জয়দ্রথ

সিন্ধু রাজ বৃদ্ধক্ষত্রের পুত্র। জয়দ্রথের ভার্যা ছিলেন ধৃতারাষ্ট্র ও গান্ধারীর একমাত্র দুহিতা দুঃশলা। ইনি ছাড়াও অবশ্য জয়দ্রথের আরও অনেক ভার্যা ছিলেন। জয়দ্রথের পুত্রের (দুঃশলার গর্ভজাত) নাম সুরথ। পাণ্ডবরা যখন কাম্যক বনে বাস করছেন, তখন সেই বনের মধ্য দিয়ে বিবাহের উদ্দেশ্যে জয়দ্রথ শাল্বদেশে যাচ্ছিলেন। বনের এক আশ্রমে তিনি পঞ্চপাণ্ডবের ভার্যা কৃষ্ণাকে (দ্রৌপদী) দেখতে পেলেন। পাণ্ডবরা মৃগয়ায় করতে বেরিয়েছেন, সেই সুযোগে জয়দ্রথ দ্রৌপদীকে বললেন পাণ্ডবদের ত্যাগ করে ওঁর ভার্যা হতে। দ্রৌপদীর কাছে তিরষ্কৃত হলে, তিনি জোর করে দ্রৌপদীকে রথে তুলে রওনা দিলেন। পাণ্ডবরা আশ্রমে ফিরে সেই খবর পাওয়ামাত্র জয়দ্রথের খুঁজতে বার হলেন। দূর থেকে পাণ্ডবদের দেখে জয়দ্রথ কৃষ্ণাকে ফেলে পালাবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু ভীমের হাতে ধরা পড়লেন এবং ভীমের নির্দয় প্রহারে জয়দ্রথ যুধিষ্ঠিরের দাসত্ব স্বীকার করতে বাধ্য হলেন। ক্ষমাশীল যুধিষ্ঠির অবশ্য জয়দ্রথকে তিরস্কার করে দাসত্ব থেকে ওঁকে মুক্তি দিলেন।
পাণ্ডবদের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে অপমানিত জয়দ্রথ হরিদ্বারে গিয়ে তপস্যায় মহাদেবকে সন্তুষ্ট করেন। জয়দ্রথ মহাদেবের কাছে পঞ্চপাণ্ডবকে পরাজিত করার বর চাইলেও মহাদেব তা দিলেন না। তবে বললেন যে, শুধু এক দিনের জন্য অর্জুন ব্যতীত অন্য পাণ্ডবভ্রাতাদের সসৈন্য যুদ্ধগতি জয়দ্রথ রুদ্ধ করতে পারবেন।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ত্রয়োদশ দিনে জয়দ্রথ দ্রোণের নির্মিত সৈন্যসজ্জার (চক্রব্যূহ) দ্বার-রক্ষক ছিলেন। পাণ্ডবপক্ষে একমাত্র অর্জুন কৃষ্ণ অভিমন্যু আর প্রদ্যুম্ন চক্রব্যূহ ভেদ করতে জানতেন। অর্জুন সেদিন সংশপ্তকদের সঙ্গে অন্য প্রান্তে যুদ্ধ করছেন। এদিকে কৌরব-সৈন্যের হাতে পাণ্ডবপক্ষ পর্যুদস্ত হচ্ছে দেখে কৌরবদের সংহত করার জন্য যুধিষ্ঠির অর্জুনপুত্র ষোড়ষবর্ষীয় অভিমন্যুকে চক্রব্যূহ ভেদ করতে আদেশ দিলেন। অভিমন্যু জানালেন যে, তিনি ব্যূহভেদ করতে পারবেন, কিন্তু বিপদ্কালে ব্যূহ থেকে বেরিয়ে আসার কৌশল তিনি তখনও পিতার কাছ থেকে শেখেন নি। ভীম অভয় দিলেন যে, ধৃষ্টদ্যুম্ন ও সাত্যকির সঙ্গে তিনি নিজে অভিমন্যুকে অনুসরণ করবেন। অভিমন্যু নিমেষে ব্যূহভেদ করলেন, কিন্তু তিনি ঢোকার পর ভীম, নকুল, সহদেব, সাত্যকি প্রমুখ বীরেরা কেউই জয়দ্রথকে অতিক্রম করতে পারলেন না। মহাদেবের বরে তিনি সেদিন অজেয়। অসংখ্য শত্রু সংহার করেও অভিমন্যু সেই ব্যূহ থেকে আর বেরোতে পারলেন না। কৌরবপক্ষের সাত মহারথী একসঙ্গে আক্রমণ করে অভিমন্যুকে বধ করলেন। প্রিয়তম পুত্রর মৃত্যুর খবর শুনে আর জয়দ্রথ পাণ্ডবসেনাদের ব্যূহমুখে আটকে দিয়েছিলেন জেনে বিষাদগ্রস্থ অর্জুন প্রতিজ্ঞা করলেন যে, পরদিন সূর্যাস্তের আগেই তিনি জয়দ্রথকে বধ করবেন, নইলে অগ্নিতে প্রবেশ করে নিজের প্রাণ সংহার করবেন। কৌরবপক্ষের মহাযোদ্ধারা জয়দ্রথকে ঘিরে থাকায় অর্জুন ওঁর কাছে পৌঁছতে পারছিলেন না। সূর্যাস্ত যখন প্রায় হয়ে আসছে,তখন কৃষ্ণ যোগযুক্ত হয়ে সূর্যকে তমসাচ্ছন্ন করলেন। সূর্যাস্ত হয়ে গেছে মনে করে কৌরবরা যখন সবাই আনন্দ করছেন, তখন অর্জুন দ্রুত জয়দ্রথের সামনে এলেন। কৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন, জয়দ্রথের পিতা বৃদ্ধক্ষত্র পুত্রের জন্মকালে দৈববাণী শুনেছিলেন যে,রণস্থলে কোনও শত্রু এঁর শিরশ্ছেদন করবেন। তাই তাঁর অভিশাপ ছিল যে, যে-ব্যক্তি তাঁর পুত্রের মস্তক ভূমিতে ফেলবে, তার মস্তক শতধা বিদীর্ণ হবে। এই বলে কৃষ্ণ অর্জুনকে নির্দেশ দিলেন কোনও দিব্যাস্ত্র ব্যবহার করে জয়দ্রথের ছিন্ন মুণ্ডু সমন্তপঞ্চকের বাইরে উপাসনারত বৃদ্ধক্ষত্রের কোলে ফেলতে। অর্জুন তাই করলেন। কোলের ওপর অকস্মাত্ কিছু পরায়, বৃদ্ধক্ষত্র ত্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে উঠলেন। তাঁর পুত্রের মস্তক ভূমিতে পড়ল,তাঁর নিজের মস্তকও শতধা বিদীর্ণ হল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *