জ্যাঠাইমার অর্থনীতি
যখন কলেজে পড়তাম, তখন অর্থশাস্ত্রের প্রথম পাঠ নিয়েছিলাম। আমাদের পাঠ্যপুস্তকের প্রথম পাতায় লেখা ছিল— মানুষের অনুশীলনের প্রধান বিষয়বস্তু হল মানুষ। কীরকম মানুষ? না, তার প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার কাজে নিবিষ্ট মানুষ। তা সে প্রাত্যহিক জীবনযাত্রাটি কী ব্যাপার? না, বেচা-কেনা ছাড়া কিছু নয়। কীরকম বেচা-কেনা? না, সবচেয়ে কম দামে কিনে, সবচেয়ে বেশি দামে বেচা। এই হল মানুষের প্রাত্যহিক অনুশীলনের বিষয় এবং এরই ওপর নির্ভর করছে কে বড়লোক হবে আর কে হবে গরিব। অর্থাৎ মানবজাতির ভবিষ্যৎ।
আমার জ্যাঠশাশুড়ি ছিলেন সেকালের বিখ্যাত হোমিওপ্যাথ বিহারীলাল ভাদুড়ীর মেয়ে এবং আরেক বিখ্যাত হোমিওপ্যাথ প্রতাপচন্দ্র মজুমদারের স্ত্রী। লেখাপড়া না জানলেও, এসব জটিল ব্যাপারের ওপর তাঁর একটা জন্মগত দখল ছিল।
হ্যাঁ, বলতেই ভুলে যাচ্ছিলাম যে এর ওপরে তিনি ছিলেন আমার পটোদিদির মা। তাঁকে ঠকানো খুব শক্ত ছিল। থাকতেন কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে; ওঁদের বাজার হত হাতিবাগানে। তিনি নিজেই যে সব কেনাকাটা করতেন, তাও নয়। তবে বাজারের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে যতটা করা যায়, এই আর কী।
একবার আলুর দোকানের সামনে গাড়িতে বসে শুনলেন আলুওয়ালা অন্য একজন খদ্দরকে বলছে, আলুর দর হয়েছে নাকি চার পয়সা সের। জ্যাঠাইমার চক্ষু চড়ক গাছ! ‘বলিস্ কী রে! এ যে দিনে ডাকাতি!’ সঙ্গে সঙ্গে ড্রাইভারকে হুকুম দিলেন ‘চেতলা চল।’ তিন পো শহর পেরিয়ে, চেতলার বাজারে গিয়ে দশ সের আলু আর দশ সের পেঁয়াজ কিনে সগর্বে বাড়ি ফিরলেন।
সওদা দেখে বউমার চক্ষুস্থির! ‘আচ্ছা মা, এই যে বললাম বাড়িতে আধ বস্তা আলু আর আধ বস্তা পেঁয়াজ ছাড়া কিছু নেই। এখন আমি কী দিয়ে কী করি?’ বউমার নির্বুদ্ধিতার পরিচয় পেয়ে জ্যাঠাইমাও গরম হয়ে উঠলেন, ‘বিষয়-আশয় তোদের হাতে পড়লে, কী অবস্থাটা হবে বল দিকিনি! হাতিবাগানের দোকানদার এমনি দুষ্টু যে এক বেচারিকে বলছে আলুর দর নাকি চার পয়সা সের—’
বউমা বাধা দিয়ে বললেন, ‘আলুর যখন দরকার নেই তখন দর জানতে চাইলেন কেন?’ জ্যাঠাইমা বললেন, ‘আহা, জানতে চাইনি! দোকানদার অন্য একটা লোককে বলছিল, কথাটা কানে ঢুকে গেল। আমি কি উট, যে কান বন্ধ করে রাখব! তা সে লোকটা বলল ফুলির-মা বলে কে যেন চেতলায় তিন পয়সা সের আলু কিনেছে। তখন চেতলায় না গিয়ে কী করি? সুযোগ কখনও ছাড়তে হয়?’
বউমাও ছাড়বার মেয়ে ছিলেন না, তিনি বললেন, ‘ওই এক পয়সা বাঁচাতে এক টাকা দিয়ে এক গ্যালন পেট্রল পুড়িয়ে চেতলায় গিয়ে তিন পয়সা সেরে কতকগুলো অদরকারি আলু কিনে আনলেন?’
তখন জ্যাঠাইমা বিজয়গর্বে মাথা উঁচু করে বললেন, ‘তা হলে তুই কিছুই বুঝিস্ না রে মা। একসঙ্গে দশ সের আলু কিনলে চার-চারটে পয়সা ছেড়ে দেয় আর সেইসঙ্গে পাঁচ পয়সা সেরে দশ সের পেঁয়াজ কিনলে, চারটে পেঁয়াজ ফাউ দেয়। এবার বল্ কীরকম সুবিধেটা হল! তবে এই যা দুঃখ যে আলুটা কিছুতেই তিন পয়সায় দিল না আর পেঁয়াজটা হাতিবাগানে চার পয়সা বলছিল।’
বউমা হতাশ হয়ে ঠাকুরকে ডেকে বললেন, ‘তুমি বরং খানিকটা ছোলার ডাল ভিজিয়ে ধোকার ডালনা করো।’ এই কি তবে সস্তায় কিনে বেশি দামে বেচা? তবে পাঠ্যপুস্তকে সব কথা লেখেনি। তবে ওই প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার সুবিধাটা, যারা কিনবে তাদের জন্য নয়, যারা বেচবে তাদের জন্যে।
পরে জ্যাঠাইমা থিয়েটার রোডে থাকতেন। সেখানে অনেক জায়গা-জমি ছিল। তাই গোরু কেনা হল। বলাবাহুল্য গোরুর যেমন আদর-যত্ন হত, দুধও দিত তেমনি বালতি ভরে। অবিশ্যি মেয়ে-বউদের খাটুনিও তেমনি বেড়ে গেল। কারণ জাব কোটা থেকে সবই তাদের দেখতে হত, নইলে গয়লারা কী করে বসবে তারই বা ঠিক কী? ‘গেরস্তর বাড়িতে দুধে জল ঢাললে পাপ হয়। বুঝলে বউমা?’
ভোর থেকে তাঁর মেয়ে-বউরা গোরু নিয়ে নাজেহাল হত। শেষটায় গোরু দোওয়া হল; বালতি ভরে রান্নাঘরে এনে, ছেঁকে কড়াইতে ঢালা হল; দুধ ফুটতে আরম্ভ করল; চারদিক তার সুগন্ধে আমোদিত হল। বউ-ঝি-রাও হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। কেউ এক ফোঁটা জল মেশাবার সুযোগ পায়নি। বাবা! শেষটা যদি গেরস্তর অকল্যাণ হত!
ঠিক এমনি সময় একটা বড় এক সেরি ঘটি হাতে জ্যাঠাইমা এসে বললেন, ‘দেখি, একটু সর তো দেখি!’ এই বলে ফুটন্ত ঘন দুধে এক ঘড়া জল ঢেলে দিয়ে বললেন, ‘এতে গেরস্তর কিঞ্চিৎ সাশ্রয় হয়!’
তবে একবার জ্যাঠাইমা বাস্তবিক একটা অসম্ভব কাজ করে ফেলেছিলেন। থিয়েটার রোড দিয়ে এগিয়ে গেলে, এখন যেখানে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, তখন সেখানে খোলা মাঠ ছিল। সেখানে পৌঁছে, গাড়ি থামিয়ে জ্যাঠাইমা বৈকালীন হাওয়া খাচ্ছেন, এমন সময় দেখলেন উলটো দিক থেকে একটা লোক একটা গোরুকে তাড়িয়ে নিয়ে আসছে।
হাড় জিরজিরে রুগ্ণ গোরু; বেচারি চলতে পারছে না, মাথা ঝুলে যাচ্ছে, চোখ দিয়ে জল পড়ছে। জ্যাঠাইমা হিন্দি জানতেন না। তবু ঠেকায় পড়ে বললেন, ‘কাইকু উসকো পেটাতা? কাঁহা নিয়ে যাতা?’
লোকটা যা বলল তার বাংলা মানে হল, গোরু ভারী বদমায়েশ। বাচ্চা দেয় না, দুধ দেয় না, খালি খেতে চায়। তাই ওকে কসাইয়ের কাছে বেচতে নিয়ে যাচ্ছে। শুনে জ্যাঠাইমা আঁতকে উঠলেন, ‘সে কত টাকা দেবে?’ লোকটা মওকা পেয়ে বলল, ‘পঁচিশ দেবে নিশ্চয়। জ্যাঠাইমা বললেন, ‘ওকে নিয়ে আমার গাড়ির পেছনে পেছনে আয়। আমি পঞ্চাশ দেব।’
বাড়ির লোক চটে গেছিল। মড়াখেকো গোরুর জন্য পঞ্চাশ টাকা! জ্যাঠাইমা কারও কথা শোনেননি। পশুচিকিৎসক এসে ওষুধপত্র দিয়ে গেল। ভাল খাবার আর ওষুধ পড়তেই দেখতে দেখতে তার কী চমৎকার চেকনাই চেহারা হল। বেশি বয়স ছিল না গোরুটার, অযত্নে অমন দেখাচ্ছিল। পরের বছর সে সুন্দর বাচ্চা দিল আর রোজ সকালে সাত সের বিকেলে পাঁচ সের দুধ দিত। তাতে জল মেশানো হত কি না ঠিক জানি না।