জ্যোৎস্নার রেল স্টেশন

জ্যোৎস্নার রেল স্টেশন

‘ডাকাত! ডাকাত!’

বাজখাঁই গলার চিৎকারে ঘুমটা ভেঙে গেল। আমি চোখ খুললাম। ট্রেন কি চলছে? নাকি থেমে আছে? ট্রেনের এই একটা মজা। অনেকক্ষণ চলার পর থেমে গেলেও বোঝা যায় না। বাইরের বদলে ট্রেন তখন চলতে থাকে শরীরের ভেতরে। ভেতরের সেই ট্রেনটা মাঝেমধ্যে হুইস্‌ল দেয়, ঘটাং ঘটাং করে নদীর সাঁকো পেরোয়!

উঠে বসলাম! না, ট্রেন থেমেই আছে। কামরা অন্ধকার। তবে একেবারে অন্ধকার নয়। কোথা থেকে যেন আবছা একটা আলো আসছে। এই তো ঘুমোনোর আগেই দেখেছি, করিডরে নীল রঙের ডুমো ডুমো আলো জ্বলছিল। সেগুলোর কী হল? ট্রেন থামার সঙ্গে আলোও নিভে গেল! আবছা আলোটা কোথা থেকে আসছে? নিশ্চয় কোনও জানলা খোলা।

আবার চিৎকার।

সাবধান সকলে! খুব সাবধান! জানলা টানলা বন্ধ করে দিন। যে-কোনও মুহূর্তে ডাকাত পড়তে পারে।

ঝপ ঝপ শব্দ। আবছা আলোটাও চলে গেল। মনে হয়, ভয় পেয়ে খোলা জানলাটা কেউ বন্ধ করে দিল। বাঃ, এবার একেবারে পুরো অন্ধকার। সত্যি যদি ডাকাত পড়ে তাদের খুব সুবিধে হবে। ক’টা বাজে? কত রাত?

আমি আপার বার্থে আছি। আমার উলটোদিকের বার্থে তমাল। ট্রেনে উঠেই গভীর মনোযোগ সহকারে ফুঁ দিয়ে হাওয়া বালিশ ফুলিয়েছে। তারপর চাদর টেনে শুয়ে পড়েছে। শোওয়ার আগে বলল, ‘আমাকে বিরক্ত করবি না, সাগর। মেজাজ ভাল নেই। ডাকাডাকি করবি না একদম।’

‘তুই কি চাদর মুড়ি দিয়ে শুবি?’

তমাল ভুরু কুঁচকে বলে, ‘কেন মুড়ি দিয়ে শোব কেন?’

আমি সামলে নিয়ে বললাম, ‘না, তেমন কিছু নয়। তবে মুখ ঢেকে শুলে ভাল হয়। তোর ওই পেঁচার মতো মুখ যত কম দেখা যায়। বেড়াতে যাওয়ার সময় বেজার মুখ দেখতে নেই। অমঙ্গল হয়।’

চাপা গলায় দাঁত কিড়মিড় করে তমাল বলল, ‘তোর কি মনে হচ্ছে, আমি বেড়াতে যাচ্ছি? তোর তাই মনে হচ্ছে?’

না, তমাল বেড়াতে যাচ্ছে না। ছন্দার সঙ্গে তুমুল ঝগড়ার কারণে সে গৃহত্যাগী হচ্ছে। গৃহত্যাগী না বলে কলকাতাত্যাগী বলাই উচিত। তবে পাকাপাকিভাবে নয়। আপাতত অফিস থেকে দিন দশেকের ছুটি নিয়েছে।

তবে গৃহত্যাগের মুখে দাঁড়িয়ে সে একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেই সিদ্ধান্তের সময় আমি ছিলাম তার সঙ্গে। সেদিন ওর পাশে বসে, ওর পয়সাতেই চা খাচ্ছিলাম।

নিয়ম হল, খিদের সময় চা খে়লে খিদে মরে দরকচা মেরে যায়। তবে আমার ক্ষেত্রে দেখেছি, বেশিরভাগ সময়ই নিয়ম ফেল মারে। সেদিনও চায়ের নিয়ম ফেল মারল। যত চা খেতে লাগলাম, আমার খিদে তত বাড়তে লাগল। বুঝতে পারলাম, সলিড কিছু খেতে হবে। পকেটের যা অবস্থা, তাতে সলিড কিছু হবে না। এই টানাটানির সময়গুলোতে তমালই আমার ভরসা হয়। চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে উদাস মুখে তমাল বলল, ‘ধুস, যদি দশ দিন পরেও মন-মেজাজ ঠিক না হয়, তা হলে ভাবছি আর ফিরবই না। এখানে থেকে কোনও লাভ নেই। কেউ শালা দামই দিল না।’

আমি তলানির চাটুকুও চুমুক মারলাম। বললাম, ‘খুবই ভাল সিদ্ধান্ত। তোর বাইরে কোথাও থেকে যাওয়াই উচিত। যেখানে কেউ দাম দেয় না সেখানে তুই থাকবি কেন? আমি একটা সামান্য, বেকার, ফালতু ধরনের ছেলে, তবু দাম না দিলে থাকি না। এই যেমন তুই এখন কাছাকাছি একটা কোনও খাবার হোটেল আমাকে নিয়ে যাবি, আমি সেখানে পেটপুরে লাঞ্চ সারব এবং তুই দাম দিবি। দাম দিবি বলেই না আমি তোর সঙ্গে থাকব।’

তমাল ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘রসিকতা করছিস সাগর? একটা বন্ধু বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে, আর তুই রসিকতা করছিস?’

না, ছেলেটার অবস্থা মনে হচ্ছে, সত্যি খুবই খারাপ। ছন্দার সঙ্গে তার ঝগড়া নতুন কোনও ঘটনা নয়। গত তিন বছর ধরে এই কাণ্ড চলছে। প্রতি মাসে দু’জনের কমপক্ষে ছ’বার করে ঝগড়া হয়। তার মধ্যে কয়েকটা থাকে মারাত্মক ধরনের। একেবারে সম্পর্ক ছাড়াছাড়ি পর্যন্ত ঘটনা গড়ায়। যে যার পথ দেখে। এবারেরটা মনে হচ্ছে, সেই মারাত্মকেরও বেশি। তমাল কলকাতা ছেড়ে পালাচ্ছে কেন? ছন্দা কি মারধরের হুমকি দিয়েছে? দিলে খারাপ করেনি। বিয়ে-থা’র আগে সব মেয়েরই উচিত সুযোগ থাকলে হবু বরকে আগাম দু’-এক ঘা দিয়ে রাখা। এতে পরের দিকে সহজে কন্ট্রোল রাখা যায়। যাক, আমার এসবের মধ্যে থেকে লাভ নেই। ওদের মারধর, ওদের ভালবাসা ওরা নিজেরা বুঝুক গে। আমার এখন খিদে পেয়েছে।

গম্ভীর হয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ, রসিকতা করছি। সম্প্রতি আমেরিকার কোনও একটা বিশ্ববিদ্যালয় যেন খিদে এবং রসিকতা নিয়ে বড় ধরনের কাজ করেছে। দীর্ঘ গবেষণার পর তারা জানতে পেরেছে, খিদের সঙ্গে খাবার ছাড়া একমাত্র মোকাবিলা করতে পারে হাসি ঠাট্টা। তমাল তুই যদি মনে করিস, এই সিদ্ধান্ত আকাশ থেকে নেওয়া হয়েছে, তা হলে খুবই ভুল করবি। আফ্রিকার কয়েকটা দুর্ভিক্ষ পীড়িত এলাকার মোট সাতশো বাইশ জনের ওপর দীর্ঘ তিন বছর ধরে নিবিড় পরীক্ষা চালানো হয়েছিল। অভুক্ত মানুষকে রুটিন করে জোকস্ এবং হাসির গল্প শোনানো হয়েছে। সকালে এক ঘণ্টা, বিকেলে চল্লিশ মিনিট। সেই পরীক্ষার ফলাফল শুনলে তুই হাঁ হয়ে যাবি তমাল। খেতে না পাওয়া হাড়গিলে মানুষগুলো হাসতে হাসতে নাকি একেবারে কেলেঙ্কারি কাণ্ড বাধিয়েছে! কেঁদে কেটে একসা।’

তমাল অবাক হয়ে বলল, ‘কেঁদে কেটে কেন? এই তো বললি হাসি। বললি না?’

আমি বিজ্ঞের মতো হেসে বললাম, ‘ওরে এই কান্না কি আর সেই কান্না রে গাধা? এ হল গিয়ে তোর আনন্দের কান্না। খিদে ভুলে যাওয়ার আনন্দ। ওদের প্রত্যেকের চোখের জল কালেক্ট করে ল্যাবরেটরিতে টেস্ট করা হয়েছিল। দেখা গেছে, সব অশ্রুই হল আনন্দাশ্রু। আমি সেই কারণেই রসিকতা করছি। তুই গৃহত্যাগী হওয়ার আগে আমাকে একটা হাসির বই প্রেজেন্ট করে যাস তো। মোটা দাগের কোনও জোকস হলে ভাল হয়। হাসতে হাসতে যেন পেটে খিল ধরে যায়। আমার আর্থিক অবস্থা যেরকম চলছে, তাতে সামনের কয়েকদিন মনে হচ্ছে, শুধু হাসি ঠাট্টার মধ্যেই থাকতে হবে। তুই গৃহত্যাগ করছিস মানে আরও বিপদ।’

তমাল মাথা নামিয়ে বলল, ‘চল, কোথায় খাবি?’

গোটা খাওয়ার পিরিডটায় তমাল মুখটাকে হাঁড়ির মতো করে রাখল আর মাঝেমধ্যে বিড়বিড় করতে লাগল। মনে হয়, নিজের মনেই ছন্দার সঙ্গে ঝগড়া করছিল। কিন্তু খাওয়াল খুব যত্ন করে। পাবদা মাছটা তো অতি চমৎকার। তমাল জোর করে দুটো দিতে বলল। শেষ পাতে আমের চাটনি আর দই। আমি সামান্য একটা মানুষ। এত যত্ন পেলে লজ্জা করে। চোখে জল চলে আসে। একেই সম্ভবত বলে আনন্দাশ্রু। আমি নিজেকে সামলে ঢেকুর তুললাম। বেশ একটা সাধু সাধু ভাব করে বললাম, ‘বৎস, আমি তোমার ব্যবহারে সন্তুষ্ট। অতি সন্তুষ্ট। এবার বলো, আমি তোমার কী উপকার করতে পারি?’

তমাল ফট করে বলল, ‘সাগর, আমার সঙ্গে যাবি?’

আমি চমকে উঠলাম। ছেলেটা বলে কী!

‘আমি! আমি কেন গৃহত্যাগ করব তমাল? আমার প্রেমও নেই, গৃহও নেই। ভাড়া বাড়িতে থাকি। তিন মাসের ভাড়া বাকি। যে-কোনও সময় ওরাই আমাকে ত্যাগ করবে।’

‘বাজে কথা রাখ। আমার মেজাজের যা অবস্থা, তাতে মনে হচ্ছে, একলা যাওয়াটা রিস্কের হয়ে যাচ্ছে। শুনেছি, এই সময়টা সুইসাইডের দিকে একটা ঝোঁক আসে। ট্রেন ফেন থেকে ঝাঁপ না দিয়ে বসি। সঙ্গে পাহারার জন্য একজনের থাকা দরকার। তুই আমাকে চোখে চোখে রাখবি। খরচ টরচ সব আমার। তা ছাড়া, তোর তো সুবিধেই হল, ক’টাদিন খাওয়া-টাওয়া নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।’

গৃহত্যাগীর পাহারাদার! বাঃ, চাকরিটা বেশ তো! তার ওপর বেড়ানোও হয়ে যাচ্ছে। দশ দিনের জন্য লাঞ্চ, ডিনার, চিফিন, চা-সিগারেট নিয়ে নো চিন্তা। তারপর যদি তমাল গৃহত্যাগের ব্যাপারটা পাকাপাকি করে ফেলে তা হলে তো আর কোনও কথাই নেই। প্রভিডেন্ড ফান্ড, গ্র্যাচুইটি, বোনাস টোনাস নিয়ে মন দিয়ে চাকরি করব।

আমি বললাম, ‘রাজি।’

তমাল বলল, ‘গুড। তা হলে রেডি হয়ে নাও। তবে একটা শর্ত আছে। যতদিন আমার সঙ্গে থাকবে ততদিন ওই মেয়ের নাম একবারের জন্যও মুখে আনতে পারবে না।’

আমি অবাক হওয়ার ভান করে বললাম, ‘কোন মেয়ে? কার কথা বলছিস তমাল?’

‘ওই যে ওই মেয়ে। নাম শুনলে আমার মাথায় আগুন জ্বলে যাবে। তোকে মেরেও দিতে পারি।’

আমি মৌরি চিবোতে চিবোতে বললাম, ‘বয়ে গেছে আমার উচ্চারণ করতে। তোর খরচে খাব-দাব, বেড়াব। অন্যের নাম বলতে যাব কোন দুঃখে? আমি শুধু তোর নামই বলব। যার নুন খাই তার গুণ গাই। আচ্ছা, ছন্দার নিন্দে করা যাবে কি?’

তমাল কড়া চোখে তাকিয়ে বলল, ‘নিন্দে, প্রশংসা কিছু করতে হবে না। সাগর, তুই কি জানতে চাস আমরা কোথায় যাচ্ছি?’

আমি একটা দার্শনিক দার্শনিক ভাব করে বললাম, ‘না, জানতে চাই না। গৃহত্যাগের কোনও ঠিকানা থাকে না। কুড়িটা টাকা দে তো।’

তমাল চলে যাওয়ার পরই আমি ঠিক করলাম, কুড়ি টাকার ফুল কিনব। কিনে ছন্দার অফিসে যাব। ওর হাতে ফুল তুলে দেব। ও অবাক হয়ে বলবে, ‘ফুল এনেছেন কেন? নিশ্চয় কোনও মতলব আছে?’ আমি হেসে বলব, ‘তুমি এত বড় একটা কাজ করেছ, শুধু হাতে ধন্যবাদ দেওয়া যায় না। সেইজন্য ফুল এনেছি।’

শুধু ধন্যবাদ নয়, ধন্যবাদের সঙ্গে ছন্দাকে অনুরোধও করব। বছরে যদি ও অন্তত দুটো এ ধরনের বড় ঝগড়ার ব্যবস্থা করতে পারে, আমার ফ্রি-তে থাকা, খাওয়া এবং বেড়ানোটা হয়ে যাবে। ছন্দা কি আমার অনুরোধ রাখবে? মনে হয় না রাখবে। মেয়েটা আমার কোনও অনুরোধই রাখে না। উলটে মাঝেমধ্যেই ধমক ধামক দেয়।

‘আপনার জন্য তমাল পাগলামি করতে পারে, কারণ সে আপনার বন্ধু। তাকে সেটা মানায়। আমি করব কেন? আমি তো আপনার বন্ধু নই। সুতরাং কথা না বাড়িয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে যান। আমার অনেক কাজ আছে। আর হ্যাঁ, যাওয়ার আগে এই প্যাকেটটা দয়া করে নিয়ে যাবেন। এটায় আপনার জন্য একটা জামা আছে। রং পছন্দ হলে পরবেন। না হলে ফেলে দেবেন। তবে দয়া করে আমাকে দেখাতে আসবেন না।’ এই মেয়ে আমার অনুরোধ কেন রাখবে?

আশ্চর্য, ছন্দা সেদিন আমার অনুরোধ রাখল! প্রথমটায় গাঁই গুঁই করছিল। শেষপর্যন্ত রাজি হয়েছে। আমি এত খুশি হলাম, মনে হল ছন্দার অফিসের মধ্যেই একটা লাফ মারি। সাহস হল না। বেকার মানুষের কাজের জায়গায় লাফালাফি করা মানায় না।

আবার কে যেন চিৎকার করে উঠল, ‘ডাকাত পড়তে পারে… ডাকাত। সাবধান সবাই…।’

সত্যি ডাকাত পড়বে নাকি? তমালকে ডাকল? থাক, দরকার নেই। যে মানুষ সব ছেড়ে ছুড়ে বিবাগী হওয়ার প্ল্যান নিয়েছে তার কাছে ডাকাতই বা কী? সন্ন্যাসীই বা কী? ঘুমোচ্ছে ঘুমুক। আহা, বাড়ি ঘর ছেড়ে এসে এমন নিশ্চিন্তে কতজনই বা ঘুমোতে পারে?

ক্রমশ অন্ধকারটা একটু চোখ সওয়া হয়েছে। ঘুম ভেঙে উঠে বসেছে অনেকেই। একজন দু’জন হাঁটা-চলাও করছে। বার্থের ওপর থেকে আমি ঝুঁকলাম। কে যেন ফস করে একটা টর্চ জ্বালল। হলুদ রঙের আলোর বল লাফিয়ে উঠল কামরায়। অমনি বাজখাঁই গলার ধমক— ‘টর্চ কে জ্বালালেন? নিভিয়ে ফেলুন, নিভিয়ে ফেলুন এখুনি। আলো দেখলেই কামরাটা টার্গেট হয়ে যাবে।’

যে টর্চ জ্বালিয়েছিল সে বোধহয় ধমক শুনে রেগে গেল। বলল, ‘রাখুন মশাই, আপনার টার্গেট। তখন থেকে ডাকাত ডাকাত করে চেঁচাচ্ছে। কী এমন সোনাদানা নিয়ে ট্রেনে উঠেছেন? সঙ্গে মেয়েছেলে আছে। অন্ধকারে কেউ গায়ে হাত টাত দিয়ে দিলে কী হবে? ধরতেও পারব না।’

এতক্ষণ সবাই চুপ করে ছিল। এই মারাত্মক কথার পর গোটা কামরায় একটা শোরগোল পড়ে গেল। চোর ডাকাত সব মাথায় উঠল।

‘অ্যাই, টর্চটা দাও। শিগগিরই দাও।’

‘শিগগিরই দেব কী করে? কিছু দেখতেই তো পাচ্ছি না।’

‘উফ তোমাদের নিয়ে বেরোনোটাই ভুল হয়েছে। নীল ব্যাগের চেনের মধ্যে আছে। হাত ঢুকিয়ে দেখো।’

‘লাল, নীল কিছু বুঝতে পারছি না। অন্ধকারে সব একরকম দেখাচ্ছে।’

‘আচ্ছা ছাড়ো, আমি দেখছি।’

‘এই যে দাদা, আমার ব্যাগটা টানাটানি করছেন কেন?’

‘ভাই, আমি কি ইচ্ছে করে টানছি? ঝগড়া করছেন কেন?’

‘অ্যাই চোপ।’

‘এদিকে ঘেঁষছেন কেন? দেখছেন না, আমার মেয়েটা শুয়ে আছে। নিজের জায়গায় ঠিক করে বসুন।’

‘মুখ সামলে কথা বলবেন। দিদি।’

‘ওফ, মোবাইলটা কাজ করছে না।’

‘মোবাইল দিয়ে কী হবে? পুলিশ ডাকবেন?’

‘চোপ।’

‘ও টিকিট চেকার দাদা, আপনি কোথায় গেলেন!’

‘কোথায় আর যাবে। নেমে জঙ্গলের মধ্যে হাঁটা মেরেছে।’

বলতে বলতে ঝপাঝপ অনেকগুলো টর্চ জ্বলে উঠেছে। ওদিকে কে যেন একটা মোমবাতিও জ্বেলেছে। আমার নিজের কোনও আলো নেই। না টর্চ, না মোমবাতি। তাতে এখন আর কোনও অসুবিধে নেই। অন্যের আলোতেই আমার কাজ চলবে। আমি নেমে এলাম। বাঙ্কের তলা হাতড়ে পায়ে চটি গলালাম। নিশ্চয় ভুল চটি পরেছি। থাকুক। এরকম পরিবেশে ভুল চটিই জমবে।

তবে ট্রেন যদি আরও খানিকক্ষণ এই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকে, আমাকে একবার নামতে হবে। নামতেই হবে।

‘সাগরকাকু, ট্রেন কোথায় দাঁড়িয়ে আছে?’ আমি মিডল বাঙ্কের দিকে ঝুঁকে, গলা নামিয়ে বললাম, ‘অ্যাই, তুই কোনটা রে? বঙ্কা না ঝঙ্কা?’

‘বঙ্কা। বলো না, ট্রেন কোথায় দাঁড়িয়ে আছে?’

তার মানে এটা ঝঙ্কা। বছর দশেকের যমজ ছেলে দুটো কাল সন্ধে থেকে এই খেলা শুরু করেছে। নাম গুলিয়ে দিচ্ছে। ওরা ওদের বাবার সঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছে। দুটোই ভয়ংকর রকমের পাজি এবং বুদ্ধিমান। মুখগুলো সুন্দর আর দেখতে প্রায় একইরকম।

ওদের বাবা ট্রেনে ওঠার পর থেকেই দুই ছেলেকে বকা ঝকার ওপরে রেখেছেন।

‘বঙ্কা-ঝঙ্কা জানলা বন্ধ করে দাও। বঙ্কা-ঝঙ্কা বাঙ্ক থেকে নামবে না। বঙ্কা-ঝঙ্কা অতবার বাথরুমে কেন যাচ্ছ? বঙ্কা-ঝঙ্কা মারপিট করবে না। বঙ্কা-ঝঙ্কা লুডো খেলা বন্ধ করো। বঙ্কা-ঝঙ্কা শুয়ে পড়ো। বঙ্কা-ঝঙ্কা চড় খাবে।’

আমার মনে হয়, এত বকা ঝকার কারণেই ওদের এরকম নাম। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও বুঝতে পারলাম না, কোন নামটা কার। ওদের বাবা সবসময়ই দু’জনকে একসঙ্গে ডাকছেন। যেন দুটো ছেলে মানে একজনই! এদের মা কোথায়?

ভদ্রলোক বাথরুমে যেতে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোরা কে বঙ্কা, আর কে ঝঙ্কা রে?’

ওরা লুডো খেলছিল। একজন চাল দিতে দিতে গম্ভীর মুখে বলল, ‘আমি বঙ্কা আর ও ঝঙ্কা।’ সঙ্গে সঙ্গে পাশের জন মিটিমিটি হেসে বলল, ‘না কাকু, ঝঙ্কা মিথ্যে বলছে। আমি বঙ্কা। ও সবসময় এরকম করে। উলটোটা বলে।’ অন্যজন হাত তুলে বলল, ‘অ্যাই ঝঙ্কা, চড় খাবি।’

বাঃ বেশ মজা তো! আমি ওদের সঙ্গে লুডো খেলতে বসে গেলাম। তমালকে বললাম, ‘অ্যাই তমাল, লুডো খেলবি? আরে বাবা, ট্রেনে একটু লুডো খেলতে হয়। নইলে রেল কোম্পানি ফাইন নেবে। আয়, নেমে আয়।’

নেমে আসার তো দূরের কথা, তমাল আমার দিকে আগুন চোখে তাকিয়ে পাশ ফিরল। বঙ্কা-ঝঙ্কা আমার কথায় খুব হাসতে লাগল। তারপর দ্রুত ঝগড়া ভুলে দুই ভাই নিজেদের মধ্যে হাত মেলাল এবং নানা ধরনের গোলমাল পাকিয়ে আমাকে হারানোর চেষ্টায় মেতে উঠল। বাপ রে, দু’জনের এত ভাব! ওদের বাবা ফিরে এসে বললেন, ‘এদের থেকে সাবধানে থাকবেন মশাই। দুটোই অতি বিপজ্জনক।’

আমি হেসে বললাম, ‘কোথায় বিপজ্জনক? আমি তো দেখছি চমৎকার।’

চমৎকার শুধু এরা নয়, এদের বাবাটিও চমৎকার।

পরে পরিচয় হতে জানতে পারলাম, তিন বছর হল ভদ্রলোকের স্ত্রী মারা গেছে। স্ত্রীর মৃত্যুর তারিখটিতে উনি কখনও বাড়িতে থাকেন না। প্রতি বছরই দুই ছেলেকে নিয়ে বাইরে কোথাও চলে যান। উনি চান না, মা সম্পর্কে গভীর দুঃখের স্মৃতি এই ফুটফুটে দুই বালকের ওপর চাপ তৈরি করুক। তাদের মা হইচই ভালবাসত। তার সন্তানেরাও হইচইয়ের মধ্যে মাকে মনে রাখুক।

‘বঙ্কা, হয়তো কোনও গভীর জঙ্গলের মধ্যে ট্রেন দাঁড়িয়ে গেছে।’

ছেলেটা উঠে বসল। ফিসফিস করে বলল, ‘দারুণ ব্যাপার, সাগরকাকু। ডাকাত আসবে?’

আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, ‘পরিস্থিতি যা তাতে মনে তো হচ্ছে, আসবে।’

উলটোদিকের বার্থে ঝঙ্কাও উঠে বসেছে। বলল, ‘ডাকাত কীসে চেপে আসবে কাকু? ঘোড়ায় চেপে?’

‘না রে, গাধায়। হি হি।’ বঙ্কা হেসে উঠল। আমি বললাম, ‘অ্যাই, তোরা চুপ কর। বাবা উঠে পড়লে কিন্তু বকবে। এখন শুয়ে থাক, আমি বরং ডাকাতের ব্যাপারটা খোঁজ নিয়ে আসি। এসে তোদের জানাচ্ছি।’

বস্কা ফিসফিস করে বলল, ‘ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি যাও। আমরা অপেক্ষা করছি। ডাকাত এলেই ছুটে এসে আমাদের খবর দেবে।’

ঠোক্কর খেতে খেতে গেটের কাছে এসে দেখলাম, সেখানে জটলা।

চিমসে ধরনের একটা লোক দরজা আটকে দাঁড়িয়ে। হাতে লম্বা টর্চ। সেটা নাড়াচ্ছে এবং ভাষণ দিচ্ছে। বাকিরা শুনছে।

‘শালা, দেশটার এইজন্য কিছু হল না। এতগুলো লোককে এই যে রাত দুপুরে জঙ্গলের মধ্যে ফেলে রেখে দিয়েছে, এর সিকিউরিটিটা কী? নো সিকিউরিটি। এই যদি বিদেশ হত, তা হলে দেখতেন কয়েক মিনিটের মধ্যে মাথার ওপর হেলিকপ্টার ভোঁ ভোঁ করত। বিদেশের ব্যাপার স্যাপারই আলাদা। এখন এখানে একটা গুড-ব্যাড কিছু হয়ে গেলে কে রেসপনসিবিলিটি নেবে?’

সামনের লোকটা কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, ‘গুড-ব্যাডের কথা কী বলছেন ভাই?’

চিমসে ছেলেটা প্রশ্নকর্তার মুখের ওপর দু’বার টর্চ নেড়ে বলল, ‘কী বলছি বুঝতে পারছেন না? ভাল-মন্দ কিছু হলে বুঝতে পারবেন।’ তারপর গলা নামিয়ে বলল, ‘এই যে গাড়িটাকে রাতদুপুরে জঙ্গলের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে দিল তা কি এমনি এমনি?’

সামনের লোকটা যেন আর্তনাদ করে উঠল, ‘তা হলে?’

‘সব সাঁট আছে মশাই। আগে থেকে বলা আছে।’

‘বলা আছে? কাকে বলা আছে?’

চিমসে মুচকি হাসল। বলল, ‘সে দেখতেই পাবেন, কাকে বলা আছে। প্রবলেম তো আর ডাকাতি নয়, আজকাল আবার নতুন কায়দা হয়েছে, ডাকাতরা লেডিস নামিয়ে নেয়। তারপর…।’

লোকটা আবার হাসল। যেন ডাকাতদের ‘লেডিস’ নামিয়ে নেওয়া বিরাট মজার কোনও ঘটনা। কিছু লোক আছে যারা ট্রেনে উঠেই একটা ‘বাড়িতে আছি, বাড়িতে আছি’ ধরনের ভান করে আনন্দ পায়। এরা ফটাফট শার্ট প্যান্ট বদলে পাজামা আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে ফেলে। খবরের কাগজের মোড়ক খুলে হাওয়াই চটি বের করে। তারপর কাঁধে একটা তোয়ালে ফেলে ব্যস্ত হয়ে কামরার মধ্যে ঘোরাঘুরি করতে থাকে। আমার পাশে যে মোটাসোটা লোকটা এসে দাঁড়াল, সে শুধু কাঁধে তোয়ালে ফেলেনি, হাতে একটা টুথব্রাশ পর্যন্ত নিয়েছে! মাঝরাতে টুথব্রাশ! লোকটা আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, ‘এই লোকটাকেই আমার টিকিট চেকার বলে মনে হচ্ছে। বিপদ বুঝে এখন ড্রেস বদলে পাবলিক সেজেছে। দেখছেন না, বেশি লেকচার মারছে।’

উলটোদিকের দরজার কোনায় একজোড়া অল্পবয়সি ছেলেমেয়ে ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে। মনে হয়, সদ্য বিয়ে করে হানিমুনে বেরিয়েছে। শুনতে পেলাম, মেয়েটা ফিসফিস করে বলছে, ‘তখনই বললাম, এসি কোচে টিকিট করো। তোমার সবটাতে কিপটেমি। এসি কোচে সিকিউরিটি অনেক বেশি।’

ছেলেটা তোতলাতে তোতলাতে বলল, ‘শিখা আমি, আমি…’

মেয়েটার নাম তা হলে শিখা।

শিখা চাপা গলায় বলল, ‘এখন হাঁদার মতো আমি, আমি করতে হবে না। এরপর যখন ডাকাতরা এসে আমাকে নামিয়ে নিয়ে যাবে, আমি কিন্তু হাসতে হাসতে চলে যাব। বুঝবে ঠেলা।’

আড় চোখে দেখলাম, ছেলেটা মেয়েটার দিকে আরও সরে এসেছে। অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না, তবে আমি নিশ্চিত সে এবার স্ত্রীর একটা হাতও ধরে ফেলেছে।

আমি এগিয়ে গেলাম। আমাকে নামতে হবে। জঙ্গল, পাহাড় যা-ই হোক আমাকে এবার নামতে হবে। এসি কোচে সিকিউরিটি বেশি শুনে বসে থাকলে চলবে না। নিজের চোখে দেখে আসা দরকার।

চিমসে লোকটাকে বললাম, ‘ভাই, একটু সরুন তো।’

আমার মুখে একবার টর্চ ফেলে কঠিন গলায় লোকটা বলল, ‘কেন? সরব কেন?’

‘এমনি ভাই। নামব।’

‘নামবেন! জঙ্গলের মধ্যে নামবেন কেন?’ লোকটা জেরা করছে। আমি মাথা ঠান্ডা রেখে বললাম, ‘কোনও কারণ নেই। নেমে একটু ঘুরে দেখব।’

‘ঘুরে দেখবেন! এটা কি দার্জিলিং-এর ম্যাল না পুরীর সি বিচ, যে ঘুরে দেখবেন?’

শান্ত গলায় বললাম, ‘তার থেকেও তো ভাল কিছু হতে পারে। নিন, সরুন এবার, দরজা খুলব।’

লোকটা এবার পা নাচিয়ে, চোখ নাচিয়ে বলল, ‘দুঃখিত, দরজাটা তো খোলা যাবে না। ট্রেন না ছাড়া পর্যন্ত দরজা, জানালা কিছুই খোলা যাবে না।’ তারপর অন্যদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বুঝলেন দাদা, ভেতরে ওদের লোক থাকে। দরজা খুলে দেয়।’ আমার রাগ বাড়াচ্ছে। একে এখনই একটা শাস্তি দেওয়া দরকার।

চিমসেটা এবার সোজা হয়ে বলল, ‘এই যে ভাই, আপনি কোথায় যাচ্ছেন? কত পর্যন্ত টিকিট কাটা?’

নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললাম, ‘জানি না।’

‘জানি না মানে?’ লোকটা মুখ ঘুরিয়ে বাকিদের দিকে তাকাল।

আমি অল্প হেসে বললাম, ‘জানি না মানে জানি না। তবে এটা জানি, আপনি টর্চটা নিয়ে অসভ্যতা করছেন। অনেকক্ষণ ধরে ব্যাপারটা লক্ষ করছি।’

‘অসভ্যতা! অসভ্যতা করছি!’ লোকটা প্রায় তেড়ে এল।

আমি একইরকম শান্ত গলায় বললাম, ‘আপনি ইচ্ছে করে বারবার ওই মেয়েটির গায়ে আলো ফেলছেন। মেয়েদের গায়ে ইচ্ছে করে আলো ফেলা একটা বিরাট অসভ্যতা। ভাই, এটা আর করবেন না। ওই মেয়েটার নাম কি আপনি জানেন? ওর নাম শিখা। অন্য কোনও নামের মেয়ে হলে অসুবিধে ছিল না, কিন্তু আপনি বোধহয় জানেন না শিখা নামের মেয়েরা ডেঞ্জারাস হয়। এরা ডাকাতদেরই ভয় পায় না, আপনি তো কোন ছুঁচো। বলা যায় না, এই অপরাধের জন্য এগিয়ে এসে ও আপনাকে একটা চড়ও মারতে পারে। সাবধান ভাই।’

ছেলেটা কেমন থতমত খেয়ে গেছে। বাকিরাও চুপ।

এমন সময় আরও একটা অদ্ভুত কাণ্ড ঘটল! উলটোদিক থেকে শিখা নামের মেয়েটি সত্যি সত্যি এগিয়ে এল! এগিয়ে এসে বলল, ‘এই যে ছোকরা, শোনো। আমিও তখন থেকে দেখছি…।’

আমি হাতল ঘুরিয়ে দরজা খুললাম এবং ট্রেন থেকে নেমে পড়লাম। নামতে গিয়ে বুঝতে পারলাম মাটিটা অনেক নীচে। ছোট একটা লাফ দিতে হল।

আরে! কোথায় জঙ্গল? ডাকাতই বা কোথায়?

এ তো একটা স্টেশন! ছোট্ট একটা স্টেশন! আলগোছে পড়ে আছে। ফটফটে জ্যোৎস্নায় যেন নিকোনো! অল্প অল্প হাওয়ায় গা এলিয়ে স্টেশন ঘুমিয়ে রয়েছে! ইট বাঁধানো একফালি প্ল্যাটফর্ম। সেই প্ল্যাটফর্মের ওপরই ঝাপসা ঝাপসা গাছ। গাছের তলায় বাঁধানো বেঞ্চ। ঝকঝকে চাঁদের আলো আর অন্ধকারে মাখামাখি হয়ে তারা দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ দেখে মনে হচ্ছে, সেজেগুজে অপেক্ষা করছে। যদি কেউ আসে?

আশেপাশে কেউ কোথাও নেই। সাহস করে ট্রেন থেকে একজনও নামেনি। ভালই হয়েছে। এখানে মানুষ মানায় না। কতকগুলো রেল স্টেশন রয়েছে, যেখানে ভুল না করলে ট্রেন কখনও দাঁড়ায় না। চলন্ত ট্রেনের জানলা থেকে এদের সঙ্গে দেখা হয়। খুব অল্পক্ষণের দেখা। হাত নাড়ার আগেই ফুরিয়ে যায়। মনে হয়, আহা, এখানে একটু নামতে পারলে বেশ হত। কখনওই সে সুযোগ হয় না। আজ আমার হয়েছে। এটা সেরকমই একটা ট্রেন না দাঁড়ানো স্টেশন। ইস, এতক্ষণ ট্রেনটা দাঁড়িয়ে রইল, আরও আগে যদি নেমে আসতাম। ওই গাছের তলায়, বেঞ্চে বসে থাকতাম। এখনই যদি ট্রেন ছেড়ে দেয় বড় আফশোসের হবে। আমাকে এখানে কিছুক্ষণ বসতে হবে। বসতেই হবে।

ছোট্ট এই স্টেশনে এত বড় ট্রেনটাকে একেবারেই মানাচ্ছে না। ট্রেনটা নিজেও যেন সেকথা বুঝতে পারছে! লজ্জা পেয়ে জড়সড় হয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি হাঁটতে শুরু করলাম। প্ল্যাটফর্ম জুড়ে আমার বড় বড় ছায়া পড়তে লাগল। জ্যোৎস্নার ছায়া।

এসি কোচগুলো যেন কোন দিকে?

তমাল বড় হাই তুলে বলল, ‘আর কতক্ষণ বসে থাকতে হবে?’

আমি হাত বাড়িয়ে বললাম, ‘একটা সিগারেট দে।’

তমাল পকেট হাতড়ে বলল, ‘প্যাকেটটা মনে হচ্ছে ট্রেনে ফেলে এসেছি। বললি না তো, আর কতক্ষণ বসে থাকতে হবে?’

‘আমি কী করে বলব? আমি কি ট্রেনের ড্রাইভার? তা ছাড়া, তোর কীসের তাড়া? কথায় বলে, ট্রেন ধরার তাড়া। সেই প্রবাদ এখানে খাটবে না। ট্রেন কয়েক হাত দূরেই দাঁড়িয়ে আছে। বলতে পারিস ধরেই আছি।’

তমাল বিরক্ত হয়ে বলল, ‘বাজে কথা বলিস না সাগর। এই রাত দুপুরে তোর নিচু স্তরের ঠাট্টা মোটেই ভাল লাগছে না। ইস, কতটা লেট হয়ে গেল! ভেবেছিলাম, পৌঁছে ব্রেকফাস্ট করব। এখন তো দেখছি, দুপুরের খাবার জুটলে হয়।’

আমি হাসলাম। বললাম, ‘গৃহত্যাগীর আবার ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ কীসের? আচ্ছা, তমাল এখানে থেকে গেলে কেমন হয়?’

‘এখানে! এই স্টেশনে? তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে সাগর।’

আমি আবার হাসলাম। বললাম, ‘ঠিকই বলেছিস। এরকম আকাশ ভরা চাঁদের আলোয় অচেনা একটা রেল স্টেশন আবিষ্কার করে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আমার মনে হচ্ছে, খুব শিগগিরই একটা পাগলামি করে বসব।’

তমাল আমার দিকে তাকাল। ওর মুখ খুব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। তবে নির্ঘাত ও ঘাবড়ে গেছে।

একটা-দুটো করে লোক ট্রেন থেকে নেমে আসছে। জানলাগুলোও খুলছে। ডাকাতের ভয় মনে হয় কেটেছে। তবে কেউই দরজা থেকে খুব বেশি দূরে যাচ্ছে না। হঠাৎ যদি গাড়ি ছেড়ে দেয়! কেউ কেউ আবার হাতল ধরে দাঁড়িয়েছে। ট্রেন ছেড়ে দিলে এখানে পড়ে না থাকি। সত্যি মানুষ পড়ে থাকতে কত ভয় পায়।

শুধু শিখা আর তার স্বামী আমাদের মতো খানিক দূরের একটা বেঞ্চে গিয়ে বসেছে। গাছের কতকগুলো ডাল নিচু হয়ে বেঞ্চটাকে ওদের জন্যই যেন একটু আড়াল করে রেখেছিল। আশ্চর্য! ওরা কি জানত? দুটো ছায়াকে মনে হচ্ছে, গাছেরই ডাল-পালা। সেই ছায়া অল্প অল্প নড়ছে। কী করছে ওরা? ওরা কি চুমু খাচ্ছে? খেলে ভাল করবে। এই চুমু সারাজীবন মনে থাকবে।

একটু আগে আমি বঙ্কা ঝঙ্কাকে ডাকতে গিয়েছিলাম। মাঝরাতে এমন একটা চমৎকার রেল স্টেশন দেখতে পেলে ওরা নিশ্চয় খুব খুশি হত। কিন্তু কামরায় উঠে দেখলাম, দু’জনেই ঘুমিয়ে কাদা। ধূর্জটিবাবু জেগে গেছেন। বসে রয়েছেন চুপ করে। অন্ধকারে, জানলার পাশে। ডাকতে গিয়েও আমি থমকে গেলাম। আজ ওঁর স্ত্রীর মৃত্যুদিন নয় তো? হতেও পারে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমি নিঃশব্দে নেমে এলাম।

টুথব্রাশ হাতে সেই লোকটা প্ল্যাটফর্মে নেমে এসেছে বটে, কিন্তু এখনও টুথব্রাশ ছাড়েনি। মাঝেমধ্যেই সে ট্রেনের এমুড়ো থেকে ওমুড়ো পর্যন্ত ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে। প্রথমটায় অবাকই হয়েছিলাম। একটু পরে বুঝতে পারলাম, লোকটা আসলে ট্রেন সংক্রান্ত খবরাখবর সংগ্রহ করছে। তারপর সেই খবর চিৎকার করে ঘোষণা করেছে। একেকবার এক-একরকম খবর। একবার ঘোষণা করল, ইঞ্জিন খারাপ। একবার জানাল, না ইঞ্জিন খারাপ নয়। সিগন্যাল খারাপ। পরেরবার হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল, ইঞ্জিন, সিগন্যাল সবই ঠিক আছে। লাইনম্যানকে পাওয়া যাচ্ছে না। শেষবারের খবর তো মারাত্মক। এক কিলোমিটার দূরে জঙ্গিরা সাতাশখানা ফিশপ্লেট খুলে ফেলেছে। কাল বিকেলের আগে ট্রেন ছাড়বার কোনও সম্ভাবনা নেই। ঘটনা শুনে কে একজন ট্রেনের ভেতর থেকে চেঁচিয়ে উঠল, ‘কেউ একটা হারামজাদাকে ধরে ট্রেন লাইনে ফেলে দিয়ে আয় তো। ফেলার আগে টুথব্রাশটা কেড়ে নিবি।’

তমাল বেঞ্চ থেকে উঠে অস্থিরভাবে পায়চারি করতে করতে বলল, ‘খুবই বিপজ্জনক পরিস্থিতি।’

আমি পা দুটো সামনে ছড়িয়ে দিয়ে বললাম, ‘বিপজ্জনক! বিপজ্জনক কোথায়? আমার তো দারুণ মজা লাগছে।’

‘মজা! রাতদুপুরে একটা অজানা স্টেশনে ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। এর মধ্যে তুই মজা কোথা থেকে পেলি সাগর?’

‘বাঃ, রাত না হলে এমন চমৎকার চাঁদের আলো পেতিস? রেল স্টেশনে চাঁদের আলো দেখা একটা বিরল অভিজ্ঞতা।’

‘রাখ তো চাঁদের আলো! আরও কিছুক্ষণ আটকে থাকলে ওসব আলো টালোর মজা বেরিয়ে যাবে।’

আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘তুইও পাবি। তুইও মজা পাবি।’

তমাল রাগে গোঁ গোঁ করতে করতে বলল, ‘একজনের জন্য আজ এই হাল হয়েছে। শুধু একজনের জন্য। তার জন্যই আজ আমি ঘর ছেড়েছি। তোর মতো একটা পাগলের সঙ্গে আজ রাত দুপুরে পথের মাঝখানে বসে গেলাস গেলাস চাঁদের আলো গিলছি।’

হাসি পাচ্ছে। হাসি চেপে বোকার মতো মুখ করে বললাম, ‘কার জন্য?’

তমাল আঙুল তুলে বলল, ‘খবরদার সাগর, ওই নাম মুখে আনবি না। তোর সঙ্গে কিন্তু শর্ত রয়েছে।’

আমি বেঞ্চের ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম। বললাম, ‘ঠিক আছে আনব না। তুই এখন যা তো। অনেক বকবক করেছিস। একটু ঘুমিয়ে নিই।’

‘সে কী, ঘুমোবি মানে! ট্রেন যদি ছেড়ে দেয়। সাগর, সবসময় রসিকতা মানায় না। ঘুমোতে হলে ট্রেনে উঠে ঘুমোও।’ আমি পাত্তা না দিয়ে বললাম, ‘আঃ কতদিন গাছের তলায় ঘুমোইনি। শুধু কি গাছ? গাছের সঙ্গে আবার ঠান্ডা হাওয়া। তুইও ওদিকের বেঞ্চটায় শুয়ে পড় না তমাল। দেখবি মাথা ঠান্ডা হয়ে যাবে। গুনগুন করে গান ধরবি।’

তমাল শুল না, আবার গেলও না। উলটোদিকে মাথার কাছে বসে রইল। বসে বিড়বিড় করতে লাগল। মনে হয়, ছন্দার সঙ্গে ঝগড়া করছে। তিনদিন ধরে দেখছি ও এই কাণ্ড করছে। সুযোগ পেলেই মনে মনে ছন্দার সঙ্গে ঝগড়া করছে। করুক, যত খুশি করুক। রাতদুপুরে চাঁদের আলো মাখা গাছের তলায় বসে প্রেমিকের সঙ্গে ঝগড়া করলেও মন ভাল হয়ে যায়। তমালেরও হবে। বাকিটুকু আমি করে দেব। সেদিন খিদের সময়ে তমাল আমাকে খাইয়েছে। খাইয়েছে বড় কথা নয়। অনেকেই খাওয়ায়। কিন্তু অমন যত্ন করে? বুকের ভেতরে খিদের থেকেও তীব্র ভালবাসা না থাকলে অমন যত্ন করে খাওয়ানো যায় না। তখনই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, ওর জন্য একটা কিছু করব। আমার মতো একটা বেকার, ফালতু ধরনের ছেলে কী বা করতে পারে? মন ভাল করে দেওয়া ছাড়া?

আমি গৃহত্যাগী তমালের মন ভাল করে দেব। খানিক আগেই সব ব্যবস্থা করে এসেছি। আমাদের সাধারণ কামরার মতো এসি কোচের টিকিট চেকার অন্ধকারে পালিয়ে যায়নি। তা ছাড়া, সেখানে আলো টালো সবই আছে। চেকার মানুষটা খারাপ নয়। রসবোধ আছে। আমি বললাম, ‘আপনাকে বলতাম না, দাদা। প্ল্যান অন্যরকম ছিল। যা ঘটবার কাল সকালেই ঘটত। কিন্তু এই স্টেশনটা দেখে মাথা খারাপ হয়ে গেছে। বিশ্বাস না হলে, আপনি একটিবারের জন্য নেমে দেখুন। আচ্ছা, নামতে হবে না। কান পাতলেই একটা শোঁ শোঁ আওয়াজ শুনতে পাবেন। বাঁধ ভাঙার আওয়াজ। বাইরে আজ চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে।’

কপালের ওপর চশমা তুলে মানুষটা বলল, ‘ভাইয়ের মনে হচ্ছে কবিতার অসুখ আছে। কাজটা বেআইনি হচ্ছে, তবে কবিতার আর আইনি বেআইনি কী? কলেজ জীবনে আমিও টুকটাক লিখতাম কিনা। ঠিক আছে, একটা ফাঁকা বার্থ ম্যানেজ করে দিচ্ছি।’

এই ভদ্রলোক আমাকে ট্রেনের খবরও দিয়েছে। চিন্তার কিছু নেই। দুটো স্টেশন আগে একটা মালগাড়ির ইঞ্জিন গড়বড় করেছে। ওয়াকিটকিতে খবর এসেছে, সারানোর কাজ প্রায় শেষ। ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই ট্রেন ছাড়বে।

আমি সেই সময়টার জন্যই অপেক্ষা করছি। বেশি দেরি নেই। সময় প্রায় হয়ে এসেছে। আমি কান খাড়া করে আছি। তমালকে আগে থেকে কিছু বুঝতে দেওয়া যাবে না। কোনওরকম আপত্তির সুযোগ পাবে না সে। ট্রেন হুইস্‌ল দিলেই ওর একটা হাত শক্ত করে ধরে ছুট লাগাব। তারপর ঠেলে এসি কোচে তুলে দিয়ে আসব।

ট্রেন ঘন ঘন হুইস্‌ল দিচ্ছে। এর মানে, এখনও যদি কেউ বাকি থাকো, উঠে এসো। উঠে এসো শিগগিরই।

আমি বসে আছি একা।

তমালকে নিয়ে আমাকে এসি কোচ পর্যন্ত যেতে হয়নি। তার আগেই ছন্দা নিজেই ওই কামরা থেকে নেমে আসে। চাঁদের আলোয় সে আমাদের সহজেই খুঁজে বের করে। তমাল ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। এত ঘাবড়ে যায় যে প্রথমটায় সে ছন্দাকে আপনি আপনি করে কথা বলতে শুরু করে—

‘আপনি! আপনি এখানে! আমি তো…।’

ছন্দা চাপা গলায় ধমকে উঠে বলে, ‘অনেক হয়েছে, নাটক আর ভাল লাগছে না। সারারাত কি তোমার জন্য জেগে বসে থাকব? চলো, শিগগিরই। ইস তোমার এই অপদার্থ বন্ধুটার জন্য একগাদা টাকা খরচ হয়ে গেল। নাও চলো, চলো।’

তমাল আরও ঘাবড়ে গিয়ে বলল, ‘যাব! কোথায় যাব?’

ছন্দা এবার এগিয়ে এসে তমালের হাত ধরল। গলা নামিয়ে বলল, ‘রাত দুপুরে আর পাগলামি করতে হবে না। চলো।’ তারপর আমার দিকে ফিরে কঠিন গলায় বলল, ‘এই যে মশাই, অনেক ঝামেলায় ফেলেছেন। বাকি পথটুকু বন্ধুর লাগেজটা দয়া করে একটু সামলে রাখবেন। কাল সকালে দেখা হবে।’

তমাল আমার দিকে তাকালই না। সেটাই স্বাভাবিক। বিশ্বাসঘাতকের দিকে কে তাকায়? তবে আমি ওদের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কুয়াশার মতো নীল আলোয় ছায়া তৈরি করতে করতে ওরা এসি কোচের দিকে হেঁটে চলে যাচ্ছে। ইস, একটা ভাল চাকরি হাতছাড়া হয়ে গেল। তা যাক। ওরা হাঁটছে হাত ধরাধরি করে। খুব ভাগ্য না করলে এমন দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায় না।

আর কেউ বাকি নেই। সবাই উঠে পড়েছে। জনমানব শূন্য রেল স্টেশন ফের ভেসে যাচ্ছে রহস্যময় চাঁদের আলোয়। ট্রেন হুইস্‌ল দিচ্ছে। শেষ হুইস্‌ল। একটু যেন নড়েও উঠল।

আমি কী করব? চলে যাব? নাকি থেকে যাব এই জ্যোৎস্নার রেল স্টেশনে?

সানন্দা পুস্পাঞ্জলি, ২০০৫

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *