2 of 2

ঝড়ে কাক মরে – স্বপ্নময় চক্রবর্তী

ঝড়ে কাক মরে – স্বপ্নময় চক্রবর্তী

ফটোকপিয়ার মেশিনের এই প্লেটটা কিন্তু খুব ইমপর্ট্যান্ট। এই যে কালো প্লেটটা দেখছেন, এর মধ্যে আছে সেলেনিয়াম কম্পাউন্ডের একটা ফিল্‌ম। সেলেনিয়ামের একটা অদ্ভুত প্রপারটি আছে, এর মধ্যে লাইট পড়লে সেলেনিয়াম অ্যাটম থেকে ইলেকট্রন বেরিয়ে আসে, ফলে সেলেনিয়াম চার্জড হয়ে যায়। এটাকে বলে ফটো ইলেকট্রিক এফেক্ট। বুঝতে পারছেন?

কিছুই বুঝতে পারছি না, তবু আলতো ঘাড় নাড়ি। পাশের ছেলেটিকে সসম্ভ্রমে ফিসফিস করি। ‘আপনি তো বেশ বুঝছেন দাদা, আপনি তো বি-এস-সি। বুঝিয়ে দেবেন কিন্তু।’ ছেলেটি পরে বলেছিল, ধুত মশাই, ফটো ফিজিকস চ্যাপ্টারটা পড়েছি নাকি, আমাদের বেলা ওটা সাজেশনে ছিল না, আগের বারে এসে গিয়েছিল। তাছাড়া ওসব থিয়োরি-ফিয়োরি বুঝে কি করবেন, প্র্যাকটিসটাই আসল।

খুব প্র্যাকটিস করলাম। দু মিনিটেই একটা করে প্রিন্ট বার করে দিচ্ছি। ট্রেনার বলল, ভেরি গুড। আপনার হবে।

কালি লাগানো বিডসগুলো প্লেটের গায়ে লেগে কী সুন্দর সির-সির শব্দ করে। হাতে কালো কালি লাগে, লাগুক! জামায় কালির গুঁড়ো পড়ে, পড়ুক। এই জামা নিয়ে আমি চন্দনার কাছে যাব। দ্যাখো, জেরক্স মেসিন। হাত মুছতে হয় বলে রুমালে ফিকসার নামক কেমিক্যালটির মৃদু গন্ধ। আঃ! ওই কেমিকালটা কী যেন? অ্যাসিটাল ডিহাইড, নাকি কার্বন টেট্রাক্লোরাইড? যা খুশি হোক। যখন বিজনেস শুরু করব, ক্যানিং স্ট্রিটে ফিকসার বললেই মাল পেয়ে যাব।

ট্রেনিং চলছে। যে কোম্পানির মেশিনটা কেনা হচ্ছে সেই কোম্পানির পাঁচ দিনের ট্রেনিং। ব্যাঙ্ক লোন ম্যানেজ হয়েছে। জেরক্স-এর বিজনেস করব। ট্রেনিং-এর লাস্ট দিনে মা পকেটে ব্যোমকালীতলার ফুল গুঁজে দিল। দুগগা-দুগগা। দিন দশ-বারোর মধ্যেই ডেলিভারি হয়ে যাবে মেশিনটা।

বাড়িওয়ালার টাকাটা পুরো ক্লিয়ার না হলে চাবি পাওয়া যাবে না, তারপরেও অনেক কাজ। ওয়ারিং করানো, সাইনবোর্ড, রঙ, তাছাড়া একটা হ্যান্ডবিল ছড়াতে হবে। সুসংবাদ! সুসংবাদ! আর শহরে ছুটিতে হইবে না। হেলাবটতলার মোড়ে নতুন জেরক্স মেশিন। গ্র্যাজুয়েট বেকার ছেলেকে মদত করুন। না। আমি এটা লিখব না। আমার বড় বানান ভুল হয়। আমি লক্ষ্মণের কাছে যাই।

লক্ষ্মণ আমার সঙ্গে স্কুলে পড়ত। বাংলায় অনার্স। এখন লক্ষ্মণ স্যার। এবলা ওব্‌লা চল্লিশটা ছাত্র পড়ে। লক্ষ্মণ রচনা লেখাচ্ছে। ‘বিজ্ঞানের জয়যাত্রা’। ‘মানুষের আগুন আবিষ্কার বাস্তবিক পক্ষে এক যুগান্তকারী ঘটনা। ইহা মানুষের জীবনযাত্রায় এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন সাধন করিল’—আরে, এ যে সুধীরবাবু স্যারের দেয়া সেই নোট। আমি ঝাড়া মুখস্থ করেছিলাম। আমাদের বেলা ভেরি ভেরি ইমপর্ট্যান্ট ছিল। সেবার কোশ্চেন আউট হবার গুজবে পরীক্ষার ঠিক আগে আগে অন্য ইস্কুলের ছেলেরা রাত জেগে আমার খাতা থেকে টুকে নিয়ে গেছিল কিন্তু পরীক্ষায় এসেছিল ‘বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ’। আমি ঝাড় খেয়ে গেলাম, কিন্তু লক্ষ্মণ তো ভাল ছেলে, সে ঠিক ঘুরিয়ে নাক দেখিয়ে দিল।

লক্ষ্মণকে একটু বাইরে ডাকি। ওকে জানাই অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে দোকান ওপেন হচ্ছে, সেদিন ওকে থাকতেই হবে। হ্যান্ডবিলটাও লিখে দিতে বলি, আর পাঁচশোটা টাকা চাই। ধার। টাকা দিতে পারবে না লক্ষ্মণ। ওর টিভির পিকচার টিউবটা কেটে গেছে। তাছাড়া দু-তিন মাসের মধ্যেই ওর জমিটা রেজিষ্ট্রি করে ফেলতে হবে।

তা হলে বরং আশুর কাছে যাই…

এইভাবে লক্ষ্মণ, আশু, কানাই, ট্যারাবাচ্ছু, অ্যাটম, চপলাপিসি, ছোটমামা, এঁদের কাছে ঘুরঘুর করে কিছু টাকা পয়সা যোগাড় করি। মায়ের গয়নায় হাত দিতে আমি চাইনি, কিন্তু উপায় ছিল না। পুঁটুলিটা নেবার সময় মায়ের মুখের দিকে তাকাতে পারিনি। পুঁটুলি মুঠো করে মাথা নিচু করে বসাক জুয়েলার্সে যাবার সময় মা বললেন, দুগ্‌গা-দুগ্‌গা। আমি আট হাজার পাই। বাঁ হাতের চেটোয় চোখ মুছে পরান ঘোষকে বাকি টাকা দিয়ে আসি। উনি চাবি দেন। সে দিন সন্ধ্যায় চন্দনার সঙ্গে সিনেমায় গেলাম।

থালায় বড্ড বেশি ঠকাস শব্দ হল, বউদি যখন ভাত দিল রাত্তিরে। মা বোধহয় বুঝলেন। বউদি যেন না শোনে ততটা আস্তে এবং অস্ফুটে বললেন, গয়না তো তোমাকেও দিয়েছি বউমা…

অথচ সবাই বলেছিল আমাকে, বসে না থেকে ব্যবসা-ট্যাবসার চেষ্টা করতে। বউদিও তো বলেছিল, চাকরি আজকার খুব ব্রিলিয়ান্ট ছেলেরাও পাচ্ছে না। চায়ের দোকান করলেও অনেক ইনকাম। কোনও কাজই তো খারাপ নয়। আমার দাদারও হেভি টাইপের স্পিড। ডায়মন্ড জুটমিলের টাইপিস্ট। বাবা বেঁচে থাকতেই ঢুকিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। দাদা চুপি চুপি দু হাজার দিয়ে বলেছিল, কাউকে বলিস না। ‘কাউকে’ কথাটার ঠিক ঠিক মানেটা আমি জানি। বউদিকে কিচ্ছু বলিনি। মা জানেন। দাদার জুটমিল প্রায়ই বন্ধ থাকে। হেলাবটতলার মোড়ে তাপস স্টুডিয়োর বারান্দায় টাইপ মেশিন নিয়ে বসে। বেকার ছেলেরা পাসপোর্ট ছবি তুলিয়ে অ্যাপ্লিকেশন টাইপ করায়। কিছু হয়ে যায় দাদার। কত রকম সমস্যা আছে মানুষের, কত রকমের দরখাস্ত।

জেরক্স বসাব শুনেই দাদা ‘জেরক্‌স’ শব্দটা এমনভাবে উচ্চারণ করেছিল যে, ওটা অনেকটা আর্তনাদের মতো লেগেছিল। জে-রক্‌স, অ্যাঁ? আমি বলেছিলাম, সবাই বলছে এ অঞ্চলে জেরক্স নেই, ভাল চলবে। অবনীর দাদা ব্যাঙ্কের ম্যানেজার, উনিও বললেন, লোনের ব্যবস্থা করে দেবেন। দাদা একটুক্ষণ চুপ ছিল, তারপর বলেছিল, আমার টাইপটা গেল। আমি বলেছিলাম, তা হলে? দাদা বলেছিল—তাহলে আর কী, কর, সায়েনস্ এগুচ্ছে, কিছুই থেমে থাকে না। আমার পাটকলও বন্ধ হয়ে আসছে, নাইলন, পলিথিন, পলিথিনকে কি থামানো যাবে? কর, জেরক্সই কর।

দেড় কাঠার ছোট প্লটে টালির চালের বাড়িটা মায়ের নামে ছিল। ওটার এগেনস্টে ব্যাঙ্ক লোন। মা গ্যারেন্টার। জেরক্স মেশিন আসছে।

বিজনেস শুরু, দোকান ওপেন, দেয়ালে মাকালী, তাকে গণেশ। একটা রবীন্দ্রনাথের ছবিও রাখলাম। দাদার মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। মাকে প্রণাম করি, মা আমার কড়ে আঙুল কামড়ালেন। একটা ঝাঁটার কাঠি মেশিনে লাগিয়ে রাখতে বললেন, তাহলে নজর লাগবে না। ব্যোমকালীতলায় পুজো দেয়া জবার মালা দিলেন, মেশিনে পরালাম। দুগ্‌গা-দুগ্‌গা। চন্দনা একবার এল। বেশ সেজেছে। ও অ্যাতো সেজেছে কেন?

মাকে লেখা মায়ের গুরুদেবের একখানা চিঠি—পরম স্নেহাস্পদা কুলবালা বিমলাসুন্দরী দেব্যাঃ, দীর্ঘজীবেষু…চার কপি আমার প্রথম জেরক্স প্রিন্ট। মা টাকা দিলেন। মা আমার চোখে চেয়ে হাসলেন। বাড়িওলা পরান ঘোষকে মা মিষ্টি খাওয়ালেন। ব্যাঙ্ক থেকেও এসেছিলেন একজন। ট্যারাবাচ্চু এই খুশির দিনে একটা পাঁইটের দাম চাইতে এল। গুরুদেবের চিঠির দশ মিনিট পরে আসে একটা পঞ্চায়েতের রসিদ, তারপর একটা ডাক্তারি প্রেসক্রিপশন, তারপর একটা দলিলের কপি, তারপর একটা প্রেমপত্র। স্টার্টিং—আমার প্রাণের শুকতারা। লাস্টে ছিল এবার ৮০, ইতি শেফালী। লোকটির মুখে দাড়ি, হাতে সিগারেট। চিন্তান্বিত। বলে, ‘দশ কপি। সার্কুলেট করে দেব শালা।’ দুগ্‌গা-দুগ্‌গা।

কে জানত, এই মফঃস্বলে এতসব সমস্যা আছে, জেরক্স মেশিনের এত দরকার ছিল। নে-রে বাচ্চু, তোর পাঁইটের দাম। দোকানটা দেখিস।

মাসের শেষে মায়ের হাতে তিনশো দিলাম। মা দুহাত বাড়িয়ে টাকাটা এমনভাবে নিলেন যেন নির্মাল্য। একটা দশ টাকার নোট গুরুদেবের ছবিতে ছুঁইয়ে কোথায় যেন রাখলেন। বাবার ছবিকে প্রণাম করতে বললেন, এত খুশি হয়েছিলেন যে, মা লুচি করেছিলেন রাত্রে, আর শোবার আগে কী যেন ভাবতে ভাবতে একটা বালিশের গায়ে হাত বুলোচ্ছিলেন, সেই স্পর্শ আমার চামড়ায় স্পষ্ট টের পাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি চোখ মুছে ফেললেন মা, বললেন, হ্যাঁ রে, ধারের কিস্তিগুলো শুধেছিস তো? বলি, ব্যাঙ্ক আর বাড়িওয়ালাকে দিয়েছি। অন্যদের দু মাস পর থেকে দেব। মা বললেন, তোর পিসি আর মামারটা ঠিক ঠিক দিয়ে দিস যেন।

একটা শাড়িও কিনেছিলাম চন্দনার জন্য। ওটা দোকানেই রাখা ছিল। চন্দনা এলেই কাগজের প্যাকেটের তলা থেকে শাড়ির প্যাকেটটা টেনে বের করে বললাম—এটা মাইরি তোমার।

চন্দনা প্যাকেটটা নিয়েই বলল, ‘উরিব্বাবা।’

তারপর আমার চোখের দিকে তাকিয়ে হাসল, প্যাকেটটার গন্ধ শুঁকল, গালে বোলাল। কালচে হয়ে যাওয়া শুকনো ব্রণর সঙ্গে ব্রাউন পেপার ঘসার মৃদু খরখর।

চন্দনা বলল, তোমার বউদির জন্য কিনেছ? আমি বলি, না তো, ও একটুক্ষণ পরে বলে, তাহলে এটা বউদিকেই দাও। আমি বলি, সে কী, এটা তো তোমার জন্য কেনা, বউদিকে না হয় পরে…চন্দনা বলল, তুমি কিচ্ছু বোঝ না। শাড়িটা বাড়ি নিয়ে গিয়ে কী বলব? কে দিয়েছে বলব? তুমি তো জানো ওরা তোমাকে…

সে তো আমি বেকার ছেলে ছিলাম বলে। এখন তো আর বেকার না…

তবু। মা বকবে। ইন্টারকাস্ট। এই জন্যই তো রেজিস্ট্রিটার কথা বলি।

দাঁড়াও, আর ছ’টা মাস সময় দাও আমাকে, আমি মটরসাইকেলে চড়ে তোমার বাড়ি যাব। ডাইরেক্ট বলব—ভালবাসি। কাস্ট-ফাস্ট সব ফুটে যাবে টাকার কাছে। দাঁড়াও, রেজিস্ট্রিটা শিগগির করে নিচ্ছি।

বড় ব্যস্ত হয়ে পড়েছি এই তিন চার মাসে। কত নতুন নতুন বাড়ি উঠছে। যে জনার্দনের মাঠে নাকি জনার্দনঠাকুরের ভূত ঘুরে বেড়াত, সেই মাঠ ঘর-বাড়িতে ভরে গেল। আমার দোকানটার ঠিক উল্টো দিকে অঘোর হালদারের লম্বা ফালি জমি। হালদার মশাইয়ের ছেলে পার্টির থেকে টাকা অ্যাডভান্স নিয়ে কয়েকটা দোকানঘর তুলছে। আমি কত রকম বায়নানামা, দলিলপত্রের জেরক্স করছি।

দেখতে দেখতে অঘোরবাবুর ফালি জমিটা দোকানঘর হয়ে বিলি বন্দোবস্ত হয়ে গেল। একটা দোকানের নাম স্ন্যাকস, কেক, পেস্ট্রি, রোল এই সব পাওয়া যায়। একটা দোকানের নাম একুশ শতক, টিভি, টেপ রেকর্ডার, ভি. সি. আর ইত্যাদি ইলেকট্রনিকস যন্ত্রাদি বিক্রয় ও মেরামত করা হয়। প্রিয়দর্শিনী নামে ব্লাউজের দোকান হল একটা, শুধু ব্লাউজ নয়, শোকেসে সব লাল-নীল ইয়ে টান টান করে রাখা, খুব লজ্জা করে দেখতে। স্টাডি সেন্‌টার নামে বইখাতা পেন্সিল, সুগন্ধী রবার, কমিকস আর রং তুলির দোকান, তার পাশেই স্পিড কপি সেন্টার। সুলভে অটোমেটিক পদ্ধতিতে মিনিটে ২০টি জেরক্স করা হয়।

অটোমেটিক ক্যানন মেশিনটি বসিয়েছেন মুকুল শিকদার। সবাই মাকলুদা ডাকে। জমির দালালিতে দু পয়সা হয়েছে, বেশ কিছু লোককে টুপি পরিয়েছেন উনি। ব্যাঙ্ক-ফ্যাঙ্কের তোয়াক্কা করেন না। বলে গেলেন, জমির লাইন বড় নোংরা লাইন। ট্যাক্‌নিকাল লাইনে শুরু করলাম। আইসো মাঝে মধ্যে।

কাঁচের ঘরের মধ্যে মেশিনটা। ছোটখাটো বডি। খালি সুইচ টেপে। ফ্রেম ধরে নাড়ানাড়ির ব্যাপার নেই, ফিকসিং চেম্বার নেই, বিডস নেই, কালির গুঁড়ো নেই, তিন সেকেন্ডে একটা করে কপি।

দামটা কীরকম পড়ল দাদা?

দামের কথায় কাম কী? বহুত দাম।

নিজেই অপারেট করবেন, নাকি লোক-টোক রাখবেন?

দেখা যাক সেল কেমুন হয়। তেমন হইলে একটা লোক-টোক রাখব অনে। জানাশুনা বিশ্বাসী আছে নিকি? সত্য কথা কইতে কী, এইসব টেপাটিপির কাম আমার পুষায় না।

দারুণ মেশিনটা কিন্তু আপনার।

সময় পাইলে আইসো মাঝে মাঝে।

কে জানত। এত বেশি সময় পেতে থাকব ক্রমশ। আমার সেল কমছে। খুব সময় পেতে থাকি। প্রায়ই চুপচাপ বাইরে তাকিয়ে থাকি। হেলাবটতলার মোড়ের রিকশাওলাদের আমার আত্মীয় মনে হয়। ওরাও আমার মতো চুপচাপ বসে আছে। ধাই করে চলে যাচ্ছে প্যাসেঞ্জার বোঝাই অটো-রিকশা। আমার সামনে স্পিড জেরকস। আমার ভাতে টান দিয়েছে বদমাশটা।

কে বদমাশ? স্পিড? না জেরক্স, নাকি লক্ষ টাকার মূলধন যা দিয়ে স্পিড কেনা যায়, জানি না। আমি সামনের দোকানটার দিকে তাকাতে পারি না। ভয় হয়। মুকুল শিকদারের স্পিড জেরক্সে এখন সব সময় কাজ। একদিন দেখতে পাই মুকুল শিকদারের স্পিড জেরক্সের গায়ে বড় বড় করে লেখা: প্রতি কপি ৬০ পয়সা মাত্র। এতদিন ৭০ পয়সা ছিল। আমার রেটও কমাতে হয়। আমিও লিখে দি ৬০ পয়সা। তার মাত্র দুদিন পরে, সবে এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে, আকাশে ঝিলিক মেরেছে রোদ্দুর, মাকলুদা ভাঁড়ে রঙ নিয়ে ৬০-এর ওপর ক্রস চিহ্ন দিল। লাল কালিতে লিখল: মাত্র ৫০ পয়সা। মাকলুদার পাতলা টেরিকট হাওয়াই শার্টের ভিতর দেখা যাচ্ছে জালি জালি গেঞ্জি। আমি দুহাতে আমার মাথার চুল চেপে ধরি। মুকুল শিকদারের কাছে ছুটে যাই। টেরিকট জামা, জালি জালি গেঞ্জি, ঘামাচি ময় চামড়া ভেদ করে আমার নখর হাত ওর হৃৎপিণ্ড চেপে ধরে। বলে দালালির কাঁচা পয়সায় অটোমেটিক মেশিন বসিয়ে খুব পাঁয়তারা হচ্ছে? কিন্তু আসলে বলি, মুকুলদা, এরকম করছেন কেন, দাদা, আমাকেও বাঁচতে দিন।

কেন? কী হয়েছে? মুকুলদা সিগারেট বাড়িয়ে দিলেন।

পঞ্চাশ পয়সায় আমার পড়তা হয় না মুকুলদা, আমার সেল কম। প্লেটের দাম বাড়ছে, কালি, কেমিকাল, দিনকে দিন বাড়ছে, আমার পোষাচ্ছে না।

কিন্তু আমার তো পোষায় ভাই…।

আপনার তো পোষাবেই, আপনি মিনিটে কুড়িটা করতে পারেন। আপনার অনেক সেল। এমনিতেই আমার কাজ নেই, রেট বেশি থাকলে কেউ আসবে না, অথচ আমার চারদিকে ধার মুকুলদা, অনেক ধার করে মেশিনটা বসিয়েছি। আমার গলার স্বর এমন বিকৃত হয়ে যায় যে অচেনা লাগে।

মুকুলদা আমার গালে দু আঙুলের টোকা মারলে একফোঁটা জল ছিত্তিছান হয়। বলে—শালা, ইয়ং ছেলে, কাঁদিস? ঘাবড়াস না, আমি তরে মাঝে মাঝে কাজ পাঠামু। আমি সামলাইতে পারছি না। দাঁড়া, চা আনাই। মুকুলদা লোক রেখেছে। সে খুব ব্যস্ত। ‘নিজে বাঁচে পরকে রাখে, ধর্ম বলে জানবি তাকে’ ১০ কপি করে ও চা আনতে যায়। আমি খাব না চা।

চন্দনা বলল, কী গো বিজনেসম্যান, কী খবর? আমার রাগ ধরে। চন্দনা বলল, আমায় দেখতে আসবে। আমি নিশ্চুপ। বলো না, আমি কি করব। চন্দনা আমার জামার হাতা খামচে ধরে।

‘যা খুশি করো’ বলে আমি অন্য দিকে মুখ ফেরাই। চন্দনা কিছুক্ষণ নির্বাক দাঁড়িয়ে থেকে চলে যায়।

লক্ষ্মণ আসে। লক্ষ্মণ স্যার। সঙ্গে গুচ্ছের ছাত্র। কাল বাংলা পরীক্ষা। গুজব রটেছে রচনা আউট হয়ে গেছে। লক্ষ্মণ বলল, শিগগির চল্লিশ কপি। রচনার হেডিং ‘মানব কল্যাণে বিজ্ঞান’। ছিল ‘বিজ্ঞানের জয়যাত্রা’। ওটা কেটে এটা করা হয়েছে। ভূমিকার ওপর কাগজের তাপ্পি। জয়যাত্রার জায়গায় মানবকল্যাণ, তাই ভূমিকায় একটু চেঞ্জ। মাঝখানে একটু এবং উপসংহারেও তাপ্পি মারা আছে। আমার ছাপতে একটু দেরি হচ্ছে দেখে লক্ষ্মণ ‘ধূস্‌, এসব আর চলে না’ বলে স্পিড জেরক্সে চলে গেল— আমার জন্য চক্ষুলজ্জায় মাত্র দশ কপি রেখে।।

পরদিন স্পিড জেরক্স আরও দশ পয়সা কমাল। মুকুলদার কাছে ছুটে যাই আমি। আমি কিছু বলার আগেই উনি বলেন, তোমার জন্য রেট কমাই নাই আমি। ইউ আর নট মাই কমপিটিটার। বাসস্ট্যান্ডে আরেকটা অটোমেটিক হইছে। ওরা এই রেটই রাখছে। কমপিটিশন মার্কেট, বুঝলা না?

অ্যাটম তাগাদা দিয়েছে তিনবার। ট্যারাবাচ্চু বলল দেখে নেবে। চপলা পিসি এসেছিল আমরা কেমন আছি দেখতে। বলে গেছে আত্মীয়স্বজনকে বিশ্বাস করা খুব মুশকিল। ব্যাঙ্কে গত মাসেও দিইনি, এ মাসেও পারব না। সারা দিনে ছ টাকার কাজ হয়েছে আজ। রাত্তিরে চাবি বন্ধ করি। এ চাবি যেন আর খুলতে না হয়। যেন মরে যাই, আজ রাত্তিরেই যেন মরে যাই। বাড়ি গিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ি। বিকৃত গলায় বলি, মা, মেশিন বেচে দেব। আমি তোমার সব নষ্ট করেছি মা, গয়না টাকা…

চন্দনারও চোখের তলায় যেন হঠাৎ কালি। বলে, মেশিনটা বেচে দিয়ে তারপর কী করবে তুমি? আমি বিড়বিড় করে বলি, মুকুলদার দোকানে কাজ নেব। ও বলল, এমন ভেঙো না। কানের কাছে মুখ আনে চন্দনা। বলে, তুমিও অটোমেটিক মেশিন কেনো। এটা বেচে দিয়ে…আমার তো হার আছে, বালা আছে…

ওতে কিছু হবে না চন্দনা, অটোমেটিক মেশিন অনেক দামি। দামের সঙ্গে পারবে যুদ্ধ করে? ক’দিন পর আরও ভাল আর আরও দামি কিছু বেরিয়ে যাবে। জানো, ঝড় বইছে, টেকনোলজির ঝড়।

এখন বড় আস্তে হাঁটি আমি। আমার সারা গায়ে হাল্কা বাতাসে ওড়া এঁটো শালপাতার দুঃখ। বাড়ি গিয়ে দেখি মায়ের গুরুদেবের ছবিটা ভাঙা। মায়ের বিছানায় ভাঙা কাচের টুকরো পড়ে আছে। মা তবে ভেঙেছেন ছবিটা, অবিশ্বাসে, রাগে, অভিমানে। মা এলেন ঘরে। মায়ের কপালে দেখি রক্ত। উঃ, রক্ত। এবার বুঝে যাই। ছবিতে মাথা ঠুকেছিলেন মা, ভীষণ। কি হবে মা?

অ্যাটম, টেরুয়া, চপলাপিসি, চিন্তা কোরো না। সবাইকে শোধ করে দেব। বাড়িওলা অঘোরবাবু হে, ছেড়ে দেব। তোমার ঘর ছেড়ে দেব আমি। কাগজে বিজ্ঞাপন দিলাম নতুন অবস্থায় একটি জেরকস মেশিন বিক্রয়। কয়েকজন দেখে গেল। বাড়িওলা বলল, সেই ভাল। অল্প কেপিটালে এইসব হয় না। এখন কী করবেন, চায়ের দোকান-টোকান? নাকি দোকানটা ছাড়বেন। দোকানটা ছাড়লে আপনার সঙ্গে কথা আছে। ভাল পার্টি আছে একটা। ফ্যান্সি সেলুন করতে চায়। মেয়েছেলের চুলও নাকি কাটাই করবে। আপনি সেলামি বাবদ আমাকে যা দিয়েছেন, তার চেয়ে দু এক হাজার বেশি ফেরত পাবেন।

ছেলেটার নাম ভুজঙ্গ সরদার। বারো ক্লাস অবধি পড়েছিল। থাকে এখান থেকে ষোল কিলোমিটার ভিতরে। নারায়ণপুরে। নারায়ণপুরে সবে ইলেকট্রিক এসেছে। জেরক্স বসাচ্ছে ভুজঙ্গ। দশ কাঠা জমি বিক্রি করেছে। গরুর গাড়ি নিয়ে এসেছে। গরুর গাড়িতে উঠবে জেরক্স মেশিন। ভুজঙ্গর কপালে সিঁদুরের টিপ। ভুজঙ্গ ভীষণ মমতায় মেশিনের গায়ে হাত বুলোচ্ছিল।

গাড়িতে উঠছে মেশিনটা। সাবধান ভাই! খুব সাবধান। মেশিনটা খুব ভাল ভুজঙ্গবাবু, কক্ষনও ট্রাবল দেয়নি। চার্জারের সুইচটা একটু জোরে টিপবেন, কেমন। পিছনে সামান্য রঙ চটে গেছে, যেন জল না পড়ে, অ্যাঁ? সব সময় ধুলো মুছে দেবেন, একটু নরম কাপড়ে। প্লেটটাই আসল, যত্নে রাখবেন, অ্যাঁ, যত্নে। নখ লাগাবেন না, মেশিনটা বড় ভাল ছিল জানেন, ওর কোনও দোষ নেই..ক্যাঁচোর ক্যাঁচোর শব্দ করে ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রটা নিয়ে গরুর গাড়ি ছাড়ল। দুগ্‌গা-দুগ্‌গা।

বিসর্জনের পর শূন্য বেদিতে বসানো একাকী প্রদীপের মতো ওই ঘরে বসে থাকি নিশ্চুপ। শূন্য প্লাগ পয়েন্ট। তার। টুকরো কাগজ। কালির দাগ।

মুকুলদা এল। বলল, একবার আইসো আমার কাছে। একটা দরকারি কথা আছে।

২৮ মে ১৯৮৯

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *