ঝম্পো
সকালে বাজার করতে গিয়ে বিপিনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল৷ বলা ভালো, সে নিজেই যেচে পড়ে আমার সঙ্গে দেখা করল৷ আমি সবে ঘণ্টারামের চাটাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে পটল দর করছি, এমন সময় সে আমার কানের কাছে মুখ এনে ভুতুড়ে ফিসফিসে গলায় বলল, ‘গুরুদা, শুনছ?’
মুখ ফিরিয়ে দেখি বিপিন দাঁড়িয়ে আছে৷ গায়ে সেই ময়লা হোলির গোলাপি ছাপ লাগা জামা, মাটিতে ঘষা লেগে গোড়ালি ছিঁড়ে যাওয়া ফুলপ্যান্ট৷ তবে মুখে সর্বক্ষণ লেগে-থাকা হাসিটা এখন উধাও৷ জিজ্ঞেস করলাম, ‘বিপিন যে৷ এই দেখো পটলের দাম শুনে তো…’
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই সে আমায় থামিয়ে দিলে, হড়বড় করে বলল, ‘গুরুদা, ভারী বিপদে পড়েছি৷’
এই এক সমস্যা৷ অবিবাহিত পুরুষরা প্রেমে ও বিবাহিত পুরুষরা ঝপাঝপ বিপদে পড়েন৷ দুটো একই জিনিস কি না কে জানে৷ যাই হোক, পটল থেকে মুখ তুলে তার মুখের দিকে চেয়ে বললাম, ‘কী ব্যাপার ভায়া? কী বিপদ?’
গলা আরও এক পর্দা নামিয়ে নিল বিপিন, ‘সারাক্ষণ কেবল মনে হয় ঘাড়টা ভার হয়ে আছে৷ যেন ঘাড়ের উপরে কেউ বসে আছে৷’
আমি ওর ঘাড়ের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম, ‘স্পন্ডেলাইটিসের ব্যথাটা চাগিয়েছে মনে হচ্ছে৷ ডাক্তার বদ্যি দেখাও আর কী…’
বিপিন হাঁ-হাঁ করে ওঠে, ‘তু-তুমি বুঝছ না, শুধু তাই নয়, সবসময় একটা পোড়া-পোড়া গন্ধ৷’
আমি মুখ বাঁকাই, ‘তা এই আধদামড়া বয়সে দাদার পয়সায় বসে খেলে একটু পোড়াপোড়া গন্ধ লাগে বই কী! ও কিছু নয়৷’
খপ করে আমার হাতটা চেপে ধরে টেনে ফাঁকা একদিকে আমাকে নিয়ে আসে বিপিন, তারপর চারপাশে একবার চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলে, ‘আমাকে ঝম্পো পেয়েছে গুরুদা৷’
‘অ্যাঁ!’ আমি বিরক্তমাখা মুখে বলি, ‘ঝম্পো আবার কী?’
নিজের ঘাড়ে হাত বোলাতে থাকে বিপিন৷ তারপর কী যেন গুছিয়ে নিয়ে বিড়বিড় করে বলতে থাকে, ‘তুমি তো আমার দাদামশাইকে চিনতে৷ বুড়োর পেটে কালির দাগ বেশি ছিল না, কিন্তু অনেকরকম জানাশোনা ছিল৷ সেকালে করালকালী তান্ত্রিকের কলকাতা-জোড়া নাম ছিল না? তার বাড়িতেই দাদু জমাদারের কাজ করতেন, মানে ওই সকালে বিকেলে গিয়ে খাটা পায়খানা থেকে…’
আমি বাধা দিয়ে উঠি, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তুমি এগোও বাছা এবার৷’
‘হ্যাঁ, তো একদিন করালকালীর বাড়ি গিয়ে দাদু দেখেন বহুত হইচই লেগেছে৷ কালিবাবু নাকি ঝম্পো নামাচ্ছেন৷ দাদু অতশত জানতেন না৷ সামনে একটা লোক দাঁড়িয়েছিল, তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ঝম্পো কী৷’
কথাটা বলে একবার তঠস্থ হয়ে নিজের ঘাড়ের দিকে তাকায় বিপিন, আমতা আমতা করতে থাকে৷
‘আরে বলবে তো৷’
আমার দাবড়ানি খেয়ে আবার যেন প্রাণ পায় বিপিন, মিনমিনে গলায় বলে,
‘ঝম্পো এক জাতের পিশাচ৷’
‘পিশাচ, কেমন পিশাচ?’
‘সোমত্ত মেয়ে, কাউকে গোপনে ভালোবাসলে, তারপর সেই ভালোবাসা না পেয়ে সেই দুঃখে আত্মহত্যা করলে তার আত্মা ঝম্পো হয়ে পুরুষটির ঘাড়ে বসে৷’
‘বলো কী হে!’ আমি আঁতকে উঠি৷ মৃত্যুঞ্জয় তান্ত্রিকের নাতি আমি৷ অবশ্য সে গুরুবিদ্যার লাঙ্গুলাগ্রটিও অর্জন করতে পারিনি, তা-ও প্রেত-পিশাচে আমার বিলক্ষণ বিশ্বাস আছে৷ মামদো, জামদো, ডাকিনি-হাকিনি, বেঁশো ভূত, কানাভুলো সব মানি৷
বিপিনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভুরু তুলে বললাম, ‘তা আমাকে এসব বলে কী লাভ, দাদু তো বেঁচে নেই৷ তুমি বরঞ্চ সেই করালকালীকে গিয়েই দেখাও একবার৷’
‘সে চেষ্টাও করেছিলাম, কিন্তু…’
‘তিনিও গত হয়েছেন?’
উপরে-নীচে মাথা দোলায় বিপিন, আমি আক্ষেপের গলায় বলি, ‘ওই হয় রে বাপ, এইসব মরণোত্তর জগৎ নিয়ে বেশি নাড়াঘাঁটা করলে পরমায়ু খাবলা খাবলা করে কমতে থাকে৷ যাক গে, তা আর কোনও তান্ত্রিক?’
বিপিনের সঙ্গেই আবার বাজারের দিকে হাঁটতে শুরু করি আমি৷ সে বলে,
‘অন্য কারও কাছে যেতাম, কিন্তু একটা সমস্যা হয়েছে৷’
‘কী রকম সমস্যা বলো তো?’
পটলের চ্যাঙারি থেকে বেছে বেছে পটল তুলতে থাকে বিপিন৷ ভারী কষ্ট হয় আমার ছেলেটার জন্য৷ ছোট থেকেই বেজায় গোবেচারা গোছের৷ ওর দাদা শ্যামলালটা আবার ঠিক উলটো৷ গাঁটে গাঁটে বুদ্ধি ধরে সে৷ ছোটোবেলায় বিপিনকে এন্তার মারধরও করত৷ বিপিন বিয়ে করার পর থেকে বউয়ের ধমক ধামক খেয়ে খানিক শক্ত হয়েছে৷
মানিব্যাগ থেকে বের করে টাকাটা মিটিয়ে দেয় বিপিন৷ তারপর ব্যাগটা আমার হাতে দিতে দিতে বলে, ‘নাও গুরুদা, আজ তরিবৎ করে একটু চিংড়ি মাছ দিয়ে বানাও দেখি৷’
‘তুমি কী যেন সমস্যার কথা বলছিলে৷’
‘ও হ্যাঁ,’ আবার প্রসঙ্গে ফিরে আসে বিপিন, ‘ওই যে বললাম সোমত্ত মেয়ে কাউকে ভালোবাসলে, তাকে না পেয়ে আত্মহত্যা করলে তার ঘাড়ে চেপে বসে, আমার বেলায় ওইটে একটা মস্ত ভুল হয়ে গিয়েছে৷’
‘কেমন ভুল?’
‘মেয়েটি যাকে ভালোবাসত, সে আমার দাদা শ্যামলাল৷ শ্যামলালকে না পেয়েই ও আত্মহত্যা করে৷’
‘সে কী হে৷ তাহলে তোমার ঘাড়ে চেপে বসল কেন?’
‘ওই খানেই তো সমস্যা,’ একটা ফাঁকা চ্যাঙারির উপরে চাপড় মারে বিপিনি, ‘রোজ এই ধরো সন্ধের দিকে মেয়েটা ছাদ থেকে জামাকাপড় তুলতে উঠত৷ আমার দাদা তখন ছাদে যেত ওই একটু নেশাটেশা করতে৷ ওদের ছাদ থেকে আমাদের ছাদ মিটার পঞ্চাশেক হবে৷ তো দু-জন দু-জনের দিকে চেয়ে ইশারা টিশারা করত৷ ব্যস, ওই ছিল প্রেম, সামনাসামনি দু-জনের তেমন দেখা হয়নি৷ হলেও সাধারণ হাসি-টাসির বেশি কিছু এগোত না৷’
‘সে কী! ছাদে-ছাদে এত দূর থেকেই প্রেম হয়ে গেল?’
‘আজ্ঞে, গুরুদা প্রেম জিনিসটাই ওই, কখন যে কোথা দিয়ে হয়ে যাবে…’
আমি একটু ভাবুক হলাম, তারপর বিপিনের ঘাড়ের দিকে একবার চোখ পড়তেই বুক শিরশির করে উঠল৷ কাঁপা গলায় বললাম, ‘তারপর?’
‘তারপর মেয়েটার বাড়ি থেকে বিয়ে ঠিক হল, মেয়েটা আপত্তি-টাপত্তি করেছিল হয়তো৷ সেসব বাড়ির লোক শুনতে চায়নি৷ জোর করে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল৷ ব্যস ছুঁড়ি ঝুলে পড়ল৷’
‘দড়ি থেকে?’
‘দড়ি থেকেও বলতে পারো, আমার ঘাড় থেকেও বলতে পারো৷’
আমি একটু অসন্তুষ্ট হলাম, ‘আহা ওভাবে বোলো না, আজকালকার দিনে একটা প্রেমের জন্য… যাক, তা তোমার ঘাড়ে চড়ল কেন সেটা এখনও বুঝতে পারলাম না৷’
‘বলছি,’ কথাটা বলে একটু দম নিল বিপিন, ‘এই ধরো, দু-খানা ছাদ, মাঝে পঞ্চাশ মিটার৷ আমাকে আবার খানিকটা আমার দাদার মতোই দেখতে৷ সন্ধেবেলা আলো কম থাকে৷’
‘বুঝেছি৷’ আমি ছোটোখাটো একটা লাফ দিয়ে উঠলাম, ‘সে ভেবেছিল শ্যামলাল নয়, তোমার সঙ্গে ইশারায় কথা হচ্ছে তার৷ তাই মরার পরে তোমার ঘাড়ে…’
‘তাহলেই ভাবো গুরুদা৷ এই কথাটা তুমি বুঝলে৷ আমার বউ বুঝবে?’
‘মনে তো হয় না৷’
‘সেই জন্যেই তোমার কাছে এসেছি৷ তোমার সঙ্গে মেলামেশা করলে ও সন্দেহ করবে না৷ এদিকে আমার ঘাড় থেকে ঝম্পোও নেমে যাবে৷’
আমি দাঁড়িয়ে পড়ে দু-সেকেন্ড ভাবলাম৷ তারপর দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বললাম, ‘কিন্তু ভাই হে, তন্ত্রের ছলাকলা যা ছিল সব আমার দাদুর, আমি তো অকালকুস্মাণ্ড হয়েছি৷ তোমাকে কিছু সাহায্য করতে পারব বলে মনে তো হয় না৷’
কাঁচুমাচু মুখে আমার হাত চেপে ধরে বিপিন, ‘বই তো আছে তোমার কাছে৷ দাদুর সব যন্ত্রপাতি তো অক্ষত আছে, সেসবই নেড়ে চেড়ে যদি এই শাপ থেকে আমাকে মুক্ত করে দাও, আজীবন তোমার পায়ে…’
ভরা রাস্তার মাঝেই আমার পায়ের উপরে নুয়ে পড়ে বিপিন৷ ভারী অস্বস্তি হয় আমার৷ কাঁধে হাত রেখে তার মাথাটা তুলে ধরে বলি, ‘আহা, আমি নাহয় চেষ্টা করে দেখব৷ তারপর নাহলে…’
‘নাহলে জানবে বিপিন ওই ঝম্পোর খপ্পরে পড়েই গঙ্গাযাত্রা করেছে৷’
মুখ নামিয়ে চোখ থেকে জল মুছে উলটোদিকের রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করে বিপিন৷ মাথাটা সামনের দিকে নুয়ে পড়েছে৷ সমস্ত শরীরে একটা অসুস্থতার ছাপ৷ সত্যি ভারী কষ্টে আছে ছেলেটা৷ আমার মনটা একটা চাপা বেদনায় ভরে যায়৷ নাঃ, কিছু একটা করতেই হবে৷
(২)
বাড়ি ফিরে সেদিন পটল চিংড়ি মাথায় উঠল৷ হরিকাকার হাতে ব্যাগটা দিয়ে দ্রুত ছুটে গেলাম ছাদের ঘরে৷ দাদু যতদিন বেঁচেছিলেন ওখানেই থাকতেন৷ কারও অনুমতি ছাড়া ওখানে যাওয়ার জো ছিল না৷ দাদু মারা গিয়েছেন বছর তিনেক হল৷ তারপর থেকে ঘরের জিনিসপত্র এখনও সরানো হয়নি৷ বাবা মাঝে-মধ্যে গিয়ে বসেন, তবে তন্ত্রমন্ত্রের তিনিও কিছু বোঝেন না৷
ছাদের ঘরের দরজা তালা দিয়ে খুলতেই বুকের ভিতর একটা ধাক্কা এসে লাগল৷ মাসখানেক হল বাবা ঘরটা খোলেননি৷ ফলে বহুদিনের বন্ধ বাতাস জমে আছে ঘরময়৷ দ্রুত ঘরে ঢুকে জানলাগুলো খুলে দিলাম৷ বাইরের একরাশ আলো এসে ভরিয়ে দিল ঘরটা৷
চারপাশে ভালো করে তাকালাম৷ একদিকে কিছু ছেঁড়াখোঁড়া বই ডাঁই করে রাখা৷ তার ঠিক পাশেই একটা ময়লা ছোপ-লাগা আয়না৷ আয়না থেকে কিছুটা ডান দিকে এলে দেওয়ালে হুক থেকে ঝুলছে একখানা সিঁদুর লাগানো খড়গ৷ ছোট থেকে ওই খড়গটার দিকে তাকালেই ভারী ভয় লাগে আমার৷ শুনেছি এক সময় ও খড়গে নাকি নরবলিও হয়েছে৷
তবে এখন ভয় পাবার আর সময় নেই আমার৷ বিপিনকে ভয় থেকে উদ্ধার করতে গেলে আগে ঝম্পো তাড়ানোর উপায় খুঁজে বের করতে হবে৷ ওসব ছাড়াও এ ঘরে যন্ত্রপাতির অভাব নেই, কিন্তু সবার আগে বই খুঁজতে হবে আমাকে৷ ঝম্পো পিশাচকে ভালো করে না বুঝলে তাকে বাগে আনা প্রায় অসম্ভব৷
মনে পড়ল ছোটোবেলায় দাদুর কাছে যেটুকু সময় আমি ছিলাম তার মধ্যেই মন ভালো থাকলে আমাকে নিজের জীবনের নানা গল্প বলতেন তিনি৷ তখন সেগুলো বিশ্বাস করতে মনে চায়নি৷ কিন্তু বড়ো হয়ে বুঝেছি, তন্ত্রে বিশ্বাস আর ভগবানে বিশ্বাস একই জিনিস৷ যতক্ষণ না তেমন বিপদে পড়ছ ততক্ষণ নাস্তিকতার অহং নিয়ে থাকা যায়৷
পুঁথিপত্রগুলোর উপরে হামলে পড়লাম৷ তবে সেগুলোর অবস্থা এতটাই ভাজাভাজা হয়ে আছে যে শক্ত করে ধরতে গেলেই চিমটিতে উঠে আসবে৷ ধীরে সুস্থে পাতা ওলটাতে লাগলাম৷
বাইরে একটা পাখি ডাকছে৷ কোকিল? কই এখন তো বসন্ত নয়৷ কী যেন কাল এখন? যাই হোক, টেবিলের উপরের স্তূপে মন দিলাম৷ সবক-টা অবশ্য বই নয়৷ মাঝে কিছু হাতে লেখা পুঁথিও আছে৷ দাদুর হাতের লেখা খুব একটা সুবিধের ছিল না৷ ঝম্পোর কথা যদি তার মধ্যে লেখা থাকে তাহলে সে জিনিস পড়ে বোঝা ভারী সহজ কিছু হবে না৷
খুঁজতে খুঁজতে একসময় হতাশ হয়ে পড়লাম৷ ছাদের এই ঘরে পাখা নেই৷ দাদু পাখার তলায় থাকা একেবারে পছন্দ করতেন না৷ পাখা না চললে ঘাম হয়৷ প্রেত-লোকের বাসিন্দাদের নাকি ঘামের গন্ধ ভীষণ প্রিয়৷ গায়ে সেই গন্ধ না থাকলে তারা সহজে দেখা দিতে চায় না৷
ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আমার মাথা থেকে টপটপিয়ে জল পড়তে শুরু করল, গলার কাছটা শুকিয়ে এল, মাথার মধ্যে খানিকটা ঝিমঝিমে ব্যথাও শুরু হল৷ কিন্তু ঝম্পো পিশাচের কথা কোথাও পেলাম না৷
হাল ছেড়ে দিয়ে চেয়ারে পিঠে এলিয়ে দিলাম৷ মাথাটা হেলান দিতেই দেওয়ালের উপরের দিকে দাদুর ঝুলন্ত ছবিটা চোখে পড়ল৷ গায়ে রক্তবস্ত্র, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, একহাতে বরাভয় মুদ্রা, তার মধ্যেই মুখে যেন ভর্ৎসনার হাসি৷ কাকে ভর্ৎসনা করছেন ভদ্রলোক? আমাকে? হ্যাঁ আমাকেই হবে৷ মৃত্যুঞ্জয় তান্ত্রিকের নাতি হয়ে সামান্য একটা পিশাচের বায়োডেটা খুঁজে পাচ্ছি না আমি৷ পরীক্ষার হলে বই খুলে চোতা করতে দিলেও যে ছেলে পাশ করতে পারে না তাকে ভর্ৎসনা ছাড়া আর কী বা করা যায়৷ রাগ হল, নিজের উপর ভয়ানক রাগ হল৷ দুটো হাত হাওয়ায় ছুড়ে দিয়ে টেবিলের উপরে মারলাম এক মোক্ষম চাপড়৷ সঙ্গে সঙ্গে পুঁথির লট থেকে একখানা হলদে কাগজ ছিটকে গিয়ে টেবিল ছাড়িয়ে কিছু দূর গিয়ে পড়ল৷
চোখে জল এসে পড়েছিল আমার৷ এমনিতেই বংশের কুলাঙ্গার হয়েছি, তার উপরে দাদুর কাগজপত্রও ছেঁড়াছিঁড়ি করতে চলেছি প্রায়৷ জামাটা তুলে মুখের ঘামটা মুছে উঠে পড়লাম৷
এগিয়ে গিয়ে পাতাটা তুলে নিয়ে টেবিলে রাখতে গিয়েই থমকে গেলাম৷ একটা বইয়ের ছেঁড়া পাতা এটা৷ কোন বইয়ের সেটা এখন আর বোঝার উপায় নেই৷ তবে বোঝার দরকারও নেই৷ আমার যা জানার তার জন্য এই পাতাটাই যথেষ্ট৷
প্রসন্ন মুখ তুলে ছবির দিকে তাকালাম৷ হ্যাঁ, দাদু হাসছেনই বটে৷ তবে ভর্ৎসনা নয়৷ মৃত্যুঞ্জয় তান্ত্রিকের অভিজ্ঞ মুখে খেলা করছে এক অনাবিল স্নেহের হাসি৷ হাতের সঙ্গে সঙ্গে তার মুখও বরাভয়ের মুদ্রা ফুটিয়ে তুলছে৷
দাদুর ছবিতে মাথা ঠেকিয়ে দ্রুত আবার চেয়ারে বসে পড়লাম আমি৷ হ্যাঁ, ঝম্পো পিশাচই বটে৷ ভালোবাসার ভিতরে যে অমোঘ শক্তি আছে সেই শক্তিতেই বলিয়ান হয় এই পিশাচ৷ প্রেমাস্পদকে না পেয়ে আত্মহত্যা করা আত্মার স্বর্গলাভ হয় না৷ তাকে দগ্ধে মরতে হয় এই মর্তলোকেই৷ সে আর কারও কথা শুনতে পায় না, কারও মুখ দেখতে পায় না, কেবল একটি মাত্র শরীর চোখে দেখতে পায় সে৷ সেটার কাঁধেই চড়ে বসে৷ জীবিত অবস্থায় তাকে না পেয়ে সূক্ষ্মদেহে তার শরীরের সঙ্গে মিশে একটু একটু করে চুষে খায় তাকে৷
যার ঘাড়ে চাপে সে পোড়া গন্ধ পায় সবসময়৷ ঘাড়ের উপরে সারাক্ষণ একটা ব্যথা হতে থাকে৷ হুম, বিপিন মিথ্যে বলেনি৷ কিন্তু এখন উপায়? ঝম্পো পিশাচকে প্রতিহত করার উপায় কী? সে-সব নিয়ে কি কিছু লেখা আছে এখানে? আমি পাতার উলটোদিক দেখলাম৷
(৩)
সেদিন রাতেই টোকা দিলাম বিপিনের বাড়ির দরজায়৷ একতলাটা তার নিজের৷ দাদা শ্যামলাল বউ নিয়ে দোতলায় থাকে৷ বড়ো একটা কারও সাতে-পাঁচে থাকে না৷ ডাকাবুকো ছেলে বলে সকলেই এড়িয়ে চলে৷
একতলার দরজায় শব্দ হতে আগে উপরের বারান্দা থেকে শ্যামলাল মুখ বাড়াল৷ তারপর আমাকে দেখে একটু ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে, আবার ঢুকে গেল ভিতরে৷ একতলার দরজা খুলে গেল৷
তবে বিপিন নয়, তার বউ কেতকীকে দেখলাম দাঁড়িয়ে আছে দরজায়, আমাকে দেখে মাথা নীচু করে বলল, ‘আপনি? আসুন৷’
ভারি মিষ্টি দেখতে মেয়েটাকে৷ বিপিনের বিয়ের সময় থেকেই দেখে আসছি৷ ডাগর দুটো লাজুক চোখ, গোলাপি ঠোঁটের কোনায় সারাক্ষণই মিহি হাসি লেগে আছে একটা৷ বয়স প্রায় তিরিশের কাছাকাছি, তা-ও ছেলেমানুষি-ভাবটা মুখ ছেড়ে যেতে চাইছে না৷ এখন একটা হলদে শাড়ি পরিপাটি করে পরে আছে সে৷
দরজার উপরে একটা নীলচে আলো জ্বলছে৷ সেই আলোর মায়ায় কি না জানি না৷ ভারী মিষ্টি লাগল মেয়েটাকে৷ সেই সঙ্গে জানি না কেন, মনে হল, তার মনের ভিতরে কোথায় যেন একটা চাপা বিষণ্ণতা আছে৷
‘আসলে আজ বাজারে ওর থেকে ক-টা টাকা ধার নিয়েছিলাম, ভাবলাম এইবেলা এসে ফেরত দিতে যাই, দেখাও হয়ে যাবে৷ হেঁহেঁ৷’ কথাটা ভারী বুদ্ধিমানের মতো বললাম কি না জানি না, কেতকীর মুখে তেমন ভাবান্তর লক্ষ করলাম না৷ সে দরজা ছেড়ে একটু সরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আসুন না ভিতরে, ও একটু স্নান করছে৷’
আমি ভিতরে ঢুকে এলাম৷ খাটের একটা ধার বোধ হয় আমার জন্য বরাদ্দ করল কেতকী, আমি সেইখানে বসতে বসতে বললাম, ‘সকালে দেখলাম, মনে হল বিপিনের শরীর ভালো নেই৷ কী হয়েছে বলুন তো?’
মেয়েটি ঠোঁট ওলটাল, ‘স্পন্ডেলাইটিসের ব্যথাটা বেড়েছে বুঝি, রোজই তো বলছে ঘাড়ে ব্যথা, এদিকে ডাক্তার দেখাতে চাইছে না৷’
আমি একটু ভেবে বললাম, ‘সে ব্যথা তো বহুকালের৷ ছেলেবেলায় মাঠে ফুটবল খেলছিলাম আমরা৷ আমি হয়েছিলাম গোলকিপার৷ আর ও অপনেন্টের স্ট্রাইকার৷ বল মারতে গিয়ে কাদায় পা পিছলে একবারে হুমড়ি খেয়ে আমাকে সুদ্ধ গোলের ভিতরে গিয়ে ঢুকল৷ আমার খানিক চোট লেগেছিল, কিন্তু ওর ঘাড়টা সটান গিয়ে লেগেছিল গোলপোস্টে৷ তারপর থেকে তো খেলাধুলা ছেড়েই দিল একরকম৷ ঘাড়ের ব্যথাটাও মনে হয় তখন থেকেই,’
কেতকীকে হতাশ দেখাল, সত্যি কোনও একটা কারণে দুঃখে আছে মেয়েটা৷ সে দুঃখের কারণ শুধুই তার স্বামীর স্পন্ডেলাইটিসের ব্যথা নয়৷
মনে হল কিছুক্ষণ ইতস্তত করল সে৷ তারপর বলেই ফেলল কথাটা,
‘আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি যদি কিছু মনে না করেন?’
আমি একটু গলা খাঁকারি দিলাম, বাথরুম থেকে জলের শব্দ আসছে, স্নান করছে বিপিন৷
‘আপনি তো ওকে অনেকদিন থেকে চেনেন?’
‘হ্যাঁ, একেবারে ল্যাংটাবেলা থেকে৷’
‘আমাকে একটা কথা সত্যি করে বলবেন?’
আবার অস্বস্তি শুরু হল আমার৷ কোনও একটা গোপন কথাই কেতকী জানতে চাইবে সন্দেহ নেই, ‘হ্যাঁ, বলুন না৷’
‘আমি তো এ পাড়ায় নতুন, কাউকেই তেমন চিনি না, পাড়ায় এমন কেউ কি আছে, যার সঙ্গে ওর প্রেম গোছের কিছু একটা ছিল?’
আমি সরাসরি কোনও উত্তর দিলাম না, উলটে প্রশ্ন করলাম, ‘কেন বলুন তো?’
মহিলা একটু ঘাবড়ে গেলেন, মিনমিন করে বললেন, ‘না, আসলে ক-দিন হল ওর হাবভাব কেমন যেন লাগছে আমার৷’
‘কেমন?’
‘জানি না৷ হুট করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়, কখনও ছাদে গিয়ে বসে থাকে৷ সবসময় কী যেন একটা ভেবে চলেছে৷ আমি ভেবেচিন্তে কোনও কূলকিনারা পাই না, মনে হয় কাউকে যেন খুঁজছে৷ কিন্তু বিয়ের পর থেকে আমার কেবলই মনে হয় আমি যেন কারও ছায়া হয়ে আছি৷’
মেয়েটার চোখ জলে ভরে আসে৷ আমার মনটা কনকনিয়ে ওঠে৷ জিজ্ঞেস করি, ‘আচ্ছা ব্যাপারটা ক-দিন হল শুরু হয়েছে বলুন তো?’
‘এই হবে মাসখানেক৷’ চোখ মুছতে মুছতে কেতকী উত্তর দেয়৷
মনে মনে হিসেব করি আমি, সেই ঝম্পো হয়ে যাওয়া মেয়েটা মারা গিয়েছে এক সপ্তাহ আগে৷ তার মানে তার আগে থেকেই উড়নচণ্ডী হয়েছে বিপিন৷ উঁহুঁ, ব্যাপার সে যা বলছে তা নয়৷ অন্য কিছু গল্প লুকিয়ে আছে এর পিছনে৷
মেয়েটার মুখের দিকে তাকালাম৷ ভরাট গাল বেয়ে আবার চোখের জল নামতে শুরু করেছে৷ মনের ভিতর থেকে একটা অদম্য ইচ্ছা জাগল আঙুলের ডগা দিয়ে সে জলটুকু মুছিয়ে দিতে৷ হোক না পরস্ত্রী, অমন সরল, শৈশব মাখা মুখে জল মানায় না একেবারে৷
তার দিকে কিছুটা এগিয়ে বসতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় খুট করে একটা শব্দ হল বাথরুমের দরজায়৷ বিপিন বেরিয়ে এল৷ পিছিয়ে বসলাম৷
‘এই যে বিপিন, তোমার জন্যই বসে আছি৷ সকালের সেই পটলের টাকাটা…’
বিপিন মনে হয় আমার এগিয়ে আসাটা লক্ষ করেনি, তার মুখে কোনও ভাবান্তর দেখলাম না, একগাল হেসে বলল, ‘তুমি আবার বাড়ি বয়ে ওই ক-টা টাকা…’
‘টাকাটা কি বড়ো কথা রে ভাই? সন্ধের দিকটা আর কাজ কী? বন্ধুবান্ধব তো আর নেই তেমন৷ ভাবলাম টাকা দেওয়ার নাম করেই…’ বুঝতে পারছি অভিনয়টা খেলো হয়ে যাচ্ছে৷ বিপিন নিজেই সামলে নিল, ‘বেশ তো, আমরা না-হয় ভিতরের ঘরে বসেই…’
‘হ্যাঁ সেই ভালো৷ পুরুষ মানুষের কথা আবার…’
কেতকীও উঠে পড়ল, ‘আমি চা করি বরঞ্চ৷’
‘উঁহুঁ, ওসব লাগবে না৷’ বিপিন কঠিন গলায় বাধা দিল৷ গলাটা কি একটু বেশি কঠিন শোনাল?
ভিতরের ধরে ঢুকে ভালো করে দরজা আটকে দিল বিপিন৷ তারপর এগিয়ে এসে বলল, ‘পেয়েছ?’
আমি একটু বাঁকা হাসি হাসলাম, ‘পেয়েছি, তবে একটা হিসেব মিলছে না ভাই৷’
‘কী?’
‘তোমার দাদার সেই প্রেমিকাটি আত্মহত্যা করেছে আজ এক সপ্তাহ আগে৷ এদিকে তোমার সংসারের দিকে মন নেই আজ মাসখানেক ধরে, আমার তো সন্দেহ হচ্ছে প্রেমিকাটি আদৌ তোমার দাদার ছিল না৷ তুমিই পরকীয়া করে…’
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলাম ভারী অপ্রস্তুতে পড়েছে বিপিন৷ সে স্বীকার-অস্বীকার কিছুই করল না৷ কেবল মাথা নামিয়ে নিয়ে বলল, ‘ওটা যদি কীভাবে ব্যবহার করতে হবে একটু বলে দাও…’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি, বেচারি কেতকীর কথা ভেবে মনটা খারাপ হয়েছিল, সেই খারাপ লাগাটুকু গলায় মাখিয়েই ঝম্পো পিশাচের থেকে মুক্তির উপায়টা বলতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় একটা বুদ্ধি খেলে গেল আমার মাথায়৷ যতদূর মনে হচ্ছে চরিত্রের দিক থেকে বিপিন খুব একটা সুবিধের ছেলে নয়৷ কচি বউটাকে অকারণেই কষ্ট দিচ্ছে সে৷
ব্যাগ থেকে একটা শিশি বের করে টেবিলের উপরে রেখে বললাম, ‘এই হল ঝম্পো তাড়ানোর পথ্য৷ আমার দাদুর নিজের ফর্মুলায় তৈরি৷ তবে এ জিনিস ব্যবহার করার বিধি আছে৷ প্রতি মঙ্গল আর শুক্রবার সন্ধায় স্নান করে মিনিট পাঁচেক ঘাড়ে লাগাতে হবে৷ মাস দুয়েক লাগালেই একটু একটু করে ঘাড় হালকা হয়ে যাবে, ঝম্পো পালিয়ে যাবে৷ তবে…’
বিপিনের মুখ খুশি খুশি হয়ে উঠছিল, ‘তবে’ শুনে আবার গম্ভীর হয়ে গেল সে, ‘তবে কী?’
আমি আবার নিজের অভিনয় প্রতিভা তুলে আনার চেষ্টা করলাম, ‘তবে যে কেউ সে ওষুধ লাগাতে পারবে না৷ তান্ত্রিক অথবা তান্ত্রিকের রক্ত বইছে এমন কেউ লাগালেই ওষুধ কাজ করবে৷’
‘আমার বাড়িতে তো কেউ…’
মুখে জোর করে একটা হতাশ ভাব আনার চেষ্টা করলাম, দীর্ঘশ্বাস টেনে বললাম, ‘এটুকু না-হয় আমিই করলাম৷ এমনিতে ও রক্তও তো আর কোনও কাজে লাগে না৷’
বিপিনের মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল৷ মনে হল ঘাড় থেকে ঝম্পো নামুক না-নামুক তার বুক থেকে পাথর নেমে গিয়েছে৷
বিপিনের ঘাড়ে ওষুধ লাগিয়ে দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ তার সঙ্গে গল্পগুজব করলাম৷ তবে সেই মৃত মেয়েটিকে নিয়ে আর কোনও কথা হল না৷ সত্যি কথা বলতে খানিকটা ভয়ই লাগছিল আমার৷ বারবার অজান্তেই বিপিনের ঘাড়ের দিকে চোখ চলে যাচ্ছিল৷
সেদিন বেরনোর সময় আর একবার দেখা হয়ে গেল কেতকীর সঙ্গে৷ ডাগর দুটো চোখ তুলে আমার দিকে তাকাল সে৷ যেন স্বামীর সম্পর্কে তার সন্দেহের কথা আমি বিপিনকে বলে দিয়েছি কি না সেটাই জানতে চাইল৷ আমি চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করলাম তাকে৷
আমি কি পরকীয়া করছি? হুঁহ, চোরের ঘরে আবার চুরি৷
(৪)
এরপরের দু-মাসে আমার মনের ভিতর কে যেন প্রতি মঙ্গল আর শুক্রবার একটা একটা করে প্রদীপ জ্বালতে শুরু করল৷ সপ্তাহের ওই দু-দিন যাই বিপিনের ঘাড়ে ঝম্পো তাড়ানোর ওষুধ লাগাতে আর নিজের মনের ভিতরে খানিকটা করে ক্ষত তৈরি করে বাড়ি ফিরি৷ বেশ বুঝতে পারি কেতকীকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি৷ তার বুকের ভিতরে কীসের যেন চাপা বেদনা, অশ্রুসিক্ত দুটো চোখ৷ অসহায় দৃষ্টি, মাঝে মাঝে টুলের উপরে মিষ্টির প্লেট রেখে যাওয়ার সময় বাধা দেওয়ার অছিলায় তার হাত ছোঁয়া৷ এই সব কিছু ভারী ভালো লাগতে শুরু করেছে আমার৷ বিপিনের কী উপকার হচ্ছে জানি না৷ সে নিজে মুখে বলছে একটু একটু করে ঘাড়ের বোঝা কমছে তার৷ কিন্তু সেসবের দিকে আমার মন নেই৷
বিপিন যখন স্নান করতে যায় আমি কেতকীর কাছ ঘেঁষে বসি৷ সে আমাকে সরাসরি বলেনি, কিন্তু ইশায় বুঝিয়েছে সেও আমাকে চায়৷ একদিন আমার বুকে ভেঙে পড়তে গিয়েও নিজেকে সামলে নিয়েছে৷ আমি জানি আর একটু সময় দিলেই পুরোপুরি ভেঙে পড়বে সে৷ সেই সঙ্গে এ-ও বুঝতে পারছিলাম, আজ হোক কাল বিপিনকে ব্যাপারটা খুলে বলতেই হবে৷
কাল বিপিনের ঝম্পো পিশাচের চিকিৎসার দু-মাস শেষ হয়েছে৷ ফলে একরকম মনস্থির করেই গেছিলাম আজ কিছু একটা জানিয়েই বাড়ি ফিরব৷
বিপিনের কাঁধ এতদিনে সোজা হয়েছে৷ দেখলেই বোঝা যায় আগের থেকে বেশ খানিকটা চাঙ্গা হয়েছে সে৷ ওষুধের শেষ পোঁছটা তার কাঁধ থেকে মিলিয়ে আসতেই আমি নিজের মনকে শক্ত করেছি৷ কঠিন গলায় কোনওরকম সংকোচ না করে বলেছি, ‘তোকে একটা কথা বলার ছিল বিপিন, কেতকীকে আমি ভালোবাসি৷ যতদূর বুঝি ও-ও ভালোবাসে আমাকে৷ এতদিন দু-বেলা আমার এখানে আসার কোনও প্রয়োজন ছিল না, তাও এসেছি কেবল ওর জন্যেই৷ অপরাধ করিনি, ভালোবেসেছি৷’
কথাটা বলে কেতকীর দিকে চেয়ে বেরিয়ে এসেছি বাড়ি থেকে৷ কথাটুকু না বললে মনের ভিতরে খচখচানিটা রয়ে যেত৷ জানি হয়তো কিছুই হবে না৷ তাও মৃত্যুঞ্জয় তান্ত্রিকের নাতি আমি৷ সধবা মহিলাকে যদি ভালো বেসেও থাকি, অন্তত অপরাধপ্রবণতা নিয়ে বাসিনি৷ সেদিন রাতে ভারী শান্তির একটা ঘুম হয়েছিল আমার৷
তবে সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখলাম হরিকাকা এসে ডাকাডাকি করছে৷ আমি চোখ-টোখ মুছে উঠে বসে ভালো করে তার কথা শুনতেই আঁতকে উঠলাম৷ বুকের ভিতরে রুনরুন করে একটা বিষণ্ণ যন্ত্র বেজে উঠল, আজ সকালে একতলার ঘর থেকে বিপিনের ঝুলন্ত মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে৷ আত্মহত্যা৷
পড়ি-কি-মরি করে ছুটলাম৷ বিপিন আত্মহত্যা করেছে? কিন্তু কেন? ওর স্ত্রী আমাকে ভালোবাসে বলে? কাল মুখের উপর কথাগুলো বলে এলাম… আমার কানের পাশ দিয়ে হাওয়া ছুটতে লাগল৷ বড্ড বড়ো একটা ভুল হয়ে গিয়েছে৷
বিপিনের বাড়ির একতলার দরজায় লোক জড়ো হয়েছে৷ দরজার ঠিক ভিতরের মেঝের উপরেই পড়ে আছে সাদা চাদরে মোড়া দেহটা৷ কেতকী হাপুস নয়নে আছাড়ি-পিছাড়ি হয়ে কেঁদে চলেছে স্বামীর বুকের উপরে শুয়ে৷ আমি আর তাকে মুখ দেখাতে পারলাম না৷
খানিক দূরে দেখলাম শ্যামলাল দাঁড়িয়ে আছে৷
তার মুখে তেমন শোকের ছাপ নেই৷ বরং ভারী নিরুৎসাহ হয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে ছেলেটা৷ আমি লুকিয়ে-চুরিয়ে তার পাশে গিয়েই মিহি গলায় বললাম, ‘কোথা থেকে যে কী হয়ে গেল ভায়া,’
‘ফালতু নাটক মেরো না তো, ভাবছি শ্মশানযাত্রীগুলো শালা…’
ভারী রাগ হল আমার৷ বললাম, ‘ভাইটা সকালে মারা গেল আর তুমি…’
‘আরে দ্যার মশাই৷’ আঙুল তুলে কেতকীর দিকে দেখাল শামলাল, ‘ওই যে ওর বউটা আকুলিবিকুলি হয়ে কাঁদছে, ওসব কি সত্যি ভেবেছ? সব শালা নাটক৷’
‘মানে? এসব কী বলছ তুমি?’ আমি অবাক হয়ে গেলাম৷
চারপাশটা একবার দেখে নেয় শ্যামলাল, তারপর চাপা গলায় বলে, ‘আমি বলছি না, ও নিজেই বলছিল আজ সকালে৷ বিপিনের বডিটা দেখে ও একটু দুঃখ যে পায়নি তা নয়, কিন্তু সে অতি অল্প৷ তার থেকে খুশি হয়েছিল বেশি৷’
‘খুশি৷ কেন?’
‘কেন আবার? বিপিনের সঙ্গে ওর সুখ ছিল নাকি?’
আমি একটু নরম গলায় বললাম, ‘না-হয় ছেলেটা একটু পাশের ছাদের মেয়ে দ্যাখে…’
‘আরে দ্যার শালা৷’ খিস্তি করে উঠল শ্যামলাল, ‘তুমি দেকছি কিছুই জানো না বে৷ মেয়ে আবার কোথায়? বিপিনটা ছোটো থেকেই মেয়ে-ফেয়ের পিছনে নেই৷ ওসবে ওর শরীরে পুরকি জাগে না৷ সেই যেবার তোমার সঙ্গে গোলপোস্টে ধাক্কা লেগে ওর ঘাড় ভাঙে, তখনই ও রিয়েলাইজ করে যে ছেলেদের বড়িতেই ওর ইন্টারেস্ট, সেই যে কী যেন বলে… ওই জন্যেই তো বউকে খুশি করতে পারেনি৷ তোমার পিছনেই ছুঁকছুঁক করত৷ তারপর কীসব তন্ত্র ফন্ত্রের ভুজুং ভাজুং দিয়ে তোমাকে দিয়ে ঘাড় মালিশ করাত৷ শালা হেব্বি আরাম পেত তুমি হাত লাগালে, তারপর কাল…’
আমার বুক কেঁপে উঠছিল৷ শরীরটা কেমন ঝিমঝিম করছিল৷ দাদুর সেই বরাভয়ের হাতটা মনে পড়ে গেল৷ জানি না কেন মনে হল মাঝের আঙুলটা ছাড়া বাকি আঙুলগুলো নামিয়ে নিয়েছেন দাদু৷
‘ও কী৷ ঘাড়টা ওরকম চেপে ধরছ কেন?’ শ্যামলাল আমার দিকে চেয়ে অবাক গলায় বলে৷
আমার ঘাড়ের উপর কিছু একটা যেন এসে বসেছে৷ শুধু যে এসে বসেছে তা-ই নয়, ঘাড়ের কাছে কীসের যেন খোঁচা লাগছে বারবার৷
কেতকীর দিকে একবার, সাদা চাদরে ঢাকা মৃতদেহের দিকে একবার তাকালাম আমি৷
শ্যামলাল আবার জিজ্ঞেস করল, ‘শরীর খারাপ নাকি? কী হল তোমার?’
ভয় ভয় গলায় আমি উত্তর দিলাম, ‘ঝম্পো৷’