়ে বললো-আমার হাতে যে মেয়ে এসেছে কেউ সতীত্ব নিয়ে ফিরে যেতে পারেনি। প্রত্যেকটা মেয়েকে আমি অঙ্গশায়িনী করেছি—হাঃ হাঃ হাঃ, কেউ উদ্ধার পায়নি আমার হাত থেকে, কাউকে আমি রেহাই দেইনি—

উঃ কি ভয়ঙ্কর কথা, সুভাষিণীর জীবনটাও তাহলে বিনষ্ট করেছো, পাপিষ্ঠ শয়তান–সঙ্গে সঙ্গে বনহুর পকেট থেকে রিভলভারটা বের করে চেপে ধরলো মঙ্গল ডাকুর বুকে।

হঠাৎ রহমতের মধ্যে এমন একটা পরিবর্তন দেখে ভড়কে গেলো মঙ্গল ডাকু–তবে ক্ষণিকের জন্য, পর মুহূর্তে বললো-বেটা, তোর কি মাথা খারাপ হলো?

বনহুর দক্ষিণ হস্তে রিভলভার মঙ্গল ডাকুর বুকে চেপে ধরে বাম হস্তে পকেট থেকে একটা বাঁশি বের করে ফুঁ দিলো, অমনি কায়েস, সোহরাব আর মাহমুদ প্রবেশ করলো কক্ষমধ্যে।

 কায়েসের দেহে ঝাঁম সর্দারের ড্রেস বিদ্যমান, সর্দারকে মঙ্গল ডাকুর বুকে রিভলভার চেপে ধরে রাখতে দেখে বুঝতে পারলো সে, সর্দারের অভিনয় শেষ হয়েছে। বললো কায়েস–সর্দার।

 বনহুর রিভলভার উদ্যত রেখে বললোেকায়েস, যা জানবার ছিলো জানা হয়ে গেছে।

একি! মঙ্গল ডাকু অবাকই শুধু হয়নি, একটু পূর্বের রহমতের গলায় এমন গাম্ভীর্যপূর্ণ স্বর তাকে স্তব্ধ করে দিলো, ঝাঁম সর্দারই রহমতকে সর্দার বলছে–সব যেন ঘোরালো লাগছে মঙ্গল ডাকুর কাছে।

 বনহুর বললো–সুভাষিণীকে নিয়ে এসো সোহরাব।

মঙ্গল ডাকু চমকে উঠলো, সুভাষিণী এখানে আসবে কি করে? তাকে তো ঝাঁম জঙ্গল থেকে। দস্যু বনহুর নিয়ে গেছে অন্যান্য বন্দীর সঙ্গে–

মঙ্গল ডাকুর চিন্তায় বাধা পড়ে, সোহরাব বেরিয়ে যায়।

একটু পরেই ফিরে আসে সোহরাব–তার সঙ্গে সুভাষিণী।

মঙ্গল ডাকুকে লক্ষ্য করে বলে বনহুর–দেখো দেখি একে চিনতে পারো কিনা?

মঙ্গল ডাকুর দৃষ্টি সুভাষিণীর উপর পড়তেই তার চোখ দুটো ক্ষুধিত শার্দুলের মত জ্বলে উঠে, তীব্র কণ্ঠে বলে–তুমি এখানে এলে কি করে?

সুভাষিণী বিষধর নাগিনীর মত ফোঁস ফোঁস করতে থাকে। মঙ্গল ডাকুর কুৎসিত বীভৎস চেহারা তার দেহে যেন আগুন ধরিয়ে দেয়।

বনহুরের মুখমণ্ডল কঠিন হয়ে উঠে, চোখ দুটো দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে। দাঁত পিষে বললো–তোমার যমদুত ওকে এখানে এনেছে।

 মঙ্গল ডাকুর মধ্যে জেগে উঠে এক পশুপ্রাণ, বনহুরের হাতখানা সরিয়ে দিয়ে রুখে দাঁড়ায়– বল কে তুই?

বনহুর বাম হস্তে টিপে মঙ্গল ডাকুর গলাটা, দক্ষিণ হস্তে রিভলভার ওর বুকে পুনরায় চেপে, ধরে–আমার পরিচয় জানতে চাও?

হাঁ, বল তুই কে? এতোবড় সাহস তোর–মঙ্গল ডাকুর মুখের শিকার কেড়ে এনেছিস?

শয়তান, দস্যু বনহুর তোমার মুখের শিকার কেড়ে এনেছে?

কোথায় সেই পাপিষ্ঠ?

মঙ্গল ডাকু কথাটা উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে কায়েস ওর বুকে ছোরাবিদ্ধ করতে উদ্যত হলো। বনহুর বাধা দিয়ে বললো–আরও পরে।

বনহুর সুভাষিণীর হস্তে রিভলভার খুঁজে দিয়ে বললো তুমি ওকে ওর পাপের সমুচিত শাস্তি দাও সুভাষিণী। তাহলে একটু শান্তি পাবে।

 সুভাষিণী বলে উঠে–তুমি আমাকে উদ্ধার করেছো, তুমিই ওকে শাস্তি দিয়ে আমাকে শান্তি দাও।

মঙ্গল ডাকু অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠে–তুই তবে দস্যু বনহুর?

. হাঁ কাকা, আমিই তোমার বন্ধু দস্যু বনহুর—

এ্যা, কি বললে?

কথা শেষ হয় না মঙ্গল ডাকুর, বনহরের রিভলভার গর্জে উঠে।

তীব্র একটা আর্তনাদ করে ভূতলে লুটিয়ে পড়ে মঙ্গল ডাকু। তার একচক্ষু দিয়ে গড়িয়ে পড়ে তাজা লাল রক্ত, চোখের ভিতর দিয়ে গুলীটা বেরিয়ে যায় মাথার পিছন অংশ গুড়ো করে নিয়ে।

ভীমকায় একটা গরিলার দেহের মত স্থির হয়ে আসে মঙ্গল ডাকুর দেহটা। রক্তে ভিজে উঠে শুকনো মেঝের খানিকটা অংশ।

 বনহুর স্বস্তির নিশ্বাস ত্যাগ করে বলে–পৃথিবীর বুক থেকে একটা জীবন্ত শয়তান নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো।

*

সর্দার, আমরা কবে কান্দাই রওয়ানা দেবো কিছু মনস্থ করেছেন কি? কথাটা বলে একপাশে দাঁড়ালো কায়েস।

বনহুর শয্যায় দেহটা এলিয়ে দিয়ে বললো–হাঁ করেছি। কারণ ঝাঁম শহরের কাজ আমাদের শেষ হয়েছে। আগামী সপ্তাহেই আমরা রওয়ানা দেবো। একটা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে

কায়েস বলে আবার সুভাদিদি কি আমাদের সঙ্গেই যাবেন?

 তাছাড়া তো কোনো উপায় নেই কায়েস।

 কিন্তু—

না, তাকে আস্তানায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

তবে কোথায় রাখবেন তাকে?

কান্দাই শহরে আমাদের যে পুরোন আস্তানা আছে সেখানে তাকে রাখলেই চলবে। হাঁ, এক কাজ করতে হবে কায়েস, সুভাকে একা সেখানে রাখা সমীচীন হবে না। নাসরিনকে তার কাছে থাকার জন্য ব্যবস্থা করতে হবে।

হাঁ সর্দার, সেভাবেই কাজ করতে হবে, না হলে সুভাদিদি একা সেখানে থাকবে কি করে?

শুধু নাসরিনই নয়, তোমাদের কয়েকজনকেও থাকতে হবে। অবশ্য কয়েকদিনের জন্য, তারপর আমি আস্তানার কাজ শেষ করে সুভাষিণীকে নিয়ে বাংলাদেশের দিকে রওয়ানা দেবো। যতক্ষণ তাকে তার স্বামীর হস্তে পৌঁছে দিতে সক্ষম না হয়েছি ততক্ষণ আমার স্বস্তি নেই।

কিন্তু তার স্বামী যদি তাকে গ্রহণে আপত্তি করে বসে? কারণ মেয়েরা যদি একবার হরণ হয়। বা গৃহত্যাগ করে তাহলে তাকে কোনো স্বামী আর গ্রহণ করতে চায় না।

 তা চায় না বটে, কিন্তু কোনো নারীকে যদি কোনো দুষ্টলোক জোরপূর্বক চুরি করে নিয়ে যায়। বা ধরে নিয়ে যায় তাতে সে নারীর কি অপরাধ বলো? সে তো সম্পূর্ণ নির্দোষ। কাজেই সুভাষিণী এ ব্যাপারে একেবারে নিষ্পাপ।

 এরপর কায়েস আর কোনো কথা বলে না, বেরিয়ে যাওয়ার জন্য দরজার দিকে পা বাড়াতেই বললো বনহুর-কায়েস, সুভাষিণীকে আপাততঃ কোনো কথাই বলো না, যা বলতে হয় আমিই বলবো।

আচ্ছা সর্দার। কথাটা বলে বেরিয়ে যায় কায়েস।

বনহুর চিন্তামগ্ন হয়ে পড়ে, আবার তাকে যেতে হবে বাংলাদেশে। বাংলার মাটি আবার তাকে আহ্বান জানাচ্ছে, না গিয়ে উপায় নেই তার।

হঠাৎ শিয়রে একটা নিশ্বাসের শব্দ।

চমকে উঠে বনহুর, পাশ ফিরে তাকায় শিয়রে–একি তুমি।

হাঁ, আমি সুভা।

এভোরাতে তুমি?

কায়েসের সঙ্গে যখন কথা বলছিলে আমি সব শুনেছি।

 মন্দ কথা কিছু বলিনি তো?

মন্দ বলোনি কিন্তু তুমি যা বলেছে তা সম্ভব নয়, কারণ আমি শুধু মেয়েই নই–হিন্দু কুলবধূ। জানো না, হিন্দু ধর্মের নীতি কুলবধূ যদি একবার কুলত্যাগী হয় তাহলে সমাজ তাকে কিছুতেই আশ্রয় দেবে না।

তুমি তাহলে কি বলতে চাও সুভাষিণী?

 আমাকে বাংলাদেশে নিয়ে গিয়ে আর লাঞ্ছিত করো না। আমি মরে গেছি আমাদের সমাজের কাছে।

সুভাষিণী।

ওগো তুমি তো জানেনা, আমি তো তোমার কাছে নতুন জন নই—সুভাষিণী বনহুরের পা দু খানা জড়িয়ে ধরে।

দ্রুত উঠে বসে পা সরিয়ে নেয় বনহুরসুভাষিণী, তুমি সংযত হও।

পারবো না, পারবো না, আমি নিজেকে সংযত করতে পারবো না।

 জানো তো আমি একজন দস্য?

সে আমি প্রথম দিন তোমাকে দেখেই বুঝেছি। আমাকে ভালবাসতে পারবে না কোনো দিন তবে কেন এসেছিলে তুমি আমার জীবনে? কেন তুমি ডাকাতের হাত থেকে উদ্ধার করেছিলে আমাকে?

বনহুর বিব্রত বোধ করলো, বললো সুভা, তুমি আমাকে ক্ষমা করো। কথা দিচ্ছি, যেমন করে হোক তোমাকে তোমাদের সমাজে প্রতিষ্ঠা করবো, তোমার স্বামীকেও পাবে তুমি।

আর যদি আমার সমাজ আমার স্বামী আমাকে গ্রহণ না করে তখন কি করবে তুমি?

দস্য বনহুরের কথা বিফলে যাবে না সুভা, আমাকে তুমি জানো না–আমি যা বলবো তা করবোই। যাও, যাও সুভাষিণী, নিজের ঘরে যাও।

কিন্তু—

 আর কোনো কিন্তু নয় যাও।

সুভাষিণী মন্থর গতিতে বেরিয়ে গেলো বনহুরের কক্ষ থেকে। একটা অতৃপ্ত করুণ নিশ্বাসের শব্দ শোনা গেলো তার চলে যাওয়া পথের শেষে।

বনহুর আলো নিভিয়ে চোখ বুজলো।

*

কান্দাই পৌঁছে বনহুর সুভাষিণীসহ তার শহরের আস্তানায় এসে উঠলো। অবাক হলো সুভাষিণী, এতোবড় বিরাট বাড়ি অথচ জনপ্রাণী নেই। প্রত্যেকটা কুক্ষ রুচিশীল আসবাবে পরিপূর্ণ, সুন্দর সুন্দর মূল্যবান তৈলচিত্রে দেয়ালগুলো সজ্জিত। সুভাষিণীকে লক্ষ্য করে বললো বনহুর–এখানে কয়েকদিন তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে সুভা।

তুমি থাকবে না?

আমার অনেক কাজ আছে, তবে তোমার কাছে লোক থাকবে।

 এতোবড় বাড়ি অথচ কাউকে দেখছি না তো?

 দেখতে চাও? কথাটা বলে বনহুর হাতে তালি দিলো।

সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন জমকালো পোশাক পরা লোক এসে দাঁড়ালো কুর্ণিশ করে।

সুভাষিণী এদের দেখে চমকে উঠলো, ভীত নজরে তাকালো লোকগুলোর দিকে। জমকালো পোশাক পরা, মাথায় পাগড়ি, কোমরের বেল্টে সূতী ধার ছোরা, দক্ষিণ হস্তে চকচকে বর্শা।

বনহুর বললো–এরাই এ বাড়িটাকে রক্ষা করে।

সুভাষিণী কোনো জবাব দিলো না।

 বনহুর তাদের চলে যাবার জন্য ইংগিত করলো।

অনুচরগণ চলে গেলো।

বনহুর বললো–ভয় পেয়েছে সুভা?

না।

ওরাই তোমাকে এ বাড়িতে পাহারা দেবে। আর তোমার সাথী হিসেবে একটি মেয়েকে পাবে যতদিন তোমাকে এ বাড়িতে থাকতে হবে সে থাকবে তোমার পাশে।

সুভাষিণী করুণ কণ্ঠে বলে–তুমি আর আসবে না?

কাজ সেরেই চলে আসবো, কারণ তোমাকে নিয়ে আমাকে যেতে হবে বাংলাদেশে, খুঁজে বের করতে হবে তোমার স্বামীকে। আমার বিলম্ব হতে পারে বাংলায়, কাজেই এদিকের কাজ সেরে তবে যাবো।

অল্পক্ষণ পর নানারকম খাদ্যসম্ভার নিয়ে একজন অনুচর হাজির হলো সেখানে।

বনহুরের ইংগিতে টেবিলে সাজিয়ে রেখে চলে গেলো।

 এবার বনহুর সুভাষিণীকে খাবার জন্য বললো-খাও সুভা?

তুমি খাবে না?

বনহুর কিছু বলবার পূর্বেই সুভাষিণী একটা আঙ্গুরের ঝোপা নিয়ে তার মুখের কাছে এগিয়ে ধরে–খাও।

বনহুর হাত বাড়িয়ে আঙ্গুরের ঝোপাটা সুভাষিণীর হাত থেকে নিয়ে খেতে শুরু করে।

সুভাষিণীও খাবার তুলে নেয় হাতে।

এক সময় নাসরিন এসে পড়ে রহমানের সঙ্গে।

বনহুর তার সঙ্গে সুভাষিণীর পরিচয় করিয়ে দিলো–সুভা, একে তুমি নিজ বোনের মত মনে করতে পারো–এ থাকবে তোমার কাছে।

সুভাষিণী একজন সঙ্গিনী পেয়ে খুশি হলো।

 বনহুর বিদায় নিলো সেদিনের মত।

*

আস্তানার কাজ শেষ করতে লেগে গেলো কয়েকদিন। এবার বনহুর চঞ্চল হয়ে উঠলো মনিরা আর নূরীর সঙ্গে দেখা করার জন্য। নূরকেও সে কতদিন দেখেনি, সেদিনও সে ওর সাক্ষাৎ পায়নি কারণ নূর মায়ের ঘরে ছিলো। সবচেয়ে বড় কর্তব্য তার–একবার মায়ের সঙ্গে প্রকাশ্য দেখা করা।

বনহুর তাই এবার স্বাভাবিক ড্রেসে চৌধুরী বাড়ি যাওয়া মনস্থ করে নিলো। তবে দিনের আলোতে নয়, রাতের অন্ধকারে তাকে যেতে হবে। না হলে হঠাৎ কোনো পরিচিত পুলিশ অফিসারের নজরে পড়ে গেলে একটু মুস্কিল হতে পারে।

 বনহুর সন্ধার অন্ধকারে নিজের গাড়িখানা নিয়ে বেরিয়ে পড়লো কিন্তু হঠাৎ মনে পড়লো নূর তাকে যদি চিনে ফেলে তখন কি হবে? না না তা হয় না, নূরের কাছে তাকে আত্মগোপন করে থাকতেই হবে। তার সন্তান নূর-দূর যেন তার মত ডাকু বা দস্যু না হয় সেই তো তার কামনা। বনহুর ব্রেক কষে গাড়ি থামিয়ে ফেললো। তারপর ফিরে এলো আস্তানায়।

গভীর রাতে জমকালো ড্রেসে সজ্জিত হয়ে তাজের পিঠে চেপে বসলো। তাজ ছুটতে শুরু করলো কান্দাই শহর অভিমুখে। বন-জঙ্গল প্রকম্পিত করে বনহুরের অশ্ব ছুটছে।

চৌধুরী বাড়ি পৌঁছতে কয়েক ঘন্টা লেগে গেলো।

প্রথমে বনহুর নূরীর দরজায় মৃদু টোকা দিলো-ঠক্ ঠক্ ঠক্–

পুনঃ পুনঃ আংগুল দিয়ে আঘাত করছে বনহুর, একটা উদ্যম বাসনা তার মনকে চঞ্চল করে তুলেছে।

হঠাৎ বনহুর পিঠে একটা হাতের স্পর্শ অনুভব করে, চমকে ফিরে তাকায়।

[পরবর্তী বই ধূমকেতু।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *