জ্যান্ত কবর
হ্যাম্পস্টিডের ওয়াল ওয়াক-এর বেশ কাছেই তিনতলা একটা বাড়ি। চারপাশে বেশ কতকটা জায়গায় আর কোন অট্টালিকা নেই। এটি, ‘দ্য ডিকনস’ নামেও পরিচিত। ভুতুড়ে বলে বাড়িটির বদনাম আছে বহু আগে থেকে। অনেক লোকই এর শিকার হয়েছেন। তবে এদের মধ্যে এক অধ্যাপক এবং এক লেখকের অভিজ্ঞতাটাই সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ও লোমহর্ষক। একটা গবেষণার প্রয়োজনে একরাত একসঙ্গে এখানে কাটান দু’জনে। লেখকের বর্ণনাতেই তাঁদের সে রাতের অভিজ্ঞতা তুলে ধরছি।
আমাদের অভিযান শুরু করি একতলার পেছনের এক কামরা থেকে, রাত দশটার দিকে। তবে এখানে অনুসন্ধান চালানোর জন্য বাড়ির মালিকের অনুমতি জোগাড়ে যথেষ্ট কাঠ-খড় পোড়াতে হয় আমাদের। আমার স্ত্রী যদি তাঁর পুরানো বন্ধু না হত তাহলে হয়তোবা এটা সম্ভবই হত না। বাড়িটাকে বাছাই করার একটা কারণ এর পরিবেশটাই অন্য রকম, ভৌতিক ঘটনার জন্য অধিকতর মানানসই। দ্বিতীয়ত এর ফ্রেঞ্চ উইণ্ডোগুলোর একটা বারান্দামুখী। বেশি বিপদ হলে ওই পথে নিচের নরম মাটিতে লাফিয়ে পড়তে পারব আমরা। এখানে একটা বিষয় স্বীকার করে নেয়া উচিত, মানুষ হিসাবে আমি অসম্ভব ভীতু প্রকৃতির। তবে অধ্যাপকের প্রতি আমার অগাধ আস্থা। আমার মনে তাঁর সাহস নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই। ভয়ানক পরিস্থিতিতেও তিনি ঘাবড়ে যাবেন বলে মনে হয় না। যদ্দূর জানি ভূত বা প্রেতাত্মা নিয়ে পূর্ব অভিজ্ঞতাও আছে তাঁর। তিনি নাকি এদের গতিবিধি টের পেয়ে যান আগেই।
মূল কাহিনীতে ফিরে আসা যাক। পেছনের ওই কামরাটায় মোটামুটি আধ ঘণ্টা হলো বসে আছি এমন সময় সিঁড়ির বাইরে একটা পদশব্দ শুনলাম বলে মনে হলো। প্রফেসর বললেন, এটা কেবল কাঠের ক্যাচক্যাচ আওয়াজ। তারপর কাঠ ও ধাতব পদার্থের সম্প্রসারণ বিষয়ে নাতিদীর্ঘ এক বর্ণনা দেয়া শুরু করলেন। একপর্যায়ে তাঁকে বললাম বহু বছর আগে স্কুলরুমেও এ ধরনের আওয়াজ শুনেছি। তারপর চুপচাপ বসে, আইভি লতার ছায়াগুলো চাঁদের আলোয় মেঝেতে খেলা করছে তা দেখতে লাগলাম। একই সঙ্গে যে কোন ধরনের শব্দ আমার দৃষ্টি ওদিকে নিয়ে যাচ্ছে।
তারপরই হঠাৎ পথ ধরে প্রচণ্ড গতিতে এগিয়ে আসা ঘোড়ার খুরের এবং গাড়ির চাকার আওয়াজ পেলাম। একপর্যায়ে আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করলাম ঘোড়ার গাড়ি বা যেটাই হোক সেটা ‘দ্য ডিকনস’-এর দিকেই ঘুরে গিয়েছে। এরপরই বাড়ির সামনের পথের পাথরে শব্দ হলো এবং পরক্ষণেই সদর দরজায় জোরে কড়া নাড়ার আওয়াজ। কিন্তু বাড়িতে যখন ঢুকি তখন দেখেছিলাম সদর দরজায় কোন কড়া নেই। একটু ভয় পেয়ে গেলাম। তবে প্রফেসরের দিকে যখন তাকালাম ওই রাতে সত্যিকার অর্থে প্রথম ধাক্কাটা খেলাম। দরজায় নক করার আগে নিজের চেয়ারে গা এলিয়ে শুয়ে ছিলেন। চেহারায় ছিল প্রশান্তির একটা ছাপ। এ সব কিছুই এখন বিদায় নিয়েছে। আমূল একটা পরিবর্তন এসেছে। একেবারে সোজা হয়ে বসে আছেন এখন, সাধারণ আকারের দ্বিগুণ হয়ে গেছে চোখজোড়া, খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে আছেন ড্যাব ড্যাব করে। হাতজোড়া চেয়ারের হাতল আঁকড়ে ধরে আছে।
তাঁর চেহারার এমন পরিবর্তন দেখে আমার রক্ত হিম হয়ে গেল। এদিকে বেশ কিছুটা সময় চলার পর দরজার শব্দটা এখন থেমে গিয়েছে। সদর দরজা খুলে কিছু একটা এগিয়ে আসার মৃদু শব্দ পেলাম।
এই চালমাত অবস্থায় প্রফেসর আবারও আমাকে চমকে দিলেন। চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে জানালার দিকে দৌড়লেন, সেখান থেকে বারান্দায়, ওই শেষবারের মত দেখলাম তাঁকে আমি।
স্বীকার করতে দোষ নেই ক্ষমতা থাকলে তাঁকে অনুসরণ করতাম। কিন্তু ভয়ে এতটাই অবশ হয়ে গিয়েছে হাত-পা এমনকী গোটা শরীর, নড়তে পারছি না। কেবল আতঙ্ক নিয়ে অতিপ্রাকৃত একটা কিছুর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। ওটা কী? কী দেখব আমি? জিনিসটা কীভাবে ভেতরে ঢুকল?
ঈশ্বর! যাঁরা এই পরিস্থিতিতে পড়েছেন তাঁরাই কেবল ওই সময়ে একজন মানুষের মনের অবস্থা কী হয় তা বুঝবেন। একটার পর একটা সেকেণ্ড পেরোতে লাগল। কিছুটা সময় তেমন কিছুই ঘটল না। তারপরই ধীরে ধীরে কুয়াশার একটা ঘেরাটোপ গোটা কামরাটাকে ঢেকে দিতে লাগল। মেঝের ছায়াগুলো অন্ধকারে বিলীন হয়ে গেল। সিঁড়িতে খুব মৃদু একটা পদশব্দ শুনলাম। আসছে ওটা। নড়ার চেষ্টা করলাম, দৌড়নোর চেষ্টা করলাম, দৃষ্টিটা দরজা ও ল্যাণ্ডিঙের দিক থেকে সরিয়ে নিতে চাইলাম। কিন্তু পারলাম না।
পদশব্দ ধীরে ধীরে আমার আরও কাছে আসতে লাগল। একপর্যায়ে সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছে গেল। আমার বরাবর ল্যাণ্ডিঙে দাঁড়িয়ে আছে এখন, স্পষ্ট বুঝতে পারছি। একসময় কামরাটায় প্রবেশ করল। তবে এখনও কিছু দেখতে পাচ্ছি না। যখন এগিয়ে এল, দুটো আলাদা গোলাকার আলো দেখতে পেলাম। ধীরে ধীরে দুটো অনিন্দ্যসুন্দর হাতে রূপ নিল। সরু, লম্বা, সাদা আঙুল, গোলাপী নখগুলো পালিশ করা। অনেকগুলো আংটি আঙুলে। হীরা, রুবি, পান্নার মত দামি রত্নপাথর ঝকঝক করছে তাতে। যখন হাতজোড়া আমার কাছাকাছি হতে লাগল, মিষ্টি, মাতাল করা একটা গন্ধ চাবুকের মত আছড়ে পড়ল আমার নাকে। কেউ একজন আমার ওপর ঝুঁকে পড়েছে। দামি পশমী গাউনের ছোঁয়া অনুভব করছি। নরম একটা হাত আমার গলা জড়িয়ে ধরল। উষ্ণ, সুগন্ধি একটা ঠোঁটের স্পর্শ পেলাম ঠোঁটে। ওই নরম আঙুলগুলো আমার গাল, কপাল, চোখে আদরের স্পর্শ বুলিয়ে দিতে লাগল। সব ভয় দূর হয়ে গেল মন থেকে।
‘হায়, ঈশ্বর!’ উল্লাসে মনে মনে চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘এটা যদি চলতেই থাকত আজীবন, তবে কী ভালই না হত!’
নরম আঙুলগুলো এবার মুখ হাঁ করাল আমার। নরম, শীতল একটা তরল নেমে গেল আমার গলা দিয়ে। চেয়ারে মাথাটা ঠেস দিয়ে রাখলাম। কপালে নরম, আদুরে একটা হাতের স্পর্শ। এই স্পর্শে ধীরে ধীরে ঘুমের অতল রাজ্যে তলিয়ে গেলাম। যখন জাগলাম, আবারও ওই স্পর্শ, মাতাল করা গন্ধের জন্য পাগল হয়ে গেলাম।
‘ফিরে এসো!’ করুণ কণ্ঠে মিনতি করলাম, ‘এক মুহূর্তের জন্য হলেও তোমার সেই স্বর্গীয় স্পর্শ চাই।’ কিন্তু কোন উত্তর পেলাম না। তারপরই আবিষ্কার করলাম কথা বলতে পারছি না। যেমন নড়াতে পারছি না শরীরটা। একটা বিছানায় শুয়ে আছি। কামরায়ও একা নই আর।
আমি দেখতে না পেলেও একাধিক মানুষ বা প্রেতাত্মা আমার কাছেই দাঁড়িয়ে আছে।
দাঁড়িয়ে আছে। আমার মৃত্যু এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া নিয়েই আলোচনা করছে তারা। কর্কশ এক জোড়া হাত নির্মমভাবে আমার শরীর মাপছে কফিনে ঢোকানোর জন্য। একপর্যায়ে সেটায় ঢোকানো হলো। পেরেক ঠুকে কফিনের ডালা আটকানো হচ্ছে এখন। নড়ার এবং চিৎকার করার প্রাণান্তকর চেষ্টা করছি। কিন্তু যেখানে শুইয়ে রাখা হয়েছে সেখানেই পড়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করা সম্ভব হলো না। কফিনের কাঠের কেমন গা গুলানো মিষ্টি একটা গন্ধে রীতিমত বমি পাচ্ছে।
তারপর দুই জোড়া হাত কফিনটা তুলে নিল। সিঁড়ি বেয়ে আমাকেসহ নামতে লাগল তারা। ঘোড়ার গাড়িতে তোলা হলো আমার দেহসহ কফিনটা। বুঝতে পারলাম গাড়ির নড়াচড়া এবং ঘোড়াগুলোর হেষা শুনে। তারপর দুলে উঠল আমার শরীরটা। পাথুরে রাস্তায় চলতে শুরু করেছে গাড়ি। কিছুক্ষণ হুঁশ ছিল না। একপর্যায়ে যখন জ্ঞান ফিরল, ভয়াবহ একটা বাস্তবতার সামনে হাজির হলাম। জীবন্ত কবর দেয়া হয়েছে আমাকে।
আবিষ্কারটা এতটাই ভয়াবহ যে জ্ঞান হারালাম। তবে মাটির শীতল, দম বন্ধ করা পরিবেশের কারণে জ্ঞান ফিরে পেলাম আবার। সব ঘটনা একের পর এক মনে পড়তে লাগল।
প্রচণ্ড একটা হতাশা প্রভাব বিস্তার করল আমার ওপর। যে কোন শব্দ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলাম। কিন্তু চোয়াল নাড়াতে পারলাম না। হাতদুটো ছুঁড়লাম। ওগুলো নাড়াতে পারছি এখন। তবে মুখের একটু ওপরে, আমার কাঠের কারাগারের ছাদে বাড়ি খেল ও-দুটো। মাথা ঝাঁকালাম। পা ছুঁড়তে লাগলাম। একপর্যায়ে পায়ের আঙুল ভাঙল। ফেনা, রক্ত মুখ দিয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল। হতাশ, পর্যুদস্ত আমি হাল ছেড়ে দিলাম।
তারপর অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো। ওপরের অন্ধকারের সমুদ্রটা যেন বুকে ইটের বোঝার মত চেপে আছে। হাঁসফাঁস করতে করতে হাত দিয়ে ওটা সরাবার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলাম।
আরও একবার স্থির হয়ে গেলাম। মৃত্যুর পর কি এভাবেই অন্ধকার ঘিরে ধরে চারপাশ থেকে? তারপরই আগের জীবনের কথা, সেখানে একের পর এক ভুলের কথা স্মরণ করলাম। পাপের কথা ভাবলাম। আহ্! একবার যদি মুক্তি পেতাম জীবনটাকে আবার নতুন করে সাজাতাম। গোরস্থানের ওপরের বাতাসটাকে অনেক মিষ্টি, তাজা, আর ঘাসগুলোকে সবুজ মনে হচ্ছে। একবার যদি সেখানে, পৌঁছতে পারতাম!
নিজের বন্ধুদের কথা ভাবলাম। আমি যে বেঁচে আছি তা যদি জানাতে পারতাম তাদের। কী খুশি হত তারা! ভাবত চিকিৎসক ভুল করেছেন। তাদের বন্ধু শ্বাস নিতে পারছে। দ্রুত তারা দৌড়ে আসত আমাকে বাঁচাতে। তারপরই নির্মম সত্যটা উপলব্ধি করতে পারলাম। আমার অবস্থা তাদের জানানোর কোন সুযোগই নেই। এখানেই একাকী মরতে হবে আমাকে। চোখ বন্ধ করেই যেন গোরস্থানের চারপাশের কাদাটে মাটির স্তূপ, দু’পাশের সমাধিগুলো দেখতে পাচ্ছি। আশ্চর্য ব্যাপার ওগুলোর ভিতরটাও দেখতে পাচ্ছি। দাঁতহীন, ধূসর চুলের ওই মহিলা, ওই বাচ্চাটার খুদে আধো বিকশিত কঙ্কাল। একটার পর একটা সারি ধরে প্রত্যেককেই দেখতে পাচ্ছি। তাদের দিকে তাকাতেই দেঁতো হাসি দিচ্ছে। কেঁপে উঠছি। আবার তাকাতেই অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। তারপরই দেখলাম বীভৎস চেহারার একটি অদ্ভুত ধরনের প্রাণী গড়িয়ে গড়িয়ে শরীর মুচড়ে আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। শরীরটা হলুদ। একসময় পৈশাচিক জিনিসটা আমার পা স্পর্শ করল। ওই পর্যায়ে জ্ঞান হারালাম। মনে হলো যেন বহু সময় পর জ্ঞান ফিরে এল আবার। চোখ খুলতেই নিজেকে আবিষ্কার করলাম ‘দ্য ডিকনস’-এর খোলা জানালাগুলোর পাশে বসা অবস্থায়।
ওখানে বসার চেষ্টা করিনি আর কখনও, এক রাতের অভিজ্ঞতাই আমার জন্য যথেষ্ট। এই বাড়ির পুরানো বাসিন্দাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হলো আমাকে। শেষ পর্যন্ত সফল হলাম। এদের দু’জন মি. ডি কোসার্ট এবং মিসেস স্মিথ আমাকে দেখতে এলেন একই সকালে।
প্রথমে এলেন ডি কোসার্ট। লম্বা, হালকা-পাতলা গড়নের এক মানুষ। মাঝবয়সের ভদ্রলোকটি মরিচা-কালো রঙের একটা স্যুট পরে আছেন।
‘আপনার কাছ থেকে কিছু জানার আছে আমার, ডিকনস সম্পর্কে।’ কথাটা বলে একটা চেয়ারে বসার ইশারা করে দরজাটা সাবধানে আটকে দিলাম। পাছে আবার আমার বাক্যবাগীশ ল্যাণ্ডলেডি কিছু শুনে ফেলে।
‘ঠিক বলেছেন। বছর তিনেক আগে দু’বছরের চুক্তিতে ‘দ্য ডিকনস’ লিজ নিই। মাত্র এক রাতই সেখানে কাটাতে পারি। আর কাছেধারেও যেতে চাই না জায়গাটির। কয়েক বছর আগে স্ত্রী গত হয়েছে আমার। বাড়িতে আমার সঙ্গে যান রাশভারী বয়স্ক এক হাউসকিপার, একজন রাঁধুনি ও একজন মেইড। দশটার দিকে সবাই যার যার বিছানায় চলে যাই আমরা। তখন মধ্যরাত। অনেক চেষ্টা করেও ঘুমাতে পারছি না। এসময় করিডোরে একটা পায়ের আওয়াজ পাই। ওটা আমার দরজার দিকেই এগিয়ে আসছে। এদিকে ওই সময়ই ওপর থেকে একের পর এক ধুপধাপ শব্দ শুনলাম।
‘ভাবলাম হাউসকিপার ওপরের কোন সমস্যার ব্যাপারে বলতে আসছে। ড্রেসিং গাউনটা গায়ে চাপিয়ে দরজার দিকে দৌড়লাম। ওটা হাউসকিপার নয় মোটেই, কিন্তু,’ এতটুকুন বলে ভয়ার্ত চোখে আমার দিকে তাকালেন একবার, তারপর আবার শুরু করলেন, ‘বিশালদেহী, আলখেল্লা পরিহিত এক লোক। বুনো, জ্বলজ্বলে চোখ, বসা কপাল, রক্তলাল চোখ। আমার দিকে হাত তুলল সে। বাতাসে নড়ছে আঙুলগুলো। লক্ষ্য করলাম ওগুলোর আগা ভাঙা, রক্ত ঝরছে।
‘ওটা যে একটা প্রেতাত্মা বুঝতে অসুবিধা হলো না, তবে আমাকে আঘাত করতে আসেনি, বরং কোন বিষয়ে সতর্ক করে দিতে চাচ্ছে। তারপরই অদৃশ্য হলো কাঠামোটা। পরমুহূর্তেই এক নারীর দুটো বাহু গলা পেঁচিয়ে ধরল আমার। বিছানায় নিয়ে গিয়ে আদর করে ঘুম পাড়িয়ে দিল। তারপর যখন ঘুম ভাঙল, কিংবা ভাবলাম জেগে উঠেছি, আবিষ্কার করলাম জ্যান্ত কবর দেয়া হচ্ছে আমাকে। সত্যি জ্ঞান ফিরে পেলাম সকালে, যখন মেইড আমার জন্য গরম পানি নিয়ে এল।
‘বিষয়টা আমাকে এতটাই নাড়া দিল যে আশপাশের প্রতিবেশীদের কাছে খোঁজ-খবর নিলাম লোকটির চেহারার বর্ণনা দিয়ে। দেখলাম মি. রবার্ট ভ্যালেন্টাইন ফার্নিস নামের এক ভদ্রলোকের সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে। এই বাড়িতেই মারা গিয়েছেন আমি বাড়িতে ওঠার কিছুদিন আগে। তাঁর আত্মীয়- স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তাদের সঙ্গে ভদ্রলোকের খুব একটা দেখা-সাক্ষাৎ ছিল না অনেক দিন ধরেই। তবে আমার দুঃস্বপ্ন তাদের নাড়া দিল ভীষণ। আবার কবর খুঁড়ে বের করা হলো তাঁর মৃতদেহ। তখনই প্রমাণ পাওয়া গেল জীবন্ত কবরের ঘটনার। তাঁর পাকস্থলীর ভেতরের জিনিস পরীক্ষা করতেই প্রমাণ মিলল ঘুম পাড়িয়ে দেয়ার মত খুব শক্তিশালী মাদকের। ওই মাদকের কারণেই কোমায় চলে যান। সবাই ধরে নেন ভদ্রলোক মারা গিয়েছেন। জীবন্ত কবর দেয়া হয় তাঁকে। অসুস্থ অবস্থায় তাঁকে দেখতে এসেছিলেন যে চিকিৎসক তাঁর পরিচয় পাওয়া যায়নি। এদিকে তাঁর বিধবা স্ত্রী কোথায় আছে এটাও জানতে পারলাম না।
‘মৃত ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে পরে আর দেখা হয়নি। তারপর একসময় ইতালির তুরিনে যাই। সেখানে এক সুন্দরী তরুণীর সঙ্গে পরিচয় হয়।
‘তার চেহারার, তবে এর চেয়েও বেশি হাতদুটোর প্রেমে পড়ি আমি।’ কেঁপে উঠলেন ডি কোসার্ট। আতঙ্কিত দৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘দ্য ডিকনস-এ যে হাতদুটো আমায় জড়িয়ে ধরেছিল ঠিক সেগুলোর মতই। কিছুদিনের মধ্যে বিয়ে হয়ে গেল আমাদের। কয়েকদিন যেতে না যেতেই আমার সব সম্পত্তি তার নামে লিখে দেয়ার জন্য চাপ দিতে আরম্ভ করল। এখন আর ওই হাতদুটো সোহাগ করে না আমাকে। রাতে ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠি।’
‘কিন্তু তা কী করে সম্ভব? আচ্ছা, স্যর, আপনার কাছে কি আপনার স্ত্রীর কোন ছবি আছে?’ জানতে চাইলাম।
‘হ্যাঁ, সঙ্গেই আছে। আমার মনে হয়েছিল আপনি দেখতে চাইতে পারেন, লেখকদের কৌতূহল বেশি থাকে জানি আমি,’ এই বলে একটা ছবি এগিয়ে দিলেন।
ওটা পরীক্ষা করতে যাব এমন সময় দরজায় মৃদু একটা টোকার শব্দ। মিসেস স্মিথ নামে এক কৃষ্ণাঙ্গ, হালকা-পাতলা গড়নের মহিলা ভেতরে প্রবেশ করলেন। ডি কোসার্ট যাওয়ার জন্য উঠলেন। এদিকে মহিলাটির ততক্ষণে ছবিটির দিকে চোখ পড়েছে। চেঁচিয়ে উঠলেন উত্তেজনায়, ‘ওহ্, খোদা! এটা কি মিসেস ফার্নিস নয়?’
‘আপনি কি একে চেনেন?’ এই বলে ছবিটা ভদ্রমহিলার সামনে ধরলেন।
‘আপনিই কি সেই লেখক?’ মিসেস স্মিথ হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন।
‘না, আমি এই মহিলার স্বামী।’
‘কিন্তু ইনি তো মিসেস ফার্নিস। তাই নয় কি?’ আমার টেনে দেয়া আসনটায় বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রমহিলা।
এই মুহূর্তে আমার একটু ব্যাখ্যা দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করলাম। ডি কোসার্টের উদ্দেশে বললাম, ‘মিসেস স্মিথও আপনার মত ‘দ্য ডিকনস’-এর ব্যাপারে আগ্রহী। তাই তিনি আজ সকালে এখানে এসেছেন। তাঁর কী বলার আছে বরং শোনা যাক।’ তারপর মহিলার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘ম্যাম, আপনি সব কিছু খুলে বলুন। আমার মত এই ভদ্রলোকেরও ওই বাড়ি নিয়ে অদ্ভুত অভিজ্ঞতা আছে।’
‘তবে,’ বলা শুরু করলেন মিসেস স্মিথ, ‘যা বলব এটা নিয়ে আমাকে কোন ঝামেলায় ফেলবেন না তো আবার! অবশ্য তাতেও খুব একটা কিছু আসে-যায় না। কারণ খুব দ্রুতই এ পৃথিবীর মায়া কাটাতে হবে আমাকে। আমার স্তন, গলা ও একটা ধমনীর ঠিক ওপরে—মোট তিন জায়গায় ক্যান্সার ধরা পড়েছে। চিকিৎসক বলেছেন ভাল হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।’ কথাগুলো বলে একটু সময় চুপ করে থাকলেন ভদ্রমহিলা। হয়তো নিজেকে প্রস্তুত করলেন। তারপর বলতে লাগলেন, ‘আমি বাস করতাম হ্যাম্পস্টিডে। তিন বছর আগে স্বামীকে হারাই। ব্রাইট’স ডিজিজে (কিডনির এক ধরনের রোগ) মারা যান তিনি। এর কিছুদিন আগেই লণ্ডি দিয়েছিলাম একটা। সেই সূত্রে মিসেস ফার্নিসের সঙ্গে যোগাযোগ। ‘দ্য ডিকনস’-এ থাকতেন ভদ্রমহিলা। আমার স্বামীর রোগের ব্যাপারে প্রথম দিন থেকেই তাঁর অদ্ভুত একটা আগ্রহ দেখি। তবে এটায় খুব একটা গুরুত্ব দিইনি প্রথমে। তারপরই একদিন আমার বাসায় হাজির হলেন হঠাৎ। আমার ছোট্ট পার্লারটিতে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘আমার মনে হয় স্বামীর অসুস্থতার পেছনে বড় ধরনের খরচ হয় তোমার।’
‘হ্যাঁ, ম্যাম। কুলাতে পারছি না একেবারেই।’ অ্যাপ্রনের কোনা দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বললাম।
‘তার কি সুস্থ হওয়ার কোন সম্ভাবনা আছে?’
‘না, ম্যাম। ডাক্তার বলেছেন আর বড়জোর কয়েকটা দিন।’
‘ডাক্তার কয়দিন পর পর আসেন?’
‘আমি ডাকলে তবেই আসেন।’
‘এবার তাঁর পেলব হাতটা দিয়ে আমার কাঁধ স্পর্শ করে গলা নামিয়ে বললেন, ‘তোমার অবস্থাটা আমি বুঝতে পারছি। কিছু টাকা-কড়ি পেলে নিশ্চয়ই ভালই হয়। একশো পাউণ্ড হলে চলবে?’
‘স্বীকার করলাম আমার মত এক দরিদ্র নারীর জন্য একশো পাউণ্ড বিশাল ব্যাপার।
‘খুব ভাল।’ মিষ্টি হেসে বলতে শুরু করলেন, ‘এর বিনিময়ে আমি চাইব তোমার স্বামীকে মৃত্যু পর্যন্ত বাকি কয়েকটা দিন আমার বাড়িতে এনে রাখো। আমি তোমাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি দ্য ডিকনস-এ তার ভালমতই দেখাশোনা হবে। আর তুমি তো বলেছই বড়জোর কয়েকটা দিন বাঁচবে সে। কোথায় মারা গেল এটা নিশ্চয়ই তোমার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। মারা যাবার পর তোমার বাড়িতে গোপনে নিয়ে আসা হবে মৃতদেহ। এখান থেকেই গোর দিতে নিয়ে যেতে পারবে। কেউ বিন্দুমাত্র সন্দেহ করবে না।’
‘প্রস্তাবটা এতটাই অস্বাভাবিক যে, কী বলব বুঝে উঠতে পারলাম না।‘
‘কিন্তু, ম্যাম, তুমি কেন এটা করছ?’
ওহ! আমি বললেও বুঝবে না।’ রহস্যময় একটা হাসি দিয়ে বললেন তিনি, ‘এখন একশো পাউণ্ড কামাতে চাইলে রাজি হয়ে যাও।’
‘আমি জানি মিসেস ফার্নিস কথা দিয়ে না রাখার মানুষ নন। কাজেই রাজি হয়ে গেলাম। আমার স্বামীকে সব কিছু বলতে আপত্তি করলেন না। আসলে তাঁর হারানোর কিছু নেই। ভাবলেন এতে যদি আমাদের কিছুটা উপকার হয়! আমি আর আমার ছেলে জিম রাতের আঁধারে স্মিথকে ‘দ্য ডিকনস-এ নিয়ে গেলাম। তিন রাত পর তাঁর মৃতদেহ বাড়িতে নিয়ে এলাম। ডাক্তার জানালেন তাঁকে খবর দিয়েও কোন লাভ হত না। কারণ কোন কিছুই আমার স্বামীকে বাঁচাতে পারত না। একশো পাউণ্ড পেলাম আমরা। মুখ বন্ধ রাখলাম আমি আর আমার ছেলে। তবে একটা বিষয় জেনে আমাদের মনটা বেশ খচখচ করতে লাগল। মি. ফার্নিস নাকি আমার স্বামী যে সময় মারা গিয়েছেন তখনই মারা যান এবং ওই একই রোগে।’
ডি কোসার্টের সঙ্গে চোখাচোখি হলো আমার। ঘৃণায় রি রি করছে আমাদের শরীরটা।
‘আপনি নিশ্চিত মি. ফার্নিস ব্রাইট’স ডিজিজে মারা গিয়েছে?’ জানতে চাইলাম।
‘আমি তাই শুনেছি,’ কাঁধ ঝাঁকিয়ে জবাব দিলেন মহিলা, ‘কয়েকজনই একই কথা বলেছে। তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় তেমন কেউ ছিল না। কেবল মিসেস আর ভাড়ায় শোক করা কয়েকজন মানুষ। আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে মনে হয় ভদ্রলোকের বনিবনা ছিল না। আমি আর জিম বিষয়টি ভুলতে পারিনি। অনেক সময়ই ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখি। বেশিরভাগ সময় জ্যান্ত গোর হওয়ার দৃশ্য এবং মিসেস ফার্নিসের সাদা, পেলব হাতজোড়া দেখি।’
‘এখন আপনি কী ভাবছেন, মিসেস স্মিথ?’ জানতে চাইলাম আমি, ‘আপনার নিশ্চয়ই একটা অনুমান আছে?’.
‘আমার মনে হয়,’ অনুতপ্ত কণ্ঠে বললেন মিসেস স্মিথ, ‘হতভাগা মি. ফার্নিসের বদলে ডেথ সার্টিফিকেট নিতে ব্যবহার করা হয়েছে আমার স্বামীকে। ডাক্তারকে হঠাৎ ডেকে পাঠিয়েছিলেন মিসেস, আর ভদ্রলোক এখানে যে চাতুরীর আশ্রয় নেয়া হচ্ছে জানতেনও না। ভাবেন সঠিক ডেথ সার্টিফিকেট দিচ্ছেন।
‘তারপর আবার একটা অদল-বদল হয়। আমার স্বামীর মৃতদেহ বাড়িতে আনা হয়। সত্যিকারের মি. ফার্নিসকে দ্য ডিকনস থেকে নিয়ে গিয়ে সমাধিস্থ করা হয়। তবে আমি এখানে বসে আছি এ ব্যাপারটা যেমন নিশ্চিত তেমনি নিশ্চিত তাঁকে জীবন্ত কবর দেয়া হয়েছে। ওই শয়তান মহিলা কোন উদ্দেশ্যে এই চাতুরীর আশ্রয় নেয়। গত তিন বছর ঘটনাটা চেপে রেখেছি বিশাল এক বোঝার মত। এখন বুকটা হালকা লাগছে।’
‘আপনার সন্দেহই সত্যি, মিসেস স্মিথ। তাঁকে জীবন্তই কবর দেয়া হয়েছে। তবে আপনার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এটা গোপনই রাখব। যেমন গোপন থাকবে আমি এক খুনিকে বিয়ে করেছি।’ বললেন ডি কোসার্ট।