ঝড়
ঝড়ের উদ্দাম নৃত্য শুরু হয়ে গেল। মহাকালের তাথৈ নৃত্য। যত রাত বাড়ে তত ঝড় বাড়ে। একটা সময় ছিল একটু দাপটে বাতাস বইলেই আমাদের আলো তিনবার হেঁচকি তুলেই অন্ধকারে তলিয়ে যেত। আমরা সেই আতঙ্কেই প্রহর গুনছি। পরিবারের একজন বললে, ‘আলো আর নিববে না। অ্যায়সা কায়দা করেছি না। এই কয়েক দিন আগে যখন ওভার হেড তার পালটাতে এসেছি তখন ইঞ্জিনিয়ার ভদ্রলোককে পটিয়ে-পটিয়ে আমাদের পোলটাকে একেবারে জম্পেশ করিয়ে নিয়েছি। তার ধরে ঝুলে পড়লেও আর কিছু হবে না।’
আর একজন বললেন, ‘যাক বাবা, আলো যদি না নেবে ঝড়কে আর ভয় পাই না। টেপরেকর্ডারে রবীন্দ্রসংগীত চালাই। আজ ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার।’ আর একজন বললেন, ‘আজ আর সিরিয়াস কিছু নয়। বেশ জড়োসড়ো হয়ে বসে থ্রিলার, ভূতের গল্প। ছেলেবেলাটা যেন ফিরে এল।’
বাইরে দুশো আশি কিমি বেগে বাতাস ছুটছে, শিস দিতে-দিতে। গাছের মাথা যেন মাটিতে নুয়ে পড়েছে। এক প্রলয়ঙ্কর কাণ্ড চলেছে প্রকৃতিতে। এক-একবার বাতাসের ধাক্কা আসছে, মনে হচ্ছে কাচের জানালা ভেঙে পড়ে যাবে। একজনের আবার রাধা-ভাব এসে গেল। তিনি বললেন, ‘এইরকম রাতে রাধা যেতেন অভিসারে।’ তাঁর কথা শেষ হওয়ামাত্র তিন চমকে আলো নিবে গেল। সঙ্গে-সঙ্গে হাততালি। পোল জম্পেশের নমুনা। ঘোর অন্ধকার। বাইরে ঘোলাটে আকাশ। ঝড় ক্রমশই বাড়ছে। প্রকৃতির নৃত্য এখন চৌদুনি চালে চলছে। পরিবারের বৃদ্ধ আর বৃদ্ধা সভ্যরা এক যোগে শুরু করলেন হরিনাম সংকীর্তন। ঘোর অন্ধকারে আমরা যেযার জায়গায় শুয়ে পড়লুম।
ভোরবেলা জানা গেল ঘটনাটা কী। আমাদেরই জামগাছ মচকে ইলেকট্রিকের তারে গিয়ে পড়েছে। আমরা খবর রাখিনি। তার ছিঁড়ে আগুন লেগে পাশের বিচিলির গোলা বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। টেলিফোন করে সাপ্লাই অফ করা হয়েছে। প্রতিবেশীরা এলেন আমার বিচারে। ‘আপনার মশাই কবে কাণ্ডজ্ঞান হবে। এত বড় একটা পেল্লায় জামগাছ কেউ পুষে রাখে! এ তো একটা দৈত্য! আপনার জন্যে মশাই একটু জোরে বাতাস বইবার উপায় নেই। বইল কী আলো নিবল।’
‘আমার জন্যে বলছেন কেন ভাই! আমার কি অপরাধ!’
‘আরে, আপনারই তো জামগাছ।’
জামগাছটা ঠিক আমার নয়। কোনও এক পাখির। বাড়ির সামনের এক চিলতে জমিতে প্রথমে একটু বাগান করার চেষ্টা করেছিলুম। আউট অভ ফ্রাসট্রেশান। জীবনে কিছুই যখন করা গেল না, কয়েকটা আফ্রিকান গাঁদা করি। চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া। মন্দ হল না। কিন্তু সব লুটপাট হয়ে গেল। পঞ্চাশ ভাগ গেল তেইশে জানুযারি। তারপর গাছফুল, খোলনলচে সব চৌপাটি হয়ে গেল সরস্বতী পুজোর আগের রাতে। ফ্রাসট্রেশানের ওপর ফ্রাসট্রেশান। সামান্য একটু হম্বিতম্বি করার চেষ্টা করেছিলুম। এগিয়ে এলেন পাড়ার নেতা। সাদা নেতা, লাল নেতা, সব নেতারই একরকম বোলচাল। ধমক মেরে কথা। সাফ জানিয়ে দিলেন, ‘পাড়ার বাগান, বাড়ির রক, পাবলিক ল্যাভেটারি সকলের প্রপার্টি। বেশি ট্যাফোঁ করলে অ্যালবাম করে দেওয়া হবে। ‘খুদে বাগান, আমার হাত থেকে চলে গেল পাখিদের হাতে। টিয়া দিয়ে গেল পেয়ারা গাছ। কাক নিয়ে এল নিম। বুলবুলি আনল জাম। ফলসা, বট এলে উড়ে। এক-একটা গাছ আসে আর আনন্দে মন ভরে ওঠে।
সেই জামের আনন্দ এখন টের পাচ্ছি। চারা অবস্থায় কেন উপড়ে দিইনি! অনেকেই বলেছিলেন জাম বাড়ির অত কাছে রেখো না, একদিন বাড়িসুদ্ধ ধ্বসিয়ে দেবে ভাই। তখন ধনে-প্রাণে মরবে। শুনিনি সে কথা। জাম হবে। পাখি আসবে। গান শোনাবে। হয়েছিলও তাই। এই কংক্রিটের অরণ্যে বিপুল এক বৃক্ষ শাখাপ্রশাখা মেলে বাতাসে দোল খায়। ডালের অংশ এসে দোতলায় জানালায় খোঁচা মারে। যেন কোনও বন্ধু এসে ডাকছে, যেমন ছেলেবেলায় ডাকত। ভোরে নানা জাতের, নানা বর্ণের পাখি এসে গান গায়। সে এক বিরল বিলাসিতা। প্রতিবেশীরা অসন্তুষ্ট হতেন—তোমার জামগাছ ঘর অন্ধকার করছে। জামপাতায় আমাদের উঠান ভরে যাচ্ছে। তা, ওই পাখি দেখিয়ে, সবুজের প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়ে, পাকা জাম খাইয়ে গাছটার প্রাণ বাঁচাচ্ছিলুম। এইবার আর জামের প্রাণ রাখা গেল না। তিনটে কারখানা স্তব্ধ করে দিয়েছে। পুরো পাড়া অন্ধকার। পাম্প চালাতে পারছে না বলে অনেক বাড়িতে জল নেই। জল নেই বলে সব প্রাত:কালীন নিম্নবেগ কুম্ভক করে ধরে রেখেছেন। চতুর্দিক থেকে আমার চৌদ্দপুরুষ উদ্ধার শুরু হয়েছে। হায় জাম! তোমার জন্যে আমার কী নিগ্রহ!
ইলেকট্রিক সাপ্লাই থেকে কর্মীদের ধরে আনলুম। ইঞ্জিনিয়ার ভদ্রলোক ফ্যাঁকড়া তুললেন, আপনার জাম আমাদের তারে দোল খাচ্ছে। আগে গাছ সাফ করুন, তারপর আমরা লাইনে কেরামতি করব। আমাদের পাড়ায় গাছকাটার একটি লোক আছে। বড় মজার মানুষ। তা বয়েস পঞ্চাশ-বাহান্ন হতে পারে, আবার ষাট-বাষট্টিও হতে পারে। স্ত্রীর বয়েস চল্লিশ-টল্লিশ। লোকটি তার স্ত্রীকে সন্দেহ করে। সম্প্রতি লোকটির সন্দেহ হয়েছে স্ত্রী মাঝরাতে এক রিকসাওয়ালার সঙ্গে প্রেম করছে। সেই নিয়ে মারদাঙ্গা। ঝটাপটি। পাড়ার লোকের মধ্যস্থতা। শেষে সিদ্ধান্ত—বুড়ো বেটাই বদ। বুড়ো মনের দু:খে ধেনো ধরে দেবদাস। কাল ঝড়ের রাতে চোলাই লোড করে নর্দমায় শুয়ে পড়েছিল। বউ আচ্ছা করে পিটিয়ে দাওয়ায় ফেলে রেখেছিল। ডাকাডাকিতে উঠে বসল। খোয়াড়ি কাটেনি। যেই শুনলে জামগাছ কাটতে হবে, বউ কাটার উৎসাহে উঠোনে লাফিয়ে পড়ল। পায়ে তেমন জোর জমেনি। উলটে পড়ে গেল। বউ বললে—’মড়া মরে রে।’ টলতে-টলতে জাম গাছের তলায় এসে বললে, ‘কাটারি দেন।’ মধ্যবিত্তের বাড়িতে বাড়িতে বঁটি খুন্তির কারবার। কাটারি আসে কোথা থেকে? যেটা পাওয়া গেল তাতে দাঁত পড়ে গেছে। শেষে পাড়ার লোক নিজেদের স্বার্থে একটা ধারালো কাটারি কোথা থেকে নিয়ে এল। লুসির বাবা। লোকটির মেয়ের নাম লুসি। মালকোঁচা মেরে টংয়ে উঠল। বেশ বোঝা গেল নেশার শেষ ঘোরে তাল রাখতে পারছে না। গাছের তলায় বসে গণ-আদালত। একই সঙ্গে আমার বিচার আর জামগাছের বিচার চলছে। হঠাৎ একজন বললে, ‘মগডাল থেকে পড়লে পুলিশকেস হবে যে।’ সঙ্গে-সঙ্গে আমাদের মিনতি—’নেমে আয় বাপ। নেমে আয়।’ নামতে বলায় তার রোক আরও বেড়ে গেল। শেষে কাটাডাল আর কাটারি সমেত সে ভূমিষ্ঠ হল। পড়ার সময় মিটার ঘর থেকে আমাদের বাড়ির ভেতরে যে ওভারহেড একসটেনসান লাইন গেছে, সেটাকে শেষ করে দিলে। ছিঁড়ে দু-টুকরো। ডালপালার ভেতর থেকে ল্যাংচাতে-ল্যাংচাতে বেরিয়ে এসে লুসির বাবা বললে—পঞ্চাশটা টাকা।
সারা পাড়ার আলো জ্বলে উঠল। জ্বলল না আমাদের বাড়ির । কানেকসান লাইন ছিঁড়ে গেছে। আবার এক প্রস্থ গালাগালি। বেরোলাম ইলেকট্রিসিয়ানের সন্ধানে। পোড়ো বাড়ির ঘুপটি ঘরে বসে আছে যুবকটি। আমরা তাকে মাস্টার বলি। গালে হাত। চুল এলোমেলো। বললে—’রাখুন আপনার আলো, আমার প্রেমের আলো নিবে গেল। কেয়া উজালি, কেয়া আঁধেরা।’ মাস্টার শুয়ে পড়ল। কী ব্যাপার! প্রেম চটকায়নি। রবিবার বিয়ে। বিরাট আয়ের দাদা পাঁচ হাজার প্রমিস করে, পনেরো মিনিট আগে ‘নো’ করে দিয়েছে। ঝট করে উঠে বসে বললে, ‘দু-হাজার দিতে পারেন। প্রেসটিজ।’
‘ভাই, তোমায় আমি পাঁচশো পর্যন্ত দিতে পারি।’
‘উসমেই হোগা।’
মাস্টার আমার আলো জ্বালিয়ে দিয়ে গেল। পাম্প চালু হল। শুরু হল আবার একপ্রস্থ গালাগাল। অপরাধ—জামগাছ। অপরাধ, কেন আমি প্রেমের পেছনে পাঁচশো ঢালছি।