জ্যোতিষী
একযুগ আগে, সেই কাণ্ডজ্ঞানের আমলে কিছু না বুঝে সরলভাবে জ্যোতিষী ও জ্যোতিষ বিষয়ে হালকা কথা লিখে ঘোরতর বিপদে পড়েছিলাম।
সেই রাজার কথা কি মনে আছে, যাঁর গল্প কোথা থেকে টুকে যেন লিখেছিলাম। গল্পটা তেমন বড় নয়, যাঁরা আগে পড়েননি, যাঁরা বোধহয় পড়েছিলেন কিন্তু এখন ভুলে গেছেন, তাঁদের সকলের জন্যে গল্পটা আরেকবার বলা চলে।
এক যে ছিল রাজা। রাজা চমৎকার রাজত্ব করছিলেন মনের সুখে, আনন্দ মনে। সকালে রাজসভা, পাত্র-মিত্র, অমাত্য, নর্তকী। দুপুরে ভুরিভোজন ও দিবানিদ্রা। সন্ধ্যায় বয়স্য ও মোসাহেবদের সঙ্গে প্রাণ ভরে সুরাপান এবং সেই সঙ্গে নাচগান।
এর মধ্যে একদিন সকালবেলায় রাজসভায় এক জ্যোতিষী এসে উপস্থিত। গণকঠাকুরের কাঁধে নামাবলি, কপালে চন্দনের তিলক, মাথায় জবাফুল বাঁধা টিকি, হাতে লাল খেরোয় বাঁধানো গণনার খাতা, পায়ে কাঠের খড়ম। রাজসভার সকলেই তাঁকে দেখে রীতিমতো অভিভূত হয়ে গেল। জ্যোতিষঠাকুরকে সবাই খুব সমীহ-সম্ভ্রম করতে লাগল।
মুখে মুখে রটে গেল যে ইনি ত্রিকালজ্ঞ জ্যোতিষী। মানুষের হাত দেখে তার ভূত-ভবিষ্যত-বর্তমান ঝরঝর করে বলে দিতে পারেন। অতীত বা বর্তমানের কথা না হয় বলেই দেওয়া গেল, গণকঠাকুরের ভবিষ্যৎবাণী অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায়।
বলা বাহুল্য, রাজামশায়ের হাতও জ্যোতিষঠাকুর দেখলেন। লাল খেরোর খাতা খুলে অনেক আঁকিবুকি, কাটাকুটি করলেন। ক্রমশ জ্যোতিষঠাকুরের মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল, তাঁকে খুবই চিন্তান্বিত দেখাল।
উৎকণ্ঠিত রাজামশায় জানতে চাইলেন, ‘কী হল, গণকঠাকুর মশায়? কোনও খারাপ কিছু দেখলেন নাকি? কোনও দুর্ভাবনার কারণ আছে ?’
‘আর খারাপ! আর-দুর্ভাবনা!’ সজোরে নিজের কপাল চাপড়ালেন গণকঠাকুর, তারপর একেবারে ডুকরে উঠলেন, ‘সর্বনাশ শিয়রে এসে পড়েছে। যাকে বলে সেই শিরে সংক্রান্তি।
এর পরে শুধু রাজামশায় কেন, মন্ত্রী, সেনাপতি, অমাত্য, সভাসদ সবাই হাহাকার করে উঠলেন, সকলের মুখেই শুধু এক প্রশ্ন, ‘হাতে কী দেখলেন, কী এত মারাত্মক ব্যাপার হয়েছে।’
সবাইকে থামিয়ে দিয়ে গণঠাকুর বললেন, ‘রাজামশায়ের ভয়ংকর শনির দশা চলছে। একটা কিছু প্রতিবিধান না করলে, অবিলম্বে কোনও ব্যবস্থা না নিলে, কয়েকদিনের মধ্যে রাজামশায়ের মৃত্যু অনিবার্য।’
এই ভবিষ্যৎদ্বাণী শুনে রাজসভার সকলের মুখ সাদা হয়ে গেল। রাজামশায় নিজে ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলেন। শুধু তরুণ সেনাপতির মনে কেমন যেন একটু খটকা লাগল, এই একটু আগেই রাজামশায় চমৎকার সুস্থ, সতেজ, হাসিখুশি ছিলেন আর এই গণক খেরোর খাতা খুলে কী কী হিসেব করল, রাজামশায় তাতেই এত ঘাবড়িয়ে গেলেন!
তরুণ সেনাপতি গণকঠাকুরের কাছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আচ্ছা গণকঠাকুর, আপনি কি নিশ্চিত যে আপনার বিচার সঠিক, আপনার গণনা নির্ভুল ?’
এই প্রশ্ন শুনে গণকঠাকুর হেসে ফেললেন, তারপর বললেন, ‘সেনাপতিমশায়, আপনার বয়েস কম, আপনি অনভিজ্ঞ, তাই জানেন না জ্যোতিষ গণনা কখনওই ভুল হয় না। আমি যা বলছি, তা অভ্রান্ত।’
সেনাপতি তখন জ্যোতিষীকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আচ্ছা, আপনি কি নিজের ভাগ্য কখনও গণনা করেছেন?’ জ্যোতিষী প্রত্যয়ের সঙ্গে বললেন, ‘অবশ্যই।’
সেনাপতি প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি হিসেব করে দেখেছেন আপনার পরমায়ু আর কত দিন ?’
জ্যোতিষী বললেন, ‘সে আরও চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর। আপনার চেয়ে বেশি বাঁচব।’
জ্যোতিষীর কথা শোনামাত্র সেনাপতি তাঁর কোমরের খাপ থেকে তীক্ষ্ণ তরবারি বের করে এক কোপে জ্যোতিষীর গলা কেটে ফেললেন। রাজসভার গালিচায় ধড় থেকে মুণ্ড বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে গেল। বীভৎস রক্তারক্তি কাণ্ড, স্তম্ভিত রাজা বললেন, ‘সর্বনাশ! এটা কী হল। আমার ব্রহ্মহত্যা হল।’
সেনাপতি বললেন, ‘হুজুর, আমাকে ক্ষমা করবেন। জ্যোতিষঠাকুর বলেছিলেন, আপনার আয়ু আর নেই। আর তাঁর নিজের পরমায়ু আরও চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর। দেখলেন তো তাঁর আয়ু এক মুহূর্তও ছিল না। যিনি নিজের আয়ু জানেন না, তিনি অন্যের ভাগ্য, অন্যের আয়ু কী করে বিচার করেন ?’
জ্যোতিষীর দ্বিখণ্ডিত মৃতদেহ সভাসদেরা ধরাধরি করে বাইরে নিয়ে গেলেন। রক্তমাখা গালিচাটা ফেলে দিতে হল।
রাজামশায়ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হলেন।