ঝড়

ঝড়

তারা ভরা ঝকঝকে আকাশ।

এমন পরিষ্কার আকাশ সচরাচর দেখা যায় না।

নীলকান্ত সমাদ্দার চারতলার ছাদে দাঁড়িয়ে আছেন। মাথা ওপরের দিকে। তিনি অবাক হয়ে ঝকঝকে আকাশ দেখছেন। তাঁর ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। ঠিক দেখছেন তো? চশমা মুছলেন। ষাটের পর দূরের পাওয়ারটা খুব দ্রুত ওলটপালট করে। দরজার পাশে সুইচ। নীলকান্তবাবু আলোটা জ্বালিয়ে দিলেন। ছাদে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে হলুদ আলো পড়ল। তবে আকাশের অবস্থা কিছু বদলাল না। আকাশ যেমন তারা ভরতি ছিল তেমনই রইল। আহা, এমন উজ্জ্বল সপ্তর্ষিমণ্ডল যে কতদিন দেখা হয়নি। নীলকান্তবাবু মুগ্ধ হয়ে সপ্তর্ষিমণ্ডল দেখতে লাগলেন।

বীণার সামনে পার্ট ওয়ান পরীক্ষা। পড়তে পড়তে মাথায় জট পাকিয়ে গেলে সে ছাদে আসে। হাঁটাহাঁটি করে জট ছাড়ায়। আজও এসেছে। তবে আজকের জটটা খুব জটিল জট। আইসটোপের ভারসাম্য সংক্রান্ত জট। ওপরে আসার সময়েই বীণার মনে হচ্ছিল, সহজ হাঁটাহাঁটিতে এ জিনিস খুলবে বলে মনে হয় না। ছোটাছুটি করতে না হয়।

ছাদের ঠিক মাঝখানে একজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বীণার বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। ওরে বাবা, কেমিস্ট্রির ভূত নয় তো। তাদের কলেজে এই রোগ আছে। পরীক্ষার আগে বিভিন্ন সাবজেক্টের ভূত ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে দেখা করতে আসে। নন্দিতার বাংলায় অনার্স ও দাবি করেছে, গত পরশু মাঝরাতে তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেখা করে গেছেন। অন্ধকারেও নন্দিতা স্পষ্ট দেখেছে কবি ঘরের চেয়ারে বসে মন দিয়ে বই পড়ছেন। বইয়ের নাম চার অধ্যায়, মলাটে— লেখা সুলভ সংস্করণ! সেরকম কিছু নয় তো? আলফ্রেড ফাউলার ধরনের কেউ চলে এলেন নাকি?

মনে সাহস এনে এগিয়ে এল বীণা। নীলকান্তবাবুকে চিনতে পারল! অবাক হয়ে বলল, ‘বাবা! বাবা, তুমি এখানে কী করছ?’ নীলকান্তবাবু ছোট মেয়েকে দেখে খুশি হলেন, আবার লজ্জাও পেয়ে গেলেন। বললেন, ‘কিছু করছি না। ঝড় দেখতে এসেছি।’ বীণা আরও অবাক হল। আকাশের দিকে তাকাল। হাতদুটো দু’পাশে। ছড়িয়ে বাতাস ধরবার ভঙ্গি করল। তারপর হাসতে হাসতে বলল, ‘ঝড়! ঝড় কোথায়? এমন ফটফটে আকাশ, তুমি ঝড় কোথায় দেখলে!’ নীলকান্তবাবুও হাসলেন। বললেন, ‘সেটাই তো ভাবছিলাম। টিভিতে খবর শুনলাম, ঝড় আসছে। ছাদে এসে দেখি এই কাণ্ড। তারাফারা ফুটে একাক্কার ব্যাপার। তুই টিভির খবর শুনিসনি?’ বীণা হাসিমুখে বলল, ‘টিভি শুনিনি, তবে খবর শুনেছি। মা পরম উৎসাহে ঘরে ঘরে গিয়ে খবর বলে এসেছে। ঝড় এলেই বা সমস্যা কী? আমরা তো মাঝসমুদ্রে মাছ ধরতে আসিনি যে পাল গুটিয়ে ফিরতে হবে। আমরা আছি যাদবপুরে। নিজেদের চারতলা বাড়িতে। এখানে ঝড় কী করবে?’ নীলকান্তবাবু মেয়ের কথায় সামান্য দুঃখ পেলেন। মুখ ঘুরিয়ে বললেন, ‘বয়স হয়ে গেলে ঝড়, বৃষ্টি, রোদ সবকিছুতেই চিন্তা হয়। বীণা বাবাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘রাগ করলে বাবা? সরি, ভেরি ভেরি সরি। আমি ওভাবে বলতে চাইনি। খামোকা টেনশন। করলে শরীর খারাপ হবে তাই বলছি। ঝড় এলে আসুক গে। মাথার ওপর এমন সুন্দর একটা আকাশ, এসো, আমরা বরং দু’জনে মিলে খানিকক্ষণ আকাশ দেখি।’ নীলকান্তবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘আমি নীচে যাই। ঠান্ডা লেগে যেতে পারে।’ বীণা বাবাকে ছেড়ে চোখ পাকিয়ে বলল, ঠান্ডা লাগলে লাগবে। বুড়ো বাবার মাঝেমধ্যে। ঠান্ডা না লাগলে মেয়েদের বিচ্ছিরি লাগে। তারা বাবাকে ঘনঘন আদা-চা করে দিতে পারে না। খুব আফশোস হয়। নীলকান্তবাবু হেসে ফেললেন। তার এই মেয়েটার খুব বুদ্ধি। ইস, বড় মেয়ে রীনাটাও যদি এমন হত। সে কী যে বোকার মতো কাণ্ড করে। বীণা বলল, ’বাবা, তুমি কি এখনও আমার ওপর রেগে আছ?’ নীলকান্তবাবু বললেন, না, রেগে নেই। বীণা বলল, ‘গুড। তা হলে এসো আমরা দু’জনে মিলে একটা কাজ করি। সপ্তর্ষিমণ্ডলের কাছে যে নতুন নক্ষত্রটাকে পাওয়া গেছে সেটা একবার খালি। চোখে খুঁজে বের করবার চেষ্টা করি। খালি চোখে ওই নক্ষত্রকে দেখা যাবে না, তবু চেষ্টা করি। খুব মজা হবে। তোমার আপত্তি আছে কি বাবা?’ মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে নীলকান্তবাবু বললেন, ‘না নেই।’

নীলকান্তবাবুর ভাল লাগছে। ভাগ্যিস ঝড়ের খবর পেলেন। নইলে কি তিনি আজ এসময় ছাদে আসতেন? নাকি মেয়ের পাশে দাঁড়িয়ে এভাবে আকাশ দেখা হত? রীনাটা থাকলে আরও ভাল লাগত। দুই মেয়েকে দু’পাশে নিয়ে আকাশ দেখা যেত।

কোথা থেকে যেন অল্প একট6ু হাওয়া ভেসে এল। ঝড়ের হাওয়া?

বলাইয়ের মা রুটি বেলছে। কিন্তু রুটি বেলায় তার মন নেই। ফলে রুটিগুলো ঠিকমতো গোল হচ্ছে না। টেরাবাঁকা হয়ে যাচ্ছে। তার কোনও দোষ নেই। মনোরমাদেবী পাশে দাঁড়িয়ে যা বলছেন তাতে রুটি গোল করে বেলা শক্ত।

মনোরমাদেবীর মুখ হাসিহাসি। এটাই তাঁর স্বভাব। টেনশন হলে তিনি হাসেন না, তবু তাঁর মুখ হাসিহাসি দেখায়। তিনি হাতায় সামান্য আলুর দমের ঝোল তুললেন, হাতে ঢেলে মুখে ঠেকালেন। নুনটা কি একটু কম হল? মুখ ফিরিয়ে বললেন, ‘বলাইয়ের মা, একটু চেখে দেখো তো নুন কম হল কিনা।’ বলাইয়ের মা শুকনো মুখে হাত বাড়িয়ে ঝোল নিল। না, কম হয়নি, বরং নুন একটু বেশির দিকেই আছে। কিন্তু মুখে বলল, ‘হ্যাঁ, কম হয়েছে।’ বলেই বুঝল ভুল হয়ে গেল। আসলে মাথার মধ্যে। দুশ্চিন্তা। এক কথা বলতে চাইলে বেরোচ্ছে আর এক। বলাইয়ের মা কথা শুধরে নেওয়ার আগেই মনোরমাদেবী কড়াইতে খানিকটা নুন ঢেলে নিলেন। কাপড়ে হাত মুছে বললেন, ‘লাস্ট খবরটা শুনেছ নাকি?’ লাস্ট-ফার্স্ট কোনও খবরই শোনেনি তবু বলাইয়ের মা মাথা নাড়ল। মনোরমাদেবী সেদিকে না তাকিয়ে বললেন, ‘ওরা বলছে ঝড়টা আর বেশি দূরে নেই। এসে পড়লেই হল। তবে এই মুহূর্তে বঙ্গোপসাগরের| ওপর থম্‌ মেরে আছে। এটাই হল গিয়ে তোমার বিপদের কথা। এমনি ঝড়ে তোমার। তেমন ভয় নেই, কিন্তু থম্‌ মারা ঝড়ে ভয় আছে।’ বলাইয়ের মা শিউরে উঠল, ‘কী। ভয় বউদি?’ মনোরমাদেবী প্রশ্ন শুনে আনন্দ পেলেন। প্রশ্ন মানেই বিষয়টার মধ্যে ঢুকতে চাইছে। তিনি বললেন, কী ভয়? খুব ভয়। সমুদ্রের ওপর থম্‌-মারা ঝড়ের। জোর হল গিয়ে তোমার এমনি ঝড়ের দশগুণ। মারাত্মক জোর। গাছপালা, ঘরবাড়ি সব উপড়ে ফেলতে ফেলতে যাবে।’ বলাইয়ের মায়ের হাত কাঁপছে। চাকির ওপর। রুটির আকার পরোটার মতো হয়ে যাচ্ছে। সেটাই স্বাভাবিক। যার ঘর বাইপাসের ধারে, ছাদ টালির, ঠেকনা বাঁশের, তার পক্ষে এইরকম মারাত্মক ঝড়ের খবর শোনার পর রুটিকে পরোটার মতো করে বেলাটাই স্বাভাবিক। সামলে নিয়ে কাপা গলায় বলল, ‘বউদি, ঝড় কখন আসবে কিছু জানেন?’ মনোরমাদেবী উদাসীন ভঙ্গিতে বললেন, ‘এটাই তোমার আসল কথা বলাইয়ের মা, ঝড় কখন আসবে। বিজ্ঞানীরা। আজও ঠিকমতো বলতে পারে না, ঝড় কখন আসবে। আর যদি বা অঙ্কটক্ক কষে বলে ফেলে, পরে দেখা যায়, হিসেবে ভুল হয়ে গেছে।’ বলাইয়ের মা বলল, ‘বউদি, আমায় ছেড়ে দেন। ছেলেপিলে ঘরে একা, বলাইয়ের বাবায় কখন ফিরবে ঠিক নেই। আপনি যা বললেন, তাতে তো ঘরদোর থাকবে বলে মনে হয় না।’ মনোরমাদেবী বললেন, ‘আমারও মনে হয় না। ঝড়ে পাকা বাড়িই থাকে না। ওড়িশার সাইক্লোনের কথা মনে নেই? কাগজে পড়োনি?’ বলাইয়ের মা পড়েনি, সে পড়তেই জানে না। তবু বলে ফেলল, ‘পড়েছি। মনোরমাদেবী বললেন, ‘তা হলে? তোমাদের তো টালির ঘর।’ সে ঘর টিকবে ভাবলে কেমন করে? এত বড়মানুষ হয়ে বোকার মতো ভাবো কেন?’ বলাইয়ের মা এবার সত্যি সত্যি কেদে ফেলল। বলল, ‘কী হবে বউদি? ছেলেপিলেগুলো ঘুমের মধ্যে বাড়ি চাপা পড়ে মরবে যে।’ চোখে আঁচল চাপ দিয়ে ফোপাতে লাগল।

মনোরমাদেবীর মুখের হাসিহাসি ভাবটা বেড়েছে। কারণ টেনশন বেড়েছে। এখন আর শুধু ঝড়ের চিন্তা নয়, বলাইয়ের মায়ের ছেলেমেয়েদের দুশ্চিন্তাও তার ঘাড়ে এসে পড়েছে। কিছু একটা করতে হবে। কী করতে হবে? মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই বুঝতে পারলেন কী করতে হবে। টেনশন কমল।হাসিমুখ গম্ভীর হল। আলুর দমের কড়াই নামাতে নামাতে বললেন, ‘তোমাদের এই একটা দোষ বলাইয়ের মা। বড় দোষ। বিপদ আসার আগেই কাঁদতে বসে যাও। তুমি বরং একটা কাজ করো, আর কয়েকটা রুটি করে ফেললা দেখি।’ বলাইয়ের মা চোখের জল মুছতে মুছতে ধরা। গলায় বলল, এই ‘ঝড়বাদলার দিনে অত রুটি কে খাবে বউদি?’ মনোরমাদেবী আরও গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘কে আবার খাবে? তোমার ছেলেমেয়েরা রাতে বুঝি না খেয়ে থাকে?’ বলাইয়ের মা অবাক হয়ে বলল, আমার ছেলেমেয়েরা! মনোরমাদেবী বললেন, হ্যাঁ, তোমার ছেলেমেয়েরা। ভেবে দেখলাম, ঝুকি নেওয়াটা। ঠিক হবে না। আজ রাতটা ওদের এ বাড়িতে পাঠিয়ে দাও। বসার ঘরের মেঝেতে টানা বিছানা করে দিয়ে। মশারি আছে তো?

বাড়ি থেকে বেরিয়ে বলাইয়ের মা আকাশের দিকে তাকাল। দক্ষিণ দিকটা লাল লাগে না? ঝড় কি এসে গেল? আসুক। যত খুশি আসুক। ছেলেমেয়েদের জন্য একটা আশ্রয় পাওয়া গেছে, এখন আর ভয় কীসের? দ্রুতপায়ে বাড়ির দিকে যেতে যেতে সে চোখ মুছল৷ সে কি এখন কাঁদছে? না কাঁদছে না, তবে চোখে জল চলে আসছে অন্য কারণে। হঠাৎ একজন চমৎকার মানুষের দেখা পেয়ে গেলে এমন হয়। চোখে জল চলে আসে।

সন্তুর মন চঞ্চল। সেই বিকেলের পর থেকেই চঞ্চল, কিন্তু জিনিসটা বাড়ল কিছুক্ষণ আগে থেকে। মা এসে ঝড়ের খবর দেওয়ার পর। সে এখন তার ঘরের দরজা আটকে পায়চারি দিচ্ছে। ঠিক রাত এগারোটায় তাকে ফোন করতে হবে। আজ। সকালে নব্যেন্দু তাকে পইপই করে বলে দিয়েছে, ‘খেয়াল রাখবি সম্ভ, ঠিক এগারোটায়। আগেও নয়, পরেও নয়। ছোটমামা সবকিছুর এদিক-ওদিক পছন্দ করেন, কিন্তু টাইমের এদিক-ওদিক পছন্দ করেন না।’ সন্তু ভয়ে ভয়ে বলল, ‘ঠিক আছে তাই করব। এগারোটায় ফোন করব।’ নব্যেন্দু উপদেশের ঢঙে বলল, ‘বেশি। ভ্যানত্যাড়ায় যাবি না। ছোটমামা হল স্ট্রেট কথার মানুষ। তুইও স্ট্রেট কথা বলবি। সোজাসুজি বলবি, চাকরিটা করে দিন। আপনি বললেই হয়ে যাবে।’ সন্তু বলল, ‘রেগে যাবেন না তো?’ নব্যন্দু বলল, ‘অফকোর্স রেগে যাবেন। রেগে যাবেন, গালাগালিও দেবেন। ওটাই ওনার স্বভাব। ছোটমামা বলে কেউ ডাকলে চাকরি দেন, তার আগে কষে গালাগালি মারেন। এই বাজারে একটা চাকরি করে দিচ্ছেন, কয়েকটা গালাগালি দেবেন না? তবে চিন্তা করিস না, ইংরেজিতে দেবেন, ফলে অতটা গায়ে। লাগবে না। তা ছাড়া তোর কাছে এখন লেনটা বেশি প্রয়োজন? চাকরি না বাবা, বাছা, সোনামণি, চাঁদের কণা বলে আদর? বল কোনটা বেশি প্রয়োজন? ছোটমামার কাছে বকুনি খাবি এতে অত প্রেস্টিজের কী আছে চাদু?’ সন্তু সামলে নিয়ে বলল, ‘ছোটমামা না বললে তো আর গালি খাবার চান্স নেই।’ নবেন্দু হতাশ গলায় বলল, ‘উফ তোকে নিয়ে পারা গেল না। ছোটমামা বলে না ডাকলে চাকরিটা জুটবে কী করে? ইন্টিমেসি দেখাবি তবেই না কাজ হবে। গাধামির একটা লিমিট আছে। খেয়াল রাখবি, রাত এগারোটার যেন এদিক-ওদিক না হয়।’

ফলে, মনোরমাদেবী ঝড়ের কথা বলে ব্যাওয়ার পর থেকে দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়েছে। সন্তু। একসঙ্গে তিনরকম দুশ্চিন্তা। ঝড়, রাত এগারোটা, গালাগাল। সত্যি যদি ঝড় আসে, তা হলে কখন আসবে? রাত এগারোটার আগে না পরে? পরে হলে ক্ষতি। নেই, কিন্তু আগে হলে সমস্যা। ঝড়ের মধ্যে একজনকে টেলিফোন করে চাকরির কথা বলা যায় কি? ইস, ঝড় আসার সময় পেল না? একবার আকাশটা দেখলে কেমন হয়? মনে হয় না কোনও লাভ হবে। আকাশ দেখে ঝড়বৃষ্টির সময় বুঝতে পারে গ্রামের কৃষক। শহরের বেকাররা কী বুঝবে? ঘোড়ার মাথা বুঝবে।

সন্তু পায়চারি থামিয়ে ঘরের জানলা একটুখানি ফাঁক করল। ঝটক মেরে খানিকটা ঠান্ডা হাওয়া ঢুকে পড়ল ঘরে। যাঃ বাবা, ঝড় কি তা হলে এসে গেল? দরজায় বীণা মুখ বাড়িয়ে বলল, ‘দাদা এককাপ লেমন টি খাবি নাকি? ঝড়ের আশে লেমন টি-র দারুণ এফেক্ট।’ সন্তু হতাশ ভঙ্গিতে বলল, ‘দে।’

এবার বাপের বাড়িতে আসার আগে রীনা প্রতিজ্ঞা করেছিল কিছুতেই কাঁদবে না।প্রতিবারই সুনির্মলের সঙ্গে ঝগড়া করে চলে আসার পর সে সন্ধের দিকটায় খানিকটা কেঁদে নেয়। অনেকটা রুটিনের মতো। বাবা, মা, বীনা, সন্তু প্রথম প্রথম ঘাবড়ে যেত, এখন আর এই কান্নায় পাত্তা দেয় না। এইসময় তার মেয়ে মালাও কাঁদে। মালা ক্লাস টু-তে পড়ে। মামার বাড়িতে এলে তার দারুণ মজা হয়। কান্নাকাটির কোনও প্রশ্নই ওঠে না। তবু মা কাঁদছে বলে তাকে কাঁদতে হয়। সুনির্মল এসে বড় মেয়েকে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত এই জিনিস চলে।

রীনা প্রতিজ্ঞা রাখতে ব্যর্থ হল। আজও কাঁদছে। খাটের ওপর বসে সে মেয়েকে ভূগোল পড়াচ্ছে এবং হাতের ফুলকাটা রুমাল দিয়ে চোখ মুছছে। মালাও চোখ মুছছে। তার কোনও রুমাল নেই, সে চোখ মুছছে হাতের চেটো দিয়ে। তবে আজ সে মায়ের কান্না দেখে কাঁদছে না। কাঁদছে, পড়া না পেরে মায়ের কাছে বকুনি খেয়ে।

রীনা যে তার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে পারল না, তার জন্য দায়ী ঝড়। এত বড় একটা ঝড় আসছে। টিভিতে এতবার বলছে। সুনির্মলের একবার মনে হল না, বউয়ের খবর নিই, একটা টেলিফোন করি। আচ্ছা, বউ না হয় বাজে, ঝগড়ুটে, রাগ করে প্রতি মাসে বাপের বাড়ি চলে আসে। কিন্তু মেয়ে? সে তো কোনও দোষ করেনি। মা একটু আগে এসে বলে গেল, ঝড় নাকি প্রায় পৌঁছে গেছে। সুনির্মল না হয় টিভি দ্যাখেনি। কিন্তু ভবানীপুরেও তো আকাশ লাল হয়ে গেছে। দমকা বাতাস দিচ্ছে। নাকি দিচ্ছে না? ঝড় শুধু এই যাদবপুৱেই! ছি ছি। এ-বাড়ির লোকেরা কী ভাবছে? নিশ্চয় ভাবছে, জামাইটা খুব খারাপ। প্রেস্টিজ বলে আর কিছু রইল না। বেশ হবে। ভাল হবে। ভাবুক, যত খুশি ভাবুক। এরকম সময় যে মেয়ে বউয়ের খোজ নেয় না, সে খারাপ না হলেও তাকে খারাপ ভাবাই উচিত। ঝড় তো আর চিরকাল থাকবে না, একদিন-না-একদিন তো থামবেই। তারপর আসুক বাড়ি ফিরিয়ে নিতে। দেখি কে যায়। নিজেও যাবে না, মেয়েকেও যেতে দেবে না। পা জড়িয়ে ধরলেও নয়।

এরপর না কেঁদে থাকা যায়?

এমন সময় সন্তু দরজার বাইরে থেকে বলল, ‘দিদি, তোদের কান্না পর্ব কি শেষ হয়েছে? নাকি এখনও চলছে? শেষ হলে বাইরে আসিস। জামাইবাবু এসেছে। ড্রইংরুমে বসে এখন লেমন টি খাচ্ছে। বলছে, তাড়াহুড়ো করার কিছু নেই। ভাল করে কেঁদেটেঁদে নিয়ে বেরোলেই হবে।’

বাবা এসেছে শুনে মালা হেসে ফেলল। রীনা হাঁসতে পারল না। তার আরও কান্না পেল। এতক্ষণে লাটসাহেব আসবার সময় পেয়েছেন। এর মধ্যে যদি ঝড় উঠে যেত? আবার আদিখ্যেতা করে চা খাওয়া হচ্ছে।

দড়াম করে কোথায় শব্দ হল। হাওয়ায় দরজা পড়বার শব্দ। চমকে উঠল রীনা। ঝড় কি তবে এসে গেল?

তিনতলার ওপর বীণার ঘর খুব বড় নয়। তবে ঘরের লাগোয়া একটা ছোট্ট বারান্দা রয়েছে। কিছুদিন হল একতলা থেকে একটা বোগেনভেলিয়া কার্নিস বেয়ে ওপরে উঠে এসেছে। উঠে এসে বারান্দায় উঁকি দিচ্ছে। বীণা লক্ষ করে দেখেছে, সেই উঁকি দেওয়ার মধ্যে কেমন একটা লজ্জা লজ্জা ব্যাপার আছে। যেন রূপকথার কোনও রাজপুত্র রূপবতী রাজকন্যার লোভে গোপনে রাজপ্রাসাদের অলিন্দে উঠে এসেছে।। উঠে এসে ভারী লজ্জায় পড়ে গেছে। বীণার মজা লাগে। কোনও কোনও দিন রাতে সে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। ফিসফিস করে বোগেনভেলিয়ার সঙ্গে কথা বলে। আবোলতাবোল কথা। ছেলেমানুষির কথা— ‘ওমা লজ্জা কীসের? রাজপুত্রের কি লজ্জা করলে চলে? এসো, উঠে এসো আমার কাছে। তুমি বুঝি আমাকে নিয়ে যেতে এসেছ। কিন্তু তোমার ঘোড়া কোথায় রাজপুত্র? আমি যাব কীসে? আমার কিন্তু একটা বাদামি ঘোড়া চাই। তার ইয়া বড় কালো কেশর থাকতে হবে…।’

একটু আগে মনোরমাদেবী বাড়িসুদ্ধ সবাইকে জানলা-দরজা আটকানোর কাজে নামিয়েছেন। ঝড় এসে গেছে কিনা বলা যাচ্ছে না, তবে দমকা হাওয়া দিচ্ছে। সেই হাওয়ায় জোর আছে। সস্তু বিরক্ত মুখে বলল, ‘মা, তুমি বড় বাড়াবাড়ি করছ। আগে ঝড় আসতে দাও।’ মনোরমাদেবী ঝাঁঝিয়ে উঠে বললেন, ‘আসার পর জানলা-দরজা আটকে কী হবে? ততক্ষণে যা হওয়ার তো হয়ে যাবে। গাদাখানেক কাচ ভাঙবে। ঘরের জিনিসপত্র সব লন্ডভন্ড হয়ে যাবে। ধুলোয় মেঝেতে পা রাখা যাবে না। সে সব কে পরিষ্কার করবে? তুই? রীনা বীণা তোরা হাঁ করে কী দেখছিল? যা।’

হাতে লেমন টি-র কাপ নিয়ে বীণা তার ঘরে জানলা আটকাতে এসেছে। এসে সব জানলাই খুলে দিয়েছে। তারপর বারান্দার দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। সত্যি ঝড় বোধহয় এসে গেল। একটু আগে ছাদ থেকে দেখা পরিষ্কার আকাশ এখন রাঙা। আঃ কী সুন্দর ঠান্ডা হাওয়া। দমকে দমকে এসে চোখেমুখে ঝাপটা মারছে। বীণা চোখ বন্ধ করল। কেমন একটা সমুদ্র সমুদ্র গন্ধ। এই হাওয়া কি বঙ্গোপসাগর থেকে উড়ে আসছে? কে জানে, হয়তো তাই হবে। প্রকৃতির এই এক মজা। বলা নেই কওয়া নেই, কলকাতার মানুষকে সে খানিকটা সমুদ্রের হাওয়া এনে দিয়েছে। বীণা চুপ করে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। দূরে বাইপাসে সারি সারি আলো জ্বলছে। হাওয়ায় সেই আলো কঁপছে। বীণার ভাল লাগছে। খুব ভাল লাগছে। খুব ভাল লাগার আবার মুশকিল আছে। এই সময় না চাইলেও চোখের সামনে গোপন প্রিয় কোনও মুখ ভেসে আসে। বীণার চোখের সামনেও আসছে। রূপকথার বোগেনভেলিয়ার দিকে তাকিয়ে বীণা হাসল। তারপর মনে মনে বলল, ‘কী গো রাজপুত্তুর, তোমার কালো কেশরের ঘোড়া আনলে না?’ ঝড়ের হাওয়ায় বোগেনভেলিয়া তার মাথা দোলাল জোরে। বীণার মনে হল সে বলছে- ‘এই তো এনেছি রাজকন্যে। এই যে ঝড়ের ঘোড়া এনেছি তোমার জন্য।’

দিদি কখন পাশে এসে দঁড়িয়েছে বুঝতে পারেনি। গলা শুনে বীণা চমকে উঠল। রীনা অবাক গলায় বলল, ‘অন্ধকারে কী করছিস?’ বীণা হেসে বলল, ‘কিছু না দিদি। ঝড় দেখছি। ভারী চমৎকার লাগছে। জামাইবাবুকে এখানে নিয়ে আয় না। দেখবি, তোর ভাল লাগবে।’ রীনা ঠোঁট উলটে বলল, ‘কচু লাগবে। ইস কী ধুলো।’ বীণা হাসতে হাসতে বলল, ‘বোকা কোথাকার। জামাইবাবু পাশে থাকলে ধুলোও ভাল লাগবে।’ রীনা হাত তুলে বলল, ‘চড় খাবি। অ্যাই বীণা, নীচে যা। তোর কাছে কে একটা ছেলে এসেছে।’ বীণা চোখ বড় বড় করে বলল, ‘ছেলে! এই ঝড়ের মধ্যে ছেলে!’ রীনা বলল, ‘হ্যাঁ, বলল তোর সঙ্গে পড়ে। পরীক্ষার সাজেশন না কী যেন নেবে বলছে। সাজেশন নেওয়ার আর সময় পেল না বাবা। ঝড়ের মধ্যেই এসে হাজির। হাওয়ায় চুলটুল সব ভূতের মতো হয়ে গেছে, চশমাটা পর্যন্ত নেমে নেমে যাচ্ছে। হি হি। তোর বন্ধু যা রোগাপ্যাংলা দেখলাম, মনে হয় ফেরার পথে ঝড়ে উড়েই যাবে। যা যা তাড়াতাড়ি ভাগিয়ে দে।’ এক মুহুর্তের জন্য বীণার শরীর কেঁপে উঠল। তবে কি সে এসেছে? সে? ঝড়ের ঘোড়ার পিঠে চড়ে এসেছে তার প্রিয়জন?

বেশি বয়স হয়ে গেলে মানুষের বড় নিঃসঙ্গ লাগে। মনে হয়, ছেলেমেয়ে নাতিনাতনিরা পাশে এসে বসুক। দুটো কথা বলি। বেশি বয়েসের এটাই নিয়ম। নীলকান্ত সমাদ্দারের বাবা মাধবকান্ত সমাদ্দারের বয়স যথেষ্ট বেশি। সামনের আশ্বিনে তিনি বিরানব্বইতে পা দেবেন। আগে চারতলায় থাকতেন। বাতের ব্যথা, বাড়বার পর থেকে একতলায় নেমে এসেছেন। কিন্তু বয়সের নিয়ম তিনি মানেন না। মানুষের সঙ্গ তাঁর একেবারেই অপছন্দ। জীবনের এই প্রান্তে এসে তার মনে হচ্ছে, মানবশান্তির প্রকৃত বীজটি আসলে লুকিয়ে আছে স্বার্থপরতার মধ্যে। নিজের খাওয়াদাওয়া, নিজের সুখটুকু হলেই ব্যস। বাদবাকি সবই আদিখ্যেতা মাত্র। সকলের ক্ষেত্রেই এটা ঠিক। কিন্তু কেউ বলতে চায় না। মনের সত্যি লুকিয়ে রাখে। এই বয়সে তাঁর আর লুকিয়ে রাখার প্রয়োজন নেই। তাই তিনি খোলাখুলি বলতে শুরু করেছেন। দরকারে-অদরকারে তার ঘরে লোকের আসা-যাওয়া তিনি মোটেও পছন্দ করেন না। ভুরু কুঁচকে বলেন, ‘আর কিছু বলার আছে? বলার থাকলে চটপট সেরে ফেলো বাপু। আমার আবার কাজ আছে কিনা।’ সবাই অবাক হয়। এই বয়েসে আবার কাজ কী? তবে অপমানের ভয়ে কথা বাড়াতে সাহস পায় না।

স্বাভাবিকভাবেই বাড়ির লোকেরা এই বৃদ্ধকে যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলে। এড়িয়ে চলে না শুধু বড় নাতনি রীনার মেয়ে মালা। তার অপমানের কোনও ভয় নেই। যখন-তখন একাতলায় চলে আসে এবং খুবই বিরক্ত করে। ঘরে এসেই খাটের ওপর পুতুল ছড়িয়ে বসে পড়বে এবং কিছুক্ষণ পর পর খেতে চাইবে। তখন তুলে রাখা কলটা, আমটা বের করে দেওয়া ছাড়া মাধবকান্তের সামনে অন্য কোনও উপায় থাকে না। তাতে মেয়েটা আরও বিরক্ত করে বলে, ‘এসব নয় তুমি চকোলেট দাও?’ চকোলেট তিনি কোথায় পাবেন? বোঝানোর পরও মেয়েটা বুঝতে চায় না। বায়না করেই যায়। ইচ্ছে করে গালে দুটো চড় লাগাই। বায়নাবাজ ছেলেমেয়েদের চড় লাগিয়ে ঠিক করতে হয়। চকোলেট খাবি তো বাবার কাছে যা, মায়ের কাছে যা। দাদু- দিদিমাও আছে। এ-বাড়িতে তো লোকের অভাব নেই। খুঁজে খুঁজে আমার কাছে কেন বাছা? না, এ-মেয়ের বায়না দ্রুত বন্ধ করা প্রয়োজন। কিন্তু কীভাবে?

শুয়ে শুয়ে সে কথাই ভাবছিলেন মাধবকান্ত। এমন সময় নীলকান্তবাবু এসে ঘরে ঢুকলেন। ছেলেকে দেখে মাধবকান্তের ভুরু কুঁচকে গেল। এই অসময়ে কেন? নীলকান্তবাবু দরজার গোড়ায় দাড়িয়ে বললেন, ‘বাবা, খুব ঝড় আসছে।’ মাধবকান্ত শান্ত গলায় বললেন, ‘আমি কী করব? ছাদে গিয়ে ঝড় আটকাব?’ নীলকান্তবাবু আমতা আমতা করে বললেন, ‘তা নয়, এমনি খবরটা দিলাম।’ মাধবকাস্তবাবু মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন, ‘আমার কোনও এমনি খবরের প্রয়োজন নেই।’ নীলকান্তবাবু বললেন, ‘না আসলে একটু দোকান বাজারে যাচ্ছিলাম। আজকাল একটু ঝড়-বৃষ্টিতেই তো দু’দিনের জন্য সব বন্ধ হয়ে যায়। তোমার জন্য যদি কিছু আনতে টানতে হয়।’

মাধবকান্তের মাথায় যেন বিদ্যুৎ চমকে উঠল। তিনি উঠে বলে বললেন, ‘হ্যাঁ, আনতে হবে। গোটা কয়েক লজেন্স চকোলেট নিয়ে এসো তে। বেশি দামের নয়। মোটামুটি দামের। দাড়াও, এগুলোর পয়সা আমি দেব।’

তোশকের তলা থেকে খুচরো পয়সা বের করে একটা একটা করে গুনছেন মাধবকান্ত। নীলকান্তবাবু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। ঝড়ের খবর শুনে বুড়ো মানুষটার মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? তাই হবে। নইলে এই বয়েসে লজেন্স খাবে। বলছে! চাপা শোঁ শোঁ আওয়াজ তুলে দশটা বাজার কিছু আগেই ঝড় শুরু হল এবং আলো চলে গেল। নিশ্চয় কোথাও তারের ওপর গাছটাছ পড়ল।

কাজের সময় দরকারি জিনিস পাওয়া যায় না। আজ পাওয়া গেছে। আশ্চর্যভাবে কেরোসিন-ভরা একটা হ্যারিকেন পাওয়া গেছে। মনোরমাদেবী সেটা জ্বালিয়ে এনেছেন। সেই হ্যারিকেন রাখা হয়েছে ড্রইংরুমে, সেন্টার টেবিলের ওপর। সবাই এখানেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। বিপদের সময় বাড়ির সকলে কাছাকাছি থাকে। এ বাড়িতে আজ সেই ‘কাছাকাছির’ সীমা ছাড়িয়ে গেছে। বাইরের কেউ কেউ বাড়ির সকলের মধ্যে মিশে গেছে। যেমন কিছুক্ষণ আগে বলাই তার দুই ভাইবোনকে নিয়ে চুলটুল আঁচড়ে চলে এসেছে। তাদের একজন অন্ধকারেই হাসছে এবং হামাগুড়ি দিয়ে সোফায় উঠে পড়ার চেষ্টা করছে। বীণার সাজেশন নিতে আসা কলেজের বন্ধু কল্লোল খুব ঝামেলায় পড়েছে। সে ঝড়ের মধ্যেই বেরিয়ে যেতে চেয়েছিল। মনোরম ধমক দিয়েছেন। সে সোফার এক কোণে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। তার খুবই লজ্জা করছে। এখনও সে বুঝতে পারছে না, এমন আহাম্মকের মতো কাজ সে কেন করল? কেন সে ঝড়ের মুখে বীণার কাছে এল? কোনওদিনই কি সে এখান থেকে বেরোতে পারবে? মনে হচ্ছে না পারাবে। এ ছাড়া একজন হাফ বাইরের লোক আছে। সে সুনির্মল। বাড়ির জামাই রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে আসা বউকে নিতে এসেছিল। ভেবেছিল বাইপাস দিয়ে গাড়ি ছুটিয়ে চট করে চলে যাবে। যেভাবে গাছটাছ পড়তে শুরু করেছে তাতে সে-পরিকল্পনা সম্পূর্ণ বাতিল হয়েছে। এতে তার অবশ্য কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। সোফায় হেলান সে এখন জাপানি টর্নেডোর উপকারিতা বিষয়ে ভাষণ দিতে ব্যস্ত। রীনা এই ভাষণে ভয়ংকর বিরক্ত হয়ে উঠে পড়েছে। সে ঠিক করেছে আজ খিচুড়ি রাঁধবে। সমস্যা একটা হচ্ছে। বৃষ্টির খিচুড়ির সঙ্গে বেগুন ভাজা চলে, ঝড়ের খিচুড়ির সঙ্গে?

মাধবকান্তবাবু ওপরে আসতে চাননি। মালা জোর করে নিয়ে এসেছে। একটাই বাঁচোয়া অন্ধকারে কারও মুখ দেখতে হচ্ছে না। একসময় তিনি কাঁপা কাঁপা হাতে ফতুয়ার পকেট থেকে একটা চকোলেট বের করে গায়ের সঙ্গে ঘেঁষে বসা মালাকে দিলেন। মালা কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, ‘ছি। বলাইৱা আছে না? শুধু আমাকে দিচ্ছ কেন? ওদের দাও।’ মাধবকান্ত ইচ্ছে করল বিচ্ছু মেয়েটার কান মলে দিই। তিনি গলা নামিয়ে বললেন, ‘আমি পারব না, তোর ইচ্ছে হলে দে। এই নে ধর। এগুলো।’

সন্তু পরম আগ্রহে জামাইবাবুর ভাষণ শুনছে। সন্ধেবেলা তার যে টেনশন শুরু হয়েছিল এখন আর নেই। কারণ সে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে পেরেছে। ঠিক করেছে এগারোটা বাজলেই নব্যেন্দুর ছোটমামাকে টেলিফোন করবে। কিন্তু লোকটাকে কিছুতেই ‘ছোটমামা’ বলে ডাকবে না। এতে তার চাকরি না হলে না হবে। কিন্তু লোকটা তাকে গালাগালি দিতে পারবে না। আজ এত লোকের সামনে। গালাগালি খাওয়া অপমানিত মুখ নিয়ে কিছুতেই ঘুরতে পারবে না সে। অন্যদিন হলে নাহয় একটা কথা ছিল।

বাইরের শোঁ শোঁ আওয়াজটা আর নেই। বৃষ্টি এসেছে মনে হচ্ছে। সুনির্মল বিজ্ঞ বিজ্ঞ গলায় বলল, ‘দেখলেন তো, ঝড় কমে গেল। আমার তো মনে হয়, ঝড়টা প্র্যাকটিকালি এদিকে এলই না। মায়ানমার বা বাংলাদেশের দিকে টার্ন নিয়েছে।’ মাধবকান্তবাবু গলা নামিয়ে বললেন, ‘হুঁ, উনি বেশি জেনে ফেলেছেন।’

হ্যারিকেনের আলোতেই বলাই তার দুই ভাইবোনকে নিয়ে মেঝেতে খেতে বসে গেল। তাদের ঘুম পেয়েছে। আর অপেক্ষা করতে পারবে না। গরম খিচুড়ি আর আলুর দম। একেবারে চেটেপুটে খাচ্ছে। নুন-বেশি আলুর দম যে এত সুস্বাদু হতে পারে তা ওদের খাওয়ার ভঙ্গি না দেখলে জানা যেত না।

বীণার ভীষণ ইচ্ছে করছে কল্লোল নামের হাঁদা ছেলেটাকে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে। দাঁড়ায়। বেশিক্ষণের জন্য নয়, এই একটুক্ষণের জন্য।

বাইরে ঝড় থেমে গেল। দমকা হাওয়া বইছে। সঙ্গে ঝিরঝিরে বৃষ্টি। আকাশ এখনও মেঘে ঢাকা। তবে এ-বাড়ির ভেতরের আকাশটা কিন্তু একদম অন্যরকম— তারাভরা ঝকঝকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *