ঝড়-বৃষ্টির নাগিনী নদী
এমন ঘনঘোর বর্ষায় নিকুঞ্জ সামন্ত অনেকক্ষণ ধরে ভাঙা চালাটার নীচে দাঁড়িয়ে আছে। মুহুর্মুহু বাজ পড়ছে কড়কড় শব্দে। তারই নিমেষ আলোয় নিকুঞ্জ দেখল, ধারেকাছে বসার মতো কিচ্ছু নেই। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তার পা টনটন করছে। মাথার উপর বিপদ থাকলে নিকুঞ্জর এরকম হয়। পা টনটন করে। বাঁ কাঁধে ব্যথা হয়। মাথার চুলের ভিতর বৃষ্টির মতো ঘাম জমতে থাকে।
নিকুঞ্জ দেখল, এটা একটা চায়ের দোকান। দুটো মোটা বেঁটে কাঠের গুঁড়ির মাথায় ব্রিজ-ঢালাই মিস্ত্রিদের ফেলে দেওয়া সিমেন্ট লেগে থাকা একটা কাঠের তক্তা পেরেক দিয়ে আটকানো। খদ্দের বলতে খেয়া-পারানিরা, ব্রিজ তৈরির লোকেরা ওটার উপর এসে বসে। চা খায়, বিস্কুট খায়। ইঞ্জিনিয়ারের চোখের বাইরে এখানে এসে বিশ্রামের অছিলায় ব্রিজ ঢালাইয়ের কাজে ফাঁকি দেয় লেবাররা। কিন্তু এখন সে-বেঞ্চিটাও ভিজে টইটই। নিকুঞ্জ বসলে তার ভেজা ধুতি আরও ভিজে যাবে। তাতে ক্ষতি নেই। এমন তোড়ে আসা বৃষ্টিতে কাপড়চোপড় শুকনো রাখা দায়।
তিরিশ-চল্লিশ হাত দূরে চায়ের দোকানের মতোই একটা তেলেভাজার দোকান দেখা গেল বাজ পড়ার তীক্ষ্ণ আলোয়। সেই দোকানিও কোন সন্ধ্যেবেলা দোকানের পাট চুকিয়ে বাড়ি চলে গেছে। এমন বৃষ্টিতে খদ্দের আসবে কোথা থেকে? সে-মিথ্যে আশা নিয়ে দোকানিরা আজ কেউ বসে নেই। একবার ধারেকাছে বাজ পড়ল। তার তীক্ষ্ণ আলোয় একটা মানুষের ছায়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল নিকুঞ্জ। পরের বাজ পড়ার আলোয়, মানুষটা হাওয়া। এমন চোখধাঁধানো আলোয় সব কিছু স্পষ্ট দেখা যায় না। তার উপর নিকুঞ্জর একটা চোখে ছানি কাটানো হয়েছে ক-মাস আগে। বাকি চোখটায় দৃষ্টি কোথায় যে দেখবে?
এখানে দাঁড়িয়ে নাগিনী নদীর ঢেউয়ের গর্জন শুনতে পাচ্ছে নিকুঞ্জ। ঢেউগুলো ফুঁসছে যেন কালনাগিনীর আক্রোশে। যতদূর চোখ যাচ্ছে, খেয়া দেখতে পাচ্ছে না। অন্ধকারের উপর অন্ধকার হয়ে বৃষ্টি পড়ছে। কী করে নিকুঞ্জ নদী পেরোবে, ভেবে কূল পাচ্ছে না। কিন্তু নদী তাকে পেরোতেই হবে যে করে হোক। মেয়ের অসুখের খবর পেয়ে আর স্থির থাকতে পারেনি নিকুঞ্জ। সন্ধ্যের দিকে খবরটা দিয়ে গেল মাধব দিন্দা। দিগন্তপুর গিয়েছিল মাধব ধানের গস্ত করতে। তার ধানের কারবার। কিন্তু এমন আকাট বৃষ্টি আসবে কে ভেবেছিল?
যাওয়ার সময় মাধব বলে গেল, ‘নিকুঞ্জদা, দিগন্তপুরের দিকে গিয়েছিলাম। শুনে এলাম, তোমার মেয়ে টুনির নাকি এখন-তখন অবস্থা। পথে তোমার জামাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ওষুধ কিনে ফিরছিল। তবে আজ নদীর যা গর্জন, মেয়ের বাড়ি যেতে পারবে কি না দ্যাখো! খেয়া পেলে হয়!’
তার নিষেধে কান দেয়নি। সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়েছিল নিকুঞ্জ। কাদায় লটরপটর করতে করতে এক ঘণ্টার পথ আসতে আড়াই ঘণ্টা লেগে গেল। তেমনি একটানা ঝড়। ছাতা ঠিক রাখা দায় হচ্ছিল। এসে লোকমুখে শুনেছে নিকুঞ্জ, ‘আজ আর খেয়া পাওয়া যাবে না! একটা খেয়া ওপারে আটকে আছে, বড়োজোর সেটা ফিরে আসবে হয়তো। কিন্তু ফের যাবে কি না সে মাঝির মর্জি।’
সেই কবে নাগিনী নদীর ব্রিজটা ভেঙেছে। ব্রিটিশ আমলে তৈরি হয়েছিল ব্রিজটা। অত গাড়িঘোড়া গেলে টিকবে কী করে? তাও তো ব্রিটিশরা তৈরি করেছিল বলে এতদিন চলল। ব্রিজটা ভেঙেছে আজ ছ-বছর। ছ-বছর ধরে কাজ চলছে। শেষ হওয়ার আর নাম নেই। এখনও কতদিন লাগবে, কেউ বলতে পারে না।
ব্রিজটা ভেঙে যাওয়ার পর নাগিনীর দু-পার থেকে এখন দু-দিকে বাস চলে। দু-দিক থেকে বাস-ভরতি যাত্রী এসে নাগিনীর পারে নামে। খেয়া পেরিয়ে তারপর অন্য পারে গিয়ে ফের বাস ধরে। খেয়াঘাটও তেমনি। যেমন গড়ানে, তেমনই হাঁটু ছোঁয়া কাদা। ব্রিজ তৈরি শেষ হয়ে যাবে বলে সরকার আর খেয়াঘাট তৈরি করেনি। জলে-কাদায় নামতে হয় ভাটার সময়। জোয়ার হলে তাও রক্ষে! মেশিন বসানো ভটভটি চালু হয়েছিল বছর তিনেক আগে। দু-বছর আগে এরকম এক বর্ষার রাতে পাকজলে পড়ে যাত্রীভরতি ভটভটি ডুবে গেল। কত মানুষ মারা গেল, খবরের কাগজে ছবি উঠল। সেই থেকে মানুষের দুর্ভোগের কমতি নেই।
নিকুঞ্জর কাছে ঘড়ি নেই। দেখতে দেখতে রাত সাড়ে আটটা হতে চলল বলে মনে হল। নৌকোরও যেমন দেখা নেই, তেমনি বৃষ্টি থামারও কোনো লক্ষণ নেই। অবিরাম বাজ পড়ে চলেছে। কিন্তু টুনির জন্যে মনটা বড়ো উতলা হয়ে উঠছে নিকুঞ্জর। মা-মরা মেয়ে। সেই কোন ছোটোবেলা থেকে মায়ের স্নেহ কী জিনিস, মেয়েটা জানে না।
ভেজা বেঞ্চিটার উপর পা তুলে উবু হয়ে বসল নিকুঞ্জ। এত জোরে বৃষ্টি হচ্ছে যে ব্রিজের পিলার ঢালাইয়ের লোহার রডে টাঙানো জেনারেটরের আলোটাও বড়ো বেশি টিমটিমে লাগছে এত দূর থেকে।
কী করবে? বাড়ি ফিরে যাওয়ার উপায় দেখছে না নিকুঞ্জ। কিন্তু টুনির যদি কিছু হয়ে যায়? এটা দিনমাস। এ মাসেই তো ডাক্তার ডেট দিয়েছে। নাতিপুতির মুখ দেখার আশায় আছে নিকুঞ্জ। কিন্তু এ কী খবর দিল মাধব? অবশ্য মাধবটা বেশ ফচকেও আছে। মজা করল না তো? অসুখের খবর নিয়ে কেউ মজা করতে পারে নাকি?
রাত ন-টা বেজে গেল মনে হয়। আর কি খেয়া আসবে? এলেও, মাঝি আর যাবে না। ঝড়-বাদলা মাথায় করে এপারে একটা বাস এসে থামল। নিকুঞ্জ চোখ চিরে দেখল, তা জনা পনেরো যাত্রী নামছে বাস থেকে। এদের মধ্যে কেউ কেউ যদি ওপারে যাওয়ার লোক থাকে, তা হলে একটা উপায় হয়তো হবে।
বাস থেকে যারা নেমেছিল, দেখতে দেখতে সবাই যে-যার এদিক-ওদিক চলে গেল। একটা লোকও খেয়াঘাটে এল না। মনে হয়, ওদের সকলেরই বাড়ি কাছেপিঠে। শেষ আশার প্রদীপ নিভে গেল নিকুঞ্জর।
প্রকৃতি যত বিরূপই হোক, বাড়ি ফিরে যাবে না নিকুঞ্জ। বাড়ি ফিরে থির থাকতে পারবে না। তার চেয়ে এই বেঞ্চিতে বসে রাতটা কাটিয়ে ভোরের প্রথম খেয়া ধরবে। টুনি না জানি কত কষ্ট পাচ্ছে!
এমন সময় মাঝ নদীতে মোচার খোলার মতো একটা কিছুকে দুলে উঠতে দেখল নিকুঞ্জ। অন্ধকার আর বৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে থাকা নাগিনীকে ভূতুড়ে নদীর মতো লাগছে। নদী থেকে চোখ ফিরিয়ে নিল। ফের বাজ পড়ল কড়াৎ শব্দে। মনে হল ব্রিজটার মাথায় পড়ল বাজটা। এখন বৃষ্টির তেজ একটু কমেছে। তাই আবছায়া ভাবটা কেটে গেল পলক ফেলতে না ফেলতে।
নাগিনীর দিকে তাকাল নিকুঞ্জ। একটু আগে দেখা মোচার খোলটা খেয়া নয়তো? নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না নিকুঞ্জ। হ্যাঁ, খেয়াই তো। নিরাপদ মাইতির খেয়া বলে মনে হচ্ছে। লোকে বলে নিরাপদর সাহস আছে। নদীও নিরাপদকে সমঝে চলে।
আগে নিরাপদ বামনগাছির খেয়াঘাট লিজে ধরত। সে-ঘাটে ওর আণ্ডারে সাত-সাতটা খেয়া চলত। কত হাঁকডাক ছিল নিরাপদর। পঞ্চায়েতের লোকও খাতির না করত তা নয়। বলত, ‘নিরাপদবাবু, একটা কথা ছিল। একবার যদি সময় করে পঞ্চায়েত অফিসে আসেন!’
তা সেই নিরাপদ খারাপ সঙ্গে পড়ে টাকা ওড়াতে লাগল দু-হাতে। মানুষকে মানুষ বলে গ্রাহ্যই করল না। দেখতে দেখতে খেয়াগুলো বিক্রি হয়ে গেল। বামনগাছির ঘাট এখন আর নিরাপদ লিজে ধরতে পারে না। টাকা কোথায়? এই খেয়াটা একজনের কাছ থেকে ভাড়ায় নিয়েছে। রোজগার হোক আর না হোক, দিনে দুশো টাকা মালিককে গুনে দিতে হয় নিরাপদকে। তারপর হাতে যা থাকে। নিরাপদকে টাকার লোভ দেখালে হয়তো ঝুঁকি নিয়ে শেষ খেয়াটা চালিয়ে দিতেও পারে। নিকুঞ্জর কাছে শ-পাঁচেক টাকা হবে হয়তো কুড়িয়ে-বাড়িয়ে।
খেয়াটা ঘাটে ভেড়ার আগেই নিকুঞ্জ তরতর করে এগিয়ে গেল নাগিনীর দিকে। বৃষ্টির তেজ একটু কমেছে বটে, কিন্তু খেয়া পর্যন্ত যেতে গিয়ে ভিজে জাউ হয়ে গেল নিকুঞ্জ। নিকুঞ্জ দেখল, খেয়ায় মাত্র দু-জন যাত্রী। ঝোড়ো বাতাস বইছে বলে নিরাপদ তাদের ছাতা খুলতে দেয়নি। ছাতা খুললেই খেয়া টুপুস করে ডুবে যাবে। খেয়ার যাত্রী দু-জন ভিজে একবারে চুপ্পুস।
খেয়াটা ধারে আসতেই হাঁক পাড়তে গিয়ে নিকুঞ্জ দেখল, এ তো নিরাপদ নয়! থমকে গিয়ে বলল, ‘ও মাঝিভাই, তোমার খেয়াটা তো চেনা লাগছে না? তুমি কি এই ঘাটের মাঝি নাকি? তা, শেষ খেয়াটা বেয়ে দাও না ভাই! আমাকে ওপারে যেতেই হবে গো!’
তখন খেয়া থেকে দু-জন যাত্রী নামছিল শাড়ির আঁচলে মাথা-মুখ সব ঢেকে। তার মধ্যে একজন বলল, ‘ও বাবা, তুমি এখন কোথায় যাচ্ছ?’
গলার স্বর শুনে নিকুঞ্জ ঠিকই চিনে ফেলেছে, ‘কে টুনি নাকি? মা, আমি তো তোমার বাড়ি যাচ্ছি গো! তোমার নাকি খুব অসুখ? মাধব বাড়ি বয়ে বলে গেল যে?’
‘বাবা, আমি ঠিক একথাই ভাবছিলাম! তোমার জামাই বাড়ি গিয়ে বলল, তার সঙ্গে নাকি মাধবকাকার দেখা হয়েছিল আমাদের দিগন্তিপুরে। কথায় কথায় ও মাধবকাকাকে বলেছে, ওষুধ কিনতে দোকানে গিয়েছিল। ব্যাস, আমি জানি, মাধবকাকা বানিয়ে একটা কিছু জুড়ে দেবে। দেখেছ, তোমার মতো বুড়ো মানুষটাকে কেমন হয়রান করে ছাড়ল? দাঁড়াও, দিগন্তিপুরের দিকে আসুক একবার। আচ্ছা করে বকে দেব!’
নিকুঞ্জ মেয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই একটা বিচ্ছিরি পচা গন্ধ নাকে এসে লাগল নিকুঞ্জর। একটু পিছিয়ে এসে হাত তুলে মেয়েকে বলল, ‘সে না হয় বকিসখ’ন! তবে তোকে বলি মা, ওরকম একটা কথা আমার মাথায়ও যে আসেনি তা নয়। মাধব যা ফিচেল টাইপের ছেলে, কী না কী বানিয়ে বলছে। কিন্তু তোর অসুখের খবর শুনলে কি আর বাড়িতে চুপ করে বসে থাকতে পারি মা?’
‘তুমি বাড়ি ফিরে যাও বাবা! আর রাত কোরো না! ভাবছি, তুমি একা অতখানি রাস্তা যাবে কী করে?’
নিকুঞ্জ পিছন ফিরে মাঝিকে আর খেয়া লাগবে না, কথাটা বলতে গিয়ে হোঁচট খেল। খেয়া আর মাঝি কেউ কোত্থাও নেই! নিকুঞ্জর গা ছমছম করে উঠল। মেয়ের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘কেন, তুমি আমার সঙ্গে যাবে তো? তুমি তো আমার কাছেই যাচ্ছিলে? এখন বাপ-বেটিতে টুকটুক করে চলে যাব মা!’
টুনি খিনখিন করে হেসে উঠল, ‘না গো বাবা! আমাকে এখন যেতে হবে নিশিগঞ্জে, তোমার একদম উলটো দিকে।’
নিকুঞ্জর চোখ কপালে উঠল, ‘নিশিগঞ্জ? সে কি এখানে নাকি। ভালো মতন পা চালিয়ে গেলে নিশি ভোর হয়ে যাবে? এই বাদলায় তোর আর নিশিগঞ্জ গিয়ে কাজ নেই! চল, চল। দু-জনে বাড়ি যাই। আয় মা, আমার সঙ্গে।’
‘না গো বাবা, তোমার জামাই এমন একটা কাজ চাপিয়ে দিল, কী বলব?’ টুনি বাবার কাছে সরে এসে কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘ওই যে আমার ছোটো ননদের বিয়ে হয়েছে না নিশিগঞ্জে? তার মেয়েকে নাকি দুপুর থেকে ভূতে ধরেছে! তেঁতুল গাছে উঠেছিল তেঁতুল পাড়তে। নেমে এসে আর কথা বলতে পারছে না। তার কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। ওঝা ডেকেছিল, বিহিত করতে পারেনি। তোমার জামাই আমাদের গ্রামের বিধুগুনিনের কাছ থেকে একটা তামার মাদুলি এনে দিয়ে বলল, ননদের বাড়ি পৌঁছে দিতে।’
নিকুঞ্জ চোখ ঘুরিয়ে ব্যঙ্গের ঢঙে বলল, ‘সে আর নিজে আসতে পারল না, তোকে পাঠিয়ে দিল এই ঝড়বাদলার মধ্যে? কী আক্কেল রে? পুরুষ মানুষ ঘরে থাকল, আর মেয়েকে ঘরের বাইরে পাঠাল। বেশ তো!’
‘না গো, তোমার জামাইয়ের দোষ ধোরো না বাবা! আমাদের গ্রামে একটা চোর ধরা পড়েছে। এখন তার বিচার চলছে। ও সেসব ছেড়ে আসবে কী করে? তখন আমিই বললাম, ‘দাও, আমি দিয়ে আসছি!’ তোমার জামাই অবশ্য কিছুটা এগিয়ে দিয়ে গেছে।’
‘তা হলে চল, আমি তোকে কিছুটা এগিয়ে দিয়ে আসি? তেমন হলে তোর ননদের বাড়িতে রাতটা থেকেও যেতে পারি? সেই যে কনেযাত্রী গিয়েছিলাম বউভাতের রাতে। আর তো যাইনি!’
টুনি খিনখিন করে আপত্তি জানাল, ‘না গো বাবা! ওই যে পিসি দাঁড়িয়ে আছে, ওদেরও বাড়ি নিশিগঞ্জে। ওকে দাঁড় করিয়ে রেখেছি। আমরা একসঙ্গে চলে যাব। তুমি বরং বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম নাও। পারলে আমি কাল একবার তোমার কাছ হয়ে তবে দিগন্তিপুর ফিরব।’
তবু নিকুঞ্জ পইপই করল, ‘দেখিস, সাবধানে যাস। আমার ছাতাটা না হয় কাছে রাখ। বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর হতে পারে?’
‘ছাতা তুমি রাখো বাবা। তুমি বুড়ো মানুষ ভিজে ভিজে যাবে, তোমার জ্বর হবে না, জ্বর হবে আমার? আচ্ছা মানুষ তো তুমি। আর কতদিন মেয়েকে আগলে আগলে রাখবে বাবা?’
নিকুঞ্জর মুখে লজ্জার ছায়া তিরতির কেঁপে উঠল। বলল, ‘টুনিমা, তুমি তা হলে সাবধানে যাও! কাল সকালে আমার কাছ হয়ে তারপর না হয় দিগন্তিপুর যেও, কেমন?’
টুনি সেই পিসির সঙ্গে নিশিগঞ্জের দিকে চলে যেতেই সেই বিচ্ছিরি পচা গন্ধটাও উধাও হয়ে গেল। বাড়ির পথের দিকে ফিরেই নিকুঞ্জ দেখল, টুনিকে আর দেখা যাচ্ছে না।
বাড়ি ফিরতে নিকুঞ্জর রাত সাড়ে দশটা পেরিয়ে গেল। ওবেলার ভাতে জল ঢেলে গিয়েছিল নিকুঞ্জ, যদি ফিরতে না পারে, ভাতগুলো যাতে নষ্ট না হয়। একার সংসার! কাঁচা লঙ্কা আর পেঁয়াজ দিয়ে ভাতক-টা খেয়ে শুয়ে পড়ল নিকুঞ্জ।
তখনও ভোর হয়নি ভালো করে। কাক দু-একবার ডেকে থেমে গেল। দরজায় ঠকঠক শব্দ শুনে ঘুমচোখে দরজা খুলে নিকুঞ্জ অবাক! জামাই কাকভেজা হয়ে এসেছে কেন? নিকুঞ্জ বলল, ‘তুমি সেই এলে যদি, তা হলে কাল রাতে অমন বিপদের মধ্যে টুনিকে পাঠালে কেন? টুনিকে এখন কোথায় রেখে এলে বাবা?’
জামাই কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘টুনিকে শ্মশানে রেখে আপনাকে খবর দিতে এসেছি। কাল রাত ন-টার সময় ডাক্তার দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে গেল।’
পাষাণ হয়ে যাওয়া নিকুঞ্জ ডুকরে কেঁদে উঠে বলল, ‘কাল রাতে অত দুর্যোগের মধ্যে নাগিনী নদীর তীরে তোকে ছুটে আসতে হল মা? পাছে বিপদ হয়, তাই বুড়ো বাবাকে ঝড়-বৃষ্টির নাগিনী পেরোতে দিলি না?’