জ্যাক লন্ডন : যাঁর আয় ছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের আয়ের দ্বিগুণ
এই ব্যক্তিটি হলেন জ্যাক লন্ডন যিনি ‘দ্য কল অব দ্য ওয়াইলন্ড’ উপন্যাস লিখে রাতারাতি বিখ্যাত হয়েছিলেন। একসময় তিনি একটি মালগাড়ির রডে চড়ে বাফেলোতে প্রবেশ করলেন এবং দ্বারে দ্বারে ভিক্ষে করতে লাগলেন। একজন পুলিশ ভবঘুরেপনার জন্য তাকে গ্রেপ্তার করে এবং তিরিশ দিনের সশ্রম কারাদণ্ড হয়।
মাত্র ছয় বছর পর এই ভবঘুরে ভিক্ষুক ব্যক্তি একজন সবচেয়ে জরুরি ব্যক্তি হয়ে গেলেন। ক্যালিফোর্নিয়ার সেরা ব্যক্তিরা তাকে আপ্যায়ন করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলেন এবং তিনি একজন বিখ্যাত ঔপন্যাসিক, সমালোচক হিসেবে খ্যাতির উজ্জ্বলতম নক্ষত্ররূপে সমাদৃত হলেন। তিনি উনিশ বছর বয়সে মাত্র তিন মাসের জন্য স্কুলে যান আর মৃত্যুর আগে মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে একান্নটি উপন্যাস লিখে রেখে গেলেন। তার লেখা ‘দ্য কল অব দ্য ওয়াইল্ড’ থেকে হলিউডের চিত্র নির্মাতারা লক্ষ লক্ষ ডলার উপার্জন করেছেন কিন্তু তিনি বইটির সর্বস্বত্ব বিক্রি করে পেলেন মাত্র দু’হাজার ডলার।
তিনি পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি জায়গায় যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়িয়েছেন এবং তার ভ্রমণ কাহিনী সংবলিত একটা বইও লিখে গেছেন। তিনি ছিলেন মাস্তুলের সামনে দাঁড়ান নাবিক, জাহাজের খালাসি, ঝিনুক লুণ্ঠনকারী পাইরেট এবং স্বর্ণখনির শ্রমিক। তাকে প্রায়ই না খেয়ে থাকতে হত, পার্কের বেঞ্চিতে কিংবা খড়ের গাদায় ঘুমুতেন। কখনো-কখনো তিনি এত ক্লান্ত থাকতেন যে মালগাড়ির রডের ওপর বসে থাকতে থাকতে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়তেন। আমেরিকায় তাকে শতবার জেলে পোরা হয়েছে, মেক্সিকো, মাঞ্চুরিয়া, জাপান ও কোরিয়ার জেলে বিভিন্ন সময়ে আটক রাখা হয়েছে।
দরিদ্র এবং দুঃখ-কষ্টে জর্জরিত হয়ে সানফ্রান্সিসকো উপসাগরের উপকূলে গুণ্ডা দলের সঙ্গে মিশে গুণ্ডামি করতেন। একদিন তিনি এক পাবলিক লাইব্রেরিতে ঢুকে পড়ে রবিনসন ক্রুশো পড়া শুরু করে দিলেন এবং পড়ে মুগ্ধ হলেন। তার খুব ক্ষিদে পেল কিন্তু তবুও দৌড়ে বাড়ি গিয়ে খাবার খেয়ে আসার জন্যও পড়া থামালেন না। পরদিন তিনি আবার লাইব্রেরিতে গেলেন, তার পড়ার ঝোঁক বেড়ে গেল এবং একের পর এক বই শেষ করতে লাগলেন তিনি। তার চোখের সামনে আরব্য উপন্যাসের বিচিত্র রজনীর মতো বিশাল সাহিত্যাঙ্গনের দরজা খুলে গিয়ে তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকল। তিনি প্রতিদিন দশ থেকে পনের ঘণ্টা বই নিয়ে জ্ঞানের সাগরে অবগাহন করতে লাগলেন। তিনি পেশী বিক্রি বন্ধ করে দিয়ে মস্তিষ্ক বিক্রি করতে মনস্থ করলেন।
ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যান্ডে এক স্কুলে ভর্তি হয়ে গেলেন জ্যাক লন্ডন। দিনরাত পড়তে লাগলেন, ঘুমানো প্রায় ছেড়ে দিলেন এবং একটা অসম্ভব ব্যাপার ঘটিয়ে ছাড়লেন। সেটা হল-তিনি চার বছরের পড়া মাত্র তিন মাসে পড়ে শিখে ফেললেন এবং সাফল্যের সঙ্গে পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন। একজন বড় লেখক হবার অদম্য প্রেরণায় তিনি বিখ্যাত সাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিকদের রচনাগুলো বারবার পড়তে লাগলেন। অবশেষে দিনে পাঁচ হাজার শব্দ করে লিখতে শুরু করলেন। তারপর একদিন ‘সানফ্রান্সিসকো কল’ আয়োজিত এক প্রতিযোগিতায় তার ‘টাইফুন অব দ্য কোস্ট অব জাপান’ গল্পটি প্রথম পুরস্কার পেল।
ক্লনভাইকে স্বর্ণের অন্বেষণে তিনি একটা বিরামহীন উত্তেজনাপূর্ণ বছর অতিবাহিত করলেন। তবে অসম্ভব দুর্ভিক্ষ ও প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় দিনের পর দিন কাটাতে হয়েছিল। তারপর একদিন যখন তার ও অনশনের মধ্যে ব্যাবধান মাত্র দু’ডলার, তখন চিরকালের জন্য কায়িক শ্রম ছেড়ে দিয়ে সাহিত্য সেবায় আত্মনিয়োগ করলেন। এটা হল ১৮৯৮ সালের ঘটনা। ১৯০৩ সালের মধ্যে তিনি দু’টি বই এবং পঁচিশটি ছোটগল্প প্রকাশ করে আমেরিকার প্রকাশনা ও সাহিত্য জগতে একজন অন্যতম প্রধান আলোচিত ব্যক্তিত্বে পরিগণিত হলেন। সাহিত্যচর্চার শুরু করার মাত্র আঠারো বছর পর জ্যাক লন্ডন পরলোক গমন করেন।
তিনি বছরে গড়ে প্রায় তিনটি বই রচনা করেন। তার বার্ষিক আয় ছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের আয়ের দ্বিগুণ। তার বইগুলো এখনো অত্যন্ত জনপ্রিয়। আমেরিকার সাহিত্যাঙ্গনে এখনো জ্যাক লন্ডন একজন প্রথিতযশা লেখক হিসেবে সমধিক পরিচিত।