জ্বালা – ১

এক

স্টোর হাউসটা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আগুন দেখা যাচ্ছে না কোথাও; শুধু সাপের মত এঁকেবেঁকে ওপরের দিকে উঠে আসছে ধোঁয়া; কালো, তৈলাক্ত।

স্টোরের লাগোয়া পাহাড়টার রিজে বসে আছে সাওলো। ওর চারদিকে ছোট-বড় পাথর, ছড়ানো-ছিটানো। পুরো লে-আউটটার ওপর আরেকবার চোখ বুলাল ও।

আশে পাশে প্রায় একশো মাইলের মধ্যে এটাই একমাত্র জেনারেল সাপ্লাই স্টোর। স্টোরের পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ছোট্ট নদী হিডালগো। হিডালগোর স্বচ্ছ ঠাণ্ডা পানি, কিছুটা হলেও, সহনীয় রেখেছে মরু-মধ্যাহ্নের অসহ্য উত্তাপকে।

শরীর একটুও না-নাড়িয়ে শকুনটার দিকে তাকাল সাওলো। পাখা ছড়িয়ে ভাসছে ওটা শূন্যে, আগের চেয়ে কিছুটা নিচে নেমে এসেছে এখন। আরেকটা শকুন এসে যোগ দিল ওটার সাথে, দুটোই ঘুরতে লাগল চক্রাকারে। জ্যান্ত কিংবা মরা, অনুমান করল সাওলো, কিছু একটা আছে নিচে। শকুন এসে জুটেছে তাই।

বাকস্কিনের তৈরি শার্ট আর জিন্সের জীর্ণ প্যান্ট সাওলোর পরনে। আদি রঙের ওপর ঘামে ভেজা ময়লার পুরু আস্তরণ, ছাইরঙা পাথরের সাথে প্রায় একাকার হয়ে গেছে। ওর পায়ের মলিন বুটজোড়ার অবস্থাও পোশাকের চেয়ে খুব একটা ভাল নয়; চামড়া পচে কয়েক জায়গায় ছাল উঠে গেছে ওগুলোর।

কোলের ওপর আড়াআড়ি শুইয়ে-রাখা শার্পসটার ওপর থেকে হাত সরাল ও। কয়লা রঙের একটা স্প্যানিশ সিগার পকেট থেকে বের করে ঠোঁটে ঝোলাল। এরপর পুরো লে-আউটটার ওপর অনুসন্ধানী দৃষ্টি বুলাল।

স্টোরটার আশে পাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। সামনের উঠানমত ফাঁকা অংশটা খালি, খালি অদূরে অবস্থিত করালও, দরজা হাঁ করে খোলা ওটার-ঘোড়াগুলো নেই।

ছাই উড়ছে বাতাসে।

ওরা চলে গেছে, অনুমান করল সাওলো। অবশ্য নাও যেতে পারে—সেক্ষেত্রে ওদের খুঁজে বের করা যাবে না, ওরা নিজে থেকে দেখা না-দিলে। কিন্তু সে আশায় বসে থাকার সময় ও ধৈর্য কোনটাই আপাতত সাওলোর নেই। ওখানে কী ঘটেছে, একবার দেখা দরকার।

কোলের ওপর থেকে রাইফেলটা নামাল সে, উঠে দাঁড়াল। দূরে, ঝোপঝাড়ের আড়ালে বেঁধে রাখা জেবরা ডানটার দিকে তাকাল এক নজর, তারপর চারদিকের রোদে-পোড়া তামাটে পাথরগুলোর ওপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে ভূতের মত নিঃশব্দে নামতে শুরু করল।

একটুও তাড়াহুড়ো না-করে সতর্ক কিন্তু দ্রুতপদে উঠানটা পেরোল সাওলো। ওর হাতে রাইফেল, সামান্য উঁচু করে ধরা; তৈরি।

সন্তর্পণে স্টোর হাউসের চারপাশে ঘুরে এল ও। আসলে স্টোর হাউস নয়, এর কাঠামোটাই দাঁড়িয়ে আছে মাত্র। পাথরের তৈরি দেয়ালের ওপরকার কাঠের ছাদ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ছাই উড়ছে মরুভূমির তপ্ত বাতাসে। সাওলো সরে গেল ওখান থেকে, প্রায় পঞ্চাশ ফুট দূরে কূপের পাড়ে গিয়ে দাঁড়াল।

গোঙানির শব্দটা প্রথমবারেই শুনতে পেল ও। তবে মনোযোগ দিল না ওদিকে। ওখান থেকে একটু দূর দিয়ে বয়ে-যাওয়া হিডালগোর দিকে চোখ পড়েছে ওর। মরু-মধ্যাহ্নের তীব্র রোদে ঝলসে যাচ্ছে নদীটা।

আবার শোনা গেল গোঙানির শব্দ। সরে যাবার জন্যে পা বাড়িয়েছিল সাওলো, জমে গেল হঠাৎ। পর মুহূর্তে অর্ধবৃত্তাকারে ঘুরল শব্দের উৎসের দিকে। কূপের পাড় থেকে সামান্য ডানে পাহাড়ের পাদদেশে খোলা জায়গা, ছোট একটা কুটির ওখানে, অক্ষত। জেনারেল স্টোরে আগুন ধরিয়েই ক্ষান্ত থেকেছে ওরা; লুট করেছে ওটাই।

কয়েক পা এগোল সাওলো। কুটিরের পাশ দিয়ে সামনের খোলা জায়গায় চোখ পড়ল ওর। দেখতে পেল লোকটাকে। ক্ষণিকের জন্যে বিভ্রান্ত বোধ করল, তারপরই সতর্কতায় টান টান হয়ে উঠল ওর পেশী।

দ্রুত চারপাশে চোখ বুলাল ও। এ-জায়গাটায় বড় গাছপালা বিশেষ নেই, উইলোসহ বিভিন্ন ছোটখাট গাছের ঝোপঝাড়। এগোতে লাগল সাওলো উঠানে পড়ে-থাকা লোকটার দিকে, চঞ্চল চোখে প্রতিটি ঝোপ, বিশেষ করে উইলোর ঝাড়গুলো তন্ন তন্ন করে দেখে নিচ্ছে, ধীরে ধীরে লোকটার পৌছে গেল ও।

লোকটা কৃশ; দড়ির মত পাকানো শরীরে নীলচে শিরা-উপশিরা, রোদে ঝলসে যাওয়া লাল চামড়া। মাথা ভর্তি বাদামী চুলে ধূসর ছায়া, পঞ্চাশের সামান্য ওপরে বা নিচে হবে বয়স। অত্যাচার চলেছে ওর ওপর; দু’চোখের পাতা কেটে নেয়া হয়েছে। খোলা কোটরে সেদ্ধ ডিমের মত ঘোলাটে ঝলসানো দু’চোখ। মাটিতে চারটে খুঁটি গেড়ে দু’হাত আর পা টেনে কাঁচা চামড়ায় পাকানো রশি দিয়ে ওগুলোর সাথে বেঁধে চিৎ করে শুইয়ে রাখা হয়েছে ওকে। দেখলে বোঝা যায়, বেশ কয়েক ঘণ্টা আগে ঘটেছে ঘটনাটা। ইতোমধ্যে কাঁচা চামড়ার দড়ি রোদে কুঁচকে তারের মত কেটে বসেছে। রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে বর্ণহীন মরাটে দেখাচ্ছে হাত-পায়ের চামড়া। কাজটা যে অ্যাপাচিদের, বলার অপেক্ষা রাখে না।

রাইফেলের বাঁটের দিকটা মাটিতে ঠেকিয়ে লোকটার মুখের ওপর ঝুঁকল সাওলো। পাথুরে মাটিতে বাঁটের ঘষায় সামান্য শব্দ হলো। মানুষের উপস্থিতি টের পেল লোকটা। মাথা ঘোরাল অতি কষ্টে। ‘কে… কে তুমি?’

লোকটার গলার স্বর কর্কশ, পাতা-কাটা চোখের দৃষ্টি সাওলোর মাথার ওপর আকাশের দিকে। চোখ বুজতে না পেরে প্রবল সূর্যতাপে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে লোকটা। নির্জীব হয়ে পড়ে আছে। তবে কান দুটো সজাগ এখনও। ওর পেটে, পাঁজরের ঠিক নিচে, গভীর ক্ষত। একবারই মাত্র ছুরির আঘাত করা হয়েছে ওখানে। তারপর হাত-পা বেঁধে চিৎ করে রোদে ফেলে রেখে চলে গেছে ওরা, যেন পাতা-কাটা চোখের অসহ্য যন্ত্রণা আর পেট থেকে অবিরাম রক্তক্ষরণের ফলে তীব্র কষ্ট পেতে পেতে তিলে তিলে মারা যায় হতভাগা লোকটা।

বাকস্কিনের তৈরি খাপ থেকে ছুরিটা বের করল সাওলো, ওর হাত- পায়ের বাঁধন কেটে দিল।

গুঙিয়ে উঠল আহত লোকটা। দীর্ঘক্ষণ বন্ধ থাকার পর হঠাৎ করে রক্ত চলাচল শুরু হওয়ায় হাতে-পায়ে তীব্র কনকনে ব্যথা শুরু হয়ে গেছে। বেল্টের সাথে আটকানো চ্যাপ্টা ফ্লাস্কটার মুখ খুলল সাওলো, পানি খেতে দিল ওকে। যত্নের সাথে নিজের কোলে তুলে নিল ওর মাথা।

যন্ত্রচালিতের মত ফ্লাস্কটা দু’হাতে ধরে নিজের মুখের কাছে নিয়ে গেল লোকটা, তারপর আচমকা লোভীর মত বিশাল এক চুমুক বসাল ওটার মুখে।

‘উঁহু,’ সাবধান করল ওকে সাওলো, একবারে অত বেশি নয়, পরে। ‘ভয় নেই,’ ফ্যাসফেঁসে গলায় ওকে আশ্বস্ত করল লোকটা, ‘এখানে কূপ আছে,…অঢেল পানি…’

‘ভয় করছি না। বলতে চাচ্ছি, একবারে অত বেশি খেতে যেয়ো না। সেটা ঠিক না।

‘বড় দেরি করে এলে, ভাই!’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল লোকটা। পানি পেয়ে গলার স্বর কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে ওর। ‘যা হোক, তবু তো এসেছ… সেটাও কম নয়। ওপর-নিচ মাথা দোলাল সে। ‘ঈশ্বর তোমার সহায় হোন।

‘দাঁড়াও, তোমার পেটের ক্ষত বেঁধে দিচ্ছি।’

হাসতে গিয়ে মুখ বিকৃত হলো লোকটার। ‘অনেক দেরি হয়ে গেছে। লাভ হবে না আর।’

‘তার আগে রোদ থেকে সরিয়ে নিতে হবে।’ অদূরে কুটিরটার দিকে চাইল সাওলো। ‘দাঁড়াও, ব্যবস্থা করছি।’

রোদে ফোসকা পড়ে গেছে লোকটার শরীরে। সামান্য ছোঁয়ায় তাতে আগুন ধরে যাচ্ছে। যথাসম্ভব আস্তে-ধীরে, আলতো হাতে পাঁজাকোলা করে ওকে কুটিরের ছায়ায় নিয়ে গেল সাওলো, চাদর বিছিয়ে শোয়াল। তারপর পাহাড়ের ওপর বেঁধে রাখা জেবরা ডানটা নিয়ে এসে একটা খুঁটিতে বাঁধল।

রক্ত বন্ধ করার জন্যে চেষ্টার কিছুই বাকি রাখল না ও। গায়ের শার্ট ছিঁড়ে দলা পাকিয়ে ক্ষতের মুখে গুঁজে দিল। পেট-পিঠ পেঁচিয়ে বাঁধল আরেকটা শার্টের সাহায্যে। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করল লোকটা। কিন্তু ওর কথাই ঠিক, রক্ত কিছুতেই বন্ধ হলো না।

‘বললাম না, অনেক দেরি হয়ে গেছে!’ রুক্ষস্বরে বলল ও। চেয়ে দেখা ছাড়া এখন আর কিছু করার নেই।

‘চুপ করে শুয়ে থাকো। নড়বে না একদম।

‘চুপ করে শুয়ে থাকব? এই চোখ নিয়ে? হাহ্, তুমি বুঝতে পারছ না, কী যন্ত্রণা যে হচ্ছে, যেন গরম তেলে ভেজে নিচ্ছে কেউ ওগুলো!’

‘পারছি,’ মাথা দোলাল সাওলো। ‘আমি জানি।’

‘কী জানো?’

‘অ্যাপাচিরা কী করতে পারে।’

‘চারজন ছিল ওরা; ভূতের মত নিঃশব্দে এসেছিল। দরজায় ধাক্কা দেবার আগে টেরই পাইনি। সকালের নাশতা খাওয়ায় ব্যস্ত ছিলাম আমরা—কিছুই করার ছিল না।’

‘আমরা?’

‘হ্যাঁ। আমি আর ম্যাগি। ওরা আমাকে বাইরে নিয়ে যায়। কি করেছে, দেখতেই তো পাচ্ছ। ম্যাগিকে ঘরের ভেতর আটকে রেখেছিল অনেকক্ষণ। এরপর সাথে করে নিয়ে গেছে।’

‘তোমার বউ?’

‘না, মেয়ে। ম্যাগি… কষ্টে গলার স্বর বুজে আসতে চাইল আহত লোকটার, ও একদম আসতে চায়নি এখানে। এর আগে উত্তরে ছিলাম আমরা। ভালই ছিলাম—গরু, ভাল ঘাস, ঠাণ্ডা উঁচু জায়গা, প্রচুর পানি, চারদিকে পাইনের সমারোহ। কিন্তু বছর দুয়েক আগে ওসব বেচে দিয়ে এদিকে চলে আসি।’

‘ম্যাক ব্রাউনের কাছ থেকে জায়গাটা কিনেছিলে, না!’

‘তোমাকে কিন্তু এদিকে নতুন মনে হচ্ছে না।’

‘নতুন নই, তবে কয়েক বছর ছিলাম না।’

‘চেহারা দেখছি না তোমার। গলা শুনে মনে হচ্ছে বয়স বেশি হয়নি। নাম কি তোমার, বাছা?’

‘স্টেইভ, সাওলো স্টেইভ।’

‘আমি পার্ক হডসন।’ হাতড়ে সাওলোর হাত ধরল। ‘তোমাকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে, বাছা। কিন্তু…’ ম্লান হাসল হডসন, ‘আমি তো এখন অন্ধ!’

‘সেটাই ভাল হয়েছে,’ ভাবল সাওলো। যদি দেখতে পেতে, আমি জানি, দ্বিতীয়বার আর আমার দিকে চাইতে না তুমি, মিস্টার।’

উঠে দাঁড়াল সাওলো। ‘মি. হডসন, বিশ্রাম দরকার তোমার।’

নিঃশ্বাস ফেলল হডসন, কথা বলল না। সাওলো পশ্চিম দিকে তাকাল, সূর্য অস্ত যাচ্ছে।

একহারা শরীর সাওলোর। চওড়া বুক আর মাংসল কাঁধ; মেদহীন পেশীবহুল। অন্যের তুলনায় সামান্য খাটো দেখায় ওকে। শক্ত, চৌকো মাথায় খুলি কামড়ে-থাকা বাদামী কোঁকড়া চুল।

ওর মুখে কোমলতা নেই। কফি বীন রঙের চারকোনা মুখের দু’পাশে ঠেলে বেরিয়ে আসা উঁচু চোয়াল। অ্যাপাচি-বাবার দিক থেকে পাওয়া ঈগলের ঠোঁটের মত বাঁকা নাক; নীলাভ সবুজ চোখ আর বাদামী চুল শ্বেতাঙ্গ মায়ের তরফ থেকে। তবে মায়ের চোখ ছিল আরও গভীর এবং চুল সোনালি।

মা মাঝে-মধ্যে বলত, সাওলোর মনে আছে, ‘তোমার নানুর চোখ আর চুল পেয়েছ তুমি।

‘হবে হয়তো, বিড়বিড় করল ও, ‘কিন্তু তাতে কী আর আসে যায় এখন?’

জেবরা ডানের পিঠ হতে মালপত্র নামিয়ে নিল ও। উইলো ঝোপের কাছে এক ফালি খোলা জমিতে নিয়ে ছেড়ে দিল ওটাকে। চমৎকার গ্যালেটা ঘাসের জমি, খেয়ে তরতাজা হয়ে উঠবে ঘোড়াটা।

শুকনো মেস্কিটের ডাল জোগাড় করে ছোট্ট করে আগুন জ্বালল ও, অল্প করে খাবার তৈরি করল।

খুব সামান্য খাবার সাথে নিয়ে পথ চলায় অভ্যস্ত সাওলো। কয়েক পাউন্ড শুকনো খাবার আর এক পাইন্ট পানিই থাকে ওর সম্বল। ছোটকালে অ্যাপাচিদের কাছে ও শিখেছে, কয়েক ফোঁটা পানির ওপর ভরসা করে কি করে কাটাতে হয় দিনের পর দিন। সে জানে, খাবারের অভাব হয় না মানুষের, তবে চিনে নিতে হয় কোনটা খাদ্য আর জানতে হয় সেটা কোথায় খুঁজতে হবে। তবে পানি নিয়ে সামান্য বিলাসিতা করল সাওলো এখন। সে জানে, অন্তত আজকের রাতটায় পানির কোন অভাব নেই; কাছেই আছে কূপ।

হডসনের খিদে নেই, তবে ওর তেষ্টা মিটছে না কিছুতেই। বারবার পানি চাইছে। ওর চেতনা এখনও পুরোপুরি লুপ্ত হয়নি। রোদে সেদ্ধ হয়ে- যাওয়া পল্লবহীন চক্ষু গোলক আর ঝলসে ফোসকা পড়ে যাওয়া চামড়া ওকে তীব্র যন্ত্রণায় ভোগাচ্ছে। কিন্তু এ ব্যাপারে বিশেষ কিছু করার নেই সাওলোর।

হডসনের জন্যে অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিল ও। একটা ব্যাপারে ও নিঃসন্দেহ, হডসনের এ-অবস্থার জন্যে দায়ী কুরিয়াপো। সাওলো মনে মনে অসহিষ্ণু হয়ে উঠল। কিন্তু সামলাল নিজেকে। মানুষটাকে এ-অবস্থায় ফেলে যাওয়া ঠিক হবে না।

‘মি. হডসন, কথা বলতে পারবে তুমি?’

‘পারব, বাছা।’

আগুনের কাছ থেকে উঠে আসল ও, হডসনের পাশে হাঁটু গেড়ে বসল। ‘কুরিয়াপোকে চেনো?’

‘কুরিয়াপোর কথা শুনেছি।’

‘দেখলে চিনতে পারবে না?’

‘উঁহু,’ মাথা নাড়ল হডসন, কত অ্যাপাচিই তো স্টোরে আসত যেত, তাদের মধ্যে কে কুরিয়াপো, আলাদা করে তা চিনতে চাইনি কখনও।’

‘ওই চারজন অ্যাপাচি, যারা তোমাদের আক্রমণ করেছে, আমার মনে হয়, ওদের মধ্যে সেও একজন।’

এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়াতে লাগল হডসন হতাশার ভঙ্গিতে। চারজনের একজনকেও দেখিনি এর আগে। পুরানো দিনের অ্যাপাচিদের মতই গোঁয়ার গোবিন্দ ছিল ওরা, হাঁটু পর্যন্ত খাটো পোশাক, পায়ে মোকাসিন আর সারা মুখে রঙ মাখানো। … কিন্তু কুরিয়াপোর কথা বলছ? শেষ যখন ওর কথা শুনেছি, তখন ওর বাবা জারিপো সহ সান লাজেরোর রিজার্ভেশনে আশ্রয় নিয়েছে ও।’

নিয়েছিল। তবে এখন ওখানে নেই। বেরিয়ে এসেছে কিছুদিন আগে। ওদের বাধা দিতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে দু’জন।’

শিউরে উঠল হডসন। ‘খোদা! কিন্তু আর্মিরা কী করছে? ওদের পিছু নেয়নি?’

‘নিয়েছিল। ধরতে পারেনি।—কুরিয়াপো বেশির ভাগ সময় দক্ষিণে থাকে, তবে সর্বত্রই দাপিয়ে বেড়ায় ও।’

‘হা খোদা!’ বিড়বিড় করল হডসন। ‘কিছুই শুনিনি এ-সম্পর্কে।’

‘ব্যাপারটা খুব তাড়াতাড়ি ঘটে গেছে। কুরিয়াপো ওর লোকদের চার- পাঁচজনের ছোট ছোট দল করে পাঠিয়েছে চারদিকে; ওরা ছড়িয়ে পড়েছে, লুটপাট করছে।’

‘বাছা,’ হডসন থামল একটু। ‘তুমি দেখছি সবকিছু জানো। খুঁটিনাটিসহ।’

সাওলোর মুখে মৃদু হাসিটা দেখতে পেল না হডসন। ঠিক। সে- সময়টায় আমি পোর্ট বিউদ্রিতে ছিলাম, মি. হডসন।’

নিজেই একটু অবাক হলো সাওলো। মিথ্যে বলছে ও। কিন্তু কেন? ‘তুমি তাহলে উত্তরে ছিলে তখন?’

সাওলো অস্পষ্ট স্বরে বলল, ‘আমি সবখানেই ছিলাম।’

উঠে দাঁড়াল ও। হডসনকে আর প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে ঘুরে মাটির কুটিরটার ওপাশে চলে গেল। দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে সিগার জ্বালাল।

পশ্চিম দিগন্তে তাকাল সে। সূর্যাস্তের আর বেশি দেরি নেই। সোনালি রঙের সাজ নিতে শুরু করেছে আকাশ-কিনারা। ঠাণ্ডা বাতাস বের হয়েছে। দিনের প্রচণ্ড তাপ কাটবে এবার। দ্রুত শীতল হয়ে পড়বে মরুভূমি।

উত্তরে তাকাল সাওলো। ওদিকে সান্তা ক্যাটালিনা পর্বতমালার নগ্ন চূড়া আর দক্ষিণে প্রলম্বিত সান্তা রিটার খাঁজকাটা রক্তাভ পিঠ; দক্ষিণ পুবে সান ইগনাসিও রেঞ্জ, চলে গেছে মেক্সিকোর দিকে। সাওলো শুনেছে, রিজার্ভেশন থেকে পালিয়ে কুরিয়াপো ইগনাসিও পর্বতমালার পাদদেশে ঘাঁটি গেড়েছে। এরই মধ্যে সে এবং ছোট ছোট দলে বিভক্ত তার অনুগত লোকেরা বিস্তীর্ণ এলাকায় হামলা চালিয়েছে। একশো মাইলের ভেতর চলার পথে যা পেয়েছে, তা-ই ধ্বংস করেছে। ওদের হাতে আক্রান্ত ছোট ছোট র‍্যাঞ্চ, বসতি প্রভৃতির লোকেরা টের পাবার আগেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। আমি ওদের পিছু ধাওয়া করেছিল। লাভ হয়নি। হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে ওরা পেছনে কোন ট্র্যাক না রেখেই।

রিজার্ভেশনে যাবার আগে কুরিয়াপোর অধীনে প্রায় পঞ্চাশজন লোক ছিল। ওখান থেকে পালিয়ে এসে কোনও মতে জনা বিশেক যোদ্ধা জোগাড় করতে পেরেছে ও। তার মানে এই নয় যে, সে আগের চেয়ে দুর্বল হয়ে গেছে। বরং বিশজন লোক নিয়েই নরক গুলজার করছে এখন। চার কি পাঁচজনের একেকটি দল ছোটখাট র‍্যাঞ্চ কিংবা বসতিতে ঝোড়ো গতিতে হঠাৎ আক্রমণ চালিয়ে মুহূর্তে কাবু করে ফেলছে দ্বিগুণ সংখ্যক শ্বেতাঙ্গকে। খুন, জখম, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ সেরে নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে স্রেফ ঘণ্টাখানেক সময় লাগে ওদের। আর যদি কোথাও প্রতিরোধের মুখে পিছু হটতে হয়, মুহূর্তে ভূতের মত নিঃশব্দে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।

সান লাজেরো থেকে কুরিয়াপোকে ট্রেইল করে এসেছে সাওলো। প্রথম দিকে ওরা বিশজন একসঙ্গে ছিল। কিন্তু এক পর্যায়ে বিশজনের দলটি ছোট ছোট কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে সমস্যায় পড়ে যায় ও। ওর দরকার কুরিয়াপোকে। কিন্তু চার-পাঁচটি দলের মধ্যে কুরিয়াপো কোনটির নেতৃত্ব দিচ্ছে, তা বুঝতে না পেরে থেমে যায়। শেষে আন্দাজে একটি দলকে অনুসরণ করতে শুরু করে।

গত দুই দিন ধরে দলটাকে ট্রেইল করে এসেছে সে। এর মধ্যে তিন- তিনবার পেয়েছে ওদের নৃশংসতার প্রমাণ। প্রথমবার একখানা বিধ্বস্ত ওয়্যাগন আর একজন পুরুষ ও মহিলার, সম্ভবত স্বামী-স্ত্রী, বিকৃত লাশ, দ্বিতীয়বার একজন মৃত প্রসপেক্টরকে দেখতে পায়। প্রসপেক্টরের বুকের ওপর দিয়ে ওর ওয়্যাগনটাকেই চালিয়ে দেয়া হয়েছে। ভারী ওয়্যাগনের চাপে থেঁতলে গেছে প্রসপেক্টরের শরীর। ওয়্যাগন টানা খচ্চরগুলোকে গুলি করে মেরে ওগুলোর শরীর থেকে চাকা চাকা মাংস কেটে নেয়া হয়েছে। এছাড়া গতকাল একটি র‍্যাঞ্চ দেখতে পেয়েছে সাওলো, সম্পূর্ণ ভস্মীভূত। কোথাও লাশের চিহ্ন নেই। হতভাগা মানুষগুলোকে যে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে, বুঝতে এতটুকু কষ্ট হয়নি ওর।

অঞ্চলটা পাথুরে, রুক্ষ। চারজনের দলটি ক্রমশ এগিয়ে গেছে। ওদের ট্র্যাক করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছিল সাওলো। ওর গতি মন্থর হয়ে পড়ে। এ-ফাঁকে ওকে অনেক পেছনে ফেলে যায় ওরা।

ওদের অনুসরণ করার ব্যাপারে চাইলে সেনাবাহিনীর সাহায্য পেত সাওলো। কিন্তু আগে একবার সেনাবাহিনীর সাথে কাজ করতে গিয়ে অর্জিত তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা মনে হতেই মত পাল্টায় ও। সেটা প্রায় দু’বছর আগের ঘটনা। ড্রাগুনে কুরিয়াপোকে ধাওয়া করার ব্যাপারে জেনারেল পি. টি. জনসনকে সাহায্য করেছিল ও। কুরিয়াপো সেবার এক মেক্সিকান পরিবারের সবাইকে হত্যা করেছিল। পরিবারটি ছিল সাওলোর ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

প্রতিশোধের নেশায় উন্মত্ত সাওলো কুরিয়াপোর পশ্চাদ্ধাবন কালে জেনারেল জনসনের বাহিনীর পথ প্রদর্শকের দায়িত্ব নিয়েছিল, এবং কুরিয়াপোর নিজের এলাকায় ওকে ফাঁদে ফেলেছিল কৌশলে। এরপর কুরিয়াপোকে রিজার্ভেশনে নিয়ে যাওয়া হয়। এদিকে জনসন দারুণ খুশি হয় সাওলোর কাজে। নিজের স্কাউট বাহিনীর প্রধানের পদ অফার করে ওকে। কিন্তু সাওলো তাতে রাজি হয়নি। এমন কী, কেন রাজি হয়নি, সেটুকু পর্যন্ত ব্যাখ্যা করতে চায়নি। ফলে জেনারেল জনসনের বিরাগভাজন হয় সে।

আসলে নিজের দিক থেকে পরিষ্কার থাকতে চেয়েছে সাওলো। সে শ্বেতাঙ্গ নয়—দোআঁশলা। তবে বুদ্ধি হবার পর থেকে নিজেকে অ্যাপাচি হিসেবে গড়ে তুলেছে। শ্বেতাঙ্গদের প্রতি ওর কোন মোহ নেই। বরং হাজার শত্রুতা এবং নিজেদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব থাকা সত্ত্বেও সে কুরিয়াপোর প্রতি সহানুভূতিশীল। এর কারণ কুরিয়াপো একজন অ্যাপাচি।

কিন্তু কুরিয়াপোর সঙ্গে ওর সংঘাত বহুদিনের। সংঘাতের জন্ম তাদের শিশু বয়সেই। বয়স বাড়ার সাথে কমেনি ওটা—বরং তীক্ষ্ণধার ইস্পাতের ছুরির ফলার মত দিন দিন ঝকঝকে হয়ে উঠেছে।

তবে এরকম দ্বন্দ্ব পাশাপাশি বেড়ে ওঠা দু’জন শিশুর মধ্যে থাকতেই পারে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য অনেক কিছুর মত এর পরিবর্তন ঘটে। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু একদিন দু’জনের মধ্যে এমন একটা ব্যাপার ঘটল, যা ওদের পারস্পরিক প্রতিযোগী মনোভাবকে তীব্র ঘৃণায় পর্যবসিত করল।

সেবার বসন্তকালে সাওলো আর কুরিয়াপো দুজনেই তেরোয় পা দিয়েছে। ওদের বাবা জারিপো নিজের লোকজন নিয়ে গিলা নদীর উজানে ক্যাম্প করেছে। খাবার জন্যে দলটির প্রচুর মাংসের দরকার। অবশ্য নদীর কাছাকাছি চওড়া অরণ্যময় গিরিখাতগুলোয় শিকারের অভাব ছিল না। টগবগ করে ফুটছিল সে-সময় সাওলো আর কুরিয়াপো। বড় কিছু শিকারের উদ্দেশ্যে দু’ভাই একদিন বাকস্কিনের থলে ভর্তি তীর আর ধনুক নিয়ে জঙ্গলের দিকে রওনা হয়ে গেল।

ওরা জারিপোর দুই ছেলে—কিন্তু পরস্পর বন্ধু ছিল না। দু’জনে কে কার চেয়ে ভাল কিছু করে পিতার মনোযোগ আকর্ষণ করবে, এ নিয়ে একটা অঘোষিত প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকত সারাক্ষণ।

ছাগলের মত তিড়িং বিড়িং করে লাফাতে লাফাতে পাহাড়ে চড়ছিল ওরা। পথ দেখিয়ে নিচ্ছিল কুরিয়াপো। বয়সে ও সাওলোর চেয়ে সামান্য বড়, আর লম্বা হাত-পা ওকে সাওলোর চেয়ে কিছুটা বাড়তি সুবিধা দিচ্ছিল।

কিন্তু সাওলো সারাক্ষণই কুরিয়াপোর সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটছিল। কুরিয়াপো তাতে খুশি হয়নি—অবাক হয়েছে বরং। এক সময় পাহাড়ের খাঁজঅলা পিঠে চড়ে নিচের দিকে তাকাল ওরা। নিচে বহু দূরে ওদের ক্যাম্প।

হঠাৎ, হেসে সাওলোর দিকে চাইল কুরিয়াপো। মাত্র শুরু, কী বলো? আরও অনেকদূর যেতে হবে, তাই না, শাদা-চোখ? নিশ্চয় এবার তুমি তোমার শাদা-মায়ের কাছে ফিরে যেতে চাইবে?’ ঠোঁট বাঁকাল সে।

‘খবরদার!’ ওকে শাসাল সাওলো, ‘শাদা-চোখ বলবে না আমাকে!’

কুরিয়াপোর অ্যাপাচি-বাবার মত প্রশস্ত বুক আর চওড়া কাঁধ আর ইয়াকি-মায়ের মত চৌকো মুখ। হাসল ও আবার। ‘ঠিক আছে। তুমি খুব ভাল ছুটতে পারো। একদম ইঁদুরের মত। চলো তাহলে আবার এগোই, ইঁদুর মশাই!’

হাঁটতে শুরু করল ওরা। একসময় একটা ছায়াময় ক্যানিয়নে গিয়ে হাজির হলো।

সিডার গাছে ভর্তি ক্যানিয়নটা। লম্বা শাখা-প্রশাখার ফাঁক গলে সামান্য সূর্যালোক এসে পড়েছে মাটিতে। স্যাঁতসেঁতে মাটি; সিডারের উষ্ণ আঠাল গন্ধে ভারী বাতাস।

ক্যানিয়ন থেকে বেরিয়ে এসে একটা নিচু ট্রেইল ধরল ওরা। কিছুদূর এগিয়ে গোলমত একটা সামান্য উঁচু ঢিবির পাশে পৌঁছল। ঢিবির পাশ ঘেঁষে গেছে ট্রেইলটা। মোড় ঘুরতেই আচমকা ভালুকটার সামনে পড়ল ওরা। কালো ভালুক, সরাসরি ওদের দিকে চেয়ে আছে।

বয়স হয়েছে ওটার, নাকে-মুখে কিছুটা ভোঁতা ভাব, সম্প্রতি বাচ্চা দেয়ায় বেশ কাহিল দেখাচ্ছে জন্তুটাকে।

দু’জন মানুষকে আচমকা সামনে দেখে লেজ গুটিয়ে পালানো উচিত ছিল ভালুকটার; কিন্তু পালাল না। সম্ভবত ওর বাচ্চারা কাছে-পিঠে কোথাও ছিল কিংবা এমনও হতে পারে চলাচলের জন্যে ওটাই একমাত্র ট্রেইল হওয়াতে ওর পিছিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। কিন্তু, সম্ভবত পূর্বে লব্ধ কোন অভিজ্ঞতা থেকে জলজ্যান্ত দু’জন মানুষকে পেছনে রেখে চলাটা নিরাপদ মনে না-হওয়ায় সটান দাঁড়িয়ে রইল; রাগ ও অস্বস্তিতে গরগর করে উঠল।

কুরিয়াপোই নেতৃত্ব দিচ্ছিল। ‘সাবধান!’ ফিস ফিস করে বলল ও, ‘একদম নড়াচড়া না!’ ধনুকে তীর যোজন করল।

মুহূর্তে গর্জন করে ধেয়ে এল জন্তুটা ওদের দিকে। কুরিয়াপো চেঁচিয়ে উঠল, তারপর ওটাসহ ট্রেইল থেকে সরে গিয়ে ঢাল বেয়ে নিচে গড়িয়ে পড়ল। সাওলোর চোখের সামনে। পলকে ঘটে গেল ব্যাপারটা। তাড়াতাড়ি কিনারায় গিয়ে নিচের দিকে তাকাল সে। প্রায় পঞ্চাশ ফুট নিচে ঢালু ক্যানিয়নের দেয়ালে কয়েকটি সিডার গাছের সঙ্গে আটকে গেছে দু’জন।

‘সাওলো!’ ভয়ার্ত গলায় চেঁচাল কুরিয়াপো। বেমক্কা ভঙ্গিতে একটা সিডারের গোড়ার সাথে আটকে আছে ও। পাথরের ঘষায় আর ভালুকের থাবায় এখানে-সেখানে মাংস আর ছাল-চামড়া উঠে গেছে।

ওর কাছ থেকে কয়েক গজ দূরে ভালুকটা। পতনের ধকল সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। মাটি শুঁকছে ও, এরপর মাথা তুলল।

কুরিয়াপো আর্তনাদ করল আবার সাওলোর নাম ধরে।

প্রথমে গলার রগ ফুলিয়ে ভালুকটার উদ্দেশে একটা ধমক লাগাল সাওলো। পাত্তা দিল না ভালুকটা। চট করে নিচু হলো ও, অমসৃণ একটা পাথরের টুকরো কুড়িয়ে নিল। তারপর সর্বশক্তি দিয়ে ছুঁড়ে মারল ওটা জন্তুটার দিকে। মাথা সই করেছিল সাওলো, লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে কাঁধে আঘাত করল পাথরখণ্ড। সেটা বরং খারাপই হলো ভালুকটার জন্যে। পঞ্চাশ ফুট ওপর থেকে পড়ে গিয়ে কাঁধে আঘাত পেয়েছিল ওটা, পাথর খণ্ডের আঘাতে ব্যথা বাড়ল। ক্ষিপ্ত হয়ে মুখব্যাদান করে ক্যানিয়নের দেয়ালের দিকে ছুটে এল সে। রাগে চোয়াল ফাঁক হয়ে দাঁত বেরিয়ে এসেছে।

ধনুকে তীর জুড়ল সাওলো। পঞ্চাশ ফুট দূর থেকে তীরটা ভালুকের কাঁধে গিয়ে বিধল। দ্বিতীয় তীরটাও একই জায়গায় আঘাত করল; পরেরটা সামনের পায়ের সামান্য পেছনে পাঁজরে গিয়ে ঢুকল। কাবু হয়ে গেল ভালুকটা। তিন-তিনটে তীর-বেঁধা প্রকাণ্ড শরীর নিয়ে ক্যানিয়ন দেয়াল থেকে নিচে গড়িয়ে পড়ল।

সাওলো ভালুকের চামড়া, নখ আর কুরিয়াপো একটা ভাঙা পা নিয়ে ক্যাম্পে ফিরে এসেছিল। চামড়ার তৈরি কোট আর নখের পুঁতির মালাটা অনেকদিন ব্যবহার করেছে সাওলো—আর ভাঙা পা নিয়ে বহুদিন খুঁড়িয়ে হেঁটেছে কুরিয়াপো। তাছাড়া ভালুকের নখের আঘাতে তৈরি দাগগুলো আর মিলায়নি ওর শরীর থেকে, শুকিয়ে চিরস্থায়ী হয়ে গেছে। সাওলো ওর প্রাণ বাঁচালেও কৃতজ্ঞতা বোধ করেনি ও—বরং ওই ঘটনার স্মৃতি ওকে ক্ষিপ্ত করে তুলত। সাগুলো কোনদিন তোলেনি ওই প্রসঙ্গ, ওটা নিয়ে কোথাও গল্পও করেনি; তবু কুরিয়াপো কখনও ওর সঙ্গে সহজ হতে পারেনি। ক্রমশ হীনম্মন্যতার সৃষ্টি হয়েছে ওর ভেতরে—এবং মনে-প্রাণে সাওলোকে ঘৃণা করতে শুরু করেছে ও।

.

অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে এল সাওলো। হডসনের কাছে এসে বসল ওর পাশে।

‘সাওলো!’ হডসন ক্ষীণকণ্ঠে ডাকল।

‘বলো।’

দুর্বল একটা হাত তুলে পশ্চিম দিকে ইশারা করল হডসন, ‘সূর্য ডুবছে, না?’

‘হুঁ।’

ঠিকই টের পাচ্ছি। এখনও গরম আছে, তবে তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যাচ্ছে তা। সাওলো?’

‘কিছু বলবে?’

‘তোমার অস্ত্রটা দেবে আমাকে?’

সাওলো জবাব দিল না।

‘তোমার কাছে তো একটা হ্যান্ডগান আছে, তাই না?’

‘আছে।’

‘তাহলে অস্ত্রটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে যাও তুমি, বাছা।’ সাওলো নিরুত্তর।

‘খ্রীষ্টের কসম, বাবা, বুঝতে চেষ্টা করো। শুধু পেটে ছুরি খাবার কষ্টই নয় আমার। সারাদিন প্রচণ্ড রোদে চামড়া ঝলসে গেছে, ফোসকা পড়েছে। তুমি তা-ই দেখতে পাচ্ছ—কিন্তু এর কষ্টটা ভোগ করছি আমি। সারারাত এক ফোঁটা ঘুমও হবে না। ঝলসানো শরীরে কাপড়-চোপড় পরা যাবে না, কম্বল গায়ে দেয়া যাবে না—এমন কী, ঠাণ্ডায় জমে গেলেও আগুনের কাছে যেতে পারব না। তুমি কি চাও সারারাত আমি এভাবে কাটাই?’

আহত লোকটার দিকে চাইল সাওলো। কতক্ষণ টিকবে আর? কে বলতে পারে!

‘আরেকটা কথা,’ হডসন বলে চলল, ‘তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না আমি, কিন্তু আমার কান সজাগ। তোমার চলাফেরার প্রতিটি শব্দের দিকে খেয়াল রেখেছি। তুমি নিঃশব্দে হাঁটতে পারো স্টেইভ, একদম অ্যাপাচিদের মত।’ একটু ইতস্তত করল সে। ‘কিন্তু—জানি না এতে কোন লাভ হয় কি না- তাছাড়া তোমাকে বলাটা ঠিক হচ্ছে কি না তাও বুঝতে পারছি না— ‘

‘বলো। সঙ্কোচ কোরো না।’ ওকে উৎসাহ দিল সাওলো।

‘অনেক দেরি হয়ে গেছে।’ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল হডসন। ‘তবু… আমার মেয়ে–ম্যাগি…ওরা যখন নিয়ে যাচ্ছিল, তখনও জীবিত ছিল ও; চেঁচিয়ে ডাকছিল আমাকে।’ হাহাকার করে উঠল আহত লোকটা। ‘ওহ্, খোদা! খোদা! স্টেইভ, ওর বয়স মাত্র আঠারো…

হডসনের দিকে তাকাল সাওলো। ঝলসানো দু’চোখের কোণ ভিজে উঠেছে লোকটার। ‘তুমি চাও আমি ওদের অনুসরণ করি?’

একটু থামল হডসন জবাব দেবার আগে। ‘তোমার হাঁটা-চলা একদম শব্দহীন, স্টেইভ।’

‘ঠিক আছে। যাব আমি। কাল সূর্য ওঠার আগেই বেরোব।’

‘গড ব্লেস ইয়ু, সান। হডসনের চোখের কোল বেয়ে নেমে এল অশ্রু। ‘শোনো, ওরা, ওরা যখন চলে যাচ্ছিল, কান পেতেছিলাম আমি। ওরা দক্ষিণ-পুবে গেছে।’

উঠতে চাইল সাওলো। হডসন ওর হাত খামচে ধরল। ‘ওটা দাও, স্টেইভ। প্লীজ, এভাবে রেখে যেয়ো না আমাকে।’

ধীরে ধীরে হাত ছাড়িয়ে নিল সাওলো, ‘তোমাকে এভাবে রেখে যাব না, মি. হডসন। কথা দিচ্ছি।’

‘হ্যাঁ,’ শান্ত হলো হডসন। ‘কাল ভোরে সূর্য ওঠার আগে। তুমি ওদের খুঁজে বের করো, বাছা। আর…আমি এভাবে বেঁচে থাকতে চাই না।’

নিজের কোল্টটা বের করে নিল সাওলো। ধরিয়ে দিল ওটা হডসনের হাতে।

‘ধন্যবাদ, স্টেইভ, অসংখ্য ধন্যবাদ।

দাঁড়াল সাওলো। হডসনের কাছ থেকে সরে গেল দ্রুত। উইলো ঝোপের পাশে গিয়ে দাঁড়াল।

সূর্য ডুবে গেছে। সন্ধের রঙে দূরে নদীর পানি চকচক করছে। ভেজা তীর এবং পানি থেকে ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে। তবু ঘামছে সাওলো। কাজটা কি ঠিক হলো? হডসনের আত্মহত্যার ইচ্ছেটাকে সমর্থন করেছে ও। ওটা নির্বিঘ্নে চুকিয়ে ফেলার জন্যে নিজে ওর হাতে অস্ত্র ধরিয়ে দিয়েছে। জানে না সে। তবে কাজটা দুঃখজনক, অবশ্যই দুঃখজনক।

‘ঠিক আছে,’ ভাবল সাওলো। ‘একটা বুলেট হডসনের জন্যে খরচ করেছে ও অনিচ্ছাসত্ত্বেও। আরেকটা বুলেট অবশ্যই কুরিয়াপোর জন্যে। এতে ব্যাপারটা সমান সমান হয়ে যাবে।’

পনেরো বছর আগে, গিলা নদীর উজানে কুরিয়াপোকে ভালুকের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল ও। না-বাঁচালে ব্যাপারটা অমানবিক হত, তা ছাড়া না- বাঁচানোর কোন কারণও ছিল না। কিন্তু কুরিয়াপোর কৃতজ্ঞতা পায়নি ও। কুরিয়াপোর স্বভাবটাই ওই রকমের। ভিক্টোরিও, সানা, রুহ্, বেরেতোনো– এসব বিখ্যাত অ্যাপাচি যোদ্ধা নেতারও এই একই স্বভাব ছিল। একা ওর দোষ নেই। তবে ওই দিন যদি ও মারা যেত, তাহলে ওর হুকুমে এখনকার ম্যাসাকারগুলো হয়তো ঘটত না।

মেক্সিকান পরিবারটার কথা ভাবল সাওলো। চমৎকার কয়েকজন মানুষ। সাওলোর পরম বন্ধু ছিল ওরা।

মাথা নাড়ল ও। কুরিয়াপোর রেহাই নেই। ওর নিরেট মাথায় একটা বুলেট ঢোকাবে ও, নিশ্চয় ঢোকাবে। এর আগে থামবে না।

আচমকা গুলির শব্দে সামান্য চমকাল ও। হডসন তাহলে মুক্তি পেয়েছে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *