জ্যোৎস্নায় সুবর্ণরেখার ধারে
একেকটা নদীকে আমরা নানান অঞ্চলে দেখি। সেসব জায়গায় নদীর পটভূমিকা বদলে বদলে যায়।
এমন বেশকিছু মানুষ আছেন, যাঁরা গঙ্গা নদীকে দেখেছেন একেবারে উৎসে, গোমুখ গঙ্গোত্রীতে, আবার একেবারে গঙ্গাসাগর মোহনায়। আমার অবশ্য হিমালয়ের সেই উৎসমুখে গঙ্গাকে এখনও দেখা হয়নি, প্রথম দর্শন হৃষীকেশ-হরিদ্বারে। মাঝখানে কালী বা ভাগলপুরে কিংবা রাজমহলেও দেখেছি বেশ কয়েকবার, মোহনায় মেলার সময় ছাড়াও অন্য ঋতুতে। যখন। বিশেষ কেউ যায় না, তখনও একাধিকবার রাত্রিবাস করেছি।
সেইরকম সুবর্ণরেখা নদীটিও দেখেছি নানান বয়েসে, নানান অঞ্চলে। খুব চমৎকার চমক্কার স্মৃতি আছে।
সুবর্ণরেখা নদীটি বাংলা সাহিত্যে সুপরিচিত। এককালে অনেক গল্প-উপন্যাস লেখা হয়েছে ঘাটশিলার পটভূমিকায়। সেখানে ছিল প্রচুর বাঙালির নিবাস, আর ভ্রমণপিপাসু বাঙালিরাও কাছাকাছির মধ্যে চলে যেতেন ঘাটশিলা, মধুপুর, গিরিডি ইত্যাদি অঞ্চলে। সুতরাং গল্প উপন্যাসেও এইসব জায়গাগুলি এসে যেত। সুবর্ণরেখা নদী আমি ঘাটশিলায় দেখেছি নানা ঋতুতে। নামটি যেমন সুন্দর, একমাত্র বর্ষাকাল ছাড়া অন্য সময় নদীটি কিন্তু তেমন সুদৃশ্য নয়। জল কমে গিয়ে বড়-বড় পাথর জেগে ওঠে। অবশ্য তারও সৌন্দর্য আছে। কিন্তু তা সুবর্ণরেখা নামটির সঙ্গে মানায় না। বর্ষার সময়ই শুধু এই নদীর অন্য একটা রূপ খোলে। তখন মনে হয় এই নদীর তটরেখায় সত্যিই যেন ছড়িয়ে আছে স্বর্ণরেণু।
বাঙালিদের প্রিয় হলেও সুবর্ণরেখা ঠিক বাংলার নদী নয়। প্রধানত বিহার ও ওড়িশার। মেদিনীপুরের সীমান্তে সামান্য একটু ছুঁয়ে গেছে। সেখানেই আছে হাতিবাড়ির ডাকবাংলো। সেখানকার কথা বলার আগে, জামশেদপুরের এক সন্ধ্যার অভিজ্ঞতা আমার স্মৃতিতে চিরকালীন হয়ে আছে।
জামশেদপুরের বাঙালিদের উদ্যোগে সেবারে একটি খুব বড় আকারের বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির উৎসব হয়েছিল তিনদিন ধরে। অনেককাল আগের কথা, তবু বছরটি আমার মনে আছে দুটি কারণে। ১৯৬২ সাল, সেই বছরেই হিন্দি-চিনি ভাই ভাই স্লোগানের এবং বিশ্বাসের ওপর একটা বড় আঘাত লেগেছিল, অকস্মাৎ শুরু হয়েছিল চিন-ভারত যুদ্ধ। তাতে অনেকেরই স্বপ্নভঙ্গ হয়। আর, সেই বছরেই ১ জুলাই পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় মারা যান। ওইদিনই তাঁর জন্মদিন। তখনই আমরা ছিলাম জামশেদপুরে।
এই উৎসবে কলকাতা থেকে আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলেন বহু কবি, লেখক, শিল্প, নাট্যকার বুদ্ধিজীবী। বিরাট একটি দল। সেই সময় কলকাতায় এসেছিলেন বিশ্ববিখ্যাত কবি অ্যালেন গিনসবার্গ ও তাঁর সঙ্গী পিটার অরলভস্কি। অ্যালেনের সঙ্গে কলকাতার কফিহাউসে, গঙ্গার ঘাটে ও আরও অনেক জায়গায় আড্ডা দিতাম রোজই। আমরা জামশেদপুরে কয়েকদিনের জন্য যাচ্ছি শুনে অ্যালেন কৌতূহলী হয়েছিল। তখন আমি বলেছিলাম, ‘তোমরা দুজনেও চলো আমাদের সঙ্গে। ওখানকার সেক্রেটারির সঙ্গে আমার চেনা আছে। তাকে বলে দেব!’
পরে বুঝেছিলাম। ওভাবে অ্যালেনকে নিয়ে যাওয়া আমার খুবই ভুল হয়েছিল। সে একজন বহু আলোচিত, একইসঙ্গে কুখ্যাত এবং সুখ্যাত কবি, তার ‘হাউল’ নামের কাব্যগ্রন্থ এক মাসে এক লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছে, তাকে কোনও সাহিত্যসভায় নিয়ে যেতে হলে বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানানো উচিত। রবাহুত হয়ে উপস্থিত হওয়া তার পক্ষে একেবারেই মানায় না।
সেখানে অ্যালেন ও পিটারের প্রতি বেশ খারাপ ব্যবহার করা হয়েছিল। তখন বইছে উল্কট অতি বামপন্থী হাওয়া। যারা তথাকথিত ‘প্রগতিশীল’, তারা যে-কোনও আমেরিকানকেই মনে করে শত্রু, আর এখানকার কারুর যদি কোনও আমেরিকান বন্ধু থাকে, তবে সে সি আই এর চর। জামশেদপুরের উদ্যোক্তারা অ্যালেন গিনসবার্গের কোনও কবিতা পড়েনি, তারা জানে না যে এই আমেরিকান কবি আমেরিকার রাষ্ট্রশক্তির ঘোর সমালোচক। সে একজন শ্বেতাঙ্গ এবং আমেরিকান, সেটাই যেন শুধু তার পরিচয় আর সেটাই তার অপরাধ।
অ্যালেন অবশ্য তার প্রতি দুর্ব্যবহারের কোনও প্রতিবাদ করেনি, মুখ বুজে সব সহ্য করেছে আমাদের কথা ভেবে। কিন্তু আমি অপরাধবোধে ভুগছিলাম এবং অন্য প্রসঙ্গে সম্মেলনের মধ্যে খুব রাগারাগি করেছিলাম মনে আছে। যাই হোক, সে প্রসঙ্গ থাক।
একটা গাড়ি জোগাড় করে আমরা কয়েকজন বেড়াতে গিয়েছিলাম এদিক ওদিক। একসময় আমরা এক জায়গায়, জঙ্গলের মধ্যে হঠাৎ দেখতে পেলাম সুবর্ণরেখা নদী। স্থানটি খুব নির্জন, আমাদের দলটি ছাড়া আর কেউ নেই। নদীর ওপারে তখন সুর্যাস্ত।
অসংখ্য সোনালি রশ্মি আকাশ থেকে নেমে এসে মিশেছে সেই নদীর তরঙ্গে। ধীরভাবে ডানা দুলিয়ে উড়ে যাচ্ছে বকের ঝাঁক। দৃশ্যটি অপ্রত্যাশিতভাবে সুন্দর।
একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর অ্যালেন আমাকে জিগ্যেস করল, ‘নদীতে নামবে না?’
শুনে বেশ অবাক হলাম। সন্ধেবেলা জলে নামার কথা আমাদের মনে আসে না। সঙ্গে আলাদা। জামাকাপড় আনিনি, মাথা মোছার জন্য তোয়ালে নেই।
সে কথা অ্যালেনকে জানাতেই সে বেশ সহজভাবে বলল, ‘জামা-প্যান্ট এখানে খুলে রাখো।’
তার মানে কি উলঙ্গ হয়ে? আমাদের দলে রয়েছেন একজন রমণী। কবিতা সিংহ, তাঁর সামনে ওসব করা যায়? তা ছাড়া এখন জলে নামতেই হবে কেন?
আমাদের আপত্তির কথা জেনে অ্যালেন আর পিটারের চোখে-চোখে কিছু কথা হল। তারপর ওরা পায়েপায়ে এগিয়ে গেল নদীর দিকে।
দুজনেরই পরনে সাধারণ প্যান্ট-শার্ট আর চটি। শুধু চটি খুলে ওরা নেমে গেল জলে। মাঝনদীতে গিয়ে সাঁতার কাটল কিছুক্ষণ। আমরা তীরে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম।
খানিকবাদে দুজন ওপরে উঠে এল।
অ্যালেন বলল, ‘চমৎকার নদী।’ পিটার বলল, ‘ভারী স্বচ্ছ আর হালকা জল।’
অ্যালেন বলল, ‘ভারতীয় সভ্যতা আর আমাদের এটাই তফাত। তোমরা দূরে দাঁড়িয়ে, শুধু চোখ দিয়ে একটা নদীর শোভা উপভোগ করতে পারো। আর আমাদের জলে নেমে, সারা শরীর দিয়ে সেই নদীকে চিনতে হয়।’
সেই জবজবে ভিজে পোশাক নিয়েই ওরা ফেরার জন্য প্রস্তুত। আমরা ভাবছি, ওদের ঠান্ডা লেগে অসুখ করে যাবে। ওরা বলছে, কিচ্ছু হবে না।
কবিতা সিংহ তখন বললেন, ‘আমি উলটো দিকে ফিরে দাঁড়াচ্ছি। তোমরা ওই ঝোঁপের আড়ালে গিয়ে জামা-প্যান্ট খুলে একবার অন্তত ভালো করে নিংড়ে নাও। প্লিজ!’
তাই-ই করল ওরা।
আবার ফিরে আসতেই কবিতা সিংহ নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে ওদের মাথা মুছিয়ে দিলেন।
অ্যালেন বলল, ‘আমাদের দেশে এরকম কেউ দেয় না। এটাও ভারতীয় সভ্যতা!’
এবার হাতিবাড়ির কথা। হাতিবাড়ি ডাকবাংলোর কথা প্রথম আমাদের জানায় ইন্দ্রনাথ। ইন্দ্রনাথ মজুমদার।
এই ইন্দ্রনাথের সুবর্ণরেখা নদীর প্রতি এমনই প্রীতি যে নিজের বইয়ের দোকান ও প্রকাশনীর নামও দিয়েছে সুবর্ণরেখা। কলেজ স্ট্রিটে আর শান্তিনিকেতন, এই দুজায়গায় আছে তার সুবর্ণরেখা দোকান।
দুর্লভ বই আর বিশিষ্ট ধরনের প্রকাশনা নিয়ে সারাজীবন কাটালেও ইন্দ্রনাথ আবার প্রচণ্ড খাদ্যরসিক। কোথায় কোন বিশেষ স্বাদের খাবার পাওয়া যায়, এসব তার নখদর্পণে। একবার ওড়িশার পুরী থেকে কোনারকে যাওয়ার পথে ইন্দ্রনাথ হঠাৎ মাঝপথে আমাদের তাড়া দিয়ে বলল, ‘ নেমে পড়ো, শিগগির নেমে পড়ো’–
‘কেন?’
সেই অখ্যাত জায়গায় নাকি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ তেলেভাজা আলুর চপ পাওয়া যায়!
বালেশ্বরের একটা ছোট্ট হোটেলে যেমন কচি পাঁঠার ঝোল হয়, তার নাকি তুলনা নেই। তা চেখে দেখতে চলে গেছি বালেশ্বরে। এইরকম খাদ্য অভিযানে আমরা কয়েক বন্ধু ইন্দ্রনাথের সঙ্গে গেছি অনেক জায়গায়। যেমন গেছি বহু প্রাচীন দুর্লভ বইয়ের সন্ধানে।
ইন্দ্রনাথ একবার বলল, ‘বাংলা ও ওড়িশার সীমান্তে হাতিবাড়ি নামে জায়গায় একটি বাংলো আছে, সে একেবারে অপূর্ব!’ কেন সেই বাংলোবাড়ির অপূর্বত্ত্ব? সুবর্ণরেখা নদীর ধারে অতি নির্জন পরিবেশ, কিন্তু ইন্দ্রনাথের প্রকৃতিপ্রেম তেমন বেশি নয়। আসল কারণ ওখানে সুবর্ণরেখা নদীতে বড় বড় চিতলমাছ পাওয়া যায় এবং বাংলোর কুক চিতলমাছ এমন রান্না করে, তার আর জবাব নেই।
হাইওয়ে দিয়ে গিয়ে ঝাড়গ্রামের রাস্তাটা পাশ কাটিয়ে কিছুক্ষণ যাওয়ার পর বাঁদিকে ওড়িশার দিকে বেঁকলে পৌঁছনো যায় হাতিবাড়ি।
বাংলোটি তখন নতুন তৈরি হচ্ছে। কিছু কিছু কাজ বাকি আছে। মিস্ত্রিরা খাটছে। আশপাশে আর কোনও বাড়ি নেই এবং সত্যিই খুব কাছে সুবর্ণরেখা নদী। বড়-বড় পাথরের খাতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীতে বেশ জল আছে। এই নদীতে বড় মাছ থাকা অসম্ভব কিছুনয়।
অল্প বয়েস থেকেই আমার বিভিন্ন বাংলোতে ঘোরাঘুরির নেশা। অনেকে যেমন স্ট্যাম্প জমায়, আমি তেমনই ডাকবাংলোর অভিজ্ঞতা জমিয়েছি। প্রত্যেকটি বাংলোরই অবস্থান ও ব্যবহারের কিছু না কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। আবার কিছু কিছু বাংলোতে বারবার আসতে ইচ্ছে হয়, অবশ্য অধিকাংশ জায়গাতেই ফেরা হয় না। অনেক বছর পর সেরকম কোনও একটিতে ফিরে গেলেও আশাভঙ্গ হতে পারে। একসময় যেটি ছিল নিরিবিলি নির্জন, সেখানে হয়তো অনেক বাড়িঘর গজিয়ে গেছে! একবার রূপনারায়ণ নদীর ধারে একটি আকর্ষণীয় একতলা বাংলোটি দোতলা হয়ে গেছে আর নীচের তলায় একটা সরকারি অফিস হয়েছে দেখে খুবই মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল।
হাতিবাড়িতে কখনও হাতি আসে কি না জানি না, তবে বাংলোটি বেশ উপভোগ্য। দুপুরবেলা পৌঁছে প্রথমেই আমরা নদীটি দেখতে গেলাম। ওপর থেকে নেমে যেতে হয় অনেকখানি।
কিছুক্ষণ পরেই যে যার কাজে লেগে পড়ল। ইন্দ্রনাথ গেল চিতলমাছ জোগাড় করতে আর শক্তি গেল মহুয়া কিংবা হাঁড়িয়ার খোঁজে।
অনেক চেষ্টা করেও চিতলমাছ অবশ্য পাওয়া গেল না। ইন্দ্রনাথ সত্যিই আগেরবার এসে চিতলমাছ খেয়েছিল কি না তা নিয়ে আমাদের মধ্যে কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করলেও আমি ইন্দ্রনাথের সমর্থনে বললাম, নদীর একটা বিশেষ বাঁকে প্রতিদিন চিতলমাছ আসবেই, তার কি কোনও গ্যারান্টি আছে? চিতলমাছেরাও বোধহয় রোজ রোজ ধরা দিতে চায় না।
সুতরাং মাছের বদলে মুরগি। মুরগি তখনও এত অখাদ্য হয়নি, অর্থাৎ পোলট্রির মুরগি সর্বত্র ছড়ায়নি। দেশি মুরগিও পাওয়া যেত। রান্নায় বেশ স্বাদ হয়েছিল।
শক্তি ঠিকই জোগাড় করে এনেছিল মহুয়া।
এ ব্যাপারে শক্তির কৃতিত্ব অসাধারণ। বাংলা-বিহার ওড়িশার এমন কোনও জায়গা নেই যেখানে গেলে শক্তি আধঘণ্টার মধ্যে কিছু না কিছু মদ্য সংগ্রহ করতে পারবে না। অনেক সময় শক্তি গর্ব করে বলত, ‘আমি মাটিতে পা ঠুকলে মাটি খুঁড়ে মদের ফোয়ারা উঠবে।’ অর্থাৎ সে অর্জুনের সমতুল্য।
মহুয়ার অল্প নেশায় ও আড্ডায় চমৎকার কাটতে লাগল সময়। আমাদের খুশি করার জন্যই যেন সন্ধের খানিকটা পরে মেঘে ভেঙে বেরিয়ে এল চাঁদ। চারদিক ফটফট করতে লাগল জ্যোৎস্নায়।
এমন জ্যোৎস্নায় ঘরের মধ্যে বসে থেকে লাভ কী?
তখন রব উঠল, ‘চলো যাই নদীর ধারে।’
বড়-বড় পাথরের ওপর বসা যায়। নদী এখন রুপোলি স্রোত। কোনও শব্দ নেই।
সেই নদী দেখে কারুর মনে গান আসে, কারুর মনে অন্য চিন্তা।
ইন্দ্রনাথ বলল, এই সময়টা নিশ্চয়ই এখানে চিতলমাছ আসে। কোনও একটা জেলেকে যদি ডেকে আনা যেত।
আমরা হেসে উঠলাম। চিতলমাছের মোহ তখন আমাদের মন থেকে ঘুচে গেছে। বরং নদী ও জ্যোৎস্না বিষয়ে কে কটা গান জানে, শুরু হল তার প্রতিযোগিতা।
রবীন্দ্রনাথ নদী এবং জ্যোৎস্না, এই দুটি বিষয়েই অকৃপণ। এখানে যত ইচ্ছে চিৎকার করে গান গাওয়া যায়।
অনেকগুলি গানের পর শক্তি আমাকে বলল, ‘চলো, জলের ধারে যাই।’
নীচে নেমে গিয়ে জলে পা ডোবাবার পর আমার মনে পড়ল অ্যালেন গিনসবার্গের সেই কথা।
এতক্ষণ আমরা নদীকে অনেক গান শুনিয়েছি। এবার শুরু হোক না উপভোগের দ্বিতীয় পর্ব। অবগাহন।
এবারে আমাদের দলে কোনও মহিলা সদস্য নেই। সুতরাং আব্রুর প্রশ্নও নেই। জামা-প্যান্ট অনায়াসে খুলে ফেলা যায়। জ্যোৎস্নার মধ্যে পুরুষের নগ্নতাও অন্য রূপ পায়।
সুবর্ণরেখা খরস্রোতা নয়। কুমির-টুমির কিছু নেই। সুতরাং বিপদের সম্ভবনাও কিছু ছিল না। আমরা সবাই সাঁতার জানি। শুধু পাথরে ধাক্কা খাওয়ার সম্ভাবনা ছিল, সেরকম কিছুও হয়নি। সেই জ্যোৎস্নায় জলের সঙ্গে খেলা চলেছিল অনেকক্ষণ।
বিপদের সম্ভাবনা ছিল অন্য একবার কোনারকে।
কোনারকের বিচে এমনিই স্নান করা বিপজ্জনক, তাও আমরা গিয়েছিলাম মধ্যরাত্রে, কিঞ্চিৎ নেশার ঝোঁকে। কথা নেই বার্তা নেই, বেলাল চৌধুরী নেমে পড়েছিল জলে। তার দেখাদেখি শক্তি আর ইন্দ্রনাথও। আমি ওদের বারণ করতে লাগলাম বারবার।
তার কিছুদিন আগেই ‘জস’ সিনেমাটা দেখেছি। আরও নানান জায়গায় পড়েছি, রাত্তিরবেলা সমুদ্রস্নান একেবারেই উচিত নয়। রাত্তিরে হাঙরগুলো তীরের কাছাকাছি চলে আসে।
বন্ধুরা কেউ আমার নিষেধ মানল না। সুতরাং আমি আর একলা ওপরে দাঁড়িয়ে কাপুরুষ হয়ে থাকি কী করে? আমাকেও পোশাক খুলে নামতে হল। যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি অন্যদের তাড়িয়ে তাড়িয়ে উঠিয়ে আনলাম ওপরে। কোনও বিপদই ঘটেনি।
পরদিন সকালে আবার সেখান এসেছি মাছের খোঁজে। দেখি যে, ভালো মাছ বিশেষ কিছু ওঠেনি, কিন্তু উঠেছে ছ’ঝুড়ি হাঙরের বাচ্চা! বড় হাঙরগুলো যে কেন আগের রাত্রে আমাদের দয়া করেছিল, তা কে জানে!