জ্বিন এবং পক্ষীকথা
নুহাশপল্লীর মাঠে বসে আছি। সময় সকাল দশটা। আমার সঙ্গে আছেন সিলেটের হ্যারল্ড রশীদ। তিনি একজন সংগীত পরিচালক, চিত্রকর এবং শখের জ্যোতির্বিদ। তিনি আমাকে বৃহস্পতির চাঁদ এবং শনিগ্রহের বলয় দেখাতে এসেছেন। নিজের টেলিস্কোপ নিয়ে এসেছেন। রাতে টেলিস্কোপ সেট হবে।
আমরা রাতের জন্যে অপেক্ষা করছি। অপেক্ষার জায়গাটা সুন্দর। বেদী দেওয়া জাপানি বটগাছের নিচে বসেছি। আমাদের ঘিরে আছে ছয়টা চেরিগাছ। দু’টাতে ফুল ফুটেছে। নীল রঙের স্নিগ্ধ ফুল। চারদিকে নানান ধরনের পাখি ডাকছে। পাখির বিষয়ে আমার তেমন আগ্রহ নেই। সব পাখি চিনিও না। তাদের কিচিরমিচিরে ভোরবেলা জেগে উঠতে হয়। কাঁচা ঘুম ভাঙানোয় এদের ওপর খানিকটা রাগও করি। দুটা কাঠঠোকরা পাখি আমাকে ভোরবেলায় অস্থির করে তোলে। এরা কাঠের ইলেকট্রিক পোলে গর্ত করে বাসা বানিয়েছে। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এরা বাসা থেকে বের হয়। আমি যে ঘরে ঘুমাই তার কাঁচের জানালায় ঠোকর দেয়। মনে হয় জানালা ফুটো করতে চায় কিংবা আয়নায় নিজেকে দেখতে চায়। আরেকটি সম্ভবনা আছে–হয়তো এদের ঠোঁট কুট কুট করে। প্রচণ্ড শক্তিতে গ্লাসে ধাক্কা দিলে ঠোঁটে আরাম হয়।
পাখি দুটির বজ্জাতির গল্প হ্যারল্ড রশীদের সঙ্গে করলাম। তিনি বললেন, আচ্ছা আপনার নুহাশপল্লীতে এত পাখি, আপনি কি কখনো এখানে মৃত পাখি দেখেছেন?
আমি বললাম, পাখির বাসা থেকে পড়ে মরে গেছে এমন দেখেছি।
পূর্ণবয়স্ক মৃত পাখি?
আমি বললাম, না।
পূর্ণবয়স্ক মৃত পাখি যে কোথাও দেখা যায় না। এই বিষয়টা আমি জানি। অনেক বছর আগে Time বা Reader’s Digest পত্রিকায় একটা লেখা পড়েছিলাম Where the dead birds go? সেখানেও মৃত পাখির বিষয়টাকে রহস্য বলা হয়েছে।
হ্যারল্ড রশীদ দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, মৃত পাখিদের জ্বিন খেয়ে ফেলে, তাই আমারা মৃত পাখি দেখি না।
বলেন কী!
জ্বিনের খাবার হলো হাড়। পাখির হাড় তারা খেয়ে ফেলে।
হ্যারল্ড রশীদের কথা গসপেল মনে করার কোনো কারণ নেই।
আমি সঙ্গে সঙ্গে সাদাত সেলিম সাহেবকে টেলিফোন করলাম। উনি একজন পক্ষীবিশারদ। বর্তমানে ঢাকা ক্লাবের প্রেসিডেন্ট। টেলিফোনে সহজে তাঁকে পাওয়া যায় না। আমার ভাগ্য ভালো, সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে গেলাম। আমি বললাম, বিশাল নুহাশপল্লীকে পক্ষীর অভয়াশ্রম বলা যায়। আমি কেন এখানে মৃত পাখি দেখি না?
সাদাত সেলিম যে জবাব দিলেন তা হ্যারল্ড রশীদের জবাবের চেয়েও অদ্ভুত। তিনি বললেন, পাখিদের একটা সিক্সথ সেন্স আছে। এরা কখন মারা যাবে তা বুঝতে পারে। বুঝতে পারা মাত্র দলবল ছেড়ে গহীন অবণ্যের দিকে যাত্রা করে। লোকচক্ষুর অন্তরালে গহীন অরণ্যে তাদের মৃত্যু হয় বলেই আমরা লোকালয়ে মৃত পাখি দেখি না।
পক্ষী বিষয়ে সাদাত সেলিমের চেয়েও অনেক অদ্ভুত কথা একজন বলে গেছেন। তার নাম বাবর। তিনি মোঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা।
বাবর তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ বাবরনামায় লিখেছেন তাঁর সংগ্রহে একটি তোতা পাখি ছিল। তোতা পাখি কথা বলত। যা শুনত তা-ই বলত। তবে এই পাখির রক্ষক একদিন সম্রাটকে বলল, পাখিটা যে সব কথা শুনে শুনে বলে তা না। সে নিজ থেকেও কথা বলতে পারে। একদিন পাখিটা বলল, আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ঢাকনাটা খুলে দাও।
আরেকদিনের কথা, সম্রাট দলবল নিয়ে যুদ্ধযাতত্রা করেছেন। সঙ্গে তোতা পাখিও আছে। পথে এক জায়গায় তোতা পাখির রক্ষক ক্লান্ত হয়ে অপেক্ষা করছে। সবাই চলে গেছে। তখন পাখিটা বলল, সবাই চলে গেছে, আমরা বসে আছি কেন? আমরা কেন যাচ্ছি না?
সম্রাট বাবর তাঁর জীবনীতে গালগল্প ফাঁদবেন বলে মনে হয় না। তিনি সেই সময়কার হিন্দুস্থানের নিখুঁত বর্ণনা তাঁর গ্রন্থে দিয়ে গেছেন। পাখির যে রক্ষক সম্রাটকে এই কথা বলেছে তার নাম আবুল কাসিম জালায়ের। সম্রাট লিখেছেন, এ আমার অত্যন্ত বিশ্বস্ত।
নানান ধরনের পাখি সম্পর্কে বাবর লিখে গেছেন। কয়েকটা উদাহরণ—
লুজাঃ মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত এর গায়ে কয়েক রকমের রঙ। গলায় কবুতরের গলার মতো চকচকে রঙ আছে। এ পাখি পর্বতের চূড়ায় বাস করে।
ফিংঃ বিশাল পাখি। এদের এক একটি ডানা লম্বায় মানুষ সমান। এর মাথা ও গলায় কোনো লোম নেই। এর গলায় থলের মতো একটা কিছু ঝুলে। এর পিঠ কালো, বুক সাদা। এ পাখি মাঝে মাঝেই কাবুলে দেখা যায়। একবার আমাকে একটা ফিং পাখি ধরে এনে দিল। পাখিটা পোষ মানল।
কোকিলঃ দৈর্ঘ্যে কাকের সমান, কিন্তু দেহ কাকের চেয়ে সরু। গান গায়। হিন্দুস্থানের বুলবুল। আমরা যেমন বুলবুল ভালোবাসি হিন্দুস্থানের লোকরা তেমনি কোকিল ভালোবাসে। ঘন গাছের বাগানে থাকে।
অদ্ভুত আরেক পাখির কথা আমি দাদাজানের কাছে শুনেছি। তিনি এই পাখির নাম বলেছেন ‘মউত পাখি’। যখন কোনো বাড়িতে কারও মৃত্যু ঘনিয়ে আসে তখন এই পাখি নাকি নিশিরাতে বাড়ির চালে এসে বসে অদ্ভুত গলায় ডাকতে থাকে। আমার সবচেয়ে ছোট ফুফুর মৃত্যুর দুই রাত আগে নাকি এমন একটা পাখি দাদাজানের বাড়ির টিনের চালে এসে বসে ডাকতে শুরু করে। আমার এই ফুপুর নাম মাহমুদা। মাত্র ১৩ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়। আমার মা সবসময় বলেন, এমন রূপবতী কিশোরী তিনি তাঁর জীবনে দেখেন নি।
পক্ষীবিশারদ সাদাত সেলিমের মতে পাখি নিজের মৃত্যুর অগ্রীম খবর পায়। এই ক্ষেত্রে অন্য প্রাণীদের মৃত্যুর খবরও তাদের কাছে থাকার কথা।
পক্ষী প্রসঙ্গের এইখানেই ইতি। এখন চলে যাই অন্য প্রসঙ্গে। অমবস্যার রাত। আকাশভর্তি তারা। হ্যারল্ড রশীদ তার টেলিস্কোপ তারাদের দিকে তাক করেছেন।
আমরা প্রথম দেখলাম লুব্ধক নক্ষত্র। আকাশের উজ্জ্বলতম তারা। ইংরেজি নাম সিরিয়াস। অতি প্রাচীন এক সভ্যতার নাম মায়া সভ্যতা। মায়ারা বলত তারা এসেছে লুব্ধক নক্ষত্রের পাশের একটি নক্ষত্র থেকে। লুব্ধক নক্ষত্রের পাশে কোনো নক্ষত্র এতদিন পর্যন্ত পাওয়া যায় নি। এখন জোতির্বিদরা একটি নক্ষত্র আবিষ্কার করেছেন।
লুব্ধকের পরে আমরা দেখলাম একটা সুপারনোভা। তারপর দেখা হলো সপ্ত ভগিনি তারাগুচ্ছ (Seven sisters)। বৃহস্পতি ডুবে গিয়েছিল বলে বৃহস্পতি বা তার চাঁদ দেখা গেল না। শনিগ্রহের অবস্থান বের করতে হয় বৃহস্পতি গ্রহ থেকে। যেহেতু বৃহস্পতি নেই আমরা শনি দেখতে পারলাম না, তবে North star খুব খুঁটিয়ে দেখলাম।
নর্থ স্টারের বাংলা নাম ধ্রুবতারা। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত গান আছে তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা। সূর্য পূর্বদিকে উঠে পশ্চিমে অস্ত যায়। আকাশের সমস্ত তারা পশ্চিমদিকে উঠে পূর্বদিকে অস্ত যায়। একমাত্র ব্যতিক্রম নর্থ স্টার বা ধ্রুবতারা। এই তারা আকাশ স্থির হয়ে থাকে। নাবিকরা এই তারা দেখে দিক ঠিক করেন। আমাদের দেশের নৌকার মাঝিরাও এই তারা খুব ভালো করে চেনে।
তারা দেখা চলছে, হঠাৎ আমাদের আসরে চকচকে কালো রঙের এক কুকুর উপস্থিত হলো। হ্যারল্ড রশিদ বললেন, হুমায়ূন ভাই, এই কুকুরটা জ্বিন।
আমি বললাম, আপনার সমস্যা কী বলুন তো। সকালে বলেছেন মরা পাখি সব জ্বিন খেয়ে ফেলে। এখন বলেছেন কালো কুকুর জ্বিন।
হ্যারল্ড রশিদ বললেন, আমি বই পড়ে বলছি।
কী বই।
বইয়ের নাম জ্বিন জাতির অদ্ভুত ইতিহাস।
কে লিখেছেন। প্রকাশক কে?
এইসব মনে নাই।
বইটা কি আছে আপনার কাছে?
না।
আমি ঢাকায় ফিরে এসেই নুহাশ চলচ্চিত্রের এক কর্মকর্তাকে বাংলাবাজারে পাঠালাম, সে যেভাবেই হোক জ্বিন জাতির অদ্ভুত ইতিহাস গ্রন্থ জোগাড় করবে।
দুপুরবেলা সে জানাল পাঁচটা ইতিহাস সে পেয়েছে। সবগুলি কিনবে কি-না।
আমি বললাম, সব কিনবে।
সে বিকেলে পাঁচটা বই নিয়ে উপস্থিত হলো। আমি দেখলাম প্রতিটি বই হলো চীন জাতির ইতিহাস। সে চীনের ইতিহাসের সব বই কিনে নিয়ে চলে এসেছে।
যাই হোক শেষ পর্যন্ত জ্বিন জাতির বিস্ময়কর ইতিহাস বইটি পাওয়া গেছে। মূল বই আরবি ভাষায়। লেখক আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়তী (রহঃ), অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ হাদীউজ্জামান। আরেকটি বই পাঅয়া গেছে জ্বিন ও শয়তানের ইতিকথা। এটিও আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়তীর (রহঃ) লেখা। বই দুটি পড়ে জ্বিন জাতি সমন্ধে যা জেনেছি তার সারমর্ম
জ্বিন শব্দের অর্থঃ গুপ্ত, অদৃশ্য, লুকানো, আবৃত।
জ্বিন জাতির শ্রেণীবিভাগঃ
ক. সাধারণ জ্বিন।
খ. আমির : মানুষের সঙ্গে থাকে।
গ. আরওয়াহ
: মানুষের সামনে আসে।
ঘ. শয়তান
ঙ. ইফরীব্ব (শয়তানের
চেয়েও বিপদজনক। এদের দেখা পেলে আযান দিতে হবে।)
জ্বিন কিসের তৈরিঃ পবিত্র কোরান শরীফে বলা হয়েছে, “আমি আদমের আগে, জ্বিনকে সৃষ্টি করেছি ‘লু’ র আগুন দিয়ে।” (সুরাহ আল হিজর, আয়াত ২৭)।
হযরত ইবনে আব্বাস (রঃ) এই আয়াতের ব্যাখা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘লু’ র আগুনের অর্থ খুবই সুন্দর আগুন। হযরত উমার বিন দীনার (রঃ) বলেছেন, জ্বিন জাতি সৃষ্টি করা হয়েছে সূর্যের আগুন থেকে।
জ্বিনদের প্রকারভেদঃ তিন শ্রেণীর জ্বিন আছে—
১. এরা হাওয়ায় উড়ে বেড়ায়। খাদ্য গ্রহণ করে না। নিজেদের মধ্যে বিয়ে হয় না। সন্তান উৎপাদন করে না।
২. এরা মানুষের সংস্পর্শে আসে। খাদ্য গ্রহণ করে। বিয়ে করে। সন্তান উৎপাদন করে।
৩. সাদা রঙের সাপ এবং সম্পূর্ণ
কালো কুকুরও জ্বিন।
জ্বিনদের খাদ্যঃ নবীজি (সঃ) বলেছেন, তোমাদের খাদ্য এমন সব হাড় যার প্রতি আল্লাহর নাম নেওয়া হয়েছে তা-ই জ্বিনের খাদ্য। (তিরমিযী)
(আমরা শুনি জ্বিনরা মিষ্টি খেতে পছন্দ করে। তার কোনো উল্লেখ পাই নি।)
জ্বিনদের সঙ্গে মানুষের বিয়েঃ এই নিয়ে আলেমদের মতভেদ আছে। এক দল বলছেন, জ্বিন যেহেতু সম্পূর্ণ অন্য প্রজাতির, কাজেই তাদের সঙ্গে মানুষের বিয়ে অবৈধ।
আলেমদের আরেক দল বলছেন, পবিত্র কোরান শরিফে আল্লাহ শয়তানকে বলেছেন, ‘তুই মানুষের সম্পদে ও সন্তানে শীরক হয়ে যা।’ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৬৪)।
সন্তানে শারীক হতে হলে বিবাহ বাঞ্ছনীয়। কাজেই জ্বিনের সঙ্গে মানুষের বিয়ে হতে পারে।
মানুষ এবং জ্বিনের যৌনক্রিয়ায় যেসব সন্তান জন্মায় তারাই হিজড়া। (হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)) এদের আরবি নাম খুন্নাস।
পাদটিকা
নিউজিল্যান্ডের এক বাড়িতে দু’টা ভূত ধরে বোতলবন্দি করা হয়েছে। একটি অল্পবয়সী দুষ্ট ভূত। অন্যটি শান্ত-ভদ্র ভূত। দু’টি ভূতই ইন্টারনেটের মাধ্যমে নিলামে তুলে বিক্রি করা হয়েছে।
সূত্র : কালের কণ্ঠ, ইন্টারনেট