ঝন্টুমামার ছাঁকনি
রূপেনকে সঙ্গে নিয়ে চক্রবেড়িয়া রোডে ঝন্টুমামার বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতেই ছটা বেজে গেল। বাড়ির সামনে ছোট একফালি ফাঁকা জায়গা আছে। তারের জাল-লাগানো গেটটা টেনে ধরতেই এক টুকরো ইট মাটি ছেড়ে হেলেদুলে খাড়া হয়ে উঠল। ব্যাপারটা রূপেনের চোখ পড়েছে দেখে বুঝিয়ে দিলাম, গেটের পাল্লা আর ওই খুঁটিটার মধ্যে দড়ি বেঁধে তার মাঝখানে ইটটাকে ঝুলিয়ে ঝন্টুমামা বঙ্গীয় কায়দায় ডোর ক্লোজার তৈরি করেছেন। গেট টানলেই ইটটা মাটি ছেড়ে শূন্যে ভেসে ওঠে। তারপর ওই ইটের টানেই পাল্লা আপনা হতে বন্ধ হয়ে যায়।
তেজপাতার ঝাঁকড়া গাছের তলায় দেখি, হুমড়ি খেয়ে বসে আছে আদিদাস। ঝন্টুমামার অ্যাসিস্ট্যান্ট! এত বিশাল চেহারায় এত সামান্য বুদ্ধি নাকি পৃথিবীতে কারও নেই। ঝন্টুমামার মতে ওয়েট লিফটিং এর সময় অতিরিক্ত পরিশ্রমে ওর ঘিলুগুলো মেল্ট করে হাতের গুলির মধ্যে এসে জমেছে। কিন্তু আদিদাস কী করছে ওখানে?
চুপিসারে আরও কয়েক পা এগিয়ে দেখি তার সামনে একটা ঘড়ি। শিকার বধ করে একটা বাঘ যেন চার হাত-পায়ে ভর রেখে বসে আছে। ভাবটা, কেল্লা ফতে, এবার খেলেই হয়।
ডাক শুনেই আদিদাস ভুরু কুঁচকে ঠোঁটের কাছে আঙুল তুলে বলল, আস্তে আস্তে!
–আদিদাসও যে বিজ্ঞানী হয়ে উঠল দেখছি। নিলয় টিপ্পনী কাটল।
–প্লিজ চেঁচামেচি করবেন না। হঠাৎ যদি অ্যালার্ম বেজে ওঠে, আর আমি শুনতে না পাই…।
–অ্যালার্ম বাজলে শুনতে পাবে না কেন? ঘড়িটা খারাপ নাকি? রূপেন প্রশ্ন করে।
–আরে বাবা, ক-টায় অ্যালাম দেওয়া আছে, দেখে নিলেই তো হয়। আমি বললাম, হাঁ করে বসে আছ কেন? ঘড়িটাও দেখতে শেখনি?
আদিদাস সঙ্গে সঙ্গে ঘড়িটা উঁচু করে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, আপনিই দেখে বলুন।
তাকিয়ে দেখি ঘড়ির কোনও কাঁটাই নেই। সেকেন্ড, মিনিট, অ্যালার্মের কাঁটা কিছু নেই। তবে ঘড়িটা যে চলছে, তাতে সন্দেহ নেই। টিকটিক শব্দ শোনা যাচ্ছে।
নিলয় ও রূপেনের দিকে তাকিয়ে দেখি তাদের অবস্থাও আমার মতো। আদিদাস বলল, স্যার মর্নিং-ওয়াকে বেরিয়েছেন, অ্যালার্ম বাজার মধ্যে না ফিরলে বুঝতে হবে, কোনও আততায়ী নিশ্চয়…
ক্রি-রি-রিং শব্দে হঠাৎ বেজে উঠল অ্যালার্ম। এমন চমকে গিয়েছিলাম যে, আরেকটু হলেই ঘড়িটা হাত থেকে পড়ে যেত।
ওয়ান-টু আওড়ে নিজেই নিজেকে দৌড়ের স্টার্টিং দিচ্ছিল আদিদাস।
বাস বাস–এসে পড়েছি! ঝন্টুমামার সুরেলা গলা কানে আসতেই আদিদাসের মুখ জুড়ে স্বর্গীয় হাসি ছড়িয়ে পড়ল। বিগলিত কণ্ঠে বলল, স্যার আজকেও ঠিক সময়ে এসে গেছেন।
এ অবধি একদিনও আদিদাসকে উদ্ধারকার্যে যেতে হয়নি বলে তার মনে মনে বড়ই দুঃখ। তা ছাড়া প্রতিদিনই নাকি ওই কাঁটাবিহীন ঘড়ির অ্যালার্ম বাজার সঙ্গে সঙ্গেই ঝন্টুমামার উদয় হয়। এ-ও একটা রহস্য বইকি!
–তোমাকে তো চিনলাম না। ঝন্টুমামা সরাসরি প্রশ্ন করলেন রূপেনকে।
আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, ও আমাদের খুব চেনাশোনা। ভারী বিপদে পড়ে, মানে ওর চাকরি নিয়ে…।
–আর চাকরি মানেই প্রাণ নিয়ে… নিলয় আবার আরেক ধাপ এগিয়ে গেল।
–ছেলেটি বোবা বুঝি? ভারী স্নেহের সুরে উচ্চারণ করলেন ঝন্টুমামা।
–না না, বোবা হবে কেন…
–তবে তোমরা খামকা বকবক করছ কেন? ওকে বলতে দাও।
রূপেনের কাঁধে হাত দিয়ে ঝন্টুমামা তাকে পরমাত্মীয়ের মতো ডেকে নিয়ে গেলেন তাঁর গবেষণাগারে। আমরা যে দুটো লোক দাঁড়িয়ে আছি, সেদিকে তাঁর খেয়ালই নেই। কিন্তু প্রফিট-লসের হিসাব কষে বুঝতে পারছি, অভিমান করার কোনও মানে হয় না। গুটিগুটি পায়ে ঝন্টুমামার পিছুপিছু ঘরে ঢুকে পড়লাম।
–তোমার ছবির এগজিবিশন আমি দেখেছি। ঝন্টুমামার কথা শুনে ধড়ে প্রাণ এল। তার মানে রূপেনকে তিনি চেনেন। তোমার ওয়াশের কাজগুলো খুব ভালো লেগেছে।
রূপেন লাজুক মুখে মাথা নিচু করে দু-হাতের দশটা আঙুলকে নিয়ে বড়ই বিব্রত।
–যাক, এবার তোমার প্রবলেমের কথাটা শুনি।
রূপেন মুখে তুলে বলল, আসলে বাবা মারা যাওয়ার আগে তো কিছু বুঝিনি। সংসারের কোনও দায়িত্বই নিতে হয়নি। গত বছর একদিন হঠাৎ বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর নিয়ে ফিরলেন। প্রথমটা কেউই গা করেনি। কয়েকদিন গেল, জ্বর আর ছাড়ে না। পাড়ার বংশীবাবুকেই বিপদে-আপদে ডাকা হয়। ভিজিটটাও খুব কম। মাত্র পাঁচ টাকা। তা বলে, ডাক্তার যে খারাপ তা নয়। আদর্শবাদী লোক। যদি মনোহরপুকুর রোডে ওঁর চেম্বারে যান –যে কোনও সময়ে হয়তো উনি ভিজিটে গেছেন, খাঁ-খাঁ পড়ে থাকবে চেম্বার, কাউকে পাহারা দেবার দরকার নেই। সামনেই যে রিকশাওলাদের স্ট্যান্ড, তারাই পাহারাদার। এর থেকেই বুঝতে পারছেন…
–এক মিনিট! তুমি একটু ফাস্টে দিয়ে দাও। ঝন্টুমামা বললেন।
–আজ্ঞে?
-বলছি, একটু রিওয়াইন্ড করে ফাস্ট স্পিডে চালাও। না হলে শেষ করতে পারবে না। ঘণ্টাখানেক বাদে আমাকে একবার বেরতে হবে।
–ও! হ্যাঁ হ্যাঁ বড় আজেবাজে কথা বলছি। আসলে, চাকরি-মানে, আমার চাকরি করাটাই দায় হয়ে উঠেছে। অথচ চাকরিটা ছাড়া কোনওমতেই সম্ভব নয়।
–ফাইন আর্ট করে–বছরে বড়জোর একটা সোলো এগজিবিশন। ক-টা ছবি আর বিক্রি হয় বলুন? বেশ ছিলাম প্রথমে, অফিসটা মোটেই খারাপ নয়। কিন্তু ওই যে সরকার বদলি হয়ে আমার ওপরের পোস্টে এসে জয়েন করল, তারপর থেকেই…।
বিজন সরকার। লোকে নাম দিয়েছে দুর্জন। চেহারাটা কিন্তু গোপাল ভাঁড়ের মতো। গোলগাল মুখ। ঠোঁটে ১২০ জর্দার লাল হাসি লেগেই আছে। মাঝে মাঝে ক্রিকেট স্টারের মতো মাথা ঝাঁকিয়ে কপালের ওপরে ঝুলে-পড়া চুলগুলোকে হটিয়ে টেরিয়ে টেরিয়ে দেখে। চেনাশোনা কারওরই (ওর অধীনস্থ ব্যক্তিদের নাম মনে রাখতে পারে না। দেখা হলেই, এই যে, আহ্-হা, ওই, ওহে বাপু ইত্যাদি দু-চার অক্ষরের সম্বোধন এবং বেশির ভাগ সময়েই অকারণে। দোতলা থেকে একজনকে ডেকে এনে একবার জিজ্ঞেস করেছিল, দোতলায় যাচ্ছিলে নাকি? দুটো শব্দ বা বাক্যের মধ্যে প্রায়ই গ্যাপ সৃষ্টি করে নিঃশব্দে হাসিসমেত চাউনি পুরে দিয়ে। রূপেনের ওপর সরকারের রাগ করার কারণ আছে। কোম্পানির একটা প্রতীক বানাবার জন্য আর্ট সেকশনের সবাইকেই ডিজাইন তৈরি করতে বলা হয়েছিল। খোদ ডিরেক্টর সাহেব সরকারের ডিজাইনকে খারিজ করে দিয়েছিল, রূপেনের কাজটাই সিলেক্টেড হয়েছিল। সেদিন থেকেই রূপেনের কপাল পুড়তে শুরু করেছে। প্রতিমুহূর্তে রূপেনকে অপদস্থ করার যজ্ঞে প্রাণ-মন নিবেদন করেছে। সরকার। অজস্র উদাহরণ আছে, কিন্তু একটা ঘটনার কথা বললেই বাকিটা জানা হয়ে যাবে।
ঠিক অফিস ছুটি হবার মুখে সরকারের তলব পেল রূপেন। ইন্টারনাল ফোনে। সরকার বলল, পিজবোর্ড কেটে কয়েকটা কিউব, মানে চারচৌকো বাক্স তৈরি করে নিয়ে এসো তো।
ছ-টার শো-এ রবীন্দ্রসদনে হাবিব তনবীরের নাটকের টিকিট কাটা ছিল। তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে প্রায় ছুটতে ছুটতে এল সরকারের ঘরে।
–এ কী! পাঁচটা কিউব বানিয়েছ কেন?–সরকার যেন শিউরে উঠল, একটা ইউনিট হিসাবে করবে তো!
-ইউনিট মানে? পাঁচটাতেও তো ইউনিট হতে পারে।
–যাঃ, তুমি কিছু বোঝ না। ইউনিট মানে
–বেশ তো, পাঁচটা থেকে একটা বা দুটো বাতিল করে দিলেও তো
-না না, আমার যে ছ-টা চাই। ছ-টা হলে তাকে দু-ভাগ করলে তিনটে করে হবে, আবার তিন ভাগ করলে হবে দুটো করে…
–সেটা তো বললেই পারতেন প্রথমে।
যা-ই হোক, আরেকটা কিউব তৈরি করে নিয়ে এল রূপেন।
সরকার একটা স্কেল নিয়ে কিউবের বাহু মাপা শুরু করলেন। প্রত্যেকটা কিউবের বারোটি বাহু ইনটু ছটা কিউব–সবসুদ্ধ বাহাত্তরবার মাপ নিয়ে তবে সন্তুষ্ট হলেন, বেশ, এবার কিউবগুলো খুলে চ্যাপটা করে ফেল!
রূপেন স্তম্ভিত, খুলে ফেল মানে?
-তুমি কি একেবারে ফেভিকল দিয়ে সব চিটিয়ে দিয়েছ নাকি! এ হে, হে হে– বাক্সগুলো খুলতে না পারলে তো কোনও কাজই হবে না! সন্দেশের বাক্স দেখনি? সেইরকম দরকার। যাতে ইচ্ছেমতো খুলে চ্যাপটা করে ফেলা যায়।
-কালকে তাহলে করে দেব। আজ তো….
–এই! তুমি এরকম ভেতো বাঙালির মতো কথা বলো না প্লিজ! আজ নয় কাল করেই তো বাঙালি জাতির….
অধঃপতিত রূপেন নিজের ডিপার্টমেন্টে ফিরে এসে আবার তৈরি করল ছ-টা কিউব।
সরকার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তারপরেই দু-আঙুলে ঘি পরখ করার মতো বাক্সের পিজবোর্ডের পুরুত্বের হদিশ নিয়েই ঠোঁট উলটে ঘাড় নাড়তে শুরু করল, না, না, এ আমি টলারেট করব না। কে তোমাকে এত মোটা বোর্ড ব্যবহার করতে বলেছে? কোম্পানিকে ফতুর করে দেবে নাকি হে! পাতলা, আরও পাতলা বোর্ড নাও।
পাতলা বোর্ডে কিউব বানাল, কিন্তু বলাই বাহুল্য, সেগুলো বেশি পাতলা হয়ে গেল।
বাক্স যদি বা অ্যাপ্রুভ হল, তারপরে এল একটা স্ট্যান্ডার্ড বোর্ডের সমস্যা। বাজারে যেসব সাইজের বোর্ড পাওয়া যায়, তার এক-একটা থেকে ছ-টা কিউব বানাতে হবে। ফলে কিউবের সাইজ ছোট করার দরকার হল। মাপে এঁটে গেল বটে, কিন্তু সরকার রায় দিল, ওয়েস্টেজ বেশি হয়ে যাচ্ছে। বাক্স ক-টার মাপ এমন হওয়া চাই, যাতে ছাঁট বাদ না যায়।
–এতটুকু ছাঁট বাদ যাবে না, সেভাবে কাজ করতে গেলে কম্পিউটার লাগবে।
রূপেনের কথার খোঁচা সরকারকে এতটুকু টলাতে পারল না, যত দূর পার চেষ্টা করতে তো দোষ নেই।
–হ্যাঁ, আরও ভালো হলে ভালো হয়।
মুখে যা-ই বলুক রূপেন তা-ও চেষ্টার কসুর করেনি। দেখে-শুনে নেড়েচেড়ে সরকার তার পরবর্তী বাণী দিল, ছাঁটের ব্যাপারে আরেকটু না-হয় তোমায় স্বাধীনতা দিচ্ছি; কিন্তু ছাঁটের চেহারাটা যেন বেশ সুন্দর হয়, তারও মধ্যে একটা প্যাটার্ন, মানে আর্টিস্টিক ব্যাপার থাকে।
রূপেনেরও তখন জেদ চড়ে গেছে। থিয়েটার তো এতক্ষণে শেষ, ক্ষতি যা হবার হয়েইছে। লোকটা কত দূর এগতে পারে দেখা যাক।
সরকার বলল, বাঃ, বেশ হয়েছে প্যাটার্নটা। কিন্তু এই যে জিনিসটা তৈরি করছি, এটা একটা খেলনা ক্যালেন্ডার। মানে, ক্যালেন্ডার-কাম-খেলনা। তুমি যা করেছ, তাতে ক্যালেন্ডার কেটে খেলনা বানাতে গেলে দেখা যাবে, ক্যালেন্ডারের ওপরের অংশ আর নিচের অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
বিচ্ছিন্নতা-বিরোধী অপারেশনেও কৃতকার্য হল রূপেন।
সরকার জানাল, প্রায় হয়ে এসেছে দেখছি। খেলনাটা, মানে কিউবগুলো কেটে, মুড়ে, জুড়ে তৈরি করা ও তা-ই দিয়ে খেলবার নির্দেশাবলি তো ছাপতে হবে। সেই নির্দেশ কোথায় কোন ফাঁকফোকরে বসাবে এবার ঠিক করো। দেখো, ছাপার হরফ যেন বারো পয়েন্টের চেয়ে ছোট না হয়।
এই বলে তিনি সিঙ্গল স্পেসে ঠাসা টাইপ-করা ফুলস্কেপ সাইজের দুটো কাগজ বাড়িয়ে দিলেন।
যে বোর্ডটা কেটে বাক্স ক-টা বার করা হবে, তার মধ্যে ওই লেখার সিকি ভাগ ধরাও সম্ভব নয়। তার ওপর বাক্সের জায়গাগুলোয় কিছু ছাপা চলবে না। এতক্ষণে বোঝ গেল, ছাঁটের অংশটাই (যেটাকে কমাবার জন্য এতক্ষণের প্রাণান্তিক চেষ্টা চলেছে) আকারে সবচেয়ে বড় হওয়া দরকার।
রাত সাড়ে দশটায় কাজ শেষ হল।
–অ্যাটেন্ডেন্স খাতায় সই করার সময়ে আবার যেন ভুল করে দশটা লিখো না। জানই তো, ওভারটাইম চাইলে বড় সাহেবের খারাপ নজর পড়বে। ডিউটি হাওয়ারসের (আওয়ারস বলতে পারে না সরকার) মধ্যে কাজ শেষ করাটাই। সবচেয়ে বিগ ক্রেডিট।
সরকারের উপদেশ মাথায় তুলে রাস্তায় বেরিয়েই রূপেন দেখল, সরকার ট্যাক্সিতে উঠছে। এই সরকারকে, লোডশেডিং সত্ত্বেও, ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেকেন্ড ক্লাস ট্রামে বসে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। কাজেই, অফিসের নামে বিল করার সুযোগ না থাকলে সে নিশ্চয়…। আরও ইন্টারেস্টিং, সরকার একবারও রূপেনকে লিফ্ট দেবার নাম করেনি, অথচ দু-জনের বাড়ির অনেকটা পথই কমন।
রূপেনের কথা শেষ হতেই নিলয় উত্তেজিত কণ্ঠে ঘোষণা করল, এ কেসটা ঝন্টুমামার নয়; আদিদাসকেই পাঠাতে হবে মনে হচ্ছে!
খাঁটি কথা বলেছে নিলয়। সুক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক শাস্তি বোধহয় এরকম রিয়্যাল পেঁচা, অর্থাৎ পেঁচালো চরিত্রকে সংশোধন করতে পারবে না।
সামনে ঝুঁকে বসে রূপেন বলল, এই জন্যেই আপনার কাছে এসেছি আমি। সরকারকে শায়েস্তা করার একটা রাস্তা আছে, কিন্তু আমার বুদ্ধিতে…
-বল বল, দ্বিধা করার কোনও কারণ নেই। এ ব্যাপারে তোমাকে সাহায্য করা মানেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করা।
ঝন্টুমামার মুখে এমন অকপট সরল উক্তি বহুদিন শুনিনি।
-মানে, ব্যাপার হচ্ছে, ওই সরকার একটা জালিয়াতি করেছে। রঙের নদী নামে ও একটা অদ্ভুত জিনিস তৈরি করেছে। জিনিসটা দেখতে খুবই সুন্দর। তিনটে দোয়াত থেকে তিনটে রং আস্তে আস্তে অবিরাম গড়িয়ে নামছে একটা এবড়োখেবড়ো পাথরের টুকরোর ওপর দিয়ে। আর নামার সময়ে রং তিনটে মিলেমিশে বহু রঙের চোখ-ধাঁধানো এক খেলা জুড়ে দেয়। আকারে খুব যে বড় তা নয়–দু-ফুট বাই তিন ফুটের মতো। আসলে, পুরো আইডিয়াটাই কিন্তু ও চুরি করেছে। এমনকী বিভিন্ন ধারার রঙের কম্পোজিশন পর্যন্ত ও কপি করেছে। গত বছর সরকার বেলগ্রেডে গিয়ে একটা মিউজিয়ামে এই জিনিসটা দেখেছিল….
-তাহলে, বেলগ্রেড মিউজিয়ামে একটা চিঠি লিখে…
লিখেছিলাম, কিন্তু ওরা জানিয়েছে জিনিসটা ওদের ওখানে এখন আর নেই। স্ক্র্যাপ করে দিয়েছে। তবে আমি যদি একটা কালার ফোটোগ্রাফ পাঠাতে পারি, তবে তারা সেটা মূল শিল্পীকে দেখিয়ে তার অভিমত জানাতে পারবে। দুর্ভাগ্যবশত, ওদের কাছেও জিনিসটার কালার ফোটো নেই। আসলে এই জিনিসটাকে ওদের দেশের শিল্পীরা ভালো চোখে দেখেনি–আর যা-ই হোক, চমক নিশ্চয় শিল্প নয়।
রূপেনের মুখে আরও জানা গেল, সরকার তার রঙিন খেলাটাকে নাকি বুকে করে আগলাচ্ছে। কাউকে ছবি অবধি তুলতে দিচ্ছে না। বলছে, আগে পেটেন্ট নেবে, তারপরে পাবলিসিটি। আসলে ও এটাকে দেখিয়ে সামনের ইন্টারভিউয়ে প্রোমোশনটা পকেটে করতে চায়। অনেক কাকুতিমিনতির পরে অফিসের ফোটোগ্রাফারকে শুধু কয়েকটা ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ফোটো তুলতে দিয়েছিল। তা-ও সরকারের ক্যামেরায়, সরকারের কেনা ফিলম ভরার পর। কাজেই কায়দা করে কালার ফোটো তুলে নেবার কোনও সুযোগ নেই। অথচ কালার ফোটো না তুললে ওই নানা রঙের কম্পোজিশনটাও ধরা পড়বে না, রূপেনের কাজও হাসিল হবে না।
মুখ ফসকে বেরিয়ে গিয়েছিল, এ তো অসম্ভব। বিজ্ঞানী তো আর ম্যাজিশিয়ান নয় যে…
নিলয়ও আমাকে সমর্থন করল, কিংবা চোর-ডাকাতও নয় যে, রেনওয়াটার পাইপ বেয়ে উঠে, কি বোম চার্জ করে….
ঝন্টুমামা পায়ের ওপর পা তুলে, চটি নাচাতে নাচাতে আমাদের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ যেন খুশি হয়ে উঠলেন, আরে! তোমরা কতক্ষণ?
এরপরেও চেয়ার আঁকড়ে বসে থাকতে শুধু বুকের পাটা লাগে না, কড়মড় শব্দে লজ্জা ঘেন্নার মুণ্ডু চিবিয়ে খেতে হয়। কিন্তু উপায় নেই যখন…
ঝন্টুমামা রূপেনকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের অফিসের ফোটোগ্রাফারটি কি মানুষ?
–হ্যাঁ, খুব ভালো ছেলে। ও সব জানে। লুকিয়ে কালার ফিল্ম তোলার জন্য অনেক চেষ্টা করেছে, কিন্তু সরকারের চোখ
বাদুড়ের মতো! তা-ই না?
হঠাৎ বিকট হাসিতে ঘর কাঁপিয়ে উঠে দাঁড়ালেন ঝন্টুমামা। বিজয়ী নেপোলিয়নের ভঙ্গিতে দু-হাত কোমরের পেছনে রেখে তিনি আদেশ জারি করলেন, তোমার ফোটোগ্রাফার বন্ধুকে একবার আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়ো। সরকার ঘুঘু দেখেছে, কিন্তু ছাঁকনি তো দেখেনি। হাঃ হাঃ–
কী বললেন ঝন্টুমামা? রূপেনও দেখি উদগ্রীব হয়ে উঠেছে, কিন্তু প্রশ্ন করাটা সমীচীন হবে কি না…।
-যা শুনেছ, ঠিকই শুনেছ। বলছি, সরকার ঘুঘু দেখেছে, কিন্তু ছাঁকনি দেখেনি!
.
এর পরের অধ্যায়টি সম্বন্ধে আমরা সম্পূর্ণ অজ্ঞ। কী ঘটল, আদৌ কিছু ঘটল কি না, তা ও জানতে পারিনি। ইন ফ্যাক্ট, ঝন্টুমামার অসহযোগিতাই আমাদের ঘনঘোর অমানিশার কারণ। রূপেনের ফোটোগ্রাফার বন্ধুর কোনও দোষ নেই। সে বেচারা বলতেই যাচ্ছিল, কিন্তু ঝন্টুমামা এমন জ্যোতির্ময় দৃষ্টিতে তাকালেন… ।
দিন পনেরো পরের কথা। রূপেন সাতসকালে সারা মুখে হাসি মেখে হাজির।
নিলয় বলল, অ্যাঃ! ভাবভঙ্গিতে ওর দেখছি একেবারে ইউরেকা-দশা!
-কাজ হাসিল। বুঝলেন! ঝন্টুমামা সত্যিই গ্রেট
বেজায় খুশি হলে লোকে ক্যাবলার মতো আচরণ করে। রূপেনের এই ঝন্টুমামা-স্তুতি শুনে মনে পড়ে গেল, একজন লোক সাহিত্যসভায় বক্তৃতা দিতে উঠে প্রথম বাক্যেই মাতিয়ে তুলে বলেছিল, রবীন্দ্রনাথ একজন বড় কবি ছিলেন।
কিন্তু আসল ব্যাপারটার কত দূর কী হল?
-কমপ্লিট।
রূপেন পকেট থেকে কয়েকটা কাগজ বার করে বাড়িয়ে ধরল, এই দেখুন ছবি।
কিন্তু এ তো দেখছি সবই সাদায়-কালোয়! তিনটে ছবিই তা-ই। রঙিন ছবি কই?
–হবে, হবে, এর থেকেই হবে!
রূপেনও কি হেঁয়ালি আরম্ভ করল নাকি! এসব ক্ষেত্রে চায়ের উপকারিতা তুলনাহীন। দু-ঢোঁক যেতেই কথা বেরতে শুরু করল।
অফিসের ফোটোগ্রাফার অনেক কষ্টে আবার ছবি তোলার অনুমতি পেয়েছিল। এবারও তাকে সরকারের ক্যামেরায়, সরকারের পুরানো ব্ল্যাক-অ্যান্ড-হোয়াইট ফিমে ছবি তুলতে হয়েছে। এই ছবি তিনটে তারই নমুনা। কিন্তু মজা হচ্ছে, এই তিনটে ছবি থেকে তিনটে ব্লক তৈরি করে সেগুলো একের ওপর আরেকটা তিন রঙে ছাপলেই একেবারে সত্যিকার রংগুলো বেরিয়ে পড়বে।
এত অল্প আলোয় কি অন্ধকার কাটে! বাবা রূপেন, আরেকটু ঝেড়ে কাশ!
রহস্যের মূলে আছে ঝন্টুমামার ছাঁকনি। ছাঁকনিই আসল খেল দেখিয়েছে। ছাঁকনি মানে কালার-ফিলটার। ঝন্টুমামা রূপেনের অফিসের ফোটোগ্রাফারকে তিনটে রঙিন কাচের ছাঁকনি বা কালার-ফিল্টার দিয়েছিলেন। ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ফিলমেই ফোটো তোলা হয়েছে, কিন্তু হাতের কারসাজিতে, একটা ফোটো তোলা হয়েছে নীল-বেগুনি ফিলটার দিয়ে, দ্বিতীয়টা তোলা হয়েছে সবুজ ফিলটার দিয়ে ও তৃতীয়টা লাল ফিলটার দিয়ে। এবার এই তিনটি নেগেটিভ থেকে তৈরি ব্লক ছাপা হবে যথাক্রমে হলুদ, ম্যাজেন্টা ও সায়ান রঙে। তাহলেই মূল জিনিসটির যেখানে যেমন রং আছে, প্রায় অবিকল সেরকম ফুটে উঠবে ছাপা ছবিতে। আসলে সাদা আলো সাতটি রঙের মিশ্রণ। শুধু তা-ই নয়, এর মধ্যে তিনটি রংকে নানাভাবে মিশিয়ে বাকি সব রং সৃষ্টি করা যায়। এই তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই রঙিন ছবির প্রতিচ্ছবি ছাপা হয়। একটি কালার ফিলটার শুধু একটি রংকে ছেকে বার করে আনে, বাকি সব রং আটকা পড়ে যায়। যেমন, নীল-বেগুনি ফিলটার ব্যবহার করে ফোটো তুললে নেগেটিভের ওপর শুধু মূল ছবির হলুদ অংশেরই প্রতিবিম্ব পড়ে। তেমনই সবুজ ফিলটার ব্যবহার করলে নেগেটিভ শুধু ম্যাজেন্টা এবং লাল ফিলটার লাগিয়ে তোলা নেগেটিভে শুধু, সায়ান রং-টির ছাপ ধরা পড়ে। এগুলি প্রত্যেকটিই সাদা কালো নেগেটিভ, কিন্তু দেখলেই বোঝা যায়, একই জিনিসের ছবি হলেও তিনটে নেগেটিভ তিনরকম।
গল্পটা এখানেই শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু রূপেন সন্দেশের বাক্সের সঙ্গে ঝন্টুমামার ছাঁকনি তিনটেও আমাদের হাতে সমর্পণ করে গেছে। ঝন্টুমামাই নাকি ওগুলো আমাদের দেখতে দিতে বলেছেন, যাতে দেখে শিখে তারপরে ওঁকে ফেরত দিই।
[প্রথম প্রকাশ: কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান, ১৯৮৪ সেপ্টেম্বর]