তৃতীয় অধ্যায়
১
সন্ধ্যে উত্তীর্ণ হয়ে গেলে অদিতি ঘরে এসে বারান্দার দরজা বন্ধ করলেন। এখন বিকেল হতে-না-হতেই অন্ধকার হয়ে যায়, ঠান্ডাও পড়তে থাকে। বারান্দায় বেশিক্ষণ বসে থাকা যায় না। ঘরে এসে অদিতি পুজোর জায়গায় একটা ধূপ জ্বাললেন। তাঁর পুজোর জায়গা বলতে দেওয়ালের একটা তাক, সেখানে একটা ছোট্ট বেতের সিংহাসনে রামঠাকুরের ছবি। আর কোনো ঠাকুরদেবতা নেই। বহুবছর ধরে অদিতি রামঠাকুরের দীক্ষিত। বাঙালি হিন্দুর বাড়িতে সচরাচর যেরকম পুজো-টুজোর নিয়ম, সন্ধ্যে ইত্যাদি মেনে চলা হয়, অদিতি ঠিক তেমনটা মানেন না। সন্ধ্যের সময় ঠাকুরের সামনে ধূপ জ্বেলে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকেন। আজও বসে ছিলেন। বসার ঘর থেকে টিভির আওয়াজ আসছে, রবিবারের হিন্দি সিনেমা। বিশ্বনাথ অন্যদিন হিন্দি প্রোগ্রাম না দেখলেও রবিবার সন্ধ্যেবেলায় তাঁর কিছু করার থাকে না। এই দিনগুলোতে সন্ধ্যে থেকেই হিন্দির দাপট, তার সামনে আত্মসমর্পণ না করলে বিশ্বনাথের রবিবার সন্ধ্যেবেলাটি নিতান্ত কর্মহীন হয়ে যায়।
অদিতি চোখ বন্ধ করে বসেই ছিলেন। হঠাৎ বেল বাজল। আজকাল বেল বাজলেই অদিতি ভেতরে ভেতরে ব্যাকুল এখন তো অন্য কারও আসার কথা নেই?
বারান্দা থেকে উঁকি দিলেন অদিতি। রাস্তার আলোগুলো জ্বলেনি। প্রায় দিনই জ্বলে না আজকাল। গলি অন্ধকার। সেখানে কেউ দাঁড়িয়ে আছে, দুজনের ঝাপসা অবয়ব। উৎকণ্ঠা চেপে অদিতি প্রশ্ন করলেন, ‘কে?’
‘মা, আমি!’
দু-এক মুহূর্ত স্তব্ধতার পর অদিতি দ্রুত নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে বললেন, ‘দাঁড়াও, আসছি।’ নীচে নামার আগে বসার ঘরে গিয়ে
হয়ে ওঠেন।
টিভিটা বন্ধ করে দিলেন। বিশ্বনাথ আশ্চর্য হয়ে বলতে যাচ্ছিলেন, ‘কী হল কী, টিভি বন্——
‘তিথিরা এসেছে।’ অদিতির সারা শরীর কাঁপছিল।
বিশ্বনাথেরও।
তিথি আজ পরে এসেছে সুধার দেওয়া তাঁতের শাড়িটা। পুজোয় একদিন মাত্র পরে শাড়িটা ভাঁজ করে তুলেই রেখেছিল সে। আজ পরতে গিয়ে বার বার মনে হচ্ছিল, এত গাঢ় রং আর চকচকে পাড় মা যদি পছন্দ না করেন! গরম কিছুই গায়ে দেয়নি সে। মনে হয়েছিল লাগবে না। কিন্তু রাস্তায় বেরিয়ে শীত শীতই করছিল। পার্থ যদিও পাঞ্জাবির ওপর অলকের পুরোনো একটা শাল চাপিয়ে এসেছে। বহুবছর বাক্সবন্দি থাকার ফলে শালটার গায়ে অজস্র ভাঁজ।
অদিতি দরজা খুলে প্রথমেই একটা তীব্র ঝাঁকুনি খেলেন। এ কি তিথি, না তিথির ছায়া? কতদিন তিনি দেখেননি তিথিকে, আটমাস! তার মধ্যে একটা মেয়ে এতটা বদলে যেতে পারে! অসম্ভব রুগ্ন, গায়ের কালো রঙের ওপর আরও গভীর মালিন্যের ছাপ, চুল অনেকটা বড়ো হয়ে গেছে, টেনে বাঁধা খোঁপা, সিঁথি থেকে কপালে ঝুঁকে এসেছে সিঁদুরের রেখা, কপালের মাঝখানেও সিঁদুরের টিপ। প্রসাধনের চূড়ান্ত অভাবে সিঁদুরটাকেই একমাত্র প্রসাধন করেছে তিথি। দু-হাতে শাঁখা-পলা আর ব্রোঞ্জের দু-গাছি চুড়ি, কান আর গলা খালি। অদিতি স্তম্ভিত হয়ে দেখছিলেন। তিথি কোনোদিনই বেশি সাজগোজ করত না, কিন্তু সে ছিল তার উদাসীনতা। আর আজকের এই তিথি যেন মূর্তিমতী দীনতার প্রতিমা। অদিতির বুকের ভেতরে যাবতীয় মাংসপেশি স্নায়ু শিরা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তিনি শান্তমুখে হাসলেন। পার্থর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এসো।’
যে কয়েকটি সামান্য মুহূর্ত অদিতির চোখ তিথির দিকে স্থির ছিল, তিথিও তাঁকে অবাক হয়ে দেখছিল। অদিতির ছোটো চুল, চুড়িহীন দু-হাত—এমন সে কখনো দেখেনি। কিন্তু আজ প্রথমবার দেখেই তার মনে হল, অদিতিকে যেন এমনভাবেই বেশি
মানিয়েছে। পরমুহূর্তেই সে একটু শঙ্কিতভাবে পার্থর দিকে একঝলক তাকাল। পার্থর কপালে কুঞ্চন। তিথির মনে হল, পার্থর ভঙ্গিমা কি আর একটু বিনয়ী হতে পারত না।
তিথি এ বাড়িতে এসেছিল একরাশ উদ্বেগ নিয়ে। কিন্তু এখানে পা দেওয়ার পর কয়েক মিনিট কেটে যেতেই সে দেখল তার খুব ভালো লাগছে। সেই পুরোনো সিঁড়ি, ল্যান্ডিং-এর কাচের জানলা, ল্যান্ডিং-এর কোণে টেরাকোটার টবে পাতাবাহার গাছ, এ সমস্ত তো সে চিরজীবনের মতো ছেড়েই চলে গিয়েছিল। আজ এই ফিরে আসাটুকু, হোক তা মাত্র কিছুক্ষণের জন্যে, কী চূড়ান্ত মধুর। সিঁড়ি ভেঙে ওপরে এসে জুতো খুলতেই অদিতি বসার ঘরের দরজার মুখে দাঁড়িয়ে আবার বললেন, ‘এসো—
তিথি হঠাৎ একটা ধাক্কা খেয়ে গেল। সে খেয়াল করল অদিতি তাদের অতিথির মতো বসার ঘরে আহ্বান জানাচ্ছেন। বিহ্বলের মতো চারিদিকে তাকাল সে, এই বাড়ি, এর প্রতিটি ঘরে, ঘরের কোণে তার আজন্মের নিশ্বাস জমে আছে, তার পায়ের তলায় কী তীব্র পরিচিত স্পর্শ, এখানে সে আজ একজন বাইরের লোক! সজোরে ঠোঁট কামড়ে ঘরে পা দিল তিথি। ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন বিশ্বনাথ। তাঁর দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিমাটিই এমন করুণ, তিথির চশমার কাচ ঝাপসা হয়ে গেল। নীচু হয়ে প্রণাম করতেই বিশ্বনাথ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গেই কেঁপে কেঁপে বেরিয়ে এল ভাঙা ভাঙা কয়েকটা শব্দ, ‘আয়.. মা!.. আয়, কেমন আছিস…’
‘তোমরা কেমন আছ–’ তিথি অদিতির পা ছুঁল। পার্থ তখন বিশ্বনাথকে প্রণাম করছে। বিশ্বনাথ নিজের দু-হাত জোড় করে কপালে ঠেকালেন, কিছু বললেন না। পার্থ তিথির পাশে এসে যখন অদিতির সামনে ঝুঁকল, তিথি তখনও প্রণাম শেষ করেনি। অদিতি দুজনের মাথায় হাত ছুঁইয়ে স্পষ্ট গলায় বললেন, ‘আহা থাক, সুখী হও।’
তিথির কান্না আর বাঁধ মানল না। সে ভেঙে পড়তেই অদিতি তাকে বুকে জড়িয়ে নিলেন, পার্থকেও একটু বিচলিত দেখাচ্ছে। অদিতি পার্থর দিকে তাকিয়ে হাসলেন, তাঁর চোখে নিঃশব্দ স্রোত। বললেন, ‘বোসো পার্থ। চা খাবে তো?’
কান্নার বেগটা একটু কমলে অদিতি তিথির পিঠে আলতো চাপড় দিলেন, ‘তিথি? আমায় একটু রান্নাঘরে যেতে হবে যে! বাবার কাছে একটু বোস। তোর বাবা তো এই ক-টা মাস কেঁদে কেঁদেই গেল।’
তিথি চোখ মুছছিল, বলল, ‘বসছি। তার আগে তোমার সঙ্গে রান্নাঘরে যাই? কী করবে? আমরা কিন্তু বেশি কিছু খাব না।’
‘তোকে আর রান্নাঘরে যেতে হবে না। পরোটা ভাজি, বেগুনভাজা দিয়ে খা? এক্ষুনি হয়ে যাবে।’
তিথি হাসিমুখে ঘাড় কাত করল। পার্থর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মা যা পরোটা বানায় না, দেখো! খেয়ে একদম পাগল হয়ে যাবে। মুচমুচে, ছোটোছোটো, ফার্স্টক্লাস!’
পার্থর মুখে কোনো ঔৎসুক্য লক্ষ করা গেল না। সে উদাসীন মুখে বিশ্বনাথের সঙ্গে কথা বলছে, বিশ্বনাথ বলছেন এবার কলকাতায় খুব তাড়াতাড়ি ঠান্ডা পড়ে গেছে। উত্তরে পার্থ খুব ভারিক্কি স্বরে বলছিল, ‘এটা তাড়াতাড়ি নয়, বরং এইটাই ঠান্ডা পড়ার ঠিক সময়। অন্যান্যবারই শীত দেরি করে আসে।…’
অদিতি বা বিশ্বনাথ কেউই তিথিকে পড়াশুনার কথা কিছু জিজ্ঞেস করেননি। খেতে খেতে তিথি নিজে থেকেই একটু ভয়ে ভয়ে বলল, ‘মা, আমি ক্লাস করছি। সামনের বছর পরীক্ষা দেব। এ বছর তো আর দেওয়া হল না…বই-টইগুলো নিয়ে যাব, হ্যাঁ?”
তিথি বুঝতে পারছিল মা-বাবা দুজনেই ধরে নিয়েছিলেন সে আর পড়াশুনা করবে না। চিঠিতে সে শুধু পরীক্ষা না দেওয়ার কথাই লিখেছিল, তখনও পড়াশুনা আর শুরু করতে পারেনি বলে আর কিছু লেখার সাহস পায়নি। তার কথা শুনে অদিতি হাসলেন, ‘যাক, শুনে খুব ভালো লাগছে তিথি, আমরা তো আর কিছু জিজ্ঞেস করতে পারি না। তুই নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিস, এর থেকে ভালো আর হয় না।’ অদিতির হাসিটাতে সামান্য দুঃখের ছাপ পড়ল, ‘খবরটা শুনে আমার আর তোর বাবার চাইতেও
কে বেশি খুশি হবে বল তো?”
তিথি মুখ নীচু করে বলল, ‘জানি, দাদা তো? দাদা ভেবেছিল আমার দ্বারা আর কিছু হবে না, তাই না?’
‘ওভাবে বলিস না। ও-ও তো কম কষ্ট পায়নি তুই এভাবে চলে যাওয়ায়।’ অদিতি হঠাৎ প্রসঙ্গ বদল করলেন, পার্থর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি খুব আস্তে আস্তে খাচ্ছ, পার্থ। আমি কিন্তু আরও ভেজে রেখেছি, দেব।’
তিথি হাসছিল, ‘ও খুব আস্তেই খায় মা, বাড়িতেও ওইরকম।’
‘তাই বুঝি! আমি ভাবলাম বোধ হয় ভালো লাগছে না খেতে—’ অদিতির গলায় সংশয়।
‘না, না, মা, দারুণ হয়েছে, ভালো লাগবে না কেন?’ তিথি প্রতিবাদ করে উঠল, ‘উফ্ কতদিন পর এই পরোটা খাচ্ছি! এই, তুমি কিছু বলছ না যে?’
পার্থর মুখ কঠিন হয়ে আসছে, সে নীরস গলায় বলল, ‘এইসব ভাজা খাবার আমি ঠিক পছন্দ করি না।’
বিশ্বনাথ এতক্ষণ চুপ করেই ছিলেন। পার্থর কথা শুনে ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘তাই তো, তাই তো! ভাজা খাবার—এঃ হে,’ বিশ্বনাথ অদিতিকে অনুযোগ করলেন, ‘তুমি আর কিছু করতে পারলে না?’
অদিতি কোনো উত্তর দিলেন না, তাঁকে অন্যমনস্ক লাগছিল। তিথি অবাক হয়ে পার্থকে দেখতে দেখতে বলল, ‘কই, তুমি ভাজা খাবার খাও না, আমি জানি না তো? তুমি তো তেলেভাজা খেতে ভালোবাসো, ওটা বুঝি ভাজা নয়?’
পার্থ গম্ভীর মুখে পরোটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। বিশ্বনাথ ফ্যালফ্যাল করে একবার তার দিকে একবার মেয়ের দিকে দেখছিলেন। ঘরে ক্রমশ যেন একটা দুরারোগ্য নৈঃশব্দ্য নেমে আসছে। অদিতি হঠাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিথিকে বললেন, ‘গায়ে গরম কিছু দাওনি, বাইরে তো বেশ ঠান্ডা।
তিথি মুখ তুলে তাকাল, কিছু বলল না। তার দৃষ্টিতে কী ছিল, অদিতি যেন সংবিৎ ফিরে পেলেন। হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, ‘ও হ্যাঁ, তোর জামাকাপড় এখানে যা যা আছে সবই তো গুছিয়ে রেখেছি। ওগুলোও আজ তাহলে নিয়ে যা?’
‘একসঙ্গে সব নিয়ে যাব না। কয়েকটা চুড়িদার আর কার্ডিগান নিয়ে যাব আজ। শাড়ি পরে কলেজ যেতে অসুবিধে হয়।’ তিথি কথাগুলো বলল পার্থর দিকে না তাকিয়ে, শক্ত মুখে।
অদিতি উঠলেন, ‘তাহলে আয়, দ্যাখ কোনটা কোনটা নিবি। আমি বের করে দিচ্ছি।’
তিথি ভেবেছিল, একসঙ্গে সব না নিয়ে গিয়ে একটু একটু করে তার জামাকাপড় আর বইপত্র ওবাড়িতে নিয়ে যাবে। কিন্তু ঘরে এসে অদিতি যখন আলমারি খুললেন, তিথির মাথায় একটা ছোট্ট চক্কর দিয়ে উঠল। এ কী! তার এত জামাকাপড়। আলমারির একটা তাক পুরো ঠাসা। অদিতি সব একজায়গায় করে থরে থরে গুছিয়ে রেখেছেন। তিথি একদৃষ্টে দেখছিল। তার মনের মধ্যে অনেক চিন্তার ভিড়, চিন্তাগুলো পরস্পর ঠেলাঠেলি করছে। এতদিন তো তার ধারণা ছিল তার পোশাকের সংখ্যা যথেষ্ট কম। মৌসুমীর রাশি রাশি নিত্যনতুন পোশাকের পাশে তার পুঁজি ছিল নিতান্তই সামান্য। যদিও এ নিয়ে তার কখনো কোনো ক্ষোভ বা হীনম্মন্যতা হয়নি কেননা সে তো মৌসুমীর প্রতিযোগী ছিল না। কিন্তু আজ তার সেই ধারণাটা একটা বিরাট ধাক্কা খেয়ে গেল। সে দেখল, তার পোশাকের সেই নেহাত মধ্যবিত্ত সংখ্যাটিই পার্থদের বাড়ির পক্ষে রীতিমতো বিসদৃশ। এমনকি, এর সবটুকু ওখানে নিয়ে গিয়ে রাখারও কোনো জায়গা নেই।
অদিতিও ওইদিকেই তাকিয়ে ছিলেন, গাঢ় গলায় বললেন, ‘তোর চিঠি পাওয়ার পর গুছিয়ে রেখেছি। কিছুই না নিয়ে চলে গেলি, আমি সব আগলে বসে আছি কতদিন বল তো! যা, সব নিয়ে যা, দাঁড়া, সোয়েটারগুলো বার করি।’
তিথি আস্তে আস্তে বলল, ‘এত জামা নিয়ে যাওয়া যাবে না।’
‘আজ যে ক-টা পারিস নে। আবার পরে এসে নিয়ে—
‘না মা! ওখানে এত জামা রাখার জায়গা নেই।’
‘মানে?’ অদিতি বুঝতে পারছেন না।
তিথির কান্না পাচ্ছিল, দু-তিনটে ঢোকের সঙ্গে কান্নাটাকে গিলে ফেলে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ‘কোথায় রাখব?’
‘সে আবার কী? ওরা জামাকাপড় কোথায় রাখে!’
‘দু-তিনটে বাক্স আছে, সেগুলো তো সব ভরতি!’
‘বাক্স!’ অদিতি যেন প্রতিধ্বনি করলেন, ‘বাক্স! বাক্সে জামাকাপড় থাকে, আলমারি নেই!’
তিথি হঠাৎ রেগে উঠল, ‘নেই তো নেই, কী হয়েছে তাতে? এমন করছ যেন বাক্সে জামাকাপড় রাখা যায় না!’
অদিতি স্তব্ধ হয়ে থাকলেন। তাঁর আর কিছু বলারও ছিল না। আজ দরজা খুলে তিথিকে দেখেই তিনি বুঝেছিলেন সে কেমন
আছে, কিন্তু সে সম্বন্ধে একটা কথাও উচ্চারণ করেননি তিনি। তিনি ঠিকই করে রেখেছিলেন কোনো প্রশ্ন করবেন না, কোনো মন্তব্যও নয়। কিন্তু প্রায় আপনা থেকেই যে তথ্য প্রকাশ হয়ে গেল, তা থেকেই অদিতি বেশ বুঝতে পারছিলেন তিথি কেমন সংসারে গিয়ে পড়েছে। তাঁর বুক ভেঙে যাচ্ছে তবু তিনি আত্মসংবরণ করলেন।
তিথি কয়েকটা জামা বের করে বিগশপারে ভরল। অদিতি তার রোগা রোগা হাতের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। এত সরু কি ছিল ওর কবজি! শাঁখা-পলাগুলো ঢলঢল করছে। তিথি সেগুলো গুঁজে দিতেই সেগুলো কনুইয়ের কাছে গিয়ে উঠল।
বলব না বলব না করেও অদিতির মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, ‘হাতে ওইসব পরেই কলেজ যাও নাকি তুমি!’
তিথি মুখ না তুলেই বলল, ‘হ্যাঁ, কেন?’
‘তুমি একজন স্টুডেন্ট, তিথি। তোমার শাঁখা-টাখা পরার কী দরকার? কপালে অত টেনেই-বা সিঁদুর পরেছ কেন? স্বাভাবিকভাবেও তো পরা যায়।’
তিথি ভেতরে ভেতরে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু সেই কারণেই সে বাইরে ফোঁস করে উঠল, ‘পরেছি তো কী হয়েছে, অন্যায় কিছু তো করিনি।’
অদিতি ঠান্ডা গলায় কথা বলছেন, কিন্তু তাঁর চোখ তীব্র হয়ে উঠেছে, বললেন, ‘অন্যায় নয়, একেবারেই অন্যায় নয়। তবে দেখতে খুব ভালো লাগছে না। অন্তত আমার চোখে। আমার ধারণা ছিল তোমার রুচি ঠিক এরকম হওয়ার কথা নয়—’
‘তুমি সিঁদুর পরোনি কেন, চুড়ি খুলে ফেলেছ কেন? আমাকেও বুঝি তোমার মতোই হতে হবে!’
অদিতি অনেকক্ষণ থেকেই এই প্রশ্নের জন্যে তৈরি ছিলেন। অদ্ভুত একটা কষ্টের হাসি হেসে বললেন, ‘কেন যে আমি সিঁদুর ছেড়েছি, হাত খালি রেখেছি সেটা এত অল্প সময়ে তোকে ঠিক বোঝাতে পারব না রে। তবে তুই চলে যাওয়ার পরই আমার মনে হল এসব আর মানব না। সত্যি বলতে কী, কোনোদিনই আমি ভেতর থেকে এটা মেনে নিতে পারিনি যে বিয়ের পর শুধু মেয়েদেরই সর্বাঙ্গে বিবাহিতের চিহ্ন ধারণ করতে হবে।’ অদিতি লম্বা একটা শ্বাস টানলেন, ‘তবে সেটা আমার বিশ্বাস, যেটা আমি বিভিন্ন কারণে নিজেই এতদিন মেনে চলতে পারিনি। মেনে চলাই উচিত ছিল। তোমাকেও আমি সেই কথাই বলব। আমার মতো কেন, তুমি কারও মতোই হবে না। তুমি শুধু নিজের মতো হবে। শুধু নিজের মতো।’
তিথি বেশ অবাক হয়েই অদিতির দিকে তাকিয়ে ছিল। সে ঠিক এইভাবে মাকে কথা বলতে শোনেনি কখনো। সে ভেবেছিল, মা বলবেন, ‘আমি সিঁদুর পরিনি আমার ইচ্ছা।’ তাহলে উত্তরে সেও বলত, ‘আমিও যেভাবে সিঁদুর পরেছি সেটা আমার ইচ্ছা!’ যদি অদিতি অনেকটা সেইরকম কথাই বললেন, তবু তিথির মনে হল, কী যেন একটু সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। ইচ্ছে আর বিশ্বাস ঠিক কতটা আলাদা! তিথি ভাবার চেষ্টা করছিল। অদিতির শেষ কথাগুলো আরও নাড়া দিয়েছে তাকে। সে তার নিজের মতোই হতে চায়, এ কথা সত্যি। অদিতি কি মনে করছেন, সে আর নিজের মতো নেই! তিথি কথাটা মনে মনে তোলা-ফেলা করছিল, মুখে কিছু জিজ্ঞেস করল না।
কার্ডিগান গায়ে চাপিয়ে বসার ঘরে আসতেই পার্থ উঠে দাঁড়াল, ‘চলো তিথি, দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
বিশ্বনাথ দ্রুত একবার অদিতির দিকে তাকালেন, অদিতি বললেন, ‘বলো, তুমিই বলো’।
তিথি বুঝতে পারছিল না মা-বাবা কী বলতে চাইছেন। বিশ্বনাথ পার্থকে বললেন, ‘একটু বোসো। তোমাদের সঙ্গে কয়েকটা কথা বলে নিই।’
‘হ্যাঁ, বলুন।’ পার্থ দাঁড়িয়েই থাকল। তার ভঙ্গিমা ঈষৎ উদ্ধত, যেন আক্রমণের আশঙ্কায় সে আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুত। তিথির অস্বস্তি হচ্ছিল।
বিশ্বনাথ বললেন, ‘তোমরা তো রেজি িকরেছ। কিন্তু এ ছাড়া তোমাদের বাড়ি থেকে কোনো অনুষ্ঠান করা হয়েছে কি? মানে, এই আত্মীয়স্বজনকে জানানোর জন্য আর কি!’
পার্থর মুখে পর পর ভাবপরিবর্তন হচ্ছিল। সে চোখ সরু করে বলল, ‘নিশ্চয়ই হয়েছে। মা ওকে লোহা-টোহা দিয়ে বরণ করেছেন, সিঁদুর পরানোর অনুষ্ঠান হয়েছে। আত্মীয়স্বজনরাও সবাই জানেন।’
বিশ্বনাথ কিছুক্ষণ পার্থর মুখের দিকে তাকিয়ে কী যেন বোঝার চেষ্টা করলেন, তারপর বললেন, ‘বেশ। আমরা ভেবেছি একটা রিসেপশনের আয়োজন করব। তোমরা বিয়ে করেছ, এই কথাটাই জানিয়ে সবাইকে নেমন্তন্ন করা আর কি—’
অদিতি মাঝখান থেকে বলে উঠলেন, ‘কোনো আচার-অনুষ্ঠান নয়, উপহার-টুপহারও নেওয়া হবে না। শুধু সবাই আসবে, আলাপ-পরিচয় হবে। সবাই বলতে বেশি কেউ নয়, খুব ঘনিষ্ঠ যারা তারাই শুধু—’
বিশ্বনাথ অনুমোদনের ভঙ্গিতে ঘাড় নাড়লেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, একেবারেই ছোটো করে। আমার মনে হয় এটা জয়েন্টলি করলেই সব থেকে ভালো হয়। তোমরা বোধ হয় রিসেপশন কিছু করোনি, একসঙ্গে দু-পক্ষেরই হয়ে যাক তাহলে। তোমাদেরও দিককার আত্মীয়স্বজনরাও এলেন, আমাদেরও—’
তিথির খুব আনন্দ হচ্ছিল। এরকম কোনো সম্ভাবনার কথা সে স্বপ্নেও ভাবেনি। সে জানে, তার বিয়েতে এরকম কিছু হয়নি বলেই পার্থর আত্মীয়স্বজনদের কাছে তার কোনো সামাজিক স্বীকৃতি নেই, বরং একটা অব্যক্ত অসম্মানই আছে। আজ
অপ্রত্যাশিত সুরাহার সম্ভাবনায় সে আপ্লুত হয়ে গেল। পার্থর হাত ধরে বলল, ‘সত্যি, কী ভালো হবে, বলো! এটাই সবচাইতে ভা——
তিথি কথা শেষ করতে পারল না। পার্থ যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে বাধা দিল, শক্ত গলায় বলল, ‘না। আপনারা যা করতে চান করুন। আমাদের বাড়ি থেকে আলাদা ব্যবস্থা করা হবে। একসঙ্গে করার দরকার নেই।’
ঘরের পরিবেশ থমথমে হয়ে উঠছিল। অদিতি বললেন, ‘তাহলে আমরা দিন-টিন ঠিক করে ফেলছি। তমাল কবে ছুটি পায় দেখি। তারপর জানাব।’
পার্থর চপ্পল পরা হয়ে গেছে। তিথি একটু সময় নিয়ে জুতো পরছিল, তার জুতোটা ছিঁড়ে এসেছে, সে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মা, আমার সেই কালো ব্যালে শু-টা আছে না? পরের দিন এসে নিয়ে যাব।’
অদিতি নীরবে ঘাড় নাড়লেন, তাঁর খুব ইচ্ছে করছিল বলতে যে তিথি তুই আজকের রাতটা এখানে থেকে যা।
তিথি সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলল, ‘বাবা আসছি, আসছি মা। তোমরা বলোনি, কিন্তু আমি আবার আসব, হ্যাঁ?’ তার কথার মধ্যে একটা ছেলেমানুষি ছিল, অদিতির প্রাণে খুব বাজল। তিনি বললেন, ‘ওভাবে বলতে নেই তিথি, নিজের বাড়িতে আসবে না? যখন ইচ্ছে আসবে। আমরা তো একা একাই পড়ে আছি। পার্থকে অবশ্য আমাদের আলাদা করে বলা উচিত’, অদিতি হাসছিলেন, ‘আবার এসো, পার্থ!’
পার্থ জবাব দিল না, দরজা খুলে বাইরে চলে গেল।
বাড়ি ফেরার পথে পার্থ কোনো কথা বলল না, তিথিও না। বাড়ি ফিরে তিথি অবাক হয়ে দেখল, পার্থ খেতে বসছে। সুধা তাকেও খেতে দিচ্ছিলেন, তিথি বলল, ‘না বড়োমা, আমি আর খাব না। মায়ের কাছে গিয়ে খেয়েছি তো!’
হাত মুখ ধুয়ে অলকের বিছানা করে মশারি টাঙিয়ে দিল তিথি। মশারির কোনা গুঁজতে গুঁজতে অনবরত তার মনে হচ্ছিল পার্থ পাঁচটা পরোটা খেয়েছে, মা প্রথমবারই ডিশে পাঁচটা করে দিয়েছিলেন। পরোটাগুলো খুব ছোটো ছোটোও নয় যে বাড়ি আসতে আসতে খিদে পেয়ে যাবে। তাহলে!
তিথি ওপরে এসে শুয়ে পড়েছিল। আজ পার্থর আসতে যে অনেক দেরি হবে সে জানে। সুধা নিশ্চয়ই জানতে চাইবেন তিথিদের বাড়িতে আজ কী কী হল, তিনি জানতে না চাইলেও পার্থ বলবে। তিথি ঘুমিয়ে পড়তে চেষ্টা করছিল, কিন্তু পারছিল না। তারও পার্থর কাছে কিছু জানতে চাওয়ার আছে।
তিথির তন্দ্রা এসে গিয়েছিল। পার্থ দরজায় কড়া নাড়তে সে উঠে দরজা খুলে দিল। পার্থ ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে আলো নিভাতে যাবে, তিথি আর ধৈর্য রাখতে পারল না, বলে উঠল, ‘তুমি না বললে কেন?’
পার্থ চমকে উঠেছিল, বলল, ‘কীসে না বললাম?’
‘একসঙ্গে রিসেপশনটা হয়ে গেলেই তো ভালো হত!’
পার্থ আলো নেভালো না, সুইচ থেকে হাত সরিয়ে নিল
। ধীরেসুস্থে চেয়ারটায় বসতে বসতে বলল, ‘কেন না করলাম, বোঝোনি?’
‘না তো, কেন!’ তিথির গলায় বিস্ময়, তার মুখেও!
‘তোমাদের বাড়ির সঙ্গে আমাদের ফ্যামিলির অনেক তফাত, তিথি! মেনলি সেটা তোমার মায়ের জন্যে। অদ্ভুত ভদ্রমহিলা। প্রথমবার যখন দেখেছিলাম তখন তাও ঠিকঠাক ছিলেন, আজ তো দেখলাম একেবারে যাচ্ছেতাই! বাবা বেঁচে তবু সিঁদুর পরেন না। এসব দেখলে আমার মা-বাবা-আত্মীয়স্বজনের রিঅ্যাকশন কেমন হবে বুঝতে পারছ?”
তিথির ব্রহ্মতালু অবধি শুকিয়ে উঠছে, তার ঠোঁট নড়ছে কিন্তু কোনো স্বর বেরোচ্ছে না, তার চোখ বিস্ফারিত কিন্তু দৃষ্টি শূন্য।
পার্থর তখনও বক্তব্য শেষ হয়নি, সম্ভবত নীচে একবার এ বিষয়ে কথাবার্তা হয়ে যাওয়ায় শব্দগুলো তার মুখের মধ্যে খুব গোছানো ছিল, ‘সবাই তো ভাববে আমি মুসলমান কিংবা ক্রিশ্চান বিয়ে করেছি। সেটা সত্যি হলেও একরকম কথা ছিল, আমি পরোয়া করতাম না। কিন্তু হিন্দুদের তো একটা নিজস্ব সংস্কৃতি আছে। আমার মাকে দ্যাখো, কপালে সিঁদুর, বড়ো খোঁপা, হাতে শাঁখা-পলা, কী পবিত্র মায়ের চেহারা। তোমার মাকে দেখে, কিছু মনে কোরো না তিথি, আমার মা বলে ভাবতেই ইচ্ছে করেনি। তোমার বাবা অনেক বেটার। তবে তিনিও তোমার মাকে কিছু বলেন না কেন বুঝতে পারছি না। অবশ্য তোমার মা মনে হয় খুব একগুঁয়ে মহিলা—’
তিথি চিৎকারকরে উঠল, ‘পার্থ! অনেক বলেছ। আর একটাও কথা বলবে না।’
পার্থ মুখটা করুণ করল, ‘সরি তিথি। তোমার শুনতে খারাপ লাগারই কথা। কিন্তু তুমি তো ঠিক করেছ, আমার কাছে চলে এসেছ, তোমার মায়ের মতো হওনি। কিছুদিন ও বাড়িতে থাকলে তোমারও সর্বনাশ হয়ে যেত।’ পার্থ উঠল। আলো নেভালো। তিথি এখনও ক্যাম্পখাটের ওপর কাঠের মতো বসে আছে। পার্থ হাই তুলে বলল, ‘শোবে না? ভয় নেই, চিন্তা কোরো না। আমার মনে হয় মায়ের কাছে তোমার বেশি যাওয়া-টাওয়া উচিত হবে না, বুঝলে? নাও এবার শুয়ে পড়ো।’ পার্থ তিথিকে টানল। তিথি তখন সম্পূর্ণ অসাড়। পার্থ তার শরীরের ওপর উঠে আসার পরও সে বাধা দিল না। তার কোনো অনুভূতি কাজ করছে না। বার কয়েক ঝাঁকুনি খাওয়ার পর সে খুব ক্লান্ত গলায় বলল, ‘এখনও হয়নি!
পার্থদের বাড়ির কাছাকাছি এসে অদিতিরা তিন জন যখন গাড়ি থেকে নামলেন, তখন সকাল আটটা। ঠিকানা খুঁজে খুঁজে এতদূর আসা গেছে, বাকিটাও ঠিকানা জিজ্ঞেস করতে করতে এগোতে হবে।
গাড়িটা ঠিক করেছে তমাল। কলকাতায় ফিরে অবধি তাকে ক্রমাগত ছোটাছুটি করতে হয়েছে। এক বন্ধুর দাদার প্রেস থেকে এক রাত্তিরের মধ্যে কার্ডও ছাপিয়ে ফেলেছে সে। আজ সেই কার্ড নিয়ে নেমন্তন্ন করতে বেরোনো হয়েছে। প্ল্যান আছে একদিনের মধ্যেই সব সেরে ফেলা হবে। হাতে বেশি সময় নেই, পরশু দিনই রিসেপশন। একটা বাড়ি ভাড়া করা হয়েছে, খাওয়া-দাওয়ার দায়িত্বও ক্যাটারিং সার্ভিসের।
অনেকক্ষণ থেকেই অদিতির বুক ধুকপুক করছিল। যে অলিগলির মধ্যে দিয়ে গাড়িটা এগোচ্ছিল, সেই গলিগুলোর চেহারা দেখলেই বোঝা যায় অঞ্চলটা খুব পুরোনো, আর নোংরা। সরু সরু গলির পাশে খোলা নর্দমা, নর্দমার ধারে রাশি রাশি তরকারির খোসা আর মাছের কাঁটা ছড়ানো। বাড়িগুলোও ছিরিছাঁদহীন। অদিতি প্রতিটি বাড়ি দেখেই ভাবছিলেন, তিথি কি এই বাড়িটায় থাকে, এই বাড়িটা! পার্থদের বাড়ি সম্বন্ধে তাঁর মনের মধ্যে একটা ধারণা আঁকা ছিল।
অবশেষে যখন বাড়িটা খুঁজে পাওয়া গেল, অদিতির মনে হল কেউ তাঁর পাঁজরগুলো ভয়ংকর জোরে খামচে চেপে ধরেছে। তিনি খুব নির্মম হাতেই মনে মনে তিথির শ্বশুরবাড়ির সম্ভাব্য ছবিটা এঁকেছিলেন, কিন্তু এই বাড়িটা তার ধারেকাছেও আসে না। এটা বাড়ি, না বাড়ির প্রেতাত্মা! অদিতির মনে হল, হেলে পড়া বাড়িটা যেন একটা প্রাগৈতিহাসিক জন্তুর মতো গুঁড়ি মেরে বসে আছে। তাঁর কপালে ঠান্ডার মধ্যেও বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠল। এত বাড়ি পেরিয়ে এলেন, তিথি তো তার মধ্যেই কোনো একটাতে থাকতে পারত! তা না হয়ে এই চূড়ান্ত কুৎসিত বাড়িটাতেই তিথি থাকে, এটা মেনে নিতে অদিতির যন্ত্রণা হচ্ছিল। তিনি
কোনোক্রমে বললেন, ‘এই বাড়ি!’ তাঁর স্বরে অবিশ্বাস।
থমকে গেছিলেন বিশ্বনাথও। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন বাড়িটার দিকে। তমালকে দেখে মনে হল সে জোর করে শক্ত থাকার চেষ্টা করছে। অদিতির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ফোরটিন সি, এটাই তো হবে মনে হচ্ছে। আচ্ছা, একটু দাঁড়াও। দেখে আসছি।’
তমাল ঘাসজঙ্গল ডিঙিয়ে একতলার বারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে একটু ইতস্তত করল, তারপর বারান্দায় পা দিল। বারান্দার দরজাটা আধখোলা। অদিতি দেখতে পাচ্ছিলেন তমাল কারও সঙ্গে কথা বলছে। একটু পরে তমাল তাঁদের দিকে ফিরে ইশারা করে ডাকল। অদিতি একবার বিশ্বনাথের দিকে তাকালেন, বিশ্বনাথের মুখেও অবিশ্বাস আর কষ্টের দাগ। অদিতি চাপা গলায় বললেন, ‘এই বাড়িটাই। চলো।’
তাঁরা কয়েক পা এগোতেই বারান্দায় ছুটে বেরিয়ে এল তিথি। তার চুল উশকোখুশকো, পরনের শাড়িটাও আলুথালু। তার বাঁ-হাতে একটা বাটি, হলুদমাখা ডান হাতে একটা পাতলা বেগুনের ফালি। রান্নাঘরে বেগুনে নুনহলুদ মাখাচ্ছিল সে, যখন সীমা গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলেছে, ‘তিথি শিগগির এসো, তোমার মা-বাবা এসেছে, দাদাও।’
তিথি বারান্দার প্রান্তে দাঁড়িয়ে একেবারে বাচ্চা মেয়ের মতো লাফালাফি শুরু করেছে, তার সারা চোখেমুখে আনন্দ বিস্ময় মাখামাখি। সে বারবার বলছে, ‘ও মা, তোমরা চলে আসবে আমি ভাবিইনি—এসো, এসো, দাদা কবে এলি!’
পার্থর সঙ্গে সেদিন যাওয়ার পর তিথি মা-বাবার কাছে আর যায়নি। তমাল কবে এসেছে, কবে রিসেপশনের দিন স্থির হয়েছে এসব সে কিছুই জানে না।
সুধা অভ্যর্থনা করলেন, ‘আসুন আসুন। সীমা ওপর থেকে মোড়া নিয়ে আয় তো। তিথি হাত-টাত ধুয়ে এসো না।’
অদিতি হাসিমুখে বললেন, ‘আবার মোড়া কেন! এই তো এখানে বসছি।’ তিনজনেই তক্তপোশে বসলেন। বিশ্বনাথের মুখে কোনো কথা নেই। তমালও নিঃশব্দে নখ খুঁটছে। সে বিয়ের পর তিথিকে এই প্রথম দেখল, এখনও ধাক্কা সামলাতে পারেনি।
অদিতি সুধার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনি দাঁড়িয়ে কেন? বসুন! দেখুন, আমাদের সম্পর্ক হয়েছে কিন্তু পরিচয় নেই। আমি তিথির মা, উনি তিথির বাবা, আর ও তিথির দাদা তমাল। নমস্কার।’
সুধার মনে হল, এভাবে আবার পরিচয় দেওয়ার কী আছে, তিনি কি বুঝতে পারছেন না কে কোন জন! অদিতিকে নমস্কার করতে দেখে হকচকিয়ে গেলেন তিনি, প্রতিনমস্কারের কথা তাঁর মাথায় এল না।
অদিতিরা আসার আগে সীমা সকালে ছাত্রছাত্রীদের পড়াচ্ছিল। তাদের বসিয়ে রেখে হন্তদন্ত হয়ে সে ওপরে মাধবীর কাছে গেছে। পার্থ তখনও ওপরের ঘরে ঘুমোচ্ছে। তিথি হলুদের হাত না ধুয়েই পার্থকে ডাকতে গেল। তার গায়ে নাড়া দিয়ে বলল, ‘এই ওঠো, শিগগির ওঠো। মা বাবা দাদা সবাই এসেছেন, নিশ্চয়ই রিসেপশনের দিন ঠিক হয়ে গেছে, শিগগির নীচে এসো। আমি যাচ্ছি।’
পার্থ তড়াক করে উঠে বসে চোখ মুছছিল। তিথি ততক্ষণে নীচে নেমে এসেছে। সে হাত ধুয়ে ঘরে আসতেই অদিতি বললেন, ‘তিথি, তুমি ছিলে না, আমরা নিজেরাই আলাপ-পরিচয় করে নিলাম—’
বিশ্বনাথ বললেন, ‘ইয়ে, মিস্টার মল্লিক বুঝি বাড়ি নেই?’
‘উনি তো বাজারে গেছেন—’ সুধা অসহায় বোধ করছিলেন। অদিতি তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনাদের বড় অসুবিধেয় ফেললাম, সকালবেলাটায় সবাই ব্যস্ত থাকেন। আসলে আমরা একদিনে সব সারব বলে বেরিয়েছি। পরশু দিনই রিসেপশন—’ অদিতি কার্ড বার করতে করতে তিথির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘পার্থ কোথায়?”
তিথিও ভাবছিল, পার্থ এত দেরি করছে কেন!
মাধবী সীমার সঙ্গে দুটো মোড়া নিয়ে নীচে এলেন। তিথি এগিয়ে গেল, ‘এসো, বড়দি, এসো মাধুবউদি—আমার মা, বাবা, দাদা। মা, এই যে আমার বড়দি আর ইনি মাধুবউদি।’
মাধবী ঝরঝর করে হাসলেন, ‘সত্যি আপনারা মেয়ের বাড়িতে এলেন তাহলে! আমি জানতাম সব ঠিক হয়ে যাবে। তবে চিন্তা করে করে তিথি শরীরটা খুব খারাপ করে ফেলেছে।’ মাধবী বসতে গিয়েও উঠে পড়লেন, ‘বসুন, চা আনি।’
‘না না, চা খেয়েই তো বেরিয়েছি’, বিশ্বনাথ ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘আজ বরং থাক। আজ একটু তাড়াতাড়ি উঠব। মিস্টার মল্লিকের সঙ্গে দেখা হলে ভালো হত, তা ওঁর বোধ হয় একটু দেরিই—’
অদিতি কার্ড বার করে সুধার হাতে দিতে গেলেন, সুধা একটু ব্যাকুল গলায় বলেলন, ‘উনি এক্ষুনি এসে যাবেন, ওঁকেই কার্ডটা দিলে ভালো হয়। আপনারা আর একটু বসুন।’ সুধা দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন, তাঁর সারা মুখে দুশ্চিন্তা আর অস্বস্তি।
তিথি বলল, ‘মা, মাধুবউদিকে নেমন্তন্ন করব, আমাকে একটা কার্ড দেবে?’
অদিতি হাসলেন, ‘নিশ্চয়ই। তোমার জন্যে গোটা পাঁচেক কার্ড আলাদা করা আছে। তোমার কাকে কাকে বলতে ইচ্ছে হয়
তিথি কার্ডগুলো নিয়ে একটা কার্ডে নাম লিখতে লিখতে বলল, ‘তোমার নামই লিখলাম মাধুবউদি। মাধুবউদি অ্যান্ড ফ্যামিলি। তুমি, সলিলদা, আর রুম্পা, সবাইকে আমার বিয়ের নেমন্তন্ন।’ তিথি হাসছিল।
তখনই হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলেন অলক। তাঁর হাতে বাজারের থলে। তিনি হইহই করে বলছিলেন, ‘আরে কী কাণ্ড কী কাণ্ড অ্যাঁ! আপনারা এসেছেন! আমি তো কিছুই জানতাম না। সবে বাজারে গিয়ে ঢুকেছি, আর——
তাঁর প্রায় সঙ্গেই ঘরে ঢুকল পার্থ। সুধা বলে উঠলেন, ‘তুমি জানলে কী করে—’
‘আরে পার্থ তো গিয়ে ধরল আমাকে বাজারে। আমি সবে কাঁচালঙ্কাটা দর করছি আর ও গিয়ে আমায় টানতে লেগেছে। দৌড়োতে দৌড়োতে এসেছি, বাব্বা! এঁদের চা-টা দাওনি নাকি? চা করো চা করো, সেইসঙ্গে আমাকেও এক কাপ—’
‘না না, আমরা চা খাব না।’ অদিতি কার্ডটা অলকের দিকে এগিয়ে দিলেন, ‘আপনারা সবাই যাবেন দয়া করে। আগামী পরশু, বৃহস্পতিবার…’
মাধবী চা করে নিয়ে এলেন। তাঁর হাতে দুটো কাপ, সীমার হাতে দুটো। বিশ্বনাথ বললেন, ‘আহা, সেই আবার চা করলেন—’ ‘নিন, এই শুধু চা আর বিস্কুটই। তিথি মোড়া দুটো এগিয়ে দে না, ওর ওপরে রাখি।’ মাধবী অলকের দিকে তাকালেন, ‘হাফ কাপ বেশি হয়েছে দাদা, ওইটে আপনার।’
বলবে।’
তিথি উশখুশ করছিল, বলল, ‘মা, চা-টা নিয়ে চলো ওপরে যাবে, আমি কোথায় থাকি দেখবে, বড়োমা মাকে নিয়ে যাই?’
সুধা সারাক্ষণ প্রায় ছায়ার মতো দেয়ালের সঙ্গে মিশে দাঁড়িয়েছিলেন, বিশেষ কোনো কথা-টথা বলছিলেন না। এখনও তিনি কিছু বলার আগেই অলক বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, একশোবার যাবে। যান আপনারা সবাই ওপরে যান ওর সঙ্গে।’
পার্থও ঘরে এসে অবধি একটাও কথা বলেনি। তিথি হঠাৎ যেন কী একটা আন্দাজ করেই দ্রুত পার্থর দিকে তাকাল। পার্থর দৃষ্টি কঠিন। সেই দৃষ্টি অনুসরণ করে তিথির চোখ পড়ল তমালের ওপর। তমালও একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে পার্থর দিকে। তার দৃষ্টি ঠান্ডা, কিন্তু তার মধ্যে ঘৃণার আভাস লুকোনো নেই। তিথি এগিয়ে গিয়ে পার্থর হাত ধরল, হাসতে হাসতে বলল, ‘ও, দাদার সঙ্গে তোমার তো আলাপ করানো হয়নি। এসো—’ তিথি পার্থর হাত ধরে তমালের সামনে নিয়ে এসে বলল, ‘এই যে আমার দাদা। দাদা, পার্থ।’
তমাল সামলে নিয়ে হাত বাড়াল। তিথির মনে হল পার্থ বুঝি হাত বাড়াবে না। কিন্তু একটু সময় নিয়ে পার্থ হাত বাড়িয়ে তমালের হাত স্পর্শ করেই নামিয়ে নিল। তার চোখের দৃষ্টির কোনো পরিবর্তন হল না। তিথি বলল, ‘চলো, আমরা ওপরে যাই, আয় দাদা।’
‘মা বাবাকে নিয়ে যা, আমি আর নাই গেলাম।’ তমাল মাথা নাড়ল, ‘আমি এখানেই বসছি।’
বিশ্বনাথের মন চায়ের কাপে, কিন্তু অদিতির চোখ কিছুই এড়াল না। তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, ও আর গিয়ে কী করবে, ও এখানেই থাক। চলো পার্থ, আমরা যাই।’
তিথি অদিতি আর বিশ্বনাথকে নিয়ে ওপরে চলে গেল। পার্থও গেল সঙ্গে। সুধা আর অলকও ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। সীমা তার আগেই পাশের ঘরে পড়াতে চলে গেছে। তমাল প্রাণপণে নিজেকে সহজ রাখার চেষ্টা করছিল। পার্থর প্রতি তার যাবতীয় অসন্তোষ সে ঢেলে দিচ্ছিল ডান হাতের বুড়ো আঙুলের নখে, দাঁত দিয়ে নখ ছিঁড়ে যাচ্ছিল ক্রমাগত। হঠাৎ মাধবী কথা বলে উঠলেন, ‘বোনকে বড্ড ভালোবাসো, না?’
তমাল চোখের জল ঢাকতে দরজা দিয়ে বাইরে তাকাল।
মাধবী বললেন, ‘চিন্তা কোরো না, এরকম কত হয়! তিথি খুব ভালো মেয়ে, ও ঠিক সব সামলে নেবে। এবার পাশটা করে গেলে—’
তমাল এক ঝটকায় ঘাড় ঘুরিয়ে মাধবীর চোখে চোখ ফেলল, ‘আপনি জানেন না, তিথি ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। পাশ ও অবশ্যই করবে, ওকে আটকানো যাবে না।’
মাধবী হাসছিলেন, ‘তবে!’
তিথি ঘরে ঢুকে জানলা খুলে দিল। বিছানাটা এলোমেলো হয়ে আছে। দ্রুত হাতে সেটা একটু পরিষ্কার করতে করতে বলল, ‘এসো মা, এসো বাবা। এই ঘরে আমি থাকি, মানে আমরা— F
অদিতি সবরকম মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে ঘরে পা দিয়েছিলেন। তিনি নিঃশব্দে চারিদিকে একবার চোখ বুলালেন। বিশ্বনাথ পার্থর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ও, এই ঘরটাও ভাড়া নিয়েছ, নাকি? ফাঁকাই ছিল?’
পার্থ নির্বিকার মুখে বলল, ‘হ্যাঁ এটা ফাঁকাই পড়ে ছিল, পাশের ঘরে একটা ছেলে ভাড়া থাকে।’
তিথি বলে উঠল, ‘না না, আমাদের ভাড়া দিতে হয় না। বাড়িওয়ালা এমনি থাকতে দিয়েছেন। মাধুবউদিই ব্যবস্থা করে দিয়েছেন সব। মা দ্যাখো, ওই খাটটাও মাধুবউদি দিয়েছেন আমাদের শোয়ার জন্য।’
তিথি খুশির স্বরেই কথাগুলো বলছিল। অদিতি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। তাঁর চোখ ক্যাম্পখাটটার দিকে, বিছানাটা অনেকখানি
ঝুলছে। এইটুকু সরু খাটে দুজনে কী করে শুতে পারে তিনি বুঝতে পারছিলেন না। ঘরটা সম্পূর্ণ নিরাভরণ, এককোণে একটা রং-ওঠা কাঠের চেয়ারের ওপর তিথির জামাকাপড় ভাঁজ করা। দেয়ালের তাকে তিথির খাতাবই আর কলেজের ব্যাগ। অদিতির ধাঁধা লাগছিল। এই ঘরে কোনো গৃহস্থ দম্পতি বাস করার চিহ্নই নেই, নেই পার্থর ব্যবহার্য কোনো জামাকাপড়ও। তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বললেন, ‘বাঃ, বেশ ঘর। আমরা আস্তে আস্তে যা দেব-টেব সব এই ঘরেই রাখবে তো?’
অদিতি তিথির দিকে তাকিয়ে কথা শুরু করেও প্রশ্নটা রাখলেন পার্থর দিকে ফিরে। পার্থর মুখে এতক্ষণে হাসি ফুটল। সে ঈষৎ মাথা নেড়ে ঘাড় নীচু করতেই তিথির মুখের হাসি মিলিয়ে গেল, তীক্ষ্ণস্বরে বলল, ‘তোমরা দেবে মানে? কী দেবে?’
‘ওমা, ওরকম করছিস কেন!’ অদিতি তিথির দিকে তাকিয়ে হাসলেন, ‘মেয়ের বিয়েতে লোকে কী দেয়? যা যা তোর দরকার—এই ধর খাটবিছানা, একটা আলমারি—
‘না! একদম না!’ তিথির চোখমুখ অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। সবাই আশ্চর্য হয়ে তাকে দেখছেন, পার্থও। তবে পার্থর বিস্ময়ের সঙ্গে একটা বিরক্তি মেশানো।
তিথি কেটে কেটে বলল, ‘আমার বিয়ে কি তোমরা দিয়েছ যে ওইসব দিতে হবে? আমি তোমাদের কাছ থেকে ওসব কিছু নেব না।’ তিথি একটু থেমে জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভেজাল, বলল, ‘আর তা ছাড়া, এই ঘরটা থেকে আমাদের যে-কোনো দিন চলে যেতে বলতে পারে, আমরা তো ভাড়া দিই না। এখানে খাট আলমারি রাখব কী করে? এই যা আছে ঠিক আছে, আর কিছু দরকার নেই।’ সে জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাচ্ছিল।
অদিতি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলেন, তিনি কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছেন না। পার্থর মুখ ক্রমশ রাগে শক্ত হয়ে উঠছিল, সেটা লক্ষ করেই অদিতি বললেন, ‘আচ্ছা, সে পরে দেখা যাবে। আজ আমরা চলি, অনেক জায়গায় যেতে হবে। হ্যাঁ শোন, তুই কি কাল
রাত্তিরে ওখানে থাকবি? সেদিনের পর আর তো গেলিও না আমাদের কাছে—’
তিথি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছিল, বলল, ‘সময় পাইনি মা, পরীক্ষাটা নিয়ে একটু টেনশন হচ্ছে। ঠিকঠাক পড়া হচ্ছে না তো। কাল…দেখি, বড়োমাকে জিজ্ঞেস করি…’
অদিতিরা নীচে নেমে এলেন। তিথি সুধাকে জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করল না। চিন্তা করে বলল, ‘না মা, থাক। আমি এখানে না থাকলে বড়োমারা ওখানে গিয়ে হঠাৎ করে ফলস্ পজিশনে পড়বে না? তার চেয়ে আমি এখান থেকে সবার সঙ্গেই যাব।’
বিদায় নেওয়ার সময় সুধা রান্নাঘর থেকে এসে দাঁড়ালেন। ইতিমধ্যে অলক গায়ে জল ঢেলে নিয়েছেন, ভিজে লুঙ্গি পরে হি-হি করে কাঁপতে কাঁপতে তিনি বললেন, ‘আবার আসবেন, দুগ্গা দুগ্গা। আমরা সবাই যাব পরশু।’
মা বাবা দাদা চলে যাওয়ার পর তিথির মাথার মধ্যে হঠাৎ একটা বিরাট শূন্যতা ঝাঁপিয়ে এল। কিন্তু সেটা মাত্র কয়েক মুহূর্তের জন্যে। তার পরেই প্রচুর প্রশ্ন মাথা তুলে দাঁড়াল সেই শূন্যতার বুকে। পার্থর সঙ্গে অনেক বোঝাপড়ার দরকার তার। কিন্তু এখন সেই সময় নয়। তাকে কলেজ যেতে হবে। পার্থও হয়তো বেরোবে। তিথি রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বলল, ‘ভাত নেমে গেছে বড়োমা? বেগুনগুলো ভাজি?’
সুধা নীরস গলায় বললেন, ‘সে বেগুন আমার কোনকালে ভাজা হয়ে গেছে। তোমার আর কিছু করতে হবে না। বাবা খেতে বসবে, গেলাসে জল-টল দেবে তো দাও।’
তিথি অপরাধীর মতো গেলাস নিয়ে জল ভরতে যাচ্ছিল। সত্যিই সে আজ রান্নাঘরের কোনো কাজ করতে পারেনি। সুধাকে সবই প্রায় একা হাতে সামলাতে হয়েছে। জল ভরে গেলাস হাতে বাইরে আসতে আসতে তিথি শুনল সুধা বলছেন, ‘সাতসকালে
মানুষ মানুষের বাড়ি এভাবে আসে! এ কী হাঙ্গামা বাপু!’ তিথি দাঁড়িয়ে পড়তেই সুধা মুখ তুলে বললেন, ‘তা, তোমার মা বাড়িতে ব্যবস্থা না করে বাইরে বাড়ি ভাড়া করলেন কেন?’
একটু ভেবে তিথি বলল, ‘আমাদের বাড়িটা খুব ছোটো বড়মা, অত লোকজন এলে কোথায় বসবে?
1
‘বরাবর দেখেছি বাড়ির ছাদেই ম্যারাপ-ট্যারাপ বেঁধে বিয়ে-অন্নপ্রাশন হয়!’
তিথি এবার ঠোঁট কামড়াল, ক্ষুব্ধ গলায় বলল, ‘এটা আমার বিয়ের অনুষ্ঠান নয় বড়োমা, এটা রিসেপশন। মা বাবা আমার বিয়ে দিচ্ছেন না।’
কথাটা বলেই আর দাঁড়াল না তিথি। অলকের আসন পেতে জল রেখে বাথরুমে স্নান করতে চলে গেল। এক্ষুনি তার মাথাটা ঠান্ডা করা দরকার।
রাত্তিরে নীচের কাজকর্ম সেরে এক বালতি জল নিয়ে ওপরে চলে এল তিথি। রোজই ওপরের বাথরুমে জল রাখতে হয়, রাত্রে দরকার হতে পারে। হিমাংশু ফিরে তার ঘরে দরজা লাগিয়ে শুয়ে পড়েছে। তিথি ঘরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে বই খুলে বসল। যদিও সে জানে আজ তার একবিন্দুও পড়া হবে না। মাথার ভেতরটা সারাদিন অগ্নিগর্ভ হয়ে রয়েছে। সে এক-একবারে ভাবতে চেষ্টা করেছে তার এত অশান্তির কারণ কী? ভাবতে ভাবতে তার মনে হয়েছে, আসলে পার্থর সঙ্গে তার একটা ঝগড়া হওয়া দরকার। খোলামেলা সোজাসুজি একটা ঝগড়া। সেটা হচ্ছে না বলেই তার মনের মধ্যে কথা জমে জমে পাহাড় হয়ে উঠেছে। সেই পাহাড়টা একটা আগ্নেয়গিরি। তার মাথায় অষ্টপ্রহর গরম ধোঁয়া। ধোঁয়ার চাপে দম বন্ধ হয়ে আসে। লাভা না উগরানো অবধি
স্বস্তি নেই।
তিথি চেয়ারে বসে ছিল। পার্থ ওপরে এসে দরজা বন্ধ করতেই সে-ও বই বন্ধ করল। পার্থ সেটা দেখে বলল, ‘পড়বে না? আলো নিভিয়ে দেব?’
‘না, তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।’
পার্থ খাটে বসতে বসতে বলল, ‘কী কথা? যা বলবে তাড়াতাড়ি বলো, আমি খুব টায়ার্ড।’ পার্থ হাই তুলল, কিন্তু তার চোখে আত্মরক্ষার সতর্কতা।
তিথি ভাবছিল কোথা থেকে শুরু করবে। ভাবতে ভাবতেই বলল, ‘না পার্থ, আমার একটু সময় লাগবে। তুমি আমাকে কখনো কোনো সময় দাওনি। আজ আমি সময় নেব। দরকার হলে সারারাত। অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর চাই আমার।’
‘সে আবার কী? শোওয়ার সময় কী আরম্ভ করলে!’
‘শোওয়ার সময় ছাড়া তোমাকে কখন পাই আমি, পার্থ? তখনও তো কোনো কথাই হয় না। সারাদিন তুমি আমার কোনো খোঁজই নাও না। আমি কেমন আছি, কী করছি তার কোনো খবর রাখো না। আমার তো তোমাকে কিছু বলার থাকতে পারে। যে কথাগুলো কারও সামনে বলার নয়, একেবারে নিজেদের মধ্যে বলার, ঘরের মধ্যে বলার কথা। কিন্তু তুমি তো শোওয়ার সময় ছাড়া এ ঘরে আসই না। কেন?’
পাৰ্থ কাঁধে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে হাত ওলটাল, ‘আশ্চর্য, তুমি বলতে চাও আমি সবসময় তোমার সঙ্গে এই ঘরে বসে থাকব?’ ‘আমি আদৌ তা বলছি না। আমিও এ ঘরে সবসময় বসে থাকি না তুমি জানো। আমি বলতে চাইছি তুমি এ ঘরে বাস করো না।
শুধু রাত্তিরে আমার সঙ্গে শুতে আস। এটা অত্যন্ত অপমানকর। আমি তোমার স্ত্রী পার্থ! তোমার সঙ্গে আমার শুধু শোয়ার সম্পর্ক নয়!’
‘চুপ করো! বাজে কথা বোলো না।’ পার্থ ধমকে উঠল, ‘কী আবোল-তাবোল বলছ! আমি তোমাকে যথেষ্ট সম্মান দিই, তুমি নিজেই নিজের সম্মান নষ্ট করছ।’
তিথি প্রতিমুহূর্তে ভয় পাচ্ছে এই বুঝি সে কেঁদে ফেলবে, কিন্তু যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে ঠান্ডা গলায় সে বলল, ‘চিৎকার কোরো না, পাশে লোক আছে। সম্মান দেওয়া বলতে তুমি কী বোঝাচ্ছ আমি জানি না। এ বাড়িতে তোমারই কোনো সম্মান নেই, তুমি আর আমাকে কী সম্মান দেবে! সে যাক, কিন্তু তা সত্ত্বেও একটা মেয়ে স্বামীর সঙ্গে যেভাবে সংসার করে, আমার তো তাও নেই। এই যে একটা ঘর পাওয়া গেল, কই এখানেও তো তুমি আমার সঙ্গে থাকো না? আমি যেন একটা বাইরের লোক…একটা…যেন…একটা আলাদা কেউ…, তোমার এমনকী একটা জামাও তুমি এ ঘরে রাখো না…’
‘তুমিই তো পারছ না মিলেমিশে সংসার করতে। নীচে সব ঠিকঠাকই ছিল, মধ্যিখান থেকে অদ্ভুত জেদ করলে আমার সঙ্গে শোবে না। তারপর ওপরের ঘরটা আদায় করলে মতলব করে। মা এতে কষ্ট পায়নি ভেবেছ? আমি যদি আমার সব জিনিসপত্র আলাদা করে এ ঘরে নিয়ে আসি মায়ের কেমন লাগবে?
অন্যদিন হলে তিথি আর পারত না, হয় স্তব্ধ হয়ে যেত নয় কান্নায় ভেঙে পড়ত। আজ তাকেও ঝগড়ার উন্মত্ততা পেয়ে বসেছে, সে চাপা গলাতেই চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘ও! আমি মতলব করে আলাদা হয়েছি! তুমি ওপরে এলে বড়োমা কষ্ট পান! তাহলে শোও কেন আমার সঙ্গে? আসবে না। সেই ব্যবস্থাই তো করেছিলাম, তখন তুমি আমায় কম জ্বালিয়েছ? নীচের ওই দুটো ঘরে, ওইভাবে অসভ্যের মতো একসঙ্গে শোওয়া খুব ভালো ছিল, না? বিয়ে করেছ, একটা ঘরের ব্যবস্থা করোনি। তোমাকে আর কী বলব। নির্লজ্জ, না নির্বোধ!’
পার্থ হিসিয়ে উঠল, ‘বুঝতে পারছি, আমাকে তোমার আর পছন্দ হচ্ছে না। তুমি খুব ভুল করছ তিথি। আমি দেখেছি, তোমার মায়ের সঙ্গে দেখা হলেই তোমার তেজ বাড়ে।’
‘আমার মায়ের সম্বন্ধে একটাও কথা উচ্চারণ করবে না তুমি। লজ্জা করে না, মা যেই বললেন খাট আলমরি দেব, অমনি তুমি ঘাড় নাড়লে! ছিঃ! তুমি আবার কথা বলো!’
পার্থ একটু মিইয়ে গেল। পরক্ষণেই তেড়েফুঁড়ে উঠে বলল, ‘নিশ্চয়ই বলব, বলব না কেন? মেয়ের বিয়েতে সবাই দেয়। দিতে হয়। সীমার বিয়ে হলে আমাদেরও দিতে হবে। এতে লজ্জার কী—
‘ব্যাস ব্যাস ব্যাস! তোমরা সবাই এক ভুল করছ। আমার বিয়ে আমার মা-বাবার ইচ্ছে অনুযায়ী হয়নি, আমি নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করেছি। মনে আছে, যেদিন আমি চলে এলাম তুমি আমাকে কী বলেছিলে? বলেছিলে তুমি নাকি বরাবর চেয়েছ আমি তোমাকে ভালোবেসে একটা সুতোও না নিয়ে ঘর ছেড়ে চলে আসব। তাই তো আমি এসেছি পার্থ! কিচ্ছু না নিয়ে এসেছি। তাই বলে আমার ন্যূনতম প্রয়োজনগুলো তো আমি ফেলে আসিনি। সেটুকু, যেটুকু ভদ্রভাবে আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে গেলে লাগে? সে তো তোমারই দেওয়ার কথা। কেননা আমি নিজে জোগাড় করতে গেলে আমাকে অন্তত পড়াশুনাটা শেষ করতে হবে। তুমি আমাকে সে সময়ও দাওনি। এখনও, আমার পড়ার জায়গা করে দিয়েছেন মাধুবউদি, এমনকি এ ঘরের বালবটাও মাধুবউদির দেওয়া। তুমি একটা দায়িত্বও পালন করেছ? আর আজ তুমি চাইছ আমার মা-বাবা আমাদের সব দেবেন, তুমি সেই
লোভে—’
‘খবরদার তিথি, মুখ সামলে—’
‘দাঁড়াও দাঁড়াও। মুখ পরে সামলাব। আগে তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি। বড়দির সঙ্গে আমার বিয়ের তুলনা করলে
তুমি। আচ্ছা বলো তো, তোমার মতো কোনো পাত্রের সঙ্গে দেবে তুমি বড়দির বিয়ে? দেবে? তখন তোমার মনে হবে না, ছেলের হাতে বোনকে দেওয়ার চেয়ে হাত-পা বেঁধে জলে ফেলে দেওয়া ভালো! কিংবা, তোমার হয়তো মনে হবে না, কিন্তু বড়োমা আর বাবার হবে…’ তিথির চোখ দিয়ে এতক্ষণে জল গড়িয়ে পড়ল, বিকৃত স্বরে সে বলল, ‘নিজের দিকে তাকাও আমার মায়ের সম্বন্ধে অযথা খারাপ কথা বোলো না।’
পার্থ জবাব হাতড়াচ্ছিল। তার সমস্ত মুখ লাল হয়ে গেছে। উপর্যুপরি পর্যুদস্ত হতে হতে সে প্রাণপণে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল, তিথি আবার তাকে আক্রমণ করল, ‘আজ সকালে ওভাবে পালালে কেন?’
‘পালালাম?’ পার্থ ঢোঁক গিলল, ‘পালালাম কোথায়!’
‘ন্যাকামি কোরো না। মা-বাবা আসামাত্রই আমি তোমাকে ডেকেছি। তারপর তুমি কাউকে না বলে—’
‘আমি বাবাকে ডাকতে গেছিলাম। বাবার সঙ্গে ওঁদের দেখা হত না নাহলে।’
‘জানি তুমি এটাই বলবে। কিন্তু এটা মিথ্যে। সেরকম হলে তুমি আগে মা-বাবার সঙ্গে একবার দেখা করে যেতে পারতে, সেটাই উচিত ছিল।’
পার্থ তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি করল, তর্জনী উঁচিয়ে বলল, ‘শোনো তিথি, আমাকে উচিত দেখিও না। বাবাকে ডেকে আনাটাই আমার প্রথম কর্তব্য ছিল। জানো বাবাকে কীভাবে খুঁজে বের করেছি বাজারের মধ্যে!’
তিথি হাসছিল, অগ্নিবর্ষী হাসি, ‘প্রথম কর্তব্য! কর্তব্য মানে বোঝো তুমি? আমার তো বিশ্বাস হয় না। আজ তোমার প্রথমেই
এমন পার্থ,
বাবার কথা মনে পড়ল, তাঁর প্রতিই কোন কর্তব্যটা তুমি করো? করলে বিয়ে করে বউ নিয়ে এসে বাবার ওপর দায়িত্ব চাপিয়ে নিশ্চিন্তে বসে থাকতে পারতে না। উনি উঠতে-বসতে তোমায় অপমান করেন, সে অপমান আমার গায়ে লাগে। অথচ তোমার কোনো বিকার নেই—’
‘না, তিথি। বাবা আমায় কোনো অপমান করেন না। এক ফ্যামিলিতে থাকতে গেলে ওরকম রাগারাগি একটু হয়ই। তোমারই ওতে আঁতে খুব লাগে, আমি কিছু মনে করি না—
‘করো না, জানি। করলে তো তোমার চলে না, তাই করো না। সেইজন্যেই আজও পিঠ বাঁচাতে বাবাকে ডাকতে গিয়েছিলে।’
‘সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছ তিথি। পিঠ বাঁচানো মানে? তোমার মা-বাবা কি আমাকে মারবেন নাকি?”
‘ওঁরা মারবেন কেন? ভয় তো সেখানে নয়। ভয় তোমার ভেতরে। ওই জন্যেই তুমি পালাচ্ছ, মায়ের সামনে দাঁড়াতে পারছ না। খারাপ ব্যবহার করছ। মিথ্যে কথা বলছ——
‘শাট আপ!’ পার্থ এবার রীতিমতো চেঁচিয়ে উঠল।
তিথি ঠোঁটে আঙুল ছোঁয়াল, বলল, ‘চেঁচাবে না। এগুলো তোমার আর আমার মধ্যেকার কথা। আর কাউকে শোনানোর দরকার নেই। তুমি মনে করে দ্যাখো কী কী অভব্যতা করেছ। মায়ের সঙ্গে, আজ দাদার সঙ্গেও। আমাদের বাড়ি গিয়ে সেদিন পরোটা খেতে খেতে বললে তুমি নাকি ভাজা খাও না। এদিকে তেলেভাজা দেখলে তো জিভ দিয়ে জল গড়ায়। আবার বাড়ি এসে খেলে। প্রমাণ করতে চাইলে আমার মা তোমাকে কিছু খেতে দেননি?’
‘মোটেই তা নয়। বাড়িতে না খেলে মা দুঃখ পাবে—’
এতক্ষণ পরে তিথির হঠাৎ ধৈর্যচ্যুতি ঘটল, সে দু-হাতে কান চেপে দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, ‘উফ্ উফ্! মা দুঃখ পাবে—এক কথা বলে চলেছ। তুমি এখানে থাকলে মা দুঃখ পাবে, আমাদের বাড়িতে খেলে মা দুঃখ পাবে।’ বলতে বলতে সে উঠে এসে পার্থর সামনে দাঁড়াল, তীব্র স্বরে বলল, ‘তুমি এখন আমার কাছে আছ, এতে বড়োমা দুঃখ পাবেন না? যাও—যাও জিজ্ঞেস করে এসো মাকে তুমি এখন আমার সঙ্গে শুতে পারবে কি না? যাও!’ কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে পার্থকে এক ধাক্কা মারল।
পার্থ তৈরি ছিল না। টাল সামলে নিয়ে সে উঠে দাঁড়িয়ে সপাটে একটা থাপ্পড় মারল তিথির গালে। তার চোখমুখ হিংস্র হয়ে উঠেছে। ফ্যাসফেসে গলায় বলল, ‘নোংরা মেয়ে একটা। যেমন মা তেমনি মেয়ে। ওই মায়ের শিক্ষায় এই জিনিসই তো তৈরি হবে। এ বাড়িতে এসব একদম চলবে না বলে দিচ্ছি। আর একটা কথা বললে’—পার্থ আবার চড় মারার জন্যে হাত ওঠাল।
তিথি ছিটকে সরে গেল ঘরের মধ্যিখানে। হাত থেকে শাঁখা-পলাগুলো খুলে খুলে ছুড়ে দিল। তার সমস্ত মুখ কান্নায় থই থই, কিন্তু চোখ দুটো অস্বাভাবিক জ্বলছে। তার গলা একটুও কাঁপছে না, বলল, ‘আমাকে তুমি চেনো না পার্থ, একটুও চেনো না। তোমার জন্যে অনেক বদলেছি নিজেকে, আর নয়। এবার থেকে আমি নিজের মতো থাকব। দেখি তুমি কী করতে পারো!’
তার সমস্ত অবয়বে এমন একটা কিছু ফুটে বেরোচ্ছিল, পার্থ তার দিকে এগোতে সাহস করল না। উদ্যত হাত গুটিয়ে নিয়ে অনেকক্ষণ স্থির চোখে দেখল তিথিকে। তার মুখে ক্রুরতার ছায়া পড়লেও তিথি বেশ বুঝতে পারছিল তাকে ওইভাবে দেখা ছাড়া পার্থ আর কিছু করতে পারবে না। তিথিও এক দৃষ্টে চোখে চোখ ফেলে দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর পার্থ হঠাৎ উঠে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল কম্বল গায়ে দিয়ে।
তিথি তখনও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টলছে।
সকালে তিথি যখন নেমে এল, সে অনেকটা বদলে গেছে। ভেতরে এবং বাইরে উভয়তই।
বাড়ি থেকে সালোয়ার-কামিজগুলো নিয়ে আসা সত্ত্বেও সেগুলো এখানে একদিনও পরেনি তিথি। পার্থ বলেছিল, বিয়ের পর সে শাড়ি ছাড়া অন্য কিছু পরলে সুধা দুঃখ পাবেন। তিথির শুনে খুব হতাশ লাগলেও সে আর কোনো কথা বলেনি। আজ তাকে দেখে সুধা হাঁ হয়ে গেলেন, সীমাও। অলক এখনও ঘুম থেকে ওঠেননি।
‘এ কী!’ সুধা উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘আরে, শাঁখাপলাগুলো খুলেছ কেন তুমি!’
তিথি যাবতীয় সংঘাতের জন্যে তৈরি ছিল। আস্তে আস্তে বলল, ‘খুলে ফেলেছি বড়োমা, আমি আর পরব না। শুধু এই চুড়ি আর লোহাই থাকবে।’
‘মানে! পরব না মানে কী? অমনি খুলে ফেললে দুম করে, পার্থর অকল্যাণের কথা ভাবলে না!’
‘এতে কিছু অকল্যাণ হয় না বড়োমা।’ তিথির গলা অচঞ্চল, নীচু—‘মাধুবউদিও তো মাঝে মাঝে শাঁখা-পলা খুলে ফেলেন!’
কথাটা সত্যি। সুধা হঠাৎ কোনো উত্তর দিতে পারলেন না। তারপরই চড়া গলায় বললেন, ‘সে যার যা ইচ্ছে করুক। তুমি তাই বলে আমায় কিছু না বলে খুলে ফেলবে?
‘আসলে কাল রাত্তিরেই ডিসিশন নিলাম তো, ওই জন্যেই তোমায় বলতে পারিনি।’
‘আর এইসব জামা পরেছ কেন? ধিঙ্গি মেয়ের মতো যা ইচ্ছে তাই করলেই হল। কী হচ্ছেটা কী এসব, অ্যাঁ?’ সুধা কোনো খেই পাচ্ছেন না। তিথির অভাবনীয় স্পর্ধায় জ্বলে উঠতে গিয়েও তার ঠান্ডা কথা বলার ভঙ্গিতে বার বার প্রতিহত হচ্ছেন।
‘এটাও কাল ভেবেছি বড়োমা। আমি এখন থেকে চুড়িদার পরব। শাড়িও পরব, তবে সবসময় নয়।’ তিথি একটা বড়ো শ্বাস টানল, ‘তুমি ভেবে দ্যাখো বড়োমা, শাড়ির থেকে চুড়িদার অনেক ভালো পোশাক। এ ছাড়া আমার অনেক চুড়িদার আছে। ওবাড়ি থেকে সেগুলো নিয়ে এলে এখন অনেকদিন আমার কোনো জামা কিনতে হবে না—
অকাট্য যুক্তি, তিথি আজ সমস্ত তর্কের উত্তর সাজিয়ে এনেছে। সুধা খণ্ডন করতে পারছেন না, অসহায় রাগে ছটফট করছেন। সীমার সমস্ত মুখে থমথম করছে মেঘ, কিন্তু তারও মুখে কোনো শব্দ নেই।
লুঙ্গি সামলাতে সামলাতে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন অলক, সদ্য ঘুমভাঙা মুখে বিরক্তি আর বিস্ময় মিশিয়ে বললেন, ‘কী হয়েছে অ্যাঁ! সকালবেলায় এত চেঁচামেচি কীসের?” তাঁর প্রশ্ন সুধাকে।
সুধা এবার সত্যি চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘চেঁচামেচি করব না! দ্যাখো একবার ওই দিকে তাকিয়ে, কী সং সেজেছে। শাঁখা-পলাগুলো সব চুকিয়েছে। হবে না! কী বাড়ির মেয়ে! কাল ওর মাকে তো দেখলাম—’
তিথির মুখ শক্ত হল, কিন্তু ঠোঁট চেপে থাকল সে। অযথা শক্তিক্ষয় করে লাভ নেই। তাকে যুঝতে হবে। যুঝতে গেলে সংযত থাকা প্রয়োজন।
অলক তিথিকে দেখছিলেন, সুধার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, ‘তা ওকে খারাপ কিছু তো লাগছে না? বাচ্চা মেয়ে। মৌ-চৌরা তো আজকাল এইরকমই পরে-টরে দেখি— 1
সুধা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন, ‘বাচ্চা? বাচ্চা মেয়ের এই ধরন? শাঁখা খুলে ছেলের অকল্যাণ করা, আবার মুখে মুখে তর্ক—ও বাচ্চা!’
অলক হাত নাড়লেন, লুঙ্গির গিঁট বাঁধতে বাঁধতে বললেন, ‘হুঁঃ, ছেলের অকল্যাণ! বউ শাঁখা পরলেই ওই ছেলের কল্যাণ হবে ভেবেছ? অকালকুষ্মাণ্ড! নাও নাও, চা দাও।’ অলক বাথরুমের দিকে হাঁটা লাগালেন।
তিথি রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতে যাচ্ছিল। সুধা ফুঁসছেন, তাঁর রাগ গিয়ে পড়েছে অলকের ওপর, ‘বাচ্চা! আমার ওর বয়সে ছেলেমেয়ে হয়ে গেছে। কই, বাচ্চা বলে আমার ওপর তো তোমার, তোমার বাপ-মায়ের কোনো দরদ দেখিনি——
তিথি খেয়াল করল, এতক্ষণ সীমার মুখ দেখে মনে হচ্ছিল তিথির এই বেয়াদপি তারও অসহ্য লাগছে। কিন্তু আস্তে আস্তে তার মুখ যেন স্বাভাবিক হয়ে আসছে। সে বলল, ‘নাও মা, চুপ করো। এক্ষুনি আমার কাছে পড়তে আসবে—
সুধা এই সমূহ পরাজয় মেনে নিতে পারছিলেন না। তিথি খুব সহজ সুরে সীমাকে বলল, ‘তুমি একদম চুড়িদার পরো না কেন বড়দি? আমারগুলো আমরা ভাগাভাগি করে পরব, হ্যাঁ! ফ্রি সাইজ তো, তোমার অসুবিধে হবে না—
‘না। সীমা ওসব পরে না।’ সুধা আবার চেঁচালেন।
সুধার রাগ অগ্রাহ্য করল সীমা। তার মুখে হাসির আভাস খেলছে, অনিশ্চিত স্বরে বলল, ‘সবাই তো পরে, কিন্তু… আমাকে কি মানাবে?’
‘খুব মানাবে বড়দি। দেখো, বড়োমাও অবাক হয়ে যাবেন।’
‘সীমা!’ সুধা ভাবতে পারছেন না সীমা তাঁর সঙ্গে এমন বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে, তাঁর স্বরে রাগের সঙ্গে কান্না মিশল, ‘ও! তোমরা সবাই তবে একজোট! আমার কথা কেউ মানে না।’
‘বড়োমা—’ তিথি কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই সীমা চেঁচিয়ে উঠল, ‘আচ্ছা বেশ, আমি পরব না। হল তো? একজোট আবার কী! আমি কোনো জোটে নেই, আমি একা।’ সীমা দুম দুম করে পা ফেলে ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকে গেল। সুধা চোখে আঁচল দিলেন।
তিথি মিনিট কয়েক দাঁড়িয়ে থেকে রান্নাঘরে চলে গেল। কাল সারারাত ঘুম হয়নি এক ফোঁটা। ঠান্ডা মেঝেতে শুয়ে ঠান্ডাও লেগেছে। মাথা ছিঁড়ে পড়ছে যন্ত্রণায়। তার ওপর আবার অশান্তি। কিন্তু তিথি দেখল, তার ভেতরে ভেতরে একটা অদ্ভুত আরামবোধ ছড়িয়ে পড়ছে। এটা কি খুব খারাপ? তার জন্যে এই সংসারে শান্তি নষ্ট হোক, এটাই কি সে চাইছে? তিথি নিজেকে ঠিক বুঝতে পারছিল না। টগবগ করে ফুটে ওঠা চায়ের জলের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার হঠাৎ নিজেকে খুব ঘেন্না করতে ইচ্ছে করছিল।
আশ্চর্য, তিথি কিছুতেই নিজেকে ঘেন্না করতে পারছিল না।
তিথির ঘর দেখে অদিতি তাকে খাট আলমারি ইত্যাদি কিছু নিতান্ত প্রয়োজনীয় সামগ্রী দেবার কথা ভেবেছিলেন ঠিকই, কিন্তু চিরাচরিত রীতি মেনে তাকে শাড়ি-গয়না দেওয়ার কথা ভাবেননি। প্রথমত, গয়না ইত্যাদিকে তিনি নিজে কোনোদিনও তেমন গুরুত্ব দেননি। তাঁর বিশ্বাস, বিয়ে করে ফেলেছে বলেই তড়িঘড়ি তিথিকে ওইসব দিতে হবে, এই ধারণার কোনো মানে নেই। তাঁর যা দেওয়ার, সেসব পরে দেবেন বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অদিতি। কিন্তু রিসেপশনের দিন তিথিকে দেখে তিনি আবার ধাক্কা খেলেন। তাঁর মনে হল, তবে কি তিথিকে তাঁর কিছু দেওয়াই উচিত ছিল, পার্থকেও?
তিথিরা পৌঁছিয়েছে সময়ের একটু আগে আগেই। মাধবীরা আসতে পারেননি, রুম্পার কাল রাত্রি থেকে হঠাৎ জ্বর এসে গেছে। অদিতি সবাইকে অভ্যর্থনা জানাতে জানাতে দেখলেন, তিথি আজও সেই শাড়িটাই পরে এসেছে যেটা পরে সে সেদিন বাড়িতে এসেছিল। তবে তার হাতে আজ শাঁখা-পলা নেই। সিঁথির সিঁদুরও কপালের সীমায় এসে থেমে গেছে। অদিতি আশ্চর্য হলেন,
খুশিও হলেন। তারপরই একটা অদ্ভুত বিষাদে ছেয়ে গেল তাঁর মন। সেদিন তিথিদের বাড়িতে ঘুরে এসেও, সব দেখেও, তিনি এটা ভাবতে পারেননি যে তিথি আজও সেই একই শাড়ি পরে আসবে। পার্থর পরনেও সেই অতি সাধারণ পাঞ্জাবি আর প্যান্ট। তার খয়েরি সুতির পাঞ্জাবির তলা থেকে উঁকি দিচ্ছে সবুজ সোয়েটার। তিথির গায়ে আজও কোনো গরম কিছু নেই। সুধা অলক আর সীমার বেশভূষাও সেরকমই।
অলক এসেই বিশ্বনাথের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলেন। সুধা আর সীমার মুখ বিবর্ণ ফ্যাকাশে। অদিতি কখনো হাসতে দেখেননি।
আর পার্থর মুখ কঠিন। এই ছেলেটিকে
তিথিকে একপাশে ডেকে এনে অদিতি বললেন, ‘হ্যাঁরে, এই শাড়িটাই পরে এলি?’
‘কেন মা, খুব খারাপ দেখাচ্ছে?’
‘তা নয়, তবে—’
‘জানি মা। মাধুবউদিও বলছিলেন সেজেগুজে আসতে। শাড়ি, সোনার হার, বালা-টালা বার করে দিয়ে বললেন, ‘পরে যা।’ আমি নেইনি। সবাই আমায় দেখে হাসবে হয়তো, তোমাদেরও মান থাকবে না। কিন্তু কী করব বলো। এইটাই যে সত্যি—’ তিথি নিজের দিকে তাকাল, বলল, ‘এটাই আমার সবচেয়ে ভালো শাড়ি, বড়োমা পুজোয় দিয়েছেন—’
অদিতির কান্না আসছে, ‘আমি যে কেন তোকে কিছু দিলাম না সেটা তুই——
‘আমি জানি। ওসব নিয়ে আমি ভাবি না। আমি যেভাবে চলে এসেছিলাম তারপর তোমাদের এভাবে মেনে নেওয়াই যথেষ্ট। তুমি
কিছু দিলেও আমি নেব না—’ তিথি হাসল, ‘ভেবো না মা। আমি খুব ভালো আছি। আমি দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। দেখো, ঠিক দাঁড়িয়ে যাব।’
‘তিথি—’ অদিতি ভাঙা গলায় কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, বলা হল না। অভ্যাগতরা আসতে শুরু করেছেন। সপরিবারে ঘরে ঢুকলেন অদিতির দাদা, তিথির বড়োমামা।
তিথি হাসিমুখে এগিয়ে গেল, ‘এসো বড়োমামু, মাইমা এসো—’ সে হেসে হেসে আলাপ করাচ্ছিল তার স্বামী আর শ্বশুর-শাশুড়ি-ননদের সঙ্গে। মামা মাইমা আর মামাতো দাদার মুখে অকৃত্রিম বিস্ময়, তাঁরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। তাঁদের সপ্রশ্ন বিস্ফারিত দৃষ্টি আনাগোনা করছিল পার্থ সুধা অলক সীমা থেকে অদিতির ওপরে। তিথি গ্রাহ্য করল না। অদিতিও। তিথি হাসিমুখে বলল, ‘ইশ্ কতদিন পর তোমাদের সঙ্গে দেখা হল, কেমন আছ তোমরা সব…’
সেই রাত্রের পর পার্থর সঙ্গে তিথির কথা বন্ধ, সেই সকালের পর থেকে সুধাও তার সঙ্গে পারতপক্ষে একটা কথাও বলছেন না। এমনকী সীমাও নিজের ভুল বুঝতে পেরে তিথিকে এড়িয়ে চলছে। আজ তিথির আশঙ্কা হচ্ছিল পার্থ রিসেপশনে আসতে আবার আপত্তি না করে। তাহলে মা-বাবাকে চূড়ান্ত অপদস্থ হতে হত। কিন্তু অলকের উৎসাহের আতিশয্যে তেমনটা ঘটতে পারেনি। তিথি জানে, অলক বিনা নেমন্তন্নেও অনুষ্ঠানে গিয়ে খেয়ে আসেন, ভোগের খিচুড়ি নিয়ে ছেলেমানুষের মতো লোভ করেন। তিনি আজ দুপুর থেকেই আসার জন্যে তৈরি হয়ে বসে ছিলেন। তিথির আশঙ্কা ব্যর্থ করে অন্যরাও বেঁকে বসেননি।
পার্থ সর্বাঙ্গে উৎকট গাম্ভীর্য ধারণ করে বসে আছে। থাক। তিথিকে আজ হাসতেই হবে।
৩
পার্থ পার্থ পার্থ তুমি আমাকে একটুও ভালোবাসো না পার্থ, কখনো কি ভালোবেসেছিলে?’ তিথির ঠোঁট নড়ছে না, কিন্তু সে অনবরত কথা বলে চলেছে। সে কথা কেউ শুনতে পাচ্ছে না। সে যেন ভাসতে ভাসতে তলিয়ে যেতে যেতে এত দূরে চলে গেছে যেখান থেকে কারও সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব নয়।
তার কী হয়েছে, তিথি বুঝতে পারছে না। শুধু চূড়ান্ত মানসিক অবসাদে আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে সে। রোজ সকালে ঘুম ভেঙে বিছানা ছাড়ার জন্যেও যে উৎসাহটুকু নিতান্ত জুরুরি, সেটুকুও যেন ফুরিয়ে গেছে তার। তার চোখ চশমাহীন, সিলিং-এর দিকে নিবদ্ধ। কিন্তু তার চোখের সামনে অন্তহীন ঘটনার স্রোত বয়ে যাচ্ছে। এই ঘটনাগুলো ঘটে গেছে, তাদেরই উপর্যুপরি ধাক্কায় ধাক্কায় আছড়ে পড়েছে তিথি, অথচ সেই ঘটনাগুলোই তার আধো-সচেতন মস্তিষ্কে বার-বার হানা দিয়ে তাকে আরও কাবু করে ফেলছে তাড়া খাওয়া পাখির ছানার মতো।
গত রাত্রি থেকে এই ওপরের ঘরে একাই শুয়ে আছে তিথি। পার্থ কাল ওপরে আসেনি। এখনও ঘরের দরজা জানলা সব বন্ধ। শুধু ঘুলঘুলি, ভাঙা জানলার ফাঁকফোকর আর দরজার তলা গলে কয়েক দানা মনমরা আলো ছড়িয়ে পড়েছে ঘরে। সকাল হয়ে গেছে অনেকক্ষণ, বেলা হতে চলল। তিথি বিছানা ছেড়ে ওঠেনি, নীচে নামেনি। সকাল থেকে প্রায় সবাইই ডেকে গেছেন—সুধা, মাধবী, পার্থ। চশমাহীন শূন্য দৃষ্টিতে তিথি দেখেছে সুধার বিরক্ত মুখ, মাধবীর করুণ মুখ, পার্থর ক্রুদ্ধ মুখ। কোন ওপার থেকে যেন তাদের কথা ভেসে আসছিল, তিথি ভালো শুনতে পাচ্ছিল না।
অবশ্য বিছানা ছেড়ে সে একবারও ওঠেনি, এ কথাটা ঠিক নয়। ভোরের দিকে ঘুম ভেঙে যাওয়ার পরই বাথরুম পেয়ে গেছিল তার। বড়ো নয়, ছোটো। তখনই বিছানা ছাড়তে গিয়ে টের পেয়েছিল তিথি যে তার কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। তার মাথা
হালকা অথচ ভারী, শরীরটা যেন নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে একটা পেল্লায় যন্ত্র, এটাকে নিয়ে সে আর ছেঁচড়ে ছেঁচড়েও চলতে পারছে না।
কোনোরকমে বাথরুম অবধি পৌঁছে বাথরুমের নালির মুখে উবু হয়ে বসে নিজেকে মুক্ত করে দিল তিথি। কাল রাত্রে ওপরে আর জল আনা হয়নি, তবে বাথরুমে হিমাংশুর বালতিতে জল আছে, ঢেলে দিলেই হবে। পরে নাহয় নীচ থেকে জল এনে হিমাংশুর বালতিটা ভরে দেবে সে! ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ তার প্রায় ঘোর ঘোর অবস্থাকে একটা ঝাঁকুনি দিল তার ষষ্ঠেন্দ্রিয়। মুহূর্তের মধ্যে তার মনে হল বাথরুমটাতে সে একা নেই। যন্ত্রচালিত বিমূঢ়ের মতো সে ঘাড় ফেরাতেই দেখতে পেল পায়খানার দরজা বন্ধ, তার নীচের ফাটা অংশ দিয়ে পায়খানার পাদানির ওপর পা দেখা যাচ্ছে। হিমাংশু পায়খানায়।
তিথির প্রথমটায় মনে হয়েছিল সে অজ্ঞান হয়ে যাবে। কিন্তু হল না। তখন তার শরীরের মধ্যে থেকে হু-হু করে তরল মুক্ত হচ্ছে বেগে, সেই মাঝপথে বেগ সংবরণ করে উঠে আসা অসম্ভব। মূর্ছাহতের মতোই শেষ হওয়া অবধি অপেক্ষা করতে হল তাকে, মূর্ছাহতের মতোই জল ঢেলে উঠে এল তিথি। বস্তুত টলতে টলতে সে যখন ঘরে এসে শুয়ে পড়ল, তার মনে হচ্ছিল সংজ্ঞা হারাতে পারলেই এই জলজ্যান্ত দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি পেত সে।
‘আমি তোমার কাছে কখনো কিছু চাইনি পার্থ, আর কখনো চাইবও না…’ তিথি ঠোঁট না নাড়িয়েই আবার বলল। তার ডান চোখের কোণ থেকে গড়িয়ে গেল একটা গরম জলের ধারা।
ঘরের কোণে পড়ে আছে একটা ছোটো ট্রাঙ্ক। পার্থর কেনা। তিথি পার্থর কাছে ওটা চেয়েছিল বাড়ি থেকে তার জামাকাপড়গুলো নিয়ে আসবে বলে। আলমারি-টালমারির স্বপ্ন সে দেখে না। কলেজের হোস্টেলে তার সহপাঠী রুমকির ঘরে সে এইরকম একটা ট্রাঙ্ক দেখেছে। অনেক দ্বিধা সংকোচ কাটিয়ে নিজের মধ্যে নিজের সঙ্গে অনেক যুঝে সে পার্থকে বলতে পেরেছিল, ‘শোনো, এবার ভাবছি বাড়ি থেকে জামাগুলো নিয়ে আসি। আমাকে একটা বাক্স কিনে দেবে?”
‘বাক্স!’ পার্থ হাসল, ‘এই মুহূর্তে আমার কাছে বাক্স কেনার পয়সা নেই যে, তিথি।’
তিথি ঠিক এই উত্তরের জন্যেই প্রস্তুত ছিল। আজকাল তার কেমন সন্দেহ হচ্ছে, পার্থ নিজেকে যতটা কপর্দকহীন দেখাতে চায়, ততটা হয়তো সত্যি সত্যিই নয়। এর মধ্যে অনেকটাই তার দায়িত্ব এড়ানোর ফিকির।
জীবনে যা সে এর আগে কখনো করেনি, সেটাই করল তিথি। পার্থকে চাপ দিল। বায়নার সুরে বলল, ‘প্লিজ সোনা, একটা বাক্সের কত আর দাম হবে? এক্ষুনি না হোক, ক-দিন পরে কিনে দিয়ো? নইলে কোথায় রাখব বলো জামাকাপড়!’
পার্থকে দেখে মনে হল সে যেন গভীর দুশ্চিন্তায় পড়েছে। তিথি দেখেও দেখল না। এতদিন ধরে সে তো এই একই জিনিস দেখে আসছে। কিচ্ছুই না চেয়ে তার আজ এই অবস্থা। আজ যখন একবার সে চেয়েছে, তখন পিছু হটবে না। দেখা যাক, অন্যরকম কিছু হয় কি না!
তারপরের দু-সপ্তাহ এই নিয়ে আর কোনো কথা তোলেনি তিথি। পার্থও কিছু বলেনি। সম্ভবত সে ভুলে গেছিল। অবশেষে একদিন রাত্রে চোখের জল ফেলল তিথি। বলল, ‘তুমি এটুকুও পারলে না তাহলে!’
এই ঘটনার দু-দিন পর, গত পরশু কলেজ থেকে ফিরে তিথি দেখল পার্থ বাড়িতে তার জন্যে অপেক্ষা করছে। তাকে দেখামাত্র বলল, ‘চলো, তোমার বাক্সটা নিয়ে আসি।’
তিথি যথেষ্ট ক্লান্ত ছিল, কিন্তু পার্থর প্রস্তাব ক্লান্তি দূর করার পক্ষে যথেষ্ট। কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকাল সে, মৃদু হেসে বলল, ‘সত্যি!’ দুজনে একসঙ্গে বেরিয়ে বাসে ওঠার পর তিথির খুব ভালো লাগছিল। মনে হচ্ছিল—ইশ্ কতদিন তারা দুজনে বেড়াতে
বেরোয়নি, এ বাড়িতে আসার পর তো একদিনও নয়। আগে তারা রোজ কত কত পথ পাগলের মতো ঘুরে বেড়িয়েছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, পরস্পরকে নিবিড় ছুঁয়ে ছুঁয়ে। এখন আর সেসব করার কথা যেন ভাবাই যায় না। কেন যে যায় না! তিথির মনটা ক্রমশ বিষণ্ণ হয়ে উঠছিল। ওই সমস্ত সময় কি চিরদিনের মতো হারিয়েই গেল তাদের জীবন থেকে? খুব পুরোনো হয়ে গেছে কি তারা, পরস্পরের কাছে! প্রথম প্রেমের সেই অদ্ভুত কড়িমধ্যম আর কোনোদিনও বাজবে না!
তিথি লেডিজ সিটে বসার জায়গা পেয়ে গেছে। পার্থ বসতে পায়নি। বাসে বেশ ভিড়। বাসের হ্যান্ডেলধরা পার্থর হাতদুটো ছাড়া তাকে একটুও দেখতে পাচ্ছে না তিথি। ওইদিকেই তাকিয়ে থাকল সে, গাঢ় ব্যাকুল দৃষ্টি দিয়েই ওই হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে পার্থকে সে মনে মনে গভীর আদর করছিল।
দোকানে গিয়ে পার্থ যে ট্রাঙ্কটা পছন্দ করল, তাতে তিথি অবাক না হয়ে পারল না। নীচু গলায় বলল, ‘এটাতে যে ধরবে না…’
পার্থ মুখে কর্তৃত্ব ফুটিয়ে হাসল, ‘যথেষ্ট ধরবে। তোমার ক-টা জামাকাপড় যে এতে ধরবে না।’ দোকানদারের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এটা রাউন্ড করেই ধরুন। একশো কুড়ি-টুড়ি না, ওই একশোই দেব।’
দোকানদার দু-একবার গাঁইগুই করে হাঁক দিল, ‘এই এটা নামা দিকি। আর একটু পুঁছে-চুঁছে দে। আপনি এদিকে আসুন দাদা, বিলটা লিখি…পাঁচটা টাকা দিয়ে দেবেন দাদা, ওই পাঁচ টাকাই লাভ—’
‘হ্যাঁ, তা না আরও কিছু। পাঁচ টাকা লাভ রেখে ব্যাবসা করছেন বললেই হল?’ পার্থ দোকানদারের সঙ্গে এগোতে এগোতে বললতিথির পা চলছিল না। দোকানের বাচ্চা চাকর এসে তাদের পছন্দ করা ট্রাঙ্কটা নামিয়ে ঝাড়ন দিয়ে মুছছে। তিথি চুপ করে যাচ্ছিল। পুরো ঘটনাটাই ঘটে গেল এত দ্রুত, তার যাবতীয় ভূমিকাকে এমন অনায়াসে অগ্রাহ্য করে, সে কিছু বলারই অবকাশ
পায়নি।
। দেখে
ফেরার পথে রিকশায় চেপে পার্থ বলল, ‘কী, এবার খুশি তো?”
তিথি নিরুত্তর। তার হাঁটুতে চাপ দিল পার্থ, ‘ওফ্, তোমাকে নিয়ে যে আর পারা যায় না দেখছি। দেখবে এটাতেই সব সুন্দর ধরে যাবে—’
‘যাবে তো?’ তিথি এমনভাবে প্রশ্নটা করল, যেন পার্থর কথাটাই অমোঘ সত্য হবে। তিথি জানে এই ট্রাঙ্কে তার সব জামাকাপড় ধরা সম্ভব নয়, সব কেন বেশিরভাগই ধরবে না, তবু সে আবার অসহায় বিশ্বাসে পার্থর ওপরই একান্ত নির্ভর করতে চাইল।
‘যাবে, যাবে, আমি বলছি দেখো, বিশ্বাস না হয়, কালই যাওয়া যাবে তোমাদের বাড়ি গিয়ে নিয়ে আসা যাবে সব।…আসলে তোমার কোনো আইডিয়া নেই, তাই বলছ…’
তিথি অভিমান করতে গিয়েও করল না। পার্থ যখন এত জোর দিয়ে বলছে তখন তাই হবে। সত্যিই তার এসব ব্যাপারে খুব একটা ভালো ধারণা তো নেই। আন্দাজের ওপর ভিত্তি করে মন অস্থির না করে বরং বিশ্বাস করে নিশ্চিন্ত থাকাটাই শ্রেয়। তিথি খুশি হওয়ার চেষ্টা করল। এই প্রথম তাদের নিজস্ব একটা জিনিস হয়েছে, এমনি করেই একটু একটু করে তারা সংসার পাতবে।
বাড়িতে ঢুকেই উচ্ছ্বাসের সঙ্গে সুধাকে ডাকল সে, ‘ও বড়োমা! দেখবে এসো একটা বাক্স কিনেছি।’ তার মনে আর খুঁতখুঁতুনি নেই, বরং সে আনন্দে ঝলমল করছে। কিন্তু সুধার কাছ থেকে যে প্রতিক্রিয়া এল, তাতে আবার এক ধাক্কায় স্বপ্নের সংসার থেকে বাস্তবে আছাড় খেল সে।
সুধা তীক্ষ্ণ চোখে বাক্সটা দেখলেন। তারপর তিথির দিকে না তাকিয়ে পার্থকে বললেন, ‘যা পেলে সব ঢেলে দিয়ে এসেছ তো! বেশ করেছ। এবার এইটা নিয়ে তো ওই ওপরের ঘরেই তুলবে, না কি?’
পার্থ কোনো জবাব না দিয়ে বাথরুমে চলে গেল। দু-মুহূর্ত তিথির দিকে কঠিন মুখে তাকিয়ে থেকে সুধাও চলে গেলেন ঘরে। ট্রাঙ্কটা প্যাসেজের পাশে রাখা। সেইদিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিঃসাড়ে দাঁড়িয়ে রইল তিথি। ঘর থেকে বেরিয়ে এল সীমা, ঝড়ের মতো কলতলার দিকে যেতে যেতে ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘কী এটা রাস্তার মাঝখানে, সরিয়ে রাখতে পারছ না?’
রিসেপশনের পর এই মাস খানেক সময়ের মধ্যে তিথি কয়েক বার মায়ের কাছে এসেছে। প্রতিবারই একা, কলেজ থেকে ফেরার পথে। একদিনও রাত্রে থাকেনি। তার ঘন ঘন মায়ের কাছে আসা নিয়েই ও বাড়িতে চাপা অসন্তোষ চলে। তিথির মনে হয়, রাত্রে সে বাড়ি না ফিরলে তাই নিয়েও আরও অশান্তি হবে। তা ছাড়া মায়ের কাছে থাকার ব্যাপারে তিথি নিজেও ঠিক স্বস্তি বোধ করে না। যখনই সে বাড়িতে আসে, তার সঙ্গে অদিতির ক্রমাগত একটা সূক্ষ্ম মনস্তাত্বিক বোঝাপড়া চলতে থাকে। প্রতি মুহূর্তে তিথির ভয় হয় এই বুঝি মা সমস্ত বুঝে ফেললেন। সে বুঝতেও পারে যে তাকে দেখেই মা অনেকটাই বুঝতে পারেন আসলে সে কেমন আছে, তবুও প্রাণপণে লুকোতে চায়। সেটা বুঝতে পেরেই অদিতিও প্রাণপণে লুকোতে চান যে সত্যিই তাঁর বুঝতে কিছু বাকি নেই। তিথির শ্রীহীন বিষণ্ণ মুখ দেখেই তাঁর সব বোঝা হয়ে যায়। কিন্তু তিনি একটা কথাও জিজ্ঞাসা করেন না। নিজের মেয়েকে ভালোই চেনেন তিনি। নিজে থেকে যেটুকু না বলবে সে, তার বাইরে মায়ের কোনো প্রশ্নও সহ্য করবে না।
কথাবার্তাও তো হয় না বিশেষ। তিথি প্রধানত বইপত্র আনতেই যায়। খাটে বসে বসে দুটো-একটা কথা বলতে বলতেই হঠাৎ কেমন এলিয়ে গিয়ে নিথর হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। আসলে, যে ক্যাম্পখাটটায় রাত্রে তারা শোয়, সেটাতে দুজনে শোয়া যায় না। পার্থ যখন তার শরীর আঁকড়ে থাকে তখনকার কথা আলাদা, কিন্তু পাশাপাশি শুয়ে ঘুমোনোর পক্ষে সেটা ভয়ংকর অপরিসর। দুমড়ে-মুচড়ে কাত হয়ে পার্থকে যথাসাধ্য জায়গা দেয় তিথি, কেননা পার্থর চিত হয়ে শোয়ার অভ্যাস। বিছানা ঝুলে থাকার জন্যে সকালে উঠে তিথির কাঁধে ঘাড়ে পিঠের পেশিতে টনটন করতে থাকে। কিন্তু মুখ ফুটে কাউকে কিছু বলে না সে। বলে কী লাভ, তার মনে হয়, এই একই ব্যথা নিশ্চয়ই পার্থরও হচ্ছে।
কিন্তু বাড়িতে এসে খোলামেলা পরিষ্কার বিছানায় বসে তার শরীর আর বশে থাকে না। দু-দণ্ডের আরামে তার চোখ লেগে আসে। তা ছাড়া ধকলও তার যায় খুবই। কলেজে যাওয়া-আসা, বাড়ির কাজকর্ম, পরীক্ষার প্রস্তুতি। তার হাড়-জাগা ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে না পেরে অদিতি রান্নাঘরে চলে যান খাবার বানিয়ে আনতে। খাবার নিয়ে এসে তিথিকে ডাকতেই সে ধড়মড় করে উঠে বসে শ্রান্তিতে লাল চোখে ঘড়ির দিকে তাকায়, বলে, ‘ইশ্ খুব ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। দেরি হয়ে গেল।’
গোগ্রাসে খাবার মুখে পুরতে থাকে সে। অদিতি বলেন, ‘আহা আস্তে। আস্তে খা, বিষম লাগবে। অত তাড়ার কী আছে।’ একটু ইতস্তত করে বলেন, ‘এর পর যেদিন আসবি, নাহয় বাড়িতে বলেই এলি…একদিন এখানে থাকলেও তো পারিস—’
‘না মা! আমি না ফিরলে বড়োমার বড্ড কাজের প্রেশার পড়ে। দু-বেলা সব রান্না করা, এখন অবশ্য শীতকাল, ওবেলার ডালটালগুলো থাকে। কিন্তু এতজনের রুটি সব বড়োমাকে একা করতে হবে আমি না থাকলে। বড়দি পড়াতে যায় তো—’
অদিতি কিছু বলেন না। তাঁর অবাক লাগে ভাবতে যে এই মেয়ে ক-দিন আগেও কাজের নামে গায়ে জ্বর এনে ফেলত, ছেলেমানুষ আর খামখেয়ালি বলে তাকে কোনো কাজের ভার দিতেও সাহস হত না। সেই মেয়েকে আজ কী খাটনিটাই না খাটতে হচ্ছে। মেয়েরাই সংসারের জন্যে পারে নিজেদের এভাবে বদলে ফেলতে, এতখানি নিঃশেষে ঢেলে দিতে।
অদিতি তিথির কলেজের ব্যাগটা খুলে তার মধ্যে কোনোদিন একটা ক্রিমের কৌটো, কোনোদিনও বা একটা ভেসলিনের টিউব ভরে দেন। এর বেশি তাঁর সাহস হয় না। তিথি যদি মনে করে তিনি ওকে দয়া করছেন। তিথি মাথা নাড়ে, বলে, ‘ওহ্ মা, বইয়েই আর জায়গা নেই ব্যাগে, আবার কী ভরছ—’
‘কিছু না, তিথি। তোর ঠোঁট বড্ড ফেটেছে, শুধু জিব দিয়ে ভেজাচ্ছিস, অমনি করলে তো রক্ত পড়বে। মনে করে ভেসলিনটা লাগাস।’
তিথি কিছু বলতে পারে না। ভালো লাগে তার, কান্নাও পায়। ভেতরে ভেতরে কোথায় যেন এও তার মনে হতে থাকে যে সে হেরে যাচ্ছে। নিজের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো মায়ের হাত থেকে নিতেও যে এত লজ্জা এটা তো জানত না এতদিন। মাথা নীচু করে চলে আসে সে। এইভাবেই চলছে।
কাল তিথি সিঁড়ি দিয়ে উঠল হইচই করতে করতে, ‘আমরা একটা বাক্স কিনেছি, জানো মা! আজ সব জামাকাপড়গুলো নিয়ে যাব।’
বাক্স! একটা বাক্স কিনে তিথি এত খুশি! অদিতি নিজেকে বহুকষ্টে সামলে নিলেন। পার্থও এসেছে আজ। তার মুখে প্রচ্ছন্ন অভিমান। অদিতির দিকে সরাসরি তাকাচ্ছে না, কেমন যেন ট্র্যাজিক নায়কের মতো ওর হাবভাব। অদিতি এই ছেলেটিকে ভালো বোঝেন না। ও কি আশা করে তিনি ওকে নিয়ে মাতামাতি করবেন, আদিখ্যেতা করবেন, নাকি বাবা-বাছা করবেন? অদিতির সেরকমই মনে হয়। তিনি স্বাভাবিক গলাতেই পার্থকে বললেন, ‘এসো পার্থ। তুমি তো আর আসই না। ভালো আছ তো? বাড়িতে সবাই ভালো?’
পার্থ মুখে কিছু বলল না। আধখানা ঘাড় হেলাতেই এত সময় নিয়ে নিল যে ততক্ষণ ধৈর্য ধরতে না পেরে তিথি আবার বলে উঠল, ‘সবাই ভালো আছে। ওমা, শোনো না, আমরা একটা বাক্স কিনেছি কাল—’
‘তাই বুঝি। বাঃ!’ অদিতি হাসলেন, ‘সবুর সয়নি দেখছি। কাল বাক্স কিনে আজই জামা নিতে চলে এসেছ দুজনে।’
তিথির সত্যিই আর সবুর সইছিল না। বাবার সঙ্গে কোনোরকমে কয়েকটা কথা বলেই সে পার্থর হাত ধরে টানল, ‘চলো না। চলো জামাকাপড়গুলো বার করি। এসো-না মা।’
অদিতি আলমারি খুলে একটার পর একটা জামা বার করে ডিভানের ওপর পর পর রাখছিলেন। হঠাৎ তাঁর মনে হল, ঘরে যেন কোনো সাড়াশব্দ নেই। একটু আগেই তিথি কলকল করছিল, হঠাৎ কী হল তার?
তিথির দিকে মুখ তুলে তাকাতেই তিনি দেখলেন তিথির ঠোঁট কাঁপছে, দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরেছে সে, চোখে জল টইটম্বুর। অদিতির চোখে চোখ পড়তেই তার চোখের জল উপচে গেল। পার্থর দিকে তাকিয়ে প্রায় অবরুদ্ধ গলায় তিথি বলে উঠল, ‘দেখেছ? দ্যাখো। আমি বলেছিলাম না তোমাকে, ধরবে না?’
অবাক হয়ে অদিতি পার্থর দিকে দৃষ্টি সরালেন। পার্থকে দেখে চমকে উঠলেন তিনি। এ কী চেহারা পার্থর! তিনি পার্থকে কখনো হাসিখুশি দেখেননি ঠিকই, কিন্তু তার মুখ এত কুটিল হয়ে উঠতে পারে এ ধারণাও তাঁর ছিল না। তার নাকের পাটা ফুলছে বিজাতীয় হিংস্রতায় সমস্ত মুখ কালি, চোখ দুটো যেন ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে তৈরি। অদিতি ভয় পেয়ে গেলেন, ব্যাকুল গলায় বললেন, ‘কী হয়েছে?’
পার্থ বা তিথি কেউই তাঁর কথার কোনো উত্তর দিল না। ঠিক যেন লড়াইয়ের পূর্ব মুহূর্তে দুটো রাগি বেড়ালের মতো তারা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আছে। পার্থ দাঁত চেপে খসখসে গলায় বলল, ‘যা ধরবে তাতেই হবে!’
‘হবে না।’ তিথি কান্নার গলায় চেঁচিয়ে উঠল। ‘তুমি বলেছিলে আমার কোনো আইডিয়া নেই, আমি বিশ্বাস করেছিলাম। এখন বলছ, যা ধরবে তাতেই হবে।’
গোটা ব্যাপারটা বুঝতে অদিতি সামান্য হলেও সময় নিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর কর্তব্য স্থির করতে একে সেকেন্ডও সময় নিলেন না। তিথির হাত ধরে তাকে জোর করে ডিভানের ওপর বসিয়ে দিলেন। আলতো ধমক দিয়ে বললেন, ‘ছিঃ তিথি ও কী! এই নিয়ে অমন করে ঝগড়া করতে আছে? বাবা শুনতে পেলে কী ভাববে?’
তিথি ঝরঝর করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমি কিছু নিয়ে যাব না! চাই না, কিছু চাই না। কলেজে সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। করুক। আমার আর জামা নিয়ে গিয়ে কাজ নেই। এইরকমই থাকব, ঝিয়ের মতো।’
‘না, তিথি, লক্ষ্মী মা আমার। এরকম করে না।’ অদিতি সান্ত্বনা দিয়ে চললেন, ‘সংসার করতে গেলে কত বুঝেশুনে চলতে হয় মা, রাগ করলে কি চলে! এখন একটা যা হোক কেনা তো হয়েছে। আবার দু-দিন পরে সুবিধামতো আরেকটা কিনে নিলেই হবে। সংসার এভাবেই চলে। একসঙ্গে দুম করে কি পারা যায় সব? ধীরে ধীরে একটু একটু করে গুছিয়ে তুলতে হয়। ধৈর্য না ধরলে কী করে হবে বল তো! আমরাও তো কত কষ্ট করে—’ অদিতি বাক্যটা আর শেষ করলেন না। তাঁর মন চাইল না। বিশ্বনাথের সঙ্গে পার্থর কোনো তুলনাই চলে না। তাঁর স্বামী নিঃস্ব হওয়া সত্ত্বেও কর্মোদ্যমী পরিশ্রমী মানুষ ছিলেন। আর পার্থ! অদিতি মেয়েকে ভোলাতে গিয়ে আসলে অনেকটা নিজেকেই ভোলাচ্ছিলেন সান্ত্বনার কথাগুলো বলে। তিনি জানেন তাঁর মেয়ে শূন্যে ঝাঁপ দিয়েছে।
পার্থর মুখের দিকে তাকাতে তাঁর প্রবৃত্তি হচ্ছিল না। কিন্তু তিনি জোর করে তাকালেন, জোর করে একটু হাসলেনও। জোর করেই বললেন, ‘ও খুব ছেলেমানুষ পার্থ। তুমি তো বড়ো, ওর ওপরে রাগ কোরো না…’
তিথির কান্না ফুরিয়ে এলে সে অবসন্নের মতো বসে ছিল। অদিতি যা পারলেন আন্দাজমতো গুছিয়ে বিগশপারে ভরে পার্থর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আর মনে হয় দরকার নেই আপাতত, তাই না?’
পার্থর স্বর থেকে কাঠিন্য মোছেনি, বলল, ‘যথেষ্ট। মোর দ্যান এনাফ।’
ফেরার পথে পার্থ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘ভালোই তো সিন করলে মায়ের কাছে গিয়ে। আরেকটা বাক্স কেনার মতলব তোমার, না? তোমার মাকে দিয়ে বলানো। তা, নিজের মাকে বলতে পারছ না কিনে দেওয়ার কথাটা?
তিথি দাউদাউ করে জ্বলছিল। কিন্তু আশ্চর্য ঠান্ডা স্বরে বলল, ‘তুমি সেইজন্যেই যে মরে যাচ্ছ আমি বেশ বুঝতে পারছি। কিন্তু আমি মা-বাবার কাছ থেকে কিছু নেব না, এ বিষয়ে তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো। একথা তোমায় আমি আগেও বলেছি।’
পার্থ মুখ বিকৃত করল, ‘আমাকেও আর বিরক্ত করবে না বলে দিচ্ছি। আমার পক্ষেও আর কিছু সম্ভব নয়।’ বাড়িতে পা দিয়েই তিথি দেখল মাধবী এসেছেন, সুধার সঙ্গে নীচু সুরে কীসব কথা বলছেন। তিথিকে দেখে বললেন, ‘মায়ের কাছে গেছিলি? সব ভালো?’
তিথি ঘাড় নাড়ল। মাধবী জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী রে, মুখ শুকনো কেন? কার সঙ্গে ঝগড়া করেছিস, মায়ের সঙ্গে না বরের সঙ্গে?’
‘মায়ের সঙ্গে আবার ঝগড়া কীসের। যত ঝাল সব আমার ওপর। কাল একটা বাক্স কেনা হল। আজ ওর মা আমাকে বলে এতে হবে না আরও একটা কেনো।’
একটা সত্যকে নির্লজ্জ নির্দ্বিধায় এমন বিকৃত করতে দেখে তিথি স্তম্ভিত হয়ে গেল। সে প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিল, তার আগেই সুধা জ্বলে উঠলেন, ‘শুনলে মাধু! শোনো। এই চলছে শুধু মা আর মেয়েতে মিলে। পার্থ একেবারে জেরবার হয়ে গেল। এদিকে উনি নিজে কিছু দেবেন না।’
‘আমি ঠিক এই কথাটাই বলেছিলাম।’ পার্থ বলল, ‘ওইজন্যে সারা রাস্তা আমার সঙ্গে ঝগড়া করতে করতে এল।’
তিথির চোখে জল এসে যাচ্ছিল ঘৃণায় আর দুঃখে। ঘৃণা পার্থর ওপর। আর দুঃখ এই কারণে যে, এদের কথা শুনে মাধবীও
কি,
নিশ্চয়ই সব বিশ্বাস করছেন! মাধবী হঠাৎ খুব ক্লান্ত স্বরে বললেন, ‘থাকগে, এসব পরে বোলো। আমার আর শুনতে ভালো লাগে না। আমারও তো মন-টন ভালো নেই। যাই দিদিভাই, কাল সকালে বেরোব, আমার তো কিছু গুছোনোই হয়নি—
মাধবী উঠে দাঁড়ালেন। তিথি রাগ ভুলে মাধবীর দিকে তাকিয়ে আছে। মাধবী কোথায় যাওয়ার কথা বলছেন! সে জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় যাচ্ছ মাধুবউদি? বেড়াতে?’
মাধবী হাসলেন, ‘জামশেদপুর যাচ্ছি রে। তোর সলিলদার কাকার বাড়ি। কাকিমা পড়ে গিয়ে শয্যা নিয়েছেন। আমাকে দেখভাল করতে হবে। দুই ছেলেই তো আমেরিকায়, মেয়েও থাকে ব্যাঙ্গালোর। আমাকে ছাড়া কাকেই বা আর পাবেন বিনিপয়সার নার্সগিরি করতে।’
তিথির বিশ্বাস হচ্ছিল না। মাধবী চলে যাবেন ভাবতেই তার পায়ের তলা থেকে জমি সরে যাচ্ছে। সে ক্ষীণ স্বরে বলল, ‘কবে আসবে?’
‘সে আর কী করে বলি বল! বুড়ো হাড় তো, সহজে সারবে না। কাল গিয়ে ক-দিন পরই রুম্পাকে নিয়ে ফিরে আসবে ওর বাবা। আমাকে এখন অন্তত মাস খানেক মাস দেড়েক তো থাকতেই হবে। ওই জন্যেই তো ডাক পড়েছে।’
চলে যেতে যেতে মাধবী বললেন, ‘কাল সকালে একবার তোর ঘরে যাব, হ্যাঁ তিথি? কেমন বাক্স কিনেছিস দেখব। কাল তো আমাকে দেখালি না!’ মাধবী হাসতে হাসতে বললেন, ‘আজ রাত্তিরের মধ্যেই বরের সঙ্গে ঝগড়া মিটিয়ে নিবি, কাল যেন হাসিমুখ দেখে যেতে পারি।’
মাধবীর এই কথাটা মনে পড়তেই তিথির চোখ দিয়ে পর পর অনেকগুলো গরম জলের ফোঁটা গড়িয়ে যেতে লাগল। আজ
সকালে রওনা হওয়ার আগেই নিশ্চয়ই মাধুবউদি এসেছিলেন তার সঙ্গে দেখা করতে। অথচ সে কোনো সাড়া দেয়নি। তিথি বিড়বিড় করল, ‘মাধুবউদি, ও মাধুবউদি, তুমি আমাকে ক্ষমা করো মাধুবউদি…আমার মাথার ঠিক নেই…আমার খুব কষ্ট হয় মাধুবউদি… আমার মাকে নিয়ে ওরা এভাবে কেন বলে…’
মাধবী এখন অনেকটা দূরে চলে গেছেন, তাঁকে আর ডেকে পাওয়া যাবে না। তবু তিথি তাঁর সঙ্গেই কথা বলে চলল। তার চোখ বন্ধ। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ পেতেই সে চমকে চোখ খুলে দেখল ঘরে এসে দাঁড়িয়েছেন সুধা, তাঁর পেছনে সীমা। তিথি একবার তাকিয়েই আবার চোখ বন্ধ করে ফেলল।
‘কী হচ্ছে কী, তিথি! বাড়াবাড়ির একটা সীমা আছে তো!’ সুধার গলায় যেন একটু আশঙ্কিত ভাব ‘রাগ দেখিয়ে টঙের ওপর শুয়ে রয়েছ, আর সংসারের হাজারটা হ্যাপা সামলে চোদ্দোবার করে তোমায় ডাকতে হচ্ছে। কোনো সাড়া দিচ্ছ না, এসব কী অ্যাঁ! ফিট-টিট আছে নাকি তোমার!’
তিথি অতি কষ্টে গলা দিয়ে আওয়াজ বার করল, ‘না বড়োমা, শরীরটা একটু খারাপ, আজ একটু শুয়ে থাকি।’
‘শুয়েই তো আছ, বেলা-দুপুর গড়িয়ে গেল।’ সুধা কঠিন হলেন, ‘দয়া করা নীচে গিয়ে মুখে একটু জল দিন, তা নইলে তো আবার ডাক্তারবাড়ি ছুটতে হবে। তোমার তো অল্পের ওপর দিয়ে কিছু হয় না।’
‘আমাকে একটু একা থাকতে দাও, প্লিজ!’ তিথি ফিসফিস করল।
‘মা চলো, চলো তো। নাটক হচ্ছে তখন থেকে।’ সীমা তীক্ষ্ণ গলায় বলে উঠল।
সুধা খাটের কাছে এসে একটা চাবি ফেলে দিলেন তিথির মাথার কাছে, তেতো গলায় বললেন, ‘একাই থাকবে। বাড়িতে কেউ রইল না। আমি আর সীমা যাচ্ছি নকুলবাবুর ওখানে। পার্থ কিংবা ওর বাবা ফিরলে চাবি নিয়ে যাবে। চল সীমা।’
সুধারা চলে গেলে তিথি আবার চোখ খুলল। নকুলবাবু মানে জ্যোতিষী, যাঁর ওপর এ বাড়ির সবার, মানে সুধা সীমা আর পার্থর অগাধ আস্থা। ইনিই গত কয়েক বছর ধরে বলে আসছেন সীমার আসছে শ্রাবণে বিয়ে হবে। এছাড়া আরও অনেক কথাই তিনি বলেন যেসব শুনে তিথি হাসবে না কাঁদবে ভেবে পায় না। যেমন, ইনি বলেছেন পার্থ নাকি গতজন্মে অত্যন্ত প্রতাপশালী রাজপুরুষ ছিল, এক দক্ষ অশ্বারোহী এবং নিষ্ঠুর শিকারি। শেষ বয়সে তার মানসিক পরিবর্তন আসে এবং ঈশ্বরে খুব ভক্তি হয় তার। সেই পুণ্যের ফলে নাকি এবার সে দিব্যজীবন লাভ করেছে। প্রায় জাতকের গল্প সন্দেহ নেই, কিন্তু দিব্যজীবন বলতে জ্যোতিষী কাকে বুঝিয়েছেন তিথি জানে না। তবে তার কৌতূহল হয়েছিল লোকটি সম্বন্ধে। একদিন পার্থকে সে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘ভদ্রলোক এত সব বলেন কীসের ওপর বেস করে?”
‘উনি দেখতে পান।’ পার্থ বলেছিল
‘সে কী, দেখতে পান মানে! কোথায় দেখেন? কী দেখেন?”
‘ওঁর একটা অদ্ভুত ভিশন আছে, উনি কারও মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ, তারপর তার মাথার পেছন দিকে দেখতে দেখতে এরকম সব বলে যান। অবশ্য সবসময় মুখ দেখারও দরকার হয় না, বর্ণনা শুনেও বলতে পারেন। যেমন তোমার সম্বন্ধেও তো উনি অনেক কিছু বলেছেন।’
‘আমার সম্বন্ধে!’ তিথি অবাক হল, ‘কী বলেছেন? কই, তুমি কিছু বলোনি তো!’
পার্থ দাড়ি চুলকাল, ‘বলিনি, কারণ তুমি নিতে পারবে না।’
‘নিতে পারব না কেন, এমন কী কথা?’ তিথির ক্রমশ আরও অদ্ভুত লাগছিল। তার সম্বন্ধে কী বলতে পারেন সেই জ্যোতিষী? পার্থ তিথির চোখে চোখ ফেলল না, বলল, ‘তিথি, উনি বলেছেন তোমার ওপর একটা অশুভ প্রভাব তোমাকে জীবনে সুখী হতে দেবে না।’
তিথি কোনো কূলকিনারা না পেয়ে আবার বলল, ‘মানে!’
‘মানে, উনি দেখেছেন তোমার মাথার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে একজন স্ত্রীলোক, শক্ত, পুরুষালি চেহারা, হাতে একটা ত্রিশূল। সে কিছুতেই তোমাকে মুক্তি দিচ্ছে না—
‘এসব কী বলছ মাথামুণ্ডু আমি কিছুই বুঝছি না।’ তিথি অধৈর্য স্বরে বলল, ‘কে স্ত্রীলোক! কে আমার মাথার পেছনে দাঁড়িয়ে—’ বলতে বলতেই হঠাৎ একটা অভাবনীয় সন্দেহে তার মাথার চুল থেকে পায়ের নখ শিউরে উঠল। সে তীক্ষ্ণ চোখে পার্থর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘উনি সেই স্ত্রীলোকটিকে চিনতে পারেননি?’
‘না, মানে, সেভাবে কিছু বলতে পারেননি। চেহারার বর্ণনা দিয়েছেন
‘ও! কী বর্ণনা শুনি?’
পার্থ উদাস মুখে বলল, ‘যাক তিথি, শুনে তো—’
‘আচ্ছা! আমার মুক্তির উপায় কিছু বলেননি উনি?’ তিথির গলায় ধার বাড়ছে।
‘বলেছেন। সেসব আমি তোমায় বলেওছি। তুমি তো কোনো কথাই শোনো না। বললাম ওখানে বেশি যাওয়া-আসা কোরো না—এ কী তুমি কাঁদছ। ওই জন্যেই আমি কিছু বলতে চাইনি——
তিথি হাউহাউ করে কাঁদছিল। বিকৃত গলায় বলল, ‘থাক আর দয়া দেখাতে হবে না। তুমি কি একটা মানুষ? তুমি কী বলতে চাইছ আমি অনেকক্ষণ থেকেই বুঝতে পারছি কিন্তু বিশ্বাস করতে পারছি না। আমাকে আমার মা সম্বন্ধে এত বড়ো কথা বললে তুমি—’
‘আমি কিন্তু কিচ্ছু বলিনি, তুমি জোর করেছ। আর এসব নকুলবাবু
‘চুপ করো। একটা কথাও আমি বিশ্বাস করি না। সব তোমার বানানো কথা!’ তিথি চোখের জল মুছল, ‘তোমার বিবেক-টিবেক কিচ্ছু নেই? আবার নিজের সম্বন্ধে জাতকের গল্প বানাও!’
পার্থ হাসল, ‘তুমি বিশ্বাস না করলে আমি কী করতে পারি বলো!’ সে পাশ ফিরে শুয়েছিল। তিথির বহুক্ষণ মনে হচ্ছিল, সে কি একটা সরীসৃপের পাশে শুয়ে আছে!
মনের এ কী জটিল অসুখ, এ অসুখে যত রাজ্যের বীভৎস স্মৃতিগুলোই বার বার মনে পড়তে থাকে। তিথি মুখ খুলে শ্বাস টানতে গিয়ে দেখল তার জিভটা টাকরার সঙ্গে এমন সেঁটে গেছে যে সে খুলতে পারছে না। সমস্ত থুতু শুকিয়ে গেছে মুখের ভেতর। ওপরে খাওয়ার জল নেই। পার্থ যখন শুতে আসে তখন একটা জলের বোতল নিয়ে আসে, আবার সকালে নীচে নিয়ে যায়। কাল অনেক রাত্রি অবধি জেগে ছিল তিথি, পার্থ আসেনি। জলের বোতলও তাই আনা হয়নি। কাল সে যখন বিগশপারটা নিয়ে
সিঁড়ি দিয়ে ওপরে আসছে, শুনেছিল সুধা বলছেন, ‘সবসময় বাপের বাড়ি থেকে জিনিস আনবে আর সব বুকলি বেঁধে নিয়ে যাবে ওপরে। লজ্জাশরমও নেই!’
পার্থও তাকে একদিন বলছিল, ‘এইসব ক্রিম-টিম হ্যানাত্যানা সব ওপরে রাখার কী দরকার! নীচে রাখলেও তো পারো। সবাই মিলে ইউজ করা যায়। মা বলছিল সীমার খুব কষ্ট হয়। ও একটু অভিমানী তো! তুমি ওকে অন্তত একটু দিলে তো পারো।’
শুনে তিথি থ হয়ে থেকেছে। অদিতি তাকে দিয়েছেন একটা ছোটো চার্মিসের কৌটো আর একটা ভেসলিনের টিউব। এ বাড়িতে ক্রিম-টিম যে একেবারে নেই, তা নয়। কিন্তু তাতে তিথি কোনোদিন হাত দেয়নি। তাকে হাত দিতে বলেওনি কেউ। বরং এই নিয়ে বাড়িতে অনেক কাণ্ড হয়ে গেছে। তারপরে পার্থ তাকে এইসব কথা বলে কী করে এটাই অচিন্তনীয়।
সীমা তার টিউশনির টাকা দিয়ে শীতের প্রথমেই পন্ডস ক্রিম কিনে এনেছিল। সেটা সে একাই মাখে। অলক আর সুধাকে কখনো এসব কিছু মাখতে দেখেনি তিথি, ওঁরা তেলই মাখেন। তিথিও তাই। সারা গায়ে নয়। দু-তিন ফোঁটা নিয়ে সারা মুখে ঘষে ওই হাতটাই আবার পায়ের পাতায় বুলিয়ে নেয়। এখানে এসে খুব পা ফেটেছে তিথির। গোড়ালিতে গভীর লম্বালম্বি চিড়। সীমা একটা ময়শ্চারাইজারও কিনেছে, তিথি দেখেছে। এক ছুটির দিন স্নানের পর সে একটু রোদের লোভে বারান্দায় গিয়ে দেখেছিল রোদের টুকরোটা সীমার দখলে। সীমা বসে বসে পায়ের পাতায় ময়শ্চারাইজার লাগাচ্ছে। তাকে দেখে একবারও মুখ তুলল না। তিথি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটুক্ষণ সীমার পদচর্চা দেখল। তারপর ঘরে এসে খাবার জায়গা করে রান্নাঘর থেকে ডালের বাটি নিয়ে আসছে, দেখতে পেল সীমা দ্রুতবেগে ময়শ্চারাইজারের বোতলটা নিয়ে ঘরে ঢুকে আবার দ্রুতই খালি হাতে বেরিয়ে গেল। তিথি ঘরে এসে কিছুটা কৌতূহলের সঙ্গেই একবার চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখল। ড্রেসিং টেবিলে, বাক্সের ওপরে, খাটের ওপরে, দেয়ালের তাকে, কোথাও ময়শ্চারাইজারের বোতলটা নেই। সীমা ময়শ্চারাইজারটা কিনে লুকিয়ে রেখেছে। তিথির হঠাৎ হাসি পেয়ে গেল। তার পরেই মনে হল—আহা রে, বেচারি সীমা! না লুকিয়ে কী আর করবে সে। বিচিত্র অনুভূতিতে পরক্ষণেই তার
দু-চোখ জ্বালা করে উঠল। সীমা তো তাকেও সন্দেহ করে।
পার্থ যে মাঝেমধ্যেই বোনকে লুকিয়ে সীমার ক্রিমের কৌটো থেকে খাবলা মারে, তিথি জানত। ব্যাপারটা তার পছন্দ না হলেও এটা ঠিক কতখানি চুরি-জাতীয় অপরাধের পর্যায়ে, সে বিষয়ে তার ধারণা ছিল না। কিন্তু সীমা যেদিন পার্থকে হাতেনাতে ধরল, যাচ্ছেতাই বলল সে দাদাকে। তিথি সেখানে উপস্থিত ছিল। সীমা চিৎকার করছিল, ‘ও, তাই বলি! এই সেদিন কিনলাম বোরোলিনটা। এরই মধ্যে এমন তুবড়ে গেল কেন! ক্রিমের কৌটোটাও ফাঁকা ফাঁকা লাগে। এই কাণ্ড! চুরি করেই ফাঁক করে দিচ্ছিস, অ্যাঁ! লজ্জা করে না। আর গুণ নেই ছার গুণ আছে, চুরি!
পার্থ নির্লজ্জের মতো বলল, ‘একদিন একটুখানি নিইছি তাতেই অত চোপা করছিস কেন রে? এইটুকু নিলে চুরি হয়? তাও আবার মুখে মাখার ক্রিম— 1
সীমা দ্বিগুণ চেঁচিয়ে বলল, ‘চোপা করব না তো কি, পুজো করব! ধোয়া তুলসী পাতা তুমি, না! চুরি কাকে বলে জানো না। একদিন নিয়েছ কি ক-দিন নিয়েছ তার আমি কী জানি। তাহলে তুমি ছাড়াও আছে কেউ হাতসাফাইয়ে—’ বলতে বলতে সে এমনভাবে তিথির দিকে তাকাল, তিথির বুঝতে বাকি রইল না সীমা তাকেও সন্দেহ করছে। লজ্জায় অপমানে দিশাহারা লাগছিল তার। সীমার চিৎকারে মাধবী নীচে নেমে এলেন। তখন বেশ রাত। খাওয়া-দাওয়া হয়ে যাওয়ার পরেই ঘটেছিল ঘটনাটা। অলক বাথরুম থেকে হন্তদন্ত হয়ে আসতে আসতে চেঁচাচ্ছিলেন, ‘কী হয়েছে ও সীমা, কী হয়েছে রে?’
পার্থ তখন ভালোমানুষের মতো কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, ‘না রে সীমু, সত্যি বলছি বিশ্বাস কর। এই শুধু আজকেই…ঠোঁটটা বড্ড চড়চড় করছিল…এর আগে কখনো…অন গড বলছি…’
সীমা অগ্নিদৃষ্টিতে তিথির দিকে একঝলক তাকিয়ে নিয়ে বলল, ‘থাক আর দিব্যি গেলে কাজ নেই। খবরদার বলছি আমার
জিনিসে হাত দেবে না। অত শখ হলে কিনে মাখবে—’
অলক গায়ে পড়ে বলে উঠলেন, ‘হুঁংঃ, পয়সা রোজগারের মুরোদ নেই আবার মুখে ক্রিম লাগায়, ছোটোলোক একটা। ও তিথি, আমার মশারিটা শিগগির টাঙিয়ে দিয়ে যাও।’
মাধবী বলছিলেন, ‘যাকগে বাবা। চিৎকার শুনে ভাবলাম কী না কী হল বুঝি…
এই সামান্য তুচ্ছ একটা ব্যাপার নিয়ে যে এমন চিৎকার চেঁচামেচি হতে পারে, তিথিরও ধারণা ছিল না। কিন্তু সে কারণে সীমাকেও তেমন দোষ দিতে পারছিল না সে। বরং তার বার বার মনে হচ্ছিল, পার্থ মিথ্যে শপথ করে কি ইচ্ছে করেই সন্দেহের তীরটা ঘুরিয়ে দিতে চাইছিল তার দিকে!
ঘুলঘুলি দিয়ে ঘরে ঢোকা আলোর দানাগুলো যখন ক্রমশ হলদে থেকে ঘোলাটে হয়ে শেষে বেগুনি হয়ে এল, তিথির মাথার মধ্যে ঝিমঝিম করছিল। এতক্ষণ একভাবে শুয়ে শুয়ে সে মাথাটা যেভাবে চালিয়ে গেছে, যেন সেটা একটা চলমান টিভির পর্দা। একটার পর একটা ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। সেখানে সিরিয়ালের মতো। আর এখন সব অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যাবার পর তার মাথায় ওই শূন্য স্ক্রিনের মতোই অসংখ্য পিনের মতো আলোর বিন্দু নাচানাচি করছে, সেইসঙ্গে কানের মধ্যে পরিত্রাহি ঝাঁ-ঝাঁ শব্দ। তিথি দু-হাতে কান চাপা দিল, শব্দ বাড়ছে। উপুড় হতে চেষ্টা করল তিথি। সমস্ত শরীরটা যেন একটা ফাঁপা নলের মতো। নলের ভেতরটা খালি, একেবারে খালি। আশ্চর্য, এত ফাঁপা আর শূন্য একটা শরীর নাড়তে পারছে না কেন সে! শূন্যতার এত ভার! তিথির কান্না পেল, কাঁদতে গিয়ে সে দেখল তার চোখে আর কোনো জল আসছে না।
ঘরের ভেতরে ক্রমশই অন্ধকার চেপে আসছে। প্রায় সংজ্ঞাহীনের মতো পড়ে থাকতে থাকতেই তিথি শুনল সিঁড়িতে যেন কার পায়ের আওয়াজ। আওয়াজটা কাছে এসে দরজা খুলে ফেলল। তিথি কিছু দেখতে পাচ্ছে না।
‘মা আবার কোথায় বেরোল? চাবি নিশ্চয়ই তোমার কাছে—’ পার্থ ঘরের আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে, ‘এ কী! তুমি সেই থেকে শুয়ে নাকি। তিথি! কী হয়েছে!’
পার্থর গলায় অপ্রত্যাশিত বেদনা ধ্বনিত হল, ‘কী পাগলামি করছ তিথি, সারাদিন খাওনি? এত রাগের কী হল তোমার?
তিথির ঠোঁট নড়ল না, কিন্তু সে বলল, ‘রাগ নয়, পার্থ। তুমি আমাকে একটুও ভালোবাসো না। সেই জন্যেই আমার বাঁচতে ইচ্ছে করছে না। তুমি একটু ভালোবাসলেই আমি উঠে দাঁড়াতে পারব…’
পার্থ শুনতে পেল না, কিন্তু তিথির পাশে বসে তার ওপর ঝুঁকে পড়ল, ‘উঠবে না তিথি? কাল আমি আসিনি বলে রাগ করেছ? আসলে আমারও খুব রাগ হয়েছিল। তোমার ওপর নয়, তোমার মায়ের ওপর। উনি তো কিছুতেই আমাকে মানতে পারেন না।’
‘আমাকে একটু ধরে দাঁড় করিয়ে দাও।’ তিথি অতি কষ্টে গলায় স্বর আনল।
পার্থকে ধরে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াতেই জগৎব্রহ্মাণ্ড ঘুরে উঠল তিথির মাথার মধ্যে। চোখে অন্ধকার দেখতে দেখতে সে বলল, ‘আহ্ পার্থ…বাথরুম…আমায় বাথরুমে নিয়ে চলো…বমি পাচ্ছে…’
কোনোরকমে বাথরুমে অবধি পৌঁছিয়েই ওয়াক তুলল তিথি। কিছু বেরোল না, শুধু তেতো পিত্তজল ছাড়া। তবু মুহুর্মুহু শরীর ভেঙে ওয়াক আসতে লাগল তার, যেন নাড়িভুঁড়ি সব ছিঁড়ে উঠে আসতে চাইছে তার মুখ দিয়ে।
8
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের শরীর দেখছিল পার্থ। এরকম সে মাঝেমধ্যে করে। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, সামনে থেকে, পাশ থেকে নানাভাবে নিজেকে দেখে। দেখতে দেখতে তার ধারণা হয়, সে যথেষ্ট সুন্দর। শুধু একটু রোগা। সেটা নিয়ে অবশ্য লজ্জার কিছু নেই। ব্যায়ামবীরের মতো ফোলানো শরীর মোটেই রুচিসম্মত কোনো চেহারা নয়। আসল ব্যাপার হল চেহারাতে ইন্টেলেক্টের ছাপ। পার্থ হাত দিয়ে মাথার চুলগুলো সুন্দরভাবে উশকোখুশকো করে দিয়ে দেখতে লাগল। তার সৌন্দর্য পেশিতে নয়, ইন্টেলেক্টে। ঠোঁটের কোণে সামান্য ভাঁজ খেলাল, – হাসি, কিন্তু হাসি নয়। বাঃ, দারুণ মানিয়েছে। –
সুধা খাটে বসে বসে ছেলের কাণ্ড দেখছিলেন। বেশ ঠান্ডা পড়েছে। শীতকালে দুপুরে ঘুমোনো যায় না। ঘুমিয়ে পড়লে লেপ-কম্বল সরিয়ে ওঠাই মুশকিল হয়ে যায়। কোনোরকমে এই সংক্ষিপ্ত দুপুরবেলাটুকু পার করে দিতে হয়। সুধা প্রশ্রয় মেশানো কৌতুকের স্বরে বললেন, ‘কী হচ্ছে ও? সিনেমা?’
‘না, স্টিল।’
‘সে আবার কী?’
‘মানে স্থিরচিত্র। পেপারে যেসব ছবি বেরোয় না? ওইরকম।’ পার্থ গালে হাত দিয়ে চিন্তার ভঙ্গি করল, সেটা পছন্দ না হওয়ায় হাত দুটো সামনে ছড়িয়ে দিয়ে দুটো বুড়ো আঙুল জুড়ে হাতের পাতার ফাঁক দিয়ে নিবিষ্ট মনে দেখতে লাগল নিজেকে।
সুধা আবার হাসলেন, ‘কী যে করিস পাগলামি!
‘পাগলামি নয় মা। দেখবে, একদিন কাগজে আমার ছবি বেরোবে। হইচই হয়ে যাবে চারিদিকে—’
সুধা সস্নেহে পার্থকে দেখতে দেখতে বললেন, ‘আরও রোগা হয়ে যাচ্ছিস কেন রে দিন দিন। ভালো করে খাওয়া-দাওয়াও করিস না। ওই ক-টা ভাত—’
পার্থ একটা নিশ্বাস ফেলে খাটের ওপর বসল ধপ করে। তারপর চিত হয়ে শুয়ে কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আর খাওয়া! প্রাণে শান্তি না থাকলে কি আর..। আমার নিজের ভেতরে তো চাপ কম নেই। এই লাইনে কেউ কাউকে সুযোগ দেয় না, লড়তে হয়। আমিও তো লড়ছি মা, তবু মাঝে মাঝে এত ফ্রান্সট্রেটেড লাগে। তার ওপর ঘরেও তো অশান্তি লেগেই আছে—’
সুধা সঙ্গে সঙ্গে সোজা হয়ে বসলেন, ‘আমি তখনই বলেছিলাম। এভাবে বিয়ে কি একটা বিয়ে। আর কপালে কী মেয়েই জুটিয়েছ—যেমন বেয়াড়া তেমনি বেহায়া। ওর বায়নাক্কা বেয়াড়াপনা সামলানো কী সহজ কথা। আর তোকেও বলি পার্থ—’, সুধা হাত বাড়িয়ে পার্থকে ছুঁলেন, তার গায়ে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘এবার একটা কাজ-টাজ দ্যাখ বাবা, এভাবে কতদিন আর—’
পার্থ আপশোসে মাথা নাড়ল। বলল, ‘তুমিও তিথির মতো কথা বলছ মা। সব মেয়েদের এই এক দোষ। তোমাদের বড়ো কোনো স্বপ্ন দেখানো সম্ভব নয়। সেই ধারণাই নেই তোমাদের।’
সুধা রাগ করলেন, পার্থ তাঁর স্বপ্ন দেখার অক্ষমতার কথা বলেছে বলে নয়, তিথির সঙ্গে তাঁর তুলনা করেছে বলে। একটু চুপ করে থেকে অপ্রসন্ন মুখে বললেন, ‘সে তুমি কী বলো কী বোঝো তুমিই জানো। তবে কিনা, অনেকদিন তো হল। আমি তো আর ওর মতো নিজের দিক দেখি না। আমি বলি সংসারের দিক চেয়ে। তোর বাবার চাকরিইবা আর ক-দিন? সীমুটার যে কী গতি হবে—সেদিন তো নকুলবাবু বললেন বাড়িতে এবার একটু পুজো-টুজো করতে হবে, কী নাকি এই বাড়িতে গ্রহের বাসা হয়েছে।
সেসব কাটিয়ে নিলে খিদিরপুরের সম্বন্ধটাই নাকি লেগে যাবে। তুই যে বললি ছেলের অফিসে গিয়ে খোঁজখবর করবি-টরবি, কই গেলি না তো? আজ তো দেখি বেরোলি না কোথাও ঘুরে আসতে পারতিস তো—অ্যাই পার্থ, বাঃ রে, ঘুমিয়ে পড়লি নাকি?” 1
সুধা পার্থকে একটু ঠেলা দিলেন। পার্থ সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঠেলা খেয়ে পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমজড়ানো গলায় বলল, ‘গায়ে একটা ঢাকা দিয়ে দাও না।’
সুধা একটা কম্বল পার্থর গায়ের ওপর ফেলে দিতে দিতে বিরস মুখে বললেন, ‘আবার এই অবেলায় ঘুম। ভালো!’
সীমা গেছে পাড়ায় উলবোনার ডিজাইন তুলতে। তিথি কলেজে। সুধা জানলা-দরজা বন্ধ করে ড্রেসিংটেবিলের ড্রয়ারের মধ্যে থেকে ওপরের ঘরের চাবিটা বার করলেন। তিথি চাবি রেখে যায়, সেই সুযোগে সুধা অবসরমতো তার ঘরে মাঝে মাঝে তদন্ত চালান। এটা এমন কিছু বড়ো অপরাধ নয়, তবু সুধা কাজটা গোপনেই করে থাকেন। পার্থ ঘুমিয়ে পড়ার পর আজও তিনি বাইরের দরজাটা ভেজিয়ে রেখে ওপরে চললেন।
প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস-টাসগুলো দুপুরের পর ছাড়া হয় না বলে কলেজ থেকে ফিরতে ফিরতে তিথির প্রায়ই বিকেল গড়িয়ে যায়। এবার কলেজ করাটা আস্তে আস্তে একটু কমাতে হবে, তিথি ভাবছিল। তার বদলে যেটুকু সময় পাওয়া যায়, বাড়িতে বসে সেটুকু পড়লে পড়াশুনাটায় আর একটু বাঁধুনি আসে। কিন্তু বাড়ির পরিবেশ দিন দিন এমন দাঁড়াচ্ছে, সেখানে দু-দণ্ড মনঃসংযোগ করে পড়তে বসাই মুশকিল। তবু আজ একটু আগে আগেই কলেজ থেকে ফিরল তিথি। মনে মনে জোরালো প্রতিজ্ঞা করতে করতে, আজ সে যেভাবেই হোক পড়বেই। এর চেয়ে অনেক বেশি প্রতিকূল পরিস্থিতিতে অনেকে পড়াশুনা করে। তিথি তো নিজের বাবার কথাই জানে। তাহলে সে পারবে না কেন!
বাড়ি ফিরে তিথি দেখল নীচের ঘরে পার্থ একা কম্বলমুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে। আর কেউ নেই। ঘরের মধ্যে অন্ধকার! আলো
জ্বালাল তিথি। ড্রয়ার খুলে ওপরের ঘরের চাবিটা খুঁজে পেল না সে। আজ সারাদিন ক্লাস করতে করতে আর লাইব্রেরিতে বসে পড়তে পড়তেও থেকে থেকে গা গুলিয়ে উঠেছে তার। এটা প্রায়ই হচ্ছে। মুখে কোনো রুচি নেই। তিথি দু-ঢোঁক জল খেল। খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আবার গা গুলোতে শুরু করল তার। এরকম হচ্ছে কেন, তিথি বোঝার চেষ্টা করছিল, সেরকম কিছু খায়নি তো সে!
পার্থর মুখে থেকে কম্বলটা টেনে সরিয়ে দিতেই চোখ কুঁচকে ফেলল পার্থ। তার চোখে আলো গেছে। চোখ পিটপিট করে জড়িত স্বরে বলল, ‘হ্যাঁ? কী?’
‘এখন ঘুমুচ্ছ? উঠে পড়ো। নইলে গা ম্যাজম্যাজ করবে।’ তিথি এদিক-ওদিক তাকাল, ‘বড়োমা কই গো?’ পার্থ আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বলল, ‘জানি না তো। তুমি আজ তাড়াতাড়ি চলে এলে যে, ক-টা বাজে!’ ‘আমার শরীরটা আবার খারাপ করছে, জানো! কী যে হয়েছে, সারাক্ষণ বমি বমি লাগে। একটু জোয়ান বা বিটনুন মুখে দিতে পারলেও হত-‘
পার্থ উঠে বসল। হঠাৎ কীরকম অদ্ভুত মুখ করে তিথিকে দেখতে দেখতে বলল, ‘দাঁড়াও দাঁড়াও, এক সেকেন্ড। তোমার পেটের গোলমাল হয়েছে?’
‘সেটাই তো বুঝতে পারছি না, কই সেরকম তো—
‘আমি কী বলছি শোনো,’ পার্থ হঠাৎ গলা নামাল, ‘বমি পাওয়াটা অন্য কিছুর লক্ষণ নয় তো?”
তিথি বজ্রাহতের মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। কী সর্বনাশ। এ কথাটাই তার মাথায় আসেনি! ভয়ে তার হাত-পা হিম হয়ে গেল। মাথার মধ্যে সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই মাথা ঠান্ডা করে ভাবতে পারছে না কবে তার শেষ পিরিয়ড হয়েছিল। এমনিতেই পিরিয়ডের তারিখ মনে থাকে না, কারণ পিরিয়ড একটু উলটোপালটাই হয় তার। সবসময়ই তারিখ এগিয়ে বা পিছিয়ে যায়। তারপর এরকম জটিল সংঘাতের মধ্যে দিয়ে ধাক্কা খেয়ে এগোতে এগোতে সে খেয়ালই রাখতে পারেনি ঋতু বন্ধ হয়ে গেছে কবে। প্রাণপণে ভাবার চেষ্টা করছিল তিথি, পুজোর পর থেকেই তো তার আর রক্তপাত হয়নি। তার মাথা ঘুরে গেল, সমস্ত শরীর অস্থির অস্থির করছে। রক্তশূন্য মুখে খাটের ছত্রি ধরে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করল সে, অস্ফুট আর্তনাদের মতো বলল, ‘কী হবে!’
ঠিক তখনই ওপরের ঘর থেকে নেমে এলেন সুধা। নেমেই তিথিকে দেখে একটু সিটিয়ে গেলেন। অবচেতন অপরাধবোধে ঘরে না ঢুকে সোজা কলতলার দিকে চলে যাচ্ছিলেন তিনি, পার্থ ডাকল, ‘মা, শোনো!’
ঝটিতি ঘুরে দাঁড়ালেন সুধা। তাঁর মুখে অস্বস্তি, কিন্তু স্বরে বিরক্তি ফুটিয়ে বললেন, ‘কী হল!’
‘একটু এসো তো এদিকে। তিথি কী বলছে দ্যাখো—’ পার্থর গলায় চাপা উত্তেজনা। সুধা ঠিক ঠাহর করতে পারছিলেন না। তাঁর একবার মনে হল তিথি কি ধরতে পেরেছে তাঁর ওপরের ঘরে যাওয়াটা? না মনে হয়। কী করে ধরবে? পার্থও তো ঘুমোচ্ছিল। সুধা অনিশ্চিত স্বরে বললেন, ‘কী? কী বলছে?’
পার্থ ঠোঁট টিপে হাসল, ‘বিটনুন চাইছে মা। ওর গা গুলোচ্ছে।’
‘অ্যাঁ!’ সুধা হঠাৎ কোনো খেই পেলেন না।
‘সেদিন বমি করছিল বললাম না? ওর আজকাল কেবলই বমি পায়।’
পার্থ ইঙ্গিত করে চলেছে। তার স্বরে কোনো দুশ্চিন্তা বা উদ্বেগ নেই। কৌতুক আছে। সুধা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তিথির দিকে তাকালেন। তার মুখে সুস্পষ্ট ভয়ের ছাপ। সুধা আত্মস্থ হলেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তিথির শরীরে চোখ বিঁধিয়ে বললেন, ‘হুঁ, ক-দিন?’
‘আমি…আমি জানি না বড়োমা…’ তিথির চোখ বিস্ফারিত, তার হাত বিছানার চাদর খামচে ধরেছে।
‘আঃ ন্যাকামো কোরো না। মাসিক কবে বন্ধ হয়েছে বলবে তো?”
তিথি অস্পষ্ট স্বরে বলল, ‘এ মাসে হয়নি বড়োমা’।
‘বমি হচ্ছে মানে দু-মাস।’ সুধা কঠিন স্বরে বললেন, ‘এ অবস্থায় বাড়ির বার হবে না বলে দিলাম। কলেজ-টলেজ যাওয়া এবার
হাতের চাবিটা ঠক করে ড্রেসিংটেবিলের ওপর রাখলেন তিনি। তাঁর হাতে চাবি দেখে চকিতের জন্যে তিথির একবার মনে হল সুধা তার অনুপস্থিতিতে ওপরের ঘরে গিয়েছিলেন। কিন্তু এ বিষয়ে আর অন্য কিছু ভাবার অবসর ছিল না তার। অন্য এক ভয়াবহ দুশ্চিন্তায় সে তখন চিবুক অবধি ডুবে যাচ্ছে।
বন্ধ করো।’
ওপরের ঘরে চলে এসে নির্জীবের মতো শুয়ে পড়ল তিথি। এ কোন গভীরতর দুঃস্বপ্নের জালে জড়িয়ে পড়ল সে! যতদিন পড়াশুনাটা সে আবার শুরু করতে পারেনি, ততদিন কোনো স্বপ্নও ছিল না। পড়াশুনা শুরু করার পর দাঁতে দাঁত চেপে সব সে সহ্য করে যাচ্ছে শুধুমাত্র একটা বহু দূরবর্তী স্বপ্নকে সামনে রেখে। সেটা না হলে এতদিনে সে পাগল হয়ে যেত। অথচ, তার স্বপ্ন
যে কেবলই তার নিজেকে নিয়ে নয়, এ কথা কেউ বিশ্বাস করে না। তিথি প্রতিমুহূর্তে অনুভব করে, তার পড়াশুনা করার চেষ্টাটা যেন তার একান্ত ব্যক্তিগত একটা বিলাস। স্বার্থপরতা। এ বাড়ির মানুষজনেরা এমনটাই ভাবেন। তিথিকে সেই নিজস্ব অবসরটুকু দিতে তাঁদের রাগ হয়, বিরক্তি হয়। এমনকী, রাত্রে পার্থও তার দাবি ছাড়ে না। তিথির একেকবার মনে হয়, এ বাড়িতে থেকে পড়াশুনা করা বোধ হয় তার পক্ষে সম্ভব নয়। যুঝতে যুঝতেই সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। মনঃসংযোগের ক্ষমতা থাকে না। মনের খুব গোপন কোণে একটা কথা ঘুরেফিরে উঁকি মারে। পরীক্ষার আগে কয়েকটা দিন মায়ের কাছে গিয়ে থাকলে কেমন হয়! কথাটা মনে হওয়ামাত্র মনের মধ্যে আর একটা মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। স্পর্ধা দেখিয়ে চলে আসার পর এখন দরকারে পড়ে সুবিধা নিতে যাওয়ার মধ্যে যে অগৌরবের গ্লানি, সেটাই উপলব্ধি করে অন্তরাত্মা সংকুচিত হয়ে ওঠে তিথির। এত তাড়াতাড়ি হারও তো সে মানতে চায় না। সে এখানে থেকেই পড়বে, পরীক্ষা দেবে, পাশ করবে…মায়ের কাছেই যে তার নিজেকে প্রমাণ করার দায় অনেক বেশি।
তিথি মুখে হাত চাপা দিয়ে কেঁদে উঠল। হল না…হল না। তার আগেই সে হারতে বসেছে। সব মিথ্যে হয়ে গেল। আর তার পড়াশুনা হবে না। দু-মাস হয়ে গেছে, পরীক্ষার আর মাস ছয়েক বাকি। কী করে ওই সময়ে পরীক্ষা দেবে! এ কী শাস্তি দিলেন তাকে ঈশ্বর। কেন উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে-না-করতেই এমন করে তার হাত পা বেঁধে দিলেন!
পার্থ ঘরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিল। তিথির দিকে তাকিয়ে হাতের এমন একটা ভঙ্গি করল যেটা একই সঙ্গে গর্বিত এবং অশালীন। তার সমস্ত মুখে আনন্দে জ্বলজ্বল করছে। তিথির মুখে হাসি নেই দেখে সে এগিয়ে এল, ‘এই মেয়েটা, ইশ্ খুব ঘাবড়ে গেছ না? সব ঠিক হয়ে যাবে। উফ্ এটা যে কী দুর্দান্ত একটা ব্যাপার, তিথি, আমি ভাবতেই পারছি না আমি বাবা হতে চলেছি! দিস ইজ রিয়েলি আ গ্রেট ফিলিং!’
‘কী খাওয়াবে?’ তিথির গলার স্বর শুকনো খটখটে। তার চোখেও এখন একফোঁটা জল নেই।
‘বলো কী খেতে চাও।’ পার্থ ডগমগ করছে, ‘বেগুনি খেতে ইচ্ছে করছে, না আলুর চপ?’
‘আমার কথা বলছি না।’
‘তবে?’ পার্থ একটু থিতিয়ে গেল।
তিথি ধীরে ধীরে উঠে বসল। তার চোখ পার্থর চোখের দিকে স্থির। খানিকক্ষণ একভাবে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘বাচ্চাটাকে তুমি কী খাওয়াবে সেটাই জানতে চাইছি। সে তো জন্মেই ভিক্ষে করবে না।’
পার্থর মুখটা একমুহূর্তে কালি হয়ে গেল। ক্ষুব্ধ স্বরে বলল, ‘বাজে কথা বোলো না। ভিক্ষে করতে যাবে কেন? ছিঃ!’
‘তা ছাড়া আর কী পার্থ!’ তিথি আর্তস্বরে বলে উঠল, ‘তুমি বুঝতে পারছ না আমরা এখন একটা বাচ্চার জন্যে তৈরি নই! আমরা ভুল করে ফেলেছি পার্থ। তুমি কিচ্ছু করো না, সংসারের এই অবস্থা। আমাকে তো পরীক্ষাটা দিতেই হবে—’ তিথি হাঁপাচ্ছিল। পার্থর হাত ধরে ফেলল সে, ব্যাকুল গলায় বলল, ‘না না পার্থ, খুব ভুল হয়ে গেছে। আমাদের কিছু করা উচিত, এ হতে পারে না।’
‘কী হতে পারে না! কী বলছ কী তুমি?’ পার্থর কপালে প্রবল ভ্রূকুটি।
‘এখন আমি…আমি পারব না…’ তিথি কাঁদতে শুরু করল। তার হাতটা সরিয়ে দিল পার্থ। চোখেমুখে ঘৃণা ফুটিয়ে বলল, ‘মানে? তুমি মা হতে চাও না? চমৎকার! কেন জানতে পারি কী!’
চেঁচিয়ে উঠল তিথি, ‘সেই কথাটাই তো বলছি আমি। তুমি কেন বুঝতে পারছ না পার্থ! আমি…আমরা…আমাদের পক্ষে এখন
এসব সম্ভব নয়—’
পার্থ তার কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিল, ‘দ্যাখো তিথি! সব বিষয় অনর্থক জটিল করে তোলা তোমার স্বভাব। এখনও ঠিক সেটাই করছ। আমাদের পক্ষে কী কতটা সম্ভব সেটা আমাকেও ভাবতে দাও। সব ভাবনা তুমি একাই ভাববে তা তো হতে পারে না। তৈরি নও মানে আবার কী? তুমি এখনও নিজেকে বাচ্চা ভাবছ নাকি, সেইজন্যে এক্ষুনি বাচ্চা চাইছ না? জানো, মায়ের তোমার মতো বয়সে আমি আর সীমা হয়ে গেছি?’ পার্থ আবার ঝাঁকাল তিথিকে, ‘একদম বাড়াবাড়ি করবে না। অত চিন্তার কিছু নেই।’
তিথি ছটফট করে বলল, ‘কিন্তু আমি পরীক্ষা দেব কী করে পার্থ! তখন আমার আটমাস চলবে…শরীর খারাপ যদি বাচ্চাটা হওয়ার সময় হয়ে যায়?’
করবে নিশ্চয়ই,
‘পরীক্ষাটা এর চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়।’ পার্থ হাত নাড়াল, ‘পরীক্ষা চাইলে পরেও দেওয়া যাবে।’
তিথি বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে থাকল। বিড়বিড় করে বলল, ‘পরে! পরে আর কবে দেব…
তার চোখের সামনে একটার পর একটা গাঢ় রঙের পর্দা পড়ে যাচ্ছিল। যেন আলোর শেষতম বিন্দুটি থেকেও অধিকারচ্যুত হয়ে যাচ্ছে তার দৃষ্টি। এ বছরও যদি পার্ট ওয়ানটা না দেওয়া হয়, তার পরের ধাপগুলো পেরোবে কবে সে! পেরোনো কি যাবে আদৌ! একটা বাচ্চার জন্ম দেওয়ার পর সেই সুযোগ তাকে দেবে কি এই সংসার! তিথি অন্ধের মতো হাত বাড়াতে চাইল, অনির্দিষ্টভাবে। সে একটা অন্ধকার খাদে ঝাঁপ দিয়েছিল। খাদটা নীচের দিকে সরু হতে হতে একটা কুয়ো হয়ে যাচ্ছে। কুয়োর দেওয়াল চারপাশ থেকে চেপে বসছে তিথির ওপরে, সে আর হাত-পাও নাড়তে পারছে না…।
রাত্তিরে খেতে বসে আবার গা গুলোচ্ছিল তিথির। সুধা ইতিমধ্যে নিশ্চয়ই অলক আর সীমাকে সব কিছু বলেছেন। সীমার মুখে
তিথির বুকে বিরাট একটা ঢেউ ভাঙার মতো ধাক্কা লাগল। সত্যিই মৌসুমী কি? না না, তা কী করে হবে। মৌসুমীর বিয়ে হয়ে গেলে সে খবর পেত না! তিথি চোখ বড়ো করে ভালো করে দেখল। মেয়েটি অনেক বড়োই হবে। মৌসুমীর মতো চুলের ধরন, সুন্দরীও। হাসিটা তো একদম মৌসুমীর মতো। কিন্তু মৌসুমী নয়, অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নিল তিথি। তার বুক এখনও ধড়াস ধড়াস করছে।
তিথি ফুটপাত ধরে এলোমেলো হাঁটতে শুরু করল। জোর করে মনটাকে অন্যদিকে সরানোর একটা উপায় পেয়েছে সে। মৌসুমীর কথা মনে পড়ছে খুব। আশ্চর্য, কতদিন দেখা হয়নি ওর সঙ্গে? তার এতদিনের প্রাণের বন্ধু! আজ তো সে মৌসুমীর নিকটাত্মীয়, তবু যোগাযোগ নেই। জীবন বুঝি এরকমই হয়। এক একটা বাঁকের আড়ালে হারিয়ে যায় কত কত মুখ। তিথি ভাবছিল, মৌসুমী নিশ্চয়ই খুব হতাশ হয়েছে। তার ওপর রাগ করেছে এভাবে পড়াশুনা ছেড়ে বিয়ে করে ফেলায়। তা ছাড়া, মৌকে সে নিজে থেকে কিছু জানাতেও চায়নি। ওর অভিমান হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে এতদিনের মধ্যে একদিনও দেখা হবে না এটা তিথি ভাবেনি। তার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। মৌ তো জানে সে কোথায় আছে, একদিন জেঠুর বাড়িতে এলেই তো তার সঙ্গে দেখা হয়! গলার কাছে একটা কষ্ট উঠে এল তিথির। মৌসুমী তাকে এড়িয়ে যেতে চেয়েছে, তাকে ভুলে যেতে চেয়েছে। বন্ধু হিসেবে তিথিকে সে সাদরে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু তার এই পরিণতি হয়তো সে চায়নি, ‘ভালোই করেছিস রে মৌ, আমায় ভুলে গিয়ে’, তিথি বিড়বিড় করল,—‘এখন আমায় দেখলে নির্ঘাত ঘেন্না করতিস তুই!’ তার মনে হল, মৌসুমী নিশ্চয়ই তার খবরাখবর রাখে। অলক তো মাঝেমধ্যে যান ওদের বাড়ি। তিথিই এতদিন তার সম্বন্ধে কোনো কথা জিজ্ঞেস করেনি। খুব অনুতপ্ত বোধ করল সে। সত্যিই, সে নিজেও মৌকে কতখানি মনে রেখেছে!
সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরে গম বাছতে বসেছিল তিথি। রেশনের গম। আটা ফুরিয়ে এসেছে। কাল গম না ভাঙানো হলে রুটিই হবে না। আগে এ বাড়িতে গম বাছার চল ছিল না। তিথি আসার পর শুরু হয়েছে। রেশনের গমে রাশিরাশি আবর্জনা মেশানো থাকে। কাঁকর, মাটির ঢেলা, কাঠি, শেয়ালকাঁটার বীজ আরও কত কী! সেসব সুদ্ধুই আটা হয়ে পিষে আসত ভাঙানির দোকান থেকে।
তিথি এ বাড়িতে আসার পর পরই একদিন বলেছিল, ‘বড়োমা, গমটা মনে হয় একটু বেছে নিলে ভালো হয়। দেব বেছে?’
‘আমার আর অত গম-টম বাছার সময় হয় না। তোমার ইচ্ছে হলে করো!’ সুধা বলেছিলেন। তারপর থেকেই গম বাছাটা তিথির নিয়মিত কাজের মধ্যে পড়ে গেছে।
দ্রুত হাত চালাতে চালাতে তিথি ভাবছিল আজ পার্থকে কীভাবে জানাবে তার সিদ্ধান্তর কথাটা। এর আগের দিনই পার্থ কোনো কথা শুনতে চায়নি। আজ নিশ্চয়ই বাড়িতে প্রলয় হবে। তিথির বুকের মধ্যে ভয় লাফাচ্ছে। কিন্তু মন স্থির রাখার চেষ্টা করছে সে। একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে অন্ধকারে ঝাঁপ দিয়ে এখনও পায়ের তলায় মাটি পায়নি, এত তাড়াতাড়ি আরও একটা ভুল সে কিছুতেই করবে না।
অলক অফিস থেকে বাড়ি আসতেই সুধা বললেন, ‘বাবার চিঠি এসেছে।’
অলক শার্টের বোতাম খুলছিলেন, ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘বাবার চিঠি? কই? কী লিখেছে?’
‘আমি খুলে দেখিনি। কোনদিক দিয়ে ছিঁড়তে কোনদিক ছিঁড়ে ফেলব। ইংল্যান্ডের চিঠি। সীমাও পড়াতে গেছে।’
ইংল্যান্ডের চিঠি শুনে তিথি অবাক হয়ে মুখ তুলে তাকাল। বাবার চিঠি মানে নিশ্চয়ই বর্ধমানের দাদু। সুধার মা-বাবা ওঁর ছোটোবেলাতেই মারা গিয়েছেন, তিথি শুনেছে। কিন্তু ইংল্যান্ড থেকে চিঠি দিয়েছেন কে!
সুধা যে চিঠিটা অলকের হাতে এনে দিলেন, সেটা দেখেই অবশ্য তিথি ভুল বুঝতে পারল। তার মুখে চাপা হাসির আভাস ফুটে উঠেছিল। অলক আড়চোখে সেটা দেখে বললেন, ‘ইংল্যান্ড না, ইনল্যান্ড ইনল্যান্ড। সীমা ছিল না, তিথি তো ছিল। ও তো জানে
ইনল্যান্ড কোনদিক দিয়ে খোলে। এতক্ষণ চিঠিটা না পড়ে রেখে দিয়েছ?’ অলক আঙুল ঢুকিয়ে এবড়োখেবড়ো করে চিঠির মুখটা ছিঁড়লেন। ভাঁজ খুলতে খুলতে বললেন, ‘এখন তো বাবার চিঠি আসার কথা না। দেখি আবার কী সংবাদ!’
পড়তে পড়তে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল অলকের মুখ, সুধাকে বললেন, ‘মা আসছে, বুঝলে! সঙ্গে অসীম পাগলাটাও! মায়ের নাকি চলতে-ফিরতে খুব অসুবিধে হচ্ছে, পা তুলে ফেলতে পারছে না। ওখানে ডাক্তার দেখিয়েছে, বলেছে নার্ভের রোগ। এক্ষুনি কলকাতায় এনে চিকিৎসা করানো দরকার—’
সুধা শুনছিলেন। ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘সব দায়িত্ব শুধু আমাদের। আর অন্যরা কেউ কিছু করবে না!’
‘সে কথা আর কী বলব বলো!’ অলক চিন্তান্বিত মুখে চিঠিটা দেখতে দেখতে বললেন, ‘খরচ খরচা কিছু মায়ের সঙ্গে পাঠিয়ে দেবে লিখেছে বাবা। সামনের রোববার আসবে। মানে…আজ তো বেস্পতিবার।…দোকানের লোকটা পৌঁছে দিয়ে যাবে। এই যে বাবা লিখেছে,
সবদিক বিবেচনা করিয়া তোমাকেই পত্র লেখা স্থির করিলাম। অন্যান্য ভাইদিগের সঙ্গে আলোচনা করিয়া যাহা সুবিধা হয় করিও। তবে আমার মনে হয় আর কেহ তোমাদের মাকে রাখিতে চাহিলেও অসীমকে রাখিতে চাহিবে না। সে বেচারি এবার কিছুতেই মাকে ছাড়িয়া থাকিতে চাহিল না। তোমাদের মাও খুব অবুঝ হইলেন। যাহা হউক আমার মনে হয় ক-টা দিন উহাদের তোমাদের গৃহেই রাখিও। কষ্ট একটু হইবে। আর কী করা। আমি আর যাওয়ার আবশ্যক দেখি না। তোমরা আমার স্নেহাশীষ নিও। ইতি তোমাদের বাবা।
‘অলক গড়গড় করে পড়ে থামলেন। সুধার দিকে তাকিয়ে বিপন্ন মুখে বললেন, ‘বোঝো অবস্থা। এর মধ্যে অসীমটার কি না এলেই চলছিল না। পাগল-ছাগল আর বলেছে কাকে। সত্যিই তো, ওকে কে রাখবে নিজের বাড়িতে। বাবা খুব ভালোই জানে
অন্য ছেলেদের ল্যাজ কত মোটা।’
অলক চিঠি রেখে জামা খুললেন। সুধা কঠিন গম্ভীর মুখে বসে ছিলেন। বললেন, ‘ওই জন্যেই তারা শুধু নিজেদের নিয়েই আছে। কর্তব্য করার বেলায় শুধু আমরা।’
অলক গজগজ করলেন, ‘আর পারা যায় না। আমার ওপর যত হ্যাপা। কেউ রাজি হবে না সে আমি জানি, তবু দেখি একবার অরূপের বাড়ি যাই কাল। এত লোক এখানে থাকারও তো অসুবিধে। অশোককেও কাল একটা ফোন করব—
‘কোনো লাভ নেই। ওদের বলে কিছু হবে না, কেউ গায় জল ফেলতে দেবে না, দেখো, বউদের তো চিনি।’ সুধা হাত নাড়লেন, ‘উপায় আমাকেই করতে হবে। থাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। ওপরের ঘরটা তো আছে। মা নীচে থাকুক, অসীমকে ওপরে পাঠিয়ে দেব।’
তিথি চমকে সুধার দিকে তাকাল। সুধা তার চোখে চোখ ফেললেন না, অলকের দিকে তাকিয়েই বললেন, ‘বিছানাপত্র নিয়েই মুশকিল হবে। ওপরে মেঝেতে বিছানা করতে হবে। তুমি আর পার্থ ওপরে মেঝেতে শুয়ো, বুঝলে? নীচে আমরা মেয়েরা রয়ে যাব।’
লুঙ্গি পরতে পরতে ছেলেমানুষের মতো মাথা ঝাঁকালেন অলক, ‘না না। আমি খাটে ছাড়া শুতে পারি না—’
‘আচ্ছা আচ্ছা সে দেখা যাবে।’ সুধার মুখে বিরক্তি, ‘খাটে শোব না বললে হবে কী করে। বুঝমতো চলবে তো! আমার হয়েছে সবদিকে জ্বালা।’ ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি।
তিথি স্থির হয়ে বসে ছিল, মনের মধ্যেটা নিভে আসছে তার, প্রাণপণে একদিক সামলাতে গিয়ে অন্যদিক দিয়ে আরেকটা সমস্যা ঢুকে পড়ছে ক্রমাগত। নাকাল হয়ে যাচ্ছে তিথি, হাবুডুবু খাচ্ছে। যাও-বা তার একটা নিজস্ব আড়াল গড়ে তুলতে পেরেছিল সে, পড়াশুনার যৎসামান্য সুযোগ, সেটুকুও আবার ধসে পড়ল খানখান হয়ে!
অলক চাপা গলায় তাকে ডাকলেন, ‘এই যে, শোনো! ও তিথি!’
তিথি মুখ তুলে তাকাতেই অলক ফিসফিস করে বললেন, ‘তুমি একটু দেখো তো, তোমার বেশ বুদ্ধি আছে। এমন একটা হিসেব বার করো যাতে আমি খাট থেকে স্থানচ্যুত না হই, বুঝলে!’ অলক ব্যস্তসমস্ত হয়ে বাথরুমের দিকে এগোতে এগোতে বললেন, ‘এই ঠান্ডায় মেঝেতে শোয়া, বাবারে! দাও দাও চা দাও –
তিথি যন্ত্রচালিতের মতো উঠল। রান্নাঘরে গিয়ে দেশলাই জ্বালাতে গিয়ে তার হঠাৎ মনে হল, সুধা কী সুন্দর চট করে হিসাব করে ফেললেন কে কোথায় শোবে। অলক যাই বলুন, এটাই সবচেয়ে ঠিকঠাক ব্যবস্থা। অথচ, ওপরের ঘরটা না থাকলে এই ব্যবস্থা সম্ভব হত না। তিথির মনে পড়ল, যেদিন সে ঘরটা পরিষ্কার করেছিল সুধা কী রাগই না করেছিলেন। সেসব তাঁর নিশ্চয়ই মনে নেই। কিংবা মনে থাকলেইবা কী!
শিবানী আর অসীমের আসার খবর শুনে পার্থর কোনো হেলদোল হল না। সীমা অবশ্য খুব খুশি। তিথি শুনল সে অলককে বলছে, ‘মা ঠিকই বলেছে বাবা। আমাদের তো এখন ঘরের অসুবিধে নেই। ঠাকমা আর ছোটোকা এখানেই বেশ থাকতে পারবে। খুব ভালো হবে।’
রাত্রে পার্থ তিথির কাঁধে হাত রাখল, ‘কী গো, মনখারাপ?’
তিথি পার্থর দিকে তাকাল না। সে মনে মনে অন্য যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে।
‘যাঃ তোমার সাধের ঘর থেকে পাততাড়ি গুটোতে হচ্ছে।’ পার্থ হাসল, ‘ভেবো না। ঠাকমা আর ক-দিন থাকবে? ট্রিটমেন্ট গেলেই চলে যাবে। আমি অবশ্য ভেবেছিলাম এ ক-দিন খুব ভালোবেসে নেব, বাচ্চাটা লাথি ছুড়তে শেখার আগে’, বন্ধ করল সে, বলল, ‘দুপুরবেলা দু-একদিন ছোটকাকে সরিয়ে আমরা ঠিক ম্যানেজ করে নেব, হ্যাঁ?’
‘আমার তোমাকে একটা কথা বলার আছে পার্থ।’ তিথি মনের সমস্ত জোর একজায়গায় করে বুক ভরে দম নিল।
পার্থ একটু অবাক হয়ে তাকিয়েছিল। তিথি হঠাৎ খুব জোর দিয়ে দিয়ে উচ্চারণ করল, ‘তোমার নিশ্চয়ই মানতে কষ্ট হবে। কিন্তু এটা আমার সিদ্ধান্ত। তোমাকে আমার কথা শুনতে হবে। শুনতেই হবে।’
‘কী বলছ? কী কথা?’ পার্থর গলায় সন্দেহ।
তিথি তীব্র গলায় বলল, ‘বলো, বলো তুমি আমার কথা রাখবে?’
‘এরকম করছ কেন? কী কথা না শুনলে কী করে বলি?’ পার্থ একইসঙ্গে বিরক্ত এবং কৌতূহলী।
তিথি সময় নিচ্ছিল। এই কথাটাকে মনে মনে বহুবার আবৃত্তি করেছে সে, কিন্তু বলতে গিয়ে মুখে আটকে যাচ্ছে তার। মরিয়া হয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল তিথি, তারপর শ্বাসরুদ্ধ স্বরে বলল, ‘আমি…আমি অ্যাবরশন করাতে চাই।’
সে ভেবেছিল, কথাটা শুনেই পার্থ চেঁচিয়ে উঠবে, তেড়ে আসবে তার দিকে। কিন্তু পার্থ সেসব কিছুই করল না। তিথি ধীরে ধীরে চোখ খুলে দেখল পার্থ ক্রূর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার সমস্ত অবয়বে বিজাতীয় নিষ্ঠুরতা, চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘না। সে আমি
হয়ে একটা চোখ
কিছুতেই হতে দেব না। আমি ভেবে পাচ্ছি না এ কথা তুমি ভাবলে কী করে!’
তিথি অনুনয়ের সুরে বলল, ‘প্লিজ, প্লিজ পার্থ। আমাকে একটু বোঝার চেষ্টা করো। এরকম কোরো না… আমাকে একটু উঠে দাঁড়ানোর সুযোগ দাও…তোমার নিজেরও তো তার আগে দাঁড়ানো দরকার…আমাদের কিছু নেই পার্থ, সন্তানকে দেওয়ার মতো কোনো ভবিষ্যৎ নেই আমাদের….’।
‘তোমাকে বার বার বলছি তিথি, এসব চিন্তা মাথা থেকে তাড়াও। পাগল হয়ে যাচ্ছ তুমি। যাবে।’
সেইসব করলে একেবারে উন্মাদ হয়ে
‘আমি পাগল!’ তিথি বিস্ফারিত চোখে বলল, ‘আমাকে তুমি পাগল বানাতে চাইছ?’
‘আমি চাইছি না। তুমি চাইছ। তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি—’ পার্থ তর্জনী নাচাল, ‘শুনে রাখো, তুমি যদি অ্যাবরশন করাও তাহলে তোমার শরীরে খুঁত হবে। জীবনে আর মা হতে পারবে না তুমি। অথচ মা হতে চাইবে পাগলের মতো। তারপর উন্মাদ হয়ে যাবে—’
তিথি কানে হাত চাপা দিল, আর্ত চিৎকারকরে বলল, ‘ব্যাস ব্যাস ব্যাস। আর শুনতে চাই না। কে বলেছে এসব কথা? তোমাদের ওই জ্যোতিষী, তাই না?’
পার্থ ঘাড় নাড়ল, ‘হ্যাঁ, অনেকদিন আগেই বলেছিলেন নকুলবাবু। তোমার মধ্যে নাকি এইসব অশুভ টেন্ডেনসি আছে। তোমার মায়ের প্রভাবের জন্যই। আমাকেই তোমায় ওই মহিলার হাত থেকে টেনে বার করে আনতে হবে। ছিঃ তিথি! অ্যাবরশন কত বড়ো একটা পাপ তোমার সে জ্ঞান নেই? মাতৃত্ব একটা মেয়ের কাছে কী বিরাট গৌরবের, তুমি তাকে—’
দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে চেঁচিয়ে উঠল তিথি, ‘হ্যাঁ, বেশ করব। বাবা হয়ে তুমি তাকে জন্মানোর পরে মারবে। আমি তাকে জন্মানোর আগেই মারব। বেশ করব, তুমি আমাকে বাধা দিতে পারো না—’
পার্থ হিসহিস করে উঠল, ‘জঘন্য! তুমি এত জঘন্য মেয়ে আমার ধারণা ছিল না। নকুলবাবু অবশ্য বলেছিলেন, তোমার মা—’
পার্থর কথা শেষ হল না, তিথি হঠাৎ পার্থর খুব কাছে এসে দাঁড়াল। তাকে অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে। তীব্র গলায় বলল, ‘ও! আচ্ছা! আরও আছে? কথাগুলো বড়ো আস্তে আস্তে বেরোচ্ছে। আরও কী কী বলেছেন তোমাদের জ্যোতিষী, আমার সম্বন্ধে?’
পার্থ দাঁতে দাঁত ঘষল, বলল, ‘তুমি একটা নোংরা ইতর মেয়ে——
তিথি আরও কাছে চলে এল, প্রচণ্ড শীতল স্বরে বলল, ‘আচ্ছা আমি না হয় নোংরা ইতর মেয়ে, কিন্তু তুমি তো পুরুষই নও, একটা নপুংসক। তোমাদের জ্যোতিষী বলতে পারবেন, আমার পেটে তোমার বাচ্চা এল কী করে?’
পার্থর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল কয়েকটা অশ্রাব্য গালাগাল। তিথির চুলের মুঠি ধরে তাকে একটা ধাক্কা মারতেই এক লহমায় তিথিও জন্তু হয়ে গেল। আজন্মের সমস্ত শিক্ষা, রুচি, ধৈর্য আর বোধ অবলুপ্ত হয়ে গেল তার। পার্থর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এলোপাথাড়ি আঁচড়ে কামড়ে দিচ্ছিল সে। পার্থ আত্মরক্ষা করতে পারছিল না, কেননা তিথি সম্পূর্ণ জ্ঞান হারিয়েছে। মিনিট খানেক পরে শরীরের সবটুকু শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার পর তিথি হড়হড় করে বমি করে দিল পার্থর গায়ে। তারপর চোখ বুজে এলিয়ে পড়ল মেঝেতে। এবারে সে সত্যি সংজ্ঞা হারিয়েছে।
রাত্রে একবার জ্ঞান ফিরেছিল তিথির, কিন্তু তারপরই আবার ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিল সে। পরের দিন যখন ঘুম ভাঙল, সারা গায়ে আর মাথায় অসহ্য ব্যথা। উঠবার শক্তি নেই। এমনকী মাথাও কাজ করছে না। একটুক্ষণ চোখ খুলে থাকার পর পরই
আবার আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছিল সে। সারাদিন এভাবেই কাটল। কেউ ডাকতেও এল না তাকে। সন্ধ্যে পেরিয়ে যাওয়ার পরে কোনোরকমে উঠে টলতে টলতে সে নীচে নেমে এল।
পার্থ নীচেই ছিল। তিথিকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিল অন্যদিকে। পার্থর কপালের ডান পাশে একটা গভীর আঁচড়ের দাগ। সেখানে মারকিউরোক্রোম লাগানো। সীমা জ্বলন্ত চোখে তিথির দিকে তাকিয়েই ছুটে রান্নাঘরে গিয়ে বলল, ‘মা, দেখবে এসো। তিনি নেমেছেন।’
রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন সুধা, দু-মুহূর্ত তিথির দিকে তাকিয়ে থেকে দাঁতে দাঁত পিষে বললেন, ‘তোমার ভাগ্য ভালো যে এখনও তোমার গায়ে কেউ হাত তোলেনি। একতরফা তুমিই মেরে যাচ্ছ। পেটের বাচ্চাটাকে খুন করতে চাও। ওইসব বদমায়েশি এ বাড়িতে চলবে না। আমার অনেক আগেই তোমায় শায়েস্তা করা উচিত ছিল, নইলে এত বাড় বাড়তে না। মাধুও তোমায় বড্ড লাই দিত, সে আর দেবে না কেন, বউ নিয়ে তো তাকে আর ঘর করতে হয় না। বাইরে থেকে ভালো সাজা খুব সহজ।’ সুধা সীমার দিকে তাকালেন, ‘নিয়ে আয় শাঁখা-পলাগুলো। আর নকুলবাবুর মাদুলিটাও নিয়ে আসবি।’
তিথি স্থির হয়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকল। সীমা গম্ভীরমুখে শাঁখা-পলাগুলো নিয়ে আসতেই সুধা বললেন, ‘আর যদি কখনো খুলেছ তো দেখবে তোমার একদিন কি আমার একদিন। পরে নাও ওগুলো। আর ওই মাদুলিটা গলায় পরো। ওতে মগজ ঠান্ডা করবে। আর একদম বেগড়বাই করবে না। পরশু মা আর অসীম আসছে। ওদের সামনে যেন কোনো বেচাল না দেখি।’
তিথি সীমার হাতের দিকে তাকিয়ে দেখল তার হাতে শাঁখা-পলা ছাড়াও একটা বড়োসড়ো মাদুলি, লাল সুতো দিয়ে বাঁধা। সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়েই থাকল, হাত বাড়াল না।
সুধা হুংকার দিলেন, ‘কী হল! কথা কানে যাচ্ছে না!’
‘ওসব আমি পরব না বড়োমা।’ তিথি মাথা নাড়ল। সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। সমস্ত শরীর ঝিমঝিম করছে। তবু ঘাড় শক্ত রেখে দাঁড়িয়ে রইল সে।
সুধা চিৎকারকরলেন, ‘পরবে না মানে? তোমার ঘাড় পরবে। তোমার চুলকাটা মায়ের মতো বেহায়া বাউণ্ডুলে সেজে ঘুরে বেড়াবে নাকি?”
‘আমার মা বেহায়া বাউণ্ডুলে নন।’ তিথির আবার গা পাক দিয়ে উঠল।
পার্থ লাফিয়ে এল, ‘ফের কথা? অনেক সহ্য করেছি আমরা। যা ইচ্ছে তাই করে যাচ্ছ তুমি। আর নয়। চুপচাপ মায়ের কথা শুনবে তো শোনো। নইলে বেরোও বাড়ি থেকে।’
তিথির শরীর মুচড়ে ওয়াক আসছিল, মুখের সামনে হাত চাপা দিল সে। কোনোক্রমে সামলে নিয়ে দু-হাতের লোহা আর ব্রোঞ্জের চুড়ি খুলে রাখল মেঝের ওপর। তারপর জুতোয় পা গলাল।
সুধা চোখ কপালে তুলে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘একী একী একী, লোহা খুলে ফেললে! এ কী সাংঘাতিক মেয়ে রে! ও কি মেয়ে না রাক্ষুসি? ও কোথায় যাচ্ছে?’
পার্থ তিথির হাত চেপে ধরল, ‘কী সিন করছ, অ্যাঁ! মার খেয়ে মরার সাধ হয়েছে?’
তিথি মাথা নাড়ল, ‘আমি সিন করছি না। তুমিও কোরো না। ডেকেছিলে বলে এসেছিলাম। চলে যেতে বলছ চলে যাচ্ছি। এই দুইয়ের মধ্যিখানে আমাকেও কম সহ্য করতে হয়নি—’
‘দে দে দে ওকে যেতে দে, যাবে আর কোন চুলোয়। আমাকে অপমান করাই ওর কাজ। তুইও গেলি আবার বউয়ের হাত ধরে টানতে। ছি ছি ছি.…..’ সুধা কাঁদতে শুরু করলেন। পার্থ তিথির হাত ছেড়ে দিল, গম্ভীর গলায় বলল, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। যা ইচ্ছে করো, আমার কিছু বলার নেই। কিচ্ছু বলার নেই।’
তিথি বেরিয়ে গেল।
খানিকক্ষণ পর যখন অলক বাড়ি ফিরলেন, পার্থ তখন গুম মেরে বসে আছে। সুধা কাঁদছেন আর তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছে সীমা। অলক বললেন, ‘তিথি কোথায় গেল? চৌরাস্তার পাশের গলিতে ওর সঙ্গে দেখা হল, আমি ডাকলাম, শুনতেই পেল না…’ হঠাৎ দৃশ্যপটের ওপর ভালো করে চোখ বুলিয়ে তিনি সন্দিগ্ধ গলায় বললেন, ‘বলি হল কী তোমাদের, অ্যাঁ!’
সুধা ডুকরে উঠলেন, ‘হবে আবার কী! মাথা আর মুণ্ডু। চোখের ওপর দেখতে হল হাতের লোহা খুলে হাত খালি করে ফেলল জলজ্যান্ত জোয়ান ছেলের বউ। ও কি কম শয়তান! আবার ঝগড়া করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল ভরসন্ধ্যেবেলা পোয়াতি অবস্থায়। এত আস্পর্ধা ধৰ্ম্মে সইবে না।’
অলক ধমক দিলেন, ‘আঃ থামো দিকি।’ পার্থর দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললেন, ‘হাত-পা কোলে করে বসে আছিস কী বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল মেয়েটা, যা গিয়ে খুঁজে আন?”
‘ছাড়ো তো!’ পার্থ চোয়াল শক্ত করল, ‘যেখানে গেছে যাক। যাবে আর কোথায় এই রাত্তিরবেলা। পয়সাও তো নেই সঙ্গে। খুঁজতে হবে না। একটু পরে নিজেই চলে আসবে।’
একটা অন্ধ উদগ্র ঝোঁকে তাড়িত হয়ে তিথি প্রায় দৌড়োচ্ছিল। রাস্তাটায় আলো খুব কম। শীতের কুয়াশার সঙ্গে আলো-আঁধারি
রে!
মিশে রহস্যসংকুল হয়ে আছে। ফাঁকা ফাঁকা গলি, বাঁকের পর বাঁক নিতে নিতে এলোপাথাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে তিথি। অলকের সঙ্গে ওভাবে দেখা হয়ে যাওয়ায় সে আরও দিশাহারা হয়ে গেছে। অল্প আলোয় অলক প্রথমে তাকে চিনতে পারেননি। তিথিও খেয়াল করেনি। উলটোদিক থেকে তাকে পেরিয়ে গিয়ে হঠাৎই থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন অলক, বলে উঠেছিলেন, ‘কে? তিথি না? কোথায় যাচ্ছ?”
তিথি উদ্ভ্রান্তের মতো পথ চলছিল। অলকের গলা শুনে সে আর পিছনে তাকায়নি। তাড়াতাড়ি গতি বাড়িয়ে গলির মোড় ঘুরে গিয়েছিল। খানিকটা প্রায় দৌড়ে চলার পর ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল সে। না, কেউ আসছে না তার পিছনে।
গলগল করে ঘামছে তিথি। তার গায়ে কোনো গরম জামা নেই, এমনকি সালোয়ার কামিজের নীচে কোনো অন্তর্বাসও নেই। পাগলের মতোই বেরিয়ে এসেছে সে বাড়ি থেকে। কোথায় যাবে সে এবার! কোথায়?
আবার আর একটা অন্ধকার খাদের পাশে দাঁড়িয়ে তিথি মনস্থির করার চেষ্টা করল। এবারের ঝাঁপটা তার অনেক বেশি সুনিশ্চিত হতে হবে। কোনো ভুল আশা নয়, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য মাথায় রেখেই লাফাতে হবে তাকে। নিশ্চিত মৃত্যুর লক্ষ্যে।
তিথি অসহায় বোধ করল। এই মুহূর্তে তার হাতে কী কী উপায় আছে আত্মহত্যার? রেললাইনে গলা দেওয়া? রেললাইন কত দূরে, এদিকে রেললাইন কোথায় আছে তাই তো সে জানে না। হাঁটতে হাঁটতে ডায়মন্ডহারবার রোডে এসে পড়ল তিথি। পাণ্ডুর হ্যালোজেন আলো আবর্জনার মতো ছড়িয়ে আছে পিচরাস্তায়। বাস ট্রাম চলছে যেন অতিকায় নিশাচর জন্তুর মতো। মাঝে মাঝে দ্রুতগতিতে চলে যাচ্ছে একটা-দুটো ট্রাকও। তিথি মনের মধ্যে উপায় হাতড়াতে লাগল। ওইরকম একটা ট্রাকের সামনে লাফিয়ে পড়া যায় না? খুব কি কঠিন হবে ব্যাপারটা? তিথি একাগ্র মনে ভাবার চেষ্টা করল। তার ঠিক পেটের ওপর দিয়ে চলে যাবে ট্রাকের পিছনের ভারী ভারী চাকা। মরতে কত সময় লাগবে তার? নিজের পিষে যাওয়া বীভৎস মৃতদেহটাকে মনশ্চক্ষে একবার দেখে নেওয়ার পরই পার্থর মুখটা কল্পনা করার চেষ্টা করল তিথি। একটুও কি কষ্টের দাগ আছে সেই মুখে? সামান্য
নাঃ, তিথি মাথা ঝাঁকাল। কিচ্ছু নেই ওই মুখে। একটা স্বাভাবিক প্রতিশোধপরায়ণ শ্বাপদের মতো অকারণ নিষ্ঠুরতা ছাড়া আর কিছু নেই। কী সাংঘাতিক ভুল করেছে সে মানুষ চিনতে! এ কাকে ভালোবেসে নিজের জীবনটা তছনছ করে ফেলল সে! কার ওপর অভিমান করে মরতে চাইছে? যার জন্যে সব কিছু ছেড়ে অন্ধকারে ঝাঁপ দিয়েছিল, কতটুকু মূল্য দিয়েছে তার? আর একবার ঝাঁপ দিলেও তো সে ঝাঁপ আরও মূল্যহীন অর্থহীন হবে।
তিথি মায়ের মুখ মনে আনতে চেষ্টা করল। তাকে মৃত দেখার পর মা কীরকম করবেন? পাগলের মতো কাঁদবেন? কাঁদতে কাঁদতে বলবেন, ‘এ আমি জানতাম, জানতাম তিথি শেষ হয়ে যাবে, ওর আর বাঁচার রাস্তা নেই!’
তিথি হঠাৎ তীব্র অস্থিরতা অনুভব করল। মা ওইভাবে কাঁদছেন কেন? বুকফাটা কান্নায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছেন মা, তাঁর মুখটা ভয়ংকর যন্ত্রণায় বেঁকেচুরে ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে। তিথির খুব ইচ্ছে করল মাকে জড়িয়ে ধরে, ধরে সান্ত্বনা দেয়। কিন্তু তার তো আর কোনো উপায় নেই। আত্মহত্যার পর সে কী করে সান্ত্বনা দেবে মাকে!
‘চুম্মা চুমা দে দে…চুম্মা চুমা দে দে চুমা…….হুঁ হুঁ দে দে…’
তিথির বুকের মধ্যে ধড়াস করে উঠল। একটা লোক তার খুব কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। সোজা তার চোখের দিকে দেখছে। তিথি তাকাতেই লোকটা একটা চোখ ছোটো করল, তার দৃষ্টি তিথির গলা বেয়ে নীচে নামছে। হঠাৎ প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেল তিথি। এই শীতের রাত্রিতে সে একেবারে একা, আলুথালু, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত…এই বাজে লোকটা শিকারের গন্ধ পেয়ে গেছে। গন্ধে গন্ধে আরও কেউ জুটে যাওয়াও অসম্ভব নয়। এই প্রথম পরিস্থিতি সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠল তিথি। দৃঢ়পায়ে লোকটাকে পেরিয়ে এগিয়ে গেল যেদিকে এস থার্টি-ওয়ান বাসটা রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে সেইদিকে। এখনই ছাড়বে মনে হচ্ছে বাসটা,
অনুশোচনার?
তার আশেপাশে কিছু লোকজন দাঁড়িয়ে রয়েছে। তিথি সেদিকে পা বাড়াতেই লোকটা শিস দিয়ে উঠল, চাপা গলায় বলল, ‘কী জানু! কোনদিকে?’
এস থার্টি-ওয়ানের এইটাই স্ট্যান্ড, বেহালা চৌরাস্তায়। তিথি দেখল, কন্ডাক্টর ফুটপাতে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছেন। সরকারি বাসের কন্ডাক্টররা বেশ শিক্ষিত আর ভদ্র চেহারার হন। এই কন্ডাক্টরও সেইরকম, প্রৌঢ়, চোখে চশমা। তিথি পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে একটু ইতস্তত করে ডাকল, ‘একটু শুনবেন?’
কন্ডাক্টর বুঝতে পারেননি তিথি কাকে ডাকছে। তিথি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল সেই বাজে লোকটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে একটু দূরে। আশা ছাড়েনি। তিথিকে তাকাতে দেখে জিভ বার করল। তিথি এবার একটু জোরে ডাকল, ‘শুনছেন? একটু শুনুন না।’
‘আমাকে বলছেন?’ কন্ডাক্টর এবার তিথির দিকে ফিরলেন।
‘বলুন?’ তিনি সিগারেটটা শেষ করে মাটিতে ফেলে পা দিয়ে পিষলেন। তিথি তখনও কিছু না বলায় কন্ডাক্টরটি একটু অবাক হয়ে গেছেন, বললেন, ‘কী ব্যাপার দিদি? কী বলছেন?’
তিথি আর দেরি করল না। এক নিশ্বাসে বলল, ‘দেখুন। আমি খুব বিপদে পড়ে আপনার হেল্প চাইছি। আমার শরীর খুব খারাপ। আমার কাছে পয়সাও নেই। আমাকে একটু…মানে…আপনাদের বাসে করে একটু পৌঁছিয়ে দেবেন?’
কন্ডাক্টরটি কিছুক্ষণ সন্দিগ্ধভাবে তার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘কোথায় যাবেন আপনি?’
‘হ্যাঁ…’
তিথি স্টপের নাম বলল।
‘অ, আচ্ছা। উঠে পড়ুন।’
নিশ্চিন্ত হতে গিয়েও দ্বিধা করছিল তিথি, আবার বলল, ‘আমার কাছে টিকিটের পয়সা নেই কিন্তু…’
‘ঠিক আছে, বললাম তো।’ কন্ডাক্টর হাত ঝাঁকালেন, ‘বাস এক্ষুনি ছেড়ে দেবে, উঠে যান।’
হু-হু করে বাস চলছিল। তিথির মাথার মধ্যেও মহাবেগে ছুটে চলেছে চিন্তার উথালপাথাল স্রোত। স্রোতে ভেসে আসছে অজস্র মুখ। প্রতিটি মুখই পার্থর। কোনো মুখ উদাসীন, কোনোটা হিংস্র, কোনোটা কুটিল। কোনো মুখে কোনো পিছুডাক নেই। হঠাৎ তিথি চমকে উঠল, স্রোতে ভেসে এসেছে অন্য একটি মুখ। মাধুবউদির। মাধুবউদিকে না বলে চলে এসেছে সে। ‘মাধুবউদি, আমাকে ক্ষমা কোরো মাধুবউদি’, তিথি ফিসফিস করল, ‘তুমি খুব দুঃখ পাবে জানি, কিন্তু বলো, আমার আর কীই বা করার ছিল…’
বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে বেল টিপতে গিয়ে থরথর করে কাঁপছিল তিথি। কিছুটা শীতে, কিছুটা ক্লান্তিতে, বেশিটাই চূড়ান্ত স্নায়ুর চাপে। অদিতি বারান্দায় এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে!’
তিথি কিছুতেই স্বাভাবিক স্বর বার করতে পারল না। ভাঙা ভাঙা বিকৃত গলায় বলল, ‘আমি!’ নিজের গলা নিজের কানেই এমন অদ্ভুত অচেনা ঠেকল তার, ভয় হল মা বোধ হয় চিনতে পারবেন না। রাস্তার আলোগুলো আজও জ্বলেনি। তিথি কাঁপতে কাঁপতে আবার বলল, ‘আমি তিথি, মা!’
অদিতি রুদ্ধশ্বাসে সিঁড়ি দিয়ে নামলেন। দরজা খুলতেই তিথি ভেতরে ঢুকে সিঁড়িতে বসে পড়ল। তার আর কাঁদারও শক্তি ছিল না। অদিতির মাথার মধ্যে ভয় আর প্রশ্ন তোলপাড় করছে। তিনি বললেন, ‘এখানে বসে পড়লি কেন তিথি! শরীর খারাপ? ডাক্তার ডাকব? তিথি?’
তিথি আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল, বলল, ‘না। শরীর একটু খারাপ। ও কিছু না। খুব টায়ার্ড। চলো ওপরে যাচ্ছি।’
ওপরে এসে তিথি আর কথা বলতে পারছিল না। তার সমস্ত শরীর ভেঙে পৃথিবীর ঘুম ঝাঁপিয়ে পড়ছে। কোনোরকমে সে অদিতিকে বলল, ‘কাল সব বলব মা। আজ একটু ঘুমোই…চিন্তা কোরো না…তেমন কিছু হয়নি…কাল…সব বলব…’ তার জিভ ভারী হয়ে মুখের ভেতর জড়িয়ে যাচ্ছে।
বিশ্বনাথ পাগলের মতো করছিলেন। বার বার বলছিলেন—’কী হয়েছে, কী হয়েছে মা? এত রাতে চলে এলি কেন?’
দুশ্চিন্তায়, উদ্বেগে অদিতিও বিহ্বল হয়ে পড়েছেন। তিনি বুঝতে পারছেন সাংঘাতিক কোনো ঘটনাই ঘটেছে যাতে তিথি এইভাবে বাড়ি থেকে চলে এসেছে। কিন্তু কী হয়েছে তার কোনো আন্দাজ পাচ্ছেন না। মনকে শক্ত হাতে বাঁধলেন তিনি, ধৈর্য ধরলেন। বিশ্বনাথের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘থাক। ওকে ঘুমোতে দাও। কাল সকালেই সব জানা যাবে।’
সারারাত তিথির পাশে শুয়ে দু-চোখের পাতা এক করতে পারলেন না অদিতি। জটিল চিন্তার আবর্তে ছটফট করলেন। কী পারে যার জন্যে চলে এল তিথি? পার্থর সঙ্গেই কিছু হয়েছে হয়তো। গভীর মনোমালিন্য, রাগারাগি, ঝগড়াঝাঁটি। এমন তো হতেই পারে। সেরকম হলে তিথি এখানে থাকুক কয়েক দিন, বিয়ের পর একদিনও তো থাকেনি। তারপর মিটমাট হয়ে গেলে চলে যাবে। অদিতি এভাবে ভাবতে চেষ্টা করে বার বার ধাক্কা খাচ্ছিলেন। মনের মধ্যে আর একটা মন তাঁকে বারবার বলছিলএত প্রচণ্ড শরীর খারাপ হয়েছে কেন তিথির! অদিতি ছটফট করছিলেন, সারারাত তিথির দিকে তাকিয়ে থেকেছেন তিনি।
হতে , কী
নিথর হয়ে ঘুমোচ্ছে মেয়েটা। নিশ্বাসও যেন প্রায় পড়ছেই না। তার গা পাথরের মতো ঠান্ডা। অদিতির বুকের মধ্যে ছ্যাঁৎ করে উঠেছে কতবার। বার বার তার গায়ে হাত দিয়ে দেখেছেন, আঙুল রেখেছেন নাকের তলে। কী হল মেয়েটার! কোনোদিন তাকে কিছু জিজ্ঞেস করেননি তিনি। জিজ্ঞেস করতে তারও রুচিতে বেধেছে, তিথির হাবভাব দেখেও তিনি বুঝেছেন প্রশ্ন করলে সে বিরক্ত হবে। কাজেই শুধু তার চোখমুখ দেখেই বুঝে নিতে হয়েছে তাঁকে। তিথির সেই চোখমুখই কাল তাঁকে বলেছে, তার ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে…সে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত।
সকালেও তিথির ঘুম ভাঙল না। অদিতিও তাকে ডাকলেন না। দেখা যাক নিজে থেকে ওঠে কি না। আর একটু বেলা হোক। না হয় একটু পরেই তার ঘুম ভাঙাবেন। বিশ্বনাথ মর্নিং ওয়াকে চলে গেছেন। অদিতি বারান্দার দরজা খুলে বাইরে এলেন। মোড়া পেতে বসে আবার ডুবে গেলেন এলোমেলো চিন্তায়।
মনটা গভীরে গেঁথে থাকলেও অদিতির চোখ ছিল রাস্তার দিকে। হঠাৎ সচকিত হয়ে উঠলেন তিনি। রাস্তার মোড় ঘুরে কে আসছে? পাৰ্থ না! অদিতি দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করলেন। হ্যাঁ, পার্থই তো। উশকোখুশকো চেহারা। এগিয়ে আসছে, তবে তার হাঁটার ভঙ্গিটা যেন কেমন, যেন ইচ্ছার একান্ত বিরুদ্ধে পা ফেলতে বাধ্য হচ্ছে সে। অদিতি শক্ত হয়ে উঠলেন। ঘরে এসে দেখলেন তিথি হাত-পা উপুড় হয়ে নিঃসাড়ে ঘুমোচ্ছে। অদিতি নিঃশব্দে নীচে নেমে গেলেন।
পার্থ দরজার সামনে এসেই অদিতিকে ওইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে স্পষ্টতই চমকে উঠল। অদিতি যে বারান্দা থেকে তাকে দেখতে পেয়েছেন সে বুঝতে পারেনি। অদিতি কিছু বললেন না, নিঃশব্দে সোজা তাকিয়ে থাকলেন পার্থর চোখের দিকে। পার্থ অস্বস্তিতে একবার চোখ সরিয়ে নিল। তারপর বলল, ‘তিথি আছে?’
অদিতি দৃষ্টি স্থির রেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি জানো না?’
‘না। কী করে জানব? বলে তো আসেনি।’
অদিতি দরজা থেকে সরে গেলেন। সংক্ষেপে বললেন, ‘এসো। ও ঘুমোচ্ছে।’
দোতলায় এসে বসার ঘরে ঢুকে অদিতি বললেন, ‘বলো কী হয়েছে।’
পার্থ বলল, ‘কালকে মায়ের সঙ্গে খুব ঝগড়া করেছে তিথি। করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে।’
‘ঝগড়া করেছে কেন?’
পার্থ ঠোঁটের কঠিন ভঙ্গি করল, বলল, ‘কেন সেটা ওকেই জিজ্ঞেস করবেন।’
‘ও ঘুমোচ্ছে। তুমিই বলো।’ অদিতি নিরুত্তাপ গলায় কথা বলছেন। তাঁর চোখমুখ সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন তিনি।
ভেতরে ভেতরে যদিও
পার্থ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর এদিক-ওদিক তাকিয়ে অসংলগ্নভাবে বলল, ‘মায়ের কথা কিছু শোনে না। উলটোপালটা কাজ করবে। শাঁখা-পলা পরবে না। আমাদের বাড়ি ওরকম নয়। বলতে গেলে অশান্তি করে। মারপিট। তা ছাড়া ওর এখন বাইরে বেরোনো-টেরোনো ঠিক নয়, তাও মা বারণ করলে শোনে না’
অদিতির কানে খট করে লাগল। বললেন, ‘কী বললে? বাইরে বেরোনো ঠিক নয়? কেন বলো তো?’
‘মানে, ওর…ও প্রেগন্যান্ট তো—’ পার্থ দাড়িতে হাত বুলোল।
অদিতির গালে যেন কেউ ঠাস করে চড় মারল একটা। তাঁর কান ঝাঁ-ঝাঁ করছে। তিথি প্রেগন্যান্ট! মাথার মধ্যে হুড়মুড় শব্দে প্রবল ভাঙন টের পাচ্ছেন অদিতি। ব্যাস্, তিথির আর কিছু করার নেই। পড়াশুনা শুরু করে যাওবা একটু কোনোরকম ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার দিকে পা বাড়িয়েছিল, আবার পিছলে গেল সে। এত তাড়াতাড়ি ফাঁদে পা জড়িয়ে ফেলল মেয়েটা! অদিতির ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করল, কিন্তু তিনি অবিচলিত স্বরেই বললেন, ‘তাই নাকি? আমাকে কিছু বলেনি তো তিথি! ও, তাই ওর শরীরটা খুব খারাপ হয়েছে দেখলাম।’
পার্থ বিরস মুখে বলল, ‘হ্যাঁ তা তো হবেই। বাড়িতে সবসময় অশান্তি করছে। নিজেও খায় না, ওর জন্যে মায়েরও খাওয়া হয় না।’
অদিতি অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলেন। হঠাৎ বললেন, ‘তিথির মনে হয় একটু রেস্ট দরকার। আমার মনে হয় এখন ও ক-দিন আমাদের কাছে থাক। বুঝলে? কাল থেকে খুব ঘুমোচ্ছে দেখছি। ওকে আর ডাকছি না—’ অদিতি উঠে দাঁড়ালেন, ‘তুমি বরং এখন এসো। পারলে সন্ধ্যেবেলায় এসো একবার। আমি তিথিকে বলব। তোমার মায়ের সঙ্গে ও খারাপ ব্যবহার করে শুনে খুব অবাক লাগছে। এটা তো ভালো কথা না।’ অদিতি মাথা নাড়লেন, ‘যা হোক। আমি বলব ওকে বুঝিয়ে। এসো, হ্যাঁ! আমি আর চা-টা করছি না।’
পার্থর হয়তো তিথিকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ারই ইচ্ছে ছিল। অন্তত তার সঙ্গে কথা বলার। কিন্তু অদিতি সেদিক দিয়েই গেলেন না। সুস্পষ্ট ইঙ্গিতে চলে যেতে বললেন, তাঁর গলার স্বরে নির্দেশ ছিল। পার্থ আর জোর করতে সাহস করল না। অখুশি মুখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ঠিক আছে, সন্ধ্যেবেলা আসব। আপনি বলবেন ও যেন আজ বাড়ি ফেরে। মা মনে খুব দুঃখ পেয়েছেন।’
পার্থ চলে যাওয়ার পর অদিতি বসার ঘরেই মূর্তির মতো নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। হু-হু করে চোখ দিয়ে জল পড়ছে তাঁর। একটু পরে জোর করে নিজেকে সামলে নিলেন তিনি। এতে তাঁর এত ভেঙে পড়ার কী আছে! তিথি তার নিজের
জীবন নিয়ে যা খুশি করবে, যেভাবে ইচ্ছে বাঁচবে। এতে তাঁর কী বলার থাকতে পারে!
অদিতি তিথির কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। সামান্য সজাগ মনে হল তিথিকে। অদিতি তার মাথায় হাত রাখতেই তিথি সাড়া দিল, ‘ম্?’
‘ঘুম ভেঙেছে, তিথি?’
‘হুঁ।…মা?’ তিথি হাত বাড়িয়ে অদিতির হাতটা টেনে নিল নিজের মুঠির মধ্যে। তার চোখ এখনও বন্ধ।
‘কী রে?’ অদিতি অন্য হাতটা দিয়ে তিথির কপালের চুল সরাতে সরাতে বললেন।
‘কিছু না মা। এমনি।’
কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর অদিতি ধীরে ধীরে বললেন, ‘পার্থ এসেছিল। সব শুনলাম।’ তিনি লক্ষ করলেন তিথির শরীরটা মুহূর্তের মধ্যে শক্ত হয়ে গেল। দ্রুত নিশ্বাস ফেলছে সে। একটু চুপ করে থেকে অদিতি বললেন, ‘ভালো খবর, খুব ভালো খবর।…তবে একটু তাড়াতাড়ি হল, এই যা…’
বলতে বলতেই দেখলেন তিথি একেবারে কুঁকড়ে গেল। তার সমস্ত শরীর এমন থরথর করে কাঁপছে, পুরো খাটটাই কাঁপছে সেই কাঁপুনিতে। অদিতি ভয় পেয়ে তার পিঠ আঁকড়ে ধরে ঝুঁকে পড়লেন—’কী হয়েছে? তিথি? কী হল? এরকম করছিস কেন? তিথি?’
হাঁটু দুটো গুটিয়ে বুকের কাছে নিয়ে এসেছে তিথি, দু-হাতে শক্ত করে জড়িয়ে আছে হাঁটু দুটোকে। মাথাটাকেও বাঁকিয়ে এনে
গুঁজে দিয়েছে বুকের কাছে। সমস্ত দেহটাকেই গুটিয়ে যেন সে কোনো উদ্যত আক্রমণের হাত থেকে বাঁচাতে চাইছে নিজেকে। একটা তীব্র মরিয়া আর্তনাদ ছিটকে এল তার গলা থেকে—’না না না মা। আমি পরীক্ষা দিতে চাই মা! আমি পরীক্ষা দেব।’
૧
তিথি ক্রমাগত নিজের শরীরটাকে দুমড়ে-মুচড়ে ফেলছিল। ছটফট করতে করতে অস্পষ্ট গোঙানির স্বরে একটা কথাই বলে যাচ্ছিল বার বার, ‘আমি পরীক্ষা দেব মা, আমি পরীক্ষা দেব।’
অদিতি প্রথমে ভয় পেয়ে গেছিলেন। তারপর তিথিকে নাড়া দিলেন, ‘তিথি, এই তিথি! স্বপ্ন দেখছিস। উঠে পড়। তিথি?’
তিথি চোখ খুলে তাকাল। বিভ্রান্ত চাহনি। ধাঁধা লেগে গেছে তার। অদিতি সস্নেহে হাসিমুখে বললেন, ‘এখনও ওই সব বাজে স্বপ্ন দেখিস, হ্যাঁরে! ভোরে উঠে মহালয়া চালালি তো দেখলাম। তারপর কী ঘুম কী ঘুম!’
তিথি চোখ মুছে বলল, ‘উফ্ বাবা, স্বপ্ন দেখছিলাম, না?’
‘সত্যি, কী দুঃস্বপ্নের দিন গেছে সেসব! ভোলা কি যায় সহজে। আমিও তো পুরোপুরি ভুলতে পারি না…’ সামলে নিলেন অদিতিকৌতুকের সুরে বললেন, ‘নিজেই এখন কলেজে ছাত্রদের পরীক্ষা নিস, আবার ঘুমের মধ্যে পরীক্ষা দেব বলে চেঁচাস। যাঃ, ওঠউঠে পড়। বাথরুম থেকে ঘুরে আয়। পরোটা ভাজছি।’
‘আজ তো কলেজ ছুটি মা।’ তিথি আড়মোড়া ভাঙল, ‘আজ আমি পরোটা ভাজব।’
‘আচ্ছা আচ্ছা। আগে ওঠ তো। আমি রান্নাঘরে গেলাম।’
তিথি খাট থেকে নামল। মাথাটা খুব ভার হয়ে আছে। এ আজ কী হয়েছিল তার! পিছু হাঁটতে হাঁটতে জীবনের কোন
, ,
অন্ধকারতম কোণে ফিরে গিয়েছিল সে! সেই কোণ থেকে কবেই তো ছিটকে বেরিয়ে এসেছে সে। বেরোনো যদিও খুব সহজ হয়নি। পার্থ সাধ্যমতো অনেকরকম খেলা খেলবার চেষ্টা করেছে। তিথিকে সেসব স্পর্শ করেনি। অদ্ভুত নিঃসাড় হয়ে গিয়েছিল সে। পার্থর জোরজবরদস্তিতে যেমন ভয় পেত না, তার অনুনয়-বিনয়ও ছাপ ফেলত না তার মনে। সব শেষ হয়ে গিয়েছিল মনে আছে, মেরি স্টোপস্ ক্লিনিক থেকে মেডিকেল টার্মিনেশন করিয়ে ও যেদিন বাড়ি ফিরল, পার্থ এসেছিল রাত্রে। মধ্যের কয়েকটা দিন তার সঙ্গে যোগাযোগ থাকলেও কোনোরকম সাহায্য করেনি সে। অদিতি একাই সব ব্যবস্থা করেছিলেন। জেনারেল অ্যানিস্থিসিয়া করা হয়েছিল তিথিকে। বাড়িতে যখন ফিরেছিল সে, পুরোপুরি চেতনা আসেনি তার। পার্থ তাকে বলেছিল, ‘আমার কথা শুনলে না তিথি। সেই পাপই করলে। তবু আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিচ্ছি, কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি। বাড়ি চলো, আমি তোমাকে শেষ সুযোগ দিতে চাই—
পাগলের মতো চিৎকারকরে উঠেছিল তিথি, ‘বেরিয়ে যাও! আজ তুমি আমাকে ভালোবাসার কথা বলতে এসেছ? ভালোবাসা? সব ফুরিয়ে গেছে পার্থ, সব শেষ হয়ে গেছে। যাও, বেরিয়ে যাও, চলে যাও তুমি। আমি আর কোনোদিন তোমার কাছে ফিরব
চিৎকারশুনে ছুটে এসেছিলেন অদিতি, ‘তিথি, শান্ত হ তিথি, তোর শরীর খুব খারাপ, এখন এত উত্তেজনা ঠিক নয়।’
শেষ মুহূর্তে আবার ভোল বদলে ফেলেছিল পার্থ। কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, ‘আমাকে অন্তত আর একটা সুযোদ দাও——
‘সুযোগ! কীসের সুযোগ? আমরা আর কেউ কাউকে কোনো সুযোগ দিতে পারি না পার্থ।’ তিথি অদিতির দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত স্খলিত স্বরে বলেছিল, ‘ওকে চলে যেতে বলো মা। বলো যেন কখনো আর এখানে না আসে।’
ডিভোর্সের মামলাও অদিতিরা করেননি। পার্থদের তরফ থেকেই সেসমস্ত চুকেবুকে গেছে। তিথি চলে আসার পর প্রথম প্রথম
না—’
পার্থ উত্ত্যক্ত করতে ছাড়েনি। উড়ো চিঠি দিত। কলেজে গিয়ে দেখা করার চেষ্টা করত। তিথির নিঃসাড় শীতলতার কাছে হার মানতে বাধ্য হওয়ার পর তার দিক থেকেই আইনি বিচ্ছেদের গরজ বেশি দেখা গেল। তিথি চেয়েছিল আর কোনো জটিলতায়, নোংরামিতে না জড়িয়ে শুধুমাত্র নৈঃশব্দ্যের আশ্রয় নিয়ে যাবতীয় টানাপোড়েন থেকে উত্তীর্ণ হতে। সেইমতো, মামলা চলাকালীন তাদের তরফ থেকে টু শব্দটিও করা হয়নি। একতরফা মামলার নিষ্পত্তি হয়ে যাওয়ার অনেক বছর পর আদালত থেকে ডিভোর্স পেপারটা সংগ্রহ করে এনেছে তিথি। তাতে লেখা আছে—’শ্ৰীমতী তিথি মল্লিক একজন অস্বাভাবিক ক্রূর এবং নিষ্ঠুর স্বভাবের মহিলা। তার মাথাও খারাপ। তার এই স্বভাবের জন্য অভিযোগকারী শ্রীপার্থ মল্লিক ও তাঁর পরিবারের সমস্ত শান্তি বিঘ্নিত হয়…’
কুররর্ কুররর্…কুররর্ কুররর্ কুররর্ কুররর্…
ফোনটা বাজছে। অদিতি গলা তুললেন, ‘তিথি! কই, বাথরুমে গেলি না এখনও। দ্যাখ তো কার ফোন!’ বিশ্বনাথ ফোনটা ধরেছিলেন। দু-একটা কথা বলার পর গলা চড়ালেন, ‘তিথি, তোর ফোন। অনিন্দ্য।’
বর্তমানে ফিরে এল তিথি। কর্ডলেস টেলিফোনটা কানে চেপে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। কথা বলতে বলতে দেখল চারিদিকে ঝলমল করছে রোদ। রোদের গা থেকে সমস্ত ধুলো ধোঁয়া বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে। উপচে পড়ছে খুশির জৌলুশ। এই সকালেও চকচকে নীল আকাশে প্যাঁচ খেলছে একটা লালঝারি আর একটা চাঁদিয়াল। ফোনে ছুটির দিনের প্রোগ্রাম করতে চাইছে অনিন্দ্য। অনিন্দ্য তিথিদের কলেজেই পড়ায়। তিথি জিওগ্রাফি, অনিন্দ্য বাংলা। অনিন্দ্য তার সহকর্মী, বন্ধু। প্রেমিক নয়।
তিথি একমুহূর্ত ভাবল। কী চমৎকার দিনটা। পুজোর গন্ধ ম-ম করছে রোদ্দুরের গায়ে। আজকের দিনটা কি সে অনিন্দ্যর সঙ্গে কাটাতে চায়? মন স্থির করতে একটু সময় নিল তিথি, তারপর বলল,—‘না, আজ থাক অনিন্দ্য। আজ একটু বাড়িতে রিল্যাক্স
‘ওকে! ঘুমোও তাহলে। দেখি আর কাকে পাওয়া যায়।’ অনিন্দ্য লাইন ছেড়ে দিল। রাগ করল না। অনিন্দ্যকে কখনো রাগ করতে দেখেনি তিথি, পাঁচ বছর একসঙ্গে কাজ করছে। হাসিখুশি ঠান্ডা মাথার ছেলে। তিথি ওকে পছন্দ করে। অনিন্দ্যও পছন্দ করে তাকে। কিন্তু না, এখনও তারা শুধু বন্ধুই। অন্য কিছু ভাবতে তিথি ভয় পায়। আর ঝাঁপ দিতে রাজি নয় সে। তার সারা শরীরে সেই প্রথম ঝাঁপের ক্ষতচিহ্ন আজও মেলায়নি। অনিন্দ্যর সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর একদিন তিথি দুম করে বলেছিল, খানিকটা অপ্রাসঙ্গিক ভাবেই, ‘জানো অনিন্দ্য, আমি একটা বিয়ে করেছিলাম, ডিভোর্স হয়ে গেছে।’ কেন যে সে ওভাবে বলল কথাটা, বলার পর নিজেই ঠিক বুঝতে পারেনি। সম্ভবত তার মনে হয়েছিল, এটা তার জানিয়ে রাখা কর্তব্য, যেন কেউ মনে না করে সে তার জীবনের একটা দাগ লুকিয়ে নিষ্কলুষ সাজছে। অনিন্দ্য খুব অবাক মুখ করে তাকিয়েছিল, ‘তাই? কিন্তু হঠাৎ এ কথা বললে কেন? আমি তো কিছু জিজ্ঞাসা করিনি!’
‘না, মানে, মনে হল…তুমি আমাকে যা ভাবছ আমি তা নই…’
অনিন্দ্য সারা মুখে আরও বিস্ময় মাখিয়ে বলল, ‘ও! বাঁ-পাটা দেখাও!’
‘তাহলে কি ডান পায়ে?’
‘কী বলছ বুঝতে পারছি না।’
‘মানে!’
করি।’
‘কোন পায়ে ছ-টা আঙুল আছে তোমার?’
ঝাঁপতাল
‘ছ-টা আঙুল! কেন, আমার তো…’ তিথি অনিন্দ্যর কথার কোনো মাথামুণ্ডু খুঁজে পাচ্ছিল না।
‘পাঁচটাই ছিল নিশ্চয়ই, ডিভোর্সের পর ছ-টা হয়ে যায়নি?’ অনিন্দ্য খুব সিরিয়াস মুখে বলল, ‘তুমি বললে যে আমি যা ভাবছি তুমি তা নও…তবে কি তোমার লেজ হয়েছে? কিংবা শিং?’
রাগ করতে গিয়ে হেসে ফেলেছিল তিথি। নিজের বোকামিতে লজ্জা করছিল তার। কিন্তু সত্যিই, নিজের সম্পর্কে এই অতিরিক্ত সচেতনতা থেকে এখনও সে পুরোপুরি মুক্ত নয়। তবু, অনিন্দ্যর সঙ্গে সহজ বন্ধুত্বে আরামবোধ হয় তার। অনিন্দ্য আর সে, পাশাপাশি যেমন হাঁটছে, কখনো কথা বলতে বলতে, কখনো চুপচাপ, তেমনই হেঁটে যেতে চায় আপাতত।
ফোন রেখে তিথি রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। পরোটা বেলছেন অদিতি। তিথিকে দেখে বললেন, ‘কার ফোন রে?’
‘অনিন্দ্য। আমাকে ডাকছিল। লোক জুটিয়ে দলবেঁধে নিক্কো পার্ক যাবে। বাচ্চা আর কাকে বলে!’ তিথি মুখে কপট বিরক্তি আনতে গিয়েও হেসে ফেলল।
‘তা একটু বাচ্চা হওয়া মন্দ কী! দেখছি তো ছেলেটিকে। এদিকে যেমন ছেলেমানুষ তেমনই আবার দায়িত্বশীলও মনে হয়। বেশ বুদ্ধিমান, না রে?’ অদিতি সমর্থন প্রত্যাশা করে তিথির দিকে তাকালেন, ‘তুই যাবি না?”
তিথি মিটিমিটি হাসল। বলল, ‘নাঃ, আজ আমি বাড়িতে থাকব, তোমার সঙ্গে আড্ডা মারব। আচ্ছা মা, অনিন্দ্যকে তোমার খুব পছন্দ, না?’
অদিতি হাসলেন। কিছু বললেন না। তাঁর মনের তলায় স্বপ্ন দানা বাঁধছে। অল্পবয়সে যে ভুল করেছিল তিথি, তার জন্যে যথেষ্ট শাস্তি ভোগ হয়ে গেছে তার। আজ সে জীবনে প্রতিষ্ঠিত। এবার কি একজন উপযুক্ত মানুষ আসতে পারে না তার জীবনে? অদিতি নিশ্বাস ফেললেন।
তিথি এখন অন্য কথা ভাবছে। মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার মনে হচ্ছে, মা না থাকলে আজ এই সুন্দর আলোময় সকালে কখনো কি ঘুম ভাঙত তার! আর কোনো পুজোও কি ফিরে আসত তার জীবনে, শাশ্বত ধ্রুবপদের মতো! আবার একটা অন্ধ ঝাঁপই তো দিতে হয়েছিল তাকে। সেই ঝাঁপের সময় মা তাকে লুফে না নিলে আবার সে কোথায় গিয়ে ঠেকত কে জানে।
‘এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছিস? আমার যে বেলা হয়ে গেল।’
তিথি ছেলেমানুষি আবদারের স্বরে গভীর আদর মিশিয়ে বলল, ‘ওই গানটা একটু গাও-না মা। ওই যে…মিথ্যা স্বপনরাজি কোথা মিলাইল, আঁধার গেল মিলায়ে…’
সঞ্চারি থেকে গানটা গেয়ে উঠল তিথি, অদিতি তার সুরের কোনাটা ধরে নিলেন… ‘শান্তি সরসী মাঝে চিত্তকমল ফুটিল আনন্দবায়ে…মনোমোহন গহন যামিনীশেষে দিলে আমারে জাগায়ে…’
সুর আর কথার মিলিত অভিঘাতে আবার জল আসছে তিথির চোখে। এ জল কোনো কান্নার নয়। আনন্দের হয়তো। হয়তো তাও নয়। শুধুই কোনো গভীর উপলব্ধির। তিথির গলার কাছে কান্না আটকে আছে বলে সে গাইতে পারছে না, অদিতির সুরেলা ভারী কণ্ঠস্বরের তলে নিজের স্বর ডুবিয়ে ফিসফিস করে আবৃত্তি করছে গানের লাইনগুলো…’মেলি দিলে শুভপ্রাতে সুপ্ত এ আঁখি…শুভ্র আলোক লাগায়ে…’
নিজস্ব নিয়মে গান ঘুরে ঘুরে ফিরে আসছে সমে…