ঝড়ের পাতা
রত্না যখন ওর নামটা লেখে, র, তয়ে দন্ত্যন আকার দিয়েই লেখে, কিন্তু বলে ফেলে অতনা। ঠিক মতো অতনাও বলে না, বরং অদনা। যেমন রক্তকে বলে অক্ত, রস কে বলে অস, ডোমকলের বাজারে একটা নতুন রামমন্দির হয়েছে, ওরা বলে আমমন্দির। আবার ‘আমজান মাসে রোজা হয়।’ ওই প্রথম-র নিয়েই গোলমাল। নইলে শাহরুক খাঁন-কে শাহরুকই বলে, সৌরভকে সৌরভ, করিম কে করিম। কিন্তু আশ্চর্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ঠিক মতোই রবীন্দ্রনাথ বলতে পারে। ইস্কুলে তো রবীন্দ্রজয়ন্তীতে কবিতা আবৃত্তির সময় বলেছে—কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা বলছি। অথ যাত্রা লোকারণ্য মহা ধূমধাম…
রত্না ক্লাস এইট অবধি পড়েছে। নাইনে উঠেও ছিল। এ প্লাস বি হোলস্কোয়ার এখনও মুখস্থ। পৃথিবীর ম্যাপে ইরান-ইরাক আরব-মক্কা কোথায় আছে জানে। ধন্য আশা কুহকিনী কবিতার আটটি ছত্র এখনও বলে দিতে পারবে। কিন্তু ক্লাস নাইনে ডোমকল ইস্কুলে আর ভরতি করায়নি রত্নার মা। ওখানে নাইন থেকে ছেলেমেয়ে একসঙ্গে পড়ে। ওখানে মেয়েরা বেশি পড়ে না, ছেলেরা বেশিরভাগই মুসলমান। রত্নার মায়ের সাহস হয়নি।
আমরা রত্না রত্না বলছি বটে, কিন্তু আসলে তো ও আদু। মানে অদনা থেকেই আদু। ও যখন ইস্কুলে পড়ত, মেয়েরা ক্ষেপাত অদনা—পাইখানার বদনা।
আদুদের গ্রামের নাম দাউদপুর। মুর্শিদাবাদ জেলার ডোমকল থেকে আট কিলোমিটার দূরে ওদের গ্রাম। যেরকম গ্রামের কথা বইতে লেখা থাকে ওদের গ্রাম ওরকমই। ওদের গ্রামে বড় বটগাছ আছে, বটগাছের তলায় পিটাই পিরের মাজার আছে, বটগাছের লাল লাল ফল মাজারের উপর পড়ে। ইস্টিকুটুম পাখি আছে, খেজুরের রস খেতে আসে, বসন্তকালে কোকিল আছে, . গাইবাছুরের হাম্বা আছে, ভোরের আজান আছে, কারবালার মাঠ আছে, ধানের উপর ঢেউ খেলে যায় বাতাস কাহার দেশে আছে। আগে মনে হত এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না কো তুমি। এখন টিভি দেখে মনে হয় পৃথিবীতে আরও কত কী আছে। কত সুন্দর সুন্দর বাড়ি, রাস্তা, গাড়ি, বেহেস্তের বাগান, কত সুন্দর মেয়ে, বেপর্দা, তবু যেন হুরি।
দাউদপুর গ্রামে পাঁচঘর মোটে হিন্দু, বাকি সব মুসলমান। রত্নার বাবা লোহার কাজ করে। কামার। তিন ঘর কামার। দুই ঘর তাঁতি। তাঁতিরা কেউ তাঁতের কাজ করে না আর। আর কামার বলতে শুধু রত্নার বাবাই। অন্য দুই ঘর রত্নাদেরই জ্ঞাতি। একঘর সাইকেল সারাইয়ের দোকান দিয়েছে ডোমকল বাজারে, অন্য ঘরের দুই ভাই বাসের কনডাক্টার। ওদের মায়ের শ্রাবণ মাসে মনসার ভর হয়।
হিন্দু-মোসলমানে ঝগড়াঝাঁটি নেই। গুজরাটে যখন গণ্ডগোল হল, তখনও কিছু হয়নি। ইরাক থেকে ওর স্বামী ক্যাসেট পাঠিয়েছিল। তাতে বলা ছিল, দাউদপুরে তুমাদের ঘরে যদি খোদা না করে কিছু হয়, তবে উরা সবাই মিলা যেন আমাদের ঘরে এসে থাকে।
হ্যাঁ, রত্নার স্বামী মোসলমান। প্যার মহাব্বতের বিয়ে। এ নিয়ে ঝামেলা একটু হয়েছিল বইকী। রত্না মোসলমান হয়েছিল। নাম হয়েছিল রাবেয়া। রাবেয়া হলে কী হবে, ও তো আদুই। শ্বশুরবাড়ির সবাই ওকে আদু বলেই ডাকে। আদু বেস্পতিবারে সন্ধ্যার সময় জায়নামাজ পেতে মনে মনে লক্ষ্মী লক্ষ্মী করে। ওর শ্বশুরবাড়ির সবাই এটা জানে, কিন্তু কিছু বলে না। আদুকে কলমা শিখিয়েছে ওরা, কিন্তু ওর ওসব মুখস্থ হয় না। বড় বিদঘুটে লাগে। ও নমাজ পড়ে না। ও নিয়ে কিছু ঝামেলা হয় না। রোজাও রাখে না। ওর স্বামী বলে দিয়েছে ওসব নিয়ে ওকে জোর জবরদস্তি করোনি। তবে কিছু নিয়ম মানে বইকী। জল বলে না, পানি বলে। স্নান-কে গোসল, টিফিন-কে নাস্তা বলে। ওর শাশুড়ি বলে দিয়েছে কম সে কম দিনে তিনবার আছলাম আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লা করতে তো পারিস। আদু তাই করে, জোরে জোরে, সবাইকে শুনিয়ে। বলার আগে একটু অজুও করে নেয় পাক পানি তে। ও জমজমা দিঘির পানি গায়ে ছিটোয়। জমজমা দিঘিটা বেশ বড় দিঘি। পদ্ম ফোটে। কে কবে হজ করতে গিয়ে কাবা থেকে একঘড়া জমজমা কুয়োর পানি নিয়ে এসে ওই পুকুরে ঢেলে দিয়েছিল, সেই থেকে ওই দিঘির জল পবিত্র পানি হয়ে গেছে। আদুর শ্বশুরমশাই জুম্মাবারে ওই পুকুরে গিয়ে অজু করে, পলিথিনের জারিকেনে ওই পানি নিয়ে আসে ঘরে। আদু সন্ধেবেলায় ওই পানি দুয়োরে ছিটোয় আর মনে মনে বলে গঙ্গা-গঙ্গা। বাপের বাড়িতে যেমন করত।
আদুর শ্বশুর চাষি। নিজের ছ’বিঘা জমি। এখনও মাঠে যায়। বছর পঞ্চাশ বয়েস হবে। সঙ্গে নেয় স্টিলের টিফিন কৌটো আর ট্রানজিস্টার। ছোট্ট মতন, কানে ছিপি দিয়ে শোনা যায়। আদুর শ্বশুর রাজশাহি শোনে, ঢাকা শোনে। বাড়িতে ফিরে লুঙ্গি পরে হাতে ঘড়িটা লাগায়। এত ফুটুনি ছেলের জন্য। ছেলের নাম ছালু। আদুর হ্যাসবান। ইরাক গেছে। ইরাক থেকে টাকা পাঠায়। সে টাকায় ফুটুনি। ছালুর ভাল নাম ছোলেমান। ছোটবেলা থেকেই আদুর খুব পেয়ারের সই ছিল রোশেনারা। ওদের বাড়িতে যেত খুব। রোশেনারার ফুফুর ছেলে ছেলেমান। থাকে আমোদিয়া গ্রামে। তিন কিলোমিটার। রোশেনারাদের বাড়িতে ওর খুব আসা-যাওয়া। ঝাঁকরা চুল, চোখে গগলস, সিগারেটের ধোঁয়া নিয়ে কেরদানি করে, গলায় চেন আর সিনেমার গান, মাধ্যমিক পাশ, বলে ইস্কুটার কিনবে।
আদুর শ্বশুরবাড়িতে একটা বই আছে। ‘কাছাছাল আম্বিয়া বা নবীদের কিচ্ছা।’ উলটো করে পড়তে হয়। বই-এর একটা পৃষ্ঠা বের করে আদুর বর বলেছিল—দ্যাখো, আমার কথা লেখা আছে। আদু পড়েছিল—‘ছোলেমান নবীর কথা।’ ‘ছোলেমান পশুপক্ষীর ভাষা বুঝিতেন ও পশুপক্ষীর সহিত কথা কহিতেন। দেও দানব তাঁহার বশে ছিল। আল্লাহ তাঁহাকে নিয়ামত করিতেন। মাটি তাঁর ভিতরের গুপ্তধনের কথা ছোলেমানকে বলিয়া দিত। তিনি সকালে ও বিকালে বায়ুর উপর সিংহাসন রাখিয়া ভ্রমণ করিতেন…।
আদু বলেছিল, তাই বলে তুমিও নবী নাকি! আমাদের মধ্যে নিমাই নামের কত আছে, তাই বলে কি সবাই নদের নিমাই? সবাই নবী? আদুর বর বলেছিল, কিন্তু আমার নামও ছোলেমান। আমিও পাখির ভাষা বুঝি। তখন কোকিল ডেকেছিল। ছোলেমান বলেছিল, বলো দেখি ডাল্লিং কোকিল কী কচ্ছে? বলেই, ছালুই তার উত্তর দিয়েছিল—ভাষায় নয়, ভঙ্গিতে।
ছালু মিঞার আর কোনও খবর পালে নাকি? প্রায়ই কেউ না কেউ জিজ্ঞাসা করে আদুদের বাড়িতে। আদু এখন ওর বাপের বাড়িতে। আদুর বাবাকে কেউ কেউ আবার জিজ্ঞাসা করে সাদ্দাম কি বেঁচে আছে? কী মনে হয়? আদু এখন এরোপ্লেনের শব্দ পেয়েছে। ঘর ছেড়ে বাইরে এসে আকাশে তাকায়। ওর পায়ে ঝমঝম মল বাজে। ইরাকি ঝুমুর। ওখানে বসরা নামে কী একটা শহর আছে, ওখানে তৈরি হয়। ছালু এনে দিয়েছিল। উপোর ঝুমুর। মানে রুপোর।
এখানকার আকাশে এরোপ্লেনের তেমন একটা দেখা মেলে না। এরোপ্লেনের শব্দ শুনলেই আদু আকাশ দেখে। আদুর তিন বছরের ছেলে মায়ের ম্যাক্সি ধরে জিজ্ঞাসা করে, উটায় চেপে ইবার আব্বা আসবে গো মা?
আদু ওর ছেলের মাথায় একটু হাত বোলায় শুধু। রা কাড়ে না। এরোপ্লেনের গমগম শব্দ দূর মেঘের ভিতরে মিশে যায়। ছোলেমান, ও নবী ছোলেমান, তুমি না বাতাসের উপর সিংহাসনে চড়ে ঘুরতে পারো?
কেয়ামতের সময় ইস্রাফিল নাকি শিঙা ফুকবেন। সেই শিঙার শব্দ কীরকম কে জানে? এরোপ্লেনের শব্দের মতো এরকম?
আদুর বাপঘরে টিভি নেই। ওর শ্বশুরবাড়িতে টিভি ছিল। ছালুই কিনেছিল, দু’বছর আগে যখন এসেছিল দেশে। টিভিতে অনেক কিছু দেখেছে আদু। জঙ্গলের বাঘ, হোটেলের হুরি, বম্বের বেহেস্ত, মন্ত্রী, পুলিশ, কত কী! এরোপ্লেনও দেখেছে, যে এরোপ্লেনের ভিতরে বোমা থাকে, ঘরবাড়ি ভাঙে, আগুন জ্বালায়, জ্বলতে থাকা শহর দেখেছে। কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া দেখেছে। কান্না শোনেনি, মানুষের চিৎকার শোনেনি, তখন টিভিতে মুজিক দেয়। কালো ধোঁয়া উঠছে টিরিং টুরুং। বাড়ি ভেঙে গেল, টুরুং টিরিং। ওই টিরিং টুরুং এর মধ্যে ওর স্বামী ছিল। ইরাকে। আর এখানে কাঁদছিল ওরা।
ছালু কাজ করে ‘কিরকুক’-এর কাছে। খেজুরগাছের ছবিওয়ালা কাগজে ছালুর চিঠি আসত। ছালুর কাজ খেজুর কারখানায়। খেজুরের ভিতর থেকে বিচি বের করে, গুল পানিতে ভিজিয়ে, একটু রোদ খাইয়ে প্যাকেটে ভরা হয়। ছালুর কাজ ছিল ধারালো ছুরি দিয়ে খেজুরের গায়ে সূক্ষ্ম আঁচড় বসিয়ে বিচিটা সন্না দিয়ে টেনে বের করে নেয়া। আমি অপারেশন করিরে আদু। যন্ত্রপাতি দিয়ে সারাদিন বিচি অপারেশন। সারাদিন ঠান্ডা ঘরে বসে খেজুর আর খেজুর। খেজুরের সাইজ কী। এত কাফি খেজুর, কিন্তু মাছি নাই।’
অনেক প্যাকেট খেজুর এনেছিল ছালু। গ্রামের অনেককে বিলি করা হয়েছিল। যেই আসে খেজুর নিয়ে আসে। অনেকেই ওই প্যাকেট রোজার মাসের জন্য রেখে দেয়। ইফতারের এম্পেশাল আইটেম। অনেকেই আত্মীয়পরিজনদের দু-এক মুঠো খেজুর পাঠায়। তখন আর এটা কিরকুক-এর খেজুর থাকে না, হয়ে যায় আমোদিয়ার খেজুর। খেজুরকে ইরাকে ওরা বলে কাফ। এইসব খেজুর কারখানাগুলির নাম কাফিস্তা। এই আমোদিয়া গ্রামে তিনজন কাফিস্তানি আছে, যারা খেজুর কারখানায় কাজ করে। সবার আগে যায় জব্বার। ও বাকিদের নিয়ে গেছে, বদলে টাকা নিয়েছে। ছালু যখন যায় তখন আদুর পেটে রফিক এসেছে। রফিক পয়দা হবার ন’মাসের মাথায় ছালু এসেছিল। সঙ্গে এনেছিল ছেলের জন্য রেশমি জামা, মেওয়া, খুরমা, সুরমা, রুপোর মল, খেজুরের প্যাকেট, আর টেপ রেকর্ডার।
খেজুরই কত রকমের হয়। খেজুরকে বেটে মণ্ড করা, খেজুরের বরফি, একটা কী সুন্দর খাবার এনেছিল, ওটার নাম নাকি কেলাইচা। ময়দার মধ্যে মশলাদার খেজুরের পুর, তারপর ঘিয়ে ভাজা। সেবার শীতকাল ছিল, এদিককার খেজুরগাছে মাটির হাঁড়ি, বাঁশের ডালে ইষ্টিকুটুম পাখি। পাখি ডাকে। ছালু বলেছিল, পাখি কী বলছে বল দিনি? খাট ভাঙবি? খাট ভাঙবি? তখন ছিল পিঠে-পায়েসের দিন। পাটিসাপটার মধ্যে আমোদিয়ার নারকোলকোরার সঙ্গে কিরকুকের খেজুরের পুর মিশিয়ে দিয়েছিল। তারপর সেই রাতে এক কাণ্ড। সেরকম কাণ্ড তো সোয়ামি-স্তিরিতে হতেই পারে, তার উপর আবার বিদেশ ফেরত। কিন্তু পরের দিন সকালে বালিশের পাশ থেকে টেপ রেকর্ডারটা বের করে ছালু সুইচ টিপে দিয়ে বলেছিল—দ্যাখো আদু, তুমি কী করেছিলে! ইশ, কী লজ্জা! আদুর নিশ্বাসের শব্দ, কত রকমের আওয়াজ, কত বাজে কথা, কী বেহায়াপনা। আদু বলেছিল, আস্তে, আস্তে, ভলুম কমিয়ে দিয়েছিল ছালু। কপট রাগে ছালুর দিকে তাকিয়ে স্পিকারে কান রেখে নিজের শীৎকার শব্দ শুনছিল আদু। বলছিল কী পাজি, অ্যাঁ, কী দুষ্টু বুদ্ধি! টেপে কেউ এসব তোলে? ছিঃ।
ছালু বলেছিল, এটা আমি নিয়ে যাব। এই ক্যাসেটটাই তো তুমি হবে আমার। ওজ রাতে বাজিয়ে শুনব।
এরপর যে ক’টা দিন ছিল, আদু বালিশের তলা হাতড়ে দেখে নিয়েছে যন্ত্রটা রাখা আছে কি না। একদিন তোশকের তলায় পেয়ে গিয়েছিল। আদু সরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু যেদিন ছালু চলে যাবে, তার আগের রাতে আদুই বলেছিল যন্ত্রটা নিয়ে শোও। কিন্তু আদু সে রাতে কান্না ছাড়া আর কোনও শব্দ দিতে পারেনি।
ছালু বলেছিল, আসব, আবার আসব। এরোপ্লেনের পয়সা জমিয়েই চলে আসব। রফিকের জন্য কত কী নিয়ে আসব। তুমি কিন্তু আমার সঙ্গেই চললে। ইচ্ছে হলেই বাজাব। ক্যাসেটের গায়ে টোকা দিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়েছিল ছালু।
এরোপ্লেন ঘন মেঘে মিশে গেলে আদু ঘরে যায়। আদুর ম্যাক্সি টেনে রফিক বলে—আব্বা বুঝি উটার ভিতরেও নেই?
আব্বাকে রফিকের মনে নেই। ওর ন’মাস বয়েসের সময় ওর আব্বা আবার আসব বলে এখনও আসেনি। ওর আব্বার গল্প শুনেছে। ছবি দেখেছে। ওর আব্বার কথা বলে কাঁদতে শুনেছে। ও দেখেছে টিভির সামনে বসে আছে ওর মা, বু, খালা, খালু, উড়াজাহাজ দেখছে, আর ছালু ছালু বলে কাঁদছে ওর বু। ওর বাবার কথাও শুনেছে রফিক। ক্যাসেটে। আমার সোনা ছেলে রফু, আমি তোমার আব্বা। আদর নাও। আমি তোমার কথা ভাবি। তোমার কী চাই বলো। লিয়ে আসপো।
এভাবেই আব্বাকে জানে রফিক। কারণ ছালু তো ওখান থেকে ক্যাসেট পাঠাত, পার্সেলে। তাও বেশি নয়, গত দু’বছরে দু-তিন বার-ই পাঠিয়েছিল। টেপ রেকর্ডারে বাজিয়ে শুনেছে। ওর ভাইকে বলা কথা, ওর আব্বা-আম্মার জন্য কথা, আর আদুর জন্যও। আদুর জন্য যে কথাগুলি বলা তা যেন মছলা-মাছায়েল থেকে পড়া। ছেলের যত্ন আব্বা-আম্মার সেবা, এইসব। ছালু তো জানে, এই ক্যাসেট সবাই শুনবে। বউ-এর জন্য তাই কোনও চুপি চুপি কথা নেই। আদু তো পার্সেল করতে পারে না। আদুর কাছে ফাকা ক্যাসেটও নেই। ফাঁকা ক্যাসেট থাকলে গোপনে ছালুর কাছে কথা বলে রাখত, নাই বা পাঠানো হল, বাজিয়ে শুনত নিজেই। আদু চিঠি লিখত, ইংরিজিতে ঠিকানা লিখত ধরে ধরে—
সোলেমান হোসেন মণ্ডল। C/o ইব্রাহিম কাফিস্তা, পোস্ট জিরিয়াম। কিরকুক। ইরাক।
এখন আর চিঠি লেখে না। সোলেমানের ঠিকানা নেই আট মাস হয়ে গেল।
তখন বসন্ত কাল। খুব কোকিল ডাকছে। তখনই ইরাকের উপর বোমা পড়ল। কতদিন ধরেই কানাঘুষো চলছিল, ইরাকের উপর বোমা ফেলবে আমেরিকা। লাদেনকে পেল না, সাদ্দামকে চাই। সাদ্দাম যদি ধরা দেয় তবে আর বোম পড়বে না। আদুর শ্বশুরবাড়িতে তখন কাকা-খালারা বলাবলি করে—সাদ্দাম মিয়াঁর অত গোঁ কেন? একজনের জন্য এত লোক মারা যাবে?
বাগদাদে যখন বোমা পড়ল, আমোদিয়া গ্রামের শিমুলগাছে তখন লাল লাল ফুল। আমোদিয়া গ্রামের মসজিদের ইমামের কাছে জব্বর, খয়রুল আর সোলেমানের বাড়ির লোকজন গিয়ে বলে, কী উপায় হবে এবার? আল্লার এ কেমন বিচার? ইমাম বলে, আল্লায় ইমান রাখো। আল্লা মেহেরবান। এবাদত করো।
বসরা, বাগদাদের পর কিরকুক। জব্বর, খয়রুল আর সোলেমানদের ঘরে টিভি আছে। ওরা সব কাফিস্তায় কাজ করে। এ ছাড়া আরও তিন-চার ঘরে টিভি আছে। ওদের বাড়িতে ভিড়। সন্ধ্যার খবরের সময় অনেক লোকজন চলে আসে। টিভির পর্দায় ভেঙে পড়া ঘর বাড়ির দিকে চেয়ে থাকে। । ব্যস্ত অ্যাম্বুলেন্স, স্ট্রেচারে শোয়ানো মানুষগুলির দিকে ওদের খর দৃষ্টি। ইট-পাথরে চাপা পড়া একটা মানুষের হাত বেরিয়ে আছে। কে যেন বলে উটা খয়রুলের হাত না তো? কাফন ঢাকা দেহ থেকে একটা পা বেরিয়ে আছে। কার পা গো? যে মানুষটি ধোঁয়ার ভেতর থেকে বেরিয়ে মুখে হাত চাপা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল, তাকে দেখে কে যেন বলল, আমাদের ছালুর মতন না? ধ্বংসস্তুপের সামনে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে এক বৃদ্ধা। একটু আগেই যেখানে ওর নিজের সংসার ছিল।
বাড়ির দাওয়ায় একইরকম মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকে সোলেমানের মা। পাড়াপ্রতিবেশীরা বলে, আল্লাকে ডাক ছালুর মা। বাঁচালেও সে মারলেও সে।
ছালুর মা আল্লা ডেকেছে। ডোমকল বাজারে রামমন্দিরে গিয়ে পয়সা ছুড়েছে, বটতলার শিবপাথরে হাত জোড় করে গোপনে বলেছে যুদ্ধ থামাও হে৷ বটবৃক্ষের কাছে বলেছে, প্রান্তরের হাহাকারকেও বলেছে। যুদ্ধ থামে না।
আর আদু? আদু কেবলই দুর্গা জপেছে। হে দুগ্গা, দুর্গতি নাশিনী! ওকে তুমি আমার কাছে এনে দাও। সিঁথিতে একটু করে সিঁদুর দিতে থাকে আদু। সতীর পুণ্যে পতির পুণ্য। একদিন পিটাই পিরের দরগায় গিয়ে কবরের উপর আচ্ছা করে পিটিয়ে আসে। পিটাই পিরের অন্য কী একটা নাম ছিল। এখন সবাই ভুলে গেছে। একটা গল্প আছে ওকে নিয়ে। ওই পির নিজে একবার একটা খারাপ কাজ করেছিল। জেনা করা যাকে বলে আর কী। মেয়েছেলে ঘটিত। পরে যখন নিজের বিবেক জাগ্রত হল, তখন নিজেই তাঁর শিষ্য-মুরিদদের বললেন—আমাকে একশো ঘা বেত মারো। আমি গুনাহ্ করেছি। আল কোরান অনুযায়ী এর শাস্তি একশো বেত। কেউ ওকে মারতে রাজি হয় না প্রথমে, তারপর তিনি হুকুম করলেন। হুকুম হলে তামিল করতেই হয়। কিন্তু ওই পির একশো বেত পর্যন্ত বাঁচলেন না। কয়েক ঘা বেত পড়তেই তাঁর ইন্তেকাল হল। কিন্তু ইন্তেকালের আগে হুকুম দিয়ে গেলেন আমার মুর্দার উপরও যেন বেতের ঘা পড়তেই থাকে। তাই হল। তাঁর কবর হল। কবরের উপরও মানুষ বেত মারে। এখনও। পিরের হুকুম। ওই হুকুম তামিল করলে নেকি হয়। পুণ্য হয়। সতীর পুণ্যে পতির পুণ্য। আদু পিরের কবরে বাড়ি মারতে মারতে বলে হে পিটাই পির, শুয়াই থাকবা? তোমার তো বিবেক জাগল। উদের বিবেক কে জাগাবে?
তারপর যুদ্ধ থামে। বাগদাদে আমেরিকার সৈন্য মার্চ করে। রামসফিল্ড বক্তৃতা দেয়, বলে সব মিটে গেছে। আমোদিয়া গ্রামের তিন ঘরে রাতের ঘুম নেই। খেজুর কারখানার ওই তিনটি ছেলের কথা কেউ জানে না। কত চিঠি লেখা হয়, লাল বাক্সে ফেলাই শুধু। ইমাম সাহেব বলে, কী করে জানা যাবে? সাদ্দাম জিন্দা আছে কি না তাই কেউ জানে না তো লেবার…..!
ওই তিন বাড়ি যাতায়াত হয়। কেউ কারুর খবর জানে কি না। ওই তিন বউ-এ কথা হয়, কখনও মুখে কথা হয় না, এ ওর চোখের দিকে চেয়ে থাকে, চোখে কথা হয়। রাত্তিরে দেখা স্বপ্নের কথা বলে। দেখনু, একটা মোটরসাইকেল দাঁড়াইল, খুব হরেন মারছে, দেখি, আমার লোক, মাথায় ব্যান্ডিজ।
বর্ষা নামে। চাষের মাঠে লোক নামে। মাছের ঝারি আর আটলে কত মাছ। ল্যাটা, কই, পুঁটি, মৌরালা, ভ্যাদা…। আদু ভাবে ও কি মাছ খাবে? ও সধবা তো?
কাগজে পড়ে ইরাক স্বাভাবিক। ইস্কুলে যাওয়া ছেলেমেয়েদের ছবি ছাপে। আদু আবার চিঠি লিখতে থাকে কিরকুকের সেই ঠিকানায়। আর উত্তরের আশায় বসে থাকে। একদিন বুদ্ধি করে বুশ সাহেবকে চিঠি লেখে। খামের উপর ইংরেজিতেই লেখে জর্জ বুশ। প্রেসিডেন্ট, আমেরিকা। ভিতরে বাংলায় লেখে মহাশয়, আপনি সবই পারেন। আমার স্বামীর সন্ধান দেন। আমার স্বামী কাজ করিত কিরকুকের…বুশ সাহেব ঠিকই বাংলা পড়িয়ে নেবে। উনি সব পারেন। ডোমকলের পোস্ট অফিসে ডাক টিকিট লাগিয়ে পোস্ট করল। পোস্টাপিসের লোকটা বলল—এখনও বুঝি কুন খবর পালে না বুন?
এইসব কথাগুলিই তো বর্ষা। ভিজিয়ে দেয়।
বর্ষা থামল। এসেছে শরৎ হিমের পরশ। মেঘগুলি সব আকাশে বাতাসে ফেরে ভেসে ভেসে। ঘরের দাওয়ায় রোর। তোমার দেখা নাইরে তোমার দেখা নাই।
এমন সময় এক ফরিস্তা এল। ডাক পিওন। খামের উপর অচেনা ডাকটিকিট। পিওন বলল ইরাকের চিঠি। আদু দেখল সত্যিই ইংরেজিতে ইরাক লেখা আছে। সাদ্দামের ছবি নেই, অন্য ছবি। গোলাপ ফুল। ইষ্টিকুটুম পাখিরা ডেকে উঠল, ধান খেত দুলে উঠল। খামটা ছিঁড়ল। ও মা! এটা কার হাতের লেখা। এটা তো ছালুর হাতের লেখা নয়। চিঠির শেষে দেখে—ইতি তোমার ছালু। আবার শুরুর দিকটা দেখল আদু। পাক জনাবেষু আম্মাজান। হাজার হাজার আদাব। মাগো, বাঁচিয়া আছি। আমাদের কারখানা আর নাই। বোমায় নষ্ট হইয়াছে। আমি সে সময় কারখানায় ছিলাম। উপরের ছাদ পড়িয়াছিল। ডান হাতটি এখন নাই। হাসপাতালে কাটিয়া দিয়াছে। খয়রুলের ইন্তেকাল হইয়াছে। আমি বাম হাতে কোনও মতে লিখিলাম। জব্বারের খোঁজ করিতেছি। সে কোথায় জানি না। আমি দেশে ফিরিবার চেষ্টায় আছি। আমেরিকা হাতটি লৈয়াছে বটে, তবে খানাপানি দিতেছে। দোয়া করিও। ঠিকানা দিয়েছে ইরবিল রেডক্রশ ক্যাম্প। ইরাক। আর একটা চিঠি আছে, মাই ডিয়ার আদু, মায়ের চিঠিতে সবই শুনিলে। গ্রান্টের জামার ডান হাত ঝুলছে। সব গেছে। দেশে ফিরবার চেষ্টায় আছি। তোমাদের কাছে গেলে বাঁচি। কিন্তু কী খাব? একহাতে কী কাজ করব? তার চেয়ে বোধহয় খয়রুলের মতো মরাই ভাল ছিল। চিন্তা করে কী করবে। তুমি বরং বাপের বাড়ি থাক। আমি আসছি ইনসাল্লা।
সেই থেকেই আদু আকাশে এরোপ্লেন দেখে। বেড়া খোলার শব্দ হলে দৌড়ে যায়। হাওয়া যখন গাছকে নাড়ায়, ওর মনে হয় সে আসছে, সে আসছে। বর্ষা গেল; এসেছে শরৎ হিমের পরশ। মেঘগুলো সব আকাশে বাতাসে ফেরে ভেসে ভেসে। আদু চলে এসেছে ওর বাপের বাড়ি। অপেক্ষায় আছে। সকালে মুখে হলুদ বাটা মাখে। পায়ে আবার মল পরে নিয়েছে। মলের ঝমঝমে বাজে এসো গো, এসো গো।
শোনা গেল, জব্বারের ঘরেও চিঠি এসেছে। জব্বারও লিখেছে আসছি।
আদু চিঠি লিখেছিল। ইরবিল রেডক্রস ক্যাম্প। উত্তর আসেনি। সোলেমানেরও চিঠি আসেনি আর। আদুর মাঝেমধ্যে মনে হয় ওই চিঠিটা সত্যি সত্যি ছালুর তো?
আদুর বাপের বাড়িতে টিভি নেই। কিছু খবর জানে না আদু। ইরাক দেশ টিভিতেই দেখেছে। স্বামীর কাছে গল্প শুনে যে ইরাকের ছবি মনে মনে আঁকা হয়েছিল, টিভির ইরাক তো সেরকম নয়। ফুরাত নদী আর দিজলা নদীর কথা শুনেছিল। ইস্কুলের বইতে যে নদীর নাম ইউফ্রেটিস আর টাইগ্রিস। বসরাই গোলাপের কথা শুনেছিল, খুরমাগাছ, আখরোট গাছের কথা শুনেছিল, আর কত রকমের কাবাবের গল্প। কিন্তু টিভিতে কী ইরাক দেখেছিল ওরা? আগুন, ধোঁয়া আর ভাঙা বাড়ি। মুখ থুবড়ে পড়া পুল, দেখেছিল দাউদাউ করে জ্বলছে একটা গোটা গাছ, আর উড়ছে কাতর পাখিরা। এখন কি ইরাকের আগুন নিভেছে? এখন কি খুরমা গাছের ছবি দেখায় টিভিতে? গোলাপ ফোটে? ফুরাত নদীর জলে ঢেউ হয়? সেই জলে মাছরাঙা ছোঁ মারে? মনে মনে ছবি দেখে আদু— ফুরাত নদীর সামনে একজোড়া খেজুর গাছের তলায় দাঁড়িয়ে আছে ছালু, মুখে দাড়ি, হাওয়ায় কাটা ডানহাতের জামাটা পতপত করছে।
আসুক না, আসুক না সে, কাটা হাতে চুমা দেবে। কাটা হাতের আদর নেবে। কেন, ভয় করবে কেন?
একদিন বিকেলবেলা সাইকেল চেপে জব্বার এল। সাইকেলের ঘণ্টি তো নয়, পুজোর ঢাক। জব্বারকে ঘিরে সবাই। জব্বার যেন দেবদূত কিংবা ফেরেস্তা। ওই মুহূর্তে দাউদপুরের আদুদের উঠোন যেন বেহেস্ত। বলো কী খবর।
জব্বার এবার খেজুরের প্যাকেট আনেনি। সঙ্গে এনেছে একটা উট। মাটির। হলদেটে রং এর। জব্বার চা খেতে খেতে বলল—এরোপ্লেন তো উড়াল দিচ্ছে। তো আমরা কী করব? আমরা খাজুরের কাজ করছি। কদিন আগে ইরাকের মেলেটারি বলে গেল কত হাজার প্যাকেট যেন চাই। তাই কাজ হচ্ছে। শুনলাম আমেরিকার মেলেটারি এদিকে আসবে না। বাগদাদ হাসিল হয়ে গেছে কাজ মিটে গেছে। এমন সময় একদিন রেতের বেলা প্রবল শব্দ। সাদ্দামের মকানে বোমা পড়ল অনেক। আমরা ব্যারাক থেকে দেখলাম। তার পরদিন সকালে আমাদের ঘরের উপর। আমি গেছিলাম বাইরে পানি আনতে, তাই রক্ষে। পাথরের ছাদ হয় কিনা, খয়রুলের মাথায় পড়ল। ছালুভাইয়ের হাতটা খুব জখম হল। ডাইন হাতটা। পাথর সরাবার গাড়ি আইল পরদিন। ততক্ষণে আমি আর কয়েকজন একটা একটা করে ইট-পাথর সরালাম। একটা খাঁজের মধ্যে এটকে ছিল ছালুভাই। আঙুলে করে মুখের মধ্যে ফোটা ফোটা পানি চোষালাম সারারাত। পরদিন দুপুরে রেডক্রস গাড়ি এল। এর মধ্যে কতজন মরে গেল। কালিজায় জোর ছিল বলে ছালু জান ফিরে পেয়েছে।
জব্বারকে কেউ বিস্কুট এনে দেয় প্লাস্টিকের ডিশে, কেউ বাতাসা দেয়। বাতাসও।
খায়রুল তো কবর পেল, ছালু গেল হাসপাতাল। আমি করি কী? কোম্পানি তো নাই। ভাঙা পাথরে ছড়ানো খেজুর। পাখিও নাই যে খাবে। দুই দিন শুধু খাজুর খেলাম। অনেক খাজুরে পোড়া পোড়া গন্ধ। খাজুর পোড়ার টেস্ট করলাম ওই পরথম।
তারপর ক্যাম্প বসাল। একজন পাকিস্তানি ছিল। ও ব্যাটা হিন্দি বোঝে। ও বলল, তুমি হলে ইন্ডিয়ান, পানির দেশের লোক, তোমার তো দেখছি হাত-পা সব ঠিক আছে। তুমকো দুসরা কাম দেগা। ক’দিন পাউরুটি আর টিনের মাংস খাওয়াল। তারপর পাঠিয়ে দিল বুক্সাস। জাব নদীর ধারে। নরম মাটির দেশ। মাটির রং হলুদ। সেই মাটি দিয়ে হরেক জিনিস হয়। ফুলদানি, ছাইদানি, চা-কফি খাবার পাত্তর, পশু পাখি চিড়িয়া। সেই মাটি পোড়াবার কায়দা আলাদা। সেই উট আনেছি।
ছালুরে কুথায় কোন হাসপাতালে নিল, তার ঠিকানা করতে পারি না। অবশেষে সন্ধান পালাম। সে এখন আমার কাছেই আছে। মাটি পাড়ায়। পায়ের কাজ। পা দিয়ে মাটি নরম করে। একটা ক্যাসেট দেয় জব্বার।
আদু দু’ হাত একসঙ্গে জোড়ে। তেষ্টার জল খেতে গেলে যেমন আঁজলা করতে হয়, সেরকম। খাম খুললে আদু দেখল ক্যাসেটের গায়ে লেখা only for you, আদুর আর তর সয় না। জব্বার চলে গেলেই আদু মেশিনটা বের করে। ভাগ্যিস নিয়ে এসেছিল ওবাড়ি থেকে। ক্যাসেট ঢুকিয়ে অন করে। আদু, এই আদু, আমার আদু, আদরের আদু। আমি বলছি। বেঁচে আছি। খোদা বাচায়ে রেখেছে। খোদা না, ভুল বল্লাম, আমেরিকা।
অনেক কথা আছে—আদু, প্রাইভেট কথা। কেউ যেন না শোনে। শুধু তুমি।
অফ করল আদু। ইতিমধ্যেই জুটে গেছে ছোটভাই, মা।
মেশিনটা কোলে নিয়ে ছুটে বাইরে যায়। সূর্য তখন ডুবতে চলেছে। সামান্য বৃষ্টিও। পুকুরপাড় ছাড়িয়ে কালভার্ট ছাড়িয়ে মাঠে নামে। মাঠে ধান গাছ বড় হয়েছে। গোড়ালি সমান জল। ধান খেতের ভিতরে চলে যায় আদু। চারিপাশের ধানগাছে আঁধার নামছে। মেশিন অন করে আদু। তখন ধানের উপর ঢেউ খেলে যায় বাতাস কাহার দেশে।
আদু, হাসপাতাল থেকে তোমায় কত মনে মনে চিঠি লিখেছি। ছাড়া পেলাম কতদিন পর। একটা হাত নেই। জামার হাত লতপত করে। সামনে দেখলাম আমেরিকার পতাকা পত পত করে উড়ছে। আমাকে এসকিউ ক্যাম্পে নিয়ে গেল। আমার কাগজপত্র পাসপোর্ট কিছু নাই। ওরা বলল, কনসুলেটে পতা করবে। এডক্রস ক্যাম্প থেকে চিঠি লিখলাম তোমাকে। তারপর তো অনেক কথা। বলতে গেলে কষ্ট হয়, আদু কত অক্ত, আতজাগা, ভুখা। আমরা তো শুধু খেজুর ফল প্যাক করতাম, আর তো কিছু নয়। কার কি খেতি করতাম গো? গেল। ওই কাজ আর করতে পারব না কুলদিন। শুন বলি, জব্বার ঠিক খোঁজ করে চলে আল। লিয়ে গেল এক লদীর ধারে। সেই লদীর নাম জাব। দু’ পাশে নরম হলুদ মাটি। সিখানে হরেক কিসিমের মাটির জিনিস তৈরি হয়। সে মাটি পোড়ালে হলুদ অঙের দেখায়। আমাদের ধম্মে মূর্তি বানানো ভাল না। বালির দেশে এই ধম্ম উৎপত্তি। বালি দিয়ে মূর্তি হয়?
যেখানে নরম মাটি মিলে, সেখানেই মূর্তি গড়ে মানুষ। যে মানুষ ভাঙে সেই মানুষই আবার গড়ে। এমন সুন্দর উট, ঘোড়া, পাখি তৈয়ার হয় যেন রুহ ফুঁকে দিলেই জিন্দা হয়ে যাবে। আমি এখন উখানে মাটির তালের উপর নাচি। সারাদিন নাচি। মাটি লরম করি। সারা পায়ে মাটি লাগে, গায়ে মাটি লাগে। মাটিতে নাচতে নাচতে দেশের কথা ভাবি, তোমার কথা ভাবি আদু।
এখন একটা হাত ফেলে রেখে দেশে কী ভাবে যাব? দেশে গেলে কী খাব? কে খাওয়াবে আমাকে? যার হাত নাই তার ভাত নাই?
যুদ্ধ থেমেছে। জাব নদীর হলুদ নরম মাটিতে যেসব মিলিটারি জুতোর ছাপ পড়েছিল, রোদে শুকেছে সব। খাঁজ খাঁজ ছাপগুলি শক্ত হয়ে রয়ে গেছে। কতগুলি কমবয়সি ছেলে একদিন ছাপগুলি লাথি মেরে ভাঙল, আর ওদের ভাষায় গাল পাড়ল।
মানে যুদ্ধ থামে নাই।
আমি থাকব না ইখেনে। দেশে যাব। তোর কোলে। তোর বুকে। হাতকাটা ছালুরে দেখ্যে ভয় পাস না। যাব। ক’দিন পর। দুটো পয়সা জমুক।
আমার আদু, ছুনুমুনু একটা প্রাইভেট কথা। জব্বার আবার ফিরবে। এক মাস পর। ওকে একটা জিনিস দেবা? সেই ক্যেসেটটা আর নাই। যেখানে তোমার আর আমার ভালবাসা লেকা ছিল। যেটা শুইনতাম, এতের বেলায়, যুদ্ধ সিটা লষ্টো করে দিয়েছে। উটা আর নাই। একটা লৈতুন ক্যাসেটে আবার কয়ে দেবে গো, দুটো ভালবাসার কথা, চুমার শব্দ, আর ওইরকম আওয়াজ? পিলিজ। খাম বন্ধ করে ক্যাসেটটা পাঠিয়ো। উটা ছাড়া বাঁচব না। অনেক চুমা নাও।
অন্ধকার মাঠে ইরাক থেকে পাঠানো চুম্বনের শব্দ শোনে আদু। তারারা কাঁপে।
আজ আবার বেরিয়েছে আদু। দুপুর। ভাদ্রমাস। হাতে সেই টেপ মেশিন। নতুন ক্যাসেট ভরতে পারেনি। ছিল না। মান্না দের গানের ক্যাসেটটাই ভরেছে। মান্নাদের হিট সংগীত। প্রথম গানটিই হচ্ছে এই কূলে আমি আর ওই কূলে তুমি, মাঝখানে নদী ওই বয়ে চলে যায়। এই গানগুলির উপরেই ওর নতুন কথা ভাসাবে। গান মুছে গিয়ে আদুর কথা থাকবে।
আদু যায় লাল পথে, আদু যায় আল পথে। যেতে যেতে ফাকা মাঠে একা গাছ! গাছের তলায় শুকনো পাতা। পাতার উপর বসে আদু। চারিদিকে কেউ নেই। গোরু চরছে, হাওয়া বয় শনশন, আদু কাঁপে।
টেপ রেকর্ডারে আঙুল চাপে আদু। ওগো, আমি বলছি, অদনা, তোমার আদু। ওগো অতন আমার…। গলা ধরে আসে।
কত কী বলতে চায়। সারা শরীর থেকে কথা বেরোতে চায়, কিছুই বলতে পারে না আদ। টেপ ঘুরে যায়। হাওয়া বয় শনশন পাখিরা ডাকে। ওগো, তুমি তো ছোলেমান। তুমি পাখির ভাষা বুঝ..
যে মানুষগুলো যুদ্ধ চায়নি, তবু যুদ্ধ ওদের মেরেছে, তাদের জন্য শোকসভার মতো দাঁড়িয়ে আছে গাছ। নিঃশব্দে ঘুরে যাচ্ছে চুম্বক ফিতে। তুমি যা চেয়েছিলে এই নাও। এই বলে, একা বৃক্ষতলে, যোজন যোজন মাইল দূরের এক প্রিয় মানুষের জন্য চুম্বনের মুদ্রা করে আদু। কিন্তু টেপ রেকর্ড গ্রহণ করে শুধু ক্রন্দনের শব্দ। শুকনো পাতার উপর কান্নায় ভেঙে পড়ে আদু। ওর দু’ চোখে ইউফ্রেটিস-টাইগ্রিস। সোলেমান, ও সোলেমান, তুমি তো কান্নার ভাষাও বোঝো!
হাওয়া বয় শনশন। পাতারা কাঁপে।
শারদীয় বর্তমান, ২০০৩