1 of 2

জ্যোৎস্নায়

জ্যোৎস্নায়

বিলেত থেকে মোট দেড়খানা চিঠি লিখতে পেরেছিল লেবু। আর সময় পায়নি। মদ সেখানে বেজায় সস্তা, আর ভারী ভালো। অফিসের সময়টুকু বাদ রেখে বাদবাকি সময় লেবু লন্ডনের নালায় নর্দমায় পড়ে থাকে, সাহেবরা বড় বিপদে আছে তাকে নিয়ে।

এ খবর জানিয়েছে ডাক্তারের ভাইঝি–জামাই নৃপেন, তার কাছেই থাকে লেবু। থাকে মানে ওই আর কি থাকার কথা, আসলে তো থাকে ফুটপাথেই।

চিঠি পেয়ে ভারী রেগে যায় ডাক্তার। রুগিভরা চেম্বার ছেড়েই উঠে আসে ভিতর বাড়িতে, দুই বউকে ডেকে হেঁকে বলে–এই দ্যাখো তোমাদের দেওরের কাণ্ডটা দ্যাখো। বলে নৃপেনের লেখা এয়ারোগ্রামখানা তাদের দিকে  ছুঁড়ে দিয়ে আবার গোঁ–গোঁ করতে-করতে চেম্বারে গিয়ে ঢোকে।

দুই বউ আসলে দু-বোন। বড়টি সোনালি। বাঁজা। বিয়ের দশ বছর তক বাচ্চা না হওয়ায় স্বামীর পায়ে মাথা খুঁড়ে নিজের ছোট বোন রূপালিকে বিয়ে করিয়েছে। ভারী ভাব দুই বোনে, সতীনের কোঁদল নেই। রূপালি দুটো ছেলেমেয়ের মা। সোনালি বাচ্চাগুলো নিয়ে সারাদিন পড়ে থাকে। রূপালি হুটোপাটা করে কাজ সারে, গান গায়, সিনেমায় যায়। বাচ্চাদের সঙ্গে তেমন সম্পর্কই নেই। তাতে সোনালিই বেশি খুশি। বাচ্চারা কথা বলতে শিখতেই সে তাদের নিজেকে মা আর রূপালিকে ছোট মা ডাকতে শিখিয়েছে।

এয়ারোগ্রামখানা দুই বোনে পড়ে। লেবু সোনালির চেয়ে বয়সে ছোট, রূপালির চেয়ে বড়। সোনালি দেওরের জন্য চিন্তায় পড়ে। রূপালি গালে হাতে দিয়ে বলে–ওমা! বিলাতেও নালা নর্দমা আছে! বলে সে গুনগুন করে গান গাইতে-গাইতে নিজের কাজে উঠে যায়।

পেটের রোগে ডাক্তারের খুব হাতযশ। একটা খয়েরি রঙের ক্কাথ মতো ওষুধ দেয়, তাতেই খিদে বেড়ে রোগীরা চাঙ্গা হয়ে ওঠে। অনেকের সন্দেহ ডাক্তারের ওষুধে আফিঙ মেশানো আছে। তা হোক, চেম্বার তবু খালি যায় না। ইচ্ছে করলে আরও দুটো বউ মেনটেন করতে পারে।

‘ব্লাডি ড্রাঙ্কার্ড’ বিড়বিড় করে এই কথা বলে আবার চেম্বারে ঢোকে ডাক্তার। ভ্রূ কোঁচকানো, মুখ গম্ভীর। এমনিতে ডাক্তার ভারী হাসিখুশি গোলগাল শান্ত মানুষটি। গম্ভীর হলে থলথলে গাল দুটো কাঁপে, ঠোঁট নড়ে, তখন তাকে দেখলে হাসি সামলানো দায়। বিলেতটা সিভিলাইজড দেশ, সেখানে কত রকম গাড়ি–ঘোড়া চলে, আর সেখানে ল্যাবাবাবু রাস্তায়–ঘাটে পড়ে থাকে, অ্যাকসিডেন্ট হতে কতক্ষণ! তা ছাড়া দেশের প্রেস্টিজ বলেও একটা কথা আছে। সাহেবরা বাঙালিকে ভাববে কী? পুরো সকালটাই ডাক্তার গম্ভীর থাকে, গাল কাঁপে, ঠোঁট নড়ে।

বেলা এগারোটায় কল–এ বেরিয়ে চৌমাথায় হাতকাটা হরেন পাড়ুইকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লঝঝরে মোটর সাইকেলখানা থামায় ডাক্তার।

–হরেন, ব্ল্যাকিটার খবর জানিস?

ব্ল্যাকি বা ডার্টি নিগার, ব্লাডি ড্রাঙ্কার্ড কিংবা শুধু ল্যাবা একজনেরই নাম, ডাক্তারের দেওয়া। লোকটা লেবু।

–কী খবর দাদা? লেবু খুব টানছে?

–টানবে সে তো জানা কথা। বংশের ধাত। কিন্তু নিগারটা যে কাছা আলগা দিয়ে গিলছে। প্রেস্টিজ রাখল না।

–টানতেই তো গেছে।

–সাহেব সুবোরা এদেশে এসে মাতাল হয়, কখনও দেখেছিস? ডার্টি নিগারগুলোই ওদেশে গিয়ে মদ আর ইয়ের নামে হামলে পড়ে!

–সাহেব আর দেখলাম কোথায় দাদা! যখন আমাদের চোখ ফুটেছে, ততদিনে তোমরা যে দেশ থেকে সাহেব ফরসা করে দিয়েছ!

একটু খুশি হয় ডাক্তার। সে নিজে ঠিক স্বদেশি ছিল না বটে, কিন্তু একবার বিয়াল্লিশে পুলিশের সামনে বন্দেমাতরম বলে চেঁচিয়ে ছিল বলে তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়, পরদিন আদালতে কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আটকে রেখে ছেড়ে দেয়। সেই থেকে স্বদেশি বলে তার খুব নামডাক। তাম্রপত্র পাওয়ার কথাও উঠেছিল। পায়নি শেষ পর্যন্ত।

–সাহেব তাড়িয়েই খারাপ হল দেখছি। তারা থাকলে অন্তত তোরা সাহেবি মাতলামিটা শিখতে পারতিস।

–লেবু শিখে নেবে, সদ্য গেছে তো। ভেবো না।

একটু দুঃখের সঙ্গে ডাক্তার বলে–সে সব সাহেব কি আছে আর? এখন শুনি তারা সব কেত্তন করে, উলিঝুলি পোশাক পরে ভিখিরির মতো ঘোরে। যত সব ন্যাকরা। কলকাতায় যে–সব সাহেব আসে…হুঁঃ। বলে মোটর সাইকেল চালিয়ে দেয় ডাক্তার।

বিকেলে ডাক্তার ঘুড়ি ওড়ায়। শরতের আকাশ দেখলে ডাক্তার আর থাকতে পারে না। উপরন্তু লেবুর জন্য দুশ্চিন্তা আছেই। দুশিন্তা কি একটা? লেবুর রেশনকার্ড থেকে এখনও রেশন তোলা হচ্ছে। ডাক্তার বারণ করেছিল, কিন্তু বড় বউটা বড্ড টিকরমবাজ, বলে–সবার ঘরেই দু চারখানা বাড়তি কার্ড আছে। অন্যায়টা কী শুনি! এ এক দুশ্চিন্তা ডাক্তারের। তার ওপর আফিমের ব্যাপারটা খুব চাউর হয়ে গেছে। সেটা আর একটা পৃষ্ঠব্রণ। ঘুড়ি ওড়ালে মনটাও ওড়ে। বিকেলবেলাটায় গোটা পাঁচেক ঘুড়ি কেটে ডাক্তারের মন ভাল হয়ে গেল।

সন্ধের মুখে জটা এল। গায়ে র‍্যাপার। বিস্তর ভাইনাম গ্যালোসিয়া ফাঁক করেছে ডাক্তারের। আবারও চায় বুঝি, ভেবে মনে-মনে আঁতকে উঠেছিল ডাক্তার। পাড়ার মস্তানদের সর্দার–পোড়ো, আফিমের ব্যাপার কিংবা রেশন কার্ডের খবর সবই রাখে।

–কী ব্যাপার রে?

–মুরগি আনাও দাদা।

–কেন?

–কাল দুপুরের লোকালে কেষ্টনগরে ফ্লাই করছিলুম, আজ সকালে এসে ল্যান্ড করছি আবার। এক ওস্তাদ কেষ্টনগরে মৌরি থেকে মাল তৈরি করেছে। এক বোতল এনেছি তোমার জন্যই।

–বলে র‍্যাপারের তলা থেকে একটা মস্ত বোতল বের করে। ডাক্তার ভারী খুশি হয়ে পড়ে। বোতলের মুখ খুলে শুকে বলে–দিব্যি গন্ধ ছাড়ছে রে!

–মিঠে মাল দাদা। গোলাপি নেশা লেগে যায়। মাইরি, মুরগি আনাও।

ডাক্তার গম্ভীর হয়ে বলল –মাল ফাল আর ছুঁতে ইচ্ছে করে না। ল্যাবাটা ঘেন্না ধরিয়ে দিলে।

–সবই শুনেছি দাদা, লেবুটা তোমাদের ঘরানা পায়নি। তোমার বাপ দাদারা মাল খেত, আমার বাপ-দাদার কাছে শুনেছি। তারা কিছু কম খানেওয়ালা ছিল না। তারা মাল খেয়ে রাজা উজির সাজত, মুখে হাতিঘোড়া মারত, কু-বাক্যি বলা কি মারধর করা তাদের ধাতে ছিল না, রাস্তায় গড়ানো মাতালকে তারা ঘেন্না করেছে। কিন্তু লেবুটা? ছিঃ ছিঃ!

বংশ গৌরবে ডাক্তারের চোখ চিকচিক করছিল। একদৃষ্টে জটার মুখের দিকে চেয়ে কথাগুলো পান করল সে। তারপর নিশ্বাস ছেড়ে বলল –বাবাকে দেখেছি, চুরচুরে মাতাল অবস্থায় ঘোড়ার গাড়ি থেকে নামছেন। পাদানিতে পা ফেলেছেন ঠিক মতো, কোঁচানো ধুতি এদিক ওদিক হয়নি, সিল্কের পাঞ্জাবির পাট নষ্ট হয়নি, কাঁধে চাদরের পাটটি পর্যন্ত ঠিকঠাক আছে। দুটো চাকর গিয়ে দুবগলে কাঁধ দিয়ে দোতলায় পৌঁছে দিয়ে যেত। মাথা উঁচু করে চলাফেরাটা মাতাল অবস্থাতেও বজায় রেখেছিলেন। আর তাঁর ছেলে লেবুর মুখে কতবার রাস্তার কুকুর ইয়ে করে দিয়ে গেছে। কার ছেলে কোথায় নেমেছে দ্যাখ!

মুরগি এসে গেল। ফোঁড়া কাটার ছুরিটা বের করে ডাক্তার তার সাবেক কালের বাড়ির উঠোনে গিয়ে জোড়া মুরগি নিয়ে বসে। ছাড়াবে। উড়ুক্কু মাছের গল্প পড়তে-পড়তে উঠে এল মেয়েটা, ছেলেটা বাতাসের মুখে খবর পেয়ে খেলা ছেড়ে দৌড়ে আসে। বড়–বউ সোনালি এসে সাবধান করে পেটে ডিম থাকলে মেরো না কিন্তু।

ডাক্তার লাল–চোখে চায়। আধ বোতল মৌরীর মাল ফাঁক করে গেছে ইতিমধ্যে। পান–জরদা অ্যালকোহলের গন্ধ ছেড়ে ডাক্তার বলে–পেটের ভিতরকার ডিম আন–ফার্টিলাইজড, খেলে। শরীরে টক্সিন ডিপোজিট কম হয়। যা জানোনা, তা নিয়ে কথা বলা কেন?

–তুমি বাপু বড্ড নির্দয় মানুষ। বলে বড়-বউ সরে যায়।

মেয়েটা ওই রকম ডিম ভালোবাসে। ডাক্তার একটা মুরগির পেট থেকে সাবধানে দুর্লভ ডিমসুদ্ধ থলি বের করে। মেয়েটা আনন্দে চেঁচায়।

জটা পাড়ায় খবরটা ছড়িয়েই এসেছিল। মুরগি কষা হতে না হতে পাড়ার মস্তান–মুরিব্বি দু চারজন এসে গেল। মৌরির মাল ততক্ষণে ফরসা। অগত্যা ডাক্তার তার নিজের স্টক বের করে। দুর্লভ জিনিস। বিলেত থেকে দেড়খানার বেশি চিঠি পাঠায়নি লেবু, কিন্তু চার-পাঁচ কিস্তিতে কয়েকজন ঘরে ফেরা বাঙালির সঙ্গে পাঠিয়েছে, স্কচ হুইস্কি, রাম, এক বোতল শ্যাম্পেন। লোকে কলম, রেডিও, ঘড়ি পাঠায়, লেবু সে-সবের ধার দিয়েও যায়নি। ল্যাবাটার দূরদৃষ্টি খুব। সমঝদার ছেলে। মাইফেলটা জমে গেল খুব। জটা আর তার সাকরেদরা বিদায় নিল ইংরিজি তারিখ পেরিয়ে। সামনের মহল থেকে ভিতর মহল পর্যন্ত দোতলায় একটা ঝুলবারান্দা আছে, অনেকটা পোলের মতো। সেটা ধরে ভিতরে মহলে ফিরবার সময়ে ডাক্তার দেখে, ভারী ভালো জ্যোৎস্নায় মাখামাখি হয়ে আছে বারান্দাটা। রেলিঙের ছায়ায় নানা নক্সা। তারই মধ্যে ডাক্তারের ছায়াটা টলতে-টলতে যাচ্ছে। ভারী লজ্জা পায় ডাক্তার। জিভ কাটে। ধমক মারে–’অ্যাও!’ ছায়াটা ভয় পেয়ে স্টেডি। হয়ে যায়। রেলিঙে ভর রেখে সাবধানে হাঁটে ডাক্তার! ছায়াটা নাটলে আবার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *