জ্বালা – ১২

বারো

অ্যারোয়োতে ফিরে আসতে প্রচুর সময় লাগল সাওলোর। ওর পিঠে মাংসের বোঝা—তায় পুরোটা পথই জঙ্গলাকীর্ণ; বোঝাপিঠে জঙ্গল ভাঙ্গার পরিশ্রমে ক্লান্তির চরম সীমায় পৌছল সে। তবু সতর্ক থাকতে হচ্ছে কাছেপিঠে সম্ভাব্য শত্রুর ভয়ে।

অ্যারোয়ো-মুখে পৌঁছে শিস দিল সাওলো পাখির অনুকরণে; অ্যাপাচিদের মনোযোগ আকর্ষণ না-করে নিজের উপস্থিতি জানান দেবার জন্যে এরকম শিস দেবার কথা যাবার সময় ইয়েটসকে বলে রাখা হয়েছিল। ইয়েটস সাড়া দিল; গজ কয়েক দূর থেকে ওর চাপা গলা শোনা গেল, ‘এখানে। এসে পড়ো, স্টেইভ।’

জোর করে নিজেকে ঠেলে নিয়ে চলল স্টেইভ, বাকি পথটা পেরোল সে অনেক কষ্টে। ইয়েটসের কাছে পৌঁছে পিঠের বোঝা নামিয়ে ধপ করে বসে পড়ল দু’হাঁটুর মধ্যে মাথা রেখে। ওর পাশে এসে বসল ইয়েটস। ঠিক আছ, বাছা?’

‘আমি ঠিক আছি। তোমাদের কোনও সমস্যা?’

‘এখনও হয়নি। কেউই ঘুমোইনি আমরা। সবাই উত্তেজনায় ভুগছে। স্টিফেন আবার চেষ্টা করেছিল, সুবিধে করতে পারেনি।’

মাংসের বোঝাটা তুলে নিল ইয়েটস। সামান্য বিশ্রামে শক্তি কিছুটা ফিরে পেল সাওলো। উঠে দাঁড়াল, হাঁটতে শুরু করল দু’জনে অ্যারোয়োর ভেতর আগুনের উদ্দেশে। আগুনের পাশে উত্তেজিতভাবে পায়চারি করছিল স্টিফেন, ইয়েটসকে দেখে থমকে দাঁড়াল। আমার মনে হয়, ব্যাপারটা আরেকবার ভেবে দেখলে ভা…’ শুরু করেছিল ও, সাওলোর ওপর চোখ পড়তে থেমে গেল।

মাংসের বোঝাটা আগুনের পাশে রাখল ইয়েটস, মেলোডি বাদে সবাই তাকাল ওদিকে। মেলোডি তাকিয়ে আছে সাওলোর দিকে। এক মুহূর্ত, তারপর হাসল স্নিগ্ধচোখে। ‘মি. স্টিফেন বলছিল,’ শুকনো স্বরে বলল, তুমি আদৌ ফিরবে না।’

‘ওর বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি ছিল নিশ্চয়!’ হাসল সাওলো নিজেও।

স্টিফেন কোনও মন্তব্য করল না। সাওলো ওর দিকে চাইল। ওর চোখে ক্রোধ আর আতঙ্ক মেশানো অদ্ভুত দৃষ্টি। যে-কোনও মুহূর্তে, ভাবল সাওলো, বিস্ফোরিত হতে পারে লোকটা।

ছুরির সাহায্যে পাতলা করে কেটে কাঠিতে গেঁথে আগুনে ঝলসে নিয়ে ভেড়ার মাংস খেল ওরা সবাই। সামান্য তিতকুটে লাগলেও চর্বিঅলা বুনো ভেড়ার মাংস খেতে খারাপ লাগল না কারও।

পেটে গরম খাবার আর শরীরে সামান্য বিশ্রাম পেয়ে অনেকটা চাঙ্গা হয়ে উঠল সাওলো। দলের কাছ থেকে একটু দূরে গিয়ে বসল ও বর্তমান পরিস্থিতি ও পরবর্তী কর্মপন্থা—দুটোই ঠাণ্ডা মাথায় খতিয়ে বিচার করার জন্যে।

সাওলো জানে, ট্যুবাক কিংবা সিলভারটন থেকে সাহায্য আসার আগ পর্যন্ত নিজেদের মনোবল অক্ষুণ্ণ রেখে অ্যাপাচিদের ঠেকিয়ে রাখাটা খুবই কঠিন হবে তাদের জন্যে। নেপুতের কথা বিশ্বাস করলে তাদের এখনই পালানো উচিত এখান থেকে। সর্বশেষ আক্রমণের মত অ্যাপাচিদের তরফ থেকে আরেকটা আক্রমণ এলে টিকে থাকার চেষ্টায় সাফল্যের সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। এমন কী, ওদের অস্ত্রশস্ত্র একেবারে ফুরিয়ে না-গেলেও শত্রুদের ঘায়েল করা সম্ভব হবে না। কারণ ওদের লোকবল কম। ওয়াল্টার নিহত, হাব ঘোরের মধ্যে আছে, গ্যানো অকেজো, স্টিফেন আর অ্যাম্বারগো অবিশ্বস্ত; এদিকে দু’জন মহিলার মধ্যে একজনও অস্ত্র চালনায় অভ্যস্ত নয়।

নিজের লোকদের ওপর কুরিয়াপোর কর্তৃত্ব যদি কমে গিয়ে থাকে, তাহলেও যে-কোনও সময় অ্যাপাচিদের আক্রমণ আসবেই। তাছাড়া কুরিয়াপো নিজেই দমবে না। ওর দোআঁশলা সৎভাইয়ের কল্লা সে নেবেই। ও সেজন্যেই এসেছে। হেলাফেলায় নিজের লোকদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে নয়। এটা খুব খারাপ ব্যাপার। অ্যাপাচিদের কাছে লড়াইটা খেলা নয়। অন্যান্য গোত্রের ইন্ডিয়ানরা তাদের যুবকদের লড়াইয়ে উৎসাহিত করে শত্রুর ওপর বিজয়ী হয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্যে। কিন্তু অ্যাপাচিদের কাছে ব্যাপারটা ভিন্ন। ওরা লড়াই করে প্রথমত টিকে থাকা, দ্বিতীয়ত লুটপাট এবং সবশেষে নাম কামানোর জন্যে। একজন অ্যাপাচি ওয়ারচীফের কৃতিত্ব হিসেব করা হয়, কতটা কম ক্ষয়-ক্ষতির বিনিময়ে কত বেশি লাভ করতে পেরেছে সে, তার ওপর। যে-নেতার অধীনে সৈন্য মারা যায়, ওদের চোখে সে কখনও ভাল নেতা নয়।

কুরিয়াপো এখন ভাল প্যাঁচে পড়েছে। এ লড়াইয়ে প্রচুর লোক হারিয়েছে ও—এটা অ্যাপাচিদের কাছে ওর জন্যে দারুণ অবমাননাকর ব্যাপার হবে। তাছাড়া যদি এই মুষ্টিমেয় ক’জন শেতাঙ্গকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে না পারে, তাহলে ওর অযোগ্যতা ক্ষমা করবে না ওরা। ওর এখন আক্রমণ করার সামর্থ্য নেই—আবার আক্রমণ না করারও উপায় নেই। ওর লোকদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে তাহলে, ওদের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারাবে ও। অগত্যা ইজ্জত বাঁচানোর তাগিদে মরিয়া হয়ে শেষ পর্যন্ত আক্রমণেই যাবে।

সেটা কখন হতে পারে? সময়টা আন্দাজ করার চেষ্টা করল সাওলো। সম্ভবত সকালেই আক্রমণটা আসবে। দুটো কারণ আছে এর পেছনে। ভোরের আলো সম্পূর্ণ ফোটার আগে আলো-আঁধারির সুবিধাটুকু নেবে ওরা; আবার ওদের বিশ্বাস মতে, এসময় কেউ নিহত হলে ওর আত্মারও আটকে থাকার ভয় থাকবে না।

গ্যানোর দেখাশোনা করছিল মেলোডি। হঠাৎ পাশে বসে ওর মুখে হাত রাখল সে। দাঁড়াল পরক্ষণেই, ঠোঁট কাঁপছে ওর; সাওলোকে ডাকল, ‘স্টেইভ, একটু আসবে এদিকে?’

দ্রুত গ্যানোর পাশে চলে গেল সাওলো। উবু হয়ে ওর পাশে বসল। গ্যানোর চোখ বন্ধ, মুখে রক্ত নেই, মোমের মত শাদা।

দাঁতে ঠোঁট চেপে ধরে একপাশে সরে গেল মেলোডি। স্টিফেন কাছে এল। একনজর দেখল গ্যানোকে, তারপর হেসে উঠল অদ্ভুতভাবে। ‘শেষ, না?’ তারপর যেন নিজেকে শোনাল, ‘আমাদেরও এক্ষুণি পালানো উচিত।’

ওর হাতে একটা উইনচেস্টার। উঁচিয়ে সাওলোর বুক বরাবার সই করল ওটার নল। ‘যাচ্ছি আমি, স্টেইভ! এতে হারাবার কিছু নেই। তুমি নিজেও তা জানো।’

রাইফেলের নলের দিকে সাওলোর চোখ। বিতৃষ্ণা বোধ করছে সে। ‘কাজটা ঠিক করছ না তুমি, স্টিফেন!’

‘প্রয়োজন হলে আরও বেঠিক করব।’ রাইফেল নাড়াল সে। ‘তুমি বাধা দিতে এলে ট্রিগার টেনে দেব।’

ম্যাগি লাফিয়ে উঠল। ‘মিস্টার, প্লীজ, প্লীজ!’ দৌড়ে স্টিফেনের কাছে চলে এল ও, ওর বাহু আঁকড়ে ধরল; মেয়েটির চোখে উন্মাদনা। আমাকেও তোমার সঙ্গে নিয়ে যাও, মি. স্টিফেন। আমাকে এখানে ফেলে রেখে যেয়ো না!’

‘ঠিক আছে,’ ওকে আশ্বস্ত করল স্টিফেন। যাবে। দুটো ঘোড়া নেব তাহলে।’

সাওলোর দিকে তাকাল সে। তাহলে এই হলো ব্যাপার, ব্রীড!’ বাকিদের দিকে ইঙ্গিত করল ও। ‘এরা কী যুদ্ধ করবে? তুমি শীঘ্রিই মারা পড়বে, বাজি ধরে বলতে পারি।’

সাওলোর মুখে কথা নেই। স্টিফেন একদৃষ্টে চেয়ে রইল ওর দিকে। ওর পেছনে হাব সাবধানে নিজের রাইফেলটা তুলে নিয়ে লিভার টানতে গেল। নিষেধ করল ওকে সাওলো মাথা নেড়ে। ‘ওদের যেতে দাও, হাব।’

‘জেন্টলমেন, অ্যাম্বারগো হাঁক দিল। ‘বে’টা আমি নিচ্ছি।’ পাছায় ভর দিয়ে এগোল খানিকটা। ‘আমিও ভাগব।’

‘ওটার কথা ভুলেও ভেবো না, অ্যাম্বারগো,’ সাওলো বলল ওকে।

ঝনাৎ করে শেকল বাঁধা দু’হাত বাজাল অ্যাম্বারগো। ‘অ্যাই, ব্ৰীড! জিমি মরে গেছে। আমি ওর বন্দী ছিলাম, তোমার নই। তুমি আটকাতে পারো না আমাকে।’

‘পারি, আমি ওকে পছন্দ করতাম। ওর কাজটা আমিই শেষ করব ভাবছি।’

ফ্যাকাসে হাসি হাসল অ্যাম্বারগো, খিস্তি করল, ‘বাস্টারডো! তোমাকে হয়তো আমিই শেষ করব, ব্রীড! আমার সুযোগ আসবে।’

‘বেশ তো!’ সাওলো স্মিত মুখে সায় দিল। ‘অপেক্ষা করব আমি।’ স্টিফেন আর ম্যাগির দিকে চাইল সে, ওর ভেতর প্রচণ্ড ক্রোধ পাক দিচ্ছে। ‘যাচ্ছ তোমরা?’

ঝোপঝাড় সরিয়ে ঘোড়াগুলোর কাছে গেল স্টিফেন। ওগুলোর পিঠে জিন চাপাতে শুরু করল।

‘স্টেইভ,’ ফ্যাকাসে মুখে সাওলোর দিকে চাইল মেলোডি, ওর চোখে আতঙ্ক। ‘না। ওদের যেতে দিয়ো না। তুমি – তুমি পাগল হয়ে গেছ, স্টেইভ! পুরোপুরি!’

ওর কাছে গেল সাওলো। হাত রাখল কাঁধে। এ দুটো মানুষের সঙ্গে দেখা হবার পর থেকে বড় অশান্তিতে আছি আমি,’ ক্লান্তস্বরে বলল। ওদের বাঁচিয়ে রাখার জন্যে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি, তুমি দেখেছ। ওরা তার কোনও মূল্য দেয়নি। আমার মুখে কেবল থুতুই ছিটিয়েছে। ওই দক্ষিণের দেখতে আপদমস্তক ভদ্র লোকটার কথা শুনেছ তুমি নিশ্চয়। বাধা দিতে গেলে হয়তো ও মরবে; নইলে আমি। যা-ই হোক না কেন, ওতে কিছু আসবে যাবে না, কিছুই না।’

স্টিফেন বে’র পিঠে আর ম্যাগি হডসন জিমি গ্যানোর পিন্টোর পিঠে চড়ে ধীরে ধীরে ওদের চোখের আড়ালে চলে গেল। পাথরে ওদের ঘোড়ার খুরের শব্দ শোনা গেল কিছুক্ষণ, আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল আওয়াজ।

পাহারা দেয়ার জন্যে উঁচু বড় পাথরটার ওপর বসে রইল ইয়েটস, অন্যেরা আগুনের পাশে গোল হয়ে বসা; চুপচাপ, কথা বলছে না কেউ

এখনও কোনও গুলির শব্দ শোনা যায়নি। অবাক হলো সাওলো। স্টিফেনের কাছে একটা পিস্তল আর উইনচেস্টার আছে। গোলাগুলি ছাড়া ওদের কোনওমতে বেরোতে পারার কথা নয় এখান থেকে।

অবশেষে নীরবতা ভাঙল মেলোডি, হয়তো… বলল ও।

ওর দিকে চাইল সাওলো। মাথা নেড়ে অসমর্থন জানাল, কোনও মন্তব্য করল না। ওর কান আবার খাড়া হলো।

অবশেষে শোনা গেল গুলির শব্দ, অনেক দূরে; হঠাৎ আবার বন্ধ হয়ে গেল।

‘ওরা নিশ্চিত ছিল,’ বলল সাওলো। ‘তাই অপেক্ষা করছিল চুপচাপ। ওদেরকে প্রায় নিশ্চিন্ত বোধ করার সুযোগ দিয়েছিল।’

‘ঈশ্বর!’ আর্তনাদ করে উঠল হাব। ঠিক তা-ই ঘটেছে!’

.

এখন ওরা পাঁচজন; আর ঘোড়া একটা। সাওলোর জেবরা ডানটা।

হাব আগুনের দিকে চাইল। নতুন করে লাকড়ি চাপাল ওখানে, আগুন জ্বলে উঠল উঁচু হয়ে। মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল সে আগুনের জ্বলা। আচমকা মাথা তুলে বলল, ‘মি. স্টেইভ, ওরা আমাদের আক্রমণ করবে, না? সকালেই?’

‘আমারও তা-ই ধারণা, হাব।’

‘তাহলে আমরাই ওদের আক্রমণ করি না কেন?’

‘সেজন্যে প্রচুর লোক আর গোলাবারুদ দরকার। আমাদের তা নেই। ওদের ঠেকিয়ে রাখতে হলেও তা দরকার।

‘ট্যুবাক থেকেও নিশ্চয় সহসা সাহায্য পাচ্ছি না?

‘না।’

‘বেশ, তাহলে, আমার মতে, আমাদের হারাবার কিছুই নেই আর। আমরা ওদের আগে আক্রমণে যাব। বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করব এখান থেকে।’

‘পারবে না, হাব। প্রথম যাত্রায়ই আমরা মারা পড়ব।’

‘হয়তো পারব। হয়তো কেন, উপায় একটা নিশ্চয়ই পেয়ে যাব। আমি আশাবাদী।’

মেলোডি আর ইয়েটসের দিকে চাইল সাওলো। মনোযোগ দিয়ে শুনছে ওরা। যখন কোনও আশা থাকে না, ভাবল তিক্ততার সাথে, মানুষ কুটোর

ওপরও ভরসা করতে চায়।

‘ধরো, হাব বলে চলল, ‘আমাদের মধ্যে কেউ একজন অ্যাপাচিদের মনোযোগ অন্যদিকে ফিরিয়ে দেবে, ওদের বিভ্রান্ত করবে। এই ফাঁকে পালাবে বাকিরা।’

‘কিভাবে বিভ্রান্ত করবে ওদের?’

জেবরা ডানটার দিকে ইশারা করল হাব। অস্থির ভঙ্গিতে খুর আছড়াচ্ছে ঘোড়াটা। ‘ধরো, একজন ঘোড়াটা নিয়ে হঠাৎ খুব দ্রুত পালানোর ভঙ্গি করল। অ্যাপাচিরা অপ্রত্যাশিত কাণ্ড দেখে প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খাবে, তারপর মরিয়া হয়ে পিছু নেবে ওর। পলায়নরত লোকটা কিছুদূর গিয়ে ঘোড়া ছেড়ে দেবে, লুকিয়ে পড়বে পাথর কিংবা ঝোপঝাড়ের আড়ালে। গুলি ছুঁড়তে শুরু করবে এলোপাতাড়ি। অনেক লোক হারিয়ে উত্তেজিত হয়ে আছে ওরা। সহজে বিভ্রান্ত হবে।’

মাথা নাড়ল সাওলো। ওর পেছনে সবাই ছুটবে না। পেছনে আর কাউকে পালাতে না-দেখে অপেক্ষা করবে বাকিরা ওদের জন্যে। এদিকে ঘোড়া ছাড়া বাকিরা বেশিদূর যেতে পারবে না।’

‘দাঁড়াও।’ হাঁটুর ওপর দু’হাত রেখে উবু হয়ে বসল হাব। ‘আরেকটা বুদ্ধি আছে। ওদের বিভ্রান্তির মধ্যেই আমাদের কেউ একজন ওদের ঘোড়ার কাছে চলে যাবে। তুমিই এটা সবচে’ ভাল পারবে।’

‘গার্ড থাকবে ওখানে, একজন হলেও।’

‘ওকে কবজা করে ঘোড়াগুলো নিয়ে যেতে হবে। হাব হাসল একটু, ভাবল, তারপর বলল, ‘এদিকে নেহাত যতটা দরকার, ততটা মালপত্র নিয়ে বাকিরা সরে যাবে এখান থেকে। অ্যাপাচিরা নিজেদের বিভ্রান্তি কাটিয়ে এবং ঘোড়া খুঁজে নিয়ে বের হতে হতে কয়েক ঘণ্টার পথ পেরিয়ে যাওয়া যাবে।’

‘হুম!’ মাথা দোলাল সাওলো। ‘খারাপ না। আমাকেই তাহলে ওদের ঘোড়ার কাছে যেতে হবে।’

‘আর আমি ওদের বিভ্রান্ত করার ভার নিচ্ছি।’ শাদা দাঁত বের করে ফেলল হাব, হাসছে। ‘দু’দিক থেকে দ্বন্দ্বে পড়ে গিয়ে বেদিশা হয়ে যাবে ইন্ডিয়ান খুনীগুলো। ওরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমাদের লোকেরা অ্যারোয়ো থেকে বেরিয়ে যেতে পারবে, আগে থেকে নির্দিষ্ট-করা একটা জায়গায় গিয়ে তোমার জন্যে অপেক্ষা করবে। তুমি প্রয়োজনীয় সংখ্যক ঘোড়া নিয়ে চলে যাবে ওখানে।’

‘এদিকে তুমি থেকে যাবে অ্যাপাচিদের ঘেরাওর মধ্যে। তারপর তুমি যদি টিকে থাকতে পারো, তাহলে আমরা পালাতে পারব। কিন্তু তোমাকে ছেঁকে ধরবে ওরা চারদিক থেকে। তাই না?’

‘ঠিক তাই,’ শান্তস্বরে বলল হাব। ‘কেন, তোমার পছন্দ হচ্ছে না পরিকল্পনাটা?’

‘ভুলে যাও, হাব, একদম ভুলে যাও। তোমার জীবনটাকে অত সস্তা ভেব না।’

‘আমি জানতে চাইছি, পরিকল্পনাটা কাজ দেবে কি না, মি. স্টেইভ?’

‘কিভাবে? ওটা চরম বোকামি হবে, ম্যান। যীশুর কসম! এক হাজারটা ফুটো রয়ে গেছে তোমার পরিকল্পনায়।’

‘এটা একটা সুযোগ। একটু ভেবে দেখো, মি. স্টেইভ। এ ছাড়া আমাদের জন্যে এখান থেকে বেরোবার আর কোনও পথ নেই।

আচমকা উঠে দাঁড়াল হাব, সাওলোর দিকে আসতে লাগল সোজা। ওর নড়াচড়াটা এত দ্রুত হয়েছে যে, সাওলো কিছুটা বিস্মিত হলো। ফলে হাবের হাতের উইনচেস্টারটার নলের দিকে লক্ষ করল না ও। ওটা হাবের একপাশ থেকে সোজা ওর বুকে তাক করা। লিভার টেনে দিল হাব।

সাওলো বসেছিল, নইলে ওর মতলব বুঝে ওঠার পর কিছু একটা করার চেষ্টা করত। তবু পিস্তলের বাঁটে হাত চলে গেল ওর।

ধমক দিল হাব, ‘থামো, মি. স্টেইভ!’

‘ম্যান, সাওলো ওকে বোঝাতে চাইল। মাথাটা খাটাও, প্লীজ! এতে কাজ হবে না।’

‘হবে,’ একগুঁয়ে স্বরে বলল হাব। ‘নরক গুলজার করে দেব আমি ওদের মাঝখান দিয়ে আচমকা ঘোড়া ছোটাব গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে। ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়ে দেব। ব্যাপারটা বুঝে উঠে অ্যাকশনে যাবার অনেক আগেই পাথরের আড়ালে চলে যাব, গুলি করতে থাকব এলোপাতাড়ি। এমন কী, যারা পাহারায় আছে, ওরা পর্যন্ত বেদিশা হয়ে যাবে। হয়তো এতেই…’

‘শোনো,’ বাধা দিল সাওলো, উঠে এক পা এগোল। ‘ঠিক আছে। আমি ঘোড়ার দিকটা দেখব। কিন্তু দয়া করে তুমি ওটা করতে যেয়ো না। ম্যান, তুমি, বুঝতে পারছ না। ওরা তোমাকে জীবিত ধরতে পারলে…ওদের নির্যাতন…’

‘আর এক পাও এগোবে না, মি. স্টেইভ।’ সামান্য পিছু হটল হাব। ওর রাইফেলের ব্যারেল একচুলও নড়ল না। ওরা আমাকে যদি পেয়েই যায়, জীবিত পাবে না। তোমাকে কথা দিচ্ছি।’

মেলোডি আর ইয়েটস ওদের কথা শুনছে। ইয়েটসকে কভার করেনি হাব, তবে প্রয়োজনে ওকেও চেক দিতে পারবে। ওর মুখভাব কঠিন, কর্তব্য সাধনের সঙ্কল্পে দৃঢ়। সাওলোকে বলল, ‘আমি মারা গেলেও আফসোস নেই, মি. স্টেইভ। তোমার কাজটা তুমি ঠিকমত করতে পারলে এরা সবাই অন্তত বাঁচার একটা সুযোগ পাবে।’

‘কিন্তু,’ এতক্ষণে কথা বলল মেলোডি। ‘তুমি কেন এসব করতে যাচ্ছ, হাব? তোমার কী লাভ এতে?’

‘লাভ, ম্যাম?’ হাব হাসল। ‘শোনো। আসলে তুমি এসবের জন্যে মি. স্টেইভকে দায়ী করতে পারো। ও-ই আমাকে শিখিয়েছে কি করে মানুষের মত বাঁচতে হয়। এখন আমি ওকে দেখাব, কিভাবে মানুষের মত মরতে হয়।

‘এসবের কোনও অর্থ নেই!’ সাওলো কর্কশস্বরে বলল।

‘নেই? তাহলে শোনো,’ হাবের মুখ পাথরের মত কঠিন দেখাল। বলে চলল ও, ‘এখানে সামান্য সময়ের জন্যে হলেও, আমি একজন মানুষ হয়েছিলাম। আমি ফের অমানুষ হতে চাই না, মি. স্টেইভ।’

‘তুমি যা চাও, তা হতে পারো, হাব।’

‘না, পারি না, একরোখার মত বলল হাব। তুমি নিজেও তা জানো। আমি তোমার মত করে বাঁচতে পারি না। তোমার জীবনটা কঠিন, সারাক্ষণই কষ্টের মধ্যে। আমি ওই ধাতের মানুষ না। আর, এ ছাড়া, এই জঘন্য শাদাদের মধ্যে মানুষের মত বেঁচে থাকার কোনও উপায় কালোদের জন্যে নেই।

ইয়েটসের দিকে চাইল ও, ‘ঘোড়াটা এনে দেবে, মি. ইয়েটস?’

লাফ দিল সাওলো। হাবের বুকে মাথার গুঁতো লাগিয়ে এবং একই সঙ্গে ওর হাত থেকে রাইফেলটা কেড়ে নিয়ে নিষ্ক্রিয় করতে চাইল ওকে। পলকে এক পাশে সরে যেতে চাইল হাব। পুরো পারল না। সাওলোর মাথা ওর কোমরে লাগল। একই সাথে রাইফেলের নাগাল পেল সাওলো, টান দিল কেড়ে নেবার জন্যে। কিন্তু সাওলোর উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে ওটাকে শক্ত করে ধরেছে হাব। সুবিধে করতে পারল না সাওলো। মরিয়া হয়ে হাবের কবজি ধরে টান দিল আচমকা। তবে হাবের ধস্তাধস্তির ফলে ভারসাম্য হারিয়েছে সে, টানটা যুৎসই হলো না। হ্যাঁচকা টানে নিজের কবজি ছাড়িয়ে নিল হাব, রাইফেল তুলে সাওলোর মাথায় বাড়ি লাগাল। শেষ মুহূর্তে মাথা সরাতে গেল সাওলো, পারল না, ওর মাথার একপাশ পিছলে কাঁধে লাগল বাড়িটা।

পরবর্তী এক মিনিট কিংবা তারচে’ বেশি সময় চোখে অন্ধকার দেখল সাওলো। কখন হাঁটু ভেঙে পড়ে গেছে টেরও পেল না। চোখের ঘোর কেটে যেতে দেখল বালির ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে। ওর মাথায় প্রবল যন্ত্রণা, ডান কাঁধ অসাড়।

হাত আর হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে ধীরে ধীরে মাথা তুলল ও। মাথা নেড়ে যন্ত্রণা সওয়ার চেষ্টা করল। হাবকে দেখল গজ কয়েক দূরে ওর দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাবের দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে ক্ষমা প্রার্থনার ভাব। ‘দুঃখিত, ‘ বলল সে। ‘এখন কিছুটা ভাল বোধ করছ?’

চোখ পিট পিট করল সাওলো। যন্ত্রণা কাটানোর চেষ্টা করছে। মাথা ঝাঁকাল।

‘গুড। তাহলে তুমি তোমার কাজে যাও—আমি আমারটা করব।

ইয়েটসের হাত থেকে জেবরা ডানের লাগামটা নিল সে। দু’পা দু’পাশে ঝুলিয়ে আনাড়ি ভঙ্গিতে ঘোড়ায় চাপল। ওর একহাতে লাগাম, আরেক হাতে উইনচেস্টার ধরা।

উঠে দাঁড়াল সাওলো, চুপচাপ তাকিয়ে রইল বিশাল কালো লোকটার দিকে।

‘আমার সঙ্গে আসতে যেয়ো না. মি. স্টেইভ। আমার কথা বাদ দাও। তুমি মরে গিয়ে আমার বেঁচে থাকার দরকার নেই। মি. ইয়েটস আর মেলোডি ম্যামকে কেবল তুমিই পারবে এখান থেকে জীবি বের করে নিতে।’

ঘোড়ার পেটে গুঁতো লাগাল লোকটা, ফিরল আবার। ‘মন খারাপ কোরো না, মিস্টার স্টেইভ। আমি যেমন বুঝেছি, মানুষের মত বেঁচে থাকা আর মরা, দুটো প্রায় একই কথা। খুব একটা পার্থক্য এতে আছে বলে মনে হয় না আমার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *